এপ্রিল ১ ও ২, ১৯৭৩ রবিবার ও সােমবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
১ জুলাই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাজ শুরু হইবে ? ইত্তেফাক রিপাের্ট। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পাট বিষয়ক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল (শনিবার) প্রকাশ করেন যে, আগামী ১ জুলাই হইতে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার কাজ শুরু হইবে। তিনি এই পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে উদার হস্তে সাহায্য করার জন্য সাহায্যকারী দেশগুলির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে সাহায্য সংক্রান্ত বিষয়ে গতকাল (শনিবার) সকালে। ঢাকায় আয়ােজিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি প্রধান অতিথির ভাষণ দিতেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোেগ্য যে, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আহুত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের সাহায্য দানকারী ১৯টি দেশের প্রতিনিধি যােগদান করিয়াছেন। ইহাছাড়া, সাহায্যকারী ৫টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবর্গও এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করিয়াছেন।
জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, দেশের জনগণের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশ হইতে দারিদ্রতার অবসান করাই আমাদের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন, আহার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থা করাই আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন যে, খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের উদ্দেশ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে কৃষিখাতে সর্বাধিক গুরুত্ব দান করা হইবে। ইহাছাড়া জনগণের কর্মসংস্থানের সুযােগ এবং রফতানি হইতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সম্প্রসারণের সুব্যবস্থা করাও আমাদের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের সংবিধানের আলােকে দেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপরেখার বর্ণনা প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, আমরা গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে জনগণের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য হইবে আয়, সম্পদ এবং সুযােগ সুবিধার ক্ষেত্রে বিশাল ব্যবধানের অবসান করা।
তিনি আরও বলেন যে, ক্রমবর্ধমান বিপুলসংখ্যক শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানাের জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করাও আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনাভিত্তিক জনসংখ্যা এবং আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসম্পদের সফল ব্যবহারের বিষয়টিকে আমরা অগ্রাধিকার দিতে চাই। বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ জনসম্পদের উন্নয়নকে আমরা অধিক গুরুত্ত্ব দান করিয়াছি। অতীতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে নিদারুণ অবহেলা করা হইয়াছে। তাই আমাদিগকে এই খাতে, বিশেষ করিয়া প্রাথমিক শিক্ষা এবং সকল পর্যায়ে শিক্ষার গুণগত উন্নয়নসহ গ্রামভিত্তিক চিকিৎসার সুযােগের সম্প্রসারণ করিতে হইবে।
বাংলাদেশের এই সব মৌলিক সমস্যা এবং এই সব সমস্যা উত্তরণের জন্য তাহার সরকারের পরিকল্পনার রূপরেখার প্রতি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, এই সব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের এবং অন্যান্য দেশের সমর্থন ও সহানুভূতি কামনা করি। তিনি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করিয়া দিবে বলিয়া গভীর আশা প্রকাশ করিয়া তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, আমরা সর্বকনিষ্ঠ এবং দরিদ্রতম জাতি হিসাবে বিশ্বের সাহায্য চাই না, সমৃদ্ধির-সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতবহ একটি জাতি হিসাবে এই সাহায্য কামনা করি। তিনি প্রত্যয় দৃঢ়কণ্ঠে আরও বলেন, অতি অল্পসময়ের মধ্যেই আমরা আমাদিগকে একটি আত্মনির্ভরশীল গতিশীল এবং প্রগতিশীল জাতি হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে সক্ষম হইব। তিনি বলেন, সুষ্ঠু কর্মসূচি এবং নীতির মাধ্যমে আমাদের আশা-আকাংখা এবং প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করিয়া তুলিতে আমরা আর কালবিলম্ব করিতে চাহি না। অর্থমন্ত্রী পুনরায় বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সকল দেশের বাস্তব সহযােগিতা। কামনা করিয়া এই মর্মে আশ্বাস দান করেন যে, প্রাপ্ত সাহায্য একটি স্বনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়িয়া তােলার কাজে ব্যয়িত হইবে। তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের সামগ্রিক জন এবং বৈষয়িক সম্পদ উন্নয়নের কাজে নিয়ােজিত করিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি