মুজিবের বিচার – প্রহসন – কোটি প্রাণের সূর্যকে আড়ালে রাখার চক্রান্ত
১১ আগস্ট ৭১ ঘানার পত্রিকায় আসে বেগম মুজিব করাচী গিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। ১৬ আগস্ট “বাংলাদেশ” পত্রিকায় খবরটি আসে। এদিকে প্রহসনের বিচারে পত্রিকাগুলো ক্ষুব্ধ ভাষায় লিখতে থাকে। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো সবাই চুপ। অথচ আজ মুজিব একটি নয় – মুজিব এখন সাড়ে সাত কোটি। বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হবে?
On 11th August 1971, a newspaper from Ghana published that Mrs Mujib reached Karachi to meet Shekh Mujib though the exact location could not be well known. On the other hand, the trial of Mujib was going on to stop the liberation movement. The outside world kept mum. Yet, Mujib is not but the name of a spirit of 75 million people now.
বঙ্গবন্ধুর বিচার-প্রহসন শুরু
১১ই আগষ্ট, আজ পাক সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গােপন বিচার আরম্ভ হয়েছে বলে আক্রা (ঘানা) বেতারে সংবাদ প্রচার করা হয়। বেগম মুজিব করাচীতে? এখানে প্রচারিত সংবাদে প্রকাশ কয়েকদিন আগে শেখ মুজিবরের স্ত্রীকে বিমানযােগে করাচীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বেগম মুজিব জঙ্গীশাহীর দ্বারা ঢাকায় গৃহবন্দী ছিলেন। তাকে সামরিক পাহারায় মুজিবের ধানমণ্ডীর আবাস থেকে বিমান বন্দরে নিয়ে গিয়ে করাচী রওনা করে দেওয়া হয়। বেগম মুজিবকে করাচীতে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের কোথায় আটক রাখা হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
বাংলাদেশ (১# ১: ১১ ১৬ আগস্ট ১৯৭১
কোটি প্রাণের সূর্যকে অন্ধকারে আড়াল করা যাবে না
ইয়াহিয়া তার সামরিক আদালতের গােপন প্রকোষ্ঠে বিচার শুরু করেছেন। ধৃষ্টতার সীমাহীন ঔদ্ধত্যে, ঔপনিবেশিক শক্তির পুতুল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার অপরাধে বিচার করবেন বঙ্গবন্ধুর। ইয়াহিয়া খান একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন; ইয়াহিয়া খান একটি সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে পরিচিত। পাকিস্তানের এই জারজ সন্তানটি আজ সমস্ত বিশ্বাসের ভিত্তিমূল ধরে টান দিয়েছে। অথচ সমগ্র পৃথিবী যেন জড় পদার্থে পরিণত। ইয়াহিয়া কে? কি তার পরিচয়? একদল লুঠেরা যদি গায়ের জোরে ডাকাতি করে তবে মার্কিনী ও চীনা আইনে কি সমস্ত সম্পত্তি ডাকাতের হয়ে যায়? তথাকথিত পাকিস্তানের আয়ুৰ কৃত সংবিধান অনুযায়ী সামরিক নেতার কোন সাংবিধানিক অস্তিত্ব নেই। সেই সামরিক শক্তিসম্পন্ন ডাকাত আজ অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম নবজাত রাষ্ট্রের কর্ণধারের বিচার করছে গােপনভাবে। আশ্চৰ্য্য এই জগত। আরও আশ্চর্য তার রাজনৈতিক নেতারা। মার্কিন জাতীর উদ্দেশ্যে আমাদের। জিজ্ঞাস্য আপনাদের প্রেসিডেন্ট নিক্সন সাহেবের বিচার করবার অধিকার তাহলে বাংলাদেশ সরকারের হাতে উঠে গেল। তাহলে পৃথিবীতে আবার আমরা শক্তির দ্বারা সবকিছুকে আইনসিদ্ধ করবার নীতি নির্ধারণ করলাম। তাহলে রাষ্ট্রসঙ্ নামক বাড়ীটাতে অতঃপর মাদক দ্রব্য বিক্রয় কেন্দ্রের সাইনবাের্ড টাঙ্গানাে হােক।
পাকিস্তানে কি মানসিক জ্ঞ্যান সম্পন্ন একটি মানুষও আর জীবিত নেই? ১৯৪৭ সালে জিন্না সাহেব কি কতগুলি অমানুষ নিয়ে একটি রাষ্ট্র স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন? ঐ দেশের যৌবন কি বেশ্যালয়ের দালালী করে জীবন কাটায়? একটি জাতীর নামে, একটি রাষ্ট্রের নামে, ধর্মের নামে একজন মূর্খ সেনা যে অন্যায় করছে সে অন্যায়ের প্রতিবাদ কোথায়? পাক জনতা কি ভাবতে পারে মুজিবের মৃত্যুর সাথে বাংলাদেশ শীতল হয়ে যাবে? বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হবে? পশ্চিম পাকিস্তানী বন্ধুদের ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কোন আবরনীতে সমস্ত চেতনাকে আহত করে আপনারা ছুটছেন? মুজিব আর ব্যক্তি নয় একটি আদর্শে পরিণত হয়েছেন। মুজিব একটি নয় সাড়ে সাত কোটি। কোনদিন কোন দাম্ভিক কি সাড়ে সাত কোটির বিচার করতে পেরেছে? আক্রমণকারী বিচার করছে আক্রান্তের। পশ্চিম পাকিস্তানী বন্ধুগণ! আপনারা না ধর্মের শক্তিতে বিশ্বাসী। আপনাদের ধৰ্ম্মনা জগতের শান্তি, ন্যায়, নীতির জন্য কোরবানীকে পবিত্র বলে? তাহলে আজ আপনারা কোথায়? পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিব ঘৃণায় প্রত্যাখান করছেন জঙ্গী বিচারের প্রহসনকে। কেন না দ্বারােয়ান আজ জরিমানা করছে প্রভুর। পেশাদার ভৃত্য আজ আন্তর্জাতিক শয়তান চক্রের শক্তির। দম্ভে সমস্ত মানবিক বােধকে পদদলিত করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ইয়াহিয়া খান সাহেব আপনি মুর্থ এবং অশিক্ষিত। ইতিহাস আপনার পড়া নেই। কিন্তু ইতিহাস চলে। সে কথা বলে না কিন্তু আপন গতিবেগে চলমান।
আপন গতিতে সে মৌনমুখর। ইতিহাসের চাকটাকে পেছনে ঘুরিয়ে দেবার মত কোন শক্তিমান আজও জন্মায় নি। মুর্থ ক্যানিউট বাণের টানে ভেসে গেছে, চেঙ্গিস, নাদিরশাহ আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত । ফুরার হিটলার ভুগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে আত্মগােপন করেও নিস্তার পায়নি মানুষের অসীম ঘৃণা থেকে। আর আপনি! সাড়ে সাত গণ্ডার জমিদার! কি আছে? ঐ মার্কিনী নাগরবৃন্দ অথবা চীনা প্রেমিক আপনাকে আগলাবে? তবে তাই হােকবাংলার সাত কোটি মানুষ শত কোটি হয়ে আঘাত হানবে আপনাদের শিরে, অপেক্ষা করুন। মুজিবের বিচার হচ্ছে। শয়তান আজ ঈশ্বরের টুটি টিপে ধরেছে। রাষ্ট্রসক্স স্থবির, জড়। মহাসচিব উথান্ট এখন প্রাণহীন শবের অপভ্রংশ। যে প্রাণী যে ভাষায় কথা বুঝে সে ভাষাতেই কথা বলা উচিত। ইয়াহিয়া মুজিবকে মারবে। সমস্ত পৃথিবীর জন-নেতারা হয়ত সেদিন শােক পালন করবেন কিন্তু আজ। এই মুহুর্তে। পৃথিবীর সামনে। চ্যালেঞ্জ রেখেছে রক্তপাগল পাক সামরিক গােষ্ঠি । আজ ইয়াহিয়া মুজিবকে হত্যা করতে পারেন তবে পৃথিবীর কোন প্রান্তে যেন আর কোন রাষ্ট্রনেতা বাগাড়ম্বর না করেন। যে সমস্ত চেতনাকে আমরা গলা টিপে হত্যা করি, সমস্ত তন্ত্রকে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে ক্রমশঃ সেই বন্য সভ্যতায় ফিরে যাই যেখানে বাঘের ইচ্ছার উপরই মানুষের বেঁচে থাকা না থাকা নির্ভর করবে। মুজিবকে হত্যা করা যাবে না। বাংলার প্রতিটি বৃক্ষপত্রকে কি ইয়াহিয়া ছিড়তে পারবেন, মাতৃগর্ভের প্রতিটি ভ্রুণকে কি তিনি বিনষ্ট করতে পারবেন? শত নদীকে তিনি গণ্ডষে শুষে নিতেপারবেন? উত্তাল তরঙ্গময় সাগর কি পান করতে পারবেন? পারবেন না। মুজিব লক্ষ কণ্ঠে লক্ষ প্রাণে, মুজিব পৃথিবীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদ। বারে বারে দুঃশাসন তাকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায় । কিন্তু বারে বারেই সে নব প্রাণে আসে। (একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় হতে)
বাংলাদেশ (1) { ১:১১ ॥ ১৬ আগস্ট ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩