You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.02.14 | দৈনিক পূর্বদেশ-ভাবগম্ভীর পরিবেশে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের আহ্বান - সংগ্রামের নোটবুক

ফেব্রুয়ারি ১৪, ১৯৭২ সােমবার ঃ দৈনিক পূর্বদেশ

ভাবগম্ভীর পরিবেশে একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের আহ্বান ঃ স্টাফ রিপাের্টার।। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গতকাল রবিবার এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে জনাব তাজউদ্দিন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি সদস্যকে ভাবগম্ভীর পরিবেশে যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে আসছে জাতীয় শহীদ দিবস পালনের আহ্বান জানান। তাজউদ্দিনের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ ঃ লাখাে শহীদের পবিত্র বক্ষের রক্তের ফরু ধারায় সিক্ত জননী বাংলার বুকে স্বাধীনতার বিজয় পতাকাবাহী ও একচেটিয়া পুঁজিপতি ও স্বৈরাচারী শাসন আর শােষণের শৃঙখলমুক্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশকে আবার সােনার বাংলায় রূপান্তরিত করার মহান শপথে বলীয়ান দেশবাসী ভাই ও বােনেরা আমার। বর্ষ পরিক্রমায় আবার আসছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালি জাতির জীবনে একটি অমর দিন।

আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে এমনি একটি দিনে মাকে মা বলে ডাকার ও মায়ের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার মানসে পাঞ্জাবি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠেছিল বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। দুর্জয় শপথে বলীয়ান সারা বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তরে বিক্ষোভ ফেটে পড়া জনতার মিছিলে পশুর দল চালিয়েছিল নির্বিচারে বুলেট। তরুণ বক্ষের রক্তে রাজপথকে রঞ্জিত করে দিয়ে মায়ের মর্যাদা সেদিন রক্ষা করেছিল বরকত, সালাম, শফিউর, আউয়াল, রফিক আর জব্বার। আর একই সঙ্গে সে রক্তস্রোতের প্রতিটি বিন্দু থেকে ওরা জন্ম দিয়ে গেল লক্ষ কোটি সালাম-বরকতকে। বাংলার মানুষের মনে জাগিয়ে দিয়ে গেল জাতীয়তাবাদের নতুন চেতনা। যার ফলশ্রুতিস্বরূপ ১৯৫৪-র নির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের হল ভরাডুবি । কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই প্রাসাদচক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাঙ্গালি জাতি পুনর্বার শৃঙ্খলিত হল। তাদের বুকের ওপর চেপে বসল সামরিক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার আর আমাদের রক্তদানের পালা।

সালাম-বরকতের উত্তরসূরী বাংলার তরুণ সম্প্রদায় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রচনা করল আত্মত্যাগের এক অশ্রু ও পূর্ব ইতিহাস। অবশেষে ১৯৬৬-র। শেষভাগে আফ্রো এশিয়ার লৌহ মানব, রাজনৈতিক বিশ্বের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পূজারী, বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হল। গণতান্ত্রিক। পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তার আওয়ামী । লীগের প্রতি জানাল পূর্ণ আস্থা । কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন সে গণ-রায়কে। বানচাল করার উদ্দেশ্যে পাঞ্জাবি হায়েনার দল সারা দেশব্যাপী বর্বর গণ-হত্যায় লিপ্ত হল। হিসেবে কিন্তু ওদের ভুল হয়ে গেল। সু-সংগঠিত বাঙ্গালি জাতির। শান্তিপ্রিয় চরিত্রে এল আমূল পরিবর্তন। পিতার আহাজারি, মায়ের আর্তনাদ, ভায়ের রক্ত আর বােনের লুষ্ঠিত সতীত্বের বেদীতটে বাংলার মানুষ হানাদারদের। বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল সশস্ত্র বিপ্লবে আর সে বিপ্লবের আদর্শ ছিল একটি মহান। নেতার কণ্ঠনিসৃত বাণী-“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সগ্রাম। স্বাধীনাতর সংগ্রাম”। যুদ্ধ বিজয়ী বীর বাঙ্গালি ভায়েরা আমার, দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। দেশের বুকে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম সরকার। এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি তাই এক নতুন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। শুধুমাত্র ভাষা আন্দোলনে শহীদ ভাইদের প্রতি স্মৃতি অর্পণ।

নয়, দেশব্যাপী এবার একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হবে জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলার বুকে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আর। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা দিয়ে গেছে আত্মাহুতি সমগ্র বাঙ্গালি জাতি এ দিনটিতে তাদেরকে জানাবে জনগণের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধার্ঘ আর সংগ্রামী অভিনন্দন। সাথে সাথে নিতে হবে নতুন শপথ-মাতৃভূমি বাংলাকে বিশ্বের অন্যতম স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে গড়ে তুলে আমরা যুগে যুগে শুধে যাব শহীদদের রক্তের ঋণ। স্বাধীন বাংলার প্রতিটি মানুষ বিশেষতঃ আওয়ামী লীগের প্রতিটি সদস্যের প্রতি তাই আমার আকুল আবেদন, তারা গম্ভীর পরিবেশে যথাযথ মর্যাদার সাথে আসছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে পালন করুন। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত, নগ্নপদ শােভাযাত্রা, কালাে ব্যাজ পরিধান, শােকসভা অনুষ্ঠান। আর শহীদ আত্মার শান্তি কামনার মাধ্যমে এ দিনটিকে তাৎপর্যমন্ডিত করে তুলুন। ‘জয় বাংলা’, শহীদ স্মৃতি অমর হােক’। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সদস্য হবে ঃ ঢাকা, ১২ ফেব্রুয়ারি। (বাসস)। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ এখানে বলেন যে, বাংলাদেশ সরকার “সময়মত” আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের সদস্য পদের জন্য আবেদন করবে। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাথে এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা সময়মত আই.এম.এফ.-এর সদস্য পদের জন্য আবেদন করবাে”। তিনি। বলেন, “আমরা জাতিসংঘের সদস্যও হতে চাই।” অর্থমন্ত্রী বলেন, একটি স্বাধীন  সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের সবকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হবার অধিকার রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব সমাজে বাংলাদেশ অবশ্যই একটি আসন পাবে। এক প্রশ্নের জবাবে জনাব তাজউদ্দিন বলেন, বেশ কিছুসংখ্যক দেশ ইতােমধ্যেই বাংলাদেশের পুনর্গঠন কাজে সাহায্য দেবার কথা ঘােষণা করেছেন।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি