বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতার প্রতি মুক্তিফৌজের আহ্বান
বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ তাদের প্রথম প্রকাশিত ইস্তেহারে মুক্তিফৌজ জনতাকে আহ্বান করে নিম্নের ইস্তেহার জারি করেছেন।
‘সারা পূর্ববাংলা জুড়িয়া স্বাধীনতা সংগ্রাম চলিতেছে। বাংলাদেশের মানুষকে গােলাম বানাইয়া রাখিবার ইয়াহিয়া জঙ্গিশাহী ও দেশীয় মীরজাফরদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পরিণত হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানি দস্যুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলিয়া যতই চিকিৎসা করুক না কেন সারা বিশ্বের কাছে আজ ইহা সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাহারা রক্ষা করিবেই। শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য কায়েম করিবে সুখী-সমৃদ্ধশালী সমাজ ব্যবস্থা। সংগ্রামী দেশবাসী, সারা বাংলাদেশ জুড়িয়া আজ যে যুদ্ধ চলিতেছে তাহা জনতার যুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ সেই বীর জনতার অংশ ও অগ্রবাহিনী। বাংলাদেশের বীর মুক্তিফৌজের হাতে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার পাক সেনা নিহত ও তিন শতাধিক অফিসার নিহত হইয়াছে। এই যুদ্ধে প্রতিটি বাঙালির তাই নিজ নিজ উদ্যোগে আগাইয়া আসা পবিত্র কর্তব্য।
বন্ধুগণ, লুটেরা পশ্চিম পাকিস্তানিরা একদিকে যেমন নারী-পুরুষ, শিশু-হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে নিষ্ঠুর গণহত্যায় মাতিয়াছে, অন্যদিকে তেমনি বন্দুকের নলের মুখে অফিস-আদালত, কোর্ট-কাছারি, মিল-কারখানা খুলিয়া গত ২৩ বছরের ন্যায় পুনরায় বাংলাদেশের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে লইয়া যাইতেছে। বিশেষ করিয়া শূন্য কোষাগার পূরণ করিবার জন্য ঘৃণ্য সরকার বাংলাদেশের সােনার আঁশ পাটের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়াছে।
সামরিক ও অর্থনৈতিক দিকে যেমন রাজনৈতিক দিকেও তেমনি বাংলাদেশে তাহাদের শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠিত করিবার জন্য পাকিস্তানি’ কুত্তারা ব্যস্ত। বাঙালি মীরজাফরদের লইয়া তাহারা গঠন করিয়াছে শান্তি কমিটি। এই শান্তি কমিটির কাজ হইতেছে পাকিস্তানি দস্যু সেনাদের হাতে স্বদেশ প্রেমিক বীর সেনানীদের সােপর্দ করা, মা-বােনদের ইজ্জত নষ্ট, বাড়ি-ঘর জ্বালানাে ও লুটের কাজে তাহাদের সাহায্য করা এবং জনগণের প্রতিরােধের মনােবল নষ্ট করা। গােলামের জাত এই চশমখােররা ইয়াহিয়া-টিক্কাকে একটি তাবেদার সরকার উপহার দিতে চাহিতেছে।
দেশবাসী ভাই বােনেরা,
সামরিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই তিন সংগ্রামেই আজ শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করিতে হইবে এবং ইহা করা সম্ভব। বাংলার দুর্জয় মানুষকে দমন করার সাধ্য কাহারও নাই। তাই প্রকৃত বাঙালি হিসেবে নিম্নোক্ত কর্তব্য কর্মগুলাে অবিলম্বে বাস্তবায়িত করুন।
* মুক্তিফৌজে যোগ দিন।
* কোনাে এলাকায় মুক্তিফৌজ গেলে তাহাদের আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যবিধ সর্বপ্রকার সাহায্য করুন।
* শত্রুসেনার অবস্থান মুক্তিফৌজকে জানান।
* এলাকার দালাল ও স্পাইদের জানে-মালে খতম করুন।
* মুক্তিফৌজের সমর্থনে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরােধ বাহিনী সৃষ্টি করুন।
* শত্রুসেনার সরবরাহ- রেল, রাস্তা, নদীপথে ব্রিজ লাইন নষ্ট করিয়া বিঘ্ন সৃষ্টি করুন।
* অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানায় যােগ দেবেন না।
* খাজনা-ট্যাক্স ঋণের টাকা পরিশােধ বন্ধ করুন।
* পশ্চিম পাকিস্তানি দ্রব্য বর্জন করুন।
* পাট ও পাটজাত দ্রব্য যাহাতে রপ্তানি না হইতে পারে তাহার জন্য পাটগুদাম, পাটবাহী যানবাহন
ও পাটের বাজার ধ্বংস করুন।
* শান্তি কমিটি ও যে সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ জঙ্গিশাহীর সহিত হাত মিলাইয়া তাবেদারি করিতেছে, তাদের হত্যা করুন।
সূত্র: দেশের ডাক ২৮ মে, ১৯৭১
১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮