You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাজউদ্দীন আহমদের প্রচেষ্টা

জনসংখ্যার উচ্চ হার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতাহেতু বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্রতম (Least Developed) দেশগুলাের অন্যতম। ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে। বাংলার শেষ গভর্নর উইলিয়াম বারােস যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলা বিভক্ত হলে তা হবে পৃথিবীর অন্যতম ‘কৃষি বস্তি’ । এ ধরনের একটি পশ্চাদপদ। অঞ্চল বাংলাদেশ পরপর দুবার দীর্ঘস্থায়ী ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকার পর সর্বব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। কিছু ঐতিহাসিক কারণে স্থানীয়ভাবে উল্লেখযােগ্য কোনাে শিল্প-কল-কারখানা এখানে গড়ে উঠতে পারেনি। তদুপরি এই অঞ্চলটি উল্লেখযােগ্য খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদ থেকেও বঞ্চিত। কোম্পানির শাসনামল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক মানুষ পুজিপতি বা বিত্তশালী হতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়ার কারণে এসব পুঁজিমালিক জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার তাগিদে পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে। অন্যদিকে এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন। এ সময় সীমিত পরিসরে যে সব শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে তার মালিকেরাও ছিল অবাঙালি। তারা পূর্ব বাংলার অর্জিত মুনাফা ও পুঁজি ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করে। বস্তুত পূর্ব বাংলার উর্বর কৃষিক্ষেত্রে পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ পাট উৎপাদিত হতাে। কিন্তু শিল্প ও পুঁজিমালিকরা পাটকেন্দ্রিক অর্থনীতির সুযােগ সুবিধা পূর্ণমাত্রায় ভােগ করলেও কৃষি উৎপাদনের আধুনিকায়নের কোনাে পদক্ষেপই গ্রহণ করে নি।

পূর্ব বাংলার প্রকৃতিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা প্রতি বছরই কোনাে না কোনাে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ফলে এখানকার মানুষের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণের মতাে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত গড়ে তােলা হয় নি। শুধু তাই নয়, উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সুশাসন— শাসন ব্যবস্থাকে জনকল্যাণে নিয়ােজিত করা। কিন্তু এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ঔপনিবেশিক মানসিকতার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধটি সংঘটিত হওয়ায় সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা শিল্প পুঁজিমালিকরাও বাংলাদেশ ত্যাগ করে । যুদ্ধজনিত কারণে সামগ্রিক অবকাঠামাের ক্ষতি সাধিত হয় এবং উৎপাদন তথা কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে বাংলাদেশের জন্ম হয় একটা ধ্বংসস্তুপের ওপর। সবকিছুই শুরু করতে হয় শূন্য থেকে । কাজেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারকে যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য অগ্রসর হতে হয় সীমাহীন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে, যা দেশকে শত্রুমুক্ত করার চেয়ে কোনাে অংশেই কম নয়। সার্বিকভাবে পুনর্গঠনের এ কাজ দুরূহ হয়ে ওঠে যুদ্ধপরবর্তী সামজিক বিক্ষিপ্ততা, অস্থিরতা এবং মানুষের স্বপ্নাশ্রয়ী প্রত্যাশার কারণে । এর সাথে যুক্ত হয় বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং কোনাে কোনাে রাষ্ট্রের বাংলাদেশবিরােধী চক্রান্ত। এ ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্র বাস্তবতায় সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রয়ােজন সমগ্র জাতিকে সংঘবদ্ধ রাখা, যুদ্ধের ন্যায় সমগ্র জনগণকে সামষ্টিক প্রচেষ্টার সঙ্গে একীভূত করে রাখা। সেজন্য প্রয়ােজন নেতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, ত্যাগ, দায়বদ্ধতাবােধ, সততা, নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা প্রভৃতির ন্যায় মহৎ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গুণাবলির।

পুনর্গঠন প্রচেষ্টা

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই সদ্য আত্মপ্রকাশকারী বাংলাদেশের নতুন সমাজ নির্মাণের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয় উপলব্ধি করেন। দূরদর্শী সেই উপলব্ধি থেকেই ড. মােজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন যার প্রতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদ কতটা গুরুত্ব প্রদান করেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৭ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার ভাষণে । নবতর সংগ্রামের জন্য আহ্বানের শেষাংশে উচ্চারিত বক্তব্য থেকে তাজউদ্দীন আহমদের উন্নয়ন দর্শন ও পুনর্গঠন প্রচেষ্টার সম্যক ধারণা পাওয়া যায়:১৫৭৮

*১৫৭৮ হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র,, তৃতীয় খণ্ড (ঢাকা: তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২), পৃ. ৩২২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা এলাে এক রক্তাপুত ভূমিতে, এক ধ্বংসস্তুপের মধ্যে । জনগণের আশা ও আকাঙক্ষা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে। দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুণঃনির্মাণ নয়-নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা পেয়েছি, সেই ঐক্য ও ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে এলে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর ভার তার ওপর ছেড়ে দিয়ে মুজিবের একজন যােগ্য, সফল ও গর্বিত সহকর্মীর পরিচয় দেন। শাসনতন্ত্র রচিত না হলেও দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতে থাকে সংসদীয় রীতিতে। সঙ্গত কারণেই প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি অর্পিত হয় অর্থ, পরিকল্পনা ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।১৫৭৯ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে যে কোনাে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বাগ্রে যে কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হলাে সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা স্থাপন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ। এগুলাে যথাযথভাবে করা না হলে যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য প্রতি-বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের আবর্তে তলিয়ে যেতে পারে। এ জন্য প্রয়ােজন যুদ্ধ পরবর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি অটল থেকে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে যাওয়া। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের চেতনাসমৃদ্ধ একজন যােগ্য প্রশাসক এবং মুজিবের উপস্থিতিতে যথাযথ দায়িত্বই প্রাপ্ত হন। দেশ পুনর্গঠন সম্পর্কিত তার দর্শনের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তার তত্ত্বাবধানে মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত প্রতিবেদন হতেও। এতে একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামাের প্রায় সার্বিক রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় যার মূল বক্তব্য ছিল জনপ্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলা। কিন্তু নানা কারণে সেটা কার্যকর করা সম্ভব হয় নি। তবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতি দৃষ্টি রেখে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য সমান অধিকার

————-

১৫৭৯ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০০), পৃ. ১৯৬। ১৫৮৫ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৫৪-৫৭৩।

. আবুল মাল আবদুল মুহিত, জেলায় জেলায় সরকার-স্থানীয় সরকার আইনসমূহের একটি পর্যালােচনা (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০২), পৃ. ৬৮-৬৯।

স্বীকৃত এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল ও বিকেন্দ্রীকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়, যার মূল লক্ষ্য ছিল শােষণহীন গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরেপক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তােলা।১৫৮২

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধিতার বিষয়টি মনে রেখে বিজয় লাভের পর স্পষ্টভাবে বলেন প্রয়ােজনে দারিদ্র্য ভাগাভাগি করে নেবেন, তবু আমেরিকার কোনাে সাহায্য গ্রহণ করবেন না। কিংবা সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন কোনাে সাহায্য বাংলাদেশের জনগণের কাম্য নয়। তার এই মনােভাবকে কেবলমাত্র আবেগের বিষয় বলে মনে করা যায় না। এটা রাজনীতিতে তার বাস্তবতাবােধ ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। বস্তুত তিনি জানতেন বিদেশী সাহায্যের সঙ্গে আসে বৈদেশিক নানা প্রকার শর্ত, যা প্রায়ই ঋণ বা সাহায্য গ্রহণকারী দেশের নতজানু হয়ে থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় যদি ঐ দেশটির সাহায্য কিংবা ঋণ গ্রহণ করা হয় তাহলে অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরােধী ভূমিকায় আমেরিকা অবতীর্ণ হবে। তবে দেশে ফিরে তিনি বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে বলেন সাহায্য যে কোনাে দেশের নেয়া যেতে পারে, কিন্তু তা যেন কোনভাবেই দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরােধী না হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে তিনি ভারত সফরে গিয়ে দিল্লিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন আজকের বিশ্বে কোনাে দেশ একে অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। এ জন্য পারস্পরিক সাহায্যসহযােগিতার প্রয়ােজন। তাই আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে কোনাে দেশেরই শর্তহীন সাহায্যকে স্বাগত জানাবে ।* বােধের এ স্তরে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গােড়ার দিকে একটি সূত্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদ জানতে পারেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করে দেওয়ার লক্ষ্যে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ. নতুনভাবে চক্রান্ত শুরু করেছে। এ সময় বাংলাদেশকে সাহায্যের জন্যে কানাডীয় উন্নয়ন সংস্থার প্রধান মসিয়ে লাজোয়া বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ৪৫ মিলিয়ন। ডলারের অনুদান দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিষয়টি একটু বেশি প্রচারিত

——

Shyamali Ghosh, ‘Constitutional Changes in Bangladesh, India Quarterly, Vol. XLll, No. 4, Oct-Dec., 1986, pp. 392-393. ১৫৮৩, দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ১৫৮৪ দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুযারি, ১৯৭২।

| আবুল মাল আবদুল মুহিত, ‘আমার দেখা তাজউদ্দিন আহমদ, মাহবুব করিম। (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও মানুষ (ঢাকা: জাগৃতি প্রকাশনী, ২০০২), পৃ.

হওয়ায় এবং পারিপার্শ্বিক কিছু কারণে তাজউদ্দীন আহমদ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই আমেরিকার সাহায্য গ্রহণ করার প্রশ্নে তাজউদ্দীন আহমদের কঠোর মনােভাব আন্তর্জাতিক মহলেও প্রথমে নানা গুজবের জন্ম দেয়।” একক কোনাে দেশের কাছ থেকে সাহায্য বা ঋণ গ্রহণের

পরিবর্তে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের জন্য জাতিসংঘের UN Relief for | Bangladesh মিশনের সাহায্য প্রার্থনা করে। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ কমিটির পক্ষে বিশ্বব্যাংক,আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসেন। সাহায্যের ধরন নিরূপণ করার জন্য গঠিত | এই কমিটির নেতৃত্ব দেন ভারতে নিযুক্ত অস্ট্রীয় রাষ্ট্রদূত মিসেস আরনা জাইলার । কমিশন প্রথমেই অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায়। ইতােমধ্যে তার পরামর্শে কৃষি উপকরণ, যােগাযােগ ব্যবস্থা তথা অভ্যন্তরীণ পরিবহণ প্রভৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে চাহিদাপত্র প্রস্তুত করা হয়। আলাপকালে তাজউদ্দীন আহমদ সরাসরি সাহায্য না চেয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসলীলার একটি বর্ণনা দেন। এ সম্পর্কে তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন:১৫৮৮

…পরদিনই জাইলার মিশনকে নিয়ে আমি মন্ত্রী সাহেবের দপ্তরে গেলাম। তিনি তার নিজের মতাে করে দেশের ধ্বংসলীলার একটি চিত্র দিলেন আর এও জানালেন যে, এই খেসারত দেশটি দিয়েছে শুধু তাদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি কোথায় কোন্ ক্ষেত্রে জরুরি সাহায্য প্রয়ােজন, তার হিসেব দিলেন। এও বললেন যে, রপ্তানী প্রক্রিয়াকে সত্বর জোরদার করতে হবে, সমুদ্রপথ বিপদমুক্ত করতে হবে এবং বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে জোর দিতে হবে। আমরা যারা মিশনের সঙ্গে ছিলাম, তাদের বুক কয়েক ইঞ্চি সম্প্রসারিত হল । মন্ত্রী খুব গােছালাে কায়দায় যুক্তির সঙ্গে তার বক্তব্য ও দাবি বা আশা তুলে ধরলেন । মিশনের যখন বিদায়কাল ঘনিয়ে এল তখন জাইলার আমাকে জানালেন যে, মন্ত্রীর কথাগুলােকে ভিত্তি করেই তারা তাদের অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং

তাদের কার্যক্রম প্রণয়ন করেছেন। ১৯৭২ সালের ৬ মার্চ ঐ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলােচনাক্রমে আশু পুনর্গঠনের বিষয়ে আলােকপাত করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বিপুলসংখ্যক মানুষের পুনর্বাসন, তাদের প্রতিদিনের খাদ্য সরবরাহ, খাদ্য ঘাটতি, কৃষি ও শিল্প

১৫৮৬. আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকার, ১১ নভেম্বর, ১৯৯৬।

ঐ।

——

১৫৮ ৬আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমার দেখা তাজউদ্দিন আহমদ, মাহবুব করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪।

ক্ষেত্রে উৎপাদন শুরু করার জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণের অভাব প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন।১৫৮৯ এর কিছুকাল পরে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা ঢাকায় আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ পরিকল্পনা কমিশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পুনর্গঠনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমেরিকার এই নাগরিক তীক্ষ স্মৃতি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত। তিনি প্রথমে তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কাজের চাহিদার বিষয়ে বলতে অনুরােধ জানান। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন একেবারে গােড়া থেকে কাজ শুরু করার জন্য এই মুহূর্তে কিছু গরু, সেগুলােকে বেঁধে রাখার জন্য দড়ি ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দরকার। তার এ ধরনের চাহিদার কথা শুনে সকলেই হতচকিত হয়ে যান। ১৫৯০ কিন্তু এর দ্বারা তাজউদ্দীন আহমদ মার্জিত কূটনৈতিক উপস্থাপনার মাধ্যমে যথার্থভাবেই বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের সামগ্রিক কাঠামাে ধ্বংস করে দিয়েছে । তাই প্রয়ােজন সর্বব্যাপী, এই মুহূর্তে জরুরি প্রয়ােজন কৃষি কাজ শুরু করা। এর মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের আমেরিকার প্রতি কতকটা ক্ষোভ ও খানিকটা বিদ্রুপ প্রকাশিত হয়। তীক্ষ্ণধী ম্যাকনামারা সহজেই বুঝতে পারেন তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের সহায়তাকারী আমেরিকার প্রতি কতটা ক্ষুব্ধ।

যাহােক, বিরূপ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেশ পুনর্গঠনের শুরুতেই সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের ফেলে যাওয়া কল-কারখানাগুলাের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিরাষ্ট্রীয়করণ অধ্যাদেশ প্রণীত হলে পাট, বস্ত্র ও চিনিকল, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানের মতাে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের আওতায় আসে। সব মিলিয়ে দেশের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ থেকে প্রতিশ্রুত সুষম বণ্টন এবং সমাজতন্ত্র অভিমুখী আর্থিক যাত্রার স্পষ্ট লক্ষণ ফুটে ওঠে। কিন্তু বাস্তব নানা কারণে

———

১৫৮৯ দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ মার্চ, ১৯৭২। **Nurul Islam, Making of a Nation: Bangladesh, An Economist’s Tale (Dhaka: The University Press Limited, 2003), p. 250. ১৫৯ মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকাল (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৩), * ২৬-২৭।

ব্যবস্থাপনাসহ এগুলােকে পুনঃউৎপাদনক্ষম করে গড়ে তােলা সহজসাধ্য ছিল না। এ সম্পর্কে সমাজ বিশ্লেষক ড. রংগলাল সেন লিখেছেন:১৫৯২

মুক্তিসংগ্রামে যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তা জাতীয় অর্থনীতির স্বাধীনতা বিকাশের লক্ষ্যে কতক প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বৃহৎ শিল্প, বীমা ও ব্যাংক ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয় । কিন্তু উন্নয়নের অনুসৃত এ পথকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তক্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পর্যাপ্ত সাংগঠনিক শক্তি ও দক্ষতা ছিল।

। অন্যদিকে, দেশের উন্নয়নের প্রয়াসকে সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল করে তােলা তথা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যাভিমুখী উক্ত অর্থনৈতিক বিকাশের পথ পরিত্যাগ করার জন্য পাশ্চাত্যের সাহায্যদাতা পুঁজিবাদী দেশ থেকে প্রচুর চাপ আসে। সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী দেশীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিসমূহ একসাথে দেশের উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু শাসকদল দেশের ভেতর ও বাইরের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট সচেতনতা প্রদর্শন করতে পারেনি।

বাস্তব (Physical) অর্থ-সম্পদের অভাব ছিলই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সুষম বণ্টনযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের কথা ব্যক্ত করেন এবং বিজয় লাভের পর সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের পদক্ষেপের বিরােধিতাও শুরু হয়ে যায়। এ বিরােধিতার অধিকাংশই ছিল তাজউদ্দীন আহমদের উন্নয়ননীতি ও কৌশলবিরােধী। তাজউদ্দীন আহমদ দেশে পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য জাতীয়করণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এমন একটি উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা হবে যাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুঁজিবাদের প্রতি উৎসাহ দেখানাে হবে না১৫৯৩, যার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অভিমুখে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। কিন্তু এ ধরনের প্রচেষ্টার জন্য প্রয়ােজন ন্যূনতম জাতীয় ঐক্য। এ কারণে তিনি জাতীয় বিষয়গুলােকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। কেবল সেই উপায়েই বাংলার আপামর মানুষের প্রকৃত মুক্তি ঘটানাে। সম্ভব। তিনি বলেন অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করে মেহনতি মানুষের সন্তুষ্টচিত্তের ওপর।১৫৯৪ তাই ‘পাকিস্তান’ শব্দের পরিবর্তে বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করলেই কেবল মানুষের

———

১৫৯২, ডক্টর রংগলাল সেন, সমাজকাঠামাে: পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র (ঢাকা: নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ১৯৯৭), পৃ. ১২২। ১৫৩, দৈনিক পূর্বদেশ, ৭ জুলাই, ১৯৭৩। ১৫৯৪ ঐ, ৩ এপ্রিল, ১৯৭২

মুক্তি আসবে না। তিনি সতর্ক মন্তব্য করেন যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অর্জিত সুফল জনগণের দোর গােড়ায় পৌছে দিতে না পারলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে এবং সার্বিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার পর সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি ওঠে। কিন্তু তাদের সমাজতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ধারণার পার্থক্য ছিল। বিস্তর । এ সম্পর্কে তার ঘনিষ্টজনদের পর্যবেক্ষণ নিমরূপ:১৫৯৬

তার কথা ছিল যে, আমরা সবাই সমাজতন্ত্রের বৈষম্যহীন সমাজে আকৃষ্ট; কিন্তু কি করে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবাে জানি না। পশ্চিমের শিক্ষালয় থেকে আহরিত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকথা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা দুঃসাধ্য। সরকারি খাতে উদ্বৃত্তের ব্যবস্থা করে বিনিয়ােগের প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ করের কি কোনাে ভূমিকা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হতে পারে? প্রয়ােজন মতাে সম্পদ যদি সবাইকে নিশ্চিত করা হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ করের তাে কোনাে অবকাশ থাকে না । অথচ উদ্বৃত্তের জন্য প্রত্যক্ষ কর এবং বৈদেশিক বাণিজ্য করই হচ্ছে প্রধান উপাদান। আমাদের বৈপ্লবিক অনুভূতিটি এত স্বল্পস্থায়ী এবং স্বার্থের সমাহারে এত জটিল যে, এর উপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ । আমাদের নেতৃত্বও যে তার জন্য প্রস্তুত আছে, তাও দাবি করা যায় না। আমার মনে হলাে স্বপ্ন আর বাস্তবের সংঘাত, আদর্শ ও প্রয়ােগের মধ্যে ফাক নিয়ে তিনি ছিলেন গভীরভাবে চিন্তি ত। প্রতিটি আলােচনায় বাংলাদেশের সমস্যা ও সাফল্যের কৌশল নিয়ে তার বক্তব্য ছিল স্পষ্ট।

ধ্রুপদি সমাজতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী সম্পর্ক এবং উন্নয়নের বিষয়ে এ ধরনের গভীরতর তত্ত্বগত বােধের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন দর্শন হিসেবে তার মনে এ সময় সীমিত পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতির সমন্বয়ে একটি নতুন মডেল দাঁড় করাবার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। তবে তিনি এও উপলব্ধি করেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন আমি নির্ভেজাল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতন্ত্রের নামের পূর্বে কোনাে বিশেষণ ব্যবহারের প্রয়ােজন হয় না। সমাজতন্ত্র শব্দটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এটি প্রতিষ্ঠার কোনাে সংক্ষিপ্ত পথ নেই। তিনি আরাে বলেন, মানুষ যাতে অবাধে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে সে জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রটি হবে গণতান্ত্রিক কিন্তু অর্থনৈতিক কাঠামাে হতে হবে অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক। ১৯৯০ সালে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর বিশেষজ্ঞ মহলে যে

——-

১৫৯৫ দৈনিক বাংলা, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

১৫৯৬ মাহবুবুল করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৬। ১৫৯৭ দৈনিক বাংলা, ২১ জুলাই, ১৯৭২।

কথাটি বিশেষভাবে আলােচিত হয়, তা হলাে সেখানে মত প্রকাশের সুযােগ ছিল।

। ফলে ভেতরের অসংগতি ও দুর্বলতার কথাগুলাে জানা যায়নি। কাজেই পতন হয় অকস্মাৎ এবং বিস্ময়করভাবে । তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রকে যেভাবে উপলব্ধি করেন, পরিবর্তনশীল বিশ্বে সেটাই যথার্থ বলে মনে হয়। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তথা বুদ্ধিদীপ্ত সম্প্রদায়টিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হতে লক্ষ করা যায়। এর প্রভাব পড়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধান জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগেও। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগকে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আরাে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে এর নীতি নির্ধারকরা জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে যুক্ত করেন। বস্তুত দলটি ১৯৪৯ সালে জন্মক্ষণ থেকে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও ১৯৬৪ সালে দলের গঠনতন্ত্রে সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে স্পষ্ট বক্তব্য উচ্চারিত হয়। সুষম বণ্টনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলােকে স্বীকার করে নিয়ে বলা হয় সমাজের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে হলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব। নির্বাচনের পূর্বে দলটি ১৯৬৯ সালের কাউন্সিলে সমাজতন্ত্রকে তার অন্যতম আদর্শ হিসেবে মূল, ভারী ও বৃহৎ শিল্প, ইস্পাত শিল্প, সমর শিল্প, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক শিল্প জাতীয়করণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।১৭৯৯ অর্থনৈতিক আদর্শ হিসেবে আওয়ামী লীগ স্বাধীন, শােষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতন্ত্রকে মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করে । মুক্তিযুদ্ধে সমাজতন্ত্রের উপাদান ও স্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশকিছু বৃহদায়তনের শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয় । কিন্তু একটি জাতীয়তাবাদী দল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে? ধ্রুপদী সমাজতান্ত্রিক দার্শনিকরা মনে করেন কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে । ১৮৭১ সালে ৭২ দিন পর্যন্ত প্যারি কমিউন টিকে থাকার পর আবার সেখানে পাল্টা-অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে স্বয়ং কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বকে অধিকতর প্রাধান্য দেন । বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘটিত এসব ঘটনাবলি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ যেমন জ্ঞাত ছিলেন তেমনি। পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনৈতিক বিকাশের স্তর সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এখানে জাতীয় বুর্জোয়ার এবং মধ্যবিত্তের বিকাশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।

——-

Shyamali Ghosh, The Awami League 1949-1971 (Dhaka: Academic Publishers, 1990), Appendix III, pp. 289-292 এবং ড. আবুল কাশেম (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ: ঐতিহাসিক দলিল (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০১), পৃ. ২০১। ১৫৯৯ ড. আবুল কাশেম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৭।

ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং অন্যান্য অনুষঙ্গের প্রেক্ষিতে এখানে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়। তদুপরি এটি একটি পশ্চাদপদ কৃষি অর্থনীতির অঞ্চল। শ্রমিক শ্রেণীও নগণ্য প্রায় ১৬০০ কাজেই শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে যাওয়ার বিষয়টি অলীক কল্পনামাত্র। বরং কৃষি ক্ষেত্রের উন্নতির পাশাপাশি ন্যায্য বণ্টনভিত্তিক একটি সমাজ কাঠামাে এবং উদার জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই প্রায়ােগিক রাজনীতির পরিচায়ক হতে পারে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে পূর্ববর্তী শাসনযন্ত্রের প্রায় কোনাে পরিবর্তনও করা হয়নি। তদুপরি আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক মানসিকতাও বর্তমান ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ এমতাবস্থায় একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তােলার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। দেশজ উপাদানের সমন্বয়ে নতুন আদলে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা তার মধ্যে জন্মলাভ করে। বস্তুত স্বাধীনতার পর তিনি সমাজতন্ত্রের কথা ব্যাপকভাবে উচ্চারণ করেন এবং সে লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মানুষকে সমবায়ভিত্তিক চাষ ও উৎপাদন পদ্ধতিতে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক হিসেবে সম্ভবত তিনি এই কৌশল অবলম্বন করেন যাতে জনগণ মনে করতে পারে সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের কর্মসূচি আওয়ামী লীগ। রাজনীতি দ্বারাই পূরণ করা সম্ভব । অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে নতুন এই দেশে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করাই তার লক্ষ্য। বস্তুত সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে একটি মূল। আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয় যা সমাজতান্ত্রিক দলগুলাের পক্ষ থেকেও

———

১৬০০ “১৯৬৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৮ কোটি লােকের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কল-কারখানা ও শিল্পে নিয়ােজিত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ লক্ষ ৮২ হাজার ৩৪৬ জন।” ডক্টর রংগলাল সেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৮। ১৬০৯ এ বিষয়ে দেখুন, মােহাম্মদ আনিসুর রহমান (সম্পা.), যে আগুন জ্বলেছিল (ঢাকা: গণপ্রকাশনী, ১৯৯৭) গ্রন্থখানি । ১৬০২, “সমাজতন্ত্রের দাবি সাময়িকভাবে মেনে নিতে হয়েছিল, তার কারণ জনগণকে শান্ত করবার ইচ্ছা। জনগণ যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছে দেশকে, তারা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেই, তাই সমাজতন্ত্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার কনেওয়া হয়েছিল- দেশের শাসনতন্ত্রে । ভয় ছিল যে, কিছুটা যদি এগোনাে না যায়, ঢিল যদি না ছাড়া যায় তবে দড়ি ছিড়ে যাবে। তাতে বামপন্থীদের সুবিধা হবার কথা।” সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয় (ঢাকা: ইউনিভার্সিটি পেস লিমিটেড, ১৯৯৯), পৃ. ১১৭।

৫১০

আংশিক সমর্থন লাভ করে।১৬০৩ কৃষকদের উন্নতি হলে একটা ভারসাম্যপূর্ণ আর্থসামজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব—এমনতর গভীর বােধ থেকেই তার চেতনায় সমাজতন্ত্রের নবতর এই সংস্করণের উৎপত্তি ঘটে বললে অত্যুক্তি হবে না। তদুপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে সকল দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল সেগুলাে সমাজতান্ত্রিক রীতিতে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির মাধ্যমে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়, এটিও তার অনুপ্রেরণার একটি কারণ হতে পারে। অন্যদিকে নেতৃস্থানীয় ধনতান্ত্রিক দেশগুলাের চেষ্টা থাকে সদ্যস্বাধীন কোনাে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না দেয়া। তাদের এই কাজকে সহজতর করে দেয় বিশ্বের আর্থিক সংস্থাগুলাে তাদের বিভিন্ন ধরনের ঋণ-শর্তের মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উন্নয়ন কৌশল হিসেবে একদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে সচেষ্ট হন, অন্যদিকে দেশের স্বার্থবিরােধী জটিল শর্তের কোনাে ঋণ গ্রহণ না করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে পক্ষ-বিপক্ষের দেশগুলাের নীতি ও আদর্শ তার ওপর অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনায় দেখা যায় যে, পুজিবাদী দেশগুলাের সাহায্য দানের শর্ত ছিল বেশ কঠিন, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সাহায্য দানের সক্ষমতা কম থাকলেও যে সাহায্য দেয় তা ছিল বেশ সহনীয়। তাই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে চারটি বাজেট উত্থাপন ও একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তাতে সমাজতান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বস্তুত মানুষের প্রত্যাশা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি মনে রেখে তাজউদ্দীন আহমদ মিশ্র অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বিবেচনায় আনেন। তাজউদ্দীন আহমদের পুনর্গঠন প্রচেষ্টা ও উন্নয়ন দর্শন সেভাবেই একজন সােভিয়েত লেখকের পর্যবেক্ষণেও বিধৃত

হয়েছে।১৬০৫

——-

১৬০৩ মােজাফফর ন্যাপের শীর্ষ নেতারা বস্তুত খসড়া সংবিধান সম্পর্কে সমালেচনা করে বলেন, সংবিধানে সমাজতন্ত্রের প্রতি সদিচ্ছা ব্যক্ত করা হলেও তা বাস্তবায়নের আইনগত দিক নির্দেশনা নেই । দেখুন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, মওলনা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকা: হাক্কানী পাবলিশার্স, ২০০৩), পৃ. ৪৫২। ১৮০৯ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়া ও সাম্প্রতিক বিশ্ব (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ১৮। ৬০০ ইভান শেদ্রোক, আমাদের অলক্ষেই মন্ত্রী ঘরে ঢুকলেন, প্রথম আলাে, ২৪.৭.২০০৬। ইভান শেদ্ৰোক অভিজ্ঞতার আলােকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ, উৎত্রা নােভােই ঝিজনি (বাংলাদেশ, নতুন দিনের সকাল) নামক একখানি গ্রন্থ লিখেন যাতে তাজউদ্দীন আহমদের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন দর্শন সম্পর্কে আলােকপাত করেছেন।

কিন্তু তার হৃদয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার মহৎ উদ্দেশ্য থাকলেও বিজয় লাভের অল্প পরেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা বিরুদ্ধ শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার নানা অপতৎপরতা শুরু হয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি দেশি-বিদেশী কোনাে কোনাে মহলের প্রতিশােধের শিকার। হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট এবং সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ে তােলার পরিপন্থী নানা প্রকার তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন অরাজকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা, লুটতরাজ, রাহাজানি প্রভৃতি সমাজবিরােধী কাজ যারা করছে তারা মূলত সমাজের শত্ৰু, কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনীর নাম ব্যবহার করে এ ধরনের কাজ যারা করছে তারা প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধা নয়। প্রকৃতপক্ষে এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বীরদের প্রতি অপপ্রচার চালানাে। ১৬০৬তাজউদ্দীন আহমদ যথার্থই অনুধাবন করেন দেশের পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সর্বোপরি সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রয়ােজন একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখা, তেমনি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সহনশীলতা, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক বােঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং ক্ষমতাসীন দল হিসেবে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্বই বেশি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের ভাষণে এ বিষয়ে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন যে, আওয়ামী লীগকে সহনশীলতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেননা সহনশীলতা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হতে পারে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেন সমাজ জীবনে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে তিনি সাংবাদিকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। তাদের প্রতি তিনি আহ্বান রাখেন, তারা যেন গঠনমূলক সমালােচনা উপহার দিয়ে সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযােগিতা করেন। তিনি মনে করেন দেশের সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত রেখে তাদের সাথে নিয়ে কাজ করলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যায়। ফলে মানুষের মনে মিথ্যা আশার জন্ম হয় না। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি সপরিবারে নিজ গ্রাম কাপাসিয়ায় যান। সেখানে একটা বীরােচিত গণসংবর্ধনায় ঐ এলাকার মানুষেরা ভালবেসে তাদের ‘তাজু ভাই’কে ‘বঙ্গতাজ’ উপাধিতে ভূষিত করে। সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি এক পর্যায়ে জনগণের প্রতি আহ্বান রাখেন সরকার কীভাবে দেশ চালাচ্ছে সে বিষয়ে সজাগ

——–

১৬০৬ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৪ মার্চ, ১৯৭২। ১৮০৭ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০। ১৬০৮ দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ মার্চ, ১৯৭২।

নজর রাখা এবং ভুল-ভ্রান্তি হলে তা শুধরে দেয়ার জন্য।১৬০৯ এ সময় গ্রামের সাধারণ মানুষেরা আশা ব্যক্ত করে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পুড়িয়ে দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের পৈতৃক টিনের বাড়িটি হয়তাে এবার সংস্কার করা হবে। তারা তার নিকট গ্রামের কাঁচা রাস্তাটি পাকা করার দাবি জানায়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ সুহে বলেন যে, তিনি বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, সমগ্র দেশের আর্থিক মঙ্গল করা তার দায়িত্ব। কাজেই সারা দেশে অসংখ্য গৃহহারা মানুষের পুনর্বাসন কিংবা সারা দেশের বিধ্বস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার না করে তিনি। নিজের বাড়ি ও এলাকার কাজ কীভাবে করবেন!১৬১০ | অর্থনীতির ছাত্র রাজনীতিক তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার আর্থিক বিধি-ব্যবস্থার বিষয়ে বিস্তর চিন্তা-ভাবনা করে এসেছেন। এখন বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার কাঁধে । কিন্তু এটা কোনাে স্বাভাবিক সময় নয়; এটা একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যার শুরু করতে হয়েছে শূন্য বা নেতিবাচক অবস্থান থেকে। জাতীয় পর্যায়ে মানুষের প্রত্যাশার বিস্ফোরণ ঘটেছে যার রাশ টেনে ধরতে না পারলে নিশ্চিত অমঙ্গল নিহিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে যথেষ্ট সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা বা অনুরূপ নেতৃস্থানীয় দেশের প্রচেষ্টায় বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহ সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী এই দেশটিকে শক্ত ঋণ-শর্তে বেঁধে ফেলতে উদগ্রীব। উপায়, অবস্থান ও প্রত্যাশার বিপরীত এই গতিপ্রকৃতিকে সমন্বিত করা খুব কঠিন কাজ। এই দুঃসাধ্য কাজকে আয়ত্তে আনার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থার চেয়েও যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এমন কি ছুটির দিনেও তাজউদ্দীন আহমদ অফিসের ফাইল-পত্রের বিশাল স্তুপের মধ্যে ডুবে থাকেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই সময়ের কর্মস্পৃহা সম্পর্কে এক চমৎকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ডাক্তার টি, হােসেন কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য থেকে। ডাক্তার টি, হােসেন এই গবেষককে বলেন, দেশে ফিরে অতি দ্রুত শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি। এক পর্যায়ে মুজিব এ বিষয়ে আলােচনার জন্য ছুটির দিন (রবিবারে) টি, হােসেনকে তার বাসায় যেতে বলেন। নির্দিষ্ট দিন সকালে তিনি সেখানে গিয়ে পৌছানাের পর কোনাে কারণবশত মুজিব তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় টেলিফোন করেন। উত্তরে জোহরা তাজউদ্দীন জানান খুব সকালে তাজউদ্দীন আহমদ কোথায়

——

১৬০৯, দৈনিক বাংলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২। ১৬১০ সিমিন হােসেন রিমি,আমার ছােট বেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দিন আহমদ (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০১), পৃ. ১২৯-১৩০। ১৬১১, ঐ, পৃ. ৯৫। ১৬৯৭, ডা. টি. হােসেনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৯ অক্টোবর, ২০০২।

যেন গেছেন। অর্থমন্ত্রীর অফিসে টেলিফোন করলে তাজউদ্দীন আহমদকে পাওয়া যায়। জানা যায় তিনি ফাইল ওয়ার্ক করছেন। টেলিফোন রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ডাক্তার, দেখ, লােকটা কত সিরিয়াস। অথচ গতরাতেই ওরা (তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধীরা) তার বিরুদ্ধে আমার কাছে কত কিছু বলে গেল।

তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট

অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের তখন বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য আহরণের পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৩০ জুন ১৯৭২ পর্যন্ত ৬ মাসের এবং ১৯৭২-১৯৭৩ অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়ন করা জরুরি ছিল। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি বাজেট ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির অনুমােদন লাভ করেছিল। ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই অনুমােদিত ঐ বাজেটে ১ বছরের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৭৩ লক্ষ ২৮ হাজার ২০৭ রুপি যা সম্পূর্ণ বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া মুদ্রা এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আয়যােগ্য বলে উল্লিখিত

হয়।১৬১৩

| ১৯৭২ সালের ৩০ জুন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের দুটো বাজেট একত্রে বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির সামনে পেশ করেন। দুর্লভ এই সুযােগ পাওয়ায় তিনি স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। একই সঙ্গে আপসােস করেন এই বলে যে, ঐতিহাসিক এই বাজেট নির্বাচিত সদস্যদের সামনে উপস্থাপন না করে রেডিও, টিভিতে উপস্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাজেট বক্তৃতার শুরুতে তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর একটি চিত্র তুলে ধরেন। এতে একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রেই একটি বিপর্যস্ত স্থবির চিত্র ফুটে ওঠে, অন্যদিকে গৃহীত পদক্ষেপ জনগণকে অনেকটা আশ্বস্ত করে। তিনি বলেন:১৬১৪

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে যখন ঢাকা মুক্ত হল, তখন আমরা পেলাম এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেউলিয়া অর্থ ব্যবস্থা। রেলপথ, সড়ক ও নদীপথসমূহ তখন সম্পূর্ণ। বিচ্ছিন্ন; নিমজ্জিত জাহাজ ও ভাসমান মাইন দিয়ে বন্দরসমূহ রুদ্ধ; শিল্পসমূহ শত্রুর আঘাতে বিধ্বস্ত বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; যন্ত্রপাতি আর কাঁচামালের অভাবে কলকারখানা স্তব্ধ। স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথেই যে বহুবিধ সমস্যা নতুন সরকারের আশু মনােযােগ দাবী করছিল, তার মধ্যে ছিল দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয়

—-

১৬১৩ এ বিষয়ে দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৭২-৮৫। ১৬১৪ দৈনিক ইত্তেফাক, ১ জুলাই, ১৯৭২।

সামগ্রীর অভাব, খাদ্য সামগ্রির সীমিত সরবরাহ, শ্রমশক্তির বেকারত্ব; আর ছিল লক্ষ লক্ষ সহায়-সম্বলহীন মানুষ, আর দেশে প্রত্যাবর্তনকারী অগণিত উদ্বাস্তু মিছিল। এইসব সমস্যার সমাধান যে কোন সরকারের জন্য ছিল দুঃসাধ্য। আর সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রাবিহীন এবং যথাযথ প্রশাসন যন্ত্রবর্জিত নতুন সরকারের জন্য এ ছিল। এক অসম্ভব কাজ ।… অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত সরকার যা করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কসমূহের পুনর্গঠন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সংগঠন, প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের সৃজন, নতুন বিনিময় হার স্থিরকরণ এবং সুখী

ও সমৃদ্ধ সমাজের ভিত্তি স্থাপন ।… | | তিনি বাজেট দুটোকে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনধর্মী বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন ভবিষ্যৎ শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তােলা এর মূল উদ্দেশ্য। কতিপয় দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলার কথাও ঘােষিত হয়। এ থেকে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, হাঙ্গেরী, বুলগেরিয়া, পােল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার কথা জানা যায়। | পাট, তুলা, চিনি ও ১৫ লক্ষ টাকার অধিক স্থাবর সম্পদবিশিষ্ট শিল্প-কলকারখানাকে জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলাে পরিচালনার জন্য ১২ টি নতুন কর্পোরেশন স্থাপনসহ প্রথাগত রীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বেসরকারি স্তর থেকে যােগ্য মানুষদের ওপর এসব কর্পোরেশন পরিচালনার। দায়িত্ব অর্পণ করা হয় যাতে করে ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে। | অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে ন্যায্য ও সুষম বণ্টননীতির প্রতি তাজউদ্দীন আহমদ সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। এ সম্পর্কে উক্ত বাজেট বক্তৃতার অংশবিশেষ একটি সুন্দর উদাহরণ হতে পারে:১৬১৫

সমাজতান্ত্রিক শােষণহীন সমাজব্যবস্থার অন্যতম দিক হল সম্পদের সুষম বণ্টন ও বর্ধন । অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের স্তরে স্বভাবতই সম্পদ বর্ধনের উপর গুরুত্ব আরােপিত হয়। সম্পদ বর্ধনের সঙ্গে সুষম বণ্টনের সমন্বয়ের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সরকারী কার্যক্রমে এর প্রতিফলন ঘটেছে, শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, উচ্চ বেতনভূক কর্মচারীদের বেতন হাস, বিভিন্ন করঅব্যহতি ও কর সমন্বয়মূলক কার্যক্রমে। বৈষম্য দূরীকরণের জন্য সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মচারীদের বেতনের সুসামঞ্জস্য করার উদ্দেশ্যে সরকার একটি বেতন কমিশন গঠন করতে যাচ্ছেন। আগে যেখানে মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার দেশের অধিকাংশ শিল্প, ব্যাংক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল এখন সেখানে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের মালিকানা

১৬১৫ ঐ

৫১৫

প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজকে কলুষমুক্ত করার সার্বিক অভিযানে চোরাকারবার, মজুতদারী, মুনাফাখােরীর বিরুদ্ধে ও দুর্নীতির শিরােচ্ছেদের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাজেটের উন্নয়ন বহির্ভূত খাতে রাজস্ব প্রাপ্তির হিসেব ধরা হয় ৪৮ কোটি ৫২ লক্ষ টাকা । ব্যয়ের পরিমাণ ৯৯ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা। এই খাতের নীট ঘাটতি ১০ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকাসহ মােট ঘাটতির পরিমাণ ৬১ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা। পক্ষান্তরে রাজস্ব খাতে ঘাটতির পরিমাণ ৫০ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। রাজস্ব প্রাপ্তির শতকরা ৫০ ভাগ ধরা হয় উৎপাদন শুল্ক হতে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের মানুষকে বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে প্রায় ৫০ কোটি টাকার রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া হয়। বিভিন্ন খাতে মােট প্রয়ােজন হয় ২২০ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার । আয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি থেকে ১১৩ কোটি টাকা এবং ১০৭ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক, ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের কথা বলা হয়। এই সময়ে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয় সাহায্য পুনর্বাসন ও শিক্ষাখাতে। সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১০৭ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। ছাত্র-শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে সহযােগিতাদান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনের জন্য শিক্ষাখাতে বরাদ্দ করা হয় ১ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা। ১০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয় যােগাযােগ, পরিবহণ, পুনর্বাসন ও অন্যান্য খাতের জন্য। যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য জরুরি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার ফলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত ২৪৭ টি ব্রিজের মধ্যে ১৯৪টির মেরামত সম্পন্ন হয়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে অতি দ্রুত চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহারােপযােগী করে ভােলা হয়। | একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য এই বাজেট মােটেও উচ্চাভিলাষী ছিলনা। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এমনটি করতে হয়। অথচ প্রয়ােজন সর্বত্রই । মূলত এই বাজেটে সীমিত আয় ও আশু প্রয়ােজনের দিকে নজর রেখে পুনর্বাসন কাজকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। সে তুলনায় ১৯৭২-১৯৭৩ সালের বাজেটটির মূল প্রবণতা পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রকৃতির হলেও ভবিষ্যৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেকখানি উন্নয়নধর্মী । এর রাজস্ব আয় ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং রাজস্ব ব্যয়

—-

১৬১৬. বদরুদ্দিন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দিন আহমদ (ঢাকা: নওরােজ সাহিত্য সম্ভার, ২০০৪), পৃ. ৮৬।

২১৮ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ধরা হয়। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের উন্নয়ন বাজেটটিকে তাজউদ্দীন আহমদ উন্নয়ন, পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন হিসেবে উল্লেখ করেন। এর মােট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয় ৫০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩১৮ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা নিদিষ্ট করা হয় বার্ষিক উন্নয়নের জন্য। অবশিষ্ট ১৮২ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। পুনঃনির্মাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য নির্ধারিত হয়। স্বাধীনতা লাভ করার ৬ মাস পরবর্তী সীমিত বাজেটের পর এই বাজেটে সার্বিকভাবে বার্ষিক উন্নয়নের জন্য উল্লিখিত পরিমাণ টাকার অংক নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন হয় যে, সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি মােটামুটি ভিত রচনার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এর লক্ষ্য। হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন উৎপাদনের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের মার্চের পূর্বে তৎকালীন পূর্ব বাংলা যে স্থানে ছিল, এই উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশকে সেই স্থানে পৌছে দেয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের ৩১৮ কোটি টাকার মধ্যে ২০০ কোটি টাকা নির্দিষ্ট হয় গ্রাম পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আগামী ১ বছরে ৩০ কোটি টাকা গ্রামীণ ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কৃষি উপকরণ ও উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট হয় ১০৩ কোটি টাকা। এর মুল লক্ষ্য হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে ক্রমাগত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। সে জন্য আগামী এক বছরে ৪ লক্ষ ২৫ হাজার টন রাসায়নিক সার, ১২ হাজার টন কীটনাশক ঔষধ, ৩৫ হাজার পাম্প স্থাপন, ২৪০০ গভীর নলকূপ ও ৪০০০ অগভীর নলকূপ। স্থাপন করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। অধিক জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত এবং তেমন খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকায় কৃষিখাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করাতেই বাংলাদেশের উন্নয়ন নিহিত—তাজউদ্দীন আহমদ এই উন্নয়ন-দর্শন দ্বারা পরিচালিত হন। একবার একজন নিকটাত্মীয় রাইস মিল স্থাপনের উদ্দেশে কিছু ঋণের জন্য তার কাছে গেলে তিনি ঐ আত্মীয়টিকে বলেন যে, তিনি বরং উচ্চ ফলনশীল জাতীয় ধান চাষ করলে তার ও দেশের অধিক লাভ হবে। এই উদাহরণ ইঙ্গিত দেয় যে, তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য। কৃষিখাতকেই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তার প্রণীত ৪টি জাতীয় বাজেট ও একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষি তথা গ্রামীণ উন্নয়নের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারােপ করা হয়। এক্ষেত্রে বিপুল জনসংখ্যাকে কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে জনসম্পদে পরিণত করার প্রতি গুরুত্বারােপ করেন। এ জন্য দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রয়ােগিক চাহিদার ভিত্তিতে দেশপ্রেমমূলক একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রয়ােজনীয়তার কথা তিনি।

বলেন।১৬১৭ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্তরকে বাধ্যতামূলক ও অহেতুক কলেজ গড়ে

তােলার প্রতি গুরুত্বারােপ করেন।৬১৮ উর্বর জমিতে ফলন বৃদ্ধি, বিদ্যমান খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- প্রাকৃতিক গ্যাস, চুনা পাথর, খরস্রোতা নদীতে জলবিদ্যুৎ, দেশের ভিতরে ও দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলে মৎস্য সম্পদ প্রভৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ একটি পরিকল্পিত আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট বক্তৃতা ও পত্রিকাগুলােকে দেয়া নানা প্রশ্নের জবাবের প্রতি নজর দিলে দেখা যায়, তিনি কেবল ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের বিষয়েই নয়, গ্রাম ও শহরের মধ্যে সম্পদ বৈষম্যের বিষয়েও সজাগ ছিলেন এবং তার ঘােষিত বাজেটগুলােতে এবং প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এ বিষয়টি ফুটে ওঠে। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের বাজেটে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য গৃহস্থালী। জিনিসপত্রের ওপর করারােপ করা হয়নি বললেই চলে। বরং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করা হয়। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত চাল, বীজ, কীটনাশক, সার, মােটা সূতা প্রভৃতি খাতে এই ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়। দ্বিতীয় খাত হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয় পরিবহণ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রয়ােজনীয় পুনঃনির্মাণ, মেরামত ইত্যাদিকে। এক্ষেত্রে রেলপথ, জল ও স্থলপথ, টেলিফোন-টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার যথাসাধ্য ব্যবহারােপযােগী ও সম্প্রসারণের কথা উল্লেখ করেন।

| এই বাজেটে কর ব্যবস্থাকে অনেকটা ন্যায়সঙ্গত ও সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বভাবতই এই পর্যায়ে বাজেটের অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে বহুলাংশে অফেরতযােগ্য বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়। উল্লেখ্য ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জি.ডি.পি-এর ৯৫ শতাংশ ছিল। বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর।৬২২ বাংলাদেশের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সহযােগিতার প্রতিশ্রুতিদানকারী রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানী, জাপান, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ। তাজউদ্দীন আহমদ বাজেট বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বহু

—–

১৬১৭ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯ মে, ১৯৭৩। ১৯১৮ ঐ, ৬ জুলাই, ১৯৭৩। ১৬১৯ ঐ, ৮ এপ্রিল, ১৯৭৩ ১৯২০ ঐ, ২৮ মে, ১৯৭৩। ১৯২১ ঐ, ৬ জুলাই, ১৯৭৩। ১৯২২ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।

আর্থিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ার কথা জাতিকে অবহিত করেন। | বাজেট বক্তৃতার শেষাংশে তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, জাতি হিসেবে কষ্টের কাল শেষ হয়ে যায়নি। তাদেরকে কৃচ্ছসাধন ও ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে পরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যেতে হবে মূলত আগামী প্রজন্মের জন্য সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তােলার লক্ষ্যে । উক্ত বাজেট দুটি ঘােষণার পর তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী শর্তযুক্ত বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের পরিবর্তে প্রয়ােজনে দারিদ্র্য ভাগাভাগি করে নেয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন দেশের বর্তমান অবস্থায় হতাশ না হয়ে দেশপ্রেমিক দলগুলাে জাতীয় ঐক্যের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি বিভিন্ন সময় আহ্বান রাখেন, একটু কম খেয়ে, একটু কম পরে, একটু কষ্ট স্বীকার করে হলেও সকলেই যেন স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে পারেন এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন।৬২* একইভাবে তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মিতব্যয়িতা ও কৃচ্ছসাধনের প্রয়ােজনীয়তার প্রতি যথার্থভাবেই গুরুত্বারােপ করেন। তার এই উপলব্ধির প্রয়ােগ বাস্তব জীবনেও দেখা যায়। ১৯৭৪ সালে দেশে যখন চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজমান তখন বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে নিজ ভ্রাতুস্পুত্র দলিলউদ্দীনের বৌ-ভাতে অতিথিদের মাত্র চা-চক্রের মাধ্যমে আপ্যায়ন সম্পন্ন করেন।৬২৬ অপরদিকে দেশের মধ্যে কতিপয় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার অপচেষ্টা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, বুভূক্ষুদেরকে কৃচ্ছসাধনের জন্য বলার অর্থ দাঁড়ায় তাদেরকে উপহাস করা। এ ধরনের অবস্থাকে তিনি বিবেকের সংকট বলে মন্তব্য করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে কতিপয় ব্যক্তির সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা আনয়ন করা হয়নি। অনুরূপভাবে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের দেশের বর্তমান অবস্থা ও উন্নয়ন ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করেন। ১৯৭২ সালে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি বলেন:১৬২৮

—-

১৬২৩ দৈনিক বাংলা, ২ জুন, ১৯৭২। ১৬২* দৈনিক পূর্বদেশ, ৩ জুন, ১৯৭২। ১৬২৫ ঐ, ৩ জুন, ১৯৭২। ১৬২৬ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা (ঢাকা: সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৯৪), পৃ. ৭০। ১৬২৭ দৈনিক বাংলা, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৩। ১৬২৮ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ২২৯।

বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন আমাদের দায়িত্ব…এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পুরনাে অর্থনৈতিক জীবন্যাত্রাকেই সচল করতে চলেছি। আওয়ামী লীগের বিঘােষিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেছেন যে, সমাজতন্ত্রই আমাদের মূল লক্ষ্য। আর এই সমাজতন্ত্র কোনাে লােক দেখানাে ব্যাপার হবে না, এ হবে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র । ব্যাঙ্ক, বীমা, পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চিনিশিল্প এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বৃহত্তর অংশের জাতীয়করণ এই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকেই দৃঢ় পদক্ষেপ। আমরা আশা করব যে, কৃষিযােগ্য জমি ও শহরের সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হবে এবং বেতনের ক্ষেত্রে এখনকার বিরাট বৈষম্য দূর করা হবে। আওয়ামী লীগ কল্যাণকর শ্রম নীতির পক্ষপাতি এবং শিক্ষার ভিত্তিকে বিস্তৃত গণমুখী করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সার্থক হবে, আমরা নতুন সমাজ

গঠন করতে সক্ষম হব। | একইভাবে নিজের উন্নয়ন ভাবনার আলােকে বিশ্বের আর্থিক সংস্থাগুলাের নিকট তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত জোরালাে যুক্তি দিয়ে বলেন বাংলাদেশের জন্য কেবলমাত্র সহজ শর্তে ঋণ গ্রহণযােগ্য। এ ব্যাপারে তার অনমনীয়তার পরিচয় পাওয়া যায় বহুভাবেই।*২# বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য ADB মালয়েশিয়ায় একটি বৈঠক আহ্বান করে। দেড় ঘণ্টা সময় তাজউদ্দীন আহমদের জন্য নির্ধারিত হলেও মাত্র ১৫ মিনিটে তিনি সহজ শর্তে বাংলাদেশকে ঋণদানের বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা তার বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশকে সহনীয় শর্তে ঋণ দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে আসে শােষণ, শৃঙ্খল ও পরনির্ভরতা । ঋণশর্ত ক্রমশ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।৬৩০ | ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সদস্যভুক্ত হয়। এর কিছু পরে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যােগদানের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ওয়াশিংটন যান। এ সময় দেশের অবস্থা বিবেচনা করে এবং সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের অনুরােধের প্রেক্ষিতে তাজউদ্দীন আহমদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মার্কিন কর্তা ব্যক্তিদের সাথে আলােচনায় মিলিত হন। মার্কিন অর্থমন্ত্রী জর্জ শুলজ, এইড

—–

১৬২৯ আতিউর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদের সমাজ ও তাঁর উন্নয়ন ভাবনা (তাজউদ্দিন আহমদ স্মারক বক্তৃতা, জুলাই ১৯৯০), পৃ. ১৮। ** অজয় দাশ গুপ্ত ও মাহবুব জামান, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে বাংলাদেশের অর্থনীতি (ঢাকা: প্রাচ্য প্রকাশনী, ১৯৮১), পৃ. ১৫ ও ৩৫। ১৬৩১ মাহবুব করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫।

৫২০

প্রশাসক ড. জন হান্না, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা, আন্তর্জাতিক । মুদ্রা তহবিলের পিয়ার পল সােইটজারসহ অন্যান্যদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ হয়। তিনি অন্যান্য দেশের অর্থমন্ত্রীদের সাথেও এ সময় আলােচনায় | মিলিত হন। এসব সাক্ষাতের সময় তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, সরকারের পরিকল্পনা, উন্নয়ন কৌশল, জরুরি করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রাণবন্ত আলােচনা করেন।১৬৩২ মার্কিন প্রশাসনে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা জন্মেছিল যে, তাজউদ্দীন আহমদ কট্টরপন্থী । কিন্তু তার রাষ্ট্রনায়কোচিত উপস্থাপন, যুক্তি প্রদর্শন এবং ধারণার স্বচ্ছতার কারণে সকলে তার প্রতি আকৃষ্ট হন। এমনকি বিরূপ ম্যাকনামারা পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদের উন্নয়ন দর্শন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অবহিত হয়ে তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তারা। স্বীকার করেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত। | প্রয়ােগবাদী এবং সৃজনশীল। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন অর্থসচিব এম. মতিউল। ইসলাম লিখেছেন:১৬৩৪

In Washington, the high point of the visit by the Finance Minister was his meeting with McNamara who had some misgiving about Tajuddin’s attitude towards World Bank’s assistance. The open and pragmatic approach of Tajuddin took McNamara by surprise and one could not but notice the joy in McNamara’s face that his first encounter with Tajuddin went

of very well. বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভাতেও তাজউদ্দীন আহমদ জোরালাে যুক্তি দিয়ে। বলেন যে, বাংলাদেশের জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী ঋণই প্রত্যাশিত। সংস্থাটির নিকট তিনি ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের আবেদন করেন। ফলে ১৯৭২-১৯৭৩ |মৌসুমে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ১৬০ মিলিয়ন এবং চলতি প্রকল্পের জন্য পৃথকভাবে ৬২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়। আই.এম.এফ. বরাদ্দ করে ৬২.৫ মিলিয়ন ডলার।৬৩৫ তিনি কেবল বিশ্বের আর্থিক সংস্থাগুলাের নিকট থেকে বাংলাদেশের জন্য ঋণ সংগ্রহ করার প্রতি গুরুত্বারােপ করেন নি। উপরন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পদ-বৈষম্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন বিশ্বের

——

১৬৩২, আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকার, ১১ নভেম্বর, ১৯৯৬।

প্রথম আলাে, ঈদ সংখ্যা, ২০০৫, সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: আলােকের অনন্তধারা’।

* M. Matiul Islam, “Tajuddin- the Man with a Golden Heart’, Daily Star, Nov. 3, 1997. [ আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকার, ১১ নভেম্বর, ১৯৯৬।

ধনী ও দরিদ্র দেশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য অনিবার্যভাবেই শান্তি ও রাজনীতির ভারসাম্য নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।১৬৩৬ কমনওয়েলথ মন্ত্রিসভাতেও তিনি বিশ্বের উন্নয়নগামী দেশগুলােকে আর্থিক ও বাণিজ্য সুযােগ প্রদান করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন।

আর্থিক কাঠামাে দাঁড় করানাের সর্বাত্মক চেষ্টা করা সত্ত্বেও ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে সংসদে বাজেট পেশ করার সময় তাজউদ্দীন আহমদ যে তথ্য উপস্থাপন করেন তাতে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। সংসদ ও দেশবাসীর নিকট এই ব্যর্থতার কারণ এবং প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন সমস্যার জটিলতা ও নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা এড়িয়ে সাফল্য সম্পর্কে বাগ্মিতা করা অনায়াসসাধ্য। ঔপনিবেশিক শাসনামলে সে অপচেষ্টাই করা হতাে। কিন্ত যে সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রকৃত অবস্থা জাতিকে অবহিত করা সেই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি এভাবে জাতির নিকট এক প্রকার জবাবদিহি করেন। তিনি জানান দেশে প্রায় সকল দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে এবং বিগত বাজেটে পুনর্বাসন ও উন্নয়নের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল তা লক্ষ্য স্পর্শ করতে পারেনি। এর কারণ হচ্ছে। সার্বিকভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুদ্রামানের ব্যাপক অস্থিতিশীলতা।৩৮ স্বাধীনতার পরে প্রতি টন গমের মূল্য যেখানে ছিল ৭৭ ডলার ১৯৭৪ সালে তা হয় ২৮২ ডলার, একই সময় চট্টগ্রাম। থেকে একটি ৭ টনি ট্রাকের ভাড়া যেখানে ছিল ৪৫০-৫০০ টাকা সেখানে ১৯৭৪ সালে তা হয় ৩২০০-৩৫০০ টাকা। বিদেশি শিপিং ভাড়াও বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে । এমনও দেখা যায়, বিদেশ থেকে ক্রয়কৃত খাদ্যশস্য অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়ার কারণে দেশে পৌছানাে সম্ভব হয় নি। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর বর্ধিত মূল্যের কারণে বাংলাদেশ সরকারও ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়ে । নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেশের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক থাকার কারণে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার মতাে উপকরণ সংগ্রহ করতে সরকারের নাভিশ্বাস ওঠে। বস্তুত বিরূপ পরিবেশ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের

——

১৬৩৬ দৈনিক বাংলা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২। ১৬৩৭ অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭২-১৯৭৩, দৈনিক পূর্বদেশ, ২০ জুন, ১৯৭৩।

* এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে যে তথ্য প্রদান করেন তা হতে দেখা যায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গমের দাম ও জাহাজ ভাড়ার হার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে হাজার গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৬-৪০৭।

অভ্যুদয় ঘটে এবং ততােধিক জটিল অবস্থায় নবীন এই দেশটি উঠে দাঁড়াবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের বছর কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে ১৯৭২-৭৩ সালে বাজারে খাদ্য ঘাটতি ও মুল্যবৃদ্ধি ঘটে অনিবার্যভাবেই । আবার ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে অনাবৃষ্টি ও খরা কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে ব্যাহত করে। অন্যদিকে দেশের কোথাও কোথাও বিশেষত সিলেট অঞ্চলে বন্যার১৬৩৯ কারণেও স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমদানিকৃত খাদ্যশষ্যও যথাসময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছে দেয়া যায়নি বস্তুত পরিবহণ ব্যবস্থাকে পুরােপুরি ব্যবহারােপযােগি করে না তুলতে পারার কারণে। কাজেই মুল্য বৃদ্ধির একটা বড় রকমের প্রবণতা বাজারে দেখা দেয়। এতদসত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ রপ্তানি বাণিজ্য থেকে সামান্য কিছু আয় বৃদ্ধি এবং সার, ইস্পাত ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির সুসংবাদ সংসদের মাধ্যমে জাতিকে জানান। এই বাজেটটিকে তিনি ধ্বংসস্তুপের ওপর অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন।১৬৪১ | আর্থিক পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের দাতাসংস্থার একটি বৈঠক বসে ঢাকায়। অবশ্য বাংলাদেশ সংস্থাটির সদস্য হয় ১৯৭৪ সালে । এমতাবস্থায় ১৯৭৩ সালের এই বৈঠকটি বাংলাদেশ বিষয়ে দাতাসংস্থার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্র রচনা করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলােচনায় বিশেষভাবে স্থান পায় উন্নয়ন সমস্যা ও কৌশলের বিষয়টি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘের রিলিফ সংস্থা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতিপয় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু এখানে একটি জটিল প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। বাস্তব প্রয়ােজনে হােক কিংবা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী আন্তর্জাতিক কোনে কোনাে মহলের ইন্ধনেই হােক পাকিস্তানের ঋণের একটি অংশ বাংলাদেশকে পরিশােধের জন্য চাপ দেয়া হয়। যেখানে নতুনভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত পর্যন্ত রচিত হতে পারে নি এবং পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের মতাে জরুরি কাজের জন্য প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য প্রয়ােজন সেখানে পাকিস্তানের গৃহীত ঋণের একটি অংশ বাংলাদেশের পক্ষে পরিশােধ কিংবা দায়ভার গ্রহণ করা অসম্ভব ব্যাপার। তদুপরি এর সঙ্গে কূটনৈতিক প্রশ্নও জড়িত; পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত প্রদান করে নি।

১৬৩৯ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি: দিনলিপি ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ২৩ আগস্ট, ২০০২। ১৬৪০° আরাে জানার জন্য দেখুন, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ জুন, ১৯৭৩, অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের বাজেট বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ । ১৬৪১ দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ জুলাই, ১৯৭৩।

তাহলে কোন্ ভিত্তিতে বাংলাদেশ তা করতে পারে? তাজউদ্দীন আহমদ দাতাগােষ্ঠীর বৈঠকে এই প্রশ্নই উত্থাপন করেন এবং বলেন বাংলাদেশের এ বিষয়ে যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে এর ভিত্তি রচনা করতে পারে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে এ জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।১৬৪২ অবশ্য কূটনৈতিক কারণে পাকিস্তান কর্তৃক গৃহীত ঋণের একটা দায়ভার গ্রহণ করা প্রয়ােজন হয়। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ সংসদ বিতর্কে অংশ নিয়ে জানান, দৃশ্যমান যে সব প্রকল্প স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে। ঐগুলাের দেয় অর্থ ১ জুলাই, ১৯৭৪ তারিখ পর্যন্ত অপরিশােধিত থাকলে তার একটি অংশ বাংলাদেশ সরকার পরিশােধের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একই বছর (১৯৭৩) জুলাই মাসের শেষের দিকে তাজউদ্দীন। আহমদ বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার সংস্কার কমিটির সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে আমেরিকা গমন করেন। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স, কৃষিমন্ত্রী আর্ল বাটজ, এইড প্রশাসক জন হান্না ও অন্যান্যদের সঙ্গে নানা বিষয়ে তার আলােলাচনা হয়। এ সময় তারা তাজউদ্দীন আহমদের নিকট পাকিস্তানের সঙ্গে আর একটি অমীমাংসিত বিষয় আলােচনার অবতারণা করেন। তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার জন্য চাপ প্রয়ােগ করেন। তারা নাইজেরিয়া ও বায়াফ্রার উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন যে, দেশ দুটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ এ বিষয়ে অনমনীয় মনােভাব ব্যক্ত করে বলেন বায়াফ্রায় সংখ্যালঘু গােষ্ঠী ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে ব্যর্থ হয়েছে। আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে এর উল্টো চিত্রপাকিস্তান কাঠামােতে সংখ্যাগুরু পূর্ব বাংলার মানুষের রায়কে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু পাকিস্তানীরা যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তারা পরাজিত হয়েছে। তারা যে বীভৎস ও অমার্জনীয় অপরাধ করেছে তা বিশ্ববাসী অবগত। তাদের সৃষ্ট নারকীয়তা পৃথিবীর নিকট অতীতের যে কোনাে নৃশংসতাকে ম্লান করে দিয়েছে। ঢালাওভাবে তারা ৯ মাস ধরে মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্রমের ওপর আঘাত হেনেছে, তদুপরি পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্থানীয় সহযােগী। বাহিনীর সদস্যদের সহযােগিতায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। বস্তুত বাংলাদেশ সরকার দালাল আইনে ধৃত ১৯৫ জন অভিযুক্তকে স্বীকৃত সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে বিচার করতে বদ্ধপরিকর। সাহায্য দানের নামে

——–

১৬৪২, মাহবুব করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭। ১৬৪৩ সংসদ বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৪ সংখ্যা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার), পৃ. ২৭৮৫।

এভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকাসহ আন্তর্জাতিক কোনাে কোনাে মহল হস্তক্ষেপ করতে উদ্যত হয় । | এরপর তাজউদ্দীন ১৯৭৪ সালে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য জুন মাসে ওয়াশিংটন পৌছেন। এ সময় দেশের ভিতরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দুর্ভিক্ষ অত্যাসন্ন প্রায়। প্রতিশ্রুতি দানকারী দেশ ও সংস্থাগুলাের কাছ থেকে পুরাে ঋণ পাওয়া যায়নি। কিছুটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কিছুটা চক্রান্তকারীদের তৎপরতায় বাজার সরকারের প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিপর্যয় রােধের কোনাে উপায় দেখা যায় না। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রা তহবিল ছাড়াও জরুরিভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহের জন্য মার্কিন প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে আলােচনা করতে বাধ্য হন। আমেরিকার পক্ষ থেকে এবার আর একটি জটিল সমস্যার কথা উত্থাপন করা হয়। মার্কিন এইড প্রশাসক ড্যানিয়েল পার্কার এবং পরবর্তীকালের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো বলেন বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঋণচুক্তি লঙ্ঘন করেছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে। সুতরাং বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য পেতে পারে না।১৬৪৫ এই সময় বাংলাদেশ কিউবায় কিছুসংখ্যক পাটের থলে রপ্তানি করে। তাজউদ্দীন আহমদ বাস্তবসম্মত জোরালাে যুক্তি দেখিয়ে বলেন বাংলাদেশের দ্রুত রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য কিউবার সঙ্গে এই চুক্তি করা হয়েছে। আর আমেরিকা নিজেই যেখানে অনেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে সেখানে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কিউবা কিংবা যে কোনাে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন অপরাধের বিষয় নয়। এমতাবস্থায় তিনি মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে ঋণশর্তের বিষয়টি নমনীয় দৃষ্টিতে দেখা, সম্ভব হলে এর সংশােধন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। এ সম্পর্কে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি চিঠির মাধ্যমে নিরূপ অবহিত করেন:৬৫

I also discussed our PL 480 request with AID Administrator Daniel Parker. He raised the question of our trade with Cuba,

———

১৬৪৪ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য-চুক্তির শর্তগুলাের জন্য দেখুন, অজয় দাশ গুপ্ত ও মাহবুব জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬-৫৭। ১৬০৫ রেহমান সােবহান খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের রাজনীতি প্রবন্ধে বলেন, দুর্ভিক্ষের সুযােগ নিয়ে খাদ্য রাজনীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে তৎপর হয় । অজয় দাশ গুপ্ত ও মাহবুব জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯। ১৬৪৬, ঐ, পৃ, ৪০। ১৬৪৭. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮-১৯।

৫২৫

and stated that under the provisions of PL 480 it created some difficulties for them in committing supplies to Bangladesh. I explained that we could not deny, Cuba a country we recognised, some jute goods” that they asked for and we could apparently spare. Political spectrum is very much changed now and I suggested that change in laws to reflect the

current thinking should be promoted. দেশের দুর্ভিক্ষাবস্থার কথা বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমদের অনতিবিলম্বে খাদ্য সরবরাহের জন্য আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানান।৬৬৮ নিজের নীতি ও বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে সাহায্যের জন্য আমেরিকার দ্বারস্থ হন কতটা স্বেচ্ছায় আর কতটা চাপের মুখে তা সহজেই বােধগম্য। তবে এটা ঠিক যে, আমেরিকাসহ বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার নিকট তিনি সহজশর্তে ঋণ প্রার্থনার পক্ষে জোরালাে যুক্তি দিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও দেশের দুর্ভিক্ষাবস্থা মােকাবিলার জন্য সহযােগিতা লাভে ব্যর্থ হন। প্রকৃতপক্ষে সংকটজনক এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরােক্ষ হস্তক্ষেপ করতে অগ্রসর হয়। বস্তুত যুদ্ধোত্তর উপমহাদেশের রাজনীতিতে মার্কিনীদের বিরূপ ভূমিকার আশংকার প্রেক্ষিতে ভারতে যেমন ইন্দিরা গান্ধী স্বনির্ভরতার প্রতি। গুরুত্বারােপ করেন তেমনি বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভিত রচনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে

যান।১৬৪৯

১৯৭৪ সালের ২৯ জুন মাত্র ৫৬ হাজার টন মজুত খাদ্যশস্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বন্যার আশংকা করে। দুরবস্থার এই সময়ে সুযােগ বুঝে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের ওপর খাদ্য-অস্ত্র ব্যবহার করতে উদ্যত হয়। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বােস্টার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আনুষ্ঠানিকভাবে কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করে

—–

১৬৪৮ মাহবুব করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮।

“The Bangldesh government, which is not in as strong an ecocnomic position as India, has nevertheless indicated that any American aid that is forthcoming will have to be channeled thorough the United Nations or other international agencies, and Finance Minister Tajuddin Ahmed has launched a study within his own Ministry to determine ways that the Bangladesh government can slice down our programmes of economic reconstruction and depend more heavily on our own resources'” Marcus Franda, Bangladesh: The First Decade (New Delhi: South Asian Publishers Pvt. Ltd., 1981), p. 11.

মার্কিন সাহায্য গ্রহণের শর্ত ভঙ্গের অভিযােগ আনেন। কাজেই খাদ্য সরবরাহ বা অন্য কোনাে সাহায্য দেয়া সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশ সরকার যদি অঙ্গীকার করে যে, আমেরিকার চরম শত্ৰু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবা এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে কোনাে বাণিজ্য সম্পর্ক রাখবে না তাহলে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে কতটা বিরুদ্ধ মনােভাব পােষণ করে তার তীব্রতা বােঝা যায় বাংলাদেশের উদ্দেশে ছেড়ে আসা আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থানরত খাদ্য বােঝাই জাহাজের গতিমুখ ফিরিয়ে নেয়ার ঘটনা হতে।১৬৫০ উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বিখ্যাত ‘Hunger and Poverty’ তত্ত্বের প্রমাণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে আমেরিকার বাংলাদেশবিরােধী খাদ্য রাজনীতির প্রয়ােগকে দায়ী করেন।৬৫২ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই ধরনের বিরূপ পরিবেশের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও স্বাধীনতাবিরােধী শক্তিগুলাে এবং কালােবাজারী আর মজুতদার চক্র পূর্বাপেক্ষা তৎপর হয়ে ওঠে এবং বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। আইন-শৃঙ্খলারও অবনতি ঘটে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। তাজউদ্দীন আহমদ এই আশংকাই করেছিলেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের বিজয় লাভের পর প্রায় বলতেন, কোনভাবেই মানুষ যেন মনে না করতে পারে যে, এর চেয়ে পাকিস্তানের শাসনই ভাল ছিল। সুতরাং সেদিকে দৃষ্টি রেখে নতুন বাংলাদেশের কর্মকৌশল নির্ধারণ ও লক্ষ্য অর্জন করার বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছিলেন,১৬৫৩ বাস্তবে তার সেই আশংকা নির্মমভাবে প্রায় সমাগত। বিপর্যয়ের জন্য উল্লিখিত কারণগুলাে ছাড়াও আরাে কতিপয় বিষয় যুক্ত হয়। ১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছরের বাজেটের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় একদিকে প্রতিশ্রুত বৈদশিক সাহায্য যেমন পাওয়া যায় নি তেমনি অন্যদিকে কয়েকটি ক্ষেত্রে বাজেট বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। এ ব্যাপারে প্রধান প্রধান খাতগুলাে ছিল প্রতিরক্ষা, শিক্ষা, সাহায্য ও পুনর্বাসন, আইন-শৃঙ্খলা এবং পাট শিল্পের সহায়ক ও গণঋণের সুদ। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন ও বেতনাদির জন্য

——–

১৬৫০ অজয় দাশ গুপ্ত ও মাহবুব জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯-৪০। ১৬৫৯ জাওয়াদুল করিম, মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ১৯৯। sedRehman Sobhan, ‘Honouring Amartya Sen: A Turning of the Weekly’, নােবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, ১৯৯৮, পৃ. ৫। আরাে দেখুন, আবদুল গাফফার চৌধুরী, এবারের নােবেল শান্তি পুরস্কারঃ একটি নােট অব ডিসেন্ট’, সমকাল, ২২ অক্টোবর, ২০০৬। ১৬৫৩, শাওয়াল খান, ‘তাজউদ্দিন: এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’, মাহবুবুল করিম বাচ্চু (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতিএ্যালবাম (ঢাকা: পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস, ১৯৯৭), পৃ. ৭০।

১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে অতিরিক্ত ১৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়। একইভাবে এ সময় প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার কারণে ৫ কোটি ৩৪ লক্ষ, পাট শিল্পকে সহযােগিতা প্রদানের জন্য ৬ কোটি ৪৫ লক্ষ, ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি ইমারত ও জনপথ মেরামতের জন্য ২ কোটি ৭৬ লক্ষ, যৌথ অভিযান ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যয়ের জন্য ১১ কোটি ২১ লক্ষ, পুলিশ বাহিনী বাবদ ২ কোটি ৭৬ লক্ষ অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হয়।১৬৫৪ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থ প্রাপ্তির স্বল্পতাহেতু ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে উন্নয়ন ও পুনঃনির্মাণ ব্যয় বাবদ পূর্ববর্তী বছরের (৫২৫ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকার পরিবর্তে) চেয়ে কম অর্থ নির্ধারণ করা হয়। এর পরিমাণ ছিল ৪৭০ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। বরাদ্দের ধরন দেখে অনুমিত হয় যে, কৃষি, বন্যা, গ্রামীণ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, শিল্পখাত এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। | তাজউদ্দীন আহমদ তার বাজেট বক্তৃতার উপসংহারে বিগত ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরকে জাতির জন্য বাস্তবানুগ উপলব্ধির কাল বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, উন্নয়নের উদ্দেশে সর্বাত্মক প্রয়াসে জাতি সর্বপর্যায়ে অগ্রণী হয়েছিল কিনা তা তলিয়ে দেখা দরকার। সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়ােজন। এ কথা মনে রাখা দরকার যে, শ্লোগান দিয়ে সামাজতন্ত্র কায়েম হয় না, দুর্নীতি দূর হয় না, বুলি আওড়ে প্রবৃদ্ধি আনা যায়

, জনসাধারণকে সর্বকালের জন্য ধোকা দেয়া যায় না। সার্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সকল পর্যায়ে নেতৃত্ব, জনগণ ও সম্পদকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সর্বাত্মক, সৎ, বাস্তবানুগ ও নিরলস প্রচেষ্টার কোনাে বিকল্প নেই। তিনি আরাে বলেন, ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে যে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি অর্জনের ন্যূনতম প্রয়াস মাত্র। তিনি হুঁসিয়ার করে দিয়ে বলেন, এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতার সুফল অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। তিনি আশা ব্যক্ত করে বলেন, জাতি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে উন্নয়ন-শৃঙ্খলা (Laws of

——

১৬৫৪, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ জুলাই, ১৯৭৪। ১৬৫৫ কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন ১৯ ভাগ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ উন্নয়ন ১৫ ভাগ, শিল্পখাত ১১.৩২, বিদ্যুৎখাত ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য ১১.৫৭ এবং পরিবহণ ও যােগাযােগ উন্নয়নের জন্য ২৩.৬৪ ভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হয়। অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ জুলাই, ১৯৭৪।

Development) ও ত্যাগের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে সর্বাত্মক চেষ্টা করে তাহলে তা অর্জন করা সম্ভব।৬৫৬ | সর্বাত্মক ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে উৎপাদনের প্রায় সকল প্রকার প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত রচনার চেষ্টা করা হয়। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা, বড় বড় শিল্পকারখানা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রভৃতির ন্যায় বৃহদায়তনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এগুলাের সুফল পাওয়ার জন্য সময়ের প্রয়ােজন ছিল। প্রায় ৩% হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আমদানি ক্ষেত্রে নানা কারণে ৭৫%- ৯১% পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে এই সময়ের পরিসংখ্যানের প্রতি দৃষ্টি দিলে অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা বােধগম্য হবে । ১৯৭২১৯৭৩ সালের স্থিরীকৃত মূল্যমানে ১৯৬৯-৭০, ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪ এবং ১৯৭৪-৭৫ আর্থিক বছরে মােট জাতীয় উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৫১৮৩,৩, ৪৫৩০.০, ৪৯৬০.০, ৫০৫৯.৮ কোটি টাকা। এ সময় মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে ৭৪৯, ৬১২, ৬৫০ ৬৪৫ টাকা। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪, ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে যথাক্রমে ৬.৭%, ৯.৫%, ২.০% প্রবৃদ্ধি হয় ।৬৫৮ পরিকল্পনার প্রথম বছরে শিল্প ও কৃষিখাতে মােট উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় যথাক্রমে ২৫% ও ১২% থেকে ১৩% কম ছিল। ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ আগের বছরের ৯৮ লক্ষ টনের চেয়ে বেড়ে হয় ১ কোটি ১৮ লক্ষ টন। এই সময় সার, প্রযুক্তি ও খাদ্যশস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ১৯৬৯-৭০ সালের স্তর অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এই অগ্রগতি ছিল সামান্য।

| বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্য ১৯৭৩-৭৪ এবং ১৯৭৪-৭৫ সময়কাল খুবই বিপর্যয়ের কাল । পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থার কারণেই কেবল নয়, আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে ব্যাপক অস্থিরতার কারণেও এটি প্রকট আকার ধারণ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আমেরিকার বাংলাদেশবিরােধী কয়েকটি সিদ্ধান্ত ও অব্যাহত চাপ এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনভিজ্ঞতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রশাসনের দুর্নীতি প্রভৃতি। দেশের ভিতরে বিরােধী শক্তিগুলাে বিভিন্ন চক্রান্তমূলক কাজে লিপ্ত হয়। এ সময় বিভিন্ন শিল্প

———-

১৬৫৬ দৈনিক পূর্বদেশ, ২২ জুন, ২০০৪।

মওদুদ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৯।

ডঃ আবুল ফজল হক, বাংলাদেশের রাজনীতি সংঘাত ও পরিবর্তন (রাজশাহী: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপৃস্তক প্রকাশনা বাের্ড, ১৯৯৪), পৃ. ১৩৪। ১৬৫৯ মওদুদ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৮।

কলকারখানায় প্রায়ই আগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।১৬৬০ ফেঞ্চুগঞ্জ সার। কারখানাতেও বিস্ফোরণ ঘটে। একের পর এক বেশকিছু জুটমিলে অজ্ঞাত কারণে। অগ্নিসংযােগর ঘটনা ঘটে। বিষয়টি সংসদে উত্থাপিত হলে প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন জানান যে, ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫৬২ গাঁট কাঁচা পাট ভস্মিভুত হয়েছে। যার মূল্য ৪ কোটি ৮০ লক্ষ ৮৭ হাজার ২৯৭ টাকা। এ সময় এমন কি ব্যাংকের কর্মচারি কর্তৃক টাকা চুরির ঘটনার কথাও জানা যায়।৬৬২ বস্তুত এ সময়ের দৈনিক পত্রিকাগুলাের পাতায় নজর দিলে এক হতাশা নিমজ্জিত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। একদিকে সাধারণ মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে অন্যদিকে কিছুসংখ্যক মানুষ রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। মননশীল লেখক আবদুল হক তার রােজনামচায় ৫ নভেম্বর, ১৯৭২ তারিখে যে বিবরণ লিখে রাখেন তাতে এ বিষয়ে একটি নির্মোহ চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি লিখেন১৬৬৩

সব কিছুর বাজারে আগুন, নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম কখনাে এত বাড়েনি, দুর্নীতি কখনাে এত দেখা যায়নি। বেশির ভাগই দায়ী ব্যবসায়ীরা, দায়ী সরকারি কর্মচারী, আওয়ামী লীগের বেশ কিছু অংশ, প্রাক্তন মুক্তিবাহিনীর কেউ কেউ, হয়তাে অনেকেই দায়ী বাংলাদেশ বিরােধীরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা, আওয়ামী লীগ আর সরকারী প্রশাসনই এজন্য দায়ী, আরাে দায়ী মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা । এত বড় অভিযােগ বিশ্বাস করা শক্ত, এমনিতেই দেশে ভােগ্য পণ্যের অভাব, তার ওপর এদেশি ও ভারতীয় চোরাকারবারীরা হাত মিলিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মতাে যথেষ্ট সং কর্মচারী ও অভিজ্ঞতার অভাব; তার ওপরে এদেশি লােকেরাই এদশের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য, এমনকি ভারতের দেয়া পণ্য মাথায় করে ভারতে পৌছে দিয়ে আসছে। সরকার পুরােপুরি দায়ী নয়, কিছু দায়ী পণ্যের অভাব, কিছু অভিজ্ঞতার অভাব, কিছু সৎ কর্মচারীর অভাব, কিছু দায়ী যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি, কিছু সাধারণ মানুষ পুরােপুরিভাবে সরকারকে, আওয়ামী লীগকে, শেখ সাহেবকে, এমনকি স্বাধীনতাকে দায়ী করছে। বলছে “ স্বাধীনতা পেয়ে কি লাভ হলাে, ভােট দিলে আবার গােলমাল হবে। এই অশিক্ষিত অভিযােগ শুধু সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকে আপনা-আপনি উঠছে না, কেউ পেছনে থেকে তাদের শেখাচ্ছে, কিন্তু সরকার। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পারছে না। পুরােপুরি পারা অবশ্য কঠিন, কিন্তু ঐ

———

১৬৬০ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪৮। ১৬৬১ সংসদ বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, পৃ. ৯০। ১৬৮২, ঐ, পৃ. ৮৭-৮৮।

** আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা, বাংলাদেশ। ১৯৫৩-‘৯৩ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ২৯২।

৫৩০

অশিক্ষিত ধারণা যাতে না ছড়ায়, যাতে নির্মূল হয়, তেমন উপযুক্ত উদ্যোগ

সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় সকল দেশকেই এ ধরনের অবস্থায় নিপতিত হতে দেখা যায়। তারা সংঘবদ্ধ চেষ্টা ও দেশপ্রেম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেগুলাে মােকাবিলা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের শেষের দিক থেকেই রাজনৈতিক অনৈক্যের সূত্রপাত হয় এবং সর্বক্ষেত্রেই একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে যা কোনভাবেই জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক নয়। আবদুল হকের ১৯৭২ সালের শেষের দিকে লেখা উক্ত বিবরণী থেকেই অনুমান করা যায় ১৯৭৩-৭৪ সালে সংকট কী ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ বেশ সতর্ক ছিলেন বলে তখনকার পত্র পত্রিকার রিপাের্টে দেখা যায়। এমনকি মাঝেমধ্যে সাইকেলযােগে সাধারণ মানুষের বেশে বাজারের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে বের হতেন তিনি। ১৬৬৪ কোনাে কোনাে অপরাধীকে হাতেনাতে ধরেও ফেলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি হুসিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যে উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তা যদি বাস্তবায়ন না করা যায়, অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলাে পূরণ করতে পারা না যায়, তাহলে এক কলঙ্কজনক পরিণতি ঘটবে । এ থেকে কেউ রেহাই পাবে না। এ বিষয়ে তিনি চূড়ান্ত সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন:১৬৬৫

আমরা যদি দেশের মানুষকে প্রয়ােজনীয় খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হই বা তাদের প্রয়ােজন মেটাতে না পারি, তবে আমাদের দেশেও বিপ্লবের নিচাপ সৃষ্টি হবে এবং যদি সময় থাকতে মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টায় আমরা ব্ৰতী না হই, তাহলে নিচাপের ফলে অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবের গতিধারায় আমরা শুধু ভেসেই যাব না,

ইতিহাসের কলংকজনক অধ্যায়েও নিক্ষিপ্ত হব। এমন গভীর উপলব্ধিবােধ সমসাময়িক বেশি নেতার মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না । পরবর্তীকালের ঘটনাবলি তার এই নির্মম ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতাকেই প্রতিপন্ন করেছে ।

তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তােলার লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) প্রণয়ন করেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ অক্টোবর এটি মন্ত্রিসভার অনুমােদন লাভ করে। অবশ্য এর মেয়াদ শুরু হয় ঐ বছরের জুলাই মাস হতেই। এই

১৬৬৪ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, ৬৮-৬৯। ১৯৬৫ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৪।

মওদুদ আহমদ, পৃ. ২০২।

পরিকল্পনার মােট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয় ৪৪৫৫ কোটি টাকা, যার ৬০ ভাগ (বা ২৬৯৮ কোটি টাকা) অভ্যন্তরীণ এবং ৪০ ভাগ (বা ১৭৫৭ কোটি টাকা) বৈদেশিক উৎস থেকে সংগৃহীত হবে বলে উল্লিখিত হয় । পরিকল্পনার মােট বরাদ্দের মধ্য হতে ৩৯৫২ কোটি টাকা সরকারি খাতে এবং ৫০৩ কোটি টাকা বেসরকারি খাতে ব্যয়ের জন্য নির্দিষ্ট হয়। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৫.৫ শতাংশ। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলাের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, কৃষি ও পানি সম্পদ, পরিবহণ ও যােগাযােগ, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস, শিক্ষা, জনসম্পদ, জনস্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণের ন্যায় সামগ্রিক উন্নয়নের মতাে বিষয়গুলােকে প্রাধান্য দেয়া

হয়।১৬৬৭

| প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল জনসাধারণের দারিদ্র লাঘব করা, সুষম বণ্টন, যথাসম্ভব দ্রুত অধিকসংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি এবং জাতীয় আয় যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য কমিয়ে আনা। এ ছাড়াও খাদ্যে স্বয়ংভরতা, শিল্প বাণিজ্য ও পরিবহণের ক্ষেত্রে সরকারি খাতের অধিকতর দক্ষতা অর্জন, সর্বোপরি একটি আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাই এর চরম উদ্দেশ্য। পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্টত লেখা হয়:

The First Five Year Plan, launched towards the end of 1973, is the first major step for transforming the economy of the Bangladesh in the broad context four state principles, namely,

nationalism, democracy, socialism and secularism. | কিন্তু এই পরিকল্পনা অনুমােদনের এক বছরের মাথায় তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিপরিষদ হতে বিদায় গ্রহণ করতে হয় এবং দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার কর্তৃক সংঘটিত রক্তমাখা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । তদুপরি ১৯৭৩-৭৪ এর দুর্ভিক্ষজনিত কারণেও পরিকল্পনাটি সূচনাতেই হোঁচট খায়। এই বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ সরকার তার আর্থিক নীতি ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে Aid Club এর নিকট অনেকটা আত্মসমর্পণ করে এবং সার্বিকভাবে বিদেশি সাহায্যনির্ভর হয়ে পড়ে। ১৯৭৪-৭৫ উন্নয়ন বাজেটের মােট ৫২৫০ মিলিয়ন টাকার মধ্যে ৪৪২০ মিলিয়ন টাকাই ছিল বিদেশি সাহায্যের

১৬৬৭*Bangladesh Progress 1973, Department of Publications, Ministry of Information and Broadcasting, Government of the People’s Republic of Bangladesh, p. 2. ১৬৬৮ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ জুন, ১৯৭৩। ১৬৬৯

Bangladesh Progress 1973, p. 1.

প্রতিশ্রুতি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে যেখানে জি.ডি.পি.এর ৯.৫% ছিল বিদেশি সাহায্যনির্ভর সেখানে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরে হয় ১১.৩%। বাংলাদেশের অর্থিক নীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনার এই গতি প্রকৃতি সম্পর্কে অধ্যাপক রেহমান সােবহান মন্তব্য করেন, The narcotic of foreign aid was injected into the veins of the economy as an adrenalin to revive its moribund state.” | ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রকৃতির মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়নের ধরন বুঝা যায় । ইউরােপের ন্যায় বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক না হলেও মধ্যযুগ থেকে। জায়গিরদারি, কখনাে বা জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। কোম্পানির শাসনাধীনে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে তা ক্রমাগত জমিদারীতে রূপান্তরিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থার ন্যায় এখানেও জমির মালিক হয় জমিদার শ্রেণী এবং চাষি প্রজাসাধারণ ভূমির অধিকারহীন রয়ে যায়। সরকার ও চাষীর মধ্যে সৃষ্টি হয় বেশ কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্ত্বভােগী শ্রেণীর। এর ফলে কৃষকের ওপর যথেচ্ছ ভূমিকর বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালে আর একটি ভূমি সংস্কার করা হয়। কিন্তু তা সাধারণ প্রজা বা কৃষকের উপকারে আসেনি। আইয়ুব খানের শাসনামলে যে ভুমি সংস্কার হয় তাতেও জমিদারদের অবশেষ রয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মােতাবেক ভূমি সংস্কারে অগ্রসর হয়। পরিকল্পনা কমিশন ভূমি সংস্কারের একটি প্রস্তাব সরকারের নিকট পেশ করে। এর মূল কথা ছিল:১৬৭১

১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে এদেশের ভূখণ্ডে জমি মালিকানায়। মেরুকরণ শুরু হয় বড় ও ছােট মালিক-চাষি এই দুই শ্রেণীই বাড়তে থাকে। এবং মাঝারি চাষি কমতে থাকে, যার ফলে, জমির মালিকানায় বৈষম্য বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে ছােট মালিক-চাষি ও বর্গাচাষি দু’য়েরই আপেক্ষিক সংখ্যা বাড়তে থাকে । ছােট চাষিদের জমিতে নিবিড় চাষ ও আধুনিক চাষ-পদ্ধতির প্রয়ােগের কারণে ফলনও বড়াে চাষিদের তুলনায় বেশি হারে বাড়তে থাকে। তাই একই সঙ্গে দুটো কারণে রাষ্ট্রীয় দর্শন অনুযায়ী সমতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের পথে যাবার জন্য, এবং দেশের কৃষিতে সার্বিকভাবে উৎপাদনের হার বাড়াবার জন্য ভূমি সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ে। জমির বণ্টনে পূর্ণ ইকুইটি এবং সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা কেবল সমাজতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় অথবা সামাজিক (যৌথ) মালিকানা ও যৌথচাষের মাধ্যমেই হতে পারে, যাতে ইকনমি অব স্কেল আদায় করা যায় এবং ফসলের বণ্টন শ্রম অনুযায়ী হতে পারে। তবে

——–

১৬৭০ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ.

মমা. আনিসুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১-৫২।

ছােট ও মাঝারি মালিক-চাষিদের নিজের নিজের জমির ওপর গভীর টান থাকে যার ফলে হঠাৎ করে মালিকানা হারিয়ে ফেলে তারা উৎপাদন-কাজে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারে। এই কারণে এই পথে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়া প্রয়ােজন। কিন্তু বড় ভূ-স্বামীদের ক্ষেত্রে যারা জমিতে বড়াে স্কেলে শ্রমিক নিয়ােগ করে ও পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় তাদের শ্রম শােষণ করে অনার্জিত আয় ভােগ করে তাদের ক্ষেত্রে একথা প্রযােজ্য নয় । উপরােক্ত বিবেচনায় পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব করে যে, ভূমি সংস্কারের প্রথম পর্যায়ে যে আয়তনের জমি ঐতিহাসিকভাবে বেশি ফলনশীল হয়েছে তাদের ব্যক্তিগত মালিকানায় রেখে বড়াে আয়তনের জমি ইকুইটি ও ফলনশীলতা বৃদ্ধির খাতিরে ছােট করা, অর্থাৎ একটা সীমার ওপরে জমি রাষ্ট্রায়াত্ত করা। এইভাবে যে উদ্বৃত্ত জমি পাওয়া যাবে সেখানে দৃষ্টান্তমূলক সমবায়ভিত্তিক চাষ হবে। বর্তমানে যেসব বর্গাচাষি এ-সমস্ত চাষ করছে তাদের এই সমবায়গুলিতে অগ্রধিকার ভিত্তিতে নেওয়া হবে। যে সমস্ত বর্গাচাষি ভূমিসংস্কার সীমার চাইতে ছােট জমিতে কাজ করছে তাদের যতদিন সমবায়ের পরিধি বাড়িয়ে সদস্য করা না হয়; ততদিন তাদের আইনগত ও অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয় । সামজিক ন্যায় বিচারের জন্য এবং সমবায়ভিত্তিক চাষের বাস্তব পরীক্ষার জন্য অর্থপূর্ণ আয়তনে জমি উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়, এই বিবেচনায় জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা প্রস্তাব করা হয় ১০ ‘স্ট্যান্ডার্ড একর, যে সীমা বিভিন্ন ভৌগােলিক অঞ্চলে জমির ফলনশীলতার তারতম্য অনুযায়ী কমবেশি হবে। (যথা, কুমিল্লার জন্য ৭.৫ একর এবং যশােরের জন্য ১৩.৮ একর)। এভাবে জমি রাষ্ট্রায়াত্ত হলে তাদের সমবায়ভিত্তিক চাষের জন্য ভূমিহীন পরিবার থেকে কর্মী নেওয়া হবে এবং তাদের সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই কর্মীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যােগ্যতা হবে অষ্টম শ্ৰেণী, এবং তাদের পারিবারিক জমির পরিমাণ তিন একরের অনুর্ধ হতে হবে । এদের মধ্যে এই কাজে মুক্তিযােদ্ধা এবং/ অথবা সেচ-গ্রুপের দায়িত্বে

অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চাষিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে । তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন পরিকল্পনা কমিশনের এই প্রস্তাব পূর্ণাঙ্গরূপে সরকার কর্তৃক গৃহীত না হওয়ার কারণে তিনি মর্মাহত হন। ৭২ কিছু পরিবর্তনের পর ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ভূমি সংস্কার আইনটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। এই আইনে ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সুদসহ সমস্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করে দেয়া হয়। পাকিস্তান আমলে খাজনা বকেয়া পড়ার কারণে।

——–

১৬৭২, ঐ, পৃ. ৫২।

প্রায় ৬০ লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা হয়েছিল। ভূমি সংস্কার প্রবর্তিত হওয়ার ফলে

কৃষকরা সার্টিফিকেট মামলার হাত থেকে মুক্তি পায়। এর মূল লক্ষ্য হলাে চাষি | যেন জমির মালিক হতে পারে এবং মনে করতে পারে উৎপাদিত পণ্যের সমস্তটার | মালিক সে। এর ফলে তার আত্মতৃপ্তি ঘটবে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ১৯৭২ সালের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী পরিবার প্রতি জমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয় ১০০ বিঘায়। তবে সমবায় সমিতি, চা, রাবার, কফি এবং শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে নিয়ােজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য এই আইন প্রযােজ্য নয়। খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে সেলামি ছাড়াই বণ্টনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ধরনের পরিবারের নিকট জমি বণ্টন করে তাদের মধ্যে সমবায়ভিত্তিক চাষ পদ্ধতি চালুর প্রতি উৎসাহ দেয়ার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করে। হাট-বাজারের ইজারাদারী ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সরাসরি শুল্ক আদায়ের বিধান রাখা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। ভূমিসংস্কার আইনে জমির উচ্চতম ও নিমতম সীমা পর্যালােচনা করে বলা যায় যে, বাস্তবে এটি ইতিবাচক কোনাে ফল বয়ে আনে নি। কেননা একশত বিঘার অধিকারী জমির মালিকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আর যাদের ছিল তারা পরিবারভুক্ত অন্যান্যদের নামে জমি বন্দোবস্ত করে নেয়।

বিরােধী শক্তিসমূহের তৎপরতা

যাহােক সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত সাফল্য চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে। যুদ্ধ সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি একটি অপূর্ব ঐক্যের পরিচয়, দিলেও এর সফল সমাপ্তির পরেই ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তি ভাবনার বিষয়টি উগ্রভাবে সমাজকে গ্রাস করে। নিজের ইচ্ছে মতাে চলাকেই যেন তাদের নিকট স্বাধীনতা বলে মনে হয়, কেবল মনে হয় না স্বাধীনতা তাদের ওপর অন্যের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। একটা সুযােগ দেখা দেয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের জনসম্মােহনী ক্ষমতা দিয়ে জাতিকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যাওয়ার। তিনি যেহেতু যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন সেহেতু এটা বুঝে ওঠার জন্য নিঃসন্দেহে সময়ের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামজিক জীবনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং অন্তর্দলীয় দ্বন্দ্বের ফলে অতি দ্রুততার সাথে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি,

—-

[১৬৭৩, ১.৫ একরের কম জমি মালিক ভূমিহীন বলে বিবেচিত। [১৬৭ কামাল সিদ্দিকী, বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র স্বরূপ ও সমাধান (ঢাকা: ডানা প্রকাশনী, ১৯৯০), পৃ. ৭৪-৭৭।

৫৩৫

কালােবাজারী, মজুতদারি, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি প্রভৃতি নেতিবাচক শক্তিকে প্রবল হতে দেখা যায়। সেই সাথে লক্ষ করা যায় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি আর ত্যাগের মনােভাবের মারাত্মক অভাব। এ সবের সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে মানুষের মধ্যে তীব্রভাবে হতাশা বৃদ্ধি পায় এবং পাকিস্তান শাসনামলের গ্লানি, সামরিক বাহিনীর নির্মম নির্যাতন, সর্বোপরি একটি জনপদকে শ্মশানে পরিণত করে দেয়ার বিষয়টি খুব দ্রুত ম্লান হয়ে যায় । ঢেকে ফেলার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এ দেশিয় সহযােগীদের অপকর্মের সকল চিহ্ন। বিজয়ােত্তর বাংলাদেশে হতাশা সৃষ্টির জন্য সহায়ক এমন সব বিষয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের নিকট স্বাধীনতাযুদ্ধকে হেয় করার জন্য এসব ঘটনা নানাভাবে যে ঘটানাে হয় কেবল তা-ই রয়ে যায় অগােচরে ।।

| দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি যে। আঘাত হানার চেষ্টা করবে সে বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই এক প্রকার নিশ্চিত হন । এ বিষয়ে তিনি জয় বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসেই ইঙ্গিত প্রদান করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের চক্রান্তের বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের অনুমান ও বিশ্লেষণ কতকটা নিষ্ঠুর ভবিষ্যৎবাণীর মতাে ছিল। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষ্যে এটি নিম্নরূপ:১৬৭৫

প্রশ্ন করলাম: বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হবে বলে আপনি মনে করেন? তাজউদ্দীন বললেন: তৃতীয় বিশ্বে ফরেন এইড বা বিদেশি সাহায্য এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে মার্কিন লেখকদেরই কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি । এই লেখা পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি শংকিত । এদের অপারেশন হবে অনেকটা এই ধরনের। বাংলাদেশ মুক্ত হলে এরা বিপুল সাহায্যের অফার নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং নিজেদের তত্ত্বাবধানে সাহায্য বিতরণ করতে চাইবে। সাহায্য যা পাওয়া যাবে, তার বারাে আনা ব্যয় হবে তাদের তদারকিতে, সাহায্য প্রেরণের জাহাজ ভাড়ায় এবং তাদের লােকদের খরচ মেটাতে। কিন্তু বাইরে প্রচার হবে, বাংলাদেশে সাহায্যের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে । এই সাহায্য প্রকৃত অভাবী লােকদের হাতে পৌঁছাবে না। সাহায্যের টাকার দৌলতে সরকারি প্রশাসনে তাদের সমর্থক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করা হবে। দেশপ্রেমিক অফিসার ও মুক্তিবাহিনীর লােকজনকে দুর্নীতি পরায়ন করার চেষ্টা হবে। সরকারবিরােধী এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশিদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাকে টাকা দেওয়া হবে। সরকারি দলের মধ্যে নিজেদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। সামরিক বাহিনীর

————

১৬৭৫ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ১০০-১০১।

আনুগত্য ও দেশাত্মবােধ নষ্ট করা হবে। তারপর বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি এই বিদেশিদের কথামত না চলেন, তাহলে সব দুর্নীতি ও খারাপ কাজের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাঁধে চাপানাে হবে। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক শ্ৰেণীকে বিক্ষুব্ধ করে তােলা হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণীকে হাত করে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হবে এবং এইভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের জনপ্রিয়তাকে নষ্ট করার পর সিভিল অথবা মিলিটারি কু ঘটিয়ে পছন্দমত তাবেদার সরকার বসানাে হবে ।

বললেন: শেখ মুজিব দেশে ফিরে কি করতে চাইবেন আমি জানি না। যদি । তিনি আমার কথা শােনেন, তাহলে এই বিপদ মােকাবিলা করা যাবে। ১৯৭২ সালের শেষ দিক থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের এই ভবিষ্যবাণী স্পষ্টতর হতে শুরু করে। এ সময় পত্রিকায় প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতাবিবৃতিতেও এক প্রকাশ হতাশা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লক্ষ করা যায় । সর্বত্রই বিশৃঙ্খলা, শ্রমিকদের ধর্মঘট, পত্রিকায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রকাশিত নানা সংবাদ, এক শ্রেণীর মুক্তিযােদ্ধা নামধারী লােকের লুটপাট ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, পারমিট ব্যবস্থার অপব্যবহার, সরকারি কর্মচারিদের দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলগুলাের ভূমিকা প্রভৃতি অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা, চীন, পাকিস্তানসহ কতিপয় দেশ, বিশ্বব্যাংক, আই.এম.এফ, প্রভৃতি আর্থিক সংস্থার নীতির বিরুদ্ধে সমালােচনা করে নানা সময় তাজউদ্দীন আহমদ অভিমত ব্যক্ত করেন। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে মহলবিশেষ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কোনাে কোনাে পত্রিকা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন:৬৭৭

অর্থমন্ত্রী বলেন বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে । এই প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ভূঁইফোড় সাপ্তাহিক পত্রিকাসমূহের প্রচারণার তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, গত একমাস ধরে ঢাকায় মনিটর করা পাকিস্তান রেডিওর বক্তব্য এবং এই সব সাপ্তাহিক পত্রিকার বক্তব্যে হুবহু মিল রয়েছে। তিনি বলেন এসব পত্রিকা আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় । এরা রাষ্ট্রীয় মূল ভিত্তিতে আঘাত হানতে চাচ্ছে ও জাতীয় বিভেদ সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে এবং এদের উসকানিতেই আমাদের শিল্পাঞ্চলে আঞ্চলিকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

——

১৬৭৬ দেখুন, সিমিন হােমেন রিমি (সম্পা.) তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ২৬০, ২৭৮, ৩২৯, ৩৪৮, ৩৭৫-৩৭৬, ৩৮৫, ৪১৩, ৪১৬-৪১৭, ৪২২-৪২৩, ৪৫৭, ৪৭০। ১৬৭৭ দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২।

১৯৭২ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশে মুসলিম বাংলা’ নামে একটি শব্দ উচ্চারিত হতে শােনা যায়। বস্তুত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেন নি। বাংলাদেশে পাকিস্তানের এজেন্টরা তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই আন্দোলন শুরু করে। তাজউদ্দীন আহমদ এর তীব্র সমালােচনা করে বলেন এ আন্দোলন কার্যকর হতে পারে না। তিনি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন পাকিস্তান আমলে ইসলামের নাম করে বাঙালিদেরকে ধোকা দেয়া হয়েছিল এখন আবার মুসলিম বাংলার নামে নতুন চক্রান্ত শুরু হয়েছে, এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি আরাে বলেন, এক শ্রেণীর কালােবাজারী, মুনাফাখাের ব্যবসায়ী দেশে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি পারমিট প্রথার দুর্নীতি দূর করার জন্য সংবাদপত্রে প্রকৃত পারমিটধারীদের নাম প্রকাশের আহ্বান জানান যাতে জনগণ তাদের চিনতে পারে।” ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, এটা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য যেমন প্রয়ােজন, তেমনি বিশ্বব্যাপী ট্রেড ইউনিয়নগুলাে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাজেই ট্রেড ইউনিয়ন কেবল দাবি আদায় আর শ্রমঘণ্টা কমানাের জন্যই নয়, বর্তমান বাস্তবতায় উৎপাদন ব্যবস্থাকে জোরদার করা অগ্রগণ্য বিষয়।৬৮২ বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে তাজউদ্দীন আহমদ সামগ্রিকভাবে নিজেদের আত্মসমালােচনা করে বলেন, দেশের যে যুবশক্তি শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করেছে তাদেরই কেউ কেউ আজ অস্ত্র হাতে লুটতরাজ করছে, এদের অনেকেই হয়তাে প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধা নয়। সমাজে অস্থিরতা ও হতাশা দেখা দিয়েছে, কেননা দেশের যুব সমাজকে কাজে লাগানাের উপযুক্ত ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত করা যায় নি। তবে এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে। তিনি আরাে বলেন জাতিকে সঠিক পথ দেখানাের দায়িত্ব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলাের।১৬৮৩

জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যখন রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি তখন অন্যান্য দল তাে দূরের কথা খােদ আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনের মধ্যে নেতৃত্বদ্বন্দ্বে বিভক্তি দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীতে যুবনেতা

——-

১৬৭৮ দৈনিক বাংলা, ১৬ জুলাই, ১৯৭৩। ১৬৭৯ ঐ, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭২। ১৬৮০, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ আগস্ট, ১৯৭২। ১৬৮১

দৈনিক পূর্বদেশ, ১৮ আগস্ট, ১৯৭২।

ঐ, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২। ১৬৮৩ দৈনিক বাংলা, ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭২।

১৬৮২,

শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খান একত্রে কাজ করলেও তাদের মধ্যে প্রধানত ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধের শেষ দিক হতে এক প্রকার প্রতিযােগিতা শুরু হয়। এর প্রথম প্রভাব পড়ে ছাত্রলীগে। ১৯৭২ সালের ২১, ২২, ২৩ জুন একই সময় রমনা রেসকোর্স মাঠে সিদ্দিকী মাখন গ্রুপ এবং পল্টন ময়দানে রব-সিরাজ গ্রুপের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমােক্ত গ্রুপের সম্মেলনে উপস্থিত হন। সম্মেলন দুটোতে উপস্থিতির পরিমাণ দেখে সরকারবিরােধী প্রবণতাই বেশি করে লক্ষ করা যায়।৬৮৮ রাষ্ট্রের পরিচালক ও প্রধান নেতা হিসেবে তিনি দেশের এই নাজুক পরিস্থিতিতে একটা পক্ষে যােগ দিয়ে কতটা রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় দেন তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই বিভক্তি রােধ করা দরকার ছিল। অনেকেই মনে করেন ছাত্র সমাজের এই বিভক্তি রােধ করতে পারলে পরবর্তীকালের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা নাও ঘটতে পারতাে। বস্তুত ১৯৭২ সালের ২৩ জুন ছাত্রদের উভয় গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় একই বছর ৩১ অক্টোবর যুবনেতা আ.স.ম রব এবং প্রাক্তন মেজর জলিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠন করেন। মুজিবনগর সরকার আমলের কিছু জের এবং যুবনেতাদের মধ্যে পারস্পরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের উৎপত্তির মূল কারণ। দলটির উৎপত্তিগত দলিলপত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে অসমাপ্ত যুদ্ধ বলে মূল্যায়ন করা হয়। এর মূল পুঁজি ছিল। বিরাজমান বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, সম্পদের সীমাবদ্ধতা আর মানুষের স্বপ্নশ্রয়ী প্রত্যাশা। এর সঙ্গে যােগ করা হয় ভারতবিরােধী প্রচারণা। বস্তুত তাদের পক্ষ থেকে চলতি সংকটের জন্য আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব ও ভারতকে কার্যত দায়ী করা হয়। জাসদ গণবাহিনী গঠন করে শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার প্রতি একদিকে আহ্বান জানায় অন্যদিকে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করে। একদিকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ পেতে বিলম্বের কারণে হাহাকার করে অন্যদিকে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে প্রায় প্রত্যাখান করে।*** চীনপন্থী মােহাম্মদ তােয়াহার নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা

১৬৮৪. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৯। ১৬৮৫ ঐ, পৃ. ২৯১1 ১৬৮৬ মােঃ রােকনুজ্জামান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও বাংলাদেশের রাজনীতি (ঢাকা: মীরা প্রকাশন, ২০০৫), পৃ. ১২৯-১৩০। ১৬৮৭ ঐ, পৃ. ৬৩-৬৮।

. ঐ, সংযােজনী-২, পৃ. ২০৬।

পার্টিও সশস্ত্র বিপ্লবের লাইন বেছে নেয়। তারা মানুষের বিদ্যমান অসন্তুষ্টিকে কাজে লাগিয়ে পরিস্থিতিকে আরাে সংকটময় করে তােলেন। আজ একথা অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নতুনভাবে যাত্রা শুরুর জন্য যে ধরনের প্রশাসনিক ও অন্যান্য দক্ষতা, প্রাজ্ঞ দৃষ্টিভঙ্গি ও দেশপ্রেম, ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা দরকার ছিল তা শাসকদলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, আমলা ও জনসাধারণের মধ্যে অভাব ছিল, তেমনি সরকারকে বিপাকে ফেলে ব্যর্থ করে দেয়ার এ ধরনের উদ্যোগ কোনভাবেই সুবিচেনাপ্রসূত ছিল না। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে যা ঘটে তাতে এগুলােকে চক্রান্তের শামিল বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বস্তুত এসময় বিভক্তি নয় প্রয়ােজন ছিল জাতীয় ঐকমত্য এবং এক্ষেত্রে সরকারি দলের দায়িত্বই ছিল অধিক। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন যতটা উপলব্ধি করেছিলেন তেমনটি অন্যদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রমিক লীগেও দ্বিধা বিভক্তি ঘটে। আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক রুহুল আমীন ভূঁইয়াসহ কয়েকজন শ্রমিকনেতাকে দুর্নীতির অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবিতে জাসদ ও এর ছাত্র সংগঠন জাসদ ছাত্রলীগ ৭ ডিসেম্বর ধর্মঘট আহ্বান করে।১৬৮৯ আসন্ন সংসদ নির্বাচনে জাসদ সব কয়টি আসনে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশের মধ্যে শীঘ্রই আওয়ামী লীগ ও মুজিববিরােধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখা যায়। অনুরূপভাবে সুযােগ বুঝে খােদ আওয়ামী লীগে তাজউদ্দীন আহমদবিরােধী অংশটি সংহত হতে চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের তৎপরতা তিনি দৃঢ়তা ও ধৈর্যের সঙ্গে মােকাবিলা করেছিলেন । কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবার উপরে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে মুক্তিযুদ্ধের সকল বিষয় জানানাের কোনাে সুযােগই তাজউদ্দীন পাননি। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি তাজউদ্দীন বিরােধীদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। মুজিবকে তুষ্ট করে কৃপালাভের জন্য তাকে ঘিরে থাকা ব্যক্তিরা ‘মুজিববাদ’ নামক একটি শ্লোগান দেয়া শুরু করে। এদের বক্তব্য ছিল ধার করা কোনাে মতবাদ দিয়ে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে না, পরিচালিত হবে শেখ মুজিব নির্দেশিত যে ধ্যান-ধারণায়

——–

১৬৮৯

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৩। ঐ, সংযােজনী-৩, পৃ, ২০৮।

“ডাকসু শেখ সাহেবের আজীবন সদস্যপদ বাতিল ঘােষণা করে। এ সম্পর্কিত সনদ ছিড়ে ফেলা হয়েছে বলে শােনা যায়। আওয়ামী লীগ বিরােধীরা শেখ সাহেবের প্রতিকৃতি দেওয়াল থেকে ছিড়ে ফেলে, তার ছবি লক্ষ্য করে গুলী বর্ষণ করে। কোনাে কোনাে সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধু” ও “জাতির পিতা” লেখা বন্ধ করে।” আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৬।

৫৪০

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে তার ভিত্তিতে। উপনিবেশের বিরুদ্ধে এটা ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম । কিন্তু মুজিব বাস্তবে কোনাে মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তাজউদ্দীন আহমদ একদল দক্ষ দেশপ্রেমিক আমলা আর বুদ্ধিজীবীর সহযােগিতায় যুদ্ধোত্তর দেশ পরিচালনার জন্য যে রূপরেখা প্রণয়ন করে রেখেছিলেন মুজিব দেশে ফিরে এলে তাকে সে বিষয়ে তাজউদ্দীন অবহিত করেন এবং বলেন সেগুলাে পর্যায়ক্রমে বাস্ত বায়ন করতে শুরু করলে ক্রমশ সকল সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আর তাজউদ্দীন নিজে থাকবেন দল নিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হন। অল্পপরেই ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। মুজিববাদের সমর্থক জিলুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হলে দলে তাজউদ্দীনের কর্তৃত্ব লােপ পায়। তাকে একজন সাধারণ সদস্য করে রাখা হয়। | এই সময় ভাসানীও বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা নিয়ে বৃহত্তর বঙ্গ গঠনের আহ্বান জানান। তিনি ভারতের ঐসব অঞ্চলের মানুষদের উদ্দেশে বলেন। যে, তারা দিল্লি ও মাড়ােয়ারী ব্যবসায়িদের দাসে পরিণত হয়েছে। তার এ ধরনের অবাস্তব আহ্বানের (উসকানির) পেছনে অন্য কোনাে যুক্তি ছিল কিনা জানা যায় । কিন্তু এর দ্বারা ভারতের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক মানুষকে যে উসকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনি হক কথা নামক একখানি পত্রিকার মাধ্যমে ভারত বিরােধিতা প্রচার করতে থাকেন।৬৯৫ যে ভাসানী ১৯৭১ সালের শেষের দিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন, তিনিই বিস্ময়করভাবে ১৯৭২-৭৩ সালে এসে ‘মুসলিম বাংলা’ গঠনের জন্যে উঠে পড়ে লাগেন। বলা যেতে পারে, পরাজিত শক্তিসমূহ কৌশলে মওলনা ভাসানীর জননেতৃত্বের ছত্রছায়ায় সংগঠিত হতে থাকে। তার এই সংগ্রামের আহ্বান ও ভুট্টোর শিথিল কনফেডারেশন অথবা মুসলিম বাংলার ধারণা অভিন্ন বিষয়ে পরিণত হয়। ১৯৭২ সালের শেষ দিক হতে তার এই নবতর সংগ্রামের কথা বিভিন্নভাবে প্রচার করতে থাকেন। এই পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর সম্যক আলােকপাত না করলে বুঝা যাবে না যে, ক্ষমতাসীন ও

——–

১৬৯২. সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। ১৬৯৩, মাে. আনিসুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫।

** আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু (ঢাকা: র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স, তৃতীয়। সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃ. ১৬-১৭। ১৬৯৫ সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৩।

ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনীতি চর্চা কতটা অদূরদর্শী ও অপরিপক্ক ছিল যার ফলে যুদ্ধোত্তর দেশ গঠনে মুক্তিযুদ্ধের ন্যায় সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় অন্তর্ভূক্ত করা যায়নি। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দল জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল । কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভিত্তিতে দেশ শাসনের নিরঙ্কুশ অধিকারী বলে বিবেচনা করে । স্বাভাবিক অবস্থায় সেটাই হওয়ার কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র সমাজের ভাবাদর্শিক অবস্থানকে এমন এক পর্যায়ে পৌছে দেয় যে, যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনের জন্য সকলের অংশীদারিত্বমূলক দায়িত্ব পালন ছিল অনস্বীকার্য। সে সুযােগ না পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তারা বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল পল্টন ময়দানের একটি জনসভায় ভাসানী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সমাজতন্ত্র অভিমুখী সরকারকে সমর্থন দানের ঘােষণার পাশাপাশি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে

বলেন:১৬৯৬

মুজিব তােমার পপুলারিটি ভাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগের একদল লােক বাড়ি গাড়ি ও ব্যাংকের মালিক হবার চেষ্টা করছে । তুমি এদের দমন করাে । তা না হলে তােমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার । তুমি লুটপাট সমিতির কার্যকলাপ বন্ধ করে মানুষকে খেতে পরতে দাও। অন্যথায় তােমার সমস্ত জনপ্রিয়তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। এ দেশের সংগ্রামী জনতা সংগ্রাম করেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিতাড়িত করেছে। পাঞ্জাবী শােষকদের ধ্বংস করেছে। এই সংগ্রামী জনতাই এরপর স্বাধীনতার শত্রু

এই পারমিট শিকারীদের উৎখাত করে ছাড়বে। | বস্তুত এ সময় পর্যন্ত সরকার সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উঠতে পারনি। এমতাবস্থায় ভাসানীর আগ্রীম এই হুঁসিয়ারি তাত্ত্বিকভাবে সঠিক হলেও বিবেচনাপ্রসূত ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নকশালপন্থীদের দেখামাত্র গুলি করার নিদের্শের সমালােচনা করে তিনি বলেন এটা গণতান্ত্রিক রীতি নয়। অপরাধীকে বিনা বিচারে শাস্তি দেয়া যায় না। গণতন্ত্রে বিরুদ্ধ মত থাকে। এর জন্য শক্তিশালী বিরােধী দলের অপরিহার্যতার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। ইতােমধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হলে ভাসানী তার সমালােচনা করে বলেন জাতির সংবিধানের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে জাতীয় কনভেনশনের

——

১৬৯৮৬*, ঐ, পৃ. ৪৪৪। [১৬৯৭ ১০ এপ্রিল ১৯৭২ গণপরিষদের বৈঠকে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হােসেনকে সভাপতি করে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, খন্দকার মােশতাক আহমদ প্রমুখ ৩৩ জন সদস্যের সমন্বয়ে সংবিধান কমিটি গঠিত হয় । ‘আনিসুজ্জামান, বিপুলা পৃথিবী’, প্রথম আলাে, ১৮ জুন, ২০০৪।

মাধ্যমে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মত গ্রহণ করা উচিত। বস্তুত বিরােধীদের এ ধরনের চাপের মুখে এবং দলের অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে তাজউদ্দীনের অভিমত ছিল শূন্য আসনগুলােতে উপনির্বাচন করার পক্ষে। নির্বাচনের সুযােগে ভাসানীকে কেন্দ্র করে অতীতের ন্যায় বিরােধীশক্তি জোটবদ্ধ হয়। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন নির্বাচিত হওয়ায় এবং কিছু আসনের ফল বিতর্কিতভাবে ঘােষণা করায় বিরােধী রাজনৈতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয় এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস দেখা দেয়। বিরােধীরা লাভ করে মােট ৮ টি আসন। ফলে শক্তিশালী বিরােধীদলের অস্তিত্ব তাে দূরের কথা প্রায় বিরােধীদলহীন সংসদ গঠিত হয় যা পক্ষান্তরে সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ রুদ্ধ করে দেয়। দলীয় সংসদ সদস্যদের ‘ফ্লোর ক্রশ করার রীতি না থাকায় সরকারের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে আলােচনার সুযােগ ছিল না। মওলনা ভাসানীর ভােটের প্রচারণা কাজ ছেড়ে অসুস্থতার অজুহাতে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের সেবাযত্ব গ্রহণের পশ্চাতে একটি রহস্যের ইঙ্গিত প্রদান করেন কোনাে কোনাে সমালােচক। যা-ই ঘটে থাকুক

কেন আওয়ামী লীগের শক্তিকে নিরঙ্কুস করার জন্য চেষ্টা করা হয়। এ জন্য সাধারণভাবে দলের নীতি নির্ধারকদের দায়ী করা না গেলেও পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন করে আওয়ামী লীগের একলা চলার নীতি পরিহার করা অথবা শক্তিশালী বিরােধীদলের বিকাশের পথ উন্মুক্ত রাখলে দূরদর্শীতার পরিচয় দেয়া হতাে। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলশন ম্যান্ডেলার দল ANC সমগ্র দেশ শাসন করার অধিকার পেলেও আজন্ম শত্রু জুলু নেতা চিফ বেথােলজীকে ক্ষমতার অংশিদারিত্ব করে বিরােধীশক্তিকে দেশ গঠনের প্রাথমিক পর্বে কাজে লাগান। ভারতেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও কমিউনিস্টদেরকে শক্তি সংহত করার আহ্বান রেখেছিলেন যাতে কংগ্রেস কোনাে কারণে ব্যর্থ হলে বিকল্প শক্তি হিসেবে অপশক্তিরা সে সুযােগ গ্রহণ না করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের আলােকে বলা যায় এতদঞ্চলের মানুষ নিজেদের দ্বারা শাসিত হওয়ার অভিজ্ঞতা কমই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেটা বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয় তার মূল প্রবণতা ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে

———

সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪৫-৪৬। ১৬৯৯ বদরুদ্দিন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯১। ১৭০০

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৯। ১৭০১ কলম মণলল

সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৮। ১৭০২, ঐ, পৃ. ৪৫৪-৪৫৫।

সংগ্রাম করা। এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ববােধ বৃদ্ধি কিংবা অভিজ্ঞতা। অর্জনের সুযােগ ছিল না, বলা যেতে পারে দায়িত্বশীল রাজনীতি চর্চার প্রবণতা। তখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয় নি। এই প্রবণতা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য দু একজন ব্যতীত তেমন কেউ সচেতন ছিলেন বলে জানা যায় না। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি প্রশাসক হিসেবে এই যােগ্যতার প্রয়ােগের সুযােগ। পান নি।

যাহােক, মওলনা ভাসানী সারা জীবন সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে তাদের। প্রাণের দাবি তুলে ধরেছেন। তার বােধ ও ব্যক্তকরণ ক্ষমতাও ছিল শক্তিশালী। তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তােলার কোনাে অবকাশ নেই। তিনিও বস্তুত দেশ। গঠনের ক্ষেত্রে বৈদেশিক শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ না করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তিনি বিভিন্নভাবেই প্রভাবিত হতেন। বস্তুত দেশের চলতি সংকটের প্রেক্ষিতে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ভাল-মন্দ উভয় প্রকার শক্তিই তাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। এক পর্যায়ে ধর্মাশ্রয়ী চরম ডানপন্থী এবং পিকিংয়ের সমর্থনপুষ্ট চরম বামপন্থী দলগুলাে তাকে কেন্দ্র করে দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টির সকল প্রকার চেষ্টাই করে। তিনি হয়ে ওঠেন চরম ডান ও চরম বামপন্থার মিলনস্থল। ডান ও বামের এমন সম্মিলন পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায় না। আজন্ম প্রতিষ্ঠানবিরােধী (Anti-Establishment) এই নেতা। সম্পর্কে মার্কিন কূটনীতিক আর্চার কে, ব্লাডের মূল্যায়নটি যথার্থ বলে মনে

হয়:১৭০৪

Maulana is a paradox-a mixture of sincerity and absordity, a Muslim, a rebel and anarchist dressed up as a revoutionary

socialist, a tragic and unfulfilled man. ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু পিত্তাশয়ের পাথর অপসারণের জন্য লন্ডনে যান এবং ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য কিছুদিন জেনেভায় অবস্থান করেন। ৫০ দিনের অধিক সময় বাইরে অবস্থান করে তিনি ফিরে আসেন ১৬ সেপ্টেম্বর। তার অনুপস্থিতির সুযােগে ঢাকাস্থ কোনাে কোনাে কূটনৈতিক মহল থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শেখ মুজিব দুরারােগ্য ক্যান্সারে ভুগছেন বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই গুজব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে

——-

১৭০৩ ঐ, পৃ. ৪৪৬।

Archer K Blood, The Cruel Birth of Bangladesh (Dhaka: The University Press Limited, 2002), p. 60. ১০ই আবদুল গাফফার চেধুৈরী, প্রাগুক্ত পৃ. ৩০। এ বিষয়ে দেখুন, কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি, দিনলিপি:

সংক্রমিত করে। এর ফল হয় ভয়াবহ । তাহলে কে হবেন ভবিষ্যৎ নেতা? শুরু হয়ে যায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব শত্রুতায় পর্যবসিত হয় এবং ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্যে মস্কো গমন করলে তার অনুপস্থিতিতে তা চরম আকার ধারন করে। অন্তর্দলীয় কোন্দলে একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালে মুজিব আলজিরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যােগ দিতে গেলে তার অনুপস্থিতিতে সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র হলে ৩ জন ছাত্র নিহত হয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরাে ৭ জন ছাত্র প্রতিপক্ষের আক্রমণে নিহত হয়। এ জন্য শেখ মণি ও তােফায়েল আহমদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযােগিতা দায়ী বলে শােনা যায়।৭০৮ শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও উত্তরসুরী হওয়ার প্রতিযােগিতা শুরু হয়। সব মিলিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের ভেতরে বহুমুখী উপদলীয় কোন্দল প্রকট হয়ে ওঠে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ অতীতের অভিজ্ঞতার আলােকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনে বিধিনিষেধ আরােপের প্রয়ােজনীয়তার কথা বার বার উচ্চারণ করেন। এই কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলােকে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ হয়। ফলে পরাজিত ধর্মাশ্রয়ী দলগুলাে প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার হারায়। তারা সুযােগের অপেক্ষায় থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কবি দাউদ হায়দার সংবাদ পত্রিকায় একটি কবিতায় হযরত মােহম্মদ, বুদ্ধ, যীশু, কৃষ্ণ ও অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে একটি কবিতা লিখেন। এই সুযােগে নিষিদ্ধঘােষিত

——-

২০০৩), পৃ. ৭৩-৭৪। রাশিয়ান চিকিৎসকদের পরীক্ষায় ধরা পড়ে যে, মুজিবের ব্রংকাইটিস হয়েছিল । দেখুন, নূরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু: ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দৃষ্টিতে (ঢাকা: মমিন অফসেট প্রিন্টিং, ১৯৯৭), পৃ. ১০২। ১৭০৬ আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০-৩১। ১৭০৭ ঐ, পৃ. ৩৪। ১৭০৮ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস (ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৬), পৃ. ৬২। আরাে দেখুন, কাজী ফজলুর রহামন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।

০৯…. শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোনাে সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনাে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোনাে প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে । বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, ১ম খণ্ড, ডিসেম্বর ১৪, ১৯৭১, পৃ. ৩৪০৬, ৩৪১২।

৫৪৫

জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সােচ্চার হয়ে উঠলে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। | একদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিসমূহের মধ্যে সংহতির মারাত্মক অভাব। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অভিযুক্ত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীরও বিচার করা সম্ভব হয়না। তাদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে অভিযােগ আনা হলে চিকন আলী নামক মাত্র একজন দালালের বিচার করা সম্ভব হলেও রায় কার্যকর করা যায়নি।১৭১২ অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসের যে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়, তার জন্য একজন অপরাধীকেও শাস্তি পেতে হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও কোনাে রাষ্ট্র, সম্প্রদায় বা জাতির প্রশ্নে অপরাধীদের ক্ষমা করে দেয়া কোনভাবেই মহত্বের পরিচায়ক হতে পারে

। কেননা এ ধরনের ক্ষমার কারণে একটি জাতির আত্মত্যাগ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি হয়ে পড়তে পারে বিপন্ন, কিংবা দেশ মানবতাবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আবর্তে তলিয়ে যেতে পারে। বস্তুত পাকিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে মুসলিম দেশগুলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার জন্য পাকিস্তানের সমর্থনে তারা প্রচণ্ড সােচ্চার ছিল। আমেরিকাও এ বিষয়ে চাপ প্রয়ােগ করে। ১৯৭৪ সালে লাহােরে ও.আই.সি, সম্মেলনে বাংলাদেশকে যােগ দেওয়ানাের জন্য চাপ দেয়ার পেছনে প্রধান একটি কারণ ছিল অভিযুক্ত ১৯৫ জনের বিচার না করতে দেয়া। এ ধরনের চাপ ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ সময়ে পাকিস্ত “নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান একটি লক্ষ্যই ছিল তাদের অপকর্মের সহযােগী ঐ সকল বাঙালিকে রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানাে। অপরাধীদের বিচার তাে করা যায় নি, উপরন্তু পাকিস্তানে আটকে পড়া সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্রততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা দেখা দেয়। প্রশাসনের একটি অংশও এ ধরনের চেষ্টা করে। তাজউদ্দীন আহমদ দালাল আইনে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানান। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের কোনাে দেশেই এভাবে ক্ষমা করা হয় না। এক্ষেত্রে যে কারণেই তাদেরকে ক্ষমা করা হােক না কেন, সেটা ন্যূনতম বিচারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দণ্ড মওকুফ করে দিতে পারেন। এটা করা হলে মুক্তিযুদ্ধে

———-

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১।

Fakhruddin Ahmed, Critical Times: Memories of a South Asin Diplomat (Dhaka: University Press Limitted, 1994), p. 91. ১৭১২, জাওয়াদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬২। ১৭১৩

এ বিষয়ে দেখুন, Fakhruddin Ahmed, op-cit., pp. 99-109.

শহীদদের আত্মীয় স্বজন ও সভ্য জগতকে বুঝানাে যাবে ন্যূনপক্ষে অপরাধীদের বিচার করা গেছে; ইতিহাসে অন্তত লেখা থাকবে যে, মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেষ্টা করা হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে কিছুটা অসুবিধা দেখা দেয়। মুজিব কিছুটা বাইরের চাপে কিছুটা অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে এ ঘােষণা দিতে বাধ্য হন। অভ্যন্তরীণ চাপ ছিল এ ধরনের যে, একই পরিবারের কেউ মুক্তিযােদ্ধা কেউবা রাজাকার ছিল। এমতাবস্থায় বিচার করাটা নিঃসন্দেহে জটিল বিষয়। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদের উক্ত মত উপেক্ষিত হয়।১৭১৫ ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করা হলে কমপক্ষে ৩৬৪০০ জন অভিযুক্ত মুক্তি লাভ করে ।(যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ ছিল তাদেরকে এই সাধারণ ক্ষমার বাইরে রাখা হয়েছিল)। সঙ্গত কারণে মুক্তিযুদ্ধের ধ্যানীপুরুষ তাজউদ্দীন আহমদ মর্মাহত হন। তিনি পরিচিতজনদের নিকট তার এই হতাশা, মর্মপীড়া ও ভবিষ্যৎ ভয়াবহতার বিষয়ে প্রায়ই ক্ষেদোক্তি ও আশংকা ব্যক্ত করতেন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বহু বছর পরে সম্প্রতি বিচার করা হয়েছে; ইসরায়েলীরা যুদ্ধাপরাধী আইখম্যানকে দীর্ঘ সময় পর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ধরে এনে বিচার করেছে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে আটকে পড়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক মানুষকে স্বদেশে ফেরত আনার স্বার্থে বাংলাদেশ সরকার দালাল আইনে অভিযুক্তদের বিচার করতে সক্ষম হয়নি। ফেরত আনার বিষয়টি ছিল নিঃসন্দেহে মানবিক। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, অতি দ্রুত তাদের ফিরিয়ে আনার ফল হয় আত্মঘাতি । কেননা তাদেরকে পুনর্বাসনের জন্য একদিকে যেমন প্রচুর অর্থের প্রয়ােজন হয়, তেমনি তারা দেশে ফিরে বিভিন্ন চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা ও অন্যন্য সুযােগ দাবি করেন। ফলে প্রশাসনে এক ধরনের

———-

১৭১৪ কাজী ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৬-৫৭। ১৭ই তপন কুমার দে, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র: তাজউদ্দিনের পদত্যাগ’, মাতৃভূমি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। ১৭১৬, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১। “” … তােমরা আমাকে ভুলতে পারাে বটে কিন্তু আমি ভারতবর্ষকে ভুলতে পারবাে

। আমি তােমাদের দেশকে ভালােবাসি এবং শ্রীমতি গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি। শেখ সাহেব। আবার পাকিস্তানি, রাজাকারদের এই দেশে ফিরিয়ে আনছেন। আমি শুধু আমার জীবনের নয় বঙ্গবন্ধুরও জীবনের আশঙ্কা করছি।” বিক্রমাদিত্য, কনফিডেনসিয়াল ডায়েরি (কলকাতা: কসমাে স্ক্রিপ্ট, ১৯৮১), পৃ. ৬২। বিক্রমাদিত্যের প্রকৃত নাম অশােক গুপ্ত, তিনি ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের প্রেস এ্যাটাচের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একই স্কুলে তাজউদ্দীন আহমদের এক ক্লাস ওপরের বন্ধুস্থানীয় ছাত্র ছিলেন।

বৈষম্য ও জটিলতার সৃষ্টি হয়। স্বভাবতই যে আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে তারা তা অনুধাবনে ব্যর্থ হন অথবা উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে প্রশাসনে আর একটি পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। এও দেখা যায় যে, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতার সুযােগ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের ওপরে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে খবরদারী করতে থাকেন।৭১৮ এতে মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজ করে আসা কর্মকর্তাকর্মচারিদের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। পাকিস্তান ফেরত আমলাদের অনেকের অপচেষ্টায় দেশপ্রেমিক, মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তাদেরকে প্রশাসন হতে বিতাড়ন করা হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষা সচিব অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের, পরিকল্পনা কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও অন্যান্যদের নাম উল্লেখ করা যায় । এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যে, তাদের অনেকেই মান সম্মান বাঁচাতে কোনাে প্রকারে পূর্বতন পেশায় ফেরত যেতে বাধ্য হন। যে কারণেই এদের সরানাে হােক না কেন এতে প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শানুসারীদের সংখ্যা কমে যায়। এ পর্যায়ে পাকিস্তান আমলের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার অনুসারী বুদ্ধিজীবী যাদেরকে প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়েছিল এই দুই গ্রুপের মধ্যে একটি দ্বিমুখী টানপােড়ন শুরু হয়। পূর্বতন আমলারা অধিকতর সুবিধাজনক স্থানে ছিলেন এই জন্য যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক মন্ত্রীই ছিলেন প্রশাসনের বিষয়ে অজ্ঞ। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ত্রিমুখী একটি সংকট সৃষ্টি হয়, যা প্রকারান্তরে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ ও অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কাজেই | পাকিস্তান হতে ফিরিয়ে আনা সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দ্বারা। নবজাত বাংলাদেশ প্রশাসন কোনভাবেই সমৃদ্ধ হয়নি। এ সম্পর্কে পরিকল্পনা।

কমিশনের অন্যতম সদস্য এবং উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানের প্রত্যক্ষ | অভিজ্ঞতা হতে তৎকালীন অবস্থার একটি চিত্র এখানে উল্লেখ করা যেতে

পারে:১৭২১

একদিকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ঘােষণা করা হলাে, অন্যদিকে প্রশাসনকে ভয়ানক দক্ষিণপন্থী গণবিরােধী আমলাদের হাতে তুলে দেয়া হলাে যারা

——

১৭১৮ তপন কুমার দে, মাতৃভূমি, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। ১৭১৯ ঐ, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। ১৭২০ মওদুদ আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০১। এ বিষয়ে আরাে দেখুন, Nurul Islam, op.cit., pp. 147-154.

২ মােঃ আনিসুর রহমান, অপহৃত বাংলাদেশ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩), পৃ. ৪৬।

তাদের মানসিকতা বদলাতে একেবারেই রাজী নয় এবং নাছােরবান্দার নাচোড়বান্দার মতাে তাদের পদমর্যাদাজ্ঞান ও বিশেষ সুবিধাদি আঁকড়ে ধরে। আছে । অল্প কিছুদিনের জন্য একটা সমতাবাদী বেতনকাঠামাের সঙ্গে প্রণয়ের ভান করে নেতৃবৃন্দ তাদের নিজেদের প্রলােভনের কাছে এবং আমলাদের কাছ থেকে চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করলাে এবং বেতন ও অন্য সুবিধাদি দুটোই বাড়াতে থাকলাে। একদিকে দেশের এলিটদের অত্যন্ত বিলাসী জীবন যাপন করতে দেওয়া হলাে, আর অন্যদিকে সাধারণ জনগণ যাদের এ রকম সামাজিক শক্তি নেই, তাদের বলা হলাে। আরাে তিনবছর কষ্ট সহ্য করতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড বিরােধিতার মুখেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিজয় লাভ করায় নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি এটিকে তাদের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শক্তির এক নতুন বিন্যাস। ঘটবে এবং তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে বলে আমেরিকার গােপন কাগজপত্রে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। তাই যুদ্ধের মাঠে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকানাে যায় নি তখন তাদের স্বার্থরক্ষার্থে আমেরিকা ‘Get our || people in, their people out’ নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। আমেরিকার স্বার্থরক্ষাকারী এই সকল ব্যক্তি কারা? পাকিস্তানের শাসনাধীনে যে সকল উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তারা। এবং পাকিস্তান থেকে আগত কোনাে কোনাে কর্মকর্তা। কেবল আমেরিকাই নয়।’ ভুট্টোও পরিকল্পিতভাবে আটকেপড়া বাঙালিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন। তারাই প্রশাসনের প্রধান জায়গাগুলাে দখল করে নেয় । সাংবাদিক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহলেও তাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। কেননা তারাই ‘৭৫ পরবর্তী | রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বেনিফিসিয়ারি হয়। মুজিব কিছুটা বুঝে কিছুটা

বুঝে এমন সব মানুষকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে বসান যারা যুদ্ধের সময় ! মুক্তিযুদ্ধবিরােধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানকে সাহায্য অথবা পাকিস্তান সরকারের অধীনে কাজ করেছিলেন। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর এর আদর্শবিরােধী ব্যক্তি এত দ্রুত পুনর্বাসিত হতে আর কখনাে কোথাও দেখা যায় না। এ ধরনের কাজ।

—–

১৭২২ লরেন্স লিফশুলজ ‘সােলার্জের চিঠিপত্র ১৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের নেপথ্য সন্ধান’, প্রথম আলাে, ২২ আগস্ট, ২০০০। ১৭২৩ বাঙালি কূটনীতিবিদ জনাব ফখরুদ্দীন আহমদ ১৯৭৩ সালের গােড়ার দিকে। বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি দেশে পৌছেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি গােপন প্রতিবেদন পেশ করেন, যাতে দেখা যায় ভুট্টো পরিকল্পিতভাবে আটকে পড়া বাঙালিদের ওপর প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছেন । Fakhruddin Ahmed, op.cit., p. 88.

আত্মঘাতি এবং বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী আদর্শে অনুপ্রাণিত এসব কর্মকর্তা মুজিব প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসিত হন। এদের সঙ্গে যুক্ত হন কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, এরা প্রায় সকলেই এক পর্যায়ে মুজিবের কৃপা লাভ করেন। তারা নিজেদের সাময়িক দুরবস্থা এবং পুরনাে প্রভুদের প্রদত্ত প্রলােভনে পড়ে বাংলাদেশের আদর্শবিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত হন। এসব ব্যক্তির মাধ্যমে আমেরিকা ও পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থা নবজাত বাংলাদেশের প্রশাসনে অনুপ্রবেশ করে। এরা ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিশােধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। মুজিবের হৃদয়ের বিশালতার সুযােগ নিয়ে এরা পুনর্বাসিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভিতর থেকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে এ ধরনের ব্যক্তিদের বসানাের বিষয়টি তখন ঢাকার সচেতন মহলকে বিস্মিত করে।”২৫ এ বিষয়ে মুজিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন শত্রুদের চোখে চোখে রাখার জন্যই এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে মুজিব ছিলেন প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী প্রকৃতির মানুষ; কেউ তাকে হত্যা করতে পারে কিংবা কোনাে অদৃশ্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। তিনিই শক্রর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছেন তা ভাবতে পারেননি। স্বাধীনতাবিরােধী এসব ব্যক্তি ‘ট্রোজান হর্স’ হয়ে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে অনুপ্রবেশ করেন। উল্লেখ্য, মুজিব সরকারের পতনের পর এরা প্রায় সকলেই। মােশতাক আহমদ ও তার পরবর্তী সরকারের অধীনে বহাল থাকেন, বলা যেতে পারে পুরস্কৃত হন। মুজিবকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্বার্থন্বেষীদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের একজন সদস্য মফিজ চৌধুরী লিখেছেন যে, তােষামােদকারী আর স্বার্থান্বেষীদের ভিড়ে মুজিবের ব্যক্তিগত অবসরেরও সুযােগও ছিল না, উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তায় নন্দিত মুজিব যেন ক্রমশ সীজারের মতই অদৃষ্টের হাতে সমর্পিত

হন।১৭২৭

প্রশাসনিক ক্ষেত্র ছাড়াও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শক্তি অতি দ্রুত সংগঠিত হতে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অভাব অনটন ও বিশৃঙ্খলার জন্য ভারত ও শাসকদলকে দায়ী করে অত্যন্ত সুকৌশলে প্রচার

——-

১৭২৪ মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসিত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার জন্য দেখুন, বিক্রমাদিত্য রচিত কনফিডেন্সিয়াল ডায়েরি এবং অধ্যাপক আবু সাইয়িদ রচিত বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস গ্রন্থ দুখানি । ১৭২৪, বিক্রমাদিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১। ১৭২৬, ঐ, পৃ. ১২২। ১৭২৭ মফিজ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯১), পৃ. ১০১-১০২।

৫৫০

প্রপাগাণ্ডা শুরু করা হয়। অতি সহজেই সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। এই ভারতই যে প্রায় ১ কোটি শরণার্থীকে প্রায় ৯ মাস কোনভাবে হলেও বাঁচিয়ে রেখেছিল। এবং মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সর্বাত্মক সহযােগিতা দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভে অবদান রেখেছে তা মানুষ একেবারে বিস্মৃত হয়। ভাসানী একদিকে ভারতবিরােধী প্রচার ও উসকানি ছড়াতে থাকেন, অন্যদিকে শেখ মুজিবের উদ্দেশ্যে বলেন: শেখ মুজিব, আমি তােমাকে আশ্বাস দিচ্ছি, তুমি যদি আমার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি ও পিকিং যাও, তাহলে আমরা শুধু পাকিস্তান ও চীনের স্বীকৃতি নয়, উদরপূর্তির জন্য চালও পাবাে। ভারত ও রাশিয়া তােমাকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারবে না।১৭২৮ চীনপন্থী হক-তােয়াহাও বসে থাকেননি। তারা মুক্তিযুদ্ধের উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে কমিউনিষ্ট বিল্পব সম্পন্ন করার লক্ষ্যে শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন বেছে নেন। প্রধান শত্রু হিসেবে তারা ক্ষমতাসীন দলকেই চিহ্নিত করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের অনুসারীরা সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে থানা, ব্যাংক-বীমা আক্রমণ করে অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে এমনকি আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের ওপরও হামলা চালানাে হতে থাকে। দেশের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির কারণে সরকার বাধ্য হয়ে জরুরি অবস্থা ঘােষণা। করে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকেও বিরােধীদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। সুতরাং রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে যেমন একদিকে কোন্দল শুরু হয় তেমনি অন্যান্য দল সরকারবিরােধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরােধী আদর্শে সংগঠিত হতে শুরু করে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য এটাই যথেষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বাধীনতাবিরােধী আমেরিকা ও অন্যন্য দেশের চক্রান্ত। এই চক্রান্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের শেষের দিক থেকে ক্রমাগত হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। তিনি আশা করেছিলেন শেখ মুজিব তার কিংবা মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিকট থেকে হয়তাে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনাবলি জানতে চাইবেন। কিন্তু তার মধ্যে সে ধরনের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। এ সময়

—–

১৭২৮ আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু, পৃ. ২১। ১৭২৯ “দেশের ভিতর জাসদ, সর্বহারা পার্টি, তােয়াহা সাহেব ও হক সাহেবের গােপন দল সরকারের ওপর প্রচণ্ড মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। সরকারও মরিয়া হয়ে ওঠে। কঠোরভাবে আইন প্রয়ােগ করতে থাকে। শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যা। সঙ্গত কারণেই শাসক দলের লােকই মারা গেল বেশি। আর বিরােধী দলের কর্মীদের ওপর রক্ষীবাহিনী ও সাদা পােশাকধারীদের আক্রমণ চরম আকার ধারন করে । গােটা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।” রিয়াজ উদ্দিন, সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করাই সবচেয়ে বড় কাজ— এ কথা যেমন ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির এই মহান অর্জনের শত্রু-মিত্র কারা সেটা জানা কম জরুরি ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুজিব দেশে ফেরার পর মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্ববিরােধী। চক্র দ্বারা অনেকটা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন। তাজউদ্দীন আহমদের এ আশংকা বরাবরই ছিল যে, তিনি যতই ত্যাগ স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে থাকুন

কেন, মুজিব দেশে ফিরেই যদি তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন এবং তিনি যদি তাদের কথামত জনসভায় বলেন যে, তাজউদ্দীন আহমদকে সরকার গঠনের অনুমতি তিনি দেননি, তাহলে সেখানেই তাজউদ্দীন আহমদের দৈহিক মৃত্যু ঘটবে । যুবনেতাদের পক্ষ থেকে এ চেষ্টা ছিল; ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দর থেকে বিশ্রামের জন্য আগে বাসায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি সে দিকে না গিয়ে সরাসরি জনসভায় অপেক্ষমান তার প্রিয়। দেশবাসীর সামনে উপস্থিত হওয়াকে অধিক জরুরি বলে বিবেচনা করেন। জনসভায় তিনি বলেন দেশ স্বাধীন হওয়ায় তার আজীবনের লালিত স্বপ্নসাধ পূরণ। হয়েছে এবং ঢাকা শহরের মানুষকে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার হাত হতে বাঁচানাের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছিলেন । কাজেই তাজউদ্দীনও বিরােধীদের রােষাণল হতে আপাত রেহাই পান।১৭৩০

মুজিব-তাজউদ্দীন মতপার্থক্য

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসার পর তাজউদ্দীন আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে পূর্বের সেই নির্ভরশীল-পরিপূরক আন্তরিক সম্পর্ক বজায় থাকেনি। মুজিব কখনােই প্রকৃত

——–

I have got a fresh lease of my life, আমি এবারের জন্য বেঁচে গেলাম । বঙ্গবন্ধু গতকাল সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বলে ফেলেছেন- ২৫শে মার্চ রাত্রে হানাদার বাহিনী রাস্তায় নেমে আসার পর তিনি আমাদের সবাইকে যে যেদিকে পারে। পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করতে বলেছেন এবং পাক সেনাদের হত্যাকাণ্ডকে নিতম পর্যায়ে রাখার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছেন।” এম.এ মােহাইমেন, ঢাকা আগরতলা মজিবনগর (ঢাকা: পাইওনিয়ার পাবলিকেশান্স, ১৯৮৯), পৃ. ৯০-৯১। ১৭”, “৭২-৭৩ সালের কথা, আমি তখন সরকারের তথ্য সচিব। এক বিয়েতে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা, আমাকে দেখেই খুব রেগে বললেন, ‘মুজিব ভাইকে একটু বােঝাও, তিনি যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন তাতে দেশটারও ক্ষতি হবে। আমি বললাম, আমি কি আপনার চাইতে বেশি বােঝাবাে?’ তখন তিনি বললেন, ‘তিনি তাে তােমাদের মত আমলাদের কথা বেশি শােনেন।” বাহাউদ্দীন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯০।

ঘটনাবলি জানতে না চাওয়ায় মূলত ব্যক্তিত্ববােধের প্রশ্নেই তাজউদ্দীন নিজে থেকে তা বলেননি। তার নামে পরিচালিত সরকারের রাজধানী মেহেরপুরে মুজিব একবারও যাননি ।২ মহান নেতা হিসেবে এগুলাে করলে ভাল করতেন। তা করা হলে হয়তাে স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় একটি প্রতি-বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তা হারাতে হতাে না। ছােটখাট ফাকের সুযােগ নিয়ে স্বাধীনতাবিরােধী শক্তি কিংবা তাজউদ্দীনের প্রতিপক্ষ মুজিব ও তাজউদ্দীনের মধ্যে স্থান করে নেয়। এতে তাজউদ্দীন আহমদ আহত হন বটে কিন্তু নেতার প্রতি তার আনুগত্যের কোনাে অভাব শেষ পর্যন্ত হয়নি। তিনি শেখ মুজিবকে অতিক্রম করার কথা কখনাে ভাবেননি, জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। অতিক্রম করা সম্ভবও ছিল না। তার প্রত্যাশা মাফিক কোনাে কিছু করতে পারছেন না, তা তিনি খুব দ্রত বুঝতে পারেন। অনেক বিষয়েই তাজউদ্দীনকে উপেক্ষা করার ঘটনা লক্ষ করা যায়। নিয়মানুযায়ী মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করে সচিব নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তা জিজ্ঞাসা করেন নি। এতে তাজউদ্দীন আহত ও বিস্মিত হন। একই ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করে অর্থসচিব মতিউল ইসলামের জন্যও।১৭৩৪ | দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এবং দেশ পুনর্গঠনের প্রশ্নে তাজউদ্দীন আহমদ কিছু কিছু নৈতিক বাধার সম্মুখীন হন। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে তিনি দেশ পুনর্গঠন ও সমাজকে অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। মুজিব তা বাতিল করে গঠন করেন রক্ষীবাহিনী । পরিকল্পনাটি এ ধরনের যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এসব সদস্য হবেন রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং মুজিবের প্রতি থাকবেন পূর্ণমাত্রায় অনুগত, যাদের মূলমন্ত্র মুজিববাদ। এটাকে মুজিববাহিনীর আর একটি সংস্করণ বলা যেতে পারে। নামে কিছু যায় আসে না । কিন্তু যে লক্ষ্যে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত তাজউদ্দীন আহমদ গ্রহণ করেছিলেন তা রক্ষীবাহিনী গঠনের মাধ্যমে অর্জিত হওয়া সম্ভব ছিলনা। ফলে সমাজকে অস্ত্রমুক্ত করার যে উদ্যোগ তাজউদ্দীন আহমদ গ্রহণ করেছিলেন তা অর্জিত হয় নি এবং সে কারণে রাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, তাজউদ্দীন আহমদের পরিচালনাধীন পরিকল্পনা কমিশন সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে

——

১৭৩২, আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ, পৃ. ১১৩। ** মঈদুল হাসানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাত্তার, ১২ জুন, ২০০৩।

M Matiul Islam, “Tajuddin- the Man with a Golden Heart’, DailyStar, November 3, 1997.

একটি ভূমি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু সেটাও পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করা হয়নি।১৭৩৫

শুরুতে তাজউদ্দীন আহমদ শর্তযুক্ত বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের পরিবর্তে দরিদ্র ভাগাভাগি করে নেয়ার যে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন বাস্তব চাপের মুখে তিনি এ বিষয়ে অনেকটা নতি স্বীকার করেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আমেরিকার নাগরিক রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফরে এলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন নিজে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে যান নি। এ কাজে পাঠানাে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে। ঢাকায় তার সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ পূর্বোক্ত ব্যাঙ্গাত্মক উক্তিটি করেন যে, পারলে বাংলাদেশের জন্য কিছু গরু আর দড়ি পাঠিয়ে দিও। প্রথম এই সাক্ষাতে ম্যাকনামারা তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। এই সাক্ষাতের আগে ১৯৭২ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে রাষ্ট্রীয় একটি অনুষ্ঠানে ম্যাকনামারা ও তাজউদ্দীন আহমদকে পাশাপাশি বসানাে হয়েছিল যাতে তারা পরস্পরের মধ্যে কথা বলতে পারেন। কিন্তু ‘৭১ সালে বিরূপ মার্কিনী ভূমিকার কারণে ম্যাকনামারার সাথে তাজউদ্দীন সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও বলেন নি। এ ধরনের সাক্ষাতের পরিণতির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম মন্তব্য করেন। যে, ম্যাকনামারার সঙ্গে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ও দেশপ্রেমে ভরপুর তাজউদ্দীন আহমদের এই সাক্ষাৎ না হলেই ভাল হতাে। কিন্তু দেশের প্রয়ােজনে শেষ পর্যন্ত তিনি আমেরিকার কাছে সাহায্যের জন্য ধর্ণা দিতেও বাধ্য হন। দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেয়া শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণের বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় । শেখ মুজিব চলতি দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রায়াত্ত কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া এবং বিশ্বব্যাংকের শর্তযুক্ত সাহায্য লাভের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বস্তুত বাংলাদেশের ঘােষিত পররাষ্ট্রনীতির প্রেক্ষিতে যে কোনাে রাষ্ট্রের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণের নীতির বিরােধ ছিল না। এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল দুটো উদ্দেশ্য ছিল

——–

১৭৩৫ প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, রেকর্ডকৃত সাক্ষাকার, ১০ নভেম্বর, ২০০২। ১৭৩৬ প্রথম আলাে, ঈদ সংখ্যা, ২০০৫, প্রাগুক্ত।

* আতিউর রহমান, অজেয় প্রাণশক্তির প্রবক্তা তাজউদ্দিন আহমদ, ড. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), জাতীয় চার নেতা (ঢাকা: জাতীয় চার নেতা পরিষদ, ১৯৯৬), পৃ. ৮৫। ১৭৩৮ বিক্রমাদিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩।

অধিকসংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ করা। সে কারণে তাজউদ্দীন যেখানে শুধু স্বাধীনতার পক্ষের এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাের নিকট থেকে সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন মুজিব সেখানে সকল রাষ্ট্রের নিকট থেকেই সাহায্য গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাে কর্তৃক প্রয়ােজনীয় সাহায্য দানের সক্ষমতার অভাবও মুজিবকে পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রতি আগ্রহী করে তােলে। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে তার প্রবল বিরােধিতার প্রেক্ষিতে তাজউদ্দীনের নীতি অনুসরণ করে জাতীয় কৃচ্ছসাধন এবং আত্মশক্তিতে দাঁড়ানাের চেষ্টার মধ্যেই নিহিত ছিল সদ্য স্বাধীন | দেশটির মাথা উঁচু করে টিকে থাকার মূল শক্তি—এই বােধের সঙ্গে আরাে ভেবে দেখা দরকার মানুষের প্রত্যাশার যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছিল তা প্রশমন করা আদৌ সম্ভব ছিল কিনা। | দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তিনি কিছু কিছু অসঙ্গতির সম্মুখীন হন। এ বিষয়ে | ড. আনিসুজ্জামান একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন:১৭৪০

অর্থমন্ত্রী হিসেবে অনেক সময়ে তিনি নৈতিক সংকটে পড়েন। স্বাধীনতালাভের পরে তার কাছে একটি সরকারি ফাইল আসে; তাতে জরুরি ভিত্তিতে সার আমদানির প্রস্তাব ছিল। সার আমদানি করা সত্যই জরুরি ছিল। তবে এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, হাতে এখন সময় এত কম যে, আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকার সময় নেই, আগে সরবরাহ করেছে, এমন এক বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সার কেনা হােক। তিনি বললেন, ‘সার কেনার কথা এতদিনে মনে পড়ল কেন? এ প্রস্তাব মেনে নিলে দুর্নীতি উৎসাহিত করা হবে, না মানলে সারের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে। আমি

যা-ই করি, তা অন্যায় হবে। | কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিয়ম করার চেষ্টা করে। তাজউদ্দীন আহমদের পরবর্তী অর্থমন্ত্রী | এ.আর. মল্লিকও এ ধরনের অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাজউদ্দীন আহমদ অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে অথবা জরুরি করণীয় বিষয়ে কোনাে | ছাড় কাউকে দেন নি, এমন কি বঙ্গবন্ধুকেও না। ১৯৭২-৭৩ অর্থ বছরে বাজেট প্রণয়নের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তথ্য সচিব বাহাউদ্দীন চৌধুরীকে | টিভি স্টেশন সম্প্রসারণের জন্য টাকা বরাদ্দ দেয়া হবে কিনা তা জানার জন্য অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট প্রেরণ করেন। ইতােমধ্যেই বঙ্গবন্ধু

—–

১৭৩৯ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫। ” আনিসুজ্জামান, এক বিরল মানুষের কথা’, পৃ. ১৪।

| দেখুন এ.আর, মল্লিক, আমার জীবন কথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম (ঢাকা: ১৯৯৫), পৃ. ১৫২-১৫৫।

৫৫৫

তাজউদ্দীনকে এ প্রস্তাব করলে তিনি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে বলেন এত গরিব। একটি দেশে টিভি স্টেশন সম্প্রসারণের জন্য বরাদ্দ করার মতাে টাকা। সরকারের নেই।১৭৪২

পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত হয় ও.আই.সি. সম্মেলন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ যােগ দেবে কিনা এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদে আলােচনা হয়। তাজউদ্দীন আহমদসহ কয়েকজন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে লাহােরে না যাওয়ার জন্যে অনুরােধ করেন। তারা প্রস্তাব করেন যে, অন্য একজন প্রবীণ মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠানাে যেতে পারে । তাজউদ্দীন আহমদ বলেন এ মুহুর্তে ভুটোকে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযােগ দিলে পাকিস্তানের সঙ্গে অমিমাংসীত সমস্যাসমূহের সমাধান বিলম্বিত হবে। উদার মেলামেশার সুযােগ গ্রহণ করে ভুট্টো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযােগ করে নেবেন। কাজেই মুজিবের এটা করা উচিত হবে না। মিশর, সিরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি কয়েকটি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মুজিবকে ইসলামী সম্মেলনে যােগ দেয়ানাের অনুরােধ নিয়ে ঢাকায় আসেন। তাদের আগ্রহে এবং নিজের বিবেচনায় শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদের উক্ত অভিমতকে অগ্রাহ্য করে ২৩ তারিখে লাহাের যাত্রা করেন। অবশ্য মুজিবের অনমনীয় চাপে এবং কোনাে কোনাে মুসলিম দেশের সুপারিশের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে বাধ্য হয় । মুজিব যথারীতি ভুট্টোকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসেন। ভুট্টো এটাকে তার। কূটনৈতিক জয় হিসেবে গ্রহণ করেন।৭৪৪ এরপরই ২৫ তারিখে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত বাংলাদেশে এক অনির্ধারিত সফরে আসেন। তিনি বাংলাদেশকে কয়েকটি ট্যাংক উপহার দেয়ার প্রস্তাব করেন। তাজউদ্দীন আহমদ তা গ্রহণ না করার পরামর্শ দিলেও তিনি ঐ উপহার গ্রহণ করেন। এর ফলে মুসলিম দেশগুলাের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তােলার সুযােগ সৃষ্টি

——–

১৭৪২ “তাজউদ্দীন সাহেব অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ের আর একটি ঘটনার কথা মনে আছে। আমাকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীন তােমার বন্ধু, সে একরােখা, আমার কথা শুনবে না। তুমি যাও, যেয়ে দেখ টিভি স্টেশন সম্প্রসারণের জন্য টাকা বরাদ্দ দেবে কিনা’।” বাহাউদ্দীন চৌধুরীর সাক্ষাকার, ২৬ অক্টোবর, ১৯৯০। ১৭৩, আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪-১৫। ১৭৪৮, ঐ, পৃ. ১৬।

* আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ, পৃ. ১১৩।

হয়।১৭৪৬ বাংলাদেশে এ সময় ভারতবিরােধী প্রচারণা তুঙ্গে এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলাে সক্রিয় হওয়ার প্রক্রিয়ায় । এমতাবস্থায় ভুট্টোকে বাংলাদেশে আসার সুযােগ দেয়া কতটা কূটনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। আমেরিকা ও পাকিস্তানের গােয়েন্দা চক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের একটি অংশ মুজিবকে ইসলামী সম্মেলনে যােগদান করানাের ব্যাপারে উৎসাহ যােগায়।১৭৪৭ এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে না দেয়া’৭১৮ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শক্তির পুনরুত্থান ঘটানাে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের গােড়ার দিকে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে মুজিব-ভুট্টোর মধ্যে সমঝােতার উদ্দেশ্যে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। অন্যদিকে অনেকগুলাে রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের স্বীকৃতি না পাওয়াটা যেন অনেকের নিকট অতৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৭৪ সালের ২৭ জুনই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শতাধিক সদস্যের একটি বিশাল প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। তাকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য বিহারীদের পাশাপাশি কিছুসংখ্যক বাঙালিও বিমানবন্দরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত হয়।৭৫ তার আগমনের পূর্বেই একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকায় এসে পুরনাে ও নতুন অনুগতদের খুঁজে বের করে। চীনপন্থী কোনাে কোনাে নেতা এবং কয়েকটি পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে ভুট্টোর এজেন্টদের সংযােগ হয়। তাদের মধ্যে প্রচুর উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়।১৭৫২ পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক, মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও অন্যান্যরা ভুট্টোর সাহায্য প্রার্থী হন। এ ছাড়াও মুসলিম লীগ, জামায়াতপন্থী নেতারা সদা তৎপর ছিলেনই। তবে কোনাে কোনাে পত্রিকা এ সময় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী ও তার সহযােগী বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতার বিষয়ে বেশ লেখালেখি করে। অন্যদিকে কোনাে কোনাে পত্রিকায় তার ঢাকায় আগমনকে কেন্দ্র করে ভারতবিরােধী ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণার চেষ্টা চালায়। ভুট্টোর আগমনের দিন খাদ্যমন্ত্রী ফনিভূষণ।

১৭৪৬ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পচাত্তর, পৃ. ১৫।

১৭৪৭ তপন কুমার দে, প্রাগুক্ত।

১৭৪৮ Fakhruddin Ahmed, op.cit., p. 105.

১৭৪৯সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২। ১৭৫০ কাজী ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯-৯০।

১৭৫২

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।

মজুমদার লাঞ্ছিত হন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের অমিমাংসীত বিষয়ে আলােচনার দাবি করা হলে তিনি অসৌজন্যমূলকভাবে বলেন যে, তিনি ‘ফাকা চেক’ সাথে করে আনেননি।১৭৫৩ এ সময় তার কয়েকটি আচরণে বাংলাদেশবিরােধী মনােভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভুট্টো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু মুজিব বলেন নিয়মানুযায়ী তিনি যদি শহীদ মিনারে না যান তাহলে তার অন্য সকল কর্মসূচি বাতিল করা হবে। শেষে ভুট্টো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে বাধ্য হন, কিন্তু প্রথা অনুযায়ী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেননি। তিনি সুযােগ পেলেই বাংলাদেশের বিষয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে ছাড়তেন না। ভুট্টোর সম্মানে দেয়া ভােজসভায় বাংলাদেশের একজন কূটনীতিককে দেখিয়ে বলেন, জান মুজিব, এই অফিসারটি কিছুদিন আগে আমার অধীনে কাজ করতেন। মুজিব তাৎক্ষণিক ও সপ্রতিভ উত্তর দেন, এটা সত্য যে, তােমার সেই অফিসার এখন আমার হয়ে কাজ করছেন, তাই না! বাহ্যত এই সফরে কোনাে সাফল্য বাংলাদেশ পায়নি। বিপরীতপক্ষে এর দ্বারা বাংলাদেশবিরােধী শক্তিগুলাে সংহত হওয়ার সুযােগ লাভ করে । ভুট্টো অবশ্য করাচি ফিরে গিয়ে তার তাৎপর্যপূর্ণ সফর ফলপ্রসু হয়েছে এবং বাংলাদেশে অচিরেই পরিবর্তন আসবে বলে মন্তব্য করেন। সম্ভবত এই পরিবর্তন ঘটানাের জন্যে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে ‘প্রিয় প্রধানমন্ত্রী’ সম্বােধন করে চিঠি লিখেন, যাতে ‘মুজিবের পুতুল সরকারকে উৎখাতের জন্য অর্থ ও বেতার যন্ত্র সাহায্য চেয়ে পাঠানাে হয়। এসবের সম্মিলিত মর্মন্তুদ ঘটনা সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালে। এ সম্পর্কে ভুট্টোর জীবনীকার Stanley Wolpert লিখেছেন:১৭৫৫

Bhutto had been functioning secret “discretionary” funds to several anti-Mujib parties during the past two years, and before the end of August 1975 that investment would pay off handsomely. Orthodox Islamic as well as Marxist Communist Bengalis on both wings of the cluttered spectrum of Bangladeshi politics now combined in an opposition chorus to Mujib’s inept, totering regime. Abdul Haq, general secretary of Bangladesh’s Marxist-Leninist Comunist party, had written on 16 December 1974 to “My dear Prime Minister” Bhutto,

——-

১৭৫৩, ঐ, পৃ. ৮৫। ১৭৫৯ ফারুক চৌধুরী, স্বদেশ স্বকাল স্বজন (ঢাকা: প্যাপিরাস, ২০০২), পৃ. ১২।

Stanley Wolpert, Zulfi Bhutto of Pakistan: His Life and Times (New York: Oxford University Press, 1993), pp. 248.

“much pain and anguish” to appeal “for funds, arms and wirless instruments” to use against the “puppet Mujib clique…today totally divorced from the people.” That “TOP SECRET/MOST IMMEDIATE” letter reached Zulphi on 16 January 1975, when he minuted on its margin “important, “authorizing “help” for this “this honest man,”

whom Bhutto rated as “fairly effectively.” পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিক থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের একটি অংশ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে এবং সরকারও তাদেরকে দমনের জন্য উঠেপড়ে লাগে। যাহােক, লাহােরে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যােগদানের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধিতা যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়। বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিব দেশে ফেরার পর তাজউদ্দীন আহমদ বিরােধিদের দ্বারা ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন। তার বিরােধী পক্ষ নানাভাবে তার বিষয়ে মুজিবের কানভারি করে। তােলে। বলা হয়ে থাকে এক্ষেত্রে প্রবাসী মুজিবনগর আমলের শত্রুতার জের সক্রিয় হয়ে ওঠে। মােশতাক আহমদ ও মুজিবের নিকটজনদের কেউ কেউ এই কাজ করেন। দেশে ফিরে মােশতাক বেগম মুজিবের নিকট গিয়ে কান্না শুরু করেন এই বলে যে, তাজউদ্দীন ভারতের নিকট দেশ বিক্রি করে দিয়েছেন।১৭৫৬ অন্যান্যরাও পরিকল্পনা মাফিক অব্যাহতভাবে মুজিবকে বুঝানাের চেষ্টা করে যে, তাজউদ্দীন চান নি যে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসুন। মুজিব একজন মানুষ, যার ফাঁসি দেয়ার আয়ােজন করা হয়েছিল, তিনি অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে এসেছেন, তার কাছে বিভিন্ন স্তর থেকে এ ধরনের কথা বার বার বলা হয়। উচ্চাদর্শ ও ব্যক্তিত্ববােধের প্রশ্নেই তাজউদ্দীন আহমদ জোর করে প্রমাণ করতে চাননি যে, তার বিরুদ্ধে একটি চক্র মুজিবনগর থেকে শত্রুতা করে আসছে। দলের একটি অংশ তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে এমনভাবে উঠেপড়ে লাগে যে, তার নির্বাচনী এলাকায় একজন ছাত্রনেতাকে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয় । তাজউদ্দীন আহমদ এতে ক্ষুব্ধ হন।

—–

১৭৫৬ আবদুল আজিজ বাগমার, স্বাধীনতার স্বপ্ন: উন্মেষ ও অর্জন (ঢাকা: অপূর্ব সংসদ, ১৯৯৯),পৃ. ২৭৩। ১৭৫৭ এইচ.টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৪), পৃ. ৮৫। ১৭৫৮ জাওয়াদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।

যুদ্ধাপরাধীদের যেভাবে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং অজ্ঞাত কারণে স্বাধীনতাবিরােধী ব্যক্তিদের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পুনর্বাসিত করা হয় তাতে পরিস্কার হয়ে যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী শক্তি তথা জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক দলগুলাে তাদের অপকর্মের সকল চিহ্ন দ্রুত মুছে ফেলতে তৎপর হয় । বিস্ময়কর হলেও তাদের প্রত্যাশা মাফিক সেভাবেই সবকিছু ঘটে চলে।১৭৫৯ এক্ষেত্রে প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধ বিরােধীদের পুনর্বাসিত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের স্বদেশে ফিরে সিভিল সার্ভিসের ‘ল অব কনটিনুয়েশন অর্ডার’ নামে অর্ডিন্যান্স জারি করাকে কেউ কেউ দায়ি করেন। কিন্তু এ কথা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করা হয়েছে যে, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরােধীদের পুনর্বাসিত করা ঠিক হয়নি; ইতিহাসে আজ এ কথা স্বীকৃত হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, দেশের প্রশাসন পরিচালনার মতাে উপযুক্ত জনবলের অভাব তীব্রতর হয়েছিল । মুজিবসহ মাত্র ৩-৪ জন ব্যতীত মন্ত্রীত্ব করার অভিজ্ঞতা অন্যান্যদের ছিল না । সকলের সহায়তায় আপাতত প্রশাসন চালানাের ব্যবস্থা করা হলেও উচিত ছিল পরবর্তীকালে যাচাইকরণের মাধ্যমে পুনঃনিয়ােগদান করা। এ বিষয়ে একটি কমিশন গঠন করা হলেও তা উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়। মােট কথা যেটা করা হয় তা মােটেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সংহত করেনি। কোনাে এক অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে দেশ যে উল্টো স্রোতে চলতে শুরু করেছে তাজউদ্দীন আহমদ তা অনুধাবন করেন। এসব দেখে অসহায় তাজউদ্দীন আহমদ একটি অদ্ভুত ভবিষ্যবাণী করে প্রায়ই বলতেন, “এমন একদিন আসবে যখন মুক্তিযুদ্ধ করার অপরাধে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে ঘরে ঘরে খুঁজে হত্যা করা হবে। তার এই দিব্যদৃষ্টির কথা আজ প্রমাণিত। বস্তুত শুরু থেকেই বিরােধীপক্ষ প্রতিটি পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। এসব বিষয় অনুধাবন করে তিনি তার ঘনিষ্টজনদের প্রায়ই বলতেন, প্রতিটি সফল বিপ্লব তার

——-

১৭৫৯ আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।

*১৭৬০ উ. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬ এবং সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, পৃ. ৭০। “, “তিনি প্রায়ই শেখ মুজিবসহ প্রবাসী মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের স্ত্রীদেরকে বলতেন, ‘ভাবী, আপনারা শীগ্রই বিধবা হচ্ছেন।’ আমাকেও একই কথা বলতেন। তিনি দেশের সর্বনাশ দিব্যচক্ষে দেখতে পেতেন।” সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০২।

৫৬০

মুজিবের অনুপস্থিতিজনিত কারণে তার উপলব্ধির যে ঘাটতি ঘটে তার প্রেক্ষিতে সর্বক্ষেত্রে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় নি। অন্যান্য নেতাদের মধ্যে প্রায় কেউই এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন নি। পরিকল্পনা কমিশন, আমলাতন্ত্র এবং মুজিবের মধ্যে একটি ত্রিমুখী টানপােড়ন শুরু হয়; কেউ কাউকে বুঝার চেষ্টা করেননি। ফলে ঢাকাসহ সমগ্র দেশে দুটো বিপরীতমুখী চিত্র; একদিকে ভােগবিলাশ অন্যদিকে দারিদ্র্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।১৭৬৬ বস্তুত পরিকল্পনা কমিশন ও আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল বিস্তর। আমলারা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের প্রায় সকলেই পাকিস্তান শাসনাধীনে বাংলার শােষিত হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি এবং স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের তত্ত্বগত ভিত্তি রচনা। করেছিলেন, তাদের প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে শেষােক্ত শ্রেণীটির প্রাধান্যই ছিল প্রত্যাশিত । দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রশাসনযন্ত্র আমলানির্ভর হয়ে পড়ে। রাজনীতিবিদদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার অভাব এর একটি অন্যতম কারণ। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যদি বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী ও আমলা এবং বিভিন্ন দলের নেতাদের সমন্বয়ে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যেত তাহলে হয়তাে এই স্বপ্ন ও বাস্তবতার একটা সমন্বয় হতে পারতাে। কিন্তু তা না হয়ে সব প্রত্যাশা। হয়ে ওঠে মুজিবকেন্দ্রিক এবং প্রশাসন হয়ে পড়ে আমলানির্ভর। তাকে কেন্দ্র করে তীব্র এই প্রত্যাশা পরােক্ষভাবে দেশের ও মুজিবের সর্বনাশ ডেকে আনে। তিনি জননেতা হিসেবে যে অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন, প্রশাসক হিসেবে তেমনটি ঘটলে সম্ভবত পরবর্তীকালের বিয়ােগান্ত ঘটনা রােধ করা যেত। | প্রায় একই সঙ্গে এই দুই নেতা মুসলিম লীগ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের কাল হতে মুজিব-তাজউদ্দীন হয়ে

ওঠেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণে মুজিব বাঙালি মুসলিম | জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন নি। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় সমৃদ্ধ একজন লিবারেল সােস্যাল ডেমােক্র্যাট। তাজউদ্দীন আহমদ যেখানে রাষ্ট্রনাকোচিত গুণাবলির অধিকারী, মুজিব সেখানে জনসম্মােহনী ক্ষমতাধর অবিসংবাদিত নেতা। মুজিব আবেগে আক্রান্ত হন। আর তাজউদ্দীন সূক্ষ বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং নির্মোহ যুক্তি দ্বারা পরিচালিত একজন প্রয়ােগবাদী রাষ্ট্রনায়ক। তবে এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের তৎকালীন সমাজ বিকাশের স্তরে এবং জনসম্মােহনী নেতা মুজিবের উপস্থিতিতে তাজউদ্দীনের এই

[১৭৬৬ ঐ, পৃ. ৪৩।

অসাধারণ গুণাবলি সাধারণ মানুষের, এমন কি অনেক বড় মাপের রাজনীতিকেরও অগােচরে থেকে যায়। তিনি তার যােগ্যতার উৎকৃষ্ট প্রমাণ দিতে সক্ষম হন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে। দেশ পুনর্গঠনে তার এই কর্মদক্ষতা ও উপলব্ধিজাত কর্মস্পৃহা অব্যাহত রাখা আবশ্যক ছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নানা কারণেই এই দুই নেতার মধ্যে কিছু কিছু মতপার্থক্য বাঙালি জাতির মারাত্মক ক্ষতি করে। এ বিষয়ে প্রফেসর নুরুল ইসলামের মূল্যায়নটি যথার্থ বলে মনে

হয়:১৭৬৭

খুব সম্ভবত রাজনীতিতে দুটো জিনিস লাগে। এক, ‘ইনটিউশন’, দুই, ‘মাস অ্যাপিল’ (জনগণের কাছে আবেগ সৃষ্টি করবার ক্ষমতা) । প্রথমটি তার মধ্যে অবশ্যই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়টি ততােটা নয়। সেটা ছিল শেখ মুজিবের । মুজিব দাড়ালেই জনতা উপচে পড়তাে ।… গণরাজনীতি আসলে আবেগের রাজনীতি। কিন্তু উনি (তাজউদ্দীন) ছিলেন বিশ্লেষক। তবে তিনি ছিলেন মেথােডিক্যাল, সিসট্যামেটিক। বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী এক সুযােগ্য রাজনীতিক হিসেবে তার মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হতে হলে তদুপরি দরকার পড়ে গণআবেদনী কারিশমার। সে জন্য আমি মনে করি তাজউদ্দীনের তুখােড় বিশ্লেষণী মন আর শেখ মুজিবের গণ-সম্মােহনী ব্যক্তিত্ব যখন এক সূত্রে গেঁথে গিয়েছিল তখনই ছিল বাংলাদেশের জন্য এক সৌভাগ্যের সময়। অবশ্য কোলকাতায় যা ঘটেছিল তার প্রভাব স্বাধীন বাংলাদেশেও পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তিতর্কের জোরে তিনি প্রথম দিকে মন্ত্রী পরিষদে নিজের নেতৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল যেসব শক্তি, তাদের বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন।… তাজউদ্দীনের শত্রুরা খুব ভাল করেই জানতেন যে, তিনি (তাজউদ্দীন) তার (মুজিব) হাতের লাঠি। সে জন্যেই সে লাঠিকে দূরে ফেলে দিতে

সচেষ্ট ছিলেন তারা। উভয় নেতার মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্যের প্রধান বিষয়ই ছিল শর্তযুক্ত বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ ও পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি । তাজউদ্দীন আহমদ যেখানে আমেরিকা বা বিশ্বের আর্থিক সংস্থাগুলাে কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া দেশের স্বার্থবিরােধী কোনাে সাহায্য গ্রহণে অনিচ্ছুক এবং আত্মশক্তিতে দাঁড়াবার ব্যাপারে প্রত্যয়ী, বঙ্গবন্ধু সেখানে পিতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুনর্গঠন ও জনগণকে বাঁচানাের জন্য যে কোনাে দেশের সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। এ ক্ষেত্রে দু নেতার দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের বিষয়টি শুরু থেকে লক্ষ করা গেলেও সম্ভবত ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশ্য মুখােমুখী হয় । ৩ জানুয়ারি

আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭), পৃ. ১২৫। ১৭৬৮ সিরাজুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৭

পটুয়াখালির এক জনসভায় মুজিব বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্য হতে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। পরদিন ৪ জানুয়ারি সােভিয়েত প্রজাতন্ত্রের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন ‘ধনবাদী দেশের সাহায্য নিয়ে কোনদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য চাই একই মতাদর্শে বিশ্বাসী তথা সমাজতান্ত্রিক দেশের সাহায্য এবং সেই সাথে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মনােভাব ।১৭৬৯ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের শত্ৰুমিত্রের কথা বিবেচনা করে ভারত-রাশিয়া বা সমাজতান্ত্রিক বলয়ের প্রতি দুর্বল, মুজিব সেখানে আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলাের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন, কিন্তু ভারত বা সােভিয়েতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন

। একই বিবেচনাবােধ থেকে তিনি মন্ত্রিসভায় দিল্লি ও মস্কোর আস্থাভাজন তাজউদ্দীন আহমদের মতাে উদার ও আধুনিক জাতীয়তাবাদীকে এবং মােশতাকের ন্যায় পিন্ডি, পিকিং ও ওয়াশিংটনের প্রতি অনুগত এবং রক্ষণপন্থী ব্যক্তিকে স্থান দান করেন। তিনি বিরাজমান বিশ্বরাজনীতির জটিলতা অতিক্রম করে সকল পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়তে উদ্যোগী হন। সে কারণে মুজিব দ্বিমেরু বিশ্ব রাজনীতির কোনপক্ষেই থাকতে চাননি এবং জোটনিরপেক্ষ আদর্শ অনুসরণে সচেষ্ট হন। বস্তুত তিনি নানা বিপরীত উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটাতে চেষ্টা করেন। সেভাবেই তিনি বিশ্বের একজন শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। কিন্তু বাংলাদেশের মতাে একটি ছােট ও দরিদ্র দেশের নেতা হয়ে এই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার নয়—এটা অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হন নি। দ্বিমেরুর যে কোনাে একটি পক্ষে যােগদান না করলে সমকালীন বিশ্ববাস্তবতায় টিকে থাকা সত্যই দুষ্কর ছিল। | শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরেই ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আহ্বান জানান। এগুলাের মধ্যে ছিল গঙ্গার জল বণ্টন, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, পাকিস্তান বাহিনীর নিকট থেকে উদ্ধারকৃত সমরাস্ত্র বাংলাদেশকে ফেরত দান, বন্দী পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যবস্থা করা এমনকি অতি দ্রত বাংলাদেশ হতে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহার প্রভৃতি বিষয় উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী এ সব বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দেন।১৭৭২ উল্লেখ্য, মুজিব মুক্তি পাওয়ার পূর্বেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যথাসম্ভব দ্রুত বাংলাদেশ।

————

১৭৬৯ মাে. আনিসুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭। > আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ, পৃ. ১০৭। ১৭৭৯ কাজী ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪। “””, এ বিষয়ে দেখুন, J.N. Dixit, Liberation and beyond, Indo-Bangladesh Relations (Dhaka: The University Press Limited, 1999), pp. 138-139.

থেকে নিজ সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা প্রদানের কারণে ভারতের প্রতি মুজিব কৃতজ্ঞ ছিলেন বটে, কিন্তু শুরু থেকেই ভারতের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হন। ভারত বাংলাদেশকে দুটো সমুদ্রগামী জাহাজ এবং ফ্রেন্ডশিপ উড়াে জাহাজ প্রদান করতে আগ্রহ ব্যক্ত করে। কিন্তু মুজিব জানান সেগুলাে অনুদান হিসেবে নয় বরং দীর্ঘমেয়াদী ঋণের আওতায় গ্রহণ করা যেতে পারে।সূচনাপর্বেই ভারতের সঙ্গে এ ধরনের মর্যাদা ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হওয়ার পশ্চাতে মুজিবের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারতীয় কূটনীতিক জে.এন. দীক্ষিত মন্তব্য করেন যে, ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু এলাকার পশ্চিম পাকিস্তান যদি পূর্বতন পূর্ব বাংলাকে শােষণ করতে পারে তাহলে পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত বিশাল ভূখণ্ড ও জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা বা শােষণ করা। অসম্ভব নয়। তদুপরি কোনভাবেই বাংলাদেশকে তিনি ভারতের ওপর অতি নির্ভরশীল করে তুলতে চাননি। এটা তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির উদাহরণ। ভারতের সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি মুজিব ইসলামী দেশগুলাের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হন। কিন্তু এত দ্রুত ইসলামী রাষ্ট্রগুলাের পক্ষ থেকে সমর্থন ও সহযােগিতা পাওয়া সম্ভব ছিল না। দীক্ষিত মূল্যায়ন করেন যে, মুজিব ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন না হলেও ইসলামী রাষ্ট্রগুলাের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়েন। মুজিবের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে মূলত মুসলিম লীগে, পাকিস্তান আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সমগ্র পাকিস্তানের শাসক হওয়ার যােগ্যতা অর্জন করেছিলেন এবং তা পেতে তিনি শেষ পর্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। ৭৫ সুতরাং বাংলাদেশকে ইসলামী দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে তিনি অধিক যত্নবান হন। তিনি অনুরূপভাবে আমেরিকা ও চীনের প্রতিও সমান আগ্রহী ছিলেন। কাজেই তিনি ভারত বিরােধিতা না করলেও মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযােগিতাকারী ভারতের প্রতি খুব আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৪ সালের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলােচনার শুরুতেই তিনি চোরাচালান প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন:১৭৭৬

——-

১৭৭৩, ফারুক চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯ এবং J.N. Dixit, op.cit., p. 132. ১৭৭৪, J.N. Dixit, op.cit., p. 136.

Ibid., pp. 133-136. 3449. Fakhruddin Ahmed, op.cit., p. 112.

১৭৭৫

৫৬৫

At the plenary session of the Delhi meeting which discussed smuggling on the boarder, Sheikh Mujib made an outburst which created quite a sensation. Pointing to India he said “unless you stop smuggling there will be no friendship.” The entire Indian deligation including Mrs. Gandhi were stunned

and prefer not to answer publicly. মুজিবের এ ধরনের উপস্থাপন কতটুকু কূটনীতিসম্মত ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কেননা এটা ঔপনিবেশিক পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অধিকার আদায়ের ব্যাপার ছিল না। এটা ছিল দুটো স্বাধীন দেশের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়। সে কারণে কূটনীতির রীতিসিদ্ধ উপস্থাপনই দুটি দেশের মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সহায়ক হতে পারতাে। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফেরত পাঠানাের কৃতিত্বের সঙ্গে এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত যে, সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ঘটনার পরেও যারা মুজিবকে ভারতের চর বলে মনে করেন, ধরে নেয়া যায় মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতবিরােধী মনােভাব জাগিয়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটা ছাড়া তাদের অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ কথাও হয়তাে অনেকের জানা নেই যে, মুজিব তার অনুমতি ব্যতীত মন্ত্রিপরিষদের কোনাে সদস্যের রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত সফর এক গােপন নিদেশে নিষিদ্ধ করেন।১৭৭৭

সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্ত করা হলেও মুজিব বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মকে অস্বীকার করেন নি।১৭৭৮ কারণ, এ কথা স্বীকার করতেই হয় তার জাতীয়তাবাদের ধারণা ছিল অত্যন্ত বাস্তবানুগ । কেননা উপমহাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্ম একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে অদ্যাবধি বিবেচিত হয়। সঙ্গত কারণেই পশ্চিমা উদার জাতীয়তাবাদের ধারণা এখানে প্রায় অচল।

————

১৭৭৭. J.N. Dixit, op.cit., p. 168,

সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্য প্রত্যাগত মুজিব বলেন পাকিস্তান কারাগারে যে সেলে তাকে রাখা হয়েছিল তার সামনে মুজিবের কবর খনন করা। হয়। তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে বলেন যে, প্রথম তিনি একজন মুসলিম । একজন মুসলিম। একবারই মরে । কাজেই তিনি ভীত নন। দ্বিতীয়ত তিনি একজন বাঙালি। তাকে হত্যা করা হলে যেন তার মরদেহ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ থেকে তার। লালিত বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায় ।

মুজিবের পররাষ্ট্রনীতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশের একজন কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর মূল্যায়নটি উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি দীক্ষিতের মত সমর্থন করে

লিখেছেন:১৭৭৯

বঙ্গবন্ধু এও চাইতেন যে, বিশ্বের মুসলিম দেশগুলাে যেন বাংলাদেশের বাঙালি মুসলিম পরিচয়টির স্বীকৃতি প্রদান করে। দীক্ষিতের মতে, বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মনােভাব, আশানুরূপ ছিল না। শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাইতেন, তবে তিনি এও চাইতেন যে, বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলাের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং টেকনােলজিভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে উঠুক, যাতে বাংলাদেশকে ভারতের উপর অতিরিক্ত মাত্রায় নির্ভরশীল না রইতে হয়। সেই সময় অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকের ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশ ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হবে। বাংলাদেশকে সেইভাবে অভিহিত করা হােক, তা শেখ মুজিব কোনদিনই চাইতেন না । দীক্ষিতের মতে, শেখ মুজিবের এও ধারণা ছিল যে, বাংলাদেশ কেবল তার বাংলা ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর নয়, তার বাঙালি মুসলমান পরিচয়ের উপরও প্রাধান্য দিক, যাতে করে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের পরিচয়ের মাঝে বাংলাদেশ তলিয়ে না যায় । সেই জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাক, শেখ মুজিব তা

চাইতেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক দর্শনগত বিষয়টি ছাড়াও আরাে কতিপয় পারিপার্শ্বিক বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে। ভুট্টো তাকে কারাগার থেকে এনে একটি অতিথিশালায় রাখেন এবং মুজিবকে ভারতের বিরুদ্ধে উত্যক্ত করেন। তিনি মুজিবকে বলেন তার সাধের দেশ ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে। এতে তিনি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, তাহলে তিনি প্রয়ােজনে ভুট্টোর সহযােগিতা নিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে তাড়িয়ে দেবেন।” মুজিবের এই প্রতিক্রিয়া গােপনে টেপ রেকর্ডারে ধারণ করেন ভুট্টো এবং সে কথা তাকে পরে জানানাে হয়। লক্ষ করা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনায় সর্বাগ্রেই মুজিব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেন। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, তার অনুপস্থিতিতে ভারতের সহযােগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। বিরােধীরা বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তাজউদ্দীন আহমদ বস্তুত ভারতের নিকট দেশ

১৭৭৯

ফারুক চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ, ১৯।

CF, Stanley Wolpert, op.cit., pp., 173-174. ১৭৮১

ফারুক চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২-২৩।

বিকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এবং ভারতের সমর্থনে তিনি বেশ শক্তিশালী। কাজেই | তাজউদ্দীন আহমদ ও অনুরূপ ব্যক্তিদের ব্যালেন্স করতে গিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধে নিজের অনুপস্থিতি অনেকটা পুষিয়ে নেয়ার মানসে তিনি ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে জে.এন. দীক্ষিত স্পষ্টত মন্তব্য করেন যে, শেখ মুজিবের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিতিজনিত কারণে অতৃপ্তিবােধ ছিল। এই অতৃপ্তিই তাকে প্রছন্নভাবে এত দ্রুত ভারতবিমুখ করে তােলে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক ঝুঁকি গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারতের সঙ্গে যে আচরণ করেন তা দেশটির নেতাদের | নিকট বিপন্ন বিস্ময়ে পরিণত হয়। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিমস্তরে স্পর্শকাতর বিষয়গুলােকে সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করলে সাধারণ মানুষের মনে এত দ্রুত ভারতবিরােধী মনােভাব স্থান করে নিতে পারতাে না। এ ধরনের মনােভাব ভাল ফল বয়ে আনে নি। শুরুতেই ভারতের সঙ্গে স্পর্শকাতর দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে মুজিব কতটা প্রজ্ঞার পরিচয় দেন সে বিষয়ে গবেষণার দাবি রাখে। স্বাভাবিকভাবে বলা যেতে পারে বিষয়টি অনুপযুক্ত সময়ে উত্থাপন করা হয়। তবে এ কথাও মনে রাখা দরকার যে, এই সময়েই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছরমেয়াদী সহযােগিতা ও বন্ধুত্ব চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিকতা ১৯২২ সালে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানীর মধ্যে সম্পাদিত রাপালাে চুক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। কেননা বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সােভিয়েট ইউনিয়ন ও পশ্চিম ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে ব্যতীত তেমন সক্রিয় সহযােগিতা পায় নি, অন্যদিকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও কূটনৈতিক স্বীকৃতি তখন পর্যন্ত বেশি রাষ্ট্র প্রদান করে নি। সুতরাং ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত উক্ত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ বরং স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ভারতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনােভাব তার নিকটজনদের অজানা ছিল না। এ সুযােগে

——-

১৭৮২, জে.এন, দীক্ষিতের সাক্ষাৎকার, প্রথম আলাে, ২১ মার্চ, ২০০১। | “এ মতবিরােধ নিয়ে কে প্রধানত দাযী তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে আমি যতটুকু অনুমান করতে পেরেছি তাজউদ্দিন কর্তৃক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করে দেশ স্বাধীন করাকে শেখ সাহেব মনেপ্রাণে সন্তুষ্টির সংগে। গ্রহণ করতে পারেননি। এটাকে তিনি তাজউদ্দিনের ব্যক্তিগত কৃতিত্ব মনে করে বােধ হয়। ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলেন।” এম. এ. মােহাইমেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪। ১. চুক্তির বিষয়ে জানার জন্য দেখুন, J.N. Dixit, op.cit., pp. 294-297. ১৭৮৫ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪।

মুক্তিযুদ্ধবিরােধী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলাে ভারতবিরােধিতায় মেতে ওঠে। এই ধরনের কিছু অপপ্রচার অল্প সময়ের মধ্যে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে।

তাজউদ্দীনের বিদায়

সার্বিকভাবে উদ্ভুত অবস্থা তাজউদ্দীন আহমদের জন্য মর্মপীড়ার কারণ হয়। তিনি উপলব্ধি করেন, যে আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার উল্টো স্রোতে দেশ চলছে। এ ধরনের অবস্থা এবং মৌলিক কিছু মতপার্থক্যের কারণে এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসন থেকে সরে আসতে চান এবং কয়েকদিন অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তবে বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে এবং ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় আবার তিনি দাফতরিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। | সার্বিক পরিস্থিতি বিচার করলে দেখা যায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যে দেশি-বিদেশি মহল থেকে চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। প্রথম কাজটিই করা হয় দেশের মধ্যে সুপরিকল্পিত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে। সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা না গেলেও ১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সিআইএ কর্তৃক প্রণীত একটি গােপন দলিল এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। এতে বাংলাদেশের জনক হিসেবে মুজিবকে অভিহিত করা হয়েছে যেমন, তেমনি কোন কারণে রাজনৈতিক দৃশ্যপট হতে তার বিদায় ঘটলে তা হবে ‘বড় দুঃখজনক ও অবিস্মরণীয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবু সাঈদ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে মুজিব পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার যদি জনসমর্থন ধরে রাখতে না পারে তাহলে নবগঠিত সামরিক বাহিনী এগিয়ে আসবে বলে মন্তব্য বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। কারণ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে লক্ষ করা যায় যে, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় আনা হয়; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে মুজিবকে হত্যার পর রাজনৈতিক উত্তরণের পথ নির্মূল করা হয় ৩ নভেম্বর জেলহত্যার মাধ্যমে।

১৭৮৬ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, পৃ. ৬৭ এবং আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ১৭৮। প্রথম আলাে, ৪,৭,২০০৫, মিজানুর রহমান, মুজিব বাংলাদেশের জনক’ । পাকিস্ত েিনর কারাগার হতে ফিরে আসা মুজিব সম্পর্কে সি আই এ কর্তৃক প্রণীত এই দলিলে বলা

WICE “Triumphantly returned, as father his country and its unchallenged leader’

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কিছু অভিযােগ সুকৌশলে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে একটা হচ্ছে তিনি যুদ্ধের সময় নাকি ভারতের সঙ্গে একটি গােপন চুক্তি করেছেন। ১৭৮৮ তাজউদ্দীন আহমদ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দিয়ে এর জবাবে বলেন যদি কোনভাবে কেউ প্রমাণ করতে পারেন যে, সত্যই এ ধরনের চুক্তি তিনি করেছেন, তাহলে তিনি সরকার থেকে কেবল পদত্যাগ করতেই নয় ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতেও প্রস্তুত আছেন।৭৮৯ প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল একদিকে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে হেয় করার একটা হীন চক্রান্ত। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের বিরুদ্ধে জনমতকে বিষিয়ে তােলার চেষ্টা। অথচ ভারতের কোনাে সূত্রেই উল্লেখ করা হয় না যে, বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের কোনাে চুক্তি হয়েছিল । এমন কি ভারতীয় কূটনৈতিকরাও এই বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। এ কথা। পূর্ববর্তী অধ্যায়েই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুজিবনগর সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যৌথবাহিনী গঠন সংক্রান্ত একটিই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক করার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ ও ডি.পি. ধরের মধ্যে এ বিষয়ে কিছু কিছু আলােচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ সফর শেষ করে নভেম্বর মাসে দেশে ফিরে এই প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সূত্র উল্লেখ করে বিরােধীরা প্রচার করেন যে, তাজউদ্দীন ভারতের সঙ্গে কথিত সাত দফাভিত্তিক একটি চুক্তি করেছিলেন যাতে দেশকে প্রায় ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই তথ্য অন্য কোনাে সূত্রে সমর্থিত হয় নি।

———

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কর্তৃক কথিত এই চুক্তির বিষয়ে দেখুন, মাসুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং “সি আই এ (ঢাকা: ওসমানিয়া প্রেস, ১৯৯০), পৃ. ১৬২-১৬৬। *** ১৯৭৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে গােপন চুক্তি করার অভিযােগ বিভিন্ন মহল থেকে পুনঃ পুনঃ উত্থাপন করা হলে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধের যখন হতাশাব্যাঞ্জক অবস্থা তখন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় গােপনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে তারা জানান, যে কোন মূল্যে তারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চান। এতে দুটো বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল: প্রথমত বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সাহায্য প্রদান করতে হবে। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্যমতে উভয়পক্ষের মধ্যে আলােচনার একটি কপি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকার কথা। দৈনিক পূর্বদেশ, ৩ জুন, ১৯৭৩ এবং ১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৪। ১৯৫ শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ মার্চ, ১৯৯৬ টি,এন, কলের এবং ১৫ মার্চ, ১৯৯৬ জে.এন দিক্ষিতের সাক্ষাৎকার ।।

৫৭০

মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ডে হুময়ুন রশীদ চৌধুরীর এমন কোনাে সম্পৃক্তির বিষয়ে জানা যায় না যাতে মনে হতে পারে যে, এ ধরনের চুক্তি হলেও তার কথা তিনি জানতে পারতেন । অপপ্রচারকারীরা কূটনৈতিক রীতিনীতি সম্পর্কে সচেতন ছিল বলে মনে হয় না। কেননা যে দেশটিকে তখন পর্যন্ত কোনাে রাষ্ট্রই স্বীকৃতি প্রদান করেনি তার সঙ্গে কিভাবে ভারত দ্বিপাক্ষিক একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে অথবা আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে তার মূল্যই বা কতটুকু? সর্বোপরি তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রকৃতই একজন দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। তার দেশপ্রেম, সাহস ও দৃঢ়তার বিষয়ে ভারতীয় কূটনৈতিক মহল শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। | তিনি শুরু থেকেই দেশের মর্যাদার ব্যাপারে অতিমাত্রায় সতর্ক ছিলেন। কাজেই

তার দ্বারা কথিত দেশ হস্তান্তরের চুক্তি করা অসম্ভব । | তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে আর একটি গুরুতর অভিযােগ উত্থাপিত হয়। যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিক প্রয়ােজন মেটানাের জন্য ভারতের নিকট কিছু কাগজের মুদ্রা ছাপিয়ে দেয়ার অনুরােধ জানায়। বাংলাদেশে ভারতবিরােধী সেন্টিমেন্ট যখন তুঙ্গে তখন একটি পত্রিকায় একই নম্বরের দুটো টাকার নােট ছাপানাে হয়। এটা যে কায়দা করেও ছাপানাে যেতে পারে তা করাে মনে হয় না । বাজার সরব হয়ে ওঠে যে, ভারত বাংলাদেশে জালমুদ্রা ছেপে পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং কালবাজারে সে সব টাকার মাধ্যমে জিনিসপত্র ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদ এটিতেও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি ভারতে ছাপানাে সকল প্রকার মুদ্রা ব্যাংকে জমা দিয়ে বদলি টাকা নেয়ার জন্য জনগণকে দু মাস সময় দেন। তখন এও বলেন যে, এ ধরনের নােট বাজারে যতগুলাে ছাড়া হয়েছে। | তার চেয়ে যদি বেশি টাকা জমা পড়ে তাহলে তিনি অর্থমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সব শেষে হিসেব করে দেখা যায় যে, বরাদ্দকৃত মােট নােট হতে ৫৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮ শত ৪০ টাকা কম জমা পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে সংসদেও আলােচনা হয়। সংসদে জনৈক সদস্যের প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ জানান গণকণ্ঠ নামক একটি পত্রিকা একই নম্বরের দুটো নােটের ছবি ছেপেছে। পত্রিকা কর্তৃপক্ষের নিকট কথিত নােট দুটো চেয়ে পাঠানাে হলে তারা তা দেখাতে বা জমা দিতে ব্যর্থ হয়। প্রকৃতপক্ষে এ সবই হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যকারী ভারত এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার জনগণের নিকট হেয় করে তােলার অপচেষ্টা।

——

১৭৯১ দৈনিক পূর্বদেশ, ৩ জুন, ১৯৭৩। ১৭৯২ সংসদ বিতর্ক, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, পৃ. ৯৩।

তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচুর টাকা আত্মসাৎ এবং সে টাকা দিয়ে ম্যানসেরু মিয়া’ নামে কালবাজারী করানাের অপপ্রচার ছড়ানাে হয়। এ ধরনের অভিযােগে তিনি মর্মাহত হন। বস্তুত সচেতন মহলে তাজউদ্দীন আহমদের সততা ছিল প্রশ্নাতীত।৭৯৩ তার এই সততা স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থবিরােধী হওয়ায় তারা তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার করে। এরই একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘ম্যানসেরু মিয়া প্রচারণী। তিনি সরকারি কাজে চট্টগ্রামে গেলে প্রচার করা হয় যে, তিনি চোরাকারবারের মালামাল ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। বাস্তবে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যিনি তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তিনিই এ ধরনের চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘৭৫ এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এই মামলার তদন্ত করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এই অভিযােগটির কোনাে ভিত্তি না পেয়ে তা খারিজ করে দেন। ১৯৭৫ সালে যখন মােশতাক আহমদের সরকার তাকে বন্দী করে নিয়ে যায় তখন সামরিক বাহিনীর লােকেরা তার বিরুদ্ধে আনীত আর একটি অভিযােগের তদন্ত করে। অভিযােগটি ছিল- তিনি সরকারের টাকায় সাত মসজিদ রােডের বাড়িটি বানিয়েছেন। কিন্তু তার এ বাড়িটি অনেক আগে পাকিস্তান আমলে সরকারি ঋণদানকারী সংস্থা থেকে অর্থ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। তদন্তে এই অভিযােগটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

এখন দেখা দরকার তাজউদ্দীন আহমদ-বিরােধিতার পশ্চাতে কি কেবল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের কতিপয় নেতার ব্যক্তিগত ঈর্ষাই কাজ করে নাকি এর পেছনে অন্য কোনাে কারণ বা উদ্দেশ্য ছিল? এক্ষেত্রে এটাকে সূচনাকারী একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে মাত্র । আসল কথা হচ্ছে স্বাধীনতা বিরােধীরা গােড়া থেকে সুপরিকল্পিতভাবে কাজে নামে। প্রথমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের ব্যাপক অবদানের বিষয়ে তারা অবহিত ছিল। কাজেই তিনি অধিক ক্ষমতাধর হয়ে উঠলে কোনাে চক্রান্ত কার্যকর হতে পারবে না। দ্বিতীয়ত তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে কেবল অসাধারণ সংগঠকই নন, তিনি সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল নেতা। সে কারণেই সম্ভবত তিনি দিল্লি ও মস্কোর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। দ্বিমেরু বিশ্ব রাজনীতিতে পুঁজিবাদী জগতের প্রধান শক্তি আমেরিকা কখনই চায় নি।

—-

১৭৯৩. কাজী ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১।

ফয়েজ আহমেদের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২০ নভেম্বর, ২০০২। | দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১০৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃ. ২০১-২০৭। ১৭৯৬ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, পৃ. ৮০।

তাজউদ্দীন আহমদের মতাে নেতা শক্তিশালী হয়ে উঠুন। দেশের ভিতরে পুঁজিবাদের পক্ষের শক্তিও চায় নি যে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতায় টিকে থাকুন। কিছুটা সমাজতান্ত্রিক চেতনা থেকে, কিছুটা বাস্তব কারণে তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয়করণ নীতি কার্যকর করতে অগ্রসর হন। যদিও কেবলমাত্র পাকিস্তানের শিল্পপতিদের ফেলে যাওয়া কল-কারখানাগুলােই জাতীয়করণ করা হয়েছিল, তথাপি তার বিরুদ্ধে দেশের সুবিধাভােগী শ্ৰেণীটি সমালােচনা করতে থাকে এই বলে যে, তাজউদ্দীন আহমদ ঢালাওভাবে জাতীয়করণ করছেন। জাতীয়করণ প্রশ্নে বাস্তবে ১৯৭২ সালে ৮২% শিল্প সরকারি মালিকানায় আনা হলেও পরে মাত্র ১৮টি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রেখে অবশিষ্ট সকল প্রতিষ্টান ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়। বেসরকারি বিনিয়ােগ সীমাও ২৫-৩০ লাখে উন্নীত করা হয়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্পষ্ট করেই বলেন যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে সব বাধা আসবে সেগুলাে দূর করে এগিয়ে যাওয়াই তার উদ্দেশ্য। তিনি বলেন: ১৭৯৯

ব্যক্তিমালিকানায় সম্পত্তি রাখার মৌলিক অধিকার দেশের বৃহত্তর অগ্রগতির স্বার্থে রহিত হওয়া প্রয়ােজন। সংবিধানে তাই রয়েছে। মৌলিক অধিকার নিয়ে আজকে যারা বাক-বিতণ্ডা করছেন তাদের আসল কথা বাক স্বাধীনতা নয়, তারা চান ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার। যার ফলে আপনার সম্পত্তি কিভাবে হল, কিভাবে বৃদ্ধি পেল, এটা কি হাইজ্যাক করে হল, না ডাকাতি করে হল, লুটপাট করে

হল তার কোন হিসাব-নিকাশ করা বা প্রশ্ন করা যাবে না। ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকেও তিনি জাতীয়করণকে অগ্রাধিকার দেন। এ ক্ষেত্রে তার যুক্তি ছিল শিল্প-কল-কারখানা রাষ্ট্রায়াত্ত করলে অধিকসংখ্যক মানুষের বেকারত্ব দূর হবে এবং পরিকল্পিত অর্থনীতির মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন করা যাবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে তাজউদ্দীন আহমদ এই ধারণার কথাই ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারের আর্থিক নীতি পরিচালিত হচ্ছে। তার এ স্বকীয় উন্নয়ন মডেল সুবিধাভােগী শ্ৰেণীটির স্বার্থে আঘাত করে। সে জন্য তাকে

—–

এই কারণে আওয়ামী লীগের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত সমাজতান্ত্রিক নীতিকে কোনাে কোনাে সমাজতান্ত্রিক দল পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র বলে সমালােচনা করে । আবুল ফজল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮। ১৭৯৮ সিমিন হেসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ আলােকের অনন্তধারা, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০৬), ১১০। ১৭৯৯ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৪।

ও তার নীতিকে হেয় করার একটি চক্রান্ত শুরু হয়। তৃতীয়ত চক্রান্তকারী মহল শেখ মুজিবুর রহমানকে তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রবাসী সরকারে একনিষ্ঠ নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুদূরপ্রসারী জাল বিস্তার করে। বিষয়টি ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যরা প্রকাশ্যেই উল্লেখ করেন। এখানে বলা হয় যে, চক্রান্ত। কারীদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে অন্যান্য নেতা থেকে পৃথক করে। ফেলা, যাতে পরে সুবিধাজনক সময়ে অতি সহজেই তার পতন ঘটানাে যায় । উক্ত কাউন্সিলে তাজউদ্দীন আহমদ বিদ্যমান পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতার আলােকে বেশ খােলামেলা আলােচনা করেন এবং ক্ষমতাসীন দলের এবং প্রশাসনের অসঙ্গতিগুলাের বিষয়ে আলােকপাত করেন। তিনি এও বলেন অপরাধকারী স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ হলেও তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনাে নাগরিকের হাতেই অস্ত্র রেখে সমাজে শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব নয় । লাইসেন্স, পারমিটের ব্যবসা বন্ধ করা জরুরি। কারখানাগুলােতে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের কাজ না করার যে প্রবণতা পেয়ে বসেছে তা দূর করে একটি ইতিবাচক শ্রম-সংস্কৃতি গড়ে তােলা অত্যাবশ্যক। জাতির তরুণতর অংশকে যদি কাজে লাগানাে না যায় তাহলে। তাদেরকে হতাশা গ্রাস করবে এবং তারা বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক পথ বেছে নেবে এবং জাতির বিপর্যয় ডেকে আনবে। এসব বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান রাখেন, তিনি যেন তার সম্মােহনী নেতৃত্বেকে কাজে লাগান। সবচেয়ে বড় কথা উন্নয়নের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার এবং সেক্ষেত্রে অনেককিছু করণীয় রয়েছে। একদিকে দলের শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার, অন্যদিকে অপরাধীকে ছাড়িয়ে নেয়ার প্রবণতা ত্যাগ করা জরুরি। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পরে:০২

এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটা দলের বা সরকারের নয়, অস্ত্রের খেলা বন্ধ করা দরকার । আমি সামান্য যেটুকু লেখাপড়া করেছি তা থেকে বলতে পারি Establishment-এর বাইরে অর্থাৎ সরকারযন্ত্রের বাইরে যদি অস্ত্র থাকে তবে অস্ত্রের প্রতিযােগিতা বন্ধ করা সম্ভব নয় । আজকে যদি কারাে হাতে অস্ত্র না। থাকত আর বঙ্গবন্ধু হুকুম দিয়ে দিতেন পুলিশকে যে ধর, অস্ত্র জমা দাও পুলিশের কাছে । বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র যদি আমার দর লােকের কাছেও থাকে, রেহাই নেই, তবে পরিস্থিতি ভিন্ন হত। অনেক বর্ণচোরা লােক আওয়ামী লীগে বিভিন্ন কৌশলে আসছে আওয়ামী লীগ কর্মী নাম দিয়ে । আপনাদের এটা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি না হলে কাজ করবেন কি দিয়ে?

—–

১৮০১ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ৩৯৪। ১৮০২, ঐ, পৃ, ৪০৮।

দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদের এ ধরনের খােলামেলা কথাবার্তা অনেকেরই পছন্দ নয়। অনেকেই তাকে এত নিরেট সত্য কথা না বলার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে তার সাহসী উচ্চারণ হচ্ছে:১৮০৩

সত্য কথা বলিতে বলিতে নিজের গর্দান যাওয়ার (assassin pains) পর্যায়ে আসিয়াছি । কিন্তু উহাতে আমি ভীত নই। মরণের পূর্বে কেহই মারিতে পারিবে। না। আমাকে অনেকে সত্য বলিতে নিষেধ করিয়াছেন। কিন্তু আমি উহা বলিয়া যাইব ।… সময় আসিতেছে না, বরং উহা দ্রুত চলিয়া যাইতেছে । এখন যদি

মানুষের জন্য কিছু করা না যায়, তাহা হইলে আর কোনদিনই করা যাইবে না। দেশে তখন দুর্ভিক্ষাবস্থা । চারিদিকে বিশৃঙ্খলা অবস্থা চরম অবনতির দিকে। ধাবমান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার হিমসিম খায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ময়মনসিংহের একটি জনসভায় বলেন দেশের মঙ্গলের জন্যই দেশের প্রকৃত অবস্থা জনগণকে জানানাে দরকার। তা না হলে ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলাে জনগণের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে বিভ্রান্তি ছড়াবে। তাই সরকারের উচিত জনগণকে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে তাদেরকে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি মােকাবিলা করা।৮০৪ জাতির এই বিপর্যস্ত অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ অকপটে সার্বিক পরিস্থিতি স্বীকার করে নিয়ে বলেন:৮০৫

আজকের এই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্দিনে পালিয়ে যেতে পারি না । মন্ত্রী থাকি বা সদস্য থাকি তা বড় কথা নয়, সাধারণ মানুষের ভাগ্যের সাথে সংগ্রাম করে যাব, পালিয়ে যাবাে না- এই আশ্বাস আপনাদের দিতে পারি।… শুধু আমরাই বিপর্যয়ে পড়ি নাই । সারা বিশ্বই আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে এখনও মাথা উঁচিয়ে দাড়িয়ে আছে এই যথেষ্ট। আমরা যে লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাতে পারিনি সে কথা আমি অকপটে স্বীকার করছি।

দেশের চরম নাজুক অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ সাহায্যের আশায় ইউরােপ আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। কিন্তু কোথাও তেমন কোনাে সাহায্য পাওয়া যায় না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শত্রু আমেরিকার নীতি নির্ধারকরা পুনরায় কিউবার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে। একই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন দেশে সফরে বের হন। তিনি অক্টোবরের ২ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে

১৮০৩. দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ মার্চ, ১৯৭৪। ১৮০৪, দৈনিক পূর্বদেশ, ৩০ মার্চ, ১৯৭৪। ১৮০৫ ঐ, ১২ জুলাই, ১৯৭৪।

সেখানকার প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে একটি আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য ঐ বছর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনেও যােগ দিতে গিয়েছিলেন অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে। তাজউদ্দীন আহমদ তার পূর্বেই সফরে বের হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশবিরােধী চক্রান্ত সম্পর্কে আভাস পান। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়া ঠিক হয় নি। বলে কোথাও কোথাও তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন।০৬ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উল্লিখিত সফরকালে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতের সময় ফোর্ড তাকে বাংলাদেশে সংবিধান সংশােধন করে রাষ্ট্রপতির হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করার পরামর্শ দেন। এই সংবাদে তাজউদ্দীন আহমদ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। সম্ভবত এরপরই তিনি পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্বাধীনতার পর থেকে নানা মহলের অব্যাহত চাপের মুখেও বাংলাদেশ কোনাে বহুজাতিক সাহায্য কনসাের্টিয়াম-এর সাহায্য গ্রহণ করে নি। কিন্তু ১৯৭৪ সালের আক্টোবর মাসে ২৪ জাতি সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সাহায্যদাতা ক্লাব গঠিত হয়। সংস্থাটি বেশ কিছু অপমানজনক শর্তের বিনিময়ে বাংলাদেশকে সাহায্যদানে সম্মত হয়। শর্তগুলাে ছিল একপেশে, অপমানজনক এবং ক্ষতিকর। যেমন- বাংলাদেশি মুদ্রার ৫০% অবমূল্যায়ন, বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি অনুসরণ, উদার আমদানি নীতি, বিদেশি পুঁজি বিনিয়ােগের পক্ষে আইন প্রণয়ন প্রভৃতি। এগুলাে তাজউদ্দীনের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়াও দেশের দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে তিনি এ সময় প্রায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সময় অতিবাহিত করতেন। দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন যে, বর্তমান দুর্যোগকালে উট পাখির মতাে বালিতে মাথা খুঁজে পড়ে থাকলে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানাে যাবে না। তিনি আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন:১৮০৯

| মানুষ না খেয়ে মরছে- এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ-বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার জন্যই বা রাজনীতি। মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাটাই

——–

১৮০৬ জাওয়াদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৯।

১৮০৭মঈদুল হাসান একান্ত সাক্ষাৎকারে গবেষককে এই তথ্য প্রদান করেন।

দেলােয়ার হােসেন, মুজিব হত্যায় সি আই এ (ঢাকা: এশিয়া পাবলিকেশানস, ১৯৯৬), পৃ. ৬১। ১৮০৯ দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক পূর্বদেশ, ১৪ অক্টোবর, ১৯৭৫।

করা দরকার । এমন কি আমিও যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত। মােটকথা যে কোন মূল্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মত বর্তমান সঙ্কট মােকবেলা করে মানুষকে

বাঁচাতে হবে । বিবেকবান এই মানুষটি আত্মসমালােচনাতেও পিছপা নন। দেশের বিদ্যমান সংকটে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান, সত্যবাদী, অকপট ও মানবতাবাদী নেতা তাজউদ্দীন আহমদ খুবই ভেঙ্গে পড়েন। অকপটে দোষ-ক্রটি স্বীকার করেন। একজন মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতা কখনাে এভাবে অকপট ও সত্য কথা স্বীকার করেন।

। তিনি অনুধাবন করেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিক থেকে বাংলাদেশের দুর্দিন অবশ্যম্ভাবীরূপে এগিয়ে আসছে। সার্বিক পরিস্থিতি তার মনে এক ধরনের হতাশাবাদী অথচ অমােঘ নিয়তিবােধের জন্ম দেয়। তিনি প্রায়ই বলতেন, একজন মানুষ জীবনে একবারই কোনাে ভাল কাজ করার সুযােগ পায়। তার জীবনে সেই সুযােগ এসেছিল ১৯৭১ সালে। তিনি সেই যুদ্ধে মারাও যেতে পারতেন। কাজেই ১৯৭১ পরবর্তী সময় হচ্ছে তার জীবনে অতিরিক্ত বেঁচে থাকা। এর অল্পপরেই তাজউদ্দীন আহমদসহ কতিপয় মন্ত্রীকে শেখ মুজিবুর রহমান অব্যহতি দেন। অভ্যন্তরীণ ও পুঁজিবাদী দুনিয়ার চাপের মুখেই মুক্তিযুদ্ধের সিপাহশালার নামে খ্যাত এই নেতাকে পদচ্যুত করা হয়। তবে তাজউদ্দীন আহমদ অনেক বিষয়েই। সরকারের অনুসৃত নীতি সমর্থন করতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় তিনি সরকার থেকে সরে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে তার ঘনিষ্টজনরাও অবহিত ছিলেন। বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুজিবের আহ্বানের অপেক্ষায় থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তার হৃদয়ের উদারতা ও দেশাত্মবােধের পরিচয় পাওয়া যায়। কেননা নিজে পদত্যাগ করলে সরকারের দুর্বলতার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ১৯৭৪ সালে বিশ্বব্যাংকের সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটনে গিয়ে ঘনিষ্টদের ইঙ্গিত দেন যে, সম্ভবত সেটাই অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার শেষ সফর। কাজেই মন্ত্রিপরিষদ থেকে তাজউদ্দীন আহমদের বাদ পড়াটা সাধারণ্যে অকস্মাৎ বিষয় বলে মনে হলেও তার ঘনিষ্টজনরা পূর্বাহ্নেই

———-

১৮১০ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, পৃ. ৭৩। ১৮১১ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫। ১৮১২, মাহবুব করিম (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭।

AL Khatib, Who Killed Mujib (New Delhi: Vikash Publishing House Ltd., 1981), p. 136. ১৮৯৮ আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎকার, ১১ নভেম্বর, ১৯৯৬।

তা জানতে পারেন। বস্তুত সচেতন মহলে এ বিষয়ে কানাঘুষাও লক্ষ করা

যায়।১৮১৫

বাংলাদেশের যখন চরম দুর্দিন তখন ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরে আসার কর্মসূচি নির্ধারিত হয়। আগস্ট মাসে ঢাকায় ফিলিপ চেরি বাংলাদেশে সি.আই.এ. প্রধান হয়ে আসেন।১৬ কিসিঞ্জারের আগমন ও সাহায্য দানের পূর্বশর্ত হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে পদচ্যুত করার জন্য মুজিবের প্রতি চাপ দেয়া হয়। পদত্যাগের চারদিন আগে পত্রিকায় ‘ঢাকাস্থ সােভিয়েত এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের আলােচনার ছবি ছাপানাে হলে পুঁজিবাদী বিশ্বের সাহায্য লাভের জন্য তাকে সরানাে অনিবার্য হয়ে ওঠে। বস্তুত শেখ মুজিবুর রহমান এই বিপর্যস্ত সময়ে পিতৃসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশের মানুষকে যে কোনাে মূল্যে বাচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর হন। তবে তাজউদ্দীন আহমদের অনেক খােলামেলা কথাবার্তা মুজিব কিংবা ক্ষমতাসীনদের অনেকের পছন্দ হয়নি বলেই মনে হয়। দীর্ঘদিন ধরে ইউরােপ ও আমেরিকা সফর শেষে দেশে ফেরার পথে জাপানের টোকিওতে যাত্রা বিরতি করেন। সেখানে বাংলাদেশ দুতাবাসে তিনি নাকি প্রকাশ্যে সমালােচনা করে বলেন যে, মুজিব দুর্নীতিপরায়নদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং তার কোনাে কোনাে আত্মীয়-স্বজনও এ ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত। এই সংবাদ মুজিব যথাসময়েই পান । কাজেই তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে বাদ দেয়ার পশ্চাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণ যুক্ত হয়। তিনি যে আওয়ামী রাজনীতিতে অনাকাক্ষিত হয়ে পড়েন, তার প্রমাণ নানাভাবেই পাওয়া যায় । পরবর্তীকালে যে বাকশাল গঠন করা হয় সেখানে তাকে সদস্যপদেও স্থান দেয়া হয়নি।২০ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রধান নেতৃত্বের সঙ্গে তার এই দূরত্ব

—–

১৮১৫ কাজী ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০। ১৮৬, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১।

“, “এই সময়ে হেনরী কিসিংগার ছয় সাত ঘণ্টার জন্যে ঢাকাতে এসেছিলেন এবং মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিসিংগার বাংলাদেশে আসার আগে। পাকিস্তানপন্থীরা এবং তাজউদ্দীনের শত্রুরা শেখ সাহেবকে পরামর্শ দিলেন যে তাজউদ্দীন যদি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী থাকেন তবে কিসিংগার ঢাকাতে আসবেন না।” বিক্রমাদিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩। sbst. Far Eastern Econcmic Review, 15 November, 1974. ১৮১৯ আবদুল মতিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় (লণ্ডনঃ র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স, তৃতীয় সংস্করণ, পুণর্মুদ্রণ, ১৯৯৯), পৃ. ১৮৯-১৯০। ** দেখুন, অধ্যাপক আবু সাঈদ, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল: দিনপঞ্জী ১৯৭৫ (ঢাকা: মুক্তি প্রকাশনী, ১৯৯৩), পৃ. ৩০৩-৩১০ এবং ৪৮০-৪৮৬।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু দেশের চলতি সংকট কাটিয়ে ওঠা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠনের জন্য তার মত দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক ও কাঠোর পরিশ্রমী রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতার প্রয়ােজন ছিল সবচয়ে বেশি। এ সম্পর্কে তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সহসভাপতি এবং আওয়ামী রাজনৈতিক বলয়ের ঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবী নুরুল ইসলামের মূল্যায়নটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ:১৮২১

When Tajuddin left the government, it was repoted that his movements were under constant surveillence and that it was not advisable to meet him in that highly charged atmosphere. I decided to visit him sometime in 1974 and found him very despondent. He never referred to Sheikh Mujib. We discussed various matters of common interest. I had known and worked closely with Taiuddin before and after independence. He was not only a great patriot but also in my view the most serious minded, conscientious and competent as well as the most hardworking among the Ministers. Tajuddin usually took the views of the Planning Commission seriously and if convinced, strongly supported them during Cabinet dicussions. The entire Planning Commission had great respect for him. The split between the two closest political associates, i.e. Sheikh Mujib and Tajuddin, was a great tragedy and bode ill for the future. It was widely believed that his detractors in the Cabinet – some of whom were members of the government in exile and were no friends of his then and later on- were sowing the seeds of mistrust between him and Sheikh Mujib. It seemed to me that he had lost the full confidence of Sheikh Mujib, which he had enjoyed in the pre-1971 days. He occasionally gave expression to his frustration in public and

was not very tactful. দুটো ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের বিষয়াটকে মাথায় রেখে সুষমবণ্টন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং আর্থিক ভিত রচনার জন্য প্রয়ােজন ছিল জাতীয় কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে আত্মশক্তি অর্জন করা। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ ধরনের একটি সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এর ফলে

——-

১৮২১Nurul Islam, op.cit., p.

প্রাথমিক অস্থিরতা কিছুটা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হয়। ১৯৭৩ সাল নাগাদ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বাড়তে শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপের সুফল শুরু হওয়ার পূর্বেই বিভিন্ন কারণে সমাজে ব্যাপক অস্থিরতার জন্ম হয়। পরবর্তীকালে দেখা যায় খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এগুলাের সঙ্গে জড়িত | ছিল না এবং আন্তর্জাতিক চক্র তা পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করেছিল। এসব বিষয়ে রাষ্টনায়কোচিত দূরদৃষ্টি ও দৃঢ়তার সঙ্গে মােকাবলা করা দরকার ছিল। সেটা সম্ভবও হতে পারতাে যুদ্ধের পূর্বে মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি যেমন পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছিলেন তেমনি সম্পর্ক যুদ্ধের পরে অটুট থাকলে। আজ এ কথা অস্বীকার করার কোনাে উপায় নেই যে, কোনাে কোনাে মহল | তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে মুজিবের মন বিষিয়ে তুলেছিল। কেননা শত্রুরা যথার্থই বুঝেছিল যে তাজউদ্দীনই ছিলেন মুজিবের প্রকৃত অস্ত্র । বিশ্বব্যাপী আর্থিক অস্থিরতা ততদিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক শক্তিগুলাে সুবিবেচনা এবং দুরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেনি। আত্মশক্তি অর্জনের জন্য প্রয়ােজন ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টা। ক্ষমতাসীন দল যদি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থাকে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হতাে তাহলে দেখা যেতাে যুদ্ধ এমন একটি স্তরে সমাজকে পৌছে দিয়েছিল যে, যৌথ বা অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব ছিল। জাতীয় সরকার গঠনের যে দাবি উচ্চারিত হয়েছিল সেটা উদার দৃষ্টিতে গ্রহণ করলে সকলেরই দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পেতাে। পরবর্তী পর্যায়ে বাকশাল গঠন ছিল এ ধরনের একটি বিলম্বিত প্রচেষ্টা। কিন্তু তখন এত দেরি হয়ে যায় যে, বিবদমান শক্তিগুলাের মধ্যে তিক্ততা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। | তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কথা বিবেচনায় এনেছিলেন। কিন্তু মুজিব আন্তর্জাতিক নানা চাপ এবং বিভিন্ন শক্তিকে ভারসাম্যে আনতে গিয়ে চূড়ান্ত অর্থে যুদ্ধাপরাধিদের বিচার করতে সক্ষম হননি। আজ এটা প্রমাণিত যে, এ বিষয়ে ছাড় দেয়ায় দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরােধীশক্তি পুনর্বাসিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরােধী শক্তিকে পুনর্বাসিত হতে দেখে তাজউদ্দীন যথার্থই আশংকা করেছিলেন যে, এমন একদিন আসবে যেদিন মুক্তিযুদ্ধ করার অপরাধে মুক্তিযােদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হবে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে নির্মমভাবে তার এই ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়ে দেখা দেয়। | বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসে বিয়ােগান্ত উপাখ্যানের নায়ক। তিনি রাজনীতিতে ঈশ্বরের বরপুত্র ছিলেন না। নিজের চেষ্টায় যে যােগ্যতা অর্জন করেছিলেন তা অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়। সে কারণেই সম্ভবত মেধাহীন লােভী রাজনীতিবিদদের অনেকের নিকট তিনি ছিলেন শক্রস্থানীয় । উচ্চাদর্শে গড়ে ওঠা পরিশীলিত অকপট এই রাজনীতিবিদ দ্বিমাত্রিক বা বহুমাত্রিক মানদণ্ডে কোনাে কিছু অর্জন করতে চেষ্টা করেননি কিংবা পরিচালিত হননি। যােগ্যতার মূল্যায়নই ছিল তার নিকট প্রধান বিবেচ্য বিষয়, সেখানে কখনাে ব্যক্তিগত আবেগ স্থান। পায়নি।

সরকার থেকে বিদায় নেয়ার পর তাজউদ্দীন কোনাে প্ররােচনাতেই মুজিবের বিকল্প কিছু ভাবতে পারেননি। বস্তুত তিনি মুজিবের আহ্বানের অপেক্ষায় থাকেন। সর্বদলীয় উদ্যোগ হিসেবে যে বাকশাল গঠন করা হয় তার কেন্দ্রীয় বা কার্যকরী কমিটির কোথাও তাজউদ্দীন আহমদকে স্থান দেয়া হয়নি। ফলে দলীয় রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদের কোনাে ভূমিকাই অবশিষ্ট থাকেনি। ইতােমধ্যে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা চরম আঘাত হানার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। অন্য অনেকের ন্যায় তাজউদ্দীনও মুজিবকে চক্রান্তের বিষয়ে সাবধান হওয়ার অনুরােধ করেন। তিনি আশংকা ব্যক্ত করে বলেন যে, শত্রুরা মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের কাউকে বাচিয়ে রাখবে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে মুজিবকে হত্যার পরদিন সকালেই তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীসহ অনেককেই ঘাতকরা গৃহবন্দী করে । ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানার অভ্যন্তরে এই চারজন জাতীয় নেতাকে হত্যা করলে তাজউদ্দীন আহমদের ভবিষ্যৎবাণী নির্মম সত্যে পরিণত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি। রাজনীতি, নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এতদঞ্চলের প্রচলিত মুসলিম মানসের প্রবণতা অতিক্রমপূর্বক ব্যক্তি-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দেয়ার মতই খুব সম্ভব রাজনীতিবিদ ও প্রশাসক হিসেবে এটি তার সবচেয়ে বড় অর্জন। এতসব বিরলগুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ। নিজেকে এভাবে ঢেকে রাখার মধ্যে সম্ভবত তিনি এক ধরনের অহংবােধ করতেন। তদুপরি মুজিবের ন্যায় জনসমম্মােহনী নেতার সমকালে যে কোনাে নেতার পক্ষেই জনগণের নিকট আলাদা সত্ত্বায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া ছিল। সুকঠিন কাজ। বস্তুত সমাজ বিকাশের এই স্তরে তাজউদ্দীনের ন্যায়। রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলির চেয়ে মুজিবের মত জনসম্মােহনী নেতার চাহিদা বেশি। তাজউদ্দীন আহমদ এ বিষয়টি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেন। তিনি তাই একটি পর্যায়ে যুগবাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বরং সময়ের সঙ্গে চলতে চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশে তার কর্তৃত্ব সীমাবদ্ধ না হয়ে গেলে বাংলাদেশের ইতিহাস। ভিন্ন রকমের হতে পারতাে। তার নেতৃত্বের যােগ্যতা, উন্নয়ন ভাবনা, দেশপ্রেম, নীতির প্রতি অবিচলতা সর্বোপরি মানবীয় গুণাবলি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষদের স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করবে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ধরনের নেতৃত্ব। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণ বয়ে আনার জন্য আদর্শস্থানীয় ।

৫৮১

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!