জুলাই ১২, ১৯৭৪ শুক্রবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ
অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছে ঃ সংসদ রিপাের্টার। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট সমাপনী ভাষণে বলেন যে, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এই সগ্রামের পথে যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন তা দূর করে জাতীয় মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে যে বিপ্লবের শুরু হয়েছে সেই বিপ্লবের গতিকে থামিয়ে দিলে চলবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিপ্লবের সেই গতিকে পরিচালিত করতে হবে। তবে তার জন্য পুরানাে মানসিকতা ত্যাগ না করলে বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌছা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমাদের কর্মপ্রবাহে যে ইচ্ছাকৃত অবহেলা ও দুর্নীতি রয়েছে তা কঠোর হাতে দমন করতে হবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এক শ্রেণীর সরকার বিরােধী রাজনৈতিক নেতার জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির সমালােচনা করেন। তিনি দেশের অর্থনৈতিক | অগ্রগতির উল্লেখ করে বলেন যে, দেশে হতাশার কোন কারণ নেই। তেমনি হতাশা সৃষ্টিরও অবকাশ নেই। তিনি বিরােধী দলসহ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের সকল সঙ্কট দূর করি। এ ব্যাপারে তিনি দেশের যুব শক্তিকে কাজে লাগানাের উপর গুরুত্ব আরােপ করেন এবং বলেন যে, দেশের যুব সমাজের বিপুল শক্তি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। এবার তাদের জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে নিয়ােজিত করতে হবে এবং এ জন্য সবাই মিলে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, মানুষকে যারা কষ্ট দেয়, তাদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আসুন, সরকার ও বিরােধী দল মিলে তাদের জনগণের সামনে চিহ্নিত করি এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের হতাশা দূর করি। যে সমালােচনা জাতির ক্ষতির কারণ হতে পারে অর্থমন্ত্রী তা থেকে বিরত হবার জন্য বিরােধী দলের প্রতি অনুরােধ জানান। তিনি বলেন, বিরােধী দলের গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির উপর সংসদীয় গণতন্ত্র নির্ভরশীল। যে সমস্যাগুলি সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগে, রাতারাতি তার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি জাতীয় সঙ্কট দূরীকরণে সরকারী অসুবিধার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুসহ তিনজন মন্ত্রী ছাড়া কারাের মন্ত্রিত্বের পুরানাে অভিজ্ঞতা নেই। ঠিক তেমনি অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারিরও জাতীয়ভিত্তিক দায়িত্ব পালনেরও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই।
তিনি বলেন যে, মাত্র আড়াই বছরে দেশের সীমাহীন সমস্যা দূর করা যায়নি এবং এর জন্য যে লােক তৈরির প্রয়ােজন ছিল তাও সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ অগ্রাধিকার পায় এবং সে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি সর্বস্তরের মানুষের সহযােগিতা কামনা করেন। তবে তিনি বলেন যে, বিরােধী দল বাজেটের ব্যাখ্যা না করে কেবল একতরফা সমালােচনা করেছেন, যা জনগণের কল্যাণে আসতে পারে না। অবশ্য সরকারী দলের সদস্যরাও মিঠে ও কড়াভাবে বাজেট আলােচনা করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জনাব তাজউদ্দিন তার দীর্ঘ বক্তৃতায় অধিকাংশ সময় বিরােধী দলীয় সদস্য জনাব আতাউর রহমান খান, সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মােহাম্মদ সালেহ উদ্দীন ও জনাব আবদুল্লাহ সরকারের সমালােচনার উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন যে, পাকিস্তান আমলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছিল সরকার তা দূর করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, জাতীয় ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে এবং সে অনুসারে বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, দেশের উত্তরাঞ্চলের অনগ্রসরতা দূর করার জন্য পদ্মা-যমুনা নদীর ওপারে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় ভিত্তিতে যে ১২৮ কোটি টাকা ধরা হয়েছে তার অংশও তারা পাবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, একমাত্র লবণ ছাড়া আর কোন কিছুতেই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। গ্যাস প্রচুর মওজুদ থাকলেও তা পুরােপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। তবে চিনিতে এবার আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হব এবং চিনি রফতানি করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এবার ১০ হাজার টন চিনি রফতানি করা হবে বলে তিনি সংসদকে জানান। মন্ত্রী বলেন যে, এক শ্রেণীর লােকের জন্য গত বছর চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যে পৌছানাে যায়নি, তারা বাধা সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আখ চাষিদের যাতে পূর্বের মত মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিতে না হয় তার জন্য পর্যাপ্ত ঋণ দেয়া হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে যােগাযােগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও একটি কারণ বটে। তিনি বলেন, আগামীতে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। চা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, উৎকর্ষতার দিক থেকে আমাদের চায়ের মান তত উঁচু নয়। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে আফ্রিকার কফির সাথে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযােগিতা করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সহায়কী দিয়ে বর্তমানে চা রফতানি করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সাবেক পাকিস্তান সরকার শুধু অঞ্চলে অঞ্চলেই বৈষম্য সৃষ্টি করে নাই, মানুষে মানুষেও বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, কিছু বাস্তব অসুবিধা সত্ত্বেও সমস্ত জেলার প্রতিনিধিত্ব রাখার জন্য সরকার সরকারী চাকুরিতে নিয়ােগের ব্যাপারে জেলা ভিত্তিক কোটা ব্যবস্থা চালু করেছেন। তিনি বলেন, কোটা ব্যবস্থা চালু করার ফলে অনেক সময় এতে মেধাবী ও যােগ্য প্রার্থীরা চাকুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর ফলে তাদের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, সকল যােগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি কোন প্রতিভাবান ছেলে চাকুরি না পায় এবং তার ফলে তার মধ্যে যদি সমাজের প্রতি প্রতিশােধ নেবার স্পৃহা দেখা দেয় তাহলে তাকে কি করে দোষ দেয়া যায়। জনাব আতাউর রহমান খান চাকুরিজীবীদের জন্য প্রতি চার বছর অন্তর যে অবসর ভাতা দানের রেওয়াজ ছিল তা কার্যকর করার যে দাবি জানিয়েছিলেন সে সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন যে, সাধারণ মানুষের অর্থে চাকুরিজীবীরা অবসর ভােগ করবেন। তারা জনগণ স্বচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত এই ভাতা চালু করার প্রশ্নই ওঠে না। শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাঘাতকারী ব্যক্তি যেই হােন, যত শক্তিশালী হােন তাদের বিরুদ্ধে চিরকাল বলেছি, আগামীতেও বলব। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের শিল্প-কারখানা এদের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। বিরােধী দলের সমালােচনার জবাবে তিনি বলেন, শিল্পের সব ক্ষেত্রেই উৎপাদন পিছিয়ে নেই। কাপড়, ওষুধ, নৌ যান, ট্রাক, সাইকেল ও বৈদ্যুতিক জিনিসপত্র উৎপাদন স্বাধীনতা পূর্বকালের চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার পর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩০ লক্ষ টন। এই বছর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ মাত্র ১৭ লক্ষ টন বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বিরােধী সদস্যদের তিনি বলেন, খাদ্য আমদানির এই হ্রাসটি তারা দেখেননি।
এই উন্নতি তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, গত আড়াই বছরে খাদ্য দ্রব্য সহ অন্যান্য ভােগ্যপণ্য জিনিসের মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭২ সালের জুন মাসে চালের মূল্য ছিল প্রতি টন ১০৫ ডলার। ১৯৭৩ সালে তা ২১৫ ডলারে এবং ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই দাম ৪০০ ডলারে উন্নীত হয়। গমের মূল্যও তেমনি টন প্রতি ৮৫ ডলার থেকে বেড়ে ১৫০ ডলার এবং পরে ২৩৫-২৪২ ডলারে পৌঁছেছে। এ ছাড়াও চিনি, পেট্রোলজাত দ্রব্যাদি ও অপরিশােধিত তেল, ভােজ্য তেল, ঢেউ টিন, সিমেন্ট, তুলা এবং জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সম্পূরক বাজেট প্রণয়ন করতে হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “আজকের এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্দিনে পালিয়ে যেতে পারি। মন্ত্রী থাকি বা সদস্য থাকি তা বড় কথা নয়, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের সাথে (জন্যে) সংগ্রাম করে যাব, পালিয়ে যাব না—এই আশ্বাস আপনাদের দিতে পারি”। অর্থমন্ত্রী বলেন, শুধু আমরাই বিপর্যয়ে পড়ি নাই। সারা বিশ্বই আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে এখনও মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে এই যথেষ্ট। তিনি বলেন, আমরা যে লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাতে পারিনি সে কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি। তিনি বিরােধী দলকে সত্য তথ্যের ভিত্তিতে বক্তৃতা দেয়ার আহ্বান জানান এবং সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, মিথ্যা তথ্যের উপর বক্তৃতা দিয়ে নেতৃত্ব করা যায় না। তিনি তাদের জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি না করে আশার উদ্রেক করার আহ্বান জানান। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্যে দেশের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরারও আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, তার বাজেট বক্তৃতায় তিনি দেশের বর্তমান অবস্থা জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। কারণ, জনগণকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে এই অবস্থার মােকাবেলা করা উচিৎ।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি