You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.21 | জল্লাদ ইয়াহিয়ার সর্বশেষ আবিষ্কার শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হইলে তাঁর অনুগামীরাই তাকে হত্যা করিবে - সংগ্রামের নোটবুক
জল্লাদ ইয়াহিয়ার সর্বশেষ আবিষ্কার শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হইলে তাঁর অনুগামীরাই তাকে হত্যা করিবে
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
একদিকে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় দুর্ধর্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান প্রচণ্ড গেরিলা আক্রমণে ক্ষত বিক্ষত ইসলামাবাদ সামরিক জান্তার পাকিস্তানের মৃত্যু সঙ্কট অপরদিকে সম্ভাব্য পাক  ভারত যুদ্ধের এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ইসলামাবাদের জল্লাধিপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান গত মাসে নিউজ উইক এর সিনিয়র এডিটর দ্য বর্চগ্রোভের সহিত সাক্ষাঙ্কারকালে সমস্যা হলে অবস্থার কথা বিবৃত করে।
যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে
ভারতের সহিত যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিউজ উইক-এর প্রতিনিধির নিকট বলে, যুদ্ধ আসন্ন নয় আপনাকে একথা বলার কোন কারণ নাই। কারণ, যুদ্ধ আসন্ন। ভারত ইতিমধ্যেই আমাদের সহিত যুদ্ধ শুরু করিয়া দিয়াছে। কিন্তু উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ সংঘটিত না হওয়ার কারণ হইল, আমরা ভারতীয় আক্রমণের জবাব দেই নাই। ভারতের ক্রমবর্ধমান উস্কানী সত্বেও আমরা সংযমের পরিচয় দিয়া চলিয়াছে। ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দেড় শত হতে ৩ সহস্র বার গােলাগুলী এবং মর্টার শেল বর্ষণ করিতেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের কথা চাপিয়া গিয়া ইয়াহিয়া খান ভারতকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছে তাহারা সেতু, বিদ্যুৎ লাইনের পাইলেন, এমনকি সেদিন খাদ্য বােঝাই জাহাজও ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। ভারত যুদ্ধে গেরিলা ট্রেনিং শিবির স্থাপন করিয়াছে। সীমান্ত এলাকা থেকে বেসামরিক জনগণকে সরাইয়া দিয়াছে এবং তাহাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জিন্নাহ আমাদিগকে হুমকী দিয়া চলিয়াছেন। ভারত যদি আমাদের কোন এলাকা দখল করিতে কিংবা বাংলাদেশে একটি তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করিতে চায় তাহা হইলে ইহার পথ হইবে যুদ্ধ । টোটাল ওয়ার সামরিক যুদ্ধ। ভারতীয় সামরিক সুবিধা প্রসঙ্গে  আমাদের চাইতে পাচগুন বিরাট ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সহিত আমরা কিভাবে যুদ্ধ কিংবা জয়লাভ করিতে পারি? তাহাদের বিরুদ্ধে আমাদের সামরিক অভিযান বাতুলতার সামিল হইবে। কিন্তু যদি আমরা আক্রান্ত হই, তাহা হইলে আমরা যুদ্ধ করিয়া ছাড়িব। ভারতের বিরাট সমরাস্ত্রের কারখানা আছে এবং তাহারা অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ ।
যদি তাহারা একদিনেই ৩ হাজার শেল নিক্ষেপ করিতে পারে তাহা হইলে ইহার অর্থ তাহাদের নিকট প্রচুর গােলা বারুদ আছে। আমাদের পক্ষে উহা। বিলাসিতা। পাকিস্তানকে চীনের সাহায্য প্রসঙ্গে।  গণচীন পাকিস্তানের উপর কোনপ্রকার হামলা বরদাশত করিবে না। কেবলমাত্র সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া আমরা চীনের নিকট হইতে প্রয়ােজনীয় সকল সমরাস্ত্র এবং গােলা বারুদ পাইব। কতকগুলি জিনিস আমরা বিনামূল্যে পাইব এবং কতকগুলির জন্য আমাদিগকে মূল্য দিতে হইবে। তাহাছাড়া, চীনের অনেক শর্ত খুবই সহজ। ২৫ বৎসর ব্যাপী সুদবিহীন ঋণ। গত বৎসর আমার চীন সফরকালে আমাদের পাঁচশালা পরিকল্পনার জন্য ২০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের ব্যবস্থা করিয়া আসিয়াছি। আপােষ প্রসঙ্গে  আমি যুদ্ধ চাই না আমি উহা এড়াইবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করিতেছি। আমি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়ােগের ব্যাপারে বার বার উথান্টের প্রস্তাব সমর্থন করিয়াছি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা, যাহা খুশী  দেখিতে পারেন ভারত হইতে প্রত্যাগত শরণার্থীদের আমরা কিভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করি তাহাও  দেখিতে পারেন। ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লক্ষ বলিয়া আমি স্বীকার করি না। বড় জোর ২০ লক্ষ অথবা ৩০ লক্ষ হইবে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের হিসাব মতে শরণার্থীদের সংখ্যা ৪০ লক্ষও হইতে পারে। সংখ্যা যাহাই হউক না, মার্চের পর যাহারা চলিয়া গিয়াছিলেন তাহারা ফিরিয়া আসিলে তাহাদিগকে গ্রহণ করা হইবে। তাহা কেবল জাতিসংঘের দ্বারাই সম্ভব হইবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে
বাঙ্গালীদের সহিত কেহই কোনদিন ভাল ব্যবহার করে নাই। আমরাও বড় ভুল করিয়াছি। আমরা বলিতে আমি বাঙ্গালীদেরও বুঝাইতেছি এবং যাহারা স্বাধীনতার পর হইতে প্রেসিডেন্ট এবং  প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশ চরম অবহেলিত হইয়াছে। উহার উন্নয়নের দিকে আমরা তত নজর। | দেই নাই। সেই হারানাে সময়ের ক্ষতিপূরণের জন্য এইবার আমরা চেষ্টা করিব।
শাসনতন্ত্র। ২০শে ডিসেম্বর নয়া শাসনতন্ত্র জারী করা হইবে। বাংলাদেশ ১ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। কাজেই তাহারা সর্বোচ্চ পরিমাণ স্বায়ত্বশাসন ভােগ করিবে এবং তাহাদের নিজেদের বিষয়গুলি নিজেরাই পরিচালনা করিবে তাহা খুবই স্বাভাবিক  অর্থাৎ দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয় এবং ট্যাক্স ছাড়া আর সব ব্যাপারেই তাহাদের স্বায়ত্ব শাসন থাকিবে। শেখ মুজিব প্রসঙ্গে অনেকেই হয়ত আমাকে বিশ্বাস না করিতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি যদি শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরিয়া যায় তাহা হইলে তাহার নিজের লােকেরাই তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিবে। কারণ, তাহারা তাহাদের এই দুর্ভোগের জন্য শেখ মুজিবকেই দায়ী করিতেছে। তিনি আমার সহিত দুই বৎসর ধরিয়া আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্ব শাসন সম্পর্কে আলােচনা করিতে ছিলেন। কিন্তু তিনি তাহার কথা হইতে সরিয়া যান। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠন করেন এবং তাঁহার নেতৃত্বে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়  ইহার পর বিদ্রোহকে নিষ্পিষ্ট করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। যে কোন সরকারই তাহা করিত। আমি এখন কি ভাবে এই লােকটিকে আলােচনায় আহ্বান এবং তাহার সহিত আপােষ করিতে পারি? তাঁহাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার এবং সেনাবাহিনীর আনুগত্য বিনষ্ট করার অভিযােগে অভিযুক্ত করা হইয়াছে। তাহার পক্ষে দেশের শ্রেষ্ঠ এবং সম্মানিত আইনবিদ এ, কে, ব্রোহীকে নিযুক্ত করা হইয়াছে।
সামরিক আদালতে কোন প্রকার হানিকপানিক হইবে বলিয়া মনে করিলে ব্রোহী এই মামলার দায়িত্ব নিতেন না। আমি মুজিবকে প্রথমে গুলী করিয়া হত্যা করি নাই এবং পরে তাহার বিচার করি নাই— কারণ কতিপয় দেশের সরকার এই ব্যাপারে আমাকে অনুরােধ জানান। বিচারে শাস্তির রায় হওয়ার পর তাঁহার কি হইবে তাহা রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ ক্ষমতার এখতিয়ার ভুক্ত। আমি খেয়ালের বশবর্তী হইয়া তাহাকে মুক্তি দিতে পারি না। ইহা একটি দায়িত্বের অবমাননা হইবে। কিন্তু দেশবাসী যদি তাঁহার মুক্তির জন্য দাবী করেন—তাহা হইলে আমি তাহাকে মুক্তি দিব। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া খান বলে ইহাতে ভারতেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হইবে। পশ্চিম বাংলা এবং আসাম শীঘ্রই উহার সহিত যুক্ত হইবে এবং ইহা হইতেই ভারত ইউনিয়নের ভাঙ্গন শুরু হইবে। আল্লাহর নিকট আমার কামনা এই মহিলাটি (শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী) যেন উহা বুঝিতে পারেন।
বাংলার বাণী ॥ ৪ সংখ্যা ৪ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩