You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.02.13 | দৈনিক ইত্তেফাক-চরমপন্থীদের উস্কানি ও স্বার্থান্বেষীদের প্ররােচনা সম্পর্কে তাজউদ্দিনের হুঁশিয়ারি - সংগ্রামের নোটবুক

ফেব্রুয়ারি ১৩, ১৯৬৯ বৃহস্পতিবার : দৈনিক ইত্তেফাক

চরমপন্থীদের উস্কানি ও স্বার্থান্বেষীদের প্ররােচনা সম্পর্কে তাজউদ্দিনের হুঁশিয়ারিঃ স্টাফ রিপাের্টার এবারকার সংগ্রাম মুক্তিকামী মানবতার সত্যিকার মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে এই সর্বপ্রথম দেশের দুই অঞ্চলের নির্যাতিত মানুষের মুক্তির কামনা একই সুরে বাজিয়াছে—গতিও লাভ করিয়াছে একই ছন্দে। গতকাল বুধবার ঢাকা সেন্ট্রাল জেল হইতে মুক্তি লাভের পর এক সাংবাদিক সাক্ষাঙ্কারে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সারা দেশের ছাত্র-জনতা-শ্রমিকের সম্মিলিত সংগ্রামের এ জোয়ারকে রােধ করার প্রয়াস যেমন হঠকারিতা—দেশের বৃহত্তর কল্যাণের প্রশ্নে সচেতন না থাকিয়া সে জোয়ারে অবলীলাক্রমে গা ভাসাইয়া দেওয়াও তেমনি মারাত্মক পরিণামবহ।

জনগণের এ সংগ্রামে প্রবীণদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া জনাব তাজউদ্দিন বলেন, জনগণের কল্যাণ সাধন ও দেশবাসীর অধিকার আদায়ের আজিকের এ সংগ্রাম যাতে চরমপন্থীদের উস্কানি ও স্বার্থান্বেষীদের প্ররােচনায় বানচাল না হইয়া যায়, সে জন্য প্রয়ােজন হইলে দেশের প্রবীণ নেতৃবৃন্দকে ঝুঁকিও গ্রহণ করিতে হইবে। সব রকমের ভাবালুতা, অতি-উৎসাহ বা উন্নাসিকতাকে সর্ব প্রযত্নে আজ এড়াইয়া চলিতে হইবে এবং অটুট ঐক্য বজায় রাখিয়া আগাইয়া যাইতে হইবে। দেশবাসী ও নিজ দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নীতি নির্ধারণী এই বক্তৃতায় তিনি বলেন, দেশবাসীর আজিকার সংগ্রাম চরম সংগ্রামের প্রথম পর্যায়। তাই এই পর্যায়ে কোনক্রমেই ভুল করার সুযােগ নাই। আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন এবং সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যেমন উদ্বেল হওয়ার সুযােগ নাই, ঠিক তেমনি অবস্থায় উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দ্বারা এ সংগ্রামকে বানচাল করিয়া দেওয়ার ধৃষ্টতাও কাহারও থাকা সমীচীন নয়। জাতির জন্য যাহা কিছু কল্যাণকর তাহাই আমাদের কাম্য এবং তাহা গ্রহণ করার মত অবারিত মনও আমাদের থাকা দরকার।

তিনি বলেন যে, আমরা অতীতে বহু সংগ্রাম করিয়াছি, কিন্তু এবারকার সংগ্রামের যে একটা বিশেষ লক্ষণীয় দিক আছে তাহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না। যে সংগ্রামে দেশের দুই অঞ্চলের মানুষের মন ও প্রাণ একই ছন্দে ছন্দিত, একই কামনায়মূছনায় সংগ্রামী চেতনা আজ অভিভূত, যে সংগ্রামের শিক্ষা কেবল রাজনৈতিক খুঁটি চালনারই শিক্ষা নয়, সে শিক্ষা মানবিক মুক্তি সগ্রামের মহা বিকাশের শিক্ষা। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জনাব তাজউদ্দিন বলেন যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে বর্তমান পরিস্থিতিটি অদ্বিতীয়। এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হইল, এই প্রশ্নের বিশ্লেষণ করিয়া তিনি বলেন যে, দীর্ঘদিন ধরিয়া দেশের রাজনৈতিক গগনে নেতৃত্বের যে শূন্যতা বিরাজ করিতেছিল তাহারই দরুন দেশবাসীর মনের চাপা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে নাই। কালচক্রের ঘূর্ণনে কোন নেতৃত্বের অপেক্ষায় না থাকিয়া দেশবাসীর মনের যে চাপা অসন্তোষ আজ বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়িয়াছে তার স্বভাবসিদ্ধ প্রকৃতিতে। এমতাবস্থায় প্রবীণ নেতৃবৃন্দ—যারা এতদিন যে কোন কারণেই হােক পিছাইয়া ছিলেন, আজ তাদেরকে তাদের মনােভাবের আমূল পরিবর্তন করিতে হইবে এবং সংগ্রামে কেবল শরিক হওয়ার মনােভাব পরিত্যাগ করিয়া সংগ্রামের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতে হইবে। সব মহলকে আজ অন্তর দিয়া উপলব্ধি করিতে হইবে যে, কেন আজ দেশের অতি বড় শক্তিধররাও ধূলার ধরায় নামিয়া আসিয়াছেন এবং এই উপলদ্ধির আলােকেই বর্তমান সগ্রামকে সঠিক পথে চালনা করিতে হইবে। জনাব তাজউদ্দিন তার দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্য করিয়া বলেন যে, এমনকি অনিচছাকৃত ভুলের জন্য বা ব্যক্তি বা দল বিশেষের অহমিকায় জন্য দেশবাসী যদি তাদের ন্যায্য পাওনা হইতে বঞ্চিত হয়, তবে তার প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হইবে এবং সে বঞ্চনার সব দায়িত্ব প্রত্যক্ষভাবে সে ব্যক্তি বা দলের স্কন্ধে গিয়া চাপিতে বাধ্য।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে বিরােধী দলসমূহের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক আলােচনা প্রসঙ্গে তাহাকে সরাসরি মন্তব্য করার জন্য চাপ দেওয়া হয়, (তখন) তিনি বলেন যে, তার দলের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার পূর্বে এ সম্পর্কে তার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব মামলার উল্লেখ করিয়া জনাব তাজউদ্দিন সমগ্র মামলাটিকে একটি রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিবেচনা করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, মামলাটির দোষগুণ বিচার করিয়া উহাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করিলে সরকার রাজনৈতিক আলােচনার প্রশ্নেও স্বচ্ছ ও সুস্থতর পরিবেশ সৃষ্টি করিতে সমর্থ হইবে। জনাব তাজউদ্দিন দৈনিক ইত্তেফাকের পুনপ্রকাশে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলেন যে, আমরা কারাগারে ছিলাম, বস্তুতঃ ইত্তেফাকও এতদিন কারাগারেই ছিল। ইত্তেফাকের অবর্তমানে বলিতে গেলে দেশবাসী সাধারণ মানুষের স্বার্থের নিঃস্বার্থ অভিভাককেই হারাইয়াছিল। তার পুনপ্রকাশে সাধারণ মানুষ তাদের পথের দিশারীকে খুঁজিয়া পাইয়াছে।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি