৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান খালেদের উত্থান ও পতন
খন্দকার মােশতাক আহমদের শাসন আমল বেশীদিন স্থায়ী হলাে না। মাত্র দুইমাস ১৮ দিন পর সংঘটিত হলাে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনা-অভ্যুত্থান। ঘটলাে ক্ষমতার হাতবদল। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর মধ্যরাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত হলাে এই “রক্তপাতহীন’ নীরব অভ্যুত্থান। একটি বুলেটও ফায়ার হলাে না, একটি প্রাণীও মারা পড়লাে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সৈনিক ব্যারাকে সবাই ছিল ঘুমিয়ে। ভাের বেলা ঘুম থেকে উঠে সবাই শুনলাে গভাররাতে অভ্যুত্থান ঘটেছে। ক্ষমতার হাতবদল বদল হয়েছে। সেনা বাহিনী। প্রধান জিয়াউর রহমান বন্দী। সি, জি, এস, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ নতুন সেনা নায়ক। কর্নেল শাফায়েত জামিলের ৪৬ ইনফেন্ট্রি-ব্রিগেডের পরিচালনায় ঘটেছে এই অভ্যুত্থান, তারাই এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। সারা ক্যান্টনমেন্টে বিরাজ করছিল শান্ত অবস্থা। রাস্তাঘাটে লােক চলাচল ছিল স্বাভাবিক। অভ্যুত্থান ঘটার সামান্যতম উত্তাপও ছিল না কোথাও। শুধু দেখা গেল, জেনারেল জিয়ার বাসভবনের গেইটে উদীপরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু অতিরিক্ত সৈন্যের জটলা। সরকার বদল হয়েছে। সকাল থেকে রেডিও বন্ধ। প্রকৃত ব্যাপার কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না। সর্বত্র কানাঘুষা। অবাক জিজ্ঞাসা বিভ্রান্তি। অগাস্ট পরবর্তী অবস্থা ১৫ অগাস্টের পর ঘটনাপ্রবাহ চলছিলাে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিকভাবে। একটি সরকারের পরিবর্তন ঘটেছিলাে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিলাে সেনাবাহিনীর হাতেগােনা ক’জন জুনিয়ার অফিসারের মাধ্যমে। এখানেই ছিলাে ঘটনার যতাে গণ্ডগােল।
অগাস্ট অভ্যুত্থান প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিলাে না। সেনাবাহিনীর কোন সিনিয়র অফিসার সরাসরি এতে জড়িত ছিলেন না। আমির মাত্র দুটি ইউনিট, দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি এবং ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার (ট্যাংক রেজিমেন্ট) ছাড়া অন্যকোন ইউনিট এতে জড়িত ছিলাে না। বিশেষ করে পদাতিক বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্ট অর্থাৎ যারা সেনাবাহিনীর মূল। বাহিনী, তাদের কোন ইউনিট জড়িত না থাকায় তথাকথিত ঐ অভ্যুত্থানের যৌক্তিকতা নিয়ে ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ৪৬ তম ব্রিগেডের কমান্ডার শাফায়েত জামিল অস্বস্তি বােধ করছিলেন। কারণ ঢাকার পদাতিক ব্রিগেডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যান্ত্রিক দুটি ইউনিট সরকার উল্টিয়ে দিলাে, আর তারা বসে বসে শুধু ঘাস কর্তন করলেন। এটা ছিল চরম অপমানের নামান্তর। . খন্দকার মােশতাক আহমদ যথেষ্ট দক্ষতার সাথে অবস্থার মােকাবেলা করার চেষ্টা করতে। থাকেন। কিন্তু বঙ্গভবনে তাকে ঘিরে তখন জেঁকে বসে আছে অভ্যুত্থানের নায়ক তরুণ মেজররা। প্রকৃতপক্ষে মেজর ফারুক, রশিদই সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠে। মেজর ডালিম, নূর, শাহরিয়ার, পাশা, রাশেদ প্রমুখ জুনিয়ার অফিসাররা বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়ে দেশ শাসন করতে থাকে। সিনিয়র অফিসারদের এড়িয়ে জুনিয়ার অফিসারদের কর্মকান্ড স্বভাবতই সিনিয়ারদের পছন্দ হয়নি। এসব ব্যাপার আর্মির সাধারণ ডিসিপ্লিনের প্রতি ছিল মারাত্মক হুমকি।
উর্ধতন হেড কোয়ার্টারের অনুমতি ব্যতিরেকেই ফারুক-রশিদ আক্রমনাত্মকভাবে বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলাে বঙ্গভবন ও সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে স্থাপন করে। আর্টিলারি ইউনিটের কামানগুলােও সেখানে ছিলাে। অগাস্ট অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে দ্রুত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসলেও ক্যান্টনমেন্টে সামরিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি। বিভিন্ন অজুহাতে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠতে লাগল। উপরে উপরে সব ঠিকঠাক, ধােপদুরস্থ, চলছে সরকার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছাই চাপা আগুন জ্বলতে লাগল। | মেজর রশিদ ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী অফিসার। তিনিই প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনী প্রধানের মধ্যে যােগাযােগ রাখছিলেন। এসব ব্যাপার মােটেই সহ্য হচ্ছিল না অনেক সিনিয়ার অফিসারের। এদের মধ্যে ছিলেন ৪৬ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। তারা জিয়াকে প্রকাশ্যে চাপ প্রয়ােগ করতে লাগলেন, অভ্যুত্থানের মেজরদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। উদ্বিগ্ন খালেদ খুব সম্ভব জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহকে তার মেয়াদ আরাে তিন বছর বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা তখনাে প্রকাশ না পেলেও জিয়া-খালেদ উভয়েই তা জেনে যান। জিয়াকে সরিয়ে দেবার প্ল্যানতাে ছিলােই, সেটা জিয়া আগেই জানতেন। এবার মাঝখান থেকে খালেদ মােশাররফের মনটা খারাপ হয়ে গেল, কারণ শফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত তারই হওয়ার কথা ছিল। তার আশা ভঙ্গ হলাে, এখন তাকে আরাে তিন তিনটি বছর অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাপার, তিন বছর পর কি হয়, কে। জানে! | নাখােশ শাফায়েত জামিল। তাকে কদলী দেখিয়ে তারই অধীনস্ত অফিসার মেজর রশিদ ও জুনিয়ার মেজররা বঙ্গভবনে ক্ষমতার মসনদে সমাসীন! অথচ চার হাজার সৈন্য নিয়ে সে। নাকি ঢাকার সক্রিয় ব্রিগেড কমাণ্ডার!
মনের গভীরে প্রবল চাপা ক্ষোভ তাদের সবাইকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। খালেদ শাফায়েত দু’জনই একটা কিছুকে ইস্যু করে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লাে। নাখােশ জিয়া। কিন্তু জিয়ার অবস্থাও ছিলাে নড়বড়ে। চতুর খন্দকার মােশতাক জেনারেল ওসমানীকে তার সামরিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করলেন। একই সাথে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ‘চীফ। অব ডিফেন্স স্টাফ করে জিয়ার উপরে স্থান করে দিলেন। মােশতাক সামরিক ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীকেই প্রাধান্য দিতেন। জিয়াকে তেমন পাত্তা দিতেন না। সরাসরি কথাও বলতেন না। এতে জিয়া ভেতরে ভেতরে প্রেসিডেন্ট মােশতাকের উপর খুবই নাখােশ ছিলেন। এছাড়া জেনারেল ওসমানী ও খলিলুর রহমানের সাথেও জিয়ার এমনিতেই বনিবনা ছিলাে
। অথচ মোশতাক এদের কিনা তার উপরে স্থান দিয়ে তার ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াস। পাচ্ছিলেন। এ সময় আমি ছিলাম স্টেশন কমান্ডার। এই সুবাদে প্রায়ই জিয়ার সাথে এসব নিয়ে। কথাবার্তা হতাে। তার অফিসে গেলেই জিয়া রাগে গরগর করতেন। ওসমানী ও খলিলুর রহানকে কড়া ভাষায় সমালােচনা করতেন। আমাকে কয়েকবার ওসমানীর কাছে গিয়ে
সরাসরি বুড়ােকে সরে দাড়াবার কথা বলতে বললেন। আমি শুধু হেসে তার রাগ থামাবার চেষ্টা করতাম। জিয়ার অবস্থা তখন খাচাবন্দী ব্যাঘ্রের মত। | খালেদ মােশাররফের রাজনৈতিক শক্তি ছিল তার ভাই রাশেদ মােশাররফের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ। নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিনের সাথেও তার আলাপ ছিল। শাফায়েত জামিলের সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শাফায়েত আবার জিয়াউর রহমানের সাথেও সমান সম্পর্ক রাখতাে। অর্থাৎ সে এদিকেও ছিল, ওদিকেও ছিল। | প্রথমদিকে শাফায়েতের সাথে রশিদের সম্পর্কও ছিল খুবই ভালাে, রশীদ ছিল শাফায়েতেরই অধীনস্ত ইউনিটের কমাণ্ডার। কিন্তু ‘ক’ করার পর সে তার ‘বস’কে টেক্কা দিয়ে নিজেই বঙ্গভবনের মসনদে বসে পড়লাে। তার সাথে ‘ক’র অন্যান্য মেজররা-ফারুক, ডালিম, নূর, হুদা, পাশা, রাশেদ প্রমুখরা। এ রকম অবস্থা ছিল শাফায়েতের কাছে রীতিমত অপমানজনক। চার হাজার সৈন্যের স্বাধীন পদাতিক ব্রিগেড নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে সে বসে থাকবে ক্ষমতাহীন হয়ে, আর বঙ্গভবনে চুনােপুটি মেজররা করবে দেশ শাসন—এটা অসম্ভব। ১৫ অগাস্ট ঘটনাবহুল দিনটিতে নিষ্ক্রিয় থেকে তার কোন লাভ হয়নি। এবার আর নয়। হত্যাকারী মেজরদের উৎখাত চাই। মেজরদের উৎখাত আর চেইন সব কমাণ্ড প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে এবার এক প্লাটফরমে এসে দাঁড়ালেন শাফায়েত জামিল ও খালেদ মােশাররফ। তারা প্রকাশ্যে হুমকি দমকি শুরু করলেন। তারা জিয়াকে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কিন্তু জিয়া নিরুত্তর। তিনি ওকূল একূল দুকুল রক্ষা করেই চলছিলেন। তিনি বললেন, wait and see..। আসলে জিয়া সার্বিক ব্যাপারটা দেখছিলেন অন্যভাবে। তিনি দেখছিলেন, মেজরদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনলেই তার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। না। ‘মােশতাক-ওসমানী-খলিল চক্র ধূলিস্মাৎ করতে না পারলে তিনি স্ব-ইচ্ছায় স্বাধীনভাবে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারছেন না। এটাই ছিল ঐ মুহুর্তে জিয়ার সবচেয়ে বড় মাথা। ব্যাথার কারণ। অতএব তিনি তার আপন পরিষ্পনায়ই কাজ করছিলেন ; গােপনে, অতি সন্তর্পণে। তাহের, খালেদ, শাফায়েতরাও বসে ছিল না। সবাই তখন ক্ষমতার মােহে ছিল আচ্ছন্ন। তারাও নিজ নিজ ছক অনুযায়ী কাজ করছিল। অক্টোবর মাসে স্পষ্ট বােঝা গেল। একটা শক্তির মহড়া’ প্রদর্শন আসন্ন। প্রকাশ্যে গােপনে বিভিন্ন ক্যাম্পে সাজ সাজ রব। কখন, কিভাবে আসছে, সেটা ছিল শুধু সুযােগ ও সময়ের ব্যাপার মাত্র। | এই সময় জিয়ার সাথে প্রায়ই আমার কথাবার্তা হতাে। টেনিস কোর্টেও দেখা হতাে। আমি তাকে সেনানিবাসের আকাশে ঝড়ের সংকেত উপলব্ধি করতে বারবার অনুরােধ করি। কিন্তু বার বার তার একই জবাব ; হামিদ, Wait and see. এক মাঘে শীত যায় না। আমি তার এসব কথার কিছুই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারি না। তাকে তার অফিসে গিয়ে আবার বলি। সে ঘাড় কাত করে অবহেলা ভরে কেবল মুচকি হাসে আর একই উত্তর দেয় ; হামিদ বললামতাে, এক মাঘে শীত যায় না। আমি বিব্রত হই। | আমার কথার কোন গুরুত্ব না দেওয়ায় আমি রাগ করে বেশ কিছুদিন তার অফিসে যাওয়াই বন্ধ করে দিলাম। এ সময় জিয়ার জন্য অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বহু অফিসার আমার কাছে এই সময় এসে বলেছেন; স্যার, আপনি তাে তার বন্ধু মানুষ, কোর্সমেট। তাকে কেন বুঝিয়ে বলছেন না, বিপদ আসন্ন। এক্ষুণি তাকে সতর্ক হতে হবে। আমি তাদের বলেছি ; ব্রাদার্স, ভেরী স্যরি, জিয়া আমার কথার কোন আমলই দিচ্ছে না। এতে তারা বড়ই নিরাশ হতেন।
কর্নেল রশিদও আমাকে বলেছে, সেও জিয়াকে খালেদ-শাফায়েতের সম্ভাব্য অভ্যখান সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। কিন্তু তিনি কোন এ্যাকশন নিতে চাননি। এতে তার মনে তখনই। জিয়ার সততা সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে। তার ধারণা হয়, জিয়া নিজেই তলে তলে কিছু একটা ঘটাতে যাচ্ছেন। গভীর জলের মৎস জিয়া। তার আসল মতলব রশিদ অথবা অন্য কেউ কিছুই বুঝতে পারছিল না। আসলে ভিতরে ভিতরে চলছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি। আসলেই কি জিয়া ভিতরে ভিতরে কি হচ্ছে তা মােটেই জানতেন না? পরবর্তী ঘটনাবলী থেকেই এর জবাব পাওয়া যাবে। জিয়া এবং তাহের একে অন্যের প্রতি খুবই বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। উভয়ে একই সাথে একই সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাহেরকে পঙ্গুত্বের জন্য অবসর দেওয়ার পর জিয়া বরাবর তার সাথে সংযােগ রক্ষা করে চলেছেন। তাহের গােপনে জাসদের আর্মস উইং গণবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রকৃত পক্ষে তারা জিয়াকে সামনে রেখে চাইনিজ পদ্ধতির। সেনা-বিপ্লবের একটা স্বপ্ন দেখছিলেন। চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিল ছিলেন প্রধান প্রতিবাদী কণ্ঠ। তারা সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঐসব উচ্চাকাংখী মেজরদের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে বললেন। জিয়া কিন্তু মেজরদের কাছে ছিলেন কৃতজ্ঞ, কারণ তারাই তাে তাকে চীফ-অব-স্টাফ বানিয়েছে। অতএব, জিয়া কৌশলে একূল ওকূল, দুকূল রক্ষা করেই চলতে থাকেন। যাকে বলে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এরকম একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছিলেন তিনি। জিয়া দুই প্রান্তের লােকজনদের সাথেই যােগাযােগ রক্ষা করছিলেন। একদিকে ফারুক-রশিদের পিঠ চাপড়ানাে, অন্যদিকে শাফায়েত জামিলের কাধে হাত, দুই-ই করছিলেন। আসলে জিয়া বহুদিন গােয়েন্দা সংস্থায় চাকুরী করায় এসব কাজে ছিলেন ভাল ওস্তাদ। | জিয়া তলে তলে আর একটি কাজ করছিলেন। তা হলাে, তিনি সবার অজ্ঞাতে জাসদের কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের সাথে গােপন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জাসদের আর্মস উইং ইতিমধ্যে আণ্ডার গ্রাউণ্ড রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। শেখ সাহেবকে উৎখাতের জন্য ইতিপূর্বে তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জিয়া সবার অজ্ঞাতে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার সুহৃদ কর্নেল তাহেরের সাথে গােপন কথাবার্তা চালিয়ে যান। জাসদের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের মতে একটি সেনা বিপ্লবের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের সাথে তাদের রীতিমত পাকাপাকি কথাবার্তা হয়। তার সাথে বেশ ক’টি গােপন মিটিং হয়। যদিও বিপ্লবের ব্যাপারে জিয়ার সদিচ্ছা নিয়ে তাদের উর্ধতন মহলে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কিন্তু কর্নেল তাহেরের পীড়াপীড়িতে তারা জিয়ার সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েন।
জিয়া বনাম মােশতাক-ওসমানী সত্যি বলতে কি খােদ জিয়াউর রহমানের আর্মির উর্ধর্তন ‘চেইন অব কমান্ড’ মােটেই সহ্য। হচ্ছিল না। তিনি নিজেই তা ভাঙতে চাচ্ছিলেন। তার মাথার ওপরে জেনারেল ওসমানী ও খলিলুর রহমানের মাতব্বরী মােটেই পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি চাচ্ছিলেন সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তিনিই যেন সর্বেসর্বা থাকেন। বর্তমান অবস্থায় তার প্রেসিডেন্টের কাছে যেতে হলে দুটি ধাপ পেরিয়ে যেতে হয়। খন্দকার মােশতাক আহমদও রগচটা লােক ছিলেন। জিয়াউর রহমান তাকে পছন্দ করতেন না। মােশতাকেরও জিয়াকে পছন্দ হতাে না। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে সবাইকে এক খােয়াড়ে ইচ্ছায় হােক, অনিচ্ছায় হােক, মানিয়ে চলতে হচ্ছিল। বলা যেতে পারে ঐ সময় প্রেসিডেন্ট মোশতাক ও সেনাপ্রধান জিয়ার মধ্যে একমাত্র যােগাযোগসূত্র ছিল মেজর রশিদ। মেজর রশিদ ছিলেন প্রধান সমন্বয়কারী অফিসার (Chief Co-ordinator) দু-একদিন পর পরই তিনি একগাদা ফাইল বগল দাবা করে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মােশতাকের কাছ থেকে আর্মি হেডকোয়াটারে সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে আসতেন। আবার জিয়ার কাছ থেকে তার পয়েন্ট নিয়ে মােশতাকের কাছে যেতেন। সরাসরি জিয়া-মােশতাকের মধ্যে বিশেষ কথাবার্তা বা দেখা সাক্ষাতও হত না। ওসমানীর সাথেও না। এভাবেই চলছিল দৈনন্দিন কাজকর্ম।
ঐ সময় একটি মজার ব্যাপার ঘটল। সেপ্টেম্বর মাসে একদিন হঠাৎ প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী আকস্মিকভাবে ঢাকা স্টেশনের অফিসার ও জেসিওদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে আসেন ক্যান্টনমেন্ট মিলনায়তনে। জিয়ার এ ব্যাপারটা মােটেই পছন্দ হলাে না। সে আমাকে ডেকে বলল ; হামিদ, আমি ও-ব্যাটা ওসমানীর সাথে বসতে চাই না। তুমি মাঝখানে ওর পাশে বসবে। তাই হলাে। ওসমানী আসলেন এবং ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার সাথে তার সাধারণ হাত মেলানাে ছাড়া আর কোন কথাই হলাে না। তিনি হল রুমে এসে বসলেনও না। বঙ্গভবনের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুদশ্য কামরাগুলােতে ক্য’র মেজররা শক্তভাবে জেঁকে বসে দেশ শাসন করতে লাগলাে। তারা নিজস্ব স্টাইলে বঙ্গভবনে একটি অঘােষিত সেক্রেটারিয়েট তৈরি করে বিভিন্ন দিকে নির্দেশ দিতে লাগলাে। স্বভাবতই ক্যান্টনমেন্টের অফিসারদের এসব পছন্দ হচ্ছিলাে না। কিন্তু মােশতাকও এসব অফিসারদের কিছু করতে পারছিলেন না, কারণ তারাইতাে একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে এই নতুন সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এভাবে সরকার পরিচালনার ব্যাপারে বঙ্গভবন ও ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে। মতানৈক্য ও তিক্ততার সৃষ্টি হলাে। জিয়াউর রহমান চুপচাপ, নীরব দর্শক। শেখ মজিবুর রহমানের মত খন্দকার মােশতাককেও সামরিক বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অর্থাৎ তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব সামাল দিতেই দেশের প্রেসিডেন্টদের গলদঘর্ম অবস্থা। চতুর মােশতাক অবশ্য এ কাজটি কিছুটা সামাল দিতে পেরেছিলেন, তার ডিফেন্স উপদেষ্টা হিসাবে বর্ষীয়ান জেনারেল ওসমানীকে তার পাশে এনে এবং চীফ-অব-ডিফেন্স স্টাফ পােস্ট সৃষ্টি করে। কিন্তু তাতেও কি রক্ষা। জুনিয়ার মেজরদের সফল অভ্যুত্থান ক্যান্টনমেন্টের কিছু সিনিয়ার এমন কি দুনিয়ার অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতায় আরােহণের নূতন প্রেরণা যােগালাে। সবাই একে অন্যকে ডিঙ্গিয়ে টেক্কা দিয়ে কেউ চীফ, কেউ প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নে বিভাের হয়ে উঠলাে। দেশের সর্বোচ্চ পদটি এখন বন্দুকের নলের ধরাছোঁয়ার নাগালে বলে মনে হতে লাগলাে। খালি ময়দান। খালি ময়দানে এই মুহূর্তে জিয়া, খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল ও তাহের। তারা নিজেদের পরিকল্পনায় গােপনে শক্তি সঞ্চয় করতে তৎপর হয়ে উঠলাে। শুরু হল ক্ষমতার লড়াই। পানি ঘােলা হয়ে উঠলাে। মৎস শিকারের এটাইতাে উপযুক্ত সময়। শিকারীরাও প্রস্তুত।
রাজনৈতিক অবস্থা ততদিনে যথেষ্ট স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। আসন্ন ফেব্রুয়ারীতে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘােষণাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তবুও কোথায় যেন অস্বস্তি ঠেকছে সবার রাজধানীর উত্তর পাড়া নিয়েই উদ্বিগ্ন সবাই। ওদিকে একটা ঝড় উঠছে, সবার তাই আশাঙ্কা । এ রকম একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসে ঘটনাবহুল মাস নভেম্বর। | অক্টোবর মাসে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে সামরিক অফিসারদের মধ্যে কোন্দল প্রবল হলাে। জিয়া এবং খালেদ গ্রুপের মধ্যে একটি মুখােমুখি সংঘাত প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয় উঠল। বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশিদরাও স্পষ্ট বুঝতে পারলাে, এ দু’গ্রুপের সংঘর্ষে তাদের অবস্থানেরও বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। সেনা প্রধান জিয়াকে বারবার বলা সত্বেও তিনি প্রতিপক্ষ গ্রুপের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। এতে বঙ্গভবনে মােশতাক, ওসমানী, খলিল, রশিদ, ফারুক সবাই জিয়ার সততা নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাদের আশংকা হয়, জিয়া কি নিজেই একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে যাচ্ছে? ২/৩ নভেম্বর রাত। ২রা নভেম্বর। রাত আনুমানিক এগারােটা। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় বাসায় এসে বাইরে থেকে কে যেন ক্রমাগত কলিং বেল বাজাতে লাগল। মনে হল অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ব্যাটম্যান ছমুজ আলীকে পাঠালাম দেখে আসতে এত রাত্রে কে আসলাে, কি চায়? হন্তদন্ত হয়ে আমি ফিড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের কমান্ডার মেজর মুদাসসার বাসায় প্রবেশ করলাে। হাফাতে হাফাতে বলল, স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট কু করছে। তারা টুপ মুভ করছে। আপনি এক্ষুণি জেনারেল জিয়াকে খবর দিন। আমি তাকে বললাম কিছুদিন ধরে জিয়া আমার কথা মােটেই শুনছে না। তুমি বরং সরাসরি নিজেই যাও এবং সংবাদটা জানাও। সে বলল, স্যার তিনি আর্মি চীফ। আমি কিভাবে এই মুহুর্তে সরাসরি যাই। আপনি ফোনে বলে দিন।
আমি তাকে বললাম, দেখ এখন গভীর রাত। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু বিস্তারিত না জেনে উঠানাে ঠিক হবে না। তুমি বরং সােজা তার বাসায় যাও। সে যদি রাগ করে বলে দিও, আমার নির্দেশে তুমি। সেখানে গেছাে। আমিই তােমাকে পাঠিয়েছি। যাও, সময় নষ্ট করাে না। সে ছিল খুবই । উত্তেজিত। সজোরে তার গাড়ি হাঁকিয়ে তৎক্ষণাৎ সেনাভবনের দিকে রওয়ানা দিলাে। | অজানা আশঙ্কায় কিছুক্ষণ জেগে জেগে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সে-রাত্রে কোন গােলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল না। গত ক’দিন ধরে এভাবে আমরা প্রতিরাতেই কিছু একটা ঘটনার আশঙ্কা করছিলাম। কিন্তু ঘটছিলাে না। একটি অ্যুত্থানের গুজব বেশ ক’দিন ধরেই শুনে আসছিলাম। জিয়াউর রহমানকেও বলেছিলাম, কিন্তু সে মােটেই এসব কথা আমল দেয়নি। উল্টো আমাকেই উপহাস করেছে। মধ্যরাতের অভ্যুত্থানে জিয়া বন্দী গভীর রাত পর্যন্ত বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক, জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, মেজর রশিদ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপরত ছিলেন। তারা জিয়া এবং খালেদ মােশাররফ, এ দুজনের রেষারেষি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে খুবই বিব্রত বোধ করছিলেন। মােশতাক, ওসমানী, খলিল তারা সবাই চাচ্ছিলেন উচ্চাকাক্ষী জিয়াকে সেনাপ্রধান পদ থেকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রশিদ একমত হচ্ছিল না। জিয়াকে সরিয়ে খালেদ মােশাররফকে চীফ বানানাের সে পক্ষপাতি ছিল না। যদিও ফারুক চাচ্ছিল খালেদকে চীফ” বানান হােক। কিন্তু বঙ্গভবনে তখন ফারুকের চেয়ে রশিদের মতামতের ওজন ছিল বেশী। এছাড়া এ দু’জনকে সরিয়ে নতুন কাকে চীফ অব স্টাফ বানানাে যায়, এ নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই ‘উত্তর পাড়া থেকে আর একটি অভুত্থানের দমকা হাওয়া। বঙ্গভবনের দ্বারপ্রান্তে এসে আঘাত হানলাে।
রশিদ তার সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছে, জিয়া এই সময় সরাসরি দেশের প্রেসিডেন্ট। হওয়ার জন্য একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। আমি তাকে কত বুঝালাম, স্যার, আপনি এখনও অনেক ইয়াং। এখন আপনাকে প্রেসিডেন্ট মানাবে না। একটু অপেক্ষা করুন। এখন চীফ আছেন ভালই আছেন। কিন্তু জিয়া অস্থির। অগত্যা আমি তাকে বলি, তাহলে স্যার এটা আমি পারবাে না। আপনাকেই আপনার পথ করে নিতে হবে। আমি যতদূর পারি আপনাকে সাহায্য করব। | গভীর রাতে এক সময় তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন; জিয়া, খালেদ উভয়কেই সরিয়ে দেওয়া উচিত। বঙ্গভবনে তারা এসব নিয়ে যখন আলাপ আলােচনা করছিলেন, তখন একজন পুলিশ এসে জানায়; স্যার, বঙ্গভবন থেকে আর্মির লােকজন সব পালিয়ে গেছে। • মেজর ইকবালের অধীনে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল বঙ্গভবনে। রাত আনুমানিক বারােটার দিকে তারা অকস্মাৎ বঙ্গভবন ত্যাগ করে। প্রহরীবিহীন বঙ্গভবন। ঝড়ের নিশ্চিত পূর্বাভাস। মিটিং ভেঙ্গে গেল। তারা বুঝতে পারলেন, তারা যা আশংকা করেছিলেন, তাই ঘটতে যাচ্ছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। রাত সাড়ে বারােটা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে প্রবেশ করলেন। কর্নেল আমিনুল হককে কৌশলে দূরে সরিয়ে তিনিই ইউনিটের সার্বিক পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। তার সাথে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিল ও অন্যান্য অফিসার। কর্নেল মালেক, ব্রিগেডিয়ার। রউফ, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান, মেজর হাফিজউদ্দিন, মেজর ইকবাল, মেজর নাসের, মেজর আমিন, স্কোয়াড্রন লীডার লিয়াকত প্রমুখরা ছিলেন।
অনেকে সকালের দিকেই আসে। ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক এবং এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন মুনীরকে ক্ষমতাহীন করে বসিয়ে রাখা হয়। | প্রথমেই ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লার নেতৃত্বে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্ল্যাটুন জিয়ার বাসায় ঝটিকার বেগে পাঠিয়ে তাকে গৃহবন্দী করা হয়। রাত তখন ১টা। একই সঙ্গে জিয়ার বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লা জিয়ার সাথে বৈঠকখানায় বসে তাকে বললাে, “স্যার আপনি বন্দী’। অতঃপর ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা জিয়ার বাসা ঘেরাও করে বাইরে থেকে সকল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাে। গৃহবন্দী হলেন জিয়া। বিনা বাধায় অপারেশনের প্রথম পর্ব সমাপ্ত হলাে। মধ্যরাতে কোথাও টু’ শব্দটি পর্যন্ত হলাে । যতদূর জানা গেছে, সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করার কাজ, অর্থাৎ প্রথম পর্বের অপারেশন, ৪৬ ব্রিগেডের কিছু তরুণ অফিসারগণ নিজেদের উদ্যোগেই সম্পন্ন করে। ব্রিগেড মেজর হাফিজউদ্দিন এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসলে ফারুক-রশিদের সফল অভ্যুত্থান তরুণ মেজরদের এ্যাডভেঞ্চারাস্ অভিযানে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে। জিয়াকে তার বাসভবনে বন্দী করার পরই খালেদ মােশাররফকে অভ্যুত্থানের খবর দেওয়া হয়। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি সরাসরি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেডকোয়ার্টারে ছুটে আসেন। ব্রিগেড কমাণ্ডার শাফায়েত জামিলও একই সময়ে আসেন। | তিনি আসার পর অবস্থা পরখ করে অপারেশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। শুরু হয় অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ প্রথম পদক্ষেপ : ৪র্থ বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী এয়ারপাের্ট রােডের কাওরান বাজার এরিয়াতে অবস্থান নিয়ে বঙ্গভবন থেকে আসার সকল যােগাযোগ বন্ধ করে দেন। ৪র্থ বেঙ্গলের আরাে কিছু সৈন্য এন্টি-ট্যাংক রকেট নিয়ে আশেপাশে অবস্থান নেয়। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেডিও স্টেশন দখল করে। ১ম বেঙ্গলের দু’টি কোম্পানী সৈন্য বঙ্গভবনের আশেপাশে ঘেরাও করে অবস্থান গ্রহণ করে। রেডিও ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাতের অন্ধকারে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে ৪৬ ব্রিগেডের ইউনিটগুলাে ক্যান্টনমেন্ট ও শহরের বিভিন্ন স্থানে কৌশলগত অবস্থান নেয়, কিন্তু কোথাও কোন হামলা হয়নি। এভাবেই শুরু হয়ে গেল ৩রা নভেম্বরের রক্তপাতহীন নিরব অভ্যুত্থান। ক্যান্টনমেন্টে সবাই তখন সবাই ঘুমিয়ে। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মধ্যরাত ১২টা থেকেই অপারেশন হেড কোয়ার্টার হিসাবে কাজ করছিল। খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল ও ৪৬ ব্রিগেডের অন্যান্য অফিসাররা সেখানেই অবস্থান করছেন। সমস্ত অপারেশন পরিচালনা করছেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। তার সাথে রয়েছেন ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিল। ঘটনা গড়াতে শুরু করলাে। মধ্যরাতে ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুত্থানের খবর পেয়েই মেজর রশিদ বঙ্গভবনে ঘুম থেকে তুলে ফারুককে এ সংবাদ দেয়। ফারুক সঙ্গে সঙ্গে তার ট্যাংকগুলাে সচল করে ফেলল। বঙ্গভবনের চারিদিকে সাজ সাজ রব। ৮টি ট্যাংক বঙ্গভবনে। ৮টি ছিল সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাকিগুলাে ক্যান্টনমেন্টে। সবগুলাে ফাইটিং এর জন্য তৈরি হয়ে গেল। ফারুক বঙ্গভবন থেকে ছুটে গিয়ে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ট্যাংকগুলাের কমান্ড গ্রহণ করলাে। সবগুলাে ট্যাংকেই তখন গােলা-বারুদ মৌজুদ রয়েছে। রশিদ বঙ্গভবনেই রয়ে গেল। ফারুক ফাইটার। রশিদ ফাইটার কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক সমন্বয়কারীও বটে, যােদ্ধাবেশে অস্ত্র কাধে মােশতাকের পাশে বসে সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে।
বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলাে যখন বঙ্গবভন ও সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধংদেহী পজিশন নিয়েছে, তখন ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের অধিকাংশ কামান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বাকি কামানগুলাে ক্যান্টনমেন্টে ইউনিট লাইনেই রয়েছে। তারা ওখানে প্রস্তুতি পজিশনে তৈরি হয়ে রইলাে। সবাই নিজ নিজ স্থানে প্রস্তুতি গ্রহণ করে আক্রমনাত্মক পজিশনে তৈরী হয়ে রইলাে। লড়বাে নয় মরবাে।” ৩রা নভেম্বর-পাল্টা অভ্যুত্থান। সকাল থেকেই সারা দেশে আবার বিভ্রান্তি। রেডিও বাংলাদেশ ধরতে গিয়েই বিপত্তি। কোন শব্দ নেই। রেডিও বন্ধ। সবাই ধরে নিল আবার ক্ষমতার হাতবদল হয়ে গেছে। যদিও মােশতাক তখনও প্রেসিডেন্ট। শাফায়েত জামিল সাভারে অবস্থিত রেডিও ট্রান্সমিটারের একটি অংশ খুলে নেওয়ায় রেডিও ব্রডকাস্টিং সম্পূর্ণ বন্ধ। দেশের মানুষ আর একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের আশকায় ভীত হয়ে পড়ল। | ভােরবেলা বঙ্গভবনের উপর দিয়ে দুটি মিগ ফাইটার প্লেন প্রচন্ড শব্দে উড়ে গেল। তারা বঙ্গভবনের উপর চক্কর খেতে লাগল। মােশতাক প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। একটি হেলিকপ্টারও ক্যান্টনমেন্টের উপর সশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছিলাে। ফারুক একটি প্লেন গুলি করে নামাবার অনুমতি চাইলাে। ওসমানী এরকম অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্ট তখন দুটি পৃথক দেশ। দুই দিকের সেনাবাহিনী একে অন্যের মুখোমুখি। তারা চরম প্রস্তুতি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে রইলাে। যে কোন মুহুতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রবল আশঙ্কা দেখা দিলাে। বঙ্গভবনে অবস্থিত ফারুক-রশিদের ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনী, ক্যান্টনমেন্টে রয়েছে খালেদ-শাফায়েতের পদাতিক বাহিনী। | খন্দকার মােশতাক আহমদ দারুণ ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ বর্ষীয়ান নেতা জেনারেল ওসমানকে ফোন করে তাড়াতাড়ি তাকে বঙ্গভবনে আসতে অনুরােধ করলেন। আসার পূর্বে ওসমানী টেলিফোনে ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে কথা বললেন। খালেদ সন্ত্রমভরেই তার সাথে কথা বললাে; স্যার, সবকিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছে। ওরা কিছু না করলে, আমরা কিছুই করবাে না। ওদের আপনি শান্ত রাখেন। আপনি চিন্তা করবেন না।
৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের লাইনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের অপারেশন হেড কোয়ার্টার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওখানে তরুণ অফিসারদের ভীড়। সকালবেলা সবাই উত্তেজিত। এদিক ওদিক ছুটাছুটি। কে কি করছে বুঝা যাচ্ছে না। সর্বত্র বিভ্রান্তি। একমাত্র খালেদ মােশাররফই শান্ত, ধীরস্থির, গম্ভীর। ওদিকে সকালবেলা ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে রীতিমত যুদ্ধাবস্থা। বেঙ্গল ল্যান্সারের ১২টি ট্যাংক ওখানে আক্রামনাত্মক পজিশন নিলে সেকেণ্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টুপস এন্টি-ট্যাংক গান নিয়ে তাদের ঘেরাও করে রাখে। দুপক্ষই মুখােমুখি। মাথার উপর উড়ছে জঙ্গী বিমান। উড়ছে হেলিকপ্টার। তারাও যে কোন মুহুর্তে আক্রমনে উদ্যত। ল্যান্সাররা বিদ্রোহী গ্রুপের দুজন অফিসার মেজর নাসের এবং মেজর আমিনকে ধরে বন্দী করে ফেলে। তাদের ছেড়ে দিতে বলা হলাে, কিন্তু ল্যন্সাররা ছাড়তে অস্বীকার করে। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত দুইপক্ষ পায়তারা করে মুখােমুখিই বসে রইল। কেউ কাউকে আক্রমন করলাে না। আপােষ-আলােচনা চলতে থাকলাে। প্রথমে শাফায়েতরা ভেবেছিল ৪৬ ব্রিগেড মুভ করলেই বঙ্গভবনের মেজররা সহজেই সারেণ্ডার করবে। কিন্তু ফারুক-রশিদ ট্যাংক, কামান নিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তারা সবাই বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। অথচ ক’দিন আগেও শাফায়েত জামিল কথায় কথায় বলতাে, আমাকে অনুমতি দিলে এসব আরমার-আর্টিলারীদের আধ ঘন্টার মধ্যেই ফিনিশ করে দিতে পারি। হুজুগের প্ল্যান। তরুণ মেজররা যা করার তাই করে ফেলেছে। এখন সিনিয়ার কমান্ডার হিসাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে তা সামাল দিতে হচ্ছে। তার ঘাড়ে বিরাট দায়ি ত্বভার। | ভাের ৫ টায় স্টেশন হেডকোয়ার্টার থেকে আমার ডিউটি অফিসার ফোন করে সংবাদ দিল, স্যার আজ রাত্রে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে। তারা জেনারেল জিয়াকে তার বাসায় অ্যারেস্ট করে রেখেছে। ‘তাই না কি ? ‘জি, স্যার।’
আমি তৎক্ষণাৎ জিয়ার বাসায় ফোন করলাম। তার বাসার লাইন ডেড। ‘হ্যালাে। হ্যালাে। হ্যালাে।’ কোন শব্দ নেই। আমার বুঝতে বাকি রইল না, আর একটি অভ্যুত্থান ঘটে গেছে। সামনে কি আছে, কে জানে। আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আমার জীপ নিয়ে তখনই জিয়ার বাসভবনে ছুটে গেলাম। ক্যান্টনমেন্টের বড় রাস্তার মােড়েই এম পি এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেপাইরা দাড়িয়েছিল। তারা আমার জীপ থামিয়ে বিনয়ের সাথে বললাে; স্যার, সামনে যেতে মানা আছে। দয়া করে ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়াটারে একটু কথা বলুন। সব বুঝতে পারবেন।
কয়েকদিন আগে শেখ সাহেবের বাসায় হতভাগ্য কর্নেল জামিলুর রহমানের দশা আমার তা মনে পড়ে গেল। আমি আর অগ্রসর হলাম না। জীপ ঘুরিয়ে আমার অফিসে ছুটে গেলাম বন্দী জিয়া : খালেদের ‘টেলিফোন-ব্যাটল” অফিসে পৌছে ফোন করলাম কর্নেল শাফায়েতকে। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপারটি শাফায়েত? সে বলল, আমরা মেজরদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আপনি তো জানেনই তাদের কথা। ‘সি, জি, এস, কোথায়?” ‘সি, জি, এস, আমাদের সাথেই আছেন। আমরা সবাই এখন ৪ বেঙ্গল-এ আছি।” “তােমরা কি জিয়াকে অ্যারেস্ট করেছ? ‘না, ঠিক তা নয়। তাকে আমরা বাসায় হেফাজতে নিয়েছি। হি ইজ অল রাইট। আমি তাকে বললাম, সব বুঝলাম শাফায়েত, কিন্তু এসব করা কি ঠিক হচ্ছে? সে বলল, স্যার আপনি ফোর বেঙ্গল-এ আসেন। সবাই আছে, এখানে কথা হবে। থ্যাংক ইউ। সকাল সকাল বেশ কিছু অফিসার আমার অফিসে ছুটে আসলেন। বেশ কিছু জে সি ও এবং সৈনিকরাও বাইরে ভীড় করেছে। প্রত্যেকের মুখে হতাশার ছাপ। সবাই অসন্তুষ্ট। সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ বন্দী। এ কেমন কথা! তাদের কেউ আর্মি চীফকে বন্দী করে রাখাটা মােটেই গ্রহণ করতে পারছে না। খালেদ মােশাররফ ও শাফায়েত এটা বুঝতেই পারলাে না, তাদের এ ধরনের পদক্ষেপ কত বড় ভূল হলাে। তাদের এই ভুল পদক্ষেপ জেনারেল জিয়ার ইমেজ তাদের অলক্ষ্যেই এক দিনেই আকাশচুম্বি করে তুললাে। প্রতিটি সৈনিকের সহানুভূতি জিয়ার দিকে আকৃষ্ট হলাে। এর জন্য জিয়াকে কিছুই করতে হলাে না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ তার অজান্তেই এই একটি একটি মাত্র ভুল পদক্ষেপের জন্য তার মহা বিপদ ডেকে আনলেন।
সৈনিকদের মধ্যে জিয়ার জনপ্রিয়তা এক দিনেই নীরবে তুঙ্গে চড়ে গেল। সারা ক্যান্টনমেন্টে একটি কথাই সৈনিকদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল, ‘জিয়া বন্দী। ‘চীফ অব স্টাফ বন্দী।’ অফিসারদের এসব কার্যকলাপ মােটেই কারাে পছন্দ হলাে না। খালেদের অভ্যুত্থান প্ল্যান ছিল কয়েকজন তরুণ অফিসার দ্বারা প্রণীত একটি হুজুগের প্ল্যান। যা খালেদকে কার্যকর করতে হচ্ছে ঘটনা ঘটানাের পর। তাদের অপারেশন চলছিল বাবুদের মত অফিসের টেবিলে বসে কাগজে আর টেলিফোনে, বলা যেতে পারে টেলিফোন যুদ্ধ (relephone Battle), যেখানে ছিল না যুদ্ধের উন্মাদনা ও গতি। | ৩ তারিখ সকাল বেলা। ৪র্থ বেঙ্গল হেড কোয়ার্টারে বসে কর অন্যান্য অফিসারদের উপস্থিতিতে খালেদ মােশাররফ একটি দাবি-নামা প্রস্তুত করলেন। তিনিই ডিক্টেশন দিলেন। বাকিরা মাথা নাল। তিনটি দাবি ছিল : (১) ট্যাংক ও কামান বঙ্গভবন ও শহর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠাতে হবে। (২) জিয়া এখন থেকে আর চীফ অব স্টাফ নন। (৩) বঙ্গভবনে বসে ফারুক-রশিদের কার্যক্রমের অবসান ঘটবে। তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে চেইন অব কমান্ড’ মানতে হবে। খন্দকার মােশতাক প্রেসিডেন্ট থাকবেন। এই সময় ব্রিগেডিয়ার রউফ হাত উচু করে বললেন, আমার একটি পয়েন্ট আছে। চার। নম্বর পয়েন্ট হবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে আমি চীফ ঘােষণা করতে হবে। কনেল চিশতিরও একই কথা। খালেদ কিছু বললেন না। মৃদু হাসলেন। এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান বলেছিলেন, জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে রাখা ঠিক হবে না। তাকে দূরে কোথাও সরিয়ে নেওয়া উচিত। কিন্তু তার কথায় তখন কেউ কান দেয়নি। ‘দেশের পরিস্থিতি বিস্ফোরণমুখ হয়ে উঠল। যে কোন মুহূর্তে তুমুল গােলগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, জনসাধারণ সম্পূর্ণ বে-খবর। শহরের রাস্তাঘাটে জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কোথাও ভয়ভীতি বা বিভ্রান্তির কোন চিহ্নই নাই। অফিস আদালতে শুধু ফিসফাস্, গুঞ্জন, নানা জিজ্ঞাসা।
বঙ্গভবনে সরকার বলতে তখন একমাত্র প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আর তার সাথে বর্ষীয়ান জেনারেল ওসমানী। খালেদ মােশাররফের পক্ষ থেকে একটি ডেলিগেশন বঙ্গভবনে রওয়ানা দিতে প্রস্তুত হলাে। ডেলিগেশনে ছিলেন কর্নেল মালেক (সাবেক মন্ত্রী), কর্নেল মান্নাফ,ও কর্নেল চিশতি। বঙ্গভবনে ঢুকতে তাদের দস্তুরমত ফারুক-রশিদের অনুমতি নিতে হয়। কারণ ক্যান্টনমেন্ট ও বঙ্গভবনে দুই প্রান্তে তখন যুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান। এক দেশের দূতরা অন্য দেশে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিনই উভয় প্রান্তে টেলিফোনে কথাবার্তা আপােষ-আলােচনা চলতে থাকে। সকালবেলা ডালিম এসেও কথাবার্তা বলে যায়। সারাদিন দূতদের আনাগােনা, সলাপরামর্শ। খন্দকার মােশতাক খালেদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে কেবিনেটের অনুমােদন ব্যতিত কোন সিদ্ধান্ত দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বললেন, আমি পদত্যাগ করবাে। ওসমানী অবশ্য সৈনিকদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবে একমত হলেন। ওসমানীর প্রস্তাবে মােশতাকও রাজী হলেন। কিন্তু মেজর রশিদ রাজী হলাে না। ক্যান্টনমেন্টে মেজরদের ফেরত পাঠানাের দাবির কথা মেজর রশিদ শুনতে পেয়ে সে তৎক্ষণাৎ এসে মােশতাক সাহেবকে বললাে ; স্যার, আমরা কিছুতেই ওখানে ফিরে যাবাে না। এরচেয়ে বরং আমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। রশিদ প্রস্তাব দিলাে, দরকার হলে বিদেশী প্লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফারুক দেশত্যাগে রাজী ছিল না। কিন্তু রশিদ তাকে বুঝিয়ে রাজী করায়। এসব শুনে মােশতাক ঘাবড়ে যান, তিনি কাদোকাদো কন্ঠে বলেন, তাহলে বাবা আমাকেও তােমাদের সাথে বাইরে যেতে দাও। মেজরদের দেশত্যাগ। অনেকক্ষণ আলােচনার পর খন্দকার মােশতাক প্রস্তাব দেন মেজরদের ক্যান্টনমেন্টে না পাঠিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। ওসমানী এ নিয়ে খালেদের সাথে আলােচনা শুরু করলেন। কর্নেল মালেক খালেদকে টেলিফোনে এই পরিস্থিতির কথা জানালে তিনি এ ব্যাপারে আরাে আলােচনার জন্য তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে বলেন।
অতঃপর ৪র্থ বেঙ্গলে খালেদের হেডকোয়াটারে এ নিয়ে মিটিং বসলাে। উপস্থিত ছিলেন এয়ার মার্শাল তােয়াব, এ্যাডমিরাল খান, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান, ব্রিগেডিয়ার রউফ, কর্নেল মালেক প্রমুখরা। বহুক্ষণ আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হলাে, এই মুহূর্তে শাস্তির খাতিরে তাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়াই মঙ্গলজনক হবে। বাংলাদেশ বিমানের একটি প্রেনের ব্যবস্থা। করা হবে।
শেষ পর্যন্ত উভয়পক্ষের সম্মতিতে মেজরদের দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়। এয়ার মার্শাল তােয়াবকে তাদের দেশত্যাগ, প্লেনের ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা ইত্যাদির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যােগাযােগ করে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ফারুক এবং রশিদ উভয়েই বলে, আমরা শুধু রক্তপাত এড়াবার জন্য দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের শক্তি ওদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। ফারুক বলে, আমি তাে তখনই ট্যাংক নিয়ে সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে মার্চ করে ৪৬ ব্রিগেড উড়িয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলাম। যদিও মেজর রশিদের দেশত্যাগের অতি-আগ্রহের কারণ নিহিত ছিল ‘অন্যত্র’ (?) ৩ তারিখ দুপুরের দিকে পুলিশের আই জি বঙ্গভবনে ফোন করলে জেনারেল খলিল ফোন ধরেন। আইজি তাকে জানান, গত রাত্রে আর্মির লােকজন জেলে ঢুকে চার আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে। তিনি চমকে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারী মাহবুব আলম চাষীকে সংবাদটি দিয়ে প্রেসিডেন্টকে জানাতে বলেন। চাষী তখনই প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে সংবাদটি দেন। রুম থেকে বেরিয়ে এসে চাষী বলেন, প্রেসিডেন্ট ঘটনা জানেন’। ঐদিন বঙ্গভবন ও ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধাবস্থার উত্তপ্ত পরিবেশ বিদ্যামান থাকায় সংবাদটি জেঃ খলিল আর কাউকে শােনাননি, চেপে যান। তার কথা হলাে, আমি ডিফেন্স স্টাফ প্রধান। আমার দায়িত্ব প্রেসিডেন্টকে ঘটনাটি জানানাে। আমি তাই করেছিলাম। অন্যান্যদের বলাবলি করতে যাবাে কেন? ওদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসাররা সারাদিন পরিশ্রম করে মেজরদের দেশত্যাগের ব্যাপার চূড়ান্ত করতে সক্ষম হন। ৩ তারিখ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের একটি প্লেন তেজগাও বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছিল। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ফারুক-রশিদসহ ১৭ জন সদস্য বিমানে আরােহণ করে। তারা তাদের স্ত্রীদেরও সঙ্গে নিয়ে যায়। মেজর শাহরিয়ার তার বান্ধবীকেও সাথে নিয়ে যায়। প্লেনে আরােহণের সময় বিপদ আশংকা করে মেজররা তাদের অস্ত্রশস্ত্র সাথে রাখতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলাে ফেলে রেখে যেতে হয়। যাওয়ার সময় তাদের বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। সন্ধ্যা ৮-৪৫ মিনিটে প্লেন তেজগাও বিমান বন্দর ত্যাগ করে। চট্টগ্রামে রিফিলিং করে প্লেনটি আবার সরাসরি ব্যাংকক রওয়ানা দেয়। মেজরদের দেশত্যাগের পর বঙ্গভবনে নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হলাে। খালেদ মােশাররফ চাইছিলেন মােশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে কাজ চালিয়ে যাবেন।
কিন্তু মােশতাক বললেন, তিনি ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। এখন তিনি তার নিজ বাসভবনে চলে যাবেন। বহুক্ষণ বিতর্ক চলার পর মােশতাক দুটি শর্তে রাষ্ট্রপতি থাকতে সম্মত হলেন| প্রথমতঃ সেনাবাহিনীকে তার প্রতি অনুগত থাকতে হবে এবং সশস্ত্র বাহিনী প্রধানরা তার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। দ্বিতীয়তঃ মন্ত্রিসভাকে বৈঠকে বসতে দিতে হবে এবং মন্ত্রিসভাকে তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের কাছে এই সব মােটামুটি মনঃপূত হলেও তিনি দাবি করলেন তাকে জেনারেল জিয়ার স্থলে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়ােগ করতে হবে। খালেদের এই দাবি এয়ার ভাইস মার্শাল তােয়াব এবং এডমিরাল এম এইচ খানও সমর্থন করলেন। প্রেসিডেন্ট এবং খালেদ মােশাররফের মধ্যে এসব বিতর্ক রাত এগারােটা পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু একগুয়ে মােশতাক কেবিনেটের অনুমােদন ছাড়া চীফ অব স্টাফ পরিবর্তন করতে অস্বীকার করেন। জেঃ ওসমানীও মােশতাককে সমর্থন করেন।
কুখ্যাত জেল হত্যা
২/৩ নভেম্বর গভীর রাতে সবার অজ্ঞাতে সংঘঠিত হলাে এক জঘন্যতম হত্যাকান্ড। রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল গাড়ী করে সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছায়। তারা ভিতরে ঢুকে অন্তরীণ আওয়ামীলীগ নেতাদের বাইরে নিয়ে যেতে চায়। জেলার আবদুল আওয়াল সশস্ত্র সৈন্য দেখে ভেতরে ঢােকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে ঘাতক দলের অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটি হলাে। তারা জোর করে ঢুকে যেতে চাচ্ছিলাে। কারাগারে পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল। অবশেষে ডি আই জিকে বাসা থেকে ডেকে আনা হলাে। তাকে মােসলেম উদ্দিন ও তার লােকজন জানালাে যে, ফারুক ও রশিদ তাদের পাঠিয়েছে। তারা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে তাদের হাতে তুলে দিতে বললাে। ডি আই জি প্রিজন বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলেন, এটা। জেল আইনের পরিপন্থী। চার নেতাকে তাদের হাতে এভাবে তিনি তুলে দিতে পারেন না। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। মােসলেম উদ্দিন তখন তাকে বঙ্গভবনে। মেজর রশিদকে ফোন করতে বলে। টেলিফোনে রশিদ ডি আই জি প্রিজনকে নির্দেশ দেন, মােসলেম উদ্দিনের কথামতাে কাজ করতে। এই নির্দেশের পরেও ডি আই জি প্রিজন তার। সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি তার কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলােচনার পর। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সঙ্গে সরাসরি ফোন করে তার নির্দেশ কামনা করেন। মােশতাক মেজর রশিদের নির্দেশ মতােই কাজ করতে বলেন। এর ফলে মােসলেম উদ্দিন ও তার দল চার নেতার সেলে যাওয়ার অনুমতি পান। খােদ প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিলে বেচারা। ডি আই জি, কিইবা করতে পারে? | তাজউদ্দিন এবং নজরুল ইসলাম ১নং সেলে ছিলেন। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী। ও কামরুজ্জামান। তাদেরকে তাজউদ্দিনের সেলে এনে জড়াে করা হয়। তারপর খুব কাছে। থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন সঙ্গে। সঙ্গেই মারা যান। তাজউদ্দিনের পায়ে ও হাঁটুতে গুলি লাগে, প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে। মারা যান। তিনি পানি পানি বলে কাৎরাচ্ছিলেন। কিন্ত ভীত বিহুল পরিবেশে কেউ এক ফোটা পানি এগিয়ে দিতেও সাহস পায়নি। পাশের সেলে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ। তার নাম লিস্টে না থাকায় ঘাতকরা তাকে ছেড়ে দেয়। বেঁচে গেলেন আজাদ। কেউ কিছু ভাল করে বুঝে উঠবার আগেই আকস্মিকভাবে ঘটে গেল এই হত্যাকাণ্ড।
ঘটনাটি এতই বর্বরােচিত ছিল যে মুখ খুলে কেউ কিছু বলতেও সাহস পায়নি। সৈনিকদের কি প্রয়ােজন পড়েছিল, একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের জেলের ভেতরে ঢুকে হত্যা করার? এর একমাত্র কারণ মনে করা হয়, খন্দকার মােশতাক আহমদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ঐসব রাজনৈতিক নেতা। কোন কারণে যদি তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তাহলে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে তার প্রতিপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রথম আভাসেই নির্মূল করে দেওয়ার পূর্ব প্রণীত (Pre-emptive) প্ল্যানটিই মােসলেম উদ্দিন নীল নকশার শিডিউল অনুযায়ী কার্যকর করে। কারাগারের অভ্যন্তরে এরকম নির্মম ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনাে ঘটেনি।
৪ নভেম্বর
সারাদিন সেনা ছাউনির সর্বত্র একই জল্পনা-কল্পনা—আর্মি চীফ জিয়াকে কেন বন্দী করে। রাখা হবে? এটা কোন ধরনের আর্মি? এসব কি ধরনের খেলা? অফিসারদের মধ্যে যদি ক্ষমতা নিয়ে এভাবে কাড়াকাড়ি চলে তাহলে সেপাইরা কোন দিকে যাবে ? এটা কি ভারতীয় চক্রান্ত? খালেদ কি ভারতের চর। ধর্ম-কর্ম কি বন্ধ হয়ে যাবে? চলে ঢালাও কানা-ঘুষা। ক্যটমেন্টের ভিতরে বাইরে সর্বত্র অশুভ জল্পনা কল্পনা।
এখানে অবাক হওয়ার ব্যাপার, হ,ে মাত্র কিছুদিন স্ব-পরিবারে রাষ্ট্রপতি শেখ মজিবর রহমান সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হন, কিন্তু তার মৃত্যুঘটনা নিয়ে সৈনিকর উত্তেজিত হয়নি, বিশেষ মাথাও ঘামায়নি, অথচ জিয়াউর রহমানের বন্দী হওয়ার ঘটনায় অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সৃষ্টি হলাে প্রবল অসন্তোষ। দু’দিন ধরে ক্যান্টনমেন্টে দারুণ অনিশ্চয়তার ছাপ। সেনাসদরে গুঞ্জন। কাজকর্ম সব বন্ধ। অসন্তোষ চরমে। খবর ছড়িয়ে পড়লাে, জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। চাপের মুখেই তা করেছেন। একখানা সাদা কাগজে তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পত্রে দস্তখত নেওয়া হয়েছে। একই পত্রে পেনশনের আবেদন করেছেন। খালেদের পক্ষ থেকে ব্রিগেডিয়ার রউফ তার কাছে গিয়ে পদত্যাগপত্র সই করিয়ে নিয়ে আসেন। গৃহবন্দী জিয়া পদত্যাগপত্রে সই। করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে জিয়ার প্রতি সবার সহানুভূতি আরাে বেড়ে গেল। সকাল বেলা ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট। বেলা সাড়ে আটটার দিকে সেখানে খালেদ-শাফায়েতের হেডকোয়ার্টার দেখতে গেলাম। ওটা তখন রীতিমত আর্মি অপারেশন হেডকোয়ার্টার। বহু তরুণ অফিসার আশেপাশে জটলা করছে। আমার জীপ থেকে নামতেই দেখি অদূরে বারান্দায় খালেদ উত্তেজিতভাবে পুলিশের ডি আই জি ই এ, চৌধুরীর সাথে কথা বলছে। তাকে শক্তভাবে চার্জ করছে, কেন এসব আগে জানালেন না? খালেদের উচ্চ কণ্ঠ। তীব্র আর্তনাদ। আমার মনে হলাে গুরুতর কিছু ঘটেছে। | এমতাবস্থায় সামনে একজন জুনিয়ার অফিসারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? কি হয়েছে। সে বললাে; স্যার, গত রাত্রে জেলে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। চারজন আওয়ামী লীগ নেতা মারা গেছেন।
আমি বিস্তারিত কিছু জানি না। হত্যাকাণ্ড ঘটনায় খালেদকে খুবই বিব্রত মনে হলাে। মাত্র গত রাত্রেই সে ফারুক-রশিদ গ্রুপের মেজরদের দেশ ত্যাগ করতে অনুমতি দিয়েছে। জেল হত্যাকাণ্ড ঘটনার কথা জানলে সে অবশ্যই সবাইকে আটকে রেখে বিচার করতাে। এখন খবরটি যখন জানাজানি হলাে, তারা তখন পাখিরা হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে গেছে। | খালেদ-শাফায়েত তখনই সিদ্ধান্ত নিলাে, মােশতাককে আর প্রেসিডেন্ট রাখা চলবে না। বিকল্প খুঁজতে হবে। ৪র্থ বেঙ্গলের পরিবেশটি তখন বেদনাবিধুর, থমথমে। আমি বাইরেই দু-একজনের সাথে কথা বলে তাড়াতাড়ি আবার স্টেশন হেডকায়ার্টারে ফিরে এলাম। ৪ নভেম্বর। সকাল ১০ টা। উন্মুক্ত বঙ্গভবন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে যে যখন পারছে ছুটে গিয়ে বঙ্গভবনে ঢুকে পড়ছে। খালেদ মােশাররফ নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানকে সাথে নিয়ে বঙ্গভবনে পৌছলেন। হাতে তার জেনারেল জিয়ার স্বহস্তে লিখিত পদত্যাগপত্র। এখন তাকে সেনাপ্রধান নিয়ােগ করার পথে আর কোন বাধাই নেই। তবু বেরসিক মােশতাক জেনারেল ওসমানীর সাথে আলােচনা করে আবার দৃঢ়তার সাথে বলেন, তিনি মন্ত্রীসভার অনুমােদন ব্যতীত কোন বড় সিদ্ধান্ত দেবেন না। মন্ত্রীসভার বৈঠক বিকেলেই ডেকেছেন। মেজররা চলে যাওয়ার পরপরই খন্দকার মােশতাক পদত্যাগ করতে চান, কিন্তু খালেদ। তাকে চালিয়ে যেতে অনুরােধ করেন, যদিও শাফায়েত জামিল তাকে পছন্দ করছিল না। আগের দিন মোশতাক দুটি শর্ত দেন। শর্ত দুটো খালেদ মােশাররফ মােটামুটি মেনে নেন।
আসলে এই সময় উচ্চাকাযী খালেদ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তিনি ক্ষমতা চাচ্ছিলেন। তিনি চীফ অব স্টাফ হতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু রক্তপাত না করে কৌশল প্রয়ােগে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি জিয়াকে সরিয়ে ‘চীফ’ হতে চাচ্ছিলেন। রাষ্ট্রপতি কে থাকে না থাকে, তাতে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না। | খালেদ নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্টের যথাযথ অনুমােদনসহ চীফ অব স্টাফ হতে চাচ্ছিলেন, শক্তি প্রয়ােগ করে নয়। এই পয়েন্টেই তিনি মােশতাকের কাছে নতজানু হয়ে পড়েন। আর সুযােগ বুঝে চতুর মােশতাক ঐ সময় তার সাথে ইদুর-বেড়াল’ খেলা শুরু করেন। এভাবে খালেদ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আসল কাজ ভুলে যান।
খালেদ বরাবরই ছিলেন একজন দক্ষ ও প্রতিভাবান অফিসার। কিন্তু ঐ মুহুর্তে তিনি যারপরনাই অদক্ষতার পরিচয় দেন, যার ফলাফল তার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনে। বারবার প্রশ্ন জাগে, অভ্যুত্থানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ একটি নাজুক। মুহূর্তে তার তুচ্ছ প্রমােশনের জন্য এভাবে খন্দকার মােশতাকের পিছনে কেন নতজানু হয়ে ছুটাছুটি করলেন? এরকম অদক্ষতার পরিচয় খালেদ জীবনে আর কোনদিন তার কর্মক্ষেত্রে দেখাননি। একজন ক্ষমতাধর সেনানায়ককে কিভাবে প্রমােশন নিতে হয়, ঐদিনই কিছুক্ষণ পর কর্নেল শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনে প্রবেশ করে দেখিয়ে দিলাে। দুপুরের বঙ্গভবন চলছে দেন-দরবার, আলাপ আলােচনা। বঙ্গভবনে উর্দিপরা অফিসারদের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে দ্রুত আনাগােনা। উত্তপ্ত আলােচনা। বিভিন্ন মতবাদের অফিসাররা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। সলা-পরামর্শ। বঙ্গভবনে অস্ত্রধারীদের উপস্থিতিতে বিশাল অবস্থা। পরিস্থিতি হয়ে ওঠে জটিল ও বিষাক্ত। ক্ষমতার সর্বোচ্চ ভবনে পেীছে সবাই ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্ন দেখতে থাকে। যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলাে। উম্মুক্ত পিস্তল, স্টেনগান কাধে তরুণ অফিসারদের আনাগােনা। ইউনিফরমধারী লােকজনদের ভারী বুটের খট খট শব্দে প্রকম্পিত বঙ্গভবন। ঘন ঘন ব্যস্ততা। ওসমানী, খালেদ, তােয়াব, এম এইচ খান, জেনারেল খলিল উপস্থিত। ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস’—বস্তুত ঐ মুহূর্তে বঙ্গভবনে সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছিল। একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে মােশতাক আহমদ ২৬ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভার বৈঠক করছিলেন। বৈঠকে জেলহত্যা তদন্তের জন্য সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সভায় জেলহত্যা নিয়ে এবং ফারুক-রশিদদের দেশ ত্যাগ নিয়েও উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। মন্ত্রীরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রসংগ উত্থাপন করে সময় নষ্ট করছিলেন। সভার প্রারম্ভেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, রিয়ার এ্যাডমিরাল এম এইচ খান ও এয়ার ভাইস মার্শাল তােয়াব ভেতরে এসে সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ও প্রেসিডেন্টকে মেনে চলার প্রতিজ্ঞা পাঠ করেন। এতে মন্ত্রীরা যথেষ্ট স্বস্তি অনুভব করে গলা খুলে কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে মন্ত্রী পরিষদে খালেদ মােশাররফকে চীফ অব স্টাফ নিয়ােগের ব্যাপারে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট তার উপদেষ্টার সুপারিশে চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করতে পারেন। তবে ওসমানী স্পষ্ট ভাষায় জোর গলায় জানিয়ে দিলেন যে, সেনাপ্রধান নিয়ােগের ব্যাপারে সাধারণ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এতে খালেদ মােশাররফের। সাথে ওসমানী ও মােশতাকের বেশ কিছুটা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। সারাদিন ধরে চলছে মিটিং মিটিং। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, সব কিছু লেজে গােবরে অবস্থা। ওদিকে দুপরের পর ক্যান্টনমেন্টে ৪র্থ বেঙ্গল হেড কোয়াটারে হতাশা চরমে ওঠে। অদ্যুত্থানের নেতা খালেদ মােশাররফ সেই যে সকালে বঙ্গভবনে গিয়েছেন, আর তার খবর
নেই। তার সাথে টেলিফোনেও কোন যােগাযােগ করা যাচ্ছে না। তিনিও মন্ত্রীদের সাথে মিটিং-গােলকধাধায় আটকা পড়ে গেছেন। সেখানে তার প্রমােশন নিয়ে ফাইট করছেন। ক্যাটনমেন্টে শাফায়েত জামিল অস্থির হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার দিকে কর্নেল মালেককে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবভনের দিকে ছুটে গেল। বঙ্গভবনে ঢুকেই সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, কোথায় খালেদ মােশাররফ? সবাই বলল : স্যার, তিনি কেবিনেট কমে মিটিং করছেন। সশস্ত্র শাফায়েতের অনুপ্রবেশ যখন মন্ত্রীসভায় উত্তপ্ত আলাপ আলােচনা চলছিল, তখন ঘটে গেল এক নাটকীয় কাণ্ড। আকস্মিকভাবে সজোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন ডাণ্ডা হাতে কর্নেল। শাফায়েত জামিল। পিছনে স্টেনগান হাতে পাচজন সশস্ত্র অফিসার। ভীত সন্ত্রস্ত মন্ত্রীসভার সদস্যগণ। তারা আসন ছেড়ে ছুটে পালাতে উদ্যত। মেজর ইকবাল (পরবর্তিতে মন্ত্রী) খন্দকার মােশতাকের দিকে স্টেনগান তাক করে বলতে থাকেন, আপনি পাকিস্তান সেনা। বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার দেখেছেন কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর দেখেননি। এখন দেখবেন। ওসমানী অসম সাহসে মাঝখানে এসে দাড়ালেন, বললেন, খােদার ওয়াস্তে গােলাগুলি করবে না। তােমরা এসব পাগলামী বন্ধ করাে। বেঁচে গেলেন মােশতাক। উত্তপ্ত মুহূর্তে উন্মুক্ত স্টেনগান যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারতাে। বঙ্গবভন চত্বরে ৩২ নম্বর : রােডের রক্তাক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে ঘটতে থেমে গেল। শাফায়েত জামিল খন্দকার মােশতাকের পদত্যাগ দাবি করে বললেন, আপনি একজন ধুনী। আপনি জাতির পিতাকে খুন করেছেন। আপনার সরকার অবৈধ। আপনার ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই। আপনাকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। মােশতাক মাথা নেড়ে তখনই রাজী হন। এই সময় শাফায়েত মােশতাকের সাথে বেশ রূঢ় ব্যবহার করে। ওসমানী প্রতিবাদ করে বলেন, ওনার সাথে অশােভন ব্যবহার করা ঠিক হবে না। খােদার ওয়াস্তে তােমরা এসব বন্ধ করাে।
রক্তপাত ঘটিও না। শাফায়েত বলল, আপনি চুপ থাকুন। আপনি উপদেষ্টা হিসাবে এতদিন কি উপদেশ দিয়েছেন? জেনারেল খলিল প্রতিবাদ করে বলেন ; দেখাে, ওনাকে এভাবে অপমান করা উচিত হবে না। দয়া করে শান্ত হও। শাফায়েত জামিলের চিৎকার, আপনি চুপ থাকুন। আর কথা বলবেন না। আপনি জেল হত্যার কথা জানতেন, তাও ওদের যেতে দিয়েছেন। আপনাকেও অ্যারেস্ট করা হলাে। শাফায়েত এই সময় উত্তেজিত। আর তার অফিসাররা শুধু সংকেতের অপেক্ষায়। শাফায়েত যখন চিৎকার দিয়ে ভেতরে ঢােকে, তখন খালেদও বসে ছিল। আসলে উত্তেজিত শাফায়েতের অবস্থা দেখে সেও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। উত্তপ্ত পরিবেশ। নাজুক পরিস্থিতি। জেনারেল ওসমানী উঠে তখন শাফায়েতকে, খালেদকে এবং অন্যান্যদের শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। এই সময় কেবিনেট মিটিং-এর পরিবেশ সম্পূর্ণ এলােমেলাে হয়ে যায়। এক সময় কর্নেল মালেক শাফায়েতকে বুঝিয়ে কোনক্রমে কক্ষের বাইরে নিয়ে যান। সবাই এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। মন্ত্রীসভার কার্যক্রম আবার শুরু করা| ওসমানী তাদের বললেন, তােমাদের যা যা প্রস্তাব মিটিং-এ বলে যাও। মিটিং-এ সবই। পাশ করা হবে। অতঃপর কর্নেল এম, এ, মালেক ভেতরে ঢুকলেন। তিনি পয়েন্টগুলাে বলে। যাচ্ছিলেন। বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হলাে। (১) মুজিব হত্যা এবং জেলহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হবে। (২) খালেদ মােশাররফকে ‘চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হবে। (৩) মােশতাক প্রেসিডেন্ট হিসাবে থাকবেন, যতক্ষণ না অন্য ব্যবস্থা হয়। তবে তিনি অসুস্থতার জন্য পদত্যাগ করবেন বলে সম্মত হন। (৪) বঙ্গভবন থেকে সৈনিক ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবে। মন্ত্রীসভার বৈঠক চললেও তখন খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল পালাক্রমে ঘােরাফেরা করে পয়েন্ট দিচ্ছিলেন। বন্দুকের নলের মুখে ঐ সময় বেশ কিছু কাগজপত্রে মােশতাকের জবরদস্তি সই নেওয়া হয়। দীর্ঘরাত পর্যন্ত মিটিং চললাে।
রাত্রি প্রায় ২টায় মিটিং শেষ হলে কর্নেল মালেক মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললেন ; ভদ্রলােকগণ, ৪জন ছাড়া আপনারা বাকি সবাই বাসায় যেতে পারেন। সর্বনাশ। এটা আবার কোন নির্দেশ। চার নেতাতা শেষ। এবার কোন চারজন সবাই চমকে উঠলেন! শাহ মােয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। তারা ভয়ে কাঁপতে থাকলেন। বাকিরা উধশ্বাসে বঙ্গভবন ত্যাগ করে নিজ নিজ বাসার দিকে ছুটে চললেন। যমদূতদের হাত থেকে ছাড় পেয়েছেন, এটাইতাে আল্লাহর রহমত।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয়। এয়ার মার্শাল তােয়াব ও অ্যাডমিরাল এম এইচ খান হাস্যরত খালেদের কাধে মেজর জেনারেলের র্যাংক পরিয়ে দেন। পরদিন বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার প্রথম পাতায় তার হাস্যরত ছবিটি ছাপানাে হয়। দুর্ভাগ্য খালেদের। মাত্র ৭২ ঘন্টা তিনি মেজর জেনারেলের র্যাংকটি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ ম্যারাথন মিটিং-এর পর ক্লান্ত শ্রান্ত বিধ্বস্ত মােশতাক, রাত তিনটায় বঙ্গভবনে তার শােবার ঘরে প্রত্যাবর্তন করলেন। তার এবং তার মন্ত্রীসভার শেষ মুহূর্ত। বর্ষীয়ান উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী তার সাথে কোলাকুলি করে তার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ওসমানী T19A : Sorry oldman, we played a bad game. Let us forget and forgive. • গভীর রাত। ওসমানী বারান্দায় এসে দাড়ালেন। তার বাসায় যাওয়ার গাড়ী নাই। বললেন, এখন আমি আর ডিফেন্স উপদেষ্টা নই। সুতরাং সরকারী গাড়ী ব্যবহার করবাে না। পাশে দাড়িয়ে থাকা কর্নেল মালেক এগিয়ে এসে বললেন; স্যার, আপনি আমার গাড়ীতে আসুন। আমি আপনাকে বাসায় পৌছে দেবাে। ওসমানী তার গাড়ীতে করেই গভীর রাতে বাসায় ফিরলেন। বঙ্গভবনে যখন খালেদ মােশাররফ প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সাথে এইসব দর কষাকষিতে। ব্যস্ত, তখন তার অজান্তেই ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিক এবং শহরে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সশস্ত্র লােকজনদের ভেতর আঘাত হানার গােপন প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। | ৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের উপস্থিতিতে মােহাম্মদপুরে এবং এলিফেন্ট রােডে একটি বাসায় জাসদ বিপ্লবী গ্রুপের গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। বেশ কিছু সৈনিক প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিল। সভায় বিস্তারিত প্রােগ্রাম আলােচনা করা হয়। বিপ্লবীরা তাদের নেতাদের তড়িৎ আঘাত হানার জন্য উত্তেজিত করতে থাকে।
ক্যান্টনমেন্টে প্রচুর লিফলেট বিতরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাহেরের নেতৃত্বে তারা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে আনবে। সবার মুষ্টিবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। বলাবাহুল্য, জিয়া বন্দী হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেই বন্ধুবর তাহেরকে অভ্যুত্থানের মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হন এবং তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা নিতে অনুরােধ জানান। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এসব ব্যাপারে জিয়ার সাথে তাহেরের আগেভাগেই একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহের এ রকম পরিস্থিতির জন্য মােটামুটি তৈরি ছিলেন। এবার ক্যান্টনমেন্টে হঠাৎ করে উদ্ভূত সৈনিক অসন্তোষের সুবর্ণ সুযােগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি দলের লােকজনদের বললেন, Now or never .. তারা কর্নেল তাহেরের নির্দেশে তৎক্ষণাৎ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ভেতরে গােপন তৎপরতা জোরদার করলাে। বিভিন্ন ইউনিটের সমমনা সৈনিকদের সাথে তারা যােগাযােগ স্থাপন করলাে। ৫ নভেম্বর। সকালবেলা আর্মি হেডকোয়ার্টারে মিটিং। সভাপতিত্ব করেন আর্মির নবনিযুক্ত চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ বীর উত্তম। কাধে তার ঝলমল করছে নতুন র্যাংক। উপস্থিত রয়েছেন নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান, ডি. জি, এফ, আই, রক্ষী বাহিনী প্রধান, আইন মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, এটর্নি জেনারেল। তারা দীর্ঘ আলােচনায় লিপ্ত হলেন, কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে আইনগত দিক বজায় রেখে মােশতাক আহমদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির কাছে হস্তান্তর করা যায়।
সভায় অন্যান্য বিষয়ও আলােচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গভবন থেকে ল্যান্সার ও টু-ফিল্ড সৈন্যদের DISARM করে সন্ধ্যায়ই ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানাে হবে। কিন্তু পরে অকস্মাৎ খালেদ কি মনে করে তার সিদ্ধান্ত পাল্টালেন ; বললেন, থাক, তাদের অস্ত্রসহই ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যেতে দাও। তা নাহলে তারা ঘাবড়ে যাবে। অন্য সমস্যা দাড়াবে। দয়ার্ত খালেদ মােশাররফ। তার পক্ষ থেকে এটি ছিল ‘ভুল সিদ্ধান্ত’। ঐ দিনই অস্ত্রশস্ত্রসহ বেঙ্গল ল্যান্সার ও টু-ফিল্ডের বাকি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে। ৫ তারিখ সন্ধ্যা ১০ ঘটিকা। জেনারেল খালেদ মােশাররফ নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানদের সাথে নিয়ে বঙ্গভবনে পেীছেন। খন্দকার মােশতাক আহমদ তখনও প্রেসিডেন্ট। তারা তার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র (অসুস্থতার কারণে) এবং অন্যান্য আরাে কিছু কাগজ শেষবারের মত সই করিয়ে নিয়ে আসেন। রাত সাড়ে এগারােটায় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মােশতাক আহমদ পুলিশ প্রহরায় বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিয়ে তার আগামসিহ লেনের বাসায় প্রত্যাবর্তন করেন। শেষ হলাে তার ২মাস ২০ দিন ব্যাপী শাসন-আমল। ৫ নভেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকদের কিছু গােপন বৈঠক হয়। সর্বত্র বিদ্রোহের উত্তাপ। বন্দী জিয়াকে বের করে আনার সংকল্প। কি অবাক কাণ্ড। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ভেতরে গােপনে এত সব ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু খালেদশাফায়েত সম্পূর্ণ বেখবর। তারা ক্ষমতার পকিলে জড়িয়ে গেছে। তারা বুঝতেই পারেনি, তাদের পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে। সর্বত্র উল্টো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ৪ তারিখ শহরে আওয়ামী লীগের বিরাট মিছিল। মিছিলের অগ্রভাগে খালেদ মােশাররফের মাতা ও ছােট ভাই রাশেদ মােশাররফ। তারা শ্লোগান তুলছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বচার চাই।৫ তারিখ সকল পত্রপত্রিকায় তাদের সচিত্র সংবাদ বের হলাে। এসব ছবি দেখে খালেদ খুবই ভেঙে পড়ে। সে ফোন করে বললাে; মা, তােমরা আমাকে শেষ করে দিলে। আমি এখন আর বাচবাে না। তােমরা কেন এসব করতে গেলে?
সবাই ধরে নিল ‘ক্যু’ আর মিছিল, ভারতের কারসাজি। আবার বুঝি ভারতীয় আগ্রাসন অত্যাসন্ন? খালেদ বুঝি ভারতের চর। জনসমর্থন ঐ সময় সম্পূর্ণভাবে খালেদের প্রতিকুলে চলে যায়। দুর্ভাগ্য খালেদের। ৫ তারিখ থেকে বাইরে ভিতরে সবকিছু তার বিপক্ষে যেতে শুরু করে। কিন্তু তখনও খালেদ কিছুই বুঝতে পারে না। ক্ষমতার উত্তাপ ছিল এতােই অন্ধ। ক্যান্টনমেন্টেও খালেদের অবস্থান ভালাে ছিল না। একমাত্র বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলাের মধ্যেই মােটামুটি তার সমর্থন ছিল। খালেদ ঢাকায় তার নড়বড়ে অবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কর্নেল হুদার রংপুর ব্রিগেডের ১০ম বেঙ্গল এবং ১৫ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় মুভ করার নির্দেশ দেন। কর্নেল নওয়াজিশের ১০ম বেঙ্গল বগুড়া থেকে খুব তাড়াতাড়ি ৫ তারিখ ঢাকার সাভারে এসে উপস্থিত হয়।
মেজর জাফর ইমাম (সাবেক মন্ত্রী) রংপুর থেকে তার ইউনিট ঢাকায় পাঠাবার জন্য সেখানে সমস্ত সিভিল বাস রিকুইজিশন করেন। জাফর ইমাম খালেদকে সাহায্য করার জন্য আগেই ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। পরে অবস্থা খারাপ দেখে আবার ৭ নভেম্বর রংপুর ফিরে যান। পরে ৯ নভেম্বর তার ইউনিটের সৈনিকরা তাকে তাড়া করলে আবার ঢাকা পালিয়ে আসেন। তার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদাও এসেছিলেন ঢাকায় খালেদের পাশে। তিনি আর ফিরে যেতে পারেননি, সৈনিকদের হাতে নিহত হন। ৫ তারিখ দুপুরের দিকে জেনারেল খালেদ মােশাররফ একবারই আমাকে টেলিফোন করেছিলেন স্টেশনের অবস্থা জানার জন্য। আমি তাকে স্পষ্ট বলেছিলাম, পরিস্থিতি কিন্তু মােটেই সুবিধার নয়। আমি তাকে আরাে বলেছিলাম, তুমি বরং ক্যান্টনমেন্টের সব সৈনিক এবং অফিসারদের ডেকে তাদের সবকিছু বুঝিয়ে শান্ত করাে। সে বললাে, আমি করবাে। এর মধ্যে আপনি স্টেশন সিকিউরিটির ব্যবস্থা নিন যাতে বাইরের কোন পলিটিক্যাল এলিমেন্ট অনুপ্রবেশ না করতে পারে। ৬ নভেম্বর ৬ নভেম্বর সকাল ৯ ঘটিকা। নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। জমজমাট বঙ্গভবন। উপস্থিত সকল উর্ধতন সিভিল ও মিলিটারী কর্মকর্তাবৃন্দ। হাসিখুশী জেনারেল খালেদ মােশাররফ। নতুন প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম। তারা ঘুরে ফিরে সবার সাথে করমর্দন করছেন। কি। ক্লিক। সর্বত্র সক্রিয় ক্যামেরা, টেলিভিশন। আনন্দমুখর পরিবেশ। বেলা ১১ টার দিকে জেনারেল খালেদ মােশাররফ বাইরে থেকে আগত ফরমেশন কমাণ্ডারদের নিয়ে কনফারেন্স করলেন।
উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লার ব্রিগেড কমাণ্ডার ব্রিঃ আমজাদ। যশােহর ব্রিগেডের ব্রিঃ শওকত, রংপুর ব্রিগেডের কর্নেল হুদা। যশােহরের ব্রিগেড কমাণ্ডার মীর শওকত আলী খালেদকে কড়া স্যালুট দিয়ে গভীরভাবে আলিঙ্গন করলেন। বললেন, Sir, I salute the chair. খালেদ হাসলেন। | আসলে ৬ তারিখ প্রকৃত অবস্থা হলাে, সকাল থেকেই ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি খুবই ঘােলাটে হয়ে ওঠে। এমনকি খবর পেলাম খালেদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরাও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তাদেরই কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল আমিনুল হক (পরে ব্রিগেডিয়ার) এক সময় কোথা থেকে আমাকে স্টেশন হেডকোয়ার্টারে ফোন করে বললাে ; স্যার, আপনারা বসে বসে খামাখা কি করছেন? আমি তার কথা শুনে অবাক হলাম। কারণ খালেদের অপারেশন হেডকোয়ার্টারই ছিল ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সেখানেই এখন উল্টো হাওয়া বইছে। ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বিভিন্ন সার্ভিস কোর ইউনিটগুলাের অবস্থার অবনতি ঘটলাে। আমার পাশেই সেকেণ্ড ফিল্ড রেজিমেন্ট। খবর পেলাম তারা আবার বিদ্রোহ করতে গােপনে তৈরি হচ্ছে। সকাল থেকে বিভিন্নজন এসে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। চারিদিকে নানান গুজব। আমার বিশ্বস্ত হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান এসে জানালাে, স্যার দেখেন আজ রাত কিভাবে পার হয়। তার মুখে মুচকি হাসি। আমি তাকে ধমক দিয়ে এসব কথা প্রকাশ্যে বলতে মানা করলাম। যদিও আমাদের অজ্ঞাতেই আমার হেড কোয়াটারের আশেপাশেই বিদ্রোহ। দানা বেঁধে উঠছিল। ক্যান্টনমেন্টে বহু লিফলেট বিতরণ করা হলাে। সবগুলােতেই অফিসারদের বিরুদ্ধে সেপাইদের উত্তেজিত করে বিদ্রোহের উদাত্ত আহ্বান জানানাে হয়েছে। অবস্থা খুবই ঘােলাটে হয়ে উঠল। বিভিন্ন ইউনিট থেকে ঘন ঘন টেলিফোন আসতে থাকলাে। অনিশ্চিত অবস্থায় সবাই অস্থির। চতুর্দিকে টগবগ অবস্থা। দরকার শুধু একটি ফুলিঙ্গের। আমি দুপরে কর্নেল খুরশিদ ও মামুনকে ফোন করলাম। সেনানিবাস আর্মি টেনিস কোর্টে জেনারেল জিয়া, জেনারেল শফিউল্লাহ, মামুন, খুরশিদ ও আমি প্রতিদিন নিয়মিত টেনিস খেলতাম। এই কদিনের গণ্ডগােল আর টেনশনে আমাদের খেলা ছিল বন্ধ। আর টেনশন ভাল্লাগছে না। বললাম, আজ খেলা হােক। সিদ্ধান্ত হলাে আজ থেকে আমরা আবার টেনিস শুরু করবাে।
বিকাল ৫ ঘটিকা। আমি ও কর্নেল খুরশিদ টেনিস খেলছিলাম। এমন সময় ই ং শব্দে হুটার বাজিয়ে কালাে লিমােজিন গাড়ীতে চড়ে এলেন জেনারেলের ফ্ল্যাগ উড়িয়ে নব নিযুক্ত চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ। তিনি টেনিস কোর্টের পাশ দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বাসায় ফিরছিলেন। আমরা খেলা বন্ধ করে তার দিকে তাকালাম। গাড়ী থেকে হাসিমুখে হাত নেড়ে আমাদের সম্ভাষণ জানালেন জেনারেল খালেদ মােশাররফ। আমরাও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিলাম। এটাই ছিল তার সাথে আমাদের শেষ দেখা। এরপর কিছুক্ষণ তিনি তার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় অবস্থান করে সন্ধ্যায় বেরিয়ে যান। আর ফিরে আসেননি। স্ত্রী সালমা সন্ধ্যারাতে প্রাইভেট গাড়ী নিয়ে দুটি মেয়েসহ খালেদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ছােট মেয়ে বাপকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলাে না। খালেদ তাকে কোলে নিয়ে আদর করলেন। মাগরেবের আজানের সাথে সাথেই তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করে আমরা বাসায় ফিরলাম। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। রাস্তাঘাট শান্ত হয়ে এলাে। সর্বত্র ঝড়ের পূর্বাভাস। সবাই যেন এক অজানা আশঙ্কায় কান পেতে রইলাে। থমথমে পরিবেশ। চারিদিকে প্রচারপত্রের ছড়াছড়ি। অফিসারদের রক্তচাই। বন্ধ হােক তাদের বাড়াবাড়ি, বন্ধ হােক ক্ষমতার কোন্দল। ‘সেপাই সেপাই ভাই ভাই। অন্ধকারের আড়ালে চলে আঘাত হানার গােপন প্রস্তুতি। সন্ধা ৬টা। ৪৬ তম ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। শাফায়েত জামিল তার দলবল নিয়ে ৪থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে করছে সলা-পরামর্শ। বঙ্গভবন গুড়িয়ে দিতে হবে। কাজের কোন অগ্রগতি হচ্ছে না বঙ্গভবনে। ব্লডি সিভিলিয়ান স্টাফদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। এদেরকে কাজ শিখিয়ে দিতে হবে। খালেদ মােশাররফও ওখানে গিয়ে সিভিলিয়ান হয়ে গেছে।
এখনাে মার্শাল ল’ ডিক্লেয়ার করতে পারেনি। মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার হিসাবে এখনও তার নাম বা কারাে নাম বেতারে ঘােষণা করেনি। এদেশ চলবে কিভাবে। বঙ্গ ভবন। রাত দশটা। সেনাপ্রধান খালেদ মােশাররফ। সারাদিন তিনি ব্যস্ত রইলেন মার্শাল ল’র আইন কানুন বাটাঘাটি করে। তাকে কেন চীফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর করা হবে না? এই নিয়ে কতাে দেন-দরবার। সিভিলিয়ান প্রেসিডেন্ট কিভাবে সি-এম-এল-এ হতে পারে? আমি চীফ প্রেসিডেন্টের নিচে থাকবে, অসম্ভব। তিনি জোরালাে যুক্তি দেখালেন, তাকে সি এম এল এ করতেই হবে। আইয়ুব খান চীফও ছিল, CMLA ও ছিল। অন্যরা সবাই বললাে ; স্যার, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, আপনি এখন ডিসি-এমএল এ-ই হােন। অন্য চীফরাও তাই চান। কিন্তু খালেদ নারাজ। ক্ষুদ্র নেভী, এয়ার ফোর্স চীফরা সেনা প্রধানের সমকক্ষ থাকবে, এটা কেমন দেখাবে? সে কাগজপত্র ঠিকমত বানাতে বলে। মাথা গরম হয়ে ওঠে শাফায়েত জামিলের। কর্নেল মালেককে নিয়ে সে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছুটে যায় বঙ্গভবনে। কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয় সে। টেবিলে তার ছড়ি কুঁকতে থাকে। কিসের এত বিলম্ব? রেডিও-টিভিতে মার্শাল-লর কথা কখন ঘােষণা দেবে? কোথায়। চীফ?ফোনে কথা বলে বাসায় অবস্থানরত খালেদ মােশাররফের সাথে, এসব কি শুরু করেছেন স্যার? এসব ছেলেখেলা নাকি? আসল কাজ কিছুই হচ্ছে না। সারা দেশ তাকিয়ে। আছে। আপনি এক্ষুণি আসুন। শাফায়েতের কষ্ঠ উত্তপ্ত। রাত তখন সাড়ে দশটা। বঙ্গভবন। রাত-১১ টা। খালেদের কপালে বুঝি আরাম নেই। ছুটে যান বঙ্গভবনে। সবাই তার অপেক্ষায়। সবাই মিলে তাকে বুঝায়; স্যার, খােদার ওয়াস্তে আপনারা তিন প্রধান ডি-—িএম-এল-এ-ই থাকুন। প্রেসিডেন্টকে CMLA থাকতে দিন। তা না হলে ট্যাকনিকেল সমস্যা হয়ে যাবে।
ওকে, ওকে, তাই হােক। তােমরা সবাই বেশী বুঝাে। ধীরে সুস্থে কাগজপত্র তৈরি করাে। ঘােষণা রেডিও টিভিতে আজ নয়, আগামীকাল যাবে।’ . হায় আগামীকাল। সেই আগামীকালের সূর্য পূর্বাকাশে উঠেছিল বটে। কিন্তু জেনারেল খালেদ মােশাররফের পক্ষে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ক্যান্টনমেন্ট। রাত ১১টা। বঙ্গভবনে যখন খালেদ-শাফায়েত মার্শাল ল’র কাগজপত্র তৈরিতে ব্যস্ত, ঢাকা সেনানিবাসে তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। রাতের আবছা অন্ধকারে সচল হয়ে উঠল বিভিন্ন ইউনিট। চঞ্চল টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট। তারা সবাই প্রস্তুত। সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী। তাকে ঘিরে দাড়ালাে জওয়ানরা। তিনি মেজর মহিউদ্দিন ও মােস্তফাকে অনুরােধ করলেন, স্যার। জওয়ানরা তৈরি। আপনি আমাদের সাথে থাকুন। মহিউদ্দিন রাজী। পাশে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট। খালেদের প্রিয় ব্যাটালিয়ন। তবু গােপনে তার কমাণ্ডিং অফিসার কর্ণেল আমিনুল হক, অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপটেন মুনীর কিছু বিশ্বস্ত সৈনিক নিয়ে তৈরি হয়ে রইলেন। ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে সার্ভিস কোরের ইউনিট, মেডিকেল, সাপ্লাই ব্যাটালিয়ন, এ এম ই, অর্ডিন্যান্স ডিপাে সবাই একসূত্রে নিজেদের গেথে নিলাে। উত্তেজিত সৈনিকরা রাত সাড়ে ১১টা থেকেই ব্যারাক ছেড়ে অন্ধকারে প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে পড়লাে দলে দলে। কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ জানে না। কিন্তু কিছু একটা ঘটবে, এটাই সবাই জানে। উত্তর প্রান্তে সিগন্যালস, ইঞ্জিনিয়ার্স, লাইট এ্যাক-এ্যাক ইউনিটগুলাের জওয়ানরাও প্রস্তুত। আজ সক ভাই ভাই। চক্রান্তবাজ অফিসারদের আজ আর রক্ষা নাই। | ক্যান্টনমেন্টের বাইরে প্রস্তুত রয়েছে জাসদের বিপ্লবী বাহিনীর ইউনিফরম পরিহিত সশস্ত্র লােকজন। তারা জমায়েত হয়েছে ইব্রাহিমপুর, এয়ারপাের্ট, মহাখালী, বনান। পয়েন্টে।
লেঃ কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম তাদের নেতা। একটি সাদা জীপে করে রাতের অন্ধকারে তাকে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে দক্ষিণ প্রান্তে ঘােরাঘুরি করতে দেখা গেল। তার গণবাহিনীর লােকজন ইতিমধ্যে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে। ফেলেছে। সারাদিন তারা লিফলেট বিলি করে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এখন তারা চূড়ান্ত । আঘাত হানতে ক্যান্টনমেন্টের চর্তুপার্থে বাইরে-ভেতরে অবস্থান নিয়েছে। সার্বিকভাবে ফায়ারিং অপারেশন শুরু করার চূড়ান্ত ঘটা টু-ফিল্ড, ইঞ্জিনিয়ার্স, লাইট এ্যাক এ্যাক-এর সুবেদার মেজরগণ এবং কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী নেতারা আলােচনা করে আগেই তৈরি করে ফেলেছে। বড় কোন প্ল্যান নাই, প্রােগ্রাম নাই, ব্রিফিং নাই, তবু সবাই প্রস্তুত। বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটাতেই হবে, এই সবার মরণপণ। টার্গেট একটাই- জিয়াউর রহমানের বাসভবন। লক্ষ্য অভিন্ন। জিয়াকে বন্দীদশা থেকে বের করে আনা। H’ hour. চরম মুহূর্ত। রাত ১২ টা। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্য সবাই অধীর অপেক্ষায়। উন্মােচিত হতে যাচ্ছে এক অভাবনীয় ঘটনা। শতাব্দির ব্যবধানে একটি আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ। বঙ্গভবন। রাত ১২ টা। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ভেতরে যখন রাতের অন্ধকারে যখন আঘাত হানার ক্রান্তিলগ্ন ঘড়িতে ঘনিয়ে আসছে। তখন বঙ্গভবনে বসে মিটিং করছেন জেনারেল খালেদ মােশাররফ। তার সাথে শাফায়েত জামিল, কর্নেল মালেক, কর্নেল হুদা, মেজর হায়দার, জিল্লুর রহমান। তখন পর্যন্ত তারা ক্যান্টনমেন্টে তাদের বিরুদ্ধে ধূমায়িত সেনা-বিদ্রোহ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। কি অবাক কাণ্ড। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ক্ষমতার আবর্তে পড়ে তারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমগ্ন। বসে আছেন খালেদ মােশাররফ। টেলিফোন বেজে উঠল। ধরলেন খালেদ। ৪৬ ব্রিগেড। থেকে কে যেন ফোন করে জানালাে, ক্যান্টনমেন্টে ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা হাতিয়ার জমা দিচ্ছে না। তারা কারাে কথা শুনছে না।
তিনি রেগে গিয়ে টেলিফোন তুলে সরাসরি ঐ ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজরের সাথে কথা বলেন। একটু পরেই খালেদ খবর পেলেন সৈনিকরা একটি অস্ত্রাগার ভেংগে ফেলার চেষ্টা করছে। তিনি মেজর হাফিজকে পাঠালেন পরিস্থিতি দেখে আসতে। এসব শুনে খালেদ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে কেউ Counter-‘কু’ করার চেষ্টা করছে। তাইতাে মনে হয়। তখন পাশে উপবিষ্ট কর্নেল মালেক বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে তার বাসায় স্ত্রীর কাছে টেলিফোন করলে সেপাইদের বিদ্রোহের কথা প্রথম জানতে পারেন। স্ত্রী বললেন, সর্বনাশ। এখানেতাে সাংঘাতিক ফায়ারিং হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবাই যে যেদিকে পারে ছুটে পালাতে লাগলাে। জেনারেল খালেদ মােশাররফ সহকমী কর্নেল হুদা ও বীর মুক্তিযােদ্ধা মেজর হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে তার প্রাইভেট গাড়া করে ঝটিকার বেগে বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে যান। তিনি প্রথমে কলাবাগানে তার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে বাকি ড্রেস পরিবর্তন করে সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর নিজেদের মধ্যে আলােচনা করে বগুড়া থেকে আনা কর্নেল হুদার বিগেডের ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওটা তখন শেরেবাংলা নগরে অবস্থান করছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ বেঙ্গল খালেদের কে ফোর্সের অধীনে তার কমাডে যুদ্ধ করেছিল। এছাড়া কর্নেল হুদা ছিলেন ঐ ইউনিটের ব্রিগেড কমান্ডার। অব স্বভাবতই খালেদ আশা করেছিলেন, তার প্রিয় ইউনিট তাকে নিরাপদ আশ্রয় দেবে। কর্নেল মালেক তার স্টাফ-কার নিয়ে দ্রুত বেগে বঙ্গভবন থেকে গ্রীন রােড ধরে ছুটে পালাতে থাকেন। তিনিও ১০ম বেঙ্গল আশ্রয় নিতে যান সাভারে। কারণ একদিন আগে পর্যন্ত ওটা সাভারেই অবস্থান করছিল। কিন্তু ৬ তারিখ তা স্থান পরিবর্তন করে শেরেবাংলা নগরে অবস্থান নেয় যা কর্নেল মালেকের জানা ছিল না। এভাবে অলৌকিকভাবে মালেক বেঁচে গেলেন।
সাভারে অনেক খোজাখুঁজি করে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে না পেয়ে তিনি তার বাড়ী মানিকগঞ্জে রওয়ানা দেন। গন্তব্যস্থলের তিন মাইল দূরে থাকতেই গাড়ী থেমে পড়লাে। উৎকণ্ঠিত মালেক জিজ্ঞাসা করলেন ; ড্রাইভার সাব, থামলেন কেন? জোরে চালান। সে বলল, স্যার পেট্রাল নাই। হায় আল্লা। বিপদের উপর বিপদ। মালেকের পকেটেও টাকা নাই। অগত্যা সামান্য যা কিছু ছিল, ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিয়ে তিনি হেঁটেই চললেন মানিকগঞ্জ। সেখানে গিয়ে আত্মগােপন করে প্রাণ বাঁচান। কর্নেল শাফায়েত জামিল বঙ্গভবনে কোন একটি রুমে বিশ্রাম করছিল। বিদ্রোহ সম্বন্ধে সে কিছুই ধারণা করতে পারেনি। রাত দুটোর দিকে গণবাহিনীর একদল সশস্ত্র ব্যক্তিদের দ্বারা তাড়িত হয়ে সে বঙ্গভবনের উঁচু দেয়াল টপকাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলে। পরে আহত অবস্থায় পলায়ণরত কর্নেল শাফায়েত জামিল মুন্সিগঞ্জে জনতার হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করে এনে ঢাকা CMH-এ ভর্তি করা হয়। নেহাত ভাগ্যগুণে শাফায়েত পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পায়। মেজর হাফিজ উদ্দিন ৪৬ বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারে ছিলেন। তড়িৎগতিতে ভিন্ন দিকে পালিয়ে গিয়ে তিনি নিজ প্রাণ বাঁচান। বাকি অফিসাররাও যে যেদিকে পারে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করে। মুখে বড় বড় কথা বললেও চরম সন্ধিক্ষণে প্রমাণ মিললাে, নিজের ব্রিগেডের সৈন্যদের উপরই কর্নেল শাফায়েত জামিলের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সৈনিকদের তাড়া খেয়ে কমান্ডারের পলায়ন। বাকি অফিসারদের বেলায়ও ঘটে একই দশা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ‘কে’ ফোর্সের দুর্ধর্ষ সেনানায়ক খালেদ মােশাররফ। নিয়তির কি পরিহাস। আজ তিনি সৈনিকদের আক্রোশ থেকে আত্মরক্ষার জন্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে পলায়ন করছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শেষ পর্যন্ত সৈনিকদের হাতেই করুণভাবে নিহত হলেন খালেদ মােশাররফ। অবসান হল তার ১২০ ঘন্টার স্বল্পস্থায়ী অভ্যুত্থান। ধুমকেতুর মত ঘটল তার উত্থান আর পতন।
৩ নভেম্বর ‘৭৫ অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলাে কেন? মাত্র ৫ দিন স্থায়ী হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের রক্তপাতহীন ৩ নভেম্বর অভ্যুথান। আর্মির দুজন সিনিয়র অফিসারের পরিকল্পনায় সংঘটিত হয়েছিল এই অভূত্থান, কিন্তু ব্যর্থ হলাে শােচনীয়ভাবে। নিহত হলেন অভ্যুত্থানের নেতা খালেদ মােশাররফ। খালেদ ছিলেন একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ অফিসার। কিন্তু নভেম্বর ‘ক্যু সামাল
দিতে গিয়ে তিনি নিজেই বেসামাল হয়ে পড়েন। এর আগে তিনি কখনও এত অদক্ষতার পরিচয় দেন নি। ৩ নভেম্বরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, ওটার প্রস্তুতি হয়েছিল ঘটা করে প্রায় সবাইকে জানিয়েই। কিন্তু এসেছিল অতি নিরবে, নিঃশব্দে, মধ্যরাতে। একটি বুলেটও ফায়ার হয়নি। একটি হত্যাকাণ্ডও ঘটেনি। ভােরবেলা সবাই ঘুম থেকে উঠে জানতে পারে, আমির ক্ষমতা বদল হয়েছে। জিয়া আর চীফ অব স্টাফ নেই। তিনি বন্দী। কেন সংঘটিত হলাে এই অভ্যুত্থান? সাধারণভাবে মনে করা হয় খালেদ-শাফায়েতের ‘ক’ ছিল মােশতাক-ফারুক-রশীদ চক্রকে উৎখাত করে আবার আওয়ামী লীগ সরকারকে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান। ধারণাটি মােটেই সত্য নয়। | খালেদ-শাফায়াতের অভ্যুত্থান মুজিব সমর্থক অথবা আওয়ামী লীগ সমর্থক অফিসার বা । সৈনিকদের কোন অভিযান ছিল না। আসলে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান মুজিব-প্রীতির জন্যে অথবা আওয়ামী লীগকে গদীতে বসাবার জন্যেও করা হয়নি। এটা খালেদ-শাফায়াত ৪৬ ব্রিগেডের কিছু অফিসারদের সহায়তায় করেছিলেন স্রেফ তাদের নিজেদেরকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্যে। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের একটি লড়াই। কোন মুজিব ভক্তের মুজিব হত্যার প্রতিশােধ গ্রহণের লড়াই নয়। খালেদ কোনভাবেই আওয়ামী লীগ অথবা মুজিব সমর্থক কোন রাজনৈতিক গােষ্ঠির সাথে কোন রকম যােগাযােগও করেননি, করলে হয়তাে পরিস্থিতি ভিন্ন আকার ধারণ করতাে। তখনকার পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ খালেদকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছিল। অখানে খালেদের কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। মেজরদের সহায়তায় জিয়ার উত্থান খালেদ-শাফায়াতকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কাউন্টার ব্যু করে তারা ক্ষমতায় ফিরে আসার সশস্ত্র প্রচেষ্টা চালান। এটাই ছিল ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের প্রকৃত উপাখ্যান। ব্যর্থ হয় খালেদ-শাফায়াতের এ্যাডভেঞ্চার। কেন ব্যর্থ হলাে খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থান? | ) রাজনৈতিকভাবে সময়টা ছিল অভ্যুত্থানের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। বিভিন্ন কারণে ঐ সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত-বিরােধী মনােভাব প্রকট হয়ে ওঠে। খালেদের অভূত্থানকে ভারতপন্থী এবং বাকশালপন্থী মনে করে সবাই ভীত হয়ে পড়ে। সৈনিকদেরও তাই ধারণা হয়। ঐ সময় এরকম অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা খালেদ মােটেই পর্যালােচনা করে দেখেননি। (২) আমি চীফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে ধরে রাখাটা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এতে বন্দী জিয়ার স্বপক্ষে সেপাই থেকে নিয়ে সকল স্তরের লােকজনদের সহানুভূতি জেগে ওঠে, যা খালেদের বিপক্ষে চলে যায়। বন্দী জিয়ার ইমেজ, মুক্ত জিয়া থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে শেষ পর্যন্ত ‘Counter’ অভ্যুত্থানের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাড়ায়—জিয়ার মুক্তি। খালেদ মােশাররফ তার ভ্রান্ত স্ট্রাটেজীর দ্বারা তার অজান্তেই প্রতিপক্ষ জিয়াউর রহমানকে ‘হিরাে বানিয়ে দেন। | (৩) ৪ তারিখ আওয়ামী লীগের মিছিলে খালেদের মা ও ছােট ভাই নেতৃত্ব দেওয়ায় সবার কাছে খালেদের অভ্যুত্থান pro-আওয়ামী লীগ অভ্যুত্থান হিসাবে সেপাই জনতার কাছে চিহ্নিত হয়ে পড়ে। এটা খালেদের সম্পূর্ণ বিপক্ষে চলে যায়।
৪) অধিকাংশ সৈনিক ধার্মিক ও নামাজী। তারা বহুদিন পর আল্লাহু আকবর, বিসমিল্লাহ জিন্দাবাদ ইত্যাদি শ্লোগান শুনে খুশী হয়ে মােশতাকের পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। কিন্তু। তারা খালেদের প্রত্যাবর্তনকে ধর্মের বিপক্ষে মনে করে শক্তি হয়ে ওঠে। ৫) খালেদ-শাফায়েত শুধু বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর নির্ভর করে অভুথান করেন। প্রধানতঃ এটা ছিল ৪৬ ব্রিগেডের বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্য। এতে স্বভাবতই ঢাকা ‘লগ এরিয়া ইউনিটগুলাে, যথা : সিগন্যালস, সাপ্লাই, মেডিক্যাল, অর্ডিন্যান্স, ই এম ই, ইঞ্জিনিয়ার্স, এ্যাক এ্যাক, বেঙ্গল ল্যান্সার (ট্যাংক) টু-ফিল্ড আর্টিলারি এসব ইউনিট ক্ষেপে যায়। তারা একত্রে মিলে পদাতিক বিগ্রেডের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ‘ (৬) খালেদের কু’তে মােটেই পাবলিক সাপাের্ট বা জনসমর্থন ছিল না। এমনকি পূর্ণ। সৈনিক সমর্থনও ছিল না। সৈনিকদের শক্তিকে তিনি কোন পাত্তাই দেননি। কেবল দুজন সিনিয়ার ও কিছু তরুণ অফিসারের উচ্চাকাংখা ও সেন্টিমেন্টের উপর ভরসা করে অভ্যুত্থান হয়। তাই এর ভিত্তি ছিল খুবই নাজুক। | (৭) জিয়াকে বন্দী করায় সাধারণ সৈনিকবৃন্দ অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতার কোন্দলকে অত্যন্ত ঘৃণ্য চোখে দেখে খালেদের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। অফিসারদের ক্ষমতার কোলে সেপাইদের জড়ানাে কেউ ভাল চোখে দেখেনি। মূলতঃ সৈনিকদের এই সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করেই জাসদের ‘খালেদ বিরােধী’ প্রােপাগাণ্ডা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। আর্মির চীফ অব স্টাফকে বন্দী করে তার অধীনস্থ ডেপুটির জোর করে সেনাপ্রধান হওয়াকে সৈনিকদের কাছে মােটেই গ্রহণযােগ্য হয়নি। ৮ে) খালেদের ‘ক’ ছিল নরম ও মানবিক। প্রধান প্রতিপক্ষ নায়ক জিয়াউর রহমানকে জীবিত রেখেই তিনি ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলেন। অথচ ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব বড়ই রুট। এখানে চরম নির্দয়তাই সাধারণতঃ সফলতার প্রধান চাবিকাঠি। খালেদ-শাফায়েত সে পথে যাননি, ফলে প্রধান নায়ক জিয়াউর রহমান জীবিত থাকায় অতি দ্রুত তাকে কেন্দ্র করে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়। (৯) ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে তরুণ মেজরদের দ্বারা পরিচালিত একটি অভ্যুত্থান। তাদের দ্বারা সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করা অতি সহজ কাজ হলেও পরবর্তী ধকল সামলানাে সহজ ব্যাপার ছিল না। খালেদ যখন মধ্য পর্যায় থেকে অপারেশন পরিচালনা শুরু করেন, তখন সবকিছু তালগােল পাকিয়ে গেছে। বঙ্গভবনে প্রতিপক্ষ গ্রুপ ততক্ষণে শক্ত “অপজিশন” নিয়ে ফেলেছে।
(১০) খালেদের অপারেশনে ‘গােপনীয়তা’ বলে কিছুই ছিল না। সবাই জেনে যায়। এতে জিয়ার পক্ষে আগাম counter-অ্যাকশন পরিকল্পনা করা সহজ হয়। এছাড়াও তাদের প্ল্যানে কোন গতি, আক্রমন, আঘাত হানা, ধ্বংস, ক্যাপচার, কিছুই ছিল না। এটা নিছক আলােচ•? আর আপােষরফার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। দেখেশুনে মনে হয়েছে, এটা যেন বাবুদের একটি Telephone Battle. লেদ আলোচনা ও ডিপ্লােমেসিতে অযথা সময় নষ্ট ফনে। মিতা চুল ওমতা শহত কত বহু সময় করেন,
যাতে ডেকে আনে। ক্যান্টনমেন্টে যখন বিদ্রোহ দানা বেধে উঠছে, তখনাে তিনি বঙ্গবভনে তার প্রমােশন ও রাজনৈতিক আলােচনায় ব্যস্ত ছিলেন। তার মত একজন বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ সামরিক অফিসারের এরকম হেঁয়ালীপনা সবাইকে অবাক করে। (১১) রেডিও, টি ভি, সবকিছু বন্ধ রেখে তিনি তার উদ্দেশ্য লক্ষ্য সম্বন্ধে জাতিকে ও সশস্ত্র বাহিনীকে কিছুই জানতে দেননি। তিনি যে ক্ষমতায় আছেন, এর সামান্য উত্তাপও কেউ টের পায়নি। জনগণ ও সৈনিকদের প্রভাবিত করার কোন চেষ্টাই তিনি করেননি। এ কয়দিন তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন সৈনিক ও জনগণ থেকে। গণমিডিয়া বন্ধ থাকায় সবৃত্র সৃষ্টি হয় নানা গুজব ও বিভ্রান্তি, যা খালেদের সম্পূর্ণ বিপক্ষে কাজ করে। (১২) বঙ্গভবনে তিনি যখন বেহুদা আলােচনায় রত, তখনই ক্যান্টনমেন্টে তার বিরুদ্ধে সেনা-বিদ্রোহ দানা বেধে উঠতে থাকে। তিনি ছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ বে-খবর। ফলে কোন counter ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। অসন্তোষকে কেন্দ্র করে সৈনিকরাও যে সংগঠিত হয়ে কমাণ্ডারদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে বিদ্রোহ করতে পারে—এরকম ধ্যান-ধারণা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার মাথায় আসেনি। (১৩) তার কমাণ্ডে ঢাকা কান্টনমেন্টের টুপস এক চতুর্থাংশও তার প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না। সৈনিকদের শক্তিকে তিনি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেন। তরুণ অফিসারদের উপরই তিনি বেশী | নির্ভরশীল ছিলেন।
(১৪) খালেদ-শাফায়েত সম্পর্ক ভাল থাকলেও উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য (AIM) অভিন্ন ছিল শাফায়েত জামিলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, মেজরদের বঙ্গভবন থেকে বহিষ্কার এবং ‘চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা। কিন্তু খালেদ মােশাররফের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ক্ষমতা দখল এবং জিয়াকে সরিয়ে নিজে চীফ অব স্টাফ হওয়া। দুই প্রধান কু-নেতার লক্ষ্যের অভিন্নতা না থাকায় খালেদ শুরু থেকেই ইচ্ছা থাকলেও সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে সরাসরি আরােহণ করতে পারেননি। এছাড়া নেপথ্যে জিয়ার সাথে ছিল শাফায়েত জামিলের মধুর সম্পর্ক। প্রাথমিক অবস্থায় সে জিয়াকে ‘চীফ রেখেই পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। এখন ঐ কাজটিই খালেদ মােশররাফকে নিয়ে করতে হচ্ছিল। ফারুক-রশিদের দৃঢ় অভিমত, ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান, খালেদ মােশাররফ নয়। অর্থাৎ জিয়াশাফায়েতের গােপন সমঝােতায়ই ৩ নভেম্বর অভ্যুথান সংঘটিত হয়। জিয়াকে তার বাসায় শাফায়েতের টুপসের তত্বাবধানে নিরাপদে আটকে রাখা হয়।
প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা দখলের ঐ দিনগুলােতে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন মতলবে ভয়ংকর গােপন খেলায় মত্ত ছিল যা উদঘাটন করা বেশ কঠিন ব্যাপার। এসব ভবিষ্যত অনুসন্ধিৎসুদের গবেষণার ব্যাপার। পরবর্তিতে ঐ অভ্যুত্থানের বিদ্রোহীদের প্রতি, বিশেষ করে শাফায়েত জামিলের প্রতি জিয়ার সদয় ব্যবহার এই ধারণা বদ্ধমূল করে। . (১৬) শাফায়েতের ৪৬ তম পদাতিক ব্রিগেডের শক্তিকে খালেদ 0ver Estimate করেছিলেন। পদাতিক ব্রিগেডই সর্বেসর্বা। অন্যান্য সার্ভিস কোরের ইউনিটগুলাে সব ফালতু, এমনিতরাে ধারণার বশবর্তী হয়ে তিনি তাদের শক্তিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেন। অথচ পরবর্তিতে দেখা গেল এসব সার্ভিস ইউনিট, ল্যানসার, আর্টিলারী এদের সম্মিলিত শক্তি তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালে এক ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। (১৭) সর্বোপরি এসব এ্যাডভেঞ্চারের ক্ষেত্রে ভাগ্য (Luck) বিরাট ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে ভাগ্যলক্ষ্মী খালেদের সপক্ষে ছিলাে না, যার জন্য মুক্তিযুদ্ধের একজন জনপ্রিয়। সমরনায়ক হয়েও শেষবেলায় তার ভাগ্যে নেমে এলাে ব্যর্থতার গ্লানি। সৈনিকদের হাতেই করুণভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলাে এই বীর সেনানায়ককে।
সূত্র : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা – লে. কর্ণেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি