You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুন ৩, ১৯৭৩ রবিবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা ও দৈনিক ইত্তেফাক

ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলতে রাজি আছি; অচল নােট পুরাপুরি জমাই হয়নি : স্টাফ রিপাের্টার। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল শনিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ৩১ মে পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ভারতে ছাপা প্রত্যাহারকৃত মােট নােটের চাইতে তিপ্পান্ন লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার আটশত চল্লিশ টাকা কম জমা পরেছে। এর আগে দেশে ভারতে মুদ্রিত নােট সম্পর্কে বিভ্রান্তির অবসান ও জনসাধারণের মনে কারেন্সি নােট সম্পর্কে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ভারতে মুদ্রিত নােট উঠিয়ে নেয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে তিনি জানান। অর্থমন্ত্রী প্রকাশ করেন যে, ভারত থেকে সর্বমােট ৪২১ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার নােট ছাপিয়ে আনা হয়েছিল। তার মধ্যে ১২০ কোটি ৭২ লাখ ৫শ’ টাকার নােট বাজারে ছাড়াই হয়নি। এ ছাড়াও এক টাকার নোেট প্রত্যাহার করা হয়নি। একশত, দশ এবং পাঁচ টাকার নােটে মােট দুইশত কোটি ৭৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ টাকা বাজারে ছাড়া হয়েছিল। ভারতে মুদ্রিত কারেন্সি নােটের বিস্তারিত হিসাব ঃ একশত টাকার নােট দুইশত সত্তর কোটি টাকা, দশ টাকার নােট নব্বই কোটি সাতাশি লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা, পাঁচ টাকার নােট ত্রিশ কোটি ষাট লাখ টাকা এবং এক টাকার নোেট ত্রিশ কোটি বার লাখ টাকা। মােট চারশত একুশ কোটি উনষাট লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা ছাপানাে হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতিসহ কারেন্সির অবস্থা বর্ণনা করে বলেন, সে সময় মাত্র ভারত ও ভূটান ছাড়া অন্য কোন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের দরকার ছিল খুব তাড়াতাড়ি নােট ছাপাননা। বলাইবাহুল্য ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে তথন নােট ছাপানাে সম্ভব ছিল না।

এরপর ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের সাথে বাংলাদেশের নােট ছাপানাে সম্পর্কে এক চুক্তি হয়। সে সময় ভারতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস বাংলাদেশ সরকারকে জানায় যে, নােটর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। হিসেবে জলছাপ, নিরাপত্তামূলক সুতা ও রঙ্গীন সুতার ছাপের ব্যবস্থা তাদের থাকলেও এত অল্প সময়ে নােটে জলছাপ দেয়া সম্ভব হবে না। যেহেতু বাংলাদেশের তখন কারেন্সি নােটের জরুরী প্রয়ােজন ছিল তাই জলছাপ। ছাড়া অপর দুইটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাসহ নােট ছাপাতে দিতে হয়। ভারত সরকার ছাপানাে নােটের প্রথম চালান ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করেন। পৃথিবীর কোন দেশের সিরিউরিটি প্রেসের পক্ষেই ছয় মাসের পূর্বে কারেন্সি নােট ছাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ভারত সরকার আমাদের বিশেষ অনুরােধে এই নােট ছাপিয়ে দেন।

কাজেই ভারতে নােট ছেপে কোন অপরাধ করেছি বলে আমি মনে করি না। তবে যাইহােক বাংলাদেশ সরকার পরে বিদেশ থেকে নােট ছাপিয়ে আনার সময় এর প্রতিবিধান করা হয় বলে অর্থমন্ত্রী জানান। কারেন্সি নােট সম্পর্কে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের ভারতে মুদ্রিত নােট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তারা এ নােট সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন বলে অর্থমন্ত্রী জানান। তারা বলেন, নােটে যে দুইটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা যথেষ্ট এবং এতে কোন উদ্বেগের কারণ নাই। ভারতে মুদ্রিত চালু নােট উঠিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর একটি কাগজে এপ্রিলের মাঝামাঝি ব্যাংকে ৭০০ কোটি টাকার নোেট ইতােমধ্যেই জমা ও আরাে ৩০০ কোটি টাকার নােট জমা হবে বলে যে খবর প্রকাশিত হয় তিনি তার কঠোর নিন্দা করেন। সে সময় দেশে ভারতে মুদ্রিত নােট চালু নােটের পরিমাণ যেখানে ৩০০ কোটি টাকাও কম ছিল সে ক্ষেত্রে কিভাবে ৭০০ কোটি টাকার নােট পরিবর্তনের জন্য জমা হতে পারে তা তার বুদ্ধির অগম্য বলে তিনি জানান। জাল নােট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৃথিবীর সব নােটই জাল হতে পারে। এটা নােট জালিয়াতদের কাজ। দেশ ভারতীয় জাল নােটে ভরে গিয়েছিল বলে এক শ্রেণীর লােক প্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু আমি বহু জনসভায় জাল নােট কেউ পেয়ে থাকলে তা আমাকে দেখাতে বলেছিলাম। কিন্তু কেউ তা দেখাতে পারেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুটি জাল নােট দেখেছি। জাল নােটের ব্যাপারে কোন সরকার, কোন বিভাগ বা কোন সাধারণ ব্যক্তি দায়ী হতে পারে না। এ জন্য নােট জালিয়াতরাই দায়ী। এ সম্পর্কিত আইনও অত্যন্ত কঠোর।

ভারতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে একই নাম্বারের নােট ছাপিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেবার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে যে অভিযােগ করা হয়েছিল জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অবিবেচনাপ্রসূত সমালােচনা বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের পক্ষে এই জাতীয় কাজ করা সম্ভব নয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি ভারতের কয়েকজন পদস্থ কর্তা ব্যক্তিকে বলেছেন, যে ভারত জন্মে বাংলাদেশকে লালন করেছে সে ভারত দোলনায় তাকে হত্যা করছে কিনা তা আমাদের দেখতে হবে। সে জন্য আমরা ভারতীয় নােট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেই। এবং টাকা বদলানাের জন্য দুই মাস সময় দেই। আমি বলেছিলাম, যে পরিমাণ নােট বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইস্যু করা হয়েছে তা থেকে বেশি নােট যদি জমা পড়ে তবে আমি অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করব। তিনি বলেন, প্রদত্ত হিসাবে দেখা যাবে ভারতে ছাপা কারেন্সি নােট সম্পর্কে সবধরনের অভিযােগই সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আলােচনাকালে এক পর্যায়ে বলেন, মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের সাথে কোন গােপন চুক্তি করেছি বলে যদি কোন প্রমাণ করতে পারেন তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ তাে করবই, এমন কি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতেও রাজি আছি। তিনি বলেন, কোন গােপন দলিল ফাস করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। এই প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন যে, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকালে ওয়াশিংটনে অবস্থানকারী জনৈক বাঙ্গালি যুবকের সাহায্যে পেন্টাগনের গােপন দলির বের করিয়েছিলেন এবং উক্ত দলিলের প্রতিলিপি ঐ সময় কোন কোন বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশ, উক্ত দলিলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ সংক্রান্ত ছিল।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!