You dont have javascript enabled! Please enable it!

সীমান্ত পেরিয়ে পায়ে পায়ে
(বিশেষ প্রতিনিধি)

বেনাপােল চেক পােস্ট। ফ্ল্যাগ স্ট্যাণ্ডের পাশে ছােট্ট একটা অক্ষরফলক—তার উপর ইংরিজীতে লেখা কয়েকটি শব্দ। ঐ শব্দগুলাে ঢেকে গেছে সাদা কাগজের প্রলেপে। কাগজটিতে ‘বাঙলাদেশ ১৯৭১ শব্দগুলাে কাঁচা হাতে লেখা রয়েছে।
পেট্রাপােলের দিকে মুখ বাড়িয়ে সীমান্তের সীমারেখা বরাবর যে সাইনবোের্ড সেটাতেও দেখলাম অনুরূপভাবে ‘গভর্নমেন্ট অব পাকিস্তান’ শব্দগুলাের মধ্যে কেবল পাকিস্তান”-এর উপর সাদা কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়েছে তার উপর বাঙলাদেশ’ শব্দটি ইংরিজীতে জ্বলজ্বল করছে।
ততক্ষণে উত্তীর্ণ সন্ধ্যা। তাই সীমান্তরেখার উভয় প্রান্তের চেক পােস্টগুলাের পতাকা নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ একটু আগেও বেনাপােলের চেক পােস্টে পত্ পত্ করে উড়তে দেখেছি স্বাধীন বাঙলাদেশের সবুজ, রক্তিম স্বর্ণালী রঙে উদ্ভাসিত ‘জয় বাঙলা’ নিশান।
শনিবার ১০ এপ্রিল। বনগাঁ শহরের পথে যাত্রা করলাম সকাল বেলায়। উদ্দেশ্য সীমান্তের ওধারের অবস্থা জানা; যেহেতু যশােহর-বনগাঁ সীমান্তের খুব কাছেই এখন প্রলয়ঙ্কর রণক্ষেত্র।
বনগাঁ পৌছতে পৌছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। তারপর রিক্সায় চড়ে হরিদাসপুর সীমান্তের পথে রওনা হলাম। রাস্তায় রিক্সাচালকটি জানাল বর্ডারের ধারেকাছে যেতে দিবে না। ভাের রাত থেকে বােম্বিং হইছে। সকালে বর্ডারে গুলি চলেছে।
একটু এগােতেই একটা সাঁকোর মুখে জনৈক পুলিশ রিক্সা থামাল। অতএব পদযাত্রা।…কিছুদূর যেতে যেতে পথে পরিচয় হলাে নিমাইপদ কুণ্ডুর সঙ্গে। যশােহর মহকুমার বিশিষ্ট শহর ঝিকরগাছা থেকে মাত্র আড়াই মাইল দূরের গ্রাম গতখালিতে বাড়ি। জানালেন—গতকাল অর্থাৎ শুক্রবার, ৯ এপ্রিল সকাল থেকে ঝিকরগাছা প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে। গােলাগুলি চলছে ঝিকরগাছার আশেপাশে বারাকপুর, মােবারকপুর, লউজুনি, কৃষ্ণগঞ্জ—গ্রামগুলােতেও।
ওঁর সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ দেখি বাঁ দিকের মেঠো রাস্তা দিয়ে সারিবন্দী গােরুর গাড়ি যশােহর রােডের দিকে এগিয়ে আসছে। সীমান্তের ওপারের গ্রামবাসীরা তাদের সর্বস্ব গােরুর গাড়িতে চাপিয়ে এগিয়ে আসছেন। প্রথম গােরুর গাড়িটি থামিয়ে প্রশ্ন করলাম ব্যাপার কি? গরুর গাড়ির মালিক জানালেন—ভাের রাত থেকে প্রচণ্ড ‘বােম্বিং’ শুরু হয়েছে। ঝিকরগাছা বিধ্বস্ত। ইয়াহিয়া বাহিনী সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসছে দ্রুতবেগে। আর তাদের যাত্রাপথের গতি দেখে ই পি ইর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বাহিনী পালিয়ে আসছে। ই পি আর বিহীন গ্রামগুলােতে আর কেউ থাকার ভরসা পাচ্ছে না।
কথা শুনে স্থির করলাম যে করেই হােক বেনাপােলের দিকে যেতে হবে। গ্রামের ভিতর দিয়েই। ও-দিকে যেতে মনস্থ করলাম। ছােট্ট গ্রামগুলােতে পেছনে ফেলে, বহু ডােবা, আশশ্যাওড়ার জঙ্গলকে পাশ কাটিয়ে, শূন্য ক্ষেতের আল ভেঙে এগিয়ে চললাম সীমান্তের দিকে।
বিরাট এক দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ পেরিয়ে সীমান্তবর্তী জয়ন্তীপুর গ্রামে ঢুকতে যাব, হঠাৎ দেখি আর একটি পরিবার এগিয়ে আসছে। পরিবারের কর্তা ৩০ বছর বয়স্ক আবদুল রসিদ। নাভারণ গ্রামে বাস। সকাল সাড়ে এগারােটা নাগাদ নাভারণ রেল বাজারের দিকে থেকে কালাে ধোঁয়া দেখেই মা, স্ত্রী আর দুই কন্যা ঝর্ণা (৬) আর রেহানা (৩) কে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। যশােহরের কথা তুলতেই ওঁর গলা অঞরুদ্ধ হয়ে। উঠল। “ভাই আর ভাইঝিটা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে আর দুটো লােককে চিনতাম—আর সরকৎ—ওদের নাভারণেই বাস। ওরাও মরেছে যশােরে।”—যতক্ষণে এই বর্ণনা দিচ্ছেন আবদুল ততক্ষণে অনেক এগিয়ে। গেছেন ওঁর মা আর স্ত্রী। দূর থেকে শােনা যাচ্ছে মার কাতর কণ্ঠস্বর—“ওরে চলি আয়, চলি আয়।”
জয়ন্তীপুরে ঢুকে দেখি কাতারে কাতারে মানুষ একই পথে এগিয়ে আসছেন। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মিছিল। ন্যূজদেহ জনৈকা বৃদ্ধা সুর করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন—“আমার আর কেউ নেই বাবা গাে।” বললেন যশােহর থেকে আসছেন। সেখানে তার দুই ছেলেকে চিরকালের মতাে রেখে এসেছেন।
জয়ন্তীপুরের পর শাদীপুর। মাঝখানে মাঠের মধ্যে উদ্ধত একটি প্রস্তর ফলক হিন্দুস্থান-পাকিস্তানের সীমানাচিহ্ন। শাদীপুর বেশ বড় গ্রাম, প্রায় হাজারখানেক ঘর লােকের বাস। ওখানে ঢুকতেই ৩০ বছরের আনওয়ারুল হক সাহেব জানালেন একটা গুজবের উপর ভিত্তি করে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পালাচ্ছেন। ইয়াহিয়া ফৌজ ঝিকরগাছা থেকে এক পাও এগােতে পারেনি। তাদের বাধা দিচ্ছে ই পি আর। ই পি আর পালাচ্ছে—এটা সম্পূর্ণ ভুল খবর। …এই বক্তব্য সমর্থন করলেন জনৈক আওয়ামী লীগ কর্মী আইয়ুব হােসেন। হাতে তার দোনলা রাইফেল। বললেন—দু কোম্পানি ই পি আর হানাদারদের ভাের রাত থেকে সকাল বারােটা পর্যন্ত তীব্রভাবে মােকাবেলা করেছেন। তাঁদের হাতে সবচেয়ে বেশি উপযােগী হয়েছে তিন ইঞ্চি মর্টার।
এবারে বাঁক নিয়ে আবার পাকা রাজপথে এসে পড়লাম। অর্থাৎ যশােহর রােডে। পাশেই মাইল। পােস্ট—তাতে ইংরেজী ও বাঙলায় লেখা “ঢাকা ১৭৯ মাইল, যশােহর ২৩ মাইল।” এক ফার্লঙ এগিয়েই পৌছলাম বেনাপােল বাজারে।
বেনাপােলে বাজারে একটা সারের দোকানের সাইনবাের্ডে লেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন কর্তৃক নিযুক্ত সারের দোকান।” ঘষে ঘষে কে বা কারা পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দদুটি প্রায় সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে।
ঐ সারের দোকানের সামনেই লম্বা বেঞ্চির উপর বসে আলাপ করলাম মুক্তিফৌজ ই পি আর-এর জনৈক নায়কের সঙ্গে। ৩০ মার্চ যশােহরে ই পি আর বাহিনীর বিদ্রোহের সময় উনিও ছিলেন বিদ্রোহীদের অন্যতম। বললেন- “আইয়ুবের আমলে বা তার পরের যুগে বহু রক্ত ঝরেছে, কিন্তু এমনটি কখনও দেখিনি। নিজের চোখে দেখেছি ১১ বছরের কিশােরের বুকে পিস্তল লাগিয়ে ইয়াহিয়া বাহিনী খুন করেছে, মেয়েদের সতীত্বহানি করেছে। যশােরে ২৫ থেকে ৩০ মার্চ যা দেখেছি তার কোন তুলনা নেই। এখন তাে বাঙালি তরুণ দেখলেই ওরা খুন করছে।”
৩ এপ্রিল যশােহর চাচড়া মােড়ের মসজিদ ইয়াহিয়া বাহিনীঅগ্নি সংযােগ করে। প্রায় একই সময় যশােহর বাজারে অবস্থিত কালীবাড়িটাও ইয়াহিয়া ফৌজ ধ্বংস করে ফেলে। যশােহর রেলস্টেশনের সামনে অবস্থিত মাদ্রাসায় কোরাণশরিফ পড়ার সময় যেমন মুসলমানরা পাক ফৌজের হাতে মৃত্যুবরণ করে। তেমনি ২৭ মার্চ তারিখে ফুলতলা মােড়ের মান্দিরে পূজা দেবার সময় মন্দিরের মালিককেও ওরা হত্যা করেছে। ইয়াহিয়া বাহিনীর কি আশ্চর্য ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা।
এই সব তথ্য দিয়ে ঝিকরগাছ সর্বশেষ বিবরণ তুলে ধরছে সৈনিকটি। ঝিকরগাছা সেতুর এপার ওপার এখন রণক্ষেত্র। মুক্তি ফৌজ অগ্রসরমান ইয়াহিয়া সৈন্যদের ওখানে বিপুল শক্তিতে প্রতিরােধ করছে।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!