You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.12.09 | শনিবার ও দৈনিক বাংলা-শিবপুরে তাজউদ্দিন ও সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়ােজন - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বর ৯, ১৯৭২ শনিবার ও দৈনিক বাংলা

শিবপুরে তাজউদ্দিন ও সমস্যা সমাধানে আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়ােজন ঃ শিবপুর। (নারায়ণগঞ্জ), ৮ ডিসেম্বর (বাসস)। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ। এখানে বলেন যে, জাতীয় পুনর্গঠনের বিরাট দায়িত্ব সম্পাদন ও জাতির বহুমুখী। সমস্যা সমাধানের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মত আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সুদৃঢ় সংকল্প প্রয়ােজন। ঢাকা থেকে ৩০ মাইল উত্তরে শিবপুর থানা সদর দফতরে জনতা ব্যাংকের শাখা উদ্বোধনকালে অর্থমন্ত্রী উপরােক্ত মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে উল্লেখযােগ্যসংখ্যক লােকের সমাবেশ হয়। সমাবেশে জনাব আহমদ খাদ্য সংকট ও অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসহ দেশের বিভিন্ন সমস্যার কথা। উল্লেখ করেন। তবে এ প্রসঙ্গে তিনি একথাও উল্লেখ করেন যে, অতীতে বছরের পর বছর যে সব সমস্যার সমাধান হয়নি এবং হানাদার আমলের পাক-বাহিনীর ধ্বংসলীলা এ সব মিলিয়ে উদ্ভূত সমস্যার আলােকে জনগণের বর্তমান অসুবিধার বিচার করতে হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, মােকাবিলা করার মত সংকল্প থাকলে কোন সমস্যাই তেমন বড় নয়, যা সমাধান করা যায় না। তিনি বলেন, তার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষ সাহস, দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমস্ত রকমের অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, সমস্ত রকমের অসুবিধা ও সংকট কাটিয়ে ওঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি।

তিনি সকলকে উৎপাদন বাড়ানাের প্রচেষ্টায় আত্মনিয়ােগের আবেদন জানান। অর্থমন্ত্রী বলেন, মানুষের দ্বারা মানুষের শােষণ অবসানের জন্য দেশে সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে সমাজতন্ত্র, যা শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে। জনাব আহমদ বলেন, আমাদের সমাজতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকটি লােকের কাজ করার অধিকার থাকবে এবং তাকে এমন পারিশ্রমিক দেয়া হবে, যাতে তিনি ভালভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। সহনশীলতার প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে সহনশীলতা। তিনি বলেন, এর অভাবে শুধু রাজনৈতিক দলগুলােরই ক্ষতি হবে না, রাষ্ট্রের খােদ স্বার্থও বিঘ্নিত হয়। রাজনৈতিক কাদা ছােড়াছুড়ির পথ পরিহার করে ক্ষমতাসীন ও বিরােধী এই উভয়পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি মন্ত্রী সহনশীলতার অনুশীলন শিক্ষার আহ্বান জানান। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থকে করেননি। নগণ্য কর্মী হিসেবে ঃ সেদিনের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা সংগ্রামের ন’মাসের স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনায় যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা বাংলাদেশ ও এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থেই নিয়েছিলাম। বাঙ্গালির আশা-আকাংখা আর বাঁচা-মরার প্রশ্নকে সেদিন সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দিয়েই আমি কাজ করে গিয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে এবং একজন খাঁটি বাঙ্গালি হিসাবে আমার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারায় আমি খুশি। তবে সামগ্রিক সাফল্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই। আমরা যা করেছি তা তারই নির্দেশিত পথ। কাজেই সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে আমাদের আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন ঘটুক আমরা সেটাই চাইব। বিপ্লব একদিনে হয়নি ঃ জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, বাংলাদেশের এই বিপ্লব কোন একদিনের ঘটনা নয়।

এর জন্য আওয়ামী লীগ বিরােধী দলের ভূমিকায় থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বাঙ্গালি জাতিকে ধীরে ধীরে বিপ্লবের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে এবং এভাবেই তাদের মানসিক প্রস্তুতি ঘটিয়েছে। এরপর ২৫ মার্চ রাতে জেনারেল ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালির উপর ঝাপিয়ে পড়লে সমগ্র বাঙ্গালি জাতি তার প্রতিরােধে ঐক্যবদ্ধ শপথ নিয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। হামলা শুরু হবার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে আমি জীবননগরে পৌছাই। সঙ্গে ছিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। মানুষের চেতনা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সুযােগ দিয়েছিল? তিনি বলেন, পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে অনিবার্য সুযােগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টঙ্গি নামক স্থানে একটি সেতুর নীচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হল ঃ “একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা”। সেদিন ঐ সীমান্তেই মেজর ওসমানের সঙ্গে আমার দেখা। তার কমান্ডে একটি ব্যাটালিয়ান তখন। কিন্তু হাতে সেই সেকেলে রাইফেল। এর বিপরীতে পাকিস্তানী খান সেনাদের হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিপুল সম্ভার। সেদিন মেজর ওসমানের বাহিনীর কাছে একটি লাইট মেশিনগানও ছিল না। যা হােক ১ এপ্রিলের মধ্যেই আমি কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করি এবং সেগুলাে মেজর ওসমানের হাতে দিয়ে দিই যা দিয়ে তিনি ঐ সীমান্তে পাক বাহিনীর অগ্রগতি রােধ করেন এবং তাদের হাত থেকে আরও বহু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দখল করেন। এরপর ১০ এপ্রিল আমি স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করি এবং ঐদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘােষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ১১ এপ্রিল মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য আমি বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘােষণা করে সেক্টর কমান্ডারও নিয়ােগ করি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী চুয়াডাঙ্গায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই ১৪ এপ্রিল।

এ খবরটা পত্রিকার আগাম প্রকাশ হয়ে পড়ায় বর্বর পাকিস্তানীরা পরের দিনই চুয়াডাঙ্গায় নির্বিচার বােমা বর্ষণ শুরু করে। ফলে সেখানে বহু লােক হতাহত হয়। এই বােমাবর্ষণের জন্য সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের চুয়াডাঙ্গা শহর ছাড়তে হয়েছিল। এরপর আমরা মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক স্থানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মনােনীত করে এর নাম দিই মুজিব নগর’। এরপর ১৮ এপ্রিল কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করি। সেই সঙ্গে শুরু হয় মুক্তি বাহিনীতে লােক নিয়ােগ। তিনি জানান, নিয়মিত, অনিয়মিত, আনসার, পুলিশ, যুবক, তরুণ মিলিয়ে মুক্তি বাহিনীর মােট সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তেমনি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করার লক্ষ্য ছিল নভেম্বর মাস। কেননা, আমি জানতাম, বাংলাদেশে বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হানাদার বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদের পরাস্ত করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সফলকাম হবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও আসবে । এছাড়া আরও বুঝেছিলাম যে, ঐ সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলে মার্কিনীরা তার সুযােগ নিবে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধকে নিয়ে আসবে বাংলার মাটিতে। কেননা, আমেরিকাকে ভিয়েতনাম থেকে সরতেই হবে। আর এ সম্পর্কে আমরা খুবই হুঁশিয়ার ছিলাম। মার্কিন ও পাকিস্তানী হঠকারিতা ও পাকিস্তানী এজেন্টদের তৎপরতার কথা তুলে জনাব তাজউদ্দিন বললেন, তারা সবসময়ই আওয়ামী লীগের ব্যাংক ও ফাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার কাজে নিযুক্ত ছিল।

এ জন্যে তারা নানা রকমের গুজব ছড়াত—দলীয় নেতা, উপনেতা ও কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু তারা ঐ সব এজেন্টের কথায় কর্ণপাত করেননি এবং তাদের ঐক্য ঠিকই। বজায় রেখেছিল। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, সে দিন তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামই যে ব্যর্থ হয়ে যেত সে কথা জোর করেই বলা যায় । তিনি আরও জানান যে, পাকিস্তানী এজেন্টদের চাইতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্টরা আমাদের বেশি উৎপাত করেছিল। তারা আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল এবং আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর রিপাের্ট প্রকাশ করত। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের বােকামির জন্যে আমরা সবচেয়ে লাভবান হয়েছি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ইয়াহিয়া বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্র ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সির ওপর আঘাত হেনেই প্রচন্ড ভুল করেছিল। আর এইটেই আমাদের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল এবং সমগ্র বাঙ্গালি জাতিকে তা মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ও তিনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং এর সভাপতি শ্রী রমেশ চন্দ্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, শ্রী রমেশ চন্দ্র সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী মি. কসেগিন, জাতিসংঘে তদানিন্তন মহাসচিব উথান্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তাদেরকে বাংলাদেশের বক্তব্য বুঝিয়ে বলেন এবং পরে তার (তাজউদ্দিন) সাথে দেখা করেন।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি