জুন ২১, ১৯৭৪ শুক্রবার ঃ দৈনিক বাংলা
৩৯৪ কোটি টাকা সাহায্য লাভের সম্ভাবনা; সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী। দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদ ঃ স্টাফ রিপাের্টার। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির পরিপন্থী ও শর্তসাপেক্ষে কোন দেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হবে না। আগামী অর্থ বছরে উন্নয়ন খাতে বিদেশ থেকে ৩৯৪ কোটি টাকা পাবার আশা প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী এই মন্তব্য করেন। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেট সম্পর্কে মত বিনিময় করছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী অর্থ বছরে ৫২৫ কোটি টাকার যে উন্নয়ন ব্যয় ধার্য করা হয়েছে তার মধ্যে ৩৯৪ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ, যা সাহায্যের আকারে পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, ইতােমধ্যেই এর উল্লেখযােগ্য অংশ বিদেশ থেকে পাবার আশ্বাস পাওয়া গেছে এবং বাকি অংশও পাওয়া যাবে এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণ দানকারী সংস্থাগুলির কাছ থেকেই। সবচেয়ে বেশি সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। এছাড়া ঋণ দান সংস্থাগুলির সদস্যভূক্ত বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দ্বি-পাক্ষিক ভিত্তিতেও সাহায্য পাওয়া যাবে বলে অর্থমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ইতােমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে যে আলাপ আলােচনা হয়েছে তার অগ্রগতির ভিত্তিতেই বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কোন ব্লকের অন্তর্ভূক্ত নয়। এটি একটি জোট-নিরপেক্ষ দেশ। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে।
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রথমেই কথা হল, আমরা বৈদেশিক সাহায্য নেব কিনা। যদি নিতে হয় তবে তা শর্তহীন হতে হবে। আমাদের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করবে, এমন দেশ থেকে আমরা সাহায্য নেব না,…..তা যত লােভনীয় হােক না কেন”। অর্থমন্ত্রী বলেন, মহাজনের কাছে খাতকের মাথা নত হওয়া যেমন স্বাভাবিক, রাষ্ট্রের বেলায়ও ঠিক তেমনটি প্রযােজ্য। অর্থমন্ত্রী বিশেষ দৃঢ়তার সাথে বলেন, সয়ম্ভর-অর্থনীতি গড়ে তােলার জন্য বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা অবশ্যই প্রয়ােজন এবং সর্বক্ষেত্রে নৈপুণ্য ও উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। তিনি বলেন, বর্তমান সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতেই শুধু বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে এবং এটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তােলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণ হবে।
। অর্থমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন খাতে অর্থ যােগাননার জন্য ১৯৭৪-৭৫ সালে ৮৯ কোটি টাকার কর আরােপের প্রস্তাব করা হয়েছে। কর আরােপের সময় যাতে তা স্বল্পবিত্ত দরিদ্র জনসাধারণের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে সে দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে যে করের প্রস্তাব করা হয়েছে তা শেষপর্যন্ত গরীব ক্রেতারদের ওপরেই বর্তাবে বলে যে আশংকা করা হচ্ছে তা যথার্থ নয়। করের বিরাট অংশই উৎপাদক পর্যায়ে সীমিত থাকবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন। খাদ্য ঘাটতি । তিনি বলেন, আগামী বছরে প্রায় ১৭ লাখ টন খাদ্য শস্য ঘাটতি থাকবে। এই বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য আমদানি ও জনসাধারণের মধ্যে বিক্রির পর সরকারের ৬০ কোটি টাকা ঘাটতি হবে বলে তিনি জানান। অর্থমন্ত্রী ভুর্তকি না দিতে হলে করের বােঝা লাঘব করা সম্ভব হত। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, পরিকল্পনা কমিশন, খাদ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে যে খাদ্য চাহিদার হিসেব পরিবেশন করা হয়েছে তার সাথে তিনি একমত নন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের গড়ে ১৫ আউন্স খাদ্য গ্রহণের যে হিসেব ধরা হয় তা যথার্থ নয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পল্লী এলাকায় অধিকাংশ লােকই তিন বেলা খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। তারা খাবার পেলে ভরপেট খায়, না পেলে অর্ধাহারে অনাহারে থাকে। এর ফলে সরকারী তথ্যের সাথে বাস্তব খাদ্য ঘাটতির বেশ ফারাক লক্ষ্য করা যায় বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে নীট ঘাটতি ৩১.৮৬ কোটি টাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এমন আশ্বাস দেয়া সম্ভব নয়। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যথাযথ হলে অথবা নৈপুণ্য বৃদ্ধি আশানুরূপ হলে কিংবা অন্য কোন আকস্মিক বিপর্যয় না দেখা দিলেই এ ধরনের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থ বছরে যে মাত্রাতিরিক্ত হারে ডেফিসিট ফিনান্স করতে হয়েছিল তার বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ পুলিশী রাষ্ট্র নয়। পুলিশী রাষ্ট্র হলে ঘাটতি বাজেটকে উদ্বৃত্ত বাজেটে দেখাননা সম্ভব ছিল বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার সব ক্ষেত্রে উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। এমন ধারণা সঠিক নয়। উদাহরণস্বরূপ তিনি চিনি শিল্পের কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থ বছরে চিনি উৎপাদন যে শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি পৌছানােও সম্ভব হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বিশেষ খেদের সাথে বলেন, বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কৃষকদের গুড় উৎপাদনের সপক্ষে এমন জোরালাে আন্দোলন শুরু করেন যে, শেষপর্যন্ত সরকারকে রক্ষী বাহিনীর সাহায্যে কৃষকদের কাছ থেকে ইক্ষু সংগ্রহ করতে হয়। তিনি বলেন, প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি শুধু উৎপাদনের কাজকেই ব্যাহত করে না অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেও ব্যাহত করে। তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে সমাজতন্ত্রের বিরােধী যারা তারাই সমাজতন্ত্রের কথা বেশি জোর গলায় বলেন। এদের উদ্দেশ্যে হচ্ছে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও জনসাধারণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করা।
তিনি অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প-কারখানার উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানাের পরিবর্তে শুল্ক বা কর আরােপের কারণ হচ্ছে কারখানাগুলির উৎপাদন ব্যয় বা খরচ সম্পর্কে সচেতন করে তােলা। তিনি বলেন, এদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হলে কারখানার মুনাফা হবে সত্যি কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধির করার প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাবে। পণ্যমূল্য ও অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পণ্যমূল্য স্থিতিশীল না হবার কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের দ্রুত ওঠানামা ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি। তবে অচিরেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ক্রেতার প্রতিবােধ চাই ঃ দ্রব্যমূল্য হ্রাস সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে ক্রেতা সাধারণের প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে। এটা সমগ্র জাতির কর্তব্য এবং এ ব্যাপারে জাতীয় সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, বাজারে দোকানি সাহস করে ক্রেতার কাছে দ্রব্যের যে দাম হাকে সেটাই মূল্যে পরিণত হয়।
অর্থমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, নিম্ন-আয়ের লােকের ওপর করের বােঝা যেন পড়ে অথবা কম পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই কর ধার্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী দেশের সংবাদপত্রসমূহকে নিজেদের উদ্যোগে একটি নিউজপ্রিন্ট কারখানা স্থাপনের পরামর্শ দেন। নিউজপ্রিন্টের মূল্য বৃদ্ধি ও রফতানি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে নিউজপ্রিন্টের দাম বেড়েছে। আমরা নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ করে ভাল আয় করতে পারি। তিনি পত্রিকাসমূহকে পৃষ্ঠা সংখ্যা সীমিতকরণের আহবান জানান। ভারতে নিউজপ্রিন্ট রফতানি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকার আন্তর্জাতিক বাজার দরে ভারতে নিউজপ্রিন্ট রফতানি করছে। কিন্তু এখানে যাদের নিউজপ্রিন্টের কোটা রয়েছে তাদের কেউ কেউ কলকাতার বাজারে তাদের কোটা থেকে নিউজপ্রিন্ট চালান করছে।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি