You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছাত্রলীগের ইতিহাস
ব্রিটিশ পর্ব

১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু মুসলমান ছাত্রদের প্রগতিশীল অংশ বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্রলীগ কিংবা কম্যুনিস্ট ছাত্র ফেডারেশনেই কাজ করেছিল। তৎকালীন মুসলীম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাবে ১৯৩৭ সালে্র ১ সেপ্টেম্বর করাচির ইসলামিয়া কলেজে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন হামিদ নিজামি সাধারন সম্পাদক হন আব্দুল ইসলাম খুরশিদ। কবি আল্লামা ইকবাল হন চিফ পেট্রোন। মামদুতের নবাব শাহ নেওয়াজ সংগঠনে ১০০ টাকা চাঁদা দেন। প্রায় একই সময়ে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস অরগানাইজেসন। এই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ স্টুডেন্ট ফেডারেশন বিলুপ্ত করে নাম রাখা হয় অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান। বাংলায় নাম বদল হলেও প্রায় সব প্রদেশেই দলটি ফেডারেশন নামেই আরও কিছুদিন কার্যক্রম চালায়। শুরু থেকেই এই সংগঠন উপদলিয় কোন্দলে জর্জরিত ছিল। দলের সভাপতি ওয়াসেক সাহেব অছাত্র হিসাবে দীর্ঘ দিন পদ আঁকড়ে রাখায় মুজিব তার উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিলেন। মুজিবের উপদলের মত আরেকটি উপদলে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী ছিল। প্রাদেশিক ছাত্র লীগের তখনকার সভাপতি ছিলেন সাদেকুর রহমান এবং সাধারন সম্পাদক ছিলেন আনোয়ার হোসেন ।

১৯৪২ সালের চুঁচড়া সম্মেলনে কমিটি গঠন নিয়ে মুজিব এবং ফজলুল কাদের আবারো ক্ষিপ্ত হন কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাধা দেওয়ায় মুজিব ফজলুল কাদেরকে সমর্থন করে সম্মেলন্ বর্জন করে চলে আসেন। বগুড়া সম্মেলনে মুজিব উপস্থিত থেকেও সভা বর্জন করেন। শেখ মুজিব ১৯৪৩ সালে স্বতন্ত্র/বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে ইসলামিয়া কলেজের সাধারণ সম্পাদক  নির্বাচিত হওয়ার পরের ৪ বছর মুজিবের সাথে আর কেউ পাল্লা দিয়ে নির্বাচন করেননি। ফলে মুজিবের মধ্যে স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন করার বাসনা জাগে। ১৯৪৪ সালে অনেক দিন পর ছাত্র লীগের সম্মেলন হয়। মুজিবের মনে আশা ছিল এবার তিনি কিছু একটা হবেন। মুজিব মনে মনে ভাবতেন সাধারন সম্পাদক অসুস্থ তাই তার পরিবর্তে ঐ পদের তিনিই যোগ্য দাবিদার। এই সময়ে আবির্ভাব হল শাহ আজিজুর রহমানের। তিনি সুন্দর বক্তৃতা দিতে পারতেন। নাজিম উদ্দিনের গ্রুপ করতেন। সাধারন সম্পাদক আনোয়ার সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ তা গড়ে তোলেন। আনোয়ার সাহেব শাহ আজিজুরকে সাধারন সম্পাদক করার নিয়তে শাহ্‌ আজিজের এলাকা কুষ্টিয়াতে সম্মেলন ডাকলেন। ঢাকা বা কলকাতায় সম্মেলন করে শাহ্‌ আজিজকে সাধারন সম্পাদক করা সম্ভব ছিলনা ।এই সময়ে ফজলুল কাদের ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে মুল দলে সম্পৃক্ত হন। তার জায়গায় (উপদলে) আসেন ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক নুরুদ্দিন। তাদের দুই পক্ষে বিরোধে মুজিব কিছু করতে পারলেন না। শাহ্‌ আজিজুররা কমিটি ছিনিয়ে নিল ।

ছাত্রলীগের ইতিহাস
পাকিস্তান পর্ব

দেশ ভাগ হল মুসলমান ছাত্ররা অনেকেই এত দিন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পূক্ত ছিলেন। এর সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নেন। সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (অখণ্ড বাংলায় বলা হতো প্রধানমন্ত্রী) খাজা নাজিমুদিনের অনুসারী ছিলেন। কাউন্সিল সভার মাধ্যমে এই সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা তেমন ছিল না। কলকাতার মুসলিম লীগের সোহরাওয়াদী-আবুল হাশিম গ্রুপের অনুসারী তরুণ ও ছাত্ররা নতুন একটি ছাত্রসংগঠন তৈরির কথা ভাবলেন। অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র লীগের নাম পরিবর্তন করে হল অল ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্ট লীগ। শাহ্‌ আজিজুর রহমান সভাপতি পদে বহাল রইলেন। এবার শাহ্‌ আজিজ গোপন স্থানে কাউন্সিল করিয়ে নিজের পদ বহাল রাখলেন। তখন ছাত্রলীগের দু’টো গ্রুপ ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অল ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। মুসলিম ছাত্রলীগ চলতো শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এবং অল-ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চলছিল শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে। প্রথম গ্রুপকে ছায়া দিতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ২য় গ্রুপকে ছায়া দেন নাজিম উদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ভর্তি হলেন। মুজিব তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফলেট ছাড়া হল। লিফলেটে মুসলিম লীগ সরকারের সমালোচনা করা হল। সাড়াও পেলেন। তারা গোপন সভা করে একটি দল করার কাজ অনেকটা এগিয়ে নিলেন। অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের প্রাক বিভাগ জেলা কমিটি সমুহে মুল দলের প্রাদেশিক সাধারন সম্পাদক আবুল হাসিম (বদর উদ্দিন উমর এর পিতা) এর দাপট থাকায় আবুল হাসিম কলকাতায় থেকে যাওয়ার সিদ্দান্ত নেওয়ায় এসকল নেতারা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তথা মুজিব গ্রুপেই চলে আসে। তাদের মধ্যে ছিল খুলনায় শেখ আজিজ(স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রী), ইকরামুল হক যশোরে আব্দুল হাই, মোশারফ হোসেন, রাজশাহীতে ছিল এ এইচ এম কামরুজ্জামান (জাতীয় ৪ নেতার ১ জন), আতাউর রহমান, মোজাম্মেল হক, মাহবুবুর হক, আব্দুর রশিদ খান, বগুড়ায় বিএম ইলিয়াস, শাহ্‌ আব্দুল বারী, রংপুরে আবুল হোসেন, পাবনায় আব্দুর রফিক চৌধুরী, চট্টগ্রামে মাহবুব আনোয়ার, কুমিল্লায় খন্দকার মোস্তাক, নোয়াখালীতে মোহাম্মদ তোয়াহা, নাজমুল করিম ঢাকায় কাজি মোহাম্মদ বশির, ইয়ার মোহাম্মদ, তাজউদ্দিন, সামসুদ্দিন, মোহাম্মদ সওকত আলী, এ কে আর আহমেদ, মশিউদ্দিন আহমেদ রেজা মিয়া, আসলাম আলী, আব্দুল আওয়াল, কমরদ্দিন। এদের বাইরে কমিটির অন্তর্ভুক্তদের নাম নতুন করে উল্লেখ করা হয়নি। এদের মুল উদ্যোক্তা ছিলেন মুজিব, অলি আহাদ, সৈয়দ নজরুল, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইম উদ্দিন, মোল্লা জালাল উদ্দিন (স্বাধীন বাংলাদেশে মন্ত্রী), আব্দুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মতিন খান চৌধুরী। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলে ছাত্র সভা আহবান করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন নাজমুল করিম। এই সভাটাকে তলবি সভাও বলা যেতে পারে। নতুন দল গঠন ছাড়াও এই মিটিং এ মুল দল অক্ষুণ্ণ রেখে শাহ আজিজকে দল থেকে বহিস্কার করার পরিকল্পনাও ছিল।মিটিং শুরু হলে উদ্যোক্তারা নতুন দল গঠনের দিকেই ঝুকে পড়েন। সভায় জনাব নঈমুদ্দিন আহমদকে পূর্ব পাকিস্তান ও অলি আহাদকে ঢাকা শহরের আহবায়ক করিয়া কমিটি গঠন করা হয় এবং নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সদস্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়ঃ

১. নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) আহবায়ক, ২. আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), ৩. শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), ৪. অলি আহাদ (কুমিল্লা) আহবায়ক ঢাকা শহর কমিটি, ৫. আজিজ অহমদ (নোয়াখালী), ৬. আবদুল মতিন (পাবনা), ৭. দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), ৮. মফিজুর রহমান (রংপুর), ৯. শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), ১০. নওয়াব আলী (ঢাকা), ১১. নূরুল কবির (ঢাকা সিটি), ১২. আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), ১৩. সৈয়দ নূরুল আলম (ময়মনসিংহ), ১৪. আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। উল্লেখ্য এই কমিটির মুজিব, শেখ আজিজ, মতিন আর অলি আহাদ ছাড়া সবাই আর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। দবিরুল আইয়ুব সরকারের নির্যাতনে মুক্তি পাওয়ার পর আর বেশি দিন বাঁচেনি। ১৯৬২ সালের দিকে তিনি মারা যান।
শেখ মুজিবুর রহমান তখনো মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনের কোন মাতৃ সংগঠন ছিল না। মুসলিম লীগের বিদ্রোহী অংশ ছিল তাদের মাতৃ সংগঠন। একই নামে কোন দল হলে সভাপতি সাধারন সম্পাদকের নাম ব্র্যাকেট বন্দী হিসাবে দেখানো হয়, তখন হয়ত ব্র্যাকেটের ব্যাবহার চালু হয় নাই। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করার সময় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ ‘মুসলিম’ শব্দটি সংগঠনের নামের সঙ্গে ব্যবহার করার বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ওই মুহূর্তে এটা রাখা দরকার। তা না হলে মুসলিম লীগ সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে। এ জন্য কেউ কেউ শেখ মুজিবকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বানানোরও চেষ্টা করেছেন। যদিও শেখ মুজিব এটা কৌশল হিসেবেই নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার মত ছিল:
“এখনো সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই যায়-আসে না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।”
মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি সংগঠন থাকা সত্ত্বেও একই নামে কেন আরেকটি সংগঠন করা হল তার ব্যাখ্যাসমেত প্রচারপত্র বিলি করা হল। নতুন দল হলেও মুজিবের অনেক অনুসারী তার দলে সামিল হয়নি। তাদের মধ্যে ছিল সিলেটের আব্দুস সামাদ আজাদ। তার একটা কারন হতে পারে সিলেটের প্রায় সকল এম এল এ নাজিম উদ্দিন গ্রুপের ছিল। ছাত্র লীগের অফিস করা হল ১৫০ মোগল টুলীতে যেখানে মুসলিম লীগের বিদ্রোহীরা অফিস করতেন। মুজিবের প্রচেষ্টায় ১ মাসেই সমগ্র প্রদেশে জেলা কমিটি করা হল।
১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এখানেও উপদলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কনভেনর নইমউদ্দিনকে অসন্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হল। নইমউদ্দিনকে পরবর্তীতে রাজনিতির মাঠে তেমন দেখা যায়নি। এই অধিবেশনেই জনাব দবিরুল ইসলামকে সভাপতি ও জনাব খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। জনাব দবিরুল ইসলামের পর জনাব শামসুল হক চৌধুরী ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করিবার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত গ্রহণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করিয়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম রাখে।

সুত্রঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১ – ডঃ মোহাম্মদ হাননান, উইকিপিডিয়া
লেখকঃ সালাহউদ্দিন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ১৯৮৮-৯৪ ও হল সংসদ নেতা ১৯৮৯ শহিদুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!