১৯৭১ – বাংলাদেশের ইতিহাসে অধিকার করে আছে এক গৌরবমন্ডিত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কেননা বাঙালি জাতির ধারাবাহিক স্বাধীকার আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল আমাদের জাতিসত্ত্বা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও আত্ম-অনুসন্ধানের লড়াই। আমাদের অহংকার ও আত্মপরিচয় তুলে ধরার ভিত্তিও হচ্ছে একাত্তরের এই যুদ্ধ । সংগ্রাম, প্রতিরােধ, উত্থান আর যুদ্ধ জয়ের কাহিনী সম্বলিত এক ইতিহাস সমৃদ্ধ গৌরব গাঁথায় ভরপুর যুদ্ধোত্তর এই বাংলাদেশ। অবশ্য এ উথান আর যুদ্ধ জয়ের প্রেক্ষাপটে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞের মত দুর্বিষহ ভয়াবহ ঘটনা। যার তাৎক্ষনিক মূল্য এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দিতে হয়েছে। আমাদের হৃদয়ে, মননে সেই রেশ আজও অব্যাহত। যুদ্ধ কেবল মাত্র দুশাে। ছেষট্টি দিনের নয়টি মাসে সীমাবদ্ধ হলেও সেই ঘটনা এবং তৎপরবর্তী ঘটনা প্রবাহে এই মুক্তিযুদ্ধ। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে আমাদের কারাে কারাে অভিজ্ঞতায়, ব্যক্তিগত জীবনাচারে বিশেষত: জাতীয় ইতিহাসেও। এদেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে (অবশ্য কিছু মানুষ হানাদার পাকিস্তানিদের পক্ষেও ছিল) গণমানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমর্থনেই সম্ভব হয়েছিল দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করা। এ যুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান অর্জনও বটে। এ অর্জন নির্মাণে, বহুবিধ উপাদানের ভেতর গণমাধ্যমও পালন করেছিল এক গুরত্বপূর্ণ অসাধারণ ভূমিকা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমেরও ছিল সাড়া জাগানাে। ঘটনা। ন’মাসের স্বল্পকালীন এ যুদ্ধ বাংলার মানুষের সংগ্রাম, অসীম ত্যাগ আর বীরত্বের পাশাপাশি পাক সামরিক বাহিনীর বর্বরতার নৃশংসতার বাস্তবতা আজ ইতিহাস এবং গণমাধ্যম তা ধরে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যুদ্ধ সংগঠিত করতে, মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে, জনগণের দৃঢ় মনােবল ও প্রত্যাশা তৈরিতে এবং জনমত গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে মুক্তাঞ্চল, মুজিবনগর ও বিদেশে বাঙালিদের উদ্যোগে প্রকাশিত বিভিন্ন নিয়মিত ও অনিয়মিত সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকাসমূহ। একাত্তরের সেই ভয়ংকর দুর্যোগময় সময়ে পাক সামরিক সরকারের শত অত্যাচার, নির্যাতন, অস্ত্রবাজিকে উপেক্ষা করে বাংলার মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে একাধিক পত্রিকা প্রকাশ করেছে। | মুক্তিযুদ্ধ যে কোন জাতির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমন ঘটনা বার বার সংঘটিত হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সারা বিশ্বে সৃষ্টি করেছিল ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশ ও বাঙালিদের প্রতি বিভিন্ন দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, সমবেদনা ও স্বতঃস্ফুর্ত সাহায্য সহযােগিতা ছিল অফুরান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের কথা প্রচারে, সহায়ক শক্তি এবং বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে পত্রিকাগুলি এক বিশাল উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল বিধায় এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম । সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র এবং ইতিহাসের একজন অনুরাগী পাঠক হিসেবে একাত্তরে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার ভূমিকা ও অবদান এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যগুলিকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে তুলে ধরাই এ কাজের মূল উদ্দেশ্য। কেননা একাত্তরের বাস্তবতার প্রামাণিক দলিল মুক্তিযুদ্ধের পত্রপত্রিকা। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলিতে বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা হয়েছে সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, সংবাদ শিরােনাম, কবিতা, গল্প, গান, কার্টুন ইত্যাদি। সেই উত্তপ্ত সংকটময় দিনগুলিতে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলাে নিঃসন্দেহে আজ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, দলিল। প্রতিটি সংবাদ পৃষ্ঠা যেন ইতিহাসের এক একটি অধ্যায়। দলিল ও তথ্যাদি একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময় ও ঘটনার কথা বলবে।
ইতিহাস নির্মাণের প্রশ্নে এ দলিল এক বড় ভূমিকা পালন করবে এবং তা হবে ইতিহাস রচনার মূল্যবান তথ্যমালা। এখানে দলিল ও তথ্য প্রকাশকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। দলিল পত্রের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে ইতিহাস। কেননা যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ইতিহাস অধ্যয়ন, অনুশীলন, অন্বেষণ ও গবেষণায় আমাদের সব সময়ই প্রয়ােজন এ ধরনের দলিল তথা বিভিন্ন তথ্য, ডকুমেন্টেশন। কেননা আজকের ডকুমেন্টশনই আগামী দিনের ইতিহাস। একাত্তরের গবেষণা ও ইতিহাস রচনায় আমাদের সব সময়ই এ ধরনের প্রাথমিক উৎসের কাছে ফিরে যেতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস লিখতে আমাদের পত্রিকার মত দলিল সংগ্রহ করা আবশ্যক। আর সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত পত্রপত্রিকার গুরুত্ব অপরিসীম। আগামী প্রজন্ম এই ভিত্তি ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলবে বস্তুনিষ্ঠ সমৃদ্ধ গৌরবময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের উপকরণ সংক্রান্ত বস্তুনিষ্ঠ গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উপর বিভিন্ন আঙ্গিকে এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রন্থাবলী, প্রবন্ধ রচিত হলেও সেই যুদ্ধময় দিনগুলিতে প্রকাশিত সংবাদপত্র বা পত্রপত্রিকাদি নিয়ে কোন উল্লেখযােগ্য কোন গ্রন্থ অদ্যাবধি রচিত হয় নি। দু’একটি সংকলন যে প্রকাশিত হয় নি তা নয়।
তবে, সামগ্রিকভাবে সব বিচার করে সংকলনের উদ্যোগ নেয়া হয় নি। জানা মতে এ নিয়ে বিস্তৃত কোন গবেষণা কর্মও সম্পাদিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর যে সমস্ত গ্রন্থ রচিত হয়েছে সেগুলাে মূলত: বর্ণনামূলক। যার মূলে রয়েছে স্মৃতিচারণ, ধারাবর্ণনা, কেস স্টাডি, যুদ্ধ অবস্থা, সাংগঠনিক দিকের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ। অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রে কিছু সংবাদ সংকলিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি গবেষণাধর্মী কোন কাজ ছিল না। তাছাড়া সেখানে তথ্যগত অনেক বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গেছে। অবশ্য একথাও ঠিক এধরনের প্রাথমিক কাজের ভুল ভ্রান্তি থাকতেই পারে। এ সমস্ত কাজ সব সময়েই প্রশংসার দাবী রাখে । দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে একাত্তরের অনেক প্রামাণ্য দলিলপত্র। দেরীতে হলেও মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও উপকরণ সংরক্ষণ এবং ইতিহাস লেখার সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ অতি সাম্প্রতিক। গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শীর্ষক শিরােনামে ধারাবাহিক গ্রন্থমালা সিরিজ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ চর্চা কেন্দ্র। ইতােমধ্যে এর দুটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খন্ড: কার্টুন এবং ২য় খন্ড: ভারতীয় ইংরেজি সাপ্তাহিকী ফ্রন্টিয়ার নিয়ে। এই গ্রন্থমালা সিরিজের ধারাবাহিক কাজের ফসল ‘একাত্তরের পত্রপত্রিকা। এর কয়েকটি খন্ড প্রকাশিত হবে। মুক্তিযুদ্ধের কম আলােচিত দিকগুলির একটি হচ্ছে একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরের, মুজিবনগর সরকার ও বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার আলােচনা, গবেষণা। এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত কোন গবেষণা কর্ম সম্পাদিত হয়নি বিধায় প্রধানত: তথ্য সংযােজন ও গবেষণা কাজের অভাব পূরণের প্রচেষ্টা থেকেই এ উদ্যোগ গ্রহণ। বর্তমান তৃতীয় খন্ডের কাজটি পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত শুধুমাত্র বাংলা পত্রপত্রিকা নিয়ে। প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সূত্র থেকে গৃহীত তথ্য নিয়ে এই সংকলন গ্রন্থটি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কাজ শুরু করার পর একাত্তরে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। নয়মাসের ভেতর শুধুমাত্র একটি বিশ্বাস ও আর্দশকে সামনে রেখে যে এতগুলি পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে এ তথ্য ছিল অজানা। পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে এত সংক্ষিপ্ত সময়ের ভেতর এতগুলি পত্রিকা বার হয়েছে এরকম নজির আছে বলে মনে হয় না। সমাজবিজ্ঞানের একজন গবেষক হিসেবে এর প্রতি আকর্ষণ বােধ করি। অর্থ, লােকবল, সময়ের অভাব ও নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে এ গবেষণা সংকলন গ্রন্থের কাজটির সূত্রপাত হয়। ২০০২ সালে ব্যক্তিগত, পারিবারিক,সামাজিক ও পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিগত তিন বছর ধরে পত্রিকা সগ্রহের কাজটি হয়েছে। যে কারণে সময় লেগেছে প্রচুর। যেভাবে কাজের মাত্রা ও অগ্রগতি হওয়ার পরিকল্পনা ছিল সেভাবে শেষ করা যায়নি। এটা সূচনা মাত্র, কোন ক্রমেই পূর্ণাঙ্গ কিংবা সম্পূর্ণ কাজ নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিংবা আগ্রহী গবেষক ও ইতিহাসবিদরা এর পূর্ণাঙ্গ করণে এ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ও প্রবাসে বাঙালি জনগণের আশার আলাে ও বেঁচে থাকার প্রেরণা ও প্রত্যাশা ছিল মুজিবনগর ও মুক্তাঞ্চল থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত পত্রপত্রিকার খবরাখবর। কি ধরনের সংবাদ ছিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশ এবং মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকায়? এ বিষয়টিকে বােঝার জন্য ঐ সমস্ত পত্রপত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত প্রকাশিত বিশেষত: এর বিভিন্ন নিউজ আইটেম তথা সংবাদ প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ/ফিচার, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকে বিষয় ভিত্তিক করে মূলত: সংবাদ শিরােনাম বিশিষ্ট সংবাদগুলিই কোন রকম সম্পাদনা ছাড়া হুবহু পুনঃমুদ্রণ করে এ সংকলন গ্রন্থ। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে যুদ্ধকালীন সময়সীমায় প্রকাশিত শুধুমাত্র বাংলা পত্রপত্রিকার আলােকে এ গ্রন্থের কাজ সম্পন্ন করা হয়। স্বাধীনতা। যুদ্ধ দলিলপত্রের ষষ্ঠ খণ্ডে ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে ৩৫টি পত্রিকার উল্লেখ আছে। একাত্তরের যুদ্ধকালীন বাস্তবতার এই প্রামাণ্য দলিলের সন্ধানপ্রাপ্ত, সংগৃহীত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রে উল্লিখিত নামসহ এ পর্যন্ত ৬৪টি বাংলা পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম পর্ব প্রকাশনায় শুধুমাত্র ৪৫টি পত্রিকা থেকে আংশিক বা সম্পূর্ণ সংবাদ সংকলন করা সম্ভব হয়েছে। প্রকাশিত পত্রিকাগুলির সংখ্যা ও সংবাদগুলির বিশালত্বের কারণে বর্তমান খন্ডের সংকলনটিকে বেশ কটি পর্বে বিভক্ত করতে হয়েছে। পত্রিকার নিউজ আইটেম তথা প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ/ফিচার, সাহিত্যকে কয়েকটি মােটাদাগে ভাগ করা হয়েছে বটে।
কিন্তু আলােচনা বা বােঝার সুবিধার্থে এই ভাগগুলিকে আবার বিষয় ভিত্তিক করে কয়েকটি উপভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। যেমন নিউজ আইটেম তথা সংবাদ প্রতিবেদনগুলিকে – বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার, রণাঙ্গন (যুদ্ধ), মুক্তিবাহিনী/ মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তাঞ্চল, রাজাকার, শরণার্থী, গণহত্যা, অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, স্বীকৃতি, আনুগত্য ইত্যাদি বিষয়ে ভাগ করা হয়। বর্তমান তৃতীয় খন্ডের প্রথম ভাগের পর্বটি সংবাদ প্রতিবেদনের শুধুমাত্র তিনটি বিষয় – বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে নিয়ে সাজানাে হয়েছে। মূলত: কলেবর বৃদ্ধির কারণে অন্য বিষয়গুলিকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে পর্যায়ক্রমে তা প্রকাশ করা হবে বলে প্রত্যাশা রাখছি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে বিষয়গুলিকে আলাদাভাবে ভাগ করা হলেও এর ভেতরকার সংবাদ ঘটনাগুলি একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং সব সংবাদকে কখনও চূড়ান্তভাবে একটি নিদিষ্ট ভুক্তি বা গন্ডির সীমারেখায় আবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়নি। একই সংবাদ একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সংবাদের গুরুত্ব বা মূল বিষয় অনুযায়ী যেটা যে বিষয়ের পর্বে থাকা উচিত * সেখানে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের শুরুতে ঐ বিষয়ের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিমূলক ভূমিকা দেয়া হয়েছে। সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর ঐ বিষয়ের ওপর সংকলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তারিখ ভিত্তিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে। সংবাদগুলির সমকালীন বাস্তবতার গুরুত্ব বােঝার লক্ষ্যে প্রায় প্রতিটি সংবাদ পরিবেশনের পর নিচে প্রথমে পত্রিকার নাম, বর্ষ, সংখ্যাসমূহের উল্লেখসহ প্রকাশনার দিন, মাস ও বছর উল্লেখ করা হয়েছে। সংবাদ শিরােনাম বােল্ড টাইপে দেয়া হয়েছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে ভাষা, বাক্য ও বানান নির্মাণেও এখানে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা হয়নি। মূল পাঠ অষ্পষ্ট বা অসম্পূর্ণ থাকলে শব্দের পর … চিহ্ন দেয়া হয়।
সে সময়ে সংঘটিত উল্লেখযােগ্য ঘটনা সমূহ এবং ঘটনার কুশিলবরা ইতিহাসের আলােয় এত বেশি উদ্ভাসিত, আলােচিত এবং পরিচিত যে তাদের জন্য আলাদা করে কোন টিকা দেয়ার প্রয়ােজনীয়তা নেই। গ্রন্থ শেষে সন্নিবেশিত গ্রন্থিপঞ্জি হতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরাে বিস্তারিত জানা যাবে। যুদ্ধকালীন সাংবাদিকতার নমুনা এই পত্রিকাগুলির কোনটির ছাপা ভালাে, কোনটি খারাপ, কোনটি আবার অশুদ্ধ বানানে জর্জরিত। তবুও সবার আর্দশ, উদ্দেশ্য ও হৃদয় ছিল একটি। আর তা হলাে বাংলাদেশের মুক্তি তথা স্বাধীনতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কোন গন্ডিতে আবদ্ধ ছিল না, তেমনি ছিলনা একাত্তরের পত্রপত্রিকা । যুদ্ধের নয় মাসে বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল, মুজিবনগর সরকার, নিরাপদ এলাকা, দেশের অভ্যন্তরে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পত্রপত্রিকা বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া সত্বেও আজ তার অধিকাংশের খোজ পাওয়া যায় না। কিছু কিছু পত্রিকার নাম ও রচনা বিভিন্ন লেখালেখি, উদ্ধৃতির মাধ্যমে টিকে আছে। মুজিবনগর ও বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে প্রায় অর্ধশত পত্রপত্রিকা বার হয়েছে বলে জানা যায়। যদিও এ সংক্রান্ত বস্তুনিষ্ঠ কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রবাসী বাঙালিদের মুখপাত্র জনমত গঠনে এবং আন্দোলনগুলিকে দ্রুত সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলা পত্রিকাগুলি অনন্য ভূমিকা পালন-করেছিল। অবশ্য সে সময় মুজিব নগর থেকে কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকাও ছাপা হয়েছিল। দি নেশন’, দি পিপল’, ‘বাংলাদেশ’ নামক এই ইংরেজি পত্রিকাগুলি বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তজাতিক জনমত সংগঠনে এবং মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিল।
অবরুদ্ধ গােটা বাংলাদেশে যখন মূলধারার জাতীয় পত্রিকাগুলি মুক্তিযুদ্ধের খবর দিতে পারছিল না, মুক্তিযােদ্ধাদের যখন চিহ্নিত করা হচ্ছিল ‘দুস্কৃতকারী’ বলে তখন প্রকাশিত হয়ে চলছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ ‘ এবং এ সংক্রান্ত নানা সংবাদ নিবন্ধ। আমাদের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্রগুলি যে কাজটি করতে পারেনি বা যা তাদের পক্ষে সে মুহূর্তে করা সম্ভব ছিল না। ২৫শে মার্চের পর সংবাদপত্রের দায়িত্বটি পালন করেছে সীমান্তবর্তী ক্ষুদ্র এই সীমিত ও অনিয়মিত প্রকাশিত পত্রিকাগুলি এবং এ কাজটি ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামে নিষ্ঠাবান সহযােগীর কাজ যা স্বাধীনতাকামীদের মনােবল বাড়িয়েছে এবং বিশ্ববাসীর সামনে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে তুলে ধরেছে। তাছাড়াও এই সমস্ত পত্রিকাগুলি যুদ্ধকালীন সময়ে সমন্বয়কারীর অনন্য ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় পত্রিকাগুলি নিজ জনপদের জীবনযাপন ও সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি স্থানিক এক প্রতিরােধের মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেছে। সে যুদ্ধময় দিনগুলিতে এদেশে মূলত: দু’ধরনের পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। একদিকে মুজিবনগর, মুক্তাঞ্চল ও অন্যান্য জায়গা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তি, যুদ্ধের সাফল্য, মুক্তিযােদ্ধা ও জনসাধারণের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা সৃষ্টি করে যুদ্ধকে সাফল্যের দ্বারে পৌছে দেয়া। অপরদিকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাক সামরিক সরকার কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাগুলি। একদিকে জয়গান করেছে পাকিস্তানি শাসনের এবং অন্যদিকে প্রচার করেছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযােদ্ধা, ভারত সম্পর্কে উদ্দেশমূলক বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ ও বিভ্রান্তকর অপপ্রচার।
যেমন মুক্তিযােদ্ধাদের আখ্যায়িত করেছে রাষ্ট্রবিরােধী দুস্কৃতিকারী / অনুপ্রবেশকারী/ বিচ্ছিন্নতাবাদী/ ভারতীয় চর/ ভারতীয় এজেন্ট ইত্যাদি অভিধায়। এখানে উল্লেখ্য পাক সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চের কালােরাত্রিতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দ্য পিপলস সহ বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র অফিস পুড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে প্রথিতযশা সাংবাদিক, প্রগতিশীল সাহিত্যিক শহীদ সাবেরকে পুড়িয়ে মারে। ২৬ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া খান ৭৭ নম্বর সামরিক বিধি জারি করে পত্রিকার উপর প্রি সেন্সরশীপ বলবৎ করে। সরকার নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমােদিত ছাড়পত্র ব্যতীত কোন রাজনৈতিক বিষয় সংবাদপত্রে মুদ্রণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এবং এই আদেশ অমান্যকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড নির্ধারিত হয়। দেশের স্বাভাবিক অবস্থা প্রমাণ করার জন্য সামরিক জান্তার নির্দেশে ২৯ মার্চ থেকে প্রেস ট্রাস্টের মর্নিং নিউজ, দৈনিক পূর্বদেশ, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশ প্রকাশিত হতে থাকে। সব ধরনের খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ ছাপানাের আগে অনুমােদনের জন্য সেন্সরশীপ হাউসে পাঠানাে হতাে। প্রিসেন্সরশীপ ছাড়াও পত্রিকা অফিসগুলিতে মাঝে মাঝে | টেলিফোনে কিংবা লিখিতভাবে প্রেস এডভাইস পাঠানাে হতাে। জুলাই মাসের একটি প্রেস এডভাইস ছিল যেমন – মুক্তিফৌজ’, ‘মুক্তিবাহিনী’, ‘গণবাহিনী’, ‘বাংলাদেশ’, ‘জয়বাংলা’ শব্দগুলি লেখা যাবে। ৩০ সেপ্টেম্বর আসে শেখ মুজিবর রহমান, তার বাবা-মা, পরিবার সম্পর্কে কোন সংবাদ ছাপানাে যাবে না, শিরােনামে বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না, ‘মুক্তিফৌজ’ বা ‘মুক্তিবাহিনী’ শব্দগুলি ব্যবহার করা যাবে না এগুলির বদলে বিদ্রোহী’ অথবা ‘ভারতের এজেন্ট’ ব্যবহার করতে হবে ইত্যাদি নানা ধরনের এডভাইস। তখন সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে থাকতাে শুধু এপিপির সংবাদ । * সেই সময় সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকে আত্নগােপন করেছিলেন নয় মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। অনেকে আবার কর্মরত থেকে পাক সরকারের অন্যায় প্রতিরােধ করতে না পারলেও প্রতিবাদ করে জেল, জুলুম, সয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের লড়াই একদিকে ছিল যেমন সশস্ত্র অস্ত্র প্রয়ােগ করে, অন্য দিকে প্রত্যক্ষ অথবা নিরব প্রতিরােধ করেও ছিল। তৎকালীন পিপিআই-এর চীফ রির্পোটার সৈয়দ নাজমুল হককে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে দু’বার পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য।
কিন্তু রাজী হননি বলে পরিণামে ১০ ডিসেম্বর রাতে একজন কর্নেলের নেতৃত্বে একদল লােক তার বাসা ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে তিনি আর ফিরে। আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আলবদর ও রাজাকারদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। | বাংলায় প্রকাশিত হাতে গােনা কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ছাড়া বাকী সবগুলি পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, সাময়িকী, বুলেটিন অথবা নিউজ লেটার ধর্মী। পত্রিকাগুলি সাইক্লোস্টাইল করে, হাতে লিখে কিংবা প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে আত্নপ্রকাশ করেছে। উল্লেখযােগ্য বাংলা প্রকাশনার মধ্যে ছিল- জয় বাংলা (আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র), জয়বাংলা (নওগাঁ), জাগ্রত বাংলা, সংগ্রামী বাংলা, স্বাধীন বাংলা, সােনার বাংলা, দেশ বাংলা, নতুন বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলা, দুর্জয় বাংলা, মুক্ত বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ (সিপিবি), রণাঙ্গন, দাবানল, অগ্রদূত, অভিযান, জন্মভূমি, ইত্যাদি । পত্রিকাগুলির নামের ক্ষেত্রে বেশ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তেমনি আবার নামের অভাববােধও বেশ প্রকট হয়ে ধরা দেয়। কারণ দেখা গেছে একই নামে ৭টি পত্রিকাও ছাপা হয়েছে। যেমন জয়বাংলা নামে ৪টি এবং বাংলাদেশ নামে ৭টি পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যায়। অবশ্য বাংলাদেশ নামের বানানে কিছু পার্থক্য আছে। নাম প্রসঙ্গে হারুন হাবীব তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন ‘জয় বাংলা’ নামে কলকাতা থেকে প্রবাসী সরকারের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিকীটির প্রকাশ ঘটলেও ত্রিপুরা এবং আসাম সীমান্তেও আরও দুটি পত্রিকা বের হতাে এই একই নামে। জয় বাংলা (নওগাঁ) পত্রিকার সম্পাদক তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- “… ১৯৭১ এর ৩০শে মার্চ তারিখে ক্ষুদ্রাকৃতি এক পাতার দৈনিক জয় বাংলা বের করি। বাংলার আবাল বৃদ্ধবনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত ‘জয় বাংলা’ কথাটি আমাদের জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল বলে আমার পত্রিকার নামটিও ‘জয় বাংলা’ রাখি। মুক্তিযুদ্ধের একটি মুখপত্রের জন্য এর চেয়ে কোন যােগ্য নাম আমার মনে আসেনি।” * নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ভাবাবেগ ও বােধ কাজ করেছে বলে মনে হয়েছে।
পত্রপত্রিকাগুলির প্রকাশনার স্থান হিসেবে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, নওগাঁ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, তেঁতুলিয়া, মুক্তাঞ্চল ও মুজিবনগর-এর নাম থাকলেও এর অধিকাংশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন পশ্চিমবংগ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা হতে প্রকাশিত হতাে। এ পত্রিকা প্রকাশনায় বিপুল সংখ্যক বাঙালি শরণার্থী ও স্থানীয় জনসাধারণের সকল প্রকার সাহায্য সহযােগিতা ও সহমর্মিতা ছিল। তাছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতাও ছিল সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। সাপ্তাহিকীগুলির অধিকাংশই নিদিষ্ট দিনে বা সময়ে প্রকাশ পায়নি, ছিল অনিয়মিত। মােটামুটি সবগুলি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম পাতায় পত্রিকার নামের নিচে অথবা ওপরে ছােট/বড় টাইপে ‘সাপ্তাহিক’ শব্দটি লেখা হতাে। তাছাড়া পত্রিকার নামের আশেপাশে, নিচে-উপরে বিভিন্ন ঘােষণা, বাণী (মূলত: বঙ্গবন্ধুর), কবিতা, শ্লোগান লেখা থাকতাে। পত্রিকাগুলি সাধারণত এক থেকে চার পাতার হতাে। ব্যতিক্রমও ছিল যেমন – জয়বাংলা (আওয়ামী লীগের) ৬-৮-১০ পাতাও ছাপা হয়েছে। বেশি পাতার পত্রিকায় সংবাদ ছাড়াও থাকতাে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার, চিঠিপত্র, গল্প, কবিতা, নিয়ে সাহিত্য বিষয়ক রচনা। আর অল্প পাতার | পত্রিকায় মূলত: থাকতাে যুদ্ধ, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, সাফল্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের কথা। মােটামুটি সেই স্বল্প | সময়ে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক সংগতি সম্পন্ন পত্রিকাগুলিতে নিয়মিত বিজ্ঞাপন ছাপা হতাে। বেশি পৃষ্ঠার | পত্রিকাগুলিতে মূলত: সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ পেতাে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কোন খবর, ঘটনা বা বিশেষ কোন বিষয়ের উপর পত্রিকার নিজস্ব মতামত তুলে ধরা হতাে। বেশির ভাগ প্রকাশনাই যুদ্ধশেষে বিলীন হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে জন্ম নেয়া এ সমস্ত পত্রিকাগুলি স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ পরিস্থিতি, সময়ের দাবী, স্থানীয় চাহিদা ও বিশেষ লক্ষ্য, উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশিত হয়েছিল। তাই স্বাধীনতা লাভের কিছু পূর্বে ও পরে এর অধিকাংশের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এখানে যুদ্ধকালীন সময়সীমায় ২৬ মার্চ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাপ্ত ও সংগৃহীত সর্বমােট ৪৫টি পত্রিকার সংবাদ ও অন্যান্য তথ্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে। এর মাঝে এক পাতা বা একটি সংবাদ শিরােনাম বিশিষ্ট | পত্রিকাও আছে। পত্রিকাগুলির প্রকাশনা ১-২-৬-১০ সংখ্যায় কিংবা আরাে কিছু বেশি সংখ্যা পর্যন্ত ছাপা হয়েছে।
শুধুমাত্র ৭টি পত্রিকার সব প্রকাশিত সংখ্যা সংগৃহীত হয়েছে বাকি পত্রিকাগুলির সব প্রকাশিত সংখ্যা পাওয়া যায়নি। আবার এমনও দেখা গেছে কোন কোন সংবাদ প্রতিবেদন অসমাপ্ত বা | আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত হবে বলে লেখা হলেও পরবর্তীতে তা আর ছাপা হয়নি। অনেক পত্রিকায় প্রকাশের স্থান ও তারিখ নেই। সংবাদে বহুল ব্যবহৃত একই নাম, বানান, বাক্য, শব্দ নির্মাণের প্রয়ােগ | এবং চর্চায় বেশ বৈচিত্র ও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন – বাংলাদেশ। বাংলা দেশ/ বাঙলাদেশ বাঙলা দেশ বাঙ্গলাদেশ, রনাঙ্গন রণাঙ্গণ, গেরিলা গােরিলা, রাজাকার রেজাকার, মুক্তি বাহিনী। | মুক্তিবাহিনী/ মুক্তিবাহিনী, আক্রমন/ আক্রমণ ইত্যাদি। তাছাড়া সেই সময়ে ঘৃণিত নাম ও শব্দ যেমন -ইয়াহিয়া খান’ নামের বানান লেখা হয়েছে এহিয়া খা’, টেন্ডেলগিরি, গােস্বা ইত্যাদি শব্দও ব্যবহৃত হয়। সেই সময়ের আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধিও চেতনা বজায় রাখার লক্ষেই তা অবিকৃত রাখা হয়েছে। বিভিন্ন ছবি, ছবির ক্যাপশন, বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, ম্যাপ (১-২টি বাদে), বিভিন্ন বাণী/ শ্লোগান, | কার্টুন, কৃতজ্ঞতা স্বীকার, ভ্রম সংশােধন ইত্যাদির মত বিষয়গুলি বাদ দেয়া হয়েছে। সে সময়ের পত্রিকাগুলিতে প্রতিবেদন, ফিচার, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ইত্যাদি বিষয়গুলির ব্যানারেই মূলত: সংবাদগুলি প্রকাশিত হতাে। কখনাে কখনাে কিছু ছবি, কবিতা, গল্প, সাক্ষাঙ্কার, যুদ্ধ, নেতাদের বিবৃতি, বক্তব্য ছাপা হয়েছে। আবার দুই একটি পত্রিকায় বেশ কিছু | মজাদার কার্টুনও প্রকাশ পেয়েছিল। পত্রিকার পাতায় থাকতাে মুজিবনগর সরকার গঠন, সরকারের | মাধ্যমে যুদ্ধ পরিকল্পনা-পরিচালনা, কূটনৈতিক তৎপরতা, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন -স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তাকে ঘিরে স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলি ।
তবে যুদ্ধকালীন পত্রিকা বিধায় এর সবটাই জুড়ে থাকতাে যুদ্ধের খবরাখবর। তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর। | তৎপরতা, হানাদার বাহিনীর লাঞ্ছনার কথা বেশ প্রাধান্য পেতাে। সংকলিত সংবাদগুলি দেখলেই এর যথার্থ পরিচয় পাওয়া যাবে। জনগণের প্রতিরােধ, সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, রাজাকারদের ভূমিকা, গণহত্যা, যুদ্ধে নারীদের ভূমিকা সংক্রান্ত খবরগুলি সে সময়কার পত্রিকাগুলিতে তুলনামূলকভাবে কম প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এ সম্পর্কে আরাে অনেক ভয়াবহ, মর্মস্পশী ও বিস্তৃত তথ্য জানতে পারি। স্থানীয় এই পত্রিকাগুলিতে বিদেশী সংবাদ তেমন প্রকাশ পায়নি বললেই চলে। সঙ্গত কারণেই সংবাদ সংগ্রহের তেমন কোন জোরালাে সূত্র, তথ্য যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন শক্তিশালী না থাকা, কারিগরী জ্ঞান, লােকবল সর্বোপরি অর্থবল সে সময় পত্রিকাগুলির ছিল না। ১৯৭২ ও তৎপরবর্তীতে এ সংক্রান্ত প্রচুর অজানা খবরাখবর ও তথ্য আমরা পত্রিকা, অনেক লেখালেখি ও ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় পাই । এক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষভাবে ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, জাপান, জার্মানী, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের সে সময়কার পত্রপত্রিকা ও সরকারি দলিলগুলি যেখানে বাংলাদেশ সংক্রান্ত যে সমস্ত খবরগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা সংগ্রহ করা আবশ্যক। | পিকিং পন্থী বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রবীনতম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান। ভাসানী একাত্তরের ২১শে মে সাপ্তাহিক জয়বাংলার আত্মপ্রকাশকে অভিনন্দন জানিয়ে বাণী পাঠান। ঐ বাণীতে তিনি বলেন “বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এক অসম অথচ মরণপণ সংগ্রামে নিয়ােজিত রয়েছেন। ইতিহাসের এই মহালগ্নে মরণ বিজয়ী নিরস্ত্র জনসাধারণকে পথ নির্দেশের জন্য আজ বলিষ্ঠ একটা সংবাদপত্রের প্রয়ােজনীয়তা সর্বাধিক। এই প্রয়ােজন মেটাবার জন্য ‘জয়বাংলা’ সাপ্তাহিকটির প্রকাশ একটা সঠিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আমি এই সাপ্তাহিকের সার্বিক সমৃদ্ধি কামনা করি এবং কর্মীদের মােবারকবাদ জানাই। আমার স্থির বিশ্বাস আছে। যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেই। ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের সু-নিশ্চিত। জয় বাংলা।” “তাছাড়াও জয়বাংলার প্রতি শুভেচ্ছবাণী পাঠিয়ে ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। তিনি জয়বাংলার সাপ্তাহিক আত্মপ্রকাশকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন “জাতি আজ এক মহা সংকটে নিপতিত, একটা বিরাট সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত ।
সংগ্রামের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে আমাদের পথ দেখাবে। আওয়ামী লীগের মুখপত্র হলেও ‘জয়বাংলা’ ত্রুটি-বিচ্যুতি | নির্দেশের ব্যাপারে আমাদের কাকেও ছাড়বে না এ বিশ্বাস আমার আছে “। | পত্রিকার প্রথম প্রকাশনা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছেন- টাকা থেকে কারফিউ তুলে নেয়ার পর বিদেশী দূতাবাসগুলিতে হত্যাযজ্ঞের বিবরণ সম্বলিত প্রচারপত্রের | সাইক্লোস্টাইল করা যে সমস্ত কপি প্রচন্ড ঝুকি নিয়ে পৌছে দেয়া হয়েছিল, তা ছিল শত্রু অধিকৃত | বাংলাদেশের প্রথম প্রকাশনা। ২৬ শে মার্চের পর অধিকৃত অঞ্চলে প্রকাশনা ইতিহাসের সূচনা এভাবেই শুরু হয় বলে উল্লেখ করেন। এই একই প্রবন্ধ হতে জানা যায় উত্তরবঙ্গের জেলা শহরগুলিতে যখন হানাদার বাহিনী হতে মুক্ত ছিল সে সময় রাজশাহী থেকে একটি পত্রিকা বেরুতাে। সেটাকে মার্চ | হত্যাযজ্ঞের পরে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও স্বাধীনতার পরবর্তীতে মিন্টু বসুসহ অন্যরা জানতে পারেন ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ বরিশাল থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ’ কে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক বিভিন্ন কার্যক্রম, বিশেষ ঘটনাসমূহ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের গেজেট নােটিফিকেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলিকে এ নােটিফিকেশনের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ পত্রিকাটির একটি মাত্র সংখ্যাই প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি বিমান হামলা ও শত্রুপক্ষের কবলে চলে যাওয়ায় তাদের পক্ষে আর কোন সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পত্রিকাটি কোলকাতা থেকে বিপ্লবী বাংলাদেশ নামে প্রকাশিত হয়। রাজশাহীর নওগাঁ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জয়বাংলাকেও মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অবশ্য এ পত্রিকাটির প্রকাশনা শুধুমাত্র ১১টি সংখ্যায় সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রথম প্রকাশনা সম্পর্কে রয়েছে।
একাধিক দাবী। মুজিবনগর সরকার, বিভিন্ন ব্যক্তি, দল, গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে পত্রিকাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত ও সমর্থন করতে। বেশির ভাগ পত্রিকাই ব্যক্তিগত এবং জনগণের আর্থিক সহযােগিতায় পরিচালিত হয়েছে। এসব পত্রিকায় রণাঙ্গনের খবর, যুদ্ধের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহ, মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বৰ্হিবিশ্বের সাহায্য সমর্থন, শেখ মুজিবের বিচার, মুক্তি, বিশ্ব নেতৃত্বের মনােভাব, শরণার্থী, গণহত্যা, বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম নির্দেশাবলী, রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতি , কার্টুন, গল্প, কবিতা ইত্যাদি বিষয়সমূহ প্রকাশিত হতাে। আরাে থাকতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নাজেহাল ও বিপর্যয়ের খবর। পত্রিকাগুলির পরিচালনা পর্ষদ বা সম্পাদকদের ভেতর মতাদর্শের নানামুখী ভিন্নতা থাকা সত্বেও একাত্তরের সেই যুদ্ধময় দিনগুলিতে সবকিছু ভুলে তারা এক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। এই জায়গায় ছিল না কোন চুক্তি, আপােষ বা সমঝােতার অবকাশ। ছিল শুধু বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা, স্বাধীনতার লক্ষ্যে যুদ্ধকে তরান্বিত ও সাফল্যমন্ডিত করে মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। “বলা যায় রাজনৈতিক সামাজিক ভূমিকাকে ছাপিয়ে তখন সংবাদপত্রের প্রধান ভূমিকাটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের”।১৩ প্রকাশিত প্রতিবেদন, সংবাদভাষ্য ও ফিচারগুলি বিভিন্ন দেশী-বিদেশী, খ্যাত-অখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কলামিস্টদের দ্বারা লেখা হতাে। দেশীয় সাংবাদিকদের ভেতর অনেকেই পূর্বে কোন না কোন পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বা কোন রাজনৈতিক দলভুক্ত ছিলেন কিংবা কোন মতাবলম্বী ছিলেন না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রপত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। অনেকে আবার কিছুদিন পর স্বনামে আত্মপ্রকাশও করেছেন। আবার একই নামে ভিন্ন ব্যক্তি বা যৌথ সম্পাদনায় বিভিন্ন জায়গা থেকে একাধিক পত্রিকাও তারা প্রকাশ করেছেন। সম্পাদকদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুই জন মহিলার নাম পাওয়া যায় । সে সময় স্থানীয় যারা দেশের অভ্যন্তরে থেকে পত্রিকা চালিয়েছেন তারা নিজেদের প্রয়ােজনে স্থানিক প্রতিরােধের এক তাগিদ হিসেবে পত্রিকাগুলি বের করেছেন। এদের অধিকাংশই অপরিচিত ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী, বেকার যুবক। কিছু রণাঙ্গন সাংবাদিক ছিলেন যারা এক হাতে কলম ও অন্য হাতে অস্ত্র, ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় অধিকাংশেরই ছিল না কোন সাংবাদিকতা পেশার অভিজ্ঞতা। তারা এসেছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনা ও অঙ্গীকার থেকে। তাদের রিপাের্টগুলিতে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আবেগের মিশ্রণ ছিল। সুতরাং তাদের সবার রিপাের্টগুলির সবই যে পুরােপুরি নৈর্ব্যক্তিক বা নিরপেক্ষতার দাবী রাখে তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। অনেকের মাঝেই পক্ষপাত প্রবণতা, প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেম ও প্রচন্ড ভাবাবেগও কাজ করেছে বলে মনে হয়েছে। একটি প্রশ্নে বা জায়গায় সবার লক্ষ্য, আদর্শ, উদ্দেশ্য একাকার হয়ে মিশে গেছে আর তা হলাে বাংলার মুক্তি তথা স্বাধীনতা। তবে একথা অনস্বীকার্য যে সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ ও ইতিহাসের ধারা প্রকৃতি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে তাদের তৈরি করা রিপাের্টগুলির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ গুরুত্বেও ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইই বিশ্লেষিত হবার জন্য গবেষণার অপেক্ষা রাখে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে যুদ্ধের খবরাখবর পাওয়ার জন্য একাধিক সূত্রের উপর নির্ভর করতে হতাে। এক গবেষণা রিপাের্ট হতে জানা যায় সংবাদপত্র হতে শতকরা ১১.৫০ যুদ্ধের খবরাখবর পাওয়া যেতাে। সাধারণত পত্রিকার সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে রেডিও, টিভি, ভারতীয় বার্তা সংস্থা, মুক্তিযােদ্ধা, সংবাদদাতাদের খবরের ওপর নির্ভর করা হতাে। এক প্রবন্ধ হতেও জানা যায় সংবাদ পাঠানাে হতাে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ থেকে, নয়তাে বাংলাদেশ ঘুরে গিয়ে প্রতিবেদকগণ প্রতিবেদন তৈরি করে ছাপাতেন। আর এই সব সংবাদই হতাে বেশি বিশ্বাসযােগ্য। অন্যথায় তৎকালীন অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাঠানাে তথ্য কেউ বিশ্বাস করতাে না। কারণ সংবাদ প্রেরণের সময় সেখানে কড়াকড়িভাবে সেন্সর করা হতাে। * এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ নূরুল কাদির লিখেছেন কলকাতা থেকে আমার নিকট নিয়মিত বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় এর গরম গরম খবর পাঠাতেন জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদক মােহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী। আমি সেই খবর, কখনও প্রেস ক্লাবে ফোন করে আবার কখনও বা আমার নিকট যারা ইন্টারভিউ নিতে আসতেন তাদের মাধ্যমে জানিয়ে দিতাম । দিল্লীর সাংবাদিকগণের পৌছে দিতাম। যে দিন কোন খবর আসতাে না, সেদিনও নিয়ম মােতাবেক কিছু না কিছু নতুন গরম গরম খবর বানিয়ে হলেও, সাংবাদিকদের নিকট পৌছে দিতাম “। ” যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য জয় বাংলা সম্পাদক রহমতউল্লাহ সীমিত সামর্থ নিয়ে জয়বাংলা সংবাদ সংস্থা (জবাসস) গঠন করেন। নিজস্ব কোন সংবাদ সংস্থা না থাকায় বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সব খবর পাওয়া যেত তা একটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রচার করা উদ্দেশ্যেই মূলত: এটি গঠন করা হয়েছিল। মুক্তাঞ্চলের কিছু টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে খবরাখবর সংগ্রহের চেষ্টা করা হয় । আর একাজে নওগাঁ পাঁচবিবির এক্সচেঞ্জ, বগুড়া সার্কিট হাউস, মুক্তিযােদ্ধা কন্ট্রোল রুম, রাইফেল বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডাররা সহযােগিতা করেছিলেন। জবাসস মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় কিছু খবর পাঠানাে হয়েছিল বটে কিন্তু পরবর্তীতে তা আর সম্ভব হয়নি। প্রকাশিত পত্রিকাগুলি সকল পর্যায়েই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত ছিল।”
“বলা হয়ে থাকে সংবাদপত্রের নিরপেক্ষ নীতি বলে কিছু নেই। সংবাদ-সাময়িকপত্র সবসময় জনগণের একটি অংশের মত প্রকাশ করে মাত্র” । ২৭ একাত্তরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এখানে দেখা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অবশ্য কিছু অংশ বাদ দিয়ে একটি আদর্শ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একমত হয়েছিল। সেই উত্তপ্ত দিনগুলিতে তেমন কোন নীতিমালা অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি। অবশ্য প্রথম দিকে তা ছিলও না। পত্রিকাগুলি এক ধরনের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভােগ করেছে। সুতরাং সব বিভ্রান্তি বাদ দিয়ে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলী যেভাবে ঘটেছিল তখন যেভাবে তার বিশ্লেষণ হয়েছে, এখানে হুবহু তাই ছাপা হচ্ছে। সব পত্রিকার সব বিশ্লেষণ হয়তাে পরে সত্য প্রমাণিত হয়নি কিন্তু তবু এর ঐতিহাসিক ও তাৎক্ষণিক মূল্যও কম ছিল না। তবে বেশ কিছু পত্রিকা মুজিবনগর সরকারের অনুমােদন ক্রমে অনুমতিপত্র নিয়ে পত্রিকা ছাপিয়েছে ( দেখুন পরিশিষ্ট)। লেখালেখির ব্যাপারে মােটামুটি সব পত্রিকাই স্বাধীনতা ভােগ করেছে। কোন একক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তা সত্বেও পত্রিকাগুলির মধ্যে কোন ধরনের প্রতিযােগিতা কিছু ছিল না।
| আগেই উল্লেখ করেছি এ সমস্ত পত্রিকাগুলি জনগণকে সাহস, শক্তি ও মনােবল যুগিয়েছিল । ভাষা ছিল সহজ, সরল সাধারণ যা পাঠক সহজেই বােঝে এবং এর পাঠক সংখ্যাও ছিল নির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ। মুক্তাঞ্চলের মানুষ, মুক্তিযােদ্ধা, শরণার্থী শিবিরের লােকজন এবং পশ্চিম বাংলা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি জনগােষ্ঠী ছিল মূলত: এর মূল পাঠক। পাঠক প্রসঙ্গে তপংকর চক্রবর্তী তার প্রবন্ধে লিখেছেন, “বিপ্লবী বাংলাদেশ ছিল রণাঙ্গনের মুক্তিযােদ্ধাদের মুখপত্র। কাজেই পত্রিকাটির জন্য রােববার মুক্তিযােদ্ধারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন। রােববার দুপুরের মধ্যে পত্রিকা পৌঁছে যেত সব ক্যাম্পে। পত্রিকা হাতে পেয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সেকি উল্লাস ! মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পগুলােতে পত্রিকা বিনা
মূল্যে বিতরণ করা হতাে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের মাধ্যমে বিলি করা হত। বরিশাল পটুয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে পত্রিকা রাতের আঁধারে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফেলে রেখে যেতেন মুক্তিযােদ্ধরা”। ” এ প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম তার বইয়ে লিখেছেন, “পত্রিকাগুলির আর্দশ ও উদ্দেশ্য। ছিল অভিন্ন – পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। এসব পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বেশি না থাকায় সেগুলাে জনগণের চাহিদা মেটাতে পারত না। এগুলাের একটি কপি জোগাড় করা বা এতে এক ঝলক চোখ বােলানাের জন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে যেতাে সবাই। প্রধানত অল্প বয়েসী ছেলেরাই এগুলাে বিলি করত। যুদ্ধের সময় এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, খবরের কাগজসহ ধরা পড়ার পর পাকিস্তানিরা এসব কিশােদের ঘটনাস্থলেই বিনা বিচারে হত্যা করেছে “। সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন, “এ দেশের মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ শুনবার জন্য যেমন ঘর বন্ধ করে আলাে নিভিয়ে উৎকর্ণ হয়ে থাকতাে তেমনি মুক্তিযুদ্ধের এক চিলতে খবরের জন্য হন্যে হয়ে ফিরতাে। চারদিকের হাজারাে বিপদের মুখেও হাতে লেখা দেওয়াল পত্রিকা এবাড়ি থেকে ওবাড়ি, ওবাড়ি থেকে অন্য বাড়ি পৌছাতে গিয়ে অনেক কচি প্রাণ ধরা পড়েছে। শত্রুর হাতে নির্যাতন ভােগ করেছে এবং তাদের উষ্ণ রক্তে রঞ্জিত করেছে এ দেশের মাটিকে”। পত্রিকা বিক্রি করে তেমন অর্থ পাওয়া যেত না, বেশির ভাগই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হতাে। ভাষা সৈনিক ও বিশিষ্ট আইনজীবি। গাজীউল হকের মতাে ব্যক্তিবর্গও কোলকাতার (ভারত) মতাে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করেছেন। পত্রিকাগুলি বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত হলেও বিভিন্ন মাধ্যমে অত্যন্ত গােপনীয়তার সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ও দেশের অভ্যন্তরে বিলি করে কিংবা পৌছে দেওয়া হতাে। ফলশ্রুতিতে জনগণ যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত সংবাদ ও তথ্য জানতে পারতাে। ভারত সরকার মুজিবনগর সরকার থেকে মাঝে মাঝে বেশ কিছু পত্রিকা কিনে নিয়ে প্রকাশনায় সাহায্য করেছে। একাত্তরের উত্তাপে তপ্ত প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার অধিকারী সকল অর্থেই একজন সাধারণ পাঠক অবরুদ্ধ বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে থেকে কিভাবে পত্রিকার সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেই পত্রিকা ঢাকা পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিলেন তার কেস স্টাডির বিবরণে লিখেছেন| “… গলা নিচু করে বললে, দুলাভাই, খুব সাবধান, কেউ যেনাে শােনে না। কারা যেনাে মাঝে মাঝে রাতের বেলায় বাজারে খবরের কাগজ রেখে যায়। আমি তাে পড়তে পারিনে, শুনেছি, ওটা নাকি স্বাধীন বাংলার কাগজ! মুক্তিযােদ্ধারা মাঝে মাঝে ঐ কাগজ রেখে যায়। ২ দিন আগে একবার রেখে গেছে। রাজাকাররা ঐ কাগজ দোকানে দোকানে খোঁজ করে । ওরা বলেছে, কারাে দোকানে যদি এই কাগজ পাওয়া যায় তবে তাকে ওরা গুলি করে মারবে।
কেউ কিছু জানলেও মুখ খােলে না। বললাম, তুমি কি আমাকে ঐ কাগজ দেখাতে পারাে ? আমাকে বসতে বলে সে বেরিয়ে গেলাে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলাে হাতে ভাজ করা ছােট (টেবলয়েড) সাইজের একখানা পত্রিকা। আমার হাতে পত্রিকাখানা তুলে দিয়ে আমাকে আবারাে সাবধান করে দিলাে। কেউ টের পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! কাগজখানা অন্য এক টুকরা কাগজ দিয়ে মুড়ে ঘরে ফিরে এলাম। ওকে বলে এলাম সকালে দেখা হবে ঘরে দরজা বন্ধ করে হারিকেনের আলােয় কাগজখানা মেলে ধরলাম। স্বাধীন বাংলার খবরের কাগজ ‘জয় বাংলা’। তাড়াতাড়ি কাগজখানা ভাঁজ করে একখানা ইংরেজী কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে আমার ব্যাগের ভিতর রেখে দিলাম। সমস্ত চিন্তা-ভাবনা গুলিয়ে যেতে লাগলাে। শরীর কাঁপতে লাগলাে কি এক শিহরণে! এই পত্রিকা দেশের কতটুকু ভেতরে গেছে? এই শক্তিশালী অস্ত্রখানা কি ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে? যারা এ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে তাদেরই কি সব দায়িত্ব? এখানকার লােকজনের কি কোনাে দায়িত্ব নেই এই কাগজ দেশের অভ্যন্তরে পৌছে দেয়ার? এ রকম নানা কথা আমার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলাে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম মুক্তিযুদ্ধের এই মূল্যবান অস্ত্র আমি ঢাকায় নিয়ে যাবাে।…পরের দিন সুরুজকে বলে আরাে এক কপি জয় বাংলা নিয়ে নিলাম এবং ওকে বলে রাখলাম, যখনই এ কাগজ আসে তুমি অন্তত দুটো কপি আমার জন্যে লুকিয়ে রেখে দেবে। পারবে কিনা? খুব পারবাে বলে কেমন যেনাে পুলকিত হয়ে উঠলাে তার চেহারা! রওনা দিলাম আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে, সাথে জয় বাংলা পত্রিকা। এই কাগজ বহন করতে মিলিটারীদের নিয়ে তেমন কোনাে ভয় নেই। ভয় রাজাকারদের নিয়ে। একটি ইংরেজী কাগজের ভেতরে ভাঁজ করে রেখে সুটকেসের মতাে দেখতে ব্যাগের তলায় রেখে দিলাম। ঝিনাইদহ মিলিটারী ক্যাম্প। বাস থামিয়ে চেক করে। ইচ্ছা হলে কাউকে নামিয়ে রাখে। দৈত্যাকৃতি রােবটের মতাে গতি, এক মিলিটারী সাথে কয়েকজনকে নিয়ে বাসে উঠলাে। বাসে লােক কম। লাইন দিয়ে এক এক করে ব্যাগ চেক করছে, শরীর চেক করছে।
আমার কাছে এসে ইশারায় ব্যাগ খুলতে বলে। আমি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকার। চেষ্টা করছি। আমার তখন গোঁফ আছে, মাথা চুল চিরদিনের অভ্যাস মতাে পেছনে একটু লম্বা। নিজেই কাপড়চোপড় উল্টিয়ে দেখালাম। তাতে হলাে না, নিজে ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে দেখলাে। আমি দেখলাম খবরের কাগজে ওর হাত ঠেকলাে। যে কাগজে লেখা আছে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রযাত্রার কথা, কাদেরিয়া বাহিনীর কথা, আবু সাইদ চৌধুরীর বিশ্ব জনমত সৃষ্টির প্রয়াসে জেনেভায় দেয়া বক্তৃতার কথা। এই সময় আর একটা বাস এসে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাে। আমার দিকে আর এবার তাকিয়ে ভারী পায়ে মেশিনগান ঘাড়ে বাস থেকে নেমে। গেলাে, আমাদের বাস ছেড়ে দিলাে। মাগুরায় রাজাকার। কামারখালীয় রাজাকার। ঢাকায় থাকি। কার্ড আছে চাকরী করি। এ সব কথা বলতে বলতে ভেতরে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে এক সময় গােয়ালন্দে পৌছে গেলাম। প্রতি মুহুর্তে ভয়, যে কোনাে সময় ঘটে যেতে পারে চরম পরিণতি। বিকাল হয়ে গেছে। আরিচা ঘাটে ফেরি থেকে নেমে ইপি আর টি সি’র বাস ধরে ঢাকায় যেতে হবে। ফেরি ঘাটে ভিড়ে গেলাে, তখনও বুঝিনি। একটু পরই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে শক্তজমাট বেঁধে যাওয়ার মতাে ঘটনা। আরিচা ঘাটে ইপি আর টি । সি’র বাস ডিপােতে মিলিটারীরা ক্যাম্প করেছে তা আমার জানা নেই। ফেরি থেকে নেমে খুব দ্রুত পায়ে ঐ। ডিপাের এরিয়ার মধ্যে মানে টিকিট কাউন্টারের সামনে দিয়ে যে টানা বারান্দা ছিলাে সেখানে পৌছে গেছি। হল্টের মতাে কি একটা বিকট শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি তিনদিক থেকে আমার দিকে রাইফেল তাক করা। সাথে। সাথে হাতের ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাত উঁচু করে ফেলেছি। তারপর অফিসার গােছের একজন আমার দিকে এগিয়ে এলাে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমি ইংরেজীতে কথা বলতে শুরু করে দিলাম। মরার আগে একবার চেষ্টা করে দেখা বাঁচা যায় কিনা। বললাম, আমি জানতাম যে, এই জায়গাটা আগের মতাে ইপি আর টি সি’র বাস স্ট্যান্ড আছে, তাই টিকিট কেটে ঢাকায় যাবাে বলে আমি এখানে এসেছি। আমি একজন চাকুরীজীবী। মানুষ। ইংরেজী বলার কারণ উর্দু আমি বলতে পারি না। হাই হুই শুনে কিছুটা বুঝতে পারি।
ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে এসে আমাকে ইশারা করলাে চলে যেতে, আমি হাত নামালাম। ব্যাগটার দিকে তাকালাম। ঠারাে! এরকম একটা শব্দ হলাে। আস্তে আস্তে সে আমার কাছে এগিয়ে এসে ইশারা করে ব্যাগ খুলতে বললাে। আবার ব্যাগ না খুলতেই ইশারা করে চলে যেতে বললাে। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং গুলির। শব্দ শােনার অপেক্ষা করতে করতে পা বাড়িয়ে দিলাম। এক সময় বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। নিজের কাছে। নিজেই জিজ্ঞেস করলাম, আমি বেঁচে আছি কিনা! তারপর ঢাকা পৌঁছানাে পর্যন্ত আমি যে কি করেছিলাম, কিভাবে ঢাকায় পৌঁছেছিলাম। সেই দিন। পৌছেছিলাম না তার পরদিন পৌছেছিলাম এর খুঁটিনাটি এখন আর মনে করতে পারি না। …পুলিশ মিলিটারীর কোন খবর নেই। চারদিকে রাজাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে রেডিওতে, কেউ স্বাধীন বাংলা শুনলে তার রক্ষা নেই। ওরা বাসায় বাসায় এসে সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছে …একখান পত্রিকা নিয়ে এমনভাবে ভাঁজ করলাম যে, প্রথম। পৃষ্ঠার ওপরের অংশ দেখা না যায় । এক টাকার চা দিতে বলে কাগজখানা দোকানে রেখে পকেটে টাকা খুঁজতে লাগলাম । চায়ের ছােট্ট ঠোংগাটা দোকানী রাখতেই আমি টাকা দিয়ে পত্রিকাখানা রেখে মুহূর্তের মধ্যে গা ঢাকা। দিয়ে ভিন্ন রাস্তায় বাসায় ফিরে এলাম। ঘরে কত চা নষ্ট হচ্ছে, আবার আমি কেন চা এনেছি, ছেলেটার এ কথার। কোন জবাব না দিয়ে বাকী কাগজখানা একইভাবে ভাজ করে জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শান্তি নগর থেকে বাসে ওঠার সময় কাগজখানা হাতে নিলাম। কাকরাইল ছেড়ে বসার জায়গা পেয়ে বসে পড়লাম। উদ্দেশ্য, কাগজখানা কোনাে জনবহুল জায়গা দেখে ফেলে দেওয়া। যতক্ষণ জানালার ধারে বসতে না পারছিততক্ষণ কাজটা করা যাবে না । জিপিওর সামনে যেয়ে সে সুযােগ এসে গেলাে। গুলিস্তানের দিকে বাস মােড় নিতেই জানালা দিয়ে কাগজখানা এমনভাবে ফেলে দিলাম যেন হাত ফসকে পড়ে গেলাে। ২/১ জন লক্ষ্য করায় বললাম, আরে, কাগজটা পড়ে গেলাে! যাক, ওটা এমন কিছু না। তারপর উঠে যেয়ে বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং গুলিস্তানে বাস থামার আগেই নেমে গেলাম। হৃষ্ট চিত্তে ফিরতি বাসে শান্তিনগর ফিরে এলাম। যেন যুদ্ধ জয় করে ঘরে ফিরলাম! জয় বাংলা পত্রিকা ঢাকা আনতে পেরেছি এই কথা ভেবে গর্বে আমার বুক ভরে উঠতে লাগলাে। সে আনন্দ একান্ত আমার নিজেরই রইলাে। কাউকে বলা গেলাে না”। যুদ্ধ জয়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য এভাবে অনেক সাধারণ লােকও নেপথ্যে পত্রিকার জন্য স্বত্ব:স্ফূতভাবে কাজ করে পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।
একাত্তরের পত্রপত্রিকা পর্যালােচনাকালে এর প্রকাশনার কারণ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হলাে একদিকে স্বদেশ ও প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়কে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তােলা এবং বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করে তাদের সাহায্য সহযােগিতা ও সমর্থন আদায় করা এর মুখ্য এবং আদর্শ লক্ষ্য ছিল। অন্যদিকে দেশের স্বাধীকার ও আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্র বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে পাক হানাদার বাহিনীকে সমূলে উচ্ছেদ করে স্বাধীনতা লাভের পথ প্রশস্ত করা। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি বা ব্যবসায়িক সাফল্যের ধারণাটি তখন গৌণ ছিল। সুব্রত শংকর ধর পত্রিকাগুলি পর্যালােচনা করে লিখেছেন, “আঙ্গিকে, প্রতিবেদন লিখনে, সম্পাদনায় কিংবা মুদ্রণ-সৌকর্যে এসব পত্রিকার অধিকাংশই মানােত্তীর্ণ ছিল না। যারা এই পত্রিকাগুলিতে সাংবাদিকতা করেছেন, তাঁদের অধিকাংশের ইতিপূর্বে সাংবাদিকতা পেশার সাথে সংশ্রব ছিলাে না। মুক্তিযুদ্ধের বহ্নিমান চেতনাকে সম্বল করেই তারা পত্রিকা প্রকাশনায় এগিয়ে এসেছেন। উপরন্ত, মুক্তাঞ্চল কিংবা অবরুদ্ধ অঞ্চলে ভালাে প্রেসে পত্রিকা মুদ্রণের কোনাে সুযােগও ছিলাে না। এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্বেও একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার জন্ম যন্ত্রণার মুহুর্তগুলাে এসব পত্রিকায় চিত্রিত করা হয়েছে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সাথে। পরিবেশিত সংবাদের সঠিকত্বেও বিচারেই শুধু নয়, একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খর সাথে জড়িত যে আবেগ তার প্রতিফলনেও সেই বিশ্বস্ততা বিচার্য ” ২৬ পত্রিকাগুলি নিঃসন্দেহে মুক্তিযােদ্ধা ও বাঙালিদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করতে যথেষ্ট সাহস, শক্তি ও মনােবল যুগিয়ে ছিল। অনেক সীমাবদ্ধতার পরেও সেই সময়ের পত্রপত্রিকাগুলি ছিল অজস্র প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে, বদিক আচ্ছন্ন করা হতাশার বিরুদ্ধে সাহসী সত্তার সােচ্চার ঘােষণা। তারা প্রকাশ করতে চেয়েছেন একাত্তরের দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীর এক সৎ ও বিশ্বস্ত দলিল । তাই, এসব পত্রিকা থেকে যুদ্ধের সবটুকু ঝাপটা আঁচ করা যায়। আর্থিক প্রতিবেদন লিখন, সম্পাদনা কিংবা মুদ্রণের দুর্বলতা সত্ত্বেও একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার জন্মযন্ত্রণার মুহূর্তগুলিকে এসব পত্রিকায় চিত্রিত করা হয়েছে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে। পরিবেশিত সংবাদের সঠিকত্বের বিচারেই শুধু নয় একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙক্ষার সঙ্গে জড়িত যে আবেগ, তার প্রতিফলনেও সেই বিশ্বস্ততা বিচার্য।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলি এখানে সংকলিত হয়েছে সত্য। কিন্তু সংকলিত তথ্যগুলিকে যাচাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা এগুলিকে বিশ্লেষণ করে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ভবিষ্যৎ গবেষকদের দায়িত্ব। একটি বিশেষ অবস্থা, সময় ও ঘটনাবলীকে বােঝার জন্য সংবাদপত্রের সংকলিত সংবাদগুলি নি:সন্দেহে মূল্যবান, বিশেষতঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণে। অনেকের কাছে হয়তাে সংবাদগুলি নিছক সংবাদ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। কিন্ত ইতিহাস রচনায় এগুলাে হতে পারে মূল্যবান তথ্য খনি। মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল ঘটনা ও চরিত্র থেকে মূলধারার উপাদান সংগ্রহ করা যদিও শ্রমবহুল সময় সাপেক্ষ কাজ, সেক্ষেত্রে এ ধরনের উপকরণ বস্তুনিষ্ঠ কিছু তথ্য তুলে ধরতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যা জরুরি উপাদান ও উপাত্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এত কম সময়ে কোথাও কোন মুক্তিযুদ্ধ যেমন শেষ হয়নি, তেমনি পৃথিবীর কোনও মুক্তিযুদ্ধে সম্ভবত: এত পত্রপত্রিকাও প্রকাশিত হয়নি। যুদ্ধকালীন পত্রিকাসমূহের ভূমিকা, বিষয় বস্তু ও সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানার সুযােগ আমাদের তেমন নেই বললেই চলে। উপরন্তু এ সমস্ত পত্রিকায় প্রকাশিত একাত্তরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের বিশেষত: বর্তমান প্রজন্মের আরও নেই কোন সুস্পষ্ট ধারণা। সেক্ষেত্রে উপরে উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলি এ বিষয় ও ধারণাকে স্পষ্ট করার পাশাপাশি একটি বিশেষ সময়ের, বিশেষ স্থানের, বিশেষ ঘটনাকে জানতে, বুঝতে কিছু সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়। একটি বিষয় ও বিশেষ সময়কে বােঝার জন্য সংবাদগুলি গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের যে বিপুল চৈতন্য, অঙ্গীকার, অন্তরঙ্গতা, হাতিয়ার তার কিছু প্রমাণ এই পত্রিকাগুলি। যুদ্ধকালীন প্রকাশিত পত্রিকাগুলি এবং এর সংবাদগুলি, বিশেষ করে এর আধেয় বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা এক কষ্টসাধ্য, দীর্ঘমেয়াদী, পরিকল্পনাপ্রসূত গবেষণালব্ধ কাজ। সুতরাং ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে। গবেষক, ইতিহাসবিদ ও আগ্রহী সচেতেন ব্যক্তিবর্গের এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা আবশ্যক। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস লিখতে আমাদের পত্রিকার মত দলিল সংরক্ষিত করা আবশ্যক।
ইতিহাস নিয়ে যেহেতু নানা সময়ে প্রশ্ন তােলা ও টানা হেচড়া হয়। ইতিহাসবিদদের মাঝে দল, মত, আদর্শ আছে সত্যি কিন্তু একটা বিষয়ে তারা একমত আর সেটা হলাে দলিল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা। পত্রিকার। মত এই দলিল অবলম্বন করে একাধিক লেখক, গবেষক নানাভাবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে। ইতিহাস রচনা করতে পারেন। এখানে বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, ঐতিহ্য নির্মাণের কিছু উপকরণ তুলে ধরা হয়েছে। এ কাজ এখন সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ অর্থাৎ গবেষকদের। কেননা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখাটা যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে ততটা নয়। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন। তাই ইতিহাসের এ মূল্যবান বিশিষ্ট অধ্যায় পত্রিকার উপকরণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়ােজন। বহু কৌনিক দৃষ্টিতে এর মূল্যায়ন প্রয়ােজন। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে তা এখনও ঠিক সংকলিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গবেষকরা তাদের প্রয়ােজন অনুযায়ী পত্রিকা ঘেটে ঘেটে সংগ্রহ করেছেন, কিন্তু এ গুলি একত্রিত করা দরকার। কারণ। সংবাদপত্র গুলি দিন দিন দুপ্রাপ্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান সংকলন করতে গিয়ে যে সব পত্রপত্রিকার খোঁজ পেয়েছি [এবং ব্যবহার করেছি| নিচে সে সব পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলাে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব বেশি তথ্য যােগাড় করা সম্ভব হয়নি।
১. অমর বাংলা
‘অমর বাংলা’ নামের এই সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এ বি ছিদ্দিকী। এটি বেঙ্গল প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশনস, ঢাকা, বাংলাদেশ এর স্বত্বাধিকারী পি.পি.বড়ুয়া কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। পত্রিকার নামের নিচে ইংরেজিতে Weekly Amor Bangla এবং বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র’ এই কথাটি লেখা হতাে। তাছাড়া পত্রিকার নামের দুই পাশের দুটি বক্সের একটিতে বঙ্গবন্ধু | শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের কয়েকটি লাইন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং ‘রক্ত যখন দিতে শিখেছি তখন আরও রক্ত দেবাে, বাংলাদেশকে শােষণ মুক্ত করবই’ উদ্ধৃত ছিল। মূল্য ২৫ পয়সা, কলাম সংখ্যা ৪ এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪। প্রথম প্রকাশ ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৭১, | বাংলায় ১৬ কার্তিক, ১৩৭৮, বৃহস্পতিবার। প্রথম প্রকাশনার প্রথম সংবাদ শিরােনাম নয়াদিল্লীস্থ পাক
দূতাবাসের পৈশাচিক কান্ড, প্রহারের চোটে বাঙ্গালী কর্মচারী নিহত? এবং সম্পাদকীয় আমাদের যাত্রা | হােল শুরু দিয়ে প্রকাশিত হয়।
২. অগ্রদূত
৩১ আগষ্ট ১৯৭১-এর রৌমারী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব আজিজুল হকের সম্পাদনায় ‘অগ্রদূত’ নামের এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সহ-সম্পাদনায় মতিয়ুর রহমান, ব্যবস্থাপক সাদাত হােসেন, এম,এন,এ ও প্রাদেশিক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম এবং প্রকাশক মােহাম্মদ আলী ছিলেন। আর এর প্রধান পৃষ্ঠপােষক লে. কর্ণেল জিয়াউর রহমান, জেড কোর্স কমান্ডার এবং মুক্তিফৌজ কমান্ডার উত্তর-পূর্ব সেক্টর (১১নং সেক্টর) ছিলেন। স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চলের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে রংপুর জেলার রৌমারী কুড়িগ্রাম হতে পত্রিকাটি হাতে লিখে সাইক্লোষ্টাইলে প্রকাশিত হতাে। | মােট ১৫টি সংখ্যায় প্রকাশিত অগ্রদূতের প্রথম সংখ্যাটি ৩১শে আগষ্ট এবং শেষ সংখ্যাটি ৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এ প্রকাশিত হয়। প্রতি সংখ্যার মূল্য ২০ পয়সা এবং কলাম সংখ্যা দুই ছিল । একাত্তরের বিরাজমান পরিস্থিতি ও মুক্তাঞ্চলের খবরাখবর এর সংখ্যাগুলিতে স্পষ্টভাবে ফুঠে উঠেছে। রৌমারী। মুক্তাঞ্চল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে রৌমারীই ছিল একমাত্র থানা সদর যা কোনদিন বর্বর পাক-বাহিনী কখনাে দখল করতে পারেনি। এখানেই প্রথম বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছিলাে। একাত্তরের বিশিষ্ট রণাঙ্গন সাংবাদিক হারুন হাবীব তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন “আমি এবং সেদিনের রংপুরের রৌমারী মুক্তাঞ্চলের অন্যতম মুক্তিফৌজ কমান্ডার লে. নুরন্নবী খান যৌথভাবে “অগ্রদূত” নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতাম । অর্থ, কাগজ এবং ছাপাখানার অভাব, সংবাদ সংগ্রহে সঙ্কট, বিভিন্ন অপ্রতুলতা এবং সর্বোপরি প্রকট এক অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেও এই সব কাগজগুলাে একদিকে যেমন শরণার্থীদের মনােবল চাঙ্গা করেছে অন্যদিকে সাহস জুগিয়েছে মুক্তিবাহিনীকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে।
৩, অভিযান।
খ্যাতমান কবি ও সাংবাদিক সিকান্দার আবু জাফর ‘অভিযান’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকার নামের নিচে ‘বাঙলাদেশ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ঢাকা লেখা হতাে। প্রকাশনার স্থান ঢাকা লেখা হলেও পত্রিকাটির যােগাযােগের অস্থায়ী ঠিকানা ছিল ৮৪/৯ রিপন ষ্ট্রীট, কলিকাতা ১৬। এই সাপ্তাহিকীটি সমকাল মুদ্রায়ণ, ডি.আই.টি এ্যাভেন্যু ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। ছাপা ঝকঝকে, দাম ৩০ পয়সা এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪-৮-এর মধ্যে ছিল। সাপ্তাহিকীটির ভাষা ছিল অত্যন্ত জোরালাে । পত্রিকাটির প্রথম আত্নপ্রকাশ ঘটে ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১। প্রথম সংখ্যায় সিকান্দার আবু জাফরের গান। ‘প্রয়ােজন হলে দেবাে এক নদী রক্ত……..আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ দিয়ে শুরু হয়। সাপ্তাহিকীটিতে যুদ্ধের সংবাদ ছাড়াও বিশ্ব রাজনীতি, কবিতা, সাংস্কৃতিক সংবাদ ও অন্যান্য সাধারণ সংবাদ ও প্রকাশিত হতাে। এই পত্রিকার চারটি সংখ্যার সম্পাদকীয় যেমন শ্রীমতি গান্ধীর পশ্চিম সফরান্তিক
সাফল্য’ ১৮ নভেম্বর, খেলা সমাপ্তির শেষ ঘন্টাধ্বনি’ ২৫ নভেম্বর, পাকিস্তানের কবর খােড়া হচ্ছে’ ১০ ডিসেম্বর এবং ‘অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি’ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১য়ে ছাপা হয়েছে।”
৪. অগ্নিবাণ ঢাকা জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত্যিাদ্ধাদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখপত্র ‘অগ্নিবাণ’ । এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি
সে সময় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মােজাফফর) কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পত্রিকা পরিচালনায় উপদেষ্টা পরিষদে আবদুল মতিন চৌধুরী, আবদুর রউফ খান, নরেশ চন্দ্র চৌধুরী, আবদুর রশীদ খান, মােবারক হােসেন লুডু, হায়াত আলী মিয়া, গােলাম মহিউদ্দিন ছানা, মােঃ শাহজাহান চৌধুরী, নাসিমা। সুলতানাসহ আরাে অনেকে যুক্ত ছিলেন। এদের মাঝে অনেকে আজ সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অগ্নিবাণ পত্রিকায় তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে সবাই একমত ছিলেন। সব কিছুর উর্ধ্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম পত্রিকায় লেখা হতাে। পত্রিকা তার অনেক ছবি, অনেক প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় ছাপে। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই প্রিন্টিং মেশিন না পাওয়ায় সাইক্লোস্টাইল মেশিন ও স্টেনসিল পেপারের মাধ্যমে পত্রিকাটি প্রকাশ করা হতাে। ঢাকা জেলার জয়পাড়া এলাকার অতুল গমেজ বঙ্গবন্ধুর ছবি স্টেনসিল পেপারে আকঁতেন। আর সাইক্লোস্টাইল মেশিনটি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার পাটগ্রাম স্কুল | থেকে নিয়ে আসেন তৎকালীন ছাত্রনেতা আশরাফ উদ্দিন খান। এই পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রধান সংবাদ শিরােনাম ছিল ‘হরিরামপুর থানায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা’।”
৫, আমার দেশ
‘আমার দেশ’ একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা যার সম্পাদক খাজা আহমদ ছিলেন। পত্রিকাটি মুক্ত বাংলার কোন এক অঞ্চলে “আমার দেশ” মুদ্রণালয় হইতে মুদ্রিত ও “আমার দেশ” কার্যালয় হইতে খাজা আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। মূল্য পঁচিশ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬, কলাম সংখ্যা ৩ ছিল । প্রথম সংখ্যা আগষ্ট মাসের দিকে প্রকাশিত হয় জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধের খবর, হানাদার বাহিনীর পরাজয় ও মুক্তাঞ্চলের খবরাখবরই বেশি প্রাধান্য পেত এ পত্রিকায়। ১১শ সংখ্যা ১১ই নভেম্বর, ১৯৭১ইং (২৪শে কার্তিক, ১৩৭৮ বাং) তারিখে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘ শান্তির পারাবত’ এবং প্রথম পাতার সংবাদ শিরােনাম ‘মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে লিচু বাগান ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন। ১৯জন খান সেনা ও রাজাকার নিহত: ৭৩জন খান সেনা ও রাজাকার ধৃত: বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার: বর্বর পাক বাহিনীর বিমান হামলা: পরশুরাম থানা হানাদার মুক্ত ইত্যাদি ছিল। ওই
৬. আমােদ
সাপ্তাহিক আমােদ ৫ মে, ১৯৫৫ সনে মােহাম্মদ ফজলে রাব্বীর সম্পাদনায় কুমিল্লার চৌধুরীপাড়া থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। আঞ্চলিক এই সংবাদপত্রটির বিস্তার ও প্রচার মূলত: কুমিল্লা, বি.বাড়ীয়া, চাঁদপুর এবং এর সন্নিহিত এলাকাসমূহে ছিল। ট্যাবলয়েড বাংলা সাধুরীতির এই পত্রিকাটি প্রথমে ছিল ক্রীড়া সাপ্তাহিকী পরে সাধারণ সাপ্তাহিকীতে পরিণত হয়। একাত্তরের অবরুদ্ধ বাংলাদেশে কুমিল্লা থেকে এর আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পত্রিকাটির নামের নিচে ইংরেজিতে THE AMOD লেখা ছিল। পত্রিকায় স্বাধীনতা বিরােধীদের সামগ্রিক তৎপরতা যথা জনসভা, মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা, বিবৃতির চিত্র যেমন পাওয়া যায় তেমনি সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের খবরও ছাপা হয়েছিল। কিছু সংবাদ শিরােনাম হতে এর পরিচয় পাওয়া যাবে যেমন ২২ জুলাই ছাপিয়েছে – ‘কুমিল্লা শহরে ভারতীয় গােলাবর্ষণ’, ‘ ঢাকা সাংবাদিক দলের কুমিল্লা সফর । জিলা
সামরিক প্রধানের সহিত বর্তমান পরিস্থিতির উপর আলােচনা”, জেলার যােগাযােগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক। ১৯শে আগষ্ট প্রতিটি মুসলমানই মুজাহিদ। লাকসামের জনসমাবেশে জেলা সামরিক প্রশাসকের ভাষণ’, ২রা ডিসেম্বর বিনা উস্কানিতে ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে জনসভা ও শােভাযাত্রা’, “নিপ্রদিপ মহড়া’। মুক্তিযুদ্ধে আমােদ-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে মামুন লিখেছেন, সেই সময় পত্রিকার পাতা ভরে ওঠেছিল বিদেশী সংবাদ রকমারী বিষয় নিয়ে । যা আঞ্চলিক পত্রিকার ধর্ম নয় – আমােদ এর বৈশিষ্ট্য তাে নয়ই। ২৫শে মার্চের সংখ্যাটি উল্টালেই এই সত্য ধরা পড়বে। এবং সম্পাদকীয়গুলি অরাজনৈতিক ও সাধারণ বিষয় ভিত্তিক। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয়নি বটে আবার স্বাধীনতা বিরােধী চক্রকেও উৎসাহিত করা হয়নি – পক্ষাবলম্বন করা হয়নি – সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। বস্তুত এই সব মিলিয়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধে আমােদ এর ভূমিকা।
৭. ইশতেহার | ২৬ মার্চ থেকে ঢাকার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে সে সময় নওঁগার তরুণ সংগ্রামীরা প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘ইশতেহার’। ইশতেহার মাত্র ২টি সংখ্যা বেরিয়েছিল, প্রথমটি ২৭ মার্চ ও দ্বিতীয় সংখ্যাটি ২৮ মার্চে। ফুলস্কেপ সাইজের এক পৃষ্ঠা সাইক্লোস্টাইল করা এ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে কারােরই নাম ছিল না। তবে এর প্রকাশনা কাজের সঙ্গে শফিক খান, মইনুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, আজিজুল হক, আ.ফ.ম আলমগীর, আখতার সিদ্দিকী, জহুরুল ইসলাম ইদুল, খায়রুল আলম প্রমুখ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজধানী ঢাকা পাক হানাদারদের আক্রমণের শিকার হলেও নওঁগা মুক্ত ছিল প্রায় একমাস যাবৎ। ২২ এপ্রিল নওঁগা পাকসেনাদের অধিকারে চলে যায়।
৮. উত্তাল পদ্মা
মুহাম্মদ আবু সাহিদ খান ছিলেন ‘সাপ্তাহিক উত্তাল পদ্মা’র সম্পাদক। রােশেমা বেগম কর্তৃক উত্তাল পদ্মা প্রেস, মুজিবনগর হ’তে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকাটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ২৪শে। নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭১। বাংলার তারিখ অগ্রহায়ণ ৭, ১৩৭৮ এবং এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬, কলম সংখ্যা ৭, মূল্য ২৫ পয়সা ছিল। প্রকাশিত আলােক চিত্র এবং ছাপা ঝকঝকে। যােগাযােগের ঠিকানা ছিল : উত্তাল পদ্মা কার্যালয়, মুজিব নগর, বাংলাদেশ আর ভারতে যােগাযােগের ঠিকানা ১১৮ ইলিয়ট রােড, কলিকাতা ১৬। প্রথম পাতায় রাজনৈতিক ভাষ্যকারের স্বাধীনতা ব্যতিরেকে রাজনৈতিক সমাধান – কল্পনা করাও মহাপাপ’, নিজস্ব সংবাদদাতার ‘মুক্তিবাহিনীর বৃহত্তম আক্রমণ যশাের সেনানিবাস ঘেরাও’, ‘শতাব্দীর সূর্য’ বিশেষ নিবন্ধকার, নিজস্ব সংবাদদাতার সংবাদ শিরােনাম ইত্যাদি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয় । দুটি সম্পাদকীয় মুক্তিবাহিনীর নৌ-কম্যান্ডাে’ ও ‘মরার’পরে খাড়ার ঘা’ প্রকাশ পায়।
৯. ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার। | মুক্তিবাহিনীর ক্রোড়পত্র ‘ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার’ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে এম. আর. আখতার কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। সচিত্র ক্রোড়পত্রটির কলাম সংখ্যা ৩ এবং এর প্রথম প্রকাশ ও অন্যান্য তথ্যাদি জানা যায়নি। তারিখ ছাড়া প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৩৭৮ সংখ্যাটিতে যুদ্ধের আক্রমণ, সাফল্য, অগ্রগতি, শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দেশবাসীর প্রতি, মুক্তিবাহিনীর প্রতি ও বিশ্ববাসীর প্রতি কিছু বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ১০. গণ মুক্তি
পত্রিকার নামের শিরােণামের ওপরে লেখা হতাে স্বাধীনতাকামী ও মেহনতি জনগণের সাপ্তাহিক মুখপত্র। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। পত্রিকা নামের পাশে আবার দুটো বক্সে তার কিছু বক্তব্য প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ১লা নভেম্বর, সমবার {সােমবার, ১৯৭১ ঢাকা থেকে প্রকাশিত। চার পাতার এই পত্রিকার মূল্য দশ পয়সা রাখা হয়। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মওলানা ভাসানী’ । এই সংখ্যার অন্যান্য সংবাদ প্রতিবেদনের শিরােনামগুলি ছিল যেমন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের দেহের পাহাড়ের নীচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। সার্বভৌম ও স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বীকৃতিই একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান’, ‘মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে সামরিক ট্রেন বিধ্বস্ত, ৫০ জন পাক সেনা নিহত ও বহু আহত”, এবার কার পালা ?’, ‘বাংলাদেশ ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি কমী শিবির সদস্যদের প্রতি আবেদন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তরুণ সমাজ-বিদুৎ’, ‘শেখ মুজিব সামরিক কারাগারে’, ‘ন্যাপ কার্যকরী সভার সিদ্ধান্ত’, ‘জাতী সংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তি’, ‘বেগম ভাসানী অন্তরীণ’, বাংলাদেশের ছায়াছবি জীবন থেকে নেওয়া ভারতে প্রর্দশনী’।৩৭
১১, গ্রেনেড | গ্রেনেড সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। সাইক্লোস্টাইল মেশিনে এবং ঢাকার তরুণ ছাত্রকর্মীদের কয়েকজন নটরডেম কলেজ থেকে মেশিনটি উঠিয়ে এনে শহরেরই কোনও এক বাড়িতে এই পত্রিকার কাজ সম্পন্ন করতেন। “বিছু’ নামের এই গেরিলা বাহিনী তরুণ শক্তি জানকে বাজি রেখে যেমন অস্ত্রে লড়েছে তেমনই কলমেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
১২. জয়বাংলা (১) | ‘জয়বাংলা’ পত্রিকাটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক নিয়মিত রাজনৈতিক মুখপত্র ছিল । সম্পাদক গণপরিষদ সদস্য আহমদ রফিক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মতিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন। মুজিবনগর জয়বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে আহমদ রফিক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতাে। ১১ই মে, ১৯৭১ ‘জয়বাংলা’র প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এর রেজিষ্টার্ড নম্বর-১ হয় এবং পত্রিকাটি সরকারী অনুদানও পেতাে। পত্রিকাটির মূল্য ২০ পয়সা এবং ৩য়। সংখ্যা থেকে মূল্য ২৫ পয়সা হয়। সুন্দর পরিপাটি সচিত্র সংবাদপত্র ছাপা ঝকঝকে, ট্যাবলয়েড সাইজ ও কলাম সংখ্যা ২-৪ ছিল । মােট ৩৪টি সংখ্যা মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ সংখ্যা ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আর বাংলায় ৮ পৌষ, ১৩৭৮, শুক্রবার প্রকাশিত হয়। যােগাযােগের ঠিকানা কর্মাধ্যক্ষ, সাপ্তাহিক জয়বাংলা, হেড অফিস মুজিবনগর, বাংলাদেশ অথবা তথ্য, গণ-সংযােগ ও প্রচার বিভাগ, বাংলাদেশ মিশন ৯, সার্কাস এভিনিউ, কলিকাতা-১৭ ছিল ।। এ সাপ্তাহিক মুখপত্রের প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের মর্মবাণী উৎসারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা, বিবৃতি, বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমতের সংবাদ ছাড়াও এর শেষ পৃষ্ঠায় যুদ্ধের খবর সম্বলিত নিয়মিত কলাম রণাঙ্গনে থাকতাে। “জয়বাংলা’র একটি সংখ্যায় সমস্ত পাতা জুড়ে ছাপা হয়েছিলাে ইয়াহিয়ার মুখের হিংস্র ছবি, যার ক্যাপসান ছিলাে-“এই জানােয়ারটাকে হত্যা করতে হবে।’ পত্রিকাটিতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম ছিলাে ‘যা দেখছি যা ভাবছি।’ একদল দক্ষ সংবাদপত্র কর্মী এ পত্রিকার জন্য কাজ করতেন। এ পত্রিকার রণাঙ্গন প্রতিনিধি হারুন হাবীব তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন – ‘ জয়বাংলা’য় একদিকে যেমন যুদ্ধের প্রচারধর্মী খবর, সংবাদ নিবন্ধ আর বিশ্লেষণমুখী প্রবন্ধ ছাপা হতাে অন্যদিকে
ছাপা হতাে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, নির্যাতন আর দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনের খবর। আমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন সাংবাদিকতার একটা ভাল ছবি এই একটি মাত্র পত্রিকা থেকে আমরা | পেতে পারি। ৩৯
১৩, জয় বাংলা (২)
ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক লিমিটেডের কর্মকর্তা জনাব এম.জি হায়দার রহমতউল্লা নাম ধারণ করে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রথমে দৈনিক পরে সাপ্তাহিকী হিসেবে প্রকাশিত হয়। মহকুমা নওগাঁ (রাজশাহী) থেকে প্রকাশিত হতাে। এটি কোন দলীয় আনুগত্য ছিল না। সময়ের তাগিদেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদক পত্রিকা সম্পর্কে লিখেছেন : নিজস্ব সীমিত পুঁজির ওপর নির্ভর করেই ‘জয় বাংলা’ প্রকাশের কাজে হাত দিয়েছিলাম। কারও কাছ থেকে কোন আর্থিক সাহায্য নেবার প্রয়ােজন হয়নি। প্রেস কর্তৃপক্ষও কোন লাভ নিতেন না, শুধু কাগজ ও মুদ্রণ এর খরচ নিতেন। “জয় বাংলার প্রথম সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা ধার্য হয়েছিল। এক ঘন্টায় ২০০ কপি বিক্রিও হয়েছিল। কিন্তু এ সামান্য দাম আদায়ে ঝামেলার কারণে প্রথম সংখ্যার অবশিষ্ট কপি ও দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শেষ সংখ্যার সকল কপিই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছিল। … প্রথম সংখ্যাটি আমি নিজে আমার স্কুল | জীবনের সহপাঠিকে সাথে নিয়ে নওগা শহরে বিলি করেছিলাম ৩০শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে।’ প্রথম সংখ্যা পত্রিকার নিচে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহে ‘জয় বাংলা’ আত্ন প্রকাশ করিতেছে। লেখা ছিল। পত্রিকাটিতে মূলত: সম্পাদকীয় এবং জনগণের প্রতি সম্পাদকের আবেদন, নির্দেশ ছাপা হতাে। তা ছাড়া প্রতিটি সংখ্যায় পবিত্র কোরানের বাণী তজমাসহ প্রকাশিত হতাে। ১০ম সংখ্যার পর থেকে প্রচারিত সংখ্যা গুলিতে কিছু সংবাদ ছাপা হতাে। দুই কলাম বিশিষ্ট এই পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় “দৈনিক জয় বাংলা’ উল্লিখিত হয় । ষষ্ঠ সংখ্যা থেকে স্বাধীন বাংলার একমাত্র দৈনিক পত্রিকা’ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাপ্ত সংখ্যাগুলােতে তারিখ লেখার নিচে দেশপ্রেম বােধক বাণী প্রকাশিত হতাে। মােট ১১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য মুখপত্র এ পত্রিকার সবগুলি সংখ্যা নিয়ে জয় বাংলা। প্রকাশনী থেকে মে ১৯৯০ সনে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৪. জয় বাংলা (৩) | পত্রিকার নামের নিচে ‘স্বাধীন বাংলার স্বাধীন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র’ এবং বন্ধনীতে ‘মুক্তিফেীজ কর্তৃক প্রচারিত’ বাক্য কয়টি লেখা ছিল। সংগৃহীত একটি মাত্র পত্রিকা ১৪শ সংখ্যা ১৭ জুলাই ১৯৭১ | (৩২ আষাঢ়, ১৩৭৮, শনিবার হতে জানা যায় পত্রিকাটি বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ কর্তৃক স্বাধীন বাংলা
প্রেস হইতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকাটির শুভেচ্ছা মূল্য ধরা হয়েছে ২০ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২ ও | কলাম সংখ্যা ৪। প্রথম প্রকাশ এবং এর সম্পাদক, পরিচালনা পরিষদ এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে | আর কিছু জানা যায়নি। ১৪ তম সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক ছ্যাচড়ামি’ নামে
প্রকাশিত হয় এবং এই সংখ্যারই প্রথম পাতার প্রধান শিরােনাম গুলি মুক্তাঞ্চলসমূহে ভােগ্য পণ্যাদি | আসছে’, ‘বাংলাদেশই আমার পরিবার -মেজর খালেদ’, ‘শাহবাজপুরে মুক্তিফৌজের হাতে ৯জন খান | সেনা নিহত’, ‘তছির আলী ধরা পড়েছে’, ‘মুক্তিফৌজের তৎপরতা’, ‘যুদ্ধ চলবে’, ‘মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয়। কমিটি’ ইত্যাদি বক্তব্য সম্বলিত ছিল।
১৫. জয় বাংলা (৪)। | বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আব্দুল বাসিত এ ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। | এটি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। পত্রিকার শিরােনামের নিচে ‘স্বাধীন বাংলার সিলেট জেলার মুখপাত্র কথাটি লেখা থাকতাে। অবশ্য এর আয়ুষ্কাল বেশী ছিল না কিছুদিন চলার পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৬. জন্মভূমি। | ‘জন্মভূমি’ একাত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিকীটির সম্পাদক বিয়ানীবাজার থানার মােস্তাফা আল্লামা ছিলেন। ঢাকায় পত্রিকার ৫টি সংখ্যা বের হয়। কোলকাতায় জন্মভূমি পুন: প্রকাশ ঘটে ১৬ জুলাই, ১৯৭১। সম্পাদক তার ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পুরােটাই জন্মভূমির প্রকাশনা তৎপরতায় ব্যয় করতেন। সম্পাদক নিজেই ছিলেন সংবাদ সংগ্রহকারী, লেখক, প্রুফরিডার, সার্কুলেশন ম্যানেজার সবকিছু। ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের বিপ্লবী মুখপত্র’ শ্লোগানসহ প্রকাশিত জন্মভূমির প্রকাশনা যুদ্ধকালীন বাস্তবতার কারণে নিয়মিত ছিল না। জন্মভূমি প্রেস। এন্ড পাব্লিকেশনের পক্ষে মােস্তফা আল্লামা কর্তৃক রবীন্দ্র এভিনিউ ও মুজিবনগর বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, মুদ্রিত ও সম্পাদিত এবং এটি লন্ডন থেকেও প্রকাশিত হতাে। বিজয় পর্যন্ত এর ৩০টি সংখ্যা বার হয়। পত্রিকাটির প্রধান পাঠক ছিল মুক্তিযােদ্ধা ও শরণার্থী। কলাম সংখ্যা ৫ এবং দু’রংয়ের এ সচিত্র সাপ্তাহিকীটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও উচু মান সম্পন্ন। সাধারণত ২-৪ পৃষ্টায় প্রকাশিত হতাে। এর মূল্য ছিল ৩০ পয়সা আর লন্ডনে ২ শিলিং। দশম সংখ্যা ১১ অক্টোবর থেকে রেজিষ্টার্ড নম্বর – বিডিএম ১৫ লেখা হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের খবর, প্রবাসী সরকারের সকল কার্যক্রম, হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন এর খবর ছাড়াও বিদেশী রাষ্ট্রের খবরও প্রকাশ করতাে। শেষের দিকের সংখ্যাগুলিতে বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত সংবাদ বেশি গুরুত্ব দেয়া হতাে। ৩০শে আগষ্ট, ষষ্ঠ সংখ্যার প্রধান লীড সংবাদ ছিল বিশ্ববাসী রুখে দাঁড়াও’। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর ১৬তম সংখ্যার প্রধান সংবাদ শিরােনাম ‘বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল’, ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর দুর্বার অগ্রগতি: ঢাকা দখলই। লক্ষ্য’, ‘পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হল’, ‘পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘােষণা’ ইত্যাদি ছিল। পত্রিকাটিতে রাজনৈতিক নিবদ্ধ, বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশিত হতাে।
১৭, জাগ্রত বাংলা।
| ‘জাগ্রতবাংলা’ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বাঙ্গালী। এখানে সম্পাদক যে ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন তা বােঝা যায়। পত্রিকার নামের নিচে ছােট করে ইংরেজিতে বড় হরফে ‘THE JAGRATA BANGLA লেখা থাকতাে। পত্রিকার কোন সংখ্যাতে মুক্তি ফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ আবার কোনটাতে মুক্তি বাহিনীর সাপ্তাহিক’ মুখপত্র লেখা থাকতাে। হাতে লেখা এবং ৯ম সংখ্যা পর্যন্ত। সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত। পত্রিকাটিতে বেশ কটি প্রচারিত ও প্রকাশিত স্থানের নাম পাওয়া যায় । স্থানগুলি ছিল যেমন – ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত, ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ভালুকা শাখা মুক্তিফৌজের বেসামরিক দফতর আজাদনগর হইতে প্রচারিত ও প্রকাশিত, ময়মনসিংহ জেলা বেসামরিক দপ্তর আজাদ নগর থেকে প্রকাশিত, ময়মনসিংহ জেলা ও উত্তর ঢাকার বেসামরিক দপ্তর আজাদ নগর থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত । পত্রিকার পাতায়। বিভিন্ন সাইজের বক্সে স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন শ্লোগান এবং বাণী লেখা প্রকাশ পায়। বক্সে একটি যেমন ছিল ‘আমাকে রক্ত দাও বিনিময়ে স্বাধীনতা দেব। বিভিন্ন বিষয় ও বক্তব্য নিয়ে বেশ কিছু কার্টুন ও স্কেচও পত্রিকাগুলিতে ছিল। এর শুভেচ্ছা মূল্য ৩০ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬-৮ এবং ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে কলাম সংখ্যা ২এর পরিবর্তে ৩ করা হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১লা জুন, ১৯৭১। ২য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১লা আগষ্ট, রবিবার, ১৯৭১ আর বাংলায় ১৫ই শ্রাবণ ১৩৭৮, ৯ জমাদিউস্সানি। ১৩৯১। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান উপলক্ষে এর ৮ম সংখ্যাটি বিশেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার পত্রিকার উপরে পবিত্র কোরাণ এবং আল-হাদিসের। বাণী দেখা যায়। এটা সম্ভবত: একমাত্র পত্রিকা যেখানে কোন কোন সংখ্যায় আরবী মাস ও সনের
উল্লেখ দেখা যায়। মূলত: পত্রিকাটি ছিলাে অধিনায়ক আফসার উদ্দিন কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত । ফলে পত্রিকাটি আফসার ও কাদের বাহিনীর সাফল্যের খবরাখবর বেশি করে প্রকাশ করতাে। সপ্তম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১ আর এর সম্পাদকীয় ছিল পাক সরকারের জরুরী অবস্থা ঘােষণা’ *৮
১৮, জাতীয় বাংলাদেশ | জাতীয় বাংলাদেশ সম্পাদনা করতেন এ এম এম আনােয়ার। পত্রিকার নামের নিচে লেখা হতাে বাঙলাদেশের একটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ও বাঙলাদেশের প্রথম দৈনিক স্বাধীন বাঙলা’ একত্রীভূত প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৭১। শেখ মােহাম্মদ শহীদ আনােয়ার কর্তৃক বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ও শেখ নি প্রেস নােয়াখালী, বাঙলাদেশ হতে মুদ্রিত। প্রথম প্রকাশ বাংলাদেশ ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১ আর বাংলায় ২৮ কার্তিক, সােমবার, ১৩৭৮ ছিল। সাপ্তাহিক চার পাতার এই পত্রিকার দাম ১৫ পয়সা, কলাম সংখ্যা ৫, রেজিষ্টেশন নং: ২৮। বিদেশে যােগাযােগের ঠিকানা: ২৮৯/এফ/৬, দরগা রােড, কলিকাতা ১৭। শ্ৰী পরিমল সাহা, ডাক বাংলাে রােড, উদয়পুর, পাে: রাধাকিশােরপুর, ত্রিপুরা। এম এম হােসেন, ৫৯ ফ্যাসন স্ট্রিট, লন্ডন ই -১। প্রথম সম্পাদকীয় ‘এ সংগ্রাম সত্যের এবং ন্যায়ের’ এভাবে প্রকাশিত হয় ।
১৯, দাবানল। | ‘দাবানল’ নামক এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির পরিচিত শ্লোগান ‘মুক্তিযােদ্ধা ও সংগ্রামী জনতার মুখপত্র’। এই লাইনটি পত্রিকার নামের উপরে লেখা থাকতাে। সম্পাদক মাে: জিনাত আলী ছিলেন। ত্রিবর্ণ প্রকাশনীর পক্ষে মােঃ সেলিম কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত এবং মুজিবনগর হাতে প্রচারিত। পত্রিকাটির বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত রেজিষ্ট্রেশন নং: ৭, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬ এবং মূল্য ২৫ পয়সা ছিল । প্রথম প্রকাশিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পত্রিকাটির ১ম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যার একটি। রাজনৈতিক ভাষ্যের শিরােনাম ছিল: ‘পাকিস্তানে নয়, বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরবেন’ । ৩য় সংখ্যার প্রকাশ ১০ই অক্টোবর ১৯৭১ আর বাংলায় ২৩ আশ্বিন, ১৩৭৮, রবিবার ছিল। ‘আপােষের বাণী আগুনে জ্বালিয়ে দাও’ এই নামে ২য় সংখ্যার সম্পাদকীয় ছিল। ৩য় ও ৪র্থ সংখ্যার পত্রিকার প্রধান দুটি শিরােনাম ‘ দেশবাসীর লাশ আর রক্তের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপােষ অসম্ভব’, ‘চরম অর্থনৈতিক সংকট-সেনাবাহিনীতে অন্তর্দ্বন্দ্ব-মুক্তিবাহিনীর দুর্বার সাফল্যে সুনিশ্চিত পরাজয়ের মুখে খুনী পাক হানাদার বাহিনী’ ছিল। ‘দাবানল’ এর ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২১ মে, ১৯৭১।
২০. দুর্জয় বাংলা | ‘দুর্জয় বাংলা’ সাপ্তাহিকীটি তুষার কান্তি কর সম্পাদনা করতেন। পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকতাে সংগ্রামী বাংলার কণ্ঠস্বর’। এটি ছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণের বিপ্লবী মুখপত্র । সিলেট সুরমা প্রকাশনীর পক্ষ হতে কান্তিকর কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। বিদেশস্থ যােগাযােগের ঠিকানাঃ রফিকুল রহমান, পুরাতন ষ্টেশন রােড, করিমগঞ্জ। আবদুল গাফফার চৌধুরীর। লেখা নিয়মিত এবং শামসুর রাহমান, সিকান্দার আবু জাফর ও দিলওয়ারের কবিতা এতে প্রায়ই ছাপা হতাে। পত্রিকাটির মূল্য ১০/ ২৫ পয়সা ছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় মন্তব্য ‘জয় আমাদের হবেই’ প্রকাশিত হয় ৪ নভেম্বর, ১৯৭১।
২১. দেশ বাংলা
সম্পাদক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী কর্তৃক দেশ বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বাংলাদেশের জনযুদ্ধের মুখপত্র হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়। সাপ্তাহিকীটি দীপক সেন কতৃর্ক বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও ‘অগ্নিশিখা’ প্রকাশনীর পক্ষে বিজয়নগর, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। যােগাযােগের ঠিকানা ছিল: দেশ বাংলা কার্যালয়, বিজয়নগর, ঢাকা-২, সত্যরঞ্জন দেব, ৩ হায়াৎ খান লেন, কলিকাতা ৯, সফিউল আলম বেবী, প্রযত্নে ঝর্ণা বুক এজেন্সী, হরিগঙ্গা বসাক রােড, আগরতলা। শম্ভ পাল প্রযত্নে কবরী চৌধুরী গান্ধী নগর, ইষ্ট বান্দ্রা, বােম্বাই। পত্রিকাটির মূল্য ২০-৩০ পয়সা, ছাপা ঝকঝকে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮, কলাম সংখ্যা ৫ রাখা হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে এবং ভারতে প্রকাশিত হতাে। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ২৭ অক্টোবর, ১৯৭১। ২য় প্রকাশনা বৃহস্পতিবার, ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭১ এবং এ সংখ্যার সম্পাদকীয় ছিল ‘অনিবার্য সমাধি’ ও প্রধান সংবাদ শিরােনাম ‘ জাতিসংঘের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে, চীন বাংলাদেশের পক্ষ নেবে ? ইয়াহিয়া চক্রের আত্নহত্যার দিন সমাগত। এই পত্রিকা সম্পর্কে ইমামুর রশীদ লিখেছেন পত্রিকাটির দৃষ্টিতে একমাত্র ধর্ম নয়, বরং ভাষা সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক একাত্নতাই জাতীয়তার মৌল ভিত্তিরূপে পরিগণিত ছিল। ৪৮
২২. ধুমকেতু
স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পিরােজপুর থেকে প্রকাশিত হয় অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’। পত্রিকাটি। সম্পাদনা করতেন অমর সাহা। ধুমকেতু মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর ঐ পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘জনমত’ নামে পুন:প্রকাশিত হয়।
২৩. নতুন বাংলা
নতুন বাংলা এই পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির । (সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ) সাপ্তাহিক মুখপাত্র লেখা হতাে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি সভাপতি কর্তৃক বাংলাদেশ হইতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত যা শেষের পাতার নিচে লেখা থাকতাে। ৪ পাতা, ৪ কলাম সংখ্যার এই পত্রিকার দাম ১০ পয়সা রাখা হয়। প্রথম প্রকাশিত ১৯ জুলাই, ১৯৭১ হয় এবং এর ১৯তম সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন খবর ছাপানাে ছাড়াও অন্যান্য খবরও প্রকাশিত হতাে। ২৫ নভেম্বর ১৫শ সংখ্যার প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরােনামগুলি যেমন – ‘অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সুষ্ঠ প্রশাসন চাই’, ‘সাতক্ষীরাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত, যশােহর ক্যান্টনমেন্টে হানা, জঙ্গীশাহী কর্তৃক পাকিস্তানে জরুরী অবস্থা ঘােষণা’, ‘আপােষের কোন প্রশ্নই উঠেনা’, ‘বাংলাদেশের নেতৃত্বের একাংশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সােচ্চার নয় কেন ?’, ‘লন্ডন প্রবাসী ন্যাপকর্মীদের জ্ঞাতব্য ছিল । আর এই সংখ্যারই দুটি সম্পাদকীয় হলাে ‘আঘাতের পর আঘাত হানাে’ ও ‘তদন্ত কমিশনের নামে নয়া মার্কিন চক্রান্ত বিষয়ে। তাছাড়া বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার একটি আবেদন ও এই সংখ্যার পত্রিকায় ছাপা হয়।
২৪. প্রতিনিধি।
আহমেদ ফরিদউদ্দিন এর সম্পাদনায় প্রতিনিধি’ সাপ্তাহিকটি বাংলাদেশের কোন এক জায়গা হতে প্রকাশিত হতাে। পত্রিকার সাপ্তাহিক প্রতিনিধি’ নামের নিচে ‘স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র’ কথাগুলি লেখা হতাে। পত্রিকাটি সম্পাদক কর্তৃক রক্তলেখা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। প্রথম প্রকাশ জানা যায় নি। ৩য় সংখ্যার প্রকাশ দেখা যায় ইংরেজিতে ১৫ই অক্টোবর,
শুক্রবার, ১৯৭১ এবং বাংলায় ২৮ আশ্বিন, ১৩৭৮। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় নাটকের প্রথম অংক: ঝড়াে হাওয়ার পূর্বাভাষ’ এবং প্রথম পাতার সংবাদ শিরােনাম ‘ইয়াহিয়া খান আমার দলে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা করছেন – ভুট্টো’, ‘স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য কোন সমাধান হতে পারে না – অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল’, ‘লাহােরে গােপন নথি-পত্র উধাও, প্রত্যেকটি বিমান বন্দরে কড়া পাহাড়া ও ব্যাপক তল্লাসির ব্যবস্থা’, ‘পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করার জন্য লেবার পার্টির প্রস্তাব’, ‘বিশ্ব। বিবেক’, ‘মােনায়েম খান খতম’ ছিল। চার কলামের এই পত্রিকার মূল্য জানা যায়নি।”
২৫. বঙ্গ বাণী | ‘বঙ্গ বাণী’ স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। পত্রিকাটি নওঁগা (রাজশাহী) থেকে প্রকাশিত। পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এম এ জলিল এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কে.এম হােসেন (খন্দকার মকবুল হােসেন) এবং সহ-সম্পাদক এ বি খােন্দকার ছিলেন। নওঁগাসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের সফলতার কথা তুলে ধরে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও সাহসী করা হতাে। এর মূল্য ১৫ পয়সা, কলাম সংখ্যা ৩ এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ ছিল। প্রথম প্রকাশ ২৩শে মে, ১৯৭১ এবং বাংলায় ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮, রবিবার ছিল। প্রথম সম্পাদকীয় ইতিহাস ভুলিবে না’ লেখা
হয় ।
২৬. বাংলার কথা
ওবায়দুর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক সােনার বাংলার পরিবতিত নাম ‘বাংলার কথা’। ১লা সেপ্টেম্বর ২য় সংখ্যা থেকে এ পরিবর্তন করা হয় (ঘােষণা অংশ)। এ সংখ্যার প্রধান পৃষ্ঠপােষক জনাব এ,এইচ,এম, কামরুজ্জামান (হেনা), স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর নাম উল্লেখ করা হয় এবং বার্তা সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন শহিদুল হক। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত এর রেজিস্টেশন। নংঃ ১১ হয় । পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮, কলাম সংখ্যা ৪। মূল্য নির্ধারণ করা হয় কমপক্ষে ২৫ পয়সা। ১লা সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ২য় সংখ্যার সম্পাদকীয় লেখা হয় ‘মানবিকতা- বাংলাদেশ রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং উল্লেখযােগ্য সংবাদ শিরােনামগুলি ছিল যেমন ‘পাক প্রশাসন যন্ত্রে পরিবর্তন আসন্ন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নাভিশ্বাস’, ‘রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য’, ‘বাংলাদেশ মিশন লন্ডনে’, ‘পর্যবেক্ষণ না গণহত্যা?’, ‘সিয়াটোর দরবারেও পাক জঙ্গীশাহী ঠাঁই পেলাে না’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও পত্রিকায় প্রকাশ পেতাে বিভিন্ন প্রবন্ধ, কবিতা, চিঠিপত্র। ৩য় সংখ্যা থেকে বাংলাদেশের জনগণের মুখপত্র’ হিসেবে ক্যাপশন লেখা হয়। এ সংখ্যার মূল্য মাত্র ১০ পয়সা এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ রাখা হয়। ৪র্থ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৮ অক্টোবর, ১৯৭১ এবং এ সংখ্যার মূল্য ১৫ পয়সা ও পৃষ্টা সংখ্যা ৮ হয়। বিশ্বজনমত 3-থান্টের বিলম্বিত উপলব্ধি’ শিরােনামে ছিল এর সম্পাদকীয় । ওঁ শান্তি’ নামে। সম্পাদকীয় লেখা হয় ১৫ নভেম্বর ৫ম সংখ্যায় ।
২৭. বাংলার বাণী | বাংলার বাণী’ স্বাধীনতা যুদ্ধকালের একটি অন্যতম সুসম্পাদিত এবং সুচিন্তিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা জানুয়ারী, ১৯৭০ সালে হাফেজ হাবিবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। মুজিবনগরে প্রথম প্রকাশিত হয় ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। ভারতে এর সম্পাদনার দায়িত্ব আমির হােসেন পালন করতেন। পত্রিকাটি মুজিব নগর থেকে আমির হােসেন কতৃর্ক বাংলার বাণী প্রেস। হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। মূল্য ৩০ পয়সা ও পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ ছিল। ২১ সেপ্টেম্বর ৪র্থ সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল এরূপ “ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারিয়া বাঙালী কুটনীতিবিদদের আনুগত্য
বদল অব্যাহত’। ৫ অক্টোবর ৬ষ্ঠ সংখ্যায় এর রাজনৈতিক ভাষ্যের শিরােনামে ছিল ‘কাহার সঙ্গে আপোেষ, কিসের আপােষ’। বেশ কয়েকটি সংখ্যায় উপ-সম্পাদকীয় রাজনৈতিক দিগন্তে লিখতেন যাত্রিক’। যাত্রিক এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীর নিয়মিত কলাম ছাড়াও একটি কম্পােজিট স্টোরি। ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও বিশ্বরাজনীতি’ ছিলাে। ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যা বাংলার বাণীতে আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘ঢাকা আমায় ডাকে’ কলামে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের অভিপ্রায় বিশ্লেষণ করে লিখেছিলেন:
‘দেশ- বিদেশের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে চরম মার খেয়ে চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গী চক্র আকস্মিকভাবে ভারত আক্রমণ করতে পারে এবং এই ভাবে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়ে তার আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের বাংলাদেশ সমস্যায় হস্তক্ষেপের সুযােগ করে দেবে। ইয়াহিয়া-চক্র আশা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন বা পাস করে তারা যদি একে পাকিস্তান ও ভারতের বিরােধ বলে প্রতিপন্ন করতে পারে এবং এই বিরােধ মীমাংসা বৃহৎ মুরুব্বী রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগুলােকে হস্তক্ষেপের সুযােগ করে দিতে পারে, একমাত্র তাহলেই তার বাঁচোয়া।” এর একটি সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল ইতিহাস আমাদের অনুকূলে’। পত্রিকাটি স্বাধীনতার দাবীতে অতি সােচ্চার ছিল।
২৮. বাংলার ডাক (১)। | বাংলার ডাক’ এর সম্পাদক দীপক রায় চৌধুরী ও প্রধান পৃষ্টপােষক অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং কার্যকরী সম্পাদক দুলাল কুমার ছিলেন। পত্রিকার নামের নিচে লেখা রক্তাক্ত বাংলার সাপ্তাহিক মুখপাত্র ছিল। কলাম সংখ্যা ২ এবং দাম ২০ পয়সা ছিল।। প্রথম প্রকাশ জানা যায়নি। মুজিবনগর থেকে ৫ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ আর বাংলায় ৬ কার্তিক, রবিবার, ১৩৭৮ লেখা। দেখা যায়। সংবাদ শিরােনাম ‘বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি- চালের মণ ১০০ টাকা, পাট কেউ কিনছে না’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশই রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র পথ- আওয়ামী লীগ’, উথান্টের চিঠি”
ছিল। ৫৫
২৯. বাংলার ডাক (২)
সুশীল সেনগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলার ডাক’ প্রকাশিত হতাে। আঙ্গিক তেমন আকর্ষনীয় ছিল না। এ সাপ্তাহিকীতে সংবাদ পর্যালােচনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের টুকটাক খবর প্রকাশিত হতাে। **
৩০. বাংলার মুখ। | ‘বাংলার মুখ’ একটি সংবাদ নিবন্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং এর সম্পাদক ছিদ্দিকুর রহমান আশরাফী ছিলেন। এটি রঞ্জিনা প্রকাশনীর পক্ষে ছিদ্দিকুর রহমান আশরাফী কর্তৃক পলাশ আর্ট প্রেস মুজিবনগর বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। দাম ২৫ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪-৮, কলাম সংখ্যা ৫, রেজিষ্টেশন নং: ৫, সচিত্র এবং ঝকঝকে ছাপা ছিল। প্রথম আত্নপ্রকাশ ১৩ আগষ্ট, ১৯৭১ হয় । বাংলার মুখের ত্রিপুরা ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের যােগাযােগের অফিস ছিল দৈনিক সংবাদ আগরতলা, ত্রিপুরা, ফোন: ৬২৮। কলকাতা অফিস: বাংলার মুখ ৩২/এ পাটুয়াটোলা লেন, কলিকাতা ৯ এবং স্থায়ী ঠিকানা: বাংলার মুখ, মুজিবনগর, বাংলাদেশ ছিল। পত্রিকাটির ৬ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ (৩১ ভাদ্র, ১৩৭৮, শুক্রবার)। এ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ছিল ‘সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের প্রতি’ | বাংলার মুখের ১০তম সংখ্যার সংবাদ শিরােনাম ছিল: ‘বাংলার স্বাধীনতা অশ্রু আর রক্তে – তাজউদ্দীন’। উল্লেখিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় স্বাধীনতা অশ্রু আর রক্ত। এরই বিনিময়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীর স্বাধীনতা সংগ্রাম। কালের গতির সাথে সাথে স্বাধীনতার সােনালী সূর্যের ক্ষণটি নিকটতর হচ্ছে। কিন্তু এর জন্যে চাই আরও রক্ত, আরও অশ্রু, আরও আত্নত্যাগ, আরও জীবন কষ্ট ‘। পত্রিকাটির ১ম বর্ষ ১৪ সংখ্যাটি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ সংখ্যা।
৩১. বাংলাদেশ (১) | ঢাকা’ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ” পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসান চৌধুরী। বাংলাদেশ সম্পাদনা পরিষদের পক্ষে আবুল হাসান চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত এবং আবদুল মমিন কর্তৃক বাংলাদেশ প্রেস, রমনা, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকতাে। ‘সাপ্তাহিক সংবাদপত্র’ । প্রথম প্রকাশ মে, ১৯৭১। চার কলাম ও চার পাতার এই পত্রিকার মূল্য পনের। পয়সা। পত্রিকাটি অবরােধের সব ক’টি মাস সক্রিয় ছিল। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা সম্বলিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য সংবাদও প্রকাশিত হয়। ২৩ আগষ্ট সংখ্যায় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় ছয় দফা না মুজিববাদ’। এতে বলা হয় ছয় দফা গঠনের পেছনে কাজ করেছে মুজিববাদ এবং এটি নিজেই একটি মতাদর্শ।
৩২. বাংলা দেশ (২)
সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ আব্দুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত যুগ্ম-সম্পাদক সালেহা বেগম ও রনজিৎ দাস। কর্তৃক বাংলা দেশ’ নামক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এটি একটি সাপ্তাহিক মুখপাত্র। পত্রিকাটির নামের নিচে “রক্তসূর্য উঠেছে, বীর বাঙালী জেগেছে’ কথাগুলি লেখা রয়েছে। প্রথম প্রকাশিত সংখ্যা ও অন্যান্য বিষয় তেমন জানা যায়নি। তবে ২য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৫ই জুন, ১৯৭১ আর বাংলায় ছিল ৩১ জ্যৈষ্ঠ, মঙ্গলবার, ১৩৭৮। এর মূল্য ১০ পয়সা ও কলাম সংখ্যা ২ দেখা যায়। প্রথম পাতার প্রধান। সংবাদ শিরােনাম “শক্র নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলার জনগণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে – বাংলার প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ” এ ধরনের সংবাদ ছাড়াও ছিল আরও অন্যান্য খবরাখবরও প্রকাশিত
হয় ৫৯
৩৩. বাংলা দেশ (৩)
| বরিশাল হতে প্রকাশিত বাংলা দেশ’ পত্রিকার প্রচারণায় ছিল এটি একটি অনিয়মিত অর্ধ সাপ্তাহিক। সম্পাদনায় ছিলেন এস,এম, ইকবাল, মিন্টু বসু, হেলাল উদ্দিন এবং প্রকাশনায় হারেছ এ, খান, এনায়েত হােসেন, মুকুল দাস। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১। আর। বাংলায় তারিখ ছিল ৩রা বৈশাখ, ১৩৭৮। দুই পাতার এই পত্রিকার দাম রাখা হয়েছিল ১৫ পয়সা। তবে এই পত্রিকার একটি মাত্র সংখ্যাই প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশকালে বরিশালে বিমান হামলা ও পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের ফলে সবকিছু বিনষ্ট করে ফেলা হয়। প্রথম সম্পাদকীয় ‘বাংলা দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং প্রথম পাতার প্রথম সংবাদ শিরােনাম ‘স্বাধীন বাংলা দেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বেতার ভাষণ দিয়ে শুরু করা হয়। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে তার নিচে ‘শােন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি সংযােজন করা হয় । আরও ছিল রণাঙ্গনের খবর, যুদ্ধ, রণাঙ্গনের দায়িত্ব ভার এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিভিন্ন মন্তব্য। কাজী মকবুল হােসেন তার এক প্রবন্ধে লিখেন -‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গেজেট বা বাংলাদেশের সংবাদপত্র সাময়িকীতে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তাতে বরিশাল থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশ” পত্রিকাটিকেই বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘৬০
৩৪. বাংলাদেশ (৪)। বাংলাদেশ’ নামক এই পত্রিকার সম্পাদক ছদ্ম নাম ব্যবহার করতেন কীর্তি (মিজানুর রহমান) নামে। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটি বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন এক স্থান থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। মুদ্রণে তড়িৎ নাম ব্যবহার করা হতাে। হাতে লেখা এই পত্রিকাটির মূল্য ২৫ পয়সা ছিল। প্রথম প্রকাশিত হয় ৩১শে অক্টোবর, ১৯৭১ (১৩ কার্তিক, ১৩৭৮ বাং)। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫, কলাম সংখ্যা ২ ছিল এবং এর মােট ১১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ বিশ্লেষণের প্রয়াস নিয়েছিল। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার নামের নিচে ডান পাশে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার কিছু কিছু বিশেষ উল্লেখযােগ্য অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যেমন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ তুলুন’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বাংলার মানুষ। বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ তার আরও অধিকার চায়’, ‘শােষণহীন। সমাজব্যবস্থাই আমার কাম্য । প্রথম ও শেষ সম্পাদকীয় মুক্তি পথের যাত্রী সশস্ত্র বাঙালী’ এবং ‘শান্তি। ও শৃঙ্খলা রক্ষা’ ছিল। এই পত্রিকার সবগুলি সংখ্যা নিয়ে সম্পাদক মিজানুর রহমান (কীর্তি) তার সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ৭০ দিন’ নামে ইতােমধ্যে একটি বই প্রকাশ করেছেন।
৩৫. বাংলাদেশ (৫)
| আব্দুল মতিন চৌধুরী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিকীটির সম্পাদক ছিলেন। প্রবাসী সরকারের জালালাবাদ আঞ্চলিক তথ্য ও জনসংযােগ দফতর থেকে এটা প্রকাশিত হতাে। প্রথমে পাক্ষিক পরে সাপ্তাহিক হিসেবে বেশ কিছুদিন নিয়মিত বের হয়।
৩৬. বাংলাদেশ (৬)
| দৈনিক বাংলাদেশ’ নামক এই দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন কাজী মাজহারুল হুদা। এই দৈনিকটি ৭ই এপ্রিল দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও থেকে বের হয়। বঙ্গশ্রী প্রেস, ঠাকুরগাঁও হতে কাজী আবদুর রহমান কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। পত্রিকার নামের নিচে স্বাধীন বাংলার স্বাধীন সংবাদ পত্র’ কথাগুলি লেখা আছে। ৩-৪ কলাম বিশিষ্ট এই পত্রিকার বিনিময় মূল্য ১৫ পয়সা। পত্রিকাটির ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মােট ৬টি সংখ্যা বের হয়। পরে আবার তেতুলিয়া মুক্তাঞ্চল থেকে আরও ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮ জুন থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। ১ম বর্ষ ৭ সংখ্যার প্রকাশনা ১৮জুন, ১৯৭১, ঠাকুরগাঁও ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার ছিল। ৭ সংখ্যার সম্পাদকীয় বিশ্ব মােড়লদের সমীপে’ এবং প্রথম পাতার প্রথম শিরােনাম ছিল ‘বীর বাঙ্গালী লাখাে সালাম’।”
৩৭. বাংলাদেশ (৭)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে বহি:প্রচার বিভাগ থেকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশ’ বুলেটিন। এই বুলেটিন ফেরদৌস মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এবং এর উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমেদ। এই বুলেটিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল বলে জানা যায়।”
৩৮, বাঙলাদেশ।
‘বাঙলাদেশ’ নামক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল এবং যুগ্ম সম্পাদক অমল চন্দ্র পাল ছিলেন। পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে ইংরেজিতে লেখা হতাে ‘THE BANGLADESH। এটি আমিনুল হক বাবুল কর্তৃক সম্পাদিত ও অমিয় কুমার ঝুনু কর্তৃক ‘আদর্শ ছাপাখানা (বাঙলাদেশ)
হইতে প্রকাশিত ও মুদ্রিত। চার পাতার এই পত্রিকার মূল্য ১৫ পয়সা। ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা শনিবার ১৮ই ভাদ্র ১৩৭৮ এবং ইংরেজি ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘গােলটেবিলে নয় – রণাঙ্গনেই সমাধান’ ছিল।
৩৯. বিপ্লবী বাংলাদেশ
‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক মুখপত্রের সম্পাদক ছিলেন নুরুল আলম ফরিদ। পত্রিকাটি বরিশাল, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় । সহ-সম্পাদক সন্তোষ কুমার চৌধুরী, বার্তা সম্পাদক মিঠু বসু, রণাঙ্গন প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম এবং আলােকচিত্র প্রতিনিধি মহঃ তৌফিক ইমাম ছিলেন। পত্রিকাটির কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ ইউসুফ নাহিদ কর্তৃক চাপা প্রেস বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত ও রফিক হায়দার রবিন কর্তৃক প্রকাশিত ছিল। ৩য় সংখ্যা ২৯ আগষ্ট, ১৯৭১ থেকে পত্রিকার নামের নিচে ইংরেজীতে Biplabi Bangla Desh লেখা ছাড়াও জনগণের নির্ভীক কণ্ঠস্বর’ এ ৩টি শব্দ পত্রিকার নামের উপর লেখা হতাে । প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা ৪ঠা আগষ্ট, ১৯৭১ প্রকাশিত হয় এবং এর মােট প্রকাশ সংখ্যা ১৯টি ছিল। ১৯তম সংখ্যাটি প্রকাশ পায় ২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৭১, রবিবার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই দাম ১৫ পয়সা রাখা ছিল। এর সাইজ ট্যাবলয়েড, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪-৬। সচিত্র, ঝকঝকে ছাপা, কলাম সংখ্যা ৪৫। বাংলাদেশ সরকারের রেজিষ্ট্রেশন নং: ১৯ (৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে)।. ৫ম সংখ্যা থেকে পত্রিকার উপরে শ্লোগান নির্দেশাবলী ও প্রথম পৃষ্ঠার নিচে একটি করে আবেদন থাকতাে যেমন বাংলাদেশকে জানতে হলে * বিপ্লবী বাংলাদেশ” পড়ন, ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ আপনি পড়ুন এবং অন্যকে পড়তে দিন। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামীদের মুখপাত্র, বিপ্লবী বাংলাদেশ’ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশেই রয়েছে ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে অবিচল ইত্যাদি ছিল। প্রধান কার্যালয় সদর রােড বরিশাল, বাংলাদেশ ভারতীয় প্রধান কার্যালয় বিপ্লবী বাংলাদেশ, হাসনাবাদ ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ কার্যালয় ২২/২৬ মনােশ্বর পুকুর রােড, কলি ২৯, ফোন ৪৭-৯১৪৯’লেখা হতাে। পত্রিকাটি মূলত মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল অটুট রাখা, জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত করা, যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে অবহিত করা সহ বেশ কিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ডায়েরী, গল্প, কবিতাও ছাপা হতাে। প্রথম সংখ্যায় ‘বিশ্ব বিবেকের কাছে আবেদন ও ১৯শ তম সংখ্যায় একটি প্রস্তাব ভূট্টোর নয়া খেলা’ শিরােনামে সম্পাদকীয় ছিল। ২৯ আগষ্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে লিখেছে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিযােদ্ধাদের জয় তত সুনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক প্রতিরােধ বাহিনী, গেরিলাযুদ্ধ জোরদার হচ্ছে, পাক সৈন্য খতম হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তাঞ্চল। ৭ই নভেম্বর সংখ্যায় একটি শিরােনামে যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন করে উঠেছে অমৃত, দেরী নেই আর, উঠিয়াছে হলাহল, থামিনে তােরা চালা মন্থন’। পত্রিকাটির প্রবাস সংখ্যা ৪ঠা আগষ্ট শুরু হয়েছিল এবং শেষ সংখ্যা বের হয় ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৭১। পরবর্তীতে বিপ্লবী বাংলাদেশ’ সাপ্তাহিক হিসেবে ২১ বছর বের হওয়ার পর ১৯৯১ সালের ৯ জুলাই পত্রিকাটি সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক এ রূপান্তরিত হয়। বিপ্লবী বাংলাদেশ সম্পর্কে কোলকাতার ‘কম্পাস’ পত্রিকা মন্তব্য করেছিল এ ভাবে পত্রিকাটি একটি দূর পাল্লার কামানের চেয়েও শক্তিশালী’ । ভারতের বহুল প্রচারিত পত্রিকা ‘ব্লিৎস’ বিপ্লবী বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে পত্রিকাটির প্রশংসা করেছিল বিপুলভাবে।”
৪০. মায়ের ডাক
‘মায়ের ডাক’ সম্পাদিকা সালেহা বেগম, একমাত্র মহিলা যিনি এ ধরনের একটি সাপ্তাহিকী পরিচালনা করতেন। এ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি অধ্যক্ষ শেখ আবদুর রহমান (সদস্য,
প্রাদেশিক পরিষদ) ছিলেন। মায়ের ডাক প্রেস, মুজিবনগর থেকে মুদ্রিত এবং শ্রীমতি নীলিমা দে কর্তৃক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। যােগাযােগের ঠিকানা ছিল প্রধান কার্যালয়: মুজিবনগর, বাংলাদেশ। আর অন্যান্য জায়গায় ছিল যেমন – মায়ের ডাক, মিউনিসিপ্যাল ট্যাঙ্ক রােড, খুলনা। মায়ের ডাক, বাগেরহাট, খুলনা। খুরশিদ আরা ইয়াসমিন, এ এ ১৮৬ লবনুহদ, কলিকাতা ৪৮। জামরুলতলা, বসিরহাট, ২৪ পরগনা। প্রথম প্রকাশ সম্পকে জানা যায় না। ২য় সংখ্যা ২২শে অক্টোবর, শুক্রবার ১৯৭১ এবং বাংলায় ৪ কার্তিক, ১৩৭৮ প্রকাশিত হয়। মায়ের ডাক’ ছিল বাংলাদেশের সংগ্রামী মহিলাদের একমাত্র মুখপত্র। মুক্তিযুদ্ধে মা-বােনেরাও পিছিয়ে ছিল না। বাংলাদেশের প্রতিটি মায়ের প্রাণের কথা ও সংগ্রামী ভূমিকা ফুটে উঠে ‘ মায়ের ডাকের মাধ্যমে। প্রচারিত হতাে প্রতি শুক্রবার। বাংলাদেশ সরকার রেজিস্টার্ড নং: ১৭, মূল্য ১৫ পয়সা, ৪ পৃষ্টায়, ৫ কলামে প্রকাশিত হতাে। দ্বিতীয় সংখ্যার সম্পাদকীয় শীত আসছে, মায়েরা তৈরী হােন ছিল। স্বাধীনতার পর বাগেরহাট থেকে সম্পাদিকা পত্রিকাটি পুন:প্রকাশ করেছিলেন।
৪১. মুক্ত বাংলা (১) | সাপ্তাহিক মুক্ত বাংলা পত্রিকাটি সিলেট জেলা, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামীদের মুখপত্র ছিল। ৬ষ্ঠ সংখ্যায় দেখা যায় পত্রিকার নামের নিচে বন্ধনীতে লেখা হয়েছে MUKTOBANGLA. The weekly mouth piece of the liberation movement of Bangladesh, Sylhet district Zone. PICIG COTT সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবুল হাসনাত সাআদত খান ‘মুক্ত বাংলার সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ও পরিচালক। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম সিলেট জেলার প্রখ্যাত সুসাহিত্যিক। আবুল হাসনাত কর্তৃক মুক্তবাংলা প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। এ সাপ্তাহিকীটি সিলেট জেলা (করিমগঞ্জ) থেকে প্রকাশিত। তাছাড়া এটি আসাম থেকেও প্রকাশ হতাে। ভারতীয় ঠিকানা: প্রযত্নে এ,এম চৌধুরী, করিমগঞ্জ, আসাম ছিল। পত্রিকাটির শুভেচ্ছা মূল্য ২০ পয়সা লন্ডনে সডাক ১ (এক) টাকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ এবং কলাম সংখ্যা ৪ ছিল। ছাপাও ছিল সুন্দর ও ঝকঝকে। প্রথম প্রকাশ ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। মুক্তবাংলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে সিলেট জেলার ভূমিকাকে যথাযােগ্যভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা – অর্থাৎ সিলেট জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের তৎপরতা এবং জেলার জনসাধারণের প্রকৃত মনােভাব প্রবাসী সিলেটীরা যাতে সঠিকভাবে বুঝিতে পারেন তার চেষ্টা করা। ৩য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ৪ঠা অক্টোবর ১৯৭১ এবং এর প্রধান সংবাদ শিরােনাম ‘জয় নিপীড়িত প্রাণ ! জয় নব অভিযান ! জয় নব উত্থান’ দেখা যায়’। আর ২৭শে নভেম্বর দশম সংখ্যায় বাংলার জলে -স্থলেঅন্তরীক্ষে এখন চতুর্দিকে যুদ্ধ চলছে’, সিলেটে হার্মাদেরা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ’, জকিগঞ্জে বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়েছে’ এবং ‘বাংলাদেশের স্বীকৃতি আসন্ন’ ছিল সংবাদ শিরােনাম।”
৪২. মুক্তবাংলা (২) | ‘মুক্তবাংলা’র সম্পাদনায় ‘দ-জ’ । সম্পাদকের নাম পত্রিকাটিতে সাংকেতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রকাশকের ঠিকানা গােপন রাখা হয়েছে। মুক্তবাংলা প্রকাশনী, বাংলাদেশ লেখা হতাে। পত্রিকাটি শক্রসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের কোন স্থান থেকে সাইক্লোস্টাইলে প্রকাশিত এক পাতায়। ক্ষুদে পত্রিকা। এটা একটা বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বলে প্রতীয়মান হয়। বর্ষ ও সংখ্যা অনুল্লেখিত। ২৩ অক্টোবর, ১৯৭১য়ে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরােনাম ‘আত্নসমর্পণের হিড়িক’ ছিল।
৪৩. মুক্তি (১) ‘মুক্তি’ সম্পাদক শরিফউদ্দীন আহমেদ। এটি মুক্তিযুদ্ধভিওিক মাসিক সাহিত্যপত্র। প্রদীপ্ত সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকাটি শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশ হতে সাইক্লোষ্টাইলে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১লা কার্তিক, ১৩৭৮ (অক্টোবর, ১৯৭১)। | এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘বাংলাদেশে আজ যুদ্ধ। যুদ্ধের পটভূমিতে সাহিত্য রচনা আজ বাংলার | লেখক-লেখিকাদের অবশ্য কর্তব্য। অধিকৃত বাংলার প্রগতিবাদী সাহিত্যিকরা যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র | ধরেছে। অস্ত্রের ভাষায় কলম ধরেছে। তারই কলম এই মুক্তি পত্রিকা। এই মাসিক সাহিত্যপত্রটি বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পটভূমিতে গণসাহিত্য ছিল।
৪৪. মুক্তি (২)। | ‘মুক্তি’ একটি পাক্ষিক সাময়িকী । সম্পাদক ছিলেন সাহাবুদ্দিন খান। প্রথম প্রকাশ ২ অগ্রহায়ণ | ১৩৭৮। পত্রিকাটি সাইক্লোষ্টইল করে ঢাকার আড়াইহাজার থানা থেকে প্রকাশিত হতাে।”
৪৫. মুক্তিযুদ্ধ
‘মুক্তিযুদ্ধ’ বাঙলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র। সম্পাদকের নাম সাংকেতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং প্রকাশকের ঠিকানা গােপন রাখা হয়েছে। এ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানের (বাঙলাদেশের) কমিউনিষ্ট পাটি কর্তৃক প্রকাশিত ও মুক্তিযুদ্ধ প্রেস বাঙলাদেশ হইতে | মুদ্রিত । প্রথম প্রকাশিত হয় জুলাই, ১৯৭১ এবং ২য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮ জুলাই, রবিবার, ১৯৭১। | ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৭১, রবিবার পর্যন্ত এর ২৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রতি সংখ্যার মূল্য ১০ পয়সা এবং এর কলাম সংখ্যা ৫। দুই রং-এ ছাপা এই পত্রিকাটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামরিক সংবাদ ছাড়াও থাকতাে কিছু কিছু সুচিন্তিত বিশ্লেষক নিবন্ধ । অনিল মুখার্জি লিখিত “আমাদের স্বাধীনতা | সংগ্রামের পটভূমি’ নামক গ্রন্থটি এই পত্রিকাতেই প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ২৬শে ডিসেম্বর প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম শিরােনাম ‘মুক্তির আনন্দে উচ্ছল সােনার বাঙলা’ এবং সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়ার সাথে ভুট্টোরও বিচার চাই’ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। বাঙালির চলমান আন্দোলন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মতামত, দেশের পরিস্থিতি, মুক্তি সংগ্রামে সংগঠিত হবার | ঘটনাবলি জনগণ খুব সহজেই এর মাধ্যমে পেয়ে যেতাে।
| ৪৬, রণাঙ্গন (১) | ‘রণাঙ্গন’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রণদূত’ এবং ছদ্মনামে এর সম্পাদকের নাম প্রকাশিত হতাে। সহযােগী সম্পাদনার দায়িত্বে ফারুক আহমেদ ছিলেন। আর এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। পত্রিকার নামের নিচে মুক্তি ফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র’ কিংবা ‘মুক্তি বাহিনীর সাপ্তাহিক মুখপত্র এভাবে লেখা রয়েছে। হাতে লেখা সাইক্লোষ্টাইলে করা ছােট আয়তনের এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১১ জুলাই, ১৯৭১। এটি টাঙ্গাইল জেলা মুক্তি ফৌজের বেসামরিক দফতর থেকে প্রকাশিত হতাে। প্রীতিমূল্য ৫০ পয়সা এবং পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ ছিল। বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবর এবং | কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর বীরত্বের সংবাদ এতে প্রাধান্য পেতে বেশী। পত্রিকাটির ১১ জুলাই সংখ্যার [সম্পাদকীয়ের শেষােক্ত উচ্চারণ ছিল এরূপ ‘ আমরা শান্তি চাই। কিন্তু কবরের শান্তি চাই না। এবার আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব – আঘাতের পর আঘাত হেনে দস্যু হানাদারদের খতম করব। জয় বাংলা’।
৪৭. রণাঙ্গন (২)
সাপ্তাহিক রণাঙ্গন’ সম্পাদক মুস্তাফা করিম কর্তৃক পত্রিকাটি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল পাটগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার নামের উপরে ‘মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র’ কথাটি লেখা হতাে। বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত রেজিষ্টার্ড নং ২১ ছিল। পত্রিকাটির কলাম সংখ্যা ৩-৪ এবং মূল্য পনের পয়সা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা মতিয়র রহমান এম,এন.এ., প্রধান পৃষ্ঠপােষক করিম উদ্দিন আহমেদ এম.পি,এ, যুগ্ম সম্পাদক এম.এ.সালেহ ও সুভাষ চন্দ্র নন্দী এবং সার্কুলেশন ম্যানেজার: এম.এ. করিম ছিলেন। ১৯৭১, ২রা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংখ্যার প্রথম পাতার প্রধান শিরােনাম ‘ ডিসেম্বরে বাঙলা মুকত’, ‘বাঙলা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মহিলা গেরিলা বাহিনী’ এবং সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়ার রণ-উন্মাদনা’ ছিল। পত্রিকাটির শুরু প্রথম কবে ও শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল জানা
যায়নি।
৪৮, রণাঙ্গন (৩)
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রংপুর থেকে রণাঙ্গন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতাে। প্রকৃতপক্ষে ভারতে এটির মুদ্রণ কাজ সম্পন্ন হতাে এবং বিভিন্ন পথে মাঝে মধ্যেই রংপুরে এর কপি পাঠানাে হত। এখানকার লােকদের মনােবল অটুট রাখার মানসে। এর সম্পাদক ছিলেন খন্দকার গােলাম মােস্তফা। বাটুল। ৭৫
৪৯, লড়াই | ‘লড়াই’ পত্রিকাটি মুক্তাঞ্চল থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। সম্পাদক, প্রকাশক কিংবা প্রকাশনার। কোন তারিখ সংগৃহীত পত্রিকাটিতে উল্লেখ নেই। পত্রিকার নামের নিচে ‘পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন ১ লিখিত এবং ডান পাশের একটি বক্সে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে। শত্রুর মােকাবেলা কর – বঙ্গবন্ধু’ এই অমােঘ বাণীটি লিপিবদ্ধ ছিল। এটি একটি অনিয়মিত পূর্বাঞ্চলীয় । যুদ্ধ বুলেটিন। ৪ কলাম বিশিষ্ট এ পত্রিকার মূল্য দশ পয়সা। পত্রিকাটিতে যুদ্ধ, যুদ্ধের সাফল্য, অগ্রগতি ও রাজাকার সম্পর্কিত লেখাই বেশি ছাপা হয়েছে। বুলেটিন ১’ এর সম্পাদকীয় লেখা হয়। ‘অস্ত্রেই আমাদের অস্তিত্ব’ নিয়ে। প্রথম পাতার শিরােনাম ‘এবার মুক্তিবাহিনী হানাদার শক্রর উপর বিমান ও নৌ আক্রমণ চালাৰে’, ‘কসবায় তুমুল সংঘর্ষ’, মুজিবের কিছু হলে স্বাধীনতার পরও আমাদের যুদ্ধ চলবে ‘, ‘২৫০ জন খানসেনা খতম’ ছিল। পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন ২’ এর প্রধান সংবাদ শিরােনাম নিয়াজির গােপন রিপাের্ট – পাক সৈন্যরা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে ছিল।
৫০. স্বদেশ
‘স্বদেশ পত্রিকাটি জাতীয়তাবাদী বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। পত্রিকাটি। সম্পাদক গােলাম সাবদার সিদ্দিকী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং তত্ত্বক বর্নালী প্রেস। বাংলাদেশ (খুলনা) থেকে মুদ্রিত। প্রথম আত্নপ্রকাশ ঘটে ১৬ জুন, বুধবার ১৯৭১ এবং এই সংখ্যার শেষ পাতার নিচে প্রকাশনার স্থানে ইংরেজিতে “The Swadesh: Voice of National Banglaclesh’ লেখা। ছিল। পত্রিকাটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদেয় রেজিষ্ট্রেশন নংঃ৪ এবং মূল্য ২০ পয়সা ছিল। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ‘আমাদের লক্ষ্য মৃত্যু অথবা জয়লাভ’ এবং সংবাদ শিরােনাম ‘বিদায় ইয়াহিয়া বিদায় ছিল। ১৪ ডিসেম্বর এই পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল ‘আসন্ন। যুদ্ধের জন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত হউন। স্বদেশে আরাে ছাপা হয়েছে নিউজউইকের লেখার অনুবাদ, কিছু। শ্লোগান ‘কলেরার টিকা নিন’, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনুন’, গ্রামে গ্রামে প্রতিরােধ
গড়ে তুলুন’, গুজব ছড়াবেন না’ ইত্যাদি। তাছাড়াও ব্যক্তিগত নিবন্ধে কোন শহীদ সহকর্মী বা বন্ধুর। কথা, মুক্তাঞ্চলের খবর, যুদ্ধ বা এ ধরনের নানা খবর।
৫১. স্বাধীনতা (প্রতিরােধ)
‘স্বাধীনতা (প্রতিরােধ)’ নামক কাগজটি পাক্ষিক ছিল এবং এর নির্দিষ্ট কোন সম্পাদক ছিল না। পত্রিকা প্রকাশনা ও লেখালেখির সাথে যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কুতুবুর রহমান। ঢাকা থেকে সাইক্লোষ্টাইলে প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে পত্রিকাটির। নাম স্বাধীনতা থাকলেও বদলে প্রতিরােধ করা হয়। মােট ৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
৫২. স্বাধীনতা | ‘স্বাধীনতা’ কবি অরুনাভ সরকার সম্পাদিত চার পৃষ্ঠার পত্রিকা। এ সংক্রান্ত অন্য আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ৭৯
৫৩. স্বাধীনবাংলা (১)
| ‘স্বাধীনবাংলা’ পত্রিকাটি ছিল কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূৰ্ব্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের পাক্ষিক মুখপত্র। পত্রিকাটি কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। দাম দশ পয়সা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ এবং কলাম সংখ্যা ৪ ছিল। প্রথম কবে প্রকাশিত হয় জানা যায়নি। সংগৃহীত ৩য় সংখ্যা ১লা নভেম্বর, সােমবার, ১৯৭১ আর বাংলায় ১৪ কার্তিক, ১৩৭৮য়ে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যার পত্রিকার নামের বাম পার্শ্বে বক্সের ভেতর আমাদের সামনে হাজার হাজার শহীদ বীরত্বের সঙ্গে জনগণের স্বার্থে প্রাণ বলি দিয়াছেন। তাহাদের সেই পতাকা উর্দ্ধে তুলিয়া আসুন আমরা আগাইয়া চলি তাহাদের সেই রক্ত চিহ্ন ধরিয়া’ লেখা ছিল। এই সংখ্যার সম্পাদকীয় ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আকাশে অশুভ কালাে মেঘের ছায়া ! মুক্তিযােদ্ধারা হুশিয়ার ও প্রধান সংবাদ শিরােনাম যেমন ‘মাঠে মাঠে এত রক্তের ঢেউ কি দামে ভাই কসম বন্ধু, খুনীদের কাছে জবাব চাই’, ‘আমেরিকান চক্রান্ত পরাজিত: জাতিসঙ্ েচীনের আসন দখল ইত্যাদি সংবাদ প্রতিবেদন। ছাড়াও অন্যান্য আরাে অনেক খবর প্রকাশিত হয়।
৫৪, স্বাধীন বাংলা (২)
সরকার কবীর খান কর্তৃক বাংলা দেশের মুক্ত অঞ্চল হইতে সম্পাদিত ও প্রকাশিত ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তি বাহিনীর সাপ্তাহিক মুখপত্র ছিল। বাংলা দেশ মুক্তি সংস্থা (উত্তর পূর্ব এলাকা) কর্তৃক অনুমােদিত এ লাইনটি পত্রিকার শেষ পাতার নিচে লেখা ছিল। সংগৃহীত পত্রিকাটির প্রকাশ তারিখ ও এ সংক্রান্ত অন্য কিছু জানা যায়নি। তবে মূল্য লেখা ছিল ১০ দশ পয়সা আর এর কলাম সংখ্যা দুই ছিল। পত্রিকার নামের সাথে ডান দিকে ছােট করে মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জয়যুক্ত হতে বাধ্য লেখা ছিল। সম্পাদকীয়তে লেখা হয় “রক্ত আখরে লেখা একটি নাম – স্বাধীন বাংলা দেশ” । শেষ পাতায় ‘রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে সৈয়দ নজরুলের চার দফা’ শীর্ষক স্বাধীন বাংলা দেশের। উপরাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি শর্ত আরােপ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে ভাষণ দান করেন তা ছাপানাে হয়। শর্তগুলাে ছিল : ১, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান ও নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের
| বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে । ২. বাংলা দেশের মাটি থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
|
৩. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ৪. আড়াই মাস ধরে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর ব্বরােচিত আক্রমণের ফলে বাংলা দেশের জন
সাধারণের যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতি পূরণ দিতে হবে।”
৫৫. স্বাধীন বাংলা (৩) | স্বাধীন বাংলা’ (সােনার দেশ) পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকা মিসেস জাহানারা কামরুজ্জামান। সম্পাদক এস, এ, আল মাহমুদ চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এবং বলাকা প্রেস জামালগঞ্জ, রাজশাহী, বাংলাদেশ হতে এম এ মজিদ কর্তৃক মুদ্রিত। প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন এ এইচ কামরুজ্জামান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, বাংলাদেশ সরকার। পত্রিকাটি প্রথম জুন, ১৯৭১ প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। পত্রিকায় সােনার দেশ’ কথাটি পত্রিকার নামের নিচে ছােট করে বন্ধনীতে এবং দুপাশের বক্সে ‘সােনার বাংলা আজ শ্মশান কেন? জাতির পিতা শেখ মুজিব’ এবং এ বাংলাকে বাচাঁতেই হবে, শেখ মুজিব’ – লেখা দেখা যায় পত্রিকাটির ১২ জুলাই সংখ্যটিতে। এ সংখ্যার পত্রিকাটির মূল্য রাখা হয় ১৫ পয়সা। তাছাড়াও স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে এ সংখ্যার পত্রিকাটি নিজেকে পরিচয়। দেয়। ৭ম সংখ্যা ১২ জুলাই এর প্রধান সংবাদ প্রতিবেদনের শিরােনাম ‘বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি। অন্তিম আবেদন বাংলার নারীদের বাচান ছিল। এ সংখ্যায় একটি নগ্ন মহিলার ছবি ছাপা হয়। ক্যাপশান ছিল ‘৯ জন পাক পশু সেনার ধর্ষণে মৃত রমণী। তার হাতের চুড়িগুলাে এখনাে বলছে ‘আমি ঘরের বৌ ছিলাম। নিচে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় যে নগ্নাবস্থার জন্য তার পরিচয় গােপন রাখা। হয়েছে। এরপরে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দেয়া হয়।
৫৬. স্বাধীন বাংলা (৪) | ‘স্বাধীন বাংলা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয়। সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি খােন্দকার সামসুল আলম দুদু কর্তৃক মুজিব নগর হতে প্রকাশিত ও স্বাধীন বাংলা প্রেস হতে মুদ্রিত। পত্রিকাটির মূল্য ১৫ পয়সা। ৩য় সংখ্যা প্রকাশিত হয় মুজিবনগর থেকে ১৪ই জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮, শনিবার এবং এর সম্পাদকীয় এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ও প্রত্যেক গেরিলা যােদ্ধাই সমাজ সংস্কারক এবং প্রধান সংবাদ শিরােনাম ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়: জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নােয়াবার নয় ছাড়াও নানাবিধ খবর প্রকাশ পায়। প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি সিঙ্গেল শিটে (২ পৃষ্টায়) প্রকাশিত হলেও পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যাটি আবার চার পাতায় প্রকাশ পায় শনিবার ১০ জুন, ১৯৭১ এবং যার মূল্য রাখা হয়েছিল ১৫ পয়সা। এ সংখ্যায় পত্রিকার নামের ওপরে ছাপা হয় সুকান্তের কবিতার দুটি পঙক্তি “প্রিয়ারে আমার কেড়েছিস তােরা ভেঙেছিস ঘরবাড়ি, সে কথা কি আমি জীবনে মরণে কখনও ভুলিতে পারি!’ এ সংখ্যার প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন ও নিবন্ধের শিরােনামগুলি যেমন ছিল বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহবান’, ‘জয় আমাদের হবেই’ ইত্যাদি। এ সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ‘আপােষ নয় – দুহাতে বাজাও প্রতিশােধের দামামা। তা ছাড়া তবুও মােরা রহিব বাঁচিয়া’ নামে একটি কবিতাও এ সংখ্যায় প্রকাশ পায়।
৫৭. স্বাধীন বাংলা (৫) | কাজী জাফর, মেনন প্রমুখের পূর্ব বঙ্গের কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি কর্তৃক এই। পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৫ অক্টোবর। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই গ্রুপটি তখন সােভিয়েট বিরােধী বামপন্থীদের নিয়ে পৃথক একটি কমিটি গড়ে ছিলাে । পত্রিকাটি সকল স্বাধীনতা কামী শক্তির মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য আহবান করে যদিও আওয়ামী লীগ এই ডাকে মােটেই সাড়া দেয়নি। পত্রিকাটি
দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের সমর্থক ছিল। ১লা নভেম্বর সংখ্যায় বলা হয়, ‘ভারতের জনগণ ও সরকার
আমাদের নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য প্রদান করিতেছে। … আর ইহাও অনস্বীকার্য সত্য যে কোন | বিদেশী রাষ্ট্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হইয়া একটি দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলতে পারে না। ইমামুর রশীদ তার এক প্রবন্ধে এই পত্রিকা সম্পর্কে লিখেছেন – পাক্ষিক এই পত্রিকাটি ১লা অক্টোবর প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপান্তরের পক্ষপাতী এবং দীর্ঘকালীন গেরিলা যুদ্ধের সমর্থক ছিল। এ জন্যে স্বাধীনতাকামী শক্তির মধ্যে ব্যাপকতর ঐক্যের আহবান জানিয়েছিল পত্রিকাটি।
৫৮. স্বাধীন বাংলা (৬) | ‘স্বাধীন বাংলা একটি দৈনিক পত্রিকা। চৌমুহনী, নােয়াখালী থেকে আ.ম.ম. আনােয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রকাশিত। ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছাপা হয়।
৫৯. সংগ্রামী বাংলা (১)
‘সংগ্রামী বাংলা’ পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপােষক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন। প্রধান সম্পাদক আবদুর রহমান সিদ্দীক এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ আবদুল মতিন ছিলেন। পত্রিকাটি বাংলাদেশের মুখপত্র ছিল বলে পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় এবং এটি সংগ্রামী বাংলাদেশ প্রেস ঢাকা হইতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতাে। প্রকাশ ও মুদ্রণে ছিল আবদুর রহমান সিদ্দিক। পত্রিকাটির | রেজিষ্ট্রেশন নং: ২২, কলাম সংখ্যা ৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ এবং বিক্রয় মূল্য ২০ পয়সা ছিল। ১৮ই
অক্টোবর, ১৯৭১ (৩১ আশ্বিন ১৩৭৮, সােমবার) বিপ্লবী আলী আসাদ সংখ্যা হিসেবে পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ পায়। আলী আসাদ ১৯৫৯ সালের দিকে গঠিত পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন এবং তার নামেই পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয় । ঈদ বিশেষ সংখ্যা ২৩ নভেম্বর, | ১৯৭১ এবং বিপ্লবী ফজলুর রহমান সংখ্যা ২৭শে নভেম্বর ১৯৭১ (৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮, শনিবার) বের | হয়। অনিয়মিত হলেও পত্রিকাটির বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নিবন্ধাদি প্রকাশ করে।
৬০. সংগ্রামী বাংলা (২)
আগষ্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের খবর জনগনের মাঝে পৌছনাের লক্ষ্যে এ্যাডভােকেট সিরাজুল ইসলাম, এম,পি’র উপদেশ ও পৃষ্টপােষকতায় ঠাকুরগাঁও সরকারী কলেজের ছাত্র এমদাদুল হক প্রধানের সম্পাদনায় ‘সংগ্রামী বাংলা’ নামের এ দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। সংগ্রামী বাংলা প্রেস তেতুলিয়া হতে এমদাদুল হক কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত। পত্রিকার বিনিময় মূল্য ১০ পয়সা, পৃষ্টা সংখ্যা ২ এবং কলাম সংখ্যা ৪ এবং ছাপা ঝকঝকে ছিল। বিশেষ ঈদ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়। এবারের ঈদকে আমরা বরণ করেছি’ ঈদ মােবারক হিসেবে নয় বরং সংগ্রামী ঈদ হিসেবে। বাংলার বুকে ঈদগাহে আজ মানুষ নাই কারণ পশুর সাথে মানুষেরা একত্রে নামাজ পড়তে পারি না।’ ৮ম সংখ্যা, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১-য়ে প্রকাশিত প্রথম পাতার প্রধান সংবাদ শিরােনাম ‘বিভিন্ন এলাকা। মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’ এবং সম্পাদকীয় স্বাধীন। সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি’ লেখা প্রকাশ পায়।
৬১, সাপ্তাহিক বাংলা মাইকেল দত্তের সম্পাদনায় বাংলাদেশের মুজিবনগর ও সিলেট থেকে এক যােগে প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক বাংলা’ পত্রিকার নামের নিচে লেখা থাকতাে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। এই পত্রিকাটি রূপসী বাংলা প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স এর পক্ষে বিজয় কুমার দত্ত কর্তৃক মুদ্রিত। পত্রিকার নামের দুই পাশে বক্স করে বিভিন্ন কবিতার ৩-৪টি লাইন প্রকাশিত হয়। কবিতার প্রকাশ ছিল | উদ্দীপনা, দেশপ্রেম, ভালবাসা ইত্যাদি। এর প্রথম প্রকাশকাল ইংরেজি ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ এবং বাংলায় ৩০ ভাদ্র, ১৩৭৮, বৃহস্পতিবার। প্রকাশিত হতাে দামী কাগজে, ছাপা ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন, আর মূল্য ছিল ৩৫ পয়সা। আলােকচিত্র সম্বলিত এই পত্রিকার পৃষ্টা সংখ্যা ৮ ও কলাম সংখ্যা ৬ ছিল। বিদেশস্থ যােগাযােগের ঠিকানা ছিল কলকাতা ৩ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা ৯। আগরতলা ৮/১ রামনগর সেকেন্ড রােড, আগরতলা। করিমগন্জ: ওল্ড স্টেশন রােড, করিমগঞ্জ, কাছাড় । লন্ডন: মি: নিজামুদ্দিন, ৪৫ আফার রােড, লন্ডন এন/১। কলকাতায় সাপ্তাহিক বাংলার একমাত্র পরিবেশক ছিল ‘হরিলাল এন্ড কোম্পানী’ ঠিকানা ছিল ৫ ধর্মতলা স্ট্রীট, কলকাতা। পত্রিকাটির সাতটি সংখ্যার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৬ই সেপ্টেম্বর প্রথম সম্পাদকীয় যাত্রা হােল শুরু’, কালপেঁচার আর্তনাদ’ এবং প্রধান সংবাদ শিরােনাম কূটনীতির পথে নয়, রণনীতির মধ্যেই বাংলার মুক্তি’ বলে প্রকাশ পায় । পত্রিকাটি সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার ওপর জোর দিয়ে লেখা হতাে। ২৬ সেপ্টেম্বর এর সংখ্যায় সঞ্জিব চৌধুরী স্বাধীনতা’: ভিক্ষায়ং নৈব নৈব চ’ এই শিরােনামে এক | প্রতিবেদনে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পাকিস্তান দুভাগ হয়ে গেলে যে টাকা পাকিস্তানকে ধার দিয়েছে তা ফেরত পাবে না। … বাংলাদেশ ক্রমশ বামপন্থী রাস্তা ধরবে। চীন মনে করে স্বাধীন হলে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসবে… ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। তার চেয়ে যদি পাকিস্তান টিকে থাকে এবং চীন পাকিস্তানের বন্ধুত্বের সুযােগে চীন পন্থীরা বাংলাদেশ সংগঠিত হবার সুযােগ পায় মন্দ কি?”… রাশিয়ার বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানাে আর সক্রিয় সমর্থন করা এক নয় । রাশিয়ার বর্তমান স্ট্রাটেজিই হলাে কারাে সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলা। বিশ্বের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভিক্ষার মাধ্যমে কোন জাতির কোন ন্যায্য দাবী আদায় হয়নি। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়ােজন সর্বান্তিক সংগ্রাম।
৬২. সােনার বাংলা (১) | ‘সােনার বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন সরকার কবীর খান। প্রধান উপদেষ্টা মতিউর রহমান এবং কে.জি. মােস্তফা কর্তৃক সােনার বাংলা প্রেস থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হতাে। ১২ই জুন শনিবার, ১৯৭১য়ে উদ্বোধনী সংখ্যা প্রকাশ পায়। পত্রিকাটির রেজিষ্ট্রেশন নং: ৩, মূল্য পনর পয়সা এবং ভারতে ২০ পয়সা ছিল। এটি মুক্তিবাহিনীর মুখপত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। সােনার বাংলা পত্রিকার বিশেষ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের এপারে ওপারে, মুক্তিযুদ্ধের অনূকুলের প্রেরণাকে সদাজাগ্রত রাখতে যথাসাধ্য সাহায্য করা। কর্মাধ্যক্ষের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে আবেদন ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এই পত্রিকা বিনামূল্যে পৌছে দেয়া এবং প্রচার করতেন আপনি এক কপি কিনলে তারা এক কপি পান। সুতরাং আপনার সহায়তা আমরা প্রার্থনা করছি। পত্রিকাটির ৪র্থ সংখ্যার সংবাদ শিরােনাম ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুক্তিবাহিনী জয়মাল্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এর ৬ষ্ঠ সংখ্যার সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল মুক্তি যােদ্ধা লহ সালাম”। সংবাদ ছাপানাে ছাড়াও পত্রিকাটিতে বিভিন্ন ফিচার, চিঠিপত্রও প্রকাশিত হতাে। ৮ম ও ৯ম সংখ্যা প্রকাশনার তারিখ ৩১ অক্টোবর, ১৯৭১ ছিল। শেষ সংখ্যা ও প্রকাশনার তারিখ পাওয়া যায়নি। অলিউর রহমান তার প্রবন্ধে স্বাধীনতার প্রশ্নে পত্রিকাটি আপসহীন ভূমিকা পালন করে বলে উল্লেখ করেন।”
৬৩. সােনার বাংলা (২)
‘সােনার বাংলা বাংলাদেশের সাপ্তাহিক মুখপত্র। প্রথম প্রকাশ (উদ্বোধনী সংখ্যা) ১৪ আগষ্ট, | ১৯৭১। দ্বিতীয় সংখ্যা ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ থেকে পত্রিকার নাম ‘সােনার বাংলা’ পরিবর্তন করে
বাংলার কথা’ রাখা হয় এবং পরিচালনায় দেখা যায় এর ব্যাপক রদবদল । সম্পাদক ওবায়দুর রহমান ও সহযােগী সম্পাদক মজিবর রহমান। উপদেষ্টা পরিষদ ড়া মুহাম্মদ আলাউদ্দিন (এমপিএ), রাজশাহী। সহসভাপতিঃ মুহ: আবদুল হাদী এমপিএ রাজশাহী। সভ্যবৃন্দ ছিলেন আবদুল্লাহিল বাকী, এম.এ সােবহান, আবদুস সামাদ, মুহ:মহসীন। ‘অবকাশ মুক্তনগর রাজশাহী বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত ও প্রকাশিত । বিনিময় মূল্য কমপক্ষে ৩০ পয়সা, ছাপা ঝকঝকে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬, কলাম সংখ্যা। ৪ ছিল। পত্রিকার ফুটে ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ (১ সংখ্যা) লেখা আছে। প্রথম। সম্পাদকীয় লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ কি কেন’। বঙ্গবন্ধুর বাণী। সংবাদ শিরােনাম গুলি ছিল এরূপ ‘ শেখ মুজিবের বিচার ? খুনী এহিয়ার ধৃষ্টতা’, ‘বাংলাদেশের ডাকটিকিট, পনেরজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিকের বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার’ ইত্যাদি ছাড়াও বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।”
৬৪. সােনার বাংলা (৩)
‘সােনার বাংলা’ মূলত সাপ্তাহিকী হলেও শেষ দিকে প্রতিদিন এর সান্ধ্য সংস্করণ বের হতাে। প্রধান সম্পাদক ছিলেন এম এ শাহ (শাহ মােদাব্বির আলী), ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এ.বি.জালাল উদ্দিন। প্রকাশনা স্থল তামাবিল, সিলেট লেখা থাকতাে।”
৭। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা বিপুল হওয়ার কারণে একই খন্ডে সবগুলি বিষয়ের সংকলন সম্ভব হয়নি বিধায় বিভিন্ন পর্বে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তা পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। প্রথম পর্বে বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকার ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ এই তিনটি বিষয়ের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরা হলাে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুজিব, শেখ সাহেব, শেখ, শেখ মুজিবুর রহমান যে নামেই তিনি সম্বােধীত। হােন না কেন, তিনি আজ ইতিহাস। বিশেষত: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অনিবার্য অবিস্মরণীয় নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম। মুক্তির সংগ্রাম…’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৯৭১ রমনা রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক জনসভায় অন্তত: দশ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে প্রত্যয়দৃপ্ত কণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই । ঘােষণা দিয়েছিলেন ইতিহাসের কিংবদন্তীর এই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তত্বকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগােষ্ঠীকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশিত করেছিল। যিনি সৃষ্টি করেন স্বাধীন বাংলাদেশের এক অবিনশ্বর ইতিহাস। যে ইতিহাসের সূচনা ষাটের দশক থেকে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ পর্যন্ত।
| বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গােপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা)। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্য এবং কৈশাের জীবন। তিনি গ্রামেই অতিবাহিত করেন। স্কুলের ছাত্র জীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। সেই দিন থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে গেছেন। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর নির্বাচন, স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রবিরােধী আন্দোলন, ‘৫৮-এর সামরিক শাসনবিরােধী। আন্দোলন, আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের মতাে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু বছর কারান্তরালে কাটিয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামী হিসেবে স্পেশাল
ট্রাইবুন্যালে বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা থেকে অব্যাহতি পাবার পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাকে রমনা রেসকোর্স ময়দানে এক গণ-সম্বর্ধনা দেন। সেখানে ছাত্র নেতা তােফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শেখ মুজিবকে দশ লক্ষাধিক জনতার উপস্থিতিতে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অগ্রণী এবং এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ দেন। ‘৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণ যা ছিল বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত সংগ্রামের ঘােষণা। তার এই ঘােষণা পুরাে বাঙালি। জাতিকে পৃথিবীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুশিক্ষিত সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় খালি হাতে লড়াই করতে এবং লড়াইয়ে জিততে অনুপ্রাণিত করেছিল। | ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম। পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার প্রসঙ্গে ডেভিড ফ্রষ্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “… সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডাে বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলােচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনাে, না বেরুনাে নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম: আমি মরি, তাও ভাল, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক। … আমি ইচ্ছা করলে যে। কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করবাে। মৃত্যুবরণ করবাে। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহবান ছিল: তােমরা প্রতিরােধ গড়ে তােল।” ৯২ ২৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে। পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলি শেখ মুজিবের গ্রেফতার হবার কোন খবরই দেয়নি। শুধুমাত্র দেশদ্রোহীতার অভিযােগে শেখ মুজিবের বিচারের কথা ছাপিয়ে ছিল। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আনােয়ার হােসেন লিখেছেন – পাকিস্তTনের লায়ালপুর সামরিক জেলে ৭ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর গােপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহী ঘােষণা করে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাকে বন্দি করে রাখার। আসলে নানা শর্ত সাপেক্ষে শেখ মুজিবের বিচারের আয়ােজনে জেনারেল ইয়াহিয়া তার অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্যটি আড়াল করতে পারেনি। তথাকথিত প্রহসনের বিচারের অন্তিম লক্ষ্য ছিলাে একটা আইনী আবরণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূর্ত প্রতীক, প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধার মনে তীব্র দেশপ্রেম আর পাকবাহিনীর প্রতি জিঘাংসা – সঞ্চারকারী নেতা মুজিবকে হত্যা করা।” ১৮ পাকিস্তানি লেখক আহমেদ সলিম এর গ্রন্থ হতে শেখ মুজিবের গ্রেফতার, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন কারাগারে তার দুঃসহ দিন ও আটকাদেশসহ, প্রহসনমূলক বিচার এবং জুলফিকার আলী ভূট্টো কর্তৃক মুক্তি প্রদান ইত্যাদি প্রসঙ্গে অনেক অজানা তথ্য জানা যায়। * পাক সরকার একদিকে যেমন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালির প্রতিরােধ যুদ্ধকে, তেমনি সাড়ে সাত কোটি জনতার সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের নিঃসঙ্গ কারাগারে আবদ্ধ রেখে তার সংগ্রামী চেতনাকে ধ্বংস করে মৃত্যুদন্ড দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়ে যায় স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষের কাছে। রবার্ট পেইন যথার্থই লিখেছেন – * নিপাট এবং নিভাঁজ ইচ্ছাশক্তির এমন একটি মাত্রা শেখ মুজিবর রহমানের ছিল যা দিয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে বিজয় একদিন আসবেই। .. বন্দীত্বের সবটা সময়েও তিনি হতাশ হননি। বিজয়ের সূর্য যে উঠবেই এ ব্যাপারে তিনি আত্নগত নিশ্চয়তায় সময় গুনছিলেন। কোন চরম অবস্থায়ও ভাবতে পারতেন। যে বাঙালীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে নত হয়েছে বা হতে পারে। তিনি বলতেন, ‘আমি আমার জনগণকে জানি তাই হতাশ হবার কোন প্রশ্নই আসে না।’ – দেশবাসী তার প্রত্যাশা, বিশ্বাসের যথার্থ। মর্যাদা রেখেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববাসীর চাপের মুখে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন। দেশের শাসনভার গ্রহণ করার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল উশৃঙ্খল, ক্ষমতালােভী, প্রতিবিপ্লবী ও স্বাধীনতার চেতনা বিরােধী ষড়যন্ত্রকারীদের একটি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। কিন্তু তা সত্বেও ষাটের দশক থেকে তার মৃত্যুর প্রায় দুদশক পরও তিনি রয়ে গেছেন আলােচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই। নৃশংসতম ঘটনা এবং এর বিভিন্ন দিক পরবর্তী সময়ে অনেকের লেখায় উঠে আসে যেগুলাে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অসাধারণ বাগ্নিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অতুলনীয় নেতৃত্বের গুনেই আজ তিনি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন এদেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান আজ শুধুমাত্র একটি নামই নয়, একটি অপঠিত, অলিখিত ইতিহাস। এর। পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও এ ইতিহাসের যথাযথ মূল্যায়ন করাও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তার সংগ্রামী জীবনের ইতিবৃত্ত, আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক নেতৃত্বদান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়ােজনীয়তা আজ অনস্বীকার্য। এ গবেষণালব্ধ ইতিহাস হবে বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ। সব বির্তকের উর্ধ্বে উঠে এই ঘটনার মহানায়কের ভূমিকা ও অবস্থানের যথাযথ মূল্যায়ন ও সমমর্যদায় যদি তাকে জাতির সামনে তুলে ধরতে কিংবা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা যায়, তাহলে ইতিহাসের দায় থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবাে না। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বিরাট মােড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। নিঃসন্দেহে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর বঙ্গবন্ধু হলেন এ যুদ্ধের অনুপস্থিত সেনাপতি। শত্রু কবলিত পাকিস্তানিদের কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল যুদ্ধকালীন বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। একাত্তরে দেশের মানুষের কাছে যেমন, তেমনি বিদেশীদের কাছেও বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব সমার্থক শব্দ হয়ে মিশেছিল । বিশ্ব জনমতের প্রধান মাধ্যম পত্রপত্রিকাগুলি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও জোরালাে ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে যেভাবে সমর্থন করেছে, ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তানি শাসক চক্রের গণহত্যা ও সেনা অভিযানকে, তেমনি বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নি:শর্ত মুক্তির দাবিও করেছে। সেই সময়ে প্রকাশিত দেশি-বিদেশী পত্রিকাগুলির পাতায় যার প্রমাণ মেলে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটি অনিবার্যভাবেই চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের এই অংশে ২রা এপ্রিল থেকে ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত মােট ২৬টি পত্রিকা থেকে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত শিরােনাম বিশিষ্ট সংবাদগুলি তারিখের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পুন:সংকলন করা হয়েছে। সে সময়ের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত যে খবরগুলি ঘুরে ফিরে এসেছে তার মধ্যে ছিল যেমন – বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে জনগণ ও বিশ্ব জনমত’, ‘বঙ্গবন্ধু আটক ও নির্যাতনের প্রতিবাদে বিশ্বনেতৃবৃন্দের উদ্বেগ প্রকাশ’, ‘পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার। বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত’, ‘প্রহসনমূলক বিচারের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সৃষ্টি’, ‘বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনই মূল বিষয় এই ধরনের বিভিন্ন নানা শিরােনামে নানা স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ, সংবাদ ভাষ্য ও সম্পাদকীয়তে বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বিচার প্রহসন বন্ধ করার বিষয়টি প্রধান্য পেয়েছে বেশী বিভিন্ন সংবাদ এবং সংবাদ ভাষ্যে।
আবার বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার সম্পর্কে বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর সংবাদও প্রকাশিত হয় যেমন- ‘বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন শুরু, বেগম মুজিব করাচীতে’। কিছু কিছু সংবাদ ভাষ্যে অতিরিক্ত উচ্ছাস ও ভাবাবেগও প্রকাশ পেয়েছে। একজন মহান আদর্শিক অনুপস্থিত নেতার প্রতি সে দেশের যুদ্ধরত জনগণের এ ধরনের আবেগের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধের গর্ব মুজিবনগর। আর এ মুজিবনগরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। জাতির এক চরম দুর্যোগময় মুহুর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। দেশের একদল বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় যেখানে এক অর্থে সমগ্র বাঙালি জাতি অংশগ্রহণ করে। মুজিবনগর বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রাথমিক পর্যায় প্রসঙ্গে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম তার বইয়ে লিখেছেন, “পচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। সেখানকার এস.ডি.পি.ও. মাহবুব আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে। যান। মার্চের ৩০ তারিখে পশ্চিমবাংলা সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করে ২ এপ্রিল দিল্লীতে গমন করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহবান করেন।” | এ পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ তখনকার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের আলােকে অস্থায়ী সরকার গঠনের (পরিশিষ্ট) সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই লক্ষ্যে ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করে ১১ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে এক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করা হয়। অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয় এবং তাজউদ্দিন আহমদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সরকার গঠনের উদ্যোগটি যে কত জরুরী ও বাস্তবসম্মত ছিল মুক্তিযুদ্ধকে তার সফল পরিণতিতে নিয়ে যেতে তার প্রমাণ ইতিহাসই সাক্ষ্য দেয়। এর কিছুদিন পরে ১৭ এপ্রিল সকাল ১১:১০ মি: কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমাধীন (বর্তমানে জেলা) ভবেরপাড়া (মুজিবনগর) গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করেন। বিপুল শ্লোগান ও করতালির মাঝে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির হুইপ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা সনদের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক বক্তৃতা প্রদান করেন। এই সভায় কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘােষণা করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এই সভায় উপস্থিত জনতা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মন্ত্রীসভা ও সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন। এ অস্থায়ী সরকারের মােট সদস্য সংখ্যা ছিল মােট ছয় জন। অস্থায়ী সরকারের এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেশী-বিদেশী সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, টিভি ক্যামেরাম্যান, রাজনৈতিক নেতাসহ বিপুলসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা, জনতা উপস্থিত ছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ ও প্রথম মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এক শিরােনামে এসেছিল “মন্ত্রীরা শপথ নিলেন, জয়বাংলা ধ্বনির মধ্যে
প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রকাশ্য অভ্যুদয় বিশ্বের কোন শক্তি বাঙ্গালীর জয় যাত্রায় বাধা দিতে পারবে ” – বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দৃঢ় প্রত্যয়। ১৭ এপ্রিলের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সেই দিন এই স্থানের নাম রাখেন মুজিবনগর এবং বঙ্গবন্ধুর নামে ঐ সরকারের নামকরণ করেন মুজিবনগর সরকার। সেই থেকে মুজিবনগরকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘােষণা করা হয় । মুজিবনগর তাই স্বাধীনতাকামী বাঙালীর হৃদয়ে এক অনন্য স্থান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। সরকার গঠনের পর মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার দায়িত্ব অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশ সরকারের উপর বর্তায়। ফলে যুদ্ধে নিয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধা ও সশস্ত্র বাহিনীর লােকদের নিয়ে একটি সামরিক প্রশাসন গঠন করে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের চারটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটিও গঠন করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ২)। অস্থায়ী রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদ, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রী এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব:) এম.এ.জি ওসমানী এদের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হতাে। “নীতিনির্ধারণের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তাদের। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনায় আমরা, অর্থাৎ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিভাগের সচিববৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতাম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধান সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে। … সরকারের লক্ষ্য একটাই, যুদ্ধে জয়লাভ করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের তাবৎ কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে। এজন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কালবিলম্বের কোন অবকাশ ছিল না।” ১০৭ সরকার গঠন প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম তার বইয়ে লিখেছেন, “ আমাদের জন্য এই সরকার গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধের উপরে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে হওয়ায় এটা ছিল সম্পূর্ণ বৈধ সরকার। ফলে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন ধরনের প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আইনানুগ ক্ষমতাও ছিল তাদের। সরকার সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন সংগঠিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনকে সক্রিয়। রাখে । স্নায়ুযুদ্ধের টানাপােড়েন ও উপমহাদেশের বহু বিভক্ত স্রোত-উপস্রোতে ভাসমান রাজনৈতিক পটভূমিতে ১৯৭১-এ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। সে জনযুদ্ধে সাধারণ মানুষ যেমন শরিক হয়েছিল সর্বাত্নকভাবে, তেমনি নানা মত ও পথে বিশ্বাসী নেতারা তাদের অবস্থান থেকে নিজ নিজ দায়িত্বে সক্রিয় হয়েছিলেন। ফলে যাদের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল তাদের সকলেই ছিলেন জনগণের প্রতিনিধি, নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করার মত সত্যিকার দাবিদার। তাই সরকার গঠনের রাজনৈতিক ও আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তােলার কোন অবকাশ দেশেবিদেশে তেমন কারাে ছিল না। ফলে মুজিবনগর সরকার ছিল সকলের কাছে বৈধ সরকার। সেই সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছিল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালিত হয়েছিল, পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে সেই সরকারের নির্দেশ সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য ও মান্য হয়েছিল । | মুজিবনগর সরকার দেশবাসীকে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিল এবং সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক কর্মকান্ডই পরিচালিত হয়েছিল। পাকিস্তানের মত একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে নয় মাস লড়াই করে বিজয় অর্জন করা মুক্তিকামী বাঙালির জন্য সত্যিই একটি কঠিন দুরুহ কাজ ছিল । কিন্তু তারা বিশ্ববাসীকে উপলব্ধি করাতে পেরেছিল যে মুক্তিকামী মানুষকে পৃথিবীর কোন শক্তি দাবিয়ে রাখতে পারে না। এবং সেই সঙ্গে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ভূট্টো চক্ৰকেও বােঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে বাংলাদেশ একটা বাস্তব সত্য। এই সরকারের নেতৃত্বে পাকিস্তানের মতাে একটি শক্তিশালী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসের মধ্যে দেশকে স্বাধীন করাটা বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় এবং উজ্জ্বলতম অহংকার। এ সরকারের বলিষ্ঠ চিন্তা, পরিকল্পনা, সহযােগিতা ও সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সহযােগিতা বাংলাদেশের বিজয়কে তরান্বিত করার ফলশ্রুতিতেই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আত্নপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপসমূহ ছিল যেমন- ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার | ঘােষণাপত্র দেয়া। ১১ই এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেন। ১৩ ও ১৪ই এপ্রিল প্রচার দফতর হতে বাংলাদেশ সরকারের নিদের্শাবলী প্রচার করা হয়। ১৭ই এপ্রিল দেশ ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী গােটা পরিস্থিতির ব্যাখ্যা ও করণীয় ব্যাখ্যা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সযযােগিতা চেয়ে ভাষণ দেন। ২৯শে এপ্রিল তিনি বিভিন্ন দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চান। ১০ই মে রেহমান সােবহান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২০শে মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। ১৩ই জুন তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রবর্গের কাছে আবেদন জানান। ৬ই জুলাই রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের সমাবেশে ভাষণ দেন এবং সেখানে তিনি এ পর্যন্ত গৃহীত সকল পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দেন। ১২ই সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা কমিটি গঠন করেন। ১০ই এই সমস্ত সংবাদগুলি সে সময়ের পত্র পত্রিকায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী সরকার’, ‘মুজিবনগর সরকার’ নামেও পরিচিত ছিল। তবে ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবেই বাংলাদেশ সরকার সমধিক পরিচিত ছিল। ‘মুজিবনগর সরকার’ সংকলনে ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত মােট ৩৪টি পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কিত যাবতীয় সংবাদ প্রতিবেদন গুলি সংকলিত হয়েছে। পূর্বের মতই তারিখের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবাদগুলি সংকলিত। পত্রিকাগুলিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার গঠন, বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রধানদের ভাষণ, বক্তৃতা, নির্দেশ, বিবৃতি, আবেদন যেমন ছাপা হয়েছে, তেমনি | এই সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রমও প্রকাশিত হয়েছে। সরকার গঠনের প্রথম দিকে | সরকার প্রধানদের ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতিই বেশি করে প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য বিশ্বজনমত
সৃষ্টি, সাহায্য, স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতার বিষয়গুলির প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। সবশেষে সরকারের সাফল্য ও বিজয় অর্জনের খবরও পাওয়া যায়। তাছাড়া এই বিপ্লবী সরকার যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকান্ড, কূটনৈতিক ও প্রচার ক্ষেত্রে বিশ্ব জনমত গঠন এবং এক কোটি উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছিল তার অনেক তথ্যই এই সমস্ত প্রকাশিত পত্রপত্রিকার পাতায় ফুটে উঠেছে। | কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকার রাজনৈতিকভাবে এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে
যে দূরদর্শিতা, নৈপুণ্য, কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল সেটার মূল্যায়ন এখনাে করা হয়নি। | সেই সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এই সংক্রান্ত খবরগুলি এ ব্যাপারে কিছু সহায়তা দিতে সক্ষম হবে। বলে আশা করছি ।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্য রাত থেকে মধ্য ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল মূলত: এক অবরুদ্ধ নিষিদ্ধ দেশ। কতটা ভয়াবহ দুঃসহ ছিল যুদ্ধদিনের সে সময়গুলি, একমাত্র এদেশে বসবাসকারী সে সময়ের সাধারণ বাঙালি জনগােষ্ঠীই কেবল তা জানেন। অনবরত ভয়, শঙ্কা ও মৃত্যুকে সামনে রেখে অনিশ্চয়তার দোলাচলে যেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন, তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদের
প্রয়ােজনীয় রসদ সংগ্রহ, তৈরী ও সরবরাহের কাজে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে নানাভাবে সাহায্যসহযােগিতা করেছেন। জীবনের ভয় তুচ্ছ করে লুকিয়ে রেখেছেন মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র । সন্তানদের যুদ্ধে পাঠিয়ে বাবা-মা পাক সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের লড়াইটা একদিকে ছিল যেমন সশস্ত্র অস্ত্র প্রয়ােগ করে, অন্য দিকে ছিল প্রতিরােধ করে। যুদ্ধকালীন এ সময়ে অস্তিত্বের লড়াইয়ে হাজারাে কৌশল এবং প্রতিরােধ অবলম্বন করে মানুষ বেঁচেছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের অভ্যন্তরস্থ অবস্থানরত বাঙালি জনগণই একাত্তরের ভয়াবহতা, প্রচণ্ডতা সবচেয়ে বেশি অনুভব ও প্রত্যক্ষ করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তিগত, যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট এবং সংলগ্ন মানুষদের অভিজ্ঞতা, অন্তরঙ্গ আলােচনা, গবেষণা ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বই থেকে এ সম্পর্কিত জানা যায়। অনেক তথ্য, বিবরণ ও অজানা কাহিনী।
একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময়টি কত কঠিন, কঠোর ও বাকরুদ্ধকর ছিল এ পরিস্থিতিতে ‘সাপ্তাহিক আমােদ’ পত্রিকা প্রকাশনা প্রসঙ্গে এর সম্পাদক তাঁর আত্নজৈবনিকে লিখেছেন: “… সমস্ত শহর জনশূন্য হয়ে যায় । কম্পােজিটর নেই, ম্যাশিনম্যান নেই, বিদ্যুৎ নেই, প্রাণের ভয়ে। মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে পালাচ্ছে। কেউ কেউ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এসবের মধ্যে প্রেস চালানাে বা | পত্রিকা চালানাের কোন প্রশ্নই ওঠে না। তারপরও জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ এল শহরে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ থাকতে হবে। অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের মত প্রেস মালিকদের নির্দেশ দেয়া হল ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাদের প্রেস খুলে কাজ আরম্ভ না করলে প্রেস। বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই নির্দেশ পাবার পর আমাদের প্রেস মালিকদের মাথায় যেন বজ্রপাত
পড়ল।”১০৫
| অবরুদ্ধ দেশে, অবরুদ্ধ সময়ের কথা সুফিয়া কামাল তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন এভাবে, “মে। ১৭, সােমবার, আশপাশের বাড়িতে মৃত্যুর বিভীষিকা, সন্তানহারা জননী, স্বামীহীনা স্ত্রী, পিতৃহীন শিশুর মুখ দেখি। গ্রামে গ্রামে মরণ লীলা। শহরের পথে সন্ত্রস্ত পথিকের নি:শব্দ পদচারণা। তবুও হারামজাদারা স্বাভাবিক অবস্থাই বলে যাচ্ছে। শুনি নারী দেহ নিয়ে কামার্ত পশুরা ছিনিমিনি খেলছে। তরুণ তাজা কিশাের যুবকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। আল্লাহ আর কত শুনাবে, কত দেখাবে। এবারে শেষ কর প্রভু। আজ ইডেন বিল্ডিংয়ে, মতিঝিলে ২টি ব্যাংকে ও নিউমার্কেটে টাইম বােমা ফেলে গেছে। | কোন কাগজে খবর বের হবে না জানি ।” সেলিনা হােসেন তার রুদ্ধশ্বসের দিনগুলাে’ প্রবন্ধে | লিখেছেন “… বােমার শব্দ না শুনলে বুক ধড়ফড় করতাে। মনে হতাে আমরা বুঝি বেঁচে নেই। গেরিলা অপারেশনে সব সাহস পুনরুজ্জীবিত হতাে। শহরটা দু’দল মানুষের শহর হয়ে গেছে। একদল বীর দর্পে ঘুরে বেড়ায়। ওদের হাতে অস্ত্র, যা খুশি তা করতে পারে। পঁচিশের রাতের পর থেকেই ওরা তা করছে। একদল ওদের তাবেদার হয়েছে। ওদের কথায় ওঠে বসে। ওদেরকে মদদ জোগায়। অন্যদল জীবন হাতের মুঠোতে নিয়ে চলাফেরা করে। বিকেল হতেই শহরের রাস্তাগুলাে খালি হয়ে যায়। ওরা মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষায় থাকে। যেন এ শহরে কোন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নেই, সবটাই ফাকা। অথচ পচিশ তারিখের রাত দশটা পর্যন্ত এ শহরের মানুষগুলাে উদ্দাম প্রাণচাঞ্চল্যে কর্মমুখর ছিলাে। যেন বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউ বয়ে গেছে শহরের আনাচে-কানাচে।””
| অবরুদ্ধ বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি সামরিকজান্তা ও তার এদেশীয় দোসর আল বদর, আল শামস, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা ছিল বহুমাত্রিক। তাদের বর্বরতা নৃশংসতা যে পাশবিকতার কোন পর্যায়ে পৌছেছিল তা অবরুদ্ধ দেশের বাঙালি জনগােষ্ঠির ভুক্তভােগীরাই জেনেছেন। কিন্তু তার অনেক কিছুই তখন দেশবাসী জানতে পায়নি। কেননা নির্যাতনেই অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। হাতে | গােনা কিছু ব্যক্তি নানা কৌশলে বা অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। ১৮ নির্যাতন অত্যাচারের হাত
থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য মানুষ তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে হাজারাে কৌশল অবলম্বন করেছে, প্রতিরােধ করেছে।
অবরুদ্ধ দেশে লােকজন মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ও অগ্রগতি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাে | এবং নানা উপায়ে তা সংগ্রহও করতাে। খবরের জন্য তারা মিলিটারী ও রাজাকার বাহিনীর ভয়ে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে কিংবা খাটের নিচে লুকিয়ে, লেপ মুড়ি দিয়ে নানাভাবে বিশেষভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার, বিবিসি, ভয়েজ অফ আমেরিকা, আকাশ বাণী শুনতাে। পাক সামরিক শাসক এসমস্ত মাধ্যমের খবর শােনাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে এর জন্য দু’বছর কারাদন্ডের আদেশ জারি পর্যন্ত করেছিল। এমনকি খবর শােনার অপরাধে অনেককে হত্যা পর্যন্ত করা হতাে বলে জানা যায়। ১০০ অবরুদ্ধ দেশের ভেতর থেকে খবর সংগ্রহ করা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক হেদায়েত হােসাইন মােরশেদ লিখেছেন – “বিদেশী পত্রপত্রিকায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব খবর প্রকাশিত হতাে, যা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল নিষিদ্ধ আইটেম, তা আমরা নানাভাবে যােগাড় করতাম। | এছাড়া ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বাঙালি জেড এ নাজমীর সহায়তায় যােগাড় করা হতাে। দূতাবাসের কূটনৈতিক প্রয়ােজনে তৈরি ‘আরটিটি ফাইল’- এর নানা খবর। এমনকি সংগ্রহ করা হয়েছিল ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্থার ক্লডের রিপাের্টের একটি কপিও। স্বাধীনতার পর কাদেরী সাহেবের সঙ্কলন ও সম্পাদনায় বাংলাদেশ জেনােসাইড এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’ নামের যে গ্রন্থটি বেরােয় তাতে এসব রিপাের্ট ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও নানা খবর যােগাড় করা হতাে’।” | দেশের অভ্যন্তরের পরিস্থিতি অনূকূলে না থাকা সত্বেও মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরােধের কার্যক্রম গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। মুক্তিযােদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু অবরুদ্ধ দেশের খােদ রাজধানী শহর ঢাকার ডি.আই.টির টিভি ষ্টেশন অপারেশন করার ঘটনা প্রসঙ্গে লিখেছেন সে সময় খালেদ মােশারফের নির্দেশ ছিল টিভি ভবন উড়িয়ে দেয়ার। কিন্ত আমাদের ভিতরে প্রবেশের কোন উপায় ছিল না। একাজে এগিয়ে এলেন মাহাবুব আলী নামে টিভির একজন। তিনি বললেন, প্রতিদিন। তিনি দুই আউন্স করে পি.কে নিতে পারবেন। জুতাের তলায়, টাকার মধ্যে, প্যান্টের নিচে করে তিনি প্রতিদিন পিকে নিয়ে ঢুকতেন। দু’পাউন্ডের মতাে ভিতরে ঢোকার পর মিলিটারী কি করে যেন খবর। পেয়ে গেলাে। ওরা চেক করে সবাইকে ঢােকাতে লাগলাে। এক পর্যায়ে তারা সারা টিভি অফিস চেক করার সিদ্ধান্ত নিলাে । মিলিটারিরা যখন দ্বিতীয় তলা চেক করছিল তখন মাহাবুব আলী দৌড়ে এলাে পল্টনের একটি বাড়িতে। সে জানতাে না কিভাবে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করা যায় তাকে শিখিয়ে দেয়া হলাে। অফিসে গিয়ে ফিউজ ফিট করে দিলাে টাওয়ারে। আমাদের খারাপ লাগছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমরা, এখন যেখানে হকি ষ্টেডিয়াম, সেখানে দাড়িয়ে দেখলাম। পুরাে টাওয়ারই কেঁপে বাকা হয়ে গিয়েছিল। পিকে যদি ঠিকভাবে বসানাে হতাে তাহলে সেটা পড়েই যেতাে। এভাবেই অবরুদ্ধ দেশে মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সমন্বিত প্রতিরােধ প্রচেষ্টার যােগফল আজকের এই স্বাধীনতা। সুতরাং, যারা শুধু অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তারাই মুক্তিযােদ্ধা নন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাঙালি জনগণের আশার আলাে ও বেঁচে থাকার আশা ও প্রেরণা ছিল মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা ও রেডিওর খবরাখবর । কি ধরনের সংবাদ ছিল অবরুদ্ধ বাংলাদেশ এবং মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকায়? ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক অধ্যায়ে এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। এখানে ১১ই মে থেকে ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত মােট ২৫টি পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ সংকলন করা হয়েছে। উল্লেখযােগ্য সংবাদ গুলির মধ্যে একদিকে যেমন পাক সরকার ও রাজাকারদের বিবিধ কার্যক্রম ছিল তেমনি মুক্তিযােদ্ধাদের নানামুখি আক্রমণ, প্রতিরােধ। এছাড়াও ছিল দেশের বন্যা পরিস্থিতি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির সংবাদ । কিছু অতিরঞ্জিতখবরও যে ছিল না তা নয়। যেমন একটি খবর ছিল ঢাকায় পিতামাতার পাশে বঙ্গবন্ধু । খবরটিতে আদৌ কি কোন সত্য ছিল না।
| একাত্তরের এই অবরুদ্ধ দেশে সাধারণ মানুষের মাঝে পাক হানাদার, রাজাকার আতঙ্ক, বিভীষিকা | ও সহজাত ভীরুতার পাশাপাশি সাহসিকতাও ছিল। আর এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও মুক্তিযােদ্ধাদের সাহসী | দীপ্ত দৃঢ় গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে সাধারণ মানুষকে প্রেরণা, সাহস ও | মনােবল যুগিয়েছে। এইচ টি ইমাম যথার্থই লিখেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে বিদেশে | প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলি এক-একটি সমরাস্ত্রের মতাে কার্যকরী হয়ে উঠেছিল।
১০
কোন পত্রিকারই মূল কপি হাতে রাখা বা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। পত্রিকাগুলি সংগ্রহের ক্ষেত্রে। বেশ কিছু সমস্যাও ছিল। পত্রিকার কাটিং কিংবা পত্রিকা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সংবাদপত্র বা সংবাদ এর প্রতি তেমন মনােযােগ ও যত্নবান ছিলেন না। মনে হয় এর গুরুত্ব বা প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে তেমন ভাবা হয়নি। পত্রিকার নাম, প্রকাশের তারিখ, সব সংখ্যা বা পাতা না পাওয়া, কাটা, ছেড়া, অস্পষ্ট, অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণতার কারণেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ কিংবা তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। অনেক জায়গায় চরম অবহেলা, অযত্নে পড়ে থাকার কারণে অনেক পেপার কাটিং তার উৎস তথ্য থেকে সম্পূর্ণ স্থানচ্যুত হয়েছে। তথাপি এগুলির প্রকাশ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে বিধায় এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কাজটি | সম্পূর্ণ ক্রটিমুক্ত একথা বলা যায় না। অনেক ভুল ত্রুটি রয়েছে এবং থাকতে পারে।
এই সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশনায় আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী এবং বিভিন্ন গ্রন্থাগার, লাইব্রেরি, জাতীয় আরকাইভস্, জাতীয় যাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর এর কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ নানাভাবে প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন আমি তাদের সবার কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞ। উৎসের সন্ধান, উৎসাহ, প্রকাশনা ও এ্যাকাডেমিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়ে সবচেয়ে বেশি সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তার সহায়তার জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ডানা প্রেসের সকল সহকর্মীদের সক্রিয় সহযােগিতা স্মর্তব্য। | মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখালেখি হতে বিভিন্ন শব্দ, বাক্য, লাইন, ভাবনা চিন্তা উদারভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে সে সমস্ত লেখকদের কাছে একান্ত কৃতজ্ঞ। এখানে মনে করছি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন রকম বাধা বা নিষেধাজ্ঞা থাকা ঠিক নয়। এক ধরনের অলিখিত দাবী নিয়েই | এ কাজ করেছি। এতে যেন আমার, আপনার, আমাদের সবার অংশগ্রহণ ও অধিকার রয়েছে। | আমি উপযুক্ত সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
যে কোন সংশােধন, ভুল ত্রুটি ও পত্রিকা সংক্রান্ত তথ্য অবহিত করার বিনীত আবেদন রাখছি।
prantik338@agnil.net
ঢাকা
ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
হাসিনা আহমেদ
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩