You dont have javascript enabled! Please enable it!

এপ্রিল ৬, ১৯৭২ বৃহস্পতিবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ

সরকারী কর্মকর্তারা দলীয় কর্মকর্তা হতে পারে না : (এনা), ঢাকা, ৫ এপ্রিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ বলেন যে, সরকারী কর্মকর্তারা দলীয় কর্মকর্তার পদে বহাল থাকতে পারবেন না। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, একজন মন্ত্রীর পক্ষে দলীয় কর্মকর্তার পদে বহাল থাকা উচিত নয়। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, কোন ব্যক্তি যদি একই সাথে সরকার এবং দলের অন্তর্ভূক্ত হন তা হলে দলে রাজনৈতিক ভারসাম্যের ক্ষতি এবং শাসন কাজে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ঢাকা, ৭-৮ এপ্রিল, ১৯৭২। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭২ সন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদের রিপাের্ট শ্রদ্ধেয় সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিষদের সদস্য ও প্রতিনিধিবৃন্দ, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে আজ সর্বাগ্রে স্মরণ করি সেই অগণিত শহীদদেরকে, যাদের চরম আত্মত্যাগের ফলে আজ আমরা স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করতে পেরেছি। সশস্ত্র বাহিনী ও গণ-বাহিনীর শহীদ সদস্যদের পাশাপাশি আজ স্মরণ করি জনাব মসিহউর রহমান, আমজাদ হােসেন, আমিনউদ্দিন আহমদ, ডাঃ জিকরুল হক, মাসুদুল হক চৌধুরী, মিলি চৌধুরী ও আলাউদ্দিনের মত আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদেরকে, যারা বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন।

এই সঙ্গে স্মরণ করি জনাব আবদুর রবকে, স্বাধীনতার পরে এক দুর্ঘটনায় যাকে আমরা হারিয়েছি। এইসব আত্মত্যাগী পুরুষের অমলিন আদর্শ। আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে চিরকাল দেশহিব্রতে অনুপ্রাণিত করবে। ১৯৭০ সালের জুন মাসের ৩ থেকে ৫ তারিখে যখন আমাদের বিগত অধিবেশন। অনুষ্ঠিত হয়, তখন আমাদের পশ্চাতে ছিল ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ঐতিহ্যপূর্ণ স্মৃতি এবং সামনে ছিল দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। গত অধিবেশনে আমরা সেই সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একদিকে ৬-দফা ভিত্তিক শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবকে সামনে রেখে এবং অন্যদিকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিয়ে। ইতিহাসের ধারায় আজ আমাদের তখনকার অনেক চিন্তা-ভাবনা ও ভয়ভীতি সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে গেছে। আবার তখনকার অনেক পরিকল্পনা আজ নতুন তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ আমার রিপাের্ট ঐ কাউন্সিল সভার পরবর্তী। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের একটা বিবরণ দেওয়া কর্তব্য। আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এই। নির্বাচন হবে ৬-দফা সম্পর্কে একটা গণভােট। এই ঘােষণায় সামরিক চক্র, কায়েমী স্বার্থবাদীরা এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলি ভয় পেয়েছিল। এইসব রাজনৈতিক দল জনসমর্থন ও নির্বাচনী প্রস্তুতির অভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবি জানিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, বাংলাদেশে বন্যা হবে এবং তার ফলে নির্বাচন হতে পারবে না। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে দেশে যখন বন্যার সূচনা হয়, তখন এই দাবি জোরদার হল। আওয়ামী লীগ এই দাবি সমর্থন করেনি।

কারণ, আমাদের এই আশঙ্কাও ছিল যে, কায়েমী স্বার্থবাদীরা কোন না কোন ছলে হয়তাে নির্বাচন এড়িয়ে যেতে চাইবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বললে তারা সেই সুযোেগ লুফে নেবে। বন্যার পরে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ সেই সুযােগের সৃষ্টি করল এবং ইয়াহিয়া খান তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নির্বাচন পিছিয়ে দিলেন ডিসেম্বরে। নভেম্বর মাসে দেখা দিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের দশ লক্ষাধিক মানুষ সে দুর্যোগে প্রাণ দিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চীন সফর শেষে ঢাকা হয়ে ইসলামাবাদে ফিরে গেলেন—অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর এই মর্মান্তিক দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখার সময় করতে পারলেন না। পৃথিবীর দূর দেশ থেকে সাহায্যসামগ্রী এবং তার বিতরণের জন্য হেলিকপ্টার এসে পৌছালাে-অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার বসে রইল, ইয়াহিয়ার মনােনীত প্রাদেশিক গভর্নরও তা চেয়ে পেলেন না। বাংলাদেশের মানুষের এই মরণ যন্ত্রণার মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্মান্তিক ঔদাসীন্যে দেশবাসীর কাছে সরকারী বৈষম্য নীতির স্বরূপ নতুন করে উদঘাটিত হল। যে মােহ বহুদিন আগে থেকেই ভাঙতে শুরু হয়েছিল, এবারে তার আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। আবারও নির্বাচন পিছিয়ে দেবার প্রস্তাব উঠল, কিন্তু গণ-সমর্থনহীন দলগুলির এই দাবির সুযােগ নিতে এবারে আর ইয়াহিয়া খান সাহস করলেন না। ডিসেম্বর মাসের ৭ ও ১৭ তারিখে শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। বাত্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলে নির্বাচন হল ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতে হল জাতীয় পরিষদের উপ-নির্বাচন।

এইসব নির্বাচনে-ইয়াহিয়া খান নিজেই যাকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে বর্ণনা করেছিলেন—আওয়ামী লীগের বিজয় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করল। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পরে দেশবাসী শেষবারের মত আশা করল যে, কায়েমী স্বার্থবাদীদের খেলা এবারে শেষ হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী এবারে ঔপনিবেশিকতাবাদী মনােবৃত্তি পরিত্যাগ করে নির্বাচনের রায় মেনে নেবেন, ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। জানুয়ারি মাসের মধ্যভাগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে “পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী” বলে আখ্যা দিলে জনমনে সে-আশা দৃঢ়তর হয়। জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক এবং পিপলস পার্টি সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৬-দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা সম্পর্কে আলােচনা হয়। সংবিধান সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের বা পিপলস পার্টির পক্ষ থেকে কোন বক্তব্য এসব আলােচনায় উত্থাপিত হয় নি, বরঞ্চ তারা শুধু ৬-দফার তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত হতে চেয়েছিলেন। অন্যপক্ষে সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৬-দফা সমর্থন করেছিলেন । ভুট্টো চেয়েছিলেন, পরিষদের বাইরে আগে সংবিধানের প্রশ্নে মীমাংসা হয়ে যাক, আর আমরা চেয়েছিলাম, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেই সংবিধান রচনার কাজে অগ্রসর হওয়া, প্রয়ােজনীয় আলাপ আলােচনা পরিষদ চলাকালেই হতে পারত। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৫ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টকে অনুরােধ করেন। প্রেসিডেন্ট যখন সে দাবি উপেক্ষা করে ভুট্টোর পরামর্শ অনুযায়ী ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন, তখন আমরা ক্ষুন্ন হলেও সে তারিখ মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ভুট্টো আকস্মিকভাবে পরিষদ বর্জনের হুমকি দিলেন। ভুট্টোর হুমকি এবং তার পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল উমরের সক্রিয় কার্যকলাপ সত্ত্বেও, পিপলস্ পার্টি ও কাইয়ুম মুসলিম লীগের সদস্যব্যতীত জাতীয় পরিষদের সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যই হয় ঢাকার এসে গিয়েছিলেন নয়তাে নির্ধারিত সময়ে ঢাকার আসবার জন্য টিকিট করেছিলেন। এমন কি, কাইয়ুম লীগ ও পিপলস্ পার্টির বহু সদস্যই যথাসময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুট্টোর প্রতিরােধ ভেঙে পড়তে পারে, এই ভয়েই ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রাখার ঘােষণা করেন। সেই সময়ে সংবিধানের খসড়া রচনার কাজে আওয়ামী লীগ প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছেছিল। ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট খসড়া প্রণয়ন কমিটি প্রভূত পরিশ্রম করে এই কাজ করেছিল এবং ১ মার্চে পূর্বাণী হােটেলে কমিটি মিলিত হয়েছিল এ-বিষয়ে চূড়ান্ত আলােচনা করার জন্য। ঠিক সেই সময়েই প্রেসিডেন্টের ঘােষণার কথা। আমরা জানতে পারি । এই ঘােষণায় সারা বাংলাদেশে, বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় ও ধর্মঘট পালিত হয়। বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ তখন থেকেই স্বাধীনতার কথা ভাবতে আরম্ভ করে। বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তারিখে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের আহবান জানান। কিন্তু সামরিকচক্র শান্তিভঙ্গের সকল ব্যবস্থা পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে। গভর্নরের পদ থেকে ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানকে অপসারিত করা হয় এবং ২ ও ৩ মার্চ নিরস্ত্র জনতার উপর সামরিক বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। ছাত্র লীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহুত ঢাকার জনসভায় ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এর পরবর্তী ঘটনা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। এরকম পরিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় নি। শুধু যে সর্বশ্রেণীর মানুষ অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়েছিল তা নয়; প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্দেশে দেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকে সচল | করে রেখেছিল। বিভিন্ন সময়ে মানুষ আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল পরামর্শ নেবার।

জন্য এবং পরামর্শ দেবার জন্য। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগই সে সময়ে একমাত্র বৈধ সরকার হিসেবে দেশের কর্ম-পরিচালনা করেছিল। সামরিক বাহিনীর দমন নীতি ও উত্তেজনা সৃষ্টির সকল প্রয়াস সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ আশ্চর্য ঐক্য ও শৃঙ্খলার পরিচয় দিয়েছিল। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের মুখে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগের প্রতি সকল দোষ আরােপ করেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথা ঘােষণা করেন। একই দিনে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুবকে অপসারণ করে কুখ্যাত টিক্কা খানকে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় । কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতিদের অসহযােগের ফলে তিনি গভর্নর হিসেবে শপথ নিতে পারেন নি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য চারটি পূর্বশর্ত আরােপ করেন। তিনি ঘােষণা করেন : “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি দেশবাসীকে সেই বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশবাসী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। অন্যদিকে ১ মার্চ থেকে অবাঙ্গালি সামরিক অফিসারদের ও পশ্চিম পাকিস্তানী ধনীদের পরিবার-পরিজন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হতে থাকে এবং সামরিক ও বেসামরিক বিমানে সামরিক বাহিনীর লােকজন, অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদপত্র বাংলাদেশে আমদানি করা হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে আপােস-আলােচনার ছল করে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে পৌছেন। পরে তার আমন্ত্রণক্রমে ভুট্টোও ঢাকায় আগমন করেন। ১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় এই আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে বঙ্গবন্ধু এককভাবে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিলিত হন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের উচ্চতম পর্যায়ের পাঁচজন নেতাসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া পক্ষের আলােচনা হয়।

তৃতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্টনের বিষয় আলাপ করেন। এসব আলােচনার ফলে যেসব বিষয়ে মতৈক্য স্থাপিত হয়, তা হল ঃ (১) ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অনুসরণে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাবলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিয়ে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে। জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন ও কেন্দ্রীয় সরকার তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রদেশসমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে।  (৪) জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যেরা প্রথমে পৃথকভাবে মিলিত হবেন, পরে পরিষদের পূর্ণ অর্থাৎ যুক্ত অধিবেশনে সংবিধানের চূড়ান্ত রূপদান করা হবে। এই মতৈক্যের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের পথে আর কোন বাধা ছিল না। তাই ২৪ মার্চে সাংবাদিকদেরকে আমি বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর আলােচনার মত কোন বিষয় নেই। ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের অনেকগুলি ঘটনা ঘটে। জয়দেবপুরে ঘটনায় বহু ব্যক্তি হতাহত হয়। সরকারের বর্বর দমন নীতি সত্ত্বেও দেশবাসীর মনােবল অটুট থাকে এবং স্বাধীনতার দাবি প্রবলতর হতে থাকে। এক্ষেত্রে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ। উন্নয়নশীল দেশমাত্রেই ছাত্র সমাজ রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশেও তার অন্যথা হয় নি। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে তারা প্রকাশ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করে এবং স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিতে থাকে। ২৩ মার্চ তারিখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ইয়াহিয়া খানের সমর-প্রস্তুতি আমাদেরও অগােচর ছিল না।

কিন্তু দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে যে গুরুদায়িত্ব আমাদের উপর অর্পিত হয়েছিল, তার ফলে আওয়ামী লীগকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। সামরিক চক্র এই অবস্থায় নতুন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙ্গালি কমাণ্ডিং অফিসারকে অপসারণ করে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসারকে তার দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় এবং সেইদিন সন্ধ্যায়ই “সােয়াত” জাহাজ থেকে জোর করে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয়। অসহযােগ আন্দোলনের পূর্বঘােষিত নীতি অনুযায়ী নিরস্ত্র জনসাধারণ অস্ত্রশস্ত্র পরিবহনের পথ রােধ করলে সামরিক বাহিনী তাদের উপর ক্রমাগত গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে অসংখ্য লােক হতাহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২৭ মার্চ তারিখে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানান। ২৫ মার্চ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান রচনার জন্য সরকার পক্ষ ও আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বিশ্বাসঘাতকতার এক অতুলনীয় ইতিহাস রচনা করে, কাউকে কিছু না জানিয়ে, আলােচনার সমাপ্তি ঘােষণা না করে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাতের বেলায় ঢাকা ত্যাগ করেন। তার পরেই পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী টিক্কা খানের ঘাতক সেনারা মধ্যরাতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যার তান্ডবে মেতে ওঠে। তারই মধ্যে তারা গ্রেপ্তার করে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৬ মার্চ রাতের ভাষণে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘােষণা করেন। কুর্মিটোলায় সেনানিবাসে, পীলখানায় ই.পি.আর, সদর দফতরে ও রাজারবাগে পুলিশ লাইনে সশস্ত্র বাঙ্গালিরা অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে আমৃত্যু যুদ্ধ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, বন্তি অঞ্চলে এবং সাধারণ মানুষের উপর বর্বর পাকসেনারা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তা প্রতিরােধ করার শক্তি ছিল না নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের।

আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা রােধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার কথা জানতে পেরে বাংলার মানুষ এক দুর্জয় প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলল। সারা বাংলাদেশে সামরিক, আধা সামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অপূর্ব দক্ষতা, অপরিসীম সাহসিকতা ও অতুলনীয় ত্যাগের মনােভাব নিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অগ্রসর হন। মাত্র তিন দিনে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ করতলগত করার যে পরিকল্পনা সামরিক সরকার করেছিল, প্রাণের বিনিময়ে বাংলার মানুষ তাকে সর্বাংশে ব্যর্থ করে দেয়। ১১ এপ্রিল তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা প্রচার করি। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, আমাকে প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব মনসুর আলি, খােন্দকার মুশতাক আহমদ ও জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে সদস্য হিসাবে নিয়ে এই মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে বিভিন্ন সামরিক অফিসারকে এক এক অঞ্চলের ভার দেওয়া হয়। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের ভার দেওয়া হয় মেজর (এখন কর্নেল) খালেদ মােশাররফকে, চট্টগ্রাম ও নােয়াখালি অঞ্চলের ভার মেজর (এখন কর্নেল) জিয়াউর রহমানকে, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের ভার মেজর (এখন কর্নেল) শফিউল্লাকে, কুষ্টিয়া ও যশােহর অঞ্চলের ভার মেজর ওসমানকে, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালি অঞ্চলের ভার মেজর জলিলকে, রাজশাহীর ভার মেজর আহমদকে, সৈয়দপুরের ভার মেজর নজরুল হককে ও রংপুরের ভার দেওয়া হয় মেজর নওয়াজেশকে। ১৮ এপ্রিলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়ােগ করা হয় জাতীয় পরিষদ সদস্য কর্নেল (এখন জেনারেল) এম. এ. জি. ওসমানীকে। ইতােমধ্যে বে-সামরিক তরুণদেরকে মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করে তাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও চূড়ান্ত করা হয়। মন্ত্রিসভা গঠনের পর আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আমাদের সরকারকে স্বীকৃতিজ্ঞাপন এবং আমাদের সংগ্রামকে সমর্থন দানের জন্য পত্র প্রেরণ করি।

১৭ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বহু দেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এই সম্মেলনে ঘােষণাপত্র প্রচারিত হয়। এই সম্মেলনের ফলে বিদেশী সাংবাদিকেরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব ভিত্তির সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরকে পাঠিয়ে সেইসব দেশের সরকার ও জনসাধারণের কাছে বাংলাদেশের বাস্তব সত্যকে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের কথা। এই সম্মেলনের প্রতিনিধিরা সর্বপ্রথম প্রকৃত পরিস্থিতি অবগত হন এবং এই সম্মেলনেই বাংলাদেশকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। জাতিসংঘেও অনুরূপ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরিত হয়। প্রবাসী বাঙ্গালিরাও বিদেশে খুব উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। সেখানে জনমত সৃষ্টি। ও অর্থসংগ্রহ করে তারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তােলেন। আমাদের আহ্বানে বহুসংখ্যক সরকারী কর্মচারি অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে মুজিবনগরে গিয়ে পৌছেন। এদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে যােগদান করেন, কিন্তু আমাদের স্বল্প-সামর্থের জন্য অনেককে চাকুরি দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকে আবার চাকুরি না করে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। দেশে মুক্তিসংগ্রামের শক্তি বৃদ্ধি হয় দ্রুতগতিতে এবং দৃঢ়ভাবে। কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তরুণ ও ছাত্রসমাজ যে বিপুলসংখ্যায় এবং আত্মত্যাগের যে মনােভাব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে, তা যে-কোন জাতির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষেই আদর্শ স্থানীয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্র প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষতঃ ছাত্র লীগ এবং শ্রমিক।

সংগঠনসমূহ, বিশেষতঃ শ্রমিক লীগের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযােদ্ধারা কেউই ব্যক্তিগত অসুবিধাকে গ্রাহ্য করে নি। আমি ও আমার সহকর্মীরা যখনই রণাঙ্গনে গিয়েছি, তখনই তাদের দৃঢ় প্রত্যয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। হাসপাতালে আহত মুক্তিযোেদ্ধারা নিজেদের কষ্টের কথা বলে নি, তাড়াতাড়ি যেন আবার যুদ্ধে যােগদানের অনুমতি পেতে পারে, সে-ব্যবস্থা করতে বলেছে। যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন নি, তারাও মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বপ্রকার সক্রিয় সাহায্য করেছেন। অধিকৃত এলাকায় যারা বসবাস করতেন, তারাও চরম ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেছেন নানাভাবে। জনসাধারণের মনােবল বৃদ্ধিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। মে মাসে এই বেতার কেন্দ্রের জন্য একটা শক্তিশালী প্রেরণ-যন্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়েছিল। এই বেতার কেন্দ্র সংগঠনে জনাব আবদুল মান্নানের অবদানের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। বাংলার এই প্রতিরােধের মুখে ইয়াহিয়া-চক্র তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে।

কুখ্যাত টিক্কা খানের বদলে একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদকে তারা গভর্নর পদে নিয়ােগ করে এবং বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ছল করতে চায়। বিশ্বমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিল করে তারা তথাকথিত উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে বশংবদ ব্যক্তিদেরকে “নির্বাচিত করে। প্রদেশে একটি তাবেদার মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বেসামরিক কর্তৃত্বে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার ভাওতা দিয়ে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংবিধান ঘােষণার জন্য ২৭ ডিসেম্বর তারিখ ধার্য করা হয় এবং বলা হয় যে, ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হবে। কিন্তু এই প্রয়াস যে কত শূন্যগর্ভ ছিল, তার প্রমাণ তারাই দিয়েছে পদে পদে। অন্য পক্ষে মুক্তিযােদ্ধা ও সশস্ত্র বাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়, তাদের গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে ঢাকায় এবং অন্যত্র পাকিস্তানী হানাদারদের মনােবল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। এই হৃত মনােবল সৈন্যরাই পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হয়ে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিসংগ্রামের কালে আমাদের রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘােষণা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ ও শ্রী ভবেশচন্দ্র নন্দী। হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার জন্য ৮ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের এক পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করা হয়। শ্রী ভবেশ নন্দী ছাড়া পূর্বোক্ত নেতারা এই কমিটির সদস্য ছিলেন; কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কমিটিতে থাকেন শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিসগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এই কমিটির অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং দেশপ্রেমিক দলগুলির মধ্যে সহযােগিতার এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। আওয়ামী লীগের নিজস্ব উদ্যোগের মধ্যে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার প্রকাশ খুব উল্লেখযােগ্য ঘটনা।

এই পত্রিকা জনমনে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশের কথাও এখানে বলা যেতে পারে। জুলাই মাসের ৫ ও ৬ তারিখে আওয়ামী লীগের কার্যকরি সমিতির সভা ও আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সভাতেই মুক্তিসংগ্রামের কর্মসূচি সমর্থন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। আমাদের সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের দলীয় কর্মকর্তার পদ ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু কার্যকরি সমিতি দেশের সংকটজনক অবস্থায় এই বিধির ব্যতিক্রম করে আমাদেরকে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে যেতে অনুরােধ করে। ২০-২১ ও ২৭-২৮ অক্টোবরে আবার আওয়ামী লীগের কার্যকরি সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিকল্পনার আভাস দান করি এবং এই সভা তা সর্বান্তকরণে গ্রহণ করে। এইখানে আমি আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্যদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। একথা সুবিদিত যে, ২৫ মার্চের রাত থেকে ইয়াহিয়া খানের রক্তলােলুপ সৈন্যরা আওয়ামী লীগের সকল শ্রেণীর কর্মীকে হন্যের মত খুঁজে বেড়িয়েছে, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে, তাদের পরিবার-পরিজনকে অত্যাচার ও সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত করেছে। দখলদার সেনাদের এই অভিযানে শহীদ কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ। নেতা ও কর্মীর কথা আগে বলেছি; আরাে অনেকে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। এ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কর্মী, নেতা ও পরিষদ সদস্যদের মনােবল ভেঙে পড়েনি। নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও তারা মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যেকটি পর্যায়ে জনসাধারণ ও সরকারের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করেছেন।

এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অপরাজেয় শক্তির উৎসস্বরূপ। বেসামরিক প্রশাসনের জন্য সারা বাংলাদেশকে ১১টি অঞ্চলে যখন ভাগ করা হয়, তখন এইসব কর্মী ও সদ্যস্যরা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য হিসাবে সরকারী কর্মচারিদের মাধ্যমে বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। মুক্তিসংগ্রামের কালে তাদের জন্যই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রসার ঘটেছে ও শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে। শুধু মুষ্টিমেয় সদস্য জাতির সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে হানাদার পক্ষে যােগ দেয়। আজ তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসাবে বিচারের অপেক্ষা করছে। মুক্তিসংগ্রামের কালে আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার জন্য বিশেষভাবে আমাদের অস্থায়ী সভাপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবদান স্মরণীয়। আমাদের সহসভাপতি জনাব মনসুর আলি ও জনাব খােন্দকার মুশতাক আহমদ, সাবেক নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা যে নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা উল্লেখযােগ্য। এ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের সকল স্তরে আমরা সবসময়ে যার অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি তিনি আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমরা পৃথিবীর সকল দেশের সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। এবং বিভিন্ন দেশে জনমত গঠনের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করেছি। ইয়াহিয়া খান তার বিচারের স্পর্ধা প্রকাশ করলে বাংলার মানুষ প্রতিবাদে গর্জন করে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে তার বিচার-প্রহসনের প্রতিবাদে যেমন বিবৃতি, প্রচারপত্র ও পােস্টার প্রচারিত হয়, তেমনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি, প্রচারপত্র ও পােস্টার ছাড়াও জনসভা এবং বিভিন্ন দূতাবাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রতিবাদলিপি প্রেরিত হয়। তবে একথা আমাদেরকে কৃতজ্ঞার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সবচেয়ে সক্রিয় ও কার্যকরি ভূমিকা পালন করেন ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন।

আমাদের মুক্তিসংগ্রামের কঠিন সময়ে আমরা সবচেয়ে বেশি সাহায্য লাভ করেছি ভারত থেকে। এক কোটি শরণার্থীর অন্ন ও আবাসের সংস্থান করে ভারত আমাদেরকে গভীর কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক ও উপকরণগত সাহায্য যুগিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। এই জন্যই পাকিস্তান সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপরে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।

মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে রক্ত দান করে বীর ভারতীয় সেনাবাহিনী মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে। তার আগেই ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানের জন্য সােভিয়েট ইউনিয়ন ২ এপ্রিলেই পাকিস্তান সরকারকে অনুরােধ জ্ঞাপন করেন। ৯ আগস্টে ভারত-সােভিয়েট মৈত্রীচুক্তি সম্পাদিত হবার পরে বাংলাদেশের বিষয়ে সােভিয়েট ভূমিকা স্পষ্টতর হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনবার ভেটো প্রয়ােগ করে সােভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে সােভিয়েট ইউনিয়নই সর্বাগ্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, পােল্যাণ্ড ও চেকোশ্লাভাকিয়া প্রভৃতি সমাজতন্ত্রী দেশ জাতিসংঘের ভিতরে ও বাইরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। কানাডা, ফ্রান্স ও বৃটেনের ভূমিকাও আমাদের অনুকূলে ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি আমাদেরকে নিরাশ করে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। হানাদার পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সর্বশেষ স্তরে জাতিসংঘে চীনের কার্যকলাপ এবং বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর প্রেরণ—এই দুই দেশের মুক্তিসংগ্রাম বিরােধী ভূমিকার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। তবে সরকারি মতামত নির্বিশেষে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সংবাদপত্র ও অপরাপর প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা বাংলাদেশের সংগ্রামের অনুকূল ছিল।

এসব দেশের বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষও আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন করেছিলেন। সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের সেই শুভেচ্ছাকে সার্থক করে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বরে। কিন্তু এর পূর্ব মুহূর্তে সামরিক চক্রের সাহায্যকারী ফ্যাসিস্ট বদর বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীনতার পরে সামরিকচক্রের সহযােগিরা নানাভাবে তােক হত্যা ও বিশৃংখলা সৃষ্টিতে রত থাকে। ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যেরা ঢাকায় এসে পৌঁছেন এবং নতুন করে প্রশাসন পরিচালনার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। এর পরে মন্ত্রিসভাও সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু তখনও আমাদের আরদ্ধ কাজ সমাপ্ত হয়নিবঙ্গবন্ধু তখনও শত্রুর কারাগারে বন্দি। সারা দেশবাসীর এবং বিশ্ব বিবেকের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্ত হন। লন্ডন হয়ে তিনি তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারিতে। ১২ তারিখে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হয়। বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি রূপে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী রূপে শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কার্যকরি সমিতির অধিবেশন হয়। মন্ত্রীদের আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা না থাকার সিদ্ধান্ত করা হয়। এই সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বন্ধুগণ,

ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এখন আমরা তা সংহত করতে চলেছি। বাংলাদেশ আজ নানা সমস্যার ভারে জর্জরিত। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, দেশের মধ্যে প্রায় দু’কোটি উদ্বাস্তু মানুষের অন্ন এবং বাসস্থানের সংস্থান, বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন, যােগাযােগ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস-এর প্রত্যেকটিই দুরূহ অথচ জরুরী কর্তব্য। খাদ্যের ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে মানুষের হাতে অর্থ এনে দিতে পারলেও সেই অর্থ দিয়ে জীবনের উপকরণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ঊর্ধ্বগতি রােধ করার উপায় হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। অবশ্য সেই সঙ্গে কালােবাজারি ও মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। আইনের শাসন যত দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, ততই আমরা গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারব। এই আইনের শাসনের নতুন ভিত্তি রচিত হতে যাচ্ছে আমাদের সংবিধানে। বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন আমাদের দায়িত্ব, সে-কথা বলেছি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পুরানাে অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকেই সচল করতে চলেছি। অর্থনৈতিক জীবনের নবরূপায়ণে আমরা বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগের বিঘােষিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই ঘােষণা করেছেন যে, সমাজতন্ত্রই আমাদের লক্ষ্য। আর এই সমাজতন্ত্র কোন লােক-দেখানাে ব্যাপার হবে না, এ হবে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। ব্যাঙ্ক, বীমা, পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বৃহত্তর অংশের জাতীয়করণ এই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকেই দৃঢ় পদক্ষেপ। আমরা আশা করব যে, কৃষিযােগ্য জমি ও শহরের সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হবে এবং বেতনের ক্ষেত্রে এখনকার বিরাট বৈষম্য দূর হবে।

আওয়ামী লীগ কল্যাণকর শ্রম নীতির পক্ষপাতী এবং শিক্ষার ভিত্তিকে বিস্তৃত ও গণমুখী করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সার্থক হবে, আমরা নতুন সমাজ গঠন করতে সক্ষম হব। পৃথিবীর কোন দেশই আজ নি:সঙ্গ দ্বীপের মত নয়। সুতরাং নানা দেশের সাহায্য ও সহযােগিতা আমাদের প্রয়ােজন। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের সহায়তায় আমরা পুনর্বাসন ও খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। পাকিস্তান থেকে সকল বাঙ্গালিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রগুলির সহায়তা আমরা। কামনা করেছি। কিন্তু আমাদের প্রয়ােজন যতই তীব্র যােক না, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করতে পারে, এমন কোন সাহায্য আমরা গ্রহণ করব না। গােষ্ঠী-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে এবং যুদ্ধজোটের বাইরে থাকতে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আজ আমরা সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে যাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও তীব্র সংগ্রাম গড়ে তুলব। আমাদের আজকের সংগ্রাম তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রামে সঠিক নেতৃত্বদানের গুরু দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগের উপর অর্পিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সে দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ যােগ্যতার পরিচয় দেবে। নিজেদের বহু কর্মী ও নেতাকে আমরা হারিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনকে আজ নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযােগ রেখে যেন নিম্নতম পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে ওঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

মানুষের কাছে আমাদের বিঘােষিত নীতি ও কার্যক্রম ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ও জনমত গঠনের দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ কর্মীমাত্রকে গ্রহণ করতে হবে। দেশের পুনর্গঠনে যেন আমরা প্রত্যেকেই মানুষের সেবার মনােভাব নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে পারি, সেটাই আজকের বড় প্রার্থনা। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সহনশীলতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেননা, সহনশীলতা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হতে পারে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেন সমাজ জীবনে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে তা দেখতে হবে। দেশপ্রেমিক সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির কাছেও আমার আবেদন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব-প্রতিরােধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আপনারা নিজের দায়িত্ব পালন করুন। অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে দেশবাসী প্রমাণ করেছে, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কিভাবে তারা ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন। দেশের মানুষের এই কল্যাণ বুদ্ধিকে সঠিক পথে পরিচালিত করে বাংলাদেশকে আমরা সত্যিকার সােনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারব। এই আশার বাণী উচ্চারণ করে আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!