ইতিহাসের নবযুগ
১৯৭১ সাল শেষ। সামনে ইংরেজী নববর্ষের পদধ্বনি। পিছনে ফেলে এলাম যুগান্তকারী ইতিহাস। এ ইতিহাসের পাতায় পাতায় দস্যু দলের বিকট উল্লাস, অসহায় নরনারীর বুকফাটা কান্না, মুক্তিকামী মানুষের বজ্রকণ্ঠ এবং অত্যাচারীর কবরের উপর নুতন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। পুরানাে বছরের নাটকীয় ঘটনাবলীর কেন্দ্রস্থান ভারত এবং বাংলাদেশ। ইউরােপ চলে গেছে পিছনে। সে আর গােটা দুনিয়ার রাজনৈতিক বিবর্তনের নিয়ামক নয়। মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল আমেরিকা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে তার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব যেমনি আকস্মিক এবং তেমনি চাঞ্চল্যকর। প্রেসিডেন্ট নিকসন যাবেন পিকিং সফরে। সব ঠিকঠাক করে ফেললেন কিসিঙ্গার। অবাক লাগল সবার। কিসের প্রেরণায় বাঘে মােষে একঘাটে জল খাবার ফিকির আঁটছে? ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সােভিয়েট রাশিয়া। তাকে কো জন্যই চীনা-মার্কিন যুক্ত পায়তারা। বিপ্লবের খােলস ছেড়ে দ্রলােক সাজল চীন। রাষ্ট্রসংঘে পেল সে সদস্য পদ। মনমরা তাইওয়ান নিল বিদায়। স্বস্তি পরিষদ জাকিয়ে বসল কমিউনিষ্ট বলে কথিত চীন। সুরু হর জল্পনা-কল্পনা। এরপর কি ভূমিকা নেবেন পিকিং? কার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবেন তারা? প্রগতির সঙ্গে না, প্রতিক্রিয়াশীলতার সঙ্গে? উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয়নি বেশী দিন।
উত্তাল তরঙ্গ কেটে চলেছে পাক-ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক তরী। ঝড়ের প্রায় সবটুকু দমকা হাওয়া কেড়ে নিয়েছে বাংলাদেশ। গত পঁচিশে মার্চ ইয়াহিয়ার সৈন্যদল ঝাপিয়ে পড়েছে জনতার উপর। মুজিবুর রহমান বন্দী এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আটক। নিরস্ত্র নরনারী পথে নেমেছে। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকবাহিনীর সামনে তারা দাঁড়াতে পারছে না। দলে দলে মরছে। ইয়াহিয়ার ঘাতক দল নারকীয় তাণ্ডবে মত্ত। চলছে গণহত্যা, চলছে নারী ধর্ষণ এবং চলছে ব্যাপক ধ্বংসলীলা। প্রায় এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। বাংলাদেশ ঘােষণা করেছে স্বাধীনতা। মুজিবনগরের আম্রকাননে হয়েছে তার সরকারের প্রতিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা দুনিয়া। আঘাত করছেন ছােট বড় সব রাষ্ট্রের দ্বারে দ্বারে। অনেকেই দেখাচ্ছেন মৌখিক সহানুভূতি। কাজের বেলায় করছে পৃষ্ঠ প্রদর্শন। যারা বেশী ধুরন্ধর তারা মাঝে মাঝে খাচ্ছে ডিগবাজী। রাষ্ট্রসংঘ বৃহন্নলা। বাংলাদেশের রক্তস্রোতে জেগে উঠছে না তার বিবেক। কেউ চায় না পূর্ব বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। যারা চায় তারাও জানে না কার্যকর উপায়। চীন এবং আমেরিকা সরব। যত দোষ ভারতের। সে-ই নাকি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি। রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য ভিটেমাটি ছাড়া মানুষগুলােকে যেতে দিচ্ছে না ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানে। মানবত্রাতা ভারত এবং মানবদ্রোহী পাকিস্তানকে একই পর্যায়ে ফেলে এরা করতে চাইছে নয়াদিল্লীর বিচার।
কলঙ্কিত দুনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে বসে নেই বাংলাদেশের যুবশক্তি এবং খেটে খাওয়া মানুষ। ওরা ধরেছে। অস্ত্র। স্বাধীনতার জন্য মুক্তিবাহিনী করেছে সর্বস্ব পণ। গণজাগরণ রূপ নিয়েছে গেরিলা লড়াই-এ। নয় মাস চলেছে প্রচণ্ড সংগ্রাম। এক একটি দিন ইতিহাসের এক একটি স্মরণীয় পৃষ্ঠা। ব্যতিব্যস্ত পাক সৈন্যদল। ইয়াহিয়া অনড় এবং অচঞ্চল। সােজাপথে তাকে অস্ত্র দিচ্ছে চীন এবং বাঁকা পথে আমেরিকা। ফেটে পড়েছে ইসলামাবাদের উন্মা। তার ধারণা, ভারতের মদতেই মুক্তিবাহিনী বেপরােয়া। নাজেহাল করছে পাকিস্ত নিকে। সীমান্তে সুরু হল পাক হামলা। উদ্দেশ্য-মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় কেন্দ্রগুলাের ধ্বংস সাধন। জওয়ানরা দিল পাল্টা মার। তারই প্রতিশােধ-গত ৩রা ডিসেম্বর ইয়াহিয়ার অতর্কিত ভারত আক্রমণ। প্রত্যাঘাত হানলেন নয়াদিল্লী। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় জওয়ানদের ক্ষরিত রক্ত থেকে জন্ম নিল দুর্নিবার বাংলাদেশ। উল্কার মত তার গতি। মাত্র তের দিনে পূর্বাঞ্চলের লড়াই খতম। পাক বাহিনীর নিঃসর্ত আত্মসমর্পণ। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ধাপ্পাবাজী ব্যর্থ। স্বস্তিপরিষদে চীন মার্কিন দাপাদাপি সােভিয়েট ভিটোতে একেবারে স্তব্ধ। পশ্চিম রণাঙ্গনে ইয়াহিয়ার ভাগ্য বিপর্যয়। চৌদ্দ দিনের শেষে অস্ত্র সম্বরণ। স্বাধীন এবং স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। ভারত এবং ভুটান অনেক আগেই তার কপালে পরিয়ে দিয়েছে কূটনৈতিক স্বীকৃতির টিকা। অনেক রাষ্ট্রই এখন করবে তাদের অনুসরণ। পশ্চিমে ইয়াহিয়া নিয়েছেন বিদায়। জুলফিকার আলি ভুট্টো হয়েছেন প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা গভীর দুঃখে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। প্রেসিডেন্ট নিকসন বাংলাদেশে নিদারুণ মার্কিন পরাজয়ের শােধ তুলছেন ভিয়েতনামে। উত্তর ভিয়েতনামের উপর চলছে অবিশ্রান্ত বােমা বর্ষণ। আর মুখে বলছেন তিনি বিকারগ্রস্ত রােগীর খাপ ছাড়া প্রলাপ। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে ভারত বিরােধী কুটুক্তি। পশ্চিম এশিয়ার আরব রাষ্ট্রগুলাে শােকমগ্ন। ওরা জানত, ভারত কথা বলে বেশী কাজ করে কম। এখন দেখছে সে কাজ করে বেশী। কথা বলে কম। তার হাতে পাক বাহিনীর এমন শােচনীয় পরাজয় আরবের কাছে অপ্রত্যাশিত। ১৯৭২ সাল কি নিয়ে আসছে জানা নেই। দিগন্তের মেঘ কাটে নি। ভুট্টো, নিক্সন এবং চৌ এন লাইর আঁতাত হয়ত আরও জ্বলাবে। তাদের তল্পী বইবে ইরান, তুরস্ক, জর্ডান এবং সৌদী আরব। তাতে কিছু আসে যায় না। আত্মপ্রত্যয়ে গড়া ভারত এবং বাংলাদেশ। তাদের নিবিড় বন্ধুত্বের বনিয়াদে সহানুভূতির হাত বুলাচ্ছে সােভিয়েট রাশিয়া। এই তিনটি দেশের বিশাল জনতা আজ একসূত্রে বাঁধা। শরণার্থীরা ফিরে যাচ্ছে স্বদেশে। তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে পাক কলঙ্কমুক্ত বিপ্লবী বাংলাদেশ। চারদিকে ছড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কঙ্কাল। পাক অত্যাচারের বীভৎস দৃশ্য। সর্বত্র হাসি কান্নার অভাবনীয় শিহরণ। তার মধ্যে নবরাষ্ট্রের আবির্ভাব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ঘনায়মান অন্ধকার। খসে পড়েছে চীনের বিপ্লবী মুখােশ এবং বেরিয়ে এসেছে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নগ্ন কদর্যতা। নবীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান গৃহবন্দী। নববর্ষের প্রথম দিনে তাকে সম্বর্ধনার সুযােগ পাবে না বাংলাদেশ। হয়ত পাবে পরে। সেদিনের আর দেরী নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১