বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে প্রধান মন্ত্রীর আবেদন- মুজিবের প্রাণ রক্ষা করুন
শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, শেখ মুজিবের বিচার করার মত আইনগত, সংবিধানগত অথবা অন্য কোন অধিকার পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেই। ক্ষমতামত্ত পাঞ্জাবী পুঁজিপতিও সামরিক চক্রের এটা একটা গণহত্যারূপী চক্রান্ত। জনাব আহমদ বলেন যে, বাংলা দেশের কল্যাণের স্বার্থে নয়, দক্সিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির জন্য শেখ মুজিবের উপস্থিতি প্রয়ােজন। শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে কিছু করা হলে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দারুণ সংকট দেখা দেবে। বলে প্রধানমন্ত্রী সকলকে সতর্ক করে দিয়েছেন। পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্যদান সম্পর্কে এক প্রশ্নোত্তরে জনাব আহমদ বলেন যে, “বিশ্বের কোন বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক দেশ ইয়াহিয়ার গণহত্যার যুদ্ধকে সাহায্য করতে পারে না।’ তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় অংশ ও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের দাবীকে সমর্থন করেছেন এবং ইয়াহিয়ার নিন্দা করেছেন। তিনি আশা করেন, মার্কিন সরকার শীঘ্রই তাদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থন জানাবেন।
জয়বাংলা (১) ৪ ১: ১৯ ॥ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
কমনওয়েলথ সংসদীয় সম্মেলনের রায়। বঙ্গবন্ধুর মত কালজয়ী নেতাকে আটক রাখা অন্যায়
(বিশেষ সংবাদ দাতা)
সম্প্রতি কুয়ালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী এসাসিয়েশনের ১৭তম সম্মেলনে বাংলাদেশে ইসলামাবাদের জঙ্গী চক্রের বর্বরতম গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ এবং ধিক্কারধ্বনি উচ্চারিত হইয়াছে। বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের উপর ইসলামাবাদ সামরিক জান্তার জঘণ্যতম। সশস্ত্র হামলার প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ এবং সমালােচনা করিয়া বক্তৃতাকালে সম্মেলনে যােগদানকারী কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলির পার্লামেন্ট সদস্যগণ অবিলম্বে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। যুক্তরাজ্যের শ্রমিকদলীয় কমনওয়েলথ সংক্রান্ত ভূতপূর্ব মন্ত্রী এবং প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান মিঃ আর্থার বটমলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠ বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়া তাহাকে অবিলম্বে মুক্তিদানের জন্য জঙ্গী ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। মিঃ বটমলী সুবিস্তৃত বৃটিশ সাম্রাজ্যের পতনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া বলেন, ভারতসহ সম্মেলনে যােগদানকারী ২৩টি দেশই এককালে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সাবেক বৃটিশ ইতিহাস হইতে এই সকল দেশ যে শিক্ষা লাভ করিয়াছে তাহাতে এই কথাই স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, শেখ মুজিবর রহমানের মত কালজয়ী নেতাকে আটক রাখা উচিত নয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, ইসলামাবাদের পক্ষ হইতে কোন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যােগদান করে নাই। কারণ, পাকিস্তানে গণতন্ত্রের কোন অস্তিত্ব নাই। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান সুলতান আবদুল হালিম এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
সম্মেলনে যােগদানকারী ২৩টি দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি ১৩টি দেশের প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশ সম্পর্কীত বিতর্কে অংশ গ্রহণ করেন। প্রাক্তন বৃটিশ মন্ত্রী মিঃ বটমলী তাঁহার ১০ মিনিটকাল স্থায়ী ভাষণে বাংলাদেশ সমস্যা এবং শরণার্থী সমস্যার উপর আলােকপাত করেন। উল্লেখযােগ্য যে, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত ইসলামাবাদের রাষ্ট্রদূত এই সম্মেলনে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়া আলােচনা না করার আবদার করিয়াছিল। কিন্তু রক্ষণশীল দলীয় বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ান স্যার রােনাল্ড রাসেল উহার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেন। তিনি বলেন, সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধির অনুপস্থিতির জন্য আমরা দোষী হইতে পারি না। পাকিস্তানে পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা নাই। তাই তাহাদের সদস্যপদ আপাততঃ বাতিল রহিয়াছে। গায়েনার প্রতিনিধি মিঃ নিভাইলী জেমস বলেন যে কমনওয়েলথ দেশগুলির পাকিস্তানের ব্যাপারে আলােচনা করার অধিকার রহিয়াছে। কারণ, বাংলাদেশে নিষ্পেষণ চালাইয়া ইসলামাবাদ চক্র নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির সকল সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৪ সংখ্যা ॥ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩