You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিব প্রসঙ্গ (বাংলার কথার বিশেষ সংবাদদাতা)।
১৪ই আগষ্ট সারা বিশ্বের নজর আজ বাংলাদেশ ও তার নির্বাচিত প্রতিনিধি বাঙ্গলার প্রিয় নেতা শেখ মুজিব-এর উপর। মুজিব জীবিত না মৃত। —এ প্রশ্ন আজ সবার মনে। জঙ্গীশাহীর হাতে বন্দী হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র ইয়াহিয়া খানের বিবৃতি ছাড়া মুজিব সম্পর্কে আর কোন খবর প্রকাশ পায় নি। স্বভাবতঃই তাই সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে সত্যিই কি মুজিব জীবিত? মুজিবের বিচার প্রহসন কি “খুনকে আইনের মােড়কে ঢাকার প্রয়াস মাত্র? লণ্ডনের “ডেলি টেলিগ্রাফ” পত্রিকা এক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন রেখেছেন : শেখ মুজিবর রহমান কি বেঁচে আছেন? তিনি ইতি মধ্যেই মারা যাননি তাে?- ইয়াহিয়াকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। পত্রিকায় আরও মন্তব্য করা হয়েছে জেনারেল ইয়াহিয়া গােটা ব্যাপারটি নিয়ে যা করছেন তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। পাক ফৌজের হাতে মুজিবের ধরা পড়ার পর তার সত্যিই যে কি হয়েছে তা কেউ জানেনা। তাঁকে বাইরের কেউ দেখেনি তাঁর কথা শােনেনি। তাঁর সম্পর্কে যা কিছু খবর ইয়াহিয়াই বলেছেন। তার সত্যাসত্য নির্ধারণের কোন উপায় নাই। এমনও হতে পারে, ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রাণ নাশ করা হয়েছে। পরিশেষে পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে : এ আশঙ্কা ঠিক না বেঠিক ইয়াহিয়াই বলতে পারেন আর সভ্য সমাজের কাছে তাকে এর জবাবদিহি করতে হবে। ইয়াহিয়া ফরমান জারী করলেন “শেখের বিচার হবে ১২ই আগষ্ট থেকে, রুদ্ধদ্বার কক্ষে।” আবার  রটনা হােল বেগম মুজিবকে তার ঢাকাস্থ বাসভবন থেকে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে নেয়া হয়েছে। কোন কোন সংবাদ পত্রে বলা হােল শেখের বিচার চলছে আবার অনেক খবরের কাগজে বিচার স্থগিত বলে খবর ছাপা হােল ।
পরস্পর বিরােধী এইরূপ নানান খবরে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। আসল খবর বের করা সত্যিই মুস্কিল। ২৫শে মার্চ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত শেখের ব্যাপারে বহু খবরই বেরিয়েছে। শেখ নিরাপদ আশ্রয়ে, শেখ বন্দী, শেখ ঢাকা জেলে, শেখ কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে, শেখ পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে, শেখ অসুস্থ, শেখ হাসপাতালে, শেখ-এর অনশন, শেখের বিচার ইত্যকার নানান খবরই প্রচার হয়েছে যাতে শেখ সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি বরং শেখের ব্যাপারে রহস্য আরও ঘনিভূত হয়েছে। এই ঘােলাটে আবহাওয়া সৃষ্টির জন্য দায়ী ইয়াহিয়া সরকার। ইয়াহিয়া ইচেছ। করলেই এই সব অহেতুক সন্দেহ থেকে সাধারণকে মুক্তি দিতে পারতেন। আর্থার বটমলী (বৃটিশ পার্লামেন্টারী দলের নেতা)-কে বাংলাদেশ পরিদর্শনের অনুমিত দেওয়া হয়েছিল কিন্তু মুজিবরের সংগে সাক্ষাৎ-প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়নি। নিক্সন সাগরেদ কিসিংগার ডাঃ কামালের মত লােকের সাথে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলােচনা করলেন কিন্তু মুজিবের সংগে আলাপ করার প্রয়ােজন বােধ করলেন বা ইয়াহিয়া সরকার তার ব্যবস্থা করলেন না।
সিনেটর কেনেডিকে প্রথমে বাংলাদেশ পরিদর্শনের অনুমিত দেওয়া হলেও পরবর্তী কালে তা বাতিল করে দেওয়া হয়  উপরােক্ত ঘটনাবলী থেকে শেখের দুঃখজনক মৃত্যু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা যুক্তি যুক্ত বটে। সাধারণ মানুষেও এটাকে প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। কিন্তু ওয়াশিংটনে পাক রাষ্ট্রদূত আগা হিলারী বললেন “শেখের বিচার হচ্ছে। তবে তাকে গুলি করে মারা হবে না। বিচারের রায় ঘােষিত হওয়ার পর তাকে মার্জনা করার ক্ষমতা জেনারেল ইয়াহিয়ার রয়েছে। তারপরে পাক রেডিওর এক ঘােষণায় বলা হয় “বিখ্যাত কোণ্ডলি এ, কে, ব্রোহী মুজিবরের সংগে আলােচনার জন্য ও মুজিবরের পক্ষ সমর্থনের জন্য কোন এক অজ্ঞাত স্থানে যাত্রা করেছেন। শেষােক্ত ঘটনা দুটি মুজিবের জীবিত থাকার স্বপক্ষে ইয়াহিয়ার সরকারী ঘােষণা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। উপরােক্ত যুক্তি বলে আমরাও গভীর ভাবে বিশ্বাস করছি এবং আশা করছি শেখ মুজিব জীবিত । সংকট কালে তিনিই আমাদের উদ্ধার করবেন।
সােনার বাংলা (বাংলার কথা) ॥ ১: ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
শাসকচক্র সুবিচারের সামান্যতম মুখােশটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে : বিবাদী পক্ষে কৌশলী রাখা আর প্রয়ােজনীয় নয়।
সাক্ষ্য গ্রহণ বা বাতিলের ক্ষমতা জল্লাদের হাতে ন্যাস্ত তবে কি ওরা বঙ্গবন্ধুকে ফাসী দেবেই?
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিচারের প্রচলিত বিধানের সামান্যতম মুখােস টুকুও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখানে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গিয়েছে যে, ৮৮ নং সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী এই বিচার প্রহসনের সংশােধিত পদ্ধতি অনুযায়ী আদালতে বিবাদী পক্ষের উকিলের উপস্থিতির কোন প্রয়ােজন হবে না। এই সংশােধনী বলে সাক্ষ্য প্রমাণ সংক্রান্ত বিধিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এতে প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথভাবে নথীভুক্ত না করে, শুধু প্রদত্ত সাক্ষ্যের স্মারকলিপি বা সংক্ষিপ্তসার (মেমােরাণ্ডাম) নথীভুক্ত করা হবে। তাছাড়া কোন সাক্ষ্যকে তাদের অভিমত অনুযায়ী বিরক্তিকর, কিম্বা বিচারে বিলম্ব ঘটতে পারে অথবা “বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে বলে মনে হলে সামরিক আদালত তা বাতিল করতে পারবে। এই সংশােধনী থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে অপরাধী বলে ঘােষণা করে তাকে প্রাণদণ্ডদানের পথে সামান্যতম অন্তরায় রাখতে চায়না। ইতিমধ্যেই গােপনে সামরিক আদালতে জনগণের ভােটে নির্বাচিত জাতীয় নেতার বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশন-বৈধতার প্রশ্ন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযােগ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সামরিক জান্তা তাতে কর্ণপাত না করে এক তরফা ভাবে দণ্ডদানের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। 
সামরিক আইনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে গােপনে বিচারের ব্যবস্থা করার পরও আদালতে বিবাদী পক্ষের কৌশুলীর উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা রহিত করার কয়েকটি অর্থ হতে পারে। সামরিক জান্তা কর্তৃক সামরিক আদালতে তার বিচারের এখতিয়ারই বঙ্গবন্ধু অস্বীকার করেছেন এবং সেই জন্যে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে রাজী হন নি। তা সত্বেও বিচারের মুখােসটা বজায় রাখার জন্যে তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশিষ্ট আইনজীবী এ, কে, ব্রোহীকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনের জন্যে নিযুক্ত করেছিল। তারপর অকস্মাৎ সেই মুখােস ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিচার পদ্ধতির সংশােধন করার প্রয়ােজন হলাে কেন? হয় সামরিক জান্তার বিচার প্রহসন এতই হাস্যকর যে, যে কোন আইনজীবীর কাছেই তা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ঠেকতে বাধ্য, কাজেই ব্রোহীর মত আইনজীবীর পক্ষে এই বিচারের সঙ্গে যুক্ত থাকা হয়তাে অসুবিধাজনক মনে হচ্ছে। অথবা নিজেদের সুবিধা ও ইচ্ছা অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রমাণ ও নথীপত্র। জাল করা সত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বিবাদী পক্ষের কৌশুলীর উপস্থিতির ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছে না। প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ না করে সাক্ষ্যে কি বলতে চাওয়া হয়েছে (যা অবশ্যই সামরিক আদালতের বিবেচনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে) সে সােরাম্ভাসে শুধু সেটুকু লিপিবদ্ধ করার অর্থ। হচ্ছে প্রদত্ত সাক্ষ্যকে তারা নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। যে সাক্ষ্য সেদিক থেকেও সামরিক কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তাদের মামলার অনুকূল বলে মনে হবে না, তাকে “বিরক্তিকর,’ ‘বিচার দীর্ঘায়িত করবে’ কিম্বা বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে বলে সেই সাক্ষ্য বাতিল করার ব্যবস্থা। করায় বিচার পদ্ধতিটিকে একটি পূর্ব নির্দিষ্ট রায়ের অনুকারী করা হয়েছে।
এর ফলে প্রকৃত পক্ষে পূর্বাহ্নেই বিচারের রায় দিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়, কারণ এ ক্ষেত্রে অভিযােগকারী নিজেই। বিচারক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে সােচ্চার বিশ্ব জনমতের প্রতি এই সংশােধনী একটা চ্যালেঞ্জ। তারা সকল চক্ষু-লজ্জার বালাই বিসর্জন দিয়েই খােলাখুলি রায় ঘােষণা করে জানিয়ে দিতে চায় যে, তারা বিশ্ব জনমতের তােয়াক্কা করে না। বঙ্গবন্ধুকে তারা দণ্ডদান করবেই,বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের খােলাখুলি ভাবে একথা জানিয়ে দিয়ে তাদের ওপর একটা চাপ সৃষ্টির অভিপ্রায়ও সামরিক জান্তার থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অধিকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা, ত্রাস ও নির্যাতনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেও তারা মুক্তি সংগ্রামীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর বে আইনী বিচার প্রহসন ও প্রাণনাশের হুমকীও মুক্তিকামী বাঙালীদের নিবৃত্ত করতে পারবে না। কারণ। বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার নির্দেশ ও নির্ধারিত পথই অনুসরণ করে চলেছে। কোন সময় নির্দেশ দেবার জন্যে তিনি না থাকলেও তার আরদ্ধ কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ওপর ন্যস্ত করে গেছেন। দেশের মানুষ সেই পথ থেকে কোন ক্রমেই বিচ্যুত হবে না। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা ও তার ঘাতক-বিচারকদেরকেই  এদেশের মানুষ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করবে।
জয়বাংলা (১) ১:১৭ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!