You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুলাই ২১, ১৯৭৩ শনিবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক

পাট উৎপাদন ও ব্যবসাঃ তাজউদ্দিন আহমদ, পাট ও অর্থমন্ত্রী ও পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কাচা পাট ও পাটজাত দ্রব্যের গুরুত্ব পৃথিবীর সর্বত্র সুপরিচিত। দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে পাটের ওপর নির্ভর করে। কারণ ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা পাট রফতানি করে অর্জন। করা হয়ে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা ছাড়াও দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৫০ লাখ পরিবার পাট চাষের সাথে সরাসরিভাবে জড়িত এবং প্রায় ৩ লাখের বেশি। লােক দেশের পাট কলে, পাটের প্রেসে এবং পাটের ব্যবসা ক্ষেত্রে জড়িত। আমাদের অর্থনীতি সরাসরিভাবে পাটের ওপর নির্ভর করে এবং পাট রফতানির মাধ্যমে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়ে থাকে। এতে এ বােঝায় না যে, আমাদের উদ্বেগের কোন কারণ নাই। আমাদের উৎপাদন ও রফতানি কতিপয় মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক বাজারে পাট আরও অন্তত: তিন প্রকারের আঁশের সাথে প্রতিযােগিতার সম্মুখীন। পাটের আঁশগুলাের সাথে তার কিছুটা সাদৃশ্য আছে এবং তা দিয়ে ব্যাগ তৈরি করা হয়ে তাকে। এ ছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে আরাে ৫ প্রকার আঁশ উৎপন্ন হয় এবং এগুলাে ব্যাগ প্রস্তুত ব্যবসায় কোন কোন শাখায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যাগ প্রস্তুতের জন্য তুলাও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাল্টিপ্লাই পেপার ব্যাগও সিমেন্ট প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে একটি স্থান দখল করেছে। কৃত্রিম উপায়ে এ জাতীয় আরাে কিছু দ্রব্য উৎপন্ন হয়ে থাকে যেমনঃ সিনথেটিকস, প্রধানত পলিপ্রপেলিন ও পলিথেলিন। পাট চাষের আর একটি দিক আছে। এটা হচ্ছে বাজারে ধানের উচ্চ মূল্য ।

অন্যান্য শস্যের উর্ধ্বগামী মূল্যের সাথে পাটের মূল্য যদি তাল রাখতে না পারে তবে পাট চাষিরা ধানের চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়বে। যদিও ধান পাটের সাথে সরাসরি কোন প্রতিযােগিতা করতে নাও পারে, তথাপি ইরি ও অন্য কতিপয় আউস ধান পাট চাষের সাথে একটা প্রতিযােগিতা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এসব কারণে সরকার ১৯৭২-৭৩ সালে প্রাথমিক বাজারে পাটের মূল্য মণ প্রতি ২০ টাকা বৃদ্ধি করেছেন। ফলে মানভেদে উক্ত মৌসুমে পাটের দর মণ প্রতি ৫৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকা পর্যন্ত উঠা-নামা করছে। কিন্তু এ মূল্য বৃদ্ধি অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য ও চাষিদের জীবন ধারণের ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ঘটছে। প্রায় ১৮১২ সালে থেকে বৃহৎ আকারে পাট উৎপাদন শুরু হয়েছে। চাষিরা পাট চাষের জন্য করে যে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করত, তা পাটের উৎপাদন থেকে পাওয়া কষ্টসাধ্য হত। উপ-মহাদেশে বৃটিশদের শাসনামলে পাটের ব্যবসা বিদেশী ব্যবসায়ী এবং তাদের অস্থানীয় এজেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং পাটের ব্যবসার ক্ষেত্রে পাট উৎপাদনকারীদের কোন বক্তব্য ছিল না। পুনরায় পাকিস্তান আমলেও অবস্থা প্রায় একইরূপ ছিল। বিদেশী ব্যবসায়ীদের পরিত্যক্ত স্থান পাকিস্তানী পুঁজিপতিরা দখল করে। যতটুকু সুবিধা থাকলে চাষিরা পাট উৎপাদন করতে চাইবে চাষীদের স্বার্থ ঠিক ততটুকুই দেয়া হত। লাভের বড় অংশ পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা এবং তাদের অস্থানীয় এজেন্টরাই আত্মসাৎ করত। অধিকন্তু বাণিজ্যিক দুর্নীতির ফলে ব্যবসাটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে জাতির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যাপক লােকসান হত। নিম্নমানের পাটের সাথে উচ্চমানের পাট মিশিয়ে ব্যবসা করার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের সুনাম নষ্ট হয়েছে।

বিজেইসি’র জন্ম ঃ এসব কারণে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার পরে রফতানী ব্যবসা জাতীয়করণ করেন এবং এ ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য একটা পৃথক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুট এক্সপাের্ট কর্পোরেশন গঠন করেন। উপযুক্ত রফতানি পলিসি ও অসুবিধা দূর করার জন্যে গােটা রফতানি ব্যবসা এ কর্পোরেশনের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। সরকারী কর্পোরেশনস কাঁচা পাটের মূল্যের অস্থিতিশীলতা ও চাষিদের লাে রিটার্ন দূর করার জন্য সরকারের তিনটি কাঁচা পাট ক্রয় এজেন্সিকে সক্রিয় করে তােলা সরকারের অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এগুলাে হচ্ছে, জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন, জুট মার্কেটিং কর্পোরেশন ও জুট প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন কর্পোরেশন। এইসব সরকারী কর্পোরেশনগুলাের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কাঁচা পাটের মূল্যের ক্ষেত্রে একটা স্থিতিশীলতা আনয়ন করা, চাষিদের ন্যায্য মূল্য প্রদান নিশ্চিত করা ও চাষিদের শােষণ বন্ধ করা। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা অপ্রচুর হয়ে পড়ায় মূল্যে মারাত্মক অবনতি এড়াবার উদ্দেশ্যে এ কর্পোরেশন স্থাপন করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। চাষিদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে এ কর্পোরেশনগুলাে যথাযথভাবে সাফল্য লাভ করেছে। মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য সফলতা লাভ করা গেছে। বিদেশী ক্রেতারা। আর অতীতের মত ম্যালপ্রাকটিস ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে না। আশংকা ঃ আংশিকভাবে পাটের সমতুল্য কতিপয় প্রাকৃতিক আঁশ ও কৃত্রিম বিকল্প দ্রব্যের ব্যাপারে যে আশংকা ছিল তাও সরকার পরীক্ষা করে দেখেছেন। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আঁশ উৎপাদনকারীদের সাথে প্রতিযােগিতা যত তীব্রই হােক না কেন, বাস্তব মূল্য-নীতিসমূহ মেনে নিলে বিশ্বের পাটের বাজারে বাংলাদেশ তার স্থান হারাবে এমন আশংকা করার কোন কারণ নেই। এটা নিশ্চিত করাই আমাদের অবিরাম চেষ্টা হবে যে, পাট বিশ্ব বাজারে প্রতিযােগিতামূলকই রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে সরকার পলিসিতে একটা নমনীয়তা অনুমােদন করবেন।

পাটের টেকনিক্যাল অক্ষমতা দূর করার জন্যে এবং উচ্চমানের কার্যক্রমের জন্যে উৎপাদন উন্নয়নের প্রতি আমাদের আরাে মনােযােগ দিতে হবে। আরাে একটা প্রকট ভয় হচ্ছে এই যে, নিম্নমূল্য নিয়ে অসন্তুষ্ট চাষিরা পাট চাষ কমিয়ে ফেলবে। সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ এবং অভ্যন্তরীণ মূল্য নির্ধারণ নীতি কার্যকরি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিশ্ব বাজারে এর বর্তমান ভূমিকা রক্ষা ও উন্নত করার জন্য পাটের জন্য সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে প্রচুর নমনীয়তা রাখতে হবে। একটা ব্যাপক কৃষি পরিকল্পনার মাধ্যমে এ উদ্দেশ্যকে সাহায্য করতে হবে। যাতে এ পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ফলে প্রতি একরে বর্তমান উৎপাদনের দ্বিগুণ উৎপাদন হয়। এ পরিকল্পনাটির সফল বাস্তবায়নের জন্য মৌলিক প্রয়ােজন হচ্ছে সম্প্রসারণের সুযােগ-সুবিধা, ঋণ দানের সুযােগ-সুবিধা এবং ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইডের মত মেটিরিয়্যাল ইনপুটস। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী (ড্রাফট) পরিকল্পনায় এসব সুযােগ-সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত বিধান রাখা হয়েছে। এ পরিকল্পনার বাস্তবায়নের সাথে জড়িত বিভিন্ন সরকারী মন্ত্রণালয়কে এ উদ্দেশ্যে একটা সংযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ। করতে হবে। এরূপ সংযােগ রক্ষার জন্যে বর্তমানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ব্যাপক কৃষি পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য চাষিদের নিকট থেকেও প্রচুর সহযােগিতা পাওয়া দরকার। এ পরিকল্পনায় প্রধান অংশগ্রহণকারী হচ্ছে চাষিরা। সরকার তাদেরকে প্রচুর সাংগঠনিক ও মেটিরিয়্যাল সুযােগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। এবং তারা যাতে তাদের কষ্টার্জিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান তারও নিশ্চয়তা দেবেন। এ ব্যাপারে কার্যকরি সংস্থা হবে জুট ট্রেডিং কর্পোরেশন ও অনুরূপ এজেন্সিগুলাে।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!