ঐক্যবদ্ধ মাের্চা গঠন করে দস্যুদের মােকাবিলা করতে হবে
স্বাধীন বাংলা সরকারের স্বীকৃতি চাই
প্রমােদ দাসগুপ্ত
আগরতলা ২২ এপ্রিল বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থনে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক আয়ােজিত এক বিরাট সমাবেশে পলিটব্যুরাে সদস্য কমরেড প্রমােদ দাশগুপ্ত বলেন, ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যে লড়াই করছেন, ভারতের মানুষকেও একইভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করে দুই দেশের মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে।
কমরেড প্রমোেদ দাশগুপ্ত তার ভাষণে বাংলাদেশের বর্তমান আন্দোলনের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, প্রথম চেষ্টা হয় বাংলাদেশের মানুষের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষার দাবিতে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীলদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে। তারপর পূর্ব বাংলার মানুষ যুক্তফ্রন্ট করে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে শাসন ক্ষমতায় আসে। কিন্তু সেটি সরকারকে বেশিদিন টিকতে দেওয়া হয়নি- আবির্ভাব হলাে আয়ুব খার। সারাদেশে নেমে এল সামরিক শাসন। পাকিস্তানের উপর অংশের মানুষ ইহা মেনে নেননি। তারা আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন সকল দমননীতিকে উপেক্ষা করে। আওয়াজ উঠল— প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটে নির্বাচিত সরকারের। আওয়াজ উঠল স্বাধীকারের আওয়াজ উঠল- প্রতি অঙ্গরাজ্যের সমানাধিকারের ভিত্তিতে সায়ত্বশাসনের। সেই আন্দোলনকে দমনে ব্যর্থ হয়ে আয়ুব পদত্যাগ করলআবির্ভূত হলাে ইয়াহিয়া খা। তাতেও আন্দোলন থামেনি। পাকিস্তান ছিল ২ ইউনিটের রাজ্য। আওয়াজ উঠল- পশ্চিম পাকিস্তানের ১ ইউনিট ভেঙে ৪ ইউনিট করতে হবে।
উত্তর অংশের আন্দোলনের চাপে ইয়াহিয়া খাকে মাথানত করতে হলাে মেনে নিতে হলাে ৪ ইউনিট গঠনের দাবি মেনে নিতে হলাে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান তৈরি করতে। যদিও এর মধ্যেও চক্রান্তের ত্রুটি ছিল না।
এই দাবিগুলাের উপর দাঁড়িয়েই নির্বাচন হলাে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক নতুন নজির সৃষ্টি করে মজিবুরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়যুক্ত হলাে। কিন্তু চক্রান্ত চললাে যাতে মজিবুরের নেতৃত্বে সরকার গঠিত না হয়। শুরু হলাে আপােষ-আলােচনা। তারপরই নেমে এল বাংলাদেশের মানুষের উপর এই জঘন্য, বর্বর আক্রমণ। রক্তের বন্যায় বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ভাসিয়ে দেওয়া হলাে।
বাংলাদেশের মানুষের মুক্তিও এছাড়া সম্ভব ছিল না কিন্তু অবস্থা তাদের বাধ্যকরল সকল ইয়াহিয়ার হিংস্র বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে– তাই দেখা গেল যে মুসলমান মহিলা ভােট দিয়েছিল— শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে মজিবুরের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে- সেই মহিলাদেরই দেখা গেল বুকে মাইন বেধে ট্যাঙ্কের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ সকল মতামত ভুলে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের ঝাপিয়ে পড়ছে গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। যে মওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কট করেছিলেন তিনিই আজ বৃদ্ধ বয়সে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং ঐক্যবদ্ধ মাের্চা গঠন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে দাশগুপ্ত বলেন, বাংলাদেশে যখন ইয়াহিয়া খা। গণহত্যা করে চলছে তখন মুখে সহানুভূতি দেখিয়ে ইন্দিরা গান্ধী কার্যত নীরব। আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয় দিয়ে এবং কিছু সাহায্য দিয়েছেন সত্য কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে তাকে আজও স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। কলিকাতায় অবস্থিত পাক ডেপুটি হাইকমিশনার যখন পাক সরকারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বলে ঘােষণা করলেন তখনও ভারত সরকার নীরব। পাক সরকার যখন নতুন কমিশনার পাঠালেন তাকেও ভারত সরকার স্বীকার করলেন, বাড়ি দখলের প্রশ্নে বলে বসলেন ইহা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ভারতের কিছু করার নেই। দাশগুপ্ত প্রশ্ন তােলেন, কেন ইন্দিরা পরিষ্কার বলে দিলেন না পাকিস্তানের নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারকে স্বীকার করতে ভারত বাধ্য নয়। এই একটি ঘটনা হতেই ভারত সরকারের চরিত্র পরিষ্কার হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গেই তিনি পশ্চিম বাংলার একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ইন্দিরা সরকার সাড়ে চার কোটি মানুষের বিরুদ্ধে ২ লক্ষ সশস্ত্র বাহিনী নিযুক্ত করে অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। গুলি করে খুন করছে নিরীহ মানুষকে। হাজারে হাজারে মানুষকে জেলে পাঠানাে হচ্ছে, লক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা জারি করা হয়েছে। দিনের পর দিন ১৪৪ ধারা, কাফু জারি করে রাখা হয়েছে। তাই পশ্চিম বাংলার মানুষকেও আজ গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা ও স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ মাের্চার মাধ্যমে এদিকে এগিয়ে নিতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। দুই দেশের মানুষের এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে পরাজিত করার ক্ষমতা বর্বরদের নেই। সভায় সভাপতিত্ব করেন লােকসভা সদস্য কমরেড দশরথ দেব।
সূত্র: দেশের ডাক
২৩ এপ্রিল, ১৯৭১
০৯ বৈশাখ, ১৩৭৮