You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ - ২য় পর্ব - সংগ্রামের নোটবুক

খ. মােশতাক-মার্কিন সংযােগ বিচ্ছিন্নকরণ

১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদকে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু তিনি আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চিত হন। উভয় সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে মােশতাক-মাহবুব। আলম-জহিরুল কাইউম-হােসেন আলী প্রমুখ কলকাতার আমেরিকান কনসুলেটের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করেন। আমেরিকার গােপন দলিলপত্রে দেখা যায় যে,

————

১২৩১ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৫৭। ১২৩২, ঐ, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১০০। ১২৩৩, আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৬। ১২৩৪ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদের নির্দেশে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ. এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী জহিরুল কাইউম জুলাই মাসের ৩০ তারিখে কলকাতাস্থ আমেরিকান কনসুলেট অফিসে সাক্ষাৎ করতে যান এবং মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সম্পর্ক গড়ে তােলেন। | বস্তুত শুরুতে করণীয় বিষয়ে অস্পষ্টতায় ভুগলেও১২৩৫ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজ স্বার্থরক্ষা ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টিকে বিবেচনায় এনে আমেরিকা অনতিবিলম্বে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় এগিয়ে আসে। পরিস্থিতিকে আমেরিকা মূল্যায়ন করে এভাবে:১২৩৬

Psychologically the concept of a united Pakistan is dead in Bengal. We see no way in which President Yahya can establish a civilian government based on any significant degree of popular support. There are, however, signs that some of the non-Awami League political leaders in East Pakistan, motivated either by fear or hatred of India, concern for the suffering of the Bengali people or by personal ambition, will come forword to re-establish a civilian administration in co-operation with president Yahya. They may be joined by some Awami Leaguers who are unwilling to adopt a

revolutionary posture. ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল প্রণীত আমেরিকান সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের উপযুক্ত গােপন মূল্যায়ন অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগ্রসর হয়। ২৮ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হেনরি কিসিঞ্জার কর্তৃক প্রস্তাবিত তিনটি বিকল্পের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়াকে সর্বাত্মক সহযােগিতা দেয়ার নীতি অনুসরণের পথ বেছে নেন। আমেরিকার আঞ্চলিক স্বার্থেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৬ এপ্রিল রিভিউ গ্রুপের প্রণীত নােটে বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তানের অনুগত প্রতিনিধি সংগ্রহের আভাস পাওয়া যায়।১২৩৮আওয়ামী লীগ। দলীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি কাজী জহিরুল কাইউমের সূত্র হতে জানা যায়, জুন মাসে কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কনসালের সাথে তিনি সাক্ষাৎ

———————–

১২৩৫ Roedad Khan (Compiled and selected), The American Papers, Secret and Confidential India-Pakistan-Bangladesh Documents 1965197 (Dhaka: University Press Limited, 1999), p. 547. ১২৩৬, Ibid., p. 541. ১২৩৭ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলো, ১.১২.২০০৩। $24. Roedad Khan, op.cit., p. 551.

করেন।১২৩৯* প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অজ্ঞাতে এই সাক্ষাৎটি ঘটে। পরে। তিনি এটি জানতে পেরে এ ধরনের প্রচেষ্টার ঘাের বিরােধিতা করেন।২০০। এতদসত্ত্বেও জহিরুল কাইউম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমদের উৎসাহে। আমেরিকান কনসাল জেনারেল ও অন্যান্য মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ অব্যাহত রাখেন। ফলে এক প্রকার জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিষয়টি ভারত সরকার। জানতে পেরে এর প্রতিবাদ জানায়। ভারতের মাটিতে বসে ঐ সরকারের। অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য কোনাে দেশের বিশেষত যে দেশটি প্রকাশ্যভাবে পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন অব্যাহত রেখে ভারতের সমালােচনামুখর তার। সাথে যােগাযােগ কূটনৈতিক রীতিবিরুদ্ধ। বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ সরকার। গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদে সতর্কতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যাতে বলা হয় যে, সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ কোনাে সরকার বা সংস্থার সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারবেন না। একই সুত্র হতে আরাে জানা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান। হােসেন আলীর মাধ্যমে আর একটি যােগাযােগ গড়ে তােলেন। এই প্রচেষ্টাতে। প্রাক্তন সি.এস.পি, আমেরিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী। যুক্ত হন। প্রাথমিক পর্যায়ের যােগাযােগে এভাবে চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে আরাে সম্প্রসারিত হয়। যােগাযােগের। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ্যে ঐ গােপন বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে এক। প্রকার বিভ্রান্তি দেখা দেয় এই বলে যে, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে। একটি সমঝােতায় পৌছাতে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত কোনাে প্রকার সমঝােতার সম্ভাবনার কথা বাতিল করে দেন।২৫৮ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও পাকিস্তান কাঠামােতে সমস্যা সমাধানের সকল সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে বলেন “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বমৈ রাষ্ট্র। পাকিস্তানের কাঠামােতে কোন রকম।

———-

১২৩৯ শামসুল হুদা চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর (ঢাকা: বিজয় প্রকাশনী, ১৯৮৫), পৃ. ২৪৩-২৫০। বিস্তারিত জানার জন্য উক্ত গ্রন্থের কাজী জহিরুল কাইয়ুমের সাক্ষাৎকার বিষয়ক অধ্যায়টি দেখুন। ১২৪৫ শামসুল হুদা চৌধূরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৩। ১২. ঐ, পৃ. ২৫০। ১২:৪২, এইচ. টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯। ১২৪৩. শামসুল হুদা চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৯। ১২৪৪

জয় বাংলা, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, ১৮ জুন, ১৯৭১।

আপোেষ-মীমাংসার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।”১২৫৫ বিভ্রান্তি নিরসন, ষড়যন্ত্র নস্যাৎ ও মনােবল অটুট রাখার জন্য এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ১৩ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন যে, বাঙালিদের বিজয় সুনিশ্চিত। কেননা এটা হচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা আর মহিলাদের ইজ্জত ও সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের সর্বাত্মক আকাক্ষা। এতদসত্ত্বেও কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল অফিসের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরােধী ঐ চক্রটির যােগাযােগ অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে যােগদানকে সামনে রেখে বিশেষ উদ্দেশ্যে চক্রটি উক্ত যােগাযােগ বাড়িয়ে দেয়।

১ আগস্ট কলকাতাস্থ আমেরিকান কনসাল কর্তৃক নতুন দিল্লির কনসাল জেনারেলকে প্রেরিত টেলিগ্রাম হতে জহিরুল কাইউমের নিমরূপ আলােচনার কথা। জানা যায়:১২৪৬

Qaiyum gave background of AL movement up through elections and events of March 25. He said AL was openly ProIndian and Pro-American. Now contact had been lost with Americans and he had been selected by Bangladesh Foreign Minister Khandakar Moshtaque Ahmed to attempt re-establish it. He said BD forign seretary Alam instructed sometime ago by BD foreign Minister to contact Americans, but Alam uncertain how best to arrange this. He gave no indication that he was aware of Alams approach to Ambassador as reported Reftel. He said BD Foreign Minister also interested meeting US government representatives, but emphasized that such as a meeting must be handlled discreetly, preferably without GOI

knowledge. জহিরুল কাইউম আমেরিকান ঐ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে আরাে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । তিনি আরাে বলেন যে, আওয়ামী লীগের অনেকেই মনে করে এখনও একটি রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব এবং আমেরিকা সেটি করে দিতে পারে।

———–

১২৪৫ জনাব তাজুদ্দীন আরও বলেন, যে কোন মূল্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ। তাদের পৃথক সত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষা করবে’, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৫২। S40 C7h, Enayetur Rahim & Joyece L Rahim, Bangladesh Liberation and the Nixon White House 1971 (Dhaka: Pustaka. 2000), pp. 166-169.

এতে অবশ্য শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়। ১৪ আগস্ট সাক্ষাতের সময় জহিরুল কাইউম মন্তব্য করেন, মুজিব যদি জীবিত। থাকেন তাহলে এখনও একটি সমঝােতার সম্ভাবনা আছে, আর যদি তিনি জীবিত

থাকেন সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই।১২৪৭ তার মতে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে । ২০ আগস্ট একটি গােপন টেলিগ্রামে স্যামুয়েল এম. হসকিনসন (Samuel M.Hoskinson) কর্তৃক ড. হেনরি কিসিঞ্জারের (Dr. Kissinger) নিকট প্রেরিত মেমােরান্ডাম হতে জানা যায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ মার্কিন প্রতিনিধিকে জানান। যে, আমেরিকার মধ্যস্থতায় ‘মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনাে সমঝােতা চুক্তি হলে তা গ্রহণযােগ্য হবে। প্রতিবেদনে লেখা হয় “Mujib’s life is more important than independence”*২* এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, খন্দকার মােশতাক আহমদ, মাহবুব আলম চাষী, জহিরুল কাইউম বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের অজ্ঞাতে আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সমঝােতায় উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এ সময় কলকাতার আমেরিকান কনসুলেট জহিরুল কাইউমের মাধ্যমে সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের বিষয়েই। জানতে পারে।১২৪৯

মােশতাক-মাহবুব আলম চাষীর জাতিসংঘের অধিবেশনে যাওয়ার বিষয়টি অবহিত করে তাদের ভিসা প্রদানের অনুরােধ করেন জহিরুল কাইউম।২৫° ২০ আগস্টের গােপন টেলিগ্রামে দেখা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩/৪ জন প্রতিনিধিসহ আমেরিকা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।২৫ জহিরুল কাইউম মার্কিন কনসুলেটের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য ২৭ আগস্ট মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আলােচনা করতে যাওয়ার সময় খন্দকার মােশতাক আহমদ কর্তৃক তাকে লেখা একটি চিঠি নিয়ে যান এবং এক পর্যায়ে তা কনসাল জেনারেলের কাছে হস্ত ন্তির করেন।২৫২ চিঠিতে জহিরুল কাইউমকে খন্দকার মােশতাক আহমদ এগিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি তাকে অবহিত রাখার

১২৪৭*, ibid, p. 173.

১২৪৮Ibid, p. 178. ২e. Ibid, pp. 180-183. DRVO “He hoped that additional contacts will be established and asked about Formin getting US visa. Qaiyum said Formin planning a trip to Moskow, but would like to visit US first.” Ibid., p. 174. ১২৫ Ibid, p. 181 ১২৫২, চিঠির জন্য দেখুন, Ibid, p. 201.–

জন্যও বলেন। বাংলাদেশ সরকারকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক সমঝােতার প্রস্তাবটি ইসলামাবাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে। অবহিত করেন।১২৫৩ ইয়াহিয়া খান প্রস্তাবটির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দেন।

Yahya’s reaction was surprisingly favorable. Recognizing that he had trapped himself, he was grouping for a way out. He welcomed our contacts in Calcutta, asking only to be kept informed. He even accepted Farland’s suggestion that we use our good offices to arrange secret contacts between his

government and the Bengali exile. এরপর কলকাতার মার্কিন কনসুলেট একধাপ অগ্রসর হয়ে সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সংযােগ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।২৫এ ব্যাপারে জহিরুল কাইয়ুমের প্রতি আহ্বান জানানাে হলে তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের ক্রমাগত শক্ত মনােভাব প্রদর্শনের কথা বলেন। জহিরুল কাইউমের ভাষ্যমতে ২৮ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে মিলিত হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদ ব্যতীত সকলেই উপরিউক্ত পন্থায় সমঝােতার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বাম দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যাহােক, ২৮ সেপ্টেম্বর কলকাতার কনসাল জেনারেল অফিসের রাজনৈতিক অফিসার খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে ৯০ মিনিটব্যাপী একটি আলােচনায় মিলিত হন। বৈঠকটির আয়ােজন করেন বাংলাদেশ সরকারের কলকাতা মিশনের প্রধান হােসেন আলী। আলােচনার শুরুতে মােশতাক আহমদ অবশ্য মন্তব্য করেন আমেরিকার সমর্থনপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং আমেরিকাই পারে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে। তিনি নিজেকে কমিউনিস্ট-বিরােধী গণতন্ত্রী বলে দাবি করেন এবং মন্তব্য করেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে সােভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি ঘটবে। পরবর্তীকালে খন্দকার মােশতাক আহমদ মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজকে

—-

১২৫৩ We would also inform Mushtaqe Ahmed that Yayhya should interest in a meeting of GOP and BD reps and volunteer to pass back to President Yahya any response Mushtaqe may have. Should reations from both sides to meeting prove favourable, we could then examine question whether further US role in providing communication link between them would necessary or desirable.”Ibid, p. 193১২৫৪ Henry Kissinger, White House Years (Boston: Little Brown and Company, Toronto, second printing, 1979), p. 870. ১২৫৫. Rahim & Joyce L Rahim, op.cit., pp. 211-212.

১৯৭৬ সালে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে এই যােগাযােগের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু কী কী শর্তে মার্কিনীদের সঙ্গে তিনি সমঝােতায় সম্মত হয়েছিলেন-এমন প্রশ্ন করা হলে মােশতাক আহমদ বলেন, নিক্সনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব না’ । লিফশুলজের গবেষণায় দেখা যায় যে, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারকে পাশ কাটিয়ে মােশতাক আহমদের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝােতা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই গ্রুপটি স্বাধীনতার দাবি ছেড়ে দিয়ে স্বায়ত্তশাসন অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে একটি ন্যূনতম সংযােগ রাখার লক্ষ্যে কনফেডারেশন গঠনে রাজি হয়।১২৫৬ ভারত সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত হয় যে, মােশতাক আহমদ জাতিসংঘের অধিবেশনে যােগদান করতে গিয়ে আমেরিকার মধ্যস্ততায় পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সমঝােতায় উপনীত হওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সবকিছু ঠিক মতাে হলে তিনি কলকাতায় না ফিরে সােজা ঢাকায় এসে সদ্যগঠিত বেসামরিক সরকারকে সমর্থন দেবেন।২৫। যাহােক জহিরুল কাইউমের মাধ্যমে মােশতাক আহমদ সম্পর্কে জেনে কনসুলেট কর্মকর্তারা যতটা প্রভাবশালী আশা করেছিল তার সঙ্গে আলােচনার পর সে ধারণা বদলে যায়। তদসত্ত্বেও সমঝােতার ব্যাপারে এরপর আরাে অগ্রসর হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ৩ অক্টোবর তারিখে কলকাতার মার্কিন কনসুলেট কর্তৃক ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে প্রেরিত গােপন টেলিগ্রাম হতে। জহিরুল কাইউমের সুত্র উল্লেখ করে বলা হয় যে, বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পূর্ববর্তী। আলােচনার সূত্র ধরে জরুরিভিত্তিতে আমেরিকার মনােভাব জানতে চান। তবে। নানা ব্যস্ততার কারণে জহিরুল কাইউম কথিত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে কিংবা মােশতাক আহমদের সঙ্গে সরাসরি আর যােগাযােগ করা যায়নি। মােশতাক-জহিরুল-কাইউম-হােসেন আলী ও অন্যান্যদের সমঝােতার উদ্দেশ্যে উক্ত যােগাযােগ স্থাপনের বিষয়টি ‘দি কার্নেগি পেপারসে’ও সমর্থিত হয়েছে ।১২৬০ এতদুদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের একখানি সাপ্তাহিক মুখপত্র থাকা

————-

১২৫৬ লরেন্স লিফশুলজ, ‘একটি অভ্যুত্থানের ব্যবচ্ছেদ’, প্রথম আলাে, ১৩ আগষ্ট, ২০০০। $289.J.N. Dixit, op.cit., p. 69. ১২৫৮ বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, Enayetur Rahim & Joyce L. Rahim, op.cit., pp. 222-228. ১২৫* Ibid, p. 231. ১২৬০, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমেরিকা সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য মার্কিন সরকার একাধিক তদন্ত কমিশন গঠন করে। প্রায় ১০০০। কার্নেগি পেপারস’ এ ধরনের একটি তদন্ত দলিল।

সত্ত্বেও মােশতাক আহমদ ‘অভিযান’ নামক আর একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে তখন এই মুখপত্রে বলা হয় | যে, যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বিপন্ন হতে পারে। শুধু তাই নয় বড় বড় শিরােনামে লেখা হতাে ‘স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু? কোনটি আগে?’ এ ধরনের প্রচারণা অনেকের মধ্যেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এই পত্রিকাখানির সম্পাদক হিসেবে প্রথমে দায়িত্ব পালন করেন কবি সিকান্দার আবু জাফর । মােশতাকের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে অসুস্থতার অজুহাতে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে জয় বাংলা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে বিষয়টি জানান এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট লেখা তার একখানি চিঠি পৌছে দেয়ার জন্য তাকে অনুরােধ করেন। অন্যান্য সুত্র হতেও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মােশতাক ও অন্যান্যদের চক্রান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন। বস্তুত মােশতাক আহমদ তার প্রত্যাশিত প্রধানমন্ত্রীর পদ না পেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে জাতিসংঘ অধিবেশনে যােগদানে ব্যর্থ হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি বিভিন্ন প্রকার বিরােধিতা, অসহযােগিতা, শত্রুপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন প্রভৃতি নেতিবাচক তৎপরতা শুরু করেন । এমন কি বাংলাদেশ মিশনের ঠিকানায় আগত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রও মােশতাক বা মাহবুবুল আলম চাষী তাকে দিতেন না।২৬২ | সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মন্ত্রিপরিষদের কাজ একদিকে বেড়ে যায়, অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি সরকারের ব্যস্ততাকে বাড়িয়ে তােলে। কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের অফিসের সঙ্গে এ সময় জহিরুল কাইউম, তার বার্তাবাহক কিংবা অন্যকোন এজেন্টের যােগাযােগ অনেকটা ক্ষীণ হয়ে আসে। এ অবস্থাকে forsets …our contacts with the Bangladesh representatives in Calcutta began to dry up’ বলে বর্ণনা করেছেন। এতদসত্ত্বেও ৯ অক্টোবর ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কলকাতাস্থ আমেরিকান কনসাল জেনারেলকে গােপন টেলিগ্রামের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কাজে লাগানাের বিবেচনাবােধ থেকে

————

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস (ঢাকা: কাকলী প্রাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ৫০। ১২৬৯ আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ (ঢাকা: জ্যোত্না পাবলিশার্স, ১৯৯৯), পৃ. ১৯৪-১৯৫। ***. Nurul Islam, Making of a Nation Bangladesh: An Econcmist’s Tale (Dhaka: The University Press Limited, 2003), p. 130.

Henry Kissinger, op.cit., p. 871.

বাংলাদেশের উক্ত গ্রুপটিকে ধরে রাখার জন্য নির্দেশ প্রদান করে।২৬ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সমঝােতা স্থাপনের প্রচেষ্টা হােচট খায়। ২৫ অক্টোবর কলকাতার আমেরিকান কনসাল জেনারেল গর্ডন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে যে গােপন টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন তাতে স্পষ্টত হতাশা ফুটে ওঠে।২৬৫ কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ হাল ছেড়ে দেয়নি। মুজিবনগর সরকারের যাদেরকে মােটামুটি কমিউনিস্টবিরােধী বলে তারা মনে করে তাদের সঙ্গে একটা। যােগাযােগ স্থাপনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। এদিকে জহিরুল কাইউম মাঝে মাঝেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলি, গৃহীত পদক্ষেপ, প্রয়াসপ্রচেষ্টা সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি জানান যে, অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি, ছাত্রনেতা কমিউনিস্টবিরােধী। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিনিময়ে অনেক ছাড় দিতেও প্রস্তুত। ওয়ার কাউন্সিল নামে একটা বিকল্প ধারার সরকারের কথাও তিনি আমেরিকান কনসুলেট অফিসকে অবহিত করে বলেন যে, এর প্রধান হতে চলেছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মার্কিন কনসুলেট অফিসের সঙ্গে জহিরুল কাইউমের যােগাযােগ ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে বলে গােপন কাগজপত্রে পাওয়া যায়। এই যােগাযােগের প্রায় প্রতিদিনের আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের প্রয়ােজনীয়তার কথা উচ্চারিত হয়। কাইউম গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলেন, একমাত্র শেখ মুজিবই পারেন একটা শিথিল ফেডারেশনের মাধ্যমে হলেও পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখতে। তিনি দাবি করেন, মুজিবের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু হিসেবে জানেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান নি। ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাশা ছিল। তিনি আরাে জানান, সমঝােতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হােসেনকে প্রয়ােজন।১২৬৮ | যাহােক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উক্ত যােগাযােগের বিষয়ে গােপনীয়তা বজায় রাখা সত্ত্বেও ভারত সরকার সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ২৬৯ এ বিষয়ে জানতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে তা অবহিত করে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের জন আরউইনের নিকট থেকে ভারতের রাষ্ট্রদূত উক্ত গােপন যােগাযােগের সংবাদটি সংগ্রহ করেন। অতঃপর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে

১২৬৪ . Enayetur Rahim & Joyce L. Rahim, op.cit., p. 248. ১২৬৫

Ibid, p. 284, Ibid, p. 411. Ibid, p. 266. Ibid, p. 213. Henry Kissinger, op.cit., p. 872.

পরাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদকে পদচ্যুত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কৌশলগত কারণে তাকে পদচ্যুত না করে বরং তাকে এক প্রকার ক্ষমতাহীন করে রাখেন। আর তার সচিব মাহবুবুল আলম চাষীকে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বরখাস্ত করেন।১২৭০

গ. অন্যান্য কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কূটনৈতিক মিশন স্থাপন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমর্থন আদায়, জনমত গঠন প্রভৃতির পাশাপাশি প্রয়ােজনীয় যুদ্ধোপকরণ ক্রয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহকেও গুরুত্ব দেয়া হয়। এ ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তিনি একই সঙ্গে প্রবাসে কূটনৈতিক কাজে নিয়ােজিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তার বিষয়েও গুরুত্ব প্রদান করেন। জুনের শেষ সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংহ লন্ডনে গেলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরী হাইকমিশনার আপা পন্থের উপস্থিতিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে যাতে অস্ত্র পাঠানাে যায়, সে ব্যবস্থা করে দেয়ার অনুরােধ জানান। শরণ সিং আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিভিন্ন দেশে সফরকালে কোনাে বিপদের সম্মুখীন হলে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। অস্ত্র পাঠানাের ক্ষেত্রে কিছু কূটনৈতিক সমস্যার কথা তিনি উল্লেখ করেন। তবে শরণ সিং শেষ পর্যন্ত আপা পন্থকে প্রবাসী বাঙালি নেতৃত্ব কোনাে কিছু মুজিবনগর সরকারের নিকট পাঠাতে চাইলে তা কূটনৈতিক ব্যাগে পাঠনাের নির্দেশ দেন। এই সুযােগ গ্রহণ করে প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিবাহিনীর ব্যবহারােপযােগী ৮২,৯৫০ ডলার মূল্যের কিছুসংখ্যক যন্ত্রপাতিও প্রেরণ করেন।

বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ সরকারের এই ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং ভারত সরকারের প্রচেষ্টার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অন্যান্য সুফল পাওয়া যায়। যেমন-এক পর্যায়ে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তান। সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানের বিমানের জন্য তেল সরবরাহ করা দেশটির পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে শ্রীলংকা পাকিস্তানকে যুদ্ধ শুরুর পূর্ব

————-

১২৭০ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০।

আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯। ১২৭২ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৩।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২।

১২৭৩

৪০৮

হতে তার আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করেন যেন দেশটি অন্তত নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। এ পর্যায়ে শ্রীলংকা পাকিস্তানের পক্ষে একটা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে অগ্রসর হয় বলেও জানা যায়।১২৭৪

| ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনের আগেই বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ফলে অক্টোবর মাসে আমেরিকা ও জাতিসংঘের সদর দফতর বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করে। দলনেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর গ্রন্থ হতে জানা যায় ঐ প্রতিনিধি দলে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যান্য দলের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও কূটনীতিকসহ মােট ১৬ জন অন্তর্ভুক্ত হন। তারা হলেন:১২৭৫ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ, এম.আর. সিদ্দিকী, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. মফিজ চৌধুরী, সিরাজুল হক, ডা. অসহাবুল হক, ফণিভূষণ মজুমদার, ফকির শাহাবুদ্দীন, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, ড.এ.আর. মল্লিক, অধ্যাপক রেহমান সােবহান, খুররম খান পন্নী, সৈয়দ আনােয়ারুল করিম, এ.এম.এ মুহিত, এ.এইচ মাহমুদ আলী। এছাড়াও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবুকেও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। দলনেতা আবু সাঈদ চৌধুরীর সুপারিশক্রমে আমেরিকাস্থ বাংলাদেশ মিশনের এ.এইচ. মাহমুদ আলীকে তার সহকারী হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এটা যে একটি জনযুদ্ধ তা প্রমাণ করার জন্য আওয়ামী লীগের বাইরে রাজনৈতিক দলের নেতা বুদ্ধিজীবীকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। | যেহেতু বাংলাদেশকে তখন পর্যন্ত কোনাে রাষ্ট্র স্বীকৃতিদান করেনি, তাই প্রটোকলজনিত কারণে জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের কাজ করতে বেশ অসুবিধা হয়। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যথার্থভাবেই অনুধাবন করেন এবং প্রতিনিধি দলকে নিদের্শ দেন জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনের সময় প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে বিশ্ব জনমতকে পক্ষে টানার চেষ্টা করাই হবে ঐ মিশনের প্রধান লক্ষ্য।

———–

১২৭৪. আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬।১ ২৭৫ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫-১৬৬। ১২৭৬

আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬। আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৬-১৫৭।

জাতিসংঘ জরুরি প্রয়ােজনে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারে। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশ ইস্যুতে তা করা হয়নি। এ বিষয়ে ঐ সংস্থাটি এর নানা ধারায় অনেক ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারতাে।১২৭৮ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর মধ্যে পারস্পারিক অভিযােগ পাল্টা-অভিযােগের এক পর্যায়ে অধিবেশনের সভাপতি আদম মালিক ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমস্যাটি দ্বিপাক্ষিকভাবে মিটিয়ে ফেলার আহ্বান জানান। কেননা তিনি মনে করেন বিষয়টি সাধারণ পরিষদে সমাধানযােগ্য নয়।১২৭৯

প্রায় প্রতিটি দেশের প্রতিনিধি কিংবা কূটনৈতিক বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন এবং যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু যেহেতু কোনাে রাষ্ট্র তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করেনি, তাই প্রতিনিধি দলটি তেমন কূটনৈতিক সাফল্য পায়নি। এমনকি সমস্যার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত রাষ্ট্র ভারতও যেহেতু স্বীকৃতি প্রদান করে নি তাই অন্যান্যরা এই বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করে। আবার মুসলিম দেশগুলােকে খুব কষ্টে বুঝানাের চেষ্টা করা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের উসকানি বা হিন্দুদের বিষয় নয়, বরং পাকিস্তান কাঠামােতে তাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত ও নির্যাতিত হওয়ার কারণেই তারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ন্যায্য যুদ্ধে লিপ্ত এবং ভােটের মাধ্যমে জনগণ সে রায় প্রদান করেছে । যে যুদ্ধে বাঙালিরা লিপ্ত সেখান থেকে ফেরার কোনাে উপায় নেই।”

সে বছর জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতির দায়িত্ব পালন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জয়ন্ত কুমার ব্যানার্জী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের জন্য নিজের রুমটি ব্যবহারের সুযােগ দেন। এ ছাড়াও জাতিসংঘের প্রেস উইং-এর সহযােগিতায় টেলিগ্রাম ও যােগাযােগের অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেন। এ ধরনের সুবিধা সাধারণত বৈধ কূটনীতিকরাই পেয়ে থাকেন। এখান থেকে বিভিন্ন বিষয়ের অগ্রগতির খবর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট প্রেরণ করতেন।১২৮২ | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিকরা বাংলাদেশের পক্ষে

১২৭৮ আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫। ১২৭৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০১। ১২৮ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৯। ১২৮৯ ঐ, পৃ. ১৬৯। ১২৮২, ঐ, পৃ. ১৬৮।

যােগদান করেন তখন নভেম্বর মাসে মুজিবনগর সরকার কতিপয় দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে। ১২৮৩ নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমােদিত উল্লিখিত মিশনের ঠিকানা, বাসা, পােষ্ট বক্স ও প্রযােজ্য ক্ষেত্রে ফোন নং প্রদান করা হয় যাতে প্রয়ােজনে যে কেউ তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারে। এভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্ব আসন্ন হওয়ার পূর্বেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কার্যকরভাবে বিশ্বমতকে পক্ষে টানতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের বিজয়লাভ যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র তখন বিশ্বব্যাপী নতুন আঙ্গিকে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।১২৮৪

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য অসাধারণ । এই অর্জন, এর সঙ্গে জড়িত সকলের প্রাপ্য। যদিও এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি নিয়ােজিত ছিলেন তথাপি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সকল বিষয়ের ন্যায় সরকারের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সদা সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাজউদ্দীন আহমদ সকল বিদেশী কূটনীতিক কিংবা প্রতিনিধিদের সাথে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে সাক্ষাৎ করতেন। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হােসেন তৌফিক ইমাম তাজউদ্দীন আহমদের কূটনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে লিখেছেন:১২৮৫

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন প্রতিটি মুহূর্তে দেশের অবস্থা, যুদ্ধের সফলতা-বিফলতা ইত্যাদির প্রতি যেমন প্রখর দৃষ্টি রেখেছিলেন তেমনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কাজও তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবে খেয়াল রাখতেন; যদিও এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তিনি সকল মন্ত্রীর খোজখবরও রাখতেন। তাদের

কাজকর্মে আন্তরিক সহযােগিতা প্রদান করতেন। তাজউদ্দীন আহমদ সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে নিজ সত্ত্বায় ধারণ করতে সক্ষম হন। বলেই সরকারের প্রতিটি বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন এবং দক্ষতার সঙ্গে সেগুলাে

——–

১২৮৩ মিশন ও মিশনপ্রধানরা ছিলেন কলকাতা: হাইকমিশনার হােসেন আলী, দিল্লি: এইচ.আর চৌধুরী, লন্ডন: বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, স্টকহােম: আবদুর রাজ্জাক, নিউইউয়ক: এস.এ করিম, ওয়াশিংটন: এম.আর সিদ্দিকী, হংকং: মহিউদ্দিন আহমদ, ম্যানিলাঃ কে কে পন্নী, কাঠমুণ্ডু: এ.এম মুস্তাফিজুর রহমান, বার্ন: ওয়ালিউর রহমান, টোকিও: এস.এম. মাসুদ। দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৮৭-৮৮৯। ১২৮৪ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৫। ১২৮৫ ঐ, পৃ. ১৭১।

পরিচালনা করেন। এ বিষয়ে দু একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার শিশুপুত্র সােহেল অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে দেখতে যেতে চাননি। এ নিয়ে তার ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার-২৮৬ ও বাংলাদেশের অনেক সহকর্মী ১২৮৭ বেশ পীড়াপীড়ি করলে এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে

বলেন:১২৮৮

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়ে স্ত্রী তাে নিরাপদেই আছে কলকাতা শহরে। এদের কথা চিন্তা করার জন্যে তাে সবাই রয়েছে। যেমন আপনারা, মিস্টার চ্যাটার্জি সবাই তাে আমার ছেলেমেয়ের ও স্ত্রীর সুখ-দুঃখের চিন্তার জন্যে রয়েছেন। অনেক মুক্তিযােদ্ধা শত্রুবাহিনীর হামলায় পা হারিয়েছে, হাত হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কেউ গুলির আঘাতের যন্ত্রণা চেপে ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে বনে-বাদাড়ে লুকেিয় লুকিয়ে। এদের তাে অনুভূতি আছে। তাদের মা-বােন-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে স্বজন রয়েছেন। কিন্তু তাদের কথা চিন্তা করার সময় কোথায়? মাইন বা গুলির আঘাতে যন্ত্রণাকাতর ওই মুক্তিযােদ্ধা তার ব্যথা-বেদনা চেপে ধরে সকল অনুভূতি, চিন্তা, চেতনা, দেশমুক্ত করার অগ্নিশপথে সমর্পণ করেছে । শেষ সম্বল নিজ প্রাণটিও। দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত। শক্রর হাতে মৃত্যুর পর গাের-কাফন হবে কি হবে না, কিংবা কোথায় গাের-কাফন হবে; আত্মীয়-স্বজন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার মৃত্যুর খবরটুকু জানতে পারবে কিনা এই ভাবনাটুকু কি তার মনে একবার উদয় হয়? কোথায় তার অনুভূতি? যদি প্রশ্ন করেন, তার কি কোন অনুভূতি আছে? এ পরিস্থিতিতে এর কী। জবাব আছে? পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে যদি আমার মুত্যু হতাে তাহলে আমার পরিবার-ছেলেমেয়েদের অবস্থা কি হতাে? কে ভাবতাে তাদের কথা? যারা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন তাদের রেখে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনদের কথা এ মুহূর্তে আমিও কি একটিবার ভাবছি? আপনার মনকে জিজ্ঞাসা করুন আপনিও কি

ভাবছেন? অনুভূতির এ ধরনের গভীরতম প্রকাশের মধ্য দিয়েই তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে ধারণ করেন তা সম্যকভাবে অনুধাবন করা যায়। দুঃসহ শরণার্থী জীবনের কষ্টের সঙ্গে যুক্ত হয় মে-জুন মাসের ঝড়-বৃষ্টি। শরণার্থী শিবিরের দুরবস্থার কথা ভেবে তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করেন। এ ধরনের একটি ঘটনার কথা লিখেছেন ড. আনিসুজ্জামন। তিনি একদিন সকালে অফিসে এসে দেখেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চোখ লাল হয়ে আছে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন যে, রাতে ঝড়াে বাতাসের শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। জানালা

——

১২৮৬. এস.চট্টোপাধ্যায়, ‘আমার চেনা তাজউদ্দিন, দৈনিক ভােরের কাগজ, ১৯৯২। ১২৮৭ নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬-১০৮। ১২৮৮

ঐ, পৃ. ১১৬-১১৭।

বন্ধ করতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়া লক্ষ করে শরণার্থী শিবিরের মানুষগুলাের কথা মনে পড়ে যায় । তারপর আর ঘুমাতে পারেন নি। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক বিষয়ে অথও মনােযােগ নিবদ্ধ করার জন্য এবং উচ্চতর মানবিক চেতনার কারণে তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারিক জীবনযাপন হতে বিরত ছিলেন। এ বিষয়ে | এ.আর. মল্লিক লিখেছেন:১২৯০

একই ভবনে তাজউদ্দিনের স্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবার বাস করতেন। কিন্তু তাজউদ্দিন সেখানে থাকতেন না। আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমার পরিবারের সঙ্গে এক বাসাতে থাকতে চাই না। কাজেরও সুবিধা হয়, সাংসারিক ঝামেলা আমি নিতে চাই না। তার গায়ে একটি শার্টই প্রায় দেখতাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, শার্ট বদলান না কেন?’ বললেন ওটাও হাঙ্গামা হবে। এই শার্টটি ময়লা কম হয়, গােসল করার সময় মাঝ মাঝে ধুয়ে

নিই।’ দ্যাট ওয়াজ তাজউদ্দিন। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করেছেন। এভাবে সমগ্র জাতিকে নিজ চেতনায় ধারণ করেছিলেন বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয় শত বাধা-বিপত্তি আতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা।

তাজউদ্দীন আহমদ বিরােধী চক্রান্ত

তাজউদ্দীন আহমদের দেশ ও জাতির প্রতি এমন দায়িত্ব ও মমত্ববােধ সত্ত্বেও বিরােধীরা তাকে নানাভাবে অপদস্থ এমন কি পদচ্যুত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এই বিরােধিতা যতটা না সরকারের প্রতি, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল তার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রতি। সরকার গঠনের পর জনবল সংগ্রহ করে প্রাথমিক কাঠামাে। প্রতিষ্ঠা করতেই বেশ সময় চলে যায় । তদুপরি মে মাসে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্ত নি বাহিনীর হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতন তীব্রতর হওয়ার ফলে শরণার্থী সমস্যা উভয় সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযােদ্ধাদের যে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ শুরু হয়, প্রায় তিন হাজার জনের প্রথম ব্যাচটির কোর্স শেষ হয় জুন মাসে। কাজেই পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর ও সীমিত আকারে আক্রমণে যাওয়া জুন মাসের পূর্ব পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকেও প্রত্যাশিত সামরিক সাহায্য কিংবা স্বীকৃতি কোনটাই

——–

১২৮৯ আনিসুজ্জামন, ‘এক বিরল মানুষের কথা, জাতীয় চার নেতা, ড. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), পৃ. ১৩। আরাে দেখুন, আনিসুজ্জামান, আমার একাত্তর, পৃ. ১৬৭। ১২৯০ এ.আর, মল্লিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭-১৪৮।

পাওয়া না যাওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী কোনাে কোনাে নেতা ও শরণার্থীদের মনে ইতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে। এ ধরনের আবেগকে পুঁজি করেই তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধীপক্ষ মাঠে নামে এবং বিভিন্ন স্তরের নেতা, বিশেষত ১৯৭০ সালে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। এ বিষয়ে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের বিশেষ একটি সংস্থার সক্রিয় সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে আর একটি বাহিনী গড়ে ওঠে এবং এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের যুবফ্রন্টের নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মন্ত্রিরিষদের সদস্য মােশতাক আহমদ ও কয়েকজন নেতার তাজউদ্দীনবিরােধী নানামুখী চক্রান্ত। তাজউদ্দীন আহমদ তােয়াজ করে চলার মত নেতা ছিলেন না। আবার পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য অনৈতিক কোনাে পন্থা অবলম্বন করবেন, এমন চর্চা ও প্রভাব কোনটিই তার ছিল |

। মুজিবের উপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের মূলনীতি নির্ধারকদের একজন ছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অসাধারণ প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অত্যন্ত স্থিতধী । এই ধরনের ব্যক্তিত্বসম্পন্নরা সাধারণত প্রচারবিমুখ হন। ফলে মুজিবের অনুপস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল প্রকট হয়ে ওঠে যা তাজউদ্দীন আহমদ বিরােধিতায় পর্যবসিত হয়। এ প্রসঙ্গে মঈদুল হাসানের মূল্যায়ন প্রণিধানযােগ্য১:১২৯১

ইতিপূর্বে দলের নীতি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যদিও তার স্থান ছিল সুউচ্চে, তবু দলের | কাছে সেই নীতিকে গ্রহণযােগ্য করার ব্যাপারে তাঁর নিজের ভূমিকা ছিল সীমিত । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হত পরিকল্পিত নীতি সম্পর্কে শেখ মুজিবের সম্মতি আদায় করেই । শেখ মুজিবের দায়িত্ব ছিল প্রস্তাবিত নীতি সম্পর্কে দলের

এবং দেশবাসীর সম্মতি আদায় করা। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদকে অন্যান্য বিষয়ের মত প্রশাসনিক কাঠামাে | গড়ে তুলতে হয় যার মূল লক্ষ্য পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর গণহত্যা বন্ধ ও দেশকে শত্রুমুক্ত করা। বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে টাকা পয়সা, চাকরি বাসস্থান প্রভৃতি সুযােগ সুবিধা প্রদানের জন্য অব্যাহতভাবে দাবি জানাতে থাকলে। সেগুলাে প্রত্যাশার তূলনায় পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হতােনা। তদুপরি ফলে এই | মর্মে অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত | আত্মগােপন করতে প্রস্তুত শেখ মুজিবুর রহমানকে তা করতে দেননি। এ ধরনের আরাে অসংখ্য অভিযােগ তার বিরােধীরা যত্রতত্র ছড়িয়ে দেয়। এরূপ বিরোধিতার |

১২৯১ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫। ১২৯২. এম.এ. মােহাইমেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯।

মুখে তাজউদ্দীন চরম অসহায় হয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার উদ্দেশ্যে শত্রুপক্ষকে মােকাবিলার ন্যায়ই তাজউদ্দীন আহমদের নিকট তার বিরােধীদের মােকাবিলা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে । নিজ দলের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদবিরােধিতার উৎপত্তি অনেক পূর্বেই ঘটেছিল বলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রাক্তন সম্পাদক ইকবাল হােসেন উল্লেখ করেন:১২৯৩

ঊনসত্তরের পর ছাত্রলীগে সমাজতন্ত্র বিষয়ক যে কোর্স চালু করা হয়েছিল তা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া হয় । তাজউদ্দিন এর সাথে যুক্ত না থাকলেও তাকে এজন্য পরােক্ষভাবে দায়ী করা হয় এবং রাশিয়ান কমিউনিস্টবলে অভিযুক্ত করে তার

সাথে ছাত্রলীগের যােগাযােগ রাখা নিষিদ্ধ করা হয় । এ ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের নিকট এবং পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলাের প্রচার মাধ্যমগুলাের নিকট অল্পকালের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের বামঘেষা আপোেষহীন নেতা বলে বিবেচিত হন।*** এমতাবস্থায় শত্রুপক্ষ তাজউদ্দীন আহমদকে বিরােধিতার মধ্যে ফেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। | শেখ মণির নেতৃত্বে তাজউদ্দীন আহমদ-বিরােধিতা শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদলীয় দ্বন্দ্বের সুত্রপাত ঘটায়। মণি সরকার গঠনের বিরােধিতা ও তাজউদ্দীন আহমদের ১১ এপ্রিল প্রচারিতব্য ভাষণ বন্ধ করার অনুরােধ জানিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতার স্বাক্ষরযুক্ত একটি আবেদপত্র প্রেরণ করেছিলেন। তাতে অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ বন্ধ করা যায় নি এবং প্রবাসী সরকারের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থনও ক্ষুন্ন হয় নি। যুবলীগ নেতারা পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অথবা তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। | শরণার্থীদের নিকট স্বাভাবিক জীবন যাপন যখন দুঃসহ হয়ে ওঠে এবং ভারত কূটনৈতিক জটিলতা ও বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানের বিবেচনা বােধ থেকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছিল তখন রটনা ছড়িয়ে পড়ে, ভারত সরকার তাজউদ্দীন আহমদের কারণেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করছে।

১২৯৩. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পৃ. ৩৬৯। **** “Mr. Tajuddin Ahmed, the Prime Minister of Bangladesh Government recognised by India is more forthrightly secessionist in his outlook than was Sheikh Mujib.” The Times, 16 December, 1971, ১২৯৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।

৪১৫

এ সময় যুদ্ধরত বাঙালিদের ন্যায় ভারত সরকারের ডানপন্থী অংশ এবং বিরােধীদলীয় সকল রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের স্বীকৃতির জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল। এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায় সাংবাদিকদের প্রতিবেদনেও।১২৯৬ ৬ জুন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এই হতাশা ফুটে ওঠে। এতে লেখা হয় “নিরাপদে শরণার্থীদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠাবার ব্যাপারে ভারত কী করতে পারবে তা বােঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মুখপাত্রদের বক্তব্য: আগামী মাস তিনেকের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটিয়ে দিতে না পারলে ওদের বােধ হয় আর কখনােই হটানাে যাবে না। এর অর্থ শরণার্থীদের ঘরে ফেরা হবে না। এটা হয়ত মুক্তি ফৌজের অনেকের সাময়িক আশাভঙ্গজনিত বক্তব্য কিন্তু তবু এ বক্তব্যের দিকে ভারতকে কান দিতেই

হবে।”১২৯৭।

| ঠিক এ ধরনের আশাভঙ্গ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে প্রকাশ্যে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, “এর চাইতে বরং দেশে ফিরে গিয়ে যুদ্ধ অথবা আপােষ করা ভালাে।” তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ হতে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ দাবি করেন।২৯৮ তাজউদ্দীন আহমদ-বিরােধিতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছিল, তা জানা যায় তাজউদ্দীন আমদের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি এম.এ. মােহাইমেনের স্মৃতিচারণ হতেও। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে মাঝেমধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। যুবনেতারা তথা মুজিব বাহিনীর সদস্যরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে কতটা দুর্বব্যহার করেন তার কোনাে কোনাে ঘটনা এম,এ. মােহাইমেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এতদসংক্রান্ত তার স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ: ১২৯৯

একদিনের কথা আমার মনে আছে। সন্ধ্যার পর আমি ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে গেলাম তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি দোতলার সিঁড়ির গােড়ায় তিনি দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপছেন। আর অনতিদূরে ছাত্রলীগের এক প্রভাবশালী নেতা দাঁড়িয়ে। ইনি বর্তমানে টাঙ্গাইলের জাসদের একজন বিশিষ্ট নেতা ও সংসদ সদস্য। তাজউদ্দিন সাহেব জুব্ধ স্বরে বলছেন আমি দিতে পারব না আর ছাত্র নেতাটি বলছে, আপনাকে দিতেই হবে-আপনি না দেবার কে? আপনি তাে একজন

——–

১২৯৬, দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১৩। ১২৯৭ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৬-২৩৭। ১২৯৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮। ১২৯৯

এম,এ, মােহাইমেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩-৯৪।

ইমপ্যার[Impostor] প্রতারক। তখন তাজউদ্দিন সাহেব রেগে বললেন, ইউ গেট আউট ফ্রম হিয়ার । ছাত্র নেতাটি প্রত্যুত্তরে বললাে, হােয়াই শুড আই গেট আউট, ইউ বেটার গেট আউট। এ সময় ভারতীয় প্রধান সিকিউরিটি অফিসার, নিরাপত্তা ও অন্যান্য ব্যাপারে নিয়ােজিত অফিসার, সিকিউরিটি গার্ড সব মিলিয়ে আট দশ জন লােক অবাক বিস্ময়ে ঘটনা অবলােকন করছিল। একটা স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তার দেশের একজন ছাত্রনেতা বলছে বেরিয়ে যাও। অকল্পনীয় ব্যাপার । এতগুলাে বিদেশী লােকের সামনে নিজেদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপদস্থ হতে দেখে লজ্জায় আমি মুখ তুলতে পারছিলাম না । আমি ভয় করছিলাম চার। খলিফার এক খলিফা এই নেতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হাতাহাতি না হয়ে যায়। যাই হােক শেষ পর্যন্ত ক্রোধ সংবরণ করে তাজউদ্দিন সাহেব নিজের কামরায় চলে গেলেন এবং ছাত্রনেতাটিও ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পর তাঁর কামরায় গিয়ে ব্যাপার কি জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এরা যখন তখন এসে বলবে টাকা দিন। আলাদা ফান্ড থেকে এদেরকে রীতিমত মাসােহারা দেয়া হয় হাত খরচ হিসাবে । এরা অধিকাংশই হােটেলে থাকে। এবং হােটেলে থাকা খাওয়ার খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করে। হাত খরচ হিসাবে যা দেওয়া হয় মাসের জন্য তা যথেষ্ট । তার উপর প্রায়ই আমার নিকট টাকা চেয়ে বসে এবং মাঝে মাঝে আমাকে কিছু দিতে হয়। এই ছেলেটিকে মাত্র কয়েকদিন। আগে ১০০ টাকা দিয়েছি , আজ আবার এসে টাকা চাওয়ায় আমি দিতে অস্বীকার করায় কি ব্যবহার করলাে নিজের চোখেই তাে দেখলেন। বিদেশী এতগুলাে লােকের সামনে অপদস্থ হওয়ায় তার মনে খুবই লেগেছিল। তিনি খুব ধীর স্থির মানুষ, ভাবাবেগে সহজে বিচলিত হন না। কিন্তু আজ দেখলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করছিলেন। তার বােধ হয় অপমানে কান্না পাচ্ছিল। তিনি অনেক চেষ্টার পর গলা পরিষ্কার করে আমাকে বললেন, এ ভার আমি আর বইতে পারছি না। কায়মনােবাক্যে প্রার্থনা করি শেখ সাহেব যতশীঘ্র হয়

ফিরে আসুক। তার হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি নিস্কৃতি পেতে চাই । ঘটনাটি কোন্ সময়ের তা এম.এ. মােহাইমেন উল্লেখ করেন নি। তবে আরাে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাজউদ্দীন আহমদের নানাভাবে অপদস্থ হওয়ার ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। এরূপ প্রবল প্রতিকূল অবস্থাতেও অবিচল থেকে একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ায় তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এইচ.টি. ইমাম লিখেছেন: ১৩০০

সবচেয়ে বড় কথা ঐ পরিস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমদ যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। অসীম ধৈর্য ছিল তাঁর। কোন প্ররােচনাতেই তিনি উত্তেজিত হতেন

———

১৩০০ আমির হােসেন আমু (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২।

না। সে সময় মন্ত্রিপরিষদের সভায় কেউ কেউ মুখের উপর কাগজ ছুঁড়ে দিয়েছেন,

এমন ঘটনাও আমার মনে আছে। এগুলাে ছিল তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি যুদ্ধরত কোনাে কোনাে নেতা ও মহলবিশেষের বৈরী আচরণ। অন্যদিকে পাকিস্তানী শত্রুপক্ষের নিকট তিনি ছিলেন একজন জঘন্য ব্যক্তি। পাকিস্তানিদের ধারণায় তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে হিন্দু, পাকিস্তানবিরােধী এবং ভারতের চরবিশেষ। | এর সঙ্গে যুক্ত হয়, মন্ত্রিসভার সদস্য বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত চাপ, ওসমানীকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করে সামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘ওয়ার কাউন্সিল গঠনের দাবি; যার চরম লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তে সামরিক কর্তৃত্বে আনয়ন, যা কোনাে দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ঘটেনি। এসব সমস্যা তাজউদ্দীন আহমদকে অত্যন্ত কৌশলে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে মােকাবিলা করতে হয় । প্রবাসী সরকার কাঠামােকে কোনভাবেই সম্প্রসারণ না করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। কেননা সেটা করলে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টির পাশাপাশি রাজনৈতিক সমস্যার জন্ম দিত যা কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত না। | এ সময় বিরােধীরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার চেষ্টা চালায়। তাদের পক্ষ থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানানাে হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধৃত হওয়ার পূর্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব যুবনেতাদের দিয়ে গেছেন। তাদের বক্তব্যের সমর্থনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি আবদুর রব শেরনিয়াবাতের একটি চিঠিসহ মুজিবের একজন ঘনিষ্ট ব্যক্তিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট প্রেরণ করা হয়। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের সমর্থন তার প্রতি নেই ।৩০২ এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থন আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। এ পর্যায়ে ডি.পি. ধর তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ট মঈদুল হাসানের নিকট জানতে চান। তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি এ ধরনের বিরােধিতার কারণ কি? এর জবাবে মঈদুল হাসান জানান যে, অন্যান্যরা বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে বিস্তর অর্থ বিলি করেন যেটা তাজউদ্দীন আহমদ পারেন না। ডি.পি. ধর বলেন, তিনিও অর্থ বিলি

———

রাও ফরমান আলী খান, বাংলাদেশের জন্ম (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ৬৬। রাও ফরমান আলী খান রচিত মূল গ্রন্থখানির নাম How Pakistan got Divided. ১৩০২, বদরুদ্দীন আহমদ, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য কাহিনী (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ৮১।

করেন না কেন? ভারত সরকার বাংলাদেশের জন্য এত কিছু করছে আর তাজউদ্দীন আহমদের জন্য টাকা ব্যয় করতে পারবে না! কত টাকা দরকার? মঈদুল হাসান বলেন, ‘টাকা বিলি করার কথা তােমরা গিয়ে বল। আমি তাজউদ্দীনকে যতটা জানি, তিনি যদি তলিয়ে যান তবু এ ধরনের অনৈতিক কাজ করবেন না ।১৩০৩ তাজউদ্দীন আহমদের বিপদের দিনে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য ময়েজউদ্দীন খুব সহায়ক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন। তাকেও মােশতাক টাকা দিয়ে বশে আনার চেষ্টা করেন।১৩০৫ মােশতাক আহমদ মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে পক্ষে টানার নানা ছল-ছুতাে করেন। তার জন্যও। মােশতাকের পক্ষ থেকে অনেক উপঢৌকন প্রেরিত হয়। | মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা-প্রচেষ্টায় স্পষ্টত দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। মােশতাক আহমদ মার্কিনী লবির এবং তাজউদ্দীন আহমদ রুশ-ভারতীয় পক্ষের বলে আমেরিকান কূটনৈতিক মহল মনে করে। এ দু’ নেতা ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সংগঠন গড়ে তােলার মাধ্যমে প্রায় একসঙ্গে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করলেও দু জনের মনন বিকাশ ও নেতৃত্বের ধরন ছিল বিপরীতমুখী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের মধ্যকার বিপরীতমুখী প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করে। এক্ষেত্রে একদিকে তাজউদ্দীন আহমদের উদারনৈতিক রাজনৈতিক দর্শন, কতিপয় কমিউনিস্ট নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা৩০৫ অন্যদিকে মােশতাক আহমদের ধর্মভিত্তিক লেবাস, প্রচণ্ড রকমের কমিউনিস্টবিদ্বেষী মনােভাব প্রভৃতি বিষয় আমেরিকার উচ্চতম কূটনৈতিক মহলের বিবেচনায় স্থান পায়। অতঃপর ঐ মহলটি পূর্বে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় মােশতাক আহমদের সঙ্গে গােপন যােগাযােগ স্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।

———

১৩০৩. মঈদুল হাসানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১২ জুন, ২০০৩।

* আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৯। মােশতাক আহমদ যে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে টাকা বিলি করতেন তা অনেকেই স্বীকার করেন । দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ-আলােকের অনন্তধারা, পৃ. ২২৫। ১৩০৫ বাম-ডান উভয় গ্রুপের নেতারা তাজউদ্দিনকে হৃদয় থেকে বিশ্বাস করতেন ।… তােয়াহা সাহেব, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, বদরুদ্দিন ওমর, আতাউর রহমান খানসহ অনেকের সঙ্গে ছিল তার চমৎকার উষ্ণ সম্পর্ক। বাম নেতৃবৃন্দের যারা যখন হুলিয়ার শিকার হতেন তাদের সব জরুরি ও গােপন কাগজ পত্র, দলিল তাজউদ্দিন আহমদের নিকট রেখে যেতেন।” ঐ, পৃ. ২৩৬। ১৩০৬ “অন্য রকমের ভাবনা ছিল একমাত্র খন্দকার শােশতাকের মাথায় । তাজুদ্দিনকে যেমন ভাবা হতাে রুশ-ভারত মৈত্রীর পক্ষের লােক, তেমনি মােশতাককে মনে করা হতাে। মার্কিন লবির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। আওয়য়ামী লীগের বহুমুখী রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থানে তাজুদ্দিনকে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের প্রেক্ষিতে একজন বামঘেঁষা সামাজিক

বিরােধীদের সম্মিলিত অপপ্রচার ও বিরােধিতা তাজউদ্দীন আহমদের প্রতি এক প্রকার নির্যাতনে পরিণত হয়। ভারতের সর্বাত্মক সহযােগিতা লাভের ক্ষেত্র প্রশস্ত করার প্রয়াসের পাশাপাশি এসব সমস্যা মােকাবিলার জন্য তাকে অনেক মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। সংকট উত্তরণের জন্য তাকে হতে হয় অনেক কৌশলী। প্রথম হতেই মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ব্যতীত সকলেরই সমর্থন তার পক্ষে ছিল। এ ছাড়াও কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিংহ, ভাসানী ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ন্যাপের অধ্যাপক মােজাফ্ফর | আহমদের সমর্থন ও সহযােগিতা তিনি শুরু থেকেই লাভ করেন। অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ও নীতি নির্ধারকদের শক্ত সমর্থন ও সহযােগিতা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি অভ্যাহত থাকে। | মওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের ঘটনাপ্রবাহ থেকে ঝড়ের পূর্বাভাস পান। চরম আঘাত নামার আগেই তিনি সম্ভবত পরাশক্তিগুলাের মতিগতি অনুধাবন করেন। তার ঘনিষ্টসুত্র হতে জানা যায় বাংলাদেশের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন না দিয়ে বরং চীনা দূতাবাস মওলানা ভাসানীকে চীনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।০৭ ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে চীনের নীতিতে নিঃসন্দেহে ক্ষুব্ধ হন। তিনি যথাসম্ভব অনুধাবন করে থাকবেন যে, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সমর্থন দিতে যাচ্ছে এবং সােভিয়েত ইউনিয়নও সে কারণে একটা ভূমিকা না নিয়ে পারবে না। এমতাবস্থায় তিনি নৌকাযােগে ভারতের আসাম সীমান্তের দিকে এগিয়ে যান। তার মতে বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা কোনাে দলের নয়। বরং এটা জাতীয় জনযুদ্ধ । তার সফর সঙ্গী মােজাফফর ন্যাপের সাইফুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের দলীয় প্রশ্ন উত্থাপন করলে। মওলানা হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন: ১৩০৮

——-

গণতন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হতাে। তাঁর মতে বাংলাদেশে শুধু শিল্প কলকারখানা নয় | বিদেশী পুঁজিও ব্যাপকভাবে জাতীয়করণ করা উচিত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্ত রীণ রাজনীতিতে খন্দকার মােশতাকের অবস্থান ছিল তাজুদ্দিন আহমদের একেবারে বিপরীত মেরুতে। তিনি খােলাখুলিভবে অবাধ গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও বিদেশী [পূজির জন্য উত্তম শর্ত, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সমর্থন করতেন এবং জাতীয়করণের ঘাের। | বিরােধী ছিলেন।” দেলােয়ার হােসেন, মুজিব হত্যায় সি আই এ (লিফশুলৎস ও কাইবার্ডের প্রতিবেদন এবং কার্ণেসি পেপারস অবলম্বনে গ্রন্থনা ও অনুবাদ) (ঢাকা: এশিয়া পাবলিকেশনস, ১৯৯৬), পৃ. ৩০। ১৩০৭ সাইফুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫। ১৩০৮ ঐ, পৃ. ৩১-৩২।

৪২০

..একটা দ্যাশের স্বাধীনতার নকসা কি হইবাে তা নির্ভর করে লড়াইয়ের নিয়ামক শক্তি কারা এবং তারা কতটুকু সংগঠিত তার ওপর। তােমার রাষ্ট্রচিন্তাভাবনা সমাজতান্ত্রিক। দেশ স্বাধীন হইলে ওটা হাইটা আইসা তােমার ঘরে উঠবাে না। তার জন্য সরকার গঠন কইরা লড়াই করা লাইগবাে । হিন্দুস্তানে, লন্ডন যাবাে । সরকার গঠন করবাে । দুনিয়াকে জানানাে লাইগবাে বাংলাদেশে কি ঘইটতাছে। বাঙ্গালীরা কি চায়। বিশ্ববাসীর কাছে সব কথা তুইলা ধইরা অস্ত্র অর্থ সংগ্রহ করা লাইগবাে। ক্যাম্প খুইলা ট্রেনিং দেয়া লাইগবাে । গেরিলা বাহিনী গইড়া তােলা লাইগবাে । লাখ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ী ছাইড়া যাইতাছে তাদের বাঁচান লাইগবাে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থাইকা জাতিসংঘ ও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের দ্যাশের হতে পারতাে]

স্বীকৃতি চাওয়া লাইগব । বিপক্ষের অপপ্রচার ঠেকানাে লাইগবাে, অনেক কম। প্রকৃতপক্ষে এসবই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য কতিপয় মৌলিক দিক। বাংলাদেশ সরকারকে মূলত এ ধরনের কাজই করতে হয়েছিল । ভাসানীর এই উপলব্ধি আর মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ তত্ত্বের মধ্যে কোনাে অমিল ছিল না। যাহােক ভাসানী যখন এ রকমের পরিকল্পনা করেন তার পূর্বেই তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের উচ্চতম মহলের সাথে যােগাযােগ করে সরকার গঠনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন এবং সরকার গঠনের ঘােষণাটিও বেতারে প্রচারিত হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে ‘বিপজ্জনক। মওলানাকে’ কর্তৃপক্ষ ভারতের মাটিতে সাদরে গ্রহণ করে ১৫-১৬ এপ্রিল।১৩০৯ ভারত সরকার তার প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের কর্মক্ষেত্র আসামে অবস্থান করাকে পছন্দ করেনি। তাই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে অবস্থিত কোহিনুর প্যালেসের পাঁচতলায় সঙ্গী সাইফুল ইসলামসহ ভাসানীকে থাকতে দেয়া হয়। বাড়িটি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হতাে। এভাবেই মূলত ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকার ভাসানীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এটাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলা যেতে পারে । কেননা ভাসানীর ন্যাপ দল খণ্ড খণ্ড হয়ে গেলেও সাধারণ মানুষের ওপর তার প্রভাব ছিল যথেষ্ট। তিনি বস্তুত নিজ প্রাজ্ঞ বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। চীনের পক্ষ থেকে যদি তাকে প্রভাবিত করে আর একটি প্রবাসী সরকার গঠন করানাে যেত তাহলে মুক্তিযুদ্ধ একটি জগাখিচুঁড়িতে পরিণত হতে পারতাে। সে চেষ্টা যে অব্যাহত থাকবে সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সে

——-

১৩০৯ ঐ, পৃ. ২২।

আশঙ্কাবােধ থেকে নিজ দলের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে সাক্ষাৎ দেননি। এর কারণ হিসেবে সাইফুল ইসলামকে তিনি বলেন:৩৯৭

যাদু মিয়ার অভিপ্রায় সম্পর্কে ভাসানীর এই মন যাদু, যাদু জানে । তেলেসমাতি যাদু । ও আইসছে আমাকে ফিরাইয়া নেওয়ার জন্যে। এখন ওর সাথে দেখা দিলে সত্যিমিথ্যা নানা ধরনের গুজব রটবে। নানান মহল যার যার সুবিধা মত তা ব্যবহার কইরবে। যাদুরা আমাকে বেইচতে কসুর কইরবে

।… ওরা আমাকে চীনে নিয়ে যাইবার চাইছিল । চীনা দূতাবাসের লােকজন তিন তিনবার আমার সাথে দেখা কইরছে ।…তাদের কথা হইলাে পাকিস্তানকে সমর্থন কর। তা যদি না পার তা হইলে চুপচাপ থাক। পূর্ব পাকিস্তানে থাকা

অসুবিধা বােধ কইরলে চল তােমাকে চীনে নিয়া যাই । মূল্যায়ন যথার্থ । কেননা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে এসে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাত মেলান । যাহােক ভাসানী কলকাতায় প্রায় কারাে সাথেই সাক্ষাৎ দিতে চাইতেন না। তাকে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার নাগালে পেয়ে অনেক অনাকাক্ষিত আশংকা হতে মুক্তি পায় । কিন্তু তার সমর্থন ও সহযােগিতা পেতে এবং তাকে অন্য কেউ ভুল বুঝতে না পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রীকে বেশ কৌশলী তৎপরতা চালাতে হয় । প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেক কষ্টে ২৭ মে কলকাতা পৌছলে ভাসানীকে তার পরিবারের পাশাপাশি রাখার ব্যবস্থা করা হয় । নিজে পূর্ব প্রতিজ্ঞার কারণে গার্হস্থ্য জীবনযাপন না করলেও একই ভবনে অবস্থানরত ভাসানীর কাছে তাজউদ্দীন আহমদ যেতেন নানা পরামর্শ গ্রহণ করার জন্য । ভাসানীও তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের হাতের রান্না খুব পছন্দ করতেন। তিনি তার মেয়েদের সঙ্গে গল্প ও খেলা করে সময় কাটাতেন। এ সময় প্রায়ই তিনি তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মদক্ষতার প্রশংসাসূচক গল্প করতেন।১২

ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ প্রচার করেন যে, তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ভাসানী চিঠি লিখে এ ধরনের অমূলক আশংকা নাকচ করে দেন। যাহােক ভারত সরকারের সহযােগিতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মওলানাকে নিয়ন্ত্রণ সীমার মধ্যে রাখতে

———

ঐ, পৃ. ৮১।

ঐ, পৃ. ৫৩

১৩৯২ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা (ঢাকা: সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৯৪), পৃ. ৪৫। ১৩১৩ সাইফুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ.১৯৬।

সমর্থ হন। অল্প পরে তার নেতৃত্বে উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করে সূচিত জনযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপ দিতে সক্ষম হন। এটা ছিল তাজউদ্দীন আহমদের অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সময়ােচিত পদক্ষেপ।

| মওলানা যাতে অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত না হন তা নিশ্চিত করার জন্য তাজউদ্দীন মাঝে মধ্যেই তার কাছে গিয়ে হাজির হতেন। অন্যরা মওলানাকে যেন ভুল বুঝতে না পারে সে দিকে দৃষ্টি রাখার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ মওলানার সহযাত্রী সাইফুল ইসলামকে অনুরােধ করেন। মওলানার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সাইফুল ইসলাম লিখেছেন:১৩১৪

…স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের কোহিনুর প্যালেসের পাঁচ তলায় আসতেন। আসতেন অবশ্য কমই, কেন। যেন রাতে স্ত্রী-পুত্রের সাথে কতেন না। প্রথম যেদিন এলেন, মওলানা সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আলােচনা করলেন। প্রবাসী সরকার গঠনের কথা বললেন এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা আভাস দিলেন। মওলানা ভাসানীর সক্রিয় সহযােগিতা কামনা করলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আবেদনের প্রতি অনুকূল সাড়া দিয়ে বললেন

– তাজউদ্দীন, সংগ্রামটা মিটিং মিছিল, হরতাল আর প্রস্তাব পাশের না । অস্ত্র হাতে লড়াই, রক্ত, ঘাম, আগুন, জীবনবাজী আর কূটনীতির । ভিতর বাইরে হাঙ্গরের হামলা। দোস্তের লেবাসের তলায় শাণিত ছুরি, তুমি একলা পারবে?

হুজুর তাে আছেনই, আপনার দোয়া, পরামর্শ, সহযােগিতা সব সময়ই চাইব। কথা বলতে বলতে মওলানা সাহেবের কক্ষ হতে বেরিয়ে এসে হল রুমে দাড়ালেন- ইসলাম সাহেব, আপনি মওলানা সাহেবের সাথে আছেন আগেই শুনেছি। ওনার সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গভীর । এ লড়াইয়ে মওলানা সাহেবের সহযােগিতা কত প্রয়ােজন তা আপনি বুঝেন। কিন্তু মওলানা সাহেবের নিজ দলের নেতৃস্থানীয় অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে একমত নয়। তারা কলকাতায়।

ঘুরঘুর করছেন। আপনি একটু নজর রেখে চলবেন। পরে এক সময় সাইফুল ইসলাম মওলানার কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বেশ দুশ্চিন্তার সাথে বলেন:৩১৫

কি আর বলবার চাব । মন্ত্রিসভার কেউ কাউকে মানে নাকি? নজরুল, মনসুর আলী, মােস্তাক কেড়া ছােট, কেডা বড়?

তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী, খুশী কেউ না। মজিবর

——–

১৩১৪ ঐ, পৃ. ৮৭-৮৮। ১৩১৫ ঐ, পৃ. ৮৮-৮৯।

থাইকলে এ সমস্য দাড়াইত না। আওয়ামী লীগের ভিতরকার কোন্দলে বহুত ক্ষতি হইবে।

– দুদিন পর প্রধানমন্ত্রী আবার কোহিনুর প্যালেসে এলেন। মওলানা ভাসানীর সাথে রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলাপ করলেন। যাবার সময় আমার কক্ষে এসে টুকটাক কথা প্রসঙ্গে বললেন| সাইফুল সাহেব, আমার চেয়ারের পায়া নড়বড়ে, ব্যাপারটা মওলানা। সাহেবকে বােঝাবেন। সরাসরি সব কথা বলতে গেলে হয়ত রেগে যাবেন। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বলবেন। – কিন্তু বুঝাবােটা কি? মওলানা সাহেবকে বুঝাবার ক্ষমতাটা কতটুকু। উনি আমার কথা শুনবেন কেন? – আপনার প্রতি তার বিশ্বাস আছে, হেও আছে । কথা প্রসঙ্গে এটা বুঝেছি ।

তারপর প্রধানমন্ত্রী যা আভাস দিলেন তা শুধু তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অনাস্থার ষড়যন্ত্রের কথাই নয় । ভিতমাটির তলা দিয়ে ইদুরের গর্ত অনেক দূর অবধি বিস্তৃত। স্বাধীনতার মূল চিন্তা চেতনার শিকড়ে মেটে ইদুর দাত লাগিয়েছে। চাল চালছে। শক্তিধর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগের লােকজনের কলকাতায় তখন বেশ আনাগােনা। সাহায্য সংস্থা, সামাজিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও ভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে তাদের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ও কার্যক্রম বিস্তৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করাই এদের মিশন। আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব ইণ্ডিয়ান স্টাডিজ পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ কমিটি (আই.আর.সি) নামে একটি সংস্থা সীমান্ত অতিক্রমকারী বুদ্ধিজীবীদের সাহায্য সহযােগিতার ব্যবস্থা করে। বেশকিছু বুদ্ধিজীবী তাদের সাহায্য গ্রহণ করেন। এটি একটি সি.আই.এ-র ছদ্ম প্রতিষ্ঠান বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মার্কিন ও পাকিস্তান লবীর সাথে যােগাযােগ গড়ে ওঠার খবর তখন

বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরপর আরাে বহুবার তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা ভাসানীর কাছে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সরকারের ভিতরে ও বাইরের চক্রান্তের কথা জানান এবং তার সর্বাত্মক সাহায্য কামনা করেন। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বিরােধীরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার চেষ্টা করে। ফলে কেবল তাজউদ্দীন আহমদই নন, মুক্তিযুদ্ধও সমূহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এমতাস্থায় উপরিউক্ত উপায়ে তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা ভাসানীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে

—-

১৩১৬ ঐ, পৃ. ৯১।

সাইফুল ইসলামের উত্থাপিত প্রসঙ্গক্রমে জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাসানী

বলেন:১৩১৭

– তাজউদ্দীন আপােষহীন, তার চিন্তা ভাবনা সাফ । কিন্তু তাকে ফালায়া দেওয়ার জন্য চক্রান্ত চইলতাছে, তা সামাল দেয়া কঠিন।

তাজউদ্দীন সাহেব পড়ে গেলে সংকট আরাে জটিল হবে হুজুর । স্বাধীনতা বিরােধীরা শক্তিশালী হবে। – ঠিকই বইলছ । মােকাবিলার একটাই পথ স্বাধীনতার পক্ষের সব দল মিলামিশা কাজ করা। মন্ত্রিসভাতে সম্ভব না হইলেও উপদেষ্টা পরিষদে সব দলকে নেয়া উচিত। মণি সিং, মােজাফফর আর মনােরঞ্জন বাবু ছাড়া আর কেউ যেন লড়াই করতাছে না। পাইরলে আমাকেও বাদ দিত। …তুমি যা বইলছ তা তামাম দুনিয়া জানে । চীন বিরােধীতা কইরতাছে । রাশিয়া সাহায্য দিতাছে। রাশিয়াও সমাজতান্ত্রিক দ্যাশ । আমি চীনে যাই নাই । তাদের কথা শুনি নাই। ওরা আমাকে হিন্দুস্থানে আইসতে বাধা দিছিল । আমি বাধা মানি নাই । তুমি আমার পক্ষ থাইকা সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চীনের সমর্থন চায়া আবেদন জানাইছ। আমি মাওসেতুংকে টেলিগ্রাম করবাে। মেননরা চীনে যায় নাই। ভারতেই আইসছে। লড়াই কইরতাছে । জীবন দিতাছে। তা হইলে তারা চীনপন্থী হইল কি কইরা । এ কথা আওয়ামী লীগের একার নয়। তাজউদ্দীন নরম আছিল, কিন্তু বাঁশের চায়া কঞ্চি

দড় । তােমার নেতাকে বুঝাও। আমার যতটুকু করার লাগে তা কইরবই । মে মাসের শেষদিকে যখন তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বিরােধীরা অনাস্থা আনার তােড়জোড় শুরু করে তখন সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকার আত্মপ্রকাশকে অভিন্দন জানিয়ে ভাসানী যে বিবৃতি প্রদান করেন তাতে দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করে বলেন, “সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হানাদারদের বিতাড়িত করবেই।”৩১৮ | ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট যুবনেতাদের উদ্যোগে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রাগুক্ত অভিযােগের প্রেক্ষিতে ২০ জুন কলকাতাস্থ ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব অশােক রায় যথাশীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একটি বৈঠক আহ্বানের অনুরােধ জানান। বিশৃঙ্খলাপূর্ণ, হতাশাব্যঞ্জক এবং এ যাবত পর্যন্ত গৃহীত ব্যবস্থার ফলাফল পেতে শুরু করার আগেই এ ধরনের একটি সম্মেলন আহ্বান করা তাজউদ্দীন আহমদ তথা

১৩১৭ ঐ, পৃ. ৯২। ১৩১৮

জয় বাংলা, তৃতীয় সংখ্যা, ২৬ মে, ১৯৭১। ১৩১৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯ ।

৪২৫

মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এতদসত্ত্বেও ৫ জুলাই পরিষদ সদস্যদের অধিবেশন আহ্বান করা হয় শিলিগুড়ির এক জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে। এই সংকটকালে পরিষদ সদস্য মােহাম্মদ ময়েজউদ্দিন মেঘালয় থেকে কলকাতা গিয়ে হাজির হন। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি সমগ্র ঘটনা ও পরিস্থিতি ময়েজউদ্দিনকে জানান এবং এক পর্যায়ে অসহায়ের মত তার হাত ধরে বলেন৩২৫ “কিছু একটা করুন ময়েজউদ্দিন সাহেব। যদি দেশ স্বাধীন করতে না পারি, কোনদিন বাংলার মাটিতে ফিরে যেতে পারব না। সমগ্র বাঙালি জাতিকে পাঞ্জাবীদের দাসত্ব বরণ করতে হবে।” চূড়ান্ত অধিবেশনের আগে প্রস্তুতিমূলক অধিবেশন বসে। ৫০-৬০ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের মিটিং বসেছিল আগরতলার মুখ্যমন্ত্রী সচীন সিংহের বাসভবনে। নির্বাচিত সদস্যরা ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় কতিপয় জেলা কমিটির সদস্যও ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতাদের সেখানে ডাকা না হলেও হঠাৎ কতিপয় ছাত্রনেতা মিটিংয়ে উপস্থিত হন এবং নেতাদের মিটিং করার অধিকার চ্যালেঞ্জ করে বসেন। মাইক দখল করে তারা বলতে থাকেন যে, তারা মুজিবনগর সরকারকে মানেন না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অকথ্য এবং অশালীন ভাষায় তারা গালাগালি শুরু করেন। পরে অবশ্য শ্রীপুর থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ. শামসুল হক এসব গালাগালির তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনেন। পরিস্থিতি মূল্যায়নপূর্বক সকলেই তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হওয়া এবং বিপথগামী ও ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে তাজউদ্দীন আহমদের হাতকে শক্ত করার ব্যাপারে একমত হন। অন্যদিকে বিরুদ্ধ পক্ষও গােলযােগ বাধাবার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কিন্তু ময়েজউদ্দিনের সাহসী ভূমিকার ফলে সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। তবে বিরুদ্ধ পক্ষের অপপ্রচার ও তৎপরতা আপাতত সফল না

———-

১৩২০ বদরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩। ৩২” “তাদের বক্তব্য হলাে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে এই প্রবাসী সরকারকে তারা স্বীকার করে না। প্রবাসী সরকারের সদস্যবর্গসহ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে চোর, প্রতারক ইত্যাদি বলে এমন অশ্লীল ভাষায় আ.স.ম আবদুর রব, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী। প্রমুখ গালি দিতে শুরু করলাে যে আমরা লজ্জায় মাথা তুলতে পারলাম না। মাইকের গােটা দুই হর্ন বাইরে বারান্দায় ফিট করা হয়েছিল। বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম রাস্তায় প্রচুর লােক দাঁড়িয়ে গেছে বক্তৃতা শােনার জন্য।” এম.এ. মােহাইমেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০। ১৩২২. বদরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩-৮৪।

হলেও তা বন্ধ হয়নি। অধিবেশনের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় নিমােক্ত ভাষ্য থেকে:১৩২৩

৫ই জুলাই ১৯৭১ জলপাইগুড়ি জেলার বাগডােরায় পরিষদ সদস্যদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল । বাঙ্গালি জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হবে ঐ দিন। খন্দকার মােশতাক আহমদ সভাপতির আসনে বসে আছেন। হাউজের অনেক সদস্যই সভাপতিকে একদিনের সভা মুলতবি ঘােষণার অনুরােধ জানান। সভাপতি তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে শেখ আবদুল আজিজকে বক্তব্য রাখতে আহ্বান জানান। শেখ আবদুল আজিজ মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে জনাব তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। জনাব ময়েজউদ্দিন সভামঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। বরাবরই তার মনে হচ্ছিল এখনই একটা কিছু করতে হবে। তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হলে কোনদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যাবে না । শেখ আবদুল আজিজের বক্তব্যে পরিষদ সদস্যরা প্রভাবিত হলে তখন কোন উপায় থাকবে না। নাটকীয়ভাবে তিনি মঞ্চে উঠে এলেন এবং এক হাতে শেখ আজিজের শার্টের কলার, অন্য হাতে ঘাড় ধরে সজোরে তাকে মঞ্চের বাইরে ফেলে দিয়ে মাইক কেড়ে নিলেন। কেউ প্রতিবাদ করার আগেই বক্তৃতা আরম্ভ করলেন ময়েজউদ্দিন। আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। তার কণ্ঠ । এতবড় একটা ঘটনার কথা ভুলে গেলেন সদস্যরা। খন্দকার মােশতাক চিৎকার করে উঠলেন Meeting is adjourned, তখন সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, না, সভা চলবে আজই সিদ্ধান্ত হবে। আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আবদুর রাজ্জাক এবং তােফায়েল আহমদ সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভা চলতে লাগল । ঐ সভায় জাতীয় পরিষদের ১৩৫ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৯ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভার কাজ ৬ ই জুলাই পর্যন্ত চলে। উক্ত সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত

বাগডােরায় গণপ্রতিনিধিদের একক সমর্থন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভিতকে আরাে মজবুত করে। সেই সঙ্গে যুবনেতাদের ষড়যন্ত্রও ভারত সরকারের নিকট ফাস

হয়ে যায় । সরকার গঠনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এই প্রথম অধিবেশন দু দিনব্যপী চলে। সামগ্রিক বিবেচনায় এর তাৎপর্য অপরিসীম। তাজউদ্দীন আহমদ নিজে এতে বিশেষ কথা বলেন নি। শুধু আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত অথচ জোরালাে ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্য রাখেন। তিনি তার বক্তব্যে বাঙালি জাতি ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে বলে মন্তব্য করেন। পাকিস্তান বাহিনীর

১৩২৩ ঐ, পৃ. ৮৪।

নারকীয় কার্যাবলির বিবরণ প্রদান করে তিনি বলেন যে, এই নারকীয়তা পৃথিবীর যে কোনাে বর্বরতার চেয়ে নিষ্ঠুর। তারা নারীদের ধর্ষণ করে গাছে টাঙ্গিয়ে। গােপনাঙ্গে গুলি করে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করছে । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, সমস্যা যতই আসুক না কেন লক্ষ্য। অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। বাঙালি জাতির চরম অগ্নিপরীক্ষার সময়ে সকলকে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে গিয়ে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার আহ্বান জানান। তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন, বিজয়ের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম ও অশেষ ত্যাগ স্বীকার করা প্রয়ােজন, তা সকল প্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে, ফলে যােগ্যতর নেতৃত্বের উদ্ভব সেখানে ঘটবেই; তিনি নিজেও যদি সক্ষম

হন, তবে যােগ্যতর ব্যক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ তিনি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। তার এ ধরনের উদার, সহনশীল ও দূরদর্শী মনােভাব এবং স্বাধীনতার প্রতি অবিচল আস্থা উপস্থিত সকলের দ্বারা অভিনন্দিত হয়।১৩২৪ | ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক দীর্ঘ আবেগময়ী ভাষণে বলেন। যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই সরকার গঠন করা হয়েছে। তিনিই তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেছেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগ দেয়া হয়েছে। সরকার সকল সমস্যা সম্পর্কে সচেতন এবং লক্ষ্যে পৌছার জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে উপস্থিত পরিষদ সদস্যরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে দলাদলি বা কোন্দল বর্জন করা অপরিহার্য। লক্ষ্যে পৌছতে হলে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্ব ও মন্ত্রিপরিষদ বহাল রাখা দরকার।

পরদিন ৬ জুলাই আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাবেক নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটি বাতিল করে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কমিটিকে দলের বৈধ নেতৃত্ব বলে ঘােষণা দেয়া হয়।২৫ ফলে এতদিন ধরে। কতিপয় ব্যক্তি দলের পদ হতে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ দাবি করে আসছিল তা কেবল বানচালই হয়নি উপরন্তু তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থন লাভ করে সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।

জয় বাংলা পত্রিকা পরিষদ সদস্যদের যৌথ অধিবেশনের তাৎপর্যের প্রতি গুরুত্ব আরােপ করে যে সম্পাদকীয় ছাপে তা ছিল নিমরূপ:

—–

১৩২৪, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯। ১৩২৫ ঐ, পৃ, ৪৯। ১৩২৬ জয় বাংলা, ১০ম সংখ্যা, ১৬ জুলাই, ১৯৭১।

রণাঙ্গনে সগ্রামরত আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা যােদ্ধাদের মনােবল ও আক্রমণ-ক্ষমতা যেমন আরাে বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যে সব বন্ধুরাষ্ট্র অকৃপণভাবে সমর্থন যােগাচ্ছেন, তাদের এই সমর্থনের নৈতিক ভিত্তি আরাে দৃঢ় হবে। কারণ, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযােদ্ধারা যেমন জানেন, তাদের সংসদীয় গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পাশেই রয়েছেন, তেমনি বিশ্বের মানবতাবাদী ও শান্তিকামী বন্ধু দেশগুলােও জানবে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সকল স্তরের মানুষের ঐক্য অটুট ও অনঢ় রয়েছে।…এই বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাড়ে পনর আনা সদস্য অংশগ্রহণ করে এ কথাই দিবালােকের মত স্পষ্ট করে। দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক সদস্যকে নিয়ে একটা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টায় ইয়াহিয়া সফল হচ্ছেন বা হবেন, এই প্রচার সম্পূর্ণ।

মিথ্যা। ইয়াহিয়ার হাতে দু চারজন বান্দা সদস্য ছাড়া কেউ নেই। বাঙালি জাতির এই ক্রান্তিকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা, যেমন—শামসুল হক, ময়েজউদ্দীন ও অন্যান্য এবং প্রবীণ জননেতা মওলানা ভাসানী যে শক্তিশালী ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের সময়ােচিত জোরালাে ভূমিকার কারণেই মুক্তিযুদ্ধকে অপপ্রচার, বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলার হাত হতে মুক্ত করা। সম্ভব হয় এবং চুড়ান্ত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে চলে। এই পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এগিয়ে যাওয়ার সুদৃঢ় ভিত্তি লাভ করে ।

রাজনৈতিক নেতৃত্বে সমন্বিত সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন

রাজনৈতিক দিক থেকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সামরিক ক্ষেত্রে তখন পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান। নিয়ােগ করা হয়েছিল বটে, কিন্তু তখন পর্যন্ত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার মতাে বাস্তব অবকাঠামাে গড়ে তােলা সম্ভব হয় নি। কিছুসংখ্যক সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাকে সীমান্তবর্তী এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালানাের কাজে নিযুক্ত করা হয় মাত্র। সেক্টর কমন্ডাররা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করলেও তখন পর্যন্ত অভিন্ন কমান্ডের অধীনে শপথ গ্রহণ করেন নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রবণতা অনেক সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। যে, ওসমানীর যুদ্ধ প্রস্তুতির লক্ষ্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে। এবং কিছুটা সেক্টর কমান্ডারদের নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় থেকে তারা। ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পরিবর্তে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়ােগ দিয়ে সেক্টর

৪৩০

কমান্ডারদের সমন্বয়ে ‘ওয়ার কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন। এটাকে ওসমানী তার সেনাপতিত্বের প্রতি তরুণ সেক্টর কমান্ডারদের এক প্রকার অনাস্থা হিসেবে। বিবেচনা করেন। এমতাবস্থায় পরিকল্পিত আক্রমণ রচনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেক্টর কমান্ডার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তিদের সম্মেলন আহ্বান করেন । ১০ জুলাই অধিবেশনের প্রাক্কালে ওসমানী উপরিউক্ত বিবেচনা থেকে পদত্যাগ করেন।*** সব মিলিয়ে আর এক জটিলতার। জন্ম হয়। যুদ্ধ প্রস্তুতির লক্ষ্যে ঐ সম্মেলন চলে ১০ থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত।৩২৮ তাজউদ্দীন আহমদ সেক্টর কমান্ডারদের বুঝাতে সক্ষম হন যে, যখন মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সবদিক থেকে বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধ প্রচেষ্টার একটা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে তখন সেনাপতি ওসমানীর পদত্যাগ নিজেদের মধ্যকার অনৈক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে। সুতরাং “ওয়ার কাউন্সিল’-এর প্রস্তাব প্রত্যাহার করা উচিত। তার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এর প্রস্তাবক সেক্টর কমান্ডাররা তা প্রত্যাহার করে নেন। প্রধানমন্ত্রী কর্ণেল ওসমানীকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরােধ জানালে তিনিও তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন এবং দ্বিতীয় দিন হতে অধিবেশনে যােগদান করেন। প্রথম দিনের অধিবেশন শুরু হয় তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে। তিনি দীর্ঘ উদ্বোধনী ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, আদর্শ, করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে আলােচনা করেন, যাতে উপস্থিত সামরিক ব্যক্তিবর্গ অনুপ্রাণিত হন। তৎকালীন মেজর ও সেক্টর কমান্ডার শফিউল্লাহ তাজউদ্দীন আহমদের এই ভাষণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পরবর্তীকালে বলেছেন১:৩৩০

তিনি আমাদের লক্ষ্য করে যে ভাষণ দেন তার মর্ম ছিল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের উপর যে অত্যাচার অবিচার করেছে তার প্রেক্ষিতে আজ আমরা এখানে। আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াই করছি তা স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারি । এতে আমাদের সবাইকে একই লক্ষ্য সামনে রেখে কর্ম পরিচালনা করা উচিত। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে বিজ্ঞি মহলের প্ররােচনায় আমরা যেন পথভ্রষ্ট না হই। বাংলাদেশ সরকার যথাসাধ্য সাহায্য করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । অস্ত্রশস্ত্র বন্ধু রাষ্ট্র ভারত যতটুকু দেয় তা আমরা গ্রহণ করব। তা ছাড়াও যদি সম্ভব হয়। অন্যকোন রাষ্ট্র থেকেও আনার চেষ্টা করব। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আমরা অনুপ্রাণিত হই।

———

১৩২৭ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০। ১৩২৮” অধিবেশন হয় ১০-১৫ জুলাই পর্যন্ত। দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৭১।

দলিলপত্র, দশম খণ্ড, পৃ. ৫২৪। . ঐ, পৃ. ২৮৭।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল কে.এম. শফিউল্লাহ তাজউদ্দীন আহমদের সামরিক প্রজ্ঞা ও উপস্থাপনার প্রশংসা করে। লিখেছেন:১৩৩২

তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১০ জুলাই ‘৭১ এই আগরতলায় কনফারেন্স টেবিলে। তার সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। তার ওপর অর্পিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বাদির মধ্যে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে সেদিন তিনি সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন। রাজনীতিবিদ। তাই সমর কর্মকাণ্ডের উপর তার অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রথম দিন তিনি যেভাবে কনফারেন্স পরিচালনা করেছিলেন এবং সামরিক ব্যাপারে তিনি যেভাবে তার মতামত প্রকাশ করেন তাতে মােটেও তাকে অনভিজ্ঞ মনে হয়। নি । সামরিক কর্মকাণ্ডের উপর তার জ্ঞান আমাকে সত্যই মুগ্ধ করেছিল। আমি । সেদিন গর্ববােধ করেছিলাম এই ভেবে যে, এমন একজন সুযোগ্য নেতৃত্বের অধীনে

আমরা কর্মরত। কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রােডের বাড়িতে প্রায় ৬ দিনব্যাপী বাংলাদেশ। সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ উচ্চ পর্যায়ের সামরিক কর্তা ব্যক্তিদের ৩২ সম্মেলনটি প্রতিদিন সকালে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলত।৩৩৩ এ সম্মেলনে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লক্ষ্য, কৌশল, বিভন্ন সেক্টরের সীমানা পুনঃনির্ধারণ, মুক্তিবাহিনীর শ্রেণীকরণ, তাদের প্রতি দায়িত্ব অর্পণ, সশস্ত্র তৎপরতার লক্ষ্য ও পরিসীমা নির্ধারণ, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন, প্রতিপক্ষের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, রসদ, যােগাযােগ ব্যবস্থা, মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ের সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। | বস্তুত একটা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রাথমিক কৌশল নির্ধারণে চেষ্টা করা হয় ঐ। সামরিক সম্মেলনের মাধ্যমে । এতে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের।

———

১৩৩৯ মেজর জেনারেল কে,এম, শফিউল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫), পৃ. ১৬৩। ১৩৩২, সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিরা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, কর্ণেল এম,এ,জি, ওসমানী, লে, কর্নেল এম.এ. রব, গ্রুপ ক্যাপটেন এ.কে. খন্দকার, মেজর (অব:) নুরুজ্জামান, মেজর সি.আর, দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর মীর শওকত, উইং কমাণ্ডার এম.কে. বাশার, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর রফিক-উল ইসলাম, মেজর নাজমুল হক, মেজর এম.এ. জলিল, মেজর এ.আর. চৌধুরী । দলিলপত্র, দশম খণ্ড, পৃ. ২৮৭। ০৩* অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ (ঢাকা: অন্য প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ১২৯। ১৩০৪ রফিকুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩।

সমন্বয় সাধন করা হয়। তবে পরিকল্পিত যুদ্ধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও অন্যান্য কারণে এরপরেও কিছু ত্রুটি থেকে গেলেও সার্বিকভাবে এ সম্মেলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামরত বাহিনীসমুহের মধ্যে একটা সমন্বয় প্রচেষ্টা চালানাে হয়। সম্মেলনের শেষ দিনে ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডাররা বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করার জন্য আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকাতে দায়িত্ব। পালনের জন্য চলে যান। লে. কর্নেল এম.এ.রবকে চীফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ। ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়।

সম্মেলনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্ত্বেও অন্তত দুটো বিষয়ে দুর্বলতা থেকে যায়। এর একটি ছিল: কেন্দ্রীয় কমান্ড গঠন এবং পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যথােচিত দৃষ্টি না দিতে পারা । বিস্তীর্ণ প্রায় এক হাজার সাত শত। মাইল সীমানা, দুর্গম এলাকায় এক সেক্টর হতে অন্য সেক্টর অথবা প্রবাসী সরকারের সদর দফতর কলকাতার সঙ্গে যােগাযােগের ক্ষেত্রে কার্যকর কোনাে ব্যবস্থা গড়ে তােলা সম্ভব হয় নি। এ ব্যাপারে স্ব স্ব সেক্টর কমাণ্ডারের বিবেচনা মােতাবেক কাজ করতে হয় অথবা ভারতীয় সিগন্যালিং- এর সহযােগিতা গ্রহণ করতে হয়। অন্যটি ছিল যুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও বিজয় অর্জনমুখী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্রটি। সম্মেলনে নির্দিষ্ট সময় ও কৌশলগত বিষয়ে নিখুঁত পরিকল্পনা করতে না পারার কারণও ছিল। কেননা ভারতের সামরিক শক্তি প্রয়ােগের প্রকৃতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞাত না হয়ে তা সম্ভব ছিল না। তবে তাজউদ্দীন আহমদ গােড়া থেকেই অভিষ্ট অর্জনােপযােগী। যুদ্ধরীতি ও কৌশলের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এ ব্যাপারে তার সামরিক জ্ঞানের প্রশংসা করতেই হয়। তার ধারণা জন্মে যে, প্রথমে অপ্রথাগত রীতিতে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীকে রণক্লান্ত করে তুলবে এবং শেষ পর্যায়ে জল-স্থল ও আকাশপথে আক্রমণে ভারতীয়। বাহিনীর প্রয়ােজন পড়বে এবং সেভাবেই বিজয় অর্জিত হবে।৩৬।

| কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে সমগ্র বাংলাদেশকে মােট ১১ টি অংশে ভাগ করা। হয়, যা সাধারণভাবে ‘সেক্টর’ নামে পরিচিত। প্রতিটি সেক্টরের দায়িত্ব প্রদান করা হয় প্রতিরােধ যুদ্ধের সামরিকম, আধাসামরিক অফিসারদের ওপর। ১১ টি সেক্টরকে আবার ৬৯ টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সামরিক এই ধরনের

—–

১৩৩৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২। ১৩৩৬ ঐ, পৃ. ৫৩। | সেক্টর, সাব-সেক্টর, সেক্টর সীমানা, নিয়মিত-অনিয়মিত মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা এবং সেক্টর-অধিনায়ক সম্পর্কিত তথ্যবলি জানার জন্য দেখুন, রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে (ঢাকা: অনন্যা, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৯৯৭,), পৃ. ২২৮-২৩১। এই পুস্তকটি

বিন্যাস পাকিস্তানের শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্রত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বেশ কার্যকর হয়। দশজন অফিসার নিয়ে একটি হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সদর দফতরে। কর্ণেল ওসমানী প্রধান সেনাপতি হিসেবে প্রায়ই বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনে যেতেন। তার ভাষ্যমতে তিনি যখন যেখানে থাকতেন সেটাই হেড কোয়ার্টার হিসেবে পরিগনিত হতাে। এই পরিস্থিতির চাহিদায় এর অল্পকাল পরে সরকার স্বতন্ত্র ব্রিগেড গঠন করে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতটুকু প্রয়ােজন ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধকে কতটা ত্বরান্বিত করেছিল সেটা মূল্যায়ন করা কঠিন কাজ। তবে মুজিবনগর সরকার দুটো বিষয়কে সামনে রেখে। উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতিরােধযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অপেক্ষাকৃত সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সামরিক বাহিনীর আলাদা ভূমিকা পালনের জন্য বিশেষ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। ওয়ার কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে তাদের কেউ কেউ অনুগত সামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিকল্প ধারার সামরিক ইউনিট গঠনের চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হলাে স্বতন্ত্র ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব। জিয়াউর রহমান প্রথমে তুরা ব্রিগেড’ গঠন করেন এবং এটিকে তার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে ‘জেড ফোর্স গঠনের প্রস্তাব সরকারের কাছে উত্থাপন করেন। এতে ওসমানি অসস্তুষ্ট হন। সমস্যা সমাধানে তাজউদ্দীন এগিয়ে আসেন এবং একক কোনাে ব্যক্তির প্রাধান্য যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে আরাে দুটো ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় দেশের কোনাে অঞ্চল দখল করার উল্লিখিত অভিপ্রায়ের প্রেক্ষিতে ওসমানী ব্রিগেড গঠন সমর্থন করেন। এগুলাে হলাে: ‘জেড’, ‘কে’ ও ‘এস ব্রিগেড। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্সের জন্ম ১৯৭১ এর ৭ জুলাই। তবে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় আরাে পরে । ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্যদের নিয়ে এই ব্রিগেডটি গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘এস’ ফোর্স। এই ব্রিগেডটির অধীনে রাখা হয় ২য় ও ১১শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯৭১ এর ৭ সেপ্টেম্বর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে।

———

মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্য পুস্তক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। এটি প্রথমে A Tale of Million শিরােনামে প্রকাশিত হয়। ১৪৩৮ রফিকুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১। ১৩৩৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭। ১৩৪০ মেজর রফিকুল ইসলাম পি এস সি, মুক্তিযুদ্ধে তিনজন (ঢাকাঃ পাণ্ডুলিপি, ১৯৯৪), পৃ. ১৭। ১৩৪১ এ, পূ, ১৬। ১৩৪২ ঐ, পৃ. ১৭। ১৩৪৩ ঐ, পৃ. ৩৫।

গঠিত হয় ‘কে’ ফোর্স। এই ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত করা হয় ইস্ট বেঙ্গলের ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম রেজিমেন্টকে।”* সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন সমাপ্তির অল্প পরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রেক্ষিতে অনুমান করা যায়, গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের দুর্বলতাগুলাে কাটিয়ে ওঠার জন্যও এটা করা হয়েছিল। যােগাযােগ ও সমম্বয়ের ক্ষেত্রে ব্রিগেড ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হয়।

সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা হয় দুভাবে। প্রথমত সেক্টর কমান্ডারদের অধীনে কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের রাখা হয়। দ্বিতীয়ত স্বতন্ত্র ব্রিগ্রেড গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক যােগাযােগের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় ঐ পর্যায়ে কেন্দ্র হতে একক কমান্ডে যুদ্ধ পরিচালনার কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। তাই বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার ন্যায় মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কমান্ড ব্যবস্থারও বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় উল্লিখিত ৩ টি ব্রিগেড গঠনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সুবিধাজনক স্থান দখল করার উদ্দেশেই কেবল এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু গেরিলা পদ্ধতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে এগুলােকে আঞ্চলিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এ কথা ঠিক যে, ব্রিগেড কমান্ডাররা সঙ্গত কারণে এক প্রকার স্বাধীন ক্ষমতা ভােগ করতেন। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করেন যে, এর ফলে গেরিলা পদ্ধতির মুক্তিযুদ্ধ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কেননা নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা ও উঁচুমানের নেতৃত্ব দ্বারা গেরিলাযুদ্ধ পরিচালিত হলে আরাে অনেক ভাল ফল পাওয়া যেতে পারতাে। তাদের মতে মূল সামরিক ব্যক্তিবর্গ ব্রিগেডের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকার কারণে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনায় নিস্তরে দলনেতার অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। প্রবাসী সরকার কর্তৃক মে-জুন মাস থেকেই মধ্যম মানের সামরিক কর্মকর্তা তৈরির জন্য রিক্রুটমেন্ট ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে এ সমস্যার কিছুটা লাঘব হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে অফিসারদের প্রথম ব্যাচটির প্রশিক্ষণ শেষ হয়। পাসিং আউট অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী ও অন্যান্যরা। এই ব্যাচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল কোর্স সম্পন্ন করেন।

যাহােক, পরিকল্পিত গেরিলা তৎপরতা সময়ের বিবেচনায় তিনটি স্তরে সংঘটিত হয় বলে সামরিক ব্যক্তিরা উল্লেখ করেছেন। যেমন প্রথম স্তরঃ জুন

———-

১৩৪৪, ঐ, পৃ. ৭৬। ১৩৪৫ লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫-৭৬।

৪৩৫

জুলাই, দ্বিতীয় স্তর: আগষ্ট-সেপ্টেম্বর এবং তৃতীয় স্তর: অক্টোবর-নভেম্বর। প্রথম স্তরে গেরিলারা সীমান্তের নিকটবর্তী স্থানসমূহে ছােটখাট কালভার্ট-ব্রীজ, রেলওয়ে স্টেশন ও অন্যান্য স্থাপনা, দ্বিতীয় স্তরে পাকিস্তানি সামরিক কনভয়, নৌ বন্দর, নৌযান, থানা প্রভৃতি স্থাপনা ও পাকিস্তানের সহযােগী ব্যক্তিদের ওপর এবং তৃতীয় স্তরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করে সামরিক ঘাঁটি, বড় বড় ব্রীজ, গুদাম, বিদ্যুৎস্থাপনা, পেট্রল পাম্প প্রভৃতির ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালায়। দেশের অভ্যন্তরে বাঙালিরা বরাবরই মুক্তিযােদ্ধাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সমর্থন প্রদান করতাে। ক্রমশ মুক্তিযােদ্ধাদের দক্ষতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি। পায়। অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে যেতে থাকে। পাকিস্তান বাহিনীর অনেক সহযােগী মুক্তিযােদ্ধাদের হাত হতে প্রাণে বাঁচার জন্য স্বপক্ষ ত্যাগ করতে থাকে। বস্তুতপক্ষে এ পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা দিনের বেলায় কোথাও কোথাও অভিযান চালালেও রাতে সুরক্ষিত বাংকার বা সেনা ছাউনি হতে বের হতে চাইতাে না। মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা। এদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে দুই, তিন সপ্তাহ বা তারও কম মেয়াদী প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরভাগে অভিযানে প্রেরণ করা হতাে। শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ের কিছুসংখ্যক অস্ত্র চালনা শিখলেও দেশমুক্ত করার তীব্র তাড়না তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। তাদেরকে এমন সব এলাকাতে দায়িত্ব পালন করতে পাঠানাে হতাে। যেখানকার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে তাদের প্রত্যক্ষ ধারনা ছিল। এমনও দেখা যায় যে, স্বাভাবিক সামরিক-জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি যেখানে প্রতিপক্ষের সীমার মধ্যে যেতে সাহস করে না, সেখানে সামরিক জ্ঞানে প্রায় অজ্ঞ গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা অকস্মাৎ শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে; এটা ছিল পাকিস্তানের প্রথাসিদ্ধ সামরিক বাহিনীর নিকট অচিন্তণীয় বিষয়। গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা দিনের বেলায় সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায় বিভিন্ন কাজের অজুহাতে রাতের আক্রমণ পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা করতাে। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে দিনের বেলাতেও আক্রমণ চালাতাে। গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা ছিল বেসামরিক জনগােষ্ঠীর অংশ। তাদেরকে আলাদাভাবে চেনার উপায় ছিল না। এই গেরিলা বাহিনী আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হৃৎকম্প ধরিয়ে দেয় । পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি মাটি রক্ষার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মােতাবেক পাকিস্তান সেনাবাহিনী সীমান্ত বরাবর ছড়িয়ে পড়লে গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণ দ্বারা অনেক সহজে তাদেরকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব হয়। একটা পর্যায়ে কে মুক্তিযােদ্ধা অথবা সাধারণ মানুষ তা চিহ্নিত করা দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর নিকট কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সর্বব্যাপী ভীতি

—–

১৩৪৬ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০-১১১।

তাদেরকে গ্রাস করে। খুব সম্ভব এরই ফলে মাত্র ১২ দিনের সম্মুখযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ৯৩ হাজারের অধিক সামরিক সদস্য নিয়ে নিয়াজী আত্মসমর্পণে বাধ্য হন।

জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি

এই পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপাদানগুলাের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইন্দো-সােভিয়েত চুক্তি সম্পাদনের পর ভারত সুনিদিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে যার প্রস্তুতি পূর্বেই শুরু হয়েছিল। এ সম্পর্কে মঈদুল হাসান

লিখেছেন:১৩৪৭

…ভারত সরকার তাদের বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যার সামগ্রিক ও সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ডি.পি, ধরকে নিযুক্ত করেন। এজন্য ইতিমধ্যেই কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘পলিসি প্লানিং কমিটি’-র চেয়ারম্যান পদে তার নিয়ােগ সম্পন্ন হয়েছে। ৬ ই সেপ্টেম্বর সামগ্রিক দায়িত্বভার গ্রহণের আগে আলােচনাধীন নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মত বিনিময় ছাড়াও বাংলাদেশের প্রবাসী নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশর আন্দোলনের রাজনৈতিক উপাদান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা গঠন করার উদ্দেশ্যে ডি.পি, ধর ২৯ শে আগস্ট সকালে কোলকাতায় আসেন। কিন্তু অন্ততঃ কয়েকটি বিষয়ে তাঁর উদ্যোগের গতি ও ধরন থেকে আমাদের মনে হয়, ভারত সরকার অবশেষে একটি নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে এবং সুনিদিষ্ট লক্ষ্যের দিকে সমগ্র ঘটনাধারাকে পরিচালিত করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ । অধিকৃত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পরিসর ও তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য যুব শিবিরের সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সহায়তা ক্রমশঃ এক সমন্বিত সম্প্রসারণের রূপ ধারণ করতে রু করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষতঃ স্বাধীনতা- সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলিকে একটি ফোরামে একত্রিত করার ব্যাপারে

ডি.পি, ধরের ব্যগ্রতা আমাদের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সার্বিক সহযােগিতা নিশ্চিত করার জন্যে ইতােমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলােচনাক্রমে একমত হন। যে, চলতি যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সকল দলের সমন্বিত প্রয়াস হিসেবে প্রতিপন্ন করার মধ্যে সমাধান নিহিত। বিশেষ করে মস্কোর সমর্থন। জরুরি। সে জন্য মস্কোপন্থী দলগুলােসহ সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় ফোরাম গঠন করা আবশ্যক। সে মর্মে ভারতের নীতি নির্ধারক মহলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ইঙ্গিত

১৩৪৭ মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮।

প্রদান করেছিলেন। কলকাতাস্থ সােভিয়েত প্রতিনিধিকেও বাংলাদেশ সরকারের। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অভিপ্রায় সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল। কিন্ত সে ক্ষেত্রে দ্বিবিধ সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেটাই ছিল সরকার গঠনের ভিত্তি। সে অর্থে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার একমাত্র দাবিদার। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতার ধারণাও ছিল অনুরূপ। তদুপরি যে সরকার গঠন করা হয় তাও সম্প্রসারণ করে সমমনা দলগুলােকে সুযােগ দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ২৫ মার্চের পর হতে বাংলাদেশে যা ঘটতে থাকে তা নিশ্চিতভাবে শুধু আর একক আওয়ামী লীগের বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বস্তুত এটা একটা জাতীয় জনযুদ্ধে পরিণত হয়। সে অর্থে স্বাধীনতা-সমর্থক সকল দলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযােগ পাওয়া উচিত ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ সমগ্র সমস্যা ও সমাধানের পারম্পর্য সম্পর্কে সচেতন থাকা সত্ত্বেও তিনি গােড়া থেকে অনেকের বিরােধিতার সম্মুখীন হওয়ার কারণে এ ধরনের একটা উদার সিদ্ধান্তের ঝুঁকি গ্রহণ। করতে অপারগ ছিলেন। দ্বিতীয়ত ভারতের নীতিনির্ধারক মহলেও ডান-বামের একটা টানপােড়েন দেখা দেয় যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের অনুপযুক্ত সময়ে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সর্বদলীয় উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করেনি। ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় সমস্যা সমাধানে সােভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাত্মক সহযােগিতার বিষয়টি অনিবার্য হয়ে উঠলে বাংলাদেশের মস্কোপন্থী দলগুলােকে যুদ্ধে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভুত হয়। ইন্দোসােভিয়েত চুক্তির পর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। ডি.পি. ধর ২৯ আগস্টে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে এ বিষয়ে যখন আলােচনা করেন তখন তাজউদ্দীন আহমদ কৌশলগত কারণে এক প্রকার নীরব থাকেন। এতে ডি.পি. ধর বিস্ময় বােধ করলেও পরে তিনি তাজউদ্দীন আহমদের নীরবতার প্রকৃত কারণ জানতে পারেন।৩৮৮ বস্তুত অন্তর্দলীয় কোন্দল থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে দ্রুত সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে এ বিষয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রতি তাজউদ্দীন আহমদ গুরুত্বারােপ করেন। তার এই কৌশল যথার্থ ছিল। কেননা জাতীয় মাের্চা গঠনের ব্যাপারে ভারতের প্রচেষ্টাকে আওয়ামী লীগের অপেক্ষাকৃত

———

১৩৪৮ SOBY “In the evining DP told me that the proposal for the united front was supported by all the members of the cabinet except Tajuddin who remained silent. DP was puzzled, unhappy. I assured him once again about Tajuddin’s view about unity and suggested that two of them should have an exclusive meetting next day” মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।

ডানপন্থী অংশটি ভারত সরকারের এক ধরনের চাপ’ ও ‘হস্তক্ষেপ’ বলে মূল্যায়ন করে।” মােশতাক আহমদের ন্যায় আমেরিকাপন্থী নেতারা এটাকে মােটেও সুনজরে দেখেননি। এ সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদমােশতাক আহমদের প্রবণতা সম্পর্কে ডি.পি, ধরের পর্যবেক্ষণে নিমােক্তভাবে বিধৃত হয়:৩৫ * in the AL (Awami League) leadership only two personalities with unshakable determination: Tajuddin with ideals and deep commitment for his country’s liberation and Mustaque with eagerness for self promotion, had a setting of political ideals.” যাহােক, আন্তর্জাতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সকল দলের সমর্থন জরুরি হয়ে পড়ে। বিশেষত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরের পূর্বেই এর আবশ্যকতা দেখা দেয়। তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সরাসরি এই প্রস্তাব উপস্থাপন করা অসুবিধাজনক বিবেচনা করে মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদকে ৭ সেপ্টেম্বও তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অনুরােধ করে পাঠান।অথ” অবশেষে সকল বিরুদ্ধ উপাদানকে উপেক্ষা করে ৮ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতার সমর্থক ৫ টি দলকে নিয়ে একটি জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়।৩৫২ এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ব্যতীত আরাে উপস্থিত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির মণি সিং, ন্যাপের অধ্যাপক মােজাফ্ফর আহমদ ও বাংলা কংগ্রেসের মনােরঞ্জন ধর। পিকিংপন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী কলকাতায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কিছু কৌশলগত কারণে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের সভায় উপস্থিত হন নি। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিমিটিতে আওয়ামী লীগের দু জন সদস্য ছাড়াও মন্ত্রিপরিষদের দু জন সদস্য; তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মােশতাক আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যান্য দলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মণি সিং, পিকিংপন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ এবং বাংলা কংগ্রেস দলের সভাপতি মনােরঞ্জন ধর ছিলেন উপদেষ্টা কমিটির সদস্য।

——

১৩৪৯ ঐ, পৃ. ৮২। ১০৫°, ঐ, পৃ. ৮২। ১৩৫০, ঐ, পৃ. ৮২। ১৩৪২, , পৃ. ৮৪।

সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃ. ৯৫ এবং সাইফুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭।

সর্বসম্মতিক্রমে তাজউদ্দীন আহমদ উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। ইন্দো-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর একটি বড় অগ্রগতি। দৃশ্যত এতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তি-সম্পর্ককে বাংলাদেশের অনুকূলে আনার পক্ষে। এটা সহায়ক হয়।৩৫ যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটি কতটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় কিংবা সে সুযােগ ছিল কতটুকু এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে তাজউদ্দীন আহমদ এর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন নি। ভাসানীর কলকাতায় অবস্থানকালে তাজউদ্দীন প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করতেন। এছাড়াও প্রায় প্রতি সপ্তাহে কমরেড মণি সিং এবং অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের সঙ্গে তিনি নানা বিষয়ে আলােচনায় মিলিত হতেন।থই তার অনুরােধে তারা মুক্তিযুদ্ধে। সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন আদায়ের জন্য মস্কো-দিল্লির মধ্যে ছুটাছুটি করেন।* ইন্দো-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন ঘটনাপ্রবাহকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষ্যাভিমুখে উৎক্ষেপ করে। সােভিয়েত নেতা পদগর্নি একটি ভােজসভায় স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অতি দ্রুত বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান হওয়া দরকার। একই ধরনের বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয় প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের মন্তব্যেও। তিনি বাংলাদেশের জনগণের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ওই পরিস্থিতির পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এর অল্পকাল পরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরের মাধ্যমে। ২৮ সেপ্টেম্বর তিন সােভিয়েট নেতা ব্রেজনেভ, পদগর্নি ও কোসিগিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৬ ঘণ্টাব্যাপী আলােচনায় মিলিত হন। ১৩৫ বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই আলােচনার গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঐ বৈঠকে উপস্থিত পঞ্চম ব্যক্তি ডি.পি. ধর ঘটনার দেড় বছর পরে একটি সাক্ষাৎকারে এর গুরুত্বের বিষয়ে নিমােক্ত মূল্যায়ন করেন:১৩৬০

——-

১৩৫৪

জয় বাংলা, ১৮’শ সংখ্যা, ১৭ সেপ্টেম্বর। ১৩৫৫ আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ, পৃ. ১৯৩-১৯৪। ১৩৫, ঐ, পৃ. ১৯৭-১৯৮। ১৩৫* জয় বাংলা, ২০তম সংখ্যা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।

ঐ, ২১তম সংখ্যা, ৪ অক্টোবর, ১৯৭১। * দেখুন, Newsweek, 6.12.1971. ১০৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২-১০৩।

৩৪০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা এই প্রথম বাংলাদেশের পরিস্থিতির মাঝে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের উপাদান বর্তমান এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে এবং এই পরিস্থিতি ভারতকে বৃহত্তর সংঘর্ষে জড়িত করে। ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় একমত হয়ে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করার পক্ষে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎশক্তির সম্মতি বাংলাদেশের মুক্তির জন্য ভারতের সর্বাত্মক সহায়তার পথ উন্মুক্ত করে। ভারতের সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি যে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সচেষ্ট হওয়ার কথা বলা হয়, সেই সমাধানের শর্তাবলি। যা যুক্ত ইস্তেহারে ঘােষণা করা হয়—কার্যতঃ ছিল বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবীর নামান্তর।

আসন্ন যুদ্ধের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের চূড়ান্ত সামরিক প্রস্তুতি

বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অনিবার্যতা বিবেচনা করে ভারতের নীতিনির্ধারক মহল সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন অনেক পূর্ব থেকেই। উপযুক্ত উপাদানসমূহের সমন্বয়ের পর ভারতীয় বাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের সময় গুরুত্ব দেয়া হয় পাকিস্তান ও তার মিত্রপক্ষের শক্তি-সামর্থের প্রতি। এই প্রস্তুতির একটি ধারাবাহিক বিকাশ লক্ষ করা যায়। | বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের ৩-৪ ডিভিশন সৈন্যের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত করা হচ্ছিল বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্য থেকে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনীর প্রায় ৭৩ হাজার আধাসামরিক সদস্যকে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে প্রায় এক লক্ষ সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মে মাস থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে । চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা রচনাকালে পাকিস্তানের বিদ্যমান সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ভারতের ৮-৯ ডিভিশন সৈন্যের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকৃত হয়। কিন্তু প্রয়ােজনীয়সংখ্যক সৈন্য ভারতের পশ্চিমাঞ্চল হতে সংস্থান করার কোনাে উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় একটা বিষয় সামরিক ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক মহলে স্বীকৃত হয় যে, অতিরিক্ত সৈন্য পূর্বাঞ্চলে সমাবেশ ঘটানাে সম্ভব কেবলমাত্র শীতকালে। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, চীনকে পক্ষে টানার জন্য জুলাই মাসে কিসিঞ্জার চীন সফর করেন। চীনা সামরিক হস্তক্ষেপের নিশ্চয়তা না পেয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোকে প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি ও দলনেতা করে নভেম্বর মাসে চীনে একটি মিশন প্রেরিত হয়। এতে আরাে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্টাফ

প্রধান গুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল আবদুর রহিম এবং কতিপয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। চীনা কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের উক্ত প্রতিনিধি দলকে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে মােকাবিলা করার পরামর্শ দেয়।১৩৬১ তার পূর্বেই অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান এবং তৃতীয় সপ্তাহে ভারত যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য উভয় অঞ্চলে ভারতকে নতুনভাবে সৈন্যবাহিনী, রসদপত্র, কমান্ড ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয়ে যথাসম্ভব পুণর্বিন্যাস করতে হয়। পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক অধিকর্তা মেজর জেনারেল অরােরা ও তার পরিচালনাধীন কমান্ড দ্রুততার সঙ্গে সামরিক বিন্যাস সম্পন্ন করেন। ইতঃপূর্বে ‘পূর্ব পাকিস্তানের দিক হতে আক্রমণ সম্ভবনা না থাকার কারণে ইস্টার্ন কমান্ডে সামরিক ক্ষমতা ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্বাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনকে লক্ষ রেখে তা পরিচালিত হতাে। উদ্ভুত অবস্থায় মে মাসে ইস্টার্ন কমান্ড একটি অন্তবর্তীকালীন সামরিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে অগ্রসর হতে থাকে। চূড়ান্ত আক্রমণ রচনার পরিকল্পনা প্রনয়ণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ডি.এম.ও. লে. জেনারেল কে.কে. সিং। তিনি অতি দ্রুততার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করেন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন লে. জেনারেল বি.এন, সরকার । চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনার প্রস্তুতি প্রক্রিয়া হতে লক্ষ করা যায় যে, এ ব্যাপারে ভারতীয় বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। আর একটি বিষয়ে ভারতীয় সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও মন্তব্য থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিল না যে, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে কিভাবে মুক্ত করতে চায়। এক্ষেত্রে একটা ধারণা কাজ করছিল যে, পূর্ব বাংলার কোনাে একটি অঞ্চল দখল করে সেখানে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সেখানে শরণার্থীদের পাঠিয়ে দেয়া। এ ব্যাপারে সমুদ্রবন্দরযুক্ত শহর খুলনা এবং চট্টগ্রাম জেলাকে অধিক প্রাধান্য প্রদান করা হয়। জেনারেল জেকবের সুত্র হতে জানা যায় জেনারেল অরােরা এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ’ অন্তত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের ধারণাই পােষণ করে আসেন। মূল যুদ্ধপরিকল্পনায় ঢাকা দখলের কোনাে কথা উল্লিখিত হয় নি এবং সে জন্য

——-

১৩৬১ গুল হাসান, পাকিস্তান যখন ভাঙলাে, এ.টি.এম. শামসুদ্দীন (অনু.) (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ৩৯-৪০। মূল গ্রন্থের নাম Memories of L. Gen. Gul Hassan Khan. ১৩৬২, লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮-৫২। ১৩৬৩, ঐ, পৃ. ৪১।

১০৪* ঐ, পৃ. ৪৯।

কোনো সামরিক বরাদ্দ রাখা হয় না ইস্টার্ন জোনে জেনারেল মানেকশ, জেনারেল অরােরা, লে. জেনারেল জেকব এবং প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ বিষয়ক উপদেষ্টা ডি,পি, ধরের উপস্থিতিতে মূল পরিকল্পনা বিবৃত করা হয়। জেকবের মতে এতে ঢাকা দখলের কোনাে ব্যবস্থা না রাখা হলেও তিনি মূল পরিকল্পনার বাইরে ১০১ কমিউিনিকেশন জোনের গুৱবক্স সিং গিলের সঙ্গে আলােচনা করে ঢাকা দখলের একটা বিকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।১৩৬৫ চূড়ান্ত পর্বে দেখা যায়, যৌথবাহিনীর অগ্রমুখ ঢাকার দিকে ধাবিত হয়। বস্তুত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঢাকা দখল করা সম্ভব নয় বিবেচনা করেই মূল পরিকল্পনায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে জেনারেল জেকুব উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় বরাবরই ঢাকা দখলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল । পরিশেষে দেখা যায় যে, পাকিস্তান বাহিনীর সৈন্য সীমানা পর্যন্ত টেনে নিয়ে ঢাকার প্রতিরােধ ব্যবস্থা দুর্বল করে ফেলার কথা এবং অপ্রচলিত পথে সকল ইউনিটকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে এমনিতেই ঢাকার পতন হওয়ার কথা। মুক্তিবাহিনীর উপর্যুপরি সাফল্য এবং যৌথবাহিনী অধিকৃত বাংলাদেশে প্রবেশ করলে নির্যাতিত জনতার অভ্যুত্থান ঘটতে পারে- এ চিন্তা ভারতের সামরিক পরিকল্পনার সময় স্থান পায়নি। তবে বিষয়টি বাংলাদেশ নেতৃত্ব ও ডি.পি, ধরের বিবেচনায় স্থান লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে আগস্ট মাস হতে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্য পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে দেয়। তারা তাদের পরাজয় সম্পর্কে আঁচ করতে পারে। এমতাবস্থায় নভেম্বর মাসে তারা যেকোনভাবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানাের প্রচেষ্টায় থাকে। কেননা বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তাদের আশংকা জন্মে, পরাজিত হলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে না। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটা বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং তাদের সুনির্দিষ্ট যুদ্ধ কৌশলও ছিল না। সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ সমর পরিকল্পনার বিষয়কে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্বিরােধ দেখা দেয় । বস্তুত পাকিস্তান বাহিনী একটি বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়।৩৬৭ তারা ক্রমাগত নদী বন্দর ও সমুদ্র বন্দরযুক্ত খুলনা ও চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয় এ বিবেচনা থেকে যে, প্রয়ােজনে জলপথে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করা যেতে পারে । অন্যদিকে ভৌগােলিক কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় শহর ভারত সীমান্তে অবস্থিত এবং পাকিস্তানি দৃষ্টিকোণ থেকে ঐগুলাে রক্ষার জন্য বেশ কিছু অন্তরায়

——

১৩৬৫, ঐ, পৃ. ৫৭-৫৮। ১৩৬৬. মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪। ১৩৬৭ লে. জেনারেল, গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮।

বিদ্যমান। ১৩৬৮ এভাবে পাকিস্তান বাহিনীকে সীমান্ত পর্যন্ত টেনে নেয়া, রণক্লান্ত করে তােলা, যুদ্ধরত ইউনিটগুলােকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং রাজধানী ঢাকার প্রতিরােধ ব্যবস্থা দুর্বল করে দেয়া, সর্বশেষে ঢাকার পতন ঘটানােকে ভারতের চূড়ান্ত রণনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। পাকিস্তান বাহিনী বাস্ত ব ক্ষেত্রে ভারতের এই রণকৌশল বুঝে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানের সামরিক পরিকল্পনায় অধিক গুরুত্বারােপ করা হয় পশ্চিমাঞ্চলের প্রতি। তাদের পরিকল্পনায় স্থান পায় ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে। পশ্চিমাঞ্চলে যত অধিক পরিমাণ ভূমি দখল করা যায় ততই ভাল—এটা ছিল। তাদের মূল পরিকল্পনার গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে বিশেষ করে কাশ্মীরের প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। তারপর আমেরিকা ও অপরাপর প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলাের উদ্যোগে সীজফায়ার-এর মাধ্যমে নিজের বিজয়ের পাল্লা ভারী করা পাকিস্তানের। রণনৈতিক কৌশলের প্রধান বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। | মধ্য আগস্টে মুক্তিবাহিনী নবউদ্যোগে যে আক্রমণ শুরু করে বস্তুত তা। প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান বাহিনী দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। এর ফলে পাকিস্তানি গােলা ভারতীয় ভূখণ্ডে আঘাত হানে। এমতাবস্থায় ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘােষণা না করলেও নভেম্বর মাসে সীমান্তের দশ মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমানা দখল করার সিদ্ধান্ত হয়।৩৭০ সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ফলে ক্রমাগত পাকিস্তান বাহিনীর অস্ত্র ক্ষমতা সীমিত হয়ে আসে। চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে ভারতীয় সমর পরিকল্পনাটির কৌশল হয় নিরূপ:৩৭ (ক) শত্রুসেনাকে সীমান্তের যতটা কাছাকাছি সম্ভব এনে তাদের রিজার্ভ কমিয়ে ফেলা, (খ) শত্রুদের শক্তিশালী ও ‘সুরক্ষিত ঘাঁটি’গুলােকে পাশ কাটিয়ে তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থার কেন্দ্রগুলােতে আঘাত হানা, (গ) শত্রুবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে তাদের কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। এক্ষেত্রে বিমানবন্দর, বড় বড় সেতু, ফেরি, সংযােগ পথ, বিভিন্ন যােগাযােগ পথ দখল কিংবা বিনষ্ট করে দেয়া। (ঘ) সুযােগ মতাে পদ্মা ও মেঘনা নদী পার হয়ে উত্তর দিক থেকে ঢাকা অভিমুখী মূল আক্রমণকে আরাে শক্তিশালী করা এবং দুই প্রধান সমুদ্রবন্দরের প্রবেশ পথ নৌ অবরােধের মাধ্যমে বন্ধ করে তাদের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হতে বিছিন্ন হয়ে পড়ার আতঙ্ক সৃষ্টির

—–

১৩৬৮ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬। ১৩৬৯ এ বিষয়ে দেখুন, লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮-৫৯।

লে, জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২-৫৩। ১৩৭১

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫। ১৩৭২ লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭।

প্রতি নজর দেয়া। ১৩৭৩যুদ্ধের চূড়ান্তপর্বে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যত কম জীবনহানী ও সম্পদ নষ্ট হয় সে দিকে নজর দেয়ার জন্য ভারতীয় কতৃপক্ষের নিকট অনুরােধ জানিয়েছিলেন। বস্তুত সে উদ্দেশ্যে এবং ব্যাপক সংঘর্ষ এড়ানাের জন্য যৌথবাহিনীকে অপ্রচলিত পথে অগ্রসর হয়ে দ্রুত লক্ষ্য অর্জনের নির্দেশ দেয়া হয়।১৩৭৪

ভারতীয় সমরবিশারদরা একটা অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে অতি সহজেই পাকিস্তান বাহিনী সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় অনেক তথ্য পেয়ে যান। কেননা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা, সামরিক মানচিত্র প্রভৃতি সম্যকভাবে অবহিত ছিল। যুদ্ধের প্রয়ােজনে পরবর্তীকালে পাকিস্তান বাহিনী যে সব এলাকায় অস্থায়ী ঘাঁটি গড়ে তােলে, অতি সহজেই সেগুলাে সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এতে গেরিলা বাহিনীর আক্রমণ। দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রাকৃতিক বিন্যাসকে গুরুত্ব দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণ রচনা করে অবরুদ্ধ সমগ্র বাংলাদেশ। দখলের জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড নিডোক্তভাবে সেনা সমাবেশ ঘটানাের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।৩৭৬ | উত্তর-পশ্চিম সেক্টর: এই সেক্টরের প্রধান কেন্দ্রীয় শহর বগুড়া দখলের জন্য মেজর জেনারেল লছমনের নেতৃত্বে প্রস্তুত হয় ২০ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৩৪০ মাউন্টেন বিগ্রেড। প্রয়ােজনে ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডকেও ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। এই কমান্ড ব্যবস্থাপনাটি ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত নির্ধারিত হয়। পশ্চিম সেক্টর: যশাের, মাগুরা এবং ফরিদপুর দখলের দায়িত্ব দেয়া হয় ৯ ইনফ্যান্ট্রি ও ৪ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রতি। সুযােগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে অভ্যন্তরীণ নদীপথ ব্যবহার করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় এই সেক্টরকে। এর একটি হেড কোয়ার্টার স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর: ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন, একটি বিগ্রেড বাদ দিয়ে ৮ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন বরাদ্দ করা হয় এই সেক্টরের অধীনে। এই বাহিনী পরিচালনার জন্য আসামস্থ ৪র্থ কোরকে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই বাহিনীর প্রতি দায়িত্ব

——-

১৩৭৩ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮।

নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ, ১৫৮। ১৩৭৫ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২-১১৩।

* লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫-৪৭। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনামূলক সামরিক শক্তির বিষয়ে আরাে দেখুন, A. Hariharan, India- Pakistan: Armed to a Point’, Far Eastern Economic Review, 30 October, 1971.

অর্পিত হয় চাঁদপুর ও দাউদকান্দিসহ মেঘনা অববাহিকা অঞ্চল দখল করা। উত্তর-পূর্ব সেক্টর: এই সেক্টরের অধীন জামালপুর, টাঙ্গাইল ঢাকা অক্ষ। এজন্য একটি ডিভিশন এবং অতিরিক্ত একটি ব্রিগেডের ব্যবস্থা রাখা হয়। এক্ষেত্রে ইস্টার্ন জোনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, এ কাজের জন্য যেহেতু পৃথক কোনাে ডিভিশন নেই সেহেতু ৬ মাউন্টেন ডিভিশনকে পর্যাপ্ত শক্তিশালী করার জন্য বাড়তি একটি বিগ্রেডকে এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। টাঙ্গাইলে নামার জন্য প্যারাশুট ব্যাটালিয়য়নকে নির্দেশ দেয়া হয় । প্রয়ােজনীয় অবকাঠামাে গড়ে তােলার জন্য সাব-এরিয়া হেডকোয়াটার্সকে আসাম থেকে ত্রিপুরায় নিয়ে যাওয়া হয় । তেলিয়ামুরায় ২ ডিভিশন, ধরমনগরে ১ ডিভিশন, পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে ২ ডিভিশন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে অবস্থিত রায়গঞ্জে ১ ডিভিশন এবং মেঘালয়ের তুরায় ১ ডিভিশনের কিছু বেশি সৈন্যের এক মাসের জন্য প্রয়ােজনীয় গােলাবারুদ ও রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের অভ্যন্তরে পরিবহনের জন্য রােড ব্যবস্থারও কিছুটা উন্নতি করা হয়। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের পূর্বে বড় রকমের সামরিক পুনর্বিন্যাস করতে হয়। এই পরিকল্পনায় মুক্তিবাহিনীর অংশগ্রহণ। গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় স্থান পায়। ভারতীয় বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে পাকিস্তানী সুত্র হতে নিলিখিত তথ্য জানা যায়: ১৩৭৭ ভারতীয় গােলন্দাজ বহরে ১৩০-এমএম রুশ কামান অন্তর্ভুক্ত করা হয় । এগুলাে ৩০ কিলােমিটার দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। টি-৫৫ ট্যাংকের একটি রেজিমেন্ট এবং পিটি-৭৬ শেরম্যান ট্যাংকের দুটি রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয় ভারতের সাজোয়া বহর। এ ছাড়াও পিটি-৭৬ ট্যাংকের অতিরিক্ত দুটি স্বাবলম্বী স্কোয়াড্রনও এতে যুক্ত করা হয়। সাজোয়া বহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাতে কার্যক্ষমতাযুক্ত এবং অতি সহজেই নদী-নালা-খাল-বিল অতিক্রম করার পারঙ্গমতা।

আকাশপথে যুদ্ধের জন্য মিগ-২১ এস (বাধা প্রদানকারী), ক্যানবেরা (বােমারু), ন্যাট (ভূমি সহায়ক বিমান), এসইউ-৭ এস (জঙ্গী ও বােমারু) বিমানের সমন্বয়ে দশটি স্কোয়াড্রন মােতায়েন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের চারিদিকে আকাশপথে। আক্রমণের একটি জাল বিস্তার করে। সামরিক পরিবহনের জন্য বিমান ও হেলিকপ্টার বহরও প্রস্তুত করা হয়। পাকিস্তানি সুত্রমতে এভাবে ভারত কর্তৃক ১,৫০,০০০ নিয়মিত সদস্য, ৫০,০০০ সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং ১,০০,০০০ মুক্তিবাহিনীর সদস্যের সমাবেশ ঘটানাে হয় পূর্বাঞ্চলে। পূর্ব, পশ্চিম

—–

১৩৭৭ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১।

ও উত্তর দিক হতে আক্রমণ চালানাের জন্য স্থাপন করা হয় তিনটি কোর হেডকোয়ার্টার। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবহর নিযুক্ত হয়। আকাশপথে চলাচলের জন্য প্রস্তুত রাখা হয় একটি হেলিকপ্টার ফ্লিট, যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি ব্যাটালিয়নকে স্থানান্তর করতে সক্ষম। প্রয়ােজনের সময় কাজে লাগানাের জন্য কলকাতায় প্রস্তুত রাখা হয় প্যারাব্রিগেড। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্রই যুদ্ধের জন্য ভারত বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ টাস্কফোর্স সৃষ্টি করে। বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বিক্রন্ত’এ ৬টি অ্যালিজি (পর্যবেক্ষণ বিমান), ১৪টি সি-হক (জঙ্গী) এবং ২টি সি-কিং (সাবমেরিন বিধ্বংসী হেলিকপ্টার) যুক্ত হয়। এছাড়াও পাহারার দায়িত্ব পালন করে ৩ টি ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট। টাস্কফোর্সটি গঠিত হয় ৪টি যুদ্ধ জাহাজ, ২টি সাবমেরিন, ১টি মাইন সুইপার, ৫টি গানবােট এবং ৩টি অবতরণ যান নিয়ে।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর উপরিউক্ত সুত্র মােতাবেক এক ব্রিগেড প্যারাশু্যট বাহিনী, ৩টি ব্রিগেড গ্রুপ, সীমান্ত নিরাপত্তার কাজে নিয়ােজিত ২৯টি ব্যাটালিয়ন, এক লাখ শক্তিশালী মুক্তিবাহিনীও হিসাবযােগ্য। আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সবাই সাধারণভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন যারা যৌথবাহিনীকে মূল্যবান সহায়তা দান করে।

ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের কারণে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের সেনা অনুপাত ছিল ৩:১। কিন্তু তার পরে উভয় পক্ষই আক্রমণাত্মক অবস্থা বজায় রাখে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আরাে শক্তিবৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নির্বাচনের পর হতে পাকিস্তান বাহিনী পশ্চিমাঞ্চলে একদিকে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে, অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে ক্রমাগত শক্তি বাড়িয়ে চলে। এই অবস্থা ২৫ মার্চের পরেও অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অত্যাসন্ন যুদ্ধকে সামনে রেখে নতুন একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর মূল বিষয়গুলাে ছিল:

ক, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আক্রমণাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে পশ্চিমাঞ্চলে ফর্মেশনগুলাের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং কৌশলগত স্থানে অধিক শত্রু-ভূমি দখল করে নেয়া এবং খ, পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধের শুরুতেই তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের অভ্যন্তরে পাল্টাআক্রমণ চালানাে। সে লক্ষ্যে সেখানে রাভী নদের দক্ষিণে রিজার্ভ ইউনিট গড়ে তােলা হয়, যা কিনা আক্রমণ পরিকল্পনার বর্শাফলকের অগ্রভাগ হিসেবে।

———-

১৩৭৮ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০। ১৩৭৯* লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯।

পরিগণিত হবে । পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য নিয়াজী অনেকগুলাে বিকল্পের মধ্যে যেটা গ্রহণ করেন তা হলাে দূর্গ প্রতিরােধ মতবাদ। এর অর্থ হলাে। সীমান্ত শহরসমূহ বিশেষ করে যেগুলাে শক্রর প্রধান আক্রমণে পতিত হবার আশংকা ছিল সেগুলােকে দূর্গে পরিণত করা। প্রাকৃতিক সীমানা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রধান ৪ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। উত্তর-পশ্চিম: নাটোরে স্থাপিত হেডকোয়ার্টার্সের অধীনে মেজর জেনারেল। নজর হুসাইন শাকের-এর নেতৃত্বে ১৬ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ছিল একটি রিকনসিলনস (লুকিয়ে নজরদারী করা) ও সাপাের্ট ব্যাটালিয়ন, এক স্কোয়াড্রনের কম একটি আর্মার রেজিমেন্ট, দুইটি ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং একটি ভারী মর্টার ব্যাটারি, এই ডিভিশন চার ব্যাটালিয়ন সম্বলিত ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে রংপুরদিনাজপুর অঞ্চলে, ২০৫ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে হিলি-ঘােড়াঘাট অঞ্চলে নিয়ােজিত করা হয়। পশ্চিম সেক্টর: মেজর জেনারেল এম.এইচ. আনসারীর অধীনে নিয়ােগ করা হয় ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের একটি আর্মার স্কোয়াড্রন, ২ টি ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ১টি মর্টার ব্যাটারি। ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সাথে ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার্স স্থাপিত হয় যশােরে এবং ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ঝিনাইদহ-মেহেরপুর-জীবননগর। এলাকায়; সাতক্ষীরাতেওঁ এর একটি অংশ অবস্থান নেয়। দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর: ১ স্কোয়াড্রন আর্মার, ২টি ফিল্ড রেজিমেন্ট ১টি হেভি মর্টার ব্যাটারিসহ ১৪ ইনফ্যান্ট্রি। ডিভিশন মেজর জেনারেল আবদুল মজিদ কাজির নেতৃত্বে উত্তরাঞ্চলে নিয়ােজিত হয়। প্রথমে এর হেডকোয়ার্টার ঢাকায় স্থাপন করা হলেও পরে ভৈরবে তা স্থানান্ত বিত হয়। ১৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড আখাউড়া-কসবা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়, মৌলভিবাজার এলাকায় ৩১৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এবং সিলেটে ২০২ ইনফ্রান্ট্রি ব্রিগেড় নিয়ােজিত হয়। মেজর জেনারেল রুহুল রহিম খানের নেতৃত্বাধীন ৩৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন ছিল এই সেক্টরের সর্বদক্ষিণে, এর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় চাঁদপুরে। ১১৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ময়নামতিতে এবং ৫৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড ফেনী অঞ্চলে নিয়ােজিত হয়। ৯১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের একটি নিয়মিত ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন ও আধাসামরিক বাহিনীর বেশ কিছুসংখ্যক সদস্যকে নিয়ােগ করা হয় ফৌজদারহাট-রামগড় এলাকায়। উত্তর পূর্ব সেক্টর: জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিয়ােজিত হয় ৯৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড। ১ ব্রিগেডের কমসংখ্যক সৈন্য ঢাকায় নিয়ােজিত রাখা হয়।

———

১৩৮০ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।

লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪-৬৫।

পূর্বাঞ্চলে আকাশপথে যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের ছিল মাত্র ৮৬-স্যাবর-এর। একটি স্কোয়াড্রন এবং নৌ যুদ্ধের জন্য মাত্র ৪ টি গানবােট।১৩৮২ পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে উভয় সেক্টরে যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর ১২ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে বলেন, ‘আপনাদের বীর সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের পবিত্র মাটির প্রতি ইঞ্চি রক্ষায় এবং সংরক্ষণে পুরােপুরি প্রস্তুত। প্রেসিডেন্টের সামরিক শক্তির প্রতি এই অতি বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জেনারেল নিয়াজী রণহুংকার দিয়ে বলেন যে, পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ হবে কলকাতায়। এটা যে নিছক ভাওতাবাজী তা অবশ্য নিয়াজী সিদ্দিক সালিকের নিকট স্বীকার করে বলেন “তুমি কি জান না, ধাপ্পা আর চালাকিই হচ্ছে যুদ্ধের উপদেবতা? পাকিস্তানি সুত্রমতে পূর্ব পাকিস্তানের তখন ৩,০০০ বর্গমাইল বেদখল হয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য যে, যুদ্ধের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী ও রাজিবপুর থানা (কোদালকাটি ইউনিয়ন ব্যতীত) মুক্ত অঞ্চল ছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। মধুপুরের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলও কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর দখলে ছিল। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামসহ কোনাে কোনাে অঞ্চল অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে মুক্ত হয়। এ অঞ্চলটিতে অক্টেবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্য উর্ধ্বতন। কর্তৃপক্ষ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কাজেই অক্টোবর মাসে। বেশ কিছু এলাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হয়।

শক্রদের চক্রান্তচ্ছেদ এবং অব্যাহত সাফল্যের ধারা

অক্টোবর শুরু হওয়ার পূর্বেই মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপাদানগুলাে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। কিছু কিছু সমস্যা তখন পর্যন্ত অমিমাংসিত থেকে যায়, যেগুলাে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপে অথবা মুক্তিযােদ্ধাদের উপর্যুপরি সাফল্যে অচিরেই দূরীভূত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি ভারতীয় সহযােগিতায় চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলে।

সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর সম্মিলিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার রাজনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভারসাম্য রক্ষার্থে পূর্ব

১৩৮২, সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, ১৩১।

১৩৮৪ ঐ, পৃ. ১২৬।

হতেই মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক দলগুলাে হতে মুক্তিবাহিনীর সদস্য রিক্রুট করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। ১৩৮৫ স্বভাবতই মস্কোপন্থী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি দল সে তালিকায় স্থান লাভ করে। তবে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই রিক্রুটমেন্ট যথাসম্ভব গােপনে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এদিকে সেপ্টেম্বর মাস হতে প্রতি মাসে কুড়ি হাজার করে মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এসব ব্যবস্থা এত দ্রুত করতে গিয়ে হিমসিম খায়। যদিও ইতােমধ্যেই যুব শিবির ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া একটা গতি লাভ করে, তা সত্ত্বেও এত অল্প সময়ের মধ্যে উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে বাছাই করা এবং তাদের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা রিক্রুটমেন্টের বাস্তব সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। যুদ্ধের মাঠে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের অতি আবশ্যকীয় উপকরণ সরবরাহ করাও দূরুহ হয়ে দাঁড়ায়। তাই মাত্র দু তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তব চাহিদার দিকে। নজর রেখে অনেক স্থানে শুধুমাত্র শত্রু-সৈন্যের অনুপাতের বিপরীতে সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একদিনের রাইফেল প্রশিক্ষণ দিয়েও যুদ্ধে পাঠাতে দেখা যায় । নভেম্বরে। অন্যান্য দলীয় মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায়: ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনয়ন ১৫ হাজার, মুজিব বাহিনী প্রায় ১০ হাজার, ছাত্রলীগ ১০ হাজার।৮৮।

| বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ যে সাফল্য আসে তার ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের বিকল্প নেই । যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ স্বয়ং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির ও অপারেশন বেইস-স্থানগুলাে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত পথে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করেন, এতে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বহুগুণ বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় পরিদর্শনের সুযােগ গ্রহণ করে তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধী পক্ষ আর একবার। সংগঠিত হয়ে তার পতন ঘটানাের জন্য শেষ চেষ্টা চালায়। অক্টোবর মাসের ৬ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত মােশতাক আহমদ পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীকে নিয়ে সীমান্তস্থিত বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ ও সেক্টর পরিদর্শন করেন। সফরকালে তাজউদ্দীন বিরােধীদের সঙ্গে তার যােগাযােগ আরাে নিবিড় ও প্রশস্ত হয়। যােগাযােগ বিবর্জিত এসব এলাকা থেকে যেসব রিপাের্ট আসে তাতে দেখা যায় যে, তখন পর্যন্ত তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সচেষ্ট

——

১৩৮৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫ । ১৩৮৬ এ, পূ, ৯৯। ১৩৮৭ ঐ, পৃ. ১১৫। ১৩৯৮ এ, পূ, ৯৮।

৪৪৯

ছিলেন।১৩৮৯এ পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ-বিরােধিতার প্রধান বক্তব্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের নীতি ভ্রান্ত, ভারতের ভূমিকা অস্পষ্ট এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরােধী।১৩৯০ এ ধরনের বক্তব্য মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে । কিন্তু সেপ্টেম্বর নাগাদ সে বক্তব্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। এই পর্যায়ে বিরুদ্ধবাদীরা প্রচার করতে শুরু করে যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও প্রবাসী সরকারের সর্বস্তরে আওয়ামী লীগের দলগত স্বার্থ নিদারুণভাবে অবহেলা করে চলেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শের প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করে আওয়ামী লীগ-বিরােধী শক্তিকে জোরদার করছেন’। মােশতাক আহমদের ইন্ধনে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীনবিরােধী একাধিক গ্রুপের উপরিউক্ত প্রচারণার সঙ্গে ছাত্র ও যুব নেতারা পূর্বের ন্যায় প্রচার করেন, ‘তাজউদ্দীনই বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়ার কারণ, তাজউদ্দীন যতদিন প্রধানমন্ত্রী, ততদিন ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান অসম্ভব’,‘তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা যতদিন ক্ষমতায় আসীন ততদিন বাংলাদেশর মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তারা এরূপ অবস্থার অবসানের জন্য সংসদের তলবী সভা এবং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাকে অপসারণের জন্য আর একবার দাবি। জানায়। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম আঞ্চলিক কাউন্সিলে এই দাবি প্রকাশ্যেই উচ্চারিত হয়। অন্তত মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের উত্তরাঞ্চলীয় কতিপয় প্রভাবশালী নেতা বিভিন্ন বাম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারের বিপরীতে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন বলে রিপাের্ট পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের একাংশের এ ধরনের ইন্ধনে ছাত্র ও যুবনেতাদের তাজউদ্দীনবিরােধিতা শত্রুতার পর্যায়ে নেমে আসে। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়ে এতটাই আপােষহীন ভূমিকা পালন করেন যে, মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ. গােপনে তাকে কলকাতা থেকে অপহরণ করে গােয়েন্দা হেলিকপ্টারযােগে দখলীকৃত পাকিস্তানে নিয়ে আসার একটা পরিকল্পনাও করেছিল বলে জানা যায়।

———-

১৩৮৯ ঐ, পৃ. ১৩১। ১৩৯০ এ, পৃ. ১৩০। | ঐ, পৃ. ১৩২। ১৩৮২, ঐ, পৃ. ১৩০।

| দেখুন, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকের দেয়া। গােপন রাজনৈতিক প্রতিবেদন, প্রথম আলাে, ২৫ মার্চ, ২০০২। *** সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের একান্ত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের প্রদত্ত তথ্য হতেও। তথ্যটি এরকম “পাপানেক বললেন, সি,আই,এ, বাংলাদেশ পক্ষে নয় । হােয়াইট হাউজের মত পাল্টাতে

অক্টোবর মাসে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অন্তত ১০ থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত আগরতলা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেইস ক্যাম্পগুলাে সফর করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহ উদ্দীপনা জোগানাের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ মাঝেমধ্যে মুক্তিযােদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চল পরিভ্রমণ করতেন। অবলীলাক্রমে পাহাড়ী দুর্গম এলাকা অথবা খরস্রোতা নদী পার হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতেন। তাদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী ভাষণ দিতেন, মাটির সানকিতে তাদের সঙ্গে বসে সামান্য খাবার গ্রহণ করেও উৎসাহ যােগাতেন। সাধারণ মুক্তিযােদ্ধারা বিপুলভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে তাকে গ্রহণ করলেও তিনি ছাত্র ও যুবনেতাদের বিরােধিতার সম্মুখীন হন অক্টোবর মাসের এই সফরকালেও।৩৯৩ কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র ও যুবনেতাদের উদ্দেশে বলেন যে, তিনি পদত্যাগ করতে অনিচ্ছুক নন। তবে বিদেশের মাটিতে বসে এ ধরনের ঝগড়া বিবাদ না করে বরং যতদ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ করে দেশে ফিরে সেগুলাের মীমাংসা করা যেতে পারে।” নতুনভাবে বিরােধিতার পূর্বাভাস পেয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও অন্যান্যদের সঙ্গে আলােচনাক্রমে তলবী সভার পরিবর্তে ২০ অক্টোবর কার্যকরী কমিটির সভা আহ্বান করেন। ফলে তলবী সভা আহ্বানের পক্ষে বিরােধী উপাদানগুলাের তােড়জোড় ভণ্ডুল হয়ে যায়। | ২০ অক্টোবর কলকাতায় আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠক শুরু হয়। ২০ ও ২১ দু দিন চলার পরে তা স্থগিত রেখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণক্রমে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গমন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর হতে ১৯ দিনব্যাপী পশ্চিম ইউরােপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য বের হন। দিল্লি গিয়ে তারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করলে তিনি মন্তব্য করেন যে,

————-

হলে আগে সি.আই.এ-এর মত পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর প্রয়ােজন। মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে সি.আই.এ-এর মত পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। উত্তরে আমি জানাই, একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে গােয়েন্দা সংস্থার সাথে কোন আলােচনা হতে পারে না, তেমনি এর প্রয়ােজনীয়তাও আমি বুঝতে পারি না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, খােলামেলা ব্যাপার”। দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পূ, ১৫৮। ১৩৯৫ দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২-২১৮।

ফোরকান বেগম, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী (ঢাকা: ডিজি গ্রাফ, ৩৪ পুরানা পল্টন, ১৯৯৮), পৃ. ২৪৯। ১৩৯৭ ঐ, পৃ. ২৫২। ১৩৯৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১।

তার সফরে সুফল বয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন না, তথাপি কূটনৈতিক কারণে তাকে যেতে হচ্ছে। বস্তুত ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বিবেচনা করবেন বলে ইঙ্গিত প্রদান করেন। সামরিক ক্ষেত্রে সে ধরনের প্রস্তুতি অনেক পূর্বেই শুরু হলেও মন্ত্রিসভায় তখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে কোনাে আলােচনা হয়নি। এমন কি মন্ত্রিপরিষদের অনেক প্রবীণ মন্ত্রীও তখন পর্যন্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনাে ইঙ্গিত পাননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিণতির বিষয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এটাই ছিল প্রথম স্পষ্ট বক্তব্য। জানা যায়, অতি গােপনীয় এই অভিব্যক্তির কথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম আনন্দের আতিশয্যে প্রকাশ করে ফেলেন। ফলে তা মন্ত্রিপরিষদ ও আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটি হয়ে পর্যায়ক্রমে একেবারে সাধারণ্যে প্রচারিত হয়ে পড়ে যে, ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ থেকে ফিরে পাকিস্তান আক্রমণ করবেন। এ সংবাদটি প্রচারিত হয়ে যাওয়ার ফলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার নিকট অপ্রস্তুত হলেও আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির ২৭ ও ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত স্থগিত সভা বেশ গঠনমূলক হয়ে ওঠে। আলােচনায় সংখ্যাগরিষ্ট সদস্যরা যে বক্তব্য ও তথ্য উপস্থাপন করেন তাতে মুক্তিযুদ্ধ। ব্যবস্থাপনাকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে দেশের মধ্যে আগস্ট মাস। হতে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ কিছু অব্যাহত সাফল্য এবং ভারতের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর স্পষ্ট বক্তব্য তাজউদ্দীনবিরােধী উপাদানগুলােকে স্নান করে দেয়। | ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে অক্টোবর মাসে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথকমান্ড গঠনের লক্ষ্যে ভারতের পক্ষে ডি.পি, ধর, জে.এন.দীক্ষিত, বি.এন, সরকার ও বাংলাদেশ পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ও এম.এ.জি. ওসমানী আলােচনায় মিলিত হন। কিন্তু উভয়পক্ষের উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তিরা বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি। ভারতীয় পক্ষের সামরিক ব্যক্তিদের যুক্তি ছিল এম.এ.জি ওসমানী কর্ণেল পদমর্যাদার অবসর গ্রহণকারী কর্মকর্তা মাত্র, তার মর্যাদা ভারতের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমান হতে পারে না। অন্যদিকে ওসমানীর দাবি ছিল তিনি অতীতে যে পদেই কাজ করে থাকুন না কেন বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান। কাজেই তার মর্যাদা হওয়া উচিত সমপর্যায়ের।১৪০০ এই পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও ডি,পি, ধর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করেন এবং অবশেষে যৌথকমান্ড গঠনের সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

——–

১৩৯৯ ঐ, পৃ. ১৩৮-১৩৯। ১৪০০ ঐ, পৃ. ১১৪।

ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই যৌথকমান্ড গঠন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।১৪০১ ওসমানী বিষয়টি হৃষ্টচিত্তে মেনে না নিয়ে পূর্বের ন্যায় আর একবার পদত্যাগ করার হুমকি প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সামরিক ব্যক্তিত্বের বাস্তব চাহিদার প্রকৃত মূল্যায়নে অপারগতা কিংবা অবিবেচনাপ্রসূত চিন্তাভাবনা তাজউদ্দীন আহমদের অনেকটা বিরক্তি উৎপাদন করে। তিনি ওসমানীকে জানিয়ে দেন যে, তিনি লিখিতভাবে পদত্যাগের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তা গ্রহণ করবেন। তাজউদ্দীনের এ ধরনের দৃঢ় মনােভাব লক্ষ করে ওসমানী এ বিষয়ে আর উচ্চবাচ্য করেন নি। কিন্তু সম্মিলিত কমান্ডের আওতায় যুদ্ধের ব্যাপারে তার আগ্রহ কমে যায়। তিনি বরং এ সময় অপ্রয়ােজনীয়। কাজে মনােযােগ দেন। সম্ভবত ভারতীয় বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর তার কোনাে কিছু করার তেমন সুযােগও ছিল না। তবে তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন। এক্ষেত্রে অবশ্য ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খােন্দকার এবং আরাে দু একজন অফিসার বেশ গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বচ্ছ পেশাগত পরামর্শ দিয়ে অবদান রাখেন।০৩ বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় এনে উপলব্ধি করেন যে, সুশৃঙ্খল আক্রমণ রচনার মাধ্যমে দ্রুত সাফল্য লাভ করতে হলে যৌথকমান্ডের কোনাে বিকল্প নেই।৯০৮ তদুপরি চুড়ান্ত আক্রমণ হানার পূর্বে। সামরিক ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া প্রয়ােজন যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও জরুরি।১৯০৫ এ বিষয়ে ভারতীয় কূটনীতিক জে,এন, দীক্ষিত পরবর্তীকালে একটি সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন,

তাজউদ্দিনের আমি একজন বড় ভক্ত। তিনি নির্বাসিত অবস্থায় একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা

————

১৪০১ J.N. Dixit, op.cit., p. 87. ১৪০২, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫-১৫৬। ১৪০৩, ঐ, পৃ. ১৫৬। 380.J.N. Dixit, op.cit., p. 87.

Pই এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত শর্তগুলাে হুবহু জানা না গেলেও তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ট সূত্র হতে জানা যায় যে, এর শর্ত ছিল ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ব্যতীত বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবে না । তদুপরি বাংলাদেশ সরকার যতদিন চাইবে তার বেশিদিন ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে থাকবে না। তাছাড়া দেশ মুক্ত হওয়ার পর কেবলমাত্র সেই সব বাঙালিকে ফেরত নেয়া হবে যারা ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী। হিসেবে গিয়েছে। দেখুন, এম, এ, মােহাইমেন, প্রাগুক্ত, ১৪৯। ১৪০৬ শাহরিয়ার কবির, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত, জনকণ্ঠ, ১৫ মার্চ, ১৯৯৬।

করেছিলেন সেই সরকারকে। যখন প্রকাশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে নামানাের সিদ্ধান্ত হয় তখন সেটা যেন যৌথ নেতৃত্বে হয় সে ব্যাপারে তিনি জোর দিয়েছিলেন। আমি তাকে এসব কারণে খুবই শ্রদ্ধা করি। যে মিটিংয়ে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। সেটাতে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে উপস্থিত উর্ধ্বতন কিছু ভারতীয় সেনা অফিসার তাজউদ্দিনকে বলেছিলেন, আমরা যুদ্ধ করি সেটাই যদি আপনারা চান তাহলে সেটা হতে হবে একটা প্রকাশ্য যুদ্ধ আর সেটা যৌথ নেতৃত্বের অধীনে হতে পারে না । যুদ্ধের নেতৃত্ব আবশ্যিকভাবে আমাদের হাতে থাকবে। তাজউদ্দিন বলেন, সেটা হবে না কারণ এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে আপনারা বলছেন যে, আপনারা আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। আর এখন আপনারা। নিজেদের নেতৃত্বের জন্য চাপ দিচ্ছেন। সেনাবাহিনী অতি অবশ্যই যৌথ নেতৃত্বে থাকবে । মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য যখন প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন তখন দুটো ঘটনা যুদ্ধরত বাঙালি জাতিকে দিশেহারা করে তােলে। একটি হলাে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার আয়ােজন এবং অন্যটি পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পাকিস্তানী অপচেষ্টা। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন মুজিবকে হত্যা না করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দেন। কেননা তাদের বিবেচনায় পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যকার ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। মুজিবই একমাত্র চাবিকাঠি হতে পারেন। পরে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত মার্কিন গবেষক এডারসনের রিপাের্ট থেকে জানা যায়, ইয়াহিয়া মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখার আশ্বাস দিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে।১৪০৭ এ পর্যায়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বজায় রাখার জন্য, বলতে গেলে সকল দায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতা, নীতি নির্ধারকদের অনেকেই উপলব্ধি করেন । ৩ জুন হেনরি কিসিঞ্জারের অফিসে উপমহাদেশের পরিস্থিতি আলােচনার জন্য একটি গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । এতে উপস্থিত ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনিথ। কিটিং এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা হ্যারল্ড এইচ, স্যান্ডার্স। আলােচনার এক পর্যায়ে কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতার বিষয়ে স্পষ্ট মন্তব্য করেন।১৯৩৮ ১৮ আগস্ট প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিকট পেশকৃত হেনরী।

——-

১৪০৭ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮। ১৪০৮ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ২ ডিসেম্বর, ২০০৩।

৪৫৪

কিসিঞ্জারের মেমােরান্ডামে ভারত উপমহাদেশের জটিল বিষয়টি ফুটে ওঠে।১৪০৯ কলকাতার কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপিত হয় তার ভিত্তিতে ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ১৫ ও ২৪ আগস্ট আলােচনায় মিলিত হন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমেরিকার যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ায় ইয়াহিয়া সন্তোষ প্রকাশ করেন।১৪১০ এর অল্পকাল পরে পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু তথাকথিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়। এটাও ছিল মার্কিনি ইচ্ছার প্রতিফলন। ১৬ আগস্ট হেনরি কিসিঞ্জার প্যারিসে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং চেনের সঙ্গে একটি আলােচনায় মিলিত হয়ে চীনকে পক্ষে টানার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিসিঞ্জার তাকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সবকিছু করার কথা বলেন। মার্কিন-জনমত সরকারের অনুসৃত নীতির বিপক্ষে চলে গেলে নিক্সন ও কিসিঞ্জার বস্তুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ছদ্মাবরণে ত্রাণ সামগ্রী ও শরণার্থী প্রত্যাবর্তনকে গুরুত্ব দেন মূলত গােপনে অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখার জন্য। এগুলাের মধ্যে শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে ত্রাণ ও পুণর্বাসনের ঘােষণা, সরকার ঘােষিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনগুলােতে উপ-নির্বাচনের তােড়জোড় এবং বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার ছদ্মাবরণ দেয়ার অপচেষ্টা ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ। ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে আবদুল মােত্তালেব মালেক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিতদের মধ্যে সবাই ছিলেন বাঙালিদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও ধিক্কত ব্যক্তি। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মােনেম খান প্রমুখ। ২০ আগষ্ট ১৯৪ টি আসনে উপনির্বাচনের ঘােষণা করা হয়।** ২ নভেম্বর কিছুসংখ্যক ইসলাম পছন্দ দল মনােনয়নপত্র দাখিল করে এবং অনেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।১৫ বস্তুতপক্ষে উপনির্বাচন করার ব্যাপারে পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে এবং রাও ফরমান

———

১৪০৯ Enayetur Rahim & Joyce L Rahim, op.cit., pp. 174-177. ১৪১০. Ibid, pp. 193-194. ১৪. আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৩। ***, আবদুল হক, লেখকের রােচনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ ১৯৫৩-১৯৯৩ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ২৬৪। ১৪১৩. সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯। ১৪১৯, আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৬। ১৪১৫ ঐ, প, ২৫৭।

আলী খানই ঐসব দলের মধ্যে আসন ভাগ-বণ্টন করে দেন। সাধারণ মানুষ উপ-নির্বাচনের বিষয়ে মােটেও আগ্রহী ছিল না। কেননা জীবনে বেঁচে থাকাই ছিল তাদের প্রধান আকুতি।১৭ পাকিস্তান সরকার ৪ সেপ্টেম্বর ‘বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে। দেশের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এমনটা প্রমাণের জন্য শরণার্থীদের ফেরৎ নেয়ার উদ্যোগও গৃহীত হয়। কিন্তু এ সকল অপচেষ্টাকে সফল হতে না দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি অবিচলিতভাবে বলেন ‘ওরা যত ইচ্ছা ইলেকশন করুক। অ্যাসেমব্লি বসতে দেব না’।* জাতিসংঘের ত্রাণ বিতরণের নামে সি.আই.এ. এবং আমেরিকার গুপ্তচরদের বাংলাদেশে আসার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন যে, ‘লাদেশে মােটেও স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না। কাজেই ত্রাণকর্মীরা বাংলা দেশে এসে বিপদে পড়লে সে ঝুঁকি তাদেরকেই বহন করতে হবে। সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অল্প পরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেলে উপ-নির্বাচনও স্থগিত হয়ে যায়। কাজেই পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের কোনাে পদক্ষেপই পাকিস্তান সরকার কার্যকর করতে পারে নি ।১৪১৯

অক্টোবর-নভেম্বরের মাঝামাঝি মুক্তিবাহিনীর সাফল্য কেবল পাকিস্তান। বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গেই দেয়নি; উপরন্তু আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলােতেও স্থান করে নেয়।২° ১১ অক্টোবর হতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ নতুন মাত্রা লাভ করে। ঐ দিন তারা ঢাকায় প্রথম মর্টার হামলা চালায়। অক্টোবর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর উল্লেখযােগ্য উদ্যোগগুলাে ছিল:১৪২১

১০ অক্টোবর ডেমরায় বােমা বিস্ফোরণ, ১১ অক্টোবর তেজগাঁও বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে অসফল মর্টার আক্রমণ, ১৩ অক্টোবর টংগীর অদূরে। রেলগাড়িসমেত রেল-ব্রীজের ধ্বংস সাধন এবং তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস ও ব্যাংকে বােমা বিস্ফোরণ, বিভিন্ন স্থানে টহলদার অথবা অবস্থানরত বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের যে নতুন পর্যায় শুরু হয়, ক্রমশ তা অক্টোবরের শেষ নাগাদ দখলদার সৈন্যের ক্ষয়ক্ষতি

————

১৪১৬ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২১। ১৪১৭ ঐ, ১২২। ১৯১৮ আনিসুজ্জামান, “একজন বিরল মানুষের কথা”, ড. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩। ১৬১৯ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০। ১৯২০ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩-১৪৪। ১৪২১ ঐ, প, ১১৮।

ও উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করে। ইতিপূর্বে জুন ও আগষ্ট মাসের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে রেল ও সড়ক ব্রীজ এবং যানবাহনের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। এর ফলে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধে পরিচালিত US-AID-এর এক সার্ভে অনুযায়ী-স্থলপথে পরিবহনের হার আগের তুলনায় এক-দশমাংশে নেমে আসে। এগুলি প্রয়ােজনীয়। মেরামত সম্পন্ন হবার আগেই মুক্তিযােদ্ধাদের নতুন আক্রমণ দখলদার বাহিনীর অভ্যন্তরীণ চলাচলের ক্ষমতাকে আরাে সঙ্কুচিত করতে শুরু করে। এর পাশাপাশি ১৫ আগষ্ট থেকে সামুদ্রিক জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের বিরুদ্ধে যে দুঃসাহসিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল ১৯শে ও ২৬শে সেপ্টেম্বরে এবং ১ লা অক্টোবরে তা আরাে ক্ষতি সাধন করে চলে। এর ফলে বিশেষতঃ বাণিজ্যিক নৌ-মহলে আতঙ্কের সঞ্চার ঘটে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দখলদার সৈন্যদের জন্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরাহ করা উত্তরােত্তর কষ্টকর হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা ও ভয়াবহতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে ২৩ অক্টোবর দিনের বেলায় প্রাক্তন গভর্নর আবদুল মােনেম খানকে তার বাড়িতে গুলি করে হত্যা করলে। এটি মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের জন্য একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদে পরিণত হয়। তুলনামূলকভাবে অনুন্নত অস্ত্র ও স্বল্পপ্রশিক্ষণসম্বলিত মুক্তিবাহিনীর শৌর্যবীৰ্য্য, পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীর ব্যাপক অস্ত্রসম্ভার থাকা সত্ত্বেও নৈতিক ও মানসিক বল হারানাে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের অদম্য মনােবল প্রসঙ্গে রবার্ট পেইন লিখেছেন:১৪২৩

এর পরের অবস্থায় অর্থাৎ সপ্তম পর্যায়ে হত্যাযজ্ঞে নিষ্পেষিত মানুষগুলাে শত্রুদের। উপর চড়াও হতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে এই পর্যায়ের জোয়ার বাড়তে থাকলে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্রমাগত আস্থাহীন হয়ে পড়তে লাগলাে । অথচ এই সর্বাধুনিক সাজে সজ্জিত বাহিনীটির ছিলাে অসম্ভব রকমের সামরিক শক্তি। এই পর্যায়ে এসেও তারা ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধে নামছিলাে, যােগাযােগ ব্যবস্থা তাদের ভীষণ নিয়ন্ত্রণে ছিলাে, বিশেষ করে টেলিযােগাযােগ । আর্মড কার আর সামরিক বিমান নিয়ে তাদের সমর সম্ভার ছিলাে অকল্পনীয়। স্থল যােগাযােগ আর গােয়েন্দা ব্যবস্থা ছিলাে খুবই উপযােগী এবং অনুকূল। আসলে আরাে হত্যাযজ্ঞ ঘটাবার সমস্ত যােগ্যতাই এই বাহিনীর ছিলাে । কিন্তু তাদের অভাব ছিল সাহসের, নৈতিকতার, মনােবলের, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের । বলা যায়, তারা অসহায়ত্বের কাছেই নিজেদেরকে সমর্পণ করে দিয়েছিলাে। মুক্তিবাহিনী এই সময় শহরগুলাের আশেপাশের ব্যাপক এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছিলাে । যুদ্ধের প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা বলছিলাে যে, সেপ্টম্বর পর্যন্ত তারা ছিলাে সৌখিন যােদ্ধা; কিন্তু অক্টোবর হতেই তারা পেশাদার

———–

১৪২৪, সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৪। ১৯২০, রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার-বাংলাদেশ-গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ংকর অধ্যায়, গােলাম হিলালী (অনু.) (ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, তা.বি.), পৃ. ৬৬-৬৭।

যােদ্ধার মতাে করে যুদ্ধ করেছে। এই পর্যায়ে তারা পেয়েছিলাে উন্নত ধরনের ট্রেনিং, শৃঙ্খলা এবং উন্নত ধরনের সামরিক সরঞ্জাম। সে সময় তাদের হাতে ছিলাে ট্যাঙ্ক, ছােট জাহাজ, মােটরবাট, আর গােটা ছয়েক যুদ্ধ বিমান। যুদ্ধের জন্যে মুক্তিবাহিনীর ছিলাে দৃপ্ত দাপট আর জয়ের জন্যে ছিলাে অদম্য স্পৃহা । অন্যদিকে শত্রুরা। ভিনদেশের পরিবেশ প্রতিনিয়তই ভাবতাে যে তারা আর দেশে ফিরে যেতে পারবেনা। মরবার ভয় সারাক্ষণই তাদের আচ্ছন্ন করে রাখতাে। নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ধারা এমন পর্যায়ে উন্নীত হয় যে, পাকিস্তান বাহিনীর নৈশকালীন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

কূটনৈতিক যুদ্ধ সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির সময় ভারতও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ২২ অক্টোবর সােভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলাই ফিরুবিন দিল্লি এসে পৌছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বীমের পাঁচদিন আগের প্রস্তাবের জবাবে ২৩ অক্টোবর সােভিয়েত কর্তৃপক্ষ মার্কিন সরকারকে জানিয়ে দেয় যে, শেখ মুজিবের মুক্তি এবং “পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত রাজনৈতিক নিষ্পত্তিসাধন ব্যতীত কেবল সীমান্ত অঞ্চল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের আশংকা রােধ করা সম্ভব নয়। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত থেকে উভয় দেশের সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য জাতিসংঘ-পর্যবেক্ষক নিয়ােগের প্রস্তাব করে। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকার এসব উদ্যোগ থেকে অনুমিত হয় যে, আগামী দিনগুলােতে বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘে কূটনৈতিক যুদ্ধ ঘনিয়ে আসছে। ২৬ অক্টোবর চীন সফর শেষে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যস্ততা দেখে মনে হয় যে, উপমহাদেশের ঘটনাধারা পাকিস্তানের পক্ষে আনার গুরু দায়িত্ব ‘হােয়ইট হাউসে স্থানান্তরিত হয়েছে ।১৯২৫ শুধু কূটনৈতিক বিষয়ই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অর্পিত হয় নি, সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও ইসলামাবাদ ওয়াশিংটনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।১৯২৬ ইন্দো-সােভিয়েত সহযােগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সােভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমান্তে সামরিক অবস্থানের পুণর্বিন্যাস করতে শুরু করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন চীনের উসরী নদী বরাবর ৪০ ডিভিশন এবং সিংকিয়াং সীমান্তে ৬-৭ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করলে পাকিস্তানকে চীনের সামরিক সহযােগিতা দানের সক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। এ ধরনের বিপদের ঝুঁকি নিয়ে।

———-

১৪২৪, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬১। ১৪২৫ এ, পূ, ১৪৬। ১৪২% লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১।

চীনের পক্ষে পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসা এবং ভারতের প্রতি সামরিক হুমকি প্রদর্শন অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়।১৯২৭ অতি সতর্ক চীনা নীতি প্রকৃতই কোন্ পথে ধাবিত হয় সেটা বােঝাও দুষ্কর হয়ে ওঠে। অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত চৌ এন লাই-এর সঙ্গে আলােচনার পর চীনের নীতি সম্পর্কে কিসিঞ্জারের মনে হয় পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল কিন্তু সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত’। এমতাবস্থায় আমেরিকার পক্ষ থেকে শেষ চেষ্টা হিসেবে তিব্বত-ভারত সীমান্তে চীনের সীমিত হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করা হয়। চীন বাংলাদেশ প্রশ্নটিকে কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হয়নি। উপরন্তু গৃহীত ব্যবস্থার প্রতি যুগপৎ সমর্থনদান এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ ও রসদ সরবরাহ করে পাকিস্তানকে সাহায্য করে। বস্তুত নানা কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস চীনা রাইফেল ও উন্নত সামরিক উপকরণ বাঙালির প্রাণসংহারে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে চীনের নিকট থেকে পাকিস্তান লাভ করে মােট ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক উপকরণ, যার মধ্যে ১৯৭১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলার।৩০ এ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতিসংঘে ভােটাভুটি শুরু হলে চীন বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ইয়াহিয়ার মাধ্যমে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয় তাতে চীনের স্বার্থ একটু বেশি ছিল। দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী সদস্য হওয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ভেটো প্রয়ােগ করে এসেছে। সংকটকালে আমেরিকা ১৯৭১ সালের ২৬ অক্টোবর তাইওয়ানের পরিবর্তে চীনের পক্ষে সাধারণ পরিষদে ভােটদান করে। এটা চীনের জন্য ছিল একটা বিশাল অর্জন। ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয়। একই দিন তক্ষশীলায় চীনা সাহায্যে নির্মিত ভারী যন্ত্রপাতি কারখানার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান দশ দিনের মধ্যে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে

————

১৪২৭ নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৫। ১৪২৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮। ১৪২৪

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস (ঢাকা: জ্যোস্লা পাবলিশার্স, ১৯৯৬), পৃ. ৫২-৫৪। ১৪৩০ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০।

“Meanwhile, China, having become a member of the United Nations as a result of withholding of the U.S. veto against her membership (a consequence of the upholding Sino-U.S. detente), pledged in the United Nations its firm support to the Pakistan people in their struggle against foreign aggression “Mizanur Rahman Shelly, op.cit., p. 103.

৪৫৯

অবতীর্ণ হওয়ার হুমকি প্রদর্শন করেন।১৪৩২ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সামরিক উত্তেজনার জন্য চীন ইন্দা-সােভিয়েত চুক্তিকে দায়ি করলেও শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে সামরিক হস্তক্ষেপে অগ্রসর হয়নি। তবে কিছু পরিমাণ সামরিক সাহায্য প্রেরণ করে।৩৩ চীনের এ ধরনের কৌশল ছিল মূলত সুচিন্তিত কূটনৈতিক বাক্যবাণ নিক্ষেপ এবং পাকিস্তানকে নৈতিক ও নিষ্ক্রিয় সমর্থনদান করার মধ্যে সীমিত। অন্যদিকে প্রবল মার্কিন জনমতকে উপেক্ষা করে ইয়াহিয়া খানের ধ্বংসযজ্ঞে সামরিক সাহায্য দান করা আমেরিকার পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির জন্য যে পথ খােলা থাকে তা হলাে কোনােভাবে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে সম্ভাব্য যুদ্ধে স্থিতাবস্থা আরােপ করানাের চেষ্টা। সােভিয়েত ভেটোর মুখে সে সুযােগও যে সঙ্কুচিত সেটা তারা অনুধাবন করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে ১ নভেম্বর হতে আকাশপথে ভারতের জন্য সােভিয়েত সামরিক সরবরাহ আসতে শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইন্দোসােভিয়েত চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কিছু পরে সােভিয়েত ইউনিয়নের একটি অস্ত্র চালান আসে মূলত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী। যেমন ক্রমাগত সাফল্যে আত্মবিশ্বাস অর্জন করে চলে তার পাশাপাশি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভারতের নিকট অব্যাহতভাবে আবেদন জানানাে হয়। ১৫ অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দানের আহ্বানসম্বলিত এ ধরনের একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশর অর্ধেক ভূখণ্ড মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে এবং সেখানে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম চলছে। ২৩ নভেম্বরে লেখা আর একটি চিঠিতে এই আবেদন পুনর্ব্যক্ত হয়। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘনিষ্ট সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনায় পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে আশংকা ব্যক্ত করেন যে, যৌথবাহিনীর অভিযান ক্রমশ সাফল্য লাভ করতে শুরু করলে পাকিস্তান বাহিনী ঢাকাকে অবরুদ্ধ ও ধ্বংস এবং সেখানকার মানুষদের হত্যা, ক্ষেত্রবিশেষে পণবন্দী করতে পারে । চীনের ভূমিকা অস্পষ্ট হলেও আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের বিষয়টিও আলােচনায় স্থান পায়। বাংলাদেশ নেতৃত্বের এ ধারণার জন্ম হয় যে, যদি উপরিউক্ত আশংকা সত্যে পরিণত হয় তাহলে পাকিস্তানের পরাজয়

১৪৩২, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩ ১৪৩৩

লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০। ১৩*, সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩। ১৪৩৫ ঐ, পৃ. ১২৬-১২৭। ১৪৩৬ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৬১।

অনিশ্চিত ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।১৪৩৭ তাজউদ্দীনের এ সময়ে আর একটি আশংকা জন্মে যে, অনিবার্য পরাজয়ের মুখে পাকিস্তান বাহিনী কেবল ঢাকা নগরীর ওপর চরম আঘাতই হানবে না, উপরন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকেও হত্যা করতে পারে। ১৪৩৮ একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে আটক বিপন্ন বাঙালিদের মুক্তির বিষয়টিও বিবেচনায় স্থান পায়। বস্তুত বাংলাদেশ নেতৃত্বের নিকট অবিচ্ছেদ্য এই তিনটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ছিল।*৩* এসব আশংকা ও উদ্বেগের কথা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ডি.পি. ধরকে জানানাে হয়। কিন্তু তখন পর্যন্ত ভারতীয় নেতৃত্ব সপ্তম নৌবহরের বিষয়টি বিবেচনায় আনেন নি। পরবর্তীকালে ডি.পি, ধর স্বীকার করেন যে, বিষয়টি বাংলাদেশ নেতৃত্বই প্রথম অনুধাবন করেন। বস্তুত উপমহাদেশের সংকটে সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ১২ নভেম্বরের পূর্বেই পারমাণবিক শক্তিচালিত পৃথিবীর বৃহত্তম রণতরী ইউ.এস.এস, এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করাসহ একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে যাতে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে উপমহাদেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি গড়ে তােলা সম্ভব হতে পারে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানাে হয় যে, লক্ষ্যসমূহ অর্জিত হতে পারে কেবল অভাবনীয় পথে অগ্রসর হয়ে দ্রুত ঢাকা দখল, বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পলায়নপর সকল পাকিস্তানি সৈন্যের পলায়নপথ রুদ্ধ করে দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধবন্দী করার মাধ্যমে। পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে তাতে ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণের মুখে ঢাকা রক্ষার কোনাে ব্যুহ রচনার জন্য প্রয়ােজনীয় সৈন্য পুনঃ একত্রীকরণ। অসম্ভব বলে বিবেচিত হয়। কেননা মুক্তিবাহিনীর ধারাবাহিক সফল অভিযান ইতােমধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে দেয়। এমতাবস্থায় যৌথবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হলে অবরুদ্ধ এলাকার নির্যাতিত মানুষদের বিদ্রোহী শক্তি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে এবং পাকিস্তান বাহিনীর অবশিষ্ট সামরিক ক্ষমতা লােপ পাবে বলে অনুমান করা হয়। লক্ষ্য অর্জনের জন্য ভারতের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত তিন বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীকে ঢাকার দিকে ফিরে

———

১৪৩৭ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪। ১৯৩৮ এ, পৃ. ১৫৮। ১৪৩৯ ঐ, প, ১৫৯। | ঐ, পৃ. ১৬৬। এ বিষয়ে ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষ থেকেও জানা যায় যে, তারাও সেটা চিন্তা করেন নি। জেনারেল উবান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮। ১৪৪১ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৩। ১৯৪২ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯।

যাওয়ার অথবা সমুদ্রপথে স্বদেশের পথে পালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা সম্ভব বলে মনে করা হয়। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সেটাই ঘটে। | ইন্দিরা গান্ধী ইউরােপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের নিকট থেকে সহানুভূতিশীল সম্মতি পেলেও আমেরিকার বিরূপ মনােভাব লক্ষ করেন। ইন্দিরা গান্ধি নিক্সনকে মুজিব সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন করলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে তিন চার বছর অপেক্ষা করতে বলেন।১৯৪৫ তার প্রত্যাবর্তনের পর ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। বাংলাদেশ প্রশ্নে সফরকৃত দেশগুলাের দৃষ্টিভঙ্গি, পরবর্তী করণীয় বিষয় হিসেবে ভারতের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথকমান্ড গঠন, সর্বোপরি পাকিস্তান বাহিনীকে চূড়ান্ত আঘাত হানার ব্যাপারে আলােচনা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ডি.পি. ধর এবং তাজউদ্দীন আহমদ ভারতসােভিয়েত সহযােগিতা চুক্তির ন্যায় একটি ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এই সাক্ষাতের সময় ইন্দিরা গান্ধী এ ধরনের কোনাে চুক্তি না করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। ভারতের দিক থেকে এ ধরনের কোনাে চুক্তিতে উপনীত হওয়া তখন পর্যন্ত কূটনৈতিক কারণে অসুবিধাজনক ছিল। কেননা তখন পর্যন্ত কোনাে দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। এই আলােচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক মনােভাব ব্যক্ত করলেও চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে সুনিদিষ্ট কোনাে মন্তব্য না করার কারণে সম্ভবত তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম তেমন উৎসাহ নিয়ে

—–

১৪৪৩, ঐ, পৃ. ১৬১। ১৯৮৮ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্যত্র তিনি রাষ্ট্রনায়কদের সহানুভূতিসূচক মনােভাব লক্ষ করেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে এই প্রশ্নে জাতিসংঘে ভােটাভুটি শুরু হলে ভেটো ক্ষমতাধর ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য ভােটদানে বিরত থাকলে। ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য সেখানে National Press Club, Washington, এ Press Conference করেন। দেখুন, Salam Azad, Contribution of India in the War of Liberation of Bangladesh (Dhaka: Ankur Prakashani, 2003), pp. 227238. ১৪৪৫ শাহরিয়ার কবির, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত’, জনকণ্ঠ, ১৩ মার্চ, ১৯৯৬। ১৪৪৮, এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৫।

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।

মুজিবনগর কার্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন নি।১৪৪৮ তবে এটা ছিল সাময়িক ব্যাপার। তার প্রত্যাবর্তনের দু দিন পরে ডি.পি. ধর কলকাতা এসে ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন।১৪৪৯ এ সময় উভয় সরকারের মধ্যে মূলত মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করে কিভাবে নতুন বাংলাদেশের কাজকর্ম শুরু করা যায় সে বিষয়ে আলােচনা হয়। ১৪৫০একই সময় ইন্দিরা গান্ধীর দপ্তরের বিশিষ্ট কর্মকর্তা ডি.কে, ভট্টাচার্য কলকাতায় পৌছে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বিভিন্ন সহযােগিতামূলক বিষয়ে আলােচনায় মিলিত হন। বলা চলে, এরপর বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম শুরু হয় বিজয়ােত্তর দেশ পুনর্গঠন ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কাজের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য কয়েকটি সচিব কমিটিও গঠন করা হয়। এগুলাে ছিল: ১৯৫২ বেসামরিক প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন ও পুনঃনির্মাণ, বিজয়ােত্তর বাংলাদেশের সার্বিক পুনর্গঠন, যুদ্ধাপরাধিদের বিচার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি।

চূড়ান্ত যুদ্ধ

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে নামার জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘােষণার ক্ষেত্রে ভারতের কূটনৈতিক দিক থেকে কিছু অসুবিধা তখনও রয়ে যায়। তা করলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে, ভারত আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ছিল অবধারিত। তাই প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘােষণা না করে সীমান্ত এলাকাতে মুক্তিবাহিনীকে সহযােগিতা প্রদান করা হতে থাকে। কোথাওবা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। করে। এ প্রচেষ্টা অনেক আগে শুরু হলেও নভেম্বর মাসে এর বিস্তৃতি ঘটে। ১২ নভেম্বরের পূর্বেই যশােরের ধর্মদহ, ১০ নভেম্বরের পূর্বে কুমিল্লার বিলােনিয়া, ১৩

———-

১৪৪৮ “…আমরা যারা সদর দফতরের প্রবেশপথে অপেক্ষমাণ ছিলাম নেতৃবৃন্দের আসার পথ চেয়ে, লক্ষ্য করলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মুখ মলিন। গাড়ী থেকে নেমে আমাদের প্রতি ম্লান হাসি দিয়ে আপনারা কেমন আছেন’- শুধু এ কথাটুকু বলেই নিজ দফতরের দিকে চলে গেলেন। আমাদেরও বুঝতে বাকি রইলাে না যে খবর ভালাে নয়।” নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫। ১৯৪৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬২-১৬৩ ১৪৫০ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৬-৩১৭। ১৪৫১, ঐ, পৃ. ৩১৯-৩২২। ১৯৫২, ঐ, পৃ. ৩১৭।

নভেম্বর খুলনার বয়রা এলাকা ভারতীয় বাহিনী দখল করে নেয়। ভারতীয় বাহিনী ২১ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে যশােরের চৌগাছা সীমানার মধ্যে ভারতীয় তিনটি ট্যাংক বিকল হয়ে পড়ে।১৪৫৩ একইভাবে ২০-২৫ নভেম্বরের মধ্যে সিলেটের অষ্টগ্রাম ও জকিগঞ্জ, জয়পুরহাটের হিলি ও দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করে। যুদ্ধে কোথাও কোথাও ভারতীয় বাহিনী কামান ও ট্যাংকের পাশাপাশি মিগ বিমান ব্যবহার করে। ভারত স্পষ্টত সরাসরি যুদ্ধ ঘােষণার ঝুঁকি গ্রহণ করার বিষয়ে সংকটে পতিত হয়। কিন্তু বেসামাল ইয়াহিয়া খান ২২ নভেম্বর ১০ দিনের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ঘােষণা প্রদান করলে ভারতের সে সংকট দূর হয়। বস্তুত ভারত যা প্রত্যাশা করেছিল পাকিস্তান তাই করে বসে। কোন্ বিবেচনা থেকে এ আক্রমণের আগাম ঘােষণা প্রদান করা হয় তা পরিস্কার ছিল না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত যুদ্ধের সূচনার মাধ্যমেই বহুল কাক্সিক্ষত বিজয় লাভের সম্ভাবনা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ সরকার ঘন ঘন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে মিলিত হয়ে দেশমুক্ত হওয়ার পর প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন ও পুণর্গঠনের জন্য সচিবদের সমবায়ে সাবকমিটি গঠনসহ প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সচিবদের সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন। ৯ জন সচিবের সকলের উপস্থিতিতে এই বেঠকে তিনি যুদ্ধের সময় সমাগত বলে অভিহিত করেন। যুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলেও সকলকে নেতৃত্বসুলভ বক্তব্য দিয়ে যুদ্ধে আহ্বান জানান।

Gentleman, you joined us under the exigency of circumstances. Now you will have to take a decision about your future… This war may end in five weeks or five months

or five years or fifteen years, we do not know. | এর আগে ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে অত্যাসন্ন বিজয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করে জাতির উদ্দেশে ভাষণদান করেন। তিনি বলেন যে, মুক্তিবাহিনী আজ দেশের যে কোনাে স্থানে শক্রর যে কোনাে ঘাঁটিতে আঘাত হানতে সক্ষম । শত্রুরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে । তাই দিশেহারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালির অত্যাসন্ন বিজয়ের দিক।

——-

১৪৫৩ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭। ১৪৫৪* সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮। ১৪৫ই ঐ, পৃ. ১৫৩। ১৪.৫৬ ঐ, পৃ. ১৬৭। ১৪৫৭

Dr. T. Hossain, op.cit., pp. 534.

৪৬৪

থেকে অন্যত্র দৃষ্টি সরানাের অপচেষ্টা হিসেবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে প্রবৃত্ত হয়েছে। তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে এখনও বন্দী। তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হলাে শত্ররা যাতে কোনভাবে পালিয়ে না যেতে পারে তজ্জন্য তাদেরকে বন্দী করে শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে হবে। সকল স্তরের সরকারি কর্মচারি-কর্মকর্তা যারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে সাহায্য করছেন, তাদের সময় হয়েছে শত্রুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করার। আর যারা তা না করবেন তাদের পরিণতি ও শত্রুর পরিণতি হবে অভিন্ন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অশেষ ত্যাগের প্রয়ােজনীয়তা ও এর চরম লক্ষ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রনায়কোচিত যে বক্তব্য জাতির উদ্দেশে প্রদান করেন তাতে তার রাষ্ট্রচিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। তিনি বলেন:১৪৫৮

অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরাে আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবনদানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগত। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি, তার উপরে। শক্ৰসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদেরকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম । আমাদের আজকের সংগ্রাম সে দিনই স্বার্থক হবে, যে দিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ তখন বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করবেন সেখানে সকল সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।

তাজউদ্দীন আহমদ বক্তব্যে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন। পরবর্তীকালে শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের সংবিধানে জাতীয়তাবাদকেও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে যুক্ত করেন। কোনাে কোনাে সমালােচক একথা বলার চেষ্টা করেন যে, যুদ্ধের ব্যাপারে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি নির্ভরশীল থাকার কারণে বিশেষত ধর্মনিরপেক্ষতা ও

——-

১৯৫৮ সম্পূর্ণ ভাষণটির জন্য দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ১৫২-১৫৪।

সমাজতন্ত্রকে মৌল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।১৯৫৯ কিন্তু এক্ষেত্রে বিবেচনা করা দরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঐতিহাসিক যে সংগ্রাম। করেছিল তার স্বরূপ কি? তাতে কি উক্ত মৌল নীতি নিহীত ছিল না? এসব বিষয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণেই রাষ্ট্রের মৌল নীতির কথা উল্লেখ করা হয়। তার কিছু পরে যুদ্ধে সােভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্ত্ব স্পষ্ট হতে শুরু করে। সুতরাং সােভিয়েত ইউনিয়নের কারণে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছিল এ কথা ঠিক নয়। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধে সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি উপাদান ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের উৎসমূল থেকে সকল কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। তাই বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও নিজের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তিতে উল্লিখিত মৌল নীতিগুলাে গ্রহণ করেছিলেন। আর মুক্তিযুদ্ধ যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত এর প্রধান শ্লোগান ‘জয় বাংলা’-র সঙ্গে কোনাে ধর্মের সম্পর্ক ছিল না, অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষ কোনাে ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল না তারা ছিল বাঙালি।

| বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আগস্ট-নভেম্বরের মধ্যে সংঘটিত উপযুক্ত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের অন্য দুটি যুদ্ধ থেকে এই তৃতীয় যুদ্ধটি ভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় তা কেবল উভয়পক্ষের সামরিক শক্তি ও যুদ্ধপরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। এই যুদ্ধের অভিঘাত বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘে গিয়ে আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের মতাে একটি বিশ্বজনীন সংস্থায় যেমন কূটনৈতিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় তেমনটি আর কখনাে দেখা যায়নি। পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিগত ন্নিতার কারণে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা একটা স্বাধীন জাতিসত্ত্বায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালেও তা স্পষ্টত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরােধ ও শক্রতায় পর্যবসিত হয়। জাতিসংঘ সনদে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশ স্বীকৃত বিষয় হলেও তখন পর্যন্ত কোনাে রাষ্ট্রকাঠামাে থেকে বেরিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া। এটাই প্রথম ঘটনা। কাজেই ধারণাটির বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সমস্যা তাে ছিলই, উপরন্তু দ্বিমেরু বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য এবং উল্লিখিত প্রবল কূটনৈতিক

——

১৪৫৯ আনিসুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমির হােসেন আমু (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ.

৩৮।

প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এটা সুকঠিন কাজে পরিণত হয়। সুতরাং বাঙালির সূচিত মুক্তিযুদ্ধ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরােধে এবং শেষাবধি তা জাতিসংঘে আমেরিকা ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার কূটনৈতিক যুদ্ধে পরিব্যাপ্ত হয়। একই সঙ্গে এটা ছিল এশিয়ার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযােগিতা।

পূর্ব ঘােষণা মােতাবেক পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। পাকিস্তানের সামরিক ক্ষেত্রে করার তেমন কিছু ছিল না। এ প্রসঙ্গে পাকিস্ত নের সেনাবাহিনীর ষ্টাফ প্রধান লে. জেনারেল গুল হাসান পরবর্তীকালে লিখেছেন:১৪৬০

প্রেসিডেন্টের সাথে এক বৈঠকে বসলাম ৩০ নভেম্বর । আমাকে বলা হলাে ৩ ডিসেম্বর ভাের রাতে আমাদের প্রাথমিক আক্রমণ শুরু করতে হবে। তার আগে পিএএফ পূর্ব পাঞ্জাবে শত্রুর বিমানঘাঁটিগুলাের ওপর হামলা চালাবে। ৩ ডিসেম্বর দিনটির কি মাহত্যু ছিল জানি না, তবে একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। সেটা হলাে, আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। ২১ নভেম্বর ভারতের প্রকাশ্য হামলা শুরু হওয়া সত্ত্বেও মনস্থির করতে দু’সপ্তাহ সময় লেগে গেছে আমাদের। অবশ্য ২১ নভেম্বরে ভারতের হামলা প্রকাশ্য ছিল না এবং তখন পাকিস্তান প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলে সামরিক দিক থেকে ভিন্নতর ফল হতে পারতাে বলে মনে হয় না। কেননা তাদের সত্যিকার অর্থে কোনাে সামরিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছিল বলে জানা যায় না। ভারত নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সীমান্ত এলাকায় যে সামান্য আক্রমণ চালায় তাকে প্রতিহত করার জন্য নিয়াজী তৎপর হয়ে ওঠেন এবং মনে করেন যে, ভারতীয় আক্রমণের গতিধারাকে বদলে দিতে পেরেছেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত ভারত সত্যিকার আক্রমণ শুরুই করে নি ১৪৬১ | ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি জনসভায় ভাষণ দান করেন। তার সফর অবশ্য অজ্ঞাত কারণে একদিন এগিয়ে নেয়া হয়। সাধারণ মানুষের ধারণা জন্মে যে, ঐদিন হয়তােবা ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে কিংবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘােষণা করতে যাচ্ছে। জনসভায় বক্তৃতাদান শেষে রাজভবনে অবস্থানকালে তিনি পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণের সংবাদ পান।

——-

১৯৬০ লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬। ১৯৬১ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬। ১৯৬২. লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২।

ভারতের অমৃতসর, আম্বালা, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর, উত্তরলাই, যােধপুর, আগ্রাসহ বেশ কয়েকটি বিমানঘাটি আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পেয়ে জরুরি ভিত্তিতে তিনি দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা মন্ত্রীদের দিল্লি ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী অনতিবিলম্বে মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ততক্ষণে ভারতের রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন। অতঃপর মধ্যরাতের কিছু পরে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত বেতার ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন “আজকে বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধ আমার সরকার ও ভারতের জনগণের ওপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। দেশকে যুদ্ধ মােকাবিলা করার জন্য তৈরি করা ছাড়া আর অন্য কোনাে বিকল্প ব্যবস্থা নেই । আমাদের জোয়ান এবং অফিসারদের দেশের প্রতিরক্ষার জন্য সীমান্তে পাঠানাে হয়েছে। সমগ্র ভারতে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয়েছে। প্রয়ােজনীয় প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা যে কোনাে আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত।১৪৬৩° ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু করার পর পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বিমান আক্রমণ লক্ষ করা যায়। ৩ ডিসেম্বর রাতেই ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকার ওপরে আঘাত হানে। ঢাকায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১৪ টি জঙ্গী বিমান থাকলেও তা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে। কেননা ঐগুলাে রাতের বেলায় কার্যক্ষম ছিল না। বাংলাদেশে বিমান আক্রমণের ক্ষেত্রে ভারতের লক্ষ্য ছিল পাকিস্ত েিনর এয়ারফিল্ডের রানওয়েসমূহ অকেজো করে দেয়া, যাতে পি.আই.এ-এর বিমানগুলাে ব্যবহার করা না যায় অথবা পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা যেন বিমানে করে পালিয়ে যেতে না পারে।৬৫ ৩ ডিসেম্বরের পূর্বেই পাকিস্তানের নৌবাহিনীর গর্ব গাজী’র সলিলসমাধি ঘটে। ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পাকিস্তান নৌশক্তি হারিয়ে ফেলে। ভারতের স্থলবাহিনী চারটি অঞ্চল থেকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়। এগুলাে হলাে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নােয়াখালী অভিমুখে, (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩ তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে, (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশাের-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিং-ঢাকা অভিমুখে রওনা দেয় ।

—–

১৪৬৩, মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮। ১৪৬৪*, ঐ, পৃ. ১৩৮। ১৯৯ই লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪। ১৪৬৬ লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।

বাংলাদেশ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্য এই যুদ্ধের জন্যই অপেক্ষা করা হয়। ৪ ডিসেম্বর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাক্ষরিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বানসম্বলিত একটি পত্র পাঠানাে হয় ভারত সরকারের নিকট। এতে ভারতবাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়। এই পত্রের অংশবিশেষ নিমরূপ:০৬

Madam Prime Minister, we have the honour to inform you that in view of the direct aggression comitted by Pakistan against your country on the 3 of December, the freedom forces of Bangla Desh are ready to fight the aggrassive forces of Pakistan in Bangla Desh, in any sector or in any front. Our joint stand against military machinations of Pakistan would be further facilited, if we enter into formal diplomatic relations with each other. May we, therefore, repeat our request to your Excellency that the Government of India accord immediate recognition to our country and our Government We should like to take this opportunity to assure your Excellency that the Government of India and the People of Banga Desh stand solidly with you in this hour of peril and danger to both countries. It is our earnest hope that our joint resistance to the nefarious plans and intentions of president Yahya Khan will

be brought to a successful conclusion. | এর জবাবে ভারত সরকার বাংলাদেশকে ৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে।৬৮ বহুল প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে ভারতের এই স্বীকৃত দানের মাধ্যমে বিশ্বের কূটনৈতিক দরবারের নতুন একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এর মাধ্যমেই দু দেশের মধ্যে প্রথম স্বীকৃত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। স্বীকৃতি দানের সংবাদ মুজিবনগর সরকারের প্রধান কার্যালয়ে ও মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্পে। অনাবিল আনন্দের শিহরণ বয়ে আনে। এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মিষ্টান্ন। বিতরণের মাধ্যমে। কিন্তু আনন্দের মধ্যেও বিষাদের অনুভূতি প্রকাশিত হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যে। আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র।

১৪৬৭ Bangladesh Documents, Vol. two, p. 587.

১৪৬৮ Ibid, pp. 587-588.

৪৬৯

কিন্তু প্রথম শিশুর কান্না শুনে জন্মদাতা পিতার যে অনুভূতি হয়, তেমনি খুশি হতে পারতেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত থাকলে।১৪৬৯ ৭ ডিসেম্বর এক প্রকার বিনাযুদ্ধে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাটি যশােরের পতন ঘটে। এর আগে ৫ ডিসেম্বর দর্শনা ও কোটচাঁদপুর যৌথবাহিনীর দখলে আসে। ৭ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ এবং ৮ ডিসেম্বর মধুমতি ফেরিঘাট দখল করে নেয়। যৌথবাহিনী । ৬ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট দখলে আসে। ৭ ডিসেম্বর পীরগঞ্জ, ৯ ডিসেম্বর পলাশবাড়ি এবং ১০ ডিসেম্বর গাইবান্ধা ও ফুলছড়িঘাট এবং ১১ ডিসেম্বর গােবিন্দগঞ্জ দখলে নেয় যৌথবাহিনী। শত্রুর শক্ত প্রতিরােধ ভেঙ্গে ৬ ডিসেম্বর বিমান আক্রমণের মাধ্যমে যৌথবাহিনী কুলাউড়ার দখলে নেয়। ১১ ডিসেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ দখলে আসে, কিন্তু শত্রুর শক্তিশালী সিলেট গ্যারিশন শক্ত অবস্থান গ্রহণ করায় ৯ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদেরকে ঘেরাও করে রাখতে হয়। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথবাহিনী মেঘনার তীরবর্তী প্রধান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ। স্থান- আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি ও চাঁদপুরের দখল নেয়। এর ফলে যৌথবাহিনীর পূর্বদিক হতে ঢাকায় প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। শক্রর আর একটি শক্ত ঘাটি ময়নামতিকে সরাসরি দখলে নেয়ার চেয়ে একে অন্তত দু দিক থেকে ঘিরে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে বার্মায় বর্তমান মিয়ানমার পালিয়ে যেতে না পারে ৯ ডিসেম্বর সে নির্দেশ প্রেরণ করেন জেনারেল মানেকশ’ । ১২ ডিসেম্বর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড জামালপুরের দক্ষিণে পৌছায়। এর একদিন। আগে মধুপুর অঞ্চলে প্রায় সাত শত প্যারাট্রুপার নামানাে হয়। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয় যে, ৫০০০ হাজার প্যারট বাহিনী নামানাে হয়েছে। এতে পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে পড়ে। প্যারশু্যট বাহিনী ঢাকা অভিমুখী। পাকিস্তান বাহিনীকে পিছনের দিক থেকে আঘাত হানে। উল্লেখ্য যে, কাদের। সিদ্দিকির বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে তাড়া করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। বস্তুত পাকিস্তান বাহিনী কোথাও তেমন প্রতিরােধ গড়ে তুলতে

———

১৯৬৯, আমার জীবদ্দশায় আজ বাঙালি জাতির লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে । জাতির এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলার একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি । আজ এটাই আমার বড় সান্ত্বনা । কিন্তু নব্যাগত শিশুর প্রথম কান্না শুনে যিনি আজ সব চেয়ে বেশি খুশি হতেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি আজ পাকিস্তান জল্লাদ বাহিনীর হাতে বন্দী ।” উপেন তরফদার বেশ কিছু প্রশ্ন করেন তাজউদ্দীন আহমদকে। সব প্রশ্নের জবাব প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেন। নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮-১৮০। ১৪৭০ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৭।

পারেনি। যেখানে যেখানে মৃদু প্রতিরােধের সম্ভাবনা দেখা দেয় সেগুলােকে হয় পাশ কাটিয়ে অথবা অবরােধ করে রাখে যৌথবাহিনী। স্থলবাহিনীর অগ্রাভিযানের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় বিমানবাহিনীর একপাক্ষিক পুনপৌণিক আক্রমণ। যুদ্ধ শুরুর প্রথম তিন দিনের মধ্যে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর কার্যক্ষমতা লােপ পেয়ে যায়। প্রথম দু দিন তারা অতিমাত্রায় উড্ডয়ন ও গােলা খরচ করে ফেলে, যা পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যয় বলে গণ্য হয়।১৪৭১ পক্ষান্তরে ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রথম দু দিন তাদের লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। কিন্তু তৃতীয় দিন ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়েতে গুরুত্বপূর্ণ সংযােগস্থলগুলােতে ৫০০ কিলােগ্রামের অর্ধডজনেরও বেশি বােমা নিক্ষেপ করে। এক একটি বােমা সহস্রাধিক মিটার দূরত্বে পড়ে। এর ফলে রানওয়েতে প্রায় পুকুরাকৃতির বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়। একইভাবে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমান বন্দরটিকেও অকেজো করে দেয়া হয়। কার্যত এভাবে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কর্মক্ষমতার পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর ভারতীয় বিমান অবাধে পাকিস্তান স্থলবাহিনীর। অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়ে যেতে থাকে। | পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনী বলতে গেলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পরাজিত হয়। যুদ্ধ করার মতাে যথেষ্ট পরিমাণ গােলাবারুদ থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র মানসিক বল ও সুষ্ঠু যুদ্ধ পরিকল্পনার অভাবহেতু পাকিস্তান বাহিনী অতি দ্রুত এই পরিণাম বরণ করতে বাধ্য হয়। ব্যর্থতার কারণ হিসেবে পরাজিত জেনারেল নিয়াজী জেনারেল হেড কোয়াটার্সকে দায়ী করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনাে অফিসারই নাকি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের খোঁজখবর নিতে আসেননি। তাছাড়াও চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিকল্পনায় কোনাে সময় ছিল না এবং পশ্চিম পাকিস্তানকেই গুরুত্ব প্রদান করা। হয়; পূর্বাঞ্চলের জন্য বলা হয় শীগ্রই চীনা সাহায্য এসে পৌছাবে। ৭৮ | পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনী প্রারম্ভিক কিছু সাফল্য লাভ করলেও ৬ ডিসেম্বর নাগাদ তারা ভারতীয় বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু সরে যেতে বাধ্য হয়। রাজস্থান-সিন্ধু সীমান্তে বরং ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়। করাচীর ওপর ভারতের নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে।*৭ই দুই

———–

১৪৭১ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৮-১৩৯। ১৪৭২. সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯। ১৯ লে.জে.এ.এ.কে. নিয়াজী, দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান, সাহাদত হােসেন (অনু.) (ঢাকা: সমুদ্র, ২০০৩), পৃ. ১৪৭। ১৪৭. এ, পৃ. ১৫৩-১৫৪। ১৪ ই লে. জেনারেল গুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭-৮০।

ফ্রন্টেই তাদের বিপুল বিজয় অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ৮ ডিসেম্বর ভারত ঘােষণা প্রদান করে যে, পাকিস্তান যদি পূর্বাঞ্চলে তার পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পণ করে তাহলে ভারত দুই ফ্রন্টেই যুদ্ধ বন্ধ করতে প্রস্তুত। কেননা অন্যের ভূমি দখলের কোনাে ইচ্ছা তার নেই।১৯৭৬

জাতিসংঘে পরিব্যাপ্ত কূটনৈতিক যুদ্ধ

পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করার জোর চেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের চেয়ে আমেরিকার গরজ ও তৎপরতাই অধিক পরিলক্ষিত হয়। নিজ দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থার নিকট প্রত্যাখ্যাত হয়ে কিসিঞ্জার নিউইয়র্কে জাতিসংঘে চীনের প্রতিনিধির দ্বারস্থ হন। তার ভাষায় চীনা প্রতিনিধিকে মার্কিন উদ্যোগের খুঁটিনাটি বিষয়ে অবহিত করার জন্য ঐ গােপন মিশনে যান। এ ছাড়াও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উপমহাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিষয়েও আলােকপাত করেন। কিন্তু তিনি সেখানে তেমন উৎসাহব্যঞ্জক কোনাে সাড়া

পেয়ে ২৪ নভেম্বর আবার WSAG (Washington Speacial Action Group) এর স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু WSAG এর মত প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। এমতাবস্থায় কিসিঞ্জার যুক্তরাজ্যের স্মরণাপন্ন হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অপর দুই স্থায়ী সদস্যের মধ্যে ফ্রান্স ইন্দিরা গান্ধীর সফরকালে ভারতের প্রতি সহানুভূতিসূচক মনােভাব ব্যক্ত করে। কাজেই ব্রিটেনের কুটনৈতিক সাহায্য পাওয়ার আশায় ২৬ নভেম্বর সেখানকার প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে টেলিফোন আলােচনা করেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। প্রধানমন্ত্রী হীথ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকার ব্যাপারে উৎসাহ না দেখানাের কারণে ২৯ নভেম্বর কিসিঞ্জার আবার চীনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন প্যারিসের একটি মাধ্যমের সহায়তায়। চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলােচনার সময় কিসিঞ্জার স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব হুমকির মুখে। এমতাবস্থায় আমেরিকা, চীন ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের পাকিস্তানের জন্য যথাসাধ্য করা উচিত। এ পর্যায়ে চীনা প্রতিনিধি মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য ভারত যে চেষ্টা চালাচ্ছে তা সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তান

——-

১৪৭৬, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৮। ১৯৭৭ ঐ, পৃ. ১৭২। ১৪৭৮ ঐ, পৃ. ১৭৩।

–নের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড।১৪৭৯ কিন্তু করণীয় বিষয়ে তিনি কোনাে মন্তব্য করা হতে বিরত থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স বিভাগ উদ্ভুত। পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট চীনের পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দানের সক্ষমতা নিরুপন করে। সার্বিক মূল্যায়নে বেরিয়ে আসে যে, পিকিং আপাতত রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রচারণামূলক তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাসাধিককাল পূর্বে আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট ১৯৫৯ সালের পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিকভাবে সম্পাদিত চুক্তির ১ নং ধারা উল্লেখ করেন। এতে বাংলাদেশ প্রশ্নে সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে আমেরিকার সরসরি সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। এই সুত্র ধরে ২ ডিসেম্বর আমেরিকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত রাজা প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা ইয়াহিয়ার একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। এতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অত্যাসন্ন সংকটে আমেরিকার করণীয় বিষয়ের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি উল্লিখিত হয়। বহুপূর্বে সম্পাদিত অকার্যকর এ ধরনের একটি চুক্তিকে সামনে এনে পাকিস্তান ও আমেরিকা ভারতকে এক প্রকার হুমকি প্রদর্শন করে। এ ব্যাপারে সরাসরি আমেরিকার সম্পর্কিত হওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে হলে ভিয়েতনাম ও ফিলিপিনস্ উপকূলে অবস্থিত পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত রণতরী সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে আনার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার মাধ্যমে ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নিক্সন ও কিসিঞ্জার এতটাই গুরুত্বারােপ করেন যে, পাকিস্তান ভারত আক্রমণের মাত্র দু ঘন্টার মধ্যে WSAG এর বৈঠক শুরু হয়। এই বৈঠকে। যথাশীঘ্র সম্ভব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানসহ ১৯৫৯ সালের উল্লিখিত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কিসিঞ্জারের আগ্রাহাতিশয্য প্রকাশ পায়। ৪ ডিসেম্বর কিসিঞ্জারের প্রত্যাশিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হয় । বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে চলমান পাকিস্তান

———

১৯৭৯ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ৬. জুলাই,২০০৩। ১৪৮০ এ, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৩। ১৯৮৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬। 3862 Henry Kissinger, op.cit., p. 894.

** চুক্তিটিতে পাকিস্তানকে সাহায্যদানের কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই বলে উক্ত বৈঠকে আলােচনা করা হয়। কিন্ত কিসিঞ্জার উপমহাদেশে আমেরিকার স্বার্থরক্ষার নামে পাকিস্ত নিকে যেভাবে সাহায্য করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন, তাতে মনে হয় এ ব্যাপারে তার ওপরেই সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে । Ibid, pp. 894-895.

বাহিনীর নির্বিচার ও নজিরহীন গণহত্যার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সামান্যতম মাথা ব্যথা হয়নি। বাংলাদেশে যা ঘটে তার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ীই ব্যবস্থা। গ্রহণে কোনাে বাধা ছিল না। নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক শুরু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ অবিলম্বে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমানার ভিতরে ফিরিয়ে নেয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার তদারকির জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব করেন।১৪৮৪ কিন্তু প্রস্তাবটিকে একপেশে’ আখ্যায়িত করে সােভিয়েত ইউনিয়ন এতে ভেটো প্রয়ােগ করে। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পােল্যান্ডও বিপক্ষে ভােটদান করে। ভােটদানে বিরত থাকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স । পরদিন ৫ ডিসেম্বর সােভিয়েত ইউনিয়ন বিকল্প একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এতে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়ােজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের নিশ্চিত অবসান ঘটবে। একমাত্র পােল্যান্ড সােভিয়েত ইউনিয়নের এই প্রস্তাবের পক্ষে ভােটদান করে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবটিতে ভেটো প্রয়ােগ করে। নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাে ভােটদানে বিরত থাকে। নিরাপত্তা পরিষদে চীন মাত্র ৪০ দিন পূর্বে প্রাপ্ত ভেটো ক্ষমতার প্রথম প্রয়ােগ করে পরােক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। একই দিন (৫ ডিসেম্বর) ৮টি দেশের পক্ষ থেকে আমেরিকার প্রস্তাবের অনুরূপ। আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন সঙ্গত কারণেই এই প্রস্তাবে তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়ােগ করে। সােভিয়েত ইউনিয়নের বার্তাসংস্থা তাস এ সময় একটি সংবাদ পরিবেশন করে যাতে উপমহাদেশের সংকটের জন্য পাকিস্তানকে সর্বাত্মক দায়ী করে বলা হয় পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানই গ্রহণযােগ্য। বর্তমান সংঘর্ষটি সােভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে হওয়ায় তার জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেও মন্তব্য করা হয়। পরিস্থিতির অবনতি রােধকল্পে বিদ্যমান পক্ষদ্বয়ের কোনােটির সঙ্গে জড়িত না হওয়ার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। সােভিয়েট ইউনিয়নের এই প্রস্তাবটি ভারতীয় ইচ্ছার প্রতিফলন বলে যুক্তরাজ্যের জাতিসংঘ প্রতিনিধি কলিন ক্রো মন্তব্য করেন। তবে বেলজিয়াম, জাপান ও ইটালী একটি এবং আর্জেন্টিনা, বুরুন্ডি, নিকারাগুয়া,

—–

১৪৮৪* নিরাপত্তা পরিষদে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বক্তব্য বিষয়ে দেখুন, মাসুদা ভাট্টি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৩-১৯৫। ১৯৮র মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১। ১৯৮৬, মাসুদা ভাট্টি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫। ১৪৮৭ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮২।

৪৭৪

সিয়েরা লিওন, সােমালিয়া আর একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এমতাবস্থায় যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি ফ্রান্সকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। ১৪৮৮ অন্যদিকে সােভিয়েট ইউনিয়ন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এই প্রথম অতি স্পষ্ট ও জোরালাে মনােভাব ব্যক্ত করে যাতে পরাশক্তিধর এই দেশটি কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত তা পরিস্কারভাবে ব্যক্ত হয় । এমতাবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্যের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরাসরি ভারত ও বাংলাদেশবিরােধী এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সতর্কভাবে নিরপেক্ষ থাকে যা পরােক্ষভাবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে সহায়ক হয়। | নিরাপত্তা পরিষদে কাক্ষিত ফললাভে ব্যর্থ হয়ে কিসিঞ্জার ৬ ডিসেম্বর WSAG এর বৈঠকে আবার মিলিত হন। এবার তিনি যুদ্ধ বিরতির উপায় অন্বেষণে নানাবিধ প্রশ্নের অবতারণা করেন। এছাড়াও তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ পরিষদের উদ্যোগে যুদ্ধ বিরতির একটা প্রচেষ্টার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। ঐ বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদে ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বনকারী সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলা হয় সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতকে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় না করে তবে পরবর্তী মে মাসে প্রস্তাবিত সােভিয়েত-মার্কিন। শীর্ষ বৈঠক করা সম্ভব হবে না। ৬ ডিসেম্বর WSAG বৈঠকে সি.আই.এ. প্রধান রিচার্ড হেলস একটি সমীক্ষার বরাত দিয়ে বলেন যে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী এক চূড়ান্ত অবস্থায় পৌছাতে পারবে। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, কিসিঞ্জার WSAG এর আনুকূল্য লাভে বেশ সচেষ্ট এবং যে কোনাে মূল্যে আমেরিকার সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত তিনি আশা করেন। এ অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত রণতরী সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করার প্রয়ােজনীয় অনুমােদন লাভের জন্য তিনি তৎপর হন। ভারত সরকার অন্তত নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহের গােড়ার দিকে গােপনসূত্রে জানতে পারে যে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার মার্কিন রণতরী সপ্তম নৌবহরের গতিপথ বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার চেষ্টায় আছেন। এছাড়া আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনাে বিকল্প খােলা ছিল না। আমেরিকার জনমতকে উপেক্ষা করে সামরিক হস্তক্ষেপের পাশাপাশি জাতিসংঘে পরবর্তী কূটনৈতিক

———

১৪৮৮ মাসুদা ভাট্টি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৬। ১৪৮৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩। ১৪৯০

ঐ, পৃ. ১৮৩। ঐ, পৃ, ১৭৪ ।

তৎপরতা অব্যাহত থাকে । ৮ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আমেরিকার ১২টি করণীয় নির্ধারণ করে। এগুলাের মধ্যে অন্যতম হলাে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে প্রেরণ, জর্ডান ও ইরানকে কিছুসংখ্যক যুদ্ধ বিমান প্রদান, যাতে ঐ রাষ্ট্র দুটো পাকিস্তানে ঐ ধরনের বিমান সরবরাহ করতে পারে, চীন যদি ভৌগােলিক শক্তির ভারসাম্য রক্ষার্থে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার প্রতি সমর্থনদান, ইরান, তুরস্ক ও থাইল্যান্ডে অবস্থিত মার্কিন বিমানঘাঁটিগুলাের শক্তি বৃদ্ধি করা প্রভৃতি।১৪৯২ এর কয়েক ঘণ্টা পূর্বে ৭ ডিসেম্বর রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, উভয়পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার এবং শরণার্থী প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বানসম্বলিত একটি প্রস্তাব পাশ হয় ১০৪-১১ ভােটে। সােভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে, ভারত ও ভুটান প্রস্তাবের বিপক্ষে ভােটদান করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভােটদানে বিরত থাকে। ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন এই দেশ দুটোর বরাবরই ভােটদানে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বিদ্যমান সংকটে তারা আমেরিকার সঙ্গে সুর মেলাতে নারাজ। নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরােধিতার মুখে কোনাে সুবিধাজনক প্রস্তাব গ্রহণ করাতে ব্যর্থ হওয়ার পর সাধারণ পরিষদে গৃহীত এ প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েই যায়। এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৯ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাহরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। নিক্সন ও কিসিঞ্জার উভয়ই স্মৃতিচারণে বলেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলা রােধ করার জন্য বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই রণতরীটিকে পাঠানাে হয়েছিল।”*° ১০ ডিসেম্বর নাগাদ জানা যায় নৌবহরটি চীন ও ভারত মহাসাগরের সংযােগকারী মালাক্কা প্রণালীর ওপারে এসে পৌছে । ওখান থেকে বঙ্গোপসাগরে পৌছাতে জাহাজটির আরাে ৪-৫ দিন সময়ের প্রয়ােজন। এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায় আমেরিকা সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তটি কার্যকর করার জন্য প্রয়ােজনে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করতেও পিছপা হবে না।

———–

১৪৯২, আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৩। ১৪৯৩ * বস্তুত ৪-১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ বন্ধের লক্ষে অনেকগুলাে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। একমাত্র সােভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত অন্যান্য রাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়নি। দেখুন, আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০; জাতিসংঘে বাংলাদেশ: খসড়া প্রস্তাব নং ১০,৪৫৩’, প্রথম আলাে, ২৬ মার্চ, ২০০২। ১৪৯৪ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯০।

মার্কিন রণতরীকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ প্রদান সংক্রান্ত। সংবাদটি দিল্লির সর্বোচ্চ সামরিক সভায় গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে মঈদুল হাসান লিখেছেন:১৪৯৫

রাত্রিতে দিল্লীর সর্বোচ্চ সামরিক মন্ত্রণাসভায় গভীর সংকটের আবহাওয়া বিরাজমান ছিল। প্রত্যাসন্ন বহিঃহস্তক্ষপের সমুচিত প্রতিবিধান নিদের্শের প্রশ্নে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চতর নেতৃবর্গের অধিকাংশ ছিলেন প্রায় নিরুত্তর। পাকিস্তান বাহিনীর শেষ প্রতিরক্ষার স্থল ঢাকাকে মুক্ত করার আগেই বাংলাদেশের উপকূলভাগে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী নৌবহর সমাবেশের আয়ােজন এবং সিকিম-ভূটানের উত্তর সীমান্তে চীনা সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিধি অসামান্যভাবে বিস্তৃত এবং এর পরবর্তী গতিধারা জটিল, অনিশ্চিত ও বিপদজনক

হয়ে ওঠে। ভারতের উক্ত আশংকার কারণ এই যে, শত্রুর গতিরােধের জন্য তখন পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত সাবমেরিনের উপস্থিতির কথা কিংবা অন্য কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল কিনা তা জানা ছিল না। মার্কিন নৌবহরের আগমন। সংবাদ ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বিচলিত করে বটে। কিন্তু তারা তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঠেকানাে ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যা কিছু সম্ভব তার সবই করে । নৌবহরটি যদি সত্যি বাংলাদেশ জলসীমায় প্রবেশ করে, তাহলে যেন ভূভাগের সঙ্গে সংযােগ স্থাপনে বাধাপ্রাপ্ত হয় তজ্জন্য স্থানীয় জলযানগুলাে জলের নিচে ডুবিয়ে দেয়া হয়।১৯৯৬ ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের জনগণকে আসন্ন বিপদের বিষয়ে সতর্ক ও প্রস্তুত হওয়ার আহ্বানসম্বলিত ভাষণ দান করেন।

মুজিবনগর সরাকরের প্রধান কার্যালয়েও আমেরিকার সর্বশেষ সিদ্ধান্তসমূহে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহে আশার আলাে দেখতে পান। এ বিষয়ে প্রধান সেনাপতির গণসংযােগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম লিখেছেন:

…প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব এতদিনকার বাকবিমুখতার অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কথা বলার জন্যে উন্মুখ। কোন কোন খবরের কথা বলছাে? মার্কিন রণতরী আসার কথা বলছাে তােমরা? আসুক। একটা কিছু ফয়সালা তাে হবে । হয় জিতবাে নয়তাে

——

১৪৯৫ ঐ, পৃ. ১৯৫। ১৬৯৬, ঐ, পৃ. ২০০। ১৯৯৭ ঐ, পৃ. ২০১।

নজরুল্ল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯-১৫০।

মরবাে । একটা কিছু তাে হবে। মার্কিন সেভেনথ ফ্লিট আসছে তাতে ভয়ের কি আছে, আসুক। …বহির্বিশ্বে এখন আমাদের মিত্র আছে। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের মােহনা হতে অক্ষত অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। সে ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি। সােভিয়েত ও ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্সপার্টরা ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢাকার মােহনায় পানির নিচে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মাইন পুঁতে রেখেছেন। ওরা আর ফিরে যেতে পারবে না। আমরা চাই তারা আসুক । এটা ভিয়েতনাম নয় । অন্যদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ৭ ডিসেম্বও থেকে পূর্বাঞ্চলে একের পর এক পাকিস্তানের ঘাঁটিগুলাের পতন ঘটতে শুরু করে । পূর্ব ও পশ্চিমের সর্বত্রই পাকিস্ত নি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং যৌথবাহিনীর অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়। ৭ ডিসেম্বর শক্তিশালী ঘাঁটি যশােরের পতন হলে নিয়াজী ও অপরাপর সুপ্রিম কমান্ডারদের মনােবল ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ে। ইস্টার্ন কমান্ড ৭ ডিসেম্বর গভর্নর আবদুল মােত্তালেব মালেককে দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট দূর্গত বার্তায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সাহায্য এসে না পৌছে তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তর বাঞ্ছনীয় বলে জানায়।১৫০০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের নিকট আত্মসর্মপণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার অনুরােধ জানিয়ে আর একটি বার্তা প্রেরিত হয়। বার্তায় জানানাে হয় পরিস্থিতি দারুণ সংকটজনক। আকাশে শক্রর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং স্থানীয় জনগণ তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে; তারা শত্রুদেরকে সর্বাত্মক সাহায্য করছে। এর জবাবে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে প্রেরিত বার্তায় সর্বাত্মক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গভর্নরকে দেয়া হয় ।” ওদিকে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার ব্যাপারে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির উদ্বেগ সর্বোচ্চ বিন্দুতে উপনীত হয়। এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় আমেরিকার কূটনৈতিক শিষ্ঠাচার বর্জিত হুমকি আর যতসব অকার্যকর সনদ ও চুক্তির কথা উল্লেখ করে পুণঃপুণ হুশিয়ারি উচ্চারণে। ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিসিঞ্জার আমেরিকায় অবস্থিত সােভিয়েত প্রতিনিধি ভরােনটসভকে (Vorontsov) টেলিফোন করে বলেন তিনি যেন তার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে হট লাইনে এ মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, আমেরিকার রণতরী বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে । তবে পারস্পরিক সহযােগিতার মনােভাব আমেরিকার শেষ হয়ে যায়নি। তাকে আরাে জানানাে হয়, ১২ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারত যদি যুদ্ধবিরতি

———

১৪৯৯ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮। ১৫০০ এ, পৃ. ১২৮-১২৯। ১৫০১. সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪-১৯৫। SOR. Henry Kissinger, op.cit., p. 910.

ঘােষণা না করে তাহলে আমেরিকা একাই চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণে অগ্রসর হবে।১৫০৩ একই দিন তিনি আর একবার হুয়াংহুয়ার (Huang Hua) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বুঝানাের চেষ্টা করেন যে, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে উপমহাদেশে শক্তির ভারসাম্য হারাবে যাতে চীনও ক্ষতিগ্রস্থ হবে ।১৭০* সুতরাং চীনের উচিত হবে সামরিকভাবে অগ্রসর হওয়া। জবাবে চীনের প্রতিনিধি চৌ এন লাইকে তার এ সংবাদ পৌছে দেয়ার আশ্বাস। ব্যক্ত করেন। যুদ্ধের পরে জানা যায় যে, আস্থা স্থাপন করা যায় চীনের এমন কোনাে সুত্র থেকে ভারত পূর্বাহ্নে চীনের সামরিকভাবে অগ্রসর না হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিল।৭০৫ ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ড রাওয়ালপিন্ডি কর্তৃপক্ষের নিকট আমেরিকা ও চীনের কথিত সাহায্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আরাে ৩৬ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলা হয়। বার্তাটি ভারতীয় সেনাবাহিনী যন্ত্রের সাহায্যে ধরতে সক্ষম হয় এবং কর্তৃপক্ষ চীনের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার বিষয়ে সুনিশ্চিত হয়।১৫০৬ | আমেরিকার রণহুংকার ও প্রায় কূটনৈতিক বিষয়ে শালীনতা বর্জিত হুমকির জবাবে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তুতি চলতে থাকে অজ্ঞাতে, প্রতিক্রিয়া ঘটে। সংক্ষিপ্ত অথচ চরম প্রত্যয়দীপ্তভাবে। জানা যায়, সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন ‘কসমস নামক একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছিল। ভারত মহাসাগর ও এর আশেপাশে তার নৌশক্তির তৎপরতা বাড়ানাে হয়। মার্কিন নৌবহরটি বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হওয়ার পূর্বেই সােভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক শক্তিচালিত অন্তত ৫ টি সাবমেরিনসহ মােট ১৬টি যুদ্ধ ও সরবরাহ জাহাজ বঙ্গোপসাগর ও তার আশেপাশে অবস্থান গ্রহণ

করে।১৫০৮

| আসন্ন বিপদে সােভিয়েত সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থনই কেবল ভারতকে রক্ষা ও বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে এই বিবেচনার পর সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির রূপকার

——–

১৫০৩. Ibid, p. 908. 38. Mizanur Rahman Shelly, op.cit., p. 106. ১৪০৭ জাওয়াদুল করিম, মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৮৭। ১৫০৬ লেজেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯। ১৪০৭ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫।

* মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪ ও জাওয়াদুল করিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭।

৪৭৯

ডি.পি. ধরকে মস্কো পাঠানাে হয় ১১ ডিসেম্বর।৭০৯ অন্যদিকে যুদ্ধটি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যে সােভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল বেশি। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের মধ্যেই যাতে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা সীমিত থাকে এবং পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন ভূভাগ। দখলে নেয়ার জন্য যাতে ভারত যুদ্ধকে প্রলম্বিত না করে তার নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে সােভিয়েত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেটসকভ দিল্লি পৌঁছেন।

সময়সীমা বেঁধে দেয়া উদ্ধত কিসিঞ্জারের হুশিয়ারির জবাবে নির্ধারিত সময়সীমার দু ঘণ্টা পূর্বেই সােভিয়েত ইউনিয়ন মূল বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানাের জন্য স্থাপিত হটলাইনে সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়: পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানের ভূ-ভাগ দখলের কোনাে ইচ্ছা ভারতের নেই । ১৫১০ সােভিয়েত ইউনিয়নের নিকট থেকে এ ধরনের সংবাদ পেয়ে নিক্সন ও কিসিঞ্জার হতাশ ও ক্ষিপ্ত হন। নিক্সন অভিযােগ তুলে বলেন, সােভিয়েত প্রতিশ্রুতিতে পাকিস্তানি কাশ্মীরের নিরাপত্তার বিষয় উল্লেখ নেই। বস্তুত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতীয় কাশ্মীরের কিছু এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়। এমতাবস্থায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল,কে, ঝা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে জানিয়ে দেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐসব এলাকা পুনর্দখল করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে ভারতের পক্ষে এ ধরনের নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। এতে কূটনৈতিক দিকটিও স্পষ্ট হয় যে, আপাতত ভারত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুমােদিত প্রস্তাবটি মেনে চলতে মােটেও রাজি নয়। ১২ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বলেন: ১৫১২

If the international comunity had willed and acted in time we would not have faced today the clouds of war which have now burst over the Indian sub-continent While the General Assembly made an appeal for cease-fire and withdrawal, there appears to have been no deliberation on whether such a cease-fire and withdrawal by itself would meet the immediate problems that today confront the people of India and Bangladesh, problems which we have attempted to meet with restraint, caution and peaceful means; problems

——–

১৫০৯ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৬।

ঐ, পৃ. ২০২। | ঐ, পৃ. ২০২। *** Salam Azad, op.cit., pp. 239-240.

which are not of our creation and which we have had to face

over the last nine months. হতবিহ্বল এই পরিস্থিতিতে চীনা প্রতিনিধি যখন পিকিং থেকে একটি জরুরি সংবাদ আসার কথা ও তা অবহিত হওয়ার জন্য কিসিঞ্জারকে নিউইয়র্ক যাওয়ার জন্য বলেন, তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জারের নিকট এর স্বকল্পিত অর্থ দাঁড়ায়পরিশেষে পিকিং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। সুতরাং তারা সােভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন না বলে স্থির করে বসেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি চীন আক্রমণ করে তাহলে তার। (সােভিয়েত ইউনিয়নের) বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু সংবাদটি যে ভিন্ন রকমের হতে পারে তা বিবেচনা করার মতাে অবস্থা ও মানসিকতা কোনটিই তাদের মধ্যে তখন অবশিষ্ট ছিল না। বস্তুত সংবাদটি আমেরিকার জন্য আশানুরূপ ছিল না। চীনের নেতা চৌ-এন-লাই জাতিসংঘ। নির্দেশিত যুদ্ধ বিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন মাত্র । ১২১৩ ডিসেম্বর চীনের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে সপ্তম নৌবহরের গতি ২৪ ঘণ্টার জন্য স্থগিত রাখা হয় মূলত জাতিসংঘ নির্দেশিত যুদ্ধবিরতি করা ও রাজনৈতিক উপায়ে সমস্যার সমাধানের শেষ সুযােগ মস্কোকে দেয়ার জন্য। সুতরাং বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি কেবল আর ভারত-পাকিস্তানের বিষয় থাকে না, তা বিবদমান পরাশক্তিদ্বয়ের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য রক্ষার যুদ্ধে পরিব্যাপ্ত হয়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে সংকটাপন্ন কূটনৈতিক অবস্থা। এই পর্যায়ে এসে দেশ দুটোর মধ্যে প্রায় সকল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। পরাশক্তিদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধের ডামাডােলের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটি কোথায় গিয়ে পােছাবে তা নিয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ও বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের নীতি নির্ধারকদের যথেষ্ট সংশয়ের জন্ম হয়। | চীনের সমর্থন আদায়ের জন্য তখন পর্যন্ত নিক্সন-কিসিঞ্জার আশাবাদী। শেষ সুযােগ দেয়ার জন্য ১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা যুদ্ধ বিরতির প্রস্ত বিটি আবার উত্থাপন করে। কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের তৃতীয় ভেটোর মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। ফলে সপ্তম নৌবহরকে আবার বঙ্গোপসাগরের দিকে চলতে নির্দেশ দেয়া হয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ হতে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে এবং নিক্সনের সর্বশেষ হটলাইনে প্রেরিত চরমপত্রের জবাবে ১৪

১৫১৩ Henry Kissiger, op.cit., p. 910. ১৫১৪, Ibid., p. 9ll

ডিসেম্বর প্রায় পূর্বের ন্যায় সােভিয়েট ইউনিয়ন জানায় যে উপমহাদেশের প্রশ্নে । তাদের দুই সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট নিকটতর’ এবং ভারত সরকারের নিকট থেকেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা নেই মর্মে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। কিন্তু এবারও সােভিয়েত নেতৃত্ব মূল প্রস্তাব অর্থাৎ ভারত কর্তৃক তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বিরতির বিষয়ে নীরব থাকেন। কাজেই সপ্তম নৌবহর এসে পৌছালেই আমেরিকা সামরিক পদক্ষেপ নেবে—এমন হতাশাব্যাঞ্জক পরিবেশের জন্ম হয়। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখে সােভিয়েত সাবমেরিনগুলাে টহল দিতে থাকে। মস্কো অন্যান্য সামরিক প্রস্তুতিও সম্পন্ন করে রেখেছিল। মস্কোর কূটনৈতিক তৎপরতার মূল লক্ষ্যই তখন ভারত তথা যৌথবাহিনীকে শেষ বিজয়টুকু অর্জনের সুযােগ করে দেয়া। কাজেই পৃথিবী আর একটি পারমাণবিক যুদ্ধের মুখােমুখী এসে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে মঈদুল হাসানের মূল্যায়নটি বেশ উপযুক্ত। তিনি লিখেছেন:১৫১৬

তবে তাদের এই প্রচেষ্টা কার্যক্ষেত্রে কালক্ষেপণের সমতুল্য হয়ে ওঠে—যেন একইভাবে বাংলাদেশ যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির জন্য ভারতকে সময় করে দেওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু যে দুটি ক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়ােজন ছিল, সেখানে নিঃশব্দে, যথােচিত মাত্রাতে এবং মার্কিন উপগ্ৰহ ক্যামেরার সামনে তা প্রদর্শিত হয়: মার্কিন নৌশক্তি মােকাবিলার ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে এবং চীনকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে সিংকিয়াং সীমান্তে। সােভিয়েত সামরিক শক্তির নিঃশব্দ প্রদর্শনী দ্বিধান্বিত

চীনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সম্পূর্ণ অর্থে। চীনের কারণে আমেরিকার রণতরীর ২৪ ঘণ্টার যাত্রা বিরতি এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মার্কিন চরমপত্রের কৌশলী জবাব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়ের জন্য অতীব মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। কেননা ১৪ ডিসেম্বর কেবলমাত্র ঢাকা ও গুটিকয়েক ছােট শহর ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর দখলে আসে। শেষ বিজয়ের জন্য প্রয়ােজন পড়ে আরাে কিছু সময়ের । বস্তুত ৮ ডিসেম্বর থেকেই পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ে।” অন্যদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছত্রছায়ায় বিস্ময়করভাবে দ্রুত গতিতে যৌথবাহিনী সাফল্য লাভ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সাহস ও বীরত্ব বেড়ে যায় অভাবিত পরিমাণে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার

———

১৫১৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১১। ১৫১৬ ঐ, পৃ. ২০২।

পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষ থেকে সংকটজনক পরিস্থিতির বর্ণনাসম্বলিত বার্তা এবং তার জবাবের বিষয়ে জানার জন্য দেখুন, রাও ফরমান আলী খানের প্রাগুক্ত গ্রন্থের ১২৯১৬৭ পৃষ্ঠা ।

সহযােগী বাহিনীর নির্যাতনে জমে থাকা জনরােষ বিজয় অভিযানের পক্ষে সহায়ক হয়। সাধারণ মানুষেরা যৌথবাহিনীকে বিপুল উদ্দীপনায় স্বাগত জানায় এবং তাদেরদিকে সহযােগিতার হাত প্রসারিত করে ।

যুদ্ধক্ষেত্রে যৌথবাহিনীর অব্যাহত সাফল্য বাংলাদেশ সরকারের মনােবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। ৭ ডিসেম্বর যশাের মুক্ত হওয়ার পর ৮ তারিখে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যশােরে হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার স্বতঃস্ফুর্ত সমাবেশে বক্তৃতা করেন। তারা জনগণকে নতুন উদ্যোমে দেশ গড়ার আহ্বান জানান । ১৫১৮ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানান।*** তাজউদ্দীন আহমদ যশােরের এই জনসভাতে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একই দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ভারতের সর্বাত্মক সহযােগিতার জন্য ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি স্বীকৃতিদানকারী দ্বিতীয় রাষ্ট্র ভুটানের প্রতিও অনুরূপ কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধানমন্ত্রী এ ছাড়াও বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান,আন্ত র্জাতিক রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী নীতিকে সমুন্নত রেখে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। রাষ্ট্রের মৌল নীতি হিসেবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। পলায়নপর শত্রুদের প্রতি আঘাত হানতে যৌথবাহিনীকে নানা সহযােগিতা দেয়া এবং বাংলাদেশ সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানান। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের তাই নিজ হাতে আইন তুলে না নেয়ার জন্যও তিনি বলেন। বিজয়ের এই সন্ধিক্ষণে দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী রয়েছেন। যুদ্ধে জয়ের সাথে সাথে শান্তিকেও জয় করে এনে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের ওপর সােনার বাংলা নির্মাণের উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি মন্তব্য করেন, বাঙালি জাতির মুক্তির এই সংগ্রাম কেবল তখনই সাফল্যমণ্ডিত হবে যখন রাষ্ট্রটির মৌল নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করা যাবে।৫১৯ অব্যাহত বিজয় লাভের সংবাদের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকগুলােতে শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তােলার মতাে জরুরি বিষয়ে অধিক গুরুত্বারােপ করা হয় । ৬ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে রুহুল কুদুসকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে মুখ্যসচিব নিয়ােগ করা হয়। ইতােমধ্যেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত

—-

১৫১৮ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৬২-১৬৩। ১৫১৯

জয় বাংলা , ৩১ সংখ্যা, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১।

দেশের প্রশাসনিক কাঠামাে পুণর্গঠন ও উন্নয়নের রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একাধিক কমিশন কাজ সম্পন্ন করে আনে।১৫২০ শত্রুমুক্ত অঞ্চলগুলােতে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলাই এ সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কাজ বলে বিবেচিত হয়। ১৫২১ এর অংশ হিসেবে প্রথমেই জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নিয়ােগ দেয়া হয়; অতি দ্রুত বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করার প্রতি গুরুত্বারােপ করা হয়। নুরুল কাদের এ সম্পর্কে লিখেছেন:১৫২২

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরের মতােই ধীরস্থিরভাবে কাজ করতে থাকলেন। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল এমন একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি কাজ করছেন, যাঁর সামনে মুক্ত একটি দেশ। কিন্তু পাহাড় সমান সমস্যা জড়িয়ে আছে চতুর্দিকে । আর তিনি একে একে সমাধান করে যাচ্ছেন।

বিজয়ক্ষণ যতােই ঘনিয়ে আসছিল ততােই যেন কাজের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যতটুকু জনবল প্রয়ােজন তা আমাদের নেই। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হবে তার সুষ্ঠু প্রশাসন ব্যবস্থা। সরকারের প্রশাসনে গুরুদায়িত্ব পালনের সুবাদে আমাকে এর জন্য অস্বাভাবিক খাটুনিতে পড়তে হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনা প্রদানের কারণে আমার পক্ষে যে-কোনাে কাজই সহজভাবে করা সম্ভব। হয়।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকেই সরকার এ সময় দেশের ভিতরকার প্রায় সকল খবর তাৎক্ষণিকভাবে পেতে থাকে। কোন্ কোন্ অঞ্চল শত্রুমুক্ত হচ্ছে, যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি কি তা জানা সম্ভব হয় । হঠাৎ একটি সংবাদ প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের হতবিহ্বল করে তােলে। গােপন সুত্রে প্রাপ্ত ঐ সংবাদে জানা যায় যে, গভর্নর হাউসে সকল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে এক বৈঠকে ডেকে তাদেরকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে ।১৭২৩ ১৪ ডিসেম্বর সকালের দিকে পাকিস্তানি একটি সিগন্যাল থেকে সংগৃহীত ঐ সংবাদ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং মিত্রবাহিনীকে বিমান হামলার মাধ্যমে তা নস্যাৎ করার অনুরােধ জানান।৫২৯ উদ্দেশ্য ছিল ঐ ধরনের বৈঠক আহ্বানের আগেই গভর্নর হাউসকে সভার অযােগ্য করে তােলা, অর্থাৎ সভা হতে না দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

——-

১৫২০ দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪২৬-৫৭৩। ১৫২১, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৯-৩১৪। ১৫২২, মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৯-১০০। ১৫২৩, ঐ, পৃ. ১০১। ১৫২৪, দৈনিক পূর্বদেশ, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।

৪৮৪

নির্দেশ মােতাবেক শিলং বিমানঘাঁটি থেকে জঙ্গি বিমান উড়ে এসে গভর্নর ভবনের ওপর নির্ভুল রকেট হামলা চালায়। বাস্তবে সে সময় সেখানে কিছুসংখ্যক উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে নিয়ে মিটিং চলছিল। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নয় বরং ১৪ ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তিকমিটির সদস্যদের অত্যুৎসাহে বরেণ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রহ করে এনে পাকিস্তান বাহিনী হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সূচনালগ্ন থেকেই পাকিস্ত নের শাসকগােষ্ঠীর রােষ জমতে থাকে। কেননা ভাষা আন্দোলনসহ বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনে তারা দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। নিশ্চিত পরাজয় বরণের পূর্বে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদেরকে হত্যার মাধ্যমে নতুন দেশ ও বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য ও পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যেই এই জঘন্য কাজ করে। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে জীবন দিতে হয় বাঙালি জাতির কতিপয় বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে।১৫২৫ অন্যদিকে ৮ ডিসেম্বর থেকে চলে আসা আত্মসমর্পণের তাড়নাবােধের প্রেক্ষিতে স্বয়ং গভর্নর ভবনে এই হামলা পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকারের মনােবলকে একেবারে চুরমার করে দেয়। তাদের জন্য বাংলাদেশে কোনাে নিরাপদ স্থান আর অবশিষ্ট নেই—এই আতঙ্ক তাদেরকে গ্রাস করে । বিমান আক্রমণ শেষ হওয়ার পর গভর্নর কয়েকজন সামরিক অফিসারকে একত্রিত করে বলেন, যেহেতু ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাবে সুনির্দিষ্ট কোনাে সাড়া প্রদান করে নি, সেহেতু তিনি পদত্যাগ করছেন। বস্তুত এ সময় নিয়াজীসহ কোনাে কোনাে সামরিক অফিসার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অতঃপর তিনি গভর্নর হাউস থেকে বেরিয়ে গিয়ে মাটির নিচে নির্মিত বিশেষ ধরনের প্রকোষ্ঠে আশ্রয় গ্রহণ করেন। গভর্নর হাউসের অন্যান্য কর্মচারি-কর্মকর্তা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রেডক্রসের নিয়ন্ত্রণাধীন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে চলে যান। অন্যদিকে ভেঙ্গেপড়া জেনারেল নিয়াজী, আহত জেনারেল রহিম এবং জেনারেল জামসেদ পূর্বদিন রাও ফরমান আলী খানের বাসভবনে একটি সংক্ষিপ্ত আলােচনায় সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাদের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনাে পথ খােলা নেই। বিমান আক্রমণ সংঘটিত হওয়ার পর নিয়াজী ও গভর্নর মালেকের যৌথস্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণের অনুমােদন চেয়ে প্রেরিত বার্তার জবাবে কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানি সৈন্য ও তার সহযােগীদের প্রাণরক্ষার্থে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করে। অতঃপর পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষ থেকে কতিপয় শর্তে

———

১৫২৫ আনিসুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০০), পৃ. ১৯ ২০। আরাে দেখুন, ‘Bengal’s Elite Dead in a Ditch’, Fazlul Quaer Quaderi, op.cit., p. 421. ১৫২৬ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৯।

আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে ভারত সরকারের নিকট বার্তা পাঠানাের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে সরাসরি এ ধরনের সংবাদ আদান-প্রদান করা একটা বাধা হিসেবে দেখা দেয়। এমতাবস্থায় মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাককে অনুরােধ করা হয় তিনি যেন ভারত সরকারকে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের বার্তাটি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু কনসাল জেনারেল বার্তাটি দিল্লির পরিবর্তে ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখনও পাকিস্তানরক্ষার শেষ উপায় অম্বেষণরত। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী ২১ ঘণ্টা পরে বার্তাটি তারা ভারত সরকারের নিকট প্রেরণ করে। এতেই বুঝা। যায় পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত হতে রক্ষার জন্য মার্কিন প্রশাসন সর্বশেষ প্রচেষ্টার কোনাে ত্রুটি করেনি। সামরিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নিশ্চিত পরাজয়, কূটনৈতিকক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলেও সর্বশেষ ১৩ ডিসেম্বরেও চক্রান্তের মাধ্যমে সবকিছু বানচাল করে দেয়ার তৎপরতা অব্যাহত থাকে। বরখাস্তকৃত মাহবুবুল আলম চাষীর মাধ্যমে এই চক্রান্ত বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালানাে হয়। তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নিকট এ ধরনের একটি প্রস্তাব নিয়ে যান যাতে উল্লেখ করা হয়, যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা করবে। এটা ছিল একটি ভয়াবহ চক্রান্ত। যদি কোনােভাবে এতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মত হতেন, তাহলে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনাে ভিত্তি থাকতাে না। | সম্ভবত ভারতের নিকট প্রেরিত উল্লিখিত বার্তাটি মার্কিন কর্তৃক বিলম্বে পৌছে। দেয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলাে রণতরী সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সময় করে দেয়া। অগ্রসরমান সপ্তম নৌবহরের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ। করেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল.কে. ঝা। তিনি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই আশংকা ব্যক্ত করেন। এ থেকে একটা বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মার্কিনীসহ বিদেশী নাগরিকদের নিরাপদে নেয়ার জন্যে বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সর্ববৃহৎ রণতরীটিকে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করা হয় নি। বরং এর পেছনে ছিল কোনভাবে পাকিস্তান সৈন্যদের আত্মসমর্পনে বিলম্ব করানাে গেলে তাদের নিয়ে বাংলাদেশের কোনাে অংশ দখল করে রাখা এবং সেখানে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করার সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা। প্রস্তাবিত আত্মসমর্পণের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও এর সহযােগীদেরকে বাংলাদেশের একটি অঞ্চলে একত্রিত হওয়ার

——–

১৫২৭ ঐ, পৃ. ২১০। ১৫২৮ ঐ, পৃ. ২০৫। ১৫২৯ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৩।

সুযােগ দানের কথা বলা হয়। যথাসম্ভব ঐ স্থানটি চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা সমুদ্রবন্দর সংলগ্ন কোনাে অঞ্চল, যাতে তারা ধেয়ে আসা সপ্তম নৌবহরে আশ্রয় নিতে কিংবা মার্কিনী সহযােগিতায় আবার আক্রমণের সুযােগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু যৌথবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোনাে কিছু মানতে প্রস্তুত ছিল ১৫ তারিখে যখন এ ধরনের সংবাদ নিয়াজীর নিকট প্রেরিত হয় তখন প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর হস্তগত। দক্ষিণ, পূর্ব, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে যৌথবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হয়। অন্যত্রও পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থা আতঙ্কগ্রস্থ ও পলায়নপর। তারা যৌথবাহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ভারতীয় জঙ্গি বিমান আকাশপথে আক্রমণ চালনা করে, সে আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে গ্রামের গাছ-গাছালির মধ্যে আশ্রয় নিতে গেলে গ্রামের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুতরাং নিয়াজীর শর্তহীন আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনাে উপায় ছিল না। অবশেষে তার অনুরােধে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪ টা হতে পরদিন সকাল সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়।৫৩০ ১৬ ডিসেম্বর সকাল হতে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের দিক থেকে আগত যৌথবাহিনীর জেনারেল নাগরার বাহিলী মীরপুর ব্রীজের নিকট এসে হাজির হয়। সেখান থেকে আত্মসমর্পণের আহ্বান বহনকারী জীপ ঢাকায় প্রবেশ করে। নিয়াজীর সম্মতির সংবাদ দিল্লি ও কলকাতা পৌছে দেয়া হয়।১৫৩০ ১৬ ডিসেম্বর বিকেল প্রায় ৫ টার দিকে রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যৌথবাহিনীর পক্ষে উপস্থিত হন জেনারেল অরােরা, জেনারেল জেকব, জেনারেল নাগরা এবং এ.কে. খন্দকার ও অন্যান্যরা। প্রায় ৯ মাসব্যাপী মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গেরিলাযুদ্ধ এবং ১৩ দিনব্যাপী যৌথবাহিনীর আক্রমণের মুখে আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পরাজয় বরণ করে। ৯৩ হাজারের অধিক সৈন্য নিয়ে দাম্ভিক জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনী অগ্রগামী থাকলেও অনতিবিলম্বে নিজ সীমানায় ফিরে আসে। অল্প পরে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তান বাহিনীর এসব সদস্যদের কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বন্দী করে রাখা হয়।

—–

| ১৫৩০ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২-২১৩।

বিজয়ােত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠন প্রচেষ্টা

নভেম্বর মাসে মুজিবনগর সরকারের কাজকর্মে যুদ্ধ-বিজয় ও তৎপরবর্তীকালের প্রশাসনিক বিষয়কে সামনে নিয়ে যে ধরনের তৎপরতা শুরু হয়েছিল, ডিসেম্বরে তা আরাে গতিলাভ করে হয়ে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাঠামাে দাঁড় করানাের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপনের কর্মযজ্ঞ। মাসের প্রথম দিনেই মন্ত্রিপরিষদ উপস্থাপিত প্রতিবেদনে স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্ণমাত্রার প্রশাসনিক কাজ শুরু করার লক্ষ্যে নিমােক্তভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।

রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা: এ. এফ.এম ফাতেহ, পুলিশ প্রশাসন পুনঃস্থাপন: স্বরাষ্ট্র সচিব, শত্রুসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারকল্পে আইন প্রণয়ন: আকবর আলী খান, সেনাবাহিনীর বেসামরিক গণসংযােগ, গণবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি: প্রতিরক্ষা সচিব, দালালদের প্রতি আচরণ এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাই: মন্ত্রিপরিষদ ও প্রতিরক্ষা সচিব, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নিয়ােগ ও বদলি: সাধারণ প্রশাসনের সচিব, বাস্তুচ্যুত ছিন্নমূল ব্যক্তিদের জন্য ত্রাণ ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন: পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. মােশাররফ হােসেন, আয় ও আমদানি: অর্থ সচিব, বেসামরিক প্রশাসন সংগঠন: অর্থসচিব পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। এই সময় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা শত্রুমুক্ত হতে থাকে এবং তদানুযায়ী সেগুলাের দায়িত্ব গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় তাজউদ্দীন আহমদ আর একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কিন্তু আশু করণীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করান, সেটা ছিল দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। ১০ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী কর্মচারি-কর্মকর্তাদের বিচারের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৫৩২

A high powered Screening Committee will be set up to punish or remove unpatriotic officials. This is an addition to the trial of those who have actively collaborated with the enemy, under

law for trial of collaborators. | এ ছাড়াও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের কতিপয় নিয়মনীতির অধীনে বিচারের বিষয়টিও ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে অনুমােদন লাভ করে। দালালের সংজ্ঞা, অপরাধের ধরণ ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি রূপরেখা প্রণীত হয়। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে

——

এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৩। ১৫৩২, ঐ, পরিশিষ্ট, মস ৬৭, পৃ. ৪৫১-৪৫২।

প্রয়ােজনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্য গ্রহণ করতে পারবে ।১৫৩৩ এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের মে মাস হতেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের আগ্রহী সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ একটি আধাসামরিক বাহিনী গড়ে তােলে। জুন মাসে টিক্কা খান ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অ্যাক্ট ১৯৭১’ জারি করেন।১৯৩৯ পূর্বর্তন আনসার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার কারণে। অধ্যাদেশটির মাধ্যমে তাদের সম্পদ রাজাকার বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। এই বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় সহযােগীদের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি ঘটানাে, প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দমন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানাে, সর্বোপরি স্থানীয় পর্যায়ে বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে সকল প্রকার সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এই বাহিনীর সদস্যরা এসব দায়িত্ব পালনের সাথে পাকিস্ত নি হানাদার বাহিনীর গাইড হিসেবে কাজ করে। তারাই মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন, নেতা-কর্মীদের চিনিয়ে দেয়। ১৪ ডিসেম্বর সারা দেশে যে পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয় তাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে এই বাহিনীর সদস্যরা। তাদের জঘন্য কার্যাবলি অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জীবনকে অতীষ্ঠ। করে তােলে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে বানচাল করে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছায় পাকিস্তান বাহিনীকে সহযােগিতা করে। অক্টোবর নাগাদ সহযােগী বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৫ হাজারে। কাজেই বিজয় লাভের পর এ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি অন্যতম নৈতিক অঙ্গীকারে পরিণত হয়।

অন্যদিকে ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন যে, এত দ্রুত ও উচ্চমূল্য দিয়ে কোনাে জাতি স্বাধীনতা লাভ করে নি ।৩৬ সংশ্লিষ্ট সকলকে এই গৌরবের অধিকারী বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরাে বলেন, যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু সংগ্রাম শেষ হয় নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করা এবং ধ্বংস্তুপের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তােলার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গীকার অনুযায়ী নতুন সমাজ ব্যবস্থাও গড়ে

——

১৫৩৩ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট ‘ঢ, পৃ. ৩১৫। ৭৩৫ ডঃ আহমদ শরীফ ও অন্যান্য (সম্পা.), একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় (ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র, পঞ্চম মুদ্রণ, ১৯৯২), পৃ. ৮৯। ১৫৩৫ ঐ, পৃ. ৯০। ১৫৩৬ ভাষণটির জন্য দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩২১-৩২২।

৪৮৯

তােলার জন্য তিনি আহ্বান জানান।১৫৩৭ পরদিন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিনি অনুরূপভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে অনতিবিলম্বে মুক্ত করার ব্যাপারে আহ্বান জানান। বস্তুত তিনি সমগ্র বাঙালি জাতিকে নবতর আর একটি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলেন। এ জন্য বাঙালি জাতি ইতােমধ্যেই যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তা অটুট রাখার প্রতি তিনি গুরুত্বারােপ করেন। তিনি ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযােগিতা কামনা করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে কেবলমাত্র দেয়ার নেয়ার মাধ্যমেই সম্পর্ক টিকে থাকতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠন করা খুবই দুরূহ কাজ। এমতাবস্থায় বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া উঠে দাঁড়ানাে কঠিন। তাই তিনি বিশ্ববাসীর নিকট শর্তহীন ঋণ আহ্বান করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে মার্কিনীদের বিরােধীভূমিকা এবং তাদের ভবিষ্যৎ দূরভিসন্ধির বিষয়টি পূর্বাহ্নে অনুধাবন করে ১৯ ডিসেম্বর তিনি মার্কিন সাহায্য গ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন। | এই পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের অতি জরুরি কিছু কাজ করণীয় বলে বিবেচিত হয়। যেমন মুক্তিযােদ্ধা ও অপরাপরদের হাতে রয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার, যােগাযােগ, পুণর্বাসন ও উৎপাদন ব্যবস্থা সক্রিয় করে তােলা, সর্বোপরি যুদ্ধজনিত কারণে মানসিকভাবে বিক্ষপ্ত সমাজ ও বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামাের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাতির মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলাবােধ স্থাপন করা। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যে যে অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয় তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে জেলা প্রশাসকদের নিয়ােগ দিয়ে পাঠানাে হতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বর অবশিষ্ট জেলাগুলােতেও জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নিয়ােগ দেয়া হয়। তবে এ সব কাজ সর্বত্রই সহজভাবে করা যায় নি। যেমন খুলনায় কামাল সিদ্দিকীকে জেলা প্রশাসক করে পাঠানাে হয়। কিন্তু খুলনা-বরিশাল অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল সে উদ্যোগের বিরােধিতা করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃত হন। এমতাবস্থায় প্রধান সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতায়

——-

১৫৩৭ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত ,পৃ. ১৬৭-১৬৮। ১৫৩৮ ঐ, পৃ. ১৬৮। ১৫৩% আনিসুজ্জামান, এক বিরল মানুষের কথা’, ড. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪। ১৫৪০. দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১।

গ্রেফতার করান।১৫৪১ ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার জরুরি কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় এই বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে সশস্ত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তকরণ, সরকারি কর্মচারিদের পুনঃদায়িত্ব বণ্টন ও অন্যান্য বিষয়ে আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।১৫৪২

মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহতি পরে সারাদেশে অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র রেখে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন সম্ভব নয়। অস্ত্র ছিল মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, স্বতন্ত্রধারার মুক্তিযােদ্ধা, পাকিস্তানের সহযােগী বাহিনী প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষের কাছে। বিজয়ের প্রাক্কালে নানাভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে অনেকেই নিজেদের মুক্তিযােদ্ধা বলে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়ে ওঠে। পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযােগীদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেয়া বা তাদের পরিত্যক্ত অস্ত্র সংগ্রহ করা ব্যক্তিরাও এই পর্যায়ভুক্ত। মুক্তিযােদ্ধাদেরকে সরবরাহকৃত অস্ত্রের হিসাব থাকলেও অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তা ছিল না। কাজেই অস্ত্র পুণরুদ্ধার করা একটা জরুরি গুরুত্বপূর্ণ অথচ জটিল কাজ বলে বিবেচিত হয়। এমতাবস্থায় সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শৃঙ্খলা স্থাপন ও যুবশক্তিকে দেশ গড়ার কাজে নিয়ােজিত করার দূরদর্শী চেতনা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ নামক একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেন যা ১৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার অনুমােদন লাভ করে। পরে আংশিক সংশােধনীর মাধ্যমে মুক্তিযোেদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধা ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সময়ােপযােগি প্রকল্পটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকল্পের অধীনে সকল তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত অস্ত্রায়িত ব্যক্তি নিজেদের অস্ত্র নিয়ে এসে নিদিষ্ট ক্যাম্পে রিপাের্ট করে অস্ত্র জমা দেবে। ক্যাম্পে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের খাওয়া থাকা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এখান থেকে যারা সামরিক বাহিনী বা অন্য আধাসামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে ইচ্ছুক তাদের সে সুযােগ দেয়া হবে । পূর্বতন পেশায় ফিরে যাওয়ারও সুযােগ থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের জন্য শিক্ষা জীবনে প্রত্যাবর্তনের সুযােগ করে দেয়া হবে। এর উপযােগিতা হলাে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্ত্র পুণরুদ্ধার করা, তাদের বৈপ্লবিক

—–

১৫৪১ নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫-১৯৬। এ বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও লিখেছেন; দেখুন, ‘বিপুলা পৃথিবী’, প্রথম আলাে, ২৩ এপ্রিল, ২০০৪। ১৫৪২ দেখুন, এইচ,টি, ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৩। ১৫৪৩ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০ ৫৪# মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ: শেখ মুজিবর রহমানের শামসকাল (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৮৩), পৃ. ৫৩-৫৪। ১৫৪৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট ৭, পৃ. ৩১৬।

চেতনাকে ধরে রেখে দেশ গঠনে কাজে লাগানাে, সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের একটি হতাশাগ্রস্ত বিশৃঙ্খল নেতিবাচক শক্তিতে পরিণত হতে না দেয়া। অর্থাৎ যুদ্ধজনিত কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে যে অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয় তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যে প্রক্রিয়ায় মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল অনুরূপ প্রক্রিয়ায় সমাজকে স্বাভাবিকীকরণ করার দূরদর্শী একটি পরিকল্পনা হচ্ছে জাতীয় মিলিশিয়া প্রকল্প। মুজিব বাহিনীর সদস্যদেরকেও এর আওতায় আনা হয়। এই উদ্দেশ্যে ২৬ ডিসেম্বর জেনারেল ওবান ঢাকায় পৌছেন। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মিলিশিয়া নিয়ন্ত্রণ বাের্ডে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি ও মুজিব বাহিনীর দু জন করে গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে অন্ত র্ভুক্ত করা হয় ।ঐ৪৬ এমতাবস্থায় শেখ ফজলুল হক মণি ব্যবস্থাটির প্রতি একত্মতা ঘােষণা করে একটি বিবৃতিতে বলেন, মুজিব বাহিনী নামে কোনাে স্বতন্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব আর থাকবে না। জেলা প্রশাসকদের নিকট জরুরিভিত্তিতে জেলা ও মহকুমায় জাতীয় মিলিশিয়া শিবির গড়ে তােলার নির্দেশ পাঠানাে হয়। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে মুজিব বাহিনীর নেতারা উক্ত সহযােগিতা দেয়ার জন্য এগিয়ে এলে পরিস্থিতি অনেকটা উৎসাহব্যাঞ্জক হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগে যে উপদলীয় কোন্দল বার বার বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল তা অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসে ২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় ৫ জন সদস্যকে গ্রহণ করার ফলে। এরা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, ফণিভূষণ মজুমদার, জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং শেখ আবদুল আজিজ। | এ কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ভারতের সাহায্য নিয়ে দেশকে মুক্ত করার কারণে তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন নীতি নির্ধারক ও জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু সে কারণে ভারতকে বিশেষ ছাড় দিয়ে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুন্ন হতে দেয়া যায় না, এ ব্যাপারে ভারতের মাটিতে বসেই তিনি স্পষ্ট ও সাহসী উচ্চারণ করেন। কলকাতা বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে উপস্থিত ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বন্ধন অটুট থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করলে তাজউদ্দীন আহমদ সপ্রতিভ জবাব দেন যে, বাংলাদেশের ওপর যদি কোনাে চাপ

১৫৪৬, ঐ, পরিশিষ্ট, পৃ. ৩২৩। ১৫৪৭ ঐ, পৃ. ২৩২। ১৫৪৮ ঐ, পৃ. ২৩৩।

সৃষ্টি অথবা বাংলাদেশের কাজকর্মে কোনাে প্রভাব বিস্তার না করা হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের মৈত্রী চিরকাল অক্ষুন্ন থাকবে।১৫৪৯

বিজয়লাভের পর অতি দ্রুত বাংলাদেশ সরকারকে ঢাকায় স্থানান্তর করার জন্য মুখ্য সচিব রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে সচিব পর্যায়ের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি অগ্রবর্তী দলকে ঢাকায় পাঠনাে হয়।৭৫° তারা ঢাকায় পৌছে প্রশাসনিক ব্যবস্থাসহ সড়ক ও আকাশপথে ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। মন্ত্রিপরিষদকে ঢাকায় স্থানান্তরের জন্য ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা করা হয়। এসব জরুরি পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ার পর ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দরে সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করে তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিক্রিয়া জানতে চান। এক পর্যায়ে বৈদেশিক বিশেষত মার্কিন সাহায্য গ্রহণ না করে কিভাবে দেশ চালাবেন এমন প্রশ্ন করা হলে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, প্রয়ােজনে দারিদ্র্য ভাগাভাগি করে নেবেন তবু শর্তযুক্ত ঋণ বা বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করবেন না। অতঃপর অপরাপর জরুরি প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলাে দ্রুত একের পর এক গ্রহণ করতে থাকেন। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটে। বিজয় লাভের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার মতাে একটি প্রশাসনিক কাঠামাে সক্রিয় হয়ে ওঠে।৫৫৩ অবস্থার এই ক্রমােন্নতির কারণে ২৭ ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ হতে ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফেরৎ নেয়ার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সম্মত হয়। ঐ দিন জেনারেল মানেকশ ঘােষণা করেন যে, ২৫ হাজার সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে এবং আরাে ২৫ হাজার সৈন্য ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ফেরত নেয়া সম্ভব হবে। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে ডি.পি, ধর ঢাকায় এসে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলােচনা করে একমত হন যে, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে ভারতীয় সকল সৈন্য স্বদেশে ফেরত নেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।৭৫* তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে সামরিক শক্তি সুদৃঢ় করার

——-

১৫৪৯ গােলক মজুমদার, তাজউদ্দিন আহমদ: একটি উজ্জ্বল স্মৃতি’, মাহবুবুল করিম বাচ্চু (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতি এ্যালবাম, পৃ. ৪১। ১৫৫০ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩২।

ঐ, পৃ. ৩৩২। ১৫৫২ আনিসুজ্জামান একজন বিরল মানুষের কথা’, পৃ. ২৬।

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার এই সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদান, আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা, জাতীয়করণ প্রভৃতি বিষয়ে অনেকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যার মাধ্যমে একটি কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। দেখুন, আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭০। ১৫৫৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৪ ।

প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এমতাবস্থায় ২৬ ডিসেম্বর সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য মন্ত্রিসভা জাতীয় দেশরক্ষা একাডেমী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ

| একই সঙ্গে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঐগুলাে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত ও সােভিয়েত সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনাও শুরু হয়। ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা পাকিস্তানের শিল্পপতিদের ফেলে যাওয়া বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে সরকারি মালিকানাধীনে এনে সেগুলােকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।১৫৫৫ এই পর্যায়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারােপ করেন। প্রথমত দলীয় সংকীর্ণতামুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক প্রশাসনিক সংস্কৃতি গড়ে তােলা। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার’৫৫৬ অনুযায়ী শােষণহীন একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামাে গঠনে ক্রমশ অগ্রসর হওয়া। তৃতীয়ত মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে ধরে রেখে একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমষ্টিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। বস্তুত এ সময় তিনি নীতি নির্ধারণী যেসব বক্তৃতা করেন তাতে এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায় । ২২ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে ঢাকায় নেমেই মন্তব্য করেন যে, সুষম বণ্টনভিত্তিক অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ কায়েম করা যখন সম্ভব হবে কেবল তখনই বাঙালির এই বিশাল আত্মত্যাগ পরিপূর্ণতার মধ্য দিয়ে বিপ্লব সফল হতে পারে।৭৫” তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ এবং অতীতের লাল ফিতার দৌরাত্মের কথা ভুলে গিয়ে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানান। তাজউদ্দীন আহমদ জাতির নতুন করে যাত্রার সূচনাতে দেশ গড়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার প্রয়ােজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেন। ধর্ম নিয়ে কোনাে রাজনীতি করতে না দেয়ার ব্যাপারেও তিনি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বিশ্ব দরবারে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং যুদ্ধজোটবিরােধী মনােভাব নিয়ে সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় বলে তাজউদ্দীন আহমদ স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নির্ভর করবে

———

১৫৫৫ ঐ, পৃ. ২৩৫।

G.P. Bhattacharjee, Renaissance and Freedom Movement in Bangladesh (Calcutta: The Minerva Associates, 1973), pp. 317-346. ১৫৫৭, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩, ডিসেম্বর, ১৯৭১। ১৫৫৮ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭১-১৭৫।

৪৯৪

সন্তুষ্টচিত্ত জনতার ওপর। তাদের মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা পেলে সকল নাগরিক দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবে।১৫৫৯* তিনি বলেন, শীঘ্রই জাতিকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দেয়া হবে যাতে প্রতিফলিত হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের আশা-আকাক্ষা যা একটি সমতাভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হবে। এ সময় তিনি আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারােপ করেন। তিনি অরাে বলেন যে, দেশের ভিতরে বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।৬৯ পরাজিত পক্ষের চক্রান্তের বিষয়ে দেশবাসীকে তিনি সাবধান থাকার আহ্বান জানান । কেননা তাদের চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা চিরস্মরণীয় বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের গতি থেমে গিয়েছিল এবং এর ফলে এতদঞ্চল একটি ভিয়েতনাম হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। | বস্তুত বিজয় লাভের পর তাজউদ্দীন আহমদ জনকল্যাণমুখী প্রশাসন ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তােলার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারােপ করেন। তিনি তার ঘনিষ্টজন ও প্রশাসনের উচ্চে সমাসীন ব্যক্তিবর্গের নিকট প্রায় বলতেন যে, মানুষ যেন কোনাে সময় মনে না করে মুক্তিযুদ্ধ করা ভুল হয়েছে; এর চেয়ে পাকিস্তান। আমলই ভাল ছিল ইত্যাদি। অতীতে বাঙালি মুসলমানরা ‘লড়কে লেংগে। পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়ে একবার স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয় নি। পাকিস্তানের জন্মের অল্প পরেই শােনা যায় ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখাে ইনসান ভুখা হ্যায়’ । তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাসের এ ধরনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি সযত্নে এ ধরনের বৈপরীত্যকে অতিক্রম করতে সচেষ্ট হন। সে জন্য নবীন এই রাষ্ট্রটির মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা প্রয়ােজন। একই উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে কোনাে ব্যক্তির ভূমিকাকে বেশি করে না দেখার পক্ষে বিভিন্ন সময় মত ব্যক্ত করেন। কারণ তা করা হলে মুক্তিযুদ্ধ কিছুটা আড়ালে পড়ে যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের অল্পকাল পরে স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধে তার অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে ‘উদয়ের পথে’ নামক একটি লেখা শুরু

———

দৈনিক বাংলা, ৫ জানুয়ারি, ১৯৭২। ১৫৬০, দৈনিক পূর্বদেশ, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ১৫৬. দৈনিক পূর্বদেশ, ১ জানুয়ারি, ১৯৭২।

১৫৬৩, দৈনিক বাংলা, ১ জানুয়ারি, ১৯৭২।

করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ নিরুৎসাহিত করেন এই বলে যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তি লাভের পর এ ধরনের লেখা নানা বিতর্ক-বিভ্রান্তির জন্ম দেয়া স্বাভাবিক যাতে দেশ গড়ার কাজ ব্যহত হতে পারে।”১৫৬৪

তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সােচ্চার হন। ৭ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, তিনি যদি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চান তাহলে অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে । বস্তুত এর একদিন পরেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ভুট্টো মুক্তি দান করেন । প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যৌথবাহিনীর নিকট যখন পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পন করে তখন ভুট্টো ওয়াশিংটনে ছিলেন। ভুট্টো ১৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যে যে বিষয়ে ভুট্টোর সঙ্গে আলােচনা করা যেতে পারে ফারল্যান্ড সংশ্লিষ্ট দফতরকে সে সব বিষয়ে আগাম একটি নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এতে অনেকগুলাে বিষয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পায়। সেখানে ফারল্যান্ড একটি বিষয়ে স্পষ্ট মত ব্যক্ত করেন যে, নবজাত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে যে শত্রুতা জন্ম হয়েছে। তা নিরসনে শেখ মুজিবুর রহমানের যথাশীঘ্র মুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।৫৬৫ তদুপরি ভারতসহ বিশ্বজনমত তাকে মুক্তি দানের পক্ষে । ১৮ ডিসেম্বর ভুট্টোকে সাক্ষাৎ দেন পররাষ্ট্র সচিব সিসকো। সেখানে তিনি, তার ভাষায়, ‘তথাকথিত বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্বল প্রকৃতির হলেও একটি কনফেডারেশন গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মুজিব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেন, এবং বলেন তিনি মার্চ মাসে যা চেয়েছেন, তাই পেয়েছেন। ইতিহাসই বলবে, ইয়াহিয়া, মুজিব ও আমার মধ্যে প্রকৃত অপরাধী কে? এর অল্প পরে। ভুট্টো দেশে ফিরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার দায়িত্ব গ্রহণের পরেই মার্কিন কূটনীতিককে ৩ জানুয়ারি তিনি জানান যে, অনতিবিলম্বে বিনাশর্তে মুজিবকে মুক্তি দিতে যাচ্ছেন। তাকে কারাগার থেকে এনে একটি অতিথিশালায় রাখা হয়েছিল। তিনি বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে যােগাযােগ বিছিন্ন ছিলেন এবং দেশের বর্তমান অবস্থা কি তাও জানতেন না। তাকে জানানাে হয় যে, তার দেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) একটি অংশ ভারতীয় সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে ।১৯৬৭ প্রথমে মুজিব কোনাে কথাই বলতে চান নি। ভুট্টোর বিভিন্ন ধরনের অভিব্যক্তির

——–

১৫৬৪. সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১।

৫৬৫ Roedad Khan, op.cit., p. 756 ১৫৬*, Ibid, p. 774,

Ibid, pp. 783-784.

প্রেক্ষিতে তিনি প্রথমেই জানতে চান, তিনি মুক্ত নাকি বন্দী? বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে তিনি মুজিবকে জানান তার দেশ ভারতীয় বাহিনী দখল করে নিয়েছে। মুজিব এতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, তাহলে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনে ভুট্টোর সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ করবেন। ভুট্টো গােপনে রাখা টেপ রেকর্ডারে এই কথাবার্তা রেকর্ড করান। মুজিবের সঙ্গে এটা ছিল সুচতুর ভুট্টোর আর এক ধরনের নােংরা খেলা। ভুট্টো পাকিস্তানের সঙ্গে শিথিল প্রকৃতির হলেও একটি সংযােগ রাখার জন্য মুজিবের প্রতি বার বার অনুরােধ করেন। মুজিব জানান দেশে না ফিরে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন মুজিবকে ফাঁসি দিতে, সে লক্ষ্যে কাগজপত্রও প্রস্তুত করা হয়েছিল। ভুট্টো প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের পর এ ধরনের ঝুঁকি গ্রহণ করেন নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছিল, মুজিবকে ফাঁসি দিলে পশ্চিম পাকিস্তানেরও অখণ্ডত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। যৌথবাহিনীর হাতে ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী রয়েছে। মুজিবকে হত্যা করলে তাদেরকে ফিরে পাওয়ার বিষয়টি হয়ে পড়বে অনিশ্চিত। সেখানকার মানুষ ভাববে ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণের জন্যই শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন। করাচীর একটি জনসভায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ভুট্টো প্রশ্ন করেন, তারা মুজিবকে মুক্তি দিতে চায় কিনা। জনতা সমস্বরে মুজিবের মুক্তির পক্ষে মত ব্যক্ত করে। অতঃপর তাকে পাকিস্তানি একটি বিমান লন্ডনে পৌছে দেয়। সেখান থেকে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে টেলিফোন করে জানতে চান, সাংবাদিক পরিবেষ্ঠিত মুজিব কি বলবেন? তাজউদ্দীন আহমদ জানান যে, তার স্বপ্নের দেশে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গণহত্যা সংঘটিত করেছে পাকিস্তান বাহিনী । বিপুল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে । | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি ব্রিটিশ বিমানে করে ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি দিয়ে বিজয়ীর বেশে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দিল্লি ও ঢাকায় লক্ষ লক্ষ জনতা আবেগঘন ঐতিহাসিক সংবর্ধনা দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও লক্ষ জনতার ঢল নামে সেদিন

———

“…তাই বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণের প্রশ্নটি তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিবের চিন্তায় অগ্রাধিকার লাভ করেছিল । ভুট্টোর সঙ্গে সেই সময় তাঁর আলােচনার গােপনে ধারণকৃত টেপ থেকে এই উক্তিটি এখন প্রকাশ পেয়েছে । অন্যদের মাঝে ভুট্টোর জীবনী লেখক স্টেনলি উলপার্ট এবং তার নিজের স্মৃতিচারণে পাকিস্তানের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুলতান এম. খান তার উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে তখন বলেছিলেন যে, দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রশ্নটিকে তিনি প্রাধান্য দেবেন। ফারুক চৌধুরী, স্বদেশ স্বকাল স্বজন (ঢাকা: প্যাপিরাস, ২০০২), পৃ. ২২।

সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এই নেতার জীবিত থাকার কামনা করে বাংলার মানুষ, স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছে, রােজা রেখেছে। তিনি শারিরীকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ টি মাস অনুপস্থিত থাকলেও যুদ্ধরত বাঙালির চেতনায় তিনিই ছিলেন অণুক্ষন দেদীপ্যমান। সেই নেতাকে এক নজর দেখার জন লাখাে জনতার এই ঢল। মৃত্যুর মুখ থেকে বিজয়ীর বেশে মুক্ত স্বদেশে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণের জন্য ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদকে জড়িয়ে ধরে নেতা আবেগে উচ্চারণ করেন, আমি জানতাম, তাজউদ্দীন, কেউ পারলে তুমিই পারবা।৫৬৯ সােহরাওয়ার্দী ময়দানের এই জনসমুদ্রে একমাত্র বক্তা শেখ মুজিবুর রহমান ঘটে যাওয়া গণহত্যায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং বলেন যে, অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। ভুট্টোর উদ্দেশে বলেন, তিনি যেন তার পাকিস্তান নিয়ে সুখে থাকেন, বাঙালিদের পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। | ১১ জানুয়ারি সকালে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে একটি স্বল্পস্থায়ী আলােচনা হয়। বাইরে সাংবাদিক ও অন্যান্য মানুষের ভিড় জমে ওঠা ও অন্যান্য কারণে তাদের মধ্যে দীর্ঘ কোনাে আলােচনার সুযােগ হয়নি। আলােচনার এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায় কিনা জানতে চান। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, আওয়ামী লীগ সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দীর্ঘ ২২ বছর সংগ্রাম করেছে, সহসা তা বাতিল করার যৌক্তিক কোনাে কারণ নেই। কাজেই দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং সে দায়িত্ব শেখ মুজিবকেই গ্রহণ করতে হবে। জনগণের প্রত্যাশাও সেটাই । শেখ মুজিব সংসদীয় ব্যবস্থা মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়ায় তাজউদ্দীন আহমদ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এই আলােচনায় তাজউদ্দীন আহমদ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রীদের দলীয় কোনাে পদে না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন এবং নিজে কোনাে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন না করে দল নিয়ে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু নেতার নির্দেশে তিনি পরিশেষে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনে সম্মত হন।৫৭২ উল্লেখ্য ১৯৭২ সালের ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি দলের কার্যকরী কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, দলের পদ

১৫৬৯ আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৭।

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩৯। ১৫৭১, দৈনিক বাংলা, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২। ১৫, সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃ.

এবং মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করা যাবে না। পরে ১৯৭২ সালের ৭ ও ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করে কোন পরিস্থিতিতে দলের উক্ত নীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ১৯৭১ সালে নির্বাচিত দলীয় প্রতিনিধিরা তাকে এবং মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুরােধ করেন তার ব্যাখ্যা দেন।*** | ১২ জানুয়ারি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর একটি অতিব সংকটজনক পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ পরিস্থিতির তাড়নায় স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। পদে পদে সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে ভারতের সর্বাত্মক সহযােগিতায় বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনেন। তারপর বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কারাগারের মৃত্যুপুরী থেকে মুক্ত করেন। এখন এই নেতার হাতে সকল দায়িত্ব তুলে দিতে পেরে গর্বিত তাজউদ্দীন আহমদ বলেন এই দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে সুখের। একই সঙ্গে তিনি এক অসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সরকার গঠন এবং বহু বিরূপ প্রবণতার মুখেও যুদ্ধরত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কৃতিত্ব তাজউদ্দীন আহমদের । কিন্তু প্রচারবিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ সকল কৃতিত্ব দিতে চান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি বলেন যে, মুক্তিসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুই সমগ্র জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছেন মাত্র। কথা প্রসঙ্গে বলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ছিল বঙ্গবন্ধুরই সরকার। আমরা বঙ্গবন্ধুর হয়ে কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধুর পায়ের খরমকে চেয়ারে রেখে আমরা সেই সরকার চালিয়েছি।”৫ বস্তুত মুজিবের জনসম্মােহনী নেতৃত্বের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের ছিল অগাধ বিশ্বাস। তার অনুপস্থিতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এমতাবস্থায় তিনি মুক্ত হয়ে এসে সামগ্রিক বিষয়টি অনুধাবন এবং জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন কিনা—জনৈক সাংবাদিকের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দমবন্ধ একটি ঘড়ির মতাে অবস্থায়

১৫৭০. সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ২২৯। ১৫৭৪, ঐ, পৃ. ২২৬। ১৫৭৫ দৈনিক বাংলা, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২। ১৫৭৬. দৈনিক বাংলা, ৭ আগষ্ট, ১৯৭২।

রয়েছেন বটে, সঠিকভাবে দম দিতে পারলে তার পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব।১৯৭৭ তার সেই ক্ষমতা দিয়ে সকল বিশৃঙ্খলা দূর করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তােলা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। | বাঙালির শ্রেষ্ঠ অহংকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ । তার সর্বোচ্চ অর্জনও এটা। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয় দীর্ঘ তিন দশকের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রায় সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রে থেকে তাজউদ্দীন আহমদ যেমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, তেমনি এই শ্রেষ্ঠ অর্জনের প্রধানতম ব্যক্তি তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে একমাত্র বাংলাদেশই আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার অর্জন করে এবং সে অধিকার নস্যাৎ করে দেয়ার অপচেষ্টা করা হলে কেবলমাত্র এ দেশটিই সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। আজ এ কথা অনেকেই জানেন এবং মানেন যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের অবিচলতা, প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ও কূটনীতি বােধের কারণেই বাঙালির এ মহিমান্বিত অর্জন সম্ভব হয়। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে, এ ধরনের একজন ত্যাগী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও মহান হৃদয়ের নেতা তারা পেয়েছিল । বাঙালি জাতির মহত্তম অর্জন স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে তাজউদ্দীন আহমদ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

——

১৫৭৭, দৈনিক পূর্বদেশ, ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২।

৫০০

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন