You dont have javascript enabled! Please enable it!

অক্টোবর ৩১, ১৯৭২ মঙ্গলবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা

সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয় ঘটানাে হয়েছে ঃ স্টাফ রিপাের্টার । অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল সােমবার সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলােচনায় অংশ নিয়ে বলেন, যত সুন্দর ভাষা ও শব্দ দিয়ে সংবিধান লেখা হােক না কেন জাতির জীবনে তা প্রয়ােগ না হলে সেটা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আর সংবিধানকে জাতীয় জীবনে বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংসদীয় সদস্যদের ওপরই ন্যস্ত। মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের এক চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খকে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি জাতির জন্য সংবিধান হচ্ছে এক পবিত্র দলিল। আমাদের খসড়া সংবিধানে তাই জাতির আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, খসড়া সংবিধানে প্রগতির পথে আমাদের যাত্রা সূচনার বিধি ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে এবং জাতির ভবিষ্যত অগ্রগতি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৪৭-র তথাকথিত স্বাধীনতার পর থেকে বাঙ্গালি জাতি তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সগ্রাম শুরু করে। এর জন্য তাকে বহু রক্ত দিতে হয়েছে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, শুধুমাত্র বিরােধিতার জন্য খসড়া সংবিধানের বিরােধিতা করা উচিত নয়।

যে কোন যুক্তিসঙ্গত সংশােধনীই সংবিধানে সংযােজিত করা হবে। তিনি বলেন, খসড়া সংবিধান তৈরি করার সময় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে যাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই এটা অপ্রয়ােজনীয় বলে প্রমাণিত না হয়। খসড়া সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক অধিকাগুলিকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই অধিকারগুলিকে রাষ্ট্র বাস্তবায়িত করবে। বিশ্বব্যাপী প্রচলিত নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে এই মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানে সংযােজিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, কিন্তু মৌলিক অধিকার সংযােজন করলেই কেবল চলবে না, জনগণ যাতে এসব অধিকার ভােগ করা থেকে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এব্যাপারে সামাজিক সচেনতা একান্ত প্রয়ােজন। তিনি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলােকে জনগণকে অধিকার সচেতন করে তােলার ব্যাপারে অগ্রবর্তি ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানান। জনগণ সচেতন না হলে আদালত তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিকে আদালতের আওতাধীনে এনে বিচারাধীন করার দাবির উল্লেখ করে বলেন, এতে কোন লাভ হবে না। তিনি বলেন, গণ-পরিষদ সদস্যদের দায়িত্ব হচ্ছে খসড়া সংবিধানে জনগণের আশা আকাংখা প্রতিফলন হয়েছে কিনা তা দেখা। অযৌক্তিক কোন প্রস্তাব তাদের পেশ করা উচিত নয়। তিনি বলেন, মৌলিক অধিকার আইনের দ্বারাই বলবৎ হয়। আজ যা আমাদের দৃষ্টিতে আসেনি বা আমরা অনুভব করিনি ভবিষ্যৎ সংসদ মূলনীতি অনুসরণ করে প্রয়ােজনে যে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবেন।

এই সংবিধান সমাজতান্ত্রিক হয়নি বলে বিভিন্ন মহলে যে সমালােচনা উঠেছে তার জবাবে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, কোন সংবিধানেই একদিনেই সমাজতন্ত্র কায়েমের বিধান দেওয়া হয়নি, কেউ যদি এমন ব্যবস্থা আমাদের বাতলে দিতে পারতেন যে সংবিধান পাসের পরই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায় আমরা তা সাদরে গ্রহণ করতাম। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের দার্শনিকরাই বলেছেন যে, শেষ কথা বলে কিছুই নাই, তাহলে ভবিষ্যৎ অগ্রগতি রুদ্ধ হবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, বর্তমান মানসিকতার পরিবর্তন ও সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্রে জনগণ দীক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের সমাজতন্ত্র আসতে পারে না। তিনি বলেন, আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনও পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌছতে পারিনি। সামন্ত প্রভু আজ নেই সত্য-কিন্তু সামন্ত মনােবৃত্তি এখনও রয়েছে। এই মানসিকতার আগে পরিবর্তন করতে হবে। তিনি বলেন, কৃষি ও ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে অগ্রগতি সাধনের জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবিধানের সাথে যারা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের তুলনা করেন তাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আমাদের বর্তমান অবস্থার সাথে ঐসব দেশের বর্তমান অবস্থার তুলনা করা উচিত নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালেই তার মেনিফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের কথা বলেছে এবং দীর্ঘ দিন ধরে তার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!