জানুয়ারি ৫, ১৯৭২ বুধবার ঃ দৈনিক বাংলা
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব পাকিস্তানের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনবে ; ভুট্টোর প্রতি তাজউদ্দিনের হুঁশিয়ারি ঃ স্টাফ রিপাের্টার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে আর কোন ছলাকলা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোকে সাবধান করে দিয়েছেন। ভুট্টোকে কড়া হুঁশিয়ারি জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জাতির জনকের মুক্তির ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত দীর্ঘসূত্রিতা পাকিস্তানের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনবে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ছাত্র লীগের ২৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলােচনা সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্যে সরকার সকল ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তাকে আনার ব্যাপারে যাতে মুহূর্ত বিলম্ব না হয় তার জন্যে নয়াদিল্লীতে একটি আন্তর্জাতিক বিমান ভাড়া করে রাখা হয়েছে। বিপুল করতালি এবং বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অনিবার্য। অচিরেই তাকে মুক্ত করে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখার অধিকার কারাে নেই। অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটিতে ফিরিয়ে দেবার দাবি জানিয়ে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর খেলা আমরা অনেক দেখেছি। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের কথা বলে তিনি দুনিয়ার মানুষকে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করছেন। যে সব রাষ্ট্র গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছেন তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য জনাব ভুট্টো চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভুট্টোর সে খেলা সফল হবে না। বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত আমরা আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শিথিল হতে দেব না।
ভুট্টোর ধাপ্পাবাজি চলবে না ? ভুট্টোর প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী গত ২৪ বছর ধরে বাংলার মানুষের সাথে ধাপ্পাবাজি করেছে। আবার যাবার বেলায় তারা আমাদের উপর মরণাঘাত হেনেছে। তিনি বলেন, এবার বাংলার মানুষ অস্ত্র নিয়েছে এবং তারা জানে কার বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কাজেই বাংলার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে তিনি দাবি জানান। ছাত্র লীগের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্র লীগের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার উচ্ছসিত প্রশংসা করে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু ২৫ মার্চ বাঙ্গালি জাতির উপর মরণাঘাত হানা হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ছাত্রসমাজ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ছাত্র লীগই শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দিয়েছে। যারা কোনদিন ঘুঘু শিকারে অভ্যস্ত ছিল তারা আজ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিখে হানাদারদের তাড়িয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছে। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে হচ্ছে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ । আমাদের অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হলে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের শান্তি অপরিহার্য। বিশ্বের অশান্তি অভ্যন্তরীণ শান্তিকেও বিঘ্নিত করতে পারে। তিনি রাষ্ট্রীয় আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার আহ্বান জানান। বৈদেশিক নীতি ও বৈদেশিক নীতির কথা উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসরণে আমাদের বৈদেশিক নীতি হবে শান্তিপূর্ন সহঅবস্থানের নীতি।
বিশ্ব শান্তির স্বার্থে আমরা কোন যুদ্ধজোটে শরিক হব না। কারণ জাতীয় ব্যয়ের ৬০% আমরা সামরিক খাতে খরচ করতে পারব না। তিনি বলেন, দেশের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে সন্তুষ্ট জনতার উপর। মানুষ যদি মনে করে দেশ তাদের এবং সম্পদের মালিক তারা, তবে প্রত্যেকটি নাগরিক সৈনিকের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবেন। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষা সমস্যার সমাধানে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার জন্যে তিনি ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি আহবান জানান। বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দুনিয়ার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু বন্ধুত্বের মূল্যায়নে তারতম্য করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সব রাষ্ট্র সাহায্য করেছে, তাদের সাথে বন্ধুত্বের মর্যাদা আমাদের শত্রুদের সাহায্যকারী দেশের মত এক হবে । তিনি বলেন, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারত আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য করেছে। সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। এছাড়া আমাদের জয়ের মুখে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যে আমেরিকা ও চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব এনেছে। সােভিয়েট ইউনিয়ন তিন তিনবার ভেটো দিয়ে সে প্রচেষ্টা বন্ধ না করলে আমাদের দেশ আজ কঙ্গো, ভিয়েতনাম, মিশর বা কোরিয়ার মত বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র হত । বৈদেশিক সাহায্যের কথা উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, দেশকে পুনর্গঠনের জন্যে আমাদের সাহায্যের দরকার আছে। কিন্তু সাহায্য নেয়ার সময় আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভিক্ষুকের মত দান আমরা নেব না।
আমরা অনাহারে মরে যেতে পারি, তবু স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেব না । পুনর্বাসন ও নাগরিকদের পুনর্বাসনের উপর গুরুত্ব আরােপ করে তিনি বলেন, শত্রুর সাথে আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু শরণার্থীদের পুনর্বাসন, শহীদ এবং যুদ্ধে আহত ও পঙ্গু যােদ্ধাদের পুনর্বাসন, গাজী হয়ে যারা বেঁচে আছেন তাদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি গুরুতর সমস্যাগুলাের সমাধান করতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মত এগুলাের মােকাবিলায় সাহায্য করার জন্যে তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। স্বাধীনতার শত্রুদের বিচার প্রসংগে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, শত্রুর সাহায্য ও দালালি যারা করেছে আইনের মাধ্যমেই তাদের বিচার হবে এবং অপরাধীকে অবশ্যই সাজা ভােগ করতে হবে। কিন্তু দালালদের সাজা দেয়ার জন্যে কেউ যেন আইনকে হাতে তুলে না নেন এবং নিরীহ মানুষ যাতে জুলুমের স্বীকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্যে তিনি ছাত্র ও যুবকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে একটি লােকও যদি ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে কাল যাপন করে তাহলে আমাদের স্বাধীনতা নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে বাংলার প্রতিটি কৃষক যেন তার খেতের ফসল ভােগ করতে পারে, প্রতিটি কর্মচারি যেন তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়। আমাদের সমাজ থেকে দারিদ্রকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, সুন্দর কল্যাণময় সমাজ গড়ে তােলা বক্তৃতা মঞ্চ থেকে উঠে আসে না। এ জন্য প্রয়ােজন কাজ করার।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি