You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ রক্তাক্ত সেনা-অভ্যুত্থান

১৯৭১ সাল। উত্তাল বাংলাদেশ। সভা মিছিল বিক্ষোভ প্রতিবাদ। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন। বিক্ষুব্ধ জনতা। ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খার পতন, জেনারেল ইয়াহিয়া খার উথান। সারা দেশে “মার্শাল ল”। ছয় দফার দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়। একাত্তর সাল। শেখ মুজিবুর রহমানের বিস্ময়কর উত্থান। উদ্বিগ্ন পাকিস্তান। শুরু হলাে সামরিক জান্তার গােপন ষড়যন্ত্র। ভুট্টো-ইয়াহিয়ার নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন। মুষ্টিবদ্ধ বাঙালী। পথঘাট অফিস আদালত বন্ধ। আন্দোলন তুঙ্গে। ২৫শে মার্চ। রাতের অন্ধকারে ঢাকা সেনানিবাস থেকে কামান বন্দুক ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে এলাে সশস্ত্র পাকবাহিনী। ভীমরুলের মত ঝাকে ঝাকে। চতুর্দিকে গুলি আর গুলি। মারা , পড়লাে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। সর্বত্র জনতার শব মিছিল।

এবার মুক্তি সংগ্রাম। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম। একদিকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত-সুশিক্ষিত পাকবাহিনী। অন্যদিকে লাঠি-ডাণ্ডা হাতে ভেতাে বাঙালী। শুরু হলাে স্বাধীনতার সংগ্রাম। পলাশীর যুদ্ধের পর দু’শাে বছর পার হয়ে গেল। কোন সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি এই ভূ-খণ্ডে। সুদীর্ঘ বিরতির পর তরুণ বাঙালীদের অস্ত্র-হাতে নতুন অভিজ্ঞতা। সৃষ্টি হলাে নতুন ইতিহাস। দীর্ঘকাল বৃটিশ আর পাকিস্তানী প্রভুরা অস্ত্রের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে ভেতাে বাঙালীদের। শতাব্দির ব্যবধানে এই প্রথমবার ব্যাপকভাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে বাঙালী তরুণরা। বন্দুকের উত্তপ্ত নল। তাজা বাবুদের গন্ধ, টগবগে রক্ত। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। পুলিশ, আনসার, বিডিআর, বাঙালী পল্টন। সশস্ত্র বাঙালী সৈনিকদের পাশাপাশি হাত মিলিয়েছে হাজার হাজার তরুণ ছাত্র যুবক পেশাজীবী শ্রমিক। জনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। হাতিয়ার পেলে লড়তে জানে বাঙালীরা। নাস্তানাবুদ খানসেনা। ঝিমিয়ে এলাে তাদের লম্ফঝম্ফ। পরাজিত পাকবাহিনী। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর। ছেড়া শার্ট, ছেড়া জুতা, পরনে ময়লা লুঙ্গী। কাঁধে ঝুলছে রাইফেল। ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার দ্বিগবিজয়ী বীর মুক্তিযােদ্ধা। তরুণদের দীপ্ত হুক্কারজয় বাংলা।

ট্যাংক, কামান, বন্দুক, ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরাজিত খানসেনা। তারা নত মস্তকে সারিবদ্ধ ভাবে দণ্ডায়মান রেসকোর্স ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে। এক লক্ষ অক্ষত সৈন্য নিয়ে পাক জেনারেল আবদুল্লা খা নিয়াজীর আত্মসমর্পণ। নিজ হাতে পিস্তল থেকে গুলি বের করে হাতিয়ার ঢেলে দেয় টাইগার নিয়াজী। কি লজ্জা! জয় হলাে জনতার, বিশ্বস্ত পাক-বাহিনী। চারিদিকে উল্লাস। গগণ বিদারী জয়ধ্বনি-জয় বাঙলা। বাঙলার জয়। শােষিত জনতার জয়। সােনক-জনতার সমন্বয়ে, জনতার সমর্থনে মাতৃভূমি রক্ষার্থে যে বাহিনী রুখে দাড়ায়,

তাকে পরাস্ত করার ক্ষমতা পৃথিবীর কোন আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর নাই। নদীমাতৃক বাঙলার ভেজা মাটিতে তার প্রমাণ মিলল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। এই ভূখণ্ডের ইতিহাসে সংযােজিত হল এক নূতন অধ্যায়। সােনার অক্ষরে লিখা থাকবে একটি সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস। বাঙালীর বিজয় গাথা। | স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্ত বাংলাদেশে গঠিত হলাে স্বাধীন সরকার। স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেন বাঙলাদেশে।

১৯৭২ সাল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হাল ধরলেন স্বাধীন সরকারের। শুরু হল ঐতিহাসিক যাত্রা। উৎফুল্ল জনতা। একমাত্র তিনিই তখন সকল চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। তাকে নিয়ে শুরু হলাে বন্ধুর পথে কঠিন যাত্রা।  বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাঙালী। সবাই এবার বিজয়ের অংশীদার। | ভারতীয় বাহিনী বলে বিজয় আমাদের। মুক্তিবাহিনী বলে আমাদের। মুজিববাহিনী ভাবে আমাদের। সেনাবাহিনী বলে আমাদের। দেশের আনাচে কানাচে ছিটিয়ে পড়া নাম-না-জানা গেরিলারা বলে আমাদের। সেতু পাড়ার গেদু মিয়া কদম আলীরা ভাবে আমাদের। কারণ তারা নাকি বাড়ীতে বাড়ীতে মুক্তিযােদ্ধাদের দিয়েছিল আশ্রয়। কবির ভাষায় :

রথযাত্রা, লােকারণ্য, মহা ধুমধাম

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।

পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,

মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’—হাসে অন্তর্যামী।

সবাই বলে আমি বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এবার আমার প্রাপ্য আমাকে দাও। আমি কেন অবহেলিত। অন্যরা কেন আমার অগ্রভাগে ? | শুরু হয়ে গেল চাওয়া পাওয়ার ‘ইদুর দৌড়। চাই, চাই, চাই। গাড়ী চাই, বাড়ী চাই, টাকা চাই, চাকুরি চাই। চাকুরিওয়ালাদের প্রমােশন চাই। নবগঠিত সেনাবাহিনীতেও একই আওয়াজ প্রমােশন চাই। অনেক ত্যাগ হয়েছে, এবার চাই প্রমােশন। আর অপেক্ষা নয়। নবগঠিত সেনাবাহিনী। চাওয়া পাওয়ার হাওয়া লাগল এখানেও। চারিদিকে বিশখলা। চাওয়ার লােক বেশী। দেওয়ার লােক নেই। নয় মাস যুদ্ধ শেষে অধৈর্য জাতি। কেউ আর জীবনযুদ্ধে এবার পিছিয়ে থাকতে রাজী নয়। ত্যাগ তিতিক্ষার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেছে নমাসেই। এই তাে বাঙালী জাতি। | জাতীয় জীবনে সর্বত্র নেমে আসে হতাশা, নৈরাজ্য। চারিদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৪ সাল। আইন শখলার চরম অবনতি। চুরি, ডাকাতি, হাইজ্যাকিং। মিল কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতি। উত্তরবঙ্গে দুর্ভিক্ষ। রিলিফ নিয়ে কারচুপি। রিলিফের চাল খালাস না করে বন্দর ছেড়ে চলে যায় বিদেশী জাহাজ। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের আবর্তে বাংলাদেশ। | যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। এর তড়িৎ পুনর্গঠনে দরকার ছিল দক্ষ প্রশাসন, অভিজ্ঞ প্রশাসনিক অফিসারবৃন্দ, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছিল অনুপস্থিত। সর্বোপরি দরকার ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির প্রশাসনিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা। শেখ সাহেবের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থাকলেও রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রকে তিনি দক্ষতার।

সঙ্গে পরিচালনা ও দিক-নির্দেশনা দিতে পারেননি। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অরাজকতা তাকে ঘিরে ধরে। দিশেহারা রাষ্ট্রপতি।

উন্মুক্ত সীমান্ত। বদ্ধি পায় চোরাচালান। অর্থনৈতিক অবস্থার চরম অবনতি। চারিদিকে লুটপাট জাতীয় সমস্যা মােকাবেলার ব্যর্থ অদক্ষ অনভিজ্ঞ দুনীতিবাজ প্রশাসন। অসহায়। রাষ্ট্রপতি। তাকে ঘিরে ‘চাটার দল। সমস্যা মােকাবেলায় ডাকা হয় সেনাবাহিনী। সীমান্তের চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ। অপ্রীতিকর সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সেনাবাহিনীর অফিসার আর রাজনৈতিক নেতা-পাতিনেতারা। তারা একে অন্যকে দোষ দেয়। ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রপতি। সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের বাড়াবাড়ি তার পছন্দ হয় না। একূল ওকূল দুকূল রক্ষার্থে প্রাণান্ত রাষ্ট্রপতি। দেশের অভ্যন্তরে প্রকাশ্যে বিরােধিতায় মাঠে নামে রব-জলিলের জাসদ পাটি। সর্বত্র জোর প্রতিবাদ। ১৯৭৫ সাল উত্তপ্ত ঢাকা স্নােনিবাস। বেশ ক’টি বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটে গেল একের পর এক। গাজী গােলাম। মােস্তফার ছেলে কর্তৃক মেজর ডালিম লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য। | বিয়ের পার্টিতে উপস্থিত নব-বিবাহিত ডালিম ও তার স্ত্রী। গাজীর ছেলে ডালিমকে অপমান করে। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি। ডালিম কর্তৃক গাজীর ছেলেকে চপেটাঘাত। কিছুক্ষণের মধ্যে গাজীর ছেলে দলবল নিয়ে হাজির। ডালিম ও স্ত্রীকে একটি গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে। যাত্রা। ক্যান্টনমেন্টে খবর শুনে ডালিমের বন্ধু মেজর নূর এক গাড়ী সৈন্য নিয়ে গাজী গােলাম। মােস্তফার বাড়ী ঘেরাও করে এবং ডালিমকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানায়। তাকে বঙ্গবন্ধুর সামনে হাজির করা হলাে। ডালিমের ফরিয়াদ, বঙ্গবন্ধু, আমরা আপনার। ডাকে লড়াই করেছি। আর এই ছেলেরা তখন ফুর্তি করেছে। আজ তারা আমাকে অপমান করছে। আপনি বিচার করুন।

শার্ট খুলে সে দেখায় পিঠের আঘাত। বঙ্গবন্ধু বিচার করলেন! তিনি সেনা-শখলা ভঙ্গের দায়ে মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করলেন। এসব নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দারুন উত্তেজনা। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ এই দুই তরুণ অফিসারকে বরখাস্ত না করার পক্ষে জোর সুপারিশ করলেও শেখ সাহেব তা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। ঘটনাটি ক্ষুদ্র হলেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী। ঐ সময় বিভিন্ন কারণে আরাে কিছু অফিসার বহিষ্কৃত হলাে। কর্নেল জিয়াউদ্দিন ইতিপূর্বেই একটি পত্রিকায় সরকারের তীব্র সমালােচনা করে প্রবন্ধ লেখার অজুহাতে বহিত। জিয়াউদ্দিনকে তার লেখার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হলে তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। কর্নেল তাহেরকে পঙ্গু হওয়ার অজুহাতে অবসর দেওয়া হয়। বীর মুক্তিযােদ্ধা মেজর জলিলকে তিন বছর আগেই বহিষ্কার করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা মালামাল লুট করে দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় জোর প্রতিবাদ জানালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে অসম্মানজনকভাবে সেনাবাহিনী থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। | সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে ঐ সময় জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মােশাররফ শেখ। সাহেবের অনুগতদের মধ্যে ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে শেখ সাহেবের অধিক নিকটবর্তী মনে করা হতাে। তিনি ঘন ঘন শেখ সাহেবের কাছে যেতে পারতেন। কিন্তু। জিয়াকে লাইনে অপেক্ষা করতে হতাে। এতে ধারণা করা হয়, শফিউল্লাহর পর খালেদকেই সেনাপ্রধান বানানাে হবে। এ ধারণা মােটেই অমূলক ছিল না। জিয়া ব্যাপারটা ঠিকই অনুধাবন

করেছিলেন। যে কোন কারণেই হােক, শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগ ব্যক্তিবর্গরা জিয়াকে উচ্চাকাখী। বলে মনে করতেন। জেনারেল ওসমানীও জিয়াকে ভাল চোখে দেখতেন না। এমনকি ঐ সময় জিয়াকে পূর্ব জার্মানীতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে আর্মি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি হয়ে যায়। এসব জেনে জিয়া কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) খুরশিদের মাধ্যমে শেখ সাহেবকে বুঝাবার চেষ্টা করেন। কর্নেল খুরশিদ আগরতলা কেইসে শেখ সাহেবের সহযােগী ছিলেন। তাই তিনি তার খুব কাছের লােক ছিলেন। কিন্তু তিনি জিয়ার প্রতি শেখ সাহেবের মনােভাব কিছুটা পরিবর্তন করাতে সক্ষম হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। তােফায়েল আহমদের সাথেও ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখার চেষ্টা করেন জিয়া, শেখ সাহেবের সহানুভূতি অর্জনের জন্যে।

এ নিয়ে পচাত্তর সালে জিয়ার মন মেজাজ ভাল ছিল না। এ সময় তিনি প্রায় একঘরে। দিন কাটান। বিশেষ কেউ তার কাছে আসা যাওয়া করতাে না। আমি তখন ঢাকার স্টেশন কমডার। ঐ সময় তার সাথে যতবারই দেখা হয়েছে, তার উগ্রতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তবে বলতেন, শেখকে ঐ ব্যাটারাই (শফিউল্লাহ, খালেদ) আমার বিরুদ্ধে খোঁপয়েছে। জেনারেল ওসমানীকেও গালাগালি করতেন। আমি তাকে শান্ত থাকার অনুরােধ করতাম। জিয়ার সাথে বরাবর আমার ছিল ভাল সম্পর্ক। তার সাথে আমার সুসম্পর্ক শফিউল্লাহ ও খালেদ ভাল চোখে দেখেননি। জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রদূত করে পূর্ব জার্মানী অথবা বেলজিয়ামে পাঠাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন জিয়া তার অফিসে আমাকে ডেকে বলল ; হামিদ, তুমি ওসমানীকে ধরে এখনই কিছু একটা না করলে চিঠি বেরিয়ে যাবে। প্লিজ ডু সামথিং। জনাব সাইদুর রহমান, একজন প্রভাবশালী মুক্তিযােদ্ধা। তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। তােফায়েল ও রাজ্জাকের সাথে উনার ছিল গভীর সংযােগ। আমি জিয়াকে আবাস দিলাম, তার মারফত আমি কিছু একটা করব। জনাব সাইদকে আমি বন্ধুবর জিয়াউর রহমানের ব্যাপারটি বললাম। তিনি কিছু একটা করবেন বলে আমাকে আশ্বাস দিলেন। আমি বরং জিয়াকেই তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, যেন জিয়া নিজেই তাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিতে পারে। পরে জনাব সাইদ, তােফায়েল আহমদ ও রাজ্জাককে ধরে বহু কষ্টে প্রায় শেষ মুহূর্তে জিয়ার সিভিল পােস্টিং ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। | ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ বহু বছর পর সেদিন জনাব সাইদ আমার টেলিফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন করে বললেন ; কর্নেল সাহেব, আপনার জন্যই ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বর এবং ৭ নভেম্বর সংঘঠিত হলাে। ব্যাপারটি আমি বুঝতে না পারায় তিনি এবার পরিষ্কার করে বললেন, আপনি সেই যে জিয়াউর রহমানের পােস্টিং ক্যানসেল করানাের জন্য আমাদের কাজে লাগিয়েছিলেন, সেটাইতাে কাল হলাে। জিয়া না থাকলেতাে এ তিনটা অভুত্থানের কোনটাই হতাে না। | বলা বাহুল্য, জনাব সাইদুর রহমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আমার অজান্তেই জিয়ার সাথে তাদের বহু গুরুত্বপর্ণ মিটিং হয়, খালেদা জিয়ার বড় বােন চকলেট আপার বাসায়, যা অভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু ছিল। | পচাত্তর সালে মাঝে-মধ্যে কু’র গুজব উঠলেও শেখ সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব এতই বিশাল ছিল সে তার অনুগত সেনাবাহিনীর দিক থেকে কোন রকম আক্রমন-আশংকা আঁচ

করা যায়নি। ঐ সময় ফারুক রশিদ অথবা অন্য ক’জন জুনিয়ার অফিসার ছােটখাট কিছু একটা করতে পারে, এমন অস্পষ্ট আঁভাস ডি জি এফ আই-র কাছে থাকলেও তারা যথােপযুক্ত প্রতিরােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। তারা সবাই বরং মেজর জলিলের। জাসদের দিক থেকে সরাসরি চোরাগুপ্তা আক্রমনের আশা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কয়েকটি স্থানে সর্বহারা এবং জাসদ আর্মস্ গ্রুপের সাথে পুলিশের গুলি বিনিময়ও হয়। খুব সম্ভব মাসটি ছিল পঁচাত্তরের জানুয়ারী অথবা ফেব্রুয়ারী। ঐ সময় আমি একবার শেখ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই। ঘটনাটি ছিল নেহাৎ আকস্মিক। একটু খােলাসা করে বলেই নেওয়া যাক| সেনানিবাস টেনিস কোর্টে একদিন টেনিস খেলা শেষে কর্নেল খুরশিদ আমাকে ডেকে কানে কানে বলল; হামিদ ভাই, আপনার উপর বঙ্গবন্ধু দারুণ ক্ষেপে আছেন। আপনি শীঘ্র তার সাথে দেখা করে পজিশন ঠিক করুন। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কাহা রাজা ভােজ, কাহা গঙ্গারাম তেলি। খুরশিদ বলল, মনে হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বুলডােজার। লাগিয়ে কচুক্ষেত মাকেট আপনার নির্দেশে উচ্ছেদ করা হয়। স্থানীয় এম পি এবং ডি জি এফ আই রউফ আপনার বিরুদ্ধে এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করেছে। এবার মনে পড়লাে, হ্যা, কচুক্ষেত বড় মার্কেটটি ক্যান্টনমেন্টের ভিতর থেকে উচ্ছেদ করে আমি বর্তমান জায়গায় স্থাপন করেছিলাম। এতে স্থানীয় লােকজন আমার উপর নাখােশ ছিল। তারা বলেছিল নতুন। যায়গায় মার্কেট চলবে না। আমি খুরশিদকে বললাম, আমি কিভাবে প্রটোকল ভেঙে একজন রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে পারি? খুরশিদ বলল ; দেখুন, এতােকিছু বলবেন না। আজই আপনি খেলা শেষে রাত দশটার দিকে সােজা তার বাসায় দেখা করতে চলে যান। বললাম—তিনি আমার সাথে দেখা করবেন কি? ‘অবশ্যই।

‘তিনি আমাকে চিনবেন কি? ‘অবশ্যই। আপনার নাম মুখস্ত হয়ে গেছে উনার। আজই যান। রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ বাসায় ফিরে গােসল করে এশার নামাজ পড়ে আমি যাত্রার জন্য সত্যি সত্যি তৈরি হয়ে গেলাম। দশটা বাজতে তখন পনেরাে মিনিট বাকি। আমি আমার প্রাইভেট কার নিয়ে সরাসরি ৩২ নং রােডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাড়ীর গেইটে পেীছে গাড়ী থেকে নেমে তার বাসায় প্রবেশ করতে আমার একটুও কষ্ট হলাে না। একটি মাত্র পুলিশ সান্ত্ৰী নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাে, ভাই সাহেব আপনি কে? বললাম, আমি কর্নেল হামিদ। শেখ সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি। বিনীত কণ্ঠে সে বলল ; স্যার, এই কিছুক্ষণ আগে তিনি উপরে শুইতে গেছেন। সবাই চলে গেছে। এখন তাে তাকে ডাকা যাবে না। বললাম, তুমি শুধু উপরে আমার নামটা বলে খবর পাঠাও। তিনি দেখা না করলে আমি চলে যাব। আমার দৃঢ়তা দেখে সে খবর পাঠাতে গেল। আমি ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি এই সময় দেখা করবেন না বলেই নিশ্চিত ধরে নিয়ে ছিলাম। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে হঠাৎ দেখি রাষ্ট্রপতি একেবারে আমার সামনে দাড়িয়ে। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। এত কাছে থেকে তাকে আমার এই প্রথম দেখা। তিনি উষ্ণ করমর্দন করলেন। সােফায় আমাকে বসতে বলে চা আনতে নির্দেশ দিলেন। অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুসুলভ মনােভাব নিয়ে তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, আপনার নামতাে অনেক শুনেছি। এতদিন আসেননি কেন?

এখন কি কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? বললাম; স্যার, আমি কোন সমস্যা নিয়ে আসিনি, স্রেফ প্রথমবার আপনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছি। আর কিছুই না। আমার সরল জবাব শুনে তিনি ক্লান্ত দেহটি চেয়ারে এলিয়ে দিলেন। উচ্চকণ্ঠে আবার হাক দিয়ে চা আনতে বললেন। এবার তিনি কথা বলতে শুরু করলেন। অনেক কথা যেন বুকে আটকা পড়েছিল কতদিন ধরে।

বললেন ; কর্নেল সাহেব কি বলবাে, আপনার আর্মির কথা। অফিসাররা শুধু আসে আর একে অন্যের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করে। অমুক এই করেছে, সেই করেছে। আমার প্রমােশন, আমার পােস্টিং। বলুন তাে কি হবে এসব আর্মি দিয়ে? অফিসাররা এভাবে কামড়া-কামড়ি করলে, ডিসিপ্লিন না রাখলে এই আর্মি দিয়ে আমি কি করবাে? আমি এদের ঠেলাঠেলি সামলাবাে, না দেশ চালাবাে। এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। তিনি শিশুর মতাে বলেই চললেন, বাঙালীদের স্বাধীনতার জন্য আমি কি-না করলাম। আইয়ুব খা, ইয়াহিয়া খার। সাথে জীবনভর লড়াই করলাম। আমাকে কতবার জেলে দিল। বাঙালী সেনা-পল্টনের জন্য লড়লাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনার লন্ডনি-সিলেটিরা আমাকে কত সাহায্য করলাে। আগরতলা কেইসে আমার জন্য উকিল পাঠালাে। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সবাই খাই খাই শুরু করছে। কোথা থেকে আমি দেবাে, কেউ ভাবতে চায় না তিনি বলেই চললেন। এভাবে ৪৫ মিনিট কেটে গেল। তিনি এত কথা, এত ব্যথা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, আমিতাে ভেবে অবাক!  রাত গভীর হয়ে যাচ্ছে দেখে এক সময় আমিই তার কথার ফাকে ছেদ দিয়ে বললাম, স্যার মাফ করবেন, আপনি ক্লান্ত। অসময়ে এসে আপনার বিশ্রাম ভঙ্গ করেছি। আমি যাই। তিনি চমকে উঠলেন। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ায় তিনিও খেয়াল করেননি। তৎক্ষণাৎ উঠে। দাঁড়ালেন। আমাকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে বিদায় দিলেন। বললেন, আপনি যখন চাইবেন সােজা চলে আসবেন বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে তাকে শুধু একটি কথা বললাম; স্যার, আপনার বাসায় সিকিউরিটি বলতেতাে কিছুই নাই। আমি সরাসরি ঢুকে পড়লাম। বদ মতলবেও তাে কেউ ঢুকে পড়তে পারতাে।

আমার কথা শুনে তার বিরাট হাসি পেল। আমাকে কাধে জড়িয়ে ধরে বললেন ; দেখুন আমি হলাম পাবলিক লীডার। জনগণের মধ্যেই আমাকে থাকতে হয়। মারতে হলে আমাকে। রাস্তা-ঘাটেও মারতে পারে। তবে কোনও বাঙালী আমাকে মারতে পারে না। তার প্রবল আত্মবিশ্বাস। সালাম দিয়ে আমি বিদায় নিলাম। তার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা , হয়নি। ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে আমি সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল খুরশিদকে ফোন করে সব বললাম। শুনে সে তাে অবাক। বলেন কি, এতােটা সময় তিনি মন্ত্রীদেরও দেননা। আমি বলেছিলাম । তিনি চাচ্ছিলেন, আপনি দেখা করুন। আমি আজও ভেবে পাই না, প্রথম সাক্ষাতেই তিনি আমার সাথে এতাে কথা বলতে গেলেন কেন? বিশালদেহী শেখ সাহেবকে তখন কেন জানি আমার বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। চারিদিকে সমস্যা তাকে ঘিরে ধরেছিল। চারিপাশে চাটুকার দল। তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার পাশে হাল ধরার মত নিঃস্বার্থ একটি লােকও বুঝি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেনাবাহিনীর অফিসারদের উচ্চাকা প্রমােশন ইত্যাদি নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিলাে। এতে বাঙলাদেশ সেনাবাহিনী সম্বন্ধে তার মনে বিরূপ ধারণাই দানা বেধে উঠছিল, তা স্পষ্ট বুঝতে পারি। বােধকরি এ জন্যই রক্ষীবাহিনী শক্তিশালী করার দিকে। তিনি মনােযােগ দেন।

১৯৭৫ সাল শেখ সাহেবের জন্য খুবই দুর্যোগপূর্ণ বছর। আইন শখলার দারুণ অবনতি ঘটে। চোরাচালান ও বর্ডার সীল করতে সেনাবাহিনী নিয়ােগ করা হয়। তরুণ অফিসাররা এ সময় ক্ষমতাসীন পার্টির বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। পার্টির নেতারা সেনাবাহিনীর আচরণের বিরুদ্ধে শেখ সাহেবের কাছে ক্রমাগত অভিযােগ তুলতে থাকে। তার দলীয় রাজনৈতিক নেতারা শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের বিরােধিতা সত্বেও শেখ সাহেব চোরাচালান, অস্ত্র উদ্ধার ও দুর্নীতি দমন করতে সেনাবাহিনীকে মাঠে। নামান। এসব অপারেশনে বেশ কিছু ক্ষমতাসীন এম পি বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হন। টাংগাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করতে ৪৬ ব্রিগেড নিয়ে অভিযান। চালান কর্নেল শাফায়েত জামিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলীয় চাপের মুখে তিনি সেনাবাহিনীকে মাঠ থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। বৃদ্ধি পেলাে তিক্ততা। ক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত রাষ্ট্রপতি। এই সময় তরুণ মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের কিছু অংশ দারুণ ক্ষেপে ওঠে। তারা ভেতরে ভেতরে দল পাকাতে থাকে। উর্ধতন অফিসারদের মধ্যে এমনিতেই রেষারেষি চলছিল। মুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত ছিল। শফিউল্লাহর ‘এস ফোর্স’, জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোর্স’ এবং খালেদ মােশাররফের ‘কে ফোর্স’। জিয়াউর রহমানের সাথে। শফিউল্লাহ ও খালেদ মােশাররফের বনিবনা ছিল না। তবে শফিউল্লাহ ও খালেদের গ্রুপ ভারী হওয়াতে ঐ সময় জিয়াউর রহমানকে কিছুটা কোণঠাসা অবস্থায় থাকতে হয়। যে সব তরুণ অফিসারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাদের প্রতি জিয়ার সহানুভূতি ছিল। জিয়ার স্টাফ অফিসার ছিল মেজর নূর। তার কামরাতে প্রায়ই এসব অফিসারদের আনাগােনা চলতাে। সেনাবাহিনীতে দু’টি বড় গ্রুপ ছিল। মুক্তিবাহিনী গ্রুপ এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ। শেষােক্ত গ্রুপ বড় গ্রুপ হলেও মুক্তিবাহিনী-অফিসারদের ক্ষমতা ও দাপট ছিল অপ্রতিহত। ক্ষুদ্র হলেও প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর পরিবেশ ও মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করছিল মুক্তিবাহিনী অফিসাররাই। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও সৈনিকরা তখন চুপচাপই দিন কাটাচ্ছিল, যদিও মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপের সাথে সিনিয়রিটি ও প্রমােশন ইত্যাদির অসামঞ্জস্যতা নিয়ে তারা ছিল অসন্তুষ্ট। শেখ সাহেব মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের অধিক স্নেহ করতেন। বেশী সুবিধা দিতেন। এসব নিয়ে তারা নাখােশ ছিলেন। বিশেষ করে তাদের দু’বছর সিনিয়রিটি দেওয়ায় প্রত্যাগতরা মনে মনে অপমানবােধ করেন। আমি ছিলাম তখন মিলিটারি সেক্রেটারী। এভাবে ঢালাও সিনিয়রিটি প্রদানের সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া, খালেদ, মঞ্জুর সবাইকে স্পষ্ট করে বলেছিলাম। কিন্তু তাদের কেউ আমার সাথে একমত হননি। শেখ সাহেবও রাজী ছিলেন না। ওসমানীও না। কিন্তু প্রবল চাপের মুখে তারা রাজী হন। ফলে তার অজ্ঞাতেই সেনাবাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তান ফেরত গ্রুপের সহানুভূতি হারান।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারত বিরােধী মনােভাবও প্রকট হয়ে ওঠে। মাত্র চার বছর আগে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কি আশ্চর্য, প্রায় সব মুক্তিযােদ্ধা অফিসারই এরই মধ্যে ভারতকে নাক সিটকাতে শুরু করেছে। জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, খালেদ মােশাররফ এরা কেউ ভারতকে ভাল চোখে দেখতেন

না। জেনারেল ওসমানী তাে ইন্দিরা গান্ধীর নামই শুনতে পারতেন না। যুদ্ধের পর তাদের মাতব্বরি ও লুটপাট সবাইকে ক্ষেপিয়ে তােলে। তবুও সার্বিকভাবে বলা যায়, দেশে ঐ সময় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা অস্থির থাকলেও সেনাবাহিনীর দ্বারা বড় রকমের একটা অভ্যুত্থান ঘটবে, তেমন কোন আলামতই। ছিল না। এ কারণে সারা দেশবাসীর জন্য ১৫ অগাস্ট সেনা-অভ্যুত্থান ছিল একটা ‘টোটাল সারপ্রাইজ’ এবং চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা। তবে অগাস্ট অভ্যুত্থান সঠিক অর্থে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিল না। কিছু জুনিয়ার অফিসারের নেতৃত্বে ওটা ছিল ঢাকায় অবস্থিত মাত্র দু’টি ইউনিটের একটি আকস্মিক ঝটিকা অভিযান। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, যশােহর, রংপুর, বগুড়া প্রভৃতি ক্যান্টনমেন্টের সকল ইউনিট ফরমেশনগুলাে ছিল নিরব, শান্ত। তারা কিছুই। বুঝে উঠতে পারেনি। ধুমায়িত অসন্তোষ চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সালে বিভিন্ন কারণে শেখ সাহেবের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে থাকে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বহুলােকের প্রাণহানি ঘটতে থাকে। রিলিফের মাল দুঃস্থ মানুষের কাছে। পৌছতে পারে না। চলে গম চুরি, চাল চুরি, কম্বল চুরি। জাসদ, সর্বহারা, কমিউনিষ্ট প্রভৃতি দল গােপনে সহিংস আত্মপ্রকাশের গােপন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাে। এসব কথা শেখ সাহেবের একেবারে অজানা ছিল না। তার প্রাণনাশের হুমকিও বেড়ে যায়, কিন্তু তিনি এ নিয়ে খুব বেশী একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে মনে হয় না। আজীবন রাজনৈতিক স্রোতের বিপরীতে সংগ্রাম করে করে তিনি এসব হুমকির বিশেষ আমলও দেননি। অগাস্ট ১৯৭৫ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলল। ধুমায়িত অসন্তোষ দমনে বেসামাল শেখ সাহেব অকস্মাৎ সব দল ভেঙে দেশে একদলীয় শাসন পদ্ধতির প্রবর্তন করে ‘বাকশাল’ সৃষ্টি করেন। যে ব্যক্তি সারা জীবন বহুমুখী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করলেন, তিনিই নিজে এখন বহুমুখী গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধ করে এক বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করলেন। একই সাথে সংবাদপত্রের উপরও নেমে এলাে খড়গ। উত্তপ্ত রাজনৈতিক অঙ্গণ। আতঙ্কিত জনগণ। তিনি যত দ্রুত বাকশাল প্রবর্তন করে রাষ্ট্রের পুর্ণ কর্তৃত্বভার কঠোর হস্তে গ্রহণ করার পরিকল্পনা করছিলেন, বিরুদ্ধবাদীরাও ততােধিক দ্রুততার সাথে শেষ কামড় দিতে প্রস্তুত হতে থাকে। শেখ সাহেব এই সময় বাকশাল ছাড়া। আর কিছুই শুনতে রাজী ছিলেন না। ওদিকে ক্যান্টনমেন্টে সেনাব্যারাকেও বাকশাল গঠনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। অন্ততঃ একদল-পদ্ধতি অফিসার বা সৈনিকদেরও কারাে পছন্দ। হয়নি। তবে অসন্তোষ থাকলেও এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে বিরােধিতার মধ্যেও যায়নি

। আমি, নেভী, এয়ারফোর্স প্রধানদের বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ডেপুটি চীপ জিয়াউর রহমানকেও সদস্য করা হয়। বলা বাহুল্য, নূতন ব্যবস্থা ।জনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে নূতন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলাে। | ক্যান্টনমেন্টে গুজব ছড়িয়ে পড়লাে, শেখ সাহেব সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে ভারতীয় সহযােগিতায় রক্ষীবাহিনীকে গড়ে তুলছেন। আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে রক্ষীবাহিনীকে সাজিয়ে দিচ্ছেন। রক্ষীবাহিনীর জন্য নূতন নূতন ব্যারাক, নূতন গাড়ী, নূতন ইউনিফরম। সেনাবাহিনীর সন্দেহ আরাে বাড়িয়ে তােলে।

এসব অসন্তোষজনক অবস্থা থাকলেও সেনাবাহিনীর উর্ধতন সকল অফিসারই শেখ সাহেবের অনুগত ছিলেন। শফিউল্লাহ, খালেদ মােশাররফতাে শেখ সাহেবের কাছের লােক। ছিলেন। একমাত্র জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ডেপুটি চীফ হিসাবে তার ক্ষমতা ছিল সীমিত এবং তখনকার সময় প্রায় ক্ষমতাহীন ও একঘরে। এ ছাড়া তার উপর টিকটিকিদের ছিল কড়া নজর। তবে একথা সত্য, মুক্তিযােদ্ধা জুনিয়ার অফিসারদের মধ্যে বেশ কিছু তরুণ বিক্ষুব্ধ অফিসার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালােচনায় মুখর ছিল। অনেকেই গােপনে গােপনে কিছু একটা করার পথ খুঁজছিল, তবে এসব অভ্যুত্থান ঘটার মত বড় বিপদ হিসাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তেই বিদ্রোহের কালােমেঘ দানা বেঁধে উঠল। ঘটনার মূল নায়ক ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং তার সহযােগী টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ফারুকেরই নিকট আত্মীয়, ভায়রা ভাই। | ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই ইউনিট। মেজর ফারুকের বেঙ্গল ল্যাম্পার ট্যাংক রেজিমেন্ট ছিল ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে। ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেঃ কর্নেল মােমেন, একজন পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার। ফারুক রহমান ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড’। রেজিমেন্টটি তারই হাতে গড়া। স্বভাবতঃই রেজিমেন্টের সৈনিক সবাই ছিল তারই অনুগত। এছাড়া ফারুক ছিল মুক্তিযােদ্ধা অফিসার। অত্যন্ত স্পিরিটেড, ড্যাশিং, প্রবল আবেগপ্রবণ- রেজিমেন্টের গৌরব ও পতাকা সমুন্নত রাখতে সদা সচেতন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বেঙ্গল ল্যান্সার ট্যাংক রেজিমেন্টে ৩০টি ট্যাংক। শেখ মুজিবকে ভালবাসার প্রতীক হিসাবে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের দেওয়া টি-৫৪ ট্যাংক, যাদের বিধ্বংসী ক্ষমতা ভয়াবহ। কিন্তু ফারুক যে ট্যাংকগুলাে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিল, তার একটিতেও কামানের গােলা ছিল না। ট্যাংকে শুধু ছিল মেশিনগানের। | প্রশ্ন জাগে, ফারুক কেন হঠাৎ শেখ সাহেবের প্রতি এত বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল? আগেই বলেছি ফারুক ছিল বড়ই আবেগপ্রবণ। দেশের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্ভিক্ষ, ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার অপব্যবহার, খুন, হাইজ্যাকিং ইত্যাদি অবলােকন করে সে ভীষণভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। দেশ ক্রমাগত ভারতের কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে, শেখ মুজিব দেশকে ভারতের সেবাদাস বানিয়ে ফেলছেনফারুকের ভেতর এই ধারণা প্রবল মানসিক যন্ত্রণার উদ্রেক করে। পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে আমরা ভারতের শখল পরতে রাজী নই—এই ছিল ফারুকের কথা। সর্বোপরি এতবড় ট্যাংক ফায়ার পাওয়ার নিয়ে ক্ষমতার কাছাকাছি বসে ফারুকের মত উচ্চাকাঙ্ক্ষী মিলিটারি অফিসার শান্তশিষ্ট হয়ে বসে থাকবে, তা কিছুতেই আশা করা যায় না। তবে অনেকের প্রশ্ন, ফারুকের মত জুনিয়ার অফিসারের শক্তির উৎস ছিল কোথায়? জবাবটা সবার জানা নেই। তার সকল শক্তির উৎস ছিল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। পারিবারিক সম্পর্কেও ফারুক ছিল খালেদের ভাগিনা। নেপথ্যে খালেদ মােশাররফই| ফারুককে সবরকম নিরাপত্তা ও সহযােগিতা দিয়েছেন। ফারুক যে কিছু একটা করবে, তা খালেদ জানতেন। তবে শেখ সাহেবকে হত্যা করার জন্য অবশ্যই তিনি ইন্ধন যােগাননি। ফারুক তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা, প্ল্যান প্রােগ্রাম নিয়েই চলছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের ছত্রছায়ায় ফারুক জুনিয়ার হলেও ক্যান্টনমেন্টে তার ছিল শক্তিশালী বিচরণ। ফারুক কি মুক্তিযোদ্ধা ছিল? এক সময় এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ফারুক আবুধাবী থেকে পাক-বাহিনী পরিত্যাগ করে পালিয়ে একাত্তরের ২১ নভেম্বর লন্ডন হয়ে নয়া দিল্লীতে উপস্থিত হয়। বিতর্ক অবসানের জন্য দুই সদস্য বিশিষ্ট এক কমিটি গঠন করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মইনুল হােসেন ও আমি ছিলাম সদস্য। আমবা ফারুকের এয়ার টিকিট ইত্যাদি চেক করে প্রায় ৮ ঘন্টার ঘাটতি পাই। আমাদের রিপাের্ট পর্যালােচনা নিয়ে বৈঠক বসে। জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া, খালেদ, মঞ্জুর, মইনুল হােসেন ও আমি উপস্থিত ছিলাম। মিটিং-এ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ফারুকের পক্ষ সমর্থন করে অত্যন্ত জোরালাে বক্তব্য রাখলে কয়েক ঘন্টার ঘাটতি থাকা সত্বেও তাকে মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তবে তাকে দুই বছর সিনিয়রিটি দেওয়া হয়নি। | ফারুকের অপর প্রধান সহযােগী মেজর আবদুর রশিদ ছিলেন টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। ধীর স্থির নবম সুরে কথাবার্তার মানুষ। আমার অফিসের পাশেই ছিল রশিদের টু-ফিলড রেজিমেন্ট। প্রায়ই দেখা হতাে। বলা যায় মেজর ফারুকের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ।

শান্ত ভদ্র এই অফিসারটি যে একটি অভ্যুত্থানের মতাে ঘটনা ঘটাতে পারে, তা কোনও সময়ই আমার মাথায় আসেনি। পঁচাত্তরের মার্চ মাসে রশিদ ভারতে গানারী স্টাফ কোর্স শেষে ঢাকা ফিরলে তাকে যশােহরে আর্টিলারী স্কুলে পােস্টিং দেওয়া হয়। পরে ফারুক আমাকে বলেন, তিনিই তার ভবিষ্যত মহা পরিকল্পনার কথা চিন্তা করে, তার গুরু CGS খালেদ মােশাররফকে ধরে রশিদের পােস্টিং ঢাকায় টু-ফিল্ড রেজিমেন্টে বদলী করান। অন্যান্য যে সব আলােচিত অফিসার, তারা ছিলেন উক্ত দুই ইউনিটের বাইরের। তাদের। মধ্যে ছিলেন মেজর ডালিম, নূর, শাহরিয়ার, হুদা, পাশা ও রাশেদ প্রমুখ। বাকি দুনিয়ার। অফিসাররা উভয় ইউনিটেরই ছিলেন। সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসার, বিভিন্ন কারণে বহিস্কৃত, অপসারিত, ক্ষু। | অভ্যুত্থানের মূল নায়ক মেজর ফারুকুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার গােপন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অবাক হলেও সত্যি, তিনি তার পরিকল্পনার কথা ১২ অগাস্টের আগে পর্যন্ত কাউকে জানাননি, অথবা কারাে সাথে পাকাপাকি আলােচনাও করেননি। কারণ বাইরে ভেতরে যে অবস্থা ছিল, তাতে কাউকে বিশ্বাস করার উপায় ছিল না। যদিও ঐ সময় বেশ কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অফিসার প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযােগ খুঁজছিল। এদের মধ্যে কর্নেল আমিন, মেজর হাফিজ, গাফফার, নাসের, ডালিম, নূর প্রমুখরা ছিলেন। মেজর রশিদ অবশ্য এতে দ্বিমত পােষণ করেছেন। তিনি বলেন, ফারুকের মন্তব্য সঠিক নয়। তিনি নিজেই আলাদাভাবে বহু আগে থেকেই বিভিন্ন সমমনা আর্মি অফিসার এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে গােপন আলােচনা চালিয়ে আসছিলেন।

১২ই অগাস্ট ১৯৭৫

দিনটি ছিল মেজর ফারুকের বিবাহ বার্ষিকী। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসার মেসে বেশ বড় রকমের পার্টির আয়ােজন করে মেজর ফারুক। অন্যান্যদের মধ্যে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সবার অজ্ঞাতে ঐ দিনই প্রথম ফারুক তার ভায়রা মেজর রশিদকে তার গােপন পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করে। রশিদ প্রথমে চমকে যায়, কিন্তু পরে ফারুকের সাথে একান্ত হয়। বলা যেতে পারে ফারুকের প্রস্তাব কিছুটা বাধ্য হয়েই তাকে গ্রহণ করতে হয়। ফারুকের ভাষ্য অনুযায়ী ; আমি যখন রশিদকে প্রস্তাব দেই তখন কিছুটা চমকে উঠলেও যখন তাকে বলি, দেখ রশিদ,

. আমি ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছিই, মরি আর বাচি। তখন ধরা পড়লে আমি তােমার নাম বলবােই। কারণ তােমার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি। অতএব ভাল হয় যদি তুমিও যােগ দাও তােমার ইউনিট নিয়ে, তাহলে সাফল্য নিশ্চিত হবে। পাটি শেষে অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে আলােচনা হয়। রশিদের কথা ছিল, এ কাজে আরাে কিছু অফিসার দরকার এবং তা গ্রহণ করতে হবে। ফারুক তাতে রাজী হয়। সরকার উৎখাত অপারেশন পরিকল্পনার পুরাে দায়িত্বভার মেজর ফারুকের হাতে থাকে এবং রাজনৈতিক দিক মেজর রশিদের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এটা অবশ্য মেজর ফারুকের ভাষ্য। রশিদ কিন্তু বলেন, এসব বাজে কথা। আসলে ১২ই অগাস্ট তারিখে আমরা দু’জন মিলে আলােচনা করে ১৫ তারিখ চূড়ান্ত আঘাত হানার দিনক্ষণটি ঠিক করি বটে, কিন্তু আমি এ ব্যাপার নিয়ে বেশ আগে থেকেই বিভিন্ন জনের সাথে সতর্ক কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মাধ্যমেই ডালিম, নুর, হুদা, রাশেদ, পাশা, শাহরিয়ার এদেরকে দলে আনা সম্ভব হয়। ডালিম, নূর তখন আমি থেকে বরখাস্তকৃত। শাহরিয়ারও অবসরপ্রাপ্ত। বজলুল হুদা। মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের অফিসার ছিল। মেজর পাশা এবং মেজর রাশেদ চৌধুরীকেও অবসর দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য এরা সবাই ব্যক্তিগত কারণে শেখ সাহেবের উপর ছিল বীতশ্রদ্ধ। সিনিয়র অফিসার বেশ কজনের সাথেও কথা হয়। তারা দোদুল্যমান থাকলেও মৌন সমর্থন দেন। সবার ছিল একটি সমস্যা ‘বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধিবে কে?’ | মেজর রশিদের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কাজ ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা অনুসন্ধান করা। এ কাজটি রশিদ অত্যন্ত নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতা খন্দকার মােশতাক আহমদ ছিলেন রশিদের পাশের গ্রামের লােক। রশিদ তার কাছে গিয়ে বিভিন্নভাবে কথাটা পাড়ে। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২রা অগাস্ট। রশিদ আমার কাছে একগাল হেসে স্বীকার করেন, মােশতাক সাহেব বহুত চালাক লােক। তিনি তার কথার ইশারা। ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন। | মােশতাক আহমদ শেখ সাহেবের সর্বশেষ কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন। অতএব রশিদ তার সাথে কথাবার্তা বলে সহজেই বুঝতে পারে, প্রয়ােজন মুহূর্তে এই বুড়ােকে ব্যবহার করা যাবে। অবশ্য রশিদ শুধু মােশতাক নয়, অগাস্টের আগে থেকে আরও কজন আওয়ামীলীগ নেতার সাথে এ নিয়ে কৌশলে আলাপ করে। তাদের অনেকেই শেখ সাহেবের সর্বশেষ রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। জনাব তাজউদ্দিন তাদের অন্যতম।

অভুত্থান প্ল্যান

১৫ অগাস্ট দ্রুত ঘনিয়ে আসে। ফারুক-রশিদের অপারেশনের প্ল্যান মােটেই বিস্তারিত কিছু ছিল । অনেকটা ফ্রি ল্যানসার কার্যক্রমের মতাে। আক্রমণ প্ল্যান শুধু ফারুকই জানতাে। রশিদের সাথে শুধু আলােচনা হতাে। ১৪/১৫ তারিখের মধ্যরাতে ফারুক প্রথমবার অফিসারদের গন্তব্যস্থল, টার্গেট ইত্যাদি দেখিয়ে দেয়। অফিসারদের নিয়ে এটাই ছিল ফারুকের প্রথম অপারেশন্যাল বৈঠক এবং ব্রিফিং। এর আগে কখনও তাদের মধ্যে প্ল্যান প্রােগ্রাম নিয়ে আলােচনা হয়নি, কোন রিহার্সেলও হয়নি। এমন ধরনের আক্রমন প্ল্যানকে ‘তড়িঘড়ির পিনিক’ প্ল্যানই বলা যেতে পারে। তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের আক্রমনপ্ল্যান গােপন থাকায় কেউ কিছুই জানতে পারেনি। এটাই ছিল তাদের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। ১৪ অগাস্ট মধ্যরাতে ব্রিফিং এবং কিছুক্ষণ পরই সৈন্যসামন্ত নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ যাত্রা। এধরনের অপারেশন যে কিভাবে সফল হলাে, তা রীতিমত অবাক ব্যাপার। মূল টার্গেট ছিল ৩২ নম্বর রােডে শেখ সাহেবের ৬৭৭ নং বাসা। আসলে টার্গেটে আঘাত হানাটাই বড় কথা নয়। এ ধরনের সরকার উৎখাত অভুথানে, আক্রমন পরবর্তী ধকল সামলানােটাই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তা না হলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। ফারুক-রশিদ তাদের অপারেশনে অন্ততঃ একটি ইনফেন্ট্রি বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইউনিট সাথে। নেওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী ছিল। কিন্তু ঢাকায় অবস্থিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিটগুলাের অফিসারদের উপর পূর্ণ বিবাস স্থাপন করতে পারছিলাে না। এ ছাড়া গােপন প্ল্যান ফাস হয়ে যাওয়ারও ভয় ছিল। শেষ মুহুর্তে দূরে জয়দেবপুরে অবস্থিত ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর শাহজাহান কথা দেয় ১৪/১৫ অগাস্ট মধ্যরাতে মূল দলের সাথে মিলিত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাহজাহান কথা রাখতে পারেনি। ফারুক অবশ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করার দরকারও মনে করেনি। ইঞ্জিনিয়ার্স এবং ৩৮ লাইট এ্যাক্ এ্যাক ইউনিটের সাথেও যােগাযােগ করা হয়েছিল বলে তারা জানিয়েছে। অপারেশন পরবর্তী কার্যক্রমের যাবতীয় প্ল্যান ছিল মেজর রশিদের। রশিদ ছিল ধীর স্থির, নিখুঁত।

রেডিও দখল, নূতন রাষ্ট্রপ্রধানকে ধরে আনা, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের একত্রকরণ এসবই সম্ভব হয়েছিল মেজর রশিদের পরিকল্পনায়। মেজর ফারুক টার্গেট দখল ও বিধ্বস্ত করেই খালাস, কিন্তু পরবর্তী দুরুহ কাজটি যে ব্যক্তি অত্যন্ত নিপুণভাবে সামাল দেয়, সে হল মেজর রশিদ। বলাই বাহুল্য; যদি প্রথম পর্ব সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন না হতাে, অর্থাৎ শেখ সাহেব যদি মারা না যেতেন, তাহলে এ অভ্যুত্থান নির্ঘাত ব্যর্থ হতাে। এতে কোন সন্দেহ নেই। ফারুক রশিদের অভূত্থান-প্ল্যান যেভাবে হালকাভাবে প্রণয়ন করা হয়, তাতে বাস্তবায়নের পথে কোথাও সামান্যতম বাধা পেলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতাে। এ ধরনের অভুথান পরিকল্পনায় ফারুক রশিদ মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। মাত্র দুটি ইউনিট নিয়ে তাদের সার্বিক সাফল্যের আশা মােটেই পাঁচ শতাংশের বেশী ছিল বলে আমি মনে করি না। | ফারুক রশিদের লক্ষ্য এক থাকলেও চিন্তাধারার মধ্যে কিছুটা ফারাক ছিল। মূল হােতা মেজর ফারুকের মতে, তার প্ল্যান ছিল শেখ সাহেবকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে এনে তার ‘বস’ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের সামনে হাজির করা এবং বিচারের ব্যবস্থা করা। অথবা প্রেসিডেন্ট সুকর্নের মত বন্দী করে রাখা। মেজর রশিদ বলেছে, তাঁকে ধরে এনে রেসকোর্স ময়দানে সংক্ষিপ্ত বিচার মহড়ার মাধ্যমে প্রাণদণ্ড প্রদান করে সাথে সাথেই তা ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে কার্যকর করা হতাে। তিনি আত্মসমর্পণ করলে হয়তাে পরিবারের সবার প্রাণ রক্ষা পেতাে, এই যা তফাৎ। এ ধরনের প্ল্যান প্রােগ্রাম যে কতাে বড় ভয়াবহ ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘটনা প্রবাহ যেভাবে গড়িয়ে যায় তাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব, শেখ মনি ও জনাব সেরনিয়াবাতের বাসভবনে আক্রমন ও হত্যা করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পন্থা ছিল বলে মনে হয় না। | ১৫ অগাস্ট ভাের চারটায় ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত থেকে অপারেশন শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন গ্রুপের অফিসাররা নিজেরাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং কোন নির্দেশের অপেক্ষা করে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতির মােকাবেলা করেছে তারা নিজেরাই। যেমনঃ রেডিওতে মুজিব হত্যার তাৎক্ষণিক ঘােষণা তাদের মূল প্রােগ্রামে না থাকলেও মেজর ডালিম তার নিজ উদ্যোগে সকালবেলা রেডিও থেকে ঘােষণা দেয়, যার মনস্তাত্তিক প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক। | ১২ অগাস্ট মেজর ফারুক ও রশিদের মধ্যে অভুথান নিয়ে চূড়ান্ত আলােচনার পর ঘটনা অতি দ্রুত গড়িয়ে চলে। ১৪/১৫ অগাস্ট তারিখটি ছিল নৈমিত্তিক নৈশকালীন ট্রেনিং। ফারুক ঐ রাতেই আঘাত হানার পরিকল্পনা করে। তা নাহলে পরবর্তী ট্রনিং-রাত পেতে দেরি হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার রাত ‘নৈশকালীন ট্রেনিং এর জন্য নির্ধারিত ছিল। এ ছাড়া ঐ সময় ল্যান্সার ইউনিট কমান্ডার কর্নেল মােমেন কয়েকদিনের ছুটিতে ছিলেন। সুতরাং ফারুক ছিল বন্ধনহীন পাখী। সে রশিদকে মেসেজ পাঠায়, তুমি প্রস্তুত? ‘খ্যা প্রস্তুত। ‘আজ রাত দশটায় তােমার সাথে দেখা হবে। ১৪ অগাস্ট। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। দিনটি খুব ভালাে ছিল না। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিল খামাকাই উত্তেজনা। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করার কথা ১৫ অগাস্ট।

এ নিয়ে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে বিপুল প্রস্তুতি। বিরােধীরাও বসে নেই। কয়েকটা শক্তিশালী বােমা ফাটায় ক্যাম্পাসে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা উদ্বিগ্ন। নিশ্চয় জাসদের কাণ্ড। এদের দৌরাত্মে টিকটিকিদের ঘুম নেই। তখন বেশ বােমাবাজি চলছে এখানে ওখানে। ১৪ অগাস্ট রাতে সিভিল মিলিটারি সব টিকটিকি সংস্থার দৃষ্টি পড়ে ছিল ঐদিকেই। ওদিকে নােয়াখালীর কাছে একটি ভারতীয় সামরিক হেলিকপটার দেশে ফেরার পথে পাখীর সাথে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। মারা গেল ভারতীয় পাইলট ও ক’জন বিমান। আরােহী। এ নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে কিছু ব্যস্ততা। ঘটনাটি কোন স্যাবােটাজ নয়। নেহায়েতই দুর্ঘটনা। তবু ঘটনা ঘটলাে দিন বেছে একেবারে ১৪ অগাস্ট। ১৪/১৫ অগাস্ট রাতে শেখ সাহেবের বড় ছেলে কামাল প্রমুখরা এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছা বাহিনী। সংস্থার লােকজন ভার্সিটির নিরাপত্তা নিয়েই ছিল মহাব্যস্ত। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবশ্য ঐ দিন অর্থাৎ ১৪ অগাস্ট স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল। কোথাও কোন অস্বাভাবিক নড়াচড়া নজরে পড়েনি। সবগুলাে ইউনিটে, হেডকোয়ার্টারে, অফিসে স্বাভাবিক কাজকর্ম চলেছে। বিকালে আর্মি টেনিসকোর্টে নিত্যদিনকার মত সিনিয়ার অফিসারদের টেনিস জমে উঠেছিল। জেনারেল শফিউল্লাহ, জিয়া, মামুন, কর্নেল খুরশিদ ও আমি সেখানে নিয়মিত টেনিস খেলতাম। ১৪ অগাস্টের বিকালেও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না। আমাদের টেনিস জমে উঠেছিল। তবে শফিউল্লাহ বােধহয় ঐদিন আসেননি। আমার মনে হয়, মেজর ডালিম ও নূরকেও সেদিন টেনিস কোর্টের আশেপাশে পায়চারি করতে দেখেছিলাম। প্রকৃতপক্ষে অগাস্টের কিছুদিন আগে থেকে হঠাৎ করে ডালিম ও নূর মাঝে মধ্যে টেনিসকোর্টে আসতে শুরু করে। জেনারেল শফিউল্লাহ একদিন আমাকে খেলার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, এসব জুনিয়ার অফিসাররা কেন এখানে খেলতে আসছে? এ দুজনকে আসতে মানা করে দাও। আমি খেলার পর নূরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কার অনুমতি নিয়ে তােমরা এখানে খেলতে এসেছ? সে জানালাে, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়েছে। আমি কথাটা শফিউল্লাহকে জানালে সে রাগে গরগর করতে লাগল। ১৪ অগাস্টের সূর্য অস্ত গেল। আমরা টেনিস কোর্ট থেকে যথারীতি বিদায় নিলাম, ক্যান্টনমেন্টের সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা। ঘুমন্ত সেনানিবাসে নেমে এলাে রাতের অন্ধকার। ১৪/১৫ অগাস্টের কালােরাত্রি। ঘড়! ঘড় ঘড়! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সক্রিয় হয়ে উঠল টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট। যানগুলাে। ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ইউনিট লাইন থেকে ১০৫ এম এম কামানগুলাে টেনে নিয়ে চলল ভারী ট্রাকগুলাে নতুন এয়ারপাের্ট অর্থাৎ বর্তমান জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের দিকে।

এয়ারপাের্টটি তখন চালু হয়নি। সবাই মনে করল। কর্তব্যপালনে নিষ্ঠাবান দুটি ইউনিট রাত্রীকালীন ট্রেনিং-এ কর্তব্য পালনে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত দশটা। ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত। বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলাে রাজকীয় স্টাইলে একটি একটি করে গড়িয়ে গড়িয়ে ইউনিট লাইন থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারা এয়ারপাের্টের কাছে মিলিত হল টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের সাথে। এয়ারপাের্টের বিরান বিস্তীর্ণ মাঠে সমবেত বাঙলাদেশ সেনাবাহিনীর দুই শক্তিশালী যান্ত্রিক ইউনিট। ১৮টি কামান, আর ২৮টি ট্যাংকের সংযােগ ঘটেছে ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ প্রান্তে। মহা দুর্যোগের ঘনঘটা ঘনিয়ে। এলাে। কালাে ঘন অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে এয়ারপাের্ট। কোথাও এক টুকরাে আলাে নেই। অন্ধকারে জমে উঠল উদীপরা নটরাজদের রক্তাক্ত নাটক। কমান্ডাররা দ্রুত পদে এদিক ওদিক ছুটছে। সৈনিকরা ভাল করে বুঝে উঠতে পারছে না—কি ঘটতে যাচ্ছে। রাত সাড়ে এগারােটার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলাে অভ্যুত্থানের অন্যান্য নায়ক মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রমুখ। এরা সবাই ছিল উক্ত ইউনিট দুটোর বাইরের অফিসার। বিকাল থেকেই তারা পায়চারি করছিল। ক্যান্টনমেন্টের আশেপাশে। তারা একে অন্যের সাথে সংযােগ রক্ষা করে চলছিল। সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে বিভক্ত হয়ে অপারেশন এরিয়াতে সময় মতই তারা মিলিত হলাে। রাত গড়িয়ে চলল। অন্ধকারে মহাব্যস্ত ফারুক, রশিদ। সৈনিকরা সুশৃঙ্খলভাবে জড়াে হয়ে নির্দেশের অপেক্ষায়। আসল ব্যাপার তারা কিছুই জানে না। ফারুক রশিদ এখানে ওখানে ছুটাছুটি করে সৈনিকদের উৎসাহ দিচ্ছে এবার হয় করবাে, নয় মরবাে। সাবাস গােলন্দাজ। সাবাস ট্যাংকার। তােরাই তাে শ্রেষ্ঠ সৈনিক। তােরাই তাে দেশের সূর্য সন্তান। দেশ আজ রসাতলে। বিক্রিত ভারতের কাছে। উদীপরা গর্বিত সৈনিকরা সব চক্রান্ত নস্যাৎ করবেই। ফারুক-রশিদ উভয়েই স্পিরিটেড অফিসার। সৈনিকরা হল রক্তমাংসের ‘রবােট’। তারা চলে কমাণ্ডারের নির্দেশে, কোন যুক্তিতে নয়। কমাণ্ডারদের নির্দেশে তারা শুধু এগিয়ে যায়, অন্ধভাবে আগুনেও ঝাপ দেয়। এক্ষেত্রেও হলাে তাই। রাত সাড়ে বারােটা। পনেরাে অগাস্টের প্রথম প্রহর। মেজর ফারুক রহমান সকল অফিসারদের এয়ারপাের্টের পাশে। অবস্থিত হেড কোয়ার্টার স্কোয়াড্রন অফিসে সমবেত হতে নির্দেশ দিলেন। অভিযানের চূড়ান্ত ব্রিফিং।

এই প্রথমবার শেখ সাহেবকে উৎখাত করার অভিযান পরিকল্পনা অংশগ্রহণকারী অফিসারদের সামনে প্রকাশ করা হলাে। কমান্ডার মেজর ফারুক টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন ঢাকা শহরের ম্যাপ। কালাে ইউনিফরম পরা ফারুক রহমান। পিঠে ঝুলছে স্টেনগান, দৃঢ় চেহারা নিয়ে অভিজ্ঞ কমান্ডারের মতাে তিনি তার অপারেশন অর্ডার শুনালেন অফিসারদের। ম্যাপে টার্গেট চিহ্নিত করাই ছিল। | প্রধান টার্গেট ৩২ নম্বর রােডে শেখ সাহেবের বাড়ী সরাসরি আক্রমন করা হবে। আক্রমনের দায়িত্বে তারই ইউনিটের বিশ্বস্ত অফিসার মেজর মহিউদ্দিন। বাসাকে ঘিরে ধরা হবে দুটো বুঝে। (Inner circle and Outer circle). ইনার বৃত্তের গ্রুপ বাসার উপরে সরাসরি আক্রমনে অংশ নেবে। আউটার বৃত্তের গ্রুপ রক্ষীবাহিনী ও বাইরের যে কোন আক্রমন ঠেকাবে। আউটার বস্তের অফিসার থাকবে মেজর নুর ও মেজর হুদা। ২৭ নম্বর রােড, সােবহানবাগ মসজিদ, লেক ব্রিজ এরিয়ায় রােড-ব্লক সৃষ্টি করা হবে। প্রধান টার্গেট শেখ সাহেবের বাসায় আক্রমনের সাথে সাথে একই সময় আক্রমন চালানাে হবে ধানমণ্ডিতে অবস্থিত শেখ ফজলুল হক মনি এবং শেখ সেরনিয়াবাতের বাসায়। ফারুক মেজর ডালিমকে শেখ সাহেবের বাসার আক্রমনে উপস্থিত থাকতে বললেন কিন্তু ডালিম পূর্ব সম্পর্কের অজুহাতে সেই আক্রমন গ্রুপে না থেকে স্বেচ্ছায় শেখ সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমনের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। গ্রুপ-কমান্ডার মেজর ডালিমকে একটি হেভী মেশিনগান সংযােজিত দ্রুতগতির জীপ দেওয়া হলাে। সাথে দেওয়া হল প্রচুর অ্যামুনিশন ও গুলি এবং এক পাটুন ল্যম্পার সৈন্যসহ একটি বড় ট্রাক। * শেখ মনির বাসায় আক্রমনের দায়িত্বে থাকলেন ফারুকের পরম বিশ্বস্ত রিসালদার মােসলেম উদ্দিন। রেডিও স্টেশন ও ইউনিভার্সিটি, নিউমার্কেট এরিয়ার নিরাপত্তা গ্রহণে থাকেন মেজর শাহরিয়ার। এই গ্রুপটি সম্ভাব্য বি, ডি, আর, আক্রমন মােকাবেলা করবে। তার সাথে রইলাে এক কোম্পানী সৈন্য। অপারেশনের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করা। শেখ সাহেবের বাসা যখন আক্রান্ত হবে, তখন প্রবল প্রতি-আক্রমনের আশংকা ছিল সভার ও শেরেবাঙলা নগরে অবস্থিত কয়েক হাজার রক্ষীবাহিনী থেকে। অপারেশন কমান্ডার মেজর ফারুক তার ট্যাংক বাহিনী নিয়ে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার দায়িত্ব স্বয়ং তার কাধে গ্রহণ করলেন। ২৮টি ট্যাংক এবং ৩৫০ জন সৈনিক নিয়ে লড়বেন রক্ষীবাহিনীর সাথে, যদিও ট্যাংকের কামানের গােলা তার কাছে ছিল না। তবে তার ট্যাংকগুলাের মেশিনগানগুলােতে মৌজদ ছিল পর্যাপ্ত গুলি। Dismounted পদাতিক দুপস ৩৫০ জন রাইফেলধারী সৈন্যকে সাজালেন রশিদের ইউনিট থেকে ধার নেওয়া ১২টি ট্রাকে। তারা মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রধান টার্গেট অভিযানে অংশ নেবে। শেখ মনির বাসায় অভিযানেও তার দুই ট্রাকে দুই প্লাটুন সৈন্য অংশ নেবে। মেজর রশিদের অবস্থান ছিল কোথায়? মেজর রশিদের প্রধান কাজ ছিল অপারেশন পরবর্তী অবস্থার সামাল দেওয়া, ও সার্বিক রাজনৈতিক সমন্বয় সাধন। সে সরাসরি কোন টার্গেট আক্রমনের দায়িত্বে ছিল না। তার ১৮টি কামান এয়ারপােটেই যথারীতি গোলা ভর্তি করে যুদ্ধাবস্থায় তৈরি করে রাখা হলাে। কামানগুলাের ব্যারেল রক্ষীবাহিনী হেড কোয়ার্টার ও প্রধান টার্গেট শেখ সাহেবের বাসার দিকেই তাক করা। প্রয়ােজনমত কমান্ডারের নির্দেশে টার্গেটের উপর সেই অবস্থান থেকেই ভারী গােলা রক্ষীবাহিনী হেডকোয়ার্টার রইলাে দূরপাল্লার কামানগুলাের রেঞ্জের মধ্যেই। শুধুমাত্র একটি ১০৫ এমএম হাউইটজার কামান আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনের অধীনে প্রধান টার্গেট পাশে লেকের ওপারে পজিশন করা হবে। রক্তঝরা অপারেশনের সার্বিক দায়িত্বে বেঙ্গল ল্যলারের মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। অবাক ব্যাপার, ঐ রাতে সমস্ত ঘটনার প্রস্তুতি চলছিল আর্মি ফিলড ইনটেলিজেন্স ইউনিটের পাশেই মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে। তারা সবাই তখন ব্যারাকে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। অভিযান শুরু রাতের অন্ধকারে সবাইকে তাজা বুলেট ইস্যু করা হল। সবাই যার যার অস্ত্র নিয়ে তৈরি। ‘স্টার্ট টাইম’ সকাল ৪টা। ল্যান্সারের সৈন্যদের অ্যামুনিশন ইস্যু করতে দেরী হচ্ছিল। ফারুক ছুটে গিয়ে ধমক দিয়ে কাজ ত্বরান্বিত করালাে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ নিজ নিজ কমান্ডারের অধীনে আপন আপন টার্গেটের উদ্দেশ্যে ধানমণ্ডির দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। সৈনিকরা গড্ডালিকার মত তাদের লিডারদের অনুসরণ করছে।

তারা সামনে কি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, তখনাে কিছুই জানে না। শঙ্কা উত্তেজনায় সবাই কাপছে। • ভাের সাড়ে ৪টা মেজর ফারুক রহমান তার ট্যাংক বাহিনীর ২৮টি ট্যাংক নিয়ে এয়ারপাের্ট রােড ধরে যাত্রা। শুরু করলেন। ট্যাংকের ঘড় ঘড় শব্দে সমগ্র ক্যান্টনমেন্ট ও বনানী এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠল। মসজিদ থেকে তখন মােয়াজ্জিনের আজান ধ্বনি ভেসে আসছে। বনানীর এম পি চেক। পােস্টের কাছে এসে মেজর ফারুক তার লিডিং ট্যাংক নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তিনি ৪৬ তম ব্রিগেডের ইউনিট লাইনের একেবারে ভিতর দিয়ে সংকীর্ণ বাইপাস রােড ধরে শাফায়েত জামিলের পদাতিক ব্রিগেডের আশেপাশের এলাকা কাপিয়ে সদর্পে। সামনে এগিয়ে চললেন। এতগুলাে ট্যাংকের বিকট শব্দে কমান্ডার শাফায়েত জামিলের নিদ্রা ভঙ্গ হওয়ারই কথা। কারণ ট্যাংকগুলাে এগিয়ে যাচ্ছিলাে তার বাসার ঠিক পিছন দিকেই। মাঠে জমায়েত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা পি টি প্যারেডে ছুটাছুটি করছিল। তারা। অবাক বিস্ময়ে তাদের লাইনের একেবারে ভেতর দিয়ে ট্যাংকগুলাের সদর্প যাত্রা অবলােকন । করছিল। কেউ কেউ হাত নাড়লাে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারল না মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের দ্বারা কি ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। ফারুক তার লিডিং ট্যাংক নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের বড় রাস্তায় এসে এয়ারফোর্স হেলিপ্যাডের উল্টোদিকে একটি ভােলা গেইট দিয়ে অকস্মাৎ ডান দিকে মােড় নিয়ে পুরাতন এয়ারপাের্টে ঢুকে পড়লেন।

তাকে অনুসরণ করছিল মাত্র দুটি ট্যাংক। বাকিরা পথ হারিয়ে কমান্ডারকে দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে সােজা। এয়ারপাের্ট রােড ধরে ফার্মগেইটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। | কমান্ডার ফারুক দ্রুত গতিতে যখন পুরাতন এয়ারপাের্টের পশ্চিম প্রান্তে উপনীত হন, তখন তাকে মাত্র একটি ট্যাংক অনুসরণ করছে। সেটাও বিকল হয়ে থমকে পড়লাে। এতে ফারুক মােটেই ভীত হলেন না। তিনি এয়ারপাের্টের দেয়াল ভেঙে তার ট্যাংক নিয়ে রক্ষী। বাহিনী হেডকোয়ার্টারের সামনে উপস্থিত হলেন। সেখানে সারি বেঁধে কয়েকশত রক্ষীবাহিনী সৈন্য অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। একটি ট্যাংকের যুদ্ধংদেহী উপস্থিতি দেখে তারা বেশ ঘাবড়ে গেল। তারা ফ্যাল ফ্যাল করে ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে থাকলাে। পরেরটুকু ফারুকের ভাষায়ই শােনা যাক: “আমি আমার ট্যাংক চালককে নির্দেশ দিলাম ধীরে ধীরে সামনে দিয়ে চলতে থাকো। ওরা আক্রমন করলে সােজা ট্যাংক তাদের উপর তুলে গুঁড়িয়ে দেবে। এছাড়া আমার আর কিছু করবার ছিল না, কারণ ট্যাংকের কামানে গােলা ছিল না। আমি অসহায়, কিন্তু ঘাবড়ে যাইনি। দেখলাম রক্ষীদের তরফ থেকে কোন আক্রমনাত্মক রিঅ্যাকশন নেই। তারা ভয় পেয়ে গেছে। আমি নিশ্চিন্তে এগিয়ে গেলাম মিরপুর রােড ধরে সাভারের দিকে। কারণ আমার ট্যাংকগুলােকে সাভারের দিকে থেকে রক্ষীবাহিনীর আক্রমন রােধের জন্য মিরপুর ব্রিজের কাছে পজিশন নিতে বলেছিলাম। | আমি দ্রুত ব্রিজের কাছে পেীছে কিছু ট্যাংক ওখানেই দেখতে পাই। কিন্তু রক্ষীবাহিনীর কোন নড়া-চড়া দেখতে পাই না। অগত্যা আমি আবার ট্যাংকগুলাে নিয়ে শেরেবাংলা নগরের কি ফিরে আসলাম। আবার রক্ষীবাহিনী হেডকোয়ার্টারে পৌছে দেখি সেখানে রক্ষী। বাহিনী অফিসাররা কনফারেন্স করছে। আমি সবগুলাে ট্যাংককে তাদের দিকে ব্যারেল তা করে রেখে আমি নিজে ট্যাংক থেকে নেমে গেলাম এবং তাদের দিকে অগ্রসর হলাম। এতগুলাে ট্যাংক তাদের ঘেরাও করে ফেলেছে দেখে রক্ষী অফিসাররা ভীষণভাবে ভীত হয়ে পড়লাে।

তাদের কমাণ্ডিং অফিসার কর্নেল হাসানতাে রীতিমত কাপছিল। এমনিতেই বেচারা ছিল দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। আমি রক্ষী-কমান্ডার কর্নেল হাসানকে বললাম, সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে, আপনাদের এখন থেকে আর্মিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। আপনারা এখনাে নির্দেশ পান নাই? কর্নেল হাসান বললেন ; ভাইসাব, আমি তাে এ সব কিছুই জানিনা। তখন আমি তাদের টেলিফোন থেকে তাদের সামনেই সি জি এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে ফোন করলাম। তাকে না পেয়ে ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশন কর্নেল নুরুদ্দিনকে ফোন করলাম। ততক্ষণে অবশ্য রেডিওতে ঘােষণা শুরু হয়ে গেছে। নুরউদ্দীন সাহেবকে বললাম, এদেরকে অবস্থাটা বুঝিয়ে দিতে। তার সাথে কর্নেল হাসানের কথা হলাে। তিনি বুঝিয়ে বললেন, এখন অপেক্ষা করুন। চীফের কামরায় মিটিং চলছে। নির্দেশ পরে জানাবাে। তখন প্রায় সাড়ে ৮টা বেজে গেছে। আমি রক্ষীবাহিনী ও তার অফিসারদের ঐভাবে আতঙ্কগ্রস্ত রেখে ট্যাংক নিয়ে ৩২ নম্বর রােডের দিকে ছুটে গেলাম।” ট্যাট-ট্যা গুড়ুম গুড়ুম। ভাের সােয়া ৫টা। আক্রান্ত হয়েছে ধানমণ্ডি এলাকায় বিভিন্ন টারগেট পয়েন্ট। চারিদিকে ছুটছে বুলেট। গােলাগুলির শব্দে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত। আক্রান্ত হয়েছে শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসা। মেজর ডালিম ও রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রায় একই সময়ে দু’টি বাসা আক্রান্ত হয়েছে। তবে মূল টারগেট শেখ সাহেবের ৩২ নং রােডের বাসার উপর আক্রমন শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব ঘটছিল। ট্যাকটিক্যাল প্ল্যান অনুযায়ী সৈন্যদের পজিশন করতে এবং কামান, মেশিনগান, স্থাপন করতে সময় লাগছিল। হামলাকারীদের নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও বিভ্রান্তির জন্যও কিছুটা সময় নষ্ট হয়। আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমন শুরু হয়ে যায়। প্রথমে গেইটে ঢুকতে গিয়েই গােলাগুলির সূত্রপাত হয়। তারপর তা প্রবল আকার ধারণ করে। আক্রমনের মাঝখানে শেখ সাহেব প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে আক্রমনকারীদের কড়াভাবে শাসিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে আক্রমন মাঝপথে প্রায় থমকে পড়ে।

শেখ সাহেব যখন গােলাগুলির মধ্যে আক্রান্ত ছিলেন, তখন তিনি বাসা থেকে বিভিন্ন দিকে ফোন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার মিলিটারি সেক্রেটারী কর্নেল জামিলকে

ফোনে পেয়েছিলেন। তাকে বলেন, জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসাে। আর্মির লােক আমার বাসা আক্রমন করেছে। শফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলাে। জামিল ফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে তার প্রাইভেট লাল কার হাঁকিয়ে ছুটে যান ৩২নং রােডে, কিন্তু সৈন্যদের গুলিতে বাসার কাছেই নিহত হন। জেনারেল শফিউল্লাহকেও তিনি ফোন করেছিলেন। হয়তাে পাচ্ছিলেন না। এক সময় শফিউল্লাহই তাকে পেয়ে যান। শেখ সাহেব বললেন ; শফিউল্লাহ, আমার বাসা তােমার ফোর্স অ্যাটাক করেছে। কামালকে হয়তাে মেরেই ফেলেছে। তুমি তাড়াতাড়ি ফোর্স পাঠাও। শফিউল্লাহ বললেন, স্যার, Can you get-out, I am doing something. এর পর তার ফোনে আর তার সাড়া পাওয়া যায়নি। শফিউল্লাহ ফোনে গােলাগুলির শব্দ শুনতে পান। তখন বেলা আনুমানিক ৫-৫০ মিনিট। শফিউল্লাহ বিভিন্ন দিকে ফোন করতে থাকেন। প্রথমেই তিনি ফোন করেন ৪৬ ব্রিগেড কমাণ্ডার শাফায়েত জামিলকে। তাকে ১ম বেঙ্গল ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুভ করতে বলেন। শফিউল্লাহ অবশ্য শাফায়েত জামিলকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই সােয়া পাঁচটার দিকেই টপস মুভ করতে বলেছিলেন। কারণ ধানমণ্ডির দিকে ট্যাংক মুভমেন্টের খবর তিনি আনুমানিক সােয়া ৫টার দিকে গােয়েন্দা প্রধান কর্নেল সালাহউদ্দিন মারফত প্রথম অবগত হন। কিন্তু তার নির্দেশ সত্বেও শাফায়েত জামিল তখন কোন এ্যাকশন নেয়নি। অন্যদিকে শাফায়েত জামিল বলেছে, শফিউল্লাহ আমাকে কোন নির্দেশ দেননি। তিনি শুধু বিড়বিড় করেছেন, কেঁদেছেন। কোন এ্যাকশন নিতে বলেননি। | শেখ সাহেবের ফোন পাওয়ার পর আবার তিনি শাফায়েতকে ফোন করেন, কিন্তু তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। ফোনের রিসিভার তুলে রাখা হয়েছিল। অগত্যা শফিউল্লাহ খালেদ মােশাররফকে ফোন করে তাকে তাড়াতাড়ি তার বাসায় চলে আসতে বলেন, খালেদ পায়জামা পরেই তার গাড়ী নিয়ে ছুটে আসেন। শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে পাঠালেন শাফায়েত জামিলকে দেখতে, সে কি করছে। ৪৬ ব্রিগেড থেকে কেন কোন টুপ মুভ করছে না শফিউল্লাহও বুঝতে পারছিলেন না, যদিও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এরপর শফিউল্লাহ বিভিন্ন দিকে উদভ্রান্তের মত বিভিন্নজনকে ফোন করতে থাকেন। এয়ার চীফকে, নেভাল চীফকে, জিয়াউর রহমানকে, আমাকেও তিনি ফোন করেন। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। | মােদ্দা কথা, তিনি সব কিছুই করলেন বটে কিন্তু রাষ্ট্রপতির সাহায্যার্থে একটি সৈন্যও মুভ করাতে পারলেন না। সকাল ৬ ঘটিকা। রেডিও বাঙলাদেশ। ভেসে আসল মেজর ডালিমের বজ্রকণ্ঠের ঘােষণা—স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। হতভম্ব বাংলাদেশ। বিনা মেঘে বজ্ৰপাত। |

কিংকর্তব্যবিমুঢ় শফিউল্লাহ। তাহলে কি তার নির্দেশ কেউ মানলাে না? তিনি কি সংবাদ শুনে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি কি নির্দেশ দিতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করছিলেন? নাকি তিনি ছিলেন অসহায়। ৩২ নম্বর রােডে অপারেশন : মুজিব হত্যাকাণ্ড মেজর ফারুক যখন রক্ষীবাহিনীর দিকে ব্যস্ত, ততক্ষণে সবগুলাে টার্গেটে বিভিন্ন গ্রুপের ঝটিকা অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। মেজর ফারুকের পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণকারীরা তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ভাের পাচটার মধ্যেই তিনটি টার্গেট ঘেরাও করে ফেলেছে। ১২টি ট্রাক ও কয়েকটি জীপে করে আক্রমনকারী ল্যান্সার ও অর্টিলারীর প্রায় ৫০০ জন রাইফেল টুপ ধানমণ্ডির আশেপাশে ছেয়ে গেছে। প্রধান টার্গেট ৩২ নং রােডে শেখ সাহেবের বাড়ী মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে আউটার ও ইনার দুটি বন্তে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে। মেজর রশিদের নির্দেশে একটি হাউইটজার কামান এনে শেখ সাহেবের বাসার বিপরীতে মাত্র ১০০ গজ দূরে লেকের ওপারে স্থাপন করা হলাে। বাসার উপর আক্রমনকারী ল্যান্সারের সৈন্যরা ৫টি ট্রাকে করে এসে একেবারে বাড়ীর প্রধান গেইটের কাছে সশব্দে নামতে শুরু করলাে। গেইটে ঢুকতে গেলে আর্টিলারীর প্রহরারত সৈনিকরা তাদের বাধা দিয়ে বসলাে। এ নিয়ে ঐ সময় নিজেদের মধ্যে উত্তপ্ত বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। একটু আগে মেজর হুদা তার অনুমতি ব্যতিত কাউকে ভিতরে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ায় এই গণ্ডগােল বাধে। গেইটের কাছে গার্ডদের হট্টগােলে শেখ কামাল জেগে যান। তিনি কিছু একটা গণ্ডগােলের | আভাস পেয়ে ওপর থেকে স্টেনগান হাতে নিচে রিসিপশন রুমের দিকে ছুটে যান। সেখানে পুলিশের একজন ডিউটিরত অফিসারও ছিলেন। প্রথমে কামাল ভেবেছিলেন হয়ত জাসদ অথবা সর্বহারা গ্রুপের হামলা। কামাল সেখান থেকে সেনা রক্ষীদের ব্যবস্থা নিতে বলেন, কিন্তু তারা নিরব থাকে। কামাল এবার আসল ব্যাপার বুঝতে পারেন। তিনি আক্রমনকারী সৈন্যদের উপর গুলি ছুঁড়েন। একজন সেপাই সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। এরপরই উভয় পক্ষে শুরু হয়ে যায় তুমুল গােলাগুলি, মুহূর্তেই পুরাে এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। |

অভ্যুত্থানের প্রধান নায়ক মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ মুজিব হত্যাকাণ্ডের ঐ মুহূর্তের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে চান। তারা বলেন, যেহেতু বাসায় আক্রমনের সময় আমরা সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না, সেহেতু স্বচক্ষে কিছু প্রত্যক্ষ না করে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ। দেওয়া বােকামীরই নামান্তর। শােনা কথা সব সময়ই অতিরঞ্জিত হবে। আমরা সবাইকে একই কথা বলেছি, কিন্তু তবু কিছু লেখক আমাদের উদ্ধৃতি দিয়ে মিথ্যা খবর তৈরি করেছে। তবে মেজর ফারুক আমাকে জানালেন, মেজর মহিউদ্দিন শেখ সাহেবকে আত্মসমর্পনের আহ্বান জানিয়ে বারবার অনুরােধ করে, কিন্তু তিনি বড় বড় কথা বলে সময় ক্ষেপণ করতে। থাকেন।

মহিউদ্দিন তাকে কয়েকটি টেলিফোন করারও সুযােগ দেয়। কিন্তু কামাল খামাখা উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে আমার একজন সােলজার নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এরপর আমাদের লােকজন তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে যােগ্য জবাব দিতে বাধ্য। হয়। এই পরিস্থিতিতে শেখ সাহেব গুলিতে নিহত হন। | বাসার ভেতরে অনুষ্ঠিত রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ইতিমধ্যে বিভিন্নজন বিভিন্নসূত্র থেকে। নিয়ে বিভিন্নভাবে পত্র পত্রিকায় আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন। | কিন্তু প্রায় সবগুলােই অতিরঞ্জিত বর্ণনায় ভরপুর। শেখ সাহেবের বাসার ভেতর অভিযানে দু’জন অফিসার জড়িত ছিলেন। মেজর মহিউদ্দিন (আরমার্ড) এবং মেজর হুদা। মেজর হুদা আক্রমনের প্রথম থেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তার সাথে আমার আন্তরিক পরিবেশে কথাবার্তা হয়। তিনি এইভাবে ঘটনার বিবরণ দিলেন। আসুন ঐ বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত থেকে। ঘটনা কিভাবে গড়িয়ে গেল, প্রত্যক্ষদশী মেজর হুদার মুখ থেকেই শােনা যাক : | “মধ্যরাতে মেজর ফারুক আমাদের অপারেশন ব্রিফিং দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ভাের ৫ টার মধ্যে ৩২ নং রােডের বাসার চতুর্দিকে অবস্থান নেই। তবে আমি একটু আগেই পেীছে যাই গার্ডদের সাথে কথা বলার জন্য। বাসার গেইটের সেন্ট্রি ডিউটি করছিল ফার্স্ট ফিড আর্টিলারির সৈনিকরা। তারা আমাকে চিনতাে। আমি অগ্রসর হয়ে তাদের বললাম,

দেখ ভাইরা, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। শেখ মুজিব এখন আর প্রেসিডেন্ট নন। তাকে আমরা বন্দী করে নিয়ে যাবাে। আমাদের সাথে মেজর ডালিম, মেজর পাশাও আছে। বলাবাহুল্য আমরা তিনজনই ঐ রেজিমেন্টের পুরানাে অফিসার। ডালিম কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন, আমি ছিলাম এ্যাডজুটেন্ট। আমার কথায় তারা সবাই রাজী হয়ে গেল। আমি তাদের শান্ত থাকতে বলে নির্দেশ দিলাম, আমার অনুমতি ছাড়া এখন থেকে কেউ যেন বাসার ভেতরে না ঢুকে। এই বলে আমি রােডের পাশে একটি মেশিনগান স্থাপন করতে যাই। এরিমধ্যে মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বেঙ্গল ল্যান্সারের সৈন্যরা বাসায় পেীছে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করলে তাদের মধ্যে জোর কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। তাদের চিৎকারে শেখ কামাল সতর্ক হয়ে ওঠেন এবং দোতলা থেকে ছুটে নিচে রিসিপশন রুমে অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে অবস্থান নেন। সৈন্যরা বাসা আক্রমন করতে এসেছে টের পেয়ে তিনি তাদের। উপর গুলিবর্ষণ করেন। এতে সৈন্যদের একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। দোতলায় উপর থেকেও একই সময় প্রবল গুলিবর্ষণ হতে থাকে। তাদের গুলির প্রত্যুত্তরে উপস্থিত সৈন্যরা সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। এই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রবল গুলিবর্ষণে রিসিপশন রুমে শেখ কামাল মারা পড়েন। তার সাথে একজন পুলিশ ডি, এস, পি,ও মারা যান। প্রবল গােলাগুলিতে উভয় পক্ষে লােকজন। হতাহত হয়। গােলাগুলি বন্ধ হলে আমি ঘটনাস্থলে ছুটে আসি এবং খােলা গেইট দিয়ে দোতলায় বাসার ভেতর প্রবেশ করি। আমি দোতলার সিঁড়ির ধাপে এসে দেখি শেখ মুজিবুর রহমান সিড়ি দিয়ে নেমে আসছেন। আমাকে দেখেই তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন, তারা কি চাস, তােরা কি করতে চাস? ‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। শেখ সাহেব আরাে রেগে যান, তুই আমাকে মারতে চাস। কামাল কোথায়? তােরা কামালকে কি করেছিস?”

‘স্যার, কামাল তার জায়গায়ই আছে। আর আপনি ‘তুই তুই করে বলবেন না। আপনি। বন্দী। আপনি চলুন। এবার শেখ সাহেব গর্জন করে উঠলেন; কি, তােদের এত সাহস। পাকিস্তান আর্মি আমাকে মারতে পারেনি। আমি জাতির পিতা। আমি বাঙালী জাতিকে ভালবাসি। বাঙালী আমাকে ভালবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না। বেশ কিছুক্ষণ তিনি আবােল-তাবােল বকতে থাকেন। তখন আমি বললাম, স্যার, এসব নাটকীয় কথাবার্তা রাখুন। আপনি চলুন আমার সাথে। আপনি বন্দী। | শেখ সাহেব এবার নরম হয়ে আসেন। বললেন, তােরা আমাকে এইভাবে নিয়ে যেতে চাস। আমার তামাক আর পাইপটা নিতে দে।

এই বলে তিনি তার শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়ান। আমিও তার পেছন পেছন যাই। মেজর মহিউদ্দিনও সাথে। আমার হাতে তার তামাকের টিন ও দিয়াশলাই নেই। তখন তাকে। আর কোন টেলিফোন করতে বা সময় ক্ষেপণ করতে দেই নাই। কথাবার্তায় মাত্র মিনিট তিনেক সময় নষ্ট হয়। কামরা থেকে বেরিয়ে তাকে নিয়ে আমি সিঁড়ির বারান্দার মুখে উপস্থিত হই। তিনি সামনে, আমি তার একটু পিছনে বা পাশে। মেজর মহিউদ্দিন ও দুতিনজন সেপাই আমার পিছনে। বারান্দায় নামতে এক পা দিতেই পেছন দিকে সিড়ি সংলগ্ন রুমের করিডােরে ঘরের ভেতর থেকে কেউ রাইফেল থেকে আচমকা গুলি ছোড়ে। আমার

ঠিক পেছনে দাড়ানাে সেপাই আহত হয়ে পড়ে যায়। আমি মেঝেতে শুয়ে পড়ে পজিশন নেই। শেখ সাহেব দাড়িয়েই থাকেন। সিড়ির নিচে ৬/৭ ফুট দূরে দাড়িয়েছিল কয়েকজন কালাে উদীপরা সৈনিক। তারাও সঙ্গে সঙ্গে সামনে থেকে এক ঝাক গুলিবর্ষণ করে। গুলি শেখ সাহেবের বুকে আঘাত হানে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে সিড়ির উপর পড়ে যান। সৈন্যরা কামরা লক্ষ্য করে আরাে গুলি ছুঁড়লাে। এর পরপরই ঘরের ভেতরে বাইরে। এলােপাথাড়ি বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলে। ঘটনাটা ঘটে গেল আমার চোখের সামনে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে। আমি নিজেই ঘটনার আকস্মিতায় হতভম্ব হয়ে যাই। | শেখ সাহেব তখন মৃত। তার বুক দিয়ে সিড়ি ভেসে প্রচুর রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তাকে ঐ অবস্থায় রেখে আমি নিচের দিকে যাই। দেখি সবাই ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপছে। আমি তখন কি। করি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যে সৈনিকটি আহত হয়েছিল তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করলাম। ঐ সময় বাসার একজন কাজের ছেলের গায়েও গুলি লাগে। তাকেও হাসপাতালে পাঠালাম।

আমি নিচের দিকে তাদের একটু দেখতে গেলাম। এমন সময় দোতলার ঐ রুমের জানালা থেকে হঠাৎ আবার এক ঝাক গুলিবর্ষণ করা হলাে। এতে গেইটের কাছে দাড়ানাে বেশ ক’জন সৈনিক আহত হলাে। সঙ্গে সঙ্গে আবার চতুর্দিকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। সৈন্যরা উত্তেজিত হয়ে উঠলাে। একজন সৈনিক সাহসে ভর করে দোতলায় শয়নকক্ষের ঐ কামরার জানালার ধারে পেীছে তাজা গ্রেনেড নিক্ষেপ করলাে। এরপর সব শান্ত হয়ে এলাে। কিছুক্ষণ পর আমরা কামরাটির দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে দেখি গ্রেনেডের । আঘাতে কামরার ভেতরে জড়াে হওয়া সবাই নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, বেগম কামাল ও বেগম জামাল। | জামাল গুলিবর্ষণ না করলে এরা সবাই রক্ষা পেয়ে যেতাে, কারণ শেখ সাহেব মারা যাওয়ার পর এরা সবাই কামরার ভেতর জীবিতই ছিলেন। গােলাগুলিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

আমার চোখের সামনে এভাবে ঘটনাগুলাে ঘটে গেল। বলা যেতে পারে সম্পূর্ণ। আকস্মিকভাবে এবং কামাল, জামালের হঠকারিতায়। আমরা এভাবে তাদেরকে মারতে চাইনি। হুদা আরাে বললেন, মেজর নূর সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় শেখ সাহেবকে গুলি করেছে বলে যেসব সংবাদ আমাকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে, এসবই সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানােয়াট। মেজর নুর বাসার বাইরে মিরপুর রােডের রক্ষা ব্যবস্থায় ছিলেন। তাকে ঐ সময় ঘটনাস্থলে দেখেছি বলে মনে হয় না। এমনকি কোন কোন বইতে রিসালদার মােসলেম উদ্দিন শেখ সাহেবকে গুলি করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে সেও ঐ সময় ঘটনাস্থলে ছিল

। মৃত্যুর সময় আমিই শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম, ওরা থাকলেতাে আমার চোখে পড়া। উচিত ছিল। যারা সিড়ির নিচ থেকে গুলি বর্ষণ করে তারা আরমার্ড কোরের সৈনিক ছিল। একজন NCO ছিল। তবে তাকে আমি চিনিনা। তারা সিড়ির উপর করিডাের থেকে গুলি হওয়ায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ব্যালান্স হারিয়ে শেখ সাহেবের প্রতি গুলি বর্ষণ করে বলেই আমার মনে হয়। আমি শেখ সাহেবের বা পাশে ছিলাম। ব্রাস ফায়ারে আমিও মারা যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। | শেখ সহেবের বাসায় অপারেশনের সময় মােট তিন দফায় গােলাগুলি হয়। প্রথমবার গেইটে ঢুকবার সময় শেখ কামালের সাথে। দ্বিতীয়বার দোতালার সিঁড়ির মুখে যখন শেখ সাহেব নিচে নেমে আসছিলেন। তৃতীয়বার দোতালার রুম থেকে যখন শেখ জামাল গুলি

বর্ষণ করে। এতে বেশ ক’জন সেপাই হতাহত হয়। তখন আবার গােলাগুলি শুরু হয়। রুমের ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।

শেখ নাসের মারা যান নিচে অন্য একটি কামরায় আলাদাভাবে। তিনি কামরা থেকে বােধহয় মুখ বের করেন। সঙ্গে সঙ্গে তার উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। আমি দেখিনি। মনে হয় তিনি পরে বাথরুমে ছুটে গিয়ে সেখানেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। ঐ মুহূর্তে যুদ্ধ উন্মাদনায়। সৈন্যরা বিভিন্ন রুমে ছুটে গিয়ে গুলি ছুঁড়ে, কিন্তু একটি রুম ছাড়া অন্যগুলােতে কেউ ছিলেন।

।| কর্নেল জামিল মারা যান বাসা থেকে সামান্য দূরে সােবহানবাগের দিকে যে রােড ব্লক ছিল সেখানে। তাকে বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর না হওয়ার জন্য সৈন্যরা নির্দেশ দেয়। তিনি -থেমে গাড়ী থেকে নেমে বরং উত্তেজিত হয়ে গালাগালি দেন। এমতাবস্থায় তার মাথায় গুলি করা হয়। পরে গাড়ীটি ঠেলে শেখ সাহেবের বাসায় আনা হয়। কেউ কেউ বলেছে, মেজর নুর তাকে গুলি করেছে। তবে আমার তা মনে হয় না।” শেখ সাহেবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হত্যাকাণ্ডের যারা প্রত্যক্ষদর্শী তারা কেউ ভালভাবে মুখ খুলতে নারাজ। অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক ও প্রধান প্রত্যক্ষদশী মেজর বজলুল হুদা | বুকে হাত দিয়ে আমাকে ঐ সময় ঘটনা যেভাবে ঘটেছে তার সঠিক তথ্যই দিয়েছেন বলে আবেগভরে জানালেন। হত্যাকাণ্ডের ভিন্ন ভাষ্য হত্যাকাণ্ড-ঘটনার বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অন্য রকম ভাষ্যও রয়েছে। “আমিই শেখকে হত্যা করেছি”—উত্তেজনা ও অসতর্ক মুহূর্তে অদ্যুথানের অন্যতম নায়ক মেজর নূরকে বঙ্গভবনে তার নিজ মুখেই গর্ব করে একথা বলতে শুনেছেন বেশ কজন। ১৫ অগাস্টের পর বঙ্গভবনে নূররা তখন মহা প্রতাপশালী। সবাই তাদের তােয়াজ করতে তৎপর। তখন তারা রেখে ঢেকে কথা বলার তােয়াক্কা করেনি।

বলাবাহুল্য হত্যাকাণ্ডের সাথে বারবার মেজর নূর ও হুদার নাম সরাসরি জড়িত করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উল্লিখিত ধরনের সংবাদ পরিবেশিত হলেও তারা কোনদিন এ সবের প্রতিবাদ করেননি। | ‘আমার নির্দেশে সৈন্যরা চতুর্দিকে ছুটাছুটি করে কামরায় কামরায় গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায়।’—এসবই ডাহা মিথ্যা মনগড়া কাহিনী, জানালেন বজলুল হুদা। দু’একটি বইতে শেখ সাহেবের হত্যাকারী হিসাবে মােসলেম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মেজর হুদা জানান, রিসালদার মােসলেম উদ্দিন সেখানে উপস্থিত ছিল না বরং | | গােলাগুলি হওয়ার পর রিসালদার সারওয়ারকে তিনি সেখানে দেখেছিলেন। প্রকৃত অবস্থা হলাে, তিনটি বাসাতেই প্রায় একই সময় আক্রমন শুরু হয়। তবে শেখ। মনির বাসার অপারেশন তাড়াতাড়ি সমাপ্ত করে মােসলেম উদ্দিন ৩২ নং রােডে শেখ সাহেবের বাসায় উপস্থিত থাকা মােটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বরং অনেকেই তাকে সেখানে দেখেছেন। – ম্যাসকার্নহাস তার লিগেসি অব ব্লাড গ্রন্থে মুহূর্তটা এইভাবে বর্ণনা করেছেন : “ফারুক আমাকে বললাে, শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত প্রবল। মেজর মহিউদ্দিন তার ব্যক্তিত্বের কাছে একেবারে নতজানু হয়ে পড়েছিল। ঐ মুহূর্তে নুর চলে না আসলে কি যে। ঘটতাে, তা আমার আন্দাজের বাইরে।

মহিউদ্দিন তখনাে ঐ একই কথা বলে চলছিলাে ‘স্যার আপনি আসুন’। অন্য দিকে শেখ মজিব তাকে কড়া ভাষায় ধমকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় নূর এসে পড়ে। তার হাতে স্বয়ংক্রিয় অত্র। সে বুঝে ফেলে মুজিব সময় কাটাতে চাইছেন। মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নূর চিৎকার করে আবােল তাবােল বকতে বকতে তার স্টেনগান থেকে মুজিবের প্রতি ব্রাস ফায়ার করে। শেখ মুজিব তাকে কিছু বলার আর সুযােগ পেলেন না। স্টেনগানের গুলি তার বুকের ডান দিকে একটা বিরাট ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল।” | লেঃ কর্নেল এম. এ. মান্নান ছিলেন একসময় মেজর মহিউদ্দিনের কমান্ডার। তিনি । বলেন, বঙ্গভবনে তার কাছে মহিউদ্দিন হত্যাকাণ্ড ঘটনাটা ঐ দিন অর্থাৎ ১৫ অগাস্ট দুপুরের দিকে এইভাবে বর্ণনা দেয়। | ‘মেজর ফারুক আমার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেন শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বাসার দোতলায় গিয়ে তাকে পেলাম। তখন ফায়ারিং থেমে গেছে। তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, তােমরা কি আমাকে মারতে চাও? আমাকে পাকিস্তানীরা মারতে পারে নাই। বাঙালীরা আমাকে মারতে পারে না। আমি বিনীতভাবে বললাম; না স্যার, আপনাকে শুধু নিতে এসেছি। আপনি চলুন। তিনি খুবই রেগে গেলেন। তিনি কামরায় গিয়ে কয়েক জায়গায় টেলিফোন করলেন। আমি আবার তাকে বললাম, স্যার, এবার প্লিজ চলুন। তিনি একটু নরম হলেন। | আমরা তাকে নিয়ে তার কামরার বাইরে যাই। তিনি তার পাইপ হাতে নিয়ে বারান্দা হয়ে সিড়ির মুখে এসে দাড়ান। আমরা তার সাথে একটু পেছনে। ঠিক ঐ সময় নিচে দাড়িয়েছিল মেজর নূর ও আরাে কয়েকজন সৈনিক, সম্ভবতঃ মােসলেম উদ্দিনও। | হঠাৎ মেজর নূর আবােল তাবােল বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে, “Stop, This bustard has | no right to live. Get aside’ সঙ্গে সঙ্গে নূর তার স্টেনগান উচু করে শেখ সাহেবের উপর এক ঝাক গুলিবর্ষণ করে। তার বিশাল দেহ সিড়ির উপর লুটিয়ে পড়ে। রক্তাক্ত ঘটনার আর এক প্রত্যক্ষ্যদশী ডাঃ ফয়সল। শেখ জামালের সহপাঠি বন্ধু। যে-মুহূর্তে শেখ সাহেবের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি ঘটনাস্থল থেকে। মাত্র ১০/১৫ গজ দূরে। চরম মুহুর্তটি তিনি আমার কাছে এইভাবে বর্ণনা করেন । | “ঐ রাতে আমি, শেখ জামাল ও আরাে দুজন বন্ধু পাশের বাড়ীর দোতলার বারান্দায় বসে গভীর রাত পর্যন্ত গল্পগুজব করছিলাম আর ক্যারাম খেলছিলাম। এমন সময় ভােররাত আনুমানিক চারটার সময় শেখ সাহেবের বাসার গেইটে হট্টগােল শুরু হয়। ঐ সময়। আমাদের নিষেধ সত্বেও জামাল পিছন দিকের দেয়াল টপকে তার বাসার ভেতর ছুটে যায়। আমরা বললাম, জামাল যাসনা, সিরিয়াস গণ্ডগােল হচ্ছে। যেতে যেতে সে বলল, বাসায় বউ রেখে আসছি। ও একা ভয় পাবে। সে বাসায় পৌছতে না পৌছতেই তুমুল গােলাগুলি শুরু হয়ে গেল। | প্রথমে দোতালার ছাদের উপর থেকে গেইটের কাছে হামলাকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করার আওয়াজ আসলাে। সঙ্গে সঙ্গে গেইটের কাছে দু তিনজন সৈন্য মাটিতে পড়ে যেতে দেখলাম। ব্যাস, এর পরপরই চর্তুদিকে গােলাগুলি শুরু হয়ে গেল। হামলাকারীদের সংখ্যা হিল অনেক বেশি। বাসার উপর বৃষ্টিধারার মত গুলি আসতে লাগল। যখন গােলাগুলি চলাছলাে তখনই দেখলাম বাসার পেছন দিকে দোতলায় উঠার সিড়ির দরজার কাছে তাদের বেশ ক’জন সৈনিক জড়াে হয়ে উপরে উঠার পায়তারা করছে। সিড়িঘরের দরজা খােলা ছিল। পাশের বাসার দোতলার বারান্দা থেকে মাত্র কয়েকগজ দূর থেকে আমি সবকিছুই পরিষ্কার দেখতে পারছিলাম, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হামলাকারীদের ক’জন সিড়ি দিয়ে বাসার ভেতর ঢুকে পড়েছে এবং শেখ সাহেবের সাথে সিড়ির ধাপে দাড়িয়েই তুমুল বাকবিতণ্ডা করছে। শেখ সাহেব চড়া সুরে উত্তেজিত কণ্ঠে তাদের সাথে ধমক দিয়ে কথা বলছিলেন। উত্তপ্ত কথাবার্তা থেকে প্রথমে আমার ধারণা হয়, হয়ত হামলাকারীরা শেখ সাহেবকে কোথাও বন্দী করে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু অকস্মাৎ গােলাগুলি শুরু হয়ে গেলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল। ‘ শেখ সাহেব বারান্দায় সিড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি কামিজ দিয়ে তার চশমা মুছছিলেন। তার মুখে সিড়ি ঘরের বাতির আলাে পড়ছিল। সিড়ি ঘরের লম্বা প্রশস্ত কাচের জানালা দিয়ে আমি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। তার পাশে পেছনে দু’জন পােষাকধারী লােকও ছিল। তার বাসার একটি চাকরকেও এক পাশে দেখলাম। একটু নিচে সিড়ির মাঝখানের ধাপে ২/৩ জন পােষাকধারী লােক অস্ত্র হাতে দাড়িয়ে ছিল। ঐ সময় গােলাগুলি একটু থেমেছে মাত্র। নিচের একজন হঠাৎ উত্তেজিতভাবে শেখ সাহেবকে গালাগালি দিয়ে বকতে শুরু করলাে। একটি আওয়াজ স্পষ্ট শুনলাম …. Get aside সঙ্গে সঙ্গে ট্য-র-র-র। বিকট শব্দে একটি ব্রাস ফায়ার। আমার চোখের সামনেই দাড়িয়ে থাকা শেষ সাহেব সিড়ির উপর লুটিয়ে পড়লেন। পরমুহূর্তেই কয়েকজন সৈন্য বাসার ভেতর পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে কামরায় কামরায় গিয়ে এলােপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করল।

ভয়াবহ ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে আমি দারুন ভয় পেয়ে গেলাম। আমি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে ছুটে বাসার পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে গেলাম। আমার দুঃখ হয়, আমরা ঐ রাতে মজা করে মুরগীর রােস্ট খাব বলে চাদা করে মুরগী কিনেছিলাম। রােস্ট খাওয়ার ঠিক পূর্ব মুহুর্তেই গণ্ডগােল শুরু হলে জামাল ছুটে চলে গেল বাসায়। তার আর রােস্ট খাওয়া হলাে না। কে জানতাে, সে আর ফিরে আসবে না।” | শেখ সাহেবের বাসায় যখন গােলাগুলি শুরু হয় তখন ভােরের আলাে পরিষ্কার। গােলাগুলির কারণে সমগ্র এরিয়াতে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হয়। যে যেদিকে পারে গুলি ছুঁড়ছিল। এই বিশখলার মধ্যে শেখ সাহেবের বাসা লক্ষ্য করে মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) কামান থেকে মাত্র ১০০ গজ দূর থেকে সরাসরি প্রথম গােলা নিক্ষেপ করে। গােলা সৌভাগ্যবশতঃ বাসায় আঘাত না করে লেকের পারে এসে সশব্দে আঘাত করে। কামানের গােলার শব্দে সমস্ত এলাকা কেঁপে ওঠে। দ্বিতীয় গােলা ব্যারেল একটু উচু করে ছোড়া হলাে। এবার কামানের গােলা সশব্দে বাসার ছাদের উপর দিয়ে ছুটে গিয়ে মােহাম্মদপুরে নিক্ষিপ্ত হয়। ওখানে কিছু লােক হতাহত হয়। আরাে তিনটি গােলা নিক্ষেপ করা হলাে। গােলার শব্দে সৈন্যগণ আরাে উত্তেজিত হয়ে উঠলাে। তারা বাসার ভেতরও ছুটাছুটি করে পাগলের মত গুলি ছুঁড়তে লাগলাে। আশেপাশের লােকজন, পুলিশ, রক্ষীবাহিনীরা মনে করল ট্যাংক থেকে গােলা বর্ষণ করা হচ্ছে। | অভিযান সফল হলাে। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মারা পড়লেন। সিড়ির ধাপে পড়ে রইল তার রক্তাপুত মৃতদেহ। অভিযানে মারা পড়লেন তার পরিবারের ছােট-বড় সকল সদস্য। শুধুমাত্র পরিবারের দু’জন সদস্য দেশের বাইরে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেচে গেলেন। তাদের একজন শেখ হাসিনা। অন্যজন শেখ রেহানা। প্রকাশ্য দিবালােকে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে অভিযান। অদূরে নিরব দাড়িয়ে রইল প্রস্তুত অবস্থায় তিন হাজার রক্ষীবাহিনী। পুলিশ, বিডিআর, রইলাে ঘুমিয়ে। মজার ব্যাপাম,

রক্ষীবাহিনীর ৪০/৫০ জন গার্ড ছিল বাসার নিরাপত্তায়। তারা প্রথম সুযােগেই আত্মসমর্পণ করে। তাদের নিরস্ত্র করে ঐখানেই মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়। শেখ সাহেবের মৃত্যু ঠিক কয়টার সময় ঘটে ? সঠিক মুহূর্তটা কেউ বলতে পারছে না। তিনি সর্বশেষ কথা বলেন আমি চীফ জেনারেল শফিউল্লাহর সাথে ৫-৫০ থেকে ৬০০টার মধ্যে। এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ তিনি ৫-৫৫ মিনিট থেকে ৬-০৫ মিনিটের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।

প্রকৃত হত্যাকারী কে?

ঘটনাবহুল ১৫ অগাস্টের সকাল বেলা। দিনটি ছিল পবিত্র শুক্রবার। আক্রান্ত হলাে ৩২ নং রােডের ৬৭৭ নং বাড়ী। আক্রমনকারীরা শেখ সাহেবকে বন্দী করে তাকে নিয়ে নিচে নামতে থাকে। তার সাথে মেজর মহিউদ্দিন (আরমার্ড) ও মেজর হুদা। একজন তার বাঁ পাশে, অন্যজন একটু পেছনে। এমন সময় সিড়ির ধাপে একটু নিচে দাড়ানাে ৩/৪ জন সৈনিক বন্দুক উচিয়ে বিনা উস্কানীতে সরাসরি রাষ্ট্রপতির উপর গুলিবর্ষণ করলাে। কারা ছিল ঐ Killer গ্রুপে? কে গুলিবর্ষণ করলাে শেখ সাহেবের বুক লক্ষ্য করে? • অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরপরই যার নাম মুজিব হত্যার সাথে সবার মুখে মুখে বঙ্গভবনে ও ক্যান্টনমেন্টে উচ্চারিত হলাে, সে হলাে মেজর নূর চৌধুরী ও রিসালদার মােসলেম উদ্দিন। প্রথমতঃ মেজর নূর ঐদিন শেখ সাহেবের বাসার উপর আক্রমণ গ্রুপেরই অন্যতম সদস্য ছিল। দ্বিতীয়তঃ শেখ সাহেব তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ায় তার ঘৃণা ও আক্রোশ ছিল স্বাভাবিক। উপরন্তু দ্বিতীয় প্রত্যক্ষদর্শী মেজর মহিউদ্দিন সরাসরি উল্লেখ করেছেন, ‘নূরই শেখ সাহেবের উপর ঠাণ্ডা মাথায় গুলিবর্ষণ করে। আমি নিজে যখন শেখ সাহেবের বাসায় ১৫ তারিখ দুপুরে পরিদর্শনে যাই, তখন আমি মেজর পাশা এবং আরাে দুজন ল্যান্সার সৈনিককে জিজ্ঞাসা করি, শেখ সাহেবকে কে গুলি করেছিল? তারাও তখন মেজর নূর এবং মােসলেম উদ্দিনের কথাই আকারে ইংগিতে উল্লেখ করে। একজন সৈনিক জনৈক এন, সি, ওর নাম বলে। নামটি এখন স্মরণ করতে পারছি । আরেকজন বলেছিল, একজন মেজর সাহেব ইংলিশে গালাগালি করে গুলি করেন। জেনারেল শফিউল্লাহও মেজর নূরের নামই শুনেছেন বলে আমাকে জানালেন। রশিদ-ফারুক সরাসরি কারাে নাম বলতে চায় না। তাদের কথা, আমরা তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। সুতরাং না দেখে কারাে নাম নেওয়া উচিত হবে না। কিছুদিন আগে আমি যখন ফারুকের সাথে একান্ত সাক্ষাতে আলাপ করছিলাম, তখন আমি তাকে বললাম ; দেখ ফারুক, ম্যাসকার্নহাস তার বইতে লিখেছে, তুমি তাকে ইন্টারভিউ দিয়ে বলেছে, মেজর নূরই গুলি করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফারুক উত্তেজিত হয়ে বললাে, ও ব্যাটা মিথ্যাবাদী, আন্ধা হাফিজ এটা ওটা যা-তা গল্প বানিয়েছে। আমি তাকে বলেছিলাম, মহিউদ্দিন ছিল আক্রমনগ্রুপের কমাণ্ডার। ঘটনার পর পরই সে আমাকে রিপাের্ট দেয় যে মেজর নূর শেখকে হত্যা করেছে। কারণ আমি তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, তােমরা উনাকে মেরে ফেললে কেন? তখন সে বলে, সিড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ নূর উত্তেজিত হয়ে তার উপর ফায়ার করে বসে। এই ছিল ফারুকের স্পষ্ট কথা। দেখা যায় এখানেও মেজর নূরের নামের প্রতিধ্বনি।

প্রকৃত অবস্থা হলাে, শেখ সাহেব যখন সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিলেন, তখনই তাকে থামিয়ে রীতিমত তাক করে মাত্র ৭ ফুট দূরত্ব (শকে তার বুক লক্ষ্য করেই গুলী করা হয়। তার বুকে ১৮টি গুলির আঘাত পাওয়া যায়। সবগুলােই তার বুকে ও পাজরে প্রায় একই স্থানে কাছাকাছি আঘাত করে। কোন গুলিই তার গলা বা মুখমণ্ডলে আঘাত করেনি। তা। আমার নিজের চোখেই কাছে থেকে দেখা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, একটি স্টেনগান থেকেই তাক করা এক ঝাক ব্রাস ফায়ার সরাসরি তার বুকে আঘাত হানেতা নূরের স্টেনগান থেকে .হােক, আর মােসলেম উদ্দিনের স্টেনগান থেকেই হােক, অথবা হাবিলদারের। অন্যরা তার উপর ফায়ার করলেও গুলি এদিক সেদিক যায়, শুধু দুটো গুলি তার পায়ে আঘাত করে। একটি গুলি উপরে একজন সৈনিকের গায়েও লাগে।

যার ‘তাক’ করা ব্রাস ফায়ার শেখ সাহেবের বুকে মৃত্যুবাণের মত আঘাত হানলাে, সে কে হতে পারে? নিঃসন্দেহে সে ঐ তিন জনেরই একজন। ৮০% সম্ভাবনা মেজর নূর, যার কথা বিভিন্ন সূত্র থেকে বেশিরভাগ লােক উল্লেখ করেছেন। শেখ সাহেবকে ফায়ার করার মুহুর্তে তাকে ইংরেজীতে বকাবকি করা হয়। তিনজনের মধ্যে একমাত্র মেজর নূরের পক্ষেই ইংরেজীতে বকাবকি করা সম্ভব ছিল। সিড়ির যে-স্থানে Killer গ্রুপটি দাড়িয়েছিল, সেখানে স্বল্প পরিসর জায়গায় সামনের ২১ জন ছাড়া তাদের পেছনে অবস্থান গ্রহণকারী অন্যদের শুট করার প্রশ্নই আসে না। তাই ধরে নেওয়া যায়, একজনই ঠাণ্ডা মাথায় স্টেনগান ‘তাক করে’ Get aside বলে ব্রাস্ ফায়ার করেছিল। বাকিরা বন্দুক উচিয়ে থাকলে তারা ফায়ার করতে পারে, নাও করে থাকতে পারে। | এখানে উল্লেখ্য যে প্রত্যক্ষদর্শী মেজর হুদা বলেছিলেন, সিড়ির নিচে দাড়িয়ে থাকা কয়েকজন ঘাবড়ে গিয়ে একসাথে ফায়ার করে, একা কেউ নয়। তার কথা সঠিক বলে ধরে। নিলে শেখ সাহেবের বিশাল দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য গুলির আঘাত পাওয়া যেত, কিন্তু তাতাে ছিল না। শুধুমাত্র বুকের একটি স্থানেই বুলেটের আঘাত কেন্দ্রীভূত ছিল। যা প্রমাণ করে একজনের ‘তাক করা’ (Aimed Fire) ব্রাস ফায়ার থেকেই ক্ষতের সৃষ্টি হয়, বহুজনের ফায়ার থেকে নয়।

অতএব বিভিন্ন তথ্য ও সুত্র এবং তাৎক্ষনিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত যায় যে, রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উপর গুলি বর্ষণকারী ব্যক্তিদের দলে ছিল তিনজন—মেজর নূর চৌধুরী, রিসালদার মােসলেম উদ্দিন ও জনৈক ল্যান্সার NC0. এদের মধ্যে মেজর নূর চৌধুরীর নামই সর্বাগ্রে। তারই তাক করা স্টেনগান থেকে বর্ষিত ব্রাস্ ফায়ার থেকেই রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এটা মােটামুটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়।

শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমন

শেখ সাহেবের বাসায় যখন আক্রমন প্রস্ততি চলছিল, তখন অন্যান্য গ্রুপ শেখ সেরনিয়াবাত ও মনির বাসায় আক্রমন শুরু করে দিয়েছে। | মেজর ডালিম এক প্লাটুন ল্যান্সার সৈন্য নিয়ে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমন করে ভাের ৫-১৫ মিনিটে। পাহারারত পুলিশকে নিরস্ত্র করার জন্য প্রথমেই এক ঝাক গুলিবর্ষণ করা হয় বাসা লক্ষ্য করে। গুলির শব্দে বাসার সবাই জেগে ওঠে। সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে হাসনাত উদীপরা লােকজন দেখে দোতলা থেকে তার স্টেনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ

করে। সেরনিয়াবাত সাহেব জেগে উঠে শেখ সাহেবের বাসায় ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঠিক এমন সময় আক্রমনকারীরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে এবং সেরনিয়াবাতকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে। ঘরের ভেতর সৈন্যরা নির্বিবাদে যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সবাইকে ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে জড়াে করে। তারপর নির্দয়ভাবে সবার উপর ব্রাস ফায়ার করে। মারা যান সেরনিয়াবাতের স্ত্রী, পুত্রবধু, পাঁচ বছরের নাতি, দুই নাতনী, তার ছােট ছেলে, ভাতিজা, আয়া, কাজের ছেলে। সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে হাসনাত আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায়। তার স্টেনগানের গুলি শেষ হয়ে গেলে গােলাগুলির সময় সে লুকিয়ে থাকে। আক্রমনকারীরা তাদের হত্যাকাণ্ড শেষ করার পর প্রস্থান করলে হাসনাত বেরিয়ে এসে পেছন দিকে দেয়াল টপকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। রিসালদার মােসলেম উদ্দিন দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে শেখ মনির বাসায় উপস্থিত হয়। তখন ভাের ৫-১০ মিনিট। নিত্যকার অভ্যাসমত তিনি ভােরবেলা ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমের দরজা খুলে দৈনিক পত্রিকা পড়ছিলেন, এমন সময় খােলা দরজা দিয়ে মােসলেম উদ্দিন। সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়ে। শেখ মনি তার দিকে তাকিয়ে তার আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করতে করতেই মােসলেম উদ্দিন সরাসরি অতি কাছ থেকে তার উপর স্টেনগান থেকে ব্রাস ফায়ারে তাকে হত্যা করে। এই সময় শেখ মনির অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী তার সাহায্যার্থে ছুটে এলে মােসলেম তার উপরও গুলি বর্ষণ করে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। অতি দ্রুততার সঙ্গে অপারেশন সমাপ্ত করে মােসলেম উদ্দিন আবার তার দলবলসহ শেখ সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। | শেখ সাহেবের বাসায় পূর্ণ অপারেশন শুরু হতে কিছুটা দেরী হচ্ছিলাে। সম্ভবতঃ শেখ মনির বাসায় তাড়াতাড়ি অপারেশন সেরে মােসলেম উদ্দিন ৩২ নং রােডে শেখ সাহেবের বাসায়ও অপারেশনে অংশ গ্রহণ করেছিল। যদিও প্রত্যক্ষদর্শী মেজর হুদা তাকে সেখানে দেখতে পাননি বলে জানান। শাফায়েতের ঘরে মেজর রশিদ শেখ সাহেবের মৃত্যু সংবাদ আটিলারীর ওয়্যারলেস সেট সঙ্গে সঙ্গে জানানাে হলাে মেজর রশিদকে। সে এই সংবাদের জন্য গভীর উৎকণ্ঠায় সেট খুলে অপেক্ষা করছিলাে। এই মুহূর্ত থেকে শুরু হলাে মেজর আবদুর রশিদের আসল অপারেশন। মিলিটারি পরিভাষায় যাকে বলে অভিযান পরবর্তী *Reorganisation and Consolidation phase. মেজর রশিদ প্রথমেই ছুটে গেল ৪৬ তম ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের কাছে। তার বাসায় পৌছে তাকে জাগিয়ে সংবাদ দিলাে, স্যার ‘We have done thie Job. Sheikh is killed’ তাকে হত্যা করা হয়েছে। এখন আপনি সামলান। সংবাদ শুনে শাফায়েত হতভম্ব হয়ে গেল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই এরকম একটি বিপজ্জনক সংবাদ শােনার জন্য সে মােটেই প্রস্তুত ছিল না। রশিদ মেজর হাফিজকেও সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। হাফিজুদ্দিন ছিল কর্নেল শাফায়েতের স্টাফ অফিসার।

তারা যখন ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিল, তখনই সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর টেলিফোন আসে। একথা মেজর রশিদ আমাকে জানায়। যদিও  বিভিন্ন পত্রিকার সাক্ষাৎকারে কর্নেল শাফায়েত বলেছে, শফিউল্লাহ আমাকে সবার শেষে টেলিফোন করেন এবং ফোনের অপর প্রান্তে ক্রন্দনরত অবস্থায় কেবলই হা-হুতাশ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান এতই ভেঙে পড়েছিলেন যে তিনি কোন স্পষ্ট নির্দেশই দিতে পারলেন না .. আসলেই কি তাই? নাকি ডালমে কুছ কালা হ্যায়’। বলাবাহুল্য ; আমার সাথে একান্ত আলােচনায় জেঃ শফিউল্লাহ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, এ সবকিছুই শাফায়েত মিথ্যা বলছে। আমি এর একটু আগেই টেলিফোন করে টুপ মুভ করতে তাকে নির্দেশ দেই। কিন্তু সে কোনও এ্যাকশন নেয়নি। | কেন কমান্ডার শাফায়েত জামিল কোন অ্যাকশন নিতে ব্যর্থ হল? এটা কি ইচ্ছাকৃত নাকি ভয় পেয়ে গিয়েছিল? নাকি নির্দেশের অভাবে? নাকি সেও ঘটনার সাথে নেপথ্যে জড়িত ছিল? ঘটনা প্রবাহ থেকেই এর প্রমাণ মিলবে। ওদিকে রেডিও বাঙলাদেশ থেকে সকাল ছয়টার অধিবেশন শুরু হতেই মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। | ঘটনা দ্রুত গড়িয়ে চলল। কর্নেল শাফায়েতের সাথে কথাবার্তা বলে রশিদ তার আপন ইউনিট লাইনে ছুটে গেল। সেখান থেকে টেলিফোনে বিভিন্ন দিকে যােগাযােগ করার চেষ্টা করল। ওদিকে শাফায়েত জামিল তার স্টাফ অফিসার হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে ডিপুটি চীফ জেনারেল জিয়ার বাসায় হেঁটেই যান। উভয়ের বাসা কাছাকাছিই। জিয়া ‘হাফ সে অবস্থায় বেরিয়ে এলেন। শাফায়েত তাকে সকাল বেলার ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত করলেন; শুনে জিয়ার স্পষ্ট জবাব, President is dead, so what? Vice-President is there. You should uphold the constitution, Get your troops ready.মুজিব হত্যার সংবাদ শুনে এই ছিল জিয়ার প্রতিক্রিয়া। জবাব শুনে কর্নেল শাফায়েত জামিল তাকে স্যালুট করে ফাস্ট বেঙ্গল ইউনিট লাইনের। দিকে ধীর পদক্ষেপে রওয়ানা দিলেন। তখন বেলা প্রায় সকাল সাড়ে ছয়টা। শাফায়েত জামিল বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে কর্নেল রশিদ তড়িৎ গতিতে জীপ চালিয়ে ছুটে এলেন জেনারেল জিয়ার বাসায়। বারান্দায়ই তাদের দেখা হয়। তাদের মধ্যে সংক্ষিপ্ত কথা হয়। জিয়া বললেন, তিনি এখন শফিউল্লাহর কাছে যাচ্ছেন। সে তাকে বাসায় যেতে ফোন করেছে। ‘ রশিদ সেখান থেকে আবার শহরের দিকে রওয়ানা দিলেন। তিনি ওয়্যারলেসে বিভিন্নস্থানে যােগাযােগ রক্ষা করতে থাকেন। রশিদ আগামসিহ-লেনে খন্দকার মােশতাক আহমদের বাসায় উপস্থিত হন। রাস্তায় পথ হারা একটি ট্যাংক ধরে তার সাথে নিয়ে যান। মােশতাকের সাথে তার আগেই কথাবার্তা হয়েছিল। প্রথমে তিনি রেডিও স্টেশনে যেতে। অস্বীকার করেন, রশিদরা যে এরকম একটা কিছু ঘটনা ঘটাবে, তার ইশারা তাকে আগেই। দেওয়া হয়েছিল। রশিদ যখন জাব্বাজুব্বা পরিহিত অবস্থায় ট্যাংক বন্দুক নিয়ে তার কাছে হাজির হয়, তখন পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে তিনি প্রর্থমে রীতিমত ঘাবড়ে যান, তাই তিনি রশিদের সাথে রেডিও স্টেশনে যেতে আমতা আমতা করতে থাকেন। কিন্তু অস্ত্রধারী মেজরের ধাতানিতে তাড়াতাড়ি চোস্ত পায়জামা, কামিজ, টুপী পরিধান করে আল্লার নাম জপতে জপতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। | ওদিকে মেজর ফারুক রক্ষীবাহিনীকে ঐভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় রেখে শেরেবাংলা নগর থেকে ৩২ নম্বর রােডে শেখ সাহেবের বাসায় সব ট্যাংক নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। ধানমণ্ডির বাসার গেইটে পেীছে ট্যাংকের উপর থেকেই সে মেজর নূরকে ডাকল। নূর এগিয়ে এসে ইয়াংকি কায়দায় বুড়াে আঙ্গুল উচিয়ে তাকে জানালাে, ‘টার্গেট ফিনিশ। শেখ ইজ ডেড়া ফারুক বলল ‘ওকে’। তখন সময় সকাল নটা। এবার ফারুক ট্যাংকগুলাে নিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা দিলাে। সে বাড়ীর ভিতর ঢুকে মৃত শেখ সাহেবকে এক নজর দেখবার কোন দরকারই মনে করলাে না।

রাস্তার পাশে লেকের ধারে দেখলাে ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হক ও কর্নেল শরীফ আজিজকে হাত চোখ বেঁধে আটকে রেখেছে মারবার জন্য। ফারুক তাদের উদ্ধার করলাে। নিউমার্কেট, ইউনিভার্সিটি এলাকা হয়ে এবার সে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় এসে দেখলাে ট্যাংকগুলাে কমাণ্ডারকে হারিয়ে তার খোঁজে এখানে সেখানে ঘােরাঘুরি করছে। ফারুক ওগুলােকে ধরে ধরে একত্র করে বঙ্গভবন মতিঝিল, কাকরাইল হয়ে সারা শহর কাপিয়ে আবার ক্যান্টনমেন্টে ৪৬ ব্রিগেড়ে ফিরে আসে। চলমান ট্যাংকগুলাের বিকট শব্দে সারা শহরে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে মেজর শাহরিয়ার নিউমার্কেট-ইউনিভার্সিটি এলাকায় অবস্থিত রক্ষী বাহিনীর লােকজনদের সাথে আলােচনা করেন এবং তাদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, আমি টেক ওভার করছে। এখন আমরা সবাই এক। কিছু বুঝে না বুঝেই তারা সুবােধ বালকের মতাে শান্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দিলাে। শাহরিয়ার কিছু সৈন্য নিয়ে নিউমার্কেট ও রেডিও স্টেশন এরিয়া নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বেশ কৌশলেই তার দায়িত্ব পালন করলেন। রেডিও স্টেশন কন্ট্রোলে নিতে তার কোন বেগ পেতে হয়নি। তবে রেডিওতে ঘােষণা দেওয়া নিয়ে মেজর শাহরিয়ার ও ডালিমের মধ্যে কিছু বচসা হয়। শেষ পর্যন্ত ডালিম তার নিজের দায়িত্বেই রেডিওতে মাইকের সামনে বসে শেখ মুজিব হত্যার ঘােষণা প্রচার করে। সেই বিখ্যাত ঘােষণা, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সারা দেশে বিনা মেঘে বজ্রপাত। সকাল বেলা এই ঘােষণা দেওয়ার জন্য ফারুক অথবা রশিদের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। এ কাজটি করেছিল মেজর ডালিম তার নিজ উদ্যোগেই। বলাবাহুল্য, মেজর ডালিম কর্তৃক রেডিওতে এই অনির্ধারিত ঘােষণার প্রতিক্রিয়া হয় কামানের গােলার চেয়েও প্রচণ্ডতর। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে অজানা ভয়, ভীতি আর আতঙ্ক। মুজিব সমর্থকগণ দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। তাসের ঘরের মতাে তাদের সকল প্রতিরােধ ক্ষমতা একমুহুর্তে হাওয়ায় উড়ে গেল। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে তাৎক্ষণিকভাবে দেখা দেয় বিশাল শূন্যতা। রাস্তাঘাট জনশূন্য। কেউ ভয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়াচ্ছে না। সবাই রেডিও ‘অন করে ক্রমাগত ডালিমের ঘােষণা শুনতে থাকলাে, আর পরবর্তী ঘােষণার জন্য উদগ্রীব রইলাে। শুন্যতার এই ক্রান্তিলগ্নে প্রধান সমন্বয়কারী ব্যক্তির ভূমিকায় মঞ্চে আবির্ভূত মেজর আবদুর রশিদ। সে ক্যান্টমেন্টের চতুর্দিকে চরকির মত ঘুরছে। ওয়্যারলেস্ ও টেলিফোনে বিভিন্নস্থানে তিন বাহিনীর সাথে যােগাযােগ রাখছে। জেনারেল জিয়া, খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল, এদের সাথে কথা বলছে। এই সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর ‘রি-অ্যাকশন’-এর উপর দেশের ভাগ্য বহুলাংশে নির্ভর করছিল। কিন্তু জিয়া, খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিলের রহস্যজনক নিরবতাই জেনারেল শফিউল্লাহকে কোন চরম ব্যবস্থা গ্রহণে নিবৃত রাখে। চরম সন্ধিক্ষণে জেনারেল শফিউল্লার ‘নিষ্ক্রিয়তার’ এটাই ছিল একমাত্র অজুহাত। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সকালবেলা সকাল সাড়ে সাতটা। শফিউল্লাহ আর্মি হেডকোয়ার্টারে তার অফিসে বসে মিটিং করছেন। পাশে জেনারেল জিয়া, খালেদ মােশাররফ, কর্নেল নাসিম। কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। উদভ্রান্ত সেনাপ্রধান।

আমি তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার। সকাল সাড়ে ছ’টার দিকে তৈরি হচ্ছিলাম অফিসে যাওয়ার জন্য। চায়ের কাপে ধীরে সুস্থে চুমুক দিয়ে বুটের ফিতা বাধছিলাম। এমন সময় ক্রীঃ ক্রীং ক্রীং শব্দে টেলিফোন বেজে উঠলাে। কর্নেল আবদুল্লার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, স্যার শুনেছেন কিছু? “নাহ, কি ব্যাপার ? ‘রেডিও আছে আপনার পাশে ? তাড়াতাড়ি ‘অন’ করুন।’

আমি ছুটে গিয়ে রেডিও অন করতেই ভেসে এলাে ডালিমের কণ্ঠস্বর “স্বৈরাচারী শেখ। মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।”

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। হ্যা, কণ্ঠস্বর ডালিমেরই বটে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! রাষ্ট্রপতি নিহত। এটা কি সেনা-অভূত্থান? | আমি তৎক্ষণাৎ জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করলাম। ফোন এনগেজড। তারপর জেনারেল জিয়ার বাসায় রিং করলাম। ধরলেন বেগম জিয়া। বললাম, ভাবী জিয়াকে দেন। তিনি বললেন, ভাই একটু আগেই সে হুড়াহুড়ি করে বেরিয়ে গেছে। বললাম, কিছু বলে গেছে • “জি না ভাই।” শুনেই আমি ফোন রেখে তাড়াতাড়ি বুটের ফিতা বেঁধে ইউনিফরম পরে আমার অফিক রওয়ানা দিতে উদ্যত হলাম। ক্রিং ক্রিং। আবার ফোন। ধরতেই সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কণ্ঠস্বর ; হামিদ, তুমি ঘটনা কিছু জানাে? বললাম, আমি রেডিওতে এসব কি শুনছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। সে বলল ; ট্যাংক আর্টিলারি ইউনিট স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল কেউ কিছু জানেনা। তুমি কিছু জানাে? শফিউল্লাহর বিব্রত কণ্ঠস্বর। বললাম, আমি তে কিছুই জানিনা, অফিসে যাচ্ছি, সেখানে কিছু খবর থাকলে শীঘ্র তােমাকে জানাচ্ছি। কিন্তু রেডিওতে তাে ঘােষণা দিচ্ছে, এটা সেনাবাহিনীর অভূত্থান। এর মানে কি? ‘ড্যাম ব্লাফ। শফিউল্লাহ ফোন রেখে দিলাে। তাকে মনে হলাে খুবই উত্তেজিত। আমার জীপ বাইরে অপেক্ষা করছিল। আমি তাড়াতাড়ি অফিসে ছুটলাম। আমার স্টেশন হেডকোয়ার্টারে পেীছে দেখি প্রচুর সৈনিকের ভিড়। তারা সবাই জড়াে হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। জীপ থেকে নামতেই তারা আমাকে ঘিরে ধরলাে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ; স্টেশন থেকে ট্যাংক ও আর্টিলারি ইউনিট কখন বেরিয়ে গেল, কেউ দেখেছ? আমার সুবেদার । সাহেব জানালেন ; স্যার, ট্যাংক ভােরেই আমাদের পাশ দিয়ে ঐ রাস্তা ধরেই শহরে গেল। ৪৬ ব্রিগেডের ভেতর দিয়েই তাে তারা গেল। কেউ তাে কিছু বললাে না। আর্টিলারি তাে। আমাদের পাশের ইউনিট। তারা রাতেই বেরিয়ে যায়। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কেউ বুঝতে পারে নাই। ভাের বেলা ধানমণ্ডির দিক থেকে প্রচণ্ড গােলাগুলির আওয়াজ এসেছে। সকালে রেডিও খুলতেই এই খবর। এখন আমাদের করণীয় কি স্যার? 

দেখলাম সবাই বিভ্রান্ত বিস্মিত এরকম ঘটনা সেনাবাহিনীতে এর আগে কখনাে ঘটেনি। সবাইকে শান্ত থাকতে উপদেশ দিয়ে আমি জীপ নিয়ে আমি হেড কোয়ার্টারের দিকে ছুটলাম। ক্যান্টনমেন্টের বড় রাস্তা ধরে জীপ ছুটে চলেছে। অন্যান্য দিন এ সময় রাস্তাটি যথেষ্ট ব্যও থাকে, আজ প্রায় ফাকা। আমি আমি হেডকোয়ার্টারের প্রধান গেইটে উপস্থিত হলাম। রােজকার মত গেইট খােলা। সেন্ট্রী স্যালুট করলাে। আমি হেডকোয়ার্টারে সরাসরি প্রবেশ করলাম। চীফ অব স্টাফ শফিউল্লাহর অফিসে প্রবেশ পথেই ডাইরেক্টর অব অপারেশন কর্নেল (পরে লেঃ জেনারেল) নরউদ্দীনের অফিস। সেখানে ১৫/২০ জন সিনিয়র অফিসার জমায়েত হয়ে জটলা করছে। জীপ থেকে নেমে আমিও সেখানে উপস্থিত হলাম। নুরউদ্দীনের কামরায় ঢুকে দেখি তার টেবিলের উপর একটি রেডিও বাজছে। অফিসাররা গভীর উৎকণ্ঠায় উপুড় হয়ে একই খবর শুনছে। আমি নুরউদ্দীনের কাছে খবর জানতে চাইলাম। সে জানালাে, স্যার, আপনি যতােটুকু জানেন, ঠিক ততােটুকুই আমি জানি। আপাততঃ খবর ঐখানেই। সে তার টেবিলের উপর রক্ষিত রেডিওটির দিকে ইঙ্গিত করলাে। / বেলা আটটার দিকে ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সব বড় অফিসারই নিজ নিজ ইউনিট থেকে প্রকৃত অবস্থা জানবার জন্যে এক এক করে আমি হেড কোয়ার্টারে এসে জড়াে হচ্ছিলেন। আমি নুরউদ্দীনের কামরার বারান্দায় দাড়িয়ে বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ডার কর্নেল। মােমেনের (পরবর্তিতে ব্রিগেডিয়ার, রাষ্ট্রদূত) সাথে কথা বলছিলাম, তাকে বলছিলাম, তােমার ইউনিট সব ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে গেল অথচ তুমি কিছুই জানাে না। সে বলল, স্যার। আমি তাে সাতদিনের ছুটিতে। ফারুক সব ট্যাংক নিয়ে শহরে বেরিয়ে গিয়ে এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি তাকে বললাম, এখন তুমি শহরে একটি জীপ নিয়ে দেখে আসাে তােমার ছেলেরা কি করছে। সে বলল, আপনার জীপটা দেননা। আমি এক্ষুণি গিয়ে অবস্থা দেখে আসছি। আমি তখন বারান্দায় দাড়িয়েই নুরউদ্দীনকে উদ্দেশ্য করে বললাম, আরে ভাই, ওকে। একটি গাড়ী দেওনা … বলতে বলতেই দেখলাম দুটি জীপ কালাে ড্রেস পরা সেপাইদের নিয়ে মেইন গেইট দিয়ে শাে শাে করে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে। আমি তৎক্ষনাৎ ওদিকে কনেল। মােমেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম; ঐ যে দেখ, তােমার কালাে পােশাকওয়ালা লােকরা জীপ নিয়ে এই দিকেই আসছে। একটাকে ধরাে। ততক্ষণে জীপটি দ্রুত বেগে বামদিকে মােড় নিয়ে একেবারে চীফ অব স্টাফের কামরার দিকেই ধেয়ে এসেছে।

কর্নেল মােমেন ওদের দেখে তৎক্ষণাৎ বারান্দা থেকে এক পা নেমে গিয়ে একটাকে ধরতে গেল। সে হাতের ইশারায় জীপকে থামতে বলল। আর যায় কোথায়। ব্রেক কষে সশব্দে জীপটি থামতেই এক লাফে উন্মুক্ত স্টেনগান হাতে গলাফাটা চিৎকার করে বেরিয়ে এলাে মেজর ডালিম; Shut up, get away from here-বলেই লােডেড স্টেনগান একেবারে কর্নেল মােমেনের দিকে তাক করে ধরলাে। | মােমেন তাে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে কি যেন বলবার চেষ্টা করল। আমি দুই হাত দূরে থাকায় কোনমতে বারান্দার ক্ষুদ্র পিলারের পেছনে নিজের শরীরটাকে আড়াল করতে পারলাম। তবুও মােমেনের উপর ব্রাস ফায়ার করলে আমারও বাচার কোন উপায় ছিল না।

ডালিমের চিৎকার আর স্টেনগানের কড়াক শব্দে এমন ভয়ংকর পরিবেশের সৃষ্টি হলাে যে যেসব অফিসার নুরউদ্দীনের কামরায় জড়াে হয়ে কান পেতে রেডিও শুনছিলাে, তারা কোনকিছু না বুঝেই মহাবিপদ আশঙ্কায় পড়িমরি করে যে যেদিকে পারলাে প্রাণ নিয়ে দিলাে দু। এক নিমিষে ১৫/২০ জন অফিসারের জটলা সাফ! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে কেউ চেয়ার উল্টালাে, কেউ অন্যজনকে মাড়ালাে, একজন তাে আস্ত টেবিলই উল্টে ফেলে দিলাে। তােপের মুখে পড়ে মােমেন যখন আমতা আমতা করে কিছু বলছিল, সেই ফাকে সুযােগ বুঝে।

পিলারের আড়াল থেকে আমিও দিলাম ভো দৌড়। বিপদে চাচা আগে আপনা প্রাণ বাচা। সবাই এখানে ওখানে গুটি মেরে পজিশন নিলাে। আমিও পজিশন নিয়ে যখন দেখলাম কিছু ঘটছে না, তখন আবার আড়ালে আড়ালে উকি ঝুঁকি দিয়ে ঘটনাস্থলে ফিরে এলাম। দেখলাম ল্যান্সারের জীপ দু’টি সেখানে দাড়িয়ে আছে। তার উপর বসে আছে কয়েকজন সেপাই। উদ্যত রাইফেল। যে কোনাে মুহূর্তে অনল বর্ষণ করতে প্রস্তুত।

চীফ অব স্টাফ হাইজ্যাক!

মেজর ডালিম চীফ অব স্টাফের কামরায় ঢুকেছে, হাতে তার উন্মুক্ত স্টেনগান। এমতাবস্থায় আমি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে শফিউল্লাহর কামরায় ঢুকতে সাহস করলাম না। তখন সেনাপ্রধানের কক্ষে ছিলেন জেঃ শফিউল্লাহ, জেঃ জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, কর্নেল নাসিম। (বর্তমানে জেনারেল), মেজর (বর্তমানে জেনারেল) হেলাল মােরশেদ। ঐ কয়েক মুহূর্ত কামরার ভেতর কি ঘটলাে, চীফ অব স্টাফ শফিউল্লাহর মুখেই শােনা যাক : | “আমার অফিসে বসে খালেদ মােশাররফ ও অন্যদের সাথে আলােচনা করছিলাম। তিনি একটু আগেই শাফায়েতের হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরেছেন। এমন সময় দড়াম করে দরজা ঠেলে মেজর ডালিম আমার রুমে প্রবেশ করে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, “চীফ কোথায় ? যদিও ঐসময় আমি তার সামনেই বসেছিলাম। তাকে মনে হল যেন অপ্রকৃতস্ত। তখন কর্নেল নাসিম তাকে শান্ত কণ্ঠে বলল, তিনিতাে তােমার সামনেই বসে আছেন, দেখছাে না? সে তৎক্ষণাৎ আমার দিকে সরাসরি স্টেনগান তা করে বলে উঠলাে, “প্রেসিডেন্ট আপনার সাথে কথা বলবেন। আপনি আসুন। আমি আমারই অফিস রুমের ভেতর তার এরকম উদ্ধত ব্যবহার পছন্দ করিনি। তাকে বললাম ; দেখাে ডালিম, আমি এইসব হাতিয়ার দেখে অভ্যস্ত। তুমি যদি এটা ব্যবহার করতে এসে থাকো, তাহলে ব্যবহারই করাে। কিন্তু আমার দিকে এটা তাক করে রাখবে না। ঐ সময় জিয়াও পাশে দাড়িয়েছিল। এরপর ডালিম তার স্টেনগান নিচে নামিয়ে ফেললাে এবং বললাে; স্যার, প্রেসিডেন্ট আপনার সাথে কথা বলতে চান। প্লিজ আসুন। আমি বললাম, কে প্রেসিডেন্ট? | ডালিম বলল, আপনি নিশ্চয় রেডিও শুনেছেন। আমি তখন তাকে বললাম, তিনি তােমার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু আমার প্রেসিডেন্ট নন। আমার যতক্ষণ পর্যন্ত না ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়েত জমিলের সাথে দেখা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ওখানে যাবাে না।

আমি তখন ৪৬ ব্রিগেডে তার সাথে যাওয়া মনস্ত করলাম। জিয়া নিরুত্তর পাশেই দাড়িয়ে রইলাে। এই ছিল অফিসের ভেতর সংক্ষিপ্ত নাটক ও বাক্য বিনিময়।” এবার অফিসের বাইরের ঘটনা দৃশ্যপটে আবার ফিরে আসা যাক। আমি ততক্ষণে উকিঝুঁকি মেরে ঘটনাস্থলে ফিরে এসেছি। কিন্তু শফিউল্লাহর অফিসের ভেতর ঢুকবাে কি ঢুকােনা, ইতস্ততঃ করছিলাম। এমন সময় দেখি তার অফিসের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন জেনারেল শফিউল্লাহ। তার পেছনে পেছনে স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম। শফিউল্লাহর মুখ কালাে, গম্ভীর। স্পষ্ট বুঝা গেল একান্ত অনিচ্ছায় তিনি ডালিমের সাথে বেরিয়ে আসছেন। ডালিমের পেছনে জেনারেল জিয়া, ডেপুটি চীফ অব স্টাফ। শফিউল্লাহ নিজের স্টাফ কারেই উঠলেন। ডালিম পেছনে। জিয়া তাকে সহাস্যে বললেন, Come on Dalim, in my car. No sir, I don’t go in General’s car. ডালিমের সুস্পষ্ট জবাব, বলেই স্টেনগান উচিয়ে তার সশস্ত্র জীপে চড়ে বসলাে। ডালিমের পেছনে চললেন জেঃ জিয়া। তার পেছনে ডালিমের দ্বিতীয় সশস্ত্র জীপ। শশা শাে করে বেরিয়ে গেল চার চারটি গাড়ী। রীতিমত তােলপাড়। খােদ আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে আর্মি চীফ অব স্টাফ হাইজ্যাক! অবিশ্বাস্য নাটকীয় ঘটনা। চীফ অব স্টাফকে নিয়ে ভয় বেরিয়ে যাওয়ার পর আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। কিছু বুঝে উঠবার আগেই সত্যি কি অদ্ভুত ব্যাপারই না ঘটে গেল ! ঘটনাটা নিজেদেরই বিশ্বাস হচ্ছিলাে না। এবার আমরা যারা ঘটনাস্থলে দাড়িয়ে ছিলাম, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাে হাে করে হেসে উঠলাম। মজার ব্যাপার, রেডিওতে তখনও ক্রমাগত মেজর ডালিমের ঘােষণাই চলছিলাে। অথচ ডালিম তখন আর্মি হেড কোয়ার্টারে। আসলে সকাল থেকে সমস্ত ব্যাপারই ছিল অনিশ্চয়তা, উত্তেজনায় ভরপুর। প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ডের মত আকস্মিক ঘটনায় সবাই ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তড়িৎ এ্যাকশনের বদলে চলছিল ক্লোজ ডাের মিটিং, সলাপরামর্শ। আর্মি হেডকোয়ার্টারে ঢুকে সবার চোখের সামনে একেবারে আমি চীফ অব স্টাফ হাইজ্যাক তাজ্জব ব্যাপার। এসব দেখে আমার নিজেরই মাথা বনবন করছিলাে। যেন বুদ্ধিশুদ্ধি সব লােপ পেয়ে গিয়েছিল।

আমি আর বিলম্ব না করে আমার জীপ ডেকে স্টেশন হেডকোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দিলাম। | আমি হেডকোয়াটার থেকে সেনাপ্রধানের কনভয় সােজা ৪৬ ব্রিগেডের ফাস্ট বেঙ্গল ইউনিট লাইনসে গিয়ে উপস্থিত হলাে। একজন জুনিয়ার অফিসার ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ সেখানে দাড়িয়েছিল। সে ‘চীফ অব স্টাফকে অভ্যর্থনা করে কমাণ্ডিং অফিসারের কামরায় বসাতে নিয়ে যায়। | ফাস্ট বেঙ্গল লাইনে শফিউল্লাহ যখন পৌছেন, তখন সেখানে অভ্যুত্থানের নায়ক মেজর রশিদও উপস্থিত ছিল। তার সাথে আশেপাশে বিদ্রোহী সৈন্যদের কিছু অংশ এবং দুটি ট্যাংকও ছিল। শফিউল্লাহ দেখেন ৪৬ ব্রিগেডের সৈন্যরা আশেপাশে হৈ চৈ করছে। তার সামনেই নাকি ৪৬ ব্রিগেডের একজন অফিসার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের ফটো নামিয়ে মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাে। | সশস্ত্র বাহিনী প্রধান কর্নেল শাফায়েত জামিলের হেড কোয়ার্টারে উপস্থিত। সেখানে উপস্থিত অভ্যুত্থানের নায়ক মেজর রশিদ, মেজর ডালিম। নেই শুধু ব্রিগেড কমাণ্ডার শাফায়েত জামিল। শফিউল্লাহ টেলিফোনে এয়ার চীফ এবং নেভাল চীফকে বেঙ্গল লাইনে আসতে অনুরােধ করলেন। তার আশেপাশে তখন সব জুনিয়ার অফিসার। এমন সময় মেজর রশিদ অত্যন্ত বিনীতভাবে তার কাছে এগিয়ে এসে বললাে; স্যার, রেডিও স্টেশনে চলুন। সবাই ওখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কর্নেল শাফায়েতের বিগ্রেড মেজর হাফিজউদ্দিনও রশিদের সাথে যােগ দিয়ে তাকে রেডিও স্টেশনে যেতে অনুরােধ করতে শুরু করলাে। বিভ্রান্ত চীফ অব স্টাফ। মজার ব্যাপার সেনাসদর থেকে শফিউল্লাহর পেছন পেছন একসাথে এলেও হঠাৎ ৪৬ ব্রিগেড লাইনে এসে জিয়া মােড় ঘুরে অন্য দিকে চলে যান, খুবসম্ভব শাফায়েতের কাছে। তিন বাহিনী প্রধান সেখানে ফাস্ট বেঙ্গল লাইনে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় লিপ্ত হলেও সেখানে জিয়া এবং শাফায়েত ছিলেন অনুপস্থিত। সেনাসদর থেকে শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেড লাইনসে আসেন শুধুমাত্র শাফায়েতের সাথে কথা বলার জন্য, অথচ সেখানে পৌছে দেখেন শাফায়েত তার ধারে কাছেই আসছে না।

দূরে দূরে পায়চারি করছে। পরে শফিউল্লাহ আমার কাছে। স্বীকার করেন যে, আসলে ঐ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে শাফায়েত জামিলের নিষ্ক্রিয়তাই তাকে কোন এ্যাকশনে যেতে বিরত থাকতে বাধ্য করে। কেন ঐ সময় শাফায়েত জামিল নিস্ক্রিয় থাকলাে? ঘটনাপ্রবাহ থেকেই এর জবাব খুঁজে পেতে হবে। শুধু শাফায়েত নয়, ঐ নাজুক মুহুর্তে, প্রকৃতপক্ষে জিয়া, খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল এই তিনজনের রহস্যজনক ভূমিকা শফিউল্লাহকে বিভ্রান্ত করে। | ইতিমধ্যে রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান এবং এয়ার মার্শাল খন্দকারও সেখানে পৌছে গেছেন। তিন বাহিনী প্রধান সংক্ষিপ্ত আলােচনায় বসলেন। অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সকাল ১০•০০ ঘটিকা। সারাদেশে স্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সেনাপ্রধানের সামনে দুটি পথই খােলা ছিল। এক। ৪৬ বিগ্রেড টুপ নিয়ে শহরে বিদ্রোহী দুটি ইউনিটের উপর আঘাত হানা এবং মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। দুই। পরিবর্তনশীল অবস্থা মেনে নেওয়া। রক্তপাত ও সংঘর্ষ এড়াতে জেনারেল শফিউল্লাহ দ্বিতীয় পথই বেছে নিলেন। আধ ঘণ্টার বেশী তিন বাহিনী প্রধান শাফায়েতের ৪৬ বিগ্রেড লাইনসে ছিলেন, এরপর তারা সেখান থেকে শাহবাগে অবস্থিত রেডিও অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে মেজর রশিদ ডালিমকে সেখানে রেখে দ্রুতবেগে আগামসিহ লেনে খন্দকার মােশতাক আহমদের বাসায় ছুটে গিয়েছে। তিন চীফ রেডিও স্টেশনে পৌছবার আগেই তাকে নিয়ে রশিদ সেখানে পৌঁছে যায়। মােশতাক সেখানে তিন বাহিনী প্রধানের আগমনের অপেক্ষায় বসে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজর ডালিম তাদের নিয়ে রেডিও স্টেশনে পেীছলাে। ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ঘটনা প্রবাহ। প্রতি মিনিটে ধাপে ধাপে পরিস্থিতির পরিবর্তন। | রেডিও স্টেশনের অভ্যন্তরে খন্দকার মােশতাক আহমদ তিন বাহিনী প্রধানকে সাদর অভিনন্দন জানালেন। সেনাবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য কনগ্রাচুলেশনস জানালেন। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আলােচনা চললাে। ঝানু পলিটিশিয়ান খন্দকার মােশতাক। তিনি প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের পূর্বে শর্ত আরােপ করলেন। সশস্ত্র বাহিনী প্রধানরা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন। তত্ত্বাবধায়ক বেসামরিক সরকার গঠন করা হবে। যথাশীঘ্র ইলেকশন দেওয়া হবে। তবেই তিনি সিংহাসনে আরােহণ করবেন। | ফারুক রশিদের ট্যাংক ও আর্টিলারি সৈনিকবৃন্দ কর্তৃক ঘেরাও রেডিও স্টেশন। চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। ভেতরে ভীমরুলের ফাঁদে আটকে পড়া অসহায় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধান। উন্মুক্ত অস্ত্র কাধে কু-মেজরদের দ্রুত পদচারণা। তিন প্রধান সব কিছুই মেনে নিলেন। ঐ পরিস্থিতিতে এছাড়া তাদের করবারও আর কিছু ছিল না। তারা এক এক করে রেডিওতে রশিদ-ফারুক মনােনীত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদের-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। মােশতাকের পক্ষে তাহের উদ্দিন ঠাকুর খসড়া বানালেন। রেডিও বাংলাদেশ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সদর্পে বারবার তাদের আনুগত্য-ঘােষণা প্রচার করে চললাে। তখন বেলা সাড়ে ১১টা।

অভ্যুত্থানের সাফল্যের পথে এ মুহূর্তটা ছিল একটি বিরাট “Turning point’। এক অধাতকর অবস্থার অবসান। প্রকৃতপক্ষে ১৫ অগাস্টের সকাল ৫টা থেকে ১১ ঢা, এই না ১১টা এই  সময়টুকু ছিল অত্যন্ত নাজুক ক্রান্তিলগ্ন। এই সময়ের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ঘটনার মােড় এক খাত থেকে অন্য খাতে প্রবাহিত করছিল। সারা দেশের ভাগ্য ঝুলছিল অতি ক্ষীণ সূতােয়! ৪৬ ব্রিগেডে উল্লাস সময় ১১-৪৫ মিনিট। ৪৬ বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার। সি জি এস বিগ্রেডিয়ার খালেদ মােশাররফ সেখানে বসে সমস্ত অপারেশন পরিচালনা করছেন। তার টেলিফোন এলাে আমার কাছে। সেখানে পৌছতে বললেন। পাচ মিনিটের মধ্যেই সেখানে পেীছে দেখি ৪৬ বিগ্রেডের প্রায় সব অফিসারই সেখানে উপস্থিত। জমজমাট ব্যাপার। সবাই উল্লাস করছে। কর্নেল শাফায়েত জামিলও সেখানে। চোখেমুখে তার বিজয়ের হাসি। যেন তার ব্রিগ্রেডই লকা জয় করেছে। আমার সাথে সজোরে হাত মিলিয়ে বলল ; দেখলেন স্যার, ফ্রিডম ফাইটার্স হ্যাভ ডান ইট বিফোর, অ্যান্ড দে হ্যাভ ডান ইট এগেইন। আমি তার কাছ থেকে বিগ্রেডিয়ার খালেদের রুমে ঢুকলাম। তিনি ভীষণ ব্যস্ত। ইশারায়। চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। ফোনে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারের সাথে সাভার কথা বলছেন, ‘আরে বাবা সারেডার নাও। কাম হিয়ার অ্যান্ড সী এভরী ওয়ান ইজ হিয়ার। ইট ইজ অল ওভার।’ তিনি রক্ষীবাহিনীর একজন উর্ধতন অফিসার সম্ভবত কর্নেল সাবেহ উদ্দিনের সাথে কথা বলছিলেন। আমার সাথে একগাল হেসে খালেদ হাত মেলালেন। বললেন ; হামিদ ভাই, স্টেশনের অবস্থা কেমন? বললাম, লেটেস্ট খবর তাে দেখছি এখানেই। তিনি বললেন, ইট ইজ অল আন্ডার কন্ট্রোল। তবে সিচুয়েশন খুবই অনিশ্চিত। যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। আপনি স্টেশন সিকিউরিটি প্ল্যান তাড়াতাড়ি তৈরি করে এসে আমার সাথে আলােচনা করুন। আবার টেলিফোন এলাে। এবার তিনি এয়ার ফোর্সের সাথে কথা বলছিলেন, দুটি ফাইটার জেট পাঠিয়ে সাভারে রক্ষীবাহিনীর উপর ‘Show of Force’ করতে বললেন। একই সাথে ফ্লায়িং ক্লাবের সাথে যােগাযােগ করে মেজর আমসা আমিন (বর্তমানে জেনারেল) ও ক্যাপ্টেন মুনীরকে ফ্লায়িং ক্লাবের একটি প্লেনে উড়ে গিয়ে সাভারে রক্ষী বাহিনীর লােকজনদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে বললেন বিভিন্ন দিকে বিভিন্ন নির্দেশ দিলেন। | বারান্দায় তুমুল কোলাহল। তার ব্যস্ততা দেখে আমি উঠে পড়লাম। শাফায়েতের অফিসে বসেই তিনি সার্বিক সিচুয়েশন কন্ট্রোল করছিলেন। কামরার বাইরে এসে বারান্দায় দেখি কালাে ব্যাটল ড্রেসে মেজর ফারুক। কাধে তার স্টেনগান। মুখে তৃপ্তির হাসি। সবাই তার সাথে হাসিখুশি হাত মেলাচ্ছে। সবাই তার সাফল্যে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কনগ্রাচুলেশন। কনগ্রাচুলেশন।

আমার সামনে আসলাে সে, হাত মেলালাম, বললাম ; ফারুক, তােমার স্টেনগানটায় গুলি আছে বাবা, নাকি ফাকা? বিরাট হাসি দিয়ে বলল ; স্যার, এটাতে অবশ্যই আছে। তবে বিশ্বাস করুন, সকালে যে ট্যাংক নিয়ে বেরিয়েছিলাম তাতে একটিও সেল ছিল না। একেবারে খালি। বলেই সে হাসতে থাকল। আমি বললাম, তােমার ট্যাংকগুলাে এখন কোথায়? সে বলল, সবগুলাে আমি ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনেছি। দেখুন গিয়ে। | ততােক্ষণে রেডিওতে নিজ নিজ কণ্ঠে বারবার তিন বাহিনী প্রধানের আনুগত্য ঘােষণা হচ্ছে। তাদের সাথে বি, ডি, আর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান এবং পুলিশ প্রধানের আনুগত্য ঘােষণাও প্রচার হতে লাগলাে। সর্বত্র খুশীর হিল্লোল। হত্যা পরবর্তী সমস্ত সমগ্র প্রােগ্রামের দায়িত্বে ছিল মেজর আব্দুর রশিদ। চতুর্দিতে। ছােটাছুটি করে সে তার দায়িত্ব সুচারুরূপেই পালন করলাে। এই সময় কোথাও সামান্যতম। দুর্বলতা প্রকাশ পেলে তাদের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতাে। অভুথানের মূল নেতা মেজর ফারুক রহমান টার্গেট আক্রমন করে ধ্বংস করেই খালাস। মেজর রশিদ যখন স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনতে গলদঘর্ম হয়ে ছুটছিলাে, ফারুক তখন তার পিছনে এক ডজন ট্যাংক নিয়ে হাকিয়ে সারা শহর চষে বেড়াচ্ছে। ট্যাংকের ঘড়ঘড় শব্দে সারা শহর কেপে উঠছিল। সবাই ধরে নিয়েছিল এটা সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানই বটে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এটা সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ছিল না। সেনাবাহিনীর মাত্র দুটি ইউনিটের ১০০ শত সৈনিক এতে অংশগ্রহণ করে, তাও তারা কেউ কিছু না বুঝেই। এই অভ্যুত্থানের সাথে সেনাবাহিনী প্রধান বা অন্য কোন সিনিয়র অফিসারও সরাসরি জড়িত ছিলেন না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারগুলাে একটির পর একটি এমন নাটকীয়ভাবে ঘটে। গেল যেন হিন্দি মারপিট মার্কা ছবির নাটককেও বুঝি হার মানায়।

মােশতাকের ট্যাংক মিছিল ও শপথ গ্রহণ

দুপুর বেলা জুম্মার নামাজের আগেই খন্দকার মােশতাক আহমদ বিরাট মিছিল সহকারে। বঙ্গভবন পেীছলেন। তার পতাকাবাহী গাড়ীর আগে পিছে দুটি করে চারটি ট্যাংক, কয়েকটি। সামরিক ট্রাক, জীপ, অনেকগুলাে কার। রেডিও স্টেশন থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে। লম্বা মিছিলটি শান-শওকতের সাথেই বঙ্গভবনে প্রবেশ করল। এমন অভিনব ট্যাংক মিছিল ইতিপূর্বে কেউ কখনও দেখেনি। সবাই বঙ্গভবনে একত্রে জুম্মার নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায়। করলেন। জুম্মার নামাজের পর তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশ, বি ডি আর এবং অন্যান্য সিভিল গণ্যমন্য ব্যক্তিবর্গের সামনে খন্দকার মােশতাক আহমদ শপথ গ্রহণ করলেন। উপস্থিত সবাই ছুটে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালাে। এরপর মােশতাক আহমদ তার নূতন মন্ত্রী সভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান। প্রায় সবাই পুরাতন মাল। তিনি নূতন বােতলে পুরাতন মদ ভরে দিলেন। পুরাতন আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার কয়েকজন বাদে সবাইকে নিয়েই নুতন মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। সবাই খুশী। শেখ সাহেবের লাশ তখনাে ৩২ নং রােডের বাসার সিড়িতে পড়ে আছে। তার কথা সবাই ভুলেই গেছে। বঙ্গভবনে চলছে আনন্দ-উল্লাস, খানাপিনা। দুপুরে ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যখন হাসিখুশী উল্লাস চলছিল, তখন রেডিও স্টেশনে। আনুগত্য পর্ব সেরে সেনা নৌ বিমান বাহিনী প্রধান, বি ডি আর প্রধান, পুলিশ প্রধান এরা। সবাই ক্যান্টনমেন্টে আমি হেডকোয়ার্টারে স্ন্যাকস খাওয়ার জন্য জমায়েত হন। মেজরদের ঘেরাও থেকে মুক্ত হয়ে তারা কিছুক্ষণ মুক্ত পরিবেশে হালকা আলােচনায় লিপ্ত হন। তারপর আবার বঙ্গভবনে ছুটে যান।

দুপুরে আমার অফিসে বসে স্টেশন সিকিউরিটি প্ল্যান বানাচ্ছিলাম। এমন সময় জেনারেল। শফিউল্লাহর ফোন এলাে। তিনি আমাকে তাড়াতাড়ি শহরের অবস্থাটা দেখে আসতে বললেন। ১৪৪ ধারা জারির প্রয়ােজন আছে কি-না তাকে অবগত করতে বললেন। সেই সাথে ৩২। নম্বর রােডের অবস্থাটাও দেখে আসতে বললেন। আমি সিকিউরিটি প্ল্যানের একটা খসড়া। দাড় করিয়ে আমার স্টাফ অফিসারকে মােসাবিদা করতে বলে জীপ নিয়ে শহরের দিকে। ছুটলাম।

এয়ারপাের্ট রােড ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তা-ঘাট ফাকা। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। মােড়ে মােড়ে জটলা। ফাকা ল বেয়ে একটি মাত্র জীপই বীরদর্পে সশব্দে এগিয়ে যাচ্ছিল। আওলাদ হােসেন মার্কেট, ফার্মগেট দিয়ে যাওয়ার পথে বিভিন্নস্থানে আমি জীপ দেখে লােকজন হাত নেড়ে শ্লোগান তুললাে, আল্লাহু আকবর। সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ। একদিনেই এতাে পরিবর্তন। অথচ গতকালও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কি অবাক কাণ্ড। | তবে আমার বুঝতে অসুবিধা রইলাে না যে পরিবর্তিত অবস্থাকে সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছে। কোন বড় রকমের গণ্ডগােল হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। আমি ১৪৪ ধারা জারির পক্ষে কোন যুক্তি দেখতে পেলাম না। | গ্রীন রােড ধরে ৩২ নম্বর রােডে গিয়ে পৌছলাম। আশেপাশে রাস্তাঘাটে কোথাও লোকজন নেই। সর্বত্র পােশাকধারী সৈনিকদের আনাগােনা। তারা বাড়ী ঘেরাও করে রেখেছে। রক্তাক্ত বাড়ী ৩২ নম্বর রােডের মুখে ঢুকতেই প্রহরারত সৈনিকরা আমার জীপ আটকালাে। আমার পরিচয় দিলে তারা রাস্তা ছেড়ে দিলাে। শেখ সাহেবের বাসার গেইটে দাড়িয়ে মেজর পাশা ও মেজর বজলুল হুদা। পাশা এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালাে। বাড়ীর দেয়ালে বুলেটের ক্ষত-বিক্ষত দাগগুলাের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে যথেষ্ট ফায়ারিং হয়েছে নাকি? মেজর পাশা বললাে ; বলেন কি স্যার, হেভী ফায়ারিং। রীতিমত যুদ্ধ। বাসার ভেতর থেকে তারাই আগে ফায়ার করে। দেখুন কতাে হাতিয়ার। আমাকে সে গেইটের পাশে লেকের ধারে সাজিয়ে রাখা হাতিয়ারগুলাের দিকে নিয়ে গেল। দেখলাম ২০/২৫টা চাইনিজ রাইফেল, স্টেনগন, মেশিনগান, গ্রেনেড, এমনকি একটি এটিএয়ারক্রাফট ভারী মেশিনগানও রয়েছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, এতগুলাে ভারী। অস্ত্র দিয়ে তাে অনেকক্ষণ তারা প্রতিরােধ করতে পারতা। পাশাকে বললাম, ভেতরে গিয়ে একটু দেখে আসতে চাই। সে তৎক্ষণাৎ মেজর হুদাকে বলল আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। হুদা প্রথমেই নিয়ে গেল নিচতলায় রিসিপশন রুমে। সেখানে শেখ কামালের মৃতদেহ টেবিলের পাশে একগাদা রক্তের মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একটা টেলিফোনের রিসিভার টেবিল থেকে ঝুলছিল। মনে হল শেষ মুহূর্তে কাউকে ফোন করতে চাইছিলেন শেখ কামাল। একটা হাত তার ওদিকেই ছিল। টেবিলের পাশে আর একটি মৃতদেহ। একজন পুলিশ অফিসার।

প্রচুর রক্তক্ষরণেই দুজন মারা গেছেন। কামালের ভাঙা চশমা পাশে পড়েছিল। মনে হলাে কামরার ভেতর থেকেই দুজন ফাইট করছিলেন। এরপর আমরা দু-তলায় উঠতে পা বাড়ালাম। সিড়ির মুখেই চমকে উঠলাম। সিড়িতেই দেখি পড়ে আছেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিলাে যে সিড়ির ওপরে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দেহ এভাবে পড়ে থাকতে পারে। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবী এবং চেক লুঙ্গি। পাশে পড়ে আছে তার ভাঙা চশমা। তার দেহ সিড়ির ওপরে – এমনভাবে পড়েছিল যেন মনে হচ্ছিলাে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে – গেছেন। আমার মনে হচ্ছিল তিনি ঘুমিয়ে আছেন, এখনই উঠে দাড়াবেন। কারণ তার মুখে = কোন রকমের আঘাতের চিহ্ন ছিল না। চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তার বুকের অংশটুকু ” ছিল ভীষণভাবে রক্তাক্ত। মনে হলাে ব্রাস লেগেছে। আমি তার বুকের কাছে মাথা নিচু করে ” দেখতে চেষ্টা করলাম কোথায় গুলি লেগেছে, কিন্তু বুক ভরা রক্তের আবিরে কিছুই বােঝা গেল না। তার বাম হাতটা ছিল বুকের উপর ভাজ করা, তবে তর্জনী আঙুলটা ছিড়ে গিয়ে চামড়ার টুকরার সাথে কুলছিল। তার দেহের অন্য কোন অঙ্গে তেমন কোন আঘাত দেখিনি। সারা সিড়ি বেয়ে রক্তের প্রবল বন্যা। কোনমতে তার বিশাল দেহ ডিঙ্গিয়ে দোতলায় গেলাম। সিড়ির মুখেই ঘরটাতে দেখি বেগম মুজিবের দেহ দেউড়ির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার গলার হারটা ঢুকে আছে মুখের মধ্যে। মনে হলাে স্বামীর উপর গুলির শব্দ শুনে তিনি ছুটে আসছিলেন। কিন্তু দরজার মুখেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে দেউড়িতে লুটিয়ে পড়েন। তার দেহ অধেক বারান্দায়, অর্ধেক ঘরের ভেতরে। তাকে পাশ কাটিয়ে কামরার ভেতর প্রবেশ করলাম। কামরার মেঝেতে এক সাগর রক্ত। থপথপ করছিল। আমার বুটের সােল প্রায় অর্ধেক ডুবে যাচ্ছিল। বিধ্বস্ত পরিবেশ। রক্তাক্ত কামরার মধ্যে পড়ে আছে কয়েকটি লাশ। বাম পাশেরটি শেখ জামাল। তার দেহের ক্ষতবিক্ষত অবস্থা দেখে মনে হলাে কামরার ভেতরে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।

মিসেস রােজী জামাল সদ্য বিবাহিতা, হাতে তাজা মেহেদীর রং। ব্রাস অথবা গ্রেনেডের আঘাত • সরাসরি তার মুখে লেগেছিল। ভাগ্যিস তার প্রিয়জন কাউকে তার চেহারা দেখতে হয়নি। পাশে মিসেস সুলতানা কামাল। কিছুদিন আগে ক্রীড়াঙ্গণের প্রিয়দর্শিনী এই গােল্ডেন গার্লকে মাঠে দেখেছিলাম ছােটাছুটি করতে। প্রচুর রক্তক্ষরণে এখন তার চেহারা সম্পূর্ণ বিবর্ণ, শুকনাে। তার কোল ঘেঁষে ছােট রাসেলের মৃতদেহ। বড়ই করুণ দেখাচ্ছিল তার মুখখানি। তার মাথার খুলির পিছনদিক একেবারে র্থেতলে যায়। এরপর কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাশে আরও দুটি কামরায় ঢুকলাম। সবগুলােই ছিল খােলা। প্রতিটি ঘরেই দামী দামী জিনিসপত্র। রাষ্ট্রপতির পরিবার। মাত্র কদিন আগেই দুদুটি বিয়ে হয়ে গেছে ঐ বাড়ীতে, কামাল ও জামালের। আনন্দ মুখর আনন্দ-ভবনটি এখন নিরব নিথর। আমরা তিন তলায় যে ঘরে শেখ সাহেব থাকতেন সেখানে গেলাম। সেখানে তার পালংক বিছানা সাজানাে গােছানাে। খাটের পাশে সুন্দর টেলিফোন সেট সবই আছে। নেই শুধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ধীরে ধীরে নেমে এলাম নিচে। মেজর হুদাকে বললাম দেহগুলােকে সাদা কাপড় বা চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে। নিচের তলার একটি বাথরুমে পড়েছিল শেখ নাসেরের রক্তাপুত মৃতদেহ, চেনাই যাচ্ছিল না। তিনি মাত্র আগের দিনই খুলনা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, বুঝি মৃত্যুর আহ্বানেই সাড়া দিতে। 

বাড়ীর পিছনে আঙ্গিনায় একটি লাল গাড়ীর পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে কর্নেল জামিলের প্রাণহীন দেহ। তার ঠিক কপালে বুলেট লেগেছিল। কপালে রক্ত জমাট হয়ে আছে, ঠিক যেন একটি লাল গােলাপ। গার্ডরা তাকে বাড়ীর দিকে অগ্রসর হতে মানা করেছিল। কিন্তু তাদের কথা না মেনে তিনি গাড়ী থেকে নেমে এগিয়ে আসেন। কাছে থেকে নেওয়া শট, বুলেটের একটি আঘাত তৎক্ষণাৎ তাকে ধরাশায়ী করে। জানা যায় একজন অফিসারই তাকে শুট করে। সম্ভবতঃ মেজর নূর। | বাড়ীর ভেতর প্রচুর সেপাই ঢুকে পড়েছিল। প্রত্যেকটি রুমই ছিল খােলা। দু’দুটো বিয়ের । প্রচুর দামী জিনিসপত্র ও উপহার সামগ্রী। আমি হুদাকে বললাম রুমগুলাে লক করে দিতে, তা না হলে জিনিসপত্র চুরি হয়ে যেতে পারে। হুদা তখনই চিৎকার করে তার সৈনিকদের । ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে বললাে। তারা আমাদের পেছন পেছন ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। মনের ভেতরে যথেষ্ট ব্যথা-বেদনা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাড়ীটা দখল করার জন্য এতগুলাে নিরীহ প্রাণ বলিদান দিতে হলাে। এত রক্তপাত হলাে। সর্বত্র রক্তের হােলি খেলা। সৈনিকদের পায়ে পায়ে সারা বাড়ীতে রক্তের ছাপ ছড়িয়ে পড়ছিল। ৩২ নং রােড থেকে ফিরে আমি স্টেশন হেড কোয়ার্টার থেকে জেনারেল শফিউল্লাহকে জানালাম ১৪৪ ধারা জারির কোন দরকার নেই। কোন রকম গণ্ডগােলের আশকা কোথাও নেই।

ক্যান্টনমেন্টে দেখা গেল সবাই হাসিখুশী। কেউ দুঃখিত নয়। উর্দীপরা জ্ঞাতি ভাইদের দ্বারা একটি বিরাট এ্যাডভেঞ্চার ঘটেছে। সফল এ্যাডভেঞ্চার। সবাই এটাকে হাসিমুখেই গ্রহণ করেছে। অবশ্য তারা কেউ ৩২ নং রােডের করুণ রক্তাক্ত দৃশ্য দেখেনি।

বিকাল বেলায়ই আটিলারী ও ল্যান্সারের কিছু ট্যাংক ও কামান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থান নেয়। কয়েকটি ট্যাংক এবং কামান একেবারে বঙ্গভবনের ভেতরে এনে স্থাপন করা হল। সন্ধ্যা নামার আগে আগেই ঢাকা শহরে ও ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। সারাদিন রেডিওতে একের পর এক ঘােষণা ও নির্দেশ প্রচার চলছিল। চলছিল মার্চিং গান, * গজল ইত্যাদি। সারাদিন কাজকর্ম ফেলে সবাই কেবল রেডিওই শুনছিল। বাইরে ছিল। কারফিউ। রেডিও মারফত তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল, যা এমনটি আর কখনও হয়নি। নূতন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ ইতিমধ্যে বঙ্গভবনে তশরিফ নিয়ে গেছেন। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি সেখান থেকেই বিভিন্ন নির্দেশ ও ফরমান দিচ্ছেন। বঙ্গভবনই এখন সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তার সাথে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে মেজর আবদুর রশিদ ও ফারুক রহমান। | বাহিনী প্রধানরা সবাই বঙ্গভবনে। জেনারেল শফিউল্লাহকে সারাক্ষণই বঙ্গভবনে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হলাে। প্রকৃতপক্ষে তাকে ১৫ থেকে ১৭ অগাস্ট পর্যন্ত এক কাপড়ে এক নাগাড়ে সুকৌশলে বঙ্গভবনে এনগেজড় (নাকি আটক রাখা হয়, যাতে কোনভাবে তার দ্বারা অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনার সৃষ্টি না হয়। শফিউল্লাহ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারছিলেন না। ফারুক-রশিদের অবশ্য এমনিতেই তাকে সরিয়ে দেবার প্ল্যান ছিল এবং চূড়ান্তভাবে তাকে ২৪ অগাস্ট থেকে অবসর দেওয়া হয়। এভাবে জোর করে অবসর দেওয়ায় শফিউল্লাহ খুবই অপমানিত বােধ করেন। | তিন বাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, অ্যাডমিরাল এম এইচ খান ও এয়ার মার্শাল খন্দকার জনাব মােশতাক আহমদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর অনিশ্চিত অবস্থা নব্বই ভাগ দুরীভূত হয়ে যায়। এবার মােতাক সাহেব তার দুই পাশে ফারুক আর রশিদকে রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলেন।

১৫ অগাস্টের ভাের বেলা ৪-৩০ মিনিটে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্ত থেকে দুটি শক্তিশালী যান্ত্রিক ইউনিটের অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে ঝটিকার বেগে যে রক্তাক্ত অত্যুত্থান সংঘটিত হয়, ১২ ঘন্টার ব্যবধানে ঐ দিন বিকাল ৪-৩০ মিনিটের মধ্যেই তার সফল পরিসমাপ্তি ঘটলাে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই নূতন রাষ্ট্র, নূতন রাষ্ট্রপতি, নূতন মন্ত্রিসভা, নূতন প্রশাসন। সর্বত্র জয়ধ্বনি। অদ্ভুত ব্যাপার। অবিবাস্য কাণ্ড। মাত্র বারাে ঘন্টার ব্যবধানে কি বিরাট পরিবর্তন। উত্থান পতন। সন্ধ্যাবেলা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্ধকার নামার সাথে সাথে সকল নাটকীয়তার অবসান ঘটল। সারাদিন ধরে সর্বত্র বিরাজ করছিল টেনশন আর উত্তেজনা। অফিসার ও সৈনিকগণ

মিলিটারি অভুথানের মাধ্যমে পরিবর্তন সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছে। এমনকি শাফায়েত জামিলের ৪৬ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের সৈনিকবৃন্দের মধ্যেও উল্লাস, স্বস্তি। রাতে টেলিভিশনে নূতন প্রেসিডেন্টের সাথে নূতন মন্ত্রীগণ, আর ফারুক রশিদ প্রমুখদের সাথে সবার হাসিখুশী চেহারা ভেসে উঠল পর্দায়। উষ্ণ করমর্দন। অভিবাদন। অভিনন্দন। | সন্ধ্যায় নব-নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাক আহমদের দেশবাসীর প্রতি ভাষণ : বিসমিল্লাহির রাহমানের রাহিম আসসালামু আলায়কুম, প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, এক ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার ও সঠিক আকাক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পূর্ণ দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা ও বাঙলাদেশের গণমানুষের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সরকারের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বাঙলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাঙলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মত অকুতােভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাঙলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, বাঙলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযােগে কাজ করে যাচ্ছেন। “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়” এই নীতির রূপরেখার মধ্যে আমরা শান্তি ও প্রগতির পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবাে ….। খােদা হাফেজ, বাঙলাদেশ জিন্দাবাদ। রাতের অন্ধকারে সারাদিন বিভিন্ন ঘটনার আবর্তে পড়ে দেহমন ছিল ক্লান্ত। তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত তিনটার দিকে আমার বেডরুমে টেলিফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং ক্রিং; ক্রমাগত বেজেই চললাে। আমার স্ত্রী বাধা দিয়ে অনিশ্চয়তার সময়ে গভীর রাতে টেলিফোন ধরতে মানা করলাে। আমি তবুও ফোন ধরলাম। অপরপ্রান্তে মেজর আবদুল মতিন (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) তিনি বললেন ; তিনি বঙ্গভবন থেকে বলছেন, নূতন রাষ্ট্রপতি এবং সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর প্রধানসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সেখানে আছেন। আপনাকে যে মেসেজ দেয়ার জন্য আমাকে বলা হয়েছে তা হলাে, আগামীকাল সূর্য ওঠার আগেই শেখ সাহেবের বাসার সমস্ত লাশগুলি বনানী গােরস্থানে দাফন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ অর্ডারটা কে দিলেন। সে বললাে, এখানে তাে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আছেন, আপনার কোন সন্দেহ থাকলে আপনি গাড়ী নিয়ে বঙ্গভবনে এসে যান।

কিন্তু তাতে আপনার সময় নষ্ট হবে। আমি আপনাকে বলছি, এটা হাইয়েস্ট কোয়ার্টারের অর্ডার। অসময়ে টেলিফোনটা উঠানাের জন্য আমি নিজেকে অভিসম্পাত দিলাম। মতিনের কণ্ঠস্বর বিব্রতকর হলেও মনে হলাে বঙ্গভবনে মােশতাকের খাস কামরাতে বসেই যেন সে নির্দেশ বিতরণ করছিল। কিছুক্ষণ পরে আবার মেজর মতিনের টেলিফোন : ‘স্যার, আরাে কিছু নির্দেশ। শেখ মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ অন্যান্য যারা ঐ ঘটনায় মারা গিয়েছেন, তাদের বাসা থেকেও মৃতদেহগুলাে কালেক্ট করতে হবে এবং তাদের লাশ বনানী গােরস্থানে দাফন করতে হবে। তবে শেখ সাহেবের লাশ শুধু বাসায় থাকবে। বনানীতে দাফন করা হবে না, স্থান পরে জানানাে হবে। সময় খুব বেশী হাতে নেই। ১নং সাপ্লাই ব্যাটালিয়ন ছিল ডিউটি ব্যাটালিয়ন। স্টেশন হেড কোয়ার্টারে আমার ডিউটি অফিসারকে তৎক্ষণাৎ তাদের জড়াে করতে নির্দেশ দিলাম। তাদের দু’টো গ্রুপ করলাম। একটা গ্রুপকে ট্রান্সপাের্টসহ শেখ সাহেবের বাসায় পাঠালাম। আর একদলকে পাঠালাম বনানী গােরস্থানে গিয়ে কবর খুঁড়তে। ৩০ জন সৈনিক একজন সুবেদারের অধীনে বনানী কবরস্থানে যায়। এরপর আমি নিজেই শেখ সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সেদিন অমাবশ্যা ছিল কিনা জানি না, রাত ছিল গভীর অন্ধকার। দু’হাত দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছিলাে না। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। মধ্যরাতে ফাকা রাস্তা দিয়ে আমার জীপ তীব্র আলাে ছড়িয়ে অন্ধকার ভেদ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৩২ নং রােডের দিকে ছুটে চলল। হঠাৎ কেন জানি গভীর রাতের অন্ধকারে আমি রাস্তায় চোরাগুপ্তা আক্রমনের আশংকা করলাম। আমার সাথে তিনজন সৈনিককে তাই রাইফেল লােড করে সাবধান থাকতে বলে দিলাম। যাই হােক নির্বিঘ্নেই আমরা ৩২নং রােডে পৌছে গেলাম। গেইটের বাইরে থাকতেই মেজর হুদার কর্কশ কষ্ঠ কানে ভেসে এলাে। সে সৈনিকদের লাইন করিয়ে কড়া ভাষায় গালাগালি দিচ্ছিলাে, কারণ তারা সুযােগ পেলেই ভেতরে ঢুকে এটা-ওটা হাতড়ে নিচ্ছিল। |আমার পৌছবার আগেই শেখ সাহেবের পরিবারের সবগুলাে লাশ কফিনবন্দী করে সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের ট্রাকে তুলে আমার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল।

ধু শেখ সাহেবের লাশ কফিন বন্দী করে বারান্দার এক কোণে একাকী ফেলে রাখা হয়েছিল। আমি সুবেদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি শেখ সাহেবের লাশ? তিনি স্মার্টলী জবাব। দিলেন ; জি স্যার, ওটা শেখ সাহেবের। আমি নিজে চেক করে রেখেছি। কেন জানি কৌতুহলবশতঃই বললাম, কফিনের ঢাকনাটা খুলুন, আমি চেক করবাে। তারা বড়ই অনিচ্ছায় হাতুড়ি বাটাল এনে আবার কফিনটি খুললেন। কি আশ্চর্য। দেখা গেল ওটা শেখ সাহেবের লাশ নয়, শেখ নাসেরের। সুবেদার সাহেব খুব ঘাবড়ে গেল। তাকে বকাঝকা করলাম। আসলে শেখ নাসেরকে দেখতে অনেকটা তার বড় ভাই শেখ মুজিবের মতই। আর এতেই সুবেদার সাহেবের ঘটে বিভ্রান্তি। আমি এবার ট্রাকে উঠে সবগুলাে কফিনের ঢাকনা খুলে ম্যাচ বাক্সের কাঠি জ্বালিয়ে শেখ সাহেবকে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে ট্রাকের এক অন্ধকার কোণে শেখ সাহেবকে পাওয়া গেল। একটি কফিনের ঢাকনা খুলতেই বরফের স্বপের ভেতর থেকে তার দীপ্ত, অক্ষত, সুপরিচিত মুখখানি বেরিয়ে এলাে। সাদা চাদরে ঢাকা বুকের সমস্ত অংশ তখনাে রক্তে রাঙ্গা। তার কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে সম্মানের সাথে তাকে নিচে নামিয়ে বারান্দায় স্থাপন করা হলাে। বারান্দা থেকে শেখ নাসেরের কফিন ট্রাকে নিয়ে তুলে দেওয়া হলাে। আমি সবগুলাে কফিন নিজ হাতে কলম দিয়ে নাম লিখে মার্ক করে দিলাম। লাশ-বদল বিভ্রাটের দরুণ বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়ে গেল। আমি কফিনগুলােসহ ট্রাকটি বানানী রওয়ানা করিয়ে দিয়ে এবার আমার জীপ নিয়ে উধশ্বাসে শেখ মনির বাসার দিকে ছুটলাম। মেজর আলাউদ্দিনকে পাঠালাম। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায়। তখন ভাের ৪-৪৫ মিনিট। | শেখ মনির বাসায় পৌছে ঘরের ভিতর ঢুকে দেখি সব ফাকা, কেউ নেই। এমন কি কোন মৃতদেহও নেই।

অথচ ঘরের দরজা সব খােলা। বাড়ীর জিনিসপত্র সবই যথাস্থানে পড়ে আছে, যেন জনমানবশূন্য ভূতুড়ে বাড়ী। আমি হাঁকাহাঁকি করলাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই। তবে ঘরের ভিতর যে একটি রক্তক্ষয় প্রলয় ঘটে গেছে তা স্পষ্টই বুঝা গেল। কাছেই পলিশ থানা। থানায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, শেখ মনির লাশ সম্পর্কে তারা কিছু জানে কিনা। তারা বলল, গােলাগুলির পর কিছু সৈন্য এসে বােধহয় ডেডবডিগুলাে মর্গে নিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে আলাউদ্দিনও সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় কোন লাশ না পেয়ে ফিরে এসেছে। অগত্যা আমি জীপ নিয়ে দ্রুত মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পৌছলাম। সেখানে ডিউটিরত পুলিশ ইন্সপেক্টর এরশাদ বললেন, মর্গেই সব লাশ আছে। লাশগুলাে বের করে দেবার জন্য মর্গের ডােমকে ডাকা হলাে। ডােম এসে দরজা খুললে দেখা গেল মর্গে পূর্বের পুরানাে পচা গলিত অনেকগুলাে লাশ একসাথে স্থপ হয়ে আছে। ওগুলাের মধ্য থেকেই সেরনিয়াবাত ও শেখ মনির পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহগুলাে সনাক্ত করা হয়। পুলিশ অফিসারই এগুলাে সনাক্ত করেন। এতগুলাে লাশ এক সাথে চাপাচাপি করে থাকায় ১২ ঘন্টায়ই একেবারে পঁচে গিয়েছিল। ভীষণ দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। মরা মানুষের লাশ এত দুর্গন্ধময় হতে পারে, আমার ধারণাই ছিল না। পুলিশ অফিসারতাে ওয়াক থু করে বমিই করে বসলেন। লাশগুলাে ট্রাকে উঠিয়ে বনানী গােরস্থানে নিয়ে যেতে বলি। আমি সেখান থেকে দ্রুত জীপ চালিয়ে বনানী ছুটলাম। সাপ্লাই ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা একটানা কাজ করে ১৮টি কবর খুঁড়ে রেখে ছিল। শেখ সাহেবের পরিবারের লাশগুলাে আগে দাফন করা হয়। তাদেরকে এক একটি কবরে সম্মানের সঙ্গে দাফন করা হয়। এ সময় ব্যাটালিয়নের একজন সিনিয়ার সুবেদার উপস্থিত ছিলেন। | শেখ পরিবারের সাতজন সদস্যের কবর আছে বনানীতে। প্রথম কবরটা বেগম মুজিবের। দ্বিতীয়টা শেখ নাসেরের। তৃতীয়টা শেখ কামালের। চতুর্থ কবর মিসেস কামালের। পঞ্চম কবর শেখ জামালের। ষষ্ঠ কবরে মিসেস জামাল এবং সপ্তম কবরে শায়িত আছে মাস্টার রাসেল।

সব মিলে ওখানে ১৮টি কবর রয়েছে। ১৩ নং কবরটি শেখ মনির। ১৪ নং বেগম মনি। ১৭নং কবরে শায়িত রয়েছেন জনাব সেরনিয়াবাত। বাকিগুলাে শেখ মনি ও জনাব সেরনিয়াবাতের বাসায় অন্যান্য যারা মারা যান তাদের লাশগুলাে দাফনের পর আমি আমার অফিস থেকে গােরস্থানে ফিরে এসে এক এক করে নামগুলাে আমার অফিসপ্যাডে লিপিবদ্ধ করি। রেকর্ডটি বহুদিন ধরে আমার কাছে রক্ষিত রয়েছে। কেউ কোনদিন খােজও করেনি। এছাড়া আর কোথাও এই সমাধিগুলাের রেকর্ড প্রয়াত রাষ্ট্রপতির দাফন সারারাত ভূতের মতাে এখানে ওখানে ছুটে আমার মাথা বন্বন করছিল। বনানীতে শেখ পরিবার, শেখ মনি ও সেরনিয়াবাত পরিবারের দাফন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। যদিও সৈনিকদের সূর্য ওঠার পরও কাজ করতে হয়েছিল। আমি ক্যান্টনমেন্ট বাের্ড অফিসারকে নির্দেশ দিলাম তাড়াতাড়ি ক’জন মালী পাঠিয়ে যেন কবরগুলাে সুন্দরভাবে ড্রেসিং করে দেয়। আমি আমার অফিসে বসেছিলাম। বঙ্গভবন থেকে টেলিফোনে আবার মেসেজ পাঠানাে হলাে, শেখ সাহেবের ডেডবডি টুঙ্গীপাড়া পাঠানাের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি এয়ারফোস। হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। | আমি অর্ডিন্যান্সের একটি প্লাটুন অর্ডিন্যান্সের মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রস্তুত রাখলাম। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসের আলী (বর্তমানে এয়ার কমােডর)। তারা তেঁজগাও এয়ারপাের্ট থেকে বেলা আড়াইটা নাগাদ শেখ সাহেবের লাশ নিয়ে টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশ্যে আকাশে পাড়ি জমালাে।

হামলার আশঙ্কায় হেলিকপ্টার অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত ছিল। আকাশযানটি টুঙ্গীপাড়ার আকাশে পৌছুলে আশেপাশের লােকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওখানে আগেই পুলিশ পাঠাবার জন্য সংবাদ দেওয়া হয়েছিল। মেজর মহিউদ্দিন পুলিশের সহায়তায় কোনক্রমে ১৫/২০ জন লােক জানাজার জন্য জড়াে করতে সক্ষম হয়েছিল। একজন স্থানীয় মৌলভীকে ডেকে এনে শেখ সাহেবের লাশ গােসল করানাে হয়। তার গায়ে ১৮টি বুলেটের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। গােসল শেষে পিতার কবরের পাশেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। সূর্যিমামা পশ্চিম গগনে হেলে গিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাে। তার আগেই দাফন কার্য শেষ করে শামসের হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উড়লাে। জাতির জনককে শেষ বিদায় জানাতে যে কোন কারণেই হােক, টুঙ্গীপাড়ার লােকজন সেদিন ভীড় করেনি। যে ব্যক্তি সারা জীবন বাঙালী জাতির স্বাধীন সত্তার জন্য সংগ্রাম করে গেলেন, তাকে শেষ বিদায় জানানাে হলাে অতি নিরবে, নিঃশব্দে, সুদূর টুঙ্গীপাড়ার একটি গ্রামে।

ভারতীয় হস্তক্ষেপ

অগাস্ট অভুথানের পর পরই ভারতীয় বাহিনীর হস্তক্ষেপের যথেষ্ট আশঙ্কা দেখা দেয়। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ গােলযােগে ভারতের হস্তক্ষেপ করার একটি বিতর্কিত ধারা রয়েছে। ভারত কেন হস্তক্ষেপ করলাে না? বিভিন্ন সূত্রমতে তারা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আহ্বানের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু কেউ তা করেনি। নেতারা ছিলেন অন্তরীণ। তবে একাত্তর আর পঁচাত্তর এক ছিল না। পচাত্তরে বাঙলাদেশের জনমত ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারতের প্রতিকূলে। এসব উপলব্ধি করেই তারা ভুল পথে পা বাড়ায়নি বলে মনে হয়। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর দিল্লী থেকে ছুটে আসেন এবং ভারতীয় আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তাকে বলতে বলা হয়, ভারতীয় এক ডিভিশন মার্চ করলে, চীন পাচ ডিভিশন সৈন্য মার্চ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্রিঃ মঞ্জুর হঠাৎ করে ১৫ অগাস্ট দিল্লী থেকে ঢাকা চলে আসেন। তিনি কিভাবে, কার নির্দেশে ঐদিন ঢাকা আসেন, তা আজো কেউ জানে না। পরদিনই তাকে ফেরত পাঠানাে হয়। ধারণা করা হয়, জিয়ার ডাকেই তিনি আসেন। যা হােক, অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় ভারতীয় হস্তক্ষেপের আশঙ্কা দুরীভূত হয়। তা না হলে আর একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। ১৫ অগাস্ট পরবর্তী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা শান্ত হয়ে এলাে বাহ্যিকভাবে, কিন্তু অশান্ত হয়ে উঠল ভেতরে ভেতরে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তখন বঙ্গভবন। নূতন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ সেখানে বসে দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাকে ঘিরে এখন অভ্যুত্থানের নায়ক ফারুক, রশিদ, ডালিম, নূর, পাশা সবাই বঙ্গভবনে অবস্থান নিয়েছে। আর্টিলারির কামান ও ল্যান্সারের ট্যাংকগুলাে বঙ্গবনের চারপাশে বাইরে ভেতরে

স্থাপন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ প্রায় সকল ক্ষমতা হারালেন। মেজররা ততক্ষযণে বঙ্গভবনে জেঁকে বসেছে। বঙ্গভবন থেকে অফিসে ফিরে এসে ঐদিনই ১৭ তারিখ বিকালে শফিউল্লাহ মিটিং করলেন। জিয়া, খালেদ মােশাররফ এবং বাকি দুই বাহিনী প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। ডি,জি,এফ,আই, ব্রিগেডিয়ার রউফও ছিলেন। কিভাবে মেজরদের বঙ্গভবন থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। রউফ বললেন, আমরা যা বলি তাদের কানে তা পৌছে যায়। অতঃপর সিদ্ধান্ত হল সবাই শপথ নেবেন, বাইরে এই মিটিং-এর আলােচনার বিষয়বস্তু কেউ কিছু প্রকাশ করবেন না। তাই হল। কসম খেয়ে মিটিং শুরু হল। অনেকক্ষণ আলােচনার পর সবাই একমত হলেন, বঙ্গভবন থেকে অনতিবিলম্বে মেজরদের ফিরিয়ে আনতে হবে। মজার ব্যাপার, আল্লাহর নামে সবাই শপথ নিলেও পরদিনই বঙ্গভবনের মেজররা মিটিং-এর বিষয়বস্তু সবকিছুই জেনে যায়। তারা মুখ টিপে হাসতে লাগলাে। এইতাে কসমের বাহার! ১৯ অগাস্ট সকাল ৮ টায় সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ব্রিগেড কমান্ডারদের মিটিং ডাকলেন। ফারুক, রশিদও উপস্থিত ছিল। শফিউল্লাহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বললেন যে, তিনি ভারতীয় আক্রমনের আশা করছেন, অতএব বেঙ্গল ল্যান্সার ও ফিল্ড রেজিমেন্টের উচিত তারা যেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শহর থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে চলে আসেন। এই পর্যায়ে এক সময় কনেল শাফায়েত জামিল গর্জে উঠল, ওরা ফিরে না এলে আমি তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবাে। আমি তাদের কোর্ট মার্শাল দাবি করবাে। মিটিং উত্তেজনা ও বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলাে। মতলব টের পেয়ে ফারুক, রশিদ বঙ্গভবনে তাদের অবস্থান আরাে সুদৃঢ় করলাে। মিটিং শুরু হওয়ার আগে কর্নেল শাফায়েত জামিল সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সাথে তার অফিসে আলাদাভাবে ব্যক্তিগত পয়েন্টে মিলিত হন। তার সাথে ছিল তার স্টাফ অফিসার বিগ্রেড মেজর হাফিজউদ্দিন। শাফায়েত উত্তেজিতভাবে শফিউল্লাহকে বললাে ; স্যার, আপনি জেনে রাখুন, এগুলাে সমস্ত গণ্ডগােলের পেছনে রয়েছে জেনারেল জিয়ার হাত। তার কথা শুনে শফিউল্লাহ হেসে উত্তর দিলেন; শাফায়েত, এই কথাটা বুঝতে তােমার এতাে সময় লাগলাে? | আসলে অভূত্থান সফল হওয়ার পর এবার শাফায়েত জামিল বুঝতে পারলাে, এ অভ্যুত্থানে তারতাে কোন লাভ হয়নি। বরং শক্তিশালী ব্রিগেড নিয়েও এখন সে উপেক্ষিত। আসল ক্ষমতা চলে গেছে বঙ্গভবনে মেজরদের হাতে। তাহলে তখন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে তার কি লাভ হলাে? গােস্মায় সে ফোশ ফোশ করতে লাগলাে। |

খন্দকার মােশতাক আহমেদ বেশ দক্ষতার সাথে দৃঢ়হস্তে দেশ শাসন করতে লাগলেন। বিশ্বের চতুর্দিক থেকে অভিনন্দনবার্তা আসতে লাগলাে। এমনকি মওলানা ভাসানীও সরকার পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে মােশতাককে উষ্ণ অভিনন্দন বার্তা পাঠালেন। মােশতাকের নির্দেশে শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখরা অন্তরীণ হলেন। অবশ্য আওয়ামী লীগ। অথবা মুজিব বাহিনী ইত্যাদির পক্ষ থেকে সবরকম প্রতিরােধ ক্ষমতা প্রথম আঘাতেই ভেঙে পড়েছে। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এখানে ওখানে পালিয়ে গা ঢাকা দেয়। একমাত্র টাঙ্গাইলের দিকে কাদের সিদ্দিকী কিছুটা প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করলে কনেল। লতিফের নেতৃত্বে দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাঠিয়ে তাকে সীমান্তের ওপারে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

বেশ ছােটখাটো লড়াই হয়ে যায় এবং কিছু সৈন্য হতাহত হয়। ইতিমধ্যে মােশতাক আহমদ জেনারেল ওসমানীকে তার ডিফেন্স উপদেষ্টা নিযুক্ত করেন। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান হন চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ। এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে, মেজর জেনারেল শফিউল্লার স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর নূতন চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয় ২৪ অগাস্ট ১৭৫ তারিখে। সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন কার্যকর করা হলাে। ফারুক রশিদের চাপেই যে এটা ঘটলাে তা বুঝতে কারাে বাকি রইলাে না। রশিদের মতে এটা ছিল পূর্ব নির্ধারিত। সিভিল মিলিটারীতে আরাে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ পরিবর্তন করা হল। ১৬ অক্টোবর বিমান বাহিনী প্রধান এ, কে, খন্দকারের স্থলে জার্মানী থেকে ডেকে এনে এম, জি, তােয়াবকে এয়ার চীফ বানানাে ছিল উল্লেখযােগ্য। চীফ অব স্টাফের গদি দখল জিয়াউর রহমানের গদি দখল ছিল আরাে নাটকীয়। ২৪ তারিখ অনুমান বেলা ১২ টায় জেনারেল জিয়ার ফোন আসলাে। তার উত্তেজিত কষ্ঠ, হামিদ Come here just now. | আমি আমার অফিসে তখন কি একটা কনফারেন্স করছিলাম, বললাম; একটু পরে। আসলে হবে না? বলল ; শাট আপ, কাম জাস্ট নাউ। আমি মিটিং ভঙ্গ করে তার দিকে ছুটলাম। বলাবাহুল্য জেনারেল জিয়া আমার কোর্স মেট। তার সাথে অফিসের বাইরে আমার ছিল ‘তুই তুকার সম্পর্ক। ছিল মধুর সম্পর্ক। | আমি তার অফিসে ঢুকতেই মিলিটারি কায়দায় উট মেরে, গর্জে উঠল, Salute properly you Guffy, You are entering Chief of Staff’s Office WI 1469 গেলাম। সে মুচকি হাসতে লাগল। তার হাতে একখানা টাইপ করা সাদা কাগজ। হেসে হেসে আমার চোখের সামনে সেটা নাড়তে লাগল। বলল, Sit down, read it। আমি তাড়াতাড়ি চোখ বুলিয়ে দেখলাম, মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স থেকে ইস্যুকৃত অফিশিয়াল চিঠি। তাকে প্রধান সেনাপতি করে নিয়ােগপত্র। আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে আলিঙ্গণ করে কনগ্রাচুলেশন জানালাম। চিঠিটা পেয়েই সে প্রথমেই আমাকে ডেকেছে। বলল; হামিদ, বল এখন কি করা যায়? জিজ্ঞাসা করলাম, শফিউল্লাহ চিঠি পেয়েছে। সে জানে? না এখনও কেউ জানে না। বললাম, তাহলে তাে তার কাছেও কপি পৌছতে হবে। তারপর অফিশিয়ালি সে হয়তাে • কয়দিন সময় নিয়ে তােমাকে ‘হ্যাণ্ড ওভার করবে। এখন একটু চুপ থাকো। | বলল; শাট-আপ, আমি কাল থেকেই টেওভার করবাে। আমি তাকে বুঝালাম, দেখাে এটাতাে তুমি ‘ক’ করতে যাচ্ছে না। সরকারের অফিশিয়াল চিঠি রয়েছে। তােমাকে তাে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়াই হয়ে গেছে। | সে বলল, তুই এসব বুঝবি না। হি ইজ এ ভেরি ক্লেভার পারসন। তুমি আগামিকাল পুরাে ঢাকা স্টেশনের সব ইউনিটের অফিসার ও সৈনিকদের বড় মাঠে একত্র হওয়ার নির্দেশ। পাঠাও। আমি দেখলাম মহা সংকট। কিছুতেই তার দেরী সইছে না। কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর বললাম, ঢাকা স্টেশনের সবগুলাে ইউনিট আমার অধীনে নয়। তাই তুমি লগ এরিয়া কমান্ডারকে ডেকে নির্দেশটা দিতে পারলে ভাল হবে। প্রস্তাবে সে রাজী হলাে। ব্রিগেডিয়ার মশহুরুল হক তখন অস্থায়ী লগ এরিয়া কমান্ডার। জিয়া তাকে তৎক্ষণাৎ টেলিফোনে ডেকে

পাঠালাে। আমি তাড়াতাড়ি জিয়ার অফিস থেকে বেরিয়ে আমার অফিসে ফিরে আসছিলাম। রাস্তায় দেখলাম ব্রিঃ মশহুরুল হকের গাড়ী পতপত করে পতাকা উড়িয়ে হেড কোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছে। চলন্ত গাড়ীতে আমরা কুশল বিনিময় করলাম।

পরদিন সকালে সারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মহা উত্তেজনা। অফিসার জওয়ান সবাই সিগন্যাল মেসের গ্রাউন্ডে সমবেত হয়েছে। কেউ কিছুই জানে না, কি ব্যাপার। ঠিক সাড়ে সাতটার সময় ডেপুটি চীফ জিয়াউর রহমান মঞ্চে এসে হাজির। সবাই অ্যাটেনশন। জিয়া মঞ্চ থেকে চিৎকার দিয়ে গর্জন করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন, আজ থেকে আমি চীফ অব স্টাফ। আপনারা সবাই আপনাদের ডিসিপ্লিন ঠিক করেন। তা না হলে কঠোর শাস্তি হবে। বলেই মঞ্চ থেকে নেমে দ্রুতপদে আবার তার গাড়ী চড়ে প্রস্থান। সবাই হতবাক, একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। আমি মুচকী হাসলাম। ওদিকে শফিউল্লাহ এ ব্যাপার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। সে তখনও কোন চিঠিই পায়। নাই। সে কিছুই জানে না। শফিউল্লাহ আমাকে টেলিফোন করল, হামিদ এসব কি হচ্ছে? কে এইসব নির্দেশ দিচ্ছে? কার হুকুমে সকালে স্টেশন অফিসার জওয়ানদের মিটিং ডাকা হলাে? আমি বহুকটে ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে মাথা গরম না করতে অনুরােধ করলাম। সে দারুণ। বিরক্ত ও অপমানবােধ করলেও পরিস্থিতির কারণে পরিবর্তন মেনে নিতে বাধ্য হলাে। ঐদিন। থেকে শফিউল্লাহ আর অফিসেই আসলাে না। এইভাবে সেনাবাহিনীর নূতন চীফ অব স্টাফের ঝটিকা স্টাইলে গদিদখল পর্ব সম্পন্ন হলাে। কোন বিদায় সংবর্ধনা, কোন আনুষ্ঠানিক ডিনার, কিছুরই আয়ােজন করা হল না। | জিয়াউর রহমানের সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার সুবাদে ভবিষ্যতে তার আকাশে ওঠার সােপান তৈরি হয়ে গেল। আলাদিনের যে চেরাগটার স্বপ্ন এতদিন ধরে সে লালন করে। আসছিল, আজ তা হাতে এসে ধরা দিলাে। ১৫ অগাস্ট জেনারেল জিয়ার জন্যে সৌভাগ্য কাঠি বয়ে আনলাে। অগাস্ট অভ্যুত্থান না হলে জিয়ার উত্থান হতাে না। বাঙলাদেশের ইতিহাসও অন্যভাবে লিখা হতাে। ফারুক রশিদকে ধন্যবাদ, তারা জিয়ার জন্য খুলে দিলাে ভবিষ্যতের অবারিত দ্বার। অপরদিকে জিয়া চীফ অব স্টাফ হওয়ায় খালেদ মােশাররফ শংকিত হয়ে পড়লাে। তার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। তাকে এবং শাফায়েতকে কলা দেখিয়ে মেজররা বঙ্গবভনে ঢুকে পড়েছে। তাদের দুজনেরই অবস্থান নাজুক হয়ে উঠল। তাদের এখন প্রেস্টিজ পুনরুদ্ধার করার সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোন পথ খােলা রইলাে না। ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানের সময় মুজিবুর রহমানকে কি বাঁচানাে যেতাে? (১) অভ্যুত্থানের গতিধারা পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে শেখ সাহেবের উপর আকস্মিক হামলার ভয় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। সবকিছু জানা স ত্বও সংশ্লিষ্ট ইনটেলিজেন্স এজেন্সীগুলাে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। তার মৃত্যুর জন্য গােয়েন্দা-ব্যর্থতা যথেষ্ট দায়ী। এমনকি ক্যান্টনমেন্টে সেনা-গােয়েন্দা সংস্থাও সামান্য তৎপর থাকলে শুরুতেই এই অভিযান নস্যাৎ করে দেওয় যেতাে। (২) শেখ সাহেবের নিজের প্রাইভেট বাসভবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল ও অপ্রতুল। বাসায় সুপরিকল্পিত সুদঢ় রক্ষাব্যবস্থা থাকলে এসব আক্রমন সফল হতাে না। তার বাসায় প্রচুর অটোমেটিক অস্ত্রশস্ত্র মজুদ থাকলেও সেগুলাের সুষ্ঠু ব্যবহার করে কড়া। প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়নি। ১৫ অগাস্টের সকালবেলা তার বাসার ভেতর থেকে

আরাে ২৫/৩০ মিনিট সময় প্রতিরােধ করতে পারলে ততােক্ষণে রক্ষীবাহিনী, আর্মি, বি ডি আর বা অন্যান্য সংস্থা তার সাহায্যার্থে বাসায় পৌছে যেতে পারতাে। (৩) বাসার ভেতর দোতলায় ওঠার পেছন দিকের গেইট খােলা থাকায় হামলাকারীরা বিনা। ক্লেশে বিনা বাধায় দোতলায় উঠার অপ্রত্যাশিত সুযােগ পেয়ে যায়। দোতলায় উঠার। সিড়িঘরের নিচের এবং উপরের দুটি সিকিউরিটি দরজা বন্ধ থাকলে হামলাকারীদের পক্ষে সরাসরি অপারেশন করা খুবই দুষ্কর হতাে। ফলে দোতলার উপর থেকে কামাল-জামালের পক্ষে দীর্ঘক্ষণ প্রতিরােধ গড়ে তােলা সম্ভব হতাে। প্রচুর Re-action টাইমও পাওয়া যেতাে, ফলে শেখ সাহেব বেঁচে যেতেও পারতেন। রাত্রিবেলা দোতলায় উঠার সিড়িঘরের দুটি দরজাই খােলা রাখার পরিণতি বড়ই আত্মঘাতি প্রমাণ করে। | (৪) আপদকালীন সময়ে তড়িৎ ‘রিঅ্যাকশন’ করার জন্য কোন আপদকালীন প্ল্যান’ বা বিশেষ টুপ রাখা হয়নি। এমনকি তড়িৎ মেসেজ পাঠাবার জন্য টেলিফোন ব্যতীত কোন বিকল্প ওয়্যারলেস ইত্যাদিও রাখা হয়নি। যার জন্য গােলাগুলি শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি যথেষ্ট সময় ও সুযােগ পাওয়া সত্বেও সঠিক স্থানে তড়িৎ গতিতে মেসেজ পৌছাতে সক্ষম হননি। | (৫) এতবড় রক্ষীবাহিনীর কমান্ড চ্যানেল ছিল বড়ই দুর্বল, অথর্ব, অকর্মণ্য। চরম মুহূর্তে কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ছিলেন লন্ডনে। তা না হলে হয়তাে রক্ষীবাহিনীর তড়িৎ ‘রি-অ্যাকশন’ শেখ সাহেবকে রক্ষা করতে পারতাে। ৩২ নং রােড থেকে শেরেবাংলা নগর রক্ষীবাহিনী হেডকোয়ার্টার ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের দূরত্বে। অথচ ঘটনার সময় কয়েক হাজার রক্ষী সৈন্য নিরবে প্রস্তুত অবস্থায় ওখানে দাড়িয়ে রইলাে। এমনকি বাসার গেইটে ছিল রক্ষীবাহিনীর ৪০/৫০ জন নিয়মিত গার্ড। তারা সবাই বিনা যুদ্ধে হাত তুললাে। এসবই ছিল অমার্জনীয় ব্যর্থতা। (৬) গােয়েন্দা প্রধান সালাহউদ্দিন সর্বপ্রথম সফিউল্লাহকে আনুমানিক ভাের ৫-১৫ মিনিটের সময় অভ্যুত্থানের খবর দেন। তখন যদি সেনাপ্রধান নিজ উদ্যোগে ৪৬ ব্রিগেডের কিছু সৈন্য তড়িৎ গতিতে মুভ করাতে পারতেন, তাহলে হয়তাে রাষ্ট্রপ্রধানকে বাঁচানাে সম্ভব হতাে। ৫-৩০ মিনিটে শাফায়েতকে যখন রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ দেওয়া হয় তখন যদি সে জরুরীভিত্তিতে কোয়ার্টার গার্ডগুলাে থেকে জরুরী ভিত্তিকে কিছু সৈন্য রওয়ানা : করাতাে তাহলেও তার বেঁচে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সংকট সময়ে একটি সৈন্যও মুভ করালাে না। | (৭) মধ্যরাতে অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, Source মারফত এরকম একটি আভাস সর্বপ্রথম জানতে পারেন ডি, জি, এফ, আই ব্রিগেডিয়ার রউফ, রাত আনুমান ২/৩টার দিকে। কিন্তু তিনি কাউকে জানাননি। জেঃ শফিউল্লাহ বললেন; তিনি যে ব্যবস্থা নেন তা হলাে, অজানা আশংকায় তিনি তৎক্ষণাৎ তার বাসা ত্যাগ করে পরিবার নিয়ে বাসার পেছনে মাঠে একটি গাছের নিচে লুকিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। ঘটনার পর সকালে বেরিয়ে এসে ব্যর্থতা। ঢাকতে বিভিন্ন অসংলগ্ন গল্পের অবতারণা করেন এবং পত্র পত্রিকায় বিবৃতি দেন। অথচ সময়মত সংশ্লিষ্ট সবাইকে সংবাদ দিলে খুব ভােরেই Counter ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতাে।

গােয়েন্দা প্রধান নিশ্চিতভাবে ভাের ৫টার আগেই আক্রমনের খবর পান। তিনি তখনও যদি সরাসরি রাষ্ট্রপ্রধানকে রেড টেলিফোনে কথা বলে তাকে শুধু সাবধান করে দিতেন, তাহলেও তার বেঁচে যাওয়ার ৮০% সম্ভাবনা ছিল। (৮) শেখ সাহেব অসম সাহসে এতাে গােলাগুলির মধ্যে হামলাকারীদের সামনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে না এসে যদি তার কামরার দরজা লক করে বাড়ীর ভেতরেই কোথাও কোন ঘরে লুকিয়ে থাকতেন, তাহলেও হামলাকারীদের পক্ষে তাকে খোঁজ করে বের করতে সময় লাগতাে। চাইলে পেছন দিকে তিনি হয়তাে পালিয়ে যেতেও পারতেন। কিন্তু তিনি কোনরকম “আত্মরক্ষামূলক পন্থার কথা চিন্তাই করলেন না। ১৫ অগাস্ট ক্যান্টনমেন্ট থেকে কেন সৈন্য মুভ করলাে না? ১৫ অগাট ভাের সাড়ে পাঁচটায় রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রান্ত হলাে। ক্যান্টমেন্টে DGFI প্রধান, ও সেনা গােয়েন্দা প্রধান ভাের ৫টার আগে অভিযানের খবর পান। সেনাবাহিনী প্রধান খবর পান আনুমানিক সােয়া ৫টায়। রাষ্ট্রপতির সাথে তার ফোনে শেষ কথা হয় ৫-৫০ মিনিটে। ঢাকার বিগ্রেড কমাণ্ডার শাফায়েত জামিল আক্রমণ সংবাদ পান সাড়ে ৫টায়। ভাের ৬টার দিকে রাষ্ট্রপতি আক্রান্ত হয়ে নিহত হলেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার সাহায্যার্থে একটি সৈন্যও মুভ করলাে না।’ | এ ব্যর্থতা কার? বহুদিন পর আজও সবার মনে বারবার এই একটি জিজ্ঞাসা তাড়া করে ফেরে—সৈন্য কেন মুভ করলাে না ক্যান্টনমেন্ট থেকে। এ নিয়ে আজও চলছে প্রবল বাক-বিতণ্ডা। | প্রথমেই সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ আক্রমনের সংবাদ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ব্রিগেড কমাণ্ডার শাফায়েত জামিলকে ভাের সাড়ে ৫টায় ফোন করেন এবং তাকে তৎক্ষণাৎ সৈন্য মুভ করতে বলেন। কিন্তু শাফায়েত জামিল বলছে সেনাপ্রধান তাকে আক্রমনের সংবাদ ঠিকই দেন কিন্তু সৈন্য মুভ করার কোন নির্দেশ দেননি। তাই তখন সে মুভ করেনি। তার ভাষায় শফিউল্লাহ তখন কেবল বিড়বিড় করেছেন। কিন্তু তাকে কোন নির্দেশ দেননি। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, উদভ্রান্ত। | শাফায়েত সৈন্য মুভ করছে না দেখে শফিউল্লাহ্ আবার তাকে ফোন করেন আনুমানিক ৬টার দিকে, কিন্তু তখন দেখা যায় শাফায়েত তার ফোনের রিসিভার তুলে রেখেছে। এক্সচেঞ্জ থেকে অপারেটর তা-ই জানায় : শফিউল্লাহর ভাষ্য।

এমতাবস্থায় শফিউল্লাহু খালেদ মােশাররফকে ফোন করে তার বাসায় ডেকে এনে তাকে শাফায়েত জামিলের কাছে পাঠান শাফায়েতের সৈন্য মুভ করাতে। শফিউল্লাহ চতুর্দিকে ক্রমাগত ফোন ঘােরাতে থাকেন। ডেপুটি চীফ জিয়াউর রহমান সহ অন্যান্যদের সাথে কথা বলতে থাকেন। তারপর তিনি তৈরী হয়ে অফিসে ছুটে যান। এখানে তার যে বড় ভুল হলাে; তা হলাে, তিনি যখন দেখলেন, যেকোন কারণেই হােক শাফায়েত জামিল তার সৈন্য মুভ করছে না, তখন তিনি মাত্র পাঁচল’ গজ দূরে অবস্থিত শাফায়েতের হেড কোয়ার্টারে একে ওকে না পাঠিয়ে নিজেই ছুটে গিয়ে শাফায়েতের সৈন্য মুভ করাবার ব্যবস্থা নিতে পারতেন। এখানে তিনি চরম মুহুর্তে টেলিফোন ও কথাবার্তায় অযথা সময় নষ্ট করলেন। কিন্তু একটি সৈন্যও ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুভ করাতে পারলেন না। | এখানে সেনাপ্রধান দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলেন। তবে সঙ্গত কারণেই বােঝা যায়, ঘটনার ভয়াবহতায় তিনি দারুণ Tension-এ ভুগছিলেন। সম্ভবতঃ উত্তেজিত হয়ে কিছুটা নার্ভাসও হয়ে পড়েন। তবে ঘটনা প্রবাহ থেকে বােঝা যায়, ঐ মুহুর্তে তার ব্যর্থতা ছিল অনিচ্ছাকৃত, মােটেই ইচ্ছাকৃত নয়। কাদের সিদ্দিকী বলেছেন; তিনি ছিলেন অথর্ব, অকর্মন্য। আমার মনে হয় এগুলাে যথেষ্ট রূঢ় শব্দ।

শাফায়েতের এ্যাকশন

এবার আলােচনা করা যাক ঢাকার ব্রিগেড কমাণ্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলের এ্যাকশন নিয়ে। তার অধীনে ছিল প্রায় ৪০০০ সৈন্য। শাফায়েত জামিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তার সৈন্য মুভ করতে না-পাবার জন্য সরাসরি সেনাপ্রধানকেই দায়ী করে বলেছে, তিনি তাকে। কোন নির্দেশ দেন নাই, তাই সে তার সৈন্য মুভ করতে পারে নাই। এরপর বলছে, রশীদ সকালবেলা তার কাছে এসেছিল দু’টি ট্যাংক এবং দু’ট্রাক সৈন্য নিয়ে।এগুলাে দেখে সে তখন কোন এ্যাকশনে যেতে পারেনি। আসুন, সকাল থেকে শাফায়েতের কিছু এ্যাকশনের পর্যালােচনা করা যাক: এক। ভােরবেলা আনুমানিক ৬ ঘটিকায় শাফায়েত সেনাপ্রধানের কাছে থেকে সংবাদ পায়। রাষ্ট্রপতি-ভবন আক্রান্ত হয়েছে। তিনি মহা বিপদে আছেন। শাফায়েত একজন Independant ব্রিগেড কমাণ্ডার। তার কি করণীয় ছিল? তার কি বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রধানের সাহায্যার্থে তৎক্ষণাৎ সৈন্য নিয়ে রওয়ানা দেওয়া উচিত ছিল না? সেনাপ্রধান কি তাকে এ্যাকশনে যেতে নিষেধ করেছিলেন? মেজর রশিদ ছিল শাফায়েতেরই অধীনস্ত একটি ইউনিটের কমাণ্ডার। তারই অধীনস্ত একটি ইউনিট এবং অধীনস্ত একজন কমাণ্ডিং অফিসার, ১৫ অগাস্ট ভােরবেলা টপস নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, রাষ্ট্রপতি ভবন আক্রমন করে ঘটাল হত্যাকাণ্ড। এরজন্য কি রশিদ একাই দায়ী? দায়-দায়িত্বের কোন কিছুই কি কমাণ্ডার শাফায়েত জমিলের উপর বর্তায় না? দুই। ভাের ৬টার সময় রাষ্ট্রপ্রধানকে খুন করে স্বয়ং রশিদই প্রথমে দুটে আসে ৪৬ ব্রিগেড। লাইনে কর্নেল শাফায়েত জামিলের কাছে। তাকে সেলুট ঠুকে বলে, Sir we have killed Sheikh. অধীনস্ত অফিসার একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে খুন করে এসে তার বসের কাছে রিপাের্ট করার পর একজন কমাণ্ডার হিসাবে কর্নেল শাফায়েতের কি উচিত ছিল না তৎক্ষণাৎ তাকে এ্যারেস্ট করে সেনাপ্রধানকে রিপাের্ট করা? | এমনকি রশিদ-ডালিমরা শাফায়েতের ব্রিগেড এরিয়াতে সারা সকাল একা একা ঘুরে বেড়ালাে। কিন্তু শাফায়েতের কোনRe-action নাই। এসব রহস্যজনক নয় কি? 

তিন। রাষ্ট্রপ্রধান হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সরাসরি হত্যাকারীর কাছ থেকে পেয়েও সে তৎক্ষণাৎ সেনাপ্রধানকে ফোন করে জানায়নি। বরং সে হেঁটে হেঁটে ডেপুটি চীফের বাসার দিকে রওয়ানা দেয়। প্রশ্ন হলাে, এরকম দুর্যোগ মুহূর্তে সে হেঁটে হেঁটে সময় নষ্ট করবে কেন? সময় বাচাতে তার গাড়ী ব্যবহার করলাে না কেন? সে ঐ মুহূর্তে তার চীফের দিকে না গিয়ে ডেপুটি চীফ জিয়াউর রহমানের দিকেই বা যাবে কেন? | চার। ঐ সময় রশিদ, ডালিমরা তার এরিয়াতে খােলামেলা হাসিখুশী ঘােরাফেরা করছিল। শাফায়েত তার এরিয়াতে চার হাজার সৈন্য নিয়ে কেন তাদের ঘেরাও করতে পারলাে না? সে ছিল ঢাকার পদাতিক ব্রিগেডের স্বাধীন কমাণ্ডার। চরম মুহূর্তে চার হাজার সৈন্য নিয়ে। সে নিস্ক্রিয় বসে থাকলাে। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আক্রান্ত হয়েছেন জেনেও নিজে থেকে সে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়ােজনীয়তাই উপলব্ধি করলাে না। শাফায়েতের এই নিস্ক্রিয়তা ছিল। ইচ্ছাকৃত, নাকি অনিচ্ছাকৃত? এসব গভীর বিশ্লেষণের দাবী রাখে। পীচ। ভাের সাড়ে ৪টার দিকে তারই ব্রিগেড এরিয়ার ভেতর দিয়ে ফারুক ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হয়। প্যারেড গ্রাউণ্ডে তারই জওয়ানরা তাকিয়ে তা দেখলাে। শাফায়েতের বাসার

পেছন দিয়েই ট্যাংকগুলাে বিকট শব্দে গড়িয়ে গেল। প্রশ্ন হলাে, ফারুক কোন সাহসে , রাস্তা দিয়ে না গিয়ে একেবারে শাফায়েতের ব্রিগেড লাইনের ভিতর দিয়ে তার আক্রমন-অভিযান পরিচালনা করলাে? এটা কি কোন পূর্ব সমঝোতার ইংগিত বহন করে? আবার রশিদই কিভাবে সাহস করে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে প্রথমেই সরাসরি ছুটে এসে তার বসের কাছে সশরীরে রিপোর্ট করে ? কেউ খুন করে একান্ত সুহৃদ ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারাে কাছে কি ঘটনা ফাস করতে ছুটে আসে?

হয়। রশিদকে প্রশ্ন করেছিলাম, তােমরা তােমাদের আক্রমন-প্ল্যানে ট্যাংক-কামান সবকিছু। নিয়ে দুর্বল রক্ষী বাহিনীকে কাউন্টার করার চিন্তায় থাকলে, কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত শাফাতের শক্তিশালী ৪৬ ব্রিগেডের কথা একবারও চিন্তা করলে না। রশিদ মুচকী হেসে জবাব দিয়েছিল, সেতাে আমাদেরই লােক। তার তরফ থেকে আমরা কোন আক্রমন-আশংকা করিনি। শাফায়েত আমার কিন্তু তখন রশিদের কথা মােটেই বিশ্বাস হয়নি। এখন সামগ্রিক ঘটনাগুলাে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না, রশিদ একেবারে মিথ্যা বলেনি। সাত। শফিউল্লাহর নির্দেশে খালেদ মােশাররফ কর্নেল শাফায়েতের হেড কোয়ার্টারে আনুমানিক সকাল ৭টার দিকে পৌছান। কিছুক্ষণ পর তিনি সেখান থেকে সেনাপ্রধানকে ফোন করেন, ‘স্যার আমাকে ওরা আসতে দিচ্ছে না, কথা বলতেও দিচ্ছে না। কারা তাকে আটকে রাখলাে, কারা তাকে কথা বলতে দিচ্ছিলাে না? কর্নেল শাফায়েতের অফিসে কাদের সাহস হতে পারে ব্রিগেডিয়ার, খালেদ মােশাররফকে আটকে রাখার ? খালেদ-শাফায়েত ঐ সময় কিসের নাটক করছিলেন? সবই পাঠকদের অনুমানের উপর ছেড়ে দেয়া হলাে। আট। সকাল ৯ ঘটিকা। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এসে উপস্থিত হন ৪৬ ব্রিগেড লাইনে। তিনি সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন শাফায়েত জামিলের জন্য। সে ঐখানে তার এরিয়াতেই ছিল। কিন্তু সে কাছে না এসে দূরে দূরেই থাকে। তারই স্টাফ অফিসার মেজর হাফিজ উদ্দিন। এগিয়ে আসে রশিদকে নিয়ে সেনাপ্রধানের কাছে। তাকে অনুরােধ করে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য। শাফায়েতের সমর্থন না-থাকলে কিভাবে তার স্টাফ অফিসার সেনাপ্রধানকে এভাবে অনুরােধ করতে পারে? 

কিছুক্ষণ পরই আসেন বিমান ও নৌবাহিনী প্রধান। তিন সশস্ত্র বাহিনী প্রধান উপস্থিত।শাফায়েত জামিলের এরিয়াতে। তারা সেখানে আধঘন্টার উপর অবস্থান করেন। তারা মিটিং করেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে শাফায়েত তাদের ধারে-কাছেও আসলাে না, এড়িয়ে চললাে। কিন্তু কেন? কেন শাফায়েত তাদেরকে এড়িয়ে চলতে চাইলাে? কেন সে ঐ সময় তিন। প্রধানের সামনে এসে অভিযান করার জোর দাবী জানলাে না? | সেখান থেকে তিন বাহিনী প্রধান রেডিও স্টেশনে রওয়ানা দেন। কিছুক্ষণ পর প্রচারিত হয়। নুতন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য। এতােদিন পর শাফায়েতের আস্ফালন, ‘ওরা ভীরু। ওরা খুনীদের কাছে নতজানু হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, এতােই যদি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শাফায়েত অনুগত ছিল, তাহলে তখনই তার চার হাজার সৈন্য নিয়ে তিন চীফসহ ডালিম, রশিদ, ফারুক মােশতাক সবাইকে রেডিও স্টেশনে গিয়ে ঘেরাও করে গ্রেফতার করলাে না কেন? সকাল থেকে ওরাতাে তার এরিয়াতেই ঘােরাফেরা করছিলাে। সকাল থেকে এতােকিছু ঘটে। যাচ্ছে, অথচ চরম মুহুর্তে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বিশ্বস্ত কমাণ্ডারের কোন প্রতিক্রিয়া নাই। সকল দায়দায়িত্ব সে এড়িয়ে চলে। অবশেষে যুদ্ধ যখন শেষ, তখন কমাণ্ডারের মঞ্চে আগমন ও তলােয়ার ঘুরিয়ে লম্ফঝম্প।

নয়। একটি বড় সত্য তিক্ত হলেও সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। ঘটনার দিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু সংবাদটাই ছিল সবচেয়ে বড় বজ্রপাত। এতে তাৎক্ষণিক ভাবে সৃষ্টি হয় ক্ষমতার বিশাল শূন্যতা’। কমাণ্ডাররা ভাবলাে; শেখ সাহেবই যখন নেই, তখন তার জন্য শূন্য মার্গে ফাইট করে আর কি হবে? যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন বাস্তবকে মেনে, নেওয়াই ভাল। হাজার হােক অ্যুত্থানটাতাে ঘটিয়েছে জ্ঞাতি ভাইরাই। অতএব ‘Salute the rising sun’, ১৫ অগাস্ট সকালবেলা সময় যতােই গড়াতে থাকে, ক্যান্টনমেন্টের সর্বত্র জ্ঞাতি ভাইদের সাফল্যকে সমর্থন করার প্রবণতাও ততােই বাড়তে থাকে। এর প্রতিফলন দেখতে পাই বেলা ১১টার দিকে ৪৬ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে কর্নেল , শাফায়েতের হেডকোয়ার্টারে। অভিযানের সাফল্যে সবাই আনন্দিত। উল্লসিত শাফায়েত জামিল। উল্লসিত উপস্থিত শ’খানেক অফিসার। সর্বত্র কনগ্রাচুলেশন, কনগ্রাচুলেশন। শাফায়েত এবং খালেদ দু’জনই শেখ সাহেবের প্রিয়পাত্র হলেও ঐদিন, ঐ মুহুর্তে তাদের কাউকে বিমর্ষ দেখতে পাইনি। সময় বিভ্রাট ১৫ অগাস্ট সকালবেলা অভ্যুত্থান ঘটনাগুলাে কখন কিভাবে ঘটলাে, কে কখন খবর পায়, এসব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আজও যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। আসুন, প্রকৃত অবস্থা অবহিত হওয়ার জন্য ঘটনাগুলাে ধারাবাহিকভাবে যাচাই করে দেখা যাক। এক। ১৪/১৫ অগাস্ট রাত ১০ ঘটিকার সময় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট মেজর রশিদের নেতৃত্বে তাদের কামানগুলাে নিয়ে নির্মানাধীন নিউ এয়ারপাের্ট (বর্তমান জিয়া • বিমান বন্দর) এর দিকে বেরিয়ে যায়। দুই। প্রায় একই সময়ে মেজর ফারুকের নেতৃত্বে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলাে ইউনিট লাইন থেকে এক এক করে বেরিয়ে নিউ এয়ারপাের্টে গিয়ে সমবেত হতে থাকে। তিন। মেজর ফারুক অভিযানকারী অফিসারদের চূড়ান্ত ব্রিফিং করেন ১৪/১৫ অগাস্টের রাত ১২-৩০ মিনিট থেকে ৮০০ টার মধ্যে। | চার। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফারুকের নেতৃত্বাধীনে বেঙ্গল ল্যান্সারের প্রথম ট্যাংকটি নিউ এয়ারপাের্ট এলাকা ত্যাগ করে ১৫ অগাস্ট ভােরবেলা ৪-৩০ মিনিটে। আশেপাশে তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। শেষ ট্যাংকটি যখন এয়ারপাের্ট ত্যাগ করে, তখন বেলা প্রায় ৫টা। পাঁচ। এই গ্রুপের ২০/২৫ মিনিট আগে অর্থাৎ আনুমানিক ৪টায় রাইফেলধারী সৈন্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন কমাণ্ডারের নেতৃত্বাধীনে আপন আপন টারগেটের উদ্দেশ্যে এয়ারপাের্ট এরিয়া ত্যাগ করে। তারা ভাের ৪-৪৫ মিনিট থেকে ৫টার মধ্যেই মিনিটের মধ্যে । সমবেত হয় ধানমণ্ডির বিভিন্ন টারগেট পয়েন্টে। মূল টারগেট শেখ সাহেবের বাসায় আক্রমন। শুরু হতে কিছুটা দেরী হলেও অন্যান্য টারগেট অর্থাৎ শেখ মনি ও সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমন শুরু হয়ে যায় ৫টার দিকেই। ধানমণ্ডি এলাকা তখন রীতিমতাে, রণক্ষেত্র।

| ছয়। শেখ সাহেবের বাসায় আক্রমণ শুরু হয়ে যায় ৫-৩০ মিনিট থেকে। রাষ্ট্রপতি মৃত্যুমুখে | পতিত হন আনুমানিক ৬ ঘটিকায়।

তারা যেভাবে সংবাদ পেলেন। এক। আক্রমন অভিযানের খবর সর্বপ্রথম সাের্স মারফত সাংবাদ জানতে পারেন DGF ব্রিগেডিয়ার রউফ। তিনি নিজেই বিবৃতিতে স্বীকার করেন, জনৈক গােয়েন্দা ডাইরেক্টর ফোন করে তাকে রাত আড়াইটা থেকে তিনটার মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে ট্যাংক ও সৈন্য চলাচলের জরুরী সংবাদ দেন। যদিও ট্যাংক এর বেশ পরেই বড় রাস্তায় নামে। অবশ্য ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ভিতরে অস্বাভাবিক মুভমেন্ট আগেই শুরু হয়ে যায়। এই জরুরী গােপন বার্তা পেয়েও রউফ চুপচাপ থাকেন। তিনি রাষ্ট্রপতিকে সাবধান করে দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করেননি। তিনি যদি তৎক্ষণাৎ সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে রেড টেলিফোনে ফোন করে সতর্ক করে দিতেন, অথবা বাসার গার্ডরুমেও ফোন করে গার্ডদেরকেও সতর্ক করে দিতেন, তাহলে হয়তাে ১৫ অগাস্টের এই রক্তপাত নিশ্চিতভাবে এড়ানাে যেতাে। | রাত তিনটা থেকে ভাের সাড়ে ৬টা পর্যন্ত DGFI ব্রিগেডিয়ার রউফ কি করলেন? তা আজও রহস্যাবৃত। জানা যায় ঐ সময় মহা বিপদ আশংকা করে তিনি তার পরিবারকে নিয়ে বাসার পেছনে দূরে গলফ কোর্সে একটি গাছের নীচে লুকিয়ে থাকেন। এবং তিনি সকাল বেলা ৬-৩০ মিনিটে লুঙ্গি পরে শফিউল্লাহর ব্যাটম্যান হাবিলদার হায়দারের সহায়তায় দেয়াল টপকে পিছনদিক থেকে সেনাভবনে প্রবেশ করেন। তখন ভেতরে জেঃ জিয়া শফিউল্লাহর সাথে কথা বলছিলেন। রউফ তখনই হন্তদন্ত হয়ে হাজির হন। DGFI রউফের এসব নাটকীয় ব্যবহার এবং অস্বাভাবিক আচরনের হেতু আজও রহস্যাবৃত। দুই। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রপতি মুজিব এই সময় ব্রিগেডিয়ার রউফকে DGFI পােস্ট থেকে সরিয়ে। অন্যত্র বদলী করেন। এতে রউফ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি DGFI দায়িত্বভার সমঝিয়ে দিতে গড়িমসি করছিলেন। পরে ১৫ অগাস্ট হস্তান্তর করবেন বলে ঠিক হয়। ঐ দিনই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। নবনিযুক্ত DGFI কর্নেল জামিল ভােরবেলা রাষ্ট্রপতির ফোন পেয়েই আক্রান্ত বাড়ীর দিকে ছুটে যান, অথচ ব্রিগেডিয়ার রউফ মধ্যরাতে আক্রমন সংবাদ পেয়েও নিষ্ক্রিয় থাকেন। রাষ্ট্রপ্রধানকে সতর্ক করার প্রয়ােজন বােধ করেননি। অফিসিয়েলী তিনিই ছিলেন। তখনাে ডি জি এফ আই। এসব ব্যাপার বিশ্লেষণের দাবী রাখে। |

তিন। ডি এম আই লেঃ কর্নেল সালাহ উদ্দিন সৈন্য ও ট্যাংক চলাচলের সংবাদ পান ৪-৩০ মিঃ থেকে ৫টার মধ্যে। এরপর তিনি ছুটে আসেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর বাসায় এবং তাকে অবস্থা অবহিত করেন। অর্থাৎ সেনাপ্রধানকে তিনি সম্ভাব্য অভিযানের সংবাদটি দেন ভাের ৫-১৫ থেকে ৫-৩০ মিনিটের মধ্যে। চার। এই সময় থেকে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে পাওয়ার জন্য ক্রমাগত ফোন ঘােরাতে থাকেন। কিন্তু পান না। অবশেষে ৫-৫০ মিনিটের দিকে রাষ্ট্রপতিকে ফোনে পেয়ে গেলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে বাসা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ দেন। তখন সময় আনুমানিক ৫-৫৫ ঘটিকা। এরপরই রাষ্ট্রপতির মৃত্যু ঘটে। তখন সময় আনুমানিক ৬ ঘটিকা। শুক্রবার, ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। | পাঁচ। শেখ সাহেবের ফোন পেয়েই প্রথমে শফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেড কমাণ্ডার কর্নেল শাফায়েত জামিলকে ফোন করে আক্রমনের সংবাদ দেন। তখন সময় ৬-০০ মিনিট থেকে ৬-৫ মিনিট। ঐ সময় অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা মেজর রশিদও পেীছে গেছে শাফায়েত জামিলের বাসায় তাকে এই সংবাদ শােনাতে যে রাষ্ট্রপতিকে তারা হত্যা করেছে। ছয়। সকাল ৬টা থেকে ৮টা, এই সময়টাতে শাফায়াতের ৪৬ ব্রিগেডের সৈন্যদল অকুস্থলে পৌঁছে যেতে পারতাে Counter action এর জন্য, যদিও শেখ সাহেবকে তখন বাচানাে সম্ভব হতাে না। এই সময় শফিউল্লাহ ও শাফায়েত জামিল নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতে করতেই সময় পার হয়ে যায়। সাত। সকাল ৯-৪৫ মিনিট। সেনা, নৌ, বিমান, তিনবাহিনী প্রধান শাফায়েত জামিলের ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে উপস্থিত। অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, কিন্তু শাফায়েত জামিল অনুপস্থিত। | আট। সকাল ১১-৩০ মিন্টি। রেডিওতে তিন বাহিনী প্রধানের আনুগত্য ঘােষণা।

১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানে ফারুক-রশিদের সাফল্যের প্রধান কারণসমূহ

সংক্ষেপে নিম্নলিখিত কারণসমূহ চিহ্নিত করা যায় : * শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আক্রমন প্ল্যানের গােপনীয়তা রক্ষা করা।

* মূল লক্ষ্য ছিল স্থির, অভিন্ন এবং এক’—অর্থাৎ ৩২ নং রােডের ৬৭৭ নং বাড়ী দখল করা এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার অথবা হত্যা। সবাই একক লক্ষ্য অর্জনেই সর্বশক্তি নিয়ােগ করে। * রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ছিলেন রাষ্ট্রের সকল শক্তির কেন্দ্রবিন্দু ও উৎস। প্রথম আঘাতেই। ঠার নিহত হওয়ার সংবাদে সর্বত্র দেখা দেয় বিরাট শূন্যতা ও অনিশ্চয়তা। তার মৃত্যুতে তার সমর্থকরা মানসিকভাবে একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তাদের প্রতিরােধ ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। তার মৃত্যুই ছিল ফারুক-রশিদের সাফল্যের প্রধান কারণ। | * TOTAL SURPRIZE: আক্রমনের আকস্মিকতায় রক্ষীবাহিনী, বি.ডি.আর, মুজিব। বাহিনী সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কোনও বাহিনী থেকেই সামান্যতম প্রতিরােধ বা প্রতি-আক্রমন আসেনি। ফলে আক্রমণকারী দুটি ইউনিট নির্বিঘ্নে তাদের অবস্থান অতি দ্রুত · সুসংহত করতে সক্ষম হয়। * আক্রমনের ব্যাপকতায় সবাই নিশ্চিত ধরে নেয় যে, এটা সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান, অতএব স্বাভাবিকভাবেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সে কারণেই অবস্থা ভালভাবে পরখ না করে কেউ তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা থেকে বিরত থাকে। . * মুজিব হত্যার রেডিও ঘােষণা ঢাকা ও দেশের সর্বত্র ভয়ংকর মনস্তাত্তিক চাপ সৃষ্টি করে, এতে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ঘােষণাও দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর নামে। সেটাও ছিল একটা বড় ‘ব্লাফ’। * ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা এবং চরম মুহুর্তে সেনাবাহিনী প্রধানের সিদ্ধান্তহীনতায় সময় নষ্ট করা। * আক্রমনকারীদের তড়িৎ এ্যাকশন। নির্মম হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে অতি দ্রুততার সঙ্গে ‘ঝটিকা আক্রমন চালিয়ে সকল সম্ভাব্য টার্গেট ধ্বংস সাধন। * আক্রমন পরবর্তী সময়ে তড়িৎ গতিতে স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনা। সময় ক্ষেপণ করে নূতন প্রেসিডেন্ট মনােনয়ন এবং তিন বাহিনী প্রধানের আনুগত্য গ্রহণের ব্যবস্থা করা। * ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সকল অফিসার ও সৈনিকবৃন্দের বিনা দ্বিধায় পরিবর্তিত অবস্থাকে সাদরে গ্রহণ ও জাতিভাইদের সাফল্যে প্রকাশ্য উল্লাস। সেনা-অভ্যুত্থানের স জনগণের প্রকাশ্য ও মৌন সমর্থন।

  • অলৌকিকভাবে একের পর এক ঘটনাবলী সুষ্ঠু টাইম-টেবিল অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়া, কোথাও সামান্যতম বাধা বিঘ্ন না ঘটা।

১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থান : একটি পর্যালােচনা

১ : (১) ১৫ অগাস্ট অভুথান ছিল এক ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যুত্থান। পাক-ভারতের ইতিহাসে এ. ধরনের সেনা-অভ্যুত্থান এই প্রথম। মাত্র গুটিকয় জুনিয়ার অফিসার ও মাত্র দুটি ইউনিটের অভিযানে এমন একটি আলােড়ন সৃষ্টিকারী অভ্যুত্থান ঘটলাে, যা কিনা একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন ঘটিয়ে দিলাে। | (২) জুনিয়ার অফিসারদের দ্বারা এরকম সরকার পরিবর্তনকারী অভ্যুত্থান রাজনৈতিক ইতিহাসেও খুব বেশী একটা নেই। বলা যেতে পারে, এদিক দিয়ে ফারুক-রশিদ সেনা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে এক নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করলাে। মাত্র একই দিনে এতাে অল্প সময়ের ব্যবধানে এতগুলাে বড় বড় ঘটনা একের পর এক ঘটে গেল, যেন ঘড়ির কাটাকেও হার মানায়। যে কারণে ঐ দিনের বিভিন্ন ঘটনার সময়-ক্ষণ নিরূপণ করতে মাথা গুলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এতবড় নাটকীয় ঘটনা রাজনৈতিক এবং মিলিটারী ইতিহাসেও এক বিরল দৃষ্টান্ত। (৩) অবাক হতে হয় এই দেখে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে এতবড় কালজয়ী একজন নেতার নেতৃত্বাধীনে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা একটি মাত্র আঘাতেই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়লাে। তার সষ্ট রক্ষী বাহিনী, মুজিব বাহিনী, পুলিশ, বি ডি আর, কিছুই এগিয়ে এলাে না সময়মতাে অভ্যুত্থান প্রতিরােধ করতে। এই ব্যর্থতা ছিল অমার্জনীয়। | (৪) শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে—ভাের ছটায় রেডিওতে ডালিমের এই ঘােষণার সাথে সাথে বিদ্যুতের মত সারাদেশে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, যা বােমার আতংকের চেয়েও মারাত্মক আতংক সৃষ্টি করে। সংবাদটি শুনে রাষ্ট্রীয় কাঠামােও ভেঙ্গে পড়ে। রাষ্ট্রীয় কাঠামাে ‘এক ব্যক্তি ভিত্তিক হওয়াতেই এমনটি ঘটলাে। ব্যক্তির পতনে সরকারেরও পতন ঘটলাে। শেখ সাহেব প্রথম আঘাতেই নিহত না হলে এ অভ্যুত্থান নির্ঘাত ব্যর্থ হতাে। এতে কোন সন্দেহ নাই। (৫) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের মধ্যে সম্পর্ক ভালাে ছিল না। পাকিস্তান আমলে সেনাবাহিনীর সাথে বরাবর তাদের দ্বন্দ্ব ছিল। পুরাতন সেই রেশ ধরেই এই মনােমালিন্য। একমাত্র শেখ সাহেবই সেনা-অফিসারদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক ‘ রাখতেন। অন্যরা এড়িয়ে চলতেন। অপরদিকে সেনাবাহিনীর তরুণ মুক্তিযােদ্ধা অফিসাররাও। আওয়ামী লীগ নেতাদের পছন্দ করতাে না। কারণ তারা মনে করত দেশের মুক্তির জন্য তারা যখন যুদ্ধ করেছে, তখন এইসব রাজনৈতিক নেতা, পাতি-নেতারা পেছনে কোলকাতায় বসে ফুর্তি করেছে। এধরনের মানসিকতা যথেষ্ট ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার এতই অধঃপতন ঘটে যে সর্বস্তরের মানুষ তখন একটা পরিবর্তন কামনা করছিল। অতঃপর সেই পবিরর্তনটি যখন এলাে, তখন তা রক্তাক্ত হলেও

সবাই যেন এটাকে বরণ করে নিলাে।

(৬) ফারুক-রাশদ দু’জনই বারবার বলেছে, শেখ সাহেবকে হত্যা করার পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। ক্যান্টনমেন্টে ধরে এনে সেখান থেকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে গিয়ে বিচারের ব্যবস্থা করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। দু’জনেই বলে, বিচারে অবশ্যই তার ফাসি হতাে এবং আমরা সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ফাসির আদেশ কার্যকর করতাম। এটা যুদ্ধাবস্থায় যেমনটি করা হয়। অন্য কথায় তাদের যে প্ল্যান ছিল, তাতে শেখ সাহেবকে হত্যা করারই প্ল্যান ছিল। তা অপারেশনের ছত্রছায়ায় হােক, আর ট্রায়ালের নামেই হােক। তবে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে এভাবে সংক্ষিপ্ত ট্রায়ালে প্রকাশ্য ফাসি দিয়ে বা গুলি করে হত্যা করা আরও কলকজনক ব্যাপার হতাে। তাই নয় কি? (৭) ১৫ অগাস্টের চরম মুহুর্তে জিয়াউর রহমান, খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল। এই তিনজনের ভূমিকাই ছিল রহস্যজনক। এই তিনজনেরই কি অভ্যুত্থানকারীদের সাথে আলাদা আলাদাভাবে কোন গােপন সমঝােতা ছিল? ঘটনা প্রবাহ থেকেই এসব প্রশ্নের জবাব। খুঁজে পেতে হবে। হামলাকারীগণ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে প্রথমেই সেনাবাহিনী প্রধানকে ফোন না করে শেখ সাহেব বিভিন্ন দিকে যােগাযােগ করতে যাবেন কেন? তাহলে কি তিনি সেনাপ্রধানের ওপর থেকেও কিছুটা আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন? | (৮) ভাের ৬টার সময় শফিউল্লাহ খালেদ মােশাররফকে পাঠান ৪৬ বিগ্রেড-এ শাফায়েতের কাছে তড়িৎ টুপ মুভ করাবার জন্য। তিনি সেখানে গিয়ে বলেন কেউ মুভ করছে বরং উল্লাস করছে। তার কথায় শফিউল্লাহ আরাে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে খালেদ ও শাফায়েত উভয়কেই দেখা যায় উল্লসিত মুডে। খালেদ মােশাররফ ঐ সময় অপারেশন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন এবং রক্ষীবাহিনীসহ অন্যান্য সবাইকে শান্ত করতে মহাব্যস্ত ছিলেন। তিনি ঐ মুহূর্তে একটি বড় কাজ করেন, তা হলাে নিজ দায়িত্বে ফারুকের জন্য ট্যাংকের গােলা সরবরাহ করার জন্য জয়দেবপুরে ডিপােকে নির্দেশ দেন। ট্যাংকের গােলা পেয়ে ফারুকের ট্যাংক বাহিনী বিরাট শক্তিতে পরিণত হয়। অথচ ভােরবেলা তার ট্যাংক ছিল গােলাবিহীন লৌহ শকট মাত্র। ঐ মুহুর্তে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়েত জামিলের হাসিখুশী উল্লাস সবাইকে অবাক করেছিল, কারণ এ দুজনই ছিলেন শেখ সাহেবের প্রিয় ব্যক্তি। – ৯) সকাল ৮-৩০ ঘটিকা পর্যন্ত আর্মি হেডকোয়ার্টার ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। যখন এতবড় একটি অভ্যুত্থান ঘটনা ঘটেছে, তখন শফিউল্লাহ আর্মি হেড কোয়ার্টারের সৈন্যদের সাধারণ সতর্ক অবস্থায় (stand to) রাখা উচিত ছিল। অন্ততঃ মেইন গেইটটা বন্ধ করে সরাসরি ভিজিটারস অনুপ্রবেশ বন্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু আপদকালীন অবস্থায় খােদ আর্মি হেড। কোয়ার্টারেই সাধারণ সতর্ক অবস্থা গ্রহণ করতে সবাই ভুলে যায়। ঐদিন সকালে আমি হেডকোয়ার্টারে সামান্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও সশস্ত্ৰ জীপ নিয়ে মেজর ডালিম। সরাসরি হেডকোয়ার্টারে ঢুকে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে ধরে নিয়ে যেতে পারতাে না। এমনকি প্রস্থানের সময়ও আউট গেইট বন্ধ থাকলে সে বেরুতে পারতাে না। সতর্ক অবস্থা থাকলে টপস আশেপাশে আত্মরক্ষামূলক পজিশনে থাকতাে। কিন্তু হায়। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়। সেনাবাহিনী প্রধান তার আপন হেডকোয়ার্টারে ধরা খেলেন। এটা এক অভূতপূর্ব ঘটনা। | বলাবাহুল্য, ঐদিন ঐ সময় সেনাপ্রধানকে ধরে রেডিও স্টেশনে না নিয়ে যেতে পারলে ১৫ অগাস্টের ইতিহাস*ভিন্নভাবে লেখা হতাে। হয়তাে জাতিকে ৩ এবং ৭ নভেম্বরের রক্তাক্ত

অভ্যুত্থান দেখতে হতাে না।

(১০) মেজর ডালিম যখন উন্মুক্ত স্টেনগান নিয়ে শফিউল্লাহর রুমে ঢুকে, তখন সে ডিম অস্ত্রহাতে মারমুখ। শফিউল্লাহ তার সাথে যেতে অস্বীকার করলে সে হয়তাে যে-কোন অঘটন ঘটিয়ে দিতে পারতাে। তবে যদি হেডকোয়াটারে সতর্কাবস্থা থাকতো এবং প্রােটেকশন উপস্ থাকতাে, তাহলে শফিউল্লাহকে এভাবে জবরদস্তি অফিস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতাে না। বরং ডালিমকেই আটক করে বন্দী করা সম্ভব হতাে। আজ ১৯ বছর পরও এ প্রশ্নটি আমার মনের ভেতর তাড়া করে ফেরে। কি হতাে যদি ঐ সময় ডালিমের বন্দুকের মুখে চীফ অব স্টাফ সেনাসদর থেকে বেরিয়ে না যেতেন? কি হতাে যদি ডালিমকে সেনা হেডকোয়াটারে ঘেরাও করে বন্দী করা হতাে? কি হতাে যদি শাফায়েত সাহস করে ডালিম রশিদকে তার ব্রিগেড এরিয়াতে তার কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে বন্দী করে আটকে ফেলতাে ! (১১) শাফায়েত বলেছে তার ৪৬ ব্রিগেডে নাকি সকাল থেকে সারাদিনই প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল। সে ছিল স্বাধীন ব্রিগেড কমাণ্ডার। সেতাে ইচ্ছে করলে যে কোন সময় প্রতি-আক্রমনে যেতে পারতাে। ভাের বেলা শফিউল্লাহ যখন তাকে ফোন করেছিল, তখন গেল না কেন? তখন তার রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তার কি কারণ ছিল? পরে যায় নাই, হয়তাে ভালই হয়েছে, তা না হলে নিজেদের মধ্যে বড় রকমের রক্তপাত হয়ে যেতাে, লাভ বিশেষ কিছুই হতাে না। এছাড়া তার নিজের ব্রিগেডের সৈন্যরাও দুপুরের পর আপন ভাইদের সাফল্যে প্রকাশ্যে। উল্লাস করছিল। তখন ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি।

(১২) ভাের ৫-১৫ মিনিটে শফিউল্লাহ যখন প্রথম ডি এম আই কর্নেল সালাহউদ্দিন মারফত খবর পান, তখন যদি তিনি বিভিন্নস্থানে টেলিফোন এবং আলােচনায় সময় নষ্ট না করে, সরাসরি তার বাসার ৫০০শত গজ দূরে অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডের বেঙ্গল লাইনসে নিজেই গাড়ী নিয়ে ছুটে গিয়ে ব্যক্তিগত নির্দেশে ইনফেন্ট্রি ইউনিটগুলাের কিছু টুপস ঘটনাস্থলের দিকে মুভ করাতেন, তাহলেও অভূত্থানকারী গ্রুপের ঘেরাও করা এবং মােকাবেলা করা সম্ভব হতাে। হয়তাে শেখ সাহেবকে বাচানােও সম্ভব হতাে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সেনাপ্রধান করুণভাবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। | (১৩) কেউ বিমান হামলার কথা চিন্তা করেননি। এই সময় আক্রমনকারী ইউনিটের উপর তড়িৎ বিমান হামলা (Air Strike) চালালে পরিস্থিতির মােড় হয়তাে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব হতাে।.. | (১৪) ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থানে কোন বিদেশী শক্তির গােপন হাত ছিল কি-না, এ নিয়ে বহু জল্পনা-কল্পনা। বিশেষ করে সি আই এ’র কথা উল্লেখ করা হয়। আসলে অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হয় সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে। এটাই ছিল বড় সত্য। অন্ততঃ ফারুক, রশিদ আমাকে হলফ করে বলেছে, কোন বিদেশী শক্তির সাথে তারা এ নিয়ে কখনাে যােগাযােগ করেনি। খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে আমেরিকান সি আই এ’র যােগসূত্র রয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করেন। তবে প্রকৃত অভ্যুত্থান ঘটানাের পেছনে সরাসরি কোন বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। খন্দকার মােশতাক আহমদ অগাস্ট অভুথানে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ না। থাকলেও ঘটনা প্রবাহ প্রমাণ করে নেপথ্যে তিনি ছিলেন। অভ্যুত্থানের মেজররা কোন বিদেশী শক্তির মদদে ও উস্কানিতে এ কাজ করেছে বলে নিশ্চিত কোন প্রমাণ নাই। এ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সীমিত থাকায় এর বেশী বলা সম্ভব নয়। (১৫) অগাষ্ট অভূত্থান সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারী ঝটিকা। অপারশন। এই অভুত্থানে সাফল্যজনক Execution এবং পরিসমাপ্তিতে কার ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল? মেজর ফারুক, না রশিদের? সত্যি বলতে কি ফারুক যদিও অপারেশনের মূল কমাণ্ডার ছিল, কিন্তু সে তাে আক্রমন গড়িয়ে দিয়েই খালাস আক্রমন পরবর্তি Re-Organisation বা পুনর্বিন্যাস পর্বের দুরূহ কাজটি ঠাণ্ডা মাথায় যে ব্যক্তিটি সামাল দেয়, সে হলাে মেজর রশিদ। ১৫ অগাস্টের সকাল ৬টা থেকে দক্ষ হাতে ঘূর্ণায়মান পরিস্থিতি সামাল না দিলে তাদের পুরাে অভ্যুত্থানটিই মাঠে মারা পড়তাে। এমন কি নূতন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং তাকে ধরে আনার জটিল কাজটিও ছিল রশিদের। অতএব আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে কমাণ্ডার ফারুকের চেয়ে মেজর রশিদের পাল্লাই মনে হয় ভারী।

(১) ফারুক-রশিদের অভ্যুত্থান স্রেফ দুটি ইউনিটের একক’ দুঃসাহসিক অভিযান মনে করা হলেও, ততােটুকু ‘একক’ ছিল না। ফারুক-রশিদ নিজেরাই বলেছে, আমাদের পেছনে ‘বড়রা’ কেউ না থাকলে কিভাবে এতােবড় অভিযানে অগ্রসর হতে সাহস করতাম। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তাদের পেছনে বড় ব্যাংকের কিছু অফিসার প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ মদদ জুগিয়েছিলেন। ৪৬ ব্রিগেডের নিষ্ক্রিয়তাই এর একটি দৃষ্টান্ত। ১৫ অগাস্ট অ্যুত্থান ঘটনায় জিয়ার প্রসংগে জেনারেল শফিউল্লাহ লণ্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় মন্তব্য করেন তিনি শুধু অনুমান নয়, তিনি সব কিছুই জানতেন। ভােরবেলা। ছয়টার দিকে খালেদ মােশাররফকে পাঠানাে হয় শাফায়েত জামিলের হেড কোয়ার্টারে তাকে তাড়া দেয়ার জন্য। খালেদ সেখান থেকে শফিউল্লাহকে জানান, ‘স্যার, ওরা আমাকে আসতে দিচ্ছে না। কিছু বলতেও দিচ্ছে না। এসব কিসের ইংগিত বাহক? তাহলে কি জিয়া-খালেদ-শাফায়েত তিন জনেরই অভ্যুত্থানের প্রতি নেপথ্য সমর্থন ছিল?সামগ্রিকভাবে। ঘটনা প্রবাহ গভীরভাবে পর্যালােচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে; ফারুক-রশিদ অভ্যুত্থান ঘটানাের মতাে কিছু একটা ঘটনা ঘটাতে পারে, এরকম অস্পষ্ট ইনফরমেশন আলাদা আলাদাভাবে জিয়া-খালেদ শাফায়েত রউফের কমবেশী গােচরীভূত ছিল। তারা খুব সম্ভব চেপে যান এই মতলবে যে, পাগলদের প্ল্যান যদি সত্যিই সাকসেসফুল হয়ে যায়, তাহলে ক্ষমতার মসনদে আরােহন করার সহজ সুযােগটির সদ্ব্যবহার করতে তারা যেন অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে না থাকেন। (১৭) রাষ্ট্রপতির বাসভবনের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল ও পরিকল্পনাবিহীন।

গােলযােগপূর্ণ দিনগুলােতেও তার বাসস্থানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা কেউ চিন্তা করেনি। বারবার প্রশ্ন জাগে, দোতলায় তার শােবার ঘরে ওঠার সিড়িঘরের নিচের এবং উপরের দু’টি দরজাই সারারাত কেন ভােলা থাকলাে? এ দুটো বন্ধ থাকলে তাে হামলাকারীদের পক্ষে সহজে উপরে ওঠাই মুশকিল হয়ে পড়তাে। প্রশ্নটি আমি আক্রমনকারী দলের নেতা মেজর হুদাকেও করেছিলাম। সেও মাথা চুলকে তাৎক্ষণিক উত্তর খুঁজে পায়নি। এমতাবস্থায় কামাল-জামালদের পক্ষে দোতলা থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় বহুক্ষণ প্রতিরােধ লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতাে। এতে করে আমি, রক্ষীবাহিনী বা অন্যান্যদের পক্ষে মূল্যবান Re-action টাইম পাওয়া সম্ভব হতাে। মনে হয় জামাল রাত্রিবেলা পাশের বাসায় খােশগল্প ও আড্ডা দিতে যাওয়ায় দরজা খােলা রেখে যায়, অথবা কামাল তার বাসার ওপর জাসদ বা সর্বহারা গ্রুপ ক্ষুদে হামলা চালিয়েছে মনে করে দরজা খুলে উপর থেকে নিচে ছুটে এসে রিসিপশন রুমে পুলিশের কাছে যায়। সেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারেনি। মােদ্দাকথা, সিড়ি রুমের সিকিউরিটি দরজা খােলা থাকায় হামলাকারীরা বিনা বাধায় সুড়সুড় করে একেবারে দোতলায় রাষ্ট্রপতির শয়ন কক্ষে গিয়ে হাজির হয়। রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এই মারাত্মক নিরাপত্তা-ক্রটি তার জীবননাশের জন্য বহুলাংশে দায়ী। | (১৮) ফারুক-রশিদের আক্রমন-প্ল্যানে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা এবং তাদের তরফ থেকে কোনরকম বিপদ আশকা না-করাটা ছিল রহস্যময় ব্যাপার। ফারুক তার সমস্ত ট্যাংক বাহিনী নিয়ে দুর্বল রক্ষীবাহিনীকে ঠকাবার চিন্তায় থাকে। ৪৬তম ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কথা তারা একবারও ভাবলাে না। এর রহস্য কি হতে পারে? | এ প্রশ্নটি প্রথমে আমি ফারুককে করেছিলাম।

সে বললাে; এটা রশিদকে জিজ্ঞাসা করুন, কারণ সে-ইsomehow ৪৬ ব্রিগেডকে ম্যানেজ করেছিল। আমি মেজর রশিদকে সরাসরি এ প্রশ্নটি করলাম। তার মুখে রহস্যভরা মুচকি হাসি। রশিদকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তােমরা শুধু রক্ষীবাহিনীর দিক থেকে হামলা মােকাবেলার কথা চিন্তা করলে, কিন্তু শক্তিশালী ৪৬ বিগ্রেডের দিক থেকে কোন প্রতি-আক্রমনের আশঙ্কা করলে না কেন? রশিদের ঠোটে আবার মুচকি হাসি ; বললাে, স্যার ব্যাপারটা আপনিই বুঝে নিন। তার কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। তাহলে এ জন্যই কি ভােরবেলা শফিউল্লার ফোন পাওয়ার পরও শাফায়েত জামিল তার টুপ মুভ করতে গড়িমশি করে। তাহলে এ জন্যই কি ভােরবেলা হত্যাকাণ্ডের পর মেজর রশিদ প্রথমেই ছুটে আসে ৪৬ ব্রিগেড লাইনে শাফায়েত জামিলের কাছে?“আমরা মুজিবকে। হত্যা করেছি” এ ঘটনা প্রকাশ করার পর সঙ্গে সঙ্গেইতাে শাফায়েত রশিদকে তার এরিয়াতে। আটক করা উচিত ছিল। তাই নয় কি? তা না করে সে রশিদের সাথে হেঁটে ডেপুটি চীফের। বাসার দিকে রওয়ানা দেয় কেন? এছাড়া সে চীফের দিকে না গিয়ে, ডেপুটি চীফের কাছে যাবে। কেন? | বােধকরি এজন্য ফারুক তার ট্যাংকগুলি সােজা বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ৪৬ ব্রিগেড লাইনের মধ্য দিয়ে সরু বাইপাস রােড হয়ে অগ্রসর হয়। উদ্দেশ্য, শাফায়েত জামিলকে জানিয়ে যাওয়া যে তারা টার্গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি তাই? | অগাস্ট অভ্যুত্থানের সময় শাফায়েত জামিলের দ্বৈত ভূমিকা” অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে তার হাক-ডাকের জন্য সবার কাছে গােপন থেকে যায়। অথচ খালেদ মােশাররফের মতাে। শাফায়েত জামিলও হিল শেখ সাহেৰে প্রিয় ব্যক্তি।

(১৯) রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন মহান জনপ্রিয় নেতা। তার অঙ্গুলি হেলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বলি দিয়েছে। তিনি ছিলেন বাঙালী স্বাধীনতা। আন্দোলনের আপােষহীন নেতা। অবাক ব্যাপার, তার করুণ মৃত্যুতে কোথাও টু’ শব্দটি উচ্চারিত হলাে না। তার বিশাল জনপ্রিয়তা হঠাৎ করে কোথায় যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। কেন তার মৃত্যুতে জনতার বিপ্লব হলাে না? কেন জনতার প্রতিরােধ গড়ে উঠলাে?তাহলে পঁচাত্তরে এসে তিনি কি সত্যি সত্যি সাধারণ মানুষের ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছিলেন? তিনি কি সাধারণ মানুষের ধর্ম প্রবণতায় আঘাত দিয়েছিলেন? তিনি কি সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করেননি? তিনি কি বাঙ্গালীদের আশা আকাখা পূরণ করতে পারেননি? কোথায় ছিল তার ব্যর্থতা? ইতিহাসের প্রয়ােজনে এগুলাে খতিয়ে দেখার গুরুত্ব রয়েছে। * যে ব্যক্তি বাঙালী জাতির স্বাধীন সত্তার জন্য মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সময় থেকে আয়ুব খ, ইয়াহিয়া খার সময় পর্যন্ত আজীবন সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন সহ করেছেন, তার ভাগ্যে এরকম একটি করুণ মৃত্যুই কি জাতির কাছ থেকে প্রাপ্য ছিল?

(২০) সামরিক, রাজনৈতিক পরিক্রমা

অগাস্ট অ্যুত্থানের দু’টি দিক আছে; একটা রাজনৈতিক, অন্যটা সামরিক। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগাস্ট ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করলে স্বীকার করতেই হবে ১৫ অগাস্ট অভ্যুত্থান ছিল বাংলা-পাকভারত উপমহাদেশে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। একটি নাটকীয় সশস্ত্র অভূত্থান। এর আগে এই উপমহাদেশে কেন, বিশ্বের কোথাও জুনিয়ার অফিসারগণ কর্তৃক এতবড় একটা অভ্যুত্থান এত সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করার দৃষ্টান্ত বিরল। মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারের উৎখাত ও নূতন সরকারের পত্তন! সবই এক অবিশ্বাস্য কাহিনী বটে। রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান তখন প্রবল প্রতাপশালী ব্যক্তি। তার অঙ্গুলি হেলনে আর্মি, বি ডি আর, পুলিশ, রক্ষীবাহিনী আর হাজার হাজার স্বেচ্ছাবাহিনী যুবদল মুহূর্তে ছুটে যেতে প্রস্তুত। তারই বিরুদ্ধে একটা সশস্ত্র উৎখাত অভিযান পরিকল্পনা দুঃসাহসিক কাজই বটে। অভিযান যেভাবে শুধু মাত্র দু’টি ইউনিটের লােকজন নিয়ে শুরু করা হয়, তাতে সামান্য প্রতিরােধে যে কোন মুহূর্তে তা ব্যর্থ হতে পারতাে। ব্যর্থতা ও সাফল্য ছিল অতি ক্ষীণ সুতায় ঝুলানাে। মাত্র ক’জন তরুণ অফিসার শুধু মাত্র দুটি ইউনিটের উপর ভরসা করে কতাে বড় ঝুঁকি নিয়ে যে অভিযান চালিয়েছিল, তা ভাবতেও অবাক লাগে। জুনিয়ার অফিসার বিধায় তাদের প্রতি এই দুটি ইউনিট ছাড়া আর কোন আর্মি ইউনিট বা ফরমেশনের সমর্থনও ছিল না। কেউ কিছু জানতােও না। এই অভিযানে মিলিটারি অপারেশনের প্রত্যেকটা Priniciple বা সমরনীতির চমৎকার সমন্বয় ঘটেছিল, যথা a. Maintenance of Aim b. Security of Information c. Surprise and Deception d. Timings e. Bold & quick Execution f. Quick Consolidation and Reorganisation g. Exploitation of success. সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে, সামরিক বাহিনীর নামে ক্ষমতা দখলের ঘােষণা করলেও সামরিক বাহিনীর চীফসহ সকল সিনিয়র অফিসারই এই অভ্যুত্থানের প্ল্যান প্রােগ্রাম সম্বন্ধে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। বরং ১৫ অগাস্টের ভােরবেলা খােদ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সকল অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ একটি সেনা-অভ্যুত্থানের সংবাদ পেয়ে যারপরনাই বিস্মিত হয়। সবার চোখে ধূলাে দিয়ে সবাইকে বােকা বানিয়ে ক’জন তরুণ অফিসার গােটা সামরিক বাহিনীর নামে যেভাবে একটা অভ্যুত্থানের ভােজবাজী দেখালাে, তা সামরিক বাহিনীর জন্য এক বিরাট বিস্ময় হয়ে থাকবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর ইসলামিক ভাবধারা ও ইসলামপন্থী রাজনীতির সমাধি রচিত হয়েছিল।

অগাস্ট অ্যুত্থানের পর আকস্মিকভাবে ইসলামপন্থী দলগুলাের উপর থেকে নিষিদ্ধ আবরণ অনেকখানি সরে গেল। আবার তারা ভেসে উঠবার সুযােগ পেয়ে গেল। সমাধি রচিত হলাে বহু বিতর্কিত বাকশালের। প্রমাণিত হলাে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদশন সত্বেও এদেশে ধর্ম সাধারণ মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বলতে গেলে বলা যেতে পারে, এরকম সশস্ত্র অভ্যুত্থান ভবিষ্যত হিংসা ও সশস্ত্র রাজনীতির বীজ বপন করলাে। জনগণ হয়তাে বাকশাল আওয়ামী লীগ

সরকারের পরিবর্তন চেয়েছিল, কিন্তু শেখ সাহেবের ও তার পরিবারের মর্মান্তিক মৃত্যু কামনা করেনি। শেখ সাহেব ছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক, জাতির অবিসংবাদিত নেতা, যার প্রতি বাংলার মানুষ তাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অকৃপণভাবে উজাড় করে দিয়েছিল। ভবিষ্যতে এত বিশাল মাপের বেসামরিক রাজনৈতিক নেতার উথান অন্ততঃ এদেশে ঘটার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। বাঙালী জাতির ইতিহাসে জাতিধর্ম নির্বিশেষে এতাে অধিক সংখ্যক লােক কোনদিন একটি ব্যক্তির পেছনে এতাে অন্ধভাবে দাড়ায়নি। এতাে বিশাল জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা নিয়ে তার মতাে রাজনৈতিক নেতার ব্যর্থতা ও অকালমৃত্যু, চিরশােষিত এই অভাগা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে। | তার মৃত্যু বাঙলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সামরিক শাসনের এবং সামরিক গােষ্ঠির লােকজনদের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে দিলাে, যার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া হয়তাে এ জাতির পক্ষে কোনদিন সম্ভব হবে না।

সূত্র : তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা – লে. কর্ণেল (অব.) এম এ হামিদ পিএসসি

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!