You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.18 | খান এবং শেখ -বাংলাদেশের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক

খান এবং শেখ

ঢাকাস্থ ওয়াকিবহাল মহলের জনৈক পূর্বপাকিস্তানী আমাকে বললেন : ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান গভর্ণর ডাঃ আব্দুল মালিকের ঘন ঘন সাক্ষাৎকারের ঘটনা থেকে পূর্ব বাংলার উচ্চ মহলে এই ধারণা জোরদার হচ্ছে যে, খান সাহেব ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমা (?) প্রদর্শন করবেন।  ডাঃ মালিক নিজেও একজন বাঙ্গালী এবং ইয়াহিয়ার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু । তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ থেকে অব্যহতি দানের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর যােগসূত্র হিসেবে কাজ করে চলেছেন। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে অজ্ঞাত স্থানে বঙ্গবন্ধুর বিচার চলছে, তবুও, ইয়াহিয়া সাহেব তার সঙ্গে আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। পূর্ব বাংলার সরকারী মহল থেকে এরূপ খবর জানা যায় । তাদের আরাে ধারণা বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার আলােচনার সম্ভাব্য ফল এই হতে পারে যে, পূর্ব বাংলার অধিকতর জনসমর্থন লাভের স্বার্থে শেখ সাহেবকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে এবং দেশদ্রোহিতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ থেকে তাঁকে নিস্কৃতি দেয়া হবে।  উক্ত সূত্র থেকে আরাে জানা গেল : ঢাকার ওয়াকিবহাল মহল আশা করেন যে, বস্তুতঃ শেখ সাহেবকে পুনরায় রাজনীতিতে প্রবেশ করতে এবং অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে থেকে বাঙ্গালীদের জন্য অধিকতর স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন চালিয়ে যেতে অনুমতি দেয়া হবে।  তিনি আমাকে আরাে বলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে শেখ সাহেবের স্ত্রী ও তার পরিবারবর্গের সঙ্গে ভাল ব্যবহারই করা হচ্ছে।

র্যাফেল শ দি টাইস লণ্ডন

সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৫

১৮ নভেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

“প্রয়ােজন হলে দেবাে এক নদী রক্ত হ’ক না পথের বাধা প্রস্তর-শক্ত, অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে একদিন সে পাহাড় টলবেই; আমাদের সংগ্রাম চলবেই” বাংলাদেশের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকল অস্তিত্বে যেন তাদেরই একান্ত সান্নিধ্য অনুভব করেছিলেন যারা নিঃশেষে রক্ত বিসর্জনের ভেতর দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে দখলদার পাকিস্তানী দুশমনের শৃঙ্খলমুক্ত করবে। তাই ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের বৃহত্তম জনসভায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছিলেন, আমরা যখন রক্ত দিয়েছি, রক্ত আরও দেবাে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়বাে।’ রক্ত দিয়েছে আরও অনেক রক্ত দিয়েছে শিশু-বৃদ্ধ নরনারী বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র অগণিত মানুষ। কত রক্ত দিয়েছে বাঙালী, জানতে চাও যদি ইতিহাসের তথ্য-লিপিকার, জিজ্ঞাসা করাে বাংলার তৃণ-মাঠ পথ-ঘাট নদীস্রোতের কাছে। রক্ত দিয়েছে বাঙলাদেশের হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীস্টান। এ রক্ত আমাদের আত্মপরিজনদেরই শুধু নয়— এ রক্ত আমাদের পিতৃ-পিতামহের। বাঙলাদেশের শত শত নদীধারা সফেন তরঙ্গ-ললাটে সন্তানবিধুরা চিরক্রন্দনময়ী বঙ্গজননীর জর্জরিত হৃদপিণ্ডের সহস্র ক্ষতমুখে উৎসারিত রক্ত চুম্বন মেখে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে, যুগান্তকালের নিস্তব্ধ কণ্ঠে সূর্যশীর্ষ মহিমার কমুধ্বনি তুলে প্লাবন হয়ে ছুটে গিয়েছে সাগর থেকে সাগরে, সমুদ্র থেকে সমুদ্রে। মহামানুষের। অবিশ্রান্ত প্রাণ-প্রবাহে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছে অনন্ত ভবিষ্যতের শুভাশীষ নিয়ে।  বঙ্গবন্ধুর আশ্বাসদীপ্ত বাংলাদেশের নির্ভয় ছাত্র-তরুণেরা স্বাধীনতার যে পতাকা সেদিন বাস্তবায়িত করেছিল, ২৩শে মার্চ তারিখে বাঙলাদেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তান্তরে যে পতাকার বর্ণে বর্ণে তারা। নীলাম্বরের উদার স্পর্শ মাখিয়েছিল সে পতাকা আজ বিশ্বের বিস্ময়ের প্রতীক। আমরা জানি সারা বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যুদ্ধজয়ী বাঙালীর জাতীয় পতাকার উদ্দেশ্যে নতশির শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে। 

২৫শে মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার সহকর্মী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তার ছায়ানুগামী– প্রখর দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত ছাত্র-তরুণ এবং বাঙলাদেশের মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ।  দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে লক্ষ লক্ষ প্রাণের মূল্যে নির্দ্বিধায় তুলে নিয়েছেন প্রতিজ্ঞার গুরুভার। সেই প্রতিজ্ঞার অস্ত্রমুখে প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রতিরােধ ছিন্নভিন্ন। হয়ে যাচ্ছে। বিধ্বস্ত অর্থনীতি, উপহসিত রাষ্ট্রনীতি এবং ধিকৃত সমরনীতির ফলে বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তান আজ করুণার কাঙালী। কিন্তু এই ঘাতকচক্র নিজেদের সত্য পরিচয় কোনাে মুখখাসেই আড়াল রাখতে পারেনি। তাই একদিকে তার বিশ্বের ভৎর্সনা যেমন কুড়ােচ্ছে অন্যদিকে বাঙলাদেশের  মাটিতে জমে উঠছে তাদের লাশের স্তুপ। আগামী ২৭শে ডিসেম্বরের আগেই সেদিনের সুর্যোদয় হবে বলে আমরা অনুমান করি, যেদিন বাঙলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী ঘাতকদের শেষ লাশটির উদর বিদীর্ণ করতে গিয়ে শবভুক শৃংগালের চোখ দুটিও বুঝি আর্দ্র হয়ে উঠবে।

অভিযান ! ১ : ১ # ১৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩