You dont have javascript enabled! Please enable it!

জুলাই ৮, ১৯৬৯ মঙ্গলবার ঃ দৈনিক ইত্তেফাক

সংশ্লিষ্ট ইস্যুর উপর গণভােট গ্রহণ করিয়া নিজেদের বক্তব্যের সারবত্তা যাচাই করুন ঃ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাপর্বে যে নবাবজাদা নসরুল্লাহ ও মওলানা মওদুদীরা আদাজল খাইয়া উহার বিরােধিতা করিয়াছিলেন এবং অখন্ড ভারতের জন্য জানপ্রাণ নেসার করিয়াছিলেন, আজ তাহারা পাকিস্তানের দরদী বনিয়া দেশ ও দেশবাসীর সত্যিকার দরদী ও বরেণ্য নেতার বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ করিবেন না তাে করিবেন কে! গতকল্য (সােমবার) আওয়ামী লীগ অফিসে সাংবাদিকদের সহিত এক ঘরােয়া আলােচনাকালে আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন পি.ডি.পি. নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ্র সাম্প্রতিক কতিপয় উক্তির উপর আলােচনাকালে উপরােক্ত মন্তব্য করেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জনাকীর্ণ উক্ত বৈঠক কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। জনাব তাজউদ্দিন বলেন, একদিন যে নবাবজাদা নসরুল্লাহ ও মওলানা মওদুদী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারই বিরােধিতা করিয়াছিলেন আজ তাহাদিগকে যখন দেশপ্রেমের সােল এজেন্ট বনিয়া দেশ বরেণ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ করিতে শুনি তখন তাহাদের সম্পর্কে আলােচনা করিতেও ঘৃণা বােধ হয়। আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি নবাবজাদার কটাক্ষের জবাব দান প্রসংগে জনাব তাজউদ্দিন নবাবজাদা ও তাহার অনুচরবর্গকে হােটেল কক্ষের ছত্রচ্ছায়া হইতে বাহিরে আসিয়া পূর্ব-পাকিস্তানের যে কোন স্থানে দাঁড়াইয়া আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে তাহার ও তাহাদের অভিযােগের পুনরুক্তি করিবার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন।

আওয়ামী লীগের ৬-দফার অন্তর্ভূক্ত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব ও এক ইউনিট বাতিলপূর্বক পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশসমূহের পুনরুজ্জীবনের দাবির প্রতি কটাক্ষ করিবার পূর্বে এই তিনটি ইস্যুর উপর অবিলম্বে দেশব্যাপী গণভােট অনুষ্ঠান করিয়া সত্যিকার গণতন্ত্র প্রীতির পরিচয় দেওয়ার জন্য তিনি নবাবজাদাদের প্রতি আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সম্পাদক বলেন, নিজেদের বক্তব্য সম্পর্কে নবাবজাদারা যদি এতই আস্থাবান হন তবে নিরাপদ দূরত্বে বসিয়া এবং কল্পনার জগতে নেতৃত্বের ডানা মেলার খেয়াল পরিত্যাগ করিয়া অবিলম্বে দেশব্যাপী প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচনে শরিক হইয়া নবাবজাদারা নিজেদের তাকত পরীক্ষা করুন। এই প্রসঙ্গে তিনি অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠান করিয়া জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়ােজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরােপ করিয়া দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হইতে বিরত থাকার জন্য পি.ডি.পি. নেতার প্রতি আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ ও নবাবজাদাদের ভূমিকার তুলনামূলক বিচার প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, বাংলার মুসলমান এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালে এই নবাবজাদা ও মওলানা মওদুদীদের মত পাকিস্তান-বিরােধী অশুভ শক্তির সহিত প্রাণপণে যুঝিতে হইয়াছিল এবং পাকিস্তানের মাটিতে বসিয়াও সেই শক্তির বিরুদ্ধেই আজও তাহাদিগকে সংগ্রাম করিতে হইবে ইহাতে আর বিচিত্র কি! তিনি বলেন, “অশুভ শক্তির বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করিয়াই ত্যাগ ও তিতিক্ষার মহা-পরীক্ষার মধ্য দিয়া আওয়ামী লীগ দেশবাসীর দাবি লইয়া সম্মুখে আগাইয়া চলিয়াছে এবং সেই দাবি-দাওয়ার প্রশ্নে জাতির সহিত তাহারা বিশ্বাসঘাতকতা করিতে জানে নাই।

তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাহার রাজনৈতিক জীবনের শুরু হইতেই পাকিস্তান বিরােধী শক্তির বিরুদ্ধে যুঝিয়া আসিয়াছেন এবং বর্তমানেও তিনি ও তাহার দল পাকিস্তান বিরােধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়া চলিয়াছেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেন যে, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন, আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে কোন কোন বিষয় থাকিবে সে প্রশ্ন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নের আজও কোন সমাধান হয় নাই। আওয়ামী লীগ এই সব প্রশ্নের স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী পাকিস্তান সৃষ্টিরই প্রয়াস পাইতেছে। এইসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ভূমিকার উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন যে, ৬-দফা এবং বিগত গােলটেবিল বৈঠকে প্রদত্ত শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে আওয়ামী লীগ এইসব প্রশ্নে তাহাদের মনােভাব পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন এবং সে মনােভাব আজ আর প্রকোষ্ঠের মধ্যে অন্তরীণ নাই। ইহা দেশ ও বিশ্বজনের অবিদিতও নয়। আওয়ামী লীগ তাহার ৬-দফা এবং ছাত্রদের ১১-দফার বাস্তবায়নের পন্থা আলােচনার উদ্দেশ্যে সর্বমহলের নেতৃবৃন্দের কাছে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন। কিন্তু কোন নেতাই আলােচনায় আগাইয়া আসেন নাই, তাহারা ছত্রচ্ছায়ায় থাকিয়া মাত্র ঘৃণ্য বিষেদগারের মাধ্যমে তাহাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করার অপপ্রয়াস পাইয়াছেন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ নবাবজাদার সরাসরি অভিযােগের উল্লেখ করিয়া বলেন যে, নবাবজাদা প্যারা মিলিশিয়া ও ট্যাক্সেশন প্রশ্নে আপত্তি তুলিয়াছেন, অথচ এই প্রশ্ন ২টি নতুন কোন বিষয় নয়। আওয়ামী লীগ বহুবার উহার ব্যাখ্যা দিয়াছে এবং সে ব্যাখ্যাও কাহারও অজানা নেই। প্যারা মিলিশিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানে প্যারা মিলিশিয়ার মত বাহিনী এখনও আছে, নাম হয়তাে তাহাদের ভিন্ন থাকিতে পারে।

পূর্ব-পাকিস্তানের আঞ্চলিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রস্তাবের মধ্য দিয়া পূর্ব-পাকিস্তান রক্ষা ব্যবস্থায় নিয়মিত বাহিনীর হাতকে শক্তিশালী করাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। কিন্তু এই সহজ বিষয়টিরই স্বকপােলকল্পিত ব্যাখ্যা করিতে গিয়া নবাবজাদারা অন্ধকারে ভূত দেখিতেছেন। কর ব্যবস্থার প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, শাসনতান্ত্রিক বিধান বলে এবং স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়াতেই প্রদেশ বা অঞ্চলে সংগৃহীত রাজস্বের নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে চলিয়া যাইবে। তিনি কেন্দ্রীয় সরকার সম্বন্ধে নবাবজাদাদের মনােভাবের কঠোর সমালােচনা করিয়া বলেন যে, তাহারা যখন কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বিলাপ করেন তখন তাহারা ধরিয়াই লন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাহাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সে সম্পত্তিতে আমাদের কোন প্রবেশাধিকার নাই। তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্মরণ করাইয়া দেন যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে নবাবজাদাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানরাও থাকিবেন। অতএব শুকাইয়া মরিতে হইলে নবাবজাদার সঙ্গে শেখ সাহেবরাও শুকাইয়া মরিবেন। ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের উল্লেখ করিয়া এবং উহা হইতে উদ্ধৃতি দিয়া জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, পাকিস্তানের যে ভিত্তি প্রস্তাব, সে প্রস্তাবে আঞ্চলিক সরকারসমূহকে দেশ রক্ষা, কাস্টমস, বৈদেশিক বিষয় ও যােগাযােগ ব্যবস্থারও দায়িত্ব দেওয়ার বিধান ছিল এবং এ বিধান সন্নিবেশকালে পাকিস্তানের বাপচাচারা নিশ্চয়ই পাকিস্তানের সর্বনাশ করিতে চান নাই। তিনি বলেন যে, জাতির বাপ-চাচারা যখন পাকিস্তান প্রস্তাব রচনা করিতেছিলেন, নবাবজাদা সাহেব তখন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের লেজুরস্বরূপ ‘আহরার দুল সংগঠনে ব্যস্ত ছিলেন।

তবু তাহাদের দেশপ্রেম নাই একথা আমরা বলি না। কিন্তু একথা নিশ্চয় বলা যায় যে, পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে তাহারা বিরােধ সৃষ্টি করিতে সচেষ্ট এবং এই কারণেই এই শক্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করিতে হইবে। গণতন্ত্রের মূল নীতির ব্যাখ্যা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, গণতন্ত্র মানেই মাথাগুণিত ব্যবস্থা এবং সে ব্যবস্থার মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিও অনিবার্যভাবেই আসিয়া যায়। এক ইউনিট প্রশ্নের অবতারণা করিয়া তিনি বলেন যে, এক ইউনিট যে উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, নবাবজাদাদের জন্য সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়াছে। কিন্তু নবাবজাদা একথা বলিলে ‘গােস্বা’ হইয়া যান তিনি। হয়তাে মনে করেন যে, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংশ্লিষ্ট এলাকা হইতে কোনদিন কোন সদস্য আসিবেন না। তিনি নবাবজাদাকে স্মরণ করাইয়া দিয়া বলেন যে, পরিষদে এইসব এলাকার সদস্য থাকিবেনই এবং প্রয়ােজনবােধে তারা তাদের দাবি লইয়া চাপাচাপি করিতেই থাকিবেন। আওয়ামী লীগ সম্পাদক হােটেল কক্ষে বা আরাম কেদারায় বসিয়া নেতা নেতা না খেলিয়া নির্বাচনের কষ্টিপাথরে নেতৃত্বের মাহাত্ম্য যাচাই করার জন্য নবাবজাদার প্রতি আহ্বান জানান। মওলানা মওদুদীর বক্তব্যের সমালােচনা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, মওলানা সাহেব সম্মানিত ব্যক্তি, কিন্তু বিগত গণ-আন্দোলনের কৃতিত্ব তিনি দেশবাসীকে না দিয়া বিদেশীদের দেওয়ার জন্য এত আগ্রহী কেন ? পূর্বপাকিস্তানের আন্দোলনে ভারতীয় হিন্দুদের হাত আবিষ্কার করিয়া তিনি পূর্বপাকিস্তানীদের প্রতি হীন কটাক্ষই’ করিয়াছেন।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!