জুন ২৩, ১৯৭৪ রবিবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিই প্রধান কারণ ঃ সংসদ রিপাের্টার। গতকাল শনিবার অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সংসদে স্পষ্টভাবে বলেন যে, অনিবার্য কারণে চলতি অর্থ বছরে সম্পূরক বাজেটে ২৭৮ কোটি ৯১ লক্ষ টাকার অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়ােজন ছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন যে, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, তা দেশে আনার ভাড়া বৃদ্ধি এবং দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক কারণে এই অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করা একান্ত প্রয়ােজন ছিল। সম্পূরক বাজেটের ওপর গত শুক্রবার জনাব আবদুস সাত্তার এবং গতকাল শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও জনাব মঈনুদ্দীন আহমদ মানিক বক্তৃতা করেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এই বাজেট প্রস্তাবের ওপর সমাপ্তি ভাষণ দেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, ২৭৮ কোটি ৯১ লক্ষ টাকার সম্পূরক বাজেটের মধ্যে ১১৯ কোটি ৫৮ লক্ষ ১১ হাজার টাকা হল চার্জ ও এক্সপেন্ডিচার। অতিরিক্ত ব্যয়ের পক্ষে মত প্রকাশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন যে, গােটা বাজেটের ব্যয়ের দিকে তাকালে এই ব্যয় তেমন কিছু নয়। তিনি বলেন, সরকারকে রিলিফ খাতে অনির্ধারিত ব্যয় হিসাবে ৬ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত যে সব দেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অহরহ মােকাবিলা করতে হয় তাদের জন্য এটা একান্ত স্বাভাবিক। পরিবহন সমস্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের কোন জাহাজ ছিল না। তবে পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে আমরা একটি ছােট-খাট নৌ-বহর তৈরি করেছি। তবে তা আমাদের প্রয়ােজন মিটানাের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি, বলেন, দু’বছর পূর্বে প্রতি টন মাল বহনে যেখানে ৪৫ ডলার লাগত তার দু’বছর পর তা হয়েছে ৭০ থেকে ৭২ ডলার। মন্ত্রী আরাে বলেন যে, প্রথমে দেশের কোন বিমানও ছিল না এবং বৈদেশিক মুদ্রাও ছিল না। তবে এ ক্ষেত্রে দেশ এখন বেশ সামর্থ সঞ্চয় করেছে। মন্ত্রী আরাে বলেন যে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে চালের টন ছিল ৭০ ডলার স্বাধীনতার পর তা হয়েছে ১০৫ ডলার এবং এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪ শত ডলার। গমের মূল্যও তেমন টন প্রতি ৮৫ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৫০ ডলার এবং পরে হয়েছে ২৪২ ডলার। তিনি বলেন, সারা বিশ্বকে মহাসাগরের সাথে তুলনা করলে একটি দেশ দ্বীপ মাত্র। কোন দেশকে বিশ্বের প্রভাব থেকে সরিয়ে রাখা অথবা পুরােপুরি সেই প্রভাব কাটিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার এই অবস্থা সত্ত্বেও খাদ্য শস্য সংগ্রহ করে চলছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বন্দরে ২০ লক্ষ ৫০ হাজার টন খাদ্য শস্য পৌছে গেছে। এবং আরাে আসছে। জাসদ সদস্য জনাব সাত্তারের সমালােচনার কথা উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, জনাব সাত্তার অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তিনি যদি আমাকে বিদায় দিতে পারতেন তবে খুব খুশিই হতাম। কিন্তু যতদিন আমাকে অব্যাহতি না দিবেন আমি আমার কাজ করে যাব। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের সর্বাধিক উপকার করব এই অঙ্গিকার আমি করতে পারি। এই প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই দুর্দিনে একটি বাজেট প্রণয়ন করা যে কি কষ্টকর ব্যাপার ভূক্তভােগী ছাড়া আর কারাে পক্ষেই তা বােধগম্য হবে না। মন্ত্রীর সংখ্যা বেশি হয়েছে বলে জনাব আবদুল্লাহ সরকার যে মন্তব্য করেছেন, তার জবাবে জবাব তাজউদ্দিন বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশের শাসন ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। তারা মিলিতভাবেই এই দায়িত্ব পালন করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের এই ব্যবস্থার পরিবর্তে আইয়ুবের মত একনায়কত্ব নিশ্চয় কারাে কাম্য নয়। এই প্রসঙ্গে তিনি বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এসব দেশে মন্ত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। শুধু মন্ত্রীই নয়, এদের রয়েছে প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি, ডেপুটি পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি, আন্ডার সেক্রেটারি প্রমুখ। তিনি বলেন, এখানে বরং দাবি করা উচিত ছিল প্রতিটি বিভাগে একজন করে সংসদ সদস্যকে বসিয়ে দেয়া। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, সম্পূরক বাজেটের ওপর বিরােধী দলীয় সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দেয়া নিপ্ৰােজন। কারণ, তারা যা বলে চলেছেন, কিছু, ভুল বােঝাবুঝি থেকে তা উদ্ভূত। সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে তারা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি বলেই সম্ভবতঃ এসব অভিযােগ করেছেন। তিনি বলেন, তারা কেন এসব বলেছেন জানি। বিরােধী দলে থাকলে এসব বলতে হয়। আমরাও বিরােধী দলে ছিলাম। তবে পরিণাম বুঝে সব কথা বলা উচিত। নইলে ভবিষ্যতে অসুবিধায় পড়তে হয় ।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি