You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুলাই ১৮, ১৯৭০ শনিবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক

গরীবের হক আদায় না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংগ্রাম চলিতে থাকিবেঃ কাপাসিয়া (ঢাকা), ১৭ জুলাই। গতকাল বিকাল ৫টায় চানপুর বাকুয়াদী হাইস্কুল মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, যতদিন এ দেশের গরীবের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা না হইবে, তাহাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোেগ না হইবে এবং গরীবের দাবি আদায় না হইবে ততদিন আওয়ামী লীগের সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। তিনি বলেন, দেশের সমুদয় সম্পদ আজ ২২ পরিবারের হাতে চলিয়া গিয়াছে। আমাদের সংগ্রাম সেই শােষক ও লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে, তারা যে অঞ্চলেরই হউক না কেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের গরীব জনসাধারণের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম নয়, তারা সুখ-স্বাচ্ছন্দে বসবাস করুক তাহা আমরাও চাই। তিনি ৬-দফার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের শশাষিত-বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষের প্রাণের দাবি, অর্থনৈতিক মুক্তির একমাত্র পথ ৬-দফা ইসলাম বিরােধী নয় এবং ৬-দফা দেশ হইতে বে-ইনসাফ, শশাষণ-নির্যাতন বন্ধ করিয়া সুখী-সমৃদ্ধিশালী পাকিস্তান গড়িয়া তুলিবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, যারা ৬দফাকে ইসলাম বিরােধী, পাকিস্তানের সংহতি বিরােধী বলিয়া অপপ্রচার চালায় তাদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক থাকিতে হইবে।

তিনি বলেন, ৬-দফায় জনগণের ভােটের কথা বলা হইযাছে; ইহা কি ইসলাম বিরােধী ? তবে কি মওদুদী, নসরুল্লাহ, নূরুল আমিন, কাইয়ুম খানরা জনগণের ভােট চান না? জনাব তাজউদ্দিন তার দীর্ঘ তিন ঘন্টাব্যাপী বক্তৃতায় বৈষম্যের চিত্র তুলিয়া ধরেন। তিনি বলেন, গত ২২ বৎসর ইসলামের নামে, সংহতির নামে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নামে, পূর্ব-বাংলাকে শােষণ করা হইয়াছে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, আগামী নির্বাচনে ৬-দফার পক্ষে রায় দিয়া পূর্ব-বাংলাকে শােষণমুক্ত করিতে হইবে। তিনি বলেন, বহু ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকের বুকের রক্তের বিনিময়ে আপনারা আপনাদের ভেটের অধিকার ফিরিয়া পাইয়াছেন। আইয়ুব-মােনেম এক কলমের খোঁচায় জনগণের ভােট কাড়িয়া নিয়াছিলেন। এদেশের মানুষ গুলি খাইয়া তাহা ফিরাইয়া আনিয়াছে। তিনি বলেন, আর আজ একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদীরা ইসলামের নামে সেই ভােট নিয়া জনগণের সাথে ছিনিমিনি খেলার চিন্তা করিতেছেন। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, যখন জনগণের ভােটের অধিকার কাড়িয়া নেওয়া হয়, বাংলার সম্পদ পশ্চিম-পাকিস্তানের ২২ পরিবারের নিকট চলিয়া যায়, দেশে অত্যাচার-অবিচার, গুলি, সুদ, খাজনা ট্যাক্স বৃদ্ধি হইতে থাকে তখন মওলানা মওদুদী সাহেবরা কোথায় ছিলেন, কয়দিন জনগণের জন্য জেলে গিয়াছেন ? আশ্চর্যের কথা, আজ সেই নিশ্রুপ লােকেরাই বাংলার দাবির বিরুদ্ধে ফতােয়া লইয়া মাঠে নামিয়াছেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষকের বেতনের বৈষম্যের উল্লেখ করিয়া বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় এখানে জিনিসপত্রের দাম বেশি, অথচ আমাদের এখানে শিক্ষকের বেতন ১২৫ টাকা আর পশ্চিম-পাকিস্তানে ১৪৫ টাকা।

মওদুদী সাহেব কয়দিন এই বে-ইনসাফীর বিরুদ্ধে ফতােয়া দিয়াছেন। জনাব তাজউদ্দিন নতুন বাজেটের সমালােচনা করিয়া বলেন, গরীব কৃষকের জমিতে ব্যবহৃত সারের উপর ট্যাক্স ধরা হইয়াছে। এতে কৃষকের সার ব্যবহার বন্ধ হইয়া যাইবে। জনাব তাজউদ্দিন ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের দাবি জানাইয়া বলেন, বড় বড় শিল্পপতিকে ট্যাক্স হলিডে দেওয়া হয়, মাসে পাঁচশত টাকা আয় পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স মাফ হয়, অথচ গরীব কৃষকের জমিতে ফসল হউক বা না হউক, বন্যায় নষ্ট হউক, পােকায় নষ্ট হউক—তাহাকে খাজনা দিতে হইবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, কায়েমী স্বার্থের দালালরা কথায় কথায় ফতােয়া দেয়। কিন্তু ইহাদের খেলা প্রদেশের মানুষ বহু দেখিয়াছে। তিনি বলেন, ইহারা এককালে পাকিস্তানের বিরােধিতা করিয়াছেন, যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে ফতােয়া দিয়াছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির বিরুদ্ধে ফতােয়া দিয়াছেন এবং বর্তমানে ৬-দফার বিরুদ্ধে ফতােয়াবাজি শুরু করিয়াছেন। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, কিন্তু বাংলার জনগণ কোনদিনই ইহাদের কথায় কর্ণপাত করে নাই, এবারও করিবে না। তিনি বলেন, রক্তের আখরে ৬-দফা লেখা হইয়াছে; আমাদের রক্ত দিয়া এ দেশে ৬-দফা বাস্তবায়ন করিয়া গরীবের দাবি প্রতিষ্ঠিত করিব।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!