জুলাই ২, ১৯৭২ রবিবার ঃ দৈনিক বাংলা
কোন একটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা নয় ; বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য নেব, খেয়ে থাকব তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব না : স্টাফ রিপাের্টার। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন যে, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজন হলে খেয়ে মরব, তবুও শর্তযুক্ত কোন ঋণ নেব না। গতকাল শনিবার বাজেট সম্পর্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিদেশী সাহায্য গ্রহণ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের নীতি হচ্ছে কোনও একটি দেশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল না হয়ে, বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করা। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, ভিক্ষার ঝুলি হাতে করে দ্বারে দ্বারে ঘুরে আমরা জাতিকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করতে চাই না; যেমনটি পাকিস্তান হয়েছিল। পশ্চিমা দেশের সাহায্য নিয়ে জোট নিরপেক্ষতা রক্ষা ও সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ স্থাপন সম্ভব কিনা এই প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, একটা জাতি যখন মাথা তুলে দাঁড়ায় তখন তাকে কেউ রােধ করতে পারে না।
আমরা পাকিস্তানী শাসনের বন্ধন ছিন্ন করেছি। ভবিষ্যতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাইলে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি করতে হলে কোন দেশই বিদেশী সাহায্য ছাড়া এগুতে পারবে না। তবে সে সাহায্য শর্তযুক্ত না নিশর্ত হবে সেটাই বিচার্য বিষয়। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের উন্নয়ন বাজেটে ৩৭৫ কোটি টাকা বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে দু’শাে কোটি টাকা ফেরত দিতে হবে না। তিনি বলেন, এই সামান্য সাহায্য পেয়ে দেশের জনগণ যদি তাদের আদর্শ ভুলে যায় তাহলে কিভাবে তাদের রােধ করা যাবে। তিনি দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করে বলেন যে, বিপদের সময় সাহায্য নিয়ে জনগণ আদর্শ ভুলে যাবে বলে আমি মনে করি না। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দের স্বল্পতার প্রতি জনৈক সাংবাদিক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, বন্যা সমস্যা কত বড় এবং ব্যাপক তা আমরা এখনাে পুরােপুরি জানি না। একটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাজ করছি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, এ খাতে কত বরাদ্দ হল সেটা বড় কথা নয়।
এই সমস্যার ব্যাপকতা পরিমাণ করা ও তার জন্য কি প্রয়ােজন তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। সে কাজই আমরা এখন করছি। খাদ্য উৎপাদন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ খাতে কম বরাদ্দের ফলে খাদ্য উৎপাদনে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হবে কিনা, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আগে বর্ষাকালীন ফসলের উপর বেশি। জোর দেয়া হত। এখন শীতকালীন ফসল ইরি, বােরাের ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। তবে বর্ষায় যে সব এলাকায় বন্যা হয় না, যেমন উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহ, সে সব এলাকার উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বাড়ানাে হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বন্যা নিয়ন্ত্রণে ভারতের সঙ্গে যৌথ নদী কমিশন গঠন এবং অন্যান্য সহযােগিতার কথা উল্লেখ করেন। সমাজতন্ত্র ঃ দেশে সমাজতন্ত্র ও শােষণহীন সমাজ কায়েমের মূলমন্ত্র এই বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, সমাজতন্ত্রের অন্যতম মূলকথা হচ্ছে অর্থের ও সম্পদের সুষম বন্টন এবং ভাগ্যবান শ্রেণী সৃষ্টি না করে সাধারণের ভাগ্যোন্নয়ন। উন্নয়ন বাজেট সাধারণের ভাগ্যোন্নয়নের প্রতি লক্ষ রেখেই। প্রণয়ন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি গ্রামভিত্তিক পরিকল্পনা উল্লেখ করেন। এই বাজেটকে প্রগতির সহায়ক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এই বাজেট দেশকে প্রগতির বুনিয়াদ গড়ে তুলতে সাহায্যে করবে।
উন্নয়ন বাজেট অর্থমন্ত্রী জানান যে, বর্তমান উন্নয়ন বাজেট একটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি মাত্র। পাঁচসালা পরিকল্পনা থাকলে তার সঙ্গেই এটা প্রকাশ করা হত। সরকার একটি পাঁচসালা পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। বিনিয়ােগ তফশিল দ্রুত প্রকাশের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান। ভারতীয় কয়লা ঃ ভারতীয় কয়লার মূল্য সম্পর্কে তিনি বলেন যে, পরিবহন ব্যয় বাদে এর দাম প্রতি টন ৭০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আগে পােল্যান্ড-চীন হতে আমদানিকৃত কয়লা এ দেশে ১৫০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হত। জামালগঞ্জের কয়লা সম্পর্কে তিনি বলেন, পাকিস্তানী শাসকরা এ দেশে এককালে সােনার খনিও আকিকার করেছিল। পরে সােনার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। কাজেই এ ব্যাপারে আসলে সঠিক কোন রিপাের্ট পেশ করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের নিকট হতে এই বাজেট সম্পর্কে গঠনমূলক সমালােচনা আহ্বান করে তার প্রতিকারের পথ নির্দেশ দানের অনুরােধ জানান। দেশ গঠনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সহযােগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ব্যাপারে সহযােগিতা কামনা করেন।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি