৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লব
৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হল ঐতিহাসিক সেপাই বিদ্রোহ। স্থান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। প্রচণ্ড গােলাগুলি, চিৎকার আর হট্টগােলের মধ্য দিয়ে উন্মােচিত হল শতাব্দির এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। রেড টেপ অফিসারদের দাপটে শিহরিত আধুনিক পেশাদার সেনাবাহিনীতে বর্তমান যুগেও যে ভয়াবহ সেপাই বিদ্রোহ ঘটতে পারে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অথচ তাই ঘটে গেল। সেপাইদের পদভারে প্রকম্পিত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। অফিসাররা ভয়ে কম্পমান। ১৮৫৭ সালের ২৯ শে মার্চ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল এই উপমহাদেশের প্রথম সেপাই বিদ্রোহ। কলকাতার ব্যারাকপুর থেকে শুরু হয়েছিল বিদ্রোহের প্রথম অগ্নি ফুলিংগ, তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। দিল্লি, আগ্রা, লকনৌ, মীরাট, কানপর সর্বত্র। বিদ্রোহী সেপাইরা শেষ মােঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে দিল্লির সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয় তাদের অভ্যুত্থান। ফাসির কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বলি দেয় শত শত সৈনিক। শতাব্দির ব্যবধানে এই উপমহাদেশে সংঘটিত হল দ্বিতীয় সেপাই বিদ্রোহ। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। ঢাকার সেনানিবাসে পুনরাবৃত্তি হল ইতিহাসের আর একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের। ১৮৫৭ সালের সেপাই বিদ্রোহে সেপাইরা মােটেই লাভবান হয়নি, বরং ফাসির বেদীতে বলি। দিতে হয়েছিল বহু প্রাণ। ১৯৭৫ সালের সেপাই বিদ্রোহেও সেপাইরা খুব বেশী একটা লাবান
হয়নি, তবে একচ্ছত্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই তার উত্থান। রাত ১২ টা। সুবেদার মেজর আনিসুল হকের ইঙ্গিতে টু-ফিড রেজিমেন্টের লাইন থেকে একটি উইসার বুলেট আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে অন্ধকার ভেদ করে আকাশে উঠল। এটাই ছিল সংকেত। ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে 38 LAA রেজিমেন্ট প্রচণ্ড শব্দে আকাশে এ্যাক, এ্যাক গান ফায়ার করে তার জবাব দিলা। ব্যাস আর যায় কোথায়-সারা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাইরে চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার বুলেট ছুটে গেল আকাশে। ট্যাঃ ট্যাঃ ট্যাঃ টঃ। ট্যারর। ট্যাররর… শুরু হল উপমহাদেশের দ্বিতীয় সেপাই বিদ্রোহ। এক মুহুর্তেই অন্ধকারের আবরণে ঘুমিয়ে থাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সচল হয়ে উঠল। চারিদিকে বুলেট আর বুলেট। ফায়ার আর ফায়ার। আলােয় আলােয় আলােকিত হয়ে উঠল। সারা ক্যান্টনমেন্ট। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্ত্রীর ধাক্কায় চমকে উঠলাম। বারান্দায় দাড়িয়ে দেখি অদ্ভুত কাণ্ড। চারিদিকে গুলি আর গুলি। দূরে চতুর্দিকে মানুষের উল্লাস আর চিৎকার ধ্বনি। আলাের ছটায় আকাশ লালে লাল। আমার বুঝতে বাকি রইল না। এটাই সেই প্রত্যাশিত সেনা-অভ্যুত্থান। যার পদধ্বনি আমরা গত কদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছিলাম। এটি ছিল তিন মাসের ব্যবধানে ঢাকা সেনানিবাসে তৃতীয় সেনা-অভ্যুত্থান।
চতুর্দিকে অবিরাম গােলাগুলি আর চিৎকার ধ্বনি। অবস্থা ভাল করে পরখ করার জন্য আমি হামাগুড়ি দিয়ে দোতলার উচু ছাদে উঠলাম, লক্ষ্য করলাম এয়ারপাের্ট, ইব্রাহীমপুর বনানী ও ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে ইঞ্জিনিয়ার্স সিগন্যাল লাইনের দিক থেকে বহু লােক একসাথে আকাশে বাতাসে গুলি ছুঁড়তে উড়তে আমার বাসা বরাবরই এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে শত শত মানুষের চিৎকার আর গুলির শব্দ একেবারে আমার বাসার কাছে এসে পৌছে গেল। এরি মধ্যে দেখি বড় রাস্তা দিয়ে একটি জীপ মাইক নিয়ে শ্লোগান দিয়ে ছুটে চলছে, “সেপাই সেপাই ভাই ভাই।” জেনারেল জিয়ার বাসা আমার বাসা থেকে দু’শাে গজের মধ্যে। ছাদের উপর থেকে পুরাে দৃশ্যই দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম উমত্ত সৈনিকবন্দ তার বাসার দিকেই ছুটে যাচ্ছে। জিয়ার বাসার গেইটের কাছেই সবাই জমায়েত হয়ে ক্রমাগত শ্লোগান দিচ্ছে আর গুলি ছুঁড়ছে। সেপাই বিদ্রোহের চরম মুহূর্ত। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্নোৎপাত। সেপাই সেপাই ভাই ভাই। জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখলাম একপাল সৈনিক জিয়ার বাসা থেকে একটি জীপ ঠেলে নিয়ে চিকার নৃত্য করতে করতে বেরিয়ে আসছে। স্পষ্ট বুঝলাম জেনারেল জিয়াকে বন্দীশালা থেকে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে। তুমুল হট্টগােল। অদ্ভুত উত্তেজনা। |আমি টেলিফোন উঠিয়ে আমার অফিসে ফোন করলাম। ডিউটি ক্লার্ক ফোন ধরলাে।
ফোনের মধ্যেই ভেসে আসলাে অফিসের ভেতর থেকে বহু লােকজনের হট্টগােল। সে প্রায়। কাদো কাদো স্বরে বলল ; স্যার, আমাদের গ্যারেজ ভেঙে বিপ্লবী সৈন্যরা আপনার জীপ ও অন্যান্য গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কি করবাে, স্যার? বললাম, ডিউটি অফিসার কোথায়?—স্যার উনি পালিয়ে গেছেন। আমি কি করবাে বলতে বলতে কে একজন ধমক দিয়ে টেলিফোন তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রেখে দিলাে। বুঝলাম বিপ্লবী কারাে কাণ্ড। ক্যান্টনমেন্টের রাস্তায় তখন সৈন্যরা উন্মাদের মত ছুটছে আর উল্লাসে শ্লোগান দিচ্ছে। এসব অবলােকন করে আমিও দারুণ উত্তেজিত বােধ করলাম। আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। এরকম এ্যাডভেঞ্চার দেখার সুযােগ জীবনে আর কখনাে আসে নি। আমি সিভিল ড্রেসে পরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কাছেই আমার অফিসের দিকে হেঁটে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। রাস্তায় অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেপাইদের অস্ত্রহাতে লাফালাফি আর উল্লাস। জিয়ার বাসা এবং টু-ফিডের মাঝামাঝি রাস্তায় সব ভীড়। আমার বাসা ও অফিস ছিল এ দুটোরই মাঝামাঝি স্থানে। জিয়াকে মুক্ত করে টু-ফিডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবাই এখন * সেদিকেই ধাওয়া করছে। আমিও সেদিকে সবার সাথে মিশে আবছা অন্ধকারে একা একা
হেটে চললাম। অদ্ভুত অনুভূতি। বিজয় মিছিলে আমিও শামিল। …—-অস্পষ্ট—( সেপাই লাগান দিচ্ছে, সেপাই সেপাই ভাই ভাই—অফিসারের রক্ত চাই। শেষােক্ত, লাগাম শুনে আমি মনে । এটা কি। সনে সম সামনে যে ফুল বাসার দিকে)– অস্পষ্ট— মুখ ফিরালাম। বাসায় ফিরে এসে গেইটের দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে তখনও চিৎকার আর থেমে থেমে গুলি। আমি ভাবছিলাম, এই আনন্দমুখর রাতে এসব কিসের শ্লোগান। একটু পরেই ফোন এলে। হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান। বলল, স্যার আপনি কোথাও বেরুবেন না, আমরা এসে টু-ফিল্ডে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। তার কথা শেষ হতে না হতেই বাইরে গেইটে দরজায় কয়েকজন সেপাই ধাক্কা দিতে লাগল। আমি দোতলার উপর থেকে তাদের সাথে কথা বললাম। আপনাকে এক্ষুনি টু-ফিতেযেতে হবে। জিয়া সাহেব সব অফিসারকে ডেকেছেন। আমি বললাম, আমি আসছি তােমরা যাও। | আপনি এই কাপড়েই চলে আসুন। জিয়া সাহেব এক্ষুণি ডাকছেন। তাদের উচ্চকণ্ঠ। আমি বললাম তােমরা যাও। আমি ড্রেস পরেই যাচ্ছি। মনে হল এরা বাইরের বিপ্লবীসেপাই। গেইট বন্ধ থাকায় তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অন্য বাসার দিকে চলে গেল। রাত ৩-৪০ মিনিটের সময় হাবিলদার সিদ্দিক এলাে, সঙ্গে আরাে দুজন সেপাই। আমি তাকে সাথে নিয়ে টু-ফিল্ডের দিকে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। ওটা কাছেই, ৩/৪ মিনিটের রাস্তা। আমার জীপটি তখন বিপ্লবী সৈনিকদের দখলে। তারা ওটা নিয়ে অস্ত্রহাতে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন দিকে ঘােরাফেরা করছে। মধ্যরাতেই বিদ্রোহী সৈনিকরা সি ও ডি-তে অবস্থিত প্রধান অস্ত্রাগারটি ভেঙে সকল অস্ত্র লুট করেছে। এখন সবার হাতে হাতে অস্ত্র। রাস্তায় সৈনিকদের দ্রুত আনাগােনা। তারা আজ মুক্তবিহঙ্গ। অস্ত্র কাধে নিজের খেয়ালে ঘুরছে ফিরছে। তাদের মধ্য দিয়ে আমি আর সিদ্দিক এগিয়ে চললাম। আজ সেপাইদের কাছে অস্ত্র। অফিসাররা নিরস্ত্র। তারা এগিয়ে চলেছে বীরদর্পে। মনে হল সেপাইদের বিজয় মিছিলে আমিই একাকী। এক অফিসার। মুক্ত জিয়া টু-ফিল্ডে পৌছে দেখি সর্বত্র অস্ত্রধারী সৈনিক গিজ গিজ করছে। কর্নেল আমিনুল হক বারান্দায় পায়চারি করছে। বললাম, জিয়া কই। দারুণ খুশীতে সে হাত মিলিয়ে বলল, আসুন স্যার। বলেই একেবারে জিয়ার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, স্যার স্টেশন কমান্ডারও এসে গেছেন। জিয়া হাসলাে। চির পরিচিত সেই মুচকি হাসি। আমার সাথে জোরে জোরে হাত মিলালাে। সে দাড়িয়ে আমার সাথে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করল। বলল, হামিদ বসাে, কেমন আছ। তারপর ঘাড় কাৎ করে একটু নিচু স্বরে বলল, কথাটা মনে আছে? এক মাঘে। আমি হাসলাম।| মুক্তির পর তাকে অপূর্ব লাগছিল। টু-ফিল্ডে কমাণ্ডিং অফিসার মেজর রশিদের চেয়ারে। বসে জিয়াউর রহমান। গায়ে তার ঘি রং এর পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা। সদ্য মুক্ত জিয়া। মুক্তির পর তাকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। যেন রীতিমত নায়ক। অবশ্য ৭ নভেম্বরের সেপাই বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক জিয়াই বটে। যেন যুগ যুগ ধরে ঐ . মুহুর্তটি তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
বেশ কজন অফিসার তখন তার কাছে বসে। সবাইকে সৈনিকরা বাসায় বাসায় গিয়ে জবরদস্তি ধরে ধরে এনে টু-ফিল্ডে জড়াে করেছে। মুহূর্তটা সুখের হলেও তাদের যেভাবে ধরে আনা হয়েছে, তা মােটেই সুখকর ছিল না। বসে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার শওকত। মুখে তার শুকনাে হাসি। সেপাইরা যখন তাকে ভি আই পি গেস্ট হাউজে আনতে যায়, তখন তিনি প্রাণের ভয়ে ছুটে পালাচ্ছিলেন। জিয়ার পাশে বসে তখন কর্নেল নুরউদ্দীন, আজহার, বারী, আবদুল্লাহ, কাশেম, হাবিবুর রহমান আরও কজন। কামরার ভেতর অবশ্য সৈনিকদের কেউ ছিল না। তারা সবাই বাইরে ভীড় করেছিল। কেউ কেউ তখনও ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছিল। সবার মুখে হাসি। বন্দী জিয়াকে যেভাবে উদ্ধার করাহলাে। বন্দী জিয়াউর রহমানকে কিভাবে উদ্ধার করা হলাে? তাকে খালেদ-শাফায়েত তার বাসভবনেই ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন গার্ড দিয়ে আটকে রেখেছিল। রাত বারােটায় সেপাই বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। তখন থেকেই বিপ্লবীরা এবং সেপাইরা বিভিন্ন ইউনিট থেকে বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিয়ার বাসভবনের চারপাশে সমবেত হতে থাকে। সবারই লক্ষ্যস্থল ছিল জিয়ার বাসভবন।। |সবাই সেখানে একত্র হয়ে দুর্গ ভেঙে বন্দী জিয়াকে বের করে আনবে, এই ছিল প্রতিন্দ্রা, সারাদিন ধরে চলে গােপন প্রস্তুতি। বাইরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা এসে যােগাযােগ করে যায় বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিক, এন সি ও, জে-সি-ওদের সাথে। জিয়াকে উদ্ধার করতে বিভিন্ন ইউনিট নিজেদের উদ্যোগেই বিশ্বস্ত লােক নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন করে। টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির এ রকম একটি দল মেজর মহিউদ্দিন, মােস্তফা ও সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে প্রস্তুত থাকে। রাত বারােটায় সেপাই বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এই গ্রুপটিই প্রথম জিয়ার বাসভবনের গেইটে গিয়ে হাজির হয়। এই একটি মাত্র গ্রুপেই অফিসার থাকায় তারা অন্যদের টেক্কা দিয়ে তড়িৎ প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পারে, বাকিরা পৌছুবার আগেই। তারা জিয়ার বাসভবনের গার্ডদের বুঝিয়ে বলল, সেপাই সেপাই-ভাই ভাই।
এখন থেকে সেপাই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবাই জিয়াকে মুক্ত করতে এসেছি। তােমরা গেইট খুলে দাও। ততক্ষণে আশে পাশে বেশকিছু সৈনিক শ্লোগান তুলতে শুরু করেছে। বিপ্লবী ভাইদের ডাকে সাধারণ সৈনিকরাও ব্যারাক ছেড়ে ছুটে আসছে রাস্তায়। সেপাই সেপাই-ভাই ভাই। জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ। | মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস এবং টু-ফিল্ডের কিছু সৈনিক যখন জিয়ার বাসার গেইটে পৌছে যায়, তখন চতুর্দিকে ভীষণ ফায়ারিং চলছে। ফাস্ট বেঙ্গলের গার্ডরা যারা তাকে বন্দী করে রেখেছিল, প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে ফায়ার করতে করতে পেছন দিকে পালিয়ে গেল। মহিউদ্দিনের লােকজন জিয়ার বাসার ছাদ লক্ষ্য করে কয়েকবার অটোমেটিক ব্রাস ফায়ার করলাে। ভেতর থেকে গার্ডরা আর কোন জবাব দিল না। তখন তারা রাইফেলের বাট দিয়ে গেইট ভেঙ্গে ফেলে ভেতরে ঢােকে। এই সময় জিয়ার ডাইভার বেরিয়ে আসে। সে শ্লোগানমুখর সৈনিকদের জিয়ার বাসার পশ্চিম পাশে কিচেন রুমের দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তারা দরজা খােলার জন্য চিৎকার দিতে থাকে। জিয়া এবং বেগম জিয়া তখন পেছনে করিডােরে বেরিয়ে আসেন। এই সময় বাসার চারিদিকে ফায়ারিং চলছিল। বহু সৈনিক চিৎকার দিতে দিতে বাসায় ঢুকে পড়লাে। উত্তেজনায় ভরপুর প্রতিটি মুহূর্ত। মহিউদ্দিন বললাে : ‘স্যার আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আপনি আসুন। ‘ জিয়া বললেন দেখ, আমি এখন রিটায়ার করেছি। আমি কিছুর মধ্যে নাই। আমি কোথাও যাব না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ‘স্যার আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। আমরা নিয়েই যাব। আপনাকে আমরা আবার চীফ বানাতে চাই। দোহাই আল্লার আপনি আসুন। মহিউদ্দিনের দঢ় আহ্বান। বেগম জিয়া পাশে দাড়িয়ে ছিলেন। তিনি এ রকম গােলাগুলি ও গণ্ডগােলের মধ্যে স্বামীকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। তিনিও বললেন, দেখুন ভাই আমরা রিটায়ার করেছি। আমাদের নিয়ে টানাটানি করবেন না। দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন।
মহিউদ্দিন বলল, স্যার আপনাকে যেতেই হবে। আপনি আসুন। বলেই মহিউদ্দিন, আনিস ও অন্যান্য সেপাইরা তাকে একেবারে চ্যাংদোলা করে কাধে উঠিয়ে অপেক্ষমান জীপে। নিয়ে তুলে ফেলল। চতুর্দিকে শ্লোগান উঠলাে, আল্লাহু আকবর।
জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ।
সেপাই সেপাই ভাই ভাই বেগম খালেদা জিয়া তখন বারান্দায় দাড়িয়ে অতীব উৎকণ্ঠা ও আনন্দের সাথে অপূর্ব দৃশ্য অবলােকন করে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলেন। ততক্ষণে আরাে বহু সৈনিক, বহু বিপ্লবী এদিক সেদিক থেকে ঘটনাস্থলে জড়াে হয়ে গেছে। জিয়াকে মুক্ত দেখে সবার। আনন্দের সীমা নাই। চতুর্দিকে মুহুর্মুহু শ্লোগান। জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ। তারা সবাই মিলে জীপ ঠেলে নিয়ে চলল টু-ফিল্ড লাইনের দিকে। আর্টিলারির সৈনিকরা তাকে বিপুলভাবে ঘেরাও করে রেখেছে। তারাই প্রথম তাকে বের করে এনেছে। বেঙ্গল রেজিমেন্টকে টপকে যান্ত্রিক ইউনিটরা আবারাে একটি গৌরব ছিনিয়ে নিল। অবশ্য গােলন্দাজদের লাইনে জিয়াকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই পাশের ইউনিট ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক টু-ফিডে হাজির হন। তাকে দেখে জিয়া খুব খুশী হন। ৪র্থ বেঙ্গল খালেদ মােশাররফকে মদদ দিচ্ছিল। এবার কর্ণেল আমিন বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে জিয়ার পাশে এসে দাড়ালাে। তার এ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন মুনীরও এলাে। বেঙ্গল রেজিমেন্টও পাশে রয়েছে দেখে তিনি আশ্বস্ত হলেন। জিয়া মুক্ত হয়েই সিনিয়র অফিসারদেরকে তার কাছে নিয়ে আসতে বলেন। জিয়া মহিউদ্দিনকে বললেন, গতকাল ফরমেশন কমাণ্ডারদের কনফারেন্স হয়েছে। তারা হয়ত এখনাে আছে, তাদের ডাকো। বােধহয় VIP গেস্ট হাউসে আছে। মহিউদ্দিন তৎক্ষণাৎ তার। জীপ নিয়ে ওদিকে ছুটল। গেস্ট হাউসে পৌছে তাদের খােজাখুঁজি করল। কিন্তু কেউ নেই। ডিউটি-সেপাই বলল, তারা সবাই যার যার স্টেশনে চলে গেছেন, শুধু ব্রিগেডিয়ার শওকত আছেন। ‘কোথায় তিনি?” “উনি ঐ পাশে এরশাদ সাহেবের বাসায় গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিন ঐদিকে ছুটল। ডাকাডাকি করল, কেউ দরজা খুলল না। তারা সেপাই ব্যাটম্যানকে উঠালাে, কিন্তু সেও বলল, উনি এখানে নেই। মহিউদ্দিন রেগে গিয়ে বলল, দরজার তালা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখবাে। তারা পেছন দরজার তালা খুলে এক একটি রুম খুঁজতে থাকে। হঠাৎ করে মহিউদ্দিন একটি স্টোর রুমের ভেতর একটি বাক্সের পেছনে কাচুমাচু হয়ে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় শওকতকে পেয়ে যায়।
তিনি বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন না। মহিউদ্দিন বলল, তাহলে আপনাকে আমি গুলি করতে বাধ্য হবে। আপনি এক্ষুণি চলুন। অতঃপর ব্রিগেডিয়ার শওকত কম্পিত দেহে তার সাথে। জীপে গিয়ে উঠলেন। জীপ ছুটে চললাে। একটুখানি এসেই বললেন, আমি ‘পেশাব’ করবাে। একটু থামাে ভাই। | মহিউদ্দিন বিগড়ে গিয়ে বলল, স্যার, পেশাব-টেশাব ওখানে গিয়েই হবে। ওখানে ভাল পেশাবখানা আছে। অতঃপর টু-ফিলেড জেনারেল জিয়ার কাছে পৌছলে ঘাম দিয়ে। শওকতের জ্বর ছাড়লাে। টু-ফিল্ডের আশেপাশে আকাশে বাতাসে তখন কেবল ফারিং চলছে। সৈনিকদের উত্তাল ঢেউ তখন টু-ফিল্ডের দিকে। এরপর অন্যান্য অফিসারদের যাকে যেখানে পাওয়া গেল সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আসা হলাে। সৈনিকরা বিভিন্ন দিকে অফিসারদের বাসায় যাচ্ছে আর তাদের ধরে নিয়ে আসছে। এসময় বহু অফিসার সেপাইদের হাতে লাঞ্ছিত হলেন, অথবা অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হলেন। AHQ এম, পি ইউনিটের একটি রুমে বেশ কজন সিনিয়র অফিসারকে সাধারণ কাপড়েই ধরে এনে জড়াে করা হয়েছিল। ঐ ড্রেসেই তাদেরকে নিয়ে আসা হলাে। মধ্যরাতে জিয়ার মুক্তির আনন্দ এসব কারণে বহুলাংশে ম্লান হয়ে যায়। অফিসাররা বুঝতে পারছিল না, জিয়ার মুক্তির সাথে অফিসারদের হেস্তনেস্ত করার কি সম্পর্ক রয়েছে। মধ্যরাতের পরিস্থিতি তখন কার নিয়ন্ত্রণে, কিছুই বােঝা যাচ্ছিল না। সৈনিকদের বন্দুকের নলের কপার উপরই সুরতে হাল অনেকখানি নির্ভর করছিল। জিয়াকে মধ্যরাতে যেসময় মুক্ত করে আনা হয়, তখন ছিল তার বাসভবনের চর্তুপার্ধে তুমুল গণ্ডগােল, চরম বিশৃঙ্খলা। চতুর্দিকে সেপাইদের তাণ্ডব নৃত্য।
চিৎকার, অবিরাম ফায়ারিং। বেশ আবছা অন্ধকার। তাকে মহিউদ্দিনআনিসরা বের করে আনলেও ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হকের ভাষ্য কিছুটা ভিন্ন। কর্নেল আমিনুল হক (পরে ব্রিগেডিয়ার) যিনি ৭ নভেম্বর রাতে প্রায় সর্বক্ষণ জিয়ার পাশে ছিলেন, বললেন, ‘মধ্যরাতে বিপ্লব শুরু হলে আমি আমার এ্যাডজুট্যান্ট মেজর মুনীর এবং ৫ জন বিশ্বস্ত সেপাই নিয়ে তাড়াতাড়ি জেঃ জিয়ার বাসার দিকে ছুটে যাই তাকে উদ্ধার করার জন্য। মাঝপথে আমার কয়েকজন সেপাই খবর দিলাে যে, জিয়া সাহেব তার বাসার পেছন দিকের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়েছেন এবং টু-ফিল্ডের কিছু সেপাই ও বিপ্লবী তাকে টু-ফিডের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে তাকে রাস্তায় পেয়ে যাই। তিনি মহাখুশীতে আমার সাথে কোলাকুলি করেন। টু-ফিডের অফিস কাছে থাকায় আমরা তাকে সেখানেই নিয়ে যাই। ঐ সময় তার আশে পাশে আমি এবং মুনীর ছাড়া আর কোন অফিসারই ছিলেন না। একটু পর কর্নেল তাহের আসে। সে তাকে বাইরে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চায়। আমি স্পষ্টভাবে তাহেরকে জানিয়ে দেই, জেনারেল জিয়া কোন অবস্থায়ই বাইরে যাবেন না। এতে তাহের আমার উপর দারুণ ক্ষেপে যায়। পরে তার ভাইকে নিয়ে চলে যায়। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য অফিসাররা আসতে থাকেন। জিয়ার নির্দেশে আমি আমার ফোর বেঙ্গল টুপকে সর্বক্ষণ রেডী অবস্থায় রাখি। বলাবাহুল্য ঐ মুহূর্তে জিয়ার কন্ট্রোল নিয়ে টু-ফিলড ও ৪ বেঙ্গলের মধ্যে কিছু রেষারেষি হয়। এম পি ইউনিটের হাবিলদার বারী বলল সে এবং আর্টিলারির কিছু সৈনিক গিয়ে জিয়াকে কাধে তুলে বের করে নিয়ে আসে। | ঐ সময় জিয়ার বাসভবনের চতুর্পার্থে এতই হট্টগােল, গােলাগুলি ও বিশখল অবস্থা ছিল যে, সঠিক কে বা কারা তাকে প্রথম বের করে আনলাে তা চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
তবে টু-ফিল্ডের মহিউদ্দিন-আনিসের ভাষ্য অধিক গ্রহণযােগ্য বলে মনে হয়। জিয়ার বাসা থেকে আমার বাসার দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ। দোতলার ছাদে উঠে আমি সমস্ত দৃশ্যই বহুক্ষণ ধরে অবলােকন করছিলাম। কিন্তু আবছা অন্ধকার থাকায় ভাল দেখা যাচ্ছিল । তবে একটি জীপ ঠেলে জিয়ার বাসভবনের গেইট থেকে সামনে রাস্তায় নিয়ে আসা হচ্ছে, তা আমি নিজেই প্রত্যক্ষ করছিলাম। সৈনিকদের ভীড়, তাণ্ডব নৃত্যের কারণে কাউকে অবশ্য চেনা যাচ্ছিলাে না। প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে সুস্থভাবে কিছু বুঝতেও পারছিলাম না। কয়েকটি গুলি আমার মাথার উপর দিয়েই শাে শাে করে চলে গেল। | ৬/৭ নভেম্বরের রাত্রে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লব শুরু হয়ে যায় রাত সাড়ে ১১ টা থেকে। শত শত সৈনিক জড়াে হয় সিগন্যাল রেজিমেন্ট এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারের কাছে স্টাফ রােডের আশেপাশে। তারা শ্লোগান দিচ্ছিলাে, থেমে থেমে ফাঁকা গুলিও ছুঁড়ছিল। এয়ারপাের্ট, ইব্রাহিমপুর প্রভৃতি এরিয়াতেও আগাম ফায়ারিং শুরু হয়ে যায়। প্রায় ১০/১২ জন অফিসারদের তখনই আশেপাশের বাংলাে থেকে ধরে এনে কর্নেল রহমানের বাসায় ড্রেসিং রুমে এনে আটক করে রাখে। তাদেরকে পরে জিয়ার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। | জিয়া মুক্ত হয়ে টু-ফিডে আসার কিছুক্ষণ পরই কর্নেল তাহের এসে সেখানে উপস্থিত হন। একটু পরে জিয়া জেনারেল খলিল এবং এয়ার মার্শাল তােয়াবকে শীঘ্র নিয়ে আসতে বলেন। তিনি হয়ত এ দুটো বাহিনীর দিক থেকে অশুভ পায়তারা আশা করছিলেন। ডিউটি অফিসার ক্যাপ্টেন জব্বারকে জীপ দিয়ে তখনই তােয়াব এবং জেনারেল খলিলকে। ডেকে আনতে পাঠান। কিন্তু বি, ডি, আর, হেডকোয়ার্টারে তারা সব গেইট বন্ধ করে দিয়ে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। একদল সৈন্যও সেখানে গিয়ে হাজির হয়। উভয় পক্ষে প্রায়। গােলাগুলি শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। অবশেষে বিডিআর এর কর্নেল মহাবত জান (পরে। জেনারেল ও মন্ত্রী) স্বেচ্ছায় তাদের সাথে যেতে রাজী হলে অবস্থা শান্ত হয়।
কর্নেল হাবিব ও জব্বার বহু দেন-দরবার করে ভেতরে ঢুকলেও জেনারেল খলিল তৎক্ষণাৎ আসতে রাজী। হননি। বহু পরে বেলা প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে জব্বার তাকে টু-ফিল্ডে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। প্রায় একই সাথে তােয়াবও এসে হাজির হন। গাড়ী থেকে নামতেই সুবেদার সারওয়ার জেনারেল খলিলের সাথে তখন বেশ অশােভন ব্যবহার করে। মধ্যরাতে ক্ষমতার লড়াই। ৬/৭ নভেম্বরের মধ্যরাতে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী বাহিনী ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দের যৌথ অভ্যুত্থানে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জিয়াউর রহমান গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় চীফ অব স্টাফের গদীতে সমাসীন হন। | এবার শুরু হলাে প্রকৃত ক্ষমতার লড়াই। মূল অভ্যুথান পরিকল্পনা করেছিলেন কর্নেল তাহের। তার সাথে জিয়াউর রহমানের কি সমঝােতা হয়েছিল, তা শুধু তারা দু’জনই জানেন। জিয়াকে মুক্ত করার কিছুক্ষণ পর পরই তাহের টু-ফিল্ড রেজিমেন্টে জিয়ার কাছে ছুটে আসেন। তখন রাত প্রায় ২-৩০ মিনিট। ঐসময় জিয়ার কক্ষে মাত্র গুটিকয় অফিসার: কর্নেল আমিনুল হক, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর জুবায়ের সিদ্দিক, মেজর মােস্তফা, মেজর মুনির, সুবেদার মেজর আনিস।
জিয়া ও তাহের উভয়ে একে অন্যকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। জিয়া বললেন, তাহের তােমাকে ধন্যবাদ। আমাকে বাচিয়েছে। তাহের বলল, আপনার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। এদিকে আসুন প্লিজ। তাহের তাকে নিয়ে কক্ষের একটু নিভৃত কোণে গেল। বহুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে গােপন কথাবার্তা চলতে থাকল। অনেক সময় লাগছে দেখে বাথরুমের প্যাসেজে আলাদাভাবে দুটি চেয়ার দেওয়া হলাে। একসময় তাদের মধ্যে বেশ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হলাে। এক ফাকে জিয়া বারান্দায় এসে সুবেদার মেজর আনিসকে কানে কানে বললেন, আনিস সাহেব, ওকে কোনভাবে সরিয়ে দিন এখান থেকে। সাবধান, বহু পলিটিকস্ আছে। তাহের জিয়াকে টু ফিল্ড থেকে বের করে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইছিল। রেডিও স্টেশনে তার লােকজন উপস্থিত ছিল। তাহের বলল, আসুন, জাতি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। জিয়া যেতে চাইছিলেন না সঙ্গত কারণেই। এতে তাহের খুবই রেগে যায়। উপস্থিত কর্নেল আমিন, মুনীর ও সুবেদার মেজর আনিস তারা জিয়ার পাশে থেকে বলেন, রেডিওতে ভাষণ দিতে হলে রেকডিং যন্ত্র এখানে আনা হবে। তাকে এখন বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না ।
ভেস্তে যায় তাহেরের প্ল্যান। সুবেদার মেজর আনিস কর্নেল তাহেরকে বললেন, আপনি এখন দয়া করে আসুন। তাহের কটমট করে তার দিকে তাকালাে। বলল, আমাকে চেনেন। আনিস বলল, জ্বি স্যার আপনাকে চিনি। তবে এখন আমার সাথে আসুন। তাহের বুঝে ফেলল, জিয়াউর রহমান কিছুতেই এই মুহুর্তে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে তার সাথে বাইরে যাবেন না। অগত্যা তাহের তার ভাই হউসুফ এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে রাগে বিড়বিড় করতে করতে অত্যন্ত বিমর্ষ মুখে টু-ফিড লাইন ত্যাগ করল। সারা ক্যান্টনমেন্টে জুড়ে তখন চলছে সৈনিকদের আনন্দ উল্লাস। ক্ষমতার সিংহাসনে বসার সন্ধিক্ষণে দুই বাদশাহ। এক সিংহাসন। মধ্যরাতের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের নাটক জমে উঠল। কে কাকে উৎখাত করে। এক জঙ্গলে দুই বাঘ। জিয়া তখন টু-ফিল্ড কমান্ডিং অফিসারের বড় কমরায় অফিসার পরিবেষ্টিত হয়ে। আসলে তখনও উপস্থিত অফিসাররা কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না, বাইরের অবসরপ্রাপ্ত একজন অফিসার কর্নেল তাহেরকে জিয়া কেন মুক্তির এই আনন্দঘন মুহূর্তে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন। তার সাথে বিপ্লবের কিইবা সম্পর্ক? কেন তাহের এত রাগান্বিত, উত্তেজিত। তার সাথে এতক্ষণ একান্তে কিইবা আলাপ হল? তার সাথে কি জিয়ার কোন গােপন সমঝােতা রয়েছে? সবার কাছেই ব্যাপারটা বড়ই রহস্যজনক ঠেকলাে। কিন্তু মুক্তির আনন্দঘন মুহূর্তে কেউ এসব তলিয়ে দেখার চিন্তা করেনি। সুবেদার মেজর আনিস বললাে, আমাদের উপস্থিত সবাইকে ছেড়ে তাহেরের সাথে জিয়া সাহেবের এত লম্বা গরম গরম আলােচনা দেখে আমার নিজেরই মাথা গুলিয়ে যায়। প্রথমে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাধারণ সৈনিকদের ধারণা ছিল, জিয়াকে মুক্ত করার পরই সেপাই বিদ্রোহ শেষ হয়ে যাবে। তারা ব্যারাকে ফিরে যাবে, কিন্তু বাইরের বিপ্লবী সৈনিক ও বিপ্লবী নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, অনেক গভীর। টু-ফিল্ডে কর্নেল তাহেরের আগমন এবং জিয়ার সাথে রাত আড়াইটায় উত্তপ্ত কথােপকথনের পরই রহস্য ঘনীভূত হতে শুরু করল। এবার উন্মােচিত হতে শুরু করলাে, বিপ্লবী নেতা কর্নেল তাহেরের দ্বিতীয় পর্বের খেলা। টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের অফিসে বসে আছেন সদ্যমুক্ত জিয়া। তাকে ঘিরে বসে আছেন ঘর থেকে ধরে আনা অফিসারবৃন্দ। অফিসের বাইরে ভেতরে গিজ গিজ করছে ঢাকা সেনানিবাসের হাজার হাজার সৈনিক। ক্যান্টনমেন্টের চতুর্দিক থেকে যে বলয়। সৃষ্টি করে সৈনিকরা জিয়ার বাসভবনের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুড়তে ছুটে আসছিল, তা এখন টার্গেট-পয়েন্টে এসে স্তিমিত হয়ে গেছে। সর্বত্র আনন্দ উল্লাস।
তারা মাঝে মাঝে ছুঁড়ছে ফাকা গুলি। সমস্ত প্ল্যান প্রােগ্রামই ছিল সাধারণ সৈনিকদের এবং বিপ্লবী তাহের গ্রুপের। শত শত সৈনিকের পদভারে টু-ফিড রেজিমেন্ট তখন প্রকম্পিত। এদের মধ্যে বহু সৈনিক দেখা গেল এলােমেলাে খাকি ড্রেসে। পায়ে ছিল বুটের বদলে সাধারণ জুতা। অনেকের মাথার টুপীও নাই। এরাই ছিল জাসদের বিপ্লবী সংস্থার সশস্ত্র সদস্যবৃন্দ। সেপাই বিদ্রোহের রাতে কি উদি পরে তারা মিশে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের সাধারণ জওয়ানদের সাথে। উপস্থিত শত শত সৈনিকের মধ্যে কে বিপ্লবী সৈনিককে আসল সৈনিক বােঝা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তারাই অফিসারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিচ্ছিল। রাতের বেলা আমিও তাদের পারিনি। সকালবেলায়ও বিপ্লবীদের উপস্থিতি বুঝতে পারিনি। দুপুরবেলা টের পেলাম। সবার অলক্ষ্যে ক্যন্টনমেন্টে বসে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বন্ধু ক্ষমতার আঙ্গুর ফল নিয়ে করছে কাড়াকাড়ি। জিয়া দ্রুত তার সেনা ইউনিট ও অফিসারদের নিয়ে তাহেরের প্রাথমিক হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হলেন। টু-ফিডে বসেই বেতার ভাষণ দিলেন। টু-ফিল্ডের অফিসেই রেডিও রেকর্ডিং ইউনিট এনে জিয়ার একটি ভাষণ রেকর্ড করা হলাে ভাের বেলা প্রচার করার জন্য। সংক্ষিপ্ত ভাষণে জিয়া ঘােষণা করেন, তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরােধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি সবাইকে এই মুহূর্তে শান্ত থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস, আদালত, বিমান বন্দর, মিল কারখানা পুনরায় চালু করার অনুরােধ জানান। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ আমাদের সহায়। জিয়ার সংক্ষিপ্ত ভাষণ সবাইকে আশ্বস্ত ও উদ্দীপিত করে তুলল। মধ্যরাতের লড়াইয়ে হেরে গেলেন তাহের। জয়ী হলেন জিয়া।
ক্ষণিকের জন্য তাহেরের পশ্চাৎপসরণ। সকালবেলা নতুন শক্তি সঞ্চয়ের আশায়। জাসদের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, যদিও কর্নেল তাহেরের লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল। তাহের সৈনিকদের ১২ দফা দাবি প্রণয়ন করে। এগুলাের মধ্যে ছিল: ব্যাটম্যান প্রথার বিলপ্তি, অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে ব্যবধান দূর, সৈনিকদের মধ্যে থেকে অফিসার নিয়ােগ, বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ব্যবস্থাকরণ, দূনীতিবাজ অফিসারদের অপসারণ, রাজবন্দীদের মুক্তি। বিপ্লবী সৈনিকদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে ১২-দফার বাস্তবায়ন। তাহরের মতে, জিয়ার সাথে তার আগেই এসব নিয়ে সমঝােতা হয়েছিল। তাহের ভেবেছিল সেই অধিক বুদ্ধিমান। জিয়াকে ব্যবহার করে সে ক্ষমতায় আরােহন করবে। কিন্তু তার সেই ক্যালকুলেশন ভুল হয়েছিল। সেপাই-জনতার বিপ্লব মধ্যরাতে জিয়াউর রহমানকে কিছুটা কমান্ডো স্টাইলে বিনা বাধায় মুক্ত করার পর সকালবেলা বিপ্লবীদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শত শত সৈনিক তাদের ইউনিটের ট্রাকে চেপে শ্লোগান দিতে দিতে শহরের দিকে ছুটতে থাকে। শহরে পেীছে তারা অবাধে আনন্দমুখর জনতার সাথে মিশে গিয়ে উল্লাস করতে থাকে। নূতন শ্লোগান উঠে ‘সেপাই জনতা-ভাই ভাই’। অদ্ভুত এ্যাডভেঞ্চার। রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানমুখর জনতা বেরিয়ে আসে সৈনিকদের সাথে একাত্ততা ঘােষণা করতে। দেখতে দেখতে সেপাই বিপ্লব মােড় নেয়ে ঐতিহাসিক ‘সেপাই জনতার বিপ্লবে। শহরের রাস্তায় মানুষের ঢল। সেপাই জনতা-ভাই ভাই। ভাের বেলা বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলাে প্রবলবেগে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাে। সারা রাত তারা শান্তভাবে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর কোণে বসে বসে ঘটনা পরখ করছিল। বিপ্লবী। সুবেদার সারওয়ারের ডাকে ভাের পাঁচটার দিকে তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক। জনতা প্রবল উল্লাসে ট্যাংকগুলাে ঘিরে ধরে সেপাইদের সাথে মিশে গিয়ে নৃত্য করতে থাকে।
সেপাই জনতা-ভাই ভাই। সেপাই বিপ্লব জিন্দাবাদ।
খালেদ আসলেন। সকাল ৭ ঘটিকা। টু-ফিলড রেজিমেন্টের বারান্দায় দাড়িয়ে সৈনিকদের ব্যস্ততা, দ্রুত আনাগােনা প্রত্যক্ষ করছিলাম। তারা হেলেদুলে ঘুরছে ফিরছে আপন খেয়ালে। অন্যসময়। হলে অফিসারদের পাশ দিয়ে যেতে তাদের স্মার্ট স্যালুট দিয়ে চলতে হতাে। আজ এসব বালাই নেই। আজ তাদের রাজ্যে তারাই রাজা। এমন সময় সৈনিকদের ভীড় ঠেলে একটি আর্মি ট্রাক শাে শশা বেগে এগিয়ে এলাে। ভেতর থেকে নেমে এলাে একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। স্যালুট দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার জেনারেল জিয়া কোথায়? জরুরী ব্যাপার আছে। বললাম, কি ব্যাপার আমাকেই বল। সে বলল ; স্যার, খুবই জরুরী, উনাকেই বলতে হবে। আমাকে উনার কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ। ঐদিন প্রটোকলের কোন বালাই ছিল না। বললাম, আসাে আমার সাথে। আমি তাকে নিয়ে জিয়ার কামরায় ঢুকলাম, তাকে বললাম, এই ছেলেটি তােমাকে কিছু বলতে চায়। লেফটেন্যান্ট তৎক্ষণাৎ জিয়াকে একটি স্মাট স্যালুট দিয়ে বললাে, ‘Sir, I have come to present you dead body of Khaled Musharraf, Col. Huda and Hyder, sir. জিয়া অবাক। বিগ্রেডিয়ার খালেদের ডেডবডি। আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন; দেখতাে হামিদ, কি ব্যাপার। আমি অফিসারকে সাথে নিয়ে বাইরে দাড়ানাে। খােলা ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখি ট্রাকের পাটাতনে খড় চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি মৃতদেহ। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার। খালেদের পেটের ভুঁড়ি কিছুটা বেরিয়ে আসছিল। তাকে পেটের মধ্যে গুলি করা হয়েছিল, হয়তােবা বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল। কি করুণ মৃত্যু। আমি জিয়াকে কামরায়। গিয়ে বললাম ; হ্যা, খালেদ, হুদা আর হায়দারের ডেডবডি। সে জিজ্ঞাসা করল, এগুলাে এখন কি করা যায়? আমি বললাম, আপাততঃ এগুলাে CMH এর মর্গে পাঠিয়ে দেই। জিয়া বললাে, প্লিজ হামিদ, এক্ষুণি ব্যবস্থা করাে।
হায় খালেদ মােশাররফ। তিনি ৭ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলেন বটে। তবে জীবিত নয়, ফিরে এলাে তার প্রাণহীন দেহ। | আমি লেফটেন্যান্টকে ডেডবডিগুলাে সি, এম, এইচ-এ নিয়ে যেতে বললাম। আমার জীপ ছিল না। রাত্রে বিপ্লবীরা আমার জীপটি গ্যারেজ থেকে নিয়ে গেছে। তাকেই রেখে আসতে বললাম। খালেদ যেভাবে মারা গেলেন। রাত ১২ টায় সেপাই বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল খালেদ মােশাররফ সঙ্গে সঙ্গে তার। প্রাইভেট কার নিয়ে বঙ্গভবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যান। তিনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। তার সাথে ছিল কর্নেল হুদা ও হায়দার। দুজনই ঐদিনই ঢাকার বাইরে থেকে এসে খালেদের সাথে যােগ দেন। | খালেদ প্রথমে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের বাসায় যান। সেখানে তার সাথে পরামর্শ করেন। নুরুজ্জামান তাকে ড্রেস পাল্টিয়ে নিতে অনুরােধ করে। সে তার নিজের একটি প্যাট ও বুশ সার্ট খালেদকে পরতে দেয়। কপালের ফের। শেষ পর্যন্ত নুরুজ্জামানের ছােট সাইজের সাট প্যান্ট পরেই খালেদকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। যাক, সেখান থেকে খালেদ কলাবাগানে তার এক আত্মীয়ের বাসায় যান। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন এবং কয়েক জায়গায় ফোন করেন। ৪থ বেঙ্গলে সর্বশেষ ফোন করলে ডিউটি অফিসার লেঃ কামরুল ফোন ধরে।
সে তাকে প্রকৃত অবস্থা অবহিত করে। এবার খালেদ বুঝতে পারেন অবস্থা খুবই নাজুক। তিনি অবস্থান পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ করতে যান। ১০ম বেঙ্গলকে বগুড়া থেকে তিনিই আনিয়েছিলেন তার নিরাপত্তার জন্য। পথে ফাতেমা নার্সিং হােমের কাছে তার গাড়ী খারাপ হয়ে গেলে তিনি কর্নেল হুদা ও হায়দার সহ পায়ে হেঁটেই ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে পৌঁছেন। | প্রথমে নিরাপদেই তারা বিশ্বস্ত ইউনিটে আশ্রয় নেন। তখনাে ওখানে বিপ্লবের কোন খবর হয়নি। কমান্ডিং অফিসার ছিলেন কর্নেল নওয়াজিশ। তাকে দেওয়া হয় খালেদের আগমনের খবর। তিনি তৎক্ষণাৎ টেলিফোনে টু-ফিল্ডে সদ্যমুক্ত জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার ইউনিটে খালেদ মােশাররফের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেন। তখন ভাের প্রায় চারটা। জিয়ার সাথে ফোনে তার কিছু কথা হয়। এর পর তিনি মেজর জলিলকে ফোন দিতে বলেন। জিয়ার সাথে মেজর জলিলের কথা হয়। এদের সাথে কি কথা হয়, সঠিক কিছু বলা মুশকিল। তবে কর্নেল আমিনুল হক বলেছেন, তিনি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জিয়াকে বলতে শুনেছেন যেন খালেদকে কিছুতেই প্রাণে মারা না হয়। যাহােক ভােরবেলা দেখতে দেখতে সেপাই বিদ্রোহের প্রবল ঢেউ ১০ম বেঙ্গলে গিয়ে লাগতে শুরু করে। সেপাইরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি কর্নেল নওয়াজিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারা খালেদ ও তার সহযােগীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সেপাইরা তাদের টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে। ইউনিটের অফিসার মেজর আসাদের বিবৃতি অনুসারে কর্নেল হায়দারকে তার চোখের সামনেই মেস থেকে টেনেহিচড়ে বের করে এনে প্রকাশ্যে সৈনিকরা গুলি করে হত্যা করে। বাকি দুজন উপরে ছিলেন, তাদের কিভাবে মারা হয় সে দেখতে পায়নি।
তবে জানা যায় হায়দার, খালেদ ও হুদা অফিসার মেসে বসে সকালের নাস্তা করছিলেন। হুদা ভীত হয়ে পড়লেও খালেদ ছিলেন ধীর, স্থির, শান্ত। জানা গেছে, মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিক নিয়ে মেসের ভেতর প্রবেশ করে। তার সাথে একজন বিপ্লবী হাবিলদারও ছিল। সে চিৎকার দিয়ে জেনারেল খালেদকে বলল, ‘আমরা তােমার বিচার চাই। খালেদ শান্ত কষ্ঠে জবাব দিলেন, ঠিক আছে তােমরা আমার বিচার করাে। আমাকে জিয়ার কাছে নিয়ে চলাে। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাগিয়ে হাবিলদার চিৎকার করে বললাে, আমরা এখানেই তােমার বিচার করবাে। | খালেদ ধীর স্থির। বললেন, ঠিক আছে, তােমরা আমার বিচার করাে।’ খালেদ দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলেন। ট্যা-র-র-র-র। একটি ব্রাস ফায়ার। আগুনের ঝলক বেরিয়ে এলাে বন্দুকের নল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানি খালেদ মােশাররফ। সাঙ্গ হলাে চায়। শেষ হলাে তায় বর্ণাঢ্য ঘন হাউস। |কর্নেল হুদা প্রথম থেকেই ভয়ে কাপছিলেন। খালেদ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কামরার ভেতরেই ধরা পড়লেন কর্নেল হুদা। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই প্রাণ ত্যাগ করেন। কর্নেল হায়দার ছুটে বেরিয়ে যান কিন্তু সৈনিকদের হাতে বারান্দায় ধরা পড়েন। উত্তেজিত সৈনিকদের হাতে তিনি নির্দয়ভাবে লাঞ্ছিত হলেন। তাকে সেপাইরা কিল ঘুষি-লাথি মারতে মারতে দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। সেখানে ঐ অবস্থায়ই একজন সৈনিকের গুলিতে তার জীবন-প্রদীপ নিভে গেল। মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক কর্নেল হায়দার। ঢাকায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বহু কমান্ডাে আক্রমনের নেতৃত্ব দেন হায়দার। ১৬ই ডিসেম্বর একাত্তরে পল্টন ময়দানে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পন মুহূর্তে অপূর্ব ভঙ্গীতে স্টেনগান কাছে হায়দারকে দেখা যায় জেঃ আরােরা ও নিয়াজীর সাথে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে। ঘটনার নায়ক মেজর জলিল এখনাে জীবিত। কিন্তু তার সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ঐ মুহুর্তে ঠিক কি ঘটেছিল আজকের কাগজ’ পত্রিকায় প্রত্যক্ষদশী মেজর আসাদুজ্জামান এভাবে বর্ণনা করেছেন, “মেজর জলিল সাহেব উপরে (দোতলায়) ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দারের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই জোয়ানরা লেঃ কর্নেল হায়দারকে কিল, ঘুসি ও চড় মারতে মারতে নিচে নামিয়ে আনতে লাগল। আমি তখন বেশ দূরে একটা জীপের ভেতর ছিলাম। আমি জীপের দরজা খুলে বের হতেই তিনি আমাকে চিৎকার করে ডেকে বললেন ‘আসাদ সেভ মি। আমি দৌড়ে তার কাছে যেতে চেষ্টা করি। তার কাছে পেীছানাের পূর্বেই পাশে দাড়ানাে এক জোয়ানের গুলিতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কতগুলাে জোয়ান তাকে ঘিরে রাখলাে। চারিদিকে তখন গােলাগুলি চলছে। এই পরিস্থিতিতে কে কি করল, তা ছিল খুবই অস্পষ্ট এবং ঘােলাটে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কোন অফিসারকেই সেদিন দেখতে পাইনি বা কাউকে এগিয়ে আসতেও দেখিনি। অন্য দুজন (খালেদ ও হুদা) কিভাবে মারা গেলেন তা স্পষ্ট বুঝতে পারিনি।” | মােটামুটি এই ছিল ৭ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি ইউনিটের খণ্ড চিত্র। কর্নেল শাফায়েত জামিল রাত্র ১টা পর্যন্ত বঙ্গভবনেই ছিল। মুক্তি পাওয়ার পর জেনারেল জিয়া বঙ্গভবনে ফোন করলে শাফায়েতের সাথেই তার কথা হয়। জিয়া তাকে সব কিছু ভুলে অস্ত্র ফেলে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে অনুরােধ করেন। শাফায়েত বলে, সে সারেণ্ডার করবে না। সকালে দেখা হবে কি আশ্চর্য। আসলে শাফায়েত ভয়াবহ সেপাই বিদ্রোহ সম্বন্ধে তখনও ছিল সম্পূর্ণ। অন্ধকারে। তার ধারণা ছিল, সে ব্রিগেড কমান্ডার। তার অর্ডারে সৈনিকরা এখনাে এ্যাটেনশন’ হবে।
অভিজাত প্রফেশন্যাল আর্মিতে সৈনিকদের দ্বারা অস্ত্রহাতে ‘সেপাই বিদ্রোহ’ ঘটতে পারে, তা তাদের কারাে মাথায়ই আসেনি। কিছুক্ষণ পরই তার ভুল ভাঙল। একদল বিপ্লবী সৈনিক বঙ্গভবন আক্রমন করলাে। তাদের দ্বারা তাড়িত হয়ে শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনের উচু দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলে। অবশেষে খােড়াতে খােড়াতে সে মুন্সিগঞ্জে গিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে সেখান থেকে সে জিয়ার সাথে টেলিফোনে আলাপ করে। জিয়া তার কুশল জিজ্ঞাসা করেন। তারপর একজন অফিসার মেজর মুনীর) পাঠিয়ে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করান। তাকে পরে সি এম এইচ-এ ভর্তি করা হয়। বিপ্লবীদের হাতে ধরা পড়লে তারও খালেদ মােশাররফের দশা, হতাে। নেহাৎ ভাগ্যগুণেই শাফায়েত প্রাণে বেঁচে গেল।
৭ নভেম্বরের মধ্যরাতের দুই বিপরীত চিত্র ; ক্যান্টনমেন্টের বন্দীশালা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে বাইরে আনা হচ্ছে, অন্যদিকে বঙ্গভবন থেকে ক্ষমতাসীন খালেদ-শাফায়েতরা পালিয়ে যাচ্ছে। নিয়তির কি খেলা। টু-ফিল্ড ব্যারাক সকাল থেকে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিস ব্যারাকে সারা দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ। এখন থেকে বঙ্গভবন নয়, ফিড ব্যারাকই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে
পরাে দেশের ভাগ্য। জিয়াউর রহমানের অপারেশনেল হেড কোয়ার্টার তখন টু-ফিল্ড ব্যারাক সবাই ছুটছে টু-ফিল্ড অভিমুখে। এক রাতেই জিয়াউর রহমানের আকাশচুম্বী। জনপ্রিয়তা। যেন যুগ যুগ ধরে এ বিপ্লবটিই অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
এলেন জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, এয়ার মার্শাল তােয়াব, অ্যাডমিরাল এম এইচ খান সহ অন্যান্য সকল সিনিয়র অফিসারগণ। সবাই অভিনন্দন জানালেন জিয়াকে। সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টা। দেখলাম একপাল সৈনিক পরিবেষ্টিত হয়ে সিভিল ড্রেসে কে যেন এগিয়ে আসছে। ক্রাচে ভর দিয়ে লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের। এত লােকজন নিয়ে সরাসরি সে একেবারে জিয়ার কামরায়ই ঢুকে গেল। আমি ভেবেছিলাম, বীর মুক্তিযােদ্ধা। তাহের অন্যান্যদের মত এমনিই হয়তাে জিয়াকে অভিনন্দন জানাতে এসেছে। আমার ভুল। ভাঙল অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ পরে। সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে ওখানেই কনফারেন্স হলাে। উপস্থিত ছিলেন জিয়া, ওসমানী, খলিলুর রহমান, তােয়াব, এম এইচ খান, মাহবুব আলম চাষী ও কর্নেল তাহের। বিপ্লবী বাহিনীর তাহের শুধু উপস্থিতই ছিল না, সে তার জোরালাে বক্তব্য রাখে। বাহিনী প্রধানদের কেউ এ প্রণও রাখলেন না যে, কিভাবে পলিসি নির্ধারণ মিটিং-এ একজন রাজনৈতিক বিপ্লবী বাহিনী নেতা উপস্থিত থাকলাে। | প্রথমেই রাষ্ট্রপতি কে হবেন, এ প্রস্তাবে জেনারেল ওসমানী খন্দকার মােশতাকের নাম উথাপন করলে জেনারেল খলিল এবং আবু তাহের বিরােধিতা করেন। সামান্য আলােচনার পর বিচারপতি সায়েমকেই রাষ্ট্রপ্রধান রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। | এম এল এ হিসাবে জিয়া থাকতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু তা হয়নি। জেনারেল খলিল রাষ্ট্রপতির হাতেই ক্ষমতাটি থাকার সপক্ষে যুক্তি দেখান। তাহের তা সমর্থন করে। সুতরাং সায়েমই সি-এম-এল-এ থাকলেন। জিয়া অন্য দুই বাহিনী প্রধানের সাথে ডি, সি, এম, এল, এ-র পােস্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। এ সিদ্ধান্ত জিয়ার মনঃপূত ছিল না, কারণ ভােরেই তিনি CMLA হিসাবে রেডিওতে নিজেকে ঘােষণা দিয়েছিলেন। | সিদ্ধান্ত হয়, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া হবে। সভায় এক পর্যায়ে কর্নেল তাহের সৈনিকদের ১২ দফা দাবির কথা উত্থাপন করে, কিন্তু উপস্থিত কেউ ১২ দফা দাবির প্রতি কোন সমর্থন দেননি। জিয়াও কিছু বলেননি। তাহের জিয়ার নীরবতায় তখনই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। সকাল ৭টার দিকে ল্যান্সারের কিছু সৈনিক মােশতাক আহমদ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে খন্দকার মােশতাককে নিয়ে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত হয়। তাকে দিয়ে কিছু বলাবার চেষ্টা করে।
কিন্তু তাহেরের বিপ্লবী বাহিনী তখন রেডিও স্টেশন দখল করে আছে। তার নির্দেশে তারা মােশতাককে কিছু বলতে দেয়নি। মােশতাক এমনিতেই কদিন ধরে মিলিটারিদের ঠেলায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আর ঝামেলার মধ্যে পড়তে চাইলেন । মানে মানে সটকে পড়লেন। অতঃপর রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে আমি ও বিপ্লবীদের মধ্যে সকাল থেকে যথেষ্ট ঠেলাঠেলি ও উত্তেজনা চলতে থাকে। পরে টু-ফিল্ডের সৈন্যরা তা কন্ট্রোলে নেয়। | ৭ নভেম্বর জিয়ার জন্য ছিল খুবই ব্যস্ত দিন। ১২ টার দিকে জিয়া ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা দেখার জন্য জীপ নিয়ে বের হলেন। সর্বত্র ঘুরলেন। সিগন্যালস্ অর্ডিন্যান্স, ইঞ্জিনিয়ার্স, লাইট এ্যাক্ এ্যাক সব দিকে চর লাগালেন। কোথাও থামলেন, কোথাও হাত নাড়লেন। সর্বত্র ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। দু-এক জায়গায় সৈনিকরা বিভিন্ন দাবিও পেশ করল। তারা কিছু অফিসারের ফাসি দাবি করল। জিয়া বললেন, তােমরা অস্ত্র জমা দাও। শান্ত -হও। আমি দাবি গুলাে দেখছি। ৭ নভেম্বর ভাের থেকেই সেপাইরা ছিল লাগামহীন। ছােট বড়াে বহু অপ্রীতিকর ঘটনা যায়। বহু অফিসার বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হন। ২ ফিল্ড হেড কোয়ার্টারে জিয়ার উপস্থিতি সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যায়। কর্নেল মান্নাফ (পরে জেনারেল) আক্রান্ত হলে মান্নাফ কি-একটা বেফাস উক্তি করে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেপাইরা তাকে ধরে ফেলল তাকে প্রায় গুলি করে মেরে ফেলার অবস্থায় মেজর মহিউদ্দিন ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে। | মেজর মতিনকে (পরে ব্রিগেডিয়ার) সেপাইরা পাকড়াও করে চরমভাবে হেস্তনেস্ত করে। তাকেও প্রায় গুলি করার মতাে অবস্থা থেকে সুবেদার মেজর আনিস উদ্ধার করে। লেং কর্নেল বাহারকে কোয়ার্টারগার্ডে আটকে রাখা হয়। সিনিয়ার জেসিওরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কর্নেল রব (পরে জেনারেল) কঃ মান্নান ও কঃ রশীদকে রাস্তা থেকে সেপাইরা ধরে নিয়ে। রেডিও স্টেশনে আটকে রাখে। তারা এক ফাকে কোনক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। ২ ফিলেড বিদ্রোহী সৈনিকরা তাদের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আনােয়ারকে (পরে জেনারেল) একটি রুমে আটকে রাখে। এ ক’দিন বিদ্রোহী সৈনিকরা মেজর মহিউদ্দিন ও সুবেদার মেজর আনিসের কথায়ই চলছিল। কর্নেল আনােয়ারকে তারা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে। সন্ধ্যায় জিয়া রেডিও স্টেশনে যান। সেখানে নূতন রাষ্ট্রপতি ও বিদায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণ ছিল। সেখানে তাহেরও উপস্থিত ছিল। তারা উভয়ে একত্র বসে ভাষণ শােনেন। উত্তেজিত সৈনিকরা লিখিতভাবে তাদের ১২ দফা দাবির একখানি কাগজ পেশ করে। প্রায় জোর করে কাগজের উপর তারা জিয়ার সই নেয়। বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় জিয়াকে। অবশ্য জিয়া আগেই অবস্থা অনুধাবন করে সারক্ষণই তার অনুগত সৈনিকদের দ্বারা নিজেকে পরিবেষ্টিত করে রাখেন। | বেলা ১১ টায় আমার ড্রাইভার ল্যান্সনায়েক মনােয়ার আমার জীপ নিয়ে ফিরে এলাে। সে কোনমতে বিপ্লবীদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জীপটি ফিরিয়ে এনেছে। ইতিমধ্যে আমার গাড়ী দিয়ে বিপ্লবীরা পুরাে শহর ঘুরেছে। মনােয়ারকে পিঠ চাপড়ে সাবাস দিলাম। জীপটি নিয়ে আমি তখনই অফিসে গেলাম। সেখানে দেখি অফিসের সামনে একজন সিভিলিয়ানকে পাকড়াও করে সৈনিকরা ভীড় করে হেস্তনেস্ত করছে। আমাকে দেখে তাকে আমার কাছে নিয়ে এলাে, বলল ; স্যার এ ব্যাটা স্পাই। ক্যামেরা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলছে। দ্রলােক ভয়ে কাঁপছিলেন, কারণ উঅঃ সেপাইরা রাইফেল বাগিয়ে তাকে শেষ করে দিতে চাইছে। তিনি জোড়-হাতে কাতর কণ্ঠে বললেন ; স্যার, আমি দৈনিক ইত্তেফাকের ফটোগ্রাফার আফতাব। সেপাই বিপ্লবের ছবি তুলতে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকেছিলাম।
এখানে উনারা আমাকে ধরে ফেলেছেন। আমাকে বাচান স্যার। আমি তাকে সেপাইদের কবল থেকে উদ্ধার করে অভয় দিয়ে আমার অফিসে নিয়ে বসালাম। বেঁচে গিয়ে চেয়ারে বসে ইফ ছেড়ে বললেন, স্যার, এক গ্লাস পানি। আমি তাকে বললাম, সাংবাদিক সাহেব, এত কি নেওয়া উচিত হয়নি আপনার। কানে হাত দিয়ে তিনি বললেন, তওবা আর কখনাে না। | অফিসে কোন কাজ নেই দেখে আমি CMH-এ খালেদ মােশাররফকে দেখার জন্য। আবার বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে ক্যামেরাম্যান হাতজোড় করে বললেন : স্যার, আমাকে দয়া করে আপনার গাড়ী দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের গেইটে পেীছে দিন, তা নাহলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি তাকে আমার সাথে জীপে তুলে সিএমএইচ নিয়ে চললাম। বললাম, ” আসুন ওখানে দু-একটা ছবি নিতে পারেন।
সিএমএইচ-এ পৌছে দেখি সেখানে খালেদ মােশাররফের লাশ একেবারে মর্গের সামনে খােলা মাঠে নির্দয়ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। চতুর্দিক থেকে সৈনিকরা দলে দলে এসে চার। দিনের বিপ্লবের নিহত নেতাকে দেখছে, কেউ থু থু দিচ্ছে। আমি আফতাবকে বললাম খালেদের দুটো ফটো নিতে। আশেপাশে রাইফেল কাধে সৈনিকদের দেখে সে আবার দারুন। ভীত হয়ে পড়ল। কারণ কিছুক্ষণ আগে ফটো নিতে গিয়েই তাে বেচারা সেপাইদের হাতে ধরা পড়েছিল। যাক আমি তার পাশে দাড়িয়ে অভয় দিলে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে সে মাঠে ফেলে রাখা খালেদের দু-তিনটি ছবি নিলাে। আমি CMH-এর কোন অফিসারকে পেলাম না। সুবেদার সাহেবকে ডেকে বললাম, খালেদ একজন সিনিয়র অফিসার, তাই তার লাশটা এভাবে অসম্মান না করে মর্গে তুলে রাখার জন্য। তিনি তখনই লাশটা সরাবার ব্যবস্থা করার জন্য ডােম ডাকতে ছুটে গেলেন। হুদা ও হায়দারের লাশ মর্গেই ছিল। ঢাকা শহরে জনতার উল্লাস সিএমএইচ থেকে ফিরে আমি জীপ নিয়ে একবার শহরের অবস্থা দেখতে বেরিয়ে গেলাম। শহরে শাহবাগ মােড় পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে। হাইকোর্টের সামনে আর যেতে পারলাম না। হাজার হাজার মানুষ জীপ দেখে আল্লাহু আকবর বলে নৃত্য করতে করতে ছুটে আসলাে। আমি বিপদ বুঝে ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি জীপ ঘুরাতে বললাম। কিছুটা শান্ত দেখে কাকরাইলের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম। সেদিকেও একই অবস্থা। মিলিটারি গাড়ী দেখলেই আনন্দের আতিশয্যে জনতা তা ঘিরে ধরছে আর জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছে। রেসকোর্সের কাছে কয়েকটি ট্যাংকের উপর বহু সিভিলিয়ান চড়াও হয়ে ফুর্তি করছে। দেখলাম। আমি আর গুলিস্তানের দিকে যাওয়ার সাহস পেলাম না। কাকরাইল থেকেই ঘুরে পুনরায় শাহবাগ হয়ে দ্রুতগতিতে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলাম। একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, জনতার বেশীরভাগ ছিল ইসলামপন্থী। তারা ক্রমাগত নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিচ্ছিল। জাসদের সমর্থক কোন মিছিল দেখলাম না। মনে হল, সাধারণ মানুষ জাসদের জড়িত থাকার কথা কিছুই জানে না। সবাই ছুটছে এক অপূর্ব আবেগে, মুক্তির আনন্দে। অভূতপূর্ব দৃশ্য।
শহরের রাস্তার বিভিন্নস্থানে দেখলাম, সৈনিকরা বিভিন্ন ইউনিট থেকে ট্রাক বের করে এনে রাস্তায় সিভিলিয়ানদের সাথে মিশে মিছিল করছে আর শ্লোগান দিচ্ছে: আল্লাহু আকবর। সেপাই জনতা ভাই ভাই। | সেপাই-জনতার বিজয় মিছিল। চতুর্দিকে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেপাই-জনতার এমন মিলন দৃশ্য ইতিপূর্বে আর কখনও দেখিনি। সেপাই বিদ্রোহের সাথে জনতার একাত্মতা ঘােষণা, এক ঐতিহাসিক ঘটনা বটে। রাস্তায় কোথাও কোন অফিসারকে দেখলাম না। দিনটি ছিল যথার্থই সেপাইদের দিন। তাদের জন্য এক বিরাট এ্যাডভেঞ্চার। শতাব্দির এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। | বিকাল আনুমানিক ৪টার দিকে আবার টু-ফিডে গেলাম জিয়ার কাছে। বারান্দায় উঠতেই দেখি একটি কক্ষে বসে আছে কর্নেল তাহের। মুখ তীর কালাে, গম্ভীর, ভারী। তিন-চারজন অফিসার কর্নেল মাহতাব, আবদুল্লা, আমিন তার সাথে বসে। আমাকে সালাম দিলাে। জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার তাহের? তুমি এত গম্ভীর কেন? বললাে, স্যার, আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখবেন না। মন খারাপ হবে না? তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। কর্নেল আমিন মুচকি হেসে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেল। বললাে, বুঝলেন না স্যার!
ব্যাপারটা তাে সব তাহেরের লােকজনই ঘটিয়েছে, এখন জিয়াকে মুঠোয় নিয়ে বারগেন করছে। এখনতাে সে জিয়াকে মেরে ফেলতে চায়। এতক্ষণে বুঝলাম ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়।’ সৈনিকদের ক্যান্টনমেন্টে অন্য কোন বিপ্লবী বাহিনীর উপস্থিতির কথা আমার মাথায়ই আসছিল না। এখন বুঝতে পারলাম আশেপাশে এলােমেলাে গােচরের উর্দিপরা লােকজন নিয়মিত সৈনিক নয়? বিপ্লবী বাহিনীর লােক। কনেল আমিনুল হককে বললাম, তােমার ফোর বেঙ্গল তােমার কন্ট্রোলে আছে তাে? অবশ্যই। ‘তাহলে তুমি তােমার লােকজন নিয়ে ডিফেন্স পেরিমিটার তৈরি করে সাবধান থাকো। আমার কাছে তাে অবস্থা গােলমেলে মনে হচ্ছে।’ | ‘জানিনা স্যার আজ রাতে কি হবে। তাহের উল্টোসিধা কথা বলছে। তবে আমার লােকজন ঠিক আছে। আমিন বলল। | এখানে টু-ফিল্ডের খবর কি?” ‘টু-ফিল্ড তাে সুবেদার মেজর কমান্ড করছে। কোন অফিসার নেই। বিপ্লবীতে ভরে। গেছে। দেখছেন না আশেপাশে। ‘জিয়া ভেতরে আছে?” ‘স্যার আছেন। আপনি গিয়ে একটু বুঝিয়ে বলুন না। রাত্রে গণ্ডগােল হতে পারে।” ‘হ্যা যাচ্ছি। আমি ভেতরে তার কক্ষে গিয়ে দেখি জিয়া বসে বসে সৈনিকদের দেওয়া দাবি-দাওয়ার। কাগজ পড়ছে। বসতে বলল। তার মেজাজ মােটেই ভাল না। বলল, ব্যাটারা কি পাইছে। যেখানে যাই সেখানে দাবি। বললাম, দাবি কয়টা? বিগড়ে গিয়ে বলল, একশােটা। ব্যাটাদের আমি ভাল করে দাবি মিটিয়ে দেব।
আমি বললাম, মনে হচ্ছে আজ রাতে কিছু গণ্ডগােল হতে পারে। তােমার টু-ফিল্ডে থাকা উচিত হবে না। বিপদ কিছুটা সে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল। আমার কথা শুনে তার মুখ আরাে শুকনাে হয়ে গেল। শুধু বলল, Keep vaich. আমিনকেও বলাে চোখকান খােলা রাখতে। আরও বলল, তুমি যাও না। টু-ফিল্ডের সুবেদার মেজর আনিসকেতাে চেনাে। উনার সাথেও একটু আলাপ করাে। আমি বাইরে এসে আনিসকে খুঁজতে লাগলাম। টু-ফিল্ডের লােকজন বলল, উনি কোথায় যেন জরুরী মিটিং করছেন। এখন তাকে পাওয়া মুশকিল হবে। আমার কাছে অবস্থা বড়ই ঘােলাটে মনে হল। টু-ফিল্ডের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের সৈনিকরা এখানে-ওখানে জটলা করছিল। তারা কে কোন পক্ষের বােঝা মুশকিল হয়ে পড়ল। কর্নেল তাহেরের কথা এবং মুড থেকে আমি স্পষ্ট বুঝলাম, তাহের এবং জিয়ার মধ্যে বড় রকমের মতবিরােধ হয়ে গেছে। তাহেরের ভাষায়, জিয়া বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুজনই এখন উন্মুক্ত ময়দানে পরস্পরের মুখােমুখি। রক্তক্ষয়ী সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। আমি সুবেদার মেজর আনিসকে অনেক খােজাখুঁজি করেও পেলাম না। বারান্দায় কর্নেল আমিনকে পায়চারী করতে দেখলাম। তার কপালে চিন্তার রেখা। আমাকে দেখেই বলল; কি স্যার, চীফের সাথে কি কথা হল? কিছু বললেন নাতাে। ‘অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। তিনি তােমাকে চোখ-কান খােলা রাখতে বলেছে। খুব সাবধান। থাকো। তােমার ফোর বেঙ্গল ঠিক রাখাে। সুবেদার মেজর আনিসকে দেখেছ? জিয়া কেন জানি না ওর সাথে আমাকে কথা বলতে বলল। | ‘উনাকে এখন পাবেন না। আমিও তাকে খুঁজছি।
তাদের টু-ফিল্ডে এখন মিটিং চলছে। বিপ্লবীরা শুনছি আজ রাত্রে অফিসারদের উপর হামলা চালাবে। আপনি চলে যান স্যার। আমি ইনশাল্লাহ সব সামলে নেবাে। অবস্থা আমার কাছে মােটেই সুবিধার মনে হলাে না। আশেপাশে সৈনিকরা ঘােরাফেরা করছে। জটলা করে কি যেন ফিশফিশ আলােচনা . করছে। তাদের হাবভাব অন্যরকম। কিছুক্ষণ পর আমি ধীরে ধীরে স্থান ত্যাগ করলাম। “ রাস্তায় দেখি বেশ কিছু অফিসার গাড়ী করে, রিকশা করে, ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এমনিতে রাস্তাঘাটে লােকজন নেই। ছমছম অবস্থা। পথে আমার অফিসের সামনে একজনকে দেখলাম। তিনি কর্নেল (পরবর্তীতে মন্ত্রী ও জেনারেল) মাহমুদুল হাসান। তার চোখেমুখে শংকা। ছুটে এসে বললাে, স্যার প্লিজ বলুন কি হচ্ছে? অফিসাররা পালাচ্ছে কেন? আমি তাকে বললাম ; ব্রাদার, তুমি এক্ষুণি বাসায় ছুটে যাও। পারলে ফ্যামিলি নিয়ে বেরিয়ে যাও। অবস্থা ভাল নয়। কি হচ্ছে, আমিও জানি না। সে উদভ্রান্তের মত তখনই বাসার দিকে ছুটে চলল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে এক অজানা আতঙ্ক সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তাঘাট সন্ধ্যার আগেই একেবারে ফাকা হয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে ঐ মুহূর্তে ক্যান্টনমেন্টে চেইন অব কমান্ড’ আর ‘ডিসিপ্লিন’ বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। বিপ্লবীদের প্রােপাগাণ্ডা, হাজার হাজার বিপ্লবী লিফলেটস্ ইত্যাদির প্রভাবে ইতিমধ্যে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন এসে গেছে লক্ষ্য করলাম। তারা অফিসারদের প্রতি অবজ্ঞাভরে তাকাচ্ছিল। ৪র্থ বেঙ্গল এবং টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কিছু অফিসার, জেসিও এবং সৈনিক জেনারেল জিয়াকে আগলে রেখেছিল।
বাদবাকীদের মতিগতি যেন কেমন হয়ে গেল। ৭ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টে সকালবেলা যে পরিবেশ বিদ্যমান ছিল, বিকেলে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার ধারণ করল। অফিসাররা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তারা ধীরে ধীরে সরে পড়তে লাগল। মনে হল যেকোন মুহূর্তে তাহেরের জিয়া-উৎখাত প্ল্যান শুরু হয়ে যেতে পারে। বাসায় ফিরে দেখি আমার স্ত্রী দারুণ উদ্বিগ্ন। মালপত্র কিছু বেঁধে তৈরী হয়ে বসে আছে। সে বলল, অনেক অফিসার টেলিফোন করেছেন, তারা ফ্যামিলি নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছেন। আমরাও আপার বাসায় শহরে চলে যাব। আমি বললাম, আমি স্টেশন কমান্ডার। সেপাইদের ভয়ে স্টেশন কমান্ডার স্টেশন ছেড়ে পালাতে পারে না। তবে তুমি বাচ্চাদের নিয়ে শহরে চলে যেতে পারাে। আমি গাড়ী ডেকে আনি। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে আমাকে ছেড়ে শহরে যেতে রাজী হল না। বলল, ঠিক আছে, মরলে সবাই একসাথেই মরি। আমার পুরানাে আদালী সেপাই সমুজ আলী পাশেই দাড়িয়েছিল। সে বলল, ঠিক আছে। স্যার, আমি দুইটা রাইফেল নিয়ে আপনাদের গার্ড দিমু। চিন্তা করবেন না। বললাম, দুইটা রাইফেল কোথেকে পেলে?
‘আরে স্যার, এখনতাে ক্যান্টনমেন্টে কেবল অস্ত্র আর অস্ত্র। সি, ও, ডি, অস্ত্রাগার। ভেংগে সব হাতিয়ার লুট হয়ে গেছে। এখন সব সেপাইদের হাতে একটা দুইটা ফালতু রাইফেল। আমি দুইটা নিছি। এখন গিয়ে নিয়ে আসি। এমন সময় নিচে কারা যেন কড়া নাড়লাে। সমুজ আলী ছুটে গেল। ভেতরে এসে ঢুকল সুবেদার কাজী ও হাবিলদার সিদ্দিক। ‘সর্বনাশ হয়েছে, স্যার। এক্ষুণি তৈরী হয়ে যান। ফ্যামিলি নিয়ে বাইরে চলে যান। আর দেরী নয় স্যার, চলুন বাইরে। আপনার জীপ নিয়ে এসেছি।’ ‘কেন কি হয়েছে?’ ‘স্যার কিছু বােঝা যাচ্ছে না। টু-ফিল্ড লাইনে বিপ্লবীদের মিটিং হয়েছে। জিয়া সাব। দাবি-দাওয়া মানেন নাই। আজ রাত্রে সব অফিসারদের মেরে ফেলা হবে। সবাই পাগল হয়ে। গেছে। স্যার, চFন্স নিয়েন না, এক্ষুণি চলুন।’ | ‘না, না, আমি স্টেশন কমান্ডার। আমি স্টেশন ছেড়ে পালাতে পারি না। তােমরা চাইলে মারতে পারাে। , ‘দোহাই আল্লার, স্যার, আপনি চলে যান। সব অফিসার চলে যাচ্ছে। না আমি যাব না। ফ্যামিলিও থাকবে। আমার দৃঢ়তা দেখে তারা আর বেশী চাপাচাপি করলাে না। তারা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ। আলােচনা করে বলল ; সমুজ আলী তুমি থাক, আমরা আবার আসছি। আমার জীপ নিয়ে তারা লাইনে চলে গেল। ২০ মিনিট পর তারা ৪ জন সেপাই নিয়ে এবং ৬টি অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল নিয়ে আমার বাসায় ফিরে আসলাে। বললাে, স্যার আমরা মিটিং করে * আপনার সেফটির জন্য চারজন ভলান্টিয়ার সেপাই নিয়ে আসলাম। তারা বাসার ভেতর থেকে আপনাকে গার্ড দেবে। আমার ব্যাটম্যান সমুজ আলী বলল, আমার রাইফেল দুইটা আছে। কুছ পরওয়া নাই। দেখি কোন ব্যাটা আসে।
সুর্য ডুবি ডুবি করছে। আকাশে একটি কাকপক্ষীও উড়ছে না। পাখিদের কলকলানিও যেন বন্ধ হয়ে গেছে। চারিদিকে পিপতন নিস্তবতা। ৭/৮ নভেম্বর। রক্তাক্ত রাত। সন্ধ্যা নেমে এলাে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরই বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকের ঘড়ঘড় শব্দ শােনা গেল বড় রাস্তায়। টেলিফোনে খবর নিয়ে জানলাম, বেঙ্গল ল্যান্সারের সৈনিকরা ট্যাংক নিয়ে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে পৌছে মেজর নাসের ও মেজর গাফফারকে তাদের হাতে তুলে দেবার জন্য জোর চাপ প্রয়ােগ করছে। খালেদ মােশাররফের কুর সাথে এ দুজন অফিসার জড়িত ছিলেন। তারা ৪র্থ বেঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল আমিন, মেজর মুনীর অফিসারদেরকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানালাে। কিছুক্ষণ জোর কথা কাটাকাটির পর ট্যাংকাররা ফিরে গেল। অফিসারদ্বয় বেঁচে গেলেন। | রাতের আঁধার ঘনিয়ে এলাে। চারিদিকে অজানা আতঙ্কের ছায়া। মাঝে মধ্যে গুলির শব্দ। রাত আনুমানিক ১২টা। গভীর অন্ধকার। আমার নিচতলায় থাকতেন সিগন্যালরেজিমেন্টের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল সামস। হঠাৎ গেইটে তুমুল চিৎকার, হট্টগােল। গেইট ঠেলে ভেঙে ১০/১২ জন সেপাই ঢুকে পড়ল চত্বরে। তারা নিচতলায় কর্নেল সামসের বাসা আক্রমন করে বসল। অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে তাকে দরজা খুলতে বলে চিৎকার দিতে লাগল। কিন্তু কেউ দরজা খুললাে না। সেপাইরা ক্রমাগত লাথি মেরে মেইন দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল। ততক্ষণে সামসরা সবাই পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেছেন। ঘরে কাউকে না পেয়ে প্রবল আক্রোশে তারা খালি ঘরে গুলি চালাতে লাগল। দুটো গুলি উপরের তলায় একেবারে আমার পায়ের তলায় এসে লাগল।
ভাবলাম সামস শেষ। কিন্তু তিনি পালিয়ে বেঁচে গেলেন। ভয়ে আমার বাচ্চারা কাদতে লাগল। নিচতলায় কর্নেল সামসকে না পেয়ে সেপাইরা এবার সিড়ি বেয়ে আমার বাসার দিকে। ধাওয়া করল। তারা উপর তলায় উঠে আসল। বারান্দায় আমার ব্যাটম্যান সেপাই সমুজ আলী ও অন্য চারজন সেপাই প্রবলভাবে তাদের বাধা দিতে লাগল। কিন্তু তারা ছিল সংখ্যায় বেশী। তাদের ঠেলে এবার তারা একেবারে আমার বেডরুমের দরজায় পেীছে হকাহকি করে দরজা খুলতে বললাে। আমার ব্যাটম্যান সমুজ আলী অসম সাহসে বিপ্লবীদের বলতে লাগল । দেখুন ভাই সাহেবেরা, আমাদের সাহেবকে কিছু করলে কিন্তু আমরা আপনাদেরকে ছাড়বাে না। আমি দেখলাম দরজা না খুললে বিপ্লবীরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। অতএব, আমি দরজা খুলে বেরুতে গেলাম। আমার স্ত্রী আমাকে থামিয়ে বললাে দাড়াও আমিই যাবাে, বলেই সে দরজা খুলে একেবারে আক্রমনকারীদের সম্মুখে এসে দাড়ালাে। লেডিজ দেখে বিপ্লবীরা প্রথমে থতমত খেয়ে গেলাে। পর মুহূর্তে সামলে নিয়ে বললাে, আপনি সরুন। আমরা আপনাকে চাই না, অফিসারকে চাই। রক্তপাগল সৈনিকরা আমার স্ত্রীকে গুলি করতে পারে ভেবে আমি নিজেই তাড়াতাড়ি দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে এলাম। বললাম, আমি কর্নেল হামিদ। তােমরা কি চাও? একজন বিপ্লবী গুলি করার জন্য রাইফেল তুলতেই সমুজ আলী ও অনুগত সেপাইরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে জাপটে ধরলাে। সমুজ আলী বলল ; খবরদার বলছি, ভাল হবে না। তারা বিপ্লবীকে প্রবলভাবে ঠেলে পেছনে নিয়ে গেল। ঐ ব্যাটাই ছিল লীডার। মনে হল এরা ভিনগ্রহের বিপ্লবী সেপাই। বাকিদের দু-তিন জনকে সামসের সিগন্যাল ইউনিটের মনে হলাে। আমার সেপাইদের দৃঢ়তা দেখে তারা পিছপা হলাে। রাগে গরগর করতে করতে তারা ফিরে চলল। একজন বলল, দাবি না। মানলে আমরা কোন অফিসারকে জিন্দা রাখবাে না। যাহােক, আমরা কোনক্রমে এ যাত্রা। রক্ষা পেয়ে গেলাম। সারারাত আমরা ঘরের আলাে নিভিয়ে জেগেই রইলাম। আমার। সেপাইরাও জেগে রইলাে।
৭/৮ নভেম্বরের ঐ বিভীষিকাময় রাত্রে গভীর অন্ধকারে উন্মাদ সৈনিকরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। বহু বাসায় হামলা হল। অনেকে বাসায় ছিলেন না। অনেকে পালিয়ে বাঁচলাে। সৈনিকরা মেজর করিম, মিসেস মুজিব, মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করল, মেজর আজিম ও মুজিব চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। বিপ্লবী সৈনিকরা তাদের এয়ারপাের্টে পাকড়াও করে। আজিমকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজিব প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে সৈনিকরা। হামলা করে তিনজন তরুণ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন মেজর মহিউদ্দিন যিনি শেখ সাহেবের লাশ টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে দাফন করেন। সৈনিকরা বনানীতে কর্নেল ওসমানের বাসায় আক্রমন করে। ওসমান পালিয়ে যান, তারা মিসেস ওসমানকে গুলি। করে হত্যা করে। হকি খেলতে এসেছিল দু’জন তরুণ লেফটেন্যান্ট। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। অর্ডিন্যান্স স্টেটে দশজন অফিসারকে এক লাইনে দাড় করানাে হয় মারার জন্য। প্রথমজন এক তরুণ ই এম ই ক্যাপটেন। তার পেটে গুলি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। বাকিরা অনুনয় বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বেঁচে গেল তারা অপ্রত্যাশিতভাবে। একজন টেলিভিশনের অফিসার মুনিরুজ্জামান। বঙ্গভবনে খালেদের সময় খুবই অ্যাকটিভ ছিলেন। তাকে ধরে গুলি করা। হয়। তিনদিন পর তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলােনীর ডােবায়। সেনাবাহিনী মেডিক্যাল কোরের ডাইরেক্টর কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশিদ। বিপ্লবীরা তার বাসা আক্রমন করে কয়েক ঝাক গুলিবর্ষণ করে। তিনি পালিয়ে যান। কিন্তু পরে আবার সেপাইদের হাতে ধরা পড়েন।
বিপ্লবীরা তার দুই হাত বেঁধে যখন গুলি করতে উদ্যত, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। হঠাৎ আশুরিক শক্তিতে বনবাদাড় ভেঙ্গে তিনি দেন ছুট। তারা পিছনে গুলি ছুড়লেও আর তাকে ধরতে পারেনি। রাস্তার ওপারে অর্ডিন্যান্স স্টেটের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। উচ্ছল সৈনিকরা দল বেঁধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়াটারে হামলা চালায়। ভীত সন্ত্রস্ত অফিসাররা বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডােবায়, ঝোপে-জঙ্গলে আত্মগােপন করে সারারাত কাটায়। এই সময় COD-এর কমাণ্ডিং অফিসার’। কর্নেল বারী সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি জীপে চড়ে ভেতরে যাচ্ছিলেন। গােলাগুলির খবর শুনে তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার গেইট থেকেই সজোরে মােড় ঘুরিয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। COD’র ভেতরে ঢুকলেই নিশ্চিত তিনি বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে মারা পড়তেন। | ১২জন অফিসার মারা পড়েন ঐ রাতে। আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান বেশ ক’জন অফিসার। নিহত ক’জন অফিসার হলেন: মেজর আনােয়ার আজিম, মেজর • মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন, আনােয়ার, লেঃ সিকান্দার, লেঃ মুস্তাফিজ, বেগম। ওসমান ও অন্যান্য। সারারাত ভয়ানক আতকের মধ্য দিয়ে কাটলাে। মাঝে মধ্যে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। বিপ্লবী সৈনিকরা সত্যি সত্যিই অফিসারদের রক্ত-নেশায় পাগল হয়ে উঠলাে। ভাগ্যিস অধিকাংশ অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সন্ধ্যার আগেই শহরে তাদের। নাগালের বাইরে চলে যান। সেপাইগণ কর্তৃক আপন অফিসারদের উপর হামলা কস্মিনকালেও ঘটেনি এর আগে। বস্তুত এসব অবিশ্বাস্য ঘটনা। ভাের হতে না হতেই সারা ক্যান্টনমেন্টে অফিসারদের মধ্যে গভীর আতঙ্কের ছায়া। আপন সেপাইদের কাছ থেকে অফিসাররা ছুটে পালাতে লাগল। কোনাে ইউনিটে, হেডকোয়ার্টারে, অফিসে অফিসার নাই। সবাই ছুটে পালাচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে। যে যে দিকে পারছে শহরে ছুটে যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে। প্রস্থানের পথে বহু অফিসার স্টেশন হেডকোয়ার্টারে এসে ভীড় করলেন। বিপ্লবের আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বেশীরভাগ অফিসার নিজের জন্য নয়, বরং তাদের পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। ঐদিন সকাল ৮টার সময়ও কয়েকজন অফিসারের উপর গুলিবর্ষণ করা হল। বহু অফিসারকে সৈনিকরা নাম ধরে খুঁজতে লাগল। অরাজকতার মধ্যে কে কাকে ধরছে, মারছে, লাঞ্ছিত করছে, কিছুই বুঝা যাচ্ছিলাে না। নিরাপত্তার অভাবে অফিসাররা সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা। আমি জিয়াকে বহু চেষ্টা করেও কোথাও পেলাম না। ফোনেও পেলাম না।
আমি তাদের বললাম, আগে প্রাণ বাঁচান। তারপর খবর নিন। কেউ কেউ শহরে আত্মীয়-স্বজন না থাকায় অখ্যাত হােটেলে উঠে আত্মগােপন করলেন। অনেকে স্টেশন হেডকোয়ার্টারে ফোন নাম্বার দিয়ে গেলেন পরিবেশ স্বাভাবিক হলেই তাদের খবর দিয়ে আনার জন্য। | মহান সেপাই বিপ্লব ৮ নভেম্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার ধারণ করলাে। অফিসার দেখলেই ” সেপাইরা তাড়া করছে। সেপাইরা বাধ্য করলাে তাদের কাদেরে র্যাংক নামিয়ে ফেলতে। কেউ র্যাংক পরতে পারবে না। আমি যথারীতি অফিসে গেলাম। আমার ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে আসে আমাকে নিতে। অফিসে আমার সুবেদার সাহেব বললেন : স্যার, আপনাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু দয়া করে অফিসের বাইরে গেলে কাধে আপনার কর্নেলের র্যাংকটা নামিয়ে যাবেন। চতুর্দিকে মহা বিপদ। সব অফিসার তাই করছে। অফিসে আমি ব্যাংক পরেই থাকলাম কিন্তু জীপ নিয়ে বেরুবার সময় ব্যাংক নামিয়েই বেরুলাম। আমি জিয়াকে খুঁজছিলাম। সে পাগলের মত এখানে ওখানে ঘুরছিল। চতুর্দিকে গণ্ডগােল থামাতে ক্যান্টনমেন্টের সবখানে ছুটে গিয়ে সেপাইদের এসব কাণ্ড বন্ধ করতে বললাে। তারা বিভিন্ন দাবি পেশ করল। জিয়া বলল, আগে তােমরা অস্ত্র জমা দাও। আমি সব দাবি মানবাে।
কর্নেল তাহেরের ইঙ্গিতে বিপ্লবী সৈনিকরা এখন একেবারে উল্টে গেছে। বিপ্লবীরা জিয়াকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে। জিয়া সৈনিকদের ১২ দফা দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। সৈনিকদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেছে, সেই দাবিগুলাে মানতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিয়া এখন পিছিয়ে গেছে। এখন তারা জিয়াকে হত্যা করবে। সব অফিসারদের হত্যা করবে বিপ্লবীদের আস্ফালন। | ‘ সৈনিকদের বিপ্লব এখন নতুন মােড় নিল। অফিসারদের রক্ত চাই। রক্ত চাই! | বেলা ১০টার দিকে সৈনিকদের একটা বড় মিটিং হলাে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের গ্রাউণ্ডে। সুবেদার কাজী জানালাে, জিয়া সাহেবকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে। তিনি আসবেন। তবে আমাকে ওদিকে যেতে মানা করলাে। সে একদল সৈনিক নিয়ে ওদিকে চলে গেল। সৈনিকদের ঐ উন্মুক্ত সভায় বেশ কজন বিপ্লবী সৈনিক বিপ্লবী ভাষণ দেয়। বহু দাবির কথা বলা হয়। ঐ মিটিং-এ প্রায় সবাই ছিল সশস্ত্র। আনাড়িদের হাতেও ছিল স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। সভাতেই একজনের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে আপনা-আপনি গুলি বেরিয়ে গেল। দুজন সৈনিক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং কয়েকজন আহত হলাে। জিয়া বললেন ; আপনারাই দেখুন, ডিসিপ্লিন না থাকলে কি অবস্থা হয়। জিয়া স্পষ্ট ভাষায় সৈনিকদের বললেন, আপনারা হাতিয়ার জমা দিন। শৃংখলার মধ্যে আসুন। ব্যারাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যান। অযথা রক্তপাত করবেন না। আপনারা ক্যান্টনমেন্টে শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনুন। “. আসলে ঐ সময় সৈনিকরা খুবই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। অফিসারদের তারা ক্যান্টনমেন্টেই যেখানেই পেয়েছে তার র্যাংক খুলে ফেলেছে। ধরে অপমান করেছে। মিটিং-এ একজন বিপ্লবী সৈনিক সম্বােধন করলাে, জনাব জিয়াউর রহমান …। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া তাকে সংশােধন করলেন, আমি ‘জনাব’ জিয়া নই, আমি জেনারেল জিয়া। সৈনিক নেতা থতমত খেয়ে গেল। অতঃপর সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাে। | সৈনিক সমাবেশে জিয়ার আকুল আহব্বান তারা আমল দিলাে না। হিংসাত্মক পরিবেশের কোন উন্নতি হলাে না। বরং জাসদ তাদের ১২ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত অস্ত্র জমা না দেওয়ার জন্য সৈনিকদের নির্দেশ দিলাে। বহু লিফলেট বিতরণ করা হল। ওগুলােতে জিয়া এবং অফিসার শ্রেণীকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করা হলাে। ৮ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃশ্য। অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে বিস্ততা। নষ্ট হয়ে গেছে। সৈনিকদের সামনেই অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে পালাতে লাগল। সৈনিকরা ফেীতুকভরে দেখতে লাগল। অবশ্য বহু ইউনিটের বিশ্বস্ত সৈনিক নিজেরাই তাদের অফিসারদেরকে ছাউনির বাইরে পার করে দিয়ে আসে। সৈনিকদের ভয়ে অফিসারদের ক্যFটনমেন্ট ছেড়ে পলায়ন—এ রকম ঘটনা কোনদিন কোথাও ঘটেছে বলে মনে হয় না। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এসব পরিস্থিতি আজ কল্পনাও করা যায় না।
সকাল থেকে জিয়া চতুর্দিকে ঘুরছে। সৈনিকদের সাথে সরাসরি কথা বলছে। তবু তারা সেনাপ্রধানের কথায় কান দিচ্ছে না। কমাণ্ড-কন্ট্রোল ও শৃখলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। আমি এক সময় অনুমান বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জিয়াকে আর্মি হেডকোয়ার্টারে গিয়ে ঘরতে পারলাম। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, জিয়া মলিন মুখে তার চেয়ারে বসে শূন্যে তাকিয়ে আছে।
তাকে স্টেশনের এইসব অবস্থা অবহিত করলাম। বললাম, অফিসাররা সবাই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কোন সিকিউরিটি নাই। জিয়া বলল। হামিদ, আমি সব দেখেছি। সকাল থেকে ঘুরছি। আমার করবার কিছুই নেই। আমি ওদের বুঝাচ্ছি। কিন্তু কেউ বুঝতে চায় না। তারা পাগল হয়ে গেছে। বলাে কি করি? তুমি তাে পুরানাে অফিসার, স্টেশন কমাণ্ডার। তুমিও একটু বুঝাও না। তবে সেইফ থেকে ঘােরাঘুরি করাে। ফ্যামিলি পারলে। বাইরে পাঠিয়ে দাও। তার সাথে কথা বলে বুঝলাম ঐ মুহূর্তে সেও অসহায়। তাকে এত অসহায়, এত বিধ্বস্ত অবস্থায় আমি আর কোনদিন দেখিনি। সৈনিকরা যেখানে অফিসারের নির্দেশ মানা দূরের কথা, তাদের রক্ত চাচ্ছে, সেখানে সে কিইবা করতে পারে? | ৭ তারিখ সকালবেলা যে ছিল বিজয়ী বীর, জনপ্রিয় সম্রাট; ৮ তারিখ সকালবেলা তাকে মনে হল সমস্যা জর্জরিত পরাজিত মুকুটহীন এক সম্রাট। দু-চারটি কথার পর আমি চলে। আসছিলাম; জিয়া বলল, অফিসারদের ডাকো। আমি তাদের সাথে আগামীকাল নয়টায় হেডকোয়ার্টারে কথা বলবাে। রণক্লান্ত জিয়া। ভাবলাম রেস্ট করুক। আমি বেরিয়ে এলাম। আমি DMO নুরউদ্দীনকে গিয়ে জিয়ার অভিপ্রায় জানালাম। প্রায় সব অফিসাররাই ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে শহরে চলে গিয়েছিলেন। যারা স্টেশন। হেডকোয়ার্টারে ফোন করলেন তাদের বললাম অন্য সবাইকে জানাতে যে, আগামীকাল নয়টায় আমি হেডকোয়ার্টারে আসতে। খবর পেলাম শহরেও বেশ কয়টি বাড়ীতে সৈনিকরা । হামলা করেছে অফিসারদের খুঁজতে গিয়ে। এসব ছিল কোন কোন অফিসারদের বিরুদ্ধে। কিছু জওয়ানের ব্যক্তিগত আক্রোশের জের। ঢাকা সেনানিবাস সেপাই বিদ্রোহের দিনগুলােতে একটি হিংস্র জঙ্গলের রূপ নেয়। জিয়া সিনিয়ার জে-সি-ওদের মাধ্যমে ক্রমাগত আলাপ আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সেপাইরা যাতে অফিসারদের রক্তপাত না করে তার জন্য সর্বত্র আকুল আবেদন জানাতে লাগলেন। | একা সে কি করবে। জিয়ার আর্মি হেডকোয়ার্টারেও অফিসাররা নেই। প্রাণ ভয়ে সবাই পালিয়েছে। গুটি চার অফিসার আর্মি হেডকোয়ার্টারে জিয়ার পাশে। এর মধ্যে একমাত্র কর্নেল (পরে লেঃ জেনারেল) নুরউদ্দীনকেই নিয়মিত টেবিলে কার্যরত দেখতে পেলাম। আর সবাই পালিয়ে। রাত্রেও জিয়ার সাথে বিভিন্ন সৈনিক গ্রুপের নেতৃবৃন্দের সাথে ঘন ঘন মিটিং হচ্ছিলাে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিলাে। একই সাথে জাসদ পার্টির কিছু লােকজনও বাসায় গিয়ে তার সাথে আলাদাভাবে আলােচনা করছিল। | জিয়াই এককভাবে আলােচনা ও কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে জিয়া ছাড়া। আর কারাে সাথে কোন কথা বলে লাভও ছিল না। কারণ একমাত্র জিয়াই জানতেন ওদের সাথে তার কি সমঝােতা হয়েছিল। জাসদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মতে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়ার মুক্তির জন্য নভেম্বরের সশস্ত্র অভূত্থানে জড়িত হয়, তাহেরের সাথে। জিয়ার একটা গােপন ১২ দফা ভিত্তিক পূর্ব সমঝােতার ভিত্তিতে। ১২ দফার দাবিগুলাের বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি শ্রেণীহীন বাহিনীতে পরিণত হতাে। তাদের প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠিত হলে সেখানে জিয়ার ক্ষমতাও বহুলাংশে খর্বিত হয়ে পড়তাে। মুক্তি পাওয়ার পর জিয়া এসব বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করেই তাদের দাবি মানতে অস্বীকার করেন।
৮ নভেম্বর সারাদিনই অফিসাররা পালাতে লাগল। এমনকি তরুণ ব্যাচেলার অফিসাররাও ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে গেল। ফ্যামিলিওয়ালাতাে সবাই তাদের পরিবার সরিয়ে নিলাে। খােদ জিয়ার শ্যালক লেঃ সাইদ ইস্কান্দারকেও ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে
যেতে হলাে। গতরাত্রে বিপ্লবীরা ব্রিগেড অফিসার মেস আক্রমন করলে সাইদ সহ তরুণ অফিসাররা কোনমতে প্রাণ নিয়ে পেছন দিকে পালিয়ে যায়। আমার স্ত্রীও বলল শহরে তার বনের মায়-চকেতকি-মি-আবললাম-স্টেশন-কমান্ডারকে যদি-সাইকে ভয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাতে হয়, তাহলে আমার আর্মি ছেড়ে দেওয়াই উচিত। অন্যদের কথা স্বতন্ত্র। আমার সুবেদার কাজী ও বিধ্বস্ত হাবিলদার সিদ্দিকও বলল, সব অফিসার রাতে . ফ্যামিলিসহ চলে গিয়েছেন, আপনি অন্ততঃ ফ্যামিলি শহরে পাঠিয়ে দেন। আমি রাজী হলাম না। বললাম, মারলে তােমরাইতাে মারবে। তারা লজ্জায় মুখ ঢেকে বললাে, স্যার আমাদের লাশের উপর দিয়ে আপনাদের মারতে পারবে। হাবিলদার সিদ্দিক বললাে, স্যার একটু আগে আপনার স্টাফ অফিসার মেজর আলাউদ্দিনকে ক্যান্টনমেন্ট পার করে দিয়ে এলাম বােরখা পরিয়ে। ‘ ‘বােরখা পরিয়ে ? | ‘জি স্যার, আমাদের জীপে আমার পাশে বসিয়ে মহিলাদের বােরখা পরিয়ে তাকে পার | করলাম। কি করবাে স্যার!’ সে বলল, আরাে অনেক বােরখাধারী অফিসারকে এভাবে রাস্তায় দেখা গেছে। তাদের সাথে দাড়িয়ে কথা বলতে বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ দেখি রিশা চড়ে দু’জন লেডিজ | আসছেন। একজন শাড়ী পরা, অন্যজন বােরখাধারী। আমার কৌতুহল হলাে। রিকশা থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? হিমশিম খেয়ে বােরখাধারী মােটা মহিলা বােরখা ফাক করে তার চেহারাখানা দেখালেন। বললেন, আসসালামালেকুম স্যার। বােরখার ভেতর থেকে কর্কশ পুরুষ কণ্ঠ। সিদ্দিকের কথাই ঠিক। শাড়ীপরা মহিলা আসল, বােরখাধারী নকল। বােরখাধারী অফিসারকে আমি চিনে ফেললাম। সেপাইদের দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার সব রকম উপায়ই তখন অফিসাররা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাকে বললাম, Checr up. এগিয়ে যাও। বাম দিকে গেলে ভাল হবে। একজন গােয়েন্দা সিনিয়র অফিসার মেয়েদের শাড়ী পরে বনানীর দিকে পালানাের সময় সেপাইদের হাতে ধরা পড়েন। তার অবস্থা দেখে সেপাইরা হেসে কুটিকুটি।
৮ নভেম্বর অবশ্য অফিসারদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে থাকার মত কোন পরিবেশ ছিল না। বিপ্লবী সৈনিকদের প্ররােচনায় সাধারণ সৈনিকরাও ঐ-দিন ভিন্ন মূর্তি ধারণ করেছিল। এসব অবস্থা সচক্ষে না দেখলে কারাে পক্ষে এখন বিশ্বাস করা কঠিন। বহু বছর পর আজ যখন ঘটনাগুলাের স্মৃতিচারণ করি, তখন মনে হয়, এরকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমার ইউনিফরমের মর্যাদার জন্য ক্যান্টনমেন্টে ফ্যামিলি নিয়ে অবস্থান করে এত রিস্ক নেওয়া মােটেই উচিত হয়নি। দুপুর ১২টা। আর্মি হেডকোয়ার্টারে জেনারেল জিয়ার অফিস কক্ষ থেকে বের হয়ে আমি কর্নেল নুরউদ্দীনের সাথে অপারেশন রুমে বসে ছিলাম। এমন সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে একটি টেলিফোন-কল এলাে। প্রথম নুরউদ্দীন কথা বলল, তারপর আমি। আওয়াজ অস্পষ্ট। থানা। থেকে পুলিশ অফিসার বলছে, একজন আর্মি অফিসারকে কে বা কারা হত্যা করে রাস্তার ডাটাবনের কাছে ফেলে রেখে গেছে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে পুলিশ অফিসার বললেন, মৃত অফিসারের পরিচয় থেকে তার নাম কর্নেল মালেক বলে জানা গেছে। আহারে মালেক। কনেল মালেক আমার বন্ধু মানুষ। তার নাম শুনে আমি খুবই মুষড়ে পড়লাম। সেখান থেকে আমরা তৎক্ষণাৎ একটি গাড়ী পাঠালাম মালেকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য।
বিকেলে লাশ নিয়ে উদ্ধার পার্টি ফিরে আসলে দেখা গেল লাশটি কর্নেল মালেকের নয়, মেজর নুরুল আজিমের। দুজন দেখতে প্রায় এক রকমের বিধায় এই বিভ্রাট হলাে। বেচারা | আজিম। বিপ্লবী সৈনিকরা তাকে এয়ারপাের্টে চিনতে পেরে ধরে নিয়ে গুলি করে। তার ছয়টি ছােট বাচ্চা-কাচ্চা এতিম হয়ে গেল। তার সাথে আর একজন অফিসার মেজর মুজিব বিপ্লবীদের কবলে পড়ে নেহাৎ বুদ্ধিবলে কোনক্রমে মুক্ত হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে | সক্ষম হয়। এসব ঘটনা শুনে অফিসাররা দারুন আতংকিত হয়ে পড়ল। সকাল নয়টা। শহর থেকে এবং আশেপাশ থেকে জনা ত্রিশেক অফিসার আমি হেডকোয়ার্টার-এ সমবেত হয়েছিলেন। তারা প্রায় সবাই সিভিল ড্রেসে। যে কজন ইউনিফরম। পরে ছিলেন তারা র্যাংক পরেননি। র্যাংক দেখলেই সেপাইরা ধরে টান দিয়ে ছিড়ে | ফেলেছে। অদ্ভুত অবস্থা। সবারই মুখে চোখে ভীতির ছায়া। সেপাইদের আক্রমনে অফিসারদের মৃত্যুসংবাদ, লুটপাট, বিচ্ছিন্ন আক্রমন সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছিল। | জিয়া এলেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। নিচু স্বরে বললেন, আপনারা সরে পড়েছেন। ঠিক আছে। এই সময় ফ্যামিলি দূরে রাখাই ভাল, আমি চেষ্টা করছি ওদের বুঝাবার। ইনশাল্লাহু শীঘ্র সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনারা ধৈর্য ধরুন। সেপাইরা কিছু, উত্তেজিত আছে। But you must face them…. ক্ষুদ্র ভাষণ দিয়ে তার প্রস্থান। ভীত সন্ত্রস্ত অফিসারগণ তার কথায় কেউ কোন আশার বাণী খুঁজে পেল না। তাড়াতাড়ি যার যার পথে নিরবে প্রস্থান করলাে। যাওয়ার পথে জিয়া আমাকে বললেন ; হামিদ, আগামীকাল দশটার দিকে আমার কাছে আসে। ১ তারিখ জিয়াউর রহমান বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও এবং এনসিওদের সাথে বেশ কিছু | মিটিং করলেন। তাদের অনুরােধ করলেন, সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরে আসার এবং অস্ত্র। জমা দেওয়ার জন্য বুঝিয়ে বলতে। তাদের দাবি-দাওয়া আস্তে আস্তে মানা হবে। | জেসিওরা শান্ত হলেও সেপাইরা অশান্ত থেকেই গেল। জিয়া তাদের দাবি দাওয়া না-মানাতে তারা বিদ্রোহী মনােভাব নিয়ে ঠায় বসে রইল। বিভিন্ন দিকে তারা মিটিং করতে | থাকল। জিয়া সুকৌশলে জেসিও এবং এনসিও-দের তার কাছে ভেড়াতে সচেষ্ট হলেন।
ঐ সময় একমাত্র জিয়া ছাড়া আর সর্ব কমাণ্ড-চ্যানেল ভেঙে যায়। আমি চীফ অব স্টাফ | জেনারেল জিয়া সরাসরি জেসিও, এমন কি সেপাই প্রতিনিধিদের সাথে আলােচনা করছিলেন। টু-ফিল্ডের সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী এই সময় জিয়ার পাশে থেকে | সৈনিকদের বােঝাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। | সারাদিন কোন বড় রকম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য পুরাে দিন ক্যান্টনমেন্টে কোন অফিসারও ছিলেন না। অফিস কাজকর্ম ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। সর্বত্র বিরাট অচলাবস্থা। অরাজকতা। অফিস, ব্যারাক সেপাইদের দখলে। বিপ্লবীরা সর্বত্র ঘুরে ফিরে সৈনিকদের উত্তেজিত করছিল। দাবি-দাওয়ার প্রচুর লিফলেট সর্বত্র বিতরণ করছিল। অবাক ব্যাপার। ঢাকা শহরে ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা। সাধারণ মানুষ অনেকেই। ক্যান্টনমেন্টের এই অস্বাভাবিক ঘটনার কথা টেরও পায়নি। ঐদিন বিকেলে জাসদের একটি বিজয় মিছিল ও মিটিং অনুষ্ঠিত হল বায়তুল মােকাররমে। জিয়ার নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে তা ভেঙে দিলাে। বিভ্রান্ত জনগণ। একবার লােনে সেপাই বিপ্লব, জাসদের বিপ্লব। আবার দেখে জাসদের মিটিং-এ গুলি। আসল ব্যাপার কি?
৯ তারিখ দুপুরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের এক চাচা শহর থেকে আমার সাথে যােগাযােগ করলেন খালেদের লাশটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভয়ে খালেদের পরিবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গত দুইদিন ধরে অবহেলায় লাশটি পড়ে আছে। কেউ আসছে না। আমি তাকে তখনই স্টেশন হেডকোয়ার্টারে চলে আসতে বললাম। তিনি ক্যান্টনমেন্টে আসতে রাজী হলেন না। অগত্যা বনানী স্টেশনের কাছে নিয়ে খালেদের লাশ তার হাতে পৌছে দেওয়া হলাে। তিনি সেনানিবাস গােরস্থানে খালেদকে দাফন করার অনুমতি চাইলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলাম। কিছুক্ষণ পর ফোন করে বললেন, তার কাছে কোন লােকজন নাই। যদি কবরটা খুঁড়ে দেওয়া যায়। আমি তৎক্ষণাৎ ক্যান্টনমেন্টে বাের্ড অফিসারকে ডেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদের কবর খুঁড়তে ৩/৪ জন সিভিলিয়ান মালি পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। বিকেলে আবার তিনি ফোন করলেন, খালেদের আত্মীয়-স্বজন সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত। তারা সন্ধ্যার দিকে খালেদকে দাফন করতে চান। তাই একটু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে অনুরােধ করলেন। আমি বললাম, দেখুন আপনি কি সেপাই গার্ড চাচ্ছেন? তিনি বললেন, তওবা, তওবা। তখন আমি বললাম, আমি নিজে সন্ধ্যার সময় ওখানে হাজির থাকবাে। আপনারা। নির্বিঘ্নে খালেদকে নিয়ে আসুন। তিনি আশ্বস্ত হলেন। ধন্যবাদ জানালেন। সন্ধ্যাবেলা ঘাের অন্ধকার। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাস্তার লাইটের স্তিমিত আলােতে ক্যান্টনমেন্ট গােরস্থানে তড়িঘড়ি করে খালেদের দাফন কার্য সমাধা করা হল। উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৪/৬ জন অতি নিকট আত্মীয় ও চাচা। আর শুধু আমি ও আমার ড্রাইভার ল্যান্স। নায়েক মনােয়ার।
খালেদ মােশাররফের দাফন কার্য শেষে আমি স্টাফ রােডে খালেদের বাসা হয়ে ফিরে আসছিলাম। বাসার গেইট থেকে দেখলাম বেশ কজন সেপাই ঘুরঘুর করছে। ঘরের দরজা খােলা, তালা ভাঙা। আমি ড্রাইভারকে বললাম দরজাটা গিয়ে বন্ধ করে দিতে এবং সেপাইদের বলতে এখান থেকে চলে যেতে। আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে। গিয়ে হেডকোয়ার্টার উইং-এর সুবেদার মেজরকে খোজাখুঁজি করে বের করলাম। তাকে বললাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদের বাসায় লুটপাট হচ্ছে। কিছু গার্ডের ব্যবস্থা করুন। তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, স্যার গার্ড কোথা থেকে দেবাে? সেপাইরাইতাে এখন আমাদের কমান্ড করছে। সবকিছু তাে এখন তাদের দয়ার উপর। সন্ধ্যার এই সময় ক্যান্টনমেন্টে আমি ঘােরাফেরা করছি দেখে তিনি খুবই আতঙ্কিত হলেন। বললেন; স্যার, আপনি তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। সেপাইদের মতিগতি। ভাল না। আপনার বিশেষ ক্ষতি হতে পারে। তার কথায় আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি জীপ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি বাসার পথ ধরলাম। এভাবে শেষ হল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের কে ফোর্সের দুর্ধর্ষ কমান্ডার খালেদ। মােশাররফ বীর উত্তমের শেষকৃত্য। গােপনে, অন্ধকারে, সবার অগােচরে। ১০ নভেম্বর জিয়া ৯/১০ তারিখ রাত থেকে যশােহর থেকে আনা কর্নেল সালামের (পরে জেনারেল) কমাণ্ডে ব্যাটালিয়নের লােকজন দ্বারা সেনা হেডকোয়ার্টার ঘেরাও করে নিজে সেখানে অবস্থান নেন। এভাবে প্রকারান্তরে ব্রিগেডিয়ার শওকত সুকৌশলে তার ব্রিগেডের লােকজন দ্বারা জিয়ার চতুর্পাশ্বে বেড়াজাল সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। জিয়াও এবার নিজেকে বিপ্লবী টু-ফিল্ড, ল্যান্সার ও জাসদপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে সেনাসদরে পেীছে মােটামুটি স্বাচ্ছন্দ্য রােধ করতে লাগলেন। যদিও তার অজান্তেই চতুর মাকড়শার দল তার চারপাশে দ্রুত নুতন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে দিলাে। গতরাতে কোন সহিংস ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কোন গােলাগুলির আওয়াজও শােনা যায়নি। অফিসাররা শহর থেকে টেলিফোনে নিজেদের ইউনিটের জেসিওদের সাথে। যােগাযােগ রাখছিলেন। সকাল ১০ টার সময় আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে জিয়ার কাছে গেলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করল ; হামিদ, স্টেশনের খবর কি? আমি বললাম, আজতাে মােটামুটি ভালই দেখছি।
সে বলল ; তােমাকে ডাকলাম, আমি তােমাকে লগ এরিয়া কমান্ডার বানাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি তাড়াতাড়ি ব্রিগেডিয়ার রউফকে রিপ্লেস করাে। লগ এরিয়াতে তােমার বহু কাজ রয়েছে। বুঝতেই পারছাে, প্রথম কাজই হচ্ছে এখন কমান্ড কন্ট্রোল ফিরিয়ে আনা। সৈনিকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনা। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা। বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলাে কন্ট্রোলেই আছে। সমস্ত সমস্যা দাড়িয়েছে তােমার লগ এরিয়া ইউনিটগুলাে নিয়ে। সার্ভিস কোরের ইউনিটগুলাে একেবারে ওয়াইড হয়ে গেছে। এ ছাড়া। তােমার কমাণ্ডে রয়েছে বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট। ট্যাংক নিয়ে এরা যা ইচ্ছা তা করে। বেড়াচ্ছে। এদের সবাইকে যেভাবেই হােক তােমার কন্ট্রোলে আনতে হবে। ঢাকার। ইউনিটগুলাের কাছে তুমিতাে ভালভাবেই পরিচিত। স্টেশন কমান্ডার হিসাবে তােমাকে সবাই চেনে। অতএব, তাড়াতাড়ি টেকওভার করে কাজ শুরু করে দাও। এখন অর্ডার-সর্ডারের অপেক্ষা করাে না। কোন অফিস ফাংশন করছে না। তুমি কালকের মধ্যেই টেকওভার করাে। এখন যাও।
আমি চলে যাচ্ছিলাম। আবার ডেকে বলল ; দেখ, তুমিতাে জান, বহু ‘ব্লাডি বিপ্লবী | আর্মডম্যান’ ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে গেছে। ওদেরকে শক্ত হাতে কন্ট্রোল করতে হবে। ৪৬ ব্রিগেডের কর্নেল আমিনের সাথে যােগাযােগ রাখবে। সে-ই এখন অ্যাকটিং কমান্ডার। আমি লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে কোন অফিসারই ছিল না। সুবেদার মেজরকে ডেকে বললাম, আগামীকাল আমি আসবাে। তারা অবশ্য আমাকে ভাল করেই | চিনতাে। আমি আসছি শুনে তারা খুবই খুশী হলাে। ঐদিন বিকেলের দিকে আবার আর্মি হেডকোয়ার্টার-এ গেলাম। অপারেশন রুমে নুরউদ্দীনের কাছে কয়েকজন অফিসারকে সিভিল | ড্রেসে বসে থাকতে দেখলাম। এমন সময় কে একজন এসে বলল ; স্যার, চীফ আপনাকে ডাকছেন। আমি সােজা ভেতরে গেলে জিয়া বলল ; হামিদ তুমি যাও তাে, ৪৪LAA রেজিমেন্টের জওয়ানরা হাতিয়ার জমা দেবে না বলে জানিয়েছে। তারা রাস্তাঘাটে ফায়ার শুরু করেছে। দেখতাে কিছু করতে পারাে কিনা। আমি তাকে হেসে বললাম, ওরাতাে আমার কমাণ্ডে নয়। ওরা কি আমার কথা শুনবে? বললাে ; তবু যাও, একটু দেখাে। স্টেশন কমাণ্ডার হিসাবে তােমাকে তারা চিনবে। আমি কি আর করি। বললাম, আচ্ছা যাই। আমি DMO কর্নেল নুরউদ্দীনের কামরায় ফিরে এসে দেখি সেখানে আর্টিলারির কর্নেল আনােয়ার (পরে জেনারেল) এবং কর্নেল সুফী (পরে জেনারেল) বসে আছে। আমি আনােয়ারকে বললাম ; এই যে আনােয়ার, তুমি তাে আর্টিলারীর কমান্ডার। চলাে একটু এ্যাক এ্যাক রেজিমেন্ট ঘুরে আসি। ওখানে গণ্ডগােল হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠলাে। স্যার আমি জানি, কিন্তু যাবাে না। Why should I kill myself for nothing. কর্নেল সুফী তার পাশে বসে ছিল। বললাম; চলাে সুফী, তুমি।
আসাে। সে ইনফেট্রির অফিসার, তবু সে রাজী হলাে। এমন সময় টু-ফিল্ড আর্টিলারির। সুবেদার মেজর আনিস এসে হাজির। আমি তাকে বললাম; চলুন আনিস সাহেব, ৩৮ এ্যাক-এ্যাক রেজিমেন্টের জওয়ানরা হাতিয়ার জমা দিচ্ছে না। গােলমাল করছে। চলুন একটু ঘুরে আসি। তিনি রাজী হলেন। সুফীকে ধন্যবাদ দিয়ে আনিসকে আমার জীপে বসিয়ে ওদিকে চললাম।। | এয়ারপাের্ট বড় রাস্তার উপর গিয়ে দেখি সেখানে ক্রমাগত ফায়ারিং হচ্ছে। রাস্তায় যান। চলাচল বন্ধ। আমরা দু’জন রেল ক্রসিং এর কাছে গাড়ী থেকে নেমে টুপী খুলে বারবার। ইশারা করতে লাগলাম ফায়ারিং থামাতে। প্রায় পাঁচ মিনিট চেষ্টার পর তারা ফায়ারিং বন্ধ করল। আমরা তখন জীপ চালিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই আবার কয়েক রাউণ্ড গুলি আমাদের মাথার উপর দিয়ে ফায়ার করলাে। সুবেদার মেজর আনিস বলল । আর এগুনাে ঠিক হবে না স্যার, আপনি একটু বসুন। প্রথমে আমি তাদের সাথে কথা বলি। তারপর আপনি আসুন। খুবই সাহসী জেসিও বটে। | সে বেপরােয়াভাবে সামনে এগিয়ে গিয়ে চিৎকার করে বলল, শােনাে। আমি টু ফিল্ডের সুবেদার মেজর আনিস। ফায়ার থামাও। বলেই তিনি সােজা তাদের কাছে গিয়ে কথাবার্তা বলতে থাকলেন। ওখানে আরাে কয়েকজন জেসিও এগিয়ে এলাে। সেপাই অভ্যুত্থানের দিনগুলােতে সুবেদার মেজর আনিস ছিলাে একজন বড় মাপের সৈনিক-নেতা। দেখলাম তার সাথে সবাই শ্রদ্ধাভরে কথা বলল। ৩/৪ মিনিট কথা হলাে। সে ফিরে আসলাে, বলল, স্যার ; ফিরে চলুন, আপনার যাওয়া লাগবে না। আজ সন্ধ্যার আগেই তারা সব হাতিয়ার জমা দিতে রাজী হয়ে গেছে। আমিও হাফ ছেড়ে বাচলাম। জীপ ঘুরিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে। ফিরে এসে জিয়াকে বললাম, ফায়ারিং বন্ধ হয়েছে। তারা সন্ধ্যার আগেই অস্ত্র জমা দেবে। জিয়া বলল, থ্যাংক ইউ। বললাম, সুবেদার মেজর আনিসকে সাথে নিয়েই গিয়েছিলাম। বলল, He is very useful Co. তাকে এখানে থাকতে বলাে। আমিও কথা বলবাে। কমান্ডার লগ এরিয়া আমি ১১ তারিখ লগ এরিয়া কমান্ডারের অফিসে গিয়ে কমাণ্ড নিলাম। অর্থাৎ খালি চেয়ারে গিয়েই বসলাম। ব্রিগেডিয়ার রউফকে তখন গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। হেড কোয়ার্টারে তখন কোন অফিসার নাই। সুবেদার মেজর, ক্লার্ক, সেপাইরা ছিল। আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দেওয়ার মতােও কেউ ছিল না। সব কিছুই গােলমেলে। আমি সুবেদার মেজরকে বললাম, আগামীকাল থেকে আমি নিয়মিত অফিসে বসবাে।
সব ইউনিটে যেন তা অফিসঅর্ডারের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। ৪৬ ব্রিগেডের কর্নেল আমিনুল হককে ফোন করলাম। আমিন খুব খুশী হলাে। বলল; স্যার, আমার ৪৬ ব্রিগেড ইপস সব আমার কন্ট্রোলে আছে। এখন আপনি লগ এরিয়ার সব ইউনিটগুলাে কন্ট্রোলে আনেন। দরকার হলে আমিও সাপাের্ট দেবাে। জেঃ জিয়া এখন খুবই অসুবিধায় আছেন। চীফ আমাকেও বলেছেন, আপনার সাথে যােগাযােগ রেখে ক্যন্টনমেন্ট ইউনিটগুলােতে কমান্ড কন্ট্রোল ফিরিয়ে আনতে। প্রকৃতপক্ষে কর্নেল আমিনুল হকই গত ২/৩ দিন ধরে তার ৪র্থ বেঙ্গলের কিছু বিবস্ত টুপ নিয়ে জিয়াকে আগলে রেখেছিল। এর মধ্যে যশােহর থেকে কর্নেল(বর্তমানে জেনারেল) সালামের কিছু কমান্ডাে টুপ নিয়ে আসা হয়ছে। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবেও জিয়া তার কিছু বিশ্বস্ত সৈনিক তার পাশে জড়াে করতে সক্ষম হয়েছেন।
জিয়া এই সময় বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও, এনসিও, এমনকি সেপাইদের প্রতিনিধিদের সাথে অফিসে, বাসায়, ঘনঘন সরাসরি আলােচনা চালিয়ে তাদের বুঝাতে থাকেন। আমি লগ এরিয়া কমাণ্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করে পরদিন থেকে একা একাই স্টাফ-কার। নিয়ে ঢাকার ইউনিটগুলােতে চক্কর দিতে থাকি।সিগন্যালস, সাপ্লাই ব্যাটালিয়ন, মেডিক্যাল, অর্ডিন্যান্স, ইএমই, বেইজ ওয়ার্কশপ, সিওডিএমপি সবগুলাে ইউনিটেই অরাজক অবস্থা। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ইউনিটগুলাের সৈনিকদের মুখােমুখি হয়ে তাদের বুঝাতে থাকি। এসব ইউনিটগুলাের সৈনিকদের বেশীরভাগই ছিল শিক্ষিত। তারা ১২ পয়েন্ট দাবির যৌক্তিকতার কথা সর্বত্র আমাকে তুলে ধরল। ব্যাটম্যান প্রথা, তাদের বেতন ভাতা, তাদের ধীরগতি প্রমােশন, তাদের বাসস্থান, তাদের পজিশন ইত্যাদি সবগুলাে পয়েন্টই ছিল যথার্থ। আমি বললাম, আমিও তােমাদের অধিকাংশ দাবি সমর্থন করি। আমি নিজে চীফকে অনুরােধ করবাে এগুলাে মেনে নিতে। তারা বলল ; স্যার, জেনারেল জিয়াকে আমরা মুক্ত করেছি, খালেদকে মেরেছি, কিন্তু তিনি এখন আমাদের দাবিগুলাে মানতে অস্বীকার করেছেন। তিনি কথা দিয়ে কথা ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমি ব্যারাকে গিয়ে তাদের বুঝাতে লাগলাম, জিয়া এসব দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। তিনি আইন শৃঙ্খলা ফিরে আসলেই এক এক করে ব্যবস্থা নিবেন। তাকে একটু সময় দিতে হবে। তারা আশ্বাস দিলাে আর কোন গণ্ডগােল হবে না। | সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টে। ফাইটিং ইউনিট, শক্তিশালী ট্যাংক। ১৩ তারিখ উন্মুক্ত মাঠে পুরাে ইউনিটের ছয়-সাতশাে সৈনিকদের একত্র করে তাদের সামনে ভাষণ দিলাম। তাদের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল মােমেনও ছিলেন। তাদের কাছে আকুল অনুরােধ জানালাম অস্ত্র নামিয়ে শখলায় ফিরে আসতে। তারা বেশ ক’টি প্রশ্ন রাখল, বললাে জিয়াউর রহমান কথা রাখেন নাই। প্রকাশ্যে মিটিং-এ দু’তিন জন বিভিন্ন প্রশ্ন তুললাে। বিপ্লবী সুবেদার সারওয়ার কড়া দাবি রাখলাে। আমি সবাইকে আশ্বাস দিয়ে আশ্বস্ত করলাম। তারা শান্ত থাকবে বলে আমাকে হাত তুলে কথা দিলাে। কথা দিলাে এখন আর কোন গণ্ডগােল করবে না। আমি সেখান থেকে সরাসরি জিয়ার কাছে আর্মি হেডকোয়ার্টার-এ গেলাম এবং তাকে ল্যান্সার সৈনিকদের সাথে আমার মিটিং এর কথা অবগত করলাম। জেনারেল শওকত বসে ছিলেন। তিনি ঐ মুহুর্তে ব্যাহতঃ সি জি এস-এর দায়িত্ব পালন করছিলেন। শওকত বললেন, এদের তােষামােদ করে কোন লাভ নেই। জিয়াও তাকে সমর্থন করলেন, বললেন ; হ্যা, আর তােষামােদ নয়, আমি তাদের ইফেন্ট্রি ডিভিশন দিয়ে ঠাণ্ডা করবে। Just wait and see. আমি বুঝলাম এসব দরকার হবে না। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন এমনিতেই শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি আমার সাথে দ্বিমত পােষণ করলেন। শওকতের কথাই ঠিক, তিনি বললেন।
এ কয়দিন আমি প্রতিটি বিদ্রোহী ইউনিটে ছুটে বেড়ালাম। সবখানেই সৈনিকরা আমাকে অকপটে শান্ত থাকবে বলে কথা দিলাে। অবস্থার উন্নতির প্রেক্ষিতে আমি লগ এরিয়ার সকল অফিসারদের ইউনিটে ফিরে আসার জন্য শক্ত নির্দেশ পাঠালাম। প্রায় সবগুলাে ইউনিটেই অফিসাররা ফিরে আসলেন। অনেকে ফ্যামিলি নিয়েও ক্যান্টনমেন্টে ফিরলেন। অনেক ইউনিটে জেসিও এবং সৈনিকরা নিজেরা গিয়ে গাড়ী করে অফিসারদের সসম্মানে ফিরিয়ে আনলাে। | আমার অধীনস্থ লগ এরিয়ার ১৩টি ছােট বড় ইউনিটগুলাের সৈনিকরাই ছিল সবচেয়ে বেশী বিদ্রোহী। ১২ তারিখ থেকে বেশীরভাগ অফিসার ক্যান্টনমেন্টে নিজ নিজ ইউনিটগুলােয় ফিরে আসতে শুরু করেন। ১৪/১৫ তারিখের দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাে। এবার সেপাই-অফিসার ভাই ভাই সৈনিকগণ তাদের অফিসারদের আবার যথাযথ সম্মান দেখানাে শুরু করলাে। তাদের পূর্ব ব্যবহারের জন্য সবাই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। প্রায় প্রতিটি ইউনিটে এখন সৈনিকগণের সাথে অফিসারদের প্রীতিভােজ অনুষ্ঠান করে পুনর্মিলন পালন করা হলাে। রক্তাক্ত যুদ্ধের পর এসেছে শান্তি। এবার সেপাই-অফিসার ভাই ভাই। করমর্দন, গলাগলি, কোলাকুলি, হাসি মশকরা—সর্বত্র আনন্দমুখর দৃশ্য। এসব দৃশ্য এখন মনে হলে রীতিমত হাসির উদ্রেক হয়। এই সময় জেনারেল জিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আমি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সবগুলাে বিদ্রোহী লগ এরিয়া ইউনিট পরিদর্শনে গেলাম। অবশ্য আমার ইউনিটগুলােতে নিয়ে যাওয়ার আগে জিয়া বারবার আমাকে বলে দেয়, কোন সেপাই তার কাছে ১২ দফার দাবির কথা তুলতে পারবে না। তাদের দাবি শুনতে শুনতে সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। অতএব আমি আগে থেকেই সিনিয়ার জেসিওদের সেইভাবে নির্দেশ দিয়ে রাখি। COD’র বিশাল অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়ে গিয়েছিল। এসব লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়েই গত কদিন ধরে বিপ্লবীরা সারা ক্যান্টনমেন্টে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। আমাকে নিয়ে সি-ও-ডি ভিজিটে গিয়ে এসব অবস্থা দেখে তাদের অফিসারদেরকে সেপাইদের সামনেই দারুণ বকাবকি করলাে। তাদের কমান্ডার কর্নেল বারী অনুপস্থিত ছিলেন। ডাইরেক্টর কর্নেল মান্নান সিদ্দিকীকে (পরে জেনারেল) সামনে পেয়ে খুব একচোট নিলাে। বলল, এখানে তােমরা সব অফিসার মেরুদণ্ডহীন।
একজন অফিসার সেপাইদের সামনে দাড়ালে এমনটি ঘটতাে না। জিয়া এই সময় বিভিন্ন ইউনিট পরিদর্শনে যাওয়ায় নিয়ম-শৃংখলার দ্রুত উন্নতি ঘটল। অফিসারদের মধ্যেও প্রবল সাহসের সঞ্চার হলাে। সবাই বুঝতে পারল সেনাপ্রধান এখন আর অসহায় নন, তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে সক্ষম। এর ফলে ইউনিট কমাণ্ডাররাও দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠল। এসব পরিস্থিতে বুদ্ধিমানরা সুযােগের অপেক্ষায় থাকে। বিভিন্নজন বিভিন্ন মতলবে এবার জোট বেধে সেনাপ্রধানের কাছে ভেড়ার প্রতিযােগিতায় নেমে পড়ল, তারাও যারা ক’দিন আগেও জিয়ার নাম শুনলেই নাক সিটকাতাে। এই সময় এই পরিস্থিতিতে ব্রিগেডিয়ার শওকত তার স্বকীয় স্টাইলে জেনারেল জিয়ার পাশে শক্তভাবে অবস্থান নিয়ে জিয়াউর রহমানকে গাইড করতে থাকেন। তিনি ৫ তারিখ যশােহর থেকে ঢাকায় আসেন খালেদ মােশাররফের মিটিং-এ যােগদান করতে। ৬/৭ তারিখ রাত্রে সৈনিকরা তাকে ধরে জিয়ার কাছে নিয়ে আসে। ঢাকায় এসেই তার লবিং শুরু হয়ে। যায়। তিনি জিয়াউর রহমানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটি নূতন নবম ডিভিশন সৃষ্টি করে তাকে প্রমােশন দিয়ে ডিভিশন কমান্ডার বানিয়ে ঢাকায় একটি অনুগত বাহিনী সৃষ্টি করার তদবির করতে থাকেন। কদিন পর এরশাদ ঢাকা আসলে তিনিও তার বন্ধু শওকতের প্রমােশনের প্রতি জোর সমর্থন দেন। জিয়া তার যুক্তি ও চাতুর্যপূর্ণ কথায় সায় দেন। গড়ে ওঠে নূতন নবম ডিভিশন। শওকত পমােশন নিয়ে হলেন মেজর জেনারেল। এই সময় শওকত আকস্মিকভাবে জিয়াকে আঁকড়ে ধরে খুবই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এরশাদের আগমনে তার নাটের বাধন আরাে শক্ত হয়ে উঠলাে। তারা দুজন তখন হরিহর আত্মা। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম; যশােহর থেকে যে কমান্ডার খালেদ মােশাররফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উল্কার। বেগে ঢাকায় ছুটে আসেন, তিনি একদিনেই লেবাছ পরিবর্তন করে স্রেফ বাকপটুতার যাদুমন্ত্রে জিয়ার শুভাকাংখী সেজে তার পদতলে স্থান করে নেন। জিয়াকে তিনি বােঝালেন, আমিতাে স্যার আপনাকেই উদ্ধার করতে ঢাকায় এসেছিলাম।
এরশাদের আগমন
ভারতের নয়াদিল্লীতে একটি কোর্সে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার এরশাদ। তার কোর্স অসমাপ্ত রেখেই শওকত তার বন্ধুবর এরশাদকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে তৎপর হন। তাই হলাে ; কোর্স। অসমাপ্ত রেখেই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন জিয়াউর রহমান। কোর্সের মধ্যেই তাকে মেজর জেনারেল র্যাংকে প্রমােশন দেওয়া হয়। এক বছরে তার দু’টি বড় প্রমােশন! এ-নিয়ে সৈনিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলাে। ঢাকায় এনে জিয়া তাকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ বানালেন। এরশাদের তড়িৎ প্রমােশন নিয়ে সৈনিকদের অসন্তোষের কথা জেসিও-দের মারফত জিয়া জানতে পারলেন, কিন্তু তখন কিছু করবার ছিল না। আমাকে ডেকে জিয়া বললেন, হামিদ তুমি এরশাদকে সাথে নিয়ে। তােমার ইউনিটগুলাের সৈনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দাও। ওর ব্যাপারে জওয়ানরা কিছু প্রশ্ন তুলেছে। বেচারা ‘সাদাসিধে নম্র মানুষ। কিন্তু দেখাে, ব্যাটারা কি সব প্রশ্ন তুলেছে। তার কথা শুনে আমার ফিক করে হাসি উঠল। জিয়া বলল ; কেন, তােমার তকলিফটা কি? বললাম, কিছু না। এমনিতেই হাসলাম। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলে তার ঐ কথাটি তখন আমার বারবার মনে পড়ছিল। | যাক, পরদিনই মেজর জেনারেল এরশাদকে সাথে নিয়ে আমার লগ এরিয়া। ইউনিটগুলাের ভিজিটে বের হলাম। এরশাদকে প্রথমে ‘ইনফরমালী’ ইউনিটগুলােতে নিয়ে ঘুরলাম। এরশাদ ছিলেন তখন সাধারণ সৈনিকদের কাছে একেবারেই একটি অজ্ঞাত নাম। অথচ জিয়ার বদৌলতে তিনি একলাফে সামনের কাতারে। জিয়ার এই সাদাসিধে নম্র বেচারা মানুষটিই দেখতে দেখতে একদিন পূর্ণ ব্যাঘ্রে পরিণত হয়েছিল! | প্রথম ভিজিটিং ইউনিট ছিল মেডিক্যাল ব্যাটালিয়ন ও সিএমএইচ। সৈনিকদের একত্র করা হলাে। তিনি কোনমতে দু-চারটি কথা আওড়ালেন। মেডিক্যাল ডাইরেক্টর কর্নেল খুরশিদ আমার পাশে বসা ছিল। আমাকে খোঁচা মেরে বললাে; হামিদ ভাই, জওয়ানদের দেইখ্যা ওর ডর লাগতাছে নাকি? ভেতরে হাওয়া একটু কম মনে হইতাছে। বললাম ; দেখেন, দুদিন গেলেই আপনা-আপনি ফুলে উঠবে।
| সবাই এরশাদকে প্রথম প্রথম তাই ভেবেছিল। কিন্তু কথায় বলে ; ক্ষমতার উত্তাপ, বলবর্ধক, বীর্য বর্ধক। তাই পরবর্তিতে তার ফুলে উঠতে মােটেই সময় লাগেনি। | ৯ নভেম্বর, জাসদের রব, জলিল প্রভৃতি নেতৃবৃন্দকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হলাে। শুধু মুক্তি নয়, জিয়া তাদের সাথে রীতিমত আলােচনা চালাতে শুরু করলেন। জাসদের নীতিমালা মানতে জিয়া রাজী হলেন না। ফলে আলােচনা ভেঙে গেল। তাহেরের জাসদ বিপ্লবী গ্রুপ আবার ভেতরে বাইরে শক্ত আঘাত হানতে তৈরী হতে লাগল। কিছুদিন পর একদিন জিয়া টেলিফোন করে বলল ; হামিদ, আজ রাতে তােমার লগ এরিয়া ইউনিটগুলােকে সাবধান থাকতে বলাে। বললাম, কি হয়েছে? সে বলল, আগামীকাল শুনতে পারবে।
পরদিন খবরের কাগজে খবর বেরুলাে ; জাসদের রব, জলিল, শাহজাহান সিরাজ, তাহের প্রমুখদের আবার গ্রেফতার করা হয়েছে। সকালবেলা জিয়া আমাকে ফোন করে বললাে, পত্রিকা পড়েছে? বললাম, হ্যা। জিয়া টিটকিরি কেটে বললাে, তােমার শিক্ষিত ইউনিটগুলােতেই ওদের আস্তানা। ওদের ঝটপট পাকড়াও করাে, আর জেলে ঢুকাও। ব্যাটাদের আমি বিপ্লব দেখিয়ে ছাড়বাে। আমার অধীনস্ত লগ এরিয়া ইউনিটগুলাের অশান্ত সৈনিকবৃন্দ তখন সবাই শান্ত, সুশখল হয়ে এসেছিল। কাকে ধরবাে, কাকে জেলে ঢুকাবে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি তাকে কোন শক্ত এ্যাকশনে না-যেতে অনুরােধ করলাম। জিয়া অধীর, অস্থির, উত্তেজিত। পরবর্তীতে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করা হলাে। বিশেষ মার্শাল-ল আদালতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিয়ারই কোর্সমেট ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার। ট্রাইবুনালের অন্যান্য সদস্য ছিলেন : উইং কমাণ্ডার রশীদ, কমাণ্ডার সিদ্দিক আহমদ, ম্যাজিষ্ট্রেট আবদুল আলী ও হাসান। তড়িঘড়ির বিচারে কর্নেল তাহেরের ফাসি হলাে। ১৭ জুলাই ৭৬ তার ফাসির রায় দেওয়া হয়। ২০ জুলাই প্রেসিডেন্টের কাছে তার ক্ষমার আবেদন নাকচ হয়। ২১ জুলাই কাকডাকা ভােরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তার ফাসির আদেশ কার্যকর করা হয়। তাড়াহুড়ার ফাসিতে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি গুরুতরভাবে লংঘন করা হলাে। এভাবেই ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বরের বিপ্লবী নেতা কর্নেল তাহের বীর উত্তম, ফাসির কাষ্ঠে কুলে প্রাণ বলি দিয়ে জিয়ার সাথে তার বন্ধুত্বের ঋণ পরিশােধ করলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনিই প্রথম অফিসার যাকে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিতে হলাে। দিনটি ছিল ২১ জুলাই ১৯৯৫ ইং। একদিন সেনাসদর থেকে জেঃ এরশাদ ফোন করে বললেন, ৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থানকারী বিদ্রোহী অফিসারদের ট্রায়াল শুরু করা হবে। লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টারের তত্বাবধানে ট্রায়াল হবে। চীফ বলেছেন, আপনাকে সব অভিযুক্ত অফিসারদের চার্জশীটগুলাে সাইন করে বাকি ব্যবস্থা নিতে। আমি বললাম, দয়া করে এসব ট্রায়ালের ঝামেলায় আমাকে ফেলবেন । এছাড়া আমি কেন এসব চার্জশীট সাইন করতে যাবাে? কিছুক্ষণ পরই জিয়ার ফোন এলাে; হামিদ, তােমরা কেন এরশাদের সাথে সহযােগিতা করাে না? Culprit-দের চার্জশীট তােমাকেই সাইন করতে হবে। ট্রায়াল পরে দেখা যাবে। জিয়া ফোন করার পরদিনই লেঃ কর্নেল (অবঃ) আজিজ একগাদা তৈরী চার্জশীট বগলদাবা করে আমার অফিসে এলেন এবং পাঁচ মিনিটেই সবগুলাে সাইন করিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। পরবর্তিতে এ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার রউফ, শাফায়েত জামিল প্রমুখরা আমার উপর নাখােশ ছিল ; তারা ভেবেছিল আমিই বুঝি তাদের চার্জশীট তৈরী করেছি। যদিও আসলে এগুলাে তৈরী করা হয়েছিল সেনাসদরে JAG ব্রাঞ্চে এরশাদেরই তত্ত্বাবধানে।
এর ক’দিন পরই জিয়ার ফোন এলাে, বললাে, হামিদ, ৩ নভেম্বরের চক্রান্তকারী ১১ জন অফিসারের কেন ট্রায়াল শুরু করছাে না? বললাম, আমিতাে তাদের চার্জশীট সই করে দিয়েছি। এখনতাে এরশাদই ব্যবস্থা করবে। বলল ; তাহলে, তুমি ওদের গিয়ে দেখে আসাে। ওদের সিকিউরিটি ব্যবস্থা ঠিক নয়। গড়বড় আছে। আসলে ওরা ডি জি এফ আই’র তত্ত্বাবধানে ছিল শেরেবাংলা নগরে প্রধানমন্ত্রীর ভবনে। তবু আমি জিয়ার কথায় তাদের দেখতে গেলাম। ওখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল মেজর হফিজউদ্দিন, মেঃ জাফর ইমাম, মেঃ গাফফার, মেঃ ইকবাল, মেঃ আমিন, মেঃ নাসের সহ আরও ক’জনকে—সবার নাম মনে পড়ছে না। তাদের সাথে কথা হল। ট্রায়াল নিয়ে তারা চিন্তায় ছিল। কি হয়, কি না-হয়। সবাই তরুণ অফিসার। তাদের ছিল একগাদা অভিযােগ। খাট নাই। পালংক নাই ফ্যান। নাই, ভাল খানা নাই। আমরা এজন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? মেজর জাফর ইমামের কণ্ঠই সবাইকে ছাড়িয়ে। তাদের যথাসম্ভব আবাস দিয়ে ফিরে এলাম। কি আশ্চর্য। আমার ভিজিটের একদিন পরই মেজর হাফিজউদ্দিন ও তার ডায়রা মেজর ইকবাল উচু দেয়াল টপকে বন্দীশালা থেকে পালিয়ে গেল। চারিদিকে হৈ চৈ। আমি জিয়াকে ঘটনা রিপাের্ট করলাম। সে বলল, এটা তােমার নেগলিজেন্স’। আমি আজও হিসাব মেলাতে পারিনা, জিয়া কর্তৃক আমাকে ওদের দেখতে যাওয়ার নির্দেশ এবং পরদিনই ওদের। পলায়নের মধ্যে যােগসূত্রটি কি? সেপাই বিদ্রোহের পক্ষকালের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মােটামুটি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে। এলাে। সেপাইরা ব্যারাকে ফিরে গেছে। অফিসাররা ইউনিটগুলােতে কাজকর্ম শুরু করেছে। সেপাইরা লুট করা অবৈধ অস্ত্র-শস্ত্র জমা দিয়েছে। বিপ্লবী সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার লগ এরিয়া ইউনিটগুলােই ছিল সবচেয়ে বেশী বিদ্রোহী। তারা সবাই শান্ত হয়ে এসেছে। সংঘর্ষের পথে জিয়া সর্বত্র শান্তি বিরাজমান। এবার শুরু হলাে চক্রান্তবাজ স্বার্থান্বেষী অফিসারদের আসল খেলা।
জিয়াউর রহমানের মাথায় ঢুকানাে হলাে ভিন্ন চিন্তা : রক্তপিপাসু এসব ১২ দফার সৈনিকদের এক্ষুণি শায়েস্তা করতে হবে। তা না হলে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবার বিদ্রোহ করবে। এদের শক্তি এখনই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তার পাশে এখন বড় বড় উপদেষ্টাগণ জড়াে হয়েছেন। এসেছেন যশােহর থেকে মীর শওকত আলী। তিনি ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকায় নবম ডিভিশন গঠন করে হয়েছেন জেনারেল। দিল্লী থেকে উড়ে এসেছেন হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও তড়িৎ প্রমােশন নিয়ে মেজর জেনারেল। এসেছেন | দিল্লী থেকে ব্রিগেডিয়ার মথুর। বার্মা থেকে ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম। CMH থেকে ভাংগা পা নিয়েও উঠে এলেন কর্নেল মইনুল হােসেন। তারা সবাই জেঁকে ধরেছেন জিয়াকে। হালুয়া। রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ির ধূম। | সেপাইদের চাপে পড়ে ইতিমধ্যে জিয়াউর রহমান বহু অপমান সহ্য করেছে। তারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিপ্লবীদের সাথে যােগ দিয়ে সেপাইরা তাকে দিয়ে ১২ দফায় সই করতে বাধ্য করিয়েছে। ইতিমধ্যে চাপ সৃষ্টি করে ব্যাটম্যান প্রথা বিলােপসহ বেশ কয়টি সুবিধা আদায় করিয়ে নিয়েছে। আর নয়। | ডেপুটি চীফ জেনারেল এরশাদ আর নবম ডিভিশন-কমাণ্ডার জেনারেল শওকত এখন প্রধান মন্ত্রণাদাতা। তাদের যাতাকলে আবদ্ধ জিয়াউর রহমান। তাদের পরামর্শেই এখন উঠেন। বসেন জিয়াউর রহমান। এবার ১২ দফা দাবিদারদের শায়েস্তা করার পালা। তারা নিজ স্বার্থেই জিয়াকে দ্রুত সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিলো। একদিন জিয়া বলল, আমি ঢাকা থেকে সিগন্যাল ইউনিটকে অতিসত্বর সরাতে চাই। এরা বেশী শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। আমি তাকে বুঝালাম, এরকম করা এখন ঠিক হবে না। অসন্তোষ বাড়বে। এসব কাজ কিছুদিন পরে করলেও চলবে। এখন করলে সবাই আবার বিগড়ে যাবে। তােমারই সমস্যা হবে। | সে কিছুই শুনলাে না। বলল, দেখাে আমি কিভাবে তাদের সােজা করি।
আর্মি হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে সিগন্যাল ইউনিটকে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে বলা হল। এ নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হলাে। প্রথমে তারা যেতে অস্বীকার করলাে। তবে শেষ পর্যন্ত সু-কৌশলে প্রীতিভােজ, চা-চক্র ইত্যাদির মাধ্যমে কাজ সেরে নেওয়া হল। তারা অসন্তুষ্ট হল বটে। তবে জিয়ার নির্দেশ মানতে তাদের ছলে-বলে-কৌশলে বাধ্য করা হলাে। সৈনিকরা জিয়ার মতিগতি নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠল। | ২০ নভেম্বর ছিল জেনারেল জিয়াকে নিয়ে আমার বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট ভিজিট করার পূর্ব নির্ধারিত প্রােগ্রাম। আমি ১৯ তারিখ দুপুরে জিয়াকে ফোন করে প্রােগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই বলল, আমি ঐ বেয়াদপ ট্যাংকওয়ালাদের ভিজিট করবাে না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ; কেন, কি হয়ে গেল? বলল ; হামিদ, তােমার বেঙ্গল ল্যান্সার সবচেয়ে উজ্জ্বল ইউনিট। এদের আমি ঢাকা থেকে বগুড়া পাঠাবাে। তাদের ঢাকায় রাখা যাবে না। তুমি মঞ্জুরের সাথে কথা বলাে, সে ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্পষ্ট বুঝলাম উধমার্গে নূতন চক্রান্ত শুরু গেছে। বললাম—এদের এখন মুভ করানাে উচিত হবে না। তারা ‘রি-অ্যাক্ট’ করবে। এদের বহু কষ্টে শান্ত করা হয়েছে। জিয়া রেগে গেল; বলল, আমি জানি ‘ইউ আর ট্রাইং টু বিকাম পপুলার’। আমি সব বুঝি। কিন্তু তারা যাবেই। আমি বললাম, তাহলে আমার লগ এরিয়া কমান্ড থেকে এই ইউনিটটি সরিয়ে নাও। আমি তাদের এরকম অর্ডার দিতে পারবাে না। কারণ আমি জানি এতে একটা গণ্ডগােল বাধবেই। যারা তােমাকে অ্যাডভাইস দিয়েছে, তারা ঠিক কাজ করেনি। সে বলল, হামিদ আমি সব বুঝি। সব খবর রাখি! ও, কে ; আজ থেকে বেঙ্গল ল্যান্সার তােমার কমাণ্ডে নয়। আমি হেডকোয়ার্টারে। সরাসরি কমান্ডে আসলাে। তুমি চিঠি পেয়ে যাবে। পরদিনই আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে জরুরী একটি ছােট্ট চিঠির মারফত লগ এরিয়া হেডকোয়াটারকে জানিয়ে দেওয়া হলাে, বেঙ্গল ল্যান্সার এখন থেকে সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হলাে। ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) মঞ্জুর তখন সি, জি, এস,। চিঠির সাথে সাথে সে আমাকে ফোন করেও এই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে দিয়ে। বলল ; দাদা, (আমাকে বরাবর শ্রদ্ধা করে সে ‘দাদা’ বলেই সম্বােধন করতাে) আমি আপনার ঘাড়ের বােঝা কিছু হাল্কা করে দিলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম ; মঞ্জুর, ব্যাপারটা আমি জানি। Thank You and wishing you best of luck with Tankers. খুব সম্ভব জেনারেল মঞ্জুরের সাথে আমার এটাই ছিল শেষ কথােপকথন। দঢ় চরিত্রের অধিকারী সেনাবাহিনীর এই প্রতিভাবান অফিসারটি পরবর্তিকালে চট্টগ্রাম সেনা অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে নিহত হন। তার সাথে বােধকরি আমার আর দেখা হয়নি। যাই হােক, এবার শক্ত এ্যাকশন নেওয়ার পালা। তাদের নির্দেশ দেওয়া হলাে, ঢাকা ত্যাগ করে বগুড়া মুভ করার জন্য। বলা হলাে, এটা ট্যাকনিক্যাল মুভ। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য বুঝতে ল্যান্সার সৈনিকদের মােটেই কষ্ট হয় নাই।
তারা জিয়ার নির্দেশ মানতে অস্বীকার করল। শুরু হলাে নূতন গণ্ডগােল। ল্যান্সার সৈনিকরা আবার অস্ত্র হাতে গর্জে উঠল। ট্যাংকগুলাে সচল করে আবার তারা লড়তে তৈরী হয়ে গেল। তারা সেনা হেডকোয়ার্টার গুড়িয়ে দেবে। শওকত-এরশাদ জিয়ার কানে দিলাে, এসবই লগ এরিয়া কমাণ্ডারের চাল। ২২ নভেম্বর। ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। যে কোন মুহূর্তে গােলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে।
আবার মহা সংকটে জিয়া।
তাকেই একা অবস্থা সামাল দিতে হচ্ছে সব সমস্যা। অন্য কোন অফিসারকে কেউ মানছে না। এবার তাে ল্যান্সাররা জিয়াকেও মানছে না। বেগতিক দেখে জিয়া ক্যান্টনমেন্ট অডিটরিয়ামে ঢাকায় সকল ইউনিটের সুবেদার মেজর, সিনিয়ার সুবেদারদের ও সৈনিক প্রতিনিধিদের জরুরী সভা আহ্বান করলেন। চীফ অব স্টাফ জিয়া তাদের সবার কাছে ল্যান্সার ইউনিটের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করার কথা বর্ণনা করে বললেন, আপনারা আমার কোন নির্দেশ মানছেন না, আমি আর অপমান সইতে পারি না। আমি আর আপনাদের চীফ থাকছি না। বলে সবার সামনে স্টেজে কোমর থেকে বেল্ট খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেন। সামনের সারিতে বসা জেসিওরা ছুটে এলেন ; স্যার, স্যার, করেন কি। তারা তাড়াতাড়ি মাটি থেকে তুলে আবার তার বেল্ট পরিয়ে দিল। ল্যান্সার ইউনিটের বিপ্লবী সুবেদার সারওয়ার নিজেই এসে বেল্ট লাগাতে সাহায্য করল। সবাই হাত মেলালাে, জিয়ার সাথে কোলাকুলি করলাে। এই সুযােগে জিয়া একখানি কোরান শরীফ (যা আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখা ছিল) এনে সব জেসিওকে চুইয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন, তারা শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। নির্দেশ মানবে। জিয়া নিজেও পবিত্র কোরান ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন। _ জিয়ার চাতুর্যপূর্ণ এই নাটক টনিকের মত কাজ দিলাে। ঢাকা স্টেশনের সব ইউনিটের জি,সি,ও,’রা তাদের যুদ্ধংদেহী ল্যান্সার ভাইদের বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে বগুড়া মুভ করাতে রাজী করালেন। একটি বিরাট গণ্ডগােলের ফাড়া থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কোনমতে সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেল, শুধুমাত্র জিয়ার কূটবুদ্ধিতে। চাটুকদার অফিসাররা জিয়াকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। অথচ একটা সংঘর্ষ বাধলে তারাই সবচে খুশী হতাে। | ২৩ তারিখ শক্তিশালী বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্ট ঢাকা ত্যাগ করে বগুড়া চলে গেল। আর্মি হেডকোয়ার্টারে সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাে। জিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। এবার ক্যান্টনমেন্টে জিয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলাে। তাকে চ্যালেঞ্জও করার কেউ রইলাে না। এই সময় ক্ষমতার আবর্তে জিয়া গভীরভাবে আটকে পড়েন। ক্ষমতায় বসেও শান্তিতে নেই জিয়া। চারিদিকে বিদ্রোহ। সৈনিকদের বিরুদ্ধাচারণ। ক্ষমতা নিরংকুশ করতে পাগল হয়ে উঠেন জিয়া। তার অবস্থা ভাল করে বুঝতে পারে চতুর পার্শ্ব-চররা। তারা বুঝতে পারে জিয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতার মসনদ থেকে যে কোন মুহূর্তে সে ছিটকে পড়তে পারে। তারপর কে কে? ঐ মুহূর্তে জিয়ার পাদপাথে থেকেই এরশাদ, শওকত ভয়ানক ক্ষমতার দ্বন্দে মেতে ওঠে। এবার মঞ্জুরও যােগ দেয়। প্রদীপের নীচেই চলে গােপন খেলা। জিয়া যতােই ক্ষমতা নিরংকুশ করতে কঠোর হয়ে উঠেন, তারা ততােই তাকে পরিণতির দিকে ঠেলতে থাকে। তিন খলিফার’ মধ্যে নেপথ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে নিরবে, অতি সন্তর্পণে। জিয় কালাে চশমার আড়াল থেকে ব্যাপারটা কিছুটা অনুধাবন করলেও তখন তেমন পাত্তা দেননি।
১৫ তারিখের দিক থেকে মােটামুটি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। অফিসাররা সবাই ক্যান্টনমেন্টে তাদের ফ্যামিলি ফিরিয়ে এনেছেন। অফিসার-সেপাই সম্পর্ক সুন্দর হয়ে উঠলাে। সবার মুখে হাসি-খুশী। ইউনিট, হেডকোয়াটার সর্বত্র স্বাভাবিক কাজকর্মে মুখরিত হয়ে উঠল।
শান্ত-সুন্দর পরিবেশ অনেকের পছন্দ নয়। ফাইটিং পরিবেশে শক্তি প্রদর্শনের সুবিধা হয়। সৈনিকদের দাবি-দাওয়া তাদের চাপের মুখে তখন বেশ কিছু মেনে নেওয়া হয়েছিল বটে,
তবে তাদের বিপ্লব এবং বিদ্রোহের অপমান অফিসাররা, এমনকি জিয়াও সহজে মেনে নিতে পারেননি। শীঘ্র ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক তল্লাসি ও খোজাখুজি শুরু হলো। জিয়ার এখন ভিন্নমূর্তি। জিয়া এখন শক্ত প্লাটফরমে দাড়িয়ে। জাসদ-বিপ্লবীদের সাথে আর কোন আপােষ নয়। ধৈর্য্যের বাধ তার ভেঙ্গে গেছে। বিগড়ে গেলে জিয়া ভয়ংকর !
জিয়ার সাথে বিপ্লবীদের আলােচনা ভেঙ্গে যায়। তাদের ভাষায়, জিয়া তাদের সাথে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জিয়া কঠোরভাবে জাসদপন্থী বিপ্লবীদের ও বিপ্লবী সৈনিকদের দমন করতে নির্দেশ দিলেন। শুরু হলাে ধর-পাকড়। আমাকে জিয়া একদিন ডেকে বললেন ; হামিদ, তােমার লগ এরিয়ার ইউনিটগুলাের শিক্ষিত সৈনিকরাই সবচেয়ে বেশী গণ্ডগােল করছে। তুমি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও। প্রতিটি ইউনিট থেকে নেতা গােছের সেপাই এন সি ও-দের লিস্ট বানিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে বুঝলাম, এই মাত্র ক’দিন আগে সেপাই বিদ্রোহ শেষ হয়েছে। এখনই এদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করলে আবার গণ্ডগােল শুরু হয়ে যাবে। আমরা দু-তিন মাস সময় নিয়ে এসব করলে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবেনা। এখন শাস্তি-চিন্তার বদলে কিছু ওয়েলফেয়ার চিন্তাভাবনা করা উচিত। পরিস্থিতির কারণে এই মুহূর্তে soft লাইন গ্রহণ করা উচিত। কমাণ্ডার হিসাবে এটা আমার আন্তরিক সাজেশন। জিয়া মাথা গরম PC96789, I don’t take your suggestion. No compromise with discipline, আমাকে অন্যান্য সিনিয়র অফিসাররা আগেই বলেছে, তােমার দ্বারা সেপাইদের মধ্যে ডিসিপ্লিন আনা সম্ভব হবে না। তুমি ‘পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমি ল্যান্সারকে শায়েস্তা করেছি। তুমি পারাে নাই। আমি বাকীদেরকেও সােজা করে ছাড়বাে। আসলে জিয়া তখন এমনই ক্ষেপে গিয়েছিলাে যে অন্ততঃ লগ এরিয়ার সব সৈনিকদেরই। সে মনে করছিল জাসদপন্থী বিপ্লবী প্রভাবিত। জিয়ার আচরণ যেন কেমন হয়ে গেল। সে আমাকে সন্দেহ করতে লাগলাে। কোন কারণ ছাড়া খামাকাই তার সাথে আমার সুসম্পর্কের হঠাৎ অবনতি ঘটলাে। শওকত ও এরশাদের কুমন্ত্রণায়ই জিয়া আমাকে ভুল বুঝেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বলাবাহুল্য, সেপাই বিদ্রোহের কঠিন সময়কালে জিয়াই আমাকে নিজে তার অফিসে ডেকে ঢাকার বিদ্রোহী ফরমেশন লগ এরিয়ার কমান্ড দিয়েছিল। বন্ধু হিসাবে রাত-দিন খেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি বিদ্রোহী ইউনিটে ছুটে গিয়ে সৈনিকদের ভাষণ দিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে রক্তাক্ত পথ পরিহার করে শখলার পথে ফিরিয়ে আনতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করি।
ঢাকার বিদ্রোহী ইউনিটগুলাের তৎকালীন কমান্ডার হিসাবে এটা ছিল অবশ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য, কোন আবেগের তাড়না নয়। এই সময় ক্যান্টনমেন্টে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে জিয়ার পাশে দাড়িয়ে ৪৬ বিগ্রেডের নূতন কমান্ডার কর্নেল (পরে বিগ্রেডিয়ার) আমিনুল হকও মুল্যবান অবদান রাখেন। সৈনিকদের পক্ষ থেকে ঐ সময় অশান্ত পরিস্থিতিকে শান্ত করতে কয়েকজন অখ্যাত জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জে, সি, ও.) অমূল্য অবদান রাখেন, তাদের মধ্যে সুবেদার মেজর আনিসুল হক, আবুল বাশার, গিয়াস চৌধুরী, আবদুল দায়ান ও শফিক চৌধুরী প্রমুখদের নাম উল্লেখ করার দাবি রাখে। কঠোর পরিশ্রম আর ভাল কাজ করলে ন’৷ক এদেশে শুভাকাংখী শত্রু সৃষ্টি হয়, অনেকের চক্ষুশূল হতে হয়। আমার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলাে না। ঢাকার ভয়াবহ সেনা বিদ্রোহ স্তিমিত হলাে। সৈনিকরা ফিরে গেল ব্যারাকে। শান্ত হলাে
পরিবেশ। সর্বত্র শান্তি শান্তি। এবার এক এক করে উদয় হলেন বড় বড় হােতারা। যাদের কারাে গায়ে সেনা-অভ্যুত্থানের কঠোর দিনগুলাের সামান্য আঁচড়ও লাগেনি। প্রধানতঃ তাদের ভ্রান্ত আক্রমণাত্মক পলিসির জন্য খামাকাই শান্ত সুন্দর পরিবেশ আবার অশান্ত হয়ে উঠলাে।
আমার পদত্যাগ
দুই দোস্ত’ শওকত আর এরশাদ তখন জোট বেধে জিয়াকে আগলে রাখলেন, যেন অন্য কেউ সহজে তার কাছে ভিড়তে না পারে। তাদের প্রভাব খুবই বেড়ে গেল। দেখতে দেখতে সেনাসদরে স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালােভী অফিসারদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল। এই চক্রের প্রথম শিকার হলাম আমি। শওকত আর এরশাদ দুজনে মিলে জিয়াকে বােঝালেন, লগ এরিয়া কমান্ডার হয়ে কর্নেল হামিদ তার বিদ্রোহী সৈনিকদের কাছে দারুণ ‘পপুলার’ হয়ে গেছে। এটা আপনার জন্য ভাল লক্ষণ নয়। আপনি খেয়াল করুন। সন্দেহপ্রবণ জিয়া। তার মাথায় চক্রান্ত-ভীতিই কিছুদিন ধরে ঢুকে আছে। কান কথায় জিয়া বরাবরই বিভ্রান্ত হয়েছে। কান-কথায় প্রভাবিত হওয়া ছিল তার বড় রকমের স্বভাবগত দোষ। এবারাে ব্যতিক্রম হলাে না। ঔষধে ধরলাে। জিয়া আমাকে সন্দেহ করতে লাগল। জিয়ার ফোন আসলাে। আমাকে তার অফিসে আসতে বললাে। গত কদিন ধরে তার। কথায় বন্ধুসুলভ আচরণ ছিল না। তার কামরাতে ঢুকতেই বললাে ; দেখাে হামিদ, সেপাই ইজ সেপাই। এদের সাথে অত মাখামাখি ভাল না। বুঝলে? আমি বললাম, তা তাে বটে। কিন্তু যা বলবার তা আমাকে সােজা বলে দাও। | ‘হ্যা, তুমি তােমার কমাণ্ডে ভাল করেছ। কঠোর পরিশ্রম করেছ। আমি খুশী। তবে শওকত আর এরশাদ তােমার উপর অসন্তুষ্ট। জানিনা ওদের সাথে কি ব্যবহার করেছ। তারা শক্ত কমপ্লেইন করেছে।’ ‘কি কমপ্লেইন করেছে? আমি আমার কাজ করছি। তারা তাদের কাজ করছে। আমার কাজ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা হবে কেন?” দেখ হামিদ, এসব নিয়ে আমার এই মুহূর্তে ঘাটাঘাটি করার ধৈর্য নেই। তবে আমি তাদের চটাতে চাই না। আমি বাধ্য হয়েই তােমাকে লগ এরিয়া কমান্ড থেকে সরিয়ে নিতে হচ্ছে ।’ “থ্যাংক ইউ ভেরী মাচ। আমি তার কামরা থেকে উঠে দাড়ালাম। এর ক’দিন পর পত্র পেয়ে গেলাম। আমার স্থলে নূতন লগ এরিয়া কমান্ডার নিযুক্ত হলেন এরশাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্ডিন্যান্স কোরের সাখাতুল বারী, তাকে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার ব্যাংকে প্রমােশন দেওয়া হলাে। | প্রায় এক ডজন কর্নেলের প্রমােশন হলাে। সর্বত্র হৈ হৈ রৈ রৈ। আমার প্রমােশন আটকে রাখা হলাে। আমার জুনিয়ারদের প্রমােশন দেওয়া হলাে। আমি জেনারেল জিয়ার কাছে গেলাম। তার কামরায় আধ ঘন্টা কড়া তর্কাতর্কি হলাে। তার সাথে একটা চরম বােঝাপড়ার জন্যই গিয়েছিলাম। জিয়া আমার কোর্স মেট। আমরা মিলিটারি একাডেমীতে শুধু আড়াই বছর এক সাথেই অধ্যয়ন করি নাই, এর পরেও তার সাথে একত্রে কাজ করেছি। বাংলাদেশ আর্মি। হেডকোয়াটারে আমি মিলিটারি সেক্রেটারী। জিয়া ডেপুটি চীফ।
ডেপুটি চীফের কামরা ছিলাে আমার পাশেই। প্রায় প্রতিদিনই কথা হতাে। বিকেলে একই সাথে টেনিস খেলা। জিয়ার। দুর্দিনে এরা যখন তাকে কৌশলে এড়িয়ে চলতাে, তখন আমার সথে জিয়ার ছিলাে খােলামেলা সম্পর্ক। কি আফসােস! চক্রান্তবাজদের কান কথায় জিয়া আমাকে ভুল বুঝলাে।। তাদের ঘৃণা প্ররােচনায় প্রভাবিত হয়ে সে শুধু আমাকে লগ এরিয়া কমাণ্ড থেকেই সরালাে , আমার নিয়মিত প্রমােশনও আটকে দেওয়া হলাে। চক্রান্তের কি নগ্ন নমুনা! তার সাথে তুমুল কথা কাটাকাটি হলাে। অনেকক্ষণ বহু কড়া কথা হলাে। আমি তার টেবিলে বসে হাতেই আমার পদত্যাগপত্র লিখে দিলাম। জিয়া নরম হয়ে এলাে। সে বললাে; হামিদ, ‘ফর গডস্ সেইক’, তুই আমাকে ক’টা দিন সময় দে। বুঝ তাে আমার সবাইকে সন্তুষ্ট করে চলতে হচ্ছে। এখন আমার পাশে তাের মতাে বহু সিনিয়ার অভিজ্ঞ অফিসার দরকার। এই নে তাের পদত্যাগপত্র…বলেই। চিঠিখানা হাতে নিয়ে টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে নিচে ঝুড়িতে ফেলে দিলাে। আমি বললাম; জিয়া, যে আর্মিতে ইনসাফ নেই, আইনের শাসন নেই, চক্রান্তের শেষ নেই, যে আর্মির চীফ অব স্টাফ অবিচার করে, কাজের মর্যাদা দেয় না, যােগ্যতার মর্যাদা দেয় না, কান কথায় চলে, সে আর্মিতে আমি আর চাকুরি করবাে না। | ‘লুক হামিদ, এই সব সেন্টিমেন্টাল কথা রাখ।” না জিয়া, প্রমােশন তােমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসিনি। IfI am fit, I get it or, I dont…..’ | আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম, জিয়া বিগড়ে গেল। সেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাে। চিৎকার করে বলল ; হামিদ, আমার বিশ্বস্ত অফিসাররা প্রমাণসহ বলেছে, তুমি জওয়ানদের কাছে পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছাে। তােমার সৈনিকগুলােই আমাকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে বাধা দিচ্ছে। তুমি কোন অ্যাকশন নিচ্ছে না। শুধু প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমি বিনীতভাবে বললাম ; দোস্ত, তুমি তােমার এসব বিশ্বস্ত অফিসারদের নিয়েই সুখে থাকো। আমাকে রেহাই দাও। তবে আমার শেষ কথাটি মনে রেখাে, যারা হঠাৎ করে উড়ে এসে তােমাকে ঘিরে ধরেছে, তারাই একদিন তােমাকে ফিনিশ করবে। আমার পদত্যাগপত্র ছিড়ে ফেলেছে। আমি অফিসে গিয়েই টাইপ করে আবার পাঠাচ্ছি। প্লীজ গ্রহণ করাে। তুমি আমাকে শুধু প্রাপ্য পেনশনটি দিও। জিয়া আজ পরপারে। জানিনা আমার কথাগুলাে তাকে কেউ স্মরণ করাবে কিনা। অফিসে এসে বহুক্ষণ চিন্তায় নিমগ্ন হলাম। দরজার উপরে রেড লাইট জ্বলতে লাগল। কেউ আসতে পারছিল না। শুধু আমার পি, এ, আমার পদত্যাগপত্রের ডিক্টেশন নিচ্ছিলাে। আমরা সৈনিকদের দোষ নেই, অথচ তুচ্ছ স্বার্থ নিয়ে সিনিয়র অফিসাররা যেভাবে একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য হিংসাদ্বেষ, কেদল, চক্রান্তে লিপ্ত হয়, তা একজন সচেতন। মানুষের পক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিন। এসব অন্যায় অবিচারের সাথে আমার। বিবেক আর সন্ধি করতে রাজী হলাে না। আমি কৃত্রিম পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। আমি আমার লিখিত পদত্যাগপত্র সেদিনই সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের। কাছে আমি হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিলাম। জিয়া এর পরেও তা গ্রহণ করতে চায়নি, কিন্তু সে তখন দুই প্রতাপশালী জেনারেলের যাতাকলে আবদ্ধ। তাদের ক্রমাগত উস্কানি ও চাপে অবশেষে তা গ্রহণ করলাে। কর্নেল অমিনুল হক দুর্যোগের দিনে ৪৬ ব্রিগেডের ভারপ্রাপ্ত কণ্ডার, আমার আকস্মিক সিদ্ধান্ত শুনে দারুন মর্মাহত হলাে এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। করতে বারবার অনুরােধ করলাে। তাকে বললাম, জল বহুদূর গড়িয়ে গেছে বন্ধু। | আমি যেদিন আমার লগ এরিয়া হেডকোয়ার্টার থেকে আমার অধীনস্থ সৈনিকদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম তারা যারপরনাই ব্যথিত ও মর্মাহত হলাে। সৈনিকদের চোখে ছিল।
জল। অনেকে প্রকাশ্যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছিল। নতুন লগ এরিয়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাখাতুল বারী অফিসের দোরগােড়ায় আমাকে বিদায় জানালেন। আমার গাড়ীর পতাকা তুলে নিয়ে তার গাড়ীতে লাগিয়ে দেওয়া হলাে। একটি বেদনাভরা পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমি আমার সৈনিদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেপাইদের বিদ্রোহের কারণে সিনিয়র অফিসারদের তড়িৎ প্রমােশনের যখন অবাধ সুযােগ সৃষ্টি হয়ে গেল ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি ইউনিফর্ম ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কাতারে বেরিয়ে এলাম। এটা ছিলাে আমার জন্য ৭ নভেম্বর সেপাই বিপ্লবের বিশেষ উপহার। সুদীর্ঘ ২২ বছরের সৈনিক জীবনের সর্বশেষ প্রাপ্তি। | পদত্যাগের পর আমার জীবনধারা কঠিন হয়ে পড়লাে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এর আগে আরাে তিনজন অফিসার প্রতিবাদ করেন। মেজর জলিল, কর্নেল তাহের ও জিয়া উদ্দিন। তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। আমিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসার যে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সরকার চাকুরী ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে এসেও আমি নিরাপদ ছিলাম না। আমাকে কড়া মূল্য দিতে হয়েছিল। এরশাল চক্রের হায়েনারা আমাকে বিপদে ফেলতে বহুদিন সক্রিয় থাকে। দেখলাম, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করার চেয়ে এসব হজম করার ফায়দা অনেক বেশী। ক্ষমতা, প্রমােশন, নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকে। ক্ষমতাধরদের চক্ষুশূল হয়ে থাকতে হয় । তাদের বন্ধু হয়ে নিশ্চিন্তে বসবাস করা যায়। দরকার শুধু স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেওয়া। প্রিয় জেনারেল জিয়া। একদিনের নভেম্বর অভ্যুত্থানের জের কাটতে প্রায় এক মাস সময় লেগেছিল, কিন্তু এই একদিনের অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর দেহের অভন্তরে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে গেল, তা মুছে যেতে বহুদিন সময় লাগে। অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবের চেতনায় প্রভাবিত সৈনিকদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হলাে। সৈনিকগণ বহিষ্কার, ট্রান্সফার ও বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হলাে। সিগন্যাল রেজিমেন্টকে ঢাকার বাইরে পাঠানাে হলাে। বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটকে ঢাকা থেকে বগুড়া যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলাে। আর্টিলারি, ৩৮ লাইট এ্যাক এ্যাক প্রভৃতি ইউনিটে বিবিধ ব্যবস্থা নেওয়া হলাে। ঢাকার বেশীরভাগ বিপ্লবী সৈনিকদের বাইরে পাঠানাে হলাে। যারাই ৭ নভেম্বর বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিল তারাই হয়রানির শিকার হলাে। যদিও ঐসব অতি উৎসাহী সৈনিকদের বিপ্লবের মাধ্যমেই জিয়া ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। | এসব নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে আবার ধীরে ধীরে ধূমায়িত হতে থাকে সৈনিকদের অসন্তোষ। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই সময় জিয়া এমন ক’জন সিনিয়র অফিসারদের দ্বারা প্রভাবিত হন, যাদের মনে কস্মিকালেও সৈনিকদের স্বার্থচিন্তা স্থান পায়নি। বিপ্লবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। রংপুর, সৈয়দপুর, যশােহর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম। সর্বত্র সংগঠিত হয় একের পর এক সেনা-বিদ্রোহ। এসব জায়গায় জিয়া ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে তার পক্ষ থেকে সুবেদার, হাবিলদার এবং সৈনিক প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে তাদের শান্ত করতে সক্ষম হন।
জাসদ কর্নেল তাহেরের মাধ্যমে জিয়ার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে কোনভাবেই লাভবান
হয়নি। জিয়া তাদের ১২-দফা দাবি শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, জাসদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে নিধন অভিযান চালানাে হয়, তাতে হাজার হাজার জাসদ-কমী গ্রেফতার হয়। ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরেও বহু বিপ্লবী জাসদপন্থী সৈনিককে আটক করা হয়। ১৯ নভেম্বর জাসদের মেজর জলিল, রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখরা মুক্তি পেলেও ২৩ নভেম্বর আবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন কর্নেল তাহের। ২১ জুলাই ১৯৭৬-এ ফাসির কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বলি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে যান হিসাব-নিকাশ।
এভাবে যে জাসদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ঢুকে পুনঃজাগরণের স্বপ্ন দেখেছিল, শীঘ্র তাদের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। বিধ্বস্ত হলাে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। অগনিত সৈনিকের বুক নিংড়ানাে দোয়া ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়ার উত্থান ঘটলেও ৭ নভেম্বরের পর থেকে জিয়া তার অভিজাত পারিষদবর্গ পরিবেষ্ঠিত হয়ে অতি দ্রুত সৈনিকদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। সৈনিকদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেন প্রিয় সেনাপতি। অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠলাে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে। একের পর এক সংঘটিত হলাে বিদ্রোহ। ৭ নভেম্বর সৈনিকরা তাদের প্রিয় জেনারেলকে। গদীতে সমাসীন করার পর সংঘটিত হলাে আরাে ১৮টি ছােট-বড় সেনা-বিদ্রোহ। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশােহর, রংপুর, সৈয়দপুর-বগুড়া। কতজন প্রাণ হারালাে, ফাসিতে। ঝুললাে, জেলে গেল। শত শত পরিবারে কান্নার রােল! সর্বশেষ বিদ্রোহে প্রাণ হারালেন স্বয়ং জেনারেল জিয়া, ১৯৮১ সালে। হায় ইতিহাস। প্রিয় জেনারেল আজ নেই। আছে সেনাবাহিনী, আছে স্মৃতি। ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর পর্যালােচনা ও মূল্যায়ন (১) শতাব্দীর ব্যবধানে সংঘটিত ৭ নভে সেপাই বিদ্রোহ ছিল যথার্থই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮৫৭ সালে এই উপমহাদেশে সংঘটিত হয়েছিল সারা ভারতবর্ষব্যাপী এক ভয়াবহ সেপাই বিদ্রোহ মােগল বাদশাহ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা ও বৃটিশ শাসককে উৎখাতের লক্ষ্যে। অর্জিত হয়নি সেই লক্ষ্য। ফাসির মঞ্চে প্রাণ বলি দিতে হয় শত শত সৈনিককে। সেপাই বিদ্রোহের সময় ঢাকায় পরাজিত ও ধৃত সেপাইদের ঢাকা ময়দানে(বর্তমানে বাহাদুর। শাহ পাক) প্রকাশ্যে যাস দেওয়া হয়। | এরই ১১৮ বছর পণ ১৯৭৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হলাে আরেক ঐতিহাসিক সেপাই বিপ্লব। একই স্টাইলে, একই চেতনায়। এই সেপাই-বিদ্রোহে উৎখাত হয়েছিলেন বিগ্রেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের কর্তৃত্ব। শতাব্দীর। ব্যবধানে উভয় বিদ্রোহই সংঘটিত হয়েছিল মূলতঃ সৈনিক অসন্তোষকে ভিত্তি করে। বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ সৈনিকবৃন্দ, অফিসারগণ নয়। ৭ নভেম্বরের প্রধান লক্ষ্য ছিল— (ক) খালেদ-শাফায়েত অক্ষশক্তির উৎখাত। (খ) জিয়াউর রহমানের মুক্তি ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা। (গ) বিপ্লবী সৈনিকদের ১২-দফার ভিত্তিতে শ্রেণীহীন সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠা। অ্যুত্থানের প্রথম দু’টি লক্ষ্য সহজে অর্জিত হয়। তৃতীয় লক্ষ্য অর্জনে বিপ্লব ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে বিপ্লবের প্রধান নেতা লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের অভিযােগে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। | (২) বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তৎকালে প্রধান ইউনিটগুলো ছিল; টু-ফিলড আর্টিলারি, ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার, ৩৮ লাইট এ্যাক এ্যাক রেজিমেন্ট, টু-ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন, সাপ্লাই ব্যাটালিয়ন, সেন্ট্রাল অর্ডিন্যান্স ডিপাে, বেইজ, ওয়ার্কশপ ইউনিট, এম, পি, ইউনিট, মেডিক্যাল ব্যাটালিয়ন, সি এম এইচ বেইজ সাপ্লাই ডিপাে, আর্মিহেডকোয়াটার ব্যাটালিয়ন, স্ট্যাটিক সিগন্যাল ইউনিট, স্টেশন হেডকোয়ার্টার ও লগ এরিয়ার অন্যান্য ক্ষুদ্র ইউনিটগুলাে। ৪৬ বিগ্রেডের ৪টি ব্যাটালিয়ন মােটামুটি খালেদের পক্ষে থাকলেও পরবর্তীতে ৬/৭ তারিখ মধ্যরাতের পর সবাই অবশ্য জিয়ার পক্ষে যােগদান করে জিয়ার হাত শক্তিশালী করে। এয়ার ফোর্স ও নেভীর কোন ভূমিকা ছিল না। পরে অবশ্য নেভীর কিছু সৈনিক যােগ দেয়। এদের সাথে বাইরে থেকে যােগ দিয়েছিল কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কয়েকশত সশস্ত্র সদস্য। মূলত সামগ্রিকভাবে অভ্যুথান-প্ল্যান করেন কর্নেল তাহের ; ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিক, এন সি ও এবং জে সি ওদের সাথে সমন্বয় করে। (৩) সাধারণভাবে মনে করা হয়, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের তার বিপ্লবী | সৈনিকদল নিয়ে জিয়াকে বন্দী দশা থেকে উদ্ধার করে ক্ষমতার গদীতে বসান। ধারণাটা পুরাপুরি সত্য নয়। প্রকৃত ঘটনা হলাে, জিয়াকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে কর্নেল তাহেরের প্ল্যান প্রােগ্রাম অনুযায়ীই অভ্যুত্থান ঘটে, তবে প্রকৃত অভিযানে শুধুমাত্র জাসদের বিপ্লবী সৈনিকরাই অংশ নেয়নি। টু-ফিল্ড, ইঞ্জিনিয়ার্স, এ্যাক্ এ্যাক্ রেজিমেন্ট, লগ এরিয়ার সিগনালস্, ই-এম-ই, মেডিকেল সাপ্লাই ব্যাটালিয়ন, অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি ইউনিটগুলােও অংশগ্রহণ করে। বলা যায়, অভিযানটি ছিল বিপ্লবী সংস্থা ও সেনা ইউনিটগুলাের যৌথ অভিযান। সেনা-ইউনিটগুলাের নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রধানতঃ জেসিও এবং এনসিও’রা। অবশ্য অভ্যুত্থানের সার্বিক পরিকল্পনা করেন কর্নেল তাহের। অভ্যুত্থানের পরপরই মধ্যরাতে তাহের ও জিয়া গদী দখলের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঐ সময় দুজনের যে কোনও একজন নিহত হতে পারতেন। আশেপাশে ছিল অস্ত্রের। | ঝনঝনানি। চূড়ান্ত মুহূর্তে ক্ষমতা দখলের Tag-of-war-এ জিয়া জয়ী হন; প্রধানতঃ ফিড রেজিমেনট ও ফোর ইস্ট বেঙ্গলের অফিসার ও সৈনিকদের প্রত্যক্ষ মদদে। জিয়া বন্দীদশা থেকে মুক্ত হন সৈনিক বিপ্লবীদের যৌথ প্রচেষ্টায়। তিনি ক্ষমতার গদীতে অধিষ্ঠিত হন নিজ বুদ্ধি ও ক্ষমতার বলে, তাহেরের দয়ায় নয়। |
(8) ৭ নভেম্বরের সেপাই বিপ্লবে বারবার জনতার নাম যুক্ত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে | বিপ্লব সংঘটিত করতে অথবা জিয়াকে মুক্ত করতে জনতার কোন হাত ছিল না। শুধুমাত্র বিপ্লব সফল হওয়ার পর ৭ নভেম্বরের সকালে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিছিলকারী ধাবমান। সৈনিকদের সাথে জনতার সংযােগ ঘটে। শুরু হয় একত্র আনন্দ, উল্লাস। বলা যেতে পারে, সেই মুহূর্ত থেকে সৈনিক বিদ্রোহ রূপান্তরিত হয় ঐতিহাসিক সেপাই-জনতার বিপ্লবে। | ৫) ৭ নভেম্বরের অভাবনীয় সাফল্য সম্ভব হয়েছিল সৈনিক অসন্তোষকে পুজি করে। ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানের দিন থেকে অফিসারদের অত্যাধিক বাড়াবাড়িতে সৈনিক অসন্তোষ চরমে ওঠে। সর্বশেষ চীফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্ষমতায় আরােহণ সৈনিক অসন্তোষকে আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করে। ফলে দরকার ছিল একটি ফুলিঙ্গ-এর যা ৬/৭ তারিখের মধ্যরাতে জাসদের বিপ্লবী গ্রুপ প্রজ্জ্বলিত করতে সক্ষম হয়। অগ্নৎপাত বিস্ফোরিত হয় তৎক্ষণাৎ। (৬) ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে তাহেরের সাথে জেনারেল জিয়ার গােপন সমঝােতা সেপাই বিদ্রোহকে হিংসাত্মক বিপ্লবে রূপ দেয়। তাহেরের সাথে জিয়ার কোন সমঝােতা ছিল একান্তভাবে তাদের প্রাইভেট ব্যাপার। মুক্ত হওয়ার পর জিয়াকে টু-ফিডে নিয়ে আসা হয়। জিয়াকে ঘিরেই তখন সৈনিকদের, অফিসারদের যত আনন্দ উচ্ছ্বাস। তাদের কাছে হঠাৎ করে তাহেরের নাম ছিল বিভ্রান্তিকর। জিয়ার মুক্তির সাথে তাহের অথবা তাহেরের গােপন বিপ্লবী সংস্থার জড়িত থাকার কথা তখন কেউ কিছুই জানে না। মধ্যরাতের ঐ ঘটনাবহুল মুহূর্তে জিয়াকে ঘিরে প্রকৃত সৈনিকদের আবেগ-উল্লাসে তাহেরের শক্তি শীঘ্র টলমলে হয়ে ওঠে। জিয়ার শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। জিয়া। তাহেরের দেয়া ১২-দফা মানতে অস্বীকার করেন। তাহেরের নির্দেশ মানতেও অস্বীকার করেন। শুরু হয় প্রবল দ্বন্দ্ব। টু-ফিল্ড ইউনিটে অফিসার জওয়ান পরিবেশিত হয়ে জিয়াই তখন শক্তিশালী। যদিও ঐ সময় কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল তাহেরের বিপ্লবী গ্রুপই বুঝি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক। ঐ দিন গভীর রাত্রি ২-টায় তাহেরের প্রবল চাপে পড়ে জিয়া যদি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে চলে যেতেন, তাহলে নভেম্বরের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতাে। জিয়া ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অফিসার ও সৈনিক পরিবেষ্টিত হয়েই টু-ফিল্ডে নিরাপদ অবস্থানে থাকেন। এইভাবে তাহেরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। | মধ্যরাতে অভ্যুথানের দুই প্রধান নেতার ক্ষমতার নিরব দ্বন্দে জিয়াই জিতে গেলেন। পরাজিত হলেন কর্নেল তাহের। | (৭) চরম মুহুর্তে লক্ষ্যস্থলে পেীছে তাহের যখন দেখলেন তার হাত থেকে ক্ষমতার মসনদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখনই শুরু করা হয় অফিসার নিধন অভিযান, চরম ও সর্বশেষ পন্থা হিসাবে। ৭/৮ নভেম্বরের রাত ছিল বিভীষিকার রাত। এই নির্মম পদক্ষেপ ক্যান্টনমেন্টে ব্যাপক ভয়-ভীতির সৃষ্টি করলেও জিয়াকে ক্ষমতার আসন থেকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়। বরং পরবর্তীতে এই অভিযােগের কারণেই তাহেরকে ফাসিতে ঝুলতে হয়।
(৮) তাহের সক্রিয় কমান্ডার ছিলেন না। তিনি জেনারেল জিয়ার কাধে বন্দুক রেখে তাকে ব্যবহার করে ক্ষমতার মসনদে আরােহণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জিয়া তার চেয়ে অধিক উচ্চাকাক্ষী ও চালাক হওয়ায় তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। বরং জিয়াই তাকে পূর্ণ ব্যবহার করে তার অনুকুলে নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হন। তাহের জিয়াকে হিসাব করতে ভুল করেছিলেন। : | প্রশ্ন ওঠে ; জিয়া নিয়মতান্ত্রিক প্রফেশন্যাল সেনাপ্রধান হয়ে কেন তাহেরের গােপন বিপ্লবী সংস্থার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ালেন? সেনাবাহিনীর নীতিমালার দৃষ্টিতে এটা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত হয়েছিল? নভেম্বরের রক্তপাতের জন্য কি জিয়াই দায়ী?
ইতিহাসই এসবের জবাব দেবে। (৯) সেপাই বিদ্রোহ ১৮৫৭ সালে সেপাইদের অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন আনেনি। ১৯৭৫ সালের সেপাই বিদ্রোহেও সেপাইরা বিশেষ কোন লাভবান হয়নি। অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সাধারণ সৈনিকদের কাছে শ্রেণীহীন সেনাবাহিনীর শ্লোগান ততাে আকর্ষণীয়
হলেও তারা অন্ততঃ আমলাতান্ত্রিক অভিজাত শ্রেণীর সেনাকাঠামাে ও দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন কামনা করেছিল। তা মােটেই হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, কোন একটি অসন্তোষকে পুজি, করে সৈনিক বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও পেশাদার সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের নেতৃত্বকাঠামাে না থাকাতে তারা কোনদিন নেতৃত্ব দিতে পারে না, ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের অভূত্থান ব্যর্থ হয়।
এজন্যই জাসদ শ্রেণীহীন সেনাবাহিনীর উপর গুরুত্ব দিচ্ছিলাে। | (১০) সৈনিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অস্ত্র সমর্পণের পর নমনীয় মনােভাব প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সেপাই বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসতে না আসতেই জিয়া কিছু ক্ষমতালােভী স্বার্থান্বেষী অফিসারের ভুল পরামর্শে সহনশীলতা ও নমনীয় নীতির পরিবর্তে সৈনিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি, বদলী সহ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা শুরু করলে আবার চতুর্দিকে সৈনিক অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ছােট বড় অন্ততঃ ১৮ টি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। শত শত সৈনিক এতে প্রাণ হারায় অথবা ফাসিতে ঝুলে নির্মম মৃত্যুবরণ করে। এসবই ছিল দুঃখজনক, অনভিপ্রেত। অথচ সামান্য ধৈর্য, সহানুভূতি ও সহনশীলতার পরিচয় দিলে এসব দুঃখজনক ঘটনা এড়ানাে সম্ভব হতাে। | (১১) সময় ও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূলে থাকায় বিপ্লবের পরিধি ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে জাসদের সীমিত গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বত্র ইসলামিক ভাবাপন্ন জনতার মধ্যে আগুনের মতাে তা ছড়িয়ে পড়ে। তখন এটা গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। আর জিয়া হয়ে পড়েন সকল ধ্যান ধারণার কেন্দ্রবিন্দু। প্রবল আবেগের স্রোতে জনতার উপর জাসদ ও তাহেরের নিয়ন্ত্রণ ভেস্তে যায়। পরিস্থিতির মহানায়ক হিসাবে আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান। জাসদের যে লক্ষ্য ছিল সৈনিক-জনতার আবেগকে জাসদের শ্রেণী সংগ্রামের দিকে প্রবাহিত করা, তা ব্যর্থ (১২) যুদ্ধ জয়ে যেমন জনসমর্থন অপরিহার্য, ঠিক তেমনি যে কোন সেনা-অভ্যুত্থানেও জনসমর্থন একটি অপরিহার্য অঙ্গ।৭ নভেম্বরের অভ্যুথানে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ অভ্যুত্থানকে সেপাই-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত করে। | দেশের সাধারণ মানুষ হিংসা, রক্তপাত, হত্যা পছন্দ করে না। তাই জাসদের বিপ্লবী গ্রুপ কিছু মিটিং মিছিল করে হিংসাত্মক শ্রেণী সংগ্রামের আহ্বান জানালেও তা বৃহত্তর জনসমর্থন পায়নি। যদি পেতাে, তাহলে নভেম্বর অভ্যুত্থানের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতাে। জনতার তাৎক্ষণিক উল্লাস ছিল নাজাত বা মুক্তির। একটি হিংসাকে ঢাকতে আর একটি হিংসাত্মক বিপ্লব শুরু করার জন্য নয়। এখানেই জনগণের ইচ্ছার চেতনার প্রভাব পড়েছিল সৈনিক-বিপ্লবের উপর। তা না হলে সেপাই বিপ্লবের স্রোত হিংসাত্মক খাতে প্রবাহিত হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতাে। জনগণের সদিচ্ছাই উত্তেজিত সৈনিকদের সঠিক পথে থাকতে প্রভাবিত করেছিল। সুস্থ চিন্তাধারার সৈনিকদের হাত শক্তিশালী করেছিল। এখানেই সূচিত হয় জনতার জয়’। বিপ্লবীরা কেন এলাে জিয়াকে উদ্ধার করতে? ৬/৭ নভেম্বর ৭৫ বিপ্লবের রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক ও বিপ্লবীরা মিশে একাকার হয়ে গেল। সেপাই-বিপ্লবের ছত্রছায়ায় এত বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র বিপ্লবী সৈনিকদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে খােলামেলা উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। এসব দৃশ্য আগে কখনও কল্পনা করাও যায়নি। প্রকৃত ঘটনা হল, ১৫ অগাস্টের পর থেকেই জিয়া এবং জাসদের বিপ্লবী গ্রুপের নেতা কর্নেল তাহেরের যােগাযােগ বেড়ে যায়। তাহেরের বিপ্লবী গ্রুপকে জিয়া তার আস্তিনের ভেতর ‘SECRET . WEAPON’ বা ‘গােপন অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন। খালেদ-শাফায়েতের উদ্দেশ্য স্পষ্ট বুঝতে পেরে আগেভাগেই জিয়া তাহেরের সাথে গােপন
সমঝােতায় আসেন। তাহেরও উচ্চাকাক্ষী অফিসার ছিলেন। তিনি তার লালিত বিপ্লব ১২ দফার ভিত্তিতে জিয়াউর রহমানকে সাথে নিয়ে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেন। যদিও জিয়া কোনদিনই শ্রেণীহীন সেনাবাহিনীর Concept-এর ধারেকাছেও ছিলেন না। সুযােগ সুবিধামত তার নিজের স্বার্থে তাহেরের বিপ্লবী গ্রুপকে ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনাই করছিলেন। | ৪৬ ব্রিগেড কর্তৃক বন্দী হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে জিয়া বন্ধুবর তাহেরকে সংবাদ পাঠাতে সক্ষম হন এবং তাকে উদ্ধার করার অনুরােধ জানান। তাহেরের বিপ্লবী গণবাহিনীর সদস্যরা তৎক্ষণাৎ একটি অভ্যুত্থানের প্ল্যান করে। ঢাকা সেনানিবাসে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকদের সাথে আগে থেকেই তাদের সংযােগ ছিল। প্রায় প্রতিটি ইউনিটে তাদের নিয়মিত রিক্রটও ছিল। কর্নেল তাহেরের নির্দেশে জাসদের বিপ্লবী গণবাহিনী দলের সদস্যরা নির্ধারিত দিনে দ্রুত ঢাকা সেনানিবাসের চারিদিকে বিভিন্ন পয়েন্টে সমবেত হয়। পূর্ব সমঝোতার ভিত্তিতেই তারা ক্যান্টনমেন্টে ছুটে আসে। জিয়াকে মুক্ত করার বিপ্লবকে পুজি করে কর্নেল তাহের তার ” সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ব্যাপক সেনা-বিদ্রোহ ঘটাতে চান। তার বিপ্লবীরা খাকি পােশাকে ক্যান্টনমেন্টের সর্বত্র অবাধে ঘােরাফেরা করে সাধারণ সৈনিকদের সাথে মিশে গিয়ে অফিসারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরবার আহ্বান জানাতে থাকে। | ৭ নভেম্বর জিয়াকে মুক্ত করে আনলেও বিপ্লব কিন্তু সেখানেই থেমে গেল না। এবার ‘অফিসারের রক্ত চাই’ শ্লোগানে অফিসারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য বিপ্লবের ২য় পর্বের সংগ্রাম শুরু করা হয়। এভাবেই ৭ নভেম্বর মহান সেনা-বিপ্লব হঠাৎ করে এক খাত থেকে অন্য খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। তাহেরের লক্ষ্য ছিল জিয়াকে ক্ষমতাহীন পুতুল-সম্রাট করে নিজেই আসল ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে মধ্যরাতেই তার সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হল। জিয়া তাহেরের কাছে মাথা নত করতে এবং পূর্বশর্তসমূহ মনতে অস্বীকার করেন। তিনি দ্রুত তার সেনা অফিসারও সেনা ইউনিটদের সমর্থন নিয়ে টু-ফিল্ডে শক্ত ঘাটি তৈরী করে। ফেলেন। অতঃপর পরাজিত উদ্ভান্ত তাহেরের অফিসার-নিধন অভিযান শুরু হলাে। কিন্তু তাও ব্যর্থ হলাে। অনর্থক রক্তপাত, হত্যাকাণ্ড সেনাবাহিনীর প্রকৃত কোন সৈনিক, NCO ও JCO-দের সমর্থন পায়নি। ফলে তা বেশীদূর এগােতে পারেনি। বিপ্লবীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলেও সাধারণ সৈনিকগণ ছিল এসবের উর্ধে। তাদের অভিযােগ অনুযােগ ছিল, কিন্তু কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। তাই সৈনিক বিপ্লব রাজনৈতিক বিপ্লবে রূপ নিতে পারেনি। | ৭ নভেম্বর রাতে এ ধরনের জটিল অবস্থা সৃষ্টির জন্য তাহের এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই সমভাবে দায়ী। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অনর্থক নিরংকুশ ক্ষমতা অর্জনের উচ্চকাংখা না থাকলে, এসব অবস্থার সৃষ্টি হতাে না। তাই দেখা যায়, তিন তিনটি রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পেছনেই উচ্চাভিলাষী অফিসারদের উচ্চাকাংখাই দায়ী। জিয়ার আহ্বানেই তাকে উদ্ধার করতে তাহেরের বিপ্লবী সৈনিকদল ক্যান্টনমেন্টে ছুটে আসে। কিন্তু সাফল্যের পর পরবর্তী কার্যক্রমের প্রশ্নে উভয় নেতার মধ্যে ঘটে তীব্র মতানৈক্য। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাত, রক্তপাত। ভেংগে যায় তাহেরের স্বপ্ন।
সেপাই বিদ্রোহ : পরবর্তী সময়কাল
ঢাকার সেপাই বিদ্রোহ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যায়। তবে এর উত্তাপ সহজে শেষ হয়ে যায়নি। বিদ্রোহ পরবর্তী দিনগুলােতে জিয়া অতি দ্রুততার সঙ্গে তার
সিভিল-মিলিটারি ক্ষমতা সুসংহত করতে সক্ষম হন। জাসদকে এবং জাসদের বিপ্লবী সংস্থাকে ভেঙে-গুড়িয়ে মেরুদণ্ডহীন করে দেন। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহী সৈনিকদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ইউনিটে সৈনিকরা অবশ্য শান্ত হয়েই এসেছিল, কিন্তু। জিয়ার প্রশাসনযন্ত্র অস্থির হয়ে ওঠে। | সৈনিকরা ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার আসনে বসানাের পর স্বভাবতই তারা তার পক্ষ থেকে সহানুভূতিশীল নীতিমালা ও ব্যবহার আশা করেছিল, কিন্তু তাদের আশা নিরাশায় পরিণত হয়। কার্যতঃ দেখা গেল, জিয়া একের পর এক সৈনিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। এসময় জিয়া কিছু অভিজাত শ্রেণীর অফিসারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে প্রভুত্বসুলভ আপােসহীন নীতিমালা গ্রহণ করেন। ইতিপূবে বেঙ্গল ল্যাপার ও সিগন্যাল রেজিমেন্টকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা এখন দেখতে পেল এসব মুভ কোন ট্যাকটিকেল মুভ নয়, তাদের দুর্বল ও বিভক্ত করার জন্যই এসব ব্যবস্থা। তাদের চরম অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ফারুক, রশিদ, পাশা, ডালিম এরা দেশে ফিরে নানাভাবে আবার সেনা-বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তােলার প্রচেষ্টা চালায়। চাপা অসন্তোষ ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলাে। ঢাকা, বগুড়া, সাভার, চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, যশােহর, দয়ারামপুর ও অন্যান্যস্থানে একের পর এক বিদ্রোহ ঘটতে থাকে। জিয়াকে উৎখাত করতে আরাে প্রায় ১৮টি ছােট বড় বিদ্রোহ সংঘটিত হলাে। অবশ্য জিয়া এখন সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আরােহণ করে আগের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী। এসব বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ দমন করতে তাকে খুব বেশী একটা বেগ পেতে হয়নি। এগুলাের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বিদ্রোহ ছিল ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিদ্রোহ এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের বিদ্রোহ। রংপুরেও সৈনিকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। রংপুরে কর্নেল মান্নাকে পাঠানাে হলাে ব্রিগেড কমাণ্ডার হিসাবে। সৈনিকরা তাকে গ্রহণ করলাে না। তাকে ফিরে যেতে বললাে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে সুবেদার মেজর আনিস ও গিয়াসকে হেলিকপ্টারে পাঠানাে হলাে সেপাইদের শান্ত করার জন্য। এতে কাজ হলাে। রংপুরে সৈনিকরা বেশ কিছু অফিসারকে ধরে কোয়ার্টার গার্ডে বন্দী করে রাখে। সুবেদার মেজর আনিস ও গিয়াসরা তাদের উদ্ধার করেন। পরে কর্নেল হান্নান শাহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন। দয়ারামপুর, সৈয়দপুরও যথেষ্ট গণ্ডগােল হয়। এসব স্থানে সৈনিকরা উচ্ছংখল হয়ে উঠলে বহু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে সৈনিক বিদ্রোহ বেশ প্রকট আকার ধারন করে। বহু অফিসার বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে লাঞ্চিত হন। অফিসারগণ তাদের ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। নৌবাহিনীর ঘাটিতে বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে ক’জন অফিসার নিহত হন। ছল, বল, কৌশল অবলম্বন করে জেনারেল জিয়াউর রহমান চতুর্দিকে প্রজ্জলিত বিদ্রোহের আগুন নেভাতে সক্ষম হলেন। অফিসারদের কর্তৃত্ব আবার প্রতিষ্ঠিত হলাে। এই সময় জেনারেল এরশাদ তার পদপার্থে থেকে তার ছত্রছায়ায় পরম অনুগত ও বিশ্বস্ত অফিসার হিসাবে নিজ | যােগ্যতার প্রমাণ দিলেন।
পরবর্তিকালে অবশ্য এই নম্র, বিনীত ও গােবেচারা অফিসারটিকেও ক্ষমতার গন্ধে রক্তনেশায় পেয়ে বসে। ১৯৮১ সালে একটি আকস্মিক সেনা-অভ্যুত্থানে নিহত হলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। নিহত হন জেনারেল মঞ্জুর। এক ঢিলে দুই পাখি কোতল। পরিষ্কার পথে হেলেদুলে এগিয়ে এসে ক্ষমতার মসনদে আরােহন করলেন লেঃ জেঃ হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ। শুরু হলাে ষড়যন্ত্র ও প্রাসাদ রাজনীতির আর এক অধ্যায়।
পচারে সালে অগাস্ট অ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ক্ষমতার কোন্দলের বিয-বৃক্ষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ৭ নভেম্বরের পর থেকে তা ভয়াবহ রূপ ধারন করে। বলাবাহুল্য; সকল দেশে, সকল ক্ষেত্রে মিলিটারী কমাণ্ডারের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষই সকল সেনা-অভ্যুত্থানের মূল কারণ। বাংলাদেশও এর ব্যক্তিক্রম নয়। বলা যেতে পারে সব বিদ্রোহের মূল উৎস ছিল ৭ নভেম্বরের সেপাই বিপ্লব। তখন সৈনিকদের সমস্যাগুলাে সততা ও সহানুভূতির সাথে বিবেচনা না করে, কঠোর দমননীতির পথ অবলম্বন করাতেই পরবর্তী দিনগুলােতে এরকম অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হলাে। জিয়াউর রহমান সাধারণ সৈনিকদের কাছে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। সৈনিকদের সদিচ্ছা, সমর্থন ও বিশ্বস্ততা আদায় করার জন্য তার মত জনপ্রিয় জেনারেলের জেল ফাসি ও কঠোর শক্তি প্রয়ােগের কোন দরকার ছিল বলে আমি তখনও মনে করিনি, আজও মনে করি । চরম সন্ধিক্ষণে কয়েকজন স্বার্থান্বেষী উচ্চাকাঙখী অফিসার জোট বেঁধে জিয়ার চারপাশে লৌহ জাল’ (Iron curtain) সৃষ্টি করে তাদের নিজ স্বার্থে জিয়াকে দমননীতি, হঠকারিতা ও আক্রমনাত্মক পথে পরিচালিত করে, যার ফলশ্রুতিতে জাতিকে এবং সেনাবাহিনীকে করুণ মূল্য দিতে হয়। বগুড়ার বিদ্রোহ ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে প্রথমে কর্নেল রশীদ, তারপর ফারুক, সবার চোখে ধূলাে দিয়ে আবার ঢাকায় এসে উপস্থিত হয়। রাজধানীর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে জিয়া বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটকে দুভাগ করে ১৪টি ট্যাংক ও ৫০০ সৈন্য বগুড়ায় পাঠিয়ে দেন। বাকি অর্ধেক ১৪টি ট্যাংক ও ৪০০ সৈন্য নিয়ে সাভারে ফাস্ট ক্যাভালরি গঠন করেন।
ফারুক ঢাকায় পৌছার সাথে সাথে সাভারে অবস্থিত ক্যাভালরির সৈনিকগণ আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা কর্নেল ফারুককে এয়ারপাের্টে এসে বরণ করে। | অতঃপর বগুড়ার ল্যান্সার সৈনিকগণ কর্নেল ফারুককে তাদের কাছে পাঠাবার জোর দাবী জানায়। জিয়া বাধ্য হয়ে একান্ত অনিচ্ছায় কড়া নিরাপত্তা গ্রহণ করে ফারুককে বগুড়া যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। এবার ফারুককে পেয়ে বেঙ্গল ল্যান্সারের সৈনিকগণ পঁচাত্তর সালের মতই গর্জে উঠল। তারা ঢাকায় মার্চ করে জিয়াকে উৎখাত করতে হাতিয়ার ধরে বসলাে। জিয়া আবারাে মহা বিপদে। তিনি বগুড়ার পদাতিক বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখলেন। এরপর এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি ফারুকের বাবা অবসরপ্রাপ্ত মেজর রহমানের স্মরণাপন্ন হলেন। আন্তরিক আলােচনার পর তিনি হেলিকপ্টারে করে ফারুকের বাবা ও বােনকে বগুড়া পাঠিয়ে কৌশল প্রয়ােগ করে তাদেরকে দিয়ে ফারুককে ঢাকায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন দেওয়া হলাে। ঢাকায় আসার সাথে সাথে ফারুককে ধরে লিবিয়ার পথে প্লেনে তুলে দেন। বলাবাহুল্য, একই স্টাইলে কর্নেল রশিদকেও দু’দিন আগে ক্যান্টনমেন্ট বাসস্থান থেকে জবরদস্তি ধরে লিবিয়া পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন। ফারুকের প্রত্যাবর্তনের পর নেতাবিহীন বগুড়ার বিদ্রোহ নিভে গেল। অতঃপর বিদ্রোহী বেঙ্গল ল্যান্সার সৈনিকদের উপর নেমে আসে ঘাের দুর্দিন। ল্যান্সার ইউনিট সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে দেওয়া হলাে। সৈনিকদের ভাগ্যে জোটে জেল আর ফাসি। কিন্তু ফারুক রশিদের কিছুই হয় নাই। বগুড়ায় আবার বিদ্রোহ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সাল। দেড় বছর পর বগুড়ায় আবার ভয়াবহ সৈনিক বিদ্রোহ মাথা চাড়া। দিয়ে ওঠে। এবার ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এই প্রথমবার একটি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করলাে। সৈনিকরা অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠল। বিদ্রোহী সৈনিকদের হাতে দু’জন তরুণ লেফটেন্যান্ট নিহত হলাে। বেশ ক’জন অফিসারকে তারা ধরে বন্দী করে। তারা ব্রিগেড কমাণ্ডার সাদেকুর রহমান চৌধুরীকে তাড়া করে। আপন সৈনিকদের তাড়া খেয়ে ব্রিগেড-কমাণ্ডার পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাচান। বিদ্রোহী সৈন্যরা তার বাসভবনে ঢুকে ফ্যামিলিকে অপমান করে। পরবর্তিতে বগুড়ার বিদ্রোহ দমন করা হয়। বিদ্রোহী সৈনিকদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হয়। যদিও ব্রিগেড কমাণ্ডার চৌধুরীর কিছুই হয়নি। তাকে যথাসময়ে প্রমােশন দিয়ে জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। সৈনিকদের ঢালাও জেল, ফাসি, বরখাস্তের মধ্য দিয়ে প্রশমিত হয় বগুড়ার সৈনিক বিদ্রোহ। ।
ঢাকায় অক্টোবর সেনা বিদ্রোহ বগুড়ার বিদ্রোহের একদিন পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আবার জ্বলে উঠে ভয়াবহ বিদ্রোহের আগুন। হঠাৎ করেই এই বিদ্রোহ শুরু হলেও জিয়া ছিলেন প্রস্তুত। বিদ্রোহের আগাম সংবাদ পেয়েই তিনি আগেভাগেই উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জিয়া তার ঐ-সময়ের বিশ্বস্ত সহচর কর্নেল আমিনুল হক ও ক’জন সঙ্গীসহ বাসার পাশে একটি ইউনিটে আত্মগােপন করেন এবং সেই নিরাপদ স্থান থেকে রেডিও ওয়্যারলেস যােগে পরবর্তী অপারেশন পরিচালনা করতে থাকেন। ফলে নেতার সাময়িক অনুপস্থিতি সেনা প্রশাসনে কোনরকম শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। ১লা অক্টোবর সৈনিক বিদ্রোহ ছিল স্বল্পস্থায়ী, কিন্তু এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ ও মর্মান্তিক। মাত্র ৮ ঘন্টা স্থায়ী ছিল এই বিদ্রোহ। প্রধানতঃ এয়ারফোর্স এবং আর্মির সিগন্যাল ইউনিট জড়িত ছিল এতে। অর্ডিন্যান্স ও সার্ভিসেস কোরের তিনটি ক্ষুদ্র ইউনিটও ছিল। ১লা অক্টোবর মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত থেকে শুরু হয় গােলযােগ। কিভাবে হঠাৎ করেই বিপ্লবটি শুরু হয়, এ নিয়ে যথেষ্ঠ বিভ্রান্তি ও গভীর সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বিদ্রোহীরা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে শ্লোগান দিতে দিতে টারগেটের দিকে অগ্রসর হয়। কোন প্ল্যান নেই, প্রােগ্রাম নেই, নেতা নেই, লক্ষ্য নেই—তারা এগিয়ে চললাে এয়ারপাের্ট রােড ধরে। শ্লোগান মুখর সৈনিক-সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই…..’ পথে বনানীতে COD’র অস্ত্রাগার ভেঙ্গে তারা অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করলাে। তখন মধ্যরাত। বনানীর রাজপথে শ্লোগানমুখর সৈনিক। এই গ্রুপে ছিল সিগন্যালস, বিমান ও অন্যান্য গ্রুপের সৈনিকবৃন্দ। ১০/১২ টি ট্রাকে চেপে তারা শ্লোগান তুলতে তুলতে শূন্যে ক্রমাগত ফায়ার করতে করতে এয়ারপাের্ট রােড ধরে ২ নং এম পি চেক পােস্টের কাছে এসে হাজির। হয়। প্রথম তিনটি ট্রাক চেক পােস্টে ডিউটিরত এমপিরা থামিয়ে দেয়। তখন বিদ্রোহী সৈনিক ও মিলিটারী পুলিশদের মধ্যে প্রবল বাদানুবাদ চলতে থাকে। ফায়ার আর গণ্ডগােলে বেশ আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সরকারী বাড়ী ছেড়ে আমি তখন ডিফেন্স সােসাইটিতে আমার নিজ বাড়ীতে। সেখানে আমার বাড়ী থেকে মাত্র ৩০০ গজ দূরে আমার চোখের সামনেই ঘটছিল ঘটনা। বাড়ীর ছাদের তিনতলা থেকে সবকিছুই পরিষ্কার দেখছিলাম। “শ্লোগানমুখর বিদ্রোহীরা মিলিটারী পুলিশদের বাধা নিষেধ অমান্য করে জবৰদস্তি করে চেক
পােস্ট অতিক্রম করে কয়েক গজ দূরে ৮ম বেঙ্গল লাইনের দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তা থেকে বাঁদিকে মােড় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের উপর শুরু হলাে অবিশ্রান্ত ধারায় গুলিবর্ষণ। টা-ট্যা-ট্য। টারর-র-র…বিপ্লবীরা তাদের আপন ভাইদের কাছ থেকে এরকম বিরূপ অভ্যর্থনার জন্য মােটেই তৈরী ছিল না। তারা সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে খােলা মাঠে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে বর্ষিত বুলেট বর্ষণের মধ্যে ধরা পড়লাে। প্রথম তিনটি শ্লোগানমুখর ট্রাকের সৈনিকদের জীবন স্পন্দন তখনই থেমে গেল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষণ চলতেই থাকলাে যতক্ষণ পর্যন্ত না বিপ্লবীদের সকল স্পন্দন থেমে গেল। বেশ কটি বুলেট আমার ছাদের পাশ দিয়ে শো শো করে উড়ে গেল, আমি ছুটে নীচে নেমে পড়লাম। পিছনের ট্রাকগুলােতে যারা ছিল, তারা রেললাইনের পাশে বড় রাস্তার পাশে কাচা দোকানগুলাের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলাে। | ভাের সাড়ে সাতটা পর্যন্ত উভয় পক্ষে গােলাগুলি চলতে থাকলাে। সকাল ৭টার দিকে , একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন তেজগা-এর দিকে থেকে এসে গােলাগুলির মধ্যে আটকা পড়লাে। প্রবল গােলাগুলিতে ট্রেনটি না পারছিল এগিয়ে যেতে, না পারছিল পিছিয়ে যেতে। ঘুমন্ত যাত্রীরা ভয়ে কম্পমান। বিদ্রোহীরা আটকে পড়া ট্রেনের আড়াল পেয়ে এবার উবাসে বনানীর দিকে ছুটে পালাতে লাগলাে, কেউ কেউ হাতিয়ার ফেলেই। ৮ম বেঙ্গলের সৈন্যরা তাদের পেছনে ধাওয়া করলাে। পলায়নপর অনেকে গুলিবিদ্ধ হলাে। অনেকে ধরা পড়লাে। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল বলা মুশকিল। গােলাগুলীর পর ল্যান্সার ইউনিটের বিপ্লবী সুবেদার সারওয়ারের মৃতদেহ রেললাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আগের দিন। তাকে ইরাকগামী প্লেন থেকে নামিয়ে আনা হয়। জেল হত্যাকাণ্ডের নায়ক সুবেদার মােসলেম উদ্দিনও গােলাগুলিতে নিহত হয় বলে জানা যায়। বহু মৃতদেহ ট্রাকে, খােলা মাঠে রেললাইনের আশেপাশে পড়ে থাক।
দ্বিতীয় গ্রুপটি ছিল প্রধানতঃ এয়ারফোর্স সেনাদের। তারা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে বড় রাস্তা ধরে, অগ্রসর হয়। পথে স্টেশন হেডকোয়ার্টারের কাছে ২ ফিল্ড অটিলারী তাদের বাদা দেয় এবং গুলিবর্ষণ করে। বেশ কিছু হতাহত হয়। বিমান সেনারা ছত্রভঙ্গ হলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা এয়ারপাের্টের দিকে ছুটে যায়। রক্তপাগল এয়রাম্যান সৈনিকরা ছুটে গিয়ে এয়ার টারমিনালে অবস্থিত বিমান বাহিনী প্রধান এ, জি, মাহমুদ ও অন্যান্য অফিসারদের উপর হামলা চালায়। ঐ সময় ঘটনাচক্রে জাপানী কমান্ডোরা হাইজ্যাক করে একটি জাপানি বােয়িং প্লেন ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করায়। জিম্মিদের ছাড়ানাের ব্যাপারে আলােচনা করতে সব সিনিয়র অফিসার টারমিনালে উপস্থিত। লক্ষ ডলার জড়াে করা হয়েছে জিম্মিদের ছাড়ানাের জন্য। বিদ্রোহীদের আকস্মিক আক্রমণে ডলারের বড় বড় বাণ্ডিল নিয়ে যে যেদিকে পারলাে পালাল। এগারােজন অফিসার করুণভাবে নিহত হলাে। শুধু রহস্যজনকভাবে বেঁচে গেলেন এয়ার মার্শাল এ, জি, মাহমুদ। যারা মারা পড়লেন তারা হলেন ; গ্রুপ কাপটেন আনসার চৌধুরী, গ্রুপ ক্যাপটেন রাস মাসুদ, উইং কমান্ডার আনােয়ার শেখ, স্কোয়াড্রন লীডার মতিন, ফ্লাইট লেঃ শওকত জাহান চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার মাহবুব আলম ও আখতারুজ্জামান, পাইলট অফিসার আনসার, নজরুল ও শরীফুল ইসলাম। | এয়ারপাের্টে হত্যাকাণ্ডের পর বিদ্রোহীরা কি করবে ভেবে পায় না। তাদের কিছু লােক রেডিও স্টেশনে পেীছে আবােল-তাবােল ভাষণ দিতে থাকে। টু-ফিল্ড আর্টিলারী, ৪৬ ব্রিগেড ও নবম ডিভিশনের টুপ দ্রুত এগিয়ে এসে সবাইকে তাড়িয়ে দেয় ও গ্রেফতার করে। তারা
মূল টার্গেট জিয়াউর রহমানের সন্ধান পায়নি, তারা তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। সকাল আটটার মধ্যেই বিদ্রোহীরা যেখানে সেখানে অস্ত্র ফেলে চতুর্দিকে পলায়ন করে। ব্যর্থ হয় অক্টোবর অভ্যুত্থান। | এবার শুরু হল জিয়ার শুদ্ধি অভিযান। বিদ্রোহী এয়ারম্যান ও সৈনিকদের পাকড়াও করে। করে তাদের নির্মমভাবে ঢালাও শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হলাে। সংক্ষিপ্ত বিশেষ ধরনের সামরিক আদালত গঠন করা হলাে। তারপর শুরু হয় তড়িৎ গতিতে বিচারের নামে প্রহসনের পালা। কয়েকশত সৈনিক ও এয়ারম্যানদের ফাসির আদেশ দেওয়া হলাে। সেনা বা বিমানবাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠিত আইন কানুন এক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। চারিদিকে হাহাকার আর কান্নার রােল। কতাে সৈনিক, এয়ারম্যান ফাসির কাষ্ঠে ঝুলল, কতােজন প্রাণ হারালাে, এর কোন হিসাব নেই। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম ক্ষমতা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বিভিন্নসূত্রে জানা যায়, সরকারী হিসাব মতে শুধুমাত্র দুই মাসেই ফাসিতে লটকানাে হয় ১১৪৩ জন সৈনিককে।
পাক-ভারতের ইতিহাসে কোন সামরিক অভ্যুত্থানে এত লােকের ফাসি, হত্যা, প্রাণহানি, জেল আর কখনও ঘটেনি। কি আশ্চর্য! এতােবড় মর্মান্তিক ঘটনার কখনও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। | কেউ দাবিও করেনি। কি বিচিত্র এই দেশ।
জিয়া হত্যাকাণ্ড : চট্টগ্রাম সেনা অভ্যুত্থান।
১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলেন জেনারেল জিয়া। রহস্যময় অ্যুত্থান। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে প্রায় ১৮টি ছােটবড় সেনা-অভ্যুথান সংঘটিত হয়। জিয়া সবগুলােই দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন। বলা যায় ঐ সময় জিয়া সৈনিকদের অভ্যুত্থান ঠেকাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারলেন না। চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান প্রকৃত পক্ষে সেনা অভ্যুত্থান ছিল না। ৩ নভেম্বরের মতাে এটা অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত একটি অফিসার্স অভ্যুত্থান’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, যেখানে সৈনিকদের স্বার্থ সামান্যই জড়িত ছিল। সবগুলাে অভ্যুত্থানই ছিল প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লড়াই। চট্টগ্রাম অভ্যুত্থানও ছিল তাই, কিন্তু পর্দার আড়ালে নেপথ্যে থেকে কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি কলকাঠি নেড়েছেন, তা সবার কাছে আজও অজ্ঞাতই থেকে গেছে। জেনারেল জিয়ার প্রিয় সেনাপতি ছিলেন মঞ্জুর, যেমনভাবে এরশাদ ছিলেন তার বড়ােই বিশ্বস্ত ফরমাবরদার। বাংলাদেশ আর্মির একজন দক্ষ, প্রতিভাবান, সৎ অফিসার মঞ্জুর; অবশ্য তিনিও ছিলেন জিয়া, এরশাদ, তাহের, খালেদ, শাফায়েতের মতাে উচ্চাকাংখী।।
কেন হঠাৎ বিগড়ে গেলেন জেনারেল মঞ্জুর? রাজধানী ঢাকার মসনদ ছেড়ে চট্টগ্রামে করলেন অভূত্থান-প্ল্যান? আজ এটা জলবৎ পরিষ্কার, জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড ৭ নভেম্বরের সেই প্রভাবশালী চক্রের চক্রান্তেরই ফসল। | ১৯৭৬ সালে ডবল প্রমােশন নিয়ে জেনারেল এরশাদের ঢাকা আগমন। আগমনের পরপরই ক্যান্টনমেন্টে সেপাইরা তার মতাে এক অখ্যাত অফিসারের এক বছরে ডবল। প্রমােশনের বিষয় তখনই যথেষ্ট উম্মার কারণ হয়ে দাড়ায়। জিয়ার কাছে বিভিন্নভাবে সৈনিকরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জানায়। জিয়া তাকে চিনতে পারেননি। তাকে দুর্বল ভেবে কাছে টেনে এনে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ভেবেছিলেন। সেটাই হলাে তার কাল।’ | এরশাদ জিয়ার কান-ভারী করে আমাকেও সরিয়ে দিয়েছিল। [ সৌভাগ্য হত্যা করেনি।] তারপর সেই যে এরশাদ-রূপী মামদো ভূত জিয়ার ঘাড়ে চাপলাে, অন্যেরা শত চেষ্টা করেও তাকে নামাতে পারেনি। | ছিটকে পড়লাে মঞ্জুর, ছিটকে পড়লাে শওকত। একাই তখন এরশাদ জিয়ার ঘাড়ে সওয়ার। ধূর্ত এরশাদ। চানক্যের কূটকৌশল প্রয়ােগ করে জিয়ার সাথে মঞ্জুর-শওকতের সম্পর্কের ফাটল ধরালাে। সময় দ্রুত গড়িয়ে চললাে। : মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ডিভিশন থেকে অপসারণ করে স্টাফ কলেজে বদলি করা হলাে। পােস্টিং মঞ্জুরের মনঃপুত হয়নি। এসব ব্যাপার নিয়ে সেনাপ্রধান এরশাদের চক্রান্তে জিয়া এবং মঞ্জুরের মধ্যে হঠাৎ করে সম্পর্কের তিক্ততা চরম আকার ধারণ করে। মঞ্জুর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তিনি জিয়াকে হত্যা করার প্ল্যান করেছিলেন কি না, এ নিয়ে গভীর। সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যতদূর জানা যায়, জিয়াকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে এনে। এরশাদের পদচ্যুতি সহ কিছু দাবী দাওয়া আদায়ই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ৩০ মে ১৯৮১ সাল। প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম পেীছেন। জেনারেল এরশাদও প্রেসিডেন্টের সাথে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তিনি অজ্ঞাত কারণে তার প্ল্যান পরিবর্তন করেন। প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রাম সাকিট হাউজে অবস্থান নেন। তিনি রাজনৈতিক মিটিং নিয়ে মহাব্যস্ত থাকেন। রাত এগারােটায় ঘুমােতে যান। ঝঞ্চা বিক্ষুব্ধ গভীর রাত তিন ঘটিকায় বিদ্রোহী অফিসারগণ তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে। সার্কিট হাউজে আকস্মিক কমান্ডাে আক্রমন চালায়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রমনের প্ল্যান প্রােগ্রাম ও উদ্দেশ্য নিয়ে অফিসারদের মধ্যে ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্বও বিভ্রান্তি। প্রথমে রকেট লাঞ্চার থেকে সার্কিট হাউজের উপর রকেট বর্ষণ করা হয়। সংগে সংগে মেশিনগান থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণে গার্ডরা ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। বিনা বাধায় বিদ্রোহী। অফিসাররা সার্কিট হাউজের দোতালায় ছুটে যায়। তারা এবং বারান্দায় ছােটাছুটি করে। প্রেসিডেন্টকে চীৎকার করে খুঁজতে থাকে। এই সময় প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেই ৪নং কক্ষ থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তােমরা কি চাও? কাছে দন্ডায়মান লেঃ মােসলেহ উদ্দিন রীতিমত ঘাবড়ে যায়। এমন সময় হঠাৎ করে লেঃ কর্নেল মতি ছুটে এসে। তার স্টেনগান দিয়ে অতি কাছে থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়ার উপর সরাসরি গুলিবর্ষণ করে। ক্ষিপ্তপ্রায় মতি তার স্টেনগান থেকে মেঝেতে পড়ে যাওয়া জিয়ার মুখমণ্ডলে আর এক ঝাক। গুলিবর্ষণ করে। আনুমানিক ৪-৩০ মিনিটে জিয়া মৃত্যু বরণ করেন। জিয়াকে হত্যা করার কোন নির্দিষ্ট প্ল্যান প্রােগ্রাম বা নির্দেশ না থাকা সত্বেও কেন কর্নেল মতি ছুটে গিয়ে তাকে হত্যা করলাে, তার এই মােটিভ আজও রহস্যাবৃত। | রাষ্ট্রপতি জিয়াকে যেভাবে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে, সে রকম নির্দেশ মঞ্জুর। জেনারেল কোনও পর্যায়ে কাউকে দিয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। | নেপথ্যে থেকে তাহলে নাটাইর সুতাটি টেনেছিল কে? লেঃ কর্নেল মতি কার নির্দেশে ছুটে গিয়ে জিয়ার বুকে স্টেনগান ধরলাে? মঞ্জুরতাে জিয়াকে হত্যা করার নির্দেশ কাউকে দেয়। নাই। তাহলে মতি এককভাবে এ-কাজটি কেন করলাে? ঘটনা প্রবাহ থেকে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের চারদিন আগে চট্টগ্রামে মতির সাথে হিলটপ মেসে এরশাদের সাথে দুঘন্টা। অন্তরঙ্গ পরিবেশে আলােচনা হয়েছিল। সকল প্রটোকলের বাইরে জুনিয়ার মতির সাথে। সেনাপ্রধানের এমন কি ব্যক্তিগত গােপন আলাপ হতে পারে ঐ সন্ধিক্ষণে? ক’দিন আগে। ঢাকায় গিয়েও মতি সেনা প্রধান এরশাদের সাথে দেখা করে। ঐদিন এরশাদ মিলিটারী একাডেমীর নির্ধারিত ভিজিট ক্যানসেল করে প্রায় সারাদিন মঞ্জুরের সাথে গভীর আলােচনায়। লিপ্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে কি গােপন আলােচনা হয়েছিলাে? এসবই আজ রহস্য। | মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড ঘটনা অবহিত হওয়ার পর কর্নেল মতিকে ডেকে বকাবকি করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সিনিয়র অফিসার হিসাবে সকল দায়-দায়িত্ব নিজ স্কন্ধে। তুলে নেন। তিনি তৎক্ষনাৎ সম্ভাব্য আক্রমন প্রতিরােধে দুই কোম্পানী সেনা শুভপুর ব্রীজের দিকে পাঠাতে নির্দেশ দেন। মঞ্জুর একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠন করেন এবং চট্টগ্রাম রেডিও মারফত বিভিন্ন ঘােষনা দিতে থাকেন। জিয়ার আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের সংবাদে সবাই হতভম্ব হলেও ঢাকায় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদ ছিলেন প্রস্তুত। তিনি ত্বড়িৎ গতিতে অতি ভােরেই আমি হেডকোয়াটারে পৌছে যান এবং সকল নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি তার স্টাফ প্রধানদের তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠান। জেঃ নুর উদ্দিন, জেঃ ওয়াহেদ, হারুণ, মইন প্রমুখরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায়। সেনাসদরে স্থাপন করা হয় ‘অপারেশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জেনারেল এরশাদর সরাসরি তত্বাবধানে। অতঃপর সেখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ড।
তিনি রেডিও বাংলাদেশ মারফত চট্টগ্রামে অবস্থিত সকল সৈনিকদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। বস্তুত তখন, রেডিও টেলিভিশন মারফতই দিবারাত্রি ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ’ চলতে থাকে। কোনাে পক্ষের সৈন্যরাই তখন অস্ত্র নিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে মােটেই আগ্রহী ছিল না। মঞ্জুর রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে ব্যর্থ হন। রাজধানী ঢাকায় তার স্বপক্ষে কারা কাজ করছিল, তা এখন তদন্ত সাপেক্ষ। তবে রেডিও, টেলিভিশন, মারফত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের দিবারাত্রি প্রােপাগাণ্ডা ও নির্দেশ চট্টগ্রামে অবস্থিত মঞ্জুরের অনুগত অফিসার ও সৈনিকদের মনােবল দ্রুত ভেংগে দেয়। তারা রেডিওর ঘােষনা অনুযায়ী তৎক্ষনাৎ আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত হয়। তারা অফিসারদের ক্ষমতার কোন্দলে নিজেদের জড়াতে আগ্রহী ছিল না। ওদিকে এরশাদের নির্দেশে কুমিল্লা থেকে বিপুল সৈন্য নিয়ে ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) মাহমুদ চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করেন। হতাশ এবং ভগ্নহৃদয় মঞ্জুর বেগতিক দেখে কয়েকজন সহকর্মী অফিসার ও ফেমিলিসহ হাটহাজারীর দিকে পালিয়ে যেতে থাকেন। ওদিকে এরশাদের নির্দেশে রেডিও বাংলাদেশ জেনারেল মঞ্জুরকে জীবিত অথবা মৃত গ্রেফতার করার জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘােষনা করে। অবশেষে একটি চা বাগানে একজন কুলির জীর্ণ কুটিরে ধরা পড়লেন সপরিবারে জেনারেল মঞ্জুর। পুলিশ ইন্সপেক্টর গােলাম কুদুস তাকে গ্রেফতার করে হাটহাজারী থানায় নিয়ে আসেন। সংবাদ পেয়ে এরশাদের বিশেষ ব্রিফিং নিয়ে মেঃ জেঃ লতিফ চট্টগ্রাম গিয়ে উপস্থিত হন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে তিনটি পিকআপ ও জীপ নিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদকে পাঠানাে হয় হাটহাজারী থানায়। সেখানে পেীছে এমদাদ প্রায় জোর করেই পুলিশ কর্তৃপক্ষের হাত থেকে জেনারেল মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেন। মঞ্জুর বারবার আকুল আবেদন করেন তাকে পুলিশের হেফাজতে রাখার জন্য। এর জবাবে ক্যাপ্টেন এমদাদ হতভাগ্য জেনারেলকে হাত-পা-চোখ বেঁধে প্রায় টেনে হিচড়ে গাড়ীতে তুলে তাকে চট্টগ্রাম অভিমুখে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেন। পুলিশের গাড়ীও পেছন পেছন ছুটে চলে। মঞ্জুরের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা কাদতে থাকে। মিসেস মঞ্জুর চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে স্বামীর জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। বন্দী জেনারেল বন্দী জেনারেলকে নিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদের জীপ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রবেশ করলাে। নিয়তির কি করুণ পরিহাস। দু-শাে বছর পর যেন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনীর বাস্তব পুনরাবৃত্তি ঘটলাে। বাউল করুণ সুরে গেয়ে উঠলাে-সকালবেলা আমীররে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা। যিনি ছিলেন রাজ্যের বাদশাহ মহান অধিপতি, দিনহীন ভিখারীর বেশে বন্দী হয়ে তার মুর্শিদাবাদ প্রবেশ। মীরজাফরপুত্র মীরনের নির্দেশে ঘাতক ভৃত্য মহম্মদি বেগ। কর্তৃক তার বুকে আমূল ছােরা প্রবেশ করিয়ে দিয়ে হত্যা।
দুশাে বছর পর চট্টগ্রামে পুরানাে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটলাে। সেনাবাহিনীর বরপুত্র চট্টগ্রামের একচ্ছত্র সেনাপতি মেজর জেনারেল মঞ্জুর তার আপন সেনানিবাসে প্রবেশ করলেন দীন-হীন বন্দী বেশে। তার হাত-পা চোখ বাঁধা। ক্ষমতার মসনদে সদ্য উপবিষ্ট নবাবের ইংগিতে ঘাতকরা তাকে হত্যা করতে প্রস্তুত। রাতের অন্ধকারে তাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদের দল সেনানিবাসে ঘুরতে থাকে। জনপ্রিয় জেনারেলকে কেউ খুন করতে রাজা হয় না। এক সময় ঘাতক দল কঠোর হয়। উপরের নির্দেশ পালন করতেই হবে। অতি
নিকট থেকে জেনারেল মঞ্জুর-এর মাথায় একটি মাত্র গুলি করা হলাে। গুলিটি তার মাথায় একটি বড় গর্তের সৃষ্টি করলে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। সরকারের রেডিও টেলিভিশন অত্যন্ত দুঃখের সংগে ঘােষনা করলাে—চট্টগ্রাম সেনানিবাসে একদল উচ্ছংখল। সৈন্যের হাতে জেনারেল মঞ্জুর নিহত হয়েছেন। কি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। মুক্তিযুদ্ধের এক বীর সেনানী ও সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর বীর উত্তম; আজ তার কবরটির কোন চিহ্ন পর্যন্ত নাই। তিনজন ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর হত্যার সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন ; ব্রিগেডিয়ার এম এ লতিফ, ব্রিগেডিয়ার অজিজুল ইসলাম ও ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান। ব্রিঃ আজিজ অকালে মারা যান। লতিফ ও মাহমুদ প্রমােশন পেয়ে জেনারেল হন।
মঞ্জুরের তিরােধানের সাথে সাথেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অবসান ঘটলাে। নিরংকুশ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন জেনারেল এরশাদ। ধরাশায়ী হলাে সকল প্রতিপক্ষ। অতঃপর তারই মনােনীত অসুস্থ অথর্ব সাত্তারকে প্রেসিডেন্টের গদীতে বসিয়ে নিজেই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা। কুক্ষিগত করে বসলেন এরশাদ। | মেজর জেনারেল মােজাম্মেলের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হলাে। অভিযুক্তদের সনাক্ত করতে। তড়িঘড়ির তদন্তে ঐ পরিস্থিতিতে কি পরিবেশ বিদ্যমান ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তিতে জেনারেল আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম জেলের অভ্যন্তরে একটি গােপন কোর্টমার্শাল অনুষ্ঠান করে ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধাকে ফাসির কাষ্ঠে। ঝুলানাে হলাে। তাদের পরিবার পরিজনদের আকুল আবেদন, কাকুতি মিনতি, অনশন কিছুই এরশাদের ইস্পাত-কঠিন হৃদয়কে টলাতে পারলাে না। | তারা জীবিত থাকলে হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতাে। বেরিয়ে আসতাে। নেপথ্য নায়কের বিভৎস চেহারা। এখন সব পাক-সাফ। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত অফিসারদের অনেকেই জিয়া-হত্যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। চট্টগ্রাম বিদ্রোহকে বাহ্যতঃ একটি বিশেষ গ্রুপের অফিসারদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করা হয়। | মঞ্জুর বরাবরই জেনারেল এরশাদকে তার দুর্নীতি ও নষ্ট চরিত্রের জন্য প্রকাশ্যে ঘৃণা করতাে। এরশাদ ভালাভাবেই জানতেন, জিয়ার পর তিনি ক্ষমতার মসনদে আরােহন করলেও জীবিত মঞ্জুরের উপস্থিতিতে কোনভাবেই তিনি নিশ্চিন্তমনে দেশ শাসন করতে পারবেন না। অতএব ভালাে করে হিসাব নিকাশ করেই এক ঢিলে দুই পাখি মারার শিকার-ব্যবস্থার আয়ােজন করা হয়। সব কিছুই ছিল মূলতঃ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের ফসল। ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের পথ ধরে জিয়ার উত্থানের আড়ালে যে বহুরুপী কালাে বিড়ালটি ম্যাও ম্যাও করে সবার অলক্ষ্যে সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতর প্রবেশ করে, পরবর্তীতে তার অশুভ পদচারণায় সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলে সুদূর প্রসারী বিপর্যয় ডেকে আনে। এর জের আজও চলছে। চলবে আরাে বহুদিন। জিয়ার উত্থানের দিনগুলােতে তার পাশে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে তাকে ঘনায়মান সংকট নিয়ে ইশিয়ার করেছিলাম, তার সাথে কড়া বাক্য বিনিময় করেছিলাম। সে আমার কোন কথাই শােনেনি। ক্ষমতার পংকিলে পড়ে সে ছিল তখন অন্ধ। সেই সুযােগে চাটুকার ষড়যন্ত্রকারীরা দল বেঁধে ঘিরে ধরে হিংসা সংঘাতের দিকে তাকে পরিচালিত করে। আমার বিরুদ্ধে জোট :
বেঁধে জিয়ার কান-ভারী করে। তার ও আমার মধ্যে বহুদিনের গভীর সুসম্পর্কে ফাটল ধরায়। ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করে চক্রান্তের পংকিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসি। ওদেরকে জিয়া চিনতে পারেনি, বরং আমাকেই ভুল বুঝেছিল। আজ বলতে দ্বিধা নেই, তখনকার সেই চাটুকার ষড়যন্ত্রকারীদের জালেই আটকা পড়ে জিয়া এবং পরবর্তীতে মঞ্জুরসহ আরাে বহু তরুণ অফিসার অকালে জীবন বিসর্জন দেয়। . আমিও জীবন-যুদ্ধে পরাজিত এক সৈনিক। সেই উথাল দিনগুলাের আমি শুধু এক নিরব সাক্ষী। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে গভীর বেদনার সাথে নিরবে নিভৃতে সহযােগীদের আকাশ-পাতাল উত্থান আর পতনের স্মৃতি রােমন্থন করে বার বার খেই হারিয়ে ফেলি। মানুষের জীবন কি বিচিত্রময়।
সূত্র : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা – লে. কর্ণেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি