You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরীর কেটে তারা আনন্দ পেত।

“আমি ছিলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী। চার বৎসর আমি পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরী করেছি। পঁচিশে মার্চের কিছুদিন আগে আমি ভলান্টারী সার্ভিসে আমি চিটাগাংয়ে আসি। সেখান থেকে আমি ছুটিতে বাড়িতে আসি। তারপর বঙ্গবন্ধুর আহবানে চাকুরীতে চট্টগ্রামে যোগ দেই। ওখান থেকে ষোলশহর, কালিঘাট, ৭ নং জেটীতে পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বরদের সাথে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করি এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত করি। পরবর্তীকালে সেখানের পতন ঘটলে এপ্রিল মাসের (৭১) ৫ তারিখে অনেক সঙ্গীসহ ওপার বাংলার আগরতলায় পৌছি।  সেখান থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ডিফেন্স দেই। তারপর পাক সৈন্যরা বিমান আক্রমণ চালালে সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। এপ্রিল মাসে ২২ তারিখে স্বগ্রাম দিঘাপাতিয়ায় পৌছি।

২৪শে এপ্রিল আমার বাড়িতে একদল পাক সৈন্য এসে ঘরের দরজা ভেঙ্গে আমাকে ধরে লাথি মারতে মারতে স্থানীয় কালীবাড়িতে নিয়ে যায়। বলা প্রয়োজন, এখানে অত্যাচারের কেন্দ্রভূমি ছিল। তারা সেখানে আমার হাত পা বেঁধে পা উপরের দিকে তুলে লটকিয়ে অত্যাচার করে। সে অত্যাচারের ভিতর ছিল বেত দিয়ে প্রহার, চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থান কাটা। শরীর কেটে তারা আনন্দ পেত। তারা জানতে চাচ্ছিল যে চট্টগ্রামে আমি কতজন পাঞ্জাবিকে হত্যা করেছি, কতটি রাইফেল কোথায়, কিভাবে লুকিয়ে রেখেছি, বাংলাদেশ সম্পর্কীয় কি কি তথ্য আমি জানি।

আমার কাছ থেকে কোন তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হলে তারা আমাকে কালীবাড়ি থেকে নাটোরের ফুলবাগানে অপারেশন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে বৈদ্যুতিক শক আমার গলায় দেওয়া হয়। হাত-পা বেঁধে ডেকচির মধ্যে করে পানির হাউজে নিক্ষেপ করে। ১০-১২ মিনিট সেখানে রাখার পর অর্ধমৃত অবস্থায় সেখান থেকে তুলে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। সেখানেও তারা ব্যর্থ হবার পর আমাকে বেয়োনেট চার্জ করতে নিয়ে যায়। এ সময় ছিল সন্ধ্যার কিছু আগে। তখন আমার হাত পিছনে বাঁধা ছিল। বলা প্রয়োজন, এর কিছু আগে আমার সাক্ষাতেই চারজন লোককে গুলি করে হত্যা করে। পরে আমাকে নিয়ে যায়। বেয়োনেটের সামনে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলাম কৌশলে হাতের বাঁধন খুলবার চেষ্টা করছিলাম। এক সময় আমি আমার হাতের বাঁধন তাদের অগোচরেই খুলতে সমর্থ হই। ফুলবাগানের মধ্যস্থ পুকুরের চারিদিকে মিলিটারীরা তখন সশস্ত্র পাহারায় ছিল। হাতের বাঁধন খুলেই ঘুরে সঙ্গীন উচানো সিপাইয়ের হাতের রাইফেল কেড়ে পুকুড়ে ফেলে দেই এবং বক্সিং মেরে তাকে ধরাশায়ী করি। তারপর পুকুরে ঝাপ দেই। ইতিমধ্যে অবশিষ্ট সৈন্যরা পুকুরের চারিদিকে সচেষ্ট হয়ে উঠে এবং আমাকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি চালানো শুরু করে। যখন পুকুরের পাড়ে উঠছিলাম ঠিক সে সময় একটি গুলি এসে আমার ডান কানে লাগে। সাথে সাথে আর একটি গুলিও আমার বাম বাহুর নিচে লাগে। এতে আমি অবশ্য খুব বেশি আহত হই না। তাদের সকলের সব রকমের অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে বর্বরদের ব্যূহ ভেদ করে পালিয়ে আখের জমির ভিতর দিয়ে ক্রলিং করে নাটোরে পৌঁছাই। শরীর থেকে তখন দরবিগলিত ধারায় রক্তপাত হচ্ছিল। উলঙ্গ অবস্থায় যখন নাটোরের সিনেমা হলের মোড়ে পৌঁছাই তখন একদল বিহারী আবার আমাকে ধরে ফেলে। সেখানেও তারা বেদম প্রহার করতে শুরু করে। পূর্বোক্ত বক্সিং প্রক্রিয়ার বদৌলতে তাদের হাত থেকেও রেহাই পাই। এবং শহরের মাঝখানে মামারবাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নেই। কিছুক্ষণ পর আমার শ্বশুর ডাক্তার আঃ লতিফের কাছে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। সেখান থেকে ঐ রাতেই মেয়ের পোষাকে এক গ্রামে আশ্রয় নেই। তার ১০ দিন পর ভারতে আশ্রয় নেই। এবং সেখানে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেই।

ফুলবাগান থেকে উধাও হবার পর পাক পশুরা আমার বাড়ি ঘেরাও করে এবং আমার বৃদ্ধ বাবা এবং মাকে মারধর করে এবং বলে যে তোমার ছেলেকে বের করে দাও, তাকে চাকুরী দেব এবং তোমার মেয়েকে আমার সাথে (জনৈক সুবেদার) বিয়ে দাও। পরবর্তী সময়ে তারা আমার বাড়ি লুটপাট করে।

আমার মতে, ফুলবাগানে ন’মাসে অন্ততঃ ১৫-১৬ হাজার লোককে পাক পশুরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

স্বাক্ষর/-

মোঃ মোসলেম উদ্দিন

গ্রাম- দিঘাপতিয়া, নতুনপাড়া

পোঃ দিঘাপতিয়া, নাটোর

জেলা- রাজশাহী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!