You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুন ২৯, ১৯৭০ সােমবার : দৈনিক ইত্তেফাক

৬-দফার ভিত্তিতেই শুধু পাকিস্তানে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব ঃ টোক, ২৭ জুন। পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ৬-দফার ভিত্তিতেই শুধু স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মাধ্যমে শােষণ-বঞ্চনা ও সন্দেহের অবসান ঘটাইয়া সুখী-সুন্দর শক্তিশালী পাকিস্তান গড়িয়া উঠিতে পারে বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ স্থানীয় টোক নয়ন বাজার হাইস্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতাকালে বলেন যে, যাহারা শক্তিশালী পাকিস্তান ও শােষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা চায় না, তাহারাই ৬-দফার বিরােধিতা করিতেছে। জনাব আহমদ আগামী নির্বাচনে ৬-দফার বাক্সে ভােট দেওয়ার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান।

আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তাজউদ্দিন আহমদ তাহার সুদীর্ঘ বক্তৃতায় স্বাধীনতাউত্তরকালের ২৩ বৎসরব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্ব-বাংলার প্রতি অবিচার-বঞ্চনা এবং দাবি আদায়ের জন্য বাংলার জনপ্রিয় নেতৃবৃন্দ ও রাজনৈতিক কর্মী এবং ছাত্রদের উপর জেল-জুলুম ও অমানুষিক নির্যাতনের ইতিহাস তুলিয়া ধরিয়া ৬-দফা কর্মসূচির পটভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। গ্রাম বাংলার আজিকার তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা প্রভৃতির উল্লেখ করিয়া আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আগামী নির্বাচনে যদি বাংলার মানুষ সঠিক রায় দিতে ভুল করেন, তাহা হইলে বাংলার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়িবে। তিনি বলেন, বাংলার মানুষকে। এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার জন্যই শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা দাবি পেশ করিয়াছেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গ্রাম-বাংলার চরম অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে কৃষকের ঘরে ফসল না উঠা পর্যন্ত খাজনা ও ট্যাক্স আদায় স্থগিত রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে সার্টিফিকেট ও ক্রোক পরােয়ানা বাতিল করার জন্য দাবি জানান। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে এত উচ্চ হারে খাজনা ও ট্যাক্স ধার্য করার নজির নাই। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আঞ্চলিক বৈষম্যের খতিয়ান তুলিয়া ধরিয়া বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে তিন তিনটি রাজধানী গড়িয়া উঠিলেও আজ পর্যন্ত বাংলার বন্যা রােধের জন্য অর্থ জোটে নাই।

তিনি বলেন, পশ্চিম-পাকিস্তানে পানি সেচের ব্যবস্থা করার এবং ভূমির লবণাক্ততা বন্ধের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তারবেলা এবং মঙ্গলা বাঁধ নির্মাণ করা হইয়াছে। আর বাংলার বন্যা রােধের কথা উঠিলেই নদীর মুখ শক্রদেশ’ ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন বলিয়া অজুহাত প্রদর্শন করা হয়। অথচ সিন্ধু অববাহিকা প্রকল্পের জন্য কাশ্মীর বিরােধকে অমীমাংসিত রাখিয়াই। শত্রুদেশ ভারতের সহিত বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে চুক্তি স্বাক্ষরিত হইতে পারে। জনাব আহমদ বলেন যে, তিনটি পাঁচসালা পরিকল্পনায় পূর্ব-বাংলায় ১১শত কোটি টাকাও ব্যয়িত হয় নাই। তিনি বলেন, ২ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের মধ্যে পূর্ব-বাংলাকে মাত্র ৫শত কোটি টাকা দেওয়া হইয়াছে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৫শত কোটি টাকা ব্যয়িত হইয়াছে। তিনি প্রাইমারি শিক্ষকদের বেতনের বৈষম্যের উল্লেখ করিয়া বলেন, পূর্ব-বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ১২৫ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৫ টাকা। জনাব আহমদ মােহাজেরদের পুনর্বাসনের দাবি জানাইয়া বলেন, বাংলার মানুষ অধিক হারে মােহাজের কর দেওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি পশ্চিম বাংলা, আসাম, কুচবিহার হইতে আগত মােহাজেরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয় নাই। তাহারা আজ স্ত্রী-পুত্রকন্যা লইয়া পথে ঘাটে দিনাতিপাত করিতেছে। তাহাদের দাফনের কাপড়ের জন্যও দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতে হয় ।

জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বাংলার প্রতি এই বৈষম্যমূলক ব্যবহারের প্রতিবাদ করিলে যে জেল-জুলুম, অত্যাচার নিপীড়ন চলিয়াছে তাহার ইতিহাস তুলিয়া ধরিয়া বলেন, এই অবিচারের প্রতিবাদ করিতে গিয়াই শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে বন্দি জীবনযাপন করিতে হইয়াছে, পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে বৃদ্ধ বয়সে জেল খাটিয়া বৈরুতের হােটেলের নির্জন কক্ষে ভগ্ন হৃদয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে হইয়াছে। দেশের কৃতী সাংবাদিক জনাব তফাজ্জল হােসেনকেও বাংলার গণ-মানুষের দাবিদাওয়ার জন্য লেখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম করিয়া বৃদ্ধ বয়সে জেলে যাইতে হইয়াছে অসুস্থ শরীরে। তাহার প্রাণের চেয়ে প্রিয় ইত্তেফাক পত্রিকাও বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। একশ্রেণীর স্বার্থবাজ আলেম সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের বিরুদ্ধেও ফতােয়া দিয়াছিলেন। ইহারাই ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসরতার জন্য দায়ী। আওয়ামী লীগ নেতা দেশের ৪টি পাঁচসালা পরিকল্পনায় বাংলাকে ঠকানাের নিন্দা করিয়া বলেন, ৪র্থ পাঁচসালা পরিকল্পনায় শিক্ষা খাতে পূর্ব-বাংলার প্রতি নিদারুণ বৈষম্য করা হইয়াছে। বাংলার ৭ কোটি মানুষের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষার জন্য এখানে মাত্র ৫শত প্রাইমারি স্কুলের স্থাপনের প্রস্তাব করা হইয়াছে, পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ কোটি মানুষের জন্য ২০ হাজার প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হইয়াছে।

তিনি বাংলার প্রতি এই বে-ইনসাফের বিরুদ্ধে ফতােয়া দেওয়ার জন্য মওলানা মওদুদী ও তাহার অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন যে, আন্দোলন, অত্যাচার ও জেল-জুলুমের সময় জনাব নূরুল আমিন, ফজলুল কাদের চৌধুরী প্রমুখের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নাই। আজ যখন শত শহীদের রক্ত এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা, কমী, ছাত্র-যুবক-শ্রমিকদের জেলজুলুম নির্যাতনের বিনিময়ে গণভােটের অধিকার অর্জিত হইয়াছে, তখনই আচকানপাঞ্জাবি লাগাইয়া পশ্চিমা একচেটিয়া পুঁজিবাদের ভাড়াটিয়া এজেন্টরা মাঠে নামিয়াছে। তিনি ইহাদের ফতােয়ায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!