You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুলাই ১, ১৯৭২ শনিবার ঃ দৈনিক বাংলা

বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ; রাজস্ব খাতে উদ্বৃত্ত ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও পুনর্গঠন বাজেট ; নতুন কর নেই : স্টাফ রিপাের্টার। এবার আর কোন নতুন কর নাই । স্বাধীন বাংলার প্রথম বাজেট করের অভিশাপ মুক্ত। বিধ্বস্ত বাংলার এবার পুনর্গঠনের পালা। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাই বাজেটকে বলেছেন, উন্নয়ন, পুননির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট। এ বাজেটে রাজস্ব খাতে উদ্ধৃত হয়েছে ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই উদ্বৃত্ত হাতে নিয়ে অর্থমন্ত্রী ৫০১ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেছেন—উন্নয়ন, পুননির্মাণ ও পুনর্বাসনের কর্মসূচি সামনে রেখে । এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩১৮ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। এবারের বাজেটে পাকিস্তানী আমলের দুঃস্বপ্নের মতই পরিত্যক্ত হয়েছে প্রতিরক্ষা খাতের অশুভ প্রভাব। এবার জোর দেয়া হয়েছে শিক্ষা ও কৃষি খাতের উপর । প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৪৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে ৩১৮ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ১০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে কৃষি খাতে। এই বাজেটে নতুন কোন কর ধার্যের প্রস্তাব করাই হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দাম যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকেও দৃষ্টি রাখা হয়েছে। বিস্তৃত বিবরণ ঃ ১৯৭২-৭৩ সালের রাজস্ব বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ২৮৫ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকা এবং ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৮ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা। এতে রাজস্ব খাতে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। রাজস্ব খাতে আয়ের মধ্যে সাবেক কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে কর শিরােনামায় প্রদর্শিত হয়েছে ২৪০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প ও প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে প্রাপ্তি হিসেবে ধরা হয়েছে ১৫ কোটি আর ভূমি রাজস্বের অংক স্থির হয়েছে ৪ কোটি টাকা। রাজস্ব খাতে ব্যয়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছে শিক্ষা খাতে।

এই খাতে ৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। শিক্ষার উপর সরকার যে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, এই বরাদ্দ তারই পরিচয় বহন করে। প্রতিরক্ষা বাবদ খরচের মাত্রা সার্বিক উন্নয়ন বহির্ভূত ব্যয়ের শতকরা মাত্র ১৮ ভাগ। উন্নয়ন বহির্ভূত মূলধন খাতে নীট ঘাটতি ধরা হয়েছে ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬ কোটি টাকা কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রকল্পিত তগাবি কৃষি ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হবে। সরকারী কর্মচারিদের গৃহ নির্মাণের জন্য ঋণ দান বাবদ যথারীতি ব্যয় সংযােজিত হয়েছে। নিম্নবেতনভুক কর্মচারিদের জন্য যথাযথ চিকিৎসা ভাতারও ব্যবস্থা এই বাজেটে স্থান পেয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালের উন্নয়ন, পুননির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেটে মোেট ৫০১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৮ কেটি ৩০ লাখ টাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের খাতে। বাকি ১৮২ কোটি ৭০ লাখ টাকা খরচ হবে পুননির্মাণ ও পুনর্বাসন খাতে। এই বাজেটের অংকের মাত্রা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে, আমাদের উন্নয়ন, পুননির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেটের পরিমাণ যে সরকারের নিজস্ব সম্পদ পরিধির বাইরে সে সম্পর্কে আমরা সচেতন। কিন্তু আমরা সারা পৃথিবী থেকে উদার সাহায্য পাচ্ছি। এ জন্যেই বাজেটের মাত্রা উল্লিখিত অংকে স্থির করতে মনস্থ হয়েছি। ১৯৭২-৭৩ সালের উন্নয়ন ও পুনর্গঠন পরিকল্পনায় সম্পদের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী প্রকাশ করেন যে, বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের নিকট হতে আরাে সাহায্য লাভের মাধ্যমে তা পূরণ হবে। এরপরও উন্নয়ন, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন খাতে বাজেটকৃত অংকের সঙ্গে ১২৬ কোটি টাকার ব্যবধান থাকবে।

এই ব্যবধান পূরণের জন্য উন্নয়ন বহির্ভূত খাত থেকে উদ্ধৃত্ত ৫৮ কেটি ৮০ লাখ টাকা আসবে। ফলে নীট ঘাটতি হবে ৬৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। আমদানি-রফতানি শুল্ক ও ইতােপূর্বে আরােপিত কর বিন্যাস করে ৬ কোটি ২০ লাখ টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ টাকা সংগ্রহের পর ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৬১ কোটি টাকার। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ খাত নিয়ে এই ৬১ কোটি টাকা ১৯৭২-৭৩ সালে সংগৃহীত হবে বলে অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন। এই বাজেটের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের বাজেট পেশ করেন। উক্ত সময়ে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে। ৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ব্যয় ৯৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এতে ৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা ঘাটতি দেখান হয়েছে। ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক উন্নয়ন সাহায্য ও পুনর্বাসন বাজেটের অবয়ব স্থির হয়েছে ১৫৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়। উন্নয়ন বহির্ভূত খাতে ৬১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঘাটতির প্রেক্ষিতে মােট টাকার প্রয়ােজনমাত্রা দাঁড়ায় ২২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকায়। এসময় বৈদেশিক সাহায্যের প্রাপ্তির পরিমাণ হিসেব করা হয় ১১৩ কোটি টাকায়। প্রয়ােজনীয় বাকি ১০৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ থেকে ঋণ হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। উন্নয়ন খাতে এই বছরের ব্যয় হচ্ছে ৫১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে জনগণকে কৃতা সাধনের আহবান জানিয়ে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয়ভার অভ্যন্তরীণ সম্পদের ভিত্তিতে নিজেদেরকে বহন করতে হবে।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!