You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.07.06 | দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা-ধ্বংসস্তুপের ওপর অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ার সংগ্রাম চলছে - সংগ্রামের নোটবুক

জুলাই ৬, ১৯৭৩ শুক্রবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা

ধ্বংসস্তুপের ওপর অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ার সংগ্রাম চলছে ঃ সংসদ রিপাের্টার। ১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট মানুষের আশা-আকাঙ্খ পূরণ করতে পারবে কিনা তা এখনই বলার সময় নয়। বাজেট কার্যকরি হলে তার পরই তা প্রমাণিত হবে। মনে রাখতে হবে যে, আমরা ধ্বংসস্তুপের ওপর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলবার সগ্রামে লিপ্ত। জাতীয় সংসদে গতকাল বৃহস্পতিবার বাজেটের ওপর সাধারণ আলােচনার সমাপনী ভাষণে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বাজেটের আলােচনা শেষ হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাজেটের উপর সংসদে ৭ দিন ধরে সাধারণ আলােচনা হয়েছে। মােট ১১টি অধিবেশনে ৭২জন সদস্য ও সদস্যা আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া সংসদের বাইরে বিভিন্ন মহল ও সংবাদপত্রে বাজেট সম্পর্কে বক্তব্য রাখা হয়েছে। পরিষদের বাইরে ও ভিতরে এই আলােচনাকে অর্থমন্ত্রী উৎসাহব্যঞ্জক ও প্রাণের লক্ষণ বলে অভিহিত করেন। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশ অনুন্নত ছিল এবং এ দেশকে পাস্তিানীদের ঔপনিবেশ হিসাবে গড়ে তােলা হয়েছিল বলে উল্লেখ করে তিনি আরাে বলেন, চলতি বাজেটকে ঔপনিবেশিক আমলের বাজেটের সাথে তুলনা করা যায় না। অর্থমন্ত্রী বলেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর অর্থনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। দেড় বছরে সে শূন্যতা পূরণ করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

এ শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব কিনা তা বিচার করবে সংসদ এবং জনগণ। তবে শূন্যতা পূরণের জন্যই জাতি হিসেবে দৃঢ়তা নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে এবং যেতে হবে। তিনি এই পটভূমিকা থেকেই সবকিছুকে বিচার করার আহবান জানান। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতায় বলেন যে, বাজেট বক্তৃতায় তিনি কোন  কথা গােপন করেন নাই। তিনি বলেন যে, আমাদের মত গরীব দেশে কর আরােপ ভীতি সঞ্চার করে। কিন্তু উন্নয়নের স্বার্থেই কর আরােপ করা হইয়াছে। কাজেই দেখিতে হইবে যে, এই উন্নয়ন ব্যয়ে কে উপকৃত হইবে। যদি উহা সাধারণ মানুষের জন্য হয়, তাহা হইলে অবশ্যই সে ব্যয়ভার বহন করিতে হইবে। তিনি জোর দিয়া বলেন যে, গরীবের উপর কোন নতুন কর ধার্য করা হয় নাই। নতুন করের মধ্যে মেশিনে প্রস্তুত বিস্কুটের উপর শতকরা ১০ ভাগ এবং দেশী প্রসাধনের উপর শতকরা ২৫ ভাগ কর আরােপ করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, কৃষি আয় ও ছাতার কাপড়ের উপর হইতে কর প্রত্যাহার বাবত ৮২ লক্ষ টাকা এবং ২১ কাউন্ট পর্যন্ত সুতার উপর হইতে কর মওকুফের ফলে সরকারের ৭ কোটি টাকা ক্ষতি হইয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, রাষ্ট্রয়াত্ত করিলেই সমাজতন্ত্র হয় না, কারণ রাষ্ট্রের পক্ষে “স্টেট ক্যাপিটালিজম” করা সম্ভব। তিনি বলেন যে, তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ করিতে হইবে। বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থ-ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল এবং জনগণের নির্বাচনী ম্যান্ডেট লইয়া তাহারা উহা পূরণ করিতে বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা কায়েম করিব। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করিতে পারিলে দুনিয়াতে আমরা একটা নজীর স্থাপন করিতে পারিব। কারণ বর্তমান বিশ্বের কোথাও এই নজির নাই। অর্থমন্ত্রী বলেন যে, বর্তমানে আমরা ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্রণের মধ্যে রহিয়াছি। তাই রাজনৈতিক সচেতন মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্রের পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে। নচেৎ নৈরাজ্যের সৃষ্টি হইবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দিয়া সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইবে না। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের পরিবেশ অনুযায়ীই সমাজতন্ত্র গড়িয়া উঠিবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, কর ধার্যের জন্য নহে, বরং উৎপাদন বা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়াছে, মুদ্রাস্ফীতিকেও তিনি অন্যতম কারণ। বলিয়া উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, দ্রব্যমূল্য কমাইয়া স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করিতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ব্যাপারে তিনি জনগণের সহযােগিতা কামনা করেন। সারের মূল্যবৃদ্ধির সমালােচনার জবাবে তিনি বলেন যে, ইউরিয়া সারের উপর কর ধার্য করা হয় নাই। বর্ধিত উৎপাদন খরচ করার ফলে উহার মূল্য বৃদ্ধি হইয়াছে। কীটনাশক ঔষধে ১১ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা সাবসিডি দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন যে, পাটের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করিতেছেন এবং শীঘ্রই পাটনীতি ঘােষণা করা হইবে। তিনি জানান যে, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য ১ শত ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা  হইয়াছে।

তিনি বলেন যে, সরকার তুলা চাষের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি দিয়াছেন। তবে দেশের কল-কারখানা যতদিন চাহিদা পূরণ করিতে না পারিবে ততদিন বিদেশ। হইতে বস্ত্র আমদানি করা হইবে। অর্থমন্ত্রী বলেন যে, খাদ্য উৎপাদনের সরকারী লক্ষ্য ১ কোটি ২০ লক্ষ ৮০ হাজার টন। পক্ষান্তরে ১ কোটি ২২ লক্ষ টন খাদ্যের প্রয়ােজন, কাজেই ঘাটতি থাকিয়া যাইবে। উহা পূরণের জন্য খাদ্য আমদানি করিতে হইবে। তিনি বলেন যে, বাড়ির মালিকরা বর্তমানে বিভিন্নভাবে ২০% হইতে ২৭% কর দিয়া থাকেন। তবে। ভবিষ্যতে ইহা বাড়িতে পারে এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভবিষ্যতে বাড়ির সংখ্যাসীমা নির্ধারণ করা হইবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে একশ্রেণীর শ্রমিক নেতা উৎপাদনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করিতেছেন। বর্তমানে সরকার এই সমস্যা কাটাইয়া উঠিতেছেন। তিনি মানসিকতার আমূল পরিবর্তনের আহ্বান জানান। অর্থমন্ত্রী বলেন যে, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনসংখ্যা রােধ করিতে হইবে, অন্যথায় উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থ হইয়া যাইতে পারে। তিনি বলেন যে, সরকার এই খাতে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, সরকার নিয়ন্ত্রিত বন্টন ব্যবস্থা করিয়াছেন এবং দ্রব্যমূল্য বাধিয়া। দিয়াছেন, অর্থমন্ত্রী বলেন যে, বিদেশী সাহায্য সম্পর্কে সরকার সর্বদা সতর্ক। থাকিবেন। কৃতা সাধনের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের আহ্বান জানাইয়া তিনি বলেন । যে, উন্নয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে, তবেই আমরা আত্মনির্ভরশীল। জাতি হিসাবে গড়িয়া উঠিব। করবৃদ্ধি প্রসংগে ঃ পণ্যকর বৃদ্ধি প্রসংগে অর্থমন্ত্রী বলেন, মিহি সুতার উপর কর বৃদ্ধি করায় দরিদ্র জনগণ ক্ষতিগ্রস্থ হবেন না। কারণ তারা ২১ কাউন্টের ওপরের মিহি সুতার কাপড় পড়েন না। স্টিল মিলে উৎপাদিত ঢেউ টিনের উৎপাদন খরচার সাথে সঙ্গতি রেখেই আমদানি করা ঢেউ টিনের কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। উদ্দেশ্য। দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করা। এছাড়া রেশনের চাল, ডাল, চিনি ও অন্যান্য ভােজ্য দ্রব্যের উপর কর আরােপ করা। হয়নি। শুধু ভুর্তকি প্রত্যাহার করা হয়েছে মাত্র। অর্থাৎ কেনা মূল্যেই এইসব ভােগ্য।

রেশনের মাধ্যমে বিক্রয় করা হবে। কারণ ৪টি শহরের ৪০ লক্ষ লােককে রেশনে। ভােগ্যপণ্য সরবরাহে সরকারী ভুর্তকি দেয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। কেননা ভুর্তকির টাকা। পরিণামে জনগণের ট্যাক্স থেকেই আসে বলে তিনি মন্তব্য করেন। শিক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দের প্রসঙ্গ টেনে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, শিক্ষার । আমূল পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা কমিশন কাজ করছেন। তিনি বলেন, নতুন সমাজ গড়ার জন্য শিক্ষা বৃত্তিমূলক হওয়া প্রয়ােজন এবং কতজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। দরকার তা জরিপ করে শিক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারী ও বেসরকারী ব্যবস্থার শিক্ষা পদ্ধতির বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দেন এবং নতুন নতুন কলেজ গড়ে তােলার প্রবণতা রােধ করার আহ্বান জানান। প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ ব্যয়ের যৌক্তিকতা দেখিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিরক্ষার সবচেয়ে বড় গ্যারান্টি হল সন্তুষ্টিচিত্ত জনগণ। কাজেই জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া আমরা জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছি। শশাষণের অবসান এবং দুনিয়ার সকল জনগণের উন্নতিই আমাদের কাম্য। দুনিয়ার মেহনতি মানুষের সাথে আমরা একাত্ম। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আত্মনির্ভরশীল আমাদের হতেই হবে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সম-মর্যাদার ভিত্তিতে আমরা সাহায্য নেয়ার পক্ষপাতি। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, আইন শৃংখলা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে নিজ নিজ এলাকায় পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি