মুজিবকে জেলে রেখে কোন সমাধানই সম্ভব নয়- ইরাণী পত্রিকা
ইরাণের রাজধানী তেহরান থেকে প্রকাশিত ‘সাদে মারদম’ পত্রিকায় দাবী করা হয়েছে, শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হােক। শেখ মুজিবকে মুক্তিদান বাঙলাদেশ সমস্যা সমাধানের প্রথম সােপান। তাকে কারাগারে আবদ্ধ রেখে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধানের কথা উঠতেই পারেনা। পত্রিকাটিতে আরাে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিলে কেবল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে না, এর ফলে যুদ্ধ উত্তেজনাও হ্রাস প্রাপ্ত হবে। পত্রিকাটির মতে, শেখ মুজিবের মুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণও সমর্থন করবে। সামরিক অভিযান বাঙলাদেশ সম্যসার সমাধান করতে পারেনি। সামরিক অভিযানের ফলে কোন অভিষ্ট সিদ্ধ হয়নি। এখন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য উদযােগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৮ ! ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলার মুক্তি আন্দোলন ও শেখ মুজিব।
কাজী মাজহারুল হুদা- প্রধান সম্পাদক, দৈনিক বাংলা দেশ
আমরা জানি যে পূর্ববর্তী অগ্রগতিকে অন্তস্থ করেই নুতন অগ্রগতি এগিয়ে চলে। এই নুতন অগ্রগতির নায়কদের কাছে পুরাতন অগ্রগতি এবং তার নায়কগণ পথ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পথ ছাড়ার এ কাজটি চলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী নিয়মে। সময়ের পরিপ্রেক্ষিত কোন অগ্রগতিই ব্যহত হয়ে থাকতে পারে না দ্বান্দ্বিক বিকাশের নিয়মে অগ্রগতির কোন ধারাই রুদ্ধ থাকতে পারে না। পরিবর্তনের স্রোতে তাত্ত্বিক দিকও যেমন নুতন পথ পরিক্রমণ করে তেমনি তার কার্যকরী দিকটিও কিছুদিন আগে অথবা পরে সামাজিক বিকাশের ধারায় নিজ আসনটি সংহত করে নেয়। ইংরেজ আমলে পাক-ভারতের জনগণ ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রাণপাত করেছিলেন। এটা ছিল পাক-ভারত উপমহাদেশের আপামর জনগণের সামাজিক বিকাশের একটা উৎক্রমণ। কিন্তু এই বিকাশের ধারায় কিছু সংখ্যক মুসলিম বুর্জোয়া কিছুটা ক্ষয়িষ্ণু চিন্তার যােগ ঘটিয়েছিল। এই ক্ষয়িষ্ণু চিন্তার যােগ ঘটানাের উদ্দেশ্য ছিল, তাদের নিজস্ব বুর্জোয়া চরিত্রের নিয়ম মাফিক নিজ শ্রেণীস্বার্থ হাসিলের পথটি সুসম করে নেওয়া এবং এটি করার জন্য সামন্তযুগীয় ধর্মভিত্তিক জাতিয়তাবাদের উপর ভর করা ছাড়া তাদের আর কোন গত্যান্তর ছিল।
যাই হােক তঙ্কালীন মুসলিম নেতৃবর্গের মধ্যে দুটো দিক পরিস্ফুটিত হয়েছিল। একটি হল বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সামাজিক অগ্রগতি মূলক দিক অপরটি হলাে সেই ঔপনিবেশিক মুক্ত পরিবেশে যাযকপন্থী চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকারকে দলিত করে মুসলিম ধনিকদের শাসন ও শােষণের পথটি সুগম করা। পাক-ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে এই দলের শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন মিঃ জিন্না। অতএব বলা চলে মিঃ জিন্না বৃটিশ ঔপনিবেশ থেকে মুক্তির অগ্রগতি মূলক চেষ্টা করলেও সাধারণ মুসলিমদের জন্য এবং বিশেষ করে বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেন। মিঃ জিন্না এবং তার স্নেহচ্ছায়ায় আচ্ছাদিত পরবর্তী কালের পশ্চিমা ফিউডাল শাসকগােষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানী সাধারণ মানুষের মধ্যে সস্তা দেশানুভূতি জাগিয়ে পূর্ব বাংলায় স্থায়ী উপনিবেশিক শাসন ও শােষণ কায়েমের পথটি প্রশস্ত করে নেয়। বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন এ সবের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ এবং এক্ষেত্রে তার ভূমিকা অধিকতর উক্রমণিক। তাঁর সব চেয়ে বড় কৃতিত্ব হলাে পশ্চিম পাকিস্তানী শাষণ ও শােষণের যাতাকল থেকে মুক্তির আন্দোলনে পূর্ব বাংলার জনগণকে সুসংবদ্ধ করার এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আবর্ত থেকে বাংলার সাধারণ মানুষকে মুক্ত করার মধ্যে। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার পূর্ব ঐতিহ্য বাংলার মানুষের ইংরেজ আমল থেকেই ছিল।
কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনটি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কার্যক্রমে একটি বিরাট অগ্রগতি। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা চলে যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিলেন বাংলার বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের একটি দল। কিন্তু তাদের কার্যক্রম ছিল মূলতঃ সাহিত্যভিত্তিক। এর সাহিত্য মূল্য থাকলেও কার্যকরী মূল্য বিশেষ ছিল না এবং কার্যকারীতা কম থাকার দরুণই মিঃ জিন্নার যাযকীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিক্রীয়ার পথেই জয়লাভ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার উত্তর কালে—যাযকীয় চিন্তার প্রচারের দ্বারা পূর্ব বাংলাকে স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করার চক্রান্তের জঘন্য দিকটা কার্যকরী ভাবে বা রাজনৈতিক ভাবে বাংলার জনগণের সামনে উদ্ভাসিত করে তােলেন শেখ মুজিব। বাংলা দেশের বর্তমান মুক্তি-আন্দোলনকে পৰ্যালােচনা করলে একথা দ্বিধাহীন ভাবে বলা চলে যে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন পুঁজিবাদী শাসক গােষ্ঠীর শােষণের মূল হাতিয়ার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ছদ্মাবরণের উপর সবল হস্তে কঠোরতম আঘাত হেনে শেখ মুজিব তাদের শােষণ যন্ত্রের ভিত্তিটাই টলিয়ে দিয়েছেন। শেখ মুজিবের প্রতি শাসক গােষ্ঠীর সব চেয়ে বড় অসন্তুষ্টীর কারণ হােল যে বঙ্গ বন্ধু যাযকীয় ইসলামী সৌভ্রাতৃত্বের আড়াল ও আবডাল দিয়ে বাংলা দেশকে শােষণের দিকটি জনগণের সামনে তথা বিশ্বাবাসীর সামনে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। শাসকগােষ্ঠীর বাংলাদেশকে শােষণ করার এই বড় যাযকীয় ভালাটির আঘাত হানতে ইসলামাবাদ কতৃপক্ষ শেখের উপর এত ক্ষিপ্ত । কিন্তু তারা জানেনা যে, কোন কিছুই লুকায়িত বা অমিত থাকে না।
নিজস্ব পথে তা বিকশিত হবেই। একদিন যাযকীয় জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তির ধাধায় বাংলার মানুষের চোখ ঝলাসিয়েছিল—সেটাই শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত বুদ্ধি সম্পন্ন নেতৃত্বের দ্বারাই উক্রমণের পথে সাফল্য লাভ করেছে এবং পরিপূর্ণ বিকাশের পথে তা আরােও এগিয়ে চলেছে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের ধারায় মুজিবের এই আন্দোলনকে সর্বাত্ত্বক বিকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা গেলেও এটাকে ছােট করে দেখার কোন কারণ নেই। কারণ, কার্যকরী ভাবে তিনি যা সম্পাদন করেছেন, তা বাঙ্গালীর সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার মূলটি দিয়ে নবতর দিকে, নতুন সংস্কৃতির। পথে উজ্জীবিত করে তুলেছে। বাংলা দেশের আন্দোলনকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। তথা একটা নিজস্ব পথে আসার জন্য গত আড়াই দশকে এটারই প্রয়ােজন ছিল সবচেয়ে বেশী । অতএব শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক্ষেত্রে বাঙ্গালীর মানসিকতায় পরিবর্তন আনায়নে একটি বিরাট অগ্রগতির শেষ ধাপ নয় অগ্রগতির চূড়ান্ত লক্ষে পৌছানাের জন্য হয়ত আরােও সংগ্রাম, আরােও ত্যাগ তিতিক্ষার প্রয়ােজন আছে। সামাজিক বিকাশের ধারায় তাও হয়ত একদিন যােগ্য নেতৃত্বের দ্বারা কার্যকরী ভাবে সম্পন্ন হবে। কিন্তু বর্তমান মুহুর্তে যা হওয়ার দরকার ছিল তা শেখ মুজিবের দ্বারাই প্রস্ফুটিত, বিকশিত এবং কার্যকরী হতে চলেছে।
সংগ্রামী বাংলা (১) ॥ ঈদ সংখ্যা | ২৩ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩