জানুয়ারি ১৩, ১৯৭০ মঙ্গলবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক
পল্টন নতুন করিয়া ডাক দিবে, স্বাধিকারের দাবি কেউ রুখিতে পারিবে না ? পল্টনের বিরাট জনসভায় ভাষণ দান প্রসঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, শত স্মৃতির সঙ্গে জড়িত পল্টন ময়দান জনগণের ত্যাগ ও তিতিক্ষা এবং জেল-জুলুম সহ্য করার মাধ্যমে পুনরায় জনগণের কাছে উন্মুক্ত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, আবার পল্টন নতুন করিয়া ডাক দিবে, যার ফলে সারা দেশ জাগিয়া উঠিবে এবং স্বাধিকার অর্জনের বুলন্দ আওয়াজকে কোন শক্তিই রুখিতে পারিবে না। তিনি বলেন যে, স্বাধীনতার ২২ বৎসর পরও দেশের মানুষ অধিকারের সনদ শাসনতন্ত্র পায় নাই। শাসনতন্ত্র পাওয়ার ফলে গণ-মানুষের অধিকার পাকাপােক্ত হয় নাই; শোষকের বিরুদ্ধে দাড়াইবার অধিকার নাই। জনাব তাজউদ্দিন দেশের শতকরা ৮০ জন অধিবাসী অর্থাৎ কৃষক সমাজের অবস্থার এক করুণ চিত্র তুলিয়া ধরিয়া বলেন যে, আজ কৃষক সমাজ মৃত্যুর পথে। কর ভার, খাজনা, ট্যাক্স ও মৌলিক গণতন্ত্র আরােপিত ৪০ প্রকার ট্যাক্সের বােঝার ভারে কৃষক সমাজ ঋণভারে জর্জরিত, সর্বহারা। তিনি বলেন যে, আপামর কৃষক।
সমাজের উপর আজ অকথ্য নির্যাতন, সার্টিফিকেটের খড়গ আর দৈহিক নির্যাতন। নামিয়া আসে। তিনি বলেন যে, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষক সমাজ পর্যদুস্ত । প্রতি বৎসর একশত থেকে দেড়শত কোটি টাকার সম্পত্তি বন্যায় বিনষ্ট হয়; অথচ প্রতিকারের কোনই ব্যবস্থা নাই। বন্যা প্রতিরােধের দাবি উঠিলে কেন্দ্রের টাকা থাকে না। কিন্তু বালাখানা রাজধানী গড়িয়া তােলার টাকার অভাব হয় না, কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এক হাজার কোটি টাকা জোটে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে যে ক্রুগ মিশন নিয়ােগ করা হইয়াছিল, উহা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এক হাজার কোটি টাকার পরিকল্পনা পেশ করিয়াছিল। তিনি বলেন যে, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ে চাষি সমাজের মেরুদন্ড ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। শতকরা ৩৫ জন কৃষক আজ ভূমিহীন, তাহাদের ঘরে কোনদিন আর নতুন ধান উঠিবে না। আজ ভূমিহীন কৃষকরা পথে পথে, ফুটপাতে দিন কাটাইতেছে; মা-বােনদের ইজ্জত যাইতে বসিয়াছে। শ্রমিক শ্রেণীর দুর্গতির বিবরণ দান প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, শ্রমিকরা আজ শ্রমের ফলভােগের সুযােগ পাইতেছে না। ন্যায্য মজুরি চাহিলে। তাহাদের উপর নির্যাতন নামিয়া আসে, তাহাদের জেলে ভরা হয়, নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং দেশ রক্ষা আইনে শাস্তি দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার কর্তৃক ঘােষিত নিম্নতম মজুরি সম্পর্কে তিনি বলেন যে, উহাতে বিরাট ফাঁকি রহিয়াছে। ৫০ জনের কম শ্রমিক নিয়ােগকারী প্রতিষ্ঠানে উহা প্রযােজ্য নয়।
বহু শিল্পপতি নিম্নতম মজুরি ফাঁকি দেওয়ার জন্য একই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে ভাগ করিয়াছেন। নিম্নতম মজুরি আইনে দক্ষ, অদক্ষ সংজ্ঞা না থাকায় সমানে সকলকে। নিম্মতম মজুরি দেওয়া হইতেছে। অতিরিক্ত মজুরি দাবি করা হইলে শ্রমিক ছাঁটাই করা হইতেছে। চা বাগান শ্রমিকদের চরম দুরবস্থা ব্যাখ্যা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, চা বাগান শ্রমিকরা স্বামী-স্ত্রী দুইজনে কাজ করিয়া একজনের মজুরি পায়। তিনি। নিম্নতম মজুরির ক্ষেত্রে আইনের মারপ্যাচের অবসান, চা বাগান শ্রমিকদের ঘৃণ্য মজুরি প্রথার অবসান দাবি করেন। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, অভিভাবক তার পুত্র-কন্যার লেখাপড়ার জন্য খরচ যােগাইতে পারেন না; কারণ তিনি তার পাট, ইক্ষু, তামাকের দাম পান না। তাই ছাত্র তার অভিভাবকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাশে দাঁড়ায়। আর এই সাথে দাঁড়ানােটাই যদি রাজনৈতিক হয় তাহা হইলে সে রাজনীতি ছাত্ররা চিরকালই করিবে। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গ্রহণযােগ্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিলে শশাষণ চলিবে না; তাই কায়েমী স্বার্থবাদী ও তাদের দালালরা আজ বেসামাল হইয়া পড়িয়াছেন। একদল রাজনৈতিক এতিম, যাহারা ২২ বছর নির্বাচন হওয়ার সুযােগে কাগজী নেতাতে পরিণত হইয়াছেন; তাহারাই নানা অজুহাতে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি বলেন যে, ইহারা প্রমাদ গণিতেছেন বলিয়াই আজ কেন স্বায়ত্তশাসন আগে দেওয়া হইল না এই অজুহাতে আসর জমাইতে চেষ্টা করিতেছেন। তিনি বলেন যে, ৬-দফার স্বায়ত্তশাসন জনগণ দাবি করিয়াছিল ; ১১ দফার ২ ও ৩ দফায় ৬-দফা অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে। কিন্তু এইসব নেতা ৬-দফা গ্রহণ করিতে পারেন নাই।
জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, গােলটেবিলে যাওয়ার সময় শেখ মুজিব নেতৃবৃন্দের দুয়ারে দুয়ারে গিয়াছেন, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একমত হইতে বলিয়াছেন; কিন্তু উহাতে তখন সাড়া দেওয়া হয় নাই। গােলটেবিলে যাওয়ার আগে সব দল স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একমত হইলেও চোপা-চাপকানওয়ালা নেতারা তথা মওদুদী-নসরুল্লাহ, চৌধুরী মােহাম্মদ আলি রাজি হন নাই। জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, বর্তমানে একশ্রেণীর শিল্পপতি সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য টাকা নিয়া মাঠে নামিয়াছেন। তিনি এই সব শিল্পপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মানিয়া নিন তবেই সমাজতন্ত্র কায়েম হইবে। তিনি বলেন যে, ইহারা বিপ্লবের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করিতে চায়। যাতে করিয়া অরাজকতার অজুহাতে আবার কেহ নির্বাচন হইবে না বলিবার সুযােগ পান। তিনি বলেন যে, যে জাতি অধিকার আদায়ের জন্য গুলি খাইতে শিখিয়াছে, ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে, সে জাতিকে বিপ্লবের নামে পিছন হইতে ছুরিকাঘাত করা সম্ভব হইবে ; বরং যাহারা এই চেষ্টা করিবেন তাহারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবেন। বক্তৃতার উপসংহারে জনাব তাজউদ্দিন নেতার ঐক্য নয়, বরং জনতার ঐক্য গড়িয়া তােলার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি বলেন যে, জনপ্রতিনিধিদেরকে জনমতের রায় অনুসারেই শাসনভার দিতে হইবে।
.
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি