মুক্তির পর যশােহরে স্বাভাবিক অবস্থা আবার ফিরে আসছে
(যশােহর প্রত্যাগত নিজস্ব প্রতিনিধি)
যশােহর থেকে খুলনা যাবার পথে রূপদিয়ায় এখন শুধু পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহের ছড়াছড়ি। বাকি পাকি-ফৌজ শুধু পালাতেই ব্যস্ত। অস্ত্রশস্ত্র, পােশাকাদি, খাবারদাবার—সবকিছুই ফেলেই তারা পালাতে শুরু করেছে, তাড়া করে চলেছেন আমাদের জওয়াননা। বস্তুত, যশাের সম্পূর্ণ পাক দখলদারবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়ে গেছে। পাক সেনাবাহিনীর সংখ্যাধিক্য সম্বন্ধে যেসব খবর আসতাে তা নেহাতই অলীক প্রমাণিত হয়ে গেছে।
এখন যশােরে ক্রমশ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। রাজারহাট বসতে শুরু করেছে। সমস্ত শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের লােকেরাই স্বগ্রহে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। আমাদের জাওয়ানেরা মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করে চলেছেন। মুক্তাঞ্চলগুলােতে অসামরিক প্রশাসন চালু হচ্ছে। সেই প্রশাসনে সাধারণ মানুষেরা মুক্তিবাহিনীকে সর্বতােভাবে সাহায্য করছেন। অপরাধীদের ধরে আনছেন তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে। মুক্তিবাহিনী অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী তাদের শাস্তি দিচ্ছেন। জায়গায় জায়গায় ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’, ‘মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস।
আমাদের সেনাবাহিনী বাঙলাদেশের মানুষের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছেন। পক্ষান্তরে পাকি-সেনাদের কথা উঠলে তারা এখনও চরম ঘৃণা হেলিকপটারগুলাের কাছে যখন তারা ঘােরাফেরা করেন তখন জাওয়ানেরা তাদেরকে ডেকে ডেকে কথাবর্তা বলেন, গল্পগুজব হয়। কিন্তু খান সেনাদের বেলা এমন কথা কল্পনাও করা যায় না। তাদের মতে, ভারতীয় জওয়ানেরা এমনকি ধানক্ষেতে পর্যন্ত এড়িয়ে চলেন, পাছে সেগুলাের কোনরকম ক্ষতি হয়। আর খানেরা লুঠ করে নিয়ে যেত ধান, খাবার-দাবার, দামী জিনিস—সবকিছু।
যশাের ক্যান্টনমেন্টর পথে আমাদের জওয়ানদের লড়তে হয়েছে অন্তত পাঁচটি পাকিস্তানি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে, তবু কোনরকম ক্ষতি না করেই ক্যান্টনমেন্টের দখল নেওয়া সম্ভব হয়েছে—শহরেরও নাভারণ থেকে যশােহরের এগারাে মাইল এদিকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত। তাছাড়া রাস্তার দুধারে তাদের অজস্র সাঙ্কার তাে ছিলই। অথচ আমাদের বাহিনীর কাছে সবই তুচ্ছ হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত পাক ফৌজ নির্বোধের মতন কেবল যশাের রােডের উপরেই প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তাছাড়া পাকিস্তানি আর আমাদের সৈনিকদের মৃত্যুর হারটাও তাদের নির্বুদ্ধিতারই প্রমাণ । হিসেবটা ধরা যেতে প্রতি ৪০ জন পাকফৌজের পাশাপাশি আমাদের মরেছেন ১ জন সৈনিকক। মােদ্দাকথা, পাকফৌজ নিরস্ত্র মানুষকে মারতে যতটা দড় সমযুদ্ধে ততটা নয়। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে তাদের অত্যাচারের । পালিয়ে যাবার সময় হাতের কাছে যে নিরীহ মানুষ পেয়েছে তাকেই মেরেছে। আমাদের বাহিনী তাই এইসব ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের কাছে মিত্র ও মুক্তিদাতা হিসেবেই হাজির হয়েছে।
পাকফৌজের এই পালিয়ে যাওয়া থেকেই বােঝা যায় যশােহরের মতন খুলনাও, শুধু খুলনা নয় সমস্ত বাঙলাদেশই অনতিবিলম্বে স্বাধীন হবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১