জানুয়ারি ২৬, ১৯৭০ সােমবার : দৈনিক ইত্তেফাক
বিচার বুদ্ধি প্রয়ােগ করিয়া নিজেদের ভাগ্যলিপি নির্ধারিত করুন ঃ বিশেষ প্রতিনিধি। কাপাসিয়া (ঢাকা), ২৫ জানুয়ারি । আজ (রবিবার) বিকালে কাপাসিয়া হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বঞ্চনা আর শােষণের অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্যে বিগত ২২ বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলােকে আগামী ৫ অক্টোবর নিজের বিচার-বুদ্ধি প্রয়ােগ করিয়া নিজেদের ভাগ্যলিপি নির্ধারণের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ৬-দফার পটভূমিকা ব্যাখ্যা করিয়া বলেন যে, ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তির উপর পাকিস্তানের সংহতি সুদৃঢ় করার মহৎ উদ্দেশ্যেই ৬-দফা প্রণীত হইয়াছে। আওয়ামী লীগ নেতা বাংলার জীবন মরণ প্রশ্ন স্বায়ত্তশাসন, বন্যা নিরােধ, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যাকে পাশ কাটাইয়া যাহারা কেবল ইসলামের ধুয়া তুলিয়া রাজনৈতিক ধােকাবাজিতে লিপ্ত হইয়াছেন তাহাদের মুখােশ জনসমক্ষে তুলিয়া ধরেন। তিনি বাংলার বুকে প্রতি বছর সর্বগ্রাসী বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির খতিয়ান দিয়া বলেন, প্রতি বছর বন্যায় এই প্রদেশে প্রায় ২শত কোটি টাকার ফসল ছিনাইয়া নেয়, মানুষের বাড়িঘর প্রতিবছর ভাসাইয়া নেয়। এভাবে বাঙ্গালি আজ পথের কাঙ্গাল বনিয়াছে। তিনি দুঃখ করিয়া বলেন, দেশের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাকে রক্ষা করার জন্য আজও সেই বন্যা নিরােধের জন্য কোন বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করা হয় নাই। তিনি আরও বলেন, শহীদ সােহরাওয়াদী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ক্রুগ মিশনের রিপাের্ট প্রস্তুত হইয়াছিল তাহার জন্য অর্থ মিলে নাই। বন্যা নিরােধের জন্য নাকি অর্থই হয় না।
আওয়ামী লীগ নেতা জিজ্ঞাসা করেন, ৭ কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা বন্যা নিরােধের জন্য যদি অর্থের অভাব হইয়া থাকে, তবে করাচী হইতে রাজধানী সরাইয়া একবার জেলা শহর রাওয়ালপিন্ডি, আবার আতােয়ারের জনমানবশূন্য পাহাড় কাটিয়া রাজধানী স্থাপনের অর্থ আসে কোথা হইতে ? তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় রাজধানীর সমান অংশীদার পূর্বপাকিস্তানীরাও। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানীদের জিজ্ঞাসা না করিয়াই কাহাদের স্বার্থে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে করাচী হইতে ইসলামাবাদে রাজধানী করা হইল ? জনাব তাজউদ্দিন পূর্ব-বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার বিষয় উল্লেখ করিয়া বলেন, পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করার জন্য ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে ভারতের সহিত বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা তুলিলে আমাদের বলা হয় ভারতের দালাল। তাছাড়া কাশ্মীর লইয়া ভারতের সহিত পাকিস্তানের শত্রুতা বিদ্যমান ইত্যাদি অজুহাত দেখানাে হইয়া থাকে। আওয়ামী লীগ নেতা জিজ্ঞাসা করেন, সিন্ধু অববাহিকা প্রকল্প ও মঙ্গলা বাঁধ নির্মাণের বেলায় কাশ্মীর সমস্যা অমীমাংসিত রাখিয়াই ভারত অধিকৃত কাশ্মীর হইতে প্রবাহিত তিন তিনটি নদী সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আইয়ুব-নেহেরু বৈঠক অনুষ্ঠানের বেলায় পাক-ভারত বিরােধের প্রশ্ন কোথায় ছিল? ভারতের সহিত কচ্ছের রান এলাকার বিরােধ মীমাংসা হইল কিভাবে ? তিনি বলেন, এইসব কথা উঠিলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী, ইসলাম গেল’, ‘পাকিস্তান গেল’ প্রভৃতি স্লোগান আর অস্ত্রের ভাষা ও গৃহযুদ্ধের হুমকি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আসে। তিনি বলেন, বাংলার গণ-মানুষের নেতা শেখ মুজিবুর ৬-দফা ঘােষণা করিতেই কায়েমী স্বার্থবাদী মহল দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছে।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ৬-দফা ও ১১-দফা দাবিতে বাংলা মা-বােন-ভাইয়েরা বুকের তাজা রক্ত দিয়া যে গণঐক্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন ইহাকে ভাঙ্গিয়া খান খান করিয়া নিজেদের শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য প্রচুর অর্থ ছড়ানাে হইতেছে-ইসলামী শাসনতন্ত্র ও সশস্ত্র বিপ্লবের নামে তথাকথিত সর্বহারা রাজ কায়েমের নামে। তিনি এই বিভেদ সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে হুশিয়ার থাকার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ৫ অক্টোবর বাঙ্গালিদের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। এই অগ্নিপরীক্ষার দিনে গত ২২ বৎসরের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলােকে নিজ ভাগ্য নির্ধারণের জন্য তিনি সকলকে। আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, ৬৫ সালের ১৭ দিনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলােকে শেখ সাহেব ৬-দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করিয়াছেন। ১৭ দিনের যুদ্ধের সময় দেড় হাজার মাইল দূরবর্তী পশ্চিম-পাকিস্তানের সাথে পূর্ব-বাংলার পােস্টকার্ড যােগাযােগও ছিল না। স্টেট ব্যাংকের হেড কোয়াটার করাচীতে অবস্থিত থাকায় টাকা-পয়সা আসাও বন্ধ ছিল, ফলে পূর্ব-বাংলার উন্নয়ন কার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হইয়া পড়ে। তিনি বলেন, ভারত এ সময় পূর্ব-বাংলা আক্রমণ করিলে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সৈন্য আসিয়া আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারি না। তাই আওয়ামী লীগ নৌ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার বাংলায় স্থাপন এবং দেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বাঙ্গালিদেরও শক্তিশালী করার দাবি তুলিয়াছে। তিনি বলেন, শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এবং পূর্ব-বাংলায় তাহাদের এজেন্টরা সেই দাবির বিরােধিতা করিতেছেন। তিনি এই সকল এজেন্টকে চিনিয়া রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বাংলার কৃষক শ্রমিকের দুর্দশার কথা উল্লেখ করিয়া বলেন যে, শিল্পপতিদের ট্যাক্স হলিডে অর্থাৎ ১০ বৎসরের জন্য ট্যাক্স মওকুফ করা যায়, অথচ বাংলার চাষির খাজনা ও সুদ আদায়ের জন্য বডি ওয়ারেন্ট ও মালামাল ক্রোক করা হইয়া থাকে।
তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ এবং ব্যাংক, ইনসিওরেন্স ও ভারি কল-কারখানা এবং পাট ব্যবসা জাতীয়করণের দাবি জানান। জনাব তাজউদ্দিন হিন্দু-মুসলমান এবং স্থানীয়-অস্থানীয়দের মধ্যে সম্প্রীতি এবং পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আস্থা বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ দেশ সকলের দেশ, এ দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানের সমান অধিকার রহিয়াছে। নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য আপনারা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া সংগ্রাম করুন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ কতিপয় প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল কর্তৃক জনসভায় লাঠিধারী স্বেচ্ছাসেবক রাখার তীব্র সমালােচনা করিয়া বলেন, বাংলার মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান, এখানে মুসলমানের ইসলাম বিপন্ন হয় নাই। ধর্মের জন্য জেহাদ করিতে চান লাঠি লইয়া ইসরাইলের সাথে লড়াই করুন। তিনি ৬-দফা ও ১১-দফার বাণী নিভৃত গ্রামের ঘরে ঘরে পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। সন্ধ্যায় তিনি কাপাসিয়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কর্মীদের এক সভায় বক্তৃতা করেন। সভায় বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে তাহাকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, কাপাসিয়া থানার অধিবাসী এবং আইয়ুব-মােনেম আমলে দীর্ঘ কারাভােগ হইতে মুক্তিলাভের পর নিজ মাতৃভূমি কাপাসিয়ার বুকে জনাব তাজউদ্দিন আহমদের বক্তৃতা দান ইহাই প্রথম। তাহার বক্তৃতা শ্রবণের জন্য সকাল হইতেই কাপাসিয়া থানার সুদূর উত্তরাঞ্চল, টোক, লােহাদী, কপালেশ্বর, হাইলজোর, গােসিঙ্গা, সিংহশ্রী, পূর্বাঞ্চল, ঘিরাটি, কামারগাঁও, আড়াল, বাঘিয়ার প্রভৃতি নিভৃত পল্লী হইতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্রোতা দল কাপাসিয়ায় আসিয়া উপস্থিত হয়। কাপাসিয়া আগমনের অব্যবহতি পরেই জনাব তাজউদ্দিন আহমদ কাপাসিয়া হাইস্কুলে আয়ােজিত কাপাসিয়া থানা ছাত্র লীগের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
থানা ছাত্র লীগের আহ্বায়ক সিদ্দিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ভাষণ দানকালে, জনাব তাজউদ্দিন ছাত্র লীগের সংগ্রামী ইতিহাস, ইহার আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ছাত্র লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করিতে হইলে চরিত্রবান ও আদর্শবান হইতে হইবে। তিনি ছাত্রগণকে শৈশব হইতে মহৎ গুণ অনুশীলনের জন্য উপদেশ দেন। তিনি বলেন, তােমরাই ভবিষ্যতের নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। দেশ ও সমাজকে সুখী করিতে হইলে নিজেদের চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখিতে হইবে। এ দেশের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ একদিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হইয়া দেশে সামাজিক ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হইবে বলিয়া তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি ছাত্রদের বিশেষ করিয়া এ দেশের শিক্ষা সমস্যার কথা উল্লেখ করিয়া এইগুলি সমাধানের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি