You dont have javascript enabled! Please enable it!

শেখ মুজিব দ্বিতীয় বিপ্লব
সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৫

সেই প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত অবশেষে গৃহীত হয়েছে জাতীয় সংসদে। জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধন গৃহীত হয়েছে, বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়েছে প্রেসিডেন্ট শাসিত শাসন ব্যবস্থা। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২৫ শে জানুয়ারী দুপুর ১ – ১৫ মিনিটে শপথ গ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর, স্বাধীনতার ১১৩৫ দিন পরে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনে যে বিশাল মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হল তা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। দেশের মানুষের বিশ্বাস – এই পরিবর্তন তাদের জীবনে শান্তি আনবে, সুখ ও সমৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করবে, সিদ্ধান্ত কার্যকর ভাবে প্রয়োগে সরকারকে শক্তি জোগাবে।

আজকের এই সিদ্ধান্ত অতীতের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের বাসনায় এই তাৎপর্য মন্ডিত পরিবর্তন। তার চেয়েও বড় কথা, যে আস্থাহীনতায় দেশবাসী সামনে চলার পথ হারিয়েছিলেন আজ তা থেকে মুক্তি পেলেন। সামনে এগিয়ে যাবার পথ এখন আলোকিত।

দেশের উল্লেখিত পরিস্থিতিতে, ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার, বাড়ি ভাড়া আদায় প্রভৃতি কারণে সেনাবাহিনী নিয়োগ সম্পর্কে বিচিত্রা বক্তব্য রেখেছিল ‘ষোলই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানিষ যে আশায় বুক বেঁধে স্বাধীনতাকে ধারণ করেছিল, আজ সে আলো কোথায়? এখন শুধু হতাশা। সর্বত্র দুঃখ বোধ, কিছুই হলো না। আস্থাহীনতা আজ জনগণকে চরম ভাবে পেয়ে বসেছে৷ সমস্যা এখন সেনাবাহিনী প্রয়োগের নয় – সমস্যা আস্থাহীনতার আস্থা হীনতা জীবন সম্পর্কে, ব্যাক্তি সম্পর্কে, চাকরী সম্পর্কে, দেশ সম্পর্কে।

আমাদের উদ্ধার পেতে হবে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে। (১৭ ই আগস্ট, ১৯৭৩) সেই অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্যই শুরু হয়েছে এই যাত্রা৷

বিগত তিন বছরে এক শ্রেণীয় মানুষের হাতে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটেছে, দেশে সন্ত্রাসের আবহাওয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। এক শ্রেণীর লোভী মানুষ দূর্নীতির পিচ্ছিল, চোরা পথে গড়ে তুলছে সম্পদের স্তুপ। অন্য দিকে দেশের দরিদ্রে, গরীব, নিরীহ, আইন মান্যকারী মানুষ এই হীন লোভের শিকার হয়েছে। ছিনিমিনি খেলা হয়েছে মুখের অন্ন নিয়ে। শিশুর খাদ্য নিয়ে, দরিদ্র মানুষের ভোগপণ্য নিয়ে।

প্রতিটি মানুষ কামনা করেছে এই অবস্থার অবসান। মানুষ আশা করছে, বঙ্গবন্ধু বিপ্লবের ডাক দেবেন, সমগ্র জাতিকে নতুন জীবনের স্পর্শে স্পন্দত করে তুলবেন৷সে আহ্বান আবার নতুন ভোরে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাদের প্রতি, যারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের জন্য কাজ করতে চান।

এই আহ্বান বঙ্গবন্ধু অতীতেও জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এমনি এক আহ্বান সম্পর্কে বিচিত্রার বক্তব্য ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর গোটা বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করে একটা কথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল, জনগণকে গতিশীল হতে হবে। এ গতির জন্য প্রয়োজন শুধু কাজ আর কাজ৷ যে যেখানেই অবস্থান করুন না কেন সেখানেই কাজের গতিকে বাড়িয়ে দিতে হবে। জন সম্পদকে অধিক হারে প্রয়োগ করতে হবে। শ্রমের ঘন্টা বাড়িয়ে দিয়ে একমাত্র দেশের কল্যাণকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে। এর উপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের বাংলাদেশের অগ্রগতি। আর জন সম্পদের সঠিক ব্যবহার না হলে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন।

একই আহ্বান বঙ্গবন্ধু বহুবার জানিয়েছেন। জাতির জনকের ঔদার্য নিয়ে, বঙ্গবন্ধু সুযোগ দিয়েছেন, ভ্রান্ত পথগামীরা হয়ত সংশোধিত হবে। কিন্তু সুযোগ সংশোধনীরা তার ভিন্ন অর্থ করেছে, সেচ্ছ্চারী কার্যালাপের মাধ্যমে অতিষ্ঠ করে তুলছে জন জীবন। তাই দুঃখী মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণে স্বভাবসুলভ বলিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এগিয়ে এসেছেন বৈপ্লবিক কর্মসূচী নিয়ে। এই কর্মসূচীর বাস্তবায়নে প্রতিটি মানুষের সহযোগিতা করা উচিৎ – আপন স্বার্থে, দেশের স্বার্থে।

অতীতে বঙ্গবন্ধু, আরো কঠোর হতে পারতেন, আরো নির্মম হতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন সহজ দৃষ্টি দিয়ে সব কিছু বিচার করতে। কিন্তু এবার কঠোর হয়ে সেই মহত্বকে দিলেন গৌরব।

সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘এটা আমার দ্বিতীয় বিপ্লব। এর লক্ষ্য দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা।’ বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্ন আজন্ম লালিত। এ প্রসঙ্গে আমরা বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু অনেকভাবে আহ্বান জানিয়েছেন দেশবাসীর প্রতি। অনেকবার সুযোগ দিয়েছেন গনবিরোধী দুষমনদের। তবুও আজ একটি কথা না বলে উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুর অনেক মন্তব্য আর সতর্কবাণী আজ বাঁধানো ছবির মত। ঠিক যেভাবে বঙ্গবন্ধু দেশকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেভাবে যেনো পারেননি। কোথায় যেন একটা গড়মিল দানা বেঁধেছে। কারা যেন অদৃশ্য হাতে থামিয়ে দিতে চাইছে বাংলাদেশের সাধারণ জীবনযাত্রাকে। অনেকে মানতে চাইবেন না – তবু এগুলি আজ বাস্তব সত্য।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যদি আপন হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতেন তাহলে আজ অবস্থা অন্য রকম হতো। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এখনো অনেকের প্রত্যাশা। দেশবাসীর বিশ্বাস, তিনিই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন। এখনো দেশবাসী তার নেতৃত্বে আস্থাবান। একটি মাত্র কারণে, তা হলো, বঙ্গবন্ধু বলেছেনঃ প্রয়োজন হলে দুঃখী মানুষের সংগ্রামে আবার নেতৃত্ব নিতে পারি। (বিচিত্রা, ২৫ মে, ১৯৭৩)

সেই প্রত্যাশার বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার কথা৷

শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই সংবিধান সংশোধনের উদ্দেশ্য। যে গণতন্ত্র দেশ ও মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করে না, যে গণতন্ত্র জনগণের স্বার্থ বিরোধী মহলকে সংযত করতে সক্ষম নয়, সে গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দেশের শোষিত মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হবে ঘুষ, দূর্নীতি, চোরাচালান, কালোবাজারী ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ দমনের জন্য। দুষ্কৃতকারী দের দমনের জন্য নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।

জনগণের বিশ্বাস – দেশ জুড়ে দৃষ্টি হবে গঠনমূলক পরিবেশ। জনগণকে উপলব্ধি করতে হবে, নতুন ব্যবস্থায় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত। কেননা এবার দায়িত্ব ও শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়েছে সেই একক ব্যাক্তিত্বের উপর৷ যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশকে মুক্ত করেছেন। সুভাষ বসু বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। নেপোলিয়ন আহ্বান জানিয়েছিলেন, দেশকে তোমরা সব দাও। বিনিময়ে তোমরা পাবে – কিছুই না। ফরাসী নেপোলিয়ান কোন প্রতিশ্রুতি দিতে চাননি। নেপোলিয়ন বলতেন, দেশ তোমাকে কিছুই দিতে পারে না। বঙ্গবন্ধুও দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত চেয়েছিলেন। বলেছিলেন – যার যা আছে, তাই নিয়ে তৈরী থেকো। স্বাধীনতার পর বলেছিলেন – তিন বছর কিছুই দিতে পারবো না। শুধু নিখাদ আবেগ দিতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সবাই দেশকে সব কিছু দেবে।

এই আত্ব – বিনিয়োগের আহ্বান যখন সেই সব স্বার্থ – সন্ধানী, ক্ষমতালোভীরা উপেক্ষা করল, তখন তিন বছর শেষে বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের। সুভাষ বসু বা নেপোলিয়নের মত বঙ্গবন্ধু এখনো ইতিহাস হয়ে যান নি। তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে বিজয়ী যোদ্ধা। রক্তে ভিজে, বঞ্চনার শিকার হয়ে, মানুষ আশা করছে – এবার ফুটবে সোনার ফসল।

সেই সোনার ফসলের জন্য বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছেন চারটি কর্মসূচীঃ উৎপাদনের ভিত্তিতে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দূর্নীতি, ঘুষ, চোরাচালান প্রভৃতি সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ দমন এবং দায়িত্ব পালনের জন্য কাজ করা। জাতীয় অগ্রগতি সাধনের জন্য এ ভিন্ন অন্য কোন পথ নেই।

পরমুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকলে, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না করলে, রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, তা অর্থহীন হয়ে যাবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অচলাবস্থা, উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি এতদিনের আকাঙ্ক্ষিত প্রগতির পথে বাঁধা হয়ে ছিল৷ সরকার কাঠামোর এই মৌলিক পরিবর্তন সেই বাঁধাকে অপসারিত করবে, প্রশাসনিক সংকট দূরীভূত হবে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে।

তাই বঙ্গবন্ধুর এই দ্বিতীয় বিপ্লব স্বার্থক ও সফল করে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। দেশ গঠনে এখন আত্মনিয়োগ করা উচিৎ প্রতিটি মানুষের।

এটা প্রত্যাশিত, দেশের উন্নয়নে, গঠনে বিভিন্ন স্তরের মানুষকে আহ্বান জানানো হবে দলমত নির্বিশেষে। উদ্দেশ্য হচ্ছে সমস্ত কিছুতে গতিশীলতা, কর্মদক্ষতা অর্জন এবং অতীতের স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা।

এতদিন বাংলাদেশে যে সংকট ছিল, সে সংকট রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সংকট নয়, সরকারী প্রশাসনিক অব্যবস্থার সংকট। এ অব্যবস্থার কারণ ছিল (ক) প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও একতার অভাব, (খ) সরকারী কার্যে বাইরের হস্তক্ষেপ। সরকারের নতুন ভিত্তি এসব অব্যবস্থার অবসান ঘটবে।

সকল অব্যবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য, সংবিধানের সংশোধনীতে বিধান রাখা হয়েছে একটি একক জাতীয় দলের। বঙ্গবন্ধু এই দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন।

বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক পদক্ষেপে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি ঘরে ঘরে এই আহ্বান প্রতিধ্বনিত হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় একমাত্র বঙ্গবন্ধুই পারবেন বৈপ্লবিক কর্মসূচিকে সীমিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত করতে। জাতিকে আকাংখিত লক্ষ্যে পৌছে দিতে। এই আশা নিয়েই জাতি তাকিয়ে আছে তার দিকে। একদিন এ মানুষটির আহ্বানে প্রাণ দিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের প্রত্যয় ছিল – স্বাধীনতার তারা সুখী – সমৃদ্ধ – নিরাপদ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পাবে, সুফল ভোগ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার।

আজ তার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন বঙ্গবন্ধু। তার এই বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হোক। দেশের ইতিহাসে সংযোজিত হোক নতুন অধ্যায়।

আমরা জানি, যে কোন গঠনমূলক কাজই কষ্টকর, বিশেষ করে অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের উপর যখন তা করতে হয়। আমরা জানি যে কোন ঐতিহাসিক কাজ, ইতিহাস সৃষ্টির কাজ দুঃসাধ্য। সব কিছু জেনে আমরা এগিয়ে যাব৷ সংগ্রাম ভিন্ন কোন কিছু অর্জন করা যায় না, সৃষ্টি করা যায় না। আগামী দিনগুলোতে অতীতের মতই উৎসাহ, উদ্দীপনা, দৃঢতা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বান সে পথের নিশানা দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের কালপঞ্জী

১৯২০ঃ ১৭ ই মার্চে ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৪২ঃ প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। ইতিমধ্যেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে ৬ দিনের জন্য কারাবরণ করেন।

১৯৪৭ঃ কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি, এ পাস করেন। পাকিস্তান হবার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

১৯৪৮ঃ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ২ রা মার্চ গ্রেপ্তার হন।

১৯৪৯ঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করার জন্য মার্চ মাসে আবার গ্রেফতার হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এই সময়ে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত হন। জেলে থাকাকালীন তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের জন্য মুক্তিলাভ করে তিনি খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নেবার জন্য আবার অন্তরীণ হন।

১৯৫২ঃ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে কারাগারে অনশন করেন।

১৯৫৩ঃ জেল থেকে মুক্তি লাভ করার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৪ঃ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য রূপে নির্বাচিত এবং শেরে বাংলার মন্ত্রী সভায় সমবায় ও কৃষি মন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হন। নতুন প্রাদেশিক সরকারের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মন্ত্রী সভা ভেঙে দেয়। তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।

১৯৫৫ঃ জুন মাসে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত। প্রদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রাদেশিক মন্ত্রী সভায় শ্রম ও বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫৭ঃ মন্ত্রী সভার দায়িত্ব থেকে জুলাই মাসে অব্যাহতি নিয়ে পুনর্গঠিত করার কাজে আত্ম-নিয়োগ করেন। জুনে পাকিস্তান টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহন (অক্টোবর, ‘৫৮ পর্যন্ত)

১৯৫৮ঃ অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে বহু মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করেন। জেলে তার ওপর নানা ধরণের মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।

১৯৫৯ঃ ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।

১৯৬২ঃ মহান নেতা সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির জন্য যখন ছাত্ররা ফেব্রুয়ারীতে ব্যাপক গণ আন্দোলনের সূচনা করে, তখন ছয় মাসের জন্য তিনি পুনর্বার কারাবরণ করেন।

১৯৬৬ঃ লাহোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তিনি ঐতিহাসিক৬ দফা দাবীনামা পেশ করেন। ৬ দফার সমর্থনে ব্যাপক গণ সমর্থন অর্জন করেন। জুনে সামরিক জান্তা তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের প্রতিবাদের৭ ই জুনে বাংলাদেশের সর্বত্র হরতাল পালিত হয়।

১৯৬৮ঃ ১৭ ই জানুয়ারী জেল থেকে সামরিক বাহিনীর হেফাজতে পাঠানো হয় এবং তার বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ আনা হয়। ১৩ মাস তাকে কঠোর প্রহরায় রাখা হয়। সামরিক আদালতে তার বিচার প্রহসন শুরু হয়।

১৯৬৯ঃ দূর্বার গণ অভ্যুত্থানের ফলে ‘২৪ শে ফেব্রুয়ারী সামরিক জান্তা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত করে৷ এই সময় তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভ করেন।

১৯৭০ঃ পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে।

১৯৭১ঃ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জানুয়ারীতে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পরে ভুট্টোর পরামর্শে সংসদের নির্ধারিত অধিবেশনের তারিখ পিছিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদে ৭ ই মার্চ স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভায় প্রতিরোধ সংগ্রামের সূচনা করেন। ২৫ শে মার্চ সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালায়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে লয়ালপুর পাঠিয়ে দেয়। ১৭ ই এপ্রিল মুজিবনগরে তার অবর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হন। সমগ্র বিশ্ব তাকে বাঙালী জাতির মহান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৭২ঃ ১০ ই জানুয়ারী বিশ্ব জনমতের চাপে পাক সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়৷ তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহন করেন। জুলিও কুরি পুরষ্কার লাভ।

১৯৭৩ঃ ৭ ই মার্চ সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়যুক্ত হয়।

১৯৭৪:২৫ শে জানুয়ারী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1975.01.31-bichitra.pdf” title=”1975.01.31 bichitra”]

(উপরোক্ত আর্টিকেলের সাথে এই লেখাটিও পরপর ছাপা হয় যা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় টাইপ করে দেয়া হল। এটি গবেষকদের কাজে লাগবে বলে আমরা মনে করি।)

আমাদের খাদ্য সমস্যা

ভূমিকাঃ এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ চাইতো কম কিন্তু পেত অনেক বেশী। ক্ষুধা নিবৃতির জন্য চারপাশে ছিল তার বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য অন্নের প্রাচুর্য্য। তারপর কেটে গেছে যুগের পর যুগ। শতাব্দির পর শতাব্দি। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষ।  ক্ষুধা বেড়েছে, বেড়েছে চাহিদা৷ কিন্তু বিশ্বের পরিধি সীমিত।  ইচ্ছে করলেই একে বাড়ানো যায় না। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে বাড়ানো যায় না  মাটির উৎপাদন ক্ষমতাকে। কারণ উৎপাদন ক্ষমতারও একটা প্রান্তিক লগ্ন আছে। তবুও প্রচেষ্টা চলছে উৎপাদন বৃদ্ধির। খাদ্যশস্য সরবরাহ বেড়ে চলেছে সঙ্গে সঙ্গে।  উন্নত চাষাবাদের দরুণ গত দুই দশকে বিশ্বের খাদ্য শস্যের উৎপাদন বেড়ে গিয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ক্রম বর্ধমান মানব সন্তানের চাপ বর্তমান বিশ্বের বুকে এতোই বেশি যে এই বর্ধিঞ্চু জনসমষ্টির চাহিদার সঙ্গে বর্ধিত খাদ্য সরবরাহ কুলিয়ে উঠতে পারছে না এর আরো একটা কারণ আছে। তা হল খাদ্য শস্যের সরবরাহ  এবং বন্টনের অসাম্যতা।  বিশ্বের জনসমষ্টির শতকরা ৩০ জন লোক বাস করে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু তার খাদ্য শস্য ভোগ করে বিশ্বের উৎপাদনের শতকরা ৫৫ ভাগ। সুতরাং বাকী ৭০ ভাগ লোককে মোট উৎপাদনের ৪৫ ভাগ খাদ্য সামগ্রী ভাগাভাগি করে ভোগ করতে হয়।  ফলে দারুণ এক ক্ষুধা এসে ক্রমেই গ্রাস করছে বিশ্বের এক ব্যাপক এলাকা জুড়ে।

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ বর্তমান শতাব্দির ষাট দশক থেকে অনাহার এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে তিনশো থেকে পাঁচশো মিলিয়ন মানুষ অপুষ্টিতে মূত্যুর দিকে ধুকছে। না খেতে পেয়ে প্রতি বছর কতো লোক মারা যাচ্ছে তার সঠিক তথ্য হয়তো জানা যায় না।  তবে প্রতি বছর এই অনাহারে মৃত্যুর হার যে বাড়ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বিশ্বের এই নিরন্ন ও পুষ্টিহীন মানুষের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী প্রধানতঃ সম্পদের অসম বন্টন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা।  ১৫৫০ সনে পৃথিবীর জনসমষ্টি ছিল মাত্র ৫৪৫ মিলিয়ন। মাত্র দুশো বছরের ব্যবধানে ১৭৫০ সনে সেই জনসংখ্যা ৭২৮ মিলিয়ন হয়ে গেল। তারও দুশো বছর পর অর্থাৎ ১৯৫০ সনে মোট সংখ্যা এসে দাড়ালো ২২৪৯ মিলিয়নে। ১৮৫০ সনে তার পরিমাণ ছিল ১১৭১ মিলিয়ন। অর্থাৎ ১৮৫০ থেকে ১৯৫৭, এই একশো বছরের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল। আজ থেকে পঁচিশ বছর পর অর্থাৎ ২০০০ সনে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৬০০০ মিলিয়ন এমনকি ৭০০০ মিলিয়নও হয়ে যেতে পারে। তার মানে, মাত্র ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে বিশ্বের জনসংখ্যা আবারও দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সুনিশ্চিত সম্ভাবনা। 

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৬ সন পর্যন্ত বিশ্বের খাদ্যের উৎপাদনের গতি এতোই মন্থর ছিলো যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যোৎপাদন প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। ফলে অনুন্নত কৃষি নির্ভর দেশগুলো দারুণ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি এসে দাড়ায়। বিশ্বের এমন অনেক কৃষি ভিত্তিক দেশ রয়েছে যে গুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূলত কৃষিজাত দ্রব্য সামগ্রীর রপ্তানীর উপর নির্ভর করতো। কিন্তু ১৯৬৬ সনের শেষ দিকে এসে সেই দেশ গুলো কৃষিজাত দ্রব্য সামগ্রী আমদানী করতে শুরু করলো কারণ জাতীয় উৎপাদন জাতীয় চাহিদাকে মেটাতে পারলো না। ফলে ত্রিশ বছর আগেও বিশ্বের অনুন্নত কৃষি নির্ভর দেশগুলো যেখানে প্রায় ১১ মিলিয়ন খাদ্য শস্য ইউরোপে রপ্তানী করতো, সেখানে ষষ্ঠ দশকের শেষ দিকে এসে তারা খাদ্য আমদানীর জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে ধর্না দিতে থাকলো।

বন্যা, খরা এবং শস্যহানীর ব্যাপকতায় ক্রমবর্ধমান খাদ্য ঘাটতিকে মোকাবিলা করার জন্য ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অনুন্নত দেশ গুলো কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই ১৪০ মিলিয়ন খাদ্য শস্য আমদানী করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ঋণ এবং অনুদান অনুন্নত দেশ গুলোকে সাময়িক ভাবে সহায়তা করতে হয়তো। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এই অনুদান মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়।  কারণ বিদেশী খাদ্য দ্রব্যের চালান ভোজ্য দেশগুলোতে পৌছানো এবং সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে বিতরণের জন্য যে খরচ হয়, তা মূলতঃ মোট খাদ্য শস্যের বিনিময় মূল্যকেও অনেকক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যায়।  ফলে ভোজ্য  দেশগুলোর খাদ্য দ্রব্যের মূল্য মান দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।  তাছাড়া খাদ্য সামগ্রীর আমদানী অনুন্নত দেশগুলোর আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষমতাকেও অনেকাংশে ব্যহত করে৷ এই অনুদান দেশের জনগণের কর্মস্পৃহা এবং বৈপরীত্বের মুখোমুখী সংগ্রামী মনোভাবকে দমিয়ে দেয়৷ উদাহরণ স্বরূপ কতগুলো অনুন্নত দেশে,

                 বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের মজুত (মিলিয়ন টন)

বছর গম^১ অন্যান্য খাদ্যশস্য^২ মোট মজুত
১৯৬০-৬১ ৬৩.৬ ৮৫.৫ ১৪৯.১
১৯৬১-৬২ ৫৪.৫ ৭০.৯ ১২৫.৪
১৯৬২-৬৩ ৫৬.১ ৫৪.০ ১২০.০
১৯৬৩-৬৪ ৪৭.৭ ৭০.৩ ১১৮.০
১৯৬৪-৬৫ ৪৭.৪ ৬০.৪ ১০৭.৮
১৯৬৫-৬৬ ৩৫.৭ ৪৯.০ ৮৪.৭
১৯৬৬-৬৭ ৩৭.৬ ৪৬.১ ৮৩.৭
১৯৬৭-৬৮ ৪৫.৫ ৫৯.০ ১০৪.৫
১৯৬৮-৬৯ ৬৩.২ ৬১.৪ ১২৪.৬
১৯৬৯-৭০ ৬৫.৮ ৬০.১ ১২৫.৯
১৯৭০-৭১^৩ ৫০.১ ৪৫.৫ ৯৫.৬

                              ১ = ৭ টি প্রদান ফসল

                              ২ = ৬ টি প্রধান অর্থকরী ফসল

                              ৩ = প্রাথমিক

প্রাপ্তিস্থানঃ ব্যবহারিক বিজ্ঞান এবং উন্নতি ভল্যুম ২, পৃষ্ঠা ১৪  

অনুন্নত দেশগুলোর প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্য আমদানী পরিমাণ (ফাও এর মতে)

বছর অনুণ্ণত দেশগুলোর উত্পাদন যদি অতিমাত্রায় বেড়ে যায় আশাপ্রদ ভাবে যদি এগিয়ে যায়
১৯৭০ ১.২ – ২.৫ মিলিয়ন টন ১১.৪ মিলিয়ন টন
১৯৮০ ৮.৭ মিলিয়ন টন ৩৯.৫ মিলিয়ন টন
২০০০ ৪৬.২ মিলিয়ন টন ১৫৩.৩ মিলিয়ন টন

                       

প্রাপ্তিস্থানঃ ব্যবহারিক বিজ্ঞান এবং উন্নতি ভল্যুম -২, পৃষ্ঠা – ১৪

ইন্সটিটিউট ফর সায়েন্টিফিক কো অপারেশন , ফেডরেল রিপাবলিক অব জার্মানী

উন্নত ফসল রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহন করে জাপানিরা তাদের কৃষির উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে৷ সে দেশের ৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে যে পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশে ৪০০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতেও সেই পরিমাণ সার ব্যবহৃত হয় না। তদপুরি সে দেশে একই জমি থেকে বছরে ৪ থেকে ৬ বার পর্যন্ত ফসল কাটার দৃষ্টান্ত রয়েছে৷  গবেষণা ও নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে তারা উৎপাদনের ক্রমিক হ্রাসের নিয়মকেও পাস কেটে যেতে সক্ষম হয়েছে৷সুতরাং জাপান, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার দৃষ্টান্তকে মেনে নিলে আমাদের দেশের খাদ্যোৎপাদনের লক্ষমাত্রা অর্জিত না হওয়ার পেছনে কোন যুক্তিই থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা, খাদ্যশস্যের উত্পাদন, চাহিদা এবং ঘাটতির হিসাব             

বছর জনসংখ্যা

মিলিয়ন

মোট উত্পাদন মোট উত্পাদন থেকে ১৯ ভাগ বাদ বীজ উত্পাদন বাদ দিয়ে আমদানী বা ঘাটতির হিসাব মোট চাহিদা
ধান

(০০০ টন)

গম

(০০০ টন)

মোট

(০০০ টন)

ধান

(০০০ টন হিসেবে)

গম

(০০০ টন হিসেবে)

মোট খাদ্যশস্য

(০০০ টন হিসেবে)

ধান

(০০০ টন হিসেবে)

গম

(০০০ টন হিসেবে)

মোট শস্য

(০০০ টন হিসেবে)

(০০০ টন হিসেবে)
১৯৫৩-৬০ ৫৩.৯০ ৮৪,৮২ ২৯ ৮৫,১১ ৭৭,৯৩ ২৬.৭ ৭৮২১.৭ ৪৬৪ ১৪৮ ৬১২ ৮৪৩৬
১৯৬০-৬১ ৫৫.৫৭ ৯৫২৯ ৩২ ৯৫৫১ ৮৭৪৮ ২১.৪ ৮৭৭৭.৪ ৪৬৪ ২৩৪ ৬৯৮ ৯৪৭৪
১৯৬১-৬২ ৫৭.২৯ ৯৪৬৫ ৩৯ ৯৫০৪ ৮৬৯৮ ৩৫.৮ ৮৭৩৩.৮ ২০৬ ২০২ ৪০৮ ৯১৪২
১৯৬২-৬৩ ৫৯.০৭ ৮৭২০ ৪৪ ৮৭৭৪ ৮০২৩ ৪০.৪ ৮০৬৩.৪ ৫৪২ ৮৯৪ ১৪৩৬ ৯৪৯১
১৯৬৩-৬৪ ৬০.৯০ ১০৪৫৬ ৩৪ ১০৪৯০ ৯৬০৯ ৩১.২ ৯৬৪০.২ ৩৪৬ ৬৫৬ ১০০২ ১০৬৪
১৯৬৪-৬৫ ৬২.৭৯ ১০৩৩৭ ৩৪ ১০৩৭১ ৯৫০০ ৩১.২ ৯৫৩১.২ ৯৫ ২৫০ ৩৪৫ ৯৮৭৩
১৯৬৫-৬৬ ৬৪.৬১ ১০৩৩৫ ৩৫ ১০৩৭০ ৯৪৯৮ ৩২.২ ৯৫৩০.২ ৩৮০ ৫৪৩ ৯২৩ ১০৪০
১৯৬৬-৬৭ ৬৬.৪৮ ৯৪২৪ ৫৮ ৯৪৭৪ ৮৬৬১ ৫৩.৩ ৮৭১৪.৩ ৪৩২ ৬৬৮ ১১০০ ৯৮১৪
১৯৬৭-৬৮ ৬৮.৪১ ১০৯৯৪ ৫৮ ১১০৫২ ১০১০৩ ৫৩.৩ ১০১৫৬.৩ ৩০৭ ৭১২ ১০১৯ ১১৭৫
১৯৬৮-৬৯ ৭০.৩৯ ১১৮১৫ ৯২ ১১২৫৭ ১০২৬১ ৮৪.৫ ১০৩৪৫.৫ ২৩৬ ৮৩৩ ১০৬৯ ১১৪১
১৯৬৯-৭০ ৭২.৪৩ ১১৮১৫ ১০৩ ১১৯১৮ ১০৮৫৯ ৯৪.৭ ১০৯৫৩.৭ ৫০২ ১০৪৫ ১৫৪৭ ১২৪৪
১৯৭০-৭১ ৭৪.৫২ ১০৯৬৮ ১১০ ১১০৭৮ ১০০৮০ ১০১.১ ১০১৮১.১ ৩৪২ ৮০৪ ১১৪৬ ১২৩২

               স্ট্যাটেকটিস ডাইজেস্ট অব বাংলাদেশ / নম্বর – ৮:১৯৭২

 এখানে একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমাদের বার্ষিক খাদ্যশস্যের চাহিদা হচ্ছে প্রায় একশো বিশ লক্ষ টন। ১৯৭৭-৭৮ সনে খাদ্যশস্যের চাহিদা ১৩৯ লক্ষ টন পর্যন্ত বেড়ে যাবে। এখন উন্নত চাষাবাদ, অধিক উৎপাদনক্ষম বীজ, রাসায়নিক সার এবং উন্নত ফসল রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে এ দেশের একর প্রতি খাদ্য শস্যের উৎপাদন ২৫ মণ পর্যন্ত বাড়ানো যায় তাহলে মোট ২২ মিলিয়ন একর আবাদি জমির মাত্র ১৫ মিলিয়ন একর খাদ্যশস্যের চাষ করা হলেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা যেতে পারে।

এখানে উপমহাদেশের শীর্ষ স্থানীয় কৃষি বিজ্ঞানী এবং প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ ছয়েফ উদ্দিন চৌধুরীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা আমাদের কোন সমস্যা নয়৷ আসল সমস্যা হচ্ছে অশিক্ষিত এবং বেকার জনগণ৷ এই বর্ধিঞ্চু জনসংখ্যাকে যদি  শিক্ষিত  করে উৎপাদন উন্মুখ করে তোলা যায়, তা হলে প্রাকৃতিক  সম্পদের অভাবজনিত সমস্যাকে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো৷ উদাহরণ স্বরূপ, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং  জাপানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সকল দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে আমাদের মতই গরীব ছিল। কিন্তু, তারা তাদের দক্ষ শ্রমিক দিয়ে সেই অভাব পূরণ করেছে। আমাদের দেশও কৃষি শ্রমিকদেরকে শিক্ষিত করে তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ফেকাল্টির ডীন আবদুল লতিফ মিয়ার মতে, বাংলাদেশকে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা সম্ভব।  এ বিষয়ে তিনি প্রশাসন যন্ত্রকে শক্তিশালী করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।  শুধু কৃষি প্রশাসন নয়, দেশের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থায় আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমেই সকল সমস্যাই মোকাবিলা করা সম্ভব। দেশের মোট উৎপাদন কে যদি পুরোপুরি ভাবে জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হতো, তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা এতো তীব্র হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷  

বিভিন্ন ফসলের একর প্রতি উত্পাদন এবং জমির পরিমাণ

(১৯৬৫-৬৬ হতে ১৯৬৯-৭০ সনের গড়)

ফসল জমির পরিমাণ

(লক্ষ একর হিসেবে)

মোট উত্পাদন

(লক্ষ টন হিসেবে)

একর প্রতি উত্পাদন

(লক্ষ টন হিসেবে)

ধান ২৩৯.০০ ১০৭.২০ ০.৪৪৭
গম ২.১৫ ০.৬৯ ০.৩২০
গোলআলু ১.৮০ ৬.৫৫ ৩.৬৪০
ইক্ষু ৪.২১ ৭৫.২৫ ১৮.০০০
তৈলবীজ ৮.১৫ ২.৬১ ০.৩২০
ডাল জাতীয় ফসল ৮.৬৮ ২.৬১ ০.৩০০
পাট ২৩.০০ ১১.৯০ ০.৫১৭
তামাক ১.২২ ০.৩৩ ০.২৯৬
চা ০.৯৯ ০.২৯ ০.২৯৩
অন্যান্য ফসল ১৮.৮৮
সব ফসলের মোট জমির পরিমাণ ৩০৭.৯৮
পতিত জমিসহ ফসল সম্পন্ন মোট জমির পরিমাণ ২২৪.২৮

সুতরাং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রথম শর্ত অপব্যয় এবং খাদ্য পাচার থেকে দেশকে মুক্ত রাখা। তাছাড়া দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে পরিকল্পিত ভাবে প্রয়োজন মতো নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বিতীয় শর্ত। তৃতীয় শর্ত কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি,  খোলা বাজারে কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের মূল্যমান স্থিতিশীল করা হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চতুর্থ শর্ত। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের আর একটি শর্ত হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ তৎপরতাকে জোরদার করা৷

ডঃ লতিফের মতে, এদেশের কৃষকের আয় অত্যন্ত সীমিত।  কৃষিজাত উৎপন্ন দ্রব্য কৃষকের মজুরীসহ বড় জোর উৎপাদন খরচটুকু প্রদান করে। স্বাভাবিকভাবেই দিনের পর দিন তাদের আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল হয়ে পড়ে। এক সময় তার কবরের জায়গাটুকু ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।  এবং পরে তার বংশধরদের জন্যও সেই দুঃখের বোঝাই রেখে যায়। বংশ পরম্পরায় এই দুঃখ আসতে থাকে ঘুর্নায়মান চাকার মতো। কারণ কৃষি কর্মের সঠিক মূল্যায়ন থেকে কৃষক বঞ্চিত।  ফলে কৃষি কর্মে কৃষকদের উৎসাহও কম। এমন সমস্যার সমাধান করতে হলে এদেশের কৃষকদের ঐক্য এবং সংহতিকে মজবুত করা প্রয়োজন। তা হলেই কৃষক তার ন্যায্য পাওনা আদায় করতে সক্ষম হবে।  কৃষি কর্মে উৎসাহ বাড়বে। উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।

আজকের বৃষিজগতের মূল সমস্যা হচ্ছে কৃষি উন্নয়নের জন্য এবং সমস্যা সমাধানের জন্য কোন ভালো কৃষি বিজ্ঞানী নেই। কারণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিই এখন কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্য।  আর বিভিন্ন কৃষি বিজ্ঞানী যেমন তত্ববিদ,  কৃষি প্রকৌশলী এবং কীটতত্ত্ববিদগণ তাদের গবেষণা প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবেন বলে আশা করেন। কিন্তু কৃষি অর্থনীতিবিদগণ কৃষি উন্নয়নের সমস্যাকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে থাকেন এবং যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা সম্পর্কে তারা যে মতপোষণ করেন তা প্রথমতঃ উৎপাদন বৃদ্ধি।  এর দুটো প্রধান দিক রয়েছে। (ক) কলা কৌশল গত দিক (খ) অর্থনৈতিক দিক।

প্রথমটিতে বিভিন্ন কৃষি বিজ্ঞানীর অবদান অনস্বীকার্য।  কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ বিভিন্ন উৎপাদনের উপকরণ কি কি পরিমাণে ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায় – এই প্রশ্নের সমাধান করবেন অর্থনীতিবিদ। 

দ্বিতীয়তঃ কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, উৎপাদন বৃদ্ধিই কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্য নয়। উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কিভাবে কৃষকের আয় কিভাবে সর্বাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করা যাবে তাও কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্য।  এ দিক থেকে দেখতে গেলে, বিভিন্ন কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদন পরিমাণ বাড়ালেই চলবে না, কারণ চাহিদার তুলনায় কৃষিজ দ্রব্য অত্যাধিক পরিমাণে হলে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেবে৷ ফলে মূল্য হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে।

তাছাড়া বিভিন্ন উৎপাদন দ্রব্যের মধ্যে কি কি পরিমাণে বিভিন্ন উৎপাদন থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করা যাবে এ সমস্যারও সমাধান করতে হবে। উপরন্তু অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্যাদি যেমন মূল্য  ও বিপনন সমস্যা,  সুষ্ঠু বিতরণের সমস্যা, কৃষি খাতে মূলধন বিনিয়োগ ও কৃষি বন্টন সংক্রান্ত সমস্যা,  ভূমিহীন ও ভূমি সংরক্ষণ,  উৎপাদন অর্থনীতি ও খামার পরিচালন পদ্ধতি, সংগঠন ও কৃষি নীতি প্রণয়ন ও নির্ধারণ ইত্যাদি সমস্যাও কৃষি উন্নয়নের সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত।

সুতরাং এ সকল সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে হবে কৃষি অর্থনীতিবিদদের।

কৃষি ঋণ বন্টন ও কৃষি মূলধন বিনিয়োগের ব্যাপারেও কৃষি অর্থনীতিবিদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন, কোন সেচ পরিকল্পনা হয়তো একজন কৃষি বিজ্ঞানীর কাছে, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু সেই সেচ পরিকল্পনা হয়তো একজন কৃষি অর্থনীতিবিদের কাছে লাভজনক নাও হতে পারে।  সেখানে কৃষি মূলধন বিনিয়োগের কোন স্বার্থকতা নেই বলতে হবে।

সুতরাং একজন কৃষি বিজ্ঞানী কৃষি উন্নয়ন সম্পর্কে যে রূপ ধারণা পোষণ করেন, একজন কৃষি অর্থনীতিবিদের মতামত তার খাদ্য সমস্যা এবং তার সমাধান সম্পর্কেও তারা ভিন্ন মত প্রদর্শন করতে পারেন। প্রসঙ্গ ক্রমে এখানে মতামত ও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি অনুষদের অধ্যাপক জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্য হলোঃ দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব কি না,  তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ বর্তমানে এদেশে মাত্র ১০ ভাগ জমিতে উন্নত ধরণের চাষাবাদ হচ্ছে।  শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে মান্ধাতা আমলের চাষাবাদের ফলে একর প্রতি ফলনে কোন পরিবর্তন আসে নি। এরই মাঝে দুর্ভাগ্য বশতঃ ঘোড়াশাল সার কারখানা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশের রাসায়নিক সারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অবশ্য সরকার বিদেশ থেকে সার আমদানী করে এই সংকট ঘাটতি মোকাবিলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। বিদেশী সার প্রয়োজন অনুপাতে পাওয়া যাবে কি না, আর পাওয়া গেলেও চাষীদের সময় মতো এই সার সরবরাহ হবে কি না এগুলো হলো মৌলিক প্রশ্ন।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যান্ত্রিক উপায়ে যে পানি সেচের ব্যবস্থা রয়েছে তার ব্যবহারিক দিক অত্যন্ত দূর্বল। ফলাফলও আশাপ্রদ নয়। একটি ২ কিউস্কে ক্ষমতাসম্পন্ন পাওয়ার পাম্প – এর কমান্ড এরিয়া হচ্ছে কমপক্ষে ৬০ একর। কিন্তু খবর নিয়ে দেখা গেছে, কোন পাম্পই ৩০ কিংবা ৪০ একরের বেশি পরিমাণ জমি সেচের আওতায় আনতে পারেনি। অর্থাৎ পাম্পগুলোর ন্যুনতম ক্ষমতাকেও কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ এর জন্যে বিদেশী মুদ্রার অপচয় হয়েছে প্রচুর। তদপুরি পাওয়ার পাম্প থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরণের যন্ত্রপাতিই বেশীর ভাগ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে যন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। বিকল হয়ে পড়লে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।  খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে এসব নষ্ট হওয়া যন্ত্র পুনরায় ব্যবহারও করা যাচ্ছে না। হিসেব করলে দেখা যাবে, যেসব যন্ত্রপাতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার একটা বিরাট অংশ আগামী ৫ বছর পর সম্পূর্ণ ভাবে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়বে। কারণ যারা এসবের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন। এ অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা তো দূরের কথা,  আমাদের ঘাটতি দিয়েই কুলানো যাবে না। 

অবস্থার উন্নতির জন্য পাওয়ার পাম্পের কমান্ড এরিয়া বাড়াতে হবে। তার জন্য এলাকা ভিত্তিক গবেষণা করা প্রয়োজন এবং সেই অনুপাতে নীতি নির্ধারণ দরকার।

বর্তমানে দেশে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষের প্রতি কৃষকদের একটা ঝোঁক আছে। কিন্তু সারের অভাবে অনেক কৃষক পরিবার উচ্চ ফলনশীল ধান চাষের প্রতি উৎসাহ হারাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি সরক্র দেশের চাহিদা পূরণ না করেন তা হলে কৃষকগণ উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে সম্পূর্ণ ভাবে অনীহা প্রকাশ করবে। এবং তাদের এই উৎসাহকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ভবিষ্যতে অনেক বেগ পেতে হবে৷

বর্তমানে দেশের কৃষি গবেষণা মুষ্টিমেয় কিছু ফসলকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু কৃষি ক্ষেত্রে সুষম উন্নতির জন্য সব ধরনের ফসলেরই গবেষণা ও মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো উচিত।  পাট চাষের কথাই ধরা যাক।  অধিক ফলনশীল পাট বীজ ব্যবহারের জন্য ময়মনসিংহের কতকগুলো এলাকায় বিগত দু বছরে একর প্রতি ফলন দেশী পাটের বেলায় ৫ মণ এবং তোষা পাটের বেলায় ১০ মণ বৃদ্ধি পেয়েছে।  এখন এই উৎপাদনের উপর নির্ভর করে যদি  ঐ এলাকার কৃষকদের শুধু পাট চাষে উৎসাহিত করা হয় এবং প্রয়োজনীয় সার বা সিড দেয়া হয়, তাহলে পাটের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য চাই গবেষণা।  চাই নির্দিষ্ট কর্মসূচি অনুযায়ী অবিরাম কর্ম প্রচেষ্টা।

বাংলাদেশে বর্তমানে শুধু বোরো এবং রোপা আমনের বেলায় উচ্চ উৎপাদনক্ষম ধান চাষের প্রচেষ্টা চলছে। বুনো আমন বা আউশ চাষের বেলায় এমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। বিশেষ করে এখানে আউশ সম্পর্কে আলোকপাত করা দরকার। কারণ এই ফসল মোট ধান চাষের  শতকরা ২৫ ভাগ এলাকা দখল করে রয়েছে।  কিন্তু পুরনো পদ্ধতির চাষাবাদের দরুণ এর ফলন আশাপ্রদ নয়।  গবেষণার মাধ্যমে যদি উৎপাদন ক্ষমতাকে বাড়ানো যায়  এবং চাষের সময় সাপ্লিমেন্টারী সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে এর চাষ পদ্ধতিকে রূপা আমনের মত রূপা আউশে পরিণত করা যায় তা হলে প্রচুরফলন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷

বর্তমানে যে সব এলাকায় উন্নত পদ্ধতির চাষাবাদ হচ্ছে ঐ সব এলাকার কৃষকগণ অপটিমাম উৎপাদন পাচ্ছে না। কখনো মোট উৎপাদন থেকে উৎপাদন খরচ হচ্ছে বেশি।  আবার কখনো চাষাবাদ ও কালচারাল অপারেশনের বেলায় হলদ থেকে যায়। সেচ এবং সারের সরবারহ অপ্রতুল।  যদিও কিছু সরবরাহ হয় তো তাও সময় মতো হয় না। উৎপাদন খরচ বহন করার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন তাও অপ্রতুল অথবা সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য হীন। তাছাড়া আমাদের চাষাবাদকে এখনো যেভাবে প্রকৃতি নিয়ণ্ত্র করছে,  তাতে বৃষ্টিপাতের অভাবে ফসল বুনন বা রূপনের সময় প্রায় ক্ষেত্রেই বিলম্বিত।  কিন্তু ফসলের উৎপাদন, বুনন বা রোপণের সময় ও মানের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।  ফলে উৎপাদন হয় বিঘ্নিত।  অবশ্য বিলম্বিত চাষাবাদের আরো একটা কারণ আছে। সে হলো সল্প পরিমাণের পশু শক্তি৷ আমাদের দেশে কৃষি মানব শক্তির অভাব হয় তো নেই। কিন্তু পশু শক্তির  দারুণ অভাব রয়েছে। দীর্ঘদিনের অবহেলা, নিয়ন্ত্রণ হীন গরু জবাই, পুরনো প্রজনন পদ্ধতি এবং সর্বোপরি সাম্প্রতিক বন্যায় যেভাবে পশু শক্তি ধ্বংসের মুখে এগিয়ে গেছে তাতে সময় মত চাষাবাদের কথা কল্পনাই করা যায় না। এমতবস্থায় চাষের বিলম্ব হওয়াই স্বাভাবিক।  ফলে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের মতে, শস্যের ফলন কম হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য।  যে সকল অঞ্চলে উন্নত চাষাবাদ চালু হয়েছে, সেসব অঞ্চলেও ক্ষুদে কৃষকদের চাষাবাদর্থ অরক্ষিত।  আধুনিক টেকনোলজির ফলে যদিও বড় কৃষকদের চেয়ে ছোট কৃষকগণ অধিক হারে লাভবান হওয়ার কথা,  তথাপি আধুনিক টেকনোলজির সুবিধা লুটছে শুধু জোতদার ও বড় কৃষকগণ। কারণ আধুনিক চাষাবাদের জন্য মোট খরচের শতকরা ২৫ ভাগ টেকনোলজি খরচ ছোট কৃষকগণ জোগানে পারে না। সুতরাং আধুনিক চাষাবাদের সুফলও তারা ভোগ করতে পারে না।  তাদের উৎপাদনও হয় ভাগ্য নিয়ণ্ত্রিত। অপরদিকে প্রচুর আর্থিক আনুকুল্যে বড় কৃষকগণ আধুনিক চাষাবাদের যান্ত্রিক সুবিধাটুকু পুরোপুরি উপভোগ করে। ফলে উৎপাদন তাদের বেড়ে যায়।  এই বৈষম্যকে আধুনিক চাষী সমবায়ের মাধ্যমেও ঠেকানো যায়নি তার কারণ হলো অর্থনৈতিক গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস।  কারণ সমাজে যে শ্রেণী যখন অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্ব পায় তারা সকল পর্যায়েই প্রভুত্ব করে। কৃষক সমবায়ের মাঝেও যে সব কৃষক বেশী শক্তিশালী, তাদের মতামতই বেশী গ্রহনযোগ্য হয়। তারাই সমবায়ের নেতৃত্ব করে। উৎপাদনের মোটা ভাগ তাদের জন্যই বরাদ্দকৃত হয়৷ সুতরাং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং সেই সঙ্গে ছোট কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার কর্তৃক সাবসিডি দেয়া প্রয়োজন। আইন করে দেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করা প্রয়োজন।  নতুবা উৎপাদন বাড়লেও সুষম বণ্টন সম্ভব নয়৷

কৃষিক্ষেত্রে আর একটি সমস্যা হচ্ছে কৃষক পরিবারের উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যার আধিক্য।  দেশের বড় কৃষকদের তুলনায় ছোট কৃষকদের উপর পারিবারিক সদস্য সংখ্যার চাপ অনেক বেশি।  .০৫ থেকে অনুর্ধ এক একর পর্যন্ত খামার সীমার চাষী পরিবারে সদস্য গড় হচ্ছে ছয় জন। এরপর থেকে যতোই খামার সীমা বেড়ে যায় পরিবার প্রতি সদস্য চাপ ততোই কমে আসে। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে, ছোট খামার সম্পন্ন কৃষক পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই হয় বৃদ্ধ, নয় রুগ্ন কিংবা শিশু। অর্থাৎ তারা কর্মক্ষমতাহীন। তারা চাষাবাদের অযোগ্য। পারিবারিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান নেই বললেই চলে। অথচ ভোগের বেলায় তারা পরিবারের একটা বড় ভাগ গ্রহন করে থাকে। ফলে ক্ষুদে কৃষক পরিবার দিনের পর দিন কেবল ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায়। এই দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে কৃষক পরিবারকে মুক্তি দিতে হলে চাষাবাদের অনুপযুক্ত জনশক্তির সাপ্লিমেন্টারী কাজের স্কিম চালু করতে হবে। এবং এই স্কিমগুলো হবে কুটির শিল্প ভিত্তিক।  উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গম উন্নয়ন কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।  বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ডঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্বার্শবর্তী প্রায় ১২ টি গ্রামে উইভিং বি – কিপিং এবং অন্যান্য হস্তচালিত কুটির শিল্পের প্রসারের ব্যবস্থা চলছে। গ্রামে কৃষকদের মাঝে এ ধরণের উদ্যোগ অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।  দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যদি এ ধরণের তৎপরতা চলতে থাকে, তা হলে ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারের স্বার্থ কে রক্ষা করা সহজতর হবে। 

উপমহাদেশের শীর্ষ খ্যাতনামা কৃষি বিজ্ঞানী এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ফেকালটির ডীন মরহুম অধ্যাপক ডঃ আবদুল করিমের সঙ্গে কৃষি বিপ্লব প্রসঙ্গে একবার কথা হয়েছিল আমার। তার মতে সমাজে যখন ব্যাথা বেদনা ও দুঃখ কষ্ট সহ্যসীমা পেরিয়ে যায়, তখন গণ মানুষের মধ্যে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের আগুন। উপ্ত হয় বিপ্লবের বীজ। সুদক্ষ এবং আস্থাবান নেতৃত্বের পরিচালনায় সংগঠিত হয় বিপ্লব। এভাবে বিপ্লব সংগঠিত হয় মানুষের মনে এবং সাধিত হয় কাজে কর্মে। ব্যক্তিগত মানসিক জ্বালা চিন্তাশীল  নেতৃত্ব, বাস্তবিক কর্মসূচি এবং নিষ্ঠাবান, সুশিক্ষিত ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী বাহিনী।  এ চারটি উপাদানের সমন্বয়ে সফল হয় বিপ্লব। এদিক থেকে বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লব ঘটার পশ্চাৎ ভূমি তৈরী হয়েই আছে। এখন বিপ্লবের বীজ রোপণ করা প্রয়োজন। কিন্তু এখানে একটি সাবধানতা অবলম্বন করার প্রয়োজন আছে৷ বিপ্লব নিয়মতান্ত্রিক, এট্ অনেকেই মানতে চায় না৷ টেকটিকস এবং স্ট্যাটিস্টিক্স বিপ্লবের ধারা নিয়ে গবেষণা করে এগোতে হবে বিপ্লবের পথে৷ প্রয়োজনের তাগিদে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে হয় অনেক সময়।  এর কোন রুটিন নেই৷ দেশের এই প্রকট খাদ্য সংকটের দিনে এ দেশে কৃষি বিপ্লবকে রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে যেতে হবে। এর জন্য চাই গতিশীল নেতৃত্ব।  দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব গ্রহন করতে পারে যৌথ ভাবে৷

                 বাংলাদেশের প্রতি একর প্রতি ধানের উত্পাদন

বছর মোট আবাদী জমি

(লক্ষ একর হিসেবে)

উত্পাদন (লক্ষ টন হিসেবে) একর প্রতি উত্পাদন (প্রতি মণ হিসেবে)
আউশ আ্মন বোরো মোট আউশ আমন বোরো মোট আউশ আমন বোরো গড়
১৯৬০-৬১ ৬৩.০ ১৪৫.৮ ১০.১ ২১৮.৯ ২৫.০ ৬৫.৭ ৪.৫ ৯৫.২ ১০.৮৩ ১২.৩২ ১২.১৫ ১১.৭৭
১৯৬১-৬২ ৫৮.৭ ১৪০.৮ ১০.১ ২০৯.৬ ২৩.৩ ৬৬.৫ ৪.৮ ৯৪.৬ ১০.৮৩ ১২.৯০ ১৩.১৪ ১২.২৯
১৯৬২-৬৩ ৫১.৯ ১৪২.২ ১০.২ ২১৪.৮ ২২.০ ৬০.৫ ৪.৮ ৮৭.৩ ৯.৭২ ৪১.৬১ ১২.২৮ ১১.২০
১৯৬৩-৬৪ ৬৫.৯ ১৪৬.০ ১০.৭ ২২২.৬ ২৬.৬ ৭২.৯ ৫.১ ১০৪.৬ ১১.০২ ১৩.৬৪ ১৩.০৪ ১২.৫৭
১৯৬৪-৬৫ ৬৬.৪ ১৫১.১ ১০.৫ ২২৮.০ ২৫.০ ৭২.৬ ৫.৭ ১০৩.৪ ১০.২৮ ১৩.১৩ ১৪.৪৯ ১২.৬৩
১৯৬৫-৬৬ ৭৩.২ ১৪৬.৭ ১১.৫ ২৩১.৩ ২৯.২ ৬৮.০ ৬.২ ১০৩.৩ ১১.০৭. ১২.৬৬ ১৪.৮৫ ১২.৮৬
১৯৬৬-৬৭ ৬৯.৬ ১৪০.৬ ১৩.৯ ২২৪.১ ২৬.৭ ৫৬.২ ৮.৩ ৯৪.২ ১০.৫০ ১১.৫০ ১৬.৩৫ ১২.৭৮
১৯৬৭-৬৮ ৮২.২ ১৪৬.৮ ১৫.৩ ২৪৪.৩ ৩০.৭ ৬৮.১ ১১.১ ১০৯.৯ ১০.২০ ১২.৬৭ ১৯.৮৩ ১৪.২৩
১৯৬৮-৬৯ ৭৬.৬ ১৪৪.০ ২০.১ ২৮০.৭ ২৬.৮ ৬৮.৭ ১৬.১ ১১১.৬ ৯.৫৭ ১৩.০৩ ২০.৭০ ১৪.৪৩
১৯৬৯-৭০ ৮৪.৬ ১৪৮.৪ ২১.৮ ২৫৪.৮ ২৯.৬ ৬০.৫ ১৯.০ ১১৮.১ ৯.৫৩ ১২.৭৫ ২৩.৭৩ ১৫.৩৪
১৯৭০-৭১ ৭৮.৮ ১৪১.৮ ২৪.৩ ২৪৪.৯ ২৮.৬ ৫৯.১ ২১.৯ ১০৯.৬ ৯.৮৮ ১১.৩৫ ২৮.৬০ ১৬.৬১
১৯৭১-৭২ ৭৪.২ ১৩৩.৭ ২১.৮ ২২৯.৭ ২৩.৪ ৫৬.৯ ১৭.৪ ৯৭.৭ ৮.৫৯ ১১.৫৯ ২১.৬৫ ১৩.৯৪

কিভাবে কৃষি বিপ্লবের সাফল্য আসতে পারে? এ প্রশ্নের জবাবে মরহুম প্রফেসর ডঃ করিম বলেছিলেনঃ কৃষি বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে বাস্তব কর্মসূচীর উপর, যেখানে নেতৃত্বের সাথে কর্মীবাহিনীর থাকবে আত্বিক যোগাযোগ। সময় মত চাষীকে সরবরাহ করতে হবে বীজ, সার, পানি সেচের যন্ত্রপাতি, ডিজেল, রোগ নাশক ওষুধ ছিটাবার যন্ত্র এবং সুদ মুক্ত কৃষি ঋণ। এ দায়িত্ব নিতে হবে সরকারের কৃষি বিভাগকে।

এখানে ‘পুটআপ’,  কাম প্রপার চ্যানেল কিংবা আর্নিং আওয়ার্স ইত্যাদি নিয়মতান্ত্রিকতার অবকাশ নেই। কারণ কৃষক তা বোঝে না। দূর দূরান্ত থেকে রোদ বৃষ্টি মাথায় করে হেঁটে এসে অসহায় চাষী ওসব কথা আর শুনতে চায় না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনেক অফিস থেকে সে তোলে, ছোট বাবু থেকে বাবুর দ্বারে ধর্না দিতে গিয়ে অনেক সময় ঝিমিয়ে ওঠে ওদের মন। সুতরাং কৃষকের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু রাখতে হবে একই স্থানে। সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ওদের হাতে জিনিসপত্র তুলে দেয়ার জন্য লোক হাজির থাকতে হবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত।  বাঁধা ধরা নিয়ম এখানে চলবে না। মহকুমা বা জেলা পর্যায়ে কোন অফিসার থাকার প্রয়োজন নেই।  কিন্তু থানা পর্যায়ে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ মাটি ও চারাগাছের চাহিদা বড় সাহেবের হুকুমের অপেক্ষা করে না।

কৃষি অফিস ও অফিসারদের কি ধরণের দায়িত্ব পালন করা উচিৎ বলে আপনারা মনে করেন?

মরহুম প্রফেসর করিমের জবাবঃ থানা অফিস সমূহ কেবল মাত্র জিনিস সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবেই কাজ করে না। এখানে আধুনিক চাষাবাদ করার নিয়মকানুনও পরিবেশন করতে হবে। এ পরিবেশন শুধু মৌখিক ভাবে নয়, সরেজমিনে আদর্শ – প্রদর্শনী খামার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কে উৎসাহিত করতে হবে। কারণ নিজ চোখে না দেখে গ্রামের কৃষকগণ নতুন পদ্ধতির চাষাবাদে বিশ্বাস স্থাপন করতে চায় না। বীজ বাছাই, বীজতলা প্রস্তুত, ভূমি কর্ষণ, বীজ বপন, চারা রোপণ, সার সরবরাহ, রোগ প্রতিষেধক বা রোগ নাশক ওষুধ ব্যবহার, চারা গাছের পরিচর্যা  ইত্যাদি বিষয়ে চাষীর কর্তব্য বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থানা পর্যায়ে থাকতে হবে। চাষীর চাহিদা মিটাবার জন্যে সর্বোতভাবে সদা প্রস্তুত থাকবে থানা কৃষি দফতর৷ এ দফতরের দায়িত্ব থাকবে একজন সুশিক্ষিত কৃষি গ্রাজুয়েটের উপর, গোটা থানার কৃষি উন্নয়নে নবযুগের সূচনা করতে হবে তাকে। ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে থাকবে কৃষি সহকারী।  কৃষি বিদ্যালয় হতে শিক্ষাপ্রাপ্ত হতে হবে ওদের। প্রতি ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়েও প্রদর্শনী খামার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।  এখান থেকে শিক্ষা গ্রহন করবে স্থানীয় চাষীরা৷ এসব প্রদর্শনী খামার বিত্তবান কৃষকের নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।  কিন্তু ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রদর্শনী খামার প্রতি বছর একই জমিতে বা গ্রামে হবে না। স্থান পরিবর্তন করতে হবে প্রতি বছর৷ কৃষি কর্মীদের উৎসাহ ও প্রেরণা দেয়ার জন্য উপাধী, পুরষ্কার, পদক ও বেতন বৃদ্ধির সুব্যবস্থা বন্দোবস্ত থাকতে হবে। আন্তঃওয়ার্ড, আন্তঃইউনিয়ন, আন্তঃথানা উৎপাদন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করতে হবে কৃষি কর্মে। পর্যায়ক্রমে তিন বছর যদি কোন এলাকার শতকরা দশ ভাগ উৎপাদন যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে সে এলাকার ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মীকে পদক দানে পুরষ্কৃত করা হবে।  আর যদি শতকরা ২৫ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় তাহলে বেতন বৃদ্ধি করতে হবে সংশ্লিষ্ট কৃষিকর্মীর। এ বেতন বৃদ্ধি হবে ফসলওয়ারী। একই বছর দুই বারও বেত বৃদ্ধি হতে পারে। যদি বা ধান ও পাট দুটি ফসলেই অনুরূপ বাড়তি উৎপাদন পাওয়া যায়।  তাছাড়া উৎপাদনে অগ্রসর কর্মীদেরকে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকায় স্থানান্তরিত করতে হবে। সে এলাকায় যদি আবার সংশ্লিষ্ট কর্মী বাড়তি ফলন ফলাতে পারে তাহলে তাকে আবার পুরষ্কৃত করতে হবে।  বেতন বাড়াতে হবে। অপরদিকে অনগ্রসর এলাকা থেকে অগ্রসর  স্থানান্তরিত কর্মীদের দায়িত্ব থাকবে ঐ এলাকার বাড়তি উৎপাদন অন্তত পক্ষে স্থিতিশীল রাখা, তা যদি না পারে, তাহলে নিয়মিত বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত হয়ে যাবে।  আর যদি পূর্বে অগ্রসরকৃত এলাকার উৎপাদন আরো বাড়াতে পারে, তাহলে অবশ্যই পুরষ্কৃত করা হবে। 

থানা গুলোর কার্যক্রম সমন্বয় সাধনের  জন্য আঞ্চলিক প্রধান থাকবে। আঞ্চলিক প্রধানদের দফতর অবস্থিত হবে মাটি, ভূমির উচ্চতা ও জলবায়ু ভিত্তিক। মাটির শ্রেণী, ভূমির উচ্চতা ও জলবায়ুর পার্থক্য  অনুযায়ী বাংলাদেশকে মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন পাহাড়িয়া ও টিলা অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল, উচ্চ সমতল পাহাড়তলী অঞ্চল এবং নিম্ন সমতল অঞ্চল।  চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকা ও রাজশাহীতে এ চার অঞ্চলের প্রধানদের দফতর গুলো থেককে চাষাবাদের বিভিন্ন দ্রব্যাদি নিয়মিত সরবরাহ করা হবে থানা পর্যায়ে।  প্রত্যেক থানা পর্যায়ে এলাকার প্রয়োজনের চেয়ে কিছু অধিক দ্রব্যাদি মওজুদ থাকতে হবে অবশ্যই।  আঞ্চলিক প্রধান দের দায়িত্ব হবে থানা পর্যায়ে এসব দ্রব্য সামগ্রী নিয়মিত সরবরাহ করা।  ক্ষেত খামারের কাজে যদি কোন বিশেষ সমস্যা দেখা দেয় তারও সমাধান দেবেন আঞ্চলিক প্রধানগণ। কিন্তু সমস্যার সমাধানে যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে সাথে সাথেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কোন গবেষণা কেন্দ্র থেকে এর সমাধান নিতে হবে।  থানা পর্যায়ে পারদর্শী কেউ হলে বিবেচিত ব্যক্তিদের দিতে হবে আঞ্চলিক প্রধানের দায়িত্ব।  তবে আপাতত আস্থাভাজন,  অভিজ্ঞ ও গতিশীল যারা রয়েছেন, তাদের দিয়ে কাজ চালাতে হবে। এ বিষয়ে যথাশীঘ্র সম্ভব ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিৎ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!