You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সংগ্রামের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা সবচেয়ে কঠিন এই সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আন্দোলনের পুরােধাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতি এবং করণীয় সম্পর্কে অস্পষ্টতার কারণে তার জন্য এ দায়িত্ব সুকঠিন গুরুভারে পরিণত হয়। একটি দুর্বিষহ আতঙ্কগ্রস্ত ও অনিশ্চিত পরিবেশেও দলের ও অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতাদের অনেকেই আক্রান্ত দেশ ও জাতিকে শত্রুমুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করার চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তে স্বাভাবিক সময়ের ন্যায় ব্যাংক এন্ড ফাইলের প্রশ্ন তুলে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। এ ধরনের নাজুক পরিস্থিতিতে তিনি অসহায়ত্ব বােধ করলেও লক্ষ্য অর্জনের জন্য অটল থাকেন এবং আশ্রয়দানকারী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার সহযােগী কূটনীতিবিদদের পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন লাভ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন। অন্যদিকে দলের অন্যান্য নেতারা প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে সরকারের যুদ্ধ পরিচালনায় তাকে সর্বোত সহযােগিতা করেন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মােশতাক আহমদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব না মেনে বিরােধীদের সঙ্গে হাত মেলান। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল চক্রান্ত ও বহুমাত্রিক জটিলতার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে স্বাধীনতা। অর্জনের লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়। | বস্তুত দ্বিমেরু (Bi-polar) বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতের মতাে অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাদপদ ও রাজনৈতিকভাবে সমস্যাসংকুল একটি দেশের সহযােগিতা নিয়ে পাকিস্তানের মতাে সামরিক শক্তিসম্পন্ন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ পরিচালনা করা যে কোনাে বিপ্লবী নেতার পক্ষেও দুরূহ কাজ।

প্রথমত ২৫ মার্চ থেকে এমন এক অভাবনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যাতে নতুন। করে করণীয় নির্ধারণের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় । ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যদিও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং এ কথা বলেছিলেন যে, তিনি হয়তাে নির্দেশ দেয়ার সময় নাও পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য যা যা করণীয় সবই করার আহ্বান জানান। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেখা। যায় যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল না। বাঙালি জাতির ওপর যখন পূর্ণমাত্রার সামরিক আক্রমণ চালিয়ে প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বন্দী করে নিয়ে যায়, তখন করণীয় ও নেতৃত্বের প্রশ্নে অন্ত দলীয় কোন্দল ও সাময়িক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত উপরিউক্ত বাস্তবতায় দলের কোনাে কোনাে নেতা প্রধান নেতৃত্বের দাবিদার হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করেন। তৃতীয়ত ছাত্র ও যুবনেতাদের অনেকেই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর হতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে ছাত্র ও যুবনেতাদের অনেকেই এ ব্যাপারে আরাে তৎপর হয়ে ওঠেন এবং তারা তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করেন। স্বাভাবিক নিয়মে এরা তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার যােগ্য ছিলেন না। তাই তারা সরকার গঠনের বিরােধিতা এবং ‘ওয়ার কাউন্সিল জাতীয় কিছু গঠনের মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন। চতুর্থত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ দেখে অনেকের এ ধারণা জাগা স্বাভাবিক ছিল যে, এবার হয়তাে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে আর ছেড়ে দেবে না। সুতরাং তার অবর্তমানে নেতা হওয়ার বাসনা তাদের অনেকের মনে স্থান পাওয়াটা বিচিত্র নয়। পঞ্চমত তাজউদ্দীন আহমদ দলের নীতি নির্ধারণীমূলক কাজে পারদর্শিতার পরিচয় দেয়ায় তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সম্পর্কে বিরােধীরা সচেতন ছিলেন। সে কারণে সম্ভবত তারা তাকে কিছুটা ঈর্ষা করে চলতেন। জাতীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও অন্তর্দলীয় উল্লিখিত প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়েও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্য শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এটি বস্তুত নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রবাসে অবস্থান করলেও এর কাঠামাে, ধরন, কার্যাবলি প্রভৃতি সব দিক থেকেই ছিল একটি নিয়মিত আধুনিক সরকারের সমতুল্য। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্র ছিল বিপ্লবী প্রকৃতির এবং আমলাতন্ত্রের জটিলতামুক্ত। সে ।

৯৫৮ মােহাম্মদ নুরুল কাদের, একাত্তর আমার (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ৬৭। মােহাম্মদ নুরুল কাদের ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব।

অর্থে বাংলাদেশের এ যাবৎকাল যতগুলাে সরকার গঠিত হয়েছে তার চেয়ে এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কালজয়ী সাফল্যের দাবিদার।৯৫৯

সরকারের মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিভাগসমূহের গঠন ও কার্যাবলি

| এ প্রসঙ্গে সরকারের কাঠামাে সম্পর্কে সম্যক আলােকপাত করা প্রয়ােজন।

আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় | পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পর দলটি নির্বাচিত সদস্যদের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি খসড়া ঘােষণাপত্র রচনা করে। এতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সরকারের। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পঠিত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে স্পষ্টত রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন কাঠামাের প্রবর্তন করা হয়েছিল যা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়। এর নবম অনুচ্ছেদে স্পষ্টত রাষ্ট্রপতিকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে বলা হয়:

…that the President shall be the Supreme Commander of all the Armed Forces of the Republic, shall exercise all the Executive and Legislative powers of the Republic including the Power to grant pardon, shall have the power to appoint a Prime Minister and such other Minister as he considers necessary,… shall have the power to summon and adjourn the Constituent

Assembly… সদ্যগঠিত সরকারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে Asian Recorder-এ সরকার কাঠামাে সম্পর্কে স্পষ্টত লেখা হয়:৬২ “…The Democratic Republic of Bangladesh was proclaimed in Mujibnagar on April 17 as a formally constituted State, to be run by a presidential form of Government” স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে রাষ্ট্রপতির

৯২৯ এইচ.টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৪), পৃ. ৬৩। এইচ.টি. ইমাম মুজিবনগর সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন।

৯৫৬. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আবদুল আজিজ বাগমার, স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন (ঢাকা: অপূর্ব সংসদ, ১৯৯৯), পৃ. ১৪৯-১৬৩। ৯৯৯ বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন,দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৪-৬। ৯৯ই, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৩।

২৯৫

অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হিসেবে সকল নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বাস্তবে দেখা যায় তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সকল কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিলেও সকল কিছুর পশ্চাতে ছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত । এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধি বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের প্রতি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিরােধী পক্ষকে মােকাবিলা করে স্বীয় বিবেচনা মােতাবেক কাজ করার জন্য তাজউদ্দীন। আহমদ সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অনেকটা রক্ষাকবচ হিসেবে পান। বিষয়টির গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ট মঈদুল। হাসান যথার্থই বলেছেন যে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে। আইন প্রণয়ন ও কার্যকরী ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বিভিন্ন দাবিদার তাদের আকাঙ্ক্ষার লড়াই স্বল্পকালের জন্য মুলতবি রাখেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে এবং বিশেষত পরবর্তী নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনরূপ সিদ্ধান্তের অভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সংকট যেখানে একরূপ অবধারিত ছিল, সেখানে মন্ত্রিসভার গঠন ছিল নিঃসন্দেহে একটি বিরাট রাজনৈতিক অগ্রগতি । বিভিন্ন তথ্য এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে নানা কাজে জড়িত অনেক ব্যক্তির নিকট থেকে জানা যায়, সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকে তাজউদ্দীন আহমদ। চেতনার গভীরে ধারণ করেন; যেটাকে এক ধরনের ধ্যানমগ্নতা বলা যেতে পারে এবং সমগ্র সিদ্ধান্ত সেই উপলব্ধিবােধ থেকেই উৎসারিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের সাধারণ রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির নিকট সেভাবেই বিধৃত। খুব সম্ভব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তাজউদ্দীন। আহমদের মতাে নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ এবং দেশপ্রেমিক স্টেটসম্যান’ এর সাক্ষাৎ পান বলেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা বাংলাদেশ প্রশ্নে সর্বোচ্চ ঝুঁকি গ্রহণে অগ্রসর হন। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের বহু গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তারা মূলত তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল যােগাযােগ রক্ষা করতেন।

সুতরাং কাঠামােগত দিক থেকে এই সরকার ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত, যা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধরত একটি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই উপযােগী। অন্যদিকে বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ সংসদীয় রীতির সরকার

—-

৯৬৩ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ও মঈদুল হাসান গবেষককে দেয়া সাক্ষাত্তারে এ তথ্য প্রদান করেন। ৯৬৪ Sheelendra Kumar Sing, Bangladesh Documents, Vol. Two (Dhaka: The University Press Limited, 1999), pp. 586-589.

কাঠামাের ন্যায় ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন এবং সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সরাসরি নিজ পরিচালনাধীন রাখেন। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সাধারণভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধান, আইন কিংবা নির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করার যে রীতি থাকে তা এই সরকারের ক্ষেত্রে ছিল না। এ ক্ষেত্রে যদিও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় তথাপি দেশকে শত্রুমুক্ত করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সচিবদের বুদ্ধি বিবেচনাই আইনের মর্যাদা পায়।

| দেশকে শত্রুমুক্ত করার কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদের নেতৃত্বে তাজউদ্দীন আহমদ গড়ে তােলেন নিয়মিত ধরনের সুসমন্বিত একটি সরকার কাঠামাে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার এ ব্যবস্থাপনা বিশেষভাবে প্রশংসার দাবিদার। কেননা বিশ্বের অনেক দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার এ যাবৎকাল গঠিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে রয়েছে এর সুসংগঠিত পারস্পরিক কার্যকারণযুক্ত সক্রিয় সাংগঠনিক কাঠামাের কারণে ।৬৫ এই সরকারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১০ এপ্রিল বেতারে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের মধ্য দিয়ে। এরপর শপথ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিদিনই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আলােচনার জন্য অথবা মুক্তিদ্বুদ্ধের অবকাঠামাে গড়ে তােলার লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ স্বীয় বিবেচনায় কতিপয় বিষয় ডায়েরিতে নােট আকারে লিখে রাখতেন। এগুলাের প্রতি দৃষ্টি দিলে অতি সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, সূচনাপর্বেই তিনি কত সূক্ষ অথচ গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিবেচনা করেছিলেন। এই বিষয়গুলাের। মধ্যে ছিল সরকারের দফতর স্থাপন সচিবালয় স্থাপন ও সচিব নিয়ােগ, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক নিয়ােগ, প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ, যুদ্ধের যাবতীয় সরবরাহ, পররাষ্ট্র, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প, খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, পূর্ত, সামরিক ও বেসামরিক সাহায্য, সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব প্রসঙ্গ, তাদের নিয়ােগ ও বেতন, বেসামরিক সরবরাহ, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার, তথ্য ও যােগাযােগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মুক্তিবাহিনী গঠন ও মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ, আঞ্চলিক প্রশাসন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, আন্তঃদলীয় সম্পর্ক, বিভিন্ন উপায় ও উপকরণের সংস্থান ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন। আহমদের চেতনা অনুসন্ধানের জন্য প্রাথমিক এসব রূপরেখার গুরুত্ব

——

৯৬৫ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২।

অপরিসীম ।৬৬ এসব নােটে যুদ্ধরত একটি সরকারের প্রায় সামগ্রিক বিষয় বিধৃত হয়। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ সূচনাপর্ব হতেই বেশ সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকার গঠনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ১৪ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিজ হাতে লিখেন। এতে বলা হয় “মন্ত্রী পরিষদ সদস্য অথবা মন্ত্রী পরিষদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কেউ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি ভারত সরকার, কোন রাজ্য সরকার অথবা কোন বিদেশী সরকার অথবা কোনরূপ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংবাদ মাধ্যমের সাথে যােগাযােগ করবেন না এবং ভারতে অবস্থানরত কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজ পরিচয় গােপন করে চলবেন।”৯৬৭ প্রবাসে বসে সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এ ধরনের দূরদর্শী কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এদিকে ১৪ মে বিভিন্ন পেশাজীবী সাধারণ মানুষদের প্রতি ১৮ দফার একটি দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের কর্তৃত্বের বিস্তার ঘটান। | শপথ গ্রহণের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ১৮ এপ্রিল। এতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর প্রভৃতি বণ্টন করা ছাড়াও মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার লক্ষ্যে কার্যকর কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উপযুক্ত যুবকদের সংগ্রহ করার জন্য কর্ণেল ওসমানীর নেতৃত্বে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক। এ ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দলীয় তৎপরতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দেয়া হয় মিজানুর রহমান চৌধুরীকে। ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে প্রকাশিত প্রতিবেদন হতে নিমলিখিত মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার পরিচয় পাওয়া যায়:” এর আলােকে পর্যায়ক্রমে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও শাখা সংগঠন এবং এগুলাের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে। | প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য। ও বেতার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও পুণর্বাসন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও ছিল সাধারণ প্রশাসন বিভাগ, সংসদ বিষয়ক

———–

৯৬৬ দেখুন, ঐ, পৃ. ৩৪৭-৩৫১।

আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশ ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭, পৃ. ৫৯২। ৯৬৮ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৮।

৯৮৯, ঐ, পৃ. ১১৫।

বিভাগ, কৃষি বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ ইত্যাদি। একটি সচিবালয় থেকে এ সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা হতাে। আরাে কতিপয় সংস্থা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করতাে। যেমন-ত্রাণ ও পুণর্বাসন কমিটি, শরণার্থী কল্যাণ বাের্ড, যুব নিয়ন্ত্রণ বাের্ড, শিল্প ও বাণিজ্য বাের্ড, পরিকল্পনা কমিশন প্রভৃতি। যুদ্ধরত একটি জাতির প্রয়ােজনীয়তার দিকে নজর রেখেই সরকারের এ সকল শাখা-প্রশাখা স্থাপন করা হয়। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রীদের মধ্যে মন্ত্রণালয়সমূহের বিভাজন বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন- প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। এ ছাড়াও তার অধীনে রাখা হয় সাধারণ প্রশাসন ও পরিকল্পনা বিভাগ। কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রােডের (বর্তমানে সেকসপিয়ার সরণী) বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্থাপিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের গুরুত্ব সাধারণভাবে সবার নিকট সুবিদিত। খন্দকার মােশতাক আহমদের অধীনে ন্যস্ত করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। তার কার্যালয় হয় ৯ নং সার্কাস এভিনিউ। এটি পূর্বে ছিল কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের কার্যালয়। পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলী বাংলাদেশ পক্ষে যােগ দিলে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ মিশন। ভারতের বুকে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য এটিই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এ. এইচ, এম, কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুণর্বাসন মন্ত্রণালয় এবং কৃষি ও খাদ্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। তার কার্যালয়ের অবস্থান ছিল কলকাতার ৪৫, প্রিন্সেপ স্ট্রীট। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অর্থ বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীর। দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তার কার্যালয় অবস্থিত হয় ৮ নং থিয়েটার রােডে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব মােহাম্মদ নুরুল কাদেরের স্মৃতিচারণমূলক লেখা হতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে জানা।

———

৯৭১ দপ্তর বণ্টনের বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৬-১৭, এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫। স, প্রকৃত নাম মােহাম্মদ নুরুল কাদের খান (১৯৩৫-১৯৯৮)। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি প্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে যােগদান করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে তাকে পাবনা জেলার জেলা প্রশাসক করে পাঠানাে হয়েছিল। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তিনি জাতীয় রাজনীতির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। ২৫ মার্চে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই তিনি পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালান। তিনি নিজে মেশিনগান চালিয়ে ১৭ টি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের নামে প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলেন। পাবনা জেলার টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে

যায়। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে তিনি কলকাতায় গিয়ে পৌছালে তাকে সংস্থাপন সচিব নিয়ােগ করা হয়। এ বিষয়ে মােহাম্মদ নুরুল কাদের লিখেছেন:

তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে দেখা করার জন্য যাই । তাঁর সঙ্গে আলাপের সময় আবারও দেখা গেল কি ধীরস্থিরভাবে তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তগুলাে প্রকাশ পাচ্ছে। তার কথায় যৌক্তিকতার কারণে অনেক ক্ষোভও সহজে মিটে যায়। তিনি বলেন, দেখুন হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে চলে এসেছে এবং আসছে । দেশের অভ্যন্তরের ঘটনা সম্পর্কে আপনি নিজেও জানেন । শুধু পশ্চিম সীমান্ত নয় আগরতলাসহ সীমান্তের প্রায় সবদিক দিয়েই আমাদের লােকজন প্রবেশ করছে । এই পরিস্থিতিতে জেনেশুনে অস্ত্র ছাড়া আপনাদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠাই কিভাবে? তাজউদ্দীন সাহেবকে তখন মনে হলাে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তে এসব আলােচনা করছেন। সকল প্রয়ােজনীয়তাকে যে তিনি স্বীকার করেন এবং একটা পরিকল্পনাও গ্রহণ করে রেখেছেন তা অনুমান করতে পারছিলাম। যদিও তিনি এসব উল্লেখ । করতেও দ্বিধা করেন নি। বললেন, “দেখুন, সবাই বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রশাসনের লােকজন তাদের কেউ কলকাতা, কেউ শিলিগুড়ি কিংবা আগরতলায়। আমরা যারা আছি তাদের তাে চাল নেই, চুলোও

নেই । এই অবস্থায় প্রশাসনিক সরকার গঠন করা সহজ বিষয় নয়। কর্মপরিকল্পনা, কাজের ধরন, শর্ত ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জানতে চাইলে। তাজউদ্দীন যা বলেন তা নুরুল কাদেরের জবানীতে নিমরূপ:

শর্ত তাে অবশ্যই আছে। আপনাকে এমন একটি সরকার কাঠামাে গঠন করতে হবে, যে সরকার এই যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ধারণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্থানান্তরে সক্ষম হবে।…কিছুক্ষণ বিরতির পর তিনি বললেন, ‘আপনাকে যখন সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তখন সরকারের সর্বোচ্চ পদ প্রশাসনের সচিব হিসেবেই নিয়ােগ করা হচ্ছে । অতএব, আপনি সচিব পদ ধারণ করবেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব। হিসেবে নিয়ােগ ঘােষণা করে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন।…এরপরেই

———–

দেশের অপরাপর অংশের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করে জানতে পারেন যে, সর্বত্রই প্রতিরােধ যুদ্ধ চলছে। ঠিক এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক সরকার গঠনের সংবাদ পান। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে কলকাতায় পৌছালে তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব নিয়ােগদান করা হয়। পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানাের জন্যে নিজের নাম থেকে ‘খান’ শব্দটি পরিত্যাগ করেন। মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১। ৭৩, ঐ, পৃ. ৫৮- ৬৬। ** মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬০-৬২।

৩০০

তাজউদ্দীন সাহেব নিয়ােগ আদেশের একটি খসড়া তৈরি করে আনতে বলেন। খসড়াটি টাইপ করা হলাে। টাইপ করলেন আবদুর রশীদ। তিনি ছিলেন তৎকালীন ওয়াপদার একজন কর্মচারী। হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করলেও তিনি টাইপও করতে জানতেন।… আবদুর রশীদ অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে নিয়ােগ আদেশটি টাইপ করে হাতে দিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব এই নিয়ােগ আদেশে সই করতে অসম্মতি জানালেন। বললেন, বাংলায় লিখতে হবে। অতঃপর নিজেই লিখে নিলেন নিয়ােগ আদেশ, খুবই সুন্দর হাতের লেখা। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সভার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য রেকর্ড তিনি নিজ হাতে লিখতেন।

এই আদেশবলে আমাকে সচিব (সাধারণ প্রশাসন) হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এখান থেকেই বাংলাদেশ সরকারের দাফতরিক কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু। আমাদের তখন বসার জায়গা, টাইপরাইটার, নথি, কাগজপত্র ইত্যাদি কোন কিছুই ছিল না ।… সঙ্গত কারণেই মন্ত্রাণালয়গুলাের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রথমেই সংস্থাপন বিভাগ সৃষ্টি করতে হলাে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল লােক নিয়ােগের ক্ষেত্রে। কারণ সরকারি লােকজনের মধ্যে অনেকেই ভারতে আসেন নি। যারা এসেছেন তাঁরাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন জায়গায়। তাঁদের খুঁজে বের করতে খানিকটা সময়ও চলে যায়।

রূপরেখা তৈরী করার সময় এবং সচিবালয়ে কর্মকাণ্ড শুরু করার সময় প্রয়ােজনের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন মন্ত্রণালয়ের লােক নিয়ােগ আগে করা হবে

তা নির্ধারিত হয়েছে সেভাবেই । বস্তুত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নুরুল কাদেরকে সংস্থাপন সচিব হিসেবে নিয়ােগ দিয়ে যথেষ্ট দূরদর্শিতা ও বিজ্ঞতার পরিচয় দেন। কেননা নুরুল কাদের বেসামরিক প্রশাসনের লােক হলেও প্রতিরােধযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধকালীন একটি সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম স্বাভাবিক সময়ের মতাে হয় না। যে উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয় তাকে পুরােমাত্রায় উপলব্ধি করতে না পারলে প্রশাসনকে প্রয়ােজন মতাে গড়ে তােলা সম্ভব নয়। সে বােধকে ধারণ করার জন্য দরকার ছিল একজন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তার । সে দিক থেকে নুরুল কাদের ছিলেন যথার্থ ব্যক্তি। তিনি পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য প্রশাসনের সহযােগিতা নিয়ে বিভিন্ন ত্রাণ শিবির থেকে বাংলাদেশী এম.এন.এ, এম.পি.এ. ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের একত্রিত করেন এবং তাদের সমন্বয়ে বেসামরিক প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে

—–

| ৯৭৫ কাজী সামসুজ্জামান, আমরা স্বাধীন হলাম (ঢাকা: এন.এ.সি-৪, ১৯৮৫), পৃ. ৫৫।

তােলেন। বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য শুরু থেকেই যােগ্য ব্যক্তিদেরকে খুঁজে বের করে দায়িত্ব প্রদান করেন। এ ধরনের যােগ্য ব্যক্তিদের সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই মুক্তিযুদ্ধ এত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয় এবং কাক্ষিত পরিণতি লাভ করে। | বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া অর্থ এবং সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একজন ট্রেজারার দরকার পড়ে। পাবনা জেলার প্রাক্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মাখন চন্দ্র মাঝিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম ট্রেজারার নিয়ােগ করা হয়। তিনিও নুরুল কাদেরের সঙ্গে সশস্ত্র প্রতিরােধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। অল্প পরেই, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন উপসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানকে অর্থ সচিব নিয়ােগ করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে কৃষি বিভাগের সচিব হিসেবে নূরউদ্দীন, স্বরাষ্ট্র সচিব আবদুল খালেক ও অন্যান্যরা নিয়ােগপ্রাপ্ত হন। আবদুল খালেক প্রাক্তন সি.এস.পি এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সারদা পুলিশ একাডেমীতে ডি.আই.জি-এর দায়িত্ব পালনরত ছিলেন। তিনি প্রতিরােধ যুদ্ধে প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরে সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় পৌছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এই মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়ােগ করা হয় সিলেট জেলার প্রাক্তন জেলা প্রশাসক এ.সামাদকে । এ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীকে। এ ছাড়াও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন কর্ণেল এম.এ. রব এম. এন.এ। পরে তাকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়ােগ করা হয়। ডেপুটি চিফ অব আর্মি ষ্টাফ নিযুক্ত হন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার। কেবিনেট সচিব হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন হােসেন তৌফিক ইমাম। তিনি ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। তিনিও আক্রমণ শুরু হওয়ার পূর্ব হতেই রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতি সতর্ক নজর রাখছিলেন। আক্রান্ত | হওয়ার পর চট্টগ্রামের প্রতিরােধ সংগ্রামের নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তাদেরও নিয়ােগ প্রদান করা হয়। যুদ্ধরত সদ্য আত্মপকাশ করা একটি দেশে সরকারের জন্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ দফতর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে মন্ত্রী মােশতাক আহমদ মাহবুবুল আলম চাষীকে বেছে নেন। তথ্য ও বেতার

——-

৯৭৬ মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. । ৯৭৭ ঐ, পৃ, ৬৩। ৯৭৮ ঐ, পৃ. ৬৪।

মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়ােগ করা হয় আনােয়ারুল হক খানকে। প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করেন টাঙ্গাইল হতে নির্বাচিত এম.এন.এ. আবদুল মান্নান। স্বাস্থ্য ও কল্যাণ। মন্ত্রণালয়টিও ছিল প্রধানমন্ত্রীর অধীন। এই মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক/সচিব নিয়ােগ করা হয় ডা. টি. হােসেনকে। তিনি যুদ্ধের পূর্বে প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকাতে সিটি নার্সিং হােম নামে একটি বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তােলেন। সে সুবাদে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মােশতাক। আহমদ, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের অন্যান্য সদস্যসহ আওয়ামী ঘরানার বহু বুদ্ধিজীবীর সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন এবং অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয়ে অবগত ছিলেন। তার ভাষ্যমতে ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর কয়েকদিন মােশতাক। আহমদ সিটি নার্সিং হােমে লুকিয়ে ছিলেন। মুজিব নাকি মােশতাক আহমদকে বলেছিলেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে তিনি সিটি নার্সিং হােমে অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। তাই মােশতাক আহমদ সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে ডা, টি, হােসেন তাকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় পৌছেন সেইদিন (১১ এপ্রিল), যেদিন তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের ব্যাপারে নেতাদের খুজতে যান আগরতলায়।”

এই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে সম্যক। আলােকপাত করা না হলে বুঝা যাবে না কি বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের জন্য সরকারের প্রথমে প্রয়ােজন একটি শক্তিশালী বাহিনী ও যুদ্ধ পরিকল্পনা। সে অর্থে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রথমে ৮ টি এবং পরে ১১ টি সেক্টর ও ৬৯ টি সাবসেক্টরে এবং অসংখ্য ইউনিটে সমগ্র দেশকে ভাগ করে ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে ঐগুলাের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

এই মন্ত্রণালয়টি কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও পরিচালনাই করে নি। উপরন্তু, প্রচার প্রপাগান্ডার প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা প্রদান করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিয়ন্ত্রণভুক্ত থাকায় এ কাজের সমন্বয় হয় উত্তমরূপে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থাপন করা হয় যুদ্ধ-প্রচারণা সেল। (Cell)। ফলে সকল প্রচারণা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও নৈতিক বলবর্ধক উপাদান হিসেবে। যুদ্ধ যখন ক্রমাগত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে তখন

| ঐ, পৃ. ৫৭। ৯৮১ Dr. T. Hossain, Involvement in Bangladesh’s Struggle for Freedom (Dhaka: Manabatabadi Karmakendra, 2nd Edition, 2001), pp. 31-43.

সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় এবং প্রচারের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল বিভাগকে প্রচারণার ধরন সম্পর্কে একটি নির্দেশনা প্রদান করে। এ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, সরকার মুক্তিযুদ্ধকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে ধারণ করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে প্রতিরক্ষা প্রশাসনের কয়েকটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। উদাহরণ হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধ সংগ্রাম সেল, যােদ্ধাদের জন্য কল্যাণমুলক কাজ, সাহসিকতার জন্য পুরস্কার প্রদান প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায় ।

| প্রচারণার বিষয়টিকে গুরুত্বারােপ করতে গিয়ে এর নামকরণ করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধ সেল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে (বেতার, মুদ্রণ ও অন্যান্য মাধ্যম) মাঝেমধ্যেই কী ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে হবে তা অবহিত করতাে। বহিঃপ্রচার বিভাগকেও নির্দেশনা প্রদান করা হতাে এখান থেকে। এ প্রসঙ্গে প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি. ওসমানীর গণসংযােগ কর্মকর্তা (পি,আর,ও) নজরুল ইসলাম লিখেছেন:৮৩

ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধারা চব্বিশ ঘণ্টায় যে সব কর্মকাণ্ড করেছে, হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর বিশেষ করে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী, শান্তি কমিটির লােকদের হত্যা, আহত গ্রেফতার কিংবা এদের কোনাে অপকর্ম বানচাল করে দেয়া, যােগাযােগ বিছিন্ন করে দেয়া যাতে ওরা চলাচল করতে না পারে, এদের ব্যবহৃত যানবাহনের উপর হামলা, এদের সরবরাহ লাইন, এদের সহায়ক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল করে দেয়া, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিরস্ত্র নিরীহ জনগণের উপর এদের অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্মম হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন, অগ্নিকাণ্ডসহ পৈশাচিক কর্মকাণ্ড এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা ও তাদের প্রতিরােধ, জনগণের মনােবল, মুক্তিযােদ্ধার দুর্জয় অভিযানের সাফল্য ইত্যাদি উল্লেখ করে প্রতিদিন সাইক্লোস্টাইল করে ওয়ার বুলেটিন প্রকাশ করতাম। এছাড়াও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সশস্ত্রবাহিনী প্রধান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বর্হিবিশ্ব বিষয়ক প্রচার বিভাগকে এই ওয়ার বুলেটিন কপি দিতাম। এতে বিগত চব্বিশ ঘণ্টায় মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতির একটা চিত্র পাওয়া। যেতাে। বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডার তাদের সেক্টরের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের খবর ও বিভিন্ন তথ্য ও খবর তাদের নিকটস্থ ওয়ারলেস স্টেশনে প্রেরণ করতেন। ওয়ারলেস স্টেশন সে সব তথ্য ও খবর সশস্ত্র বাহিনীর সদর দফতরের স্টেশনে পাঠাতাে।

——–

৯৮২, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১২৩। ৯৮৩ নজরুল ইসলাম, একাত্তরের রণাঙ্গন কিছু কথা (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ২৯-৩০।

টেলিপ্রিন্টারে প্রাপ্ত তথ্য ও খবরকে ভিত্তি করে আমরা এই ওয়ার বুলেটিন তৈরী করতাম।

প্রচারণার কৌশল মাঝেমধ্যে পরিবর্তন করতে হতাে। যখন বিশ্বদরবারে মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও ভারতের পক্ষ থেকে (৩ার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয় তখন প্রচারণায় বাঙালি রাজাকার, আল•1দর, আল-শামস, শান্তি কমিটির প্রসঙ্গটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে প্রচার না করার অন্য বলা হয়। কেননা তা করা হলে বিশ্ববাসীর কাছে চলমান যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ না হয়ে গৃহযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অন্যদিকে বিভিন্ন অভিনব কায়দায় পাকিস্তান বাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবার পরিজনদের মনােবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য সৈনিকদের নামে পাকিস্তান থেকে আগত চিঠিপত্র ও ঠিকানা সংগ্রহ করে বাংলাদেশে তাদের দুর্ভোগের কথা লিখে ঐসব সৈনিকের আত্মীয়স্বজনের নিকট উত্তর পাঠানাে হতাে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু অঞ্চলের ঠিকানা হলে পাঞ্জাবী শাসনে তাদের দুর্ভোগের বিষয়ে লেখা হতাে। এতে ফুটে উঠতাে যুদ্ধবিরােধী মনােভাব। ভারত কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আরাে এগিয়ে প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতাে। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে পাকিস্তানীদের প্রিয় গানের অনুষ্ঠানের মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করা হতাে। বস্তুত সরকারের সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রের প্রচার-প্রপাগান্ডা হয়ে ওঠে যুদ্ধকেন্দ্রিক যার মূল লক্ষ্য হয় একদিকে মুক্তিবাহিনী ও জনগণের নৈতিক মনােবল বৃদ্ধি করা অন্যদিকে শত্রুপক্ষের মনােবল ভেঙে দেয়া। | মুক্তিবাহিনীর জন্য চিকিৎসা ও অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজ করা সরকারের বিঘােষিত নীতির অন্তর্ভুক্ত। সীমিত সম্পদ ও অর্থ দিয়ে হলেও সরকার আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নানাভাবে সহযােগিতা প্রদানের জন্য মন্ত্রিপরিষদে ৭ অক্টোবর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২৪ নভেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবার পরিজনদের জন্য ৭,০০০ করে টাকার একটি চেক প্রদান করে। অনুরূপভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কাজে উৎসাহ যােগানাের জন্য মন্ত্রিপরিষদ ২৮ আগস্ট বিশেষ ধরনের সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পরিকল্পিত সময়সীমার মধ্যে বিজয় লাভের জন্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত “লিবারেশন ওয়ার’ শিরােনামযুক্ত একটি পরিকল্পনায় নিজের বিষয়গুলােকে

—–

৯৮৪, দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ১৬৯। ১৮ই ঐ, পৃ. ২৪৪।

৩০৫

প্রাধান্য প্রদান করা হয়; যুদ্ধের কৌশলগত লক্ষ্য ও সময়সীমা নিরূপণ, যুদ্ধকৌশল নির্ধারণ, রাজনৈতিক অবকাঠামাে মূল্যায়ন, চাহিদা অনুযায়ী জনবল নিয়ােগ, প্রশিক্ষণ এবং সংগঠিতকরণ, প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ নির্ণয় ও সরবরাহ, যুদ্ধৰ্ঘাটি স্থাপন, যােগাযােগ কিংবা সিগন্যাল এবং যুদ্ধ গােয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তােলা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থায়ন। এ সব কাজে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আগেই বলা হয়েছে, তাজউদ্দীন আহমদের নিয়ন্ত্রণাধীন এই মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলেন আবদুল মান্নান এম.এন.এ। এর তিনজন পরিচালক হলেন কামরুল হাসান, আবদুল জব্বার ও এম.আর. আখতার (মুকুল)। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সকল প্রচার প্রপাগান্ডার দায়িত্ব পালন করে এই মন্ত্রণালয়টি। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এই গণমাধ্যমটি প্রবাসী সরকারের কার্যকলাপ, জনমত গঠন, যুদ্ধের পরিস্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনাতেই আবির্ভাব ঘটে বিল্পবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের । প্রথমে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কিছুসংখ্যক বেতারকর্মী এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তির উদ্যোগে এর যাত্রা শুরু হয় ২৬ মার্চ। চট্টগ্রাম চরমভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর অস্থায়ী বেতার কেন্দ্রটির যন্ত্রাংশ খুলে স্থানান্তর করা হয়। এ কাজে প্রাক্তন পাকিস্তান বেতার কেন্দ্রের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বেতার কেন্দ্র হতেও বিভিন্ন তথ্যসম্বলিত রেকর্ড নিয়ে যান বেতার কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্যদের উদ্যোগে ভারত সরকারের নিকট থেকে ৫০ কিলােওয়াট মধ্যমতরঙ্গের প্রেরণ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিচালিত কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা। সরকার গঠনের পর আনুষ্ঠাকিভাবে এর যাত্রা শুরু ২৫ মে, ১৯৭১। বালিগঞ্জ সার্কুলার রােডের বালু হক্কা লেনের ৫৭/৮ নং দ্বিতল বাড়িটির একটি কক্ষে অপ্রতুল যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ শুরু করা হলেও তা অবিলম্বে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপে গড়ে ওঠে। অনুষ্ঠান,বার্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রশাসন প্রভৃতি বিভাগে বিপুলসংখ্যক কর্মী বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে সফলভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিভিন্ন বিভাগের

———-

৯৮৬. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৭। *৯৮৭ শামসুল হুদা চৌধুরী, একাত্তরের রণাঙ্গন (ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ১৯৮৪), পৃ. ৭৫। ৯৮৮ আমির হােসেন আমু (সম্পা.), স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ (ঢাকা: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ১৯৯৭), পৃ. ৮৯; এই বেতার কেন্দ্রের বিস্তারিত কার্যক্রমের জন্য দেখুন, বেলাল মােহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৩)।

কাঠামােগত দিকের প্রতি নজর দিলে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, প্রবাসে বসে যুদ্ধরত একটি জাতি কি বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সাফল্যজনকভাবে একটি বেতার মাধ্যম গড়ে তােলে।

বিশেষ আগ্ৰদ্দীপক অনুষ্ঠানের মধ্যে এম.আর. আখতার মুকুল রচিত ও পঠিত ‘চরমপত্র খুবই জনপ্রিয় হয়। তিনি গ্রাম বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের কারণ, উৎপত্তি, অগ্রগতি, মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজাকার, আল বদর, আল সামস বাহিনী ও শান্তি কমিটির পর্যদস্ত হওয়ার কাহিনী ব্যাঙ্গাত্মকভাবে রচনা ও উপস্থাপন করতেন। প্রযােজ্য ক্ষেত্রে উপযুক্ত ভাষা ব্যবহার ও উপস্থাপন শৈলী-গুণে শ্রোতার নিকট তা জীবন্ত বলে মনে হতাে। মানুষ আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে চরমপত্র শােনার জন্য। চরমপত্রের তাৎপর্য সম্পর্কে এই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এম.আর. আখতার মুকুল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলােতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘চরমপত্র’ মূলতঃ মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দানের জন্য রচিত ও পরিবেশিত হলেও এই অনুষ্ঠান বাংলাদেশের শত্রু দখলীকৃত এলাকার সাড়ে ছয় কোটি জনগােষ্ঠী এবং ভারতে অবস্থানরত এক কোটি বাঙালি শরণার্থীদের মনোেবল দারুনভাবে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে আরাে কয়েকটি অনুষ্ঠান প্রচার করা হতাে, যথা- জাগরণী, অগ্নিশিখা, রণভেরী, দর্পণ ও রক্ত স্বাক্ষর। বিশ্ব জনমত এবং জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় অনুষ্ঠান দুটো কিছুকাল পরে শুরু হয়। বিশ্ব জনমত লিখতেন সাদেকীন। আবুল কাশেম সন্দ্বীপও মাঝেমধ্যে এর পাণ্ডুলিপি রচনা করতেন। অনুষ্ঠান দুটোর পাণ্ডুলিপি পড়তেন আমিনুল হক বাদশা। বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ পঠিত হতাে। ইংরেজি সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে ডাঃ টি. হােসেনের স্ত্রী পারভীন হােসেন বিশুদ্ধ উচ্চারণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন। ৬ জুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সার্বিক বিষয়ে সমম্বয়ের জন্য নীতি নির্ধারণী সভার আয়ােজন করা হয়। এতে উপস্থিত হন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সামাদ। ৩ সেপ্টেম্বর হতে ১৩ অক্টোবর ১৯৭১ পর্যন্ত আবদুস সামাদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পরে অবশ্য ১৪ অক্টোবর ১৯৭১ হতে আনােয়ারুল হক তথ্য মন্ত্রণালয়ের

———-

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারি ব্যক্তিবর্গের নাম সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন, শামসুল হুদা চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫-৭৫। *** এম.আর. আখতার মুকুল, চরমপত্র (ঢাকা: সাগর পাবলিশার্স, ২০০০), “আমার কথা’। *** স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানার জন্য দেখুন, ঐ, পৃ. ৬৫-৭৫।

সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন।৯২ জুলাই মাস হতে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালাও হয়ে ওঠে আরাে জোরালাে, আরাে আবেগ সৃষ্টিকারী। বস্তুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারণার মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পরে দ্বিতীয় ফ্রন্টে পরিণত হয়। এটা ছিল অনেকটা মুক্তিযুদ্ধের হৃদস্পন্দনের মত।

| এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের প্রচার মাধ্যমগুলােতে বিশেষ স্থান করে নেয়। এ ছাড়াও অবরুদ্ধ বাংলাদেশ, ভারত, গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, ডেনমার্ক প্রভৃতি স্থানে কতিপয় বাঙালির উদ্যোগে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এগুলাের মধ্যে আহমদ রফিক সম্পাদিত আওয়ামী লীগ দলীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা জয় বাংলা, কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক পত্রিকা মুক্তি, মিশ্র ধারার পত্রিকা বিল্পবী বাংলাদেশ (সম্পাদক নুরুল ইসলাম মঞ্জুর), বাংলার বাণী (আমির হােসেন), দেশ বাংলা (ফেরদৌস আহমদ কোরেশী), দাবানল (মােঃ জিনাত আলী), জন্মভূমি (মােস্তফা আল্লামা), সাপ্তাহিক বাংলা (মাইকেল দত্ত), দি পিপল (আবিদুর রহমান),স্বাধীন বাংলা (জাহানারা কামরুজ্জামান এবং মাহমুদ চৌধুরী), মুক্তি (খন্দকার আবদুল মালেক- ইবনে ইমাম) এবং মহিলাদের পত্রিকা মায়ের ডাকএর সম্পাদক নিলুফার মাহবুব (মধ্য নভেম্বর হতে প্রকাশিত) প্রভৃতি। এই পত্রিকাগুলাের কোনাে কোনটি ৫-৭টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জয় বাংলা ১১মে থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মােট ৩৪টি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তথ্য। মন্ত্রণালয় কিছুসংখ্যক পুস্তিকা, প্যাম্পলেট, ব্রশিউ (Brochure), প্রামাণ্য ছবি, ছায়াছবি প্রভৃতি প্রকাশ ও প্রচারণার ব্যবস্থা করে।

ডেনমার্কে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে ডেনিস ভাষায় একখানি সংবাদ বুলেটিন প্রকাশিত হতাে। এতে থাকতাে বাংলাদেশের মানচিত্র এবং শিরােনামে বাংলাদেশের সংবাদ । ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন শিল্পী এ.কে.এম আবদুর রউফ। সুন্দর হস্তাক্ষর ও কর্ম দক্ষতার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে সংবিধানের লিপিকারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। লন্ডনের গােরিং স্ট্রিট অফিস থেকে প্রকাশিত হতাে আফরােজ চৌধুরী

—-

৯৯২, ঐ, পৃ. ৬৬-৬৭। ৯৯৩, কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯-৭০। . জয় বাংলা, ২৮ সংখ্যা, ১৯ নভেম্বর, ১৯৭১।

আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, চতুর্থ মুদ্রণ, ২০০০), পৃ. ১১৮। ৯৯৬ আনিসুজ্জামান, ‘বিপুলা পৃথিবী’, প্রথম আলাে, ১৮ জুন, ২০০৪।

সম্পাদিত বাংলার রণাঙ্গন নামক পত্রিকাখানি। সেখানে স্টিয়ারিং কমিটি প্রকাশ করতে ইংরেজি পত্রিকা বাংলাদেশ টুডে। এছাড়াও বি.করিমের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকাও প্রকাশিত হতাে। লিডসে গবেষণারত শিক্ষার্থী নুরুল দোহা প্রকাশ করেন জয় বাংলা নামক আর একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ব্রিটেনের সকল বড় বড় শহরে, আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলাে এবং ইউরােপের অপরাপর দেশে প্রবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তােলে। নানা রকম প্রচারপত্র, স্মারকলিপি, সভাসমাবেশের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্থান করে নেয়। এর ফলে ঐ সব দেশের রাজনৈতিক মহলে অনেকাংশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে জনমত গড়ে ওঠে। | এ সব উদ্যোগের সঙ্গে বহিঃপ্রচার বিভাগও যুক্ত হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এই বিভাগের উপদেষ্টা ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এম.এন.এ এবং আমিনুল হক বাদশা। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রামাণ্য চিত্র বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা এবং বাংলাদেশের ন্যায্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায় করা। এ কাজে আরাে যারা বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করেন তারা ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ. বাদল রশিদ, শিল্পী মােস্তফা আজিজ, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জহির রায়হান ও অন্যান্যরা। বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হতাে। তার ভিত্তিতে প্রামাণ্য ছায়াছবিও নির্মিত হয়। সেগুলাে লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান আহমদ শরীফের মাধ্যমে ইউরােপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করা হয়। জহির রায়হান নির্মাণ করেন বিখ্যাত ‘স্টপ জেনােসাইড’ নামক ছায়াছবিটি। এছাড়াও গণহত্যা, শরণার্থী জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আরাে কয়েকটি প্রামাণ্য ছবি নির্মিত হয়। এগুলাের মধ্যে রিফিউজি ‘৭১ ও ডায়েরি অন বাংলাদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।

মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ডাকঘর স্থাপন করে । ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পােস্ট মাস্টার জেনারেল এবং সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করেন আবদুল আজিজ। বিমান মল্লিকের নক্সা করা ছবি স্ট্যাম্প

——

আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২। *, পৃ. ১৫২। “, পৃ.১৫২। •|জী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে বাজারে ছাড়া হয়। এগুলাে কলকাতা ও লন্ডনের বাজারে বিক্রি হতাে। বাংলাদেশ সরকার পাটগ্রামের মুক্তাঞ্চলে একটি ডাকঘর স্থাপন করে।”০২ ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ মিশন অফিসের কেন্দ্রীয় ডাকঘর থেকে ৮ টি ডাক টিকেট ও অফিসিয়াল ফার্স্ট ডে কভার বের করা হয়। লম্বা সাদা খামের ওপরে সবুজ রং-এ বাংলাদেশ’ শব্দটি লিখে এটির উদ্বোধন করা হয়।১৯০৩ ২৬ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাইকোর্ট কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ডাক টিকেট প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ ব্যাপারে। ব্রিটেনের এমপি, জন স্টোনহাউস বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ইংল্যান্ডে ডাকটিকেট প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সম্মতি লাভ করেন।”ই ডাকটিকেটের একটিতে দেখা যায় বাংলাদেশের মানচিত্র, অপর একটিতে ব্যালট বাক্স । একটি টিকেটে শিকল ভাঙ্গার ছবি। অপর একটি টিকেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। অন্য আর একটি টিকেটে দেখা যায় রক্তাক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । এসবের মধ্য দিয়ে শিল্পী বিমান মল্লিক ব্যক্ত করেন যে, বাঙালিরা নিয়মতান্ত্রিক রীতিতে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমান তাদের নেতা । কিন্তু বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দিয়ে বরং পাকিস্তান বাহিনী দেশের সর্বত্র বর্বর আক্রমণ পরিচালনা করছে যা থেকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীরাও রক্ষা পায় নি। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক প্রয়ােজনের চেয়ে কূটনৈতিক কারণেই করা হয়। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, বাংলাদেশ সরকার একটা বাস্তব বিষয়। পাকিস্তানের অপপ্রচার অনুযায়ী এটা ভারতীয় প্রচারণা বা উস্কানির ফসল নয় । | প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন ডাঃ টি, হােসেন। ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে সাহায্য করার জন্যও তাকে নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজকে

——–

১০০১, আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী বাংলাদেশ ১৯৭১ (লন্ডন: র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯১), পৃ. ৯৫। ১০০২, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১২৬-১৪৭। ২০০৩ মুহাম্মদ নুরুল কাদির, দুশাে ছেষট্টি দিলে স্বাধীনতা (ঢাকা: মুক্ত পাবলিশার্স, ষষ্ঠ। সংস্করণ, ১৯৯৯), পৃ. ১৯০। ১০০৪ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪। ১০০৫ ঐ, পৃ. ৯৪। ১০০৫ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫।

৩১০

প্রধানত দু ভাগে বিভক্ত করা হয়। শরণার্থী শিবিরগুলােতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গড়ে তােলা। এক পর্যায়ে এই মন্ত্রণালয় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসালয় স্থাপন করে। ভারত সরকারের সহযােগিতায় ডাঃ টি হােসেন, ডাঃ আসহাবুল হক, ব্যারিস্টার বাদল রশিদ, ডা.আহমেদ আলী ও অন্যান্যরা কলকাতা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে যােগাযােগ করে মুজিবনগর সরকারের একটা চিকিৎসা কাঠামাে গড়ে তােলেন। অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হয় যে, প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। বিশ্রামগঞ্জে এ ধরনের একটি হাসপাতাল গড়ে তােলার কথা জানা যায়। সেখানে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করেন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, অধ্যাপিকা জাকিয়া বেগম, লুলু, টুলু, টুকু, অনুপম দেবনাথ ও অন্যান্যরা। তবে প্রথমে সােনামুড়াতে যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছিল। পাকিস্তান বাহিনীর নিক্ষিপ্ত শেলের আঘাত হতে রক্ষার জন্য পরে এটিকে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত ভারত ভূখণ্ডের বিশ্রামগঞ্জে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রাথমিক উদ্যোগে ডাক্তারদের মধ্যে উল্লেখযােগ্যরা ছিলেন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক আখতার, ডাঃ ডালিয়া সালাউদ্দিন, ডাঃ সামসুদ্দিন ও অন্যান্যরা। | উল্লিখিত মন্ত্রণালয়গুলাে ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অধীনে রাখা হয় বেসামরিক প্রশাসনের মূল কেন্দ্র সচিবালয় । সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের, কেবিনেট সচিব হােসেন তওফিক ইমাম এবং প্রায় দেড় ডজন উপসচিব ও সহকারী সচিবকে নিয়ে গড়ে ওঠে সচিবালয়টি। | পরিকল্পনা, তথ্য ও বেতার, বেসামরিক প্রশাসন এবং অন্যান্য বিষয়াবলি পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদকে যারা নানাভাবে সহযােগিতা করেন তারা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম উপদেষ্টা, মেজর নুরুল ইসলাম (শিশু) এ.ডি.সি, ড, ফারুখ আজিজ খান একান্ত সচিব ও অন্যান্যরা। কাপ্তাইয়ে পাকিস্ত নি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ফারুখ আজিজ খান বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে অনেক কষ্টে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা পৌছেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই অনুধাবন করেন যে, অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত প্রকৃতির প্রধানমন্ত্রী খুব কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা

করছেন।১৯০৭

পরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়ে গেলে বিভন্ন। মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কমিটির কাজের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিস।

———-

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, Faruq Aziz Khan, Spring 1971 (Dhaka: The University Press Limited, 1998), pp. 173-174.

থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানাে হয় যে, বিশেষ কারণ ব্যতীত প্রতি সােমবার সকাল ৯ টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সচিব পর্যায়ের সাপ্তাহিক আলােচনা অনুষ্ঠিত হবে। ২৩ আগষ্টে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত প্রবাসী সরকার অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যকরভাবে প্রয়ােগ করে। ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কেবিনেট সময়ােপযােগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় মুক্তিযুদ্ধ সুসমন্বিত গতি লাভ করে।৭০৮

অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর ওপর । এই মন্ত্রণালয়ের একান্ত সচিব ছিলেন সাদাত হােসেন। তিনি ছিলেন যশাের জেলার প্রাক্তন জেলা প্রশাসক । সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার আসাদুজ্জামান। অর্থ মন্ত্রণালয়কে কতিপয় কাজ করতে হতাে, যেমন-বাজেট প্রণয়ন কিংবা যুদ্ধকালীন আয় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তর ও অন্যান্য উৎস। থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুতকরণ, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন, রাজস্ব ও শুল্ক আদায় এবং আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিশন গঠন। | যে কোনাে আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য এস,বড়ুয়াকে সদস্য সচিব ও এ. হান্নান এবং জে,জি ভৌমিককে সদস্য করে একটি কমিটি গঠিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব বা পূর্ণাঙ্গ বাজেট ছিল । শুধু সরকারের নয় বরং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সকল সংস্থা, বিভিন্ন দফতর, অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক অফিস, যুব ক্যাম্প, শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, বেতার প্রচারপ্রপাগান্ডার জন্য যে ব্যয় হয় তারও হিসেব সংরক্ষণ করা হয়। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে নিয়মিত সরকারের আদলে। সমগ্র প্রশাসনিক কাঠামােকে কার্যকরভাবে সংহত করা। শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প বাের্ড গঠন করা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। কয়েকজন সহকারী সচিব এখানে কাজ করতেন। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিল্প ও নিয়ন্ত্রণ বাের্ড স্থাপন করা হয়। এই বাের্ড শুধুমাত্র আয়ের বিভিন্ন উৎসই নয় বরং বাংলাদেশের। আর্থিকভাবে টিকে থাকার জন্য বিদেশে পণ্য রপ্তানির বিভিন্ন উৎস অনুসন্ধান

| পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ মাহবুবুল আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে বেছে নেন। এখানে আরাে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা ছিলেন একান্ত সচিব কামাল সিদ্দিকী, ও.এস.ডি

—–

১০০৮ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৯৮-৯৯। ১০০৯ ঐ, পৃ. ৯২।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কলকাতা মিশন প্রধান-এম, হােসেন আলী, প্রথম। সচিব- আর.আই. চৌধুরী, দ্বিতীয় সচিব-আনােয়ারুল করীম চৌধুরী ও কাজী নজরুল ইসলাম।

| খন্দকার মােশতাক আহমদের দায়িত্বে আরাে দেয়া হয় আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। এর সাচিবিক দায়িত্ব প্রদান করা হয় দিনাজপুর জেলার প্রাক্তন জেলা জজ এ. হান্নান চৌধুরীকে। তবে তিনি যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে আসেন নি। উপসচিবের দায়িত্ব পালন করেন দিনাজপুর জেলার দুজন প্রাক্তন সাবজজ রবীন্দ্র কুমার বিশ্বাস ও শিলুব্রত বড়ুয়া।

| স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের অন্যতম সদস্য এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, একান্ত সচিব-বি.বি. বিশ্বাস, সচিব- এম.এ. খালেক, উপসচিব- খসরুজ্জামান চৌধুরী। সহকারী সচিব হিসেবে অনেকেই। দায়িত্ব পালন করেন। যেমন-এস. কে. চৌধুরী, সৈয়দ মাহবুবুর রশীদ, জ্ঞান। রঞ্জন সাহা, গােলাম আকবর। এরা সকলেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিসের সদস্য ছিলেন । ষ্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন এম.এ. গফফার, ডি,এন,ব্যাপারী এবং গণসংযােগ কর্মকর্তা রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবাসী সরকারের যুদ্ধ চালানাের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন প্রয়ােজন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের মাটিতে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে তার ব্যবস্থাপনায় ভারত সরকারকে সহযােগিতা প্রদান এবং মুক্তাঞ্চলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরই সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ। | ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যা মূলত ভারত সরকারকেই মােকাবিলা করতে। হলেও প্রবাসী সরকার সরাসরি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। নানাভাবে তার ওপর চাপ পড়ে । বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ন্যায় বাংলাদেশ সরকারকে সমানভাবে শরণার্থী সমস্যার দিকে নজর দিতে হয়। তাই ত্রাণ ও পুণর্বাসন নামে একটি বিভাগ খােলা হয়, যার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় অনেকগুলাে কমিটি ও দফতরকে। এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ,এম, কামারুজ্জামান। তবে শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুণর্বাসনের ব্যাপারে অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম.এন.এ. গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যান্য সদস্যরা হলেন: আব্দুল মালেক উকিল, সােহরাব হােসেন, শামসুল হক, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ।১৯১০

—-

১০১০ কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭।

সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিল ব্যাপক। কলকাতায় আগত শরণার্থীদেরকে সার্টিফিকেট প্রদান, মুক্তিযােদ্ধা অভ্যর্থনা শিবির গড়ে তােলা, উপযুক্তদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা, বিভিন্ন ত্রাণ শিবিরের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ ও উভয় সরকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন, মুক্তিযােদ্ধা আশ্রয় ও অভ্যর্থনা শিবিরে শরণার্থীদেরকে রন্ধনােপকরণ, বস্ত্র, অর্থ প্রভৃতি প্রাথমিক উপকরণ সরবরাহ করা এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল।

যুব অভ্যর্থনা অধিদপ্তর নামে সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী যুবকদের অংশগ্রহণকে পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা। এই দফতরে বহুসংখ্যক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন। এর অধীনে ছিল একটি পরিকল্পনা বাের্ড। বাের্ডের সচিবের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন: আব্দুল মালেক উকিল, শামসুল হক, সােহরাব হােসেন, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন কাজী শামসুজ্জামান। | এই অধিদপ্তরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থাপন করা হয় ‘বােড অব কন্ট্রোল ইয়ুথ ক্যাম্পস’ নামক শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প। প্রকৃতপক্ষে সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুণর্বাসন মন্ত্রণালয় এবং যুব অভ্যর্থনা, যুব শিবির, ট্রেনিং ক্যাম্প প্রভৃতি বিষয় আন্ত-সম্পর্কিত একটি বহুমুখী প্রকল্প । তাই এ ব্যাপারে অনেকগুলাে কমিটি ও দফতর খােলা হয়। এগুলাে ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল কর্মযজ্ঞের অন্তর্ভুক্ত। | মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রহের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত এলাকাগুলােতে অভ্যর্থনা শিবির নামে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর খােলে। প্রথম দিকে শরণার্থী শিবির থেকে উপযুক্তদের বাছাই করে সরাসরি ট্রেনিং ক্যাম্পগুলােতে প্রেরণ করা হতাে। কিন্তু জুলাই মাস থেকে এর অন্তর্বর্তী আর একটা স্তর স্থাপন করা হয়, যার নাম দেয়া হয় যুব শিবির। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, শরণার্থীদের মধ্য হতে সংগৃহীত যুবকদের শারীরিক ও মানসিক উপযুক্ততা নিরুপণ করার পর সেখান থেকে যােগ্যদের যুবশিবিরে প্রেরণ করা হতাে। যুব শিবির থেকে বাছাই করে। তাদেরকে প্রশিক্ষণ শিবিরগুলােতে পাঠানাে হতাে। প্রশিক্ষণ শেষে পর্যায়ক্রমে সেক্টর, সাবসেক্টর ও ইউনিটে প্রেরণ করলে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা আক্রমণ রচনা করতাে। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যুবকদের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত

—-

ঐ, পৃ. ৩৯-৪০।

মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভারত সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুনাচরণ সেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ভারতের কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদের বাসায় এ আলােচনায় বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত হন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি. ওসমানী, পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী, সংস্থাপন সচিব মােহাম্মদ নুরুল কাদের। প্রতি মাসে এক হাজার মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে ঐ বৈঠকে প্রস্তাব। উত্থাপিত হয় যে, তিনটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলে আপাতত তিন মাসের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এর অর্থ দাঁড়ায় তিন মাসে মাত্র নয় হাজার মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তব চাহিদা অনেক বেশি, বস্তুত সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার আশংকা থাকে। তাজউদ্দীন আহমদ এ থেকে ধারণা পান যে, মাহবুবুল আলম চাষী ও অন্য দুয়েকজন স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিনঘেঁষা ড, ত্রিগুনাচরণ সেনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি নিজ হাতে গ্রহণ করতে তৎপর। সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনার পর প্রধানমন্ত্রী মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যুৰ ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরােধ জানান। নুরুল কাদেরের প্রতিরােধযুদ্ধে অবদানের কথা মনে রেখে তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যয় জন্মে যে, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে সভাপতি ও নুরুল কাদেরকে সচিব নিয়ােগ করা হলে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দানের বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে । যাহােক আলােচনাক্রমে উভয় সরকার প্রথমে ২৫ হাজার গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দানের বিষয়ে সম্মত হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্নরূপে দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগ্রহ জানিয়ে অসংখ্য যুবক প্রতিদিন ভিড় জমাতে থাকে। অন্যান্য দলের কথা বাদ দিলেও খােদ আওয়ামী লীগেই নিজ নিজ এলাকার মানুষকে গেরিলা বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করানাের জন্য নেতাদের মধ্যে। প্রতিযােগিতা শুরু হয়। সময় আরাে অগ্রসর হলে চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর জনবলের অনুপাতে যৌথবাহিনীর জনবল বৃদ্ধির জন্য আরাে দ্রুত অধিকসংখ্যক গেরিলা বাহিনীর সদস্য বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমােদন পায়। তখন এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় এক লাখ । শরণার্থী জীবনের। দুঃসহ গ্লানি তাদেরকেই কেবল অধৈর্য করে তােলে নি, প্রায় এক কোটি বাড়তি মানুষের চাপে ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও সংকটজনক হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় উভয় সরকারের লক্ষ্য হয় কিভাবে অতি দ্রুত পরবর্তী শীতের মধ্যেই

—-

১০১২, মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬।

৩১৫

বাংলাদেশকে পাকিস্তান বাহিনীর দখল মুক্ত করা যায়। কাজেই ধীর গতিতে গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দানের চিন্তা কোনভাবেই বাস্তবানুগ ছিল না। এ পর্যায়ে উভয় সরকার প্রধানত তিনটি কাজের প্রতি অধিক গুরুত্বারােপ করে: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তােলার জন্য কুটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি, চূড়ান্ত আক্রমণ হানার জন্য প্রয়ােজনীয় বস্তুগত প্রস্তুতি এবং শরণার্থী ব্যবস্থাপনা। | মুজিবনগর সরকার গােড়া থেকেই শরণার্থী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সতর্কভাবে অগ্রসর হয়। বিষয়টিকে কেবল মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয় শরণার্থীদের মনে সদ্য গঠিত সরকার সম্পর্কে যাতে ইতিবাচক ধারণা জন্মে সে বিবেচনা থেকেও প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। মে মাসের শেষ নাগাদ শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ লাখে। এমতাবস্থায় ২৮ মে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের আঞ্চলিক পরিষদের প্রশাসকদের নিকট শরণার্থীদের সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার নির্দেশ প্রদান করেন। এই নির্দেশের এক স্থানে বলা হয়:

আমি এই মর্মে আপনাকে জানাতে আদিষ্ট হয়েছি যে, বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং এই জন্য সরকার সীমান্ত এলাকার জেলামূহকে চারটি জোনে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এই সমস্ত জোনে যে সমস্ত শরণার্থী। বাংলাদেশ থেকে আসছেন এবং বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা, তাঁদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি করা যে, বাংলাদেশের একটি সরকার গঠন করা হয়েছে এবং সেই সরকার তাদেরই সরকার। এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে যদি বংলাদেশ থেকে আগত অফিসার ও কর্মচারীদেরকে ঐ সমস্ত

শরণার্থী শিবিরের কাজ-কর্ম দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়া যায়। এই নিদের্শে আরাে বলা হয়:

…ইতিমধ্যেই বন্ধুদেশ যথেষ্টসংখ্যক শরণার্থী শিবির খুলেছে এবং বন্ধুদেশের সরকারি কর্মচারীরা ঐ সমস্ত শরণার্থী শিবির পরিচালনা করছেন কিন্তু আমরা যদি ঐ সমস্ত সমস্যার সম্মুখে না আসি তাহলে আমাদের সরকার সম্পর্কে শরণার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এই সমস্ত সমস্যা দূর করার জন্য এই একটা সুযােগ । ভারতীয় সরকারি কর্মচারীদের সংগে মিলেমিশে আমাদের সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তাগণও ঐ সমস্ত শিবিরের দায়িত্ব পালন করবেন। ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সংগে যদি আমাদের কর্মকর্তাগণ শরণার্থীদের সংগে একযােগে বসবাস করেন তাহলে শরণার্থীদের সমস্যা অনেকাংশে কমতে পারে এবং শরণার্থীরা যেন মাতৃভূমিতেই আছে, এই ধ্যানধারণা পােষণ করতে পারে। আমাদের কর্মচারী ও

————-

১০১৩ কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২-৬৩।

কর্মকর্তাদের পক্ষে শরণার্থী শিবিরে শত্রুপক্ষের এজেন্টদের অনুপ্রবেশ রােধ এবং শরণার্থী শিবিরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করাও সম্ভবপর হতে পারে।

মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্য যেমন আসাম, পশ্চিম বাংলা মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরকে শরণার্থী ব্যবস্থাপনার অনুরােধ জানিয়ে ১২ মে চিঠি পাঠায়। ত্রাণ শিবিরে সরকারি জনবল নিয়ােগের একটা কাঠামাে ও নির্দেশনাও প্রণীত হয় যাতে প্রতি এক হাজার শরণার্থীর জন্য একজন অফিসার নিয়ােগের কথা স্বীকৃত হয় । যে সকল আঞ্চলিক অফিস এসব কর্মকর্তা কর্মচারি নিয়ােগ করে তার একটি তালিকা সরকারের কেন্দ্রে প্রেরণ করতে বলা হয়। | ভারত সরকারের পক্ষে ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যার সমাধান সহজতর হয় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করার পর। বলা যেতে পারে এক প্রকার সুসমন্বিত শৃঙ্খলা স্থাপন করা সম্ভব হয়। সরকারি হিসেব মতে শেষ পর্যন্ত এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যারা ভারতে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে তারা ঐ হিসাবের অর্ন্তভুক্ত ছিল না। | এই পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের আঞ্চলিক প্রশাসনিক বা জোনাল প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক আলােকপাত করা দরকার। কেননা এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, যুব অভ্যর্থনা শিবির, যুব ক্যাম্প পরিচালনা সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক সামরিক উদ্যোগের পরিপূরক হিসেবে গণভিত্তিসম্পন্ন বিকেন্দ্রীভূত একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মুজিবনগর সরকারের এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন সাধারণ প্রশাসনের অংশ হিসেবে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ পরিচালিত হয়।

| ত্রাণ শিবিরের দেখাশােনা, শিবিরের সমস্যাবলি সম্পর্কে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত এবং সমস্যার সমাধান করা, মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের কাজ তদারকি, শত্রুপক্ষের এজেন্টদের খুঁজে বের করাসহ বিবিধ লক্ষ্যে আঞ্চলিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, এই কার্যক্রম শুরু হয় ২৮ মে। তখন সমগ্র বাংলাদেশকে মােট ৪ টি জোন বা অঞ্চলে ভাগ করা। হয়েছিল। ২৪ জুন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বিস্তারিত আলােচনার পর এই সংখ্যা ৫ টিতে০১৫ এবং আরাে পরে সেক্টরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সীমানা পুনঃনির্ধারণ করলে পর্যায়ক্রমে এই সংখ্যা ১১ টিতে উন্নীত হয়।১০১৬

————

১০১৪, ঐ, পৃ ৬২। ১০১৫ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২২। ১০১৬ ঐ, পৃ. ৭৭-৭৮।

মন্ত্রিপরিষদ আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি দায়িত্ব আরােপ করে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি বা এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ-দের সমন্বয়ে এগুলাে গড়ে তােলা হয়। নিজ নিজ এলাকার নির্বাচিত সকল প্রতিনিধি আঞ্চলিক প্রশাসনের সদস্য হন। তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আঞ্চলিক প্রশাসনের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যদিকে প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে অভিজ্ঞ সচিব নিয়ােগ দেয়া হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন প্রাক্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সদস্য। তিনি ও অন্যান্য জোনাল কর্মকর্তা সরকারের নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত হতেন। সচিব আঞ্চলিক প্রশাসনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব। পালন করতেন। বাংলাদেশ থেকে যে জেলা বা এলাকা হতে মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে গমন করে তারা ঐ আঞ্চলিক প্রশাসনের অন্তর্ভুক্ত হতাে। তাদের সামগ্রিক সমস্যা দেখাশােনা এবং ঐ এলাকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সহযােগিতা করা স্ব স্ব অঞ্চলের প্রধান কাজ। এগুলাে শরণার্থী শিবির, যুব অর্ভ্যথনা শিবির, যুব ক্যাম্প প্রভৃতি পরিচালনায় নানাভাবে সহযােগিতা করতাে। প্রতিটি জোনের ছিল নিজস্ব সচিবালয় । চেয়ারম্যান ও সচিব ছাড়াও আঞ্চলিক সচিবালয়ে অর্থ, ত্রাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য, প্রকৌশল ও পুলিশ প্রভৃতি বিষয়ে একজন করে কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করতেন।১৯১৭

মুজিবনগর সরকারের আঞ্চলিক প্রশাসন সমম্বয়ের জন্য একটি সচিবালয় স্থাপন করা হয়। একজন অতিরিক্ত আঞ্চলিক প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে উপরিউক্ত কর্মকর্তাসহ একজন করে জোনাল পুলিশ, স্বাস্থ্য, ত্রাণ, শিক্ষা, প্রকৌশল, হিসাব, গণসংযােগ কর্মকর্তা, দুইজন স্টাফ অফিসার, ১ম ও ২য় শ্রেণীর দু’জন বিশেষ কর্মকর্তা, একজন অফিস সুপারিনটেনডেন্ট, দু জন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, কিছুসংখ্যক ইউডি/এলডি স্টেনােগ্রাফার, টাইপিষ্ট, পিয়ন, নাইট গার্ড প্রভৃতি প্রায় ১৫০ জনের জনবল সম্বলিত আঞ্চলিক প্রশাসনের কেন্দ্রীয় সচিবালয় গড়ে

ওঠে।১০১৮

| প্রতিটি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য পাঁচটি করে উপকমিটি গঠন করা হয় যেমন: অর্থ, ত্রাণ,স্বাস্থ্য, প্রচারণা ও শিক্ষা উপকমিটি। প্রতিটি উপকমিটি কেন্দ্রে নিজেদের দফতর স্থাপন করে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক উপকমিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতাে। অবশ্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অনুমােদন সাপেক্ষে প্রয়ােজনে আরাে উপকমিটি গঠনের নির্দেশ আঞ্চলিক প্রশাসনিক

———-

১০১৭ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৯। ১০১৮

বি.বি. বিশ্বাস, একাত্তরে মুজিবনগর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৪), পৃ. ৩৮। ১০১৯ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৮৮।

পরিষদকে দেয়া হয়। এর প্রতিটি উপকমিটিতে ৩-৭ জন সদস্যের বিধান রাখা হয়। সদস্যরা নিজেদের মধ্য হতে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন। কাজেই পদ্ধতিটি ছিল কাঠামােগতভাবে গণতান্ত্রিক বিধিসম্মত এবং জবাবদিহিতামূলক। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত প্রশাসনিক এই ব্যবস্থাটিকে স্থানীয় শাসনের একটি আদর্শ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ভেবে বিস্মিত হতে হয় যে, একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার সময়ও তাজউদ্দীন আহমদ এ ধরনের প্রশাসনিক কাঠামােতে গণতন্ত্রায়ন করতে ভুলেন নি। বস্তুত সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ ১১ টির মধ্যে ৯ টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হয়। | আঞ্চলিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য ব্যয় নির্বাহ করতে বাংলাদেশ সরকার । প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিরােধ যুদ্ধের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রশাসকরা যথাসম্ভব নিজ নিজ এলাকার ট্রেজারি হতে টাকা নিয়ে যান যা ভারতীয় মুদ্রায় ১১,২২,৮০,৬৭৮ রুপির সমান। এগুলাে ভারত সরকারের সহযােগিতা নিয়ে ব্যাংকে জমা ও কনভার্ট করার ব্যবস্থা করা হয়। এই টাকা থেকে নির্ধারিত হারে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের বেতন প্রদান ও অন্যান্য ব্যয় করা হতাে। এসবের পরেও যুদ্ধশেষে সরকারের বেশ কিছু অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল।৭২২

আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের উপযুক্ত কার্যাদি ছাড়াও নিমলিখিত বিষয়গুলােও তাদের কর্ম পরিধির আওতায় ছিল:১০২৩

১, মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তবলি বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরামর্শ প্রদান, ২. জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ট যােগাযােগ রক্ষা এবং তাদেরকে সরকারের প্রয়ােজনীয় নির্দেশ ও পরামর্শ অবহিতকরণ, ৩. শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় সংস্থাসমূহের সঙ্গে যােগাযােগ, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা, ৪. ত্রাণ শিবিরগুলাে পরিচালনা এবং সেগুলােতে অবস্থানরত দুষ্কৃতিকারীদের শনাক্তকরণ,

১০২০ এইচ টি ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২২। ১০২১

আফসান চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮১ ১০২৭. খন্দকার আসাদুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ মুজিবনগর বাংলাদেশ’ জনকণ্ঠ, ১৮ এপ্রিল, ২০০৪।

মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ.৭৯।

১০২৩

৫. যুব শিবির পরিচালনা ক্যাম্পে তাদের সামগ্রিক সহায়তা দান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ, ৬. প্রতিটি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদে এবং সেক্টর কমান্ডারদের কার্যক্রমের সমন্বয় এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যােগাযােগ রক্ষা, ৭. নিজ নিজ এলাকাঙ্খিত কোনাে অঞ্চল মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের কাজ সম্প্রসারণ করা। ৮, সদস্য সচিব চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শক্রমে আঞ্চলিক পরিষদের সভা

আহ্বান ও এজেন্ডা নির্ধারণ এবং সদস্যদেরকে নােটিশ প্রদান করতেন। আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের ওপর আরাে কতিপয় বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যেমন১০২৪

ক. যুদ্ধরত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন ও পূর্ণ। সহযােগিতা প্রদান, খ. মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পগুলাে পরিচালনা এবং সতর্কতার সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা রিকুট ও ট্রেনিং-এ পাঠানাের ব্যবস্থা গ্রহণ, গ. শরণার্থীদের দেখাশুনা ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন, ঘ. তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রকার পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও পােস্টার শরণার্থী ক্যাম্পগুলাে ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতরণের ব্যবস্থা এবং ঙ. হানাদার দখলীকৃত অঞ্চল থেকে কোনাে সরকারি কর্মচারি এসে হাজির হলে তার নাম পরিচয় লিপিবদ্ধ করে যােগ্যতা অনুসারে

কাজে লাগানাে ও বেতনের ব্যবস্থা করা। মুজিবনগর সরকারের আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের গঠন, কার্যাবলি ও পরিসর আলােচনা না করলে বুঝা যাবে না যে, সরকার কেবল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার কাজেই নিয়ােজিত ছিল না; উপরন্তু প্রশাসনিক কাঠামাের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন এবং এক প্রকার বিপ্লবও সম্পন্ন করে। এ প্রসঙ্গে মােহাম্মদ নুরুল কাদেরের মূল্যায়নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন১০২৫,

১০২৪, এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৯। ১০২৫ মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০।

৩২০

জোনাল কাউন্সিলের গঠন প্রণালি, কার্যক্রম এবং এতে দায়িত্ব পালনকারী জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারি নিয়ােগের ধরন দেখে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, জোনাল কাউন্সিল শুধু একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিটই ছিল না, এর প্রতিটি ইউনিট ছিল গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমাদের যৌথ অংশগ্রহণ এবং সম্বয়নয়ভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা আজকে স্বপ্নের বিষয় হলেও মুক্তিযুদ্ধকালে তা ছিল বাস্তব। জোনাল কাউন্সিলগুলােতে দক্ষ আমলাতন্ত্রের উপস্থিতি ছিল। আবার এসব কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রশাসনের জবাবদিহিতা ছিল রাজনৈতিক

নেতৃত্বের কাছে, প্রকারান্তরে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার শামিল। আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও একটা গতিশীল, জবাবদিহিতামূলক ও সাবলিল প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তুলতে সরকারকে সাহায্য করেন। আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ শুধু কাগজপত্রেই নয় বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধ প্রচেষ্টায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর চেয়ারম্যান ও সচিব সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে আলােচনা-পর্যালােচনার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিকল্পনায় অবদান রাখতেন। এছাড়াও এটা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় এবং বাংলাদেশ সরকারের অন্যান্য কার্যক্রমের চালিকাশক্তিবিশেষ। | আধুনিক সমরাস্ত্র-সজ্জিত পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধ শুরু করার পর উপরিউক্ত উপায়ে বাংলাদেশ সরকার রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধে মােটামুটিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ একটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, মে-জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে যে অনাস্থাভাব ও হতাশার সৃষ্টি হয় তা কাটিয়ে উঠে মুজিবনগর সরকার সংহত হয় এবং গতিশীল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামাে লাভ করে। এরপর হতে সরকারের বিভিন্ন শাখা উপশাখা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত আঘাত হানার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উক্ত দুটি ক্ষেত্রে মােটামুটি শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারা ছিল প্রবাসী সরকারের অতি তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন এবং একটি বড় মাপের অগ্রগতি। | আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের গঠন, কার্যাবলি ও ধরনের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এটা আমলাতন্ত্র ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের এক অপূর্ব সমন্বয়। এর মাধ্যমে প্রবাসী সরকার শরণার্থী ব্যবস্থাপনা, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও যুদ্ধ পরিচালনায় সকল শ্রেণীর মানুষের অংশীদারিত্বকে নিশ্চিত করে।

মুজিবনগর সরকার স্বাভাবিক সময়ের ন্যায় কৃষি বিভাগ নামক একটি প্রশাসনিক শাখা স্থাপন করে। এই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। এ.এইচ.এম.কামারুজ্জামান এবং সচিব নূরউদ্দিন আহমদ। কৃষি বিভাগকে সংগঠিত করা সম্ভব হয় নি। এতে শুধুমাত্র একজন সচিব নিয়ােগ করা হয়। দেশের স্বাধীনতা উত্তর কৃষি পুণর্বাসনের জন্য কিছু কাজ এই বিভাগ করে রাখে। ২৭ সচিবদের সভায় প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সচিবের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন যে, তিনি। যেন ভূমিসংস্কার, সমবায়, কৃষির আধুনিকায়ন প্রভৃতি বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিকল্পনা কমিশনকে সহযােগিতা করেন।২৬ | মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় নামে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর স্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের সচিব এর দায়িত্ব পালন করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়কে মূলত সরকারের নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজের সমন্বয় করতে হতাে। যেমন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মন্ত্রিপরিষদের নিকট ও সভায় পেশ করা, সিদ্ধান্তসমূহ লিপিবদ্ধ ও বিতরণ করা, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ/ অনুসরণ এবং মন্ত্রিপরিষদের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়, কিন্তু অন্য কোনাে মন্ত্রণালয়ের/বিভাগের আওতাধীনও নয় এরূপ অন্যান্য বিষয়াদি নিয়ে কাজ করতাে এই সচিবালয়টি। | মুজিবনগর সরকার একটি প্রকৌশল বিভাগ স্থাপন করে। এই বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন ইমদাদ আলী। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন উপ-প্রধান প্রকৌশলী-এম.এ. রউফ, প্রকৌশলী এম.এ.লতিফ, প্রকৌশলী এম.এ. হান্নান।

প্রকৌশল বিভাগের কাজ ছিল মূলত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরের রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, স্থাপনা ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে মানচিত্র প্রস্তুত করা। এই বিভাগ এছাড়াও অন্যান্য উপকরণ তৈরি ও সরবরাহের মাধ্যমে সরকারের যুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে সহযােগিতা করে । ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন জানিয়ে প্রধান প্রকৌশলী তার বিভাগের করণীয় বিষয়ে যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন তা থেকে এর কাজের ধরন অনেকটা অনুধাবন করা যায়, যেগুলাের মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ তরান্বিতকরণ এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার পর দ্রুততর সময়ে পুনর্বাসন কাজ শুরু করা।১০২৭

——–

১০২৬, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫৭। ১০২৭, ঐ, পৃ. ১৫৮-১৫৯।

বাংলাদেশ সরকার একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে। কাজ করার জন্য কমিশনকে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। উল্লিখিত নির্দেশিকায় আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহারসহ বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়। কমিটিতে বিশিষ্ট বিদ্বান ও পরিকল্পনাবিদদেরকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। ড.মােজাফফর আহম্মদ চৌধুরীকে সভাপতি করে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। এর অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন: ড. মােশাররফ হােসেন, স্বদেশ বসু, ড. আনিসুজ্জামান, ড. খান সারওয়ার মুরশিদ, এ.এম. হােসেন, খালেকুজ্জামান, এ.কে. রায়, ড. আনিসুর রহমান, সনকুমার সাহা প্রমুখ । কমিশনে অন্যান্য বিষয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞকেও স্থান দেয়া হয়। এরা ছিলেন ডেপুটি চিফ (টেলিফোন)- এ.এ. মাসুদ মিয়া, ডেপুটি চিফ (পাওয়ার)কে.এস.ডি, সরমান। রিসার্চ অফিসার হিসেবে নিয়ােগ করা হয় ডি.কে. কলিনগাে, তপন কুমার বােস, এম.এ. নওজেস আলী, ডি.কে. নাথ, ওয়াজেদ আলী, শ্যামল কুমার সরকার প্রমুখকে। সহসভাপতি হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয় ড.ওয়াজিউর রহমান ও উ.এম. নুরুল ইসলামকে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় প্রকৌশল, কৃষি ও অন্যান্য কয়েকটি বিভাগকে। বাংলাদেশ সরকার ১০ নভেম্বর এম.এ. গফুরকে পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়ােগ দান

করে।১০২৯

| পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই প্রায় সামগ্রিক বিষয়ে একটা রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পদক্ষেপে এগুলাের প্রতিফলন ঘটে। ৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে গৃহীত তিনটি সিদ্ধান্তের মধ্যে অন্যতম ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।৩০ ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা ড. এস, চক্রবর্তী, ডি.কে, ভট্টাচার্য এবং এ.কে, রায় কলকাতায় এসে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ২৪ সেপ্টেম্বর আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনায় মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিতকরণ এবং প্রয়ােজনীয় উপায় ও উপকরণের সংস্থান কিভাবে করা যেতে পারে তা প্রাধান্য পায়। এ সবের ধারাবাহিকতায় পরিকল্পনা কমিশন কাজ করে যেতে থাকে।

উপরিউক্ত মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কমিটি ছাড়াও কতিপয় সংস্থা মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সহযািগিতা করে। এগুলাে হলাে: বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতি।

——–

১০২৮ ঐ, পৃ. ৯৬।

ঐ, পৃ. ২০৮ । ১৮৩০ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৬।

ঐ, পৃ. ২৯৬-২৯৭।

(চেয়ারম্যান ডা. আহসাবুল হক এম.পি.এ) বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি: সভাপতি কামরুজ্জামান, এম.এন.এ। বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা (বি.ভি.এস) চেয়ারম্যান (আমীর-উল-ইসলাম, এম.এন.এ)। শেষােক্ত সংস্থাটির উপদেষ্টা ছিলেন করিমুদ্দীন আহমদ এবং মামুনুর রশীদ নির্বাহী পরিচালক। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’ এই স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা গঠনের জন্য প্রাথমিকভাবে অর্থ প্রদান করে । স্বেচ্ছাসেবকদের একটি সম্মেলন হয় জুলাই মাসে কৃষ্ণনগরে। শরণার্থী শিবিরের কাজকর্মের বিবরণসহ বিভিন্ন নির্দেশিকা সম্বলিত পুস্তিকা ছেপে সম্মেলনে বিতরণ করা হয়। রাজনীতি ও সমাজসচেতন যে সব শরণার্থীর যুদ্ধে যাওয়ার মতাে সামর্থ্য ছিল না তারা যেন মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য সহযােগিতা করতে পারে সে উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা গড়ে তােলা হয়। শরণার্থী ও আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার্থে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মকে সহযােগিতা দেয়ার জন্য একটি মেডিক্যাল এসােসিয়েশন গঠন করা হয়।১৯৩৩

মুক্তিবাহিনী

২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা প্রথমত স্ব স্ব সংস্থার বিদ্রোহী অংশের প্রতিপক্ষ অবাঙালি সদস্যদের পরিকল্পিত আঘাত হতে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য যে যেভাবে পারে প্রতি-আক্রমণ শুরু করে। তারা স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের সাথে যােগ দিয়ে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রাথমিকভাবে অনেক অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। বস্তুত এভাবেই পরবর্তীকালের মুক্তিযুদ্ধের অবয়ব তথা প্রাথমিক সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা প্রাথমিক প্রতিরােধ সংগ্রামের নেতাদের অনেকে অনেকটা ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যুদ্ধের রসদ সংগ্রহ ও সমন্বিত যুদ্ধ প্রয়াসের জন্য সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ৪ এপ্রিল একটা বৈঠকে মিলিত হন। সামরিক বাহিনীর ঐ তাৎক্ষণিক বৈঠকে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণকারী কর্ণেল ওসমানী উপস্থিত হন। তাকে প্রতিরােধ বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণের অনুরােধ করা হলে তিনি রাজি হন। এর অল্প পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের ১১ এপ্রিলে প্রচারিত জাতির উদ্দেশ্যে

——-

১০৩২, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৩৮-১৩৯। ১০৩৩, Dr. T. Hossain, op.cit., p. 281. ১০৩৪

দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ২৪৩, ২৪৪।

প্রদত্ত ভাষণে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে কতিপয় ভাগে বিভক্ত করে স্পষ্টতঃ পাঁচজন সামরিক কর্মকর্তার ওপর দায়িত্ব বিভাজন করে দেন।১৯৩৫ এখানে আরাে মনে রাখা প্রয়ােজন যে, নবগঠিত সরকার প্রতিরােধযুদ্ধে যারা যেখানে নেতৃত্বে ছিলেন তাদেরকে সেভাবেই দায়িত্ব প্রদান করে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। গড়ে ওঠা এই প্রতিরােধ যুদ্ধকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ‘জনযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে দল-বল নির্বিশেষে সকলকে এতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। তার ভাষণের সংশ্লিষ্ট অংশ নিরূপ১০৩৬,

..সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শক্রর সঙ্গে মােকাবেলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনীতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম ও নােয়াখালি অঞ্চলে সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর । নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর অক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরােধবুহ্য গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবােনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মােকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে এই প্রতিরােধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া। চট্টগ্রাম ও সমগ্র নােয়াখালি জেলাকে “মুক্ত এলাকা” বলে ঘােষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর শফিউল্লার ওপর। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযােগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছােট ছােট শিবিরগুলােকে সমূলে নিপাত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ই.পি.আর এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলার । কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রু বাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা। এখন যশােহর ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালীর ।

———–

১০৩৫ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৯-১০। ১০৩৬ ঐ, পৃ. ৮-১৫।

৩২৫

উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নােয়াজেস রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরােধ করে ব্ৰিত করে তুলেছেন। দিনাজপুর পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে । রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট

এলাকা ছাড়া বাকি অংশ এখন মুক্ত। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সামরিক ব্যক্তিত্ব পরবর্তীকালের মেজর জেনারেল কে.এম. শফিউল্লার সূত্র হতে’৩৭ জানা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অন্তত আরাে দু জন সামরিক ব্যক্তিত্বকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অঞ্চল। বিভাজন করে দেন। এদের মধ্যে মেজর নাজমুল হক-রাজশাহী-পাবনাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং ক্যাপ্টেন নওয়াজিশ-রংপুর দিনাজপুর ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তবে তারা ঐ এলাকাগুলােতে শুরু থেকেই প্রতিরােধযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম এই বেতার ভাষণে আক্রান্ত বাঙালি জাতিকে প্রভূতভাবে উজ্জীবিত করার মনােস্তাত্ত্বিক প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এ থেকে এটা পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায় যে, প্রতিরােধ সংগ্রাম ক্রমাগত সংগঠিত ও পরিকল্পিতভাবে আক্রমণাত্বক হয়ে ওঠে। বস্তুত পাকিস্তান বাহিনীর পরিকল্পিত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাঙালি জাতিকে চরমভাবে দমন করে কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে সর্বস্তরের মানুষ যার যা আছে তাই নিয়ে পাল্টা-আক্রমণ করে, যা পাকিস্তান বাহিনীর প্রথাসিদ্ধ পরিকল্পনায় ছিলনা। তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ তার প্রথম বেতার ভাষণে বাঙালি জাতির বীরত্বপূর্ণ সাফল্যের যে চিত্র তুলে ধরেন, বাস্তবতা তার চেয়ে কোনাে অংশেই কম ছিল না। এই সাফল্য এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। | দখলদার পাকিস্তান বাহিনী পরিস্থিতি পুণমূল্যায়নপূর্বক নিজেদের শক্তি সংহত করে একযােগে আকাশ ও স্থলে ভারী অস্ত্রের আক্রমণ চালায়। কর্তৃপক্ষ ২৫ মার্চ হতে ৭ এপ্রিলের মধ্যে দু ডিভিশন সৈন্য; ৯ম ও ১৬শ, আকাশপথে এনে আক্রমণ তীব্রতর করে। ফলে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ হতে মুক্তিবাহিনী। ক্রমাগত ভারত সীমান্তের দিকে নিরাপদ স্থানের সন্ধানে চলে যেতে থাকে । ততদিনে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ করে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্তে পৌছে। এততদুদ্দেশ্যে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণে যে সব

———–

মেজর জেনারেল কে, এম, শফিউল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫), পৃ. ১১০। ১০৩৮ মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯২), পৃ. ২৯।

অঞ্চলে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না সে সব অঞ্চল হতে প্রতিরােধ যােদ্ধাদের সরকারের পক্ষ হতে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এই সময় অবরুদ্ধ দেশবাসীকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যােগানাের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কতিপয় করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন। এগুলাে হলাে: সামরিক বেসামরিক কোনাে বাঙালি কর্মচারি কর্তৃক হানাদার বাহিনীকে সহযােগিতা প্রদান না করা, যে সকল কর্মচারি অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তারা। নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন এবং তারা নানাভাবে বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করবেন, সকল প্রকার সামরিক, আধাসাসরিক বাহিনীর সদস্য নিকটস্থ মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে যােগাযােগের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব গ্রহণ, পাকিস্তান সরকারকে কোনাে প্রকার খাজনা প্রদান না করা, যােগাযােগ কর্মে নিয়ােজিত। ব্যক্তিরা কোনভাবেই হানাদার বাহিনীকে সহযােগিতা না করা, নিজ নিজ এলাকায় খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, কালােবাজারি, মুনাফাখােরি, চুরি-ডাকাতি বন্ধ করা, পাকিস্তান কিংবা ইসলাম রক্ষার নামে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়া এবং পাকিস্তানের এসব দালাল সম্পর্কে সচেতন থাকা, নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য গ্রামরক্ষী বাহিনী গড়ে তােলা, শত্রুবাহিনীর গতিবিধির খবর মুক্তিবাহিনীকে অবহিত করা, শত্রুবাহিনীকে যে কোনােভাবে সাহায্য করাকে মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা বলে গণ্য করা, মিথ্যা গুজবে কান না দেয়া, নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটস্থ মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে যােগাযােগ, শত্রুপক্ষের ধৃত ব্যক্তিকে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে সাের্পদ এবং তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের সংবাদ বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।

পরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রথমেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধা তথা সিভিল সমাজের সদস্য অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারি, ছাত্র-শিক্ষক, নানা শ্রেণী পেশার মানুষ, সামরিক বাহিনীর স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী, আধাসামরিক অর্থাৎ ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একত্রিত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে ঘােষণা এবং সকল স্তরের মানুষকে তাতে অংশগ্রহণের আহ্বান জনানাের ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুলসংখ্যক তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আকাক্ষায় সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার প্রাথমিক উদ্যোগ

————

১০৩৯ মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১-৫২। ১০০০ জয় বাংলা, প্রথম সংখ্যা, ১১ মে, ১৯৭১।

সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ‘প্রিন্সিপ্যাল এইড অফিসার আমীর-উল-ইসলামকে দায়িত্ব প্রদান করেন। এ সম্পর্কে আমীর-উল-ইসলাম লিখেছেন:০৪১

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে শত শত লােক প্রতিদিন আসছে। এদের মধ্যে সরকারি কর্মচারি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, উকিল, ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্তরের লােক রয়েছে। সকলেই চলে আসে বাংলাদেশ মিশনে। এদের পেশা উল্লেখ করে নাম ঠিকানা রেকর্ড হতে লাগলাে। মিলিটারি, পুলিশ, বিডি.আর (ইপিআর), মুক্তিযােদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়ার কথা ছিল। এখান থেকে আমি তাদেরকে প্রয়ােজনীয় কাজে লাগাবার

চেষ্টা করতাম । এর অল্প পরে সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদেরকে প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে দায়িত্ব প্রদান করেন। বস্তুত অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি অসংখ্য শরণার্থী শিবির। পরিদর্শন করে একদিকে বাস্তব অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেন, অন্যদিকে মুক্তিফৌজ গঠনের লক্ষ্যে যােগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করেন। অতঃপর উপরিউল্লিখিত উপায়ে যুব অভ্যর্থনা শিবির ও যুবশিবিরে তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ শেষে অপারেশনের জন্য দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হতে থাকে। শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাের্ড অব কন্ট্রোল ইয়ুথ ক্যাম্পাস স্থাপন করা হয়। বস্তুত এটা। হচ্ছে মুক্তিবাহিনী সংগৃহীতকরণ প্রক্রিয়ার নাম। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে চেয়ারম্যান এবং নুরুল কাদেরকে সচিব করে প্রকল্পটি গড়ে তােলা হয়। মহাপরিচালক ও পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে উইং কমান্ডার এস.আর, মির্জা ও আহমদ রেজা। সদস্য ও অন্যান্য পদে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা ছিলেন: ড. মফিজ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন করিম, গৌর চন্দ্র বালা, হারুন চৌধুরী, পি.কে. বােস, রাকায়েত উল্লাহ, জেমস এস.কে. বসু প্রমুখ। | মে-জুন মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা জোরদার করলে ব্যাপক আকারে শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। এমতাবস্থায় যুব সম্প্রদায়ের বৃহদাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশপূর্বক সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করতে থাকে। বাঙালি জাতির কঠিন এই সময়ে যুব সম্প্রদায়ের আকাঙক্ষাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে সরকার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয় ইয়ুথ ক্যাম্পস-এর বাের্ড অব কন্ট্রোল ওপর। প্রথমদিকে এটি যুব অভ্যর্থনা শিবির পরিচালনা করলেও জুলাই মাস হতে সেখান থেকে কিছুসংখ্যক যুবককে আলাদা করে

——–

১০৪১ দলিলপত্র, চতুর্দশ খণ্ড, পৃ. ১২৫।

উন্নততর পরিবেশে প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ গৃহীত হয় যা যুব শিবির নামে পরিচিতি পায় । নিচে এগুলাে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােকপাত করা হলাে। | বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ৫ মাইল ভিতরে ভারতীয় ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থানে যুব অভ্যর্থনা শিবিরগুলাে স্থাপন করা হয় নিলিখিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে: শরণার্থী যুবকদের দীর্ঘ পথ পাড়িজনিত ক্লান্তি ও অবসাদ থেকে সাময়িক আশ্রয় ও বিশ্রাম দেয়া, তাদের পরিচয় জানা, শত্রুপক্ষের এজেন্ট কিনা তা পরীক্ষা করা। এবং ত্রাণ শিবিরে প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে কয়েকদিন সেখানে রাখা। আরাে। বলা হয় এ যুবকদেরকে কোনাে সুবিধাজনক স্থানে একত্রে রেখে নির্বিঘ্ন পরিবেশে। নানা বিষয়ে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের চলমান মুক্তিযুদ্ধে তাদেরকে কাজে লাগানাে, সর্বোপরি বাংলাদেশের। সুনাগরিক হতে সাহায্য করা যুব অভ্যর্থনা শিবির স্থাপনের লক্ষ্য। তাদের এ ধরনের প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশের নিয়মিত অথবা গেরিলা বাহিনীতে রিক্রুট করা হতাে। যাদেরকে ঐ দু ধরনের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতাে না তাদেরকে পূর্বোক্তদের সহায়ক শক্তি বা ভিত্তি হিসেবে কাজে লাগানাে হতাে। জুন মাসের ৬ তারিখে প্রণীত পরিকল্পনাটিতে ১০০০০০ ভিত্তি কৰ্মী, ৩৬০০০ সশস্ত্র বাহিনীর। সদস্য এবং গড়ে প্রতি মাসে ২৪,০০০ জনকে রিক্রুট করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ৫০০ জনের প্রতি ক্যাম্পে মাসে এক লাখ টাকার বাজেট বরাদ্দের কথা উল্লিখিত হয়।১৯৪২ অভ্যর্থনা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কাঠামাে সম্পর্কে প্রকল্পে প্রতি ক্যাম্পের জন্য একজন করে অধিকর্তা, সহকারী অধিকর্তা, ক্যাম্প পরিদর্শক, ছাত্র প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা রাখা হয়।

| প্রথমদিকে অভ্যর্থনা শিবিরে গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাগাদ অভ্যর্থনা শিবিরের সংখ্যা দাঁড়ায় শতাধিক। প্রশিক্ষণার্থীদের সাধারণত রাইফেল, স্টেনগান চালানাে ও হাতবােমা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে।°৪৩ যুব অভ্যর্থনা শিবিরে গেরিলাবাহিনী গড়ে তােলার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদী সামরিক প্রশিক্ষণ ও সুশৃঙ্খল কঠোর জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে তােলার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।০৪* বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুব শিবিরের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সেখান থেকেই যুবকদেরকে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে গড়ে

———

১০৪২. দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৭৪।

তালিকার জন্য দেখুন, দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৯৯-২০০ এবং কাজী। সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫-৫১।

মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৪-৮৫।

তােলার প্রক্রিয়া শুরু হতাে । সংশ্লিষ্ট সূত্র হতে ১০৬ টি যুব অভ্যর্থনা ক্যাম্প স্থাপন করার কথা জানা যায় ।১৯৪৫।

যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রের সকল যুবককে উচ্চতর অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে না। কেবল যাদের উপযুক্ত শিক্ষাসহ শারীরিক, মানসিক ও অন্যান্য যােগ্যতা ছিল তাদেরকেই উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যুব শিবিরে পাঠানাে হতাে অন্যান্যদের মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়ােগ দেয়া হতাে। যুব শিবিরের ধারণা এবং এর ব্যবস্থাপনা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটা হচ্ছে এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চিন্তা ও পরিকল্পনার ফল। যুদ্ধের শেষ নাগাদ ২৩ টি যুব প্রশিক্ষণ শিবির খােলা হয়। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টি দিলে লক্ষ করা যায় যে, প্রথমত সরকারের নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভুতভাবে মুজিব বাহিনী নামে একটি স্বতন্ত্র ধারার বাহিনী গড়ে ওঠে, দ্বিতীয়ত কিছুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর দেশের মধ্যে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণের জন্য প্রেরণ করা হয়। তবে প্রয়ােজনীয়সংখ্যক সামরিক অফিসারের বা কমান্ডারের অভাব দেখা দেয়। তৃতীয়ত অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার দাবি জোরালাে হয়ে ওঠে। চতুর্থত ভারতীয় কর্তৃপক্ষও মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করার ক্ষেত্রে সতর্ক মনােভাব ব্যক্ত করে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে বুঝা যাচ্ছিল না যে, মুক্তিযুদ্ধ কত সময়ব্যাপী স্থায়ী হতে পারে। যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে নতুন প্রজন্মের নিকট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, আদর্শ পৌছে দেয়ার প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। এমতাবস্থায় জুলাই মাস থেকে যুব অভ্যর্থনা শিবির হতে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বাছাইকৃত যুবকদের যুব প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রেরণ করা শুরু হয়। এখানে তাদেরকে আরাে উন্নত পরিবেশে, উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ ও রাজনৈতিক আদর্শসম্বলিত একটি প্যাকেজ কর্মসূচির অধীনে দক্ষ গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা গড়ে তােলা হয়। নাম রেজিস্ট্রেশনের পর যুবকদের ৩৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ রুটিন পালন করতে হতাে। যেমন প্রথম থেকে ১৬শ দিন পর্যন্ত

——-

১০৪৫ ঐ, পৃ. ৮০। ১০. যুব ট্রেনিং শিবিরগুলাে হলাে: ১. ব্যারাকপুর, ২. বােতাল, ৩, ছাপড়া (বাংগালজী), ৪. পিটা, ৫, জমসেরপুর, ৬, গৌর বাগান, ৭. পাত্ৰাম, ৮. ধানসারীগাও, ৯, গকুলনগর১, ১০. গকুলনগর-২, ১১, টাপুরহাট, ১২,চারিলাম-১, ১৩, চারিলাম-২, ১৪, কাঠালিয়াচরা, ১৫. মেনু, ১৬. বাগিতা, ১৭.কালেনগর, ১৮, হাসন, ১৯.লাবাে, ২০. সলিন, ২১. ক্লোভার হাউস, ২২.ডালু, ২৩,পরিপল। এর মধ্যে কুচবিহারে অবস্থিত ডালু যুব শিবিরটির সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারত সরকার। কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ.

১৯৫।

* মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২। ১০৪৮ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৭৩-৩৯২।

৩৩০

যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। অতঃপর পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণরা মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র শাখায় যােগদানের সুযােগ পেতে এবং ২০তম দিবস হতে ৩২তম দিবস পর্যন্ত অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। অতঃপর ৩৩ ও ৩৪তম দিবসে অভ্যর্থনা ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা রাজনৈতিক মটিভেশন প্রদান করতেন। এ সময় নেতারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বুঝাতেন যে, স্বাধীনতা লাভ করতে হলে নিজেদেরকেই যুদ্ধ করতে হবে; নিজেদের মুক্তি নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। শক্তি সম্পদের দিক বিবেচনা করে গেরিলা পদ্ধতিতে তাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ ‘হিট এন্ড রান’ হবে যুদ্ধ কৌশল । তাদেরকে আরাে বুঝানাে হতাে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ উন্নততর হলেও তারা বেতনভােগী যােদ্ধা মাত্র। আর মুক্তিবাহিনী যুদ্ধ করছে সত্য ও ন্যায়ের জন্য, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। সুতরাং তাদের বিজয় অনিবার্য। ঐ দু দিনে তাদের যােগ্যতার ভিত্তিতে গ্রুপিং করা হতাে এবং গ্রুপ লিডার ঠিক করে নিদিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করা হতাে। ৩৫ তম দিবসে হতাে পাসিং আউট । তার পর তারা দায়িত্ব নিয়ে নির্ধারিত সেক্টর/সাবসেক্টরে চলে যেত। এভাবে দেখা যায় মােটামুটি দেড় থেকে পৌনে দুই মাসের মধ্যে একজন উপযুক্ত শরণার্থী যুবককে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধায় পরিণত করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে সম্ভব হতাে | অন্যদিকে অনুত্তীর্ণদেরকে আবারও ১৬ দিনব্যাপী উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণের অন্ত ভুক্ত করা হতাে। এরপরও যারা অনুত্তীর্ণ থাকতাে তাদেরকে সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী হিসেবে দেশের মধ্যে পাঠানাে হতাে। কেননা তারা যুদ্ধ করার জন্য উদগ্রীব, তাদের পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তাদেরকে শেখানাে হতাে “গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়/ শেখ মুজিবের অস্ত্র ধরাে”। এদেরকে বলা হয় ভিত্তি ফৌজ’ । তাদের কাজ নির্ধারিত হয় তৃণমূল পর্যায়ে। তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে আরাে শেখানাে হয় যে, শত্রু-কবলিত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা নিজেদের অনুকূলে রাখতে হবে, উৎপাদন ব্যবস্থা রাখতে হবে অব্যাহত। তাদেরকে রাজনৈতিক প্রশিক্ষকরা বুঝাতেন, যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সরকার যাতে বেকায়দায় না পড়ে সেজন্য উৎপাদন ব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলার প্রতি ভিত্তিফৌজের সদস্যদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের কর্মক্ষেত্র হয় শত্রুকবলিত দেশের ভিতরে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি গ্রামে ৫-৭ জনের ভিত্তিফৌজ পাঠানাে হতাে। তাদেরকে দায়িত্ব প্রদান করা হতাে গ্রামের

মানুষদেরকে নিয়ে গ্রামপঞ্চায়েত প্রকৃতির স্থানীয়শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার ভিত্তিফৌজের ধারণা ছিল সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ।১৯৪৯ | ভারত সরকারের সহায়তায় তাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যুবশিবিরগুলাে গড়ে উঠলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেয়ার ভার পড়ে বাংলাদেশের (প্রাক্তন) পুলিশ, ইপিআর ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর অফিসারদের ওপর । যুব ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনাও ছিল অনেকটা অভ্যর্থনা শিবিরের ন্যায়। তবে প্রশিক্ষণের মান আরাে উন্নত করা হয়। এখানে দায়িত্ব পালন করতেন একজন করে ক্যাম্প অধিকর্তা, সহকারী অধিকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। এ ছাড়াও প্রতি ২৫০ জনের জন্য একজন রাজনৈতিক প্রশিক্ষক নিয়ােগ দেয়া হতাে। যুব প্রশিক্ষণ শিবিরের ৬ মাসের সর্বমােট ১,২৫,০০,০০০ রুপীর একটি বাজেট এবং ৫০,০০০ যুবককে প্রশিক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রকল্প গৃহীত হয়।°৫২ ৬ নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত উল্লিখিত ২৩ টি যুব প্রশিক্ষণ শিবিরে মােট ২০,৯৬৪ জন যুবকের প্রশিক্ষণদান করা সম্ভব হয় ।”৫৩

| প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা গড়ে তােলার লক্ষ্যে এভাবে প্রতিষ্ঠিত অভ্যর্থনা শিবির ও যুব ক্যাম্পের গঠন, কাঠামাে, নিয়মনীতি, ধরন, প্রশিক্ষণ প্রভৃতি সম্পর্কে যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, এটা ছিল সরকারের আর একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ।১৯৫৪

বাের্ড অব ইয়ুথ কন্ট্রোল এক প্রকার যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সতর্কতার সঙ্গে যুব শিবিরগুলাের ব্যবস্থাপনা করতে অগ্রসর হয়। এতে অবশ্য মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধসক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মােটামুটি জুলাই মাস থেকে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার শীতের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রশ্নের একটা সমাধানে আসার পরিকল্পনায় হাত দেয়। কিন্তু তা করতে হলে যে সংখ্যায় মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার তা বিদ্যমান অবস্থায় চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে বিবেচিত হয়। এ ধরনের বাস্তবতার আলােকে মুক্তিযােদ্ধা রিক্রুটমেন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি করার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে যুব অভ্যর্থনা শিবির ও যুব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সংখ্যা ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ট সুত্র হতে জানা যায় যে, আগস্টের

১০৪৯ যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম সম্পর্কে দেখুন, মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮২৮৮। ১০৫০ কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৪। ১০৫১ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৫৮৩-৫৮৪। ১০৫২, ঐ, পৃ. ৩৭৮। ১০৫৩ ঐ, পৃ. ১৯৯-২০০। ১০৫* দেখুন, ঐ, পৃ. ৩৭৩-৩৮৩।

মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযাদ্ধার সংখ্যা হয় প্রায় দশ হাজার। বাস্তব। অবস্থা বিবেচনা করে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিমাসে কুড়ি হাজার মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ দানের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।৭৫৫ কিন্তু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয় নি। অবশ্য ১৫, ১৬ ও ২১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র এবং সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রী কামারুজ্জামানের সভাপতিত্বে বােড অব ইয়ুথ কন্ট্রোল বিশেষ অধিবেশনে কিছু উন্নততর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।৭৫৭ | অন্যদিকে এপ্রিলের শুরুতে ভারত সরকারের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের কার্যকর যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশর বিষয়ে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৯ মে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার ব্যাপারে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ১৯ মে তাজউদ্দীন আহমদের সরকার বিভিন্ন ধরনের সশস্ত্র বাহিনী সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে ভারত সরকার মে মাস থেকে সীমিত আকারে সশস্ত্র সাহায্যদানের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেই সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণদানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষক নিয়ােগ এবং হালকা ধরনের অস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে।৬° ভারতের পক্ষ থেকে সামরিক সহযােগিতার আশ্বাস পাওয়ার পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকারী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীকে প্রয়ােজনীয় কিছু অস্ত্রের তালিকাসহ লিখিতভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা তার নিকট পেশ করতে বলেন। এ পর্যায়ে কর্ণেল ওসমানী প্রথাগত যুদ্ধের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। অন্যদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ লক্ষ্য অর্জনের জন্য উভয় প্রকার বাহিনীর সমন্বয় সাধনপূর্বক যুদ্ধ পরিচালনার প্রতি প্রাধান্য দেন। প্রধান সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিগত এই পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণদানের কাজ অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলে। প্রতিরােধ যুদ্ধ যে স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় বিকাশ লাভ করে তাতে দেখা যায়, আধাসামরিক বাহিনীগুলাের বাঙালি সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করলেও এবং বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর তুলনায় তাদের অবদান কোনভাবেই কম

———

১০৫৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪। ১০৫৬, ঐ, পৃ. ১১০-১১১। ১০৫৭ ঐ, পৃ. ১১৬।

ঐ, পৃ. ২১। ঐ , পৃ. ৪৯।

মজিবর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ও রাজনীতি (ঢাকা: বড়াল পকাশনী, ১৯৯৪), পৃ. ৫৭।

2050

হওয়া সত্ত্বেও তা ক্রমশ বেঙ্গল রেজিমেন্টনির্ভর হয়ে ওঠে, মূলত আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করে লক্ষ্য অর্জনের কারণে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব সদস্য নেতৃত্ব প্রদান করেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সমপদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কর্তৃত্ব লাভের এক ধরনের প্রতিযােগিতা ছিল। এর প্রভাব পড়ে স্বাধীনতা-উত্তর সেনাবাহিনী ও রাজনীতিতে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রথাগত অবজ্ঞা ও উন্নাসিকতাহেতু রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারি বাঙালি সামরিক ব্যক্তিদের তেমন আস্থা ছিল না। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে যুদ্ধ চলাকালে তাদের অনেকের বিভিন্ন ঘােষণা, মন্তব্য ও প্রস্তাবে। যেমন: মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে প্রতিরােধ সংগ্রাম চলাকালে এক সময় নিস্পৃহভাবে মন্তব্য করেন ‘পুওর শেখ! হি মাস্ট বি রটিং ইন দি আটক প্রিজন নাউ’। আমি চমকে উঠে জানতে চাইলাম, ‘ডু ইউ নাে ফর শিওর? উনি বললেন, ‘দিজ ইজ মাই গেস।৬২ রাজনৈতিক নেতৃত্বে চট্টগ্রামে প্রতিরােধ শুরু হলে, এক পর্যায়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অনুভুত হয়। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, সদ্য স্থাপিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের জন্য মেজর জিয়াকে অনুরােধ করা হলে কিছু ঘটনা পরম্পরায় তিনি প্রথম দিকে নিজেকে ‘Provisional Head’ হিসেবে ঘােষণা দেয়ার প্রয়াস পান। রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনার ব্যাপারে ঐ সামরিক অফিসারদের অনেকের পক্ষ থেকেই বিরােধিতা লক্ষ করা যায়। যাহােক পরিকল্পিত আক্রমণ রচনার পূর্বেই তাদের পক্ষ হতে কর্ণেল ওসমানীকে সেনাপতির পদ হতে সরিয়ে তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগদান এবং ‘ওয়ার কাউন্সিল’ গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এর দ্বিবিধ উদ্দেশ্য ছিল বলে অনুমান করা যায়: প্রথমত কয়েকজন মেজর পদমর্যাদার সামরিক ব্যক্তি কর্তৃক তাজউদ্দীন আহমদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে সামরিক ব্যক্তি ওসমানীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষা; দ্বিতীয়ত ওসমানীর বাহ্যত কঠোর সামরিক শৃঙ্খলাপূর্ণ কিন্তু পুরনাে ধাঁচের সেনাপতিত্বের প্রতি অনাস্থা জানানাে। সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রে ও সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় এ ধরনের প্রস্তাব আসে। যে ব্যাখ্যাই দেয়া হােক না কেন,

———

১০৬১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ (ঢাকা: অন্য পকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ১২৪-১২৫। ১০৬২, মােহাম্মদ নুরুল কাদের, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫। ১০৬৩ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ৭১ এর দশমাস (ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ৮২। ১০৬৪ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৯-১৩০।

পরবর্তীকালে তিনটি ব্রিগেড গঠন ও তার দূরবর্তী ফলাফল সেটাই প্রমাণ করে । জিয়াউর রহমান ছাড়াও অন্য দু জন ব্রিগেড কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ ও মেজর শফিউল্লাহ ওসমানী ব্যতীত একই সঙ্গে সংগ্রামরত অন্য কোনাে সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির কর্তৃত্ব মানতেন বলে মনে হয় না। যুদ্ধ চলাকালেই এক প্রকার প্রতিযােগিতা পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের উচ্চাক্ষা এবং ওসমানীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন জটিলতার জন্ম দেয়। সামরিক ক্ষেত্রে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিশ্চিতভাবে শত্রুপক্ষ এর সুযােগ গ্রহণ করতাে এবং মুক্তিযুদ্ধকে আরাে জটিল করে তুলতাে। প্রথমদিকে তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ডিঙ্গিয়ে ভারতীয় সাহায্য সংগ্রহে সচেষ্ট হন বলেও জানা যায়। এক পর্যায়ে মেজর খালেদ মােশাররফ এবং মেজর জিয়াউর রহমান একটি বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করলে তা নিয়ে ভারত সরকার ও প্রবাসী সরকারের মধ্যে তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এ ধরনের প্রচেষ্টা ঠিক দোষের না হলেও সরকার গঠনের পর এ ধরনের আচরণ শৃঙ্খলাপরিপন্থী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, প্রবাসে সরকার গঠন করা। এবং তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্বকে রাজনৈতিক একটি মহল মেনে নেয় নি। কার্যত উপরিউক্ত দু প্রকারের বিরােধিতার ধরনের মধ্যে ঐক্যগত সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় । কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের প্রাজ্ঞ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ উভয় ধরনের প্রচেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দেয়। প্রাসঙ্গিকভাবে আরাে উল্লেখ্য যে, উদ্ধৃত বাস্তবতায় কর্ণেল ওসমানী সমগ্র বিষয়টি অনুধাবন করতে কতটুকু সক্ষম ছিলেন সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে । জানা যায় ভারতীয় সমরবিদরা এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্নও ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ একজন সমরবিদ না হলেও বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে অবহিত ছিলেন । তিনি তার দূরদর্শী কূটনৈতিক দক্ষতা ও যুদ্ধভাবনার কারণে ভারতীয় কূটনীতিবিদদের মাধ্যমে সেখানকার সমরবিশারদদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। কর্ণেল ওসমানীর সামরিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তােলা গেলেও মুক্তিযুদ্ধে তার আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয় নি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অবস্থানগত কারণে তার অবস্থান সম্ভবত অপরিবর্তনীয় ও যথার্থ ছিল; বস্তুত তিনি এক্ষেত্রে ছিলেন সরকারের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রয়াসের যােগসূত্রবিশেষ।

——–

১০৬৫ ঐ, পৃ. ১৩০। ১৬. আনিসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৫-১৬৬। ১০১৭

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২।

৩৩৫

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি সরকার নিয়ন্ত্রিত বাহিনীসমূহকে সংক্ষেপে এফ,এফ বা ফ্রিডম ফাইটার্স বলা হয়। এফ.এফ কয়েকটি শাখায় বিন্যাস্ত। যেমন- গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনী। গেরিলা বাহিনী জল ও স্থল সর্বত্রই শক্রর বিরুদ্ধে দক্ষতার সঙ্গে আক্রমণ রচনা করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, প্রাক্তন ইপিআর, আনসার ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত বাহিনী গঠিত হয়। বিমানবাহিনীর সদস্যদেরকে প্রথমে স্থল বাহিনীতে কাজ করতে বলা হয়। পরে ছােট কলেবরে হলেও বিমানবাহিনী স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সামগ্রিকভাবে উল্লিখিত সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে পরবর্তীতে সেক্টর ট্রপস এবং বিগ্রেড গঠন করা হয়। শত্রু বাহিনীকে সামনাসামনি মােকাবিলা করার লক্ষ্যে নিয়মিত বাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। অর্থাৎ গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী যখন আতঙ্কগ্রস্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে তখন নিয়মিত বাহিনী সামনাসামনি তাদেরকে মােকাবিলা করবে। এছাড়াও পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ রচনায় অঞ্চলবিশেষে গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনী শক্তি যােগাতে পারবে। নিয়মিত বাহিনী গঠনের আর একটি উদ্দেশ্যের কথা জানা যায়, বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি প্রথাসিদ্ধ যুদ্ধ পরিচালনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ প্রক্রিয়ায় দেশের কোনাে কোনাে সুবিধাজনক অঞ্চল দখল করে সেখান থেকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা তার মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল । কিন্ত ভৌগােলিক অবস্থা ও উদ্ভূত বাস্তবতায় এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত ছিল তা বলা দূরূহ। কেননা আধুনিক নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলার জন্য আকাশ ও নৌপথ ব্যবহারের সুযােগ থাকা আবশ্যক। সে ধরনের অবকাঠামাে গড়ে তােলার জন্য মুজিবনগর সরকারের যথেষ্ট সামর্থ্য, সময় ও সুযােগ ছিল না। সে বিষয়ে ভারতের প্রতি সরাসরি নির্ভর করা ছাড়া। কোনাে বিকল্প দেখা যায় না। আর ভারত সরাসরি ঐ পর্যায়ে অনুরূপ সহযােগিতা দিলে শুরুতেই ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়তাে। ঐ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কূটনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা ছিল। | নিয়মিত ও অনিয়মিত স্থলবাহিনীর পাশাপশি ভারতীয় সহযােগিতায় কার্যকরভাবে নৌবাহিনী গড়ে তােলার উদ্যোগ গৃহীত হয় মে মাস থেকেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাস মােটামুটিভাবে বর্ষাকাল। এ সময় মরু অঞ্চলের অধিবাসী পাকিস্তান বাহিনীর গতিবিধি সঙ্কুচিত হয়ে আসবে বলে অনুমান করা হয়। বর্ষা মৌসুমে তাদেরকে আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করে দেয়া এবং সমুদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশ সীমানায় গেরিলা আক্রমণ চালানাের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ

সরকার নৌবাহিনী গড়ে তােলার কাজে হাত দেয়। সরকারের এই প্রয়াসে শামিল হয় পাকিস্তান নৌবাহিনীর কতিপয় সদস্য। ফ্রান্সের নৌবন্দর তুলনে অবস্থিত পাকিস্তানের ডুবাে জাহাজ পি.এন,এস, ম্যাংগ্রোতে প্রশিক্ষণরত ৮ জন বাঙালি নৌ-কমান্ডাে পালিয়ে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। পাকিস্তানে অবস্থানরত নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের অনেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশ পক্ষে যােগ দিলে সরকারের নৌবাহিনী গঠনের কাজ ত্বরান্বিত হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগিতায়। ভাগিরথীর তীরে পলাশী স্মৃতিসৌধের পাশে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে লােকচক্ষুর অন্তরালে গড়ে উঠতে থাকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রাথমিক কাঠামাে। প্রথম দুটি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয় জুলাই মাসে। প্রশিক্ষণ শুরুর প্রথম দিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও জেনারেল ওসমানী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুপ্রেরণা দেন। | ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার সুমন্ত (ক্যাম্প কমান্ডার) ও কমান্ডার মাটিস (ক্যাম্প পরিচালক) এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ১৩ মে। দেশের স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে আত্মােৎসর্গ করার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারি ‘সুইসাইডাল প্রকৃতির এই নৌ কমান্ডাে বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ৩৫৭ জনের প্রশিক্ষণ শুরু হয় প্রথম ব্যাচে। নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি দীর্ঘমেয়াদী । কিন্তু বর্ষাকালকে সামনে রেখে খুব দ্রুত নৌকমান্ডাে গঠনের কাজ এগিয়ে নেয়া হয়। নৌ কমান্ডাে দল গঠনের লক্ষ্যে ‘সি-২ পি’ সাংকেতিক নামের ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা দেশপ্রেমের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বল্প পরিমান খাদ্য ও অপ্রতুল সুযােগ সুবিধার ভেতরেও ট্রেনিং এর প্রচণ্ড কষ্ট সহাস্যে বরণ করে নেয়। ট্রেনিংয়ের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহের মধ্যে ৯- ১০ ঘন্টান বিভিন্ন প্রকার সাঁতার কখনাে তার ও লিমপেট মাইনসহ সঁতার, কখনাে রাতের জন্যে নিঃশব্দে সাঁতার। অপারেশনের কৌশল, গ্রেনেড নিক্ষেপ, অস্ত্র ব্যবহার এবং চূড়ান্তভাবে সাতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়। | পাকিস্তান বাহিনীর নিকট থেকে কেড়ে নেয়া কয়েকটি নৌযান ও পশ্চিম। বাংলা সরকারের নিকট থেকে সংগ্রহ করা দুটো জাহাজ নিয়ে গঠিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বস্তুগত কাঠামাে। নৌযানগুলাে হলাে: বঙ্গ শার্দুল, বঙ্গ অসি, বঙ্গ বীৰ্য্য, বঙ্গ তরী, বঙ্গ আশা এবং ৭ টি স্পীডবােট। পশ্চিম বাংলা

—–

হুময়ন হাসান, মুক্তিযুদ্ধের জলসীমায় (ঢাকা: ম্যাগনাম ওপাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯৯), পৃ. ৪৮।

১৮.b৯

ঐ, পৃ. ৬৩।

সরকারের দেয়া জাহাজ দুটোর নাম পদ্মা ও পলাশ। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী এগুলােকে হলুদ রঙে রঞ্জিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ আগষ্ট হতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কমান্ডােরা অত্যন্ত সফল অভিযান চালিয়ে শত্রুর প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডােদের বিস্ময়কর অস্তিত্বের কথা প্রকাশিত হয়। তাদের আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ-নৌযানগুলাে ধ্বংস হয়ে যায়। এই সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনী শত্রুপক্ষের ১৫টি পাকিস্তানী জাহাজ, ১১টি কোস্টার, ৭টি গানবোেট, ১১টি বার্জ, ২টি ট্যাঙ্কার ও ১৯টি নৌযান দখল করে, ধ্বংস করে অথবা ডুবিয়ে দেয়।”৭° নৌ কমান্ডােরা আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৬৬০৪০ টন ক্ষমতার জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত ও ৫০৮০০০ টন জাহাজ নিমজ্জিত করে দেয়। এর ফলে বাংলাদেশগামী বাণিজ্য জাহাজগুলাের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফলে পাকিস্তানের বাণিজ্যের ওপর চাপ পড়ে।” আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু করা এ আক্রমণের ফলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নৌশক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের এ সাফল্য মুক্তিবাহিনীকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে দেয় । | নিয়মিত বাহিনীর অংশ হিসেবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের একটি বিমানবাহিনী গড়ে তােলার ইচ্ছা ছিল। ১৭ মে নাগাদ বিমানবাহিনীর প্রায় তিনশত জুনিয়ার টেকনিশিয়ান বিভিন্ন পথে ভারতে গিয়ে পৌছলে বিমানবাহিনীর তকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকার সরকারের নিকট এ ধরনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে তখন সেটা করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান পিসি লাল স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাৎ করে সহযােগিতার আশ্বাস দেন। অল্প পরে নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুর বিমানঘাটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গােড়াপত্তন হয় ২৮ সেপ্টেম্বর। কয়েকটি হেলিকপ্টার, একটা অটার, একটি ডাকোটা বিমান নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু। এগুলাে সবই ভারত সরকারের নিকট থেকে প্রাপ্ত। বাস্তব ক্ষেত্রে এ দিয়ে আকাশযুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। তার পরেও এসব

——

লে. জেনারেল জে.আর.এফ. জেকব, সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, আনিসুর রহমান মাহমুদ (অনু.) (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৯), পৃ. ৭০। এরপর লেখা হবে লে, জেনারেল জেকব। ১০৭ মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ঢাকা: ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৯২), পৃ. ৩৫৫। ১০৭২, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ, ১৯৭।

সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ- আলােকের অনন্তধারা, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৭৬।

বিমান ও হেলিকপ্টারে মেশিনগান যােগ করে শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। সিলেট বিমানঘাঁটিতে এভাবে আক্রমণ করা হলে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি সি ১৩০ বিমান আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শমসেরনগরে জরুরি। অবতরণ করতে বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে মুজিবনগর সরকারের একটি বড় রকমের গর্বের বিষয় এই যে, চূড়ান্ত যুদ্ধের সূচনাতে ৪ ডিসেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদস্যরা প্রথম আঘাত হেনেছিল।” | মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলােচনায় মুজিব বাহিনীর বিষয়েও আলােকপাত করা আবশ্যক। মুজিব বাহিনী মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত মূলত একটি সামরিক প্রচেষ্টা, যার সঙ্গে একটি ক্ষীণ রাজনৈতিক সংশ্রব লক্ষ করা যায়। ভারতীয় সরকারের উচ্চতম মহলের ইচ্ছায় এর উৎপত্তি। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় কতিপয় যুব ও ছাত্রনেতাকে। বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী এসব ছাত্র ও যুবনেতাদের মধ্যে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, তােফায়েল আহমদ, আবদুর রব, আবদুল কুদুস মাখন, সিরাজুল আলম খান, কাজী। আরেফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এ সকল নেতার সঙ্গে ভারতীয় একটি বিশেষ সংস্থার সংযােগ স্থাপিত হয়। এ কাজে শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতায় অবস্থানকারী প্রতিনিধি চিত্তরঞ্জন সুতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করেন।৭৭৬ ভারতীয় পক্ষে মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারে সরাসরি কাজ করেন জেনারেল ওবান । বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে ভিন্ন ধারার একটি বাহিনী। কিভাবে সুকৌশলে পূর্বোক্ত চিত্তরঞ্জন সুতারের সহযােগিতায় জেনারেল ওবান গড়ে তােলেন তা জানা যায় মাসুদুল হকের বিশ্লেষণ হতে:

কাজটি তার (ওবানের) জন্য সহজ হয়ে গেল তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হবার ঘটনায় । তাজউদ্দীন আহমদ হঠাৎ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের চার যুবনেতা। তাদের বিক্ষুব্ধতার সুযােগ নেয়া হলাে । যদিও তাদের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল আগে থেকেই, অন্যভাবে।

এবং গড়ে ওঠে মুজিব বাহিনী। চিত্তরঞ্জন সুতারের সহযােগিতায় ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ তাজউদ্দীন আহমদ বিরােধী উক্ত ছাত্র ও যুবনেতাদের ব্যবহার করে স্বাধীনতার জন্য।

——-

রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯২), পৃ. ১২৮-১২৯। ১৫৭৫ এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩। ** মাসুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সি আই এ (ঢাকা: ওসমানিয়া •াইব্রেরী, ১৯৯০), পৃ. ৯৭।

নিবেদিতপ্রাণ তরুণদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র ধারার একটি বাহিনী গড়ে তােলে। জেনারেল শ্যাম মানেকশ’-এর পরিচালনায় এবং অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওবানের তত্ত্বাবধানে এই বাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জেনারেল ওবান এক সময় চীন-ভারত যুদ্ধে তিব্বতে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরাস্ত হয়ে একপ্রকারে পালিয়ে আসেন। ভারতের পক্ষ থেকে রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ঠিক কোন কারণে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূতভাবে আর একটি সামরিক সংগঠন গড়ে তােলা হয় তা স্পষ্ট নয়। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। আহমদের ঘনিষ্ট মঈদুল হাসানের পর্যবেক্ষণটি উল্লেখ করা যেতে পারে:

প্রথমদিকে মুজিব বাহিনীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের তিনটি সম্ভাব্য কারণ অনুমান করা হয়: (১) শেখ মণির দাবী অনুযায়ী, সত্যই কেবল মাত্র তারাই স্বশস্ত্র বাহিনী গঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কর্তৃক মনােনীত প্রতিনিধি এবং এই সম্পর্কে ভারত সরকারের উর্ধ্বতন মহল কেবল অবহিতই নন, অধিকন্তু এদেরও সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; (২) যদি কোন কারণে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা নেতৃত্বদানে ব্যর্থ হন, তবে সেই অবস্থার বিকল্প নেতৃত্ব হিসাবে এদেরকে সংগঠিত রাখা এবং (৩) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কোনাে কারণে দীর্ঘায়িত হলে বামপন্থী প্রভাব যদি বৃদ্ধি পায়, তবে তার পাল্টাশক্তি হিসাবে এদের প্রস্তুত করে তােলা । কিন্তু কেবল শেষােক্ত এই দুই আশঙ্কা থেকেই প্রথম দিকে যদি ‘মুজিব বাহিনীকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে, তবে বলা যায় আগস্ট নাগাদ দুটো

আশঙ্কাই প্রায় অমূলক হয়ে পড়েছে। | আগস্ট মাস নাগাদ মুক্তিযুদ্ধ প্রচণ্ডতা পায়। বিশেষ করে দুটি ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের গতিকে প্রবলভাবে ত্বরান্বিত করে। জুন মাসের শেষ দিক থেকে গেরিলা বাহিনী তৎপরতা শুরু করে এবং তা ক্রমাগত দেশের ভিতরে অগ্রসর হয়ে বেশ কিছু সাফল্য বয়ে আনে। কিন্তু আগস্ট মাসে উল্লিখিত নৌ কমান্ডােদের সাফল্য শত্রুবাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়, যা সামরিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিশাল অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানকল্পে ভারত সরকারের উদ্যোগে আগস্ট মাসের গােড়ার দিকে ইন্দো-সােভিয়েট প্রতিরক্ষামূলক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হলে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ পর্যায়ে সম্ভবত অনুমিত প্রথম দুটি কারণের গুরুত্ব হ্রাস পায়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় অক্টোবর মাসে তাজউদ্দীন

——

১০৭৮ ঐ, পৃ. ৯৫।

৩৪০

আহমদের আবেদনক্রমে, মুজিব বাহিনীকে ভারত সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ, সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার ইঙ্গিত প্রদান হতে । | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত বেশ সতর্কতার সঙ্গেই অগ্রসর হয়। এরই প্রমাণ হচ্ছে তাদের তত্ত্বাবধানে মুজিব বাহিনী গঠন। যুবনেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ ও এর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে ধারণা জন্মে যে, সংযােগটি অকস্মাৎ ঘটেনি। এ ব্যাপারে ১৯৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল তােফায়েল আহমদের দেয়া একটি সাক্ষাৎকার হতে কিছু তথ্য জানা যায়:

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন গিয়েছিলেন। সফরটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। সেখানে বসে তিনি স্বাধীনতার পরিকল্পনা রচনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে কথা ছিল আমরা মাসে পঁচিশ জন ছেলে রিক্রুট করবাে এবং প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের একটি বিশেষ জায়গায় গেলে ট্রেনিং পাবাে। আমরা চারজন রিক্রুটমেন্ট শুরু করি । সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক এবং আমি । ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন থেকে ফিরে এলে আমরা ট্রেনিংয়ের জন্য গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করবাে বলে তৈরি হয়ে যাই । কিন্তু ইতিমধ্যে সত্তুরের নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হয়ে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু এই পরিকল্পনাটি স্থগিত রাখেন। বললেন, নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়ােজন এই কারণে যে, বাংলায় নেতা কে? সেটা প্রমাণিত হওয়া উচিত। এখন যদি ট্রেনিং নিতে কেউ যায় এবং ট্রেনিং শেষে অস্ত্র হাতে কেউ ধরা পড়ে তাহলে, এই অজুহাতে তারা নির্বাচন বানচাল করবে। যে কারণে আমাদের সেই ট্রেনিং পরিকল্পনা স্থগিত থাকে। নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরিত হচ্ছেনা দেখে বঙ্গবন্ধু আমাদেরই এক সহকর্মীকে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে পাঠালেন। সতুরের নির্বাচনের আগেও বঙ্গবন্ধু তার প্রতিনিধিকে ভারতে পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর পাঠান। ডাক্তার আবু হেনাকে ।…আগে যিনি গিয়েছিলেন তিনি আমাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতায় গিয়ে আমি সানি ভিলায় উঠি । একাত্তরের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এই বাড়িটি নেওয়া ছিল। এ ছাড়া বনগাঁ, বসিরহাট এবং আগরতলায় আমাদের জন্য সেন্টার ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমাদের চার জনকে নিয়ে বসতে । সত্তরের নির্বাচনের পর যখন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসছেনা, তখন আমরা তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে বৈঠক করি । বৈঠকে আলােচনা হয়েছিল যে, আমাদের সংগঠনই ট্রেনিংপ্রাপ্ত হবে। এটা হবে রাজনৈতিক লক্ষ্য প্রণােদিত একটি বাহিনী। এটা কিন্তু একাধিকবার বঙ্গবন্ধু বলেছেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন। গণহত্যা শুরু হলে আমরা ভারতে গেলাম । ভারতে গিয়ে আমাদের আশ্রয়, যেটার ঠিকানা বঙ্গবন্ধু আমাদের মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলেন, কাগজে লেখা

——-

মুহাম্মদ নুরুল কাদির, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭১-৪৭২।

ছিল, সেই ঠিকানায় শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং আমি গিয়ে উঠি।

আবদুর রাজ্জাক জানান যে, ভারতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে জেনারেল ওবানের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটে এবং মুজিব বাহিনী গড়ে তােলার পদক্ষেপ শুরু হয় । কিন্তু এ বিষয়ে জেনারেল ওবান লিখিত ‘ফানটমস্ অব চিটাগং এন্ড ফিফথ আমি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেননি যে কোন যুবনেতাদের সঙ্গে কার মাধ্যমে যােগাযােগ স্থাপনে সক্ষম হন এবং কোন সংস্থার পক্ষে তিনি সেটা করেন।১৯৮০

বস্তুত চীন-ভারত যুদ্ধের পর তাকে ভারত সরকার তিব্বত থেকে আগত চীনা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে নিযুক্ত করে । ঐ যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি তিব্বত সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব। সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য আমেরিকায় প্রেরণ করা হলে খুব সম্ভব তার সঙ্গে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এর যােগসুত্র ঘটে এর অল্প পরেই ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর জন্ম হয়। ওবান চীনে তেমন সফল না হলেও একাত্তর সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উল্লিখিত যুবনেতাদের যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সক্ষম। হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা বিরােধিতা করে। এমতাবস্থায় সি.আই.এ প্রভাবিত একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে একটি বিশেষ ধরনের বাহিনী গড়ে তােল কতটা যুক্তিযুক্ত এবং এ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকে কতটা শক্তিশালী কিংবা দুর্বল করতে পারে সেটা ভারত সরকারের বিবেচনায় ছিল কিনা এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সম্ভবত ভারত সরকার মুজিবনগর সরকারের একটা বিকল্প শক্তি আয়ত্তে রাখা প্রয়ােজন বলে মনে করে। কোনাে কারণে মুজিবনগর সরকার ব্যর্থ হলে কিংবা তাকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তাদের (মুজিব বাহিনীর সদস্যদের) যেন ব্যবহার করা যায়। এটা আরাে একটা কারণে প্রয়ােজন হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে হতাশাজনিত কারণে। কমিউনিস্টদের প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রেও যাতে মুজিব বাহিনীকে ব্যবহার করা যায় সে রকম সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মাথায় ছিল। বিশেষত তখন কমিউনিস্ট প্রভাবিত নকশাল ও অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ভারত সরকারকে ব্যস্ত করে রেখেছিল, এর সঙ্গে যদি বাংলাদেশ ইস্যুতে সেখানকার বামধারার প্রভাব বৃদ্ধি পায় তাহলে ভারতের জন্য বড় রকমের। বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে এবং তার সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে

১০৮০ মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭। ১০৮১ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩।

বলে আশংকা জন্মে। সব মিলিয়ে তারা সকল ডিম একত্রে না রাখা’র নীতি অনুসরণ করে। অন্যদিকে মুজিব বাহিনীর নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশে কমিউনিস্ট রাজনীতিকে ভাল চোখে গ্রহণ করেন নি। মস্কোপন্থীদেরকে যদিওবা সহ্য করা যায়, কিন্তু পিকিংপন্থীদেরকে কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। পিকিংপন্থী নেতাদের কেউ কেউ কলকাতায় গিয়ে বিভিন্ন হােটেলে অবস্থান গ্রহণ করে ভারতের নকশালপন্থীদের সঙ্গে সংযােগ স্থাপনের চেষ্টা করছে বলে যুবনেতারা জেনারেল ওবানের নিকট থেকে অবহিত হন। তারা এও জানতে পারেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আগ্রহে পিকিংপন্থী রাজনীতির পুরােহিত মওলনা ভাসানীর অনুসারীরাও যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযােগ পাচ্ছে । যুবনেতাদের কেউ কেউ স্পষ্ট করে বলেন যে, তারা তাজউদ্দীন আহমদ, ডি.পি, ধর, জেনারেল অরােরা, কর্ণেল ওসমানী প্রমুখকে বিশ্বাস করেন না। তারা আরাে বলেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মতলবে আছেন। বস্তুত যুবনেতাদের ধারণা ছিল তিনি। প্রধানমন্ত্রীর পদ জবরদখল করেছেন এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশের বামপন্থীরা আরাে সুবিধা করে নিতে পারে। ওবানের মতে যুবনেতাদের এসব অভিযােগ ও দাবি সত্ত্বেও ভারত সরকার তাজউদ্দীনকেই সমর্থন জানায়। তার গ্রহণযােগ্যতা ভারতের সকল মহলের নিকট স্বীকৃত হয়।৭৮৬ যুবনেতারা কিন্তু শুধু তাকেই কেবল অবিশ্বাস করেন তা নয়, তার সরকারকে মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত কোনাে তথ্যই প্রদান করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু যুদ্ধরত একাধিক বাহিনী পারস্পরিক অবস্থান ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত না থাকলে নিজেদের মধ্যে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় হওয়া স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় জেনারেল অরােরা মুজিব বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল ওবানের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, মুক্তিবাহিনী সীমান্তের ২০ মাইলের মধ্যে চলাফেরা করবে এবং মুজিব বাহিনীকে থাকতে হবে দেশের অভ্যন্তরভাগে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে আপাত একটা সমঝােতা স্থাপিত হয়।

——–

দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৩১। মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৮৪। মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৫। ঐ, পৃ. ১১৪। ঐ, পৃ. ১১০। ঐ, পৃ. ১২০।

যাহােক মুজিব বাহিনী গঠনের জন্য উল্লিখিত যুবনেতারা কেবল ভারত সরকারের উচ্চতম মহলের আনুকূল্য লাভ করেন তাই নয়, উপরন্তু তারা সূচনাপর্বে এম.এ.জি. ওসমানীর নিকট থেকেও কৌশলে সুযােগ আদায় করে নেন। রাজ্জাক তােফায়েল প্রমুখ কয়েকজন ছাত্রনেতা ওসমানীর নিকট গিয়ে বলেন যে, তাদেরকে দায়িত্ব দিলে মুক্তিবাহিনীর জন্য ভাল ছেলেদের রিক্রুট করে দেবেন। এমতাবস্থায় ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সভায় তাদেরকে সেই অধিকার প্রদান করা হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই। অবশ্য তখন যুবনেতাদের স্বতন্ত্র উদ্দেশ্যের বিষয়টি বেশি স্পষ্ট ছিল না। জেনারেল ওবানের সঙ্গে তাদের সংযােগ স্থাপিত হওয়ার পর বিষয়টি প্রকাশিত হয়। যুব নেতাদের নেতৃত্বে দেরাদুনের অদূরে চাকরাতায় ১১ মে বিশেষ এই বাহিনী গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত হলে ২৯ মে থেকে প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয় ভারতের সামরিক প্রশিক্ষণ শহর দেরাদুন থেকে দেড় কি.মি. দূরে পাহাড়শীর্ষের শহর তানদুয়ায় । আরও কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলা হয় মেঘালয়ের তুরার হাফলং-এ । ২৫০ জনের প্রথম ব্যাচটির প্রশিক্ষণ ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ দেয়। এ ব্যাচের গুরুত্বপূর্ণদের মধ্য থেকে ৮ জনকে ইনস্ট্রাক্টর নিয়ােগ করা হয়। এরা হলেন: শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক, রফিকুজ্জামান, মাসুদ আহমদ রুমী, সৈয়দ আহমদ ফারুক, তৌফিক আহমদ, মােহনলাল সােম ও তােফায়েল আহমদ। পরে অবশ্য প্রশিক্ষকদের সংখ্যা বায়ান্ন জনে বৃদ্ধি পায়। নভেম্বর মাসের ২০ তারিখে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ দানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ হাজার সদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালনায় থাকতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রধান হিসেবে কাজ করতেন হাসানুল হক ইনু। তার ওপরে অবশ্য একজন ভারতীয় কর্ণেল দায়িত্ব পালন করতেন। এ বিষয়ে অন্তত আর একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তার নাম জানা যায়, তিনি মেজর মালহােত্রা।৯ অক্টোবর মাসে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। অন্যান্য অঞ্চলে পাকিস্তান। বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখা হলেও মূলত ভৌগােলিক কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রথমে মুক্ত করার একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বয়ং মেজর জেনারেল ওবানসহ কর্ণেল পুরকায়স্থ, মেজর।

———-

১০৮৮ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৩০-১৩১। ১০৮৯ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮।

এ বিষয়ে দেখুন, মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, ৯৮-১০০ পৃ. ।

মালহােত্রা প্রমুখ অন্তর্ভুক্ত হন। অল্প সময়ের মধ্যে মরিস্যা, হরিণা এবং বরকল অঞ্চলকে মুক্ত করা হয়।১৯৯১

মুজিব বাহিনী গড়ে তােলা ও তাদের পরিচালনার জন্য ব্যয় নির্বাহ করে ভারত সরকার। সমগ্র বাংলাদেশকে ৪ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, যথা পূর্বাঞ্চলীয়। কমান্ড, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড, উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ড এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড । এগুলাের অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয় যথাক্রমে শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান এবং তােফায়েল আহমদকে। চারজন সেক্টর কমান্ডারকে ভারতীয় ঐ কর্তৃপক্ষটি জেনারেলের মর্যাদা প্রদান করে। তাদের চলাফেরার জন্য দেয়া হয় হেলিকপ্টার। এসব সুযােগ সুবিধা পেয়ে যুবনেতারা নিজেদেরকে সরকার থেকে আলাদা এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেন যা মুজিবনগর সরকারের জন্য একটা বড় রকমের সমস্যায় পরিণত হয়। | নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এই কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার উপদেষ্টারা, সেনাবাহিনী প্রধান শ্যাম মানেকশ’, ‘র’এর পরিচালক আর.এন, কাউ প্রমুখ। বিষয়টি এত উঁচু থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পর্যন্ত পরিষ্কার কিছু জানত না। বস্তুত এই বাহিনী গড়ে ওঠে। জেনালের মানেকশ’র দায়িত্বে। এ জন্য মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ‘শ্যামের। ছেলেরা’ বলে কখনাে কখনাে সম্বােধিত হতাে। এ বিষয়ে অন্যান্য সংস্থাও তেমন জ্ঞাত ছিল না। ফলে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এমন কি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক পর্যন্ত এই দ্বৈত ব্যবস্থাপনার বিরােধিতা করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘র’এর ডিরেক্টর আর.এন. কাউকে বস্তুত দু জন ব্যক্তির কাছে জবাবদিহি করতে হতাে; এরা হলেন সেনাবাহিনী প্রধান শ্যাম মানেকশ’ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ ব্যাপারে তাদেরকে অনুরােধ জানানাে হয় যেন সুষ্ঠুভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে ঐ বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের কমান্ডে ছেড়ে দেয়া হয়। ইতােমধ্যেই মুজিব বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ

———–

শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেন, মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি.এল.এফ.) (ঢাকা: অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০২), পৃ. ৮৬-৮৭। ১০৯২, ঐ, পৃ. ৬৬-৬৭।

| ঐ, পৃ. ৭০ এবং মেজর জেনারেল এস এস ওবান, হােসাইন রিদওয়ান আলী খান। (অনু.) “ফ্যান্টমস অব চিটাগং দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ (ঢাকা: ঘাস ফুল নদী, ২০০৫), পৃ. ৬২। পরে এই তথ্যসূত্রটি উল্লেখ করা হবে জেনালের ওবান নামে । ১০৯৮, দেখুন, মেজর জেনারেল ওবান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯-৪৩। মুজিববাহিনীর প্রতি। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দ্বিমতের বিষয়ে আরাে জানা যায় ভােরের কাগজ, ২৬ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে প্রকাশিত ‘মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ার রাজনীতি’ শিরােনামের লেখা হতেও।

৩৪৫

সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বাহিনীসমূহের ওপর নানা চাপ প্রয়ােগ করে, কোথাওবা সংঘর্ষ হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার জন্য ঘাতক প্রেরিত হয় বলে তার ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায় ।৭৯৫ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ মুজিব বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতিকার চেয়ে ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকদের স্মরণাপন্ন হন এবং প্রতিকার না পেয়ে ব্রিতকর অবস্থায় পড়েন। তবে মুক্তিযুদ্ধের উপাদানগুলাে পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার পর অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ডি.পি, ধর দীর্ঘ নীরবতার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন যে, এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ । তাজউদ্দীন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে দিল্লি গমন করেন। এমতাবস্থায় অক্টোবর মাসের ২২-২৬ তারিখে অন্যান্য আলােচনার পাশাপাশি ডি.পি. ধরের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর নিকট মুজিব বাহিনী সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের অনুরােধ জানানাে হয়। তিনি সমস্যাটি অনুধাবন করে ডি.পি. ধরকে এ বিষয়ে ত্বরিৎ প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। তখন থেকে ডি.পি. ধর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে মুজিব বাহিনীর খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করেন। বস্তুত ডি.পি. ধর ৬ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বিষয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের দ্বৈত নীতির অবসান হয় এবং সর্বাত্মক প্রস্তুতি এগিয়ে চলে। পরবর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন:১০৯৮

ডি.পি, ধর ‘মুজিব বাহিনী’কে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করার জন্য মেজর জেনারেল বি.এন, সরকারকে নিয়ােগ করেন। এই উদ্দেশ্যে যথাশীছ কোলকাতায় এক বৈঠকের আয়ােজন করা হয়। এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের

——

১০৯৫ এক যুবক কিভাবে যেন প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষে সশস্ত্র অবস্থায় ঢুকে পড়ে এবং তার অস্ত্র সমর্পণ করে জানায় যে, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে । যুবকটি প্রধানমন্ত্রীকে বাঁচানাের জন্য স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব গ্রহণ করে তার নিকট উপস্থিত হয়ে সমগ্র বিষয়টি অবহিত করে। মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২-১৩৩, ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলামের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৩ জুন, ২০০১। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুখ আজিজ খানও লিখেছে দেখুন, Faruq Aziz Khan, Spring 1971 (Dhaka: The University Press Limited, 1998), p. 184. খান সারওয়ার মুরশিদও এ বিষয়ে জানতেন, দেখুন, তাজউদ্দীন আহমদ- আলােকের অনন্তধারা, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০৬), পৃ. ২২২। ১০৯৬, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৭-১৩৯। ১০৯৭ মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০। *** মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯।

পক্ষে তাজউদ্দিন ও কর্ণেল ওসমানী, মুজিব বাহিনীর পক্ষে তােফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক (আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও শেখ মণি। অনুপস্থিত থাকেন) এবং ভারতের পক্ষে মেজর জেনারেল সরকার ও ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত উপস্থিত ছিলেন। আলােচনার এক পর্বে একজন যুবনেতা দাবী করেন, আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার অধিকার একমাত্র তারই রয়েছে। এরপর আলােচনা আর এগুতে পারেনি। পরে বি.এন.সরকার কেবলমাত্র যুবনেতাদের নিয়ে আলােচনার জন্য ‘ফোর্ট উইলিয়ামে মধ্যাহ্নভােজনের আয়ােজন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার একমাত্র অধিকারী’ সেই যুবনেতা ছাড়া আর কেউই হাজির হননি।… মেজর জেনারেল সরকারও এই পণ্ডশ্রম বাদ দিয়ে

মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য কাজে মনােনিবেশ করেন। এই সমস্যা স্বয়ং মুজিব বাহিনীর মধ্যেও দেখা দেয়। এর দুই প্রধান নেতা | শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খানের মধ্যেও বিরােধ স্পষ্টতর হয়। এ | দ্বন্দ্বে মুজিব বাহিনী স্পষ্টত সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে | অন্যদিকে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে বিপরীত আদর্শ স্থাপনের ইস্যুতে দ্বিধা | বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর হতে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন অংশটি

তাজউদ্দীন আহমদের সরকারের প্রতি কিছুটা নমনীয় মনােভাব প্রদর্শন করে। | নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রতিপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে কোথাও কোথাও সংঘর্ষ হয় বলেও জানা যায়।৭৯৯ ২০ নভেম্বর প্রশিক্ষণ শিবির অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়। ভারত সরকারের নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত মানতে অবাধ্যতার জন্য মুজিব বাহিনীর কোনাে কোনাে নেতাকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এক প্রকার বন্দী করে রাখা হয়।”°° মুজিব বাহিনীর অস্তিত্ব নিয়ে ভারত সরকারে | বিভিন্ন মহলে সমালােচনা শুরু হয়েছিল এবং প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে

———

ঐ, পৃ. ১৩২। দেখুন, মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০০-১০৪।

“এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব এবং পরে উপদেষ্টা পি,এন, হাকসার সম্প্রতি বলেছেন-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় | আমাদের একটা বড় ভুল ছিল মুজিব বাহিনী গঠনে সাহায্য করা। আমি মিসেস গান্ধীকে | বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম এর ফলে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার আমাদের ভুল বুঝতে পারে। মুক্তিবাহিনীর ভিতরেও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তিনি বলেছেন, এরা শেখ মুজিবের খুব কাছের লােক। তাজউদ্দীনের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক ছিল না। এদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে তাজউদ্দীন তার অসন্তোষের কথা আমাকে | একাধিকবার বলেছিলেন। শেষবার তাকে বলেছিলাম, আপনি এ বিষয়ে সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব এদের পরামর্শকে বেশী গুরুত্ব দিতেন। তাজউদ্দীনের সঙ্গে এবং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রবাসী। সরকারের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব এদের কারণেই সৃষ্ট। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী।

অনাকাক্ষিতভাবে সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারের কাজ দেখা দিয়েছিল । এদিকে আগস্ট মাস থেকে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ভিন্নমাত্রা যুক্ত হয়, যাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যাশিত স্থানে পৌঁছাতে বদ্ধপরিকর এবং যােগ্যতার সঙ্গে সে কাজ করছে। সেক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর গুরুত্ব হ্রাস পায়। | মুজিব বাহিনী ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র ধারার কয়েকটি গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে। এগুলাে মূলত প্রতিরােধযুদ্ধের মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার জঙ্গলাকীর্ণ অংশে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে উল্লেখ্য। মধুপুর ও ভাওয়ালের জঙ্গল অঞ্চলে এই বাহিনীর ঘাঁটিগুলাে স্থাপিত হয়। সদস্যদের যুদ্ধ শেখাতে হয়নি, শত্রুর মােকাবিলা করেই তারা যুদ্ধ শেখে।০২ এই বাহিনীর গেরিলা যােদ্ধার সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ থেকে ১৭,০০০ এর মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট থেকে আধুনিক সমরাস্ত্র কেড়ে নিয়ে কাদেরিয়া বাহিনী বিমান ও নৌবাহিনী বাদে। প্রায় সকল শাখাসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উল্লিখিত এলাকার প্রায় ১৫,০০০ বর্গ মাইলের মধ্যে এর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনার সময় হিসেব করা যে, উত্তর দিক থেকে ভারতীয় ছত্রী সেনারা এয়ার ড্রপের মাধ্যমে এই বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবে । বস্তুত ১২ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল মুক্ত হওয়ার পর পরিকল্পিতভাবেই যৌথবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ তারিখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কাদের সিদ্দিকীই। একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি যিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন।

স্বতন্ত্র ধারার আর একটি বাহিনী গড়ে তােলেন ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা। থানার আওয়ামী লীগ সহসভাপতি এবং মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের কাউন্সিল সদস্য আফসার উদ্দিন আহমেদ। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র একটি রাইফেল নিয়ে তিনি মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন ডাকাত ও দুষ্কৃতিকারীদের আস্তানায় হামলা চালিয়ে এবং পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে। পর্যায়ক্রমে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। রাইফেল, রকেট লঞ্চার, স্টেনগান, এস.এম.জি. প্রভৃতি। মিলিয়ে সংগৃহীত অস্ত্রের পরিমাণ আড়াই হাজারের মতাে। তার অধীনে গেরিলা। যােদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার হাজার । জানা যায় জুন মাসে ভালুকা থানার

———

এদের প্রাধান্য সুনজরে দেখেনি। এর চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড।” মুহাম্মদ নুরুল কাদির, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৫। ১৯০২ মজিবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮।

ভাওয়ালিয়া বাজু এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ৪৮ ঘণ্টার সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে আফসার উদ্দিন একক প্রচেষ্টায় প্রতিরােধ যুদ্ধে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।১০৩

হেমায়েত উদ্দীন ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের একজন হাবিলদার। যুদ্ধ শুরুর সময় তার কর্মস্থল ছিল ঢাকার জয়দেবপুর সেনানিবাস। ২৫ মার্চের পর তিনি। ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে পৌছে জানতে পারেন তার স্ত্রী দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক তার বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে। মে মাসের শেষ নাগাদ তিনি বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার বাটরা বাজারে স্বীয় বাহিনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তার নামানুনারে বাহিনীটির নামকরণ হয় ‘হেমায়েত বাহিনী’ । এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০৫৪ জন যার মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৩৪০ জন। হেমায়েত বাহিনীর মূল কর্মক্ষেত্র বরিশাল ও ফরিদপুরের কিয়দাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। এই বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৮ টি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায়ও শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর বিক্রম’ পদকে ভূষিত করে।”

| বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র ধারার এসব গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ। সরকারের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং ঐ ধারাকে টিকিয়ে রাখা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন:

…বাংলাদেশ সামরিক সদর দফতরে নিযুক্ত অফিসারদের নিদারুণ সংখ্যাল্পতা এবং সংশ্লিষ্ট সহায়ক সার্ভিসের অশেষ দৈন্যতার জন্য ‘Ops planing’ এর জন্য সুযােগ ছিল সামান্য। এই সব বিষয়ে অভাব পূরণ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরেবিশেষতঃ টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল ও নােয়াখালীতে- যেসব স্বতন্ত্র গেরিলা গ্রুপ প্রতিরােধ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তাদের কাছে অস্ত্র পৌছানাের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ট্রেনিং ও অস্ত্রের এইসব বর্ধিত সহায়তার ফলসঞ্চার অক্টোবরের আগে ঘটে ওঠেনি।

যুদ্ধের সূচনাপর্বে বরিশাল অঞ্চলে প্রতিরােধ যুদ্ধের কোনাে কোনাে নেতার অনুরােধের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অস্ত্র সরবরাহের নির্দেশ

———

১১০৩, ঐ, পৃ. ৬৯-৭০। ১১০৪, ঐ, পৃ.৭০।

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫।

১১০৫

দিয়েছিলেন। কিন্তু সংবাদটি পাকিস্তান বাহিনী জেনে যায় এবং প্রেরিত অস্ত্রভর্তি লঞ্চ আক্রমণ ও দখল করে নেয়। | বাংলাদেশের তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চরম মতপার্থক্য পরিণক্ষিত হয়। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গণহত্যা চালায় তখন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলাে পরস্পরের তত্ত্বের ভুলভ্রান্তি অনুসন্ধানে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এক পার্টি অন্য পার্টির এবং এক অংশ অন্য অংশের ভুল খুঁজতে শুরু করে, বিষয়টি এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, একই নেতার মধ্যে দ্বৈত সত্ত্বা লক্ষ করা যায় । মুক্তিযুদ্ধকে শুরুতে তারা মূল্যায়ন করে বলেন যে, এটা মূলত পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের বুর্জোয়াদের স্বার্থ নিয়ে। টানাটানির ব্যাপার-সাধারণ মানুষের চাওয়া পাওয়ার সঙ্গে এর কোনাে সম্পর্ক নেই। রুশ-ভারতের সম্প্রসারণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের হাত রয়েছে এর পশ্চাতে । নেতারা তত্ত্ব নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর। গণহত্যা ও বাঙালি জাতির আশা-উদ্দীপনাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। দ্বন্দ্ব দেখা দেয় আবদুল হক, মােহাম্মদ তােয়াহা, আলাউদ্দীন, সুখেন্দু দস্তিদার, দেবেন। সিকদার ও অন্যান্য নেতার মধ্যে। তবে তারা সকলে একমত হন যে, বাংলাদেশরূপী একখণ্ড মাংশপিণ্ড নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের মধ্যে এ যুদ্ধ। শুরু হয়েছে । এটি সাধারণভাবে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ তত্ত্ব নামে পরিচিত। এসব তত্ত্বগত তর্ক-বিতর্ক করতেই মুক্তিযুদ্ধের চার মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। এক পর্যায়ে তােয়াহা ও সুখেন্দু দস্তিদার চরম দোদুল্যমানতার মধ্যে একটি দ্বিমুখী। রণনীতির ভিত্তিতে নােয়াখালী ও চট্টগ্রামের চরাঞ্চলে নিজ সমর্থকদের নিয়ে সশস্ত্র ‘লাল ফৌজ গড়ে তােলেন। তারা একদিকে মুক্তিবাহিনী অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। নােয়াখালীর একটি এলাকায় তােয়াহা মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেন। স্বতন্ত্র ধারার এ যুদ্ধের সময় কৃষকদের মধ্যে প্রায় দু হাজার একর জমি বিলি করে সমাজতন্ত্রের একটা লেবেল দেয়ার চেষ্টা করা হয়। মুক্তাঞ্চলে আবার এক প্রকার প্রশাসনিক কাঠামাে এবং গণআদালত প্রকৃতির বিচার ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। তবে অনতিবিলম্বে মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর অগ্রাভিযানে তােয়াহা-সুখেন্দু দস্তিদারের স্বতন্ত্র ধারার দ্বি-মুখীযুদ্ধ স্তিমিত হয়ে আসে এবং ক্রমাগত তাদের গণবিচ্ছিন্নতা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। আবদুল হক ও আলাউদ্দীনের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশটি বিচ্ছিন্নভাবে দেশের অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধ। করে। উভয় গ্রুপের নেতা সংগঠকরাই ঢাকা, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম, যশাের,

———-

১৯০৬ কাজী সামসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট খ, অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে লেখা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিঠি ।

৩৫০

ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর প্রভৃতি ১৬ টি জেলাতে বিচ্ছিন্নভাবে পাকিস্তান বাহিনী, ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করেন। | মুক্তিযুদ্ধে পিকিংপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের দোদুল্যমান অবস্থার মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্কিন গবেষক লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন:

পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বর্বর হত্যযজ্ঞ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রয়ােজনীয় করে তুললাে। তবুও, এই কঠিন সংকটে কি করণীয় তা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) এর মধ্যে তীব্র মতানৈক্য। আবদুল হকের নেতৃত্বে এক দলের বক্তব্য ছিল যে, সমস্ত সংঘাতের সৃষ্টি করা হয়েছে শুধুমাত্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভাঙ্গার জন্য। আর পেছনে আসল হােতা হচেছ সােভিয়েত মদদপুষ্ট ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা। হকের সহকর্মী তােয়াহা কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করতে পারলেন না। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার মাসের মধ্যে এই দল ভেঙ্গে দুভাগ হয়ে যায় । হক দলের পুরনাে নাম অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটা অক্ষুন্ন রাখে। এরা এমন কি পাকিস্তান সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযােগ করে ও ইঙ্গিত দেয় পাক বাহিনী তাদের স্বভাবসুলভ চরম বর্বরতা ত্যাগ করলে বিনিময়ে তারা অত্যাসন্ন ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সহায়তা করতে প্রস্তুত …অন্যদিকে মােহাম্মদ তােয়াহা নােয়াখালী চট্টগ্রাম এলাকায় তার ঘাঁটি স্থাপন করেন। তিনি তার সমর্থকদের “পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল) এই নতুন নামে সংগঠিত করেন। আওয়ামী লীগের কোলকাতা কেন্দ্রীক অস্থায়ী সরকার যে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মদদপুষ্ট সে ব্যাপারে তােয়াহা ও হকের সঙ্গে একমত ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করবেন কি-না সেই ব্যাপারে তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। এদিকে গ্রাম-গঞ্জে সারা দেশের প্রতিটি মানুষ তখন পাকিস্তানী নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনে জেগে উঠেছে। শেষে তােয়াহার দল এক দ্বি-মুখী যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করলেন- একদিকে তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন, আবার একই সাথে আওয়ামী লীগের অনুগত মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে যান। কোন কোন সময় বােঝা খুব কষ্ট ছিল তােয়াহা কি মুক্তিবাহিনী না পাকিস্তান বাহিনীকে তার বড় শত্রু বলে মনে করেন। …তােয়াহার নিজস্ব শিবিরে তার এই দ্বিধা-পূর্ণ অবস্থান নিয়ে প্রচণ্ড মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। জাতীয় অধিকারের প্রশ্নকে ঠিকভাবে বুঝতে তােয়াহার অক্ষমতার অভিযােগ তুলে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর দল ত্যাগ করেন। উমর পাকবাহিনীকেই প্রধান শত্রু মনে করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যে সবার উচিত ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া; এতে জাতীয় বুর্জোয়ারা নেতৃত্ব দিল কি দিল না তা নিয়ে মাথা ঘামানাে উচিত নয় বলে

————

১১০৭ লরেন্স লিফসুলৎজ, অসমাপ্ত বিপ্লব: তাহেরের শেষ কথা, মুনীর হােসেন (অনু.) (ঢাকা: কর্ণেল তাহের সংসদ, ১৯৮৮), পৃ. ৩৩-৩৫।

তিনি মনে করতেন। পিকিংপন্থী দলগুলাের বাকী অংশ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পতাকা তুলে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকে

পুরােপুরি সমর্থন দান করে। তবে তােয়াহার ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতা থাকলেও আবদুল হকের ক্ষেত্রে তা ছিল না। আবদুল হক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে ‘মাই ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার’ সম্বােধন করে পূর্ব পাকিস্তানকে পুনর্বহাল করার জন্য অস্ত্র ও বেতারযন্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করেন। শুধু তাই নয় তার নেতৃত্বাধীন দলটি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নামই রক্ষা করে চলে । অন্যদিকে তােয়াহা ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থনদান না করে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে একই মানদণ্ডে ফেলেন।

লরেন্স লিফসুলৎজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পিকিংপন্থী দলগুলার অবস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করেন এভাবে “জাতীয় প্রশ্নে এদের (তােয়াহা ও আবদুল হকের) অবস্থান ছিল ভদ্রলােকের ভাষায় দ্বিধান্বিত; নিন্দুকের ভাষায় বলতে গেলে দালালীর সমতুল্য।”১০৮ আন্তর্জাতিক রাজনীতির শত্রু-মিত্র, মুখ্যশত্রু- গৌণশত্রু খুঁজতে গিয়ে তাদের ভিত্তিভূমি যেখান থেকে কথিত বিপ্লব করতে চান সেখানকার জাতীয় বা বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পিকিংপন্থী দলগুলাের মধ্যে কেবল মওলানা ভাসানীর। নেতৃত্বাধীন অংশটি বাদে অন্যান্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। পিকিংপন্থী ১৪ টি দল একটা সমন্বয় কমিটি গঠন করে। তারা মওলানা ভাসানীকে তাদের সঙ্গে আহ্বান করলে তিনি তা প্রত্যাখান করে মুজিবনগর সরকারের পাশেই অবস্থান করেন। এমতাবস্থায় উক্ত সমন্বয় কমিটির নেতা। মনােনীত হন দিনাজপুরের কমরেড বরদা চক্রবর্তী। তাদেরকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযােগ দানের আবেদন নিয়ে তিনি হাজির হন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট। প্রধানমন্ত্রী তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে যা বলেন তা বেশ। তাৎপর্যপূর্ণ:১১০৯

কমরেড বরদা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে আলােচ্য কমিউনিস্ট সমম্বয় কমিটির পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দাখিল করে। দাবিগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে হবে এবং চীনপন্থী কমিউনিস্ট ক্যাডারদের মস্কোপন্থীদের অনুরূপ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা এবং অস্ত্র দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী

———-

১১০৮ এম.আর. আখতার মুকুল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮),পৃ. ৮৪-৮৫।

তাজউদ্দীন আহমদ চমক্কার জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, কোনাে দল বা গােষ্ঠীর স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কোনাে রকম অনুমতির প্রয়ােজন হয়

। কাদেরিয়া বাহিনী, হালিম বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনীসহ যেসব বাহিনী এই মুহূর্তে বাংলদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা কোন অনুমতির তােয়াক্কা করেনি। তাই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে আপনাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভশীল। তিনি আরাে বললেন, এর পরেই হচ্ছে ট্রেনিং ও অস্ত্র প্রদানের প্রশ্ন । দেখুন কমরেডরা, মার্কসিজম সম্পর্কে আমরাও কিছু কিছু পড়াশােনা করেছি। এতে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে যে, শত্রুর অস্ত্রই হচ্ছে মার্কসিস্ট গেরিলাদের অস্ত্র। সাচ্চা কমিউনিস্ট গেরিলারা শক্রর অস্ত্র দখল করে মুক্তিযুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এখন দেখছি, দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতাে চীনপন্থী মার্কসিস্টরা অস্ত্রের জন্য মুজিবনগরের পেটিবুর্জোয়া সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছে। এটা কেমন করে সম্ভব? আমি পেটিবুর্জোয়া আওয়ামী লীগ সরকারের এমন আহাম্মক প্রধানমন্ত্রী’ নই যে, আপনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেব; আপনারা কিছুদিন পরে সেই অস্ত্র আমাদেরই বুকে চেপে ধরবেন। কেমন ঠিক কিনা! সত্য কথা বলতে কি, আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমাদের অস্ত্র কোথা থেকে সরবরাহ হচ্ছে? সেক্ষেত্রে যেসব শর্ত রয়েছে তার এক নম্বরই হচ্ছে এসব অস্ত্র যেন আপনাদের হাতে না যায়। কেননা আপনাদের মাধ্যমে এসব অস্ত্র দিব্বি পশ্চিম বাংলা ও বিহারের নকশালদের হাতে চলে যাবে। আপনাদের মতবাদ সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল রয়েছি । কেননা বাংলাদেশের যুদ্ধ

সম্পর্কে আপনাদের থিসিসগুলাে ইতােমধ্যেই আমি পড়ে দেখেছি। | পিকিংপন্থী ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের কোনাে কোনােটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম ধনিক শ্রেণীর প্ররােচনার ফসল বলে মূল্যায়ন করে। চারু মজুমদার নিরপেক্ষ থাকার নীতি অনুসরণ করলেও অসীম চ্যাটার্জী উপরিউক্ত মর্মে একটি গােপন প্রচারপত্র ছাপেন এবং তা বিলি করেন।১৯১০ | অন্যদিকে বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দান করে। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ২০ এপ্রিল ঘােষণা করেন যে, তার দল (মস্কোপন্থী ন্যাপ) প্রবাসী সরকারকেই বৈধ সরকার বলে মনে করে। তিনি জাতির এই ক্রান্তিকালে দলবল নির্বিশেষে সকলের প্রতি এই সরকারকে সহযােগিতা করার আহ্বান জানান।” মণি সিংহও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২১ মে প্রবাসে মস্কোপন্থী

——-

১১১০° আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪। ২৫ জুলাই দি অবজার্ভার পত্রিকা এই সংবাদটি ছাপে। ১১১১ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৪-১৫৫।

কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক চরিত্র, সে সংগ্রামের শক্তি, শত্রু-মিত্র প্রভৃতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে এবং ২২ মে এর ভিত্তিতে একটি দলিল গৃহীত হয়। এই মূল্যায়নে ফুটে ওঠে যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলাে সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্যতীত শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী। |প্রভৃতি বাংলাদেশের আপামর জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে সমবেত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর হাজার হাজার দেশপ্রেমিক সৈনিক, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও কৃষক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে। গৃহীত দলিলে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম’ বলৈ মূল্যায়ন করে। এর পশ্চাতে নিমােক্ত কয়েকটি যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। যেমন-১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি দক্ষিণ | এশিয়ায় শান্তি ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে, ২. পরােক্ষভাবে তা সাম্রাজ্যবাদকে দুর্বল করবে, ৩. ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কারণে উভয় দেশের জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ৪. বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মেরুকরণের ফলে বিশ্বের অন্যান্য সংগ্রামী জাতির সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠবে।” এই মূল্যায়ন ও অবস্থানগত কারণে। মুক্তিযুদ্ধে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল সহায়ক। বস্তুত মস্কোপন্থী কমিউসিস্টরা মুজিবনগর সরকারের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং নানাভাবে সহযােগিতার মনােভাব ব্যক্ত হয়। তাদের সদিচ্ছার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। | কাজী জাফর আহম্মদ, রাশেদ খান মেনন এবং আকবর হায়দার খান রনাে। চীনপন্থী এই তিন নেতা জুন মাসের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধে তাদের ছেলেদের প্রশিক্ষণের দাবি জানান। উদ্ভূত বাস্তবতায় তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরই মুক্তিযুদ্ধে সকল দলের জন্য সুযােগ উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষে নীতিগত অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় দু দিক থেকে ভারতের কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি জাতীয়তাবাদী সরকারের সমর্থন গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও নীতির বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখতে হয়। দ্বিতীয় সমস্যাটি ছিল আওয়ামী লীগও | একটি জাতীয়তাবাদী দল যা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নজিরহীন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। স্পষ্টত দলটির অন্যান্য নেতারা মুক্তিযুদ্ধে কেবল

———-

১১১২. মােঃ শাহজাহান, বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা (১৯৬৬-১৯৭১): একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ (অপ্রকাশিত পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০২), পৃ. ২৯১-২৯২। [১১১৩ ঐ, পৃ. ২২৮।

তাদের নেতৃত্ব দেয়া এবং শুধুমাত্র তাদের ছেলেদের প্রশিক্ষণ পাওয়ার দাবিদার। বলে মনে করতেন। তদুপরি দলে তাজউদ্দীনের নিজের অবস্থানই ছিল নড়বড়ে।। পরে অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক দলগুলাের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সীমিত সুযােগ সৃষ্টি হলে কিছু কিছু বামপন্থী কর্মীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযােগ প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা

মুজিবনগর সরকার ভারতে অবস্থিত ছিল এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর। বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যুদ্ধপ্রস্তুতি ও তা পরিচালনার জন্য তাকে ভারত সরকারের। ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। বস্তুত ভারত সরকারের আন্তরিক প্রয়াস। ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এত অল্প সময়ে সাফল্য লাভ করতে পারতাে না। তাই বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের প্রতিক্রিয়া ও নীতি সম্পর্কে আলােচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের আলােচনার ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থা তথা জাতীয় নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলের মনােভাব—দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ ছাড়াও বিশ্বের শক্তিবলয়সূমহের বিন্যাস ও ভারসাম্য সম্পর্কিত বিষয়টি এবং প্রবাসী সরকারের দক্ষতা সমধিক তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রকৃষ্টরূপে অনুধাবনের জন্য তাই ভারতের নীতি ও কর্মকৌশল সম্পর্কে সম্যক আলােকপাত নিঃসন্দেহে জরুরি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিতে গিয়ে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতি ও কর্মকৌশলকে সূক্ষ্ম সীমারেখা দ্বারা প্রধান দুটো ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথম অংশটি অন্তবর্তীকালীন এবং দ্বিতীয় অংশটি চূড়ান্ত লক্ষ্যাভিমুখী অর্থাৎ পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। অর্জন। প্রথম অংশে মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা ও রণক্লান্ত করে তােলা এবং দ্বিতীয় অংশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সমস্যাটির যৌক্তিকতা তুলে ধরা এবং ভারতীয় বাহিনীকে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা। বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার খবর বিশ্বের অন্যান্য দেশ অবহিত হওয়ার পূর্বেই ভারতের সীমান্তস্থিত রাজ্যগুলােতে গিয়ে পৌঁছে। আকাশবাণীতে ২৬ মার্চ ছােট্ট একটি সংবাদে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তারপর বাজানাে হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার

৩৫৫

বাংলা গানটি।১১১৪ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কলকাতায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ভারত সরকার কর্তৃক পূর্ব বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে স্বীকৃতিদান এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে গণহত্যা বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানাে হয়। এ ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।১৬ ঐ দিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভা বার্ষিক বাজেট অধিবেশনে মিলিত হয়েছিল । বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মূল আক্রমণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকদের ওপর পরিচালিত হওয়ার সংবাদ পেয়ে সিনেট সভা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। অনতিবিলম্বে পরবর্তীকালে তারা যুদ্ধের মাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য নানা ধরনের সাহায্য সহযােগিতা নিয়ে হাজির হন।১৭ কলকাতা বিশববিদ্যালয়ের উক্ত উদ্যোগই অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’-রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক সমিতির তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রয়েছে । | ২৭ মার্চ কলকাতা ছাড়াও নয়াদিল্লি, বােম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি বড় শহরে একই দাবি উচ্চারিত হয়। ২৮ মার্চে পাটনা, রায়পুর, দিল্লি প্রভৃতি শহরে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করলে তা ক্রমশ মূল রাজনৈতিক দলগুলাের দাবিতে পরিণত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের সমর্থনে যেভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে সেখানে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা বিস্ময়কর । উপরিউক্ত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন কতটা আবেগ লাভ করে তা কোনাে কোনাে পত্রিকার রিপাের্ট হতেও জানা যায়:

সংগ্রামী বাংলাদেশের জন্য এই বাংলার মানুষের যে কী গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। রবিবার (২৭ মার্চ) কলকাতার নাগরিক সভায় তা প্রকাশ পেল । শ্রী বিজয় সিংহ।

১১১৪ অমর সাহা, কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ১২৫। *** দেখুন, দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ২৯৭-৩০৫। ১১১৬ ঐ, পৃ. ২৯৭।

A Nation is Born, Calcutta University Bangladesh Sahayak Samiti কর্তৃক ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে আয়ােজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে পঠিত দিলীপ চক্রবর্তীর স্বাগত ভাষণ হতে সংগৃহীত, পৃ. ৩-৪। এই সূত্রটি এরপর হতে A Nation is Born. বলে উল্লিখিত হবে । ১৯১৮ দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৩০১-৩০২। ১১১৯ দেখুন, ঐ, পৃ. ৩০৩।

নাহার বললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে পশ্চিম বঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলুন। ভারত সরকারকে বলব, আমাদেরকে অনুমতি দিন, আমরা ওদের পাশে গিয়ে লড়তে চাই’। শ্রী অজয় মুখার্জী বললেন- আমরা নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারিনা। এর আগে ময়দানে বহু জনসমাবেশের রিপাের্ট করেছি। কিন্তু এ দিনের জমায়েতের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সমগ্র পশ্চিম বঙ্গের মানুয়ের মন আজ বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনে যে আবেগে উদ্বেল এই সভায় তাই প্রতিফলিত। এদিকের সমস্ত মানুষ সারাদিন যে অসীম আগ্রহ নিয়ে ট্রানজিস্টারের সামনে বসে আছেন স্বাধীন বাংলার বেতার ঘােষণা শােনার জন্য, যে উন্মাদনায় এপারের সহস্র সহস্র যুবক ছুটে চলেছেন সীমান্তের দিকে সেই উত্তেজনায় সমস্ত সভা সারাক্ষণ থরথর করে কেঁপেছে। যখনই কোন বক্তা বলেছেন, ওপারে পাক হানাদার ফেীজের বুলেটে আহত হয়ে শত শত ভাই এপারে আশ্রয় নিচ্ছেন, তাঁদের সাহয্যের জন্য রক্ত দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সভায় সহস্র কণ্ঠের আকুল জিজ্ঞাসা -কোথায় কোথায় রক্ত দিতে হবে। সবাই

সেজন্য তৈয়ার ।… উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বস্তুত পশ্চিম বাংলাসহ বাংলাদশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলােয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভেঙ্গে পড়ে। তাদের চেতনা ও আবেগের জগতে এক অপূর্ব আলােড়ন সৃষ্টি হয়।৯২০ স্বয়ং ভারতের অন্য কোন রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে সেখানে এত দ্রুত এমন প্রতিক্রিয়া হতাে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটা হওয়ার কারণও ছিল। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় তখন যারা রাজনীতি, সাংবাদিকতা, বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম, আইন ব্যবসা, অধ্যাপনা প্রভৃতি পেশায় নিয়ােজিত ছিলেন তাদের অধিকাংশেরই আদি নিবাস ছিল পূর্ব বাংলা। তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন তখনও পূর্ব বাংলায় বসবাস করতাে। ফলে পূর্ব বাংলার প্রতি তাদের অনুভূতি একটা নস্টালজিয়া হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে যারা সহযােগিতা দিয়েছিলেন তারা শুধুমাত্র মানবিক মূল্যবােধের কারণেই তা করেন নি। সেটা করেছিলেন বাংলাদেশকে মাতৃভূমি ও আক্রান্ত বাঙালিকে তাদের স্বজন হিসেবে গণ্য করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ঐতিহাসিক বিভিন্ন সংগ্রামে তাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে অর্জিত সাফল্যকে তাদেরও অহংকার বলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা গণ্য করে। তাই বলা যেতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে

—–

১১২০ শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা’ নীল কমল বিশ্বাস (সম্পা.), যুদ্ধে যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ: দুনিয়া কঁপানাে ২৬ দিন (ঢাকা: এশিয়া পাবলিকেশনস, ১৯৯৮), পৃ. ২৭৬।

পশ্চিম বাংলার মানুষের ব্যাপক সমর্থনের পেছনে ছিল অভিন্ন ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি অর্থাৎ ইতিহাস ঐতিহ্য ও নৃতাত্ত্বিক আবেগমিশ্রিত উপাদান। পশ্চিম বাংলার একজন কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় যার জন্মস্থান বাংলাদেশের দর্শনায়, তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় ২৭ বছর পরে এক স্মৃতিচারণে বলেন ‘চোখের সামনে। জ্বলছে আমার প্রিয় জন্মভূমি, বাংলাদেশ। বাতাসে ভাসছে আমার ধর্ষিতা বােনের চিৎকার, দু আঙ্গুলে কান চাপা দেই। বানের জলের মতাে সর্বহারা মানুষ আসছে। এপারে, প্রাণ নিয়ে, সম্ভ্রম বাঁচাতে । কি লিখবাে আমি ভিয়েতনাম নিয়ে, আমার সামনে তাে আরেক ভিয়েতনাম বাংলাদেশ’ । ঠিক এ ধরনের আর একটি স্মৃতি রােমন্থন করেন তৎকালীন পশ্চিম বাংলার কংগেস দলীয় সভাপতি এবং উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার। তিনি বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির কার্যকরী সভাপতি হিসেবে ছুটে বেড়িয়েছেন সীমান্তবর্তী সকল শরণার্থী শিবিরে। তার জন্মস্থান দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ। তার পিতামহ ছিলেন রায় বাহাদুর সেতাব সিংহ নাহার। গভীর আবেগে তিনি সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন ‘একাত্তরের যুদ্ধ। সে তাে আমারই জন্মভূমি স্বাধীন করার যুদ্ধ । ওই মুক্তিযুদ্ধ তাে আমারই মুক্তিযুদ্ধ । কাজেই আমি কখনােই অনুভব করিনি এই যুদ্ধ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তাে বটেই, ব্যক্তিগত জীবনের গােটা সময় ও সুযােগটুকুও ব্যবহার করেছিলাম বাংলাদেশী মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য।৯২২ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষে বাংলাদেশের রণাঙ্গণে বিভিন্ন সাহায্য সহযােগিতা নিয়ে প্রথমেই প্রবেশ করেন মাষ্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত এবং তারতিক সার্টিফিকেট গ্রহণকালে গভর্নর জ্যাসনকে গুলি করে হত্যা করার পরিকল্পনাকারী বিপ্লবী বীণা ভৌমিক। তিনি নিজ প্রাণের ভয় ভুলে অবরুদ্ধ সীমান্ত এলাকায় চলে যান সাহায্য নিয়ে।২৩ ইলা মিত্র আর একজন বাঙালি বিল্পবী নারী নেতা, নাচোলে সাঁওতাল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে পাকিস্তান সরকার যার ওপর অকথ্য পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তিনিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির শক্তিশালী সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি বলেন ‘একটি জাতি কতটা নিষ্পেষিত হলে প্রাণ দেওয়ার জন্য এগিয়ে যায় তা ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মানুষদের না দেখলে বােঝা যাবে না। গােটা জাতি সেদিন একাত্ম হয়েছিল। …কিন্তু সব ছাপিয়ে যা হলাে তা বাঙালির বিজয়, বাঙালির মুক্তি।১১২০

———–

১১২১ অমর সাহা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১। ১১২২, ঐ, পৃ. ১৪। ১১২৩, ঐ, পৃ. ২৭। ১১২৪ ঐ, পৃ, ৫৩-৫৪।

তাদের এই সমর্থনের পেছনে আবার অনেকের এমনও প্রত্যাশা জন্মে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তারা ফিরে আসবেন নিজেদের অথবা পূর্ব পুরুষদের ছেড়ে যাওয়া ভিটে মাটিতে।১২৫। | বস্তুত যুদ্ধটি দুই বাংলার বাঙালির একটি সম্মলিত প্রয়াসে পরিণত হয়। ক্রমাগত শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশ এবং তাদের নিকট থেকে ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা শুনে সেখানকার সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলােতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ জনমত গড়ে ওঠে, যা সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। ভারত সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ইস্যুতে তার মূল অভিপ্রায়ের পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার মানুষদের আবেগসহ সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলাের আসন্ন সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল । তাই ভারতের উচ্চতম মহল লােকসভা ও রাজ্যসভায় বাংলাদেশের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ঘােষণা করে। ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এসব আলােচনার পর ৩১ মার্চ ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়সঙ্গত এই যুদ্ধকে নৈতিক সমর্থন দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দরা গান্ধী কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবকে সর্বাত্মক সমর্থন জানায়।২৬ ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টত বাংলাদেশে ঘটে চলা বিষয়াবলির প্রতি তার গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। সে সঙ্গে তিনি বিরােধী দলীয় নেতাদের আবেগের প্রতি একাত্মতা ঘােষণার পাশাপাশি এও বলেন যে, ক্রান্তিকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকেও খেয়াল রাখা দরকার। লােকসভায় বক্তৃতার পর তিনি রাজ্য সভাতেও প্রায় অনুরূপ বক্তব্য রাখেন। এখানে বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে তিনি আরাে বেশি সতর্ক, বিশেষত আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ব্যাপারে।২৭

শুরু থেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রশ্নে কেবল রাজপথের অন্দোলনের চাপের মুখে পড়েননি, উপরন্তু বিরােধী দল, সরকারি দল এমন কি মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের অনেকের পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের একটি বহুমুখী জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বাস্তববাদী রাষ্ট্রনায়ক ইন্দিরা গান্ধী ও তার নীতি নির্ধারকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবার উক্ত চাপ উপেক্ষা করাও যায় না। এমতাবস্থায় সীমান্তে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বাঙালিদের

——–

১১২৫, এম, এ. মােহাইমেন, ঢাকা আগরতলা মুজিবনগর (ঢাকা: পাইওনিয়ার পাবলিকেশন্স, ১৯৮৯), পৃ. ১০৮। **** Sheelendra Kumar Sing, op.cit., Vol. one, p. 670. ১৯২৭ Ibid., p. 670.

নিরাপদে আশ্রয় দানের লক্ষ্যে ২৭ মার্চ সীমান্ত খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারত তার অভিপ্রায়ের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।১১২৮।

৩১ মার্চ দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর ওয়ার্ল্ড এ্যাফেয়ার্স’এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত একটি সিম্পােজিয়ামে দিল্লি ইন্ডিয়ান ইনন্সিটিটিউট ফর ডিফেন্স স্ট্যাডিজ এন্ড এনালিসিস’ এর পরিচালক কে সুব্রামনিয়াম মন্তব্য করেন ভারতের অনুধাবন করা উচিত যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া মূলত ভারতের স্বার্থেই আসবে । এ এমন। একটি সুযােগ যা কখনােই আসবে না। এখানেই মন্তব্য করা হয় যে, এটা ভারতের জন্য ‘শতাব্দীর সেরা সুযােগ।” রাজনীতি বিষয়ক কোনাে কোনাে পর্যবেক্ষক ভারতের এই নীতির পশ্চাতে তাদেরর জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে দেখতে পান।৩০ সার্বিক পরিস্থিতি ভারতের জনসাধারণকে তাে বটেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটের প্রভাবশালী কোনাে কোনাে সদস্যকেও প্রবলভাবে আলােড়িত করে। কতিপয় অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তি, রাজনীতিক এবং বিএসএফ-সহ কতিপয় সংস্থার পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের সমর্থনে ভারতের চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়। তবে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় প্রথম দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সুনজরে দেখে নি। বলা বাহুল্য এ ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের অনুরূপ, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আসলে ভারতের সমর্থনপুষ্ট কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদী তথা হিন্দুদের কাজ ছাড়া আর কিছু নয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আরাে একটু অসুবিধা ছিল- নাগা বিদ্রোহ, নকশাল আন্দোলনসহ কতিপয় ছােটখাট বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ । অপর পক্ষে একটি শক্তিশালী ইতিবাচক দিক ছিল বিগত নির্বাচনে কংগ্রেস দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায়। সে কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে বিরােধী কোনাে দলের মুখাপেক্ষী হওয়ার আবশ্যকতা ছিল না। বলা হয়ে থাকে পূর্বের যে কোনাে সরকারের চেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ছিল অধিক

————-

১১২৮ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩। ১৯২৯ মজিবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮। ১৯৩০ “একাত্তর সালে পাকিস্তানের সেনা শাসকদের বর্বরতা দক্ষিণ এশীয় মানচিত্রে নতুন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ থেকে বিছিন্ন করার অবকাশ নেই, শরণার্থী সমস্যা থেকে শুরু করে প্রায় সকল বিষয়ে পাকিস্ত নের অভ্যন্তরীণ সংকটের অংশীদার ছিলাে ভারত, কিংবা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান একটি বড়াে বাধা বা প্রতিযােগী ছিলাে যা অপসারণ করা ভারতের জন্য প্রয়ােজন হয়ে পড়লাে।” বদিউজ্জামান, মুসলিম মধ্যবিত্তের রাজনীতি (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৭), পৃ. ৬৫-৬৬। ১৯৩৯ তপন কুমার দে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা (ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ৮৯।

৩৬০

শক্তিশালী। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধী ও তার নীতি নির্ধারকদের নিকট প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অসুবিধা দেখা দেয় দ্বিবিধ প্রকৃতির—কূটনৈতিক ও সামরিক। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অসুবিধা ছিল তড়িঘড়ি করে হস্তক্ষেপ করলে পাকিস্তানের অপপ্রচারটি আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশংকা। সামরিক দিক থেকেও ভারত সরকার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ভারতের বিস্তীর্ণ সীমানা জুড়ে অনেকগুলাে রাষ্ট্রের অবস্থান, যেগুলাের প্রায় সবই তার প্রতিবেশিসূলভ শত্রুভাবাপন্ন। সুতরাং জাতীয় নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা রাখার পরেই কেবল বাংলাদেশ প্রশ্নে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব বলে ইন্দিরা গান্ধী ও তার নীতি নির্ধারকদের নিকট প্রতিভাত হয়। তদুপরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা নিশ্চিতভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পর্যবসিত হবে এবং এর আড়ালে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি চাপা পড়ে যেতে পারে, জাতিসংঘ বা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সম্ভাব্য চাপে, যা ইন্দিরা গান্ধী ও তার নীতি নির্ধারকদের কাম্য নয়। মধ্যযুগীয় ভাবধারায় পরিচালিত পাকিস্তানের রাজনীতির আবর্ত হতে বের হয়ে এসে উদারপন্থী ভাবধারায় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বিকাশের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর এক ধরনের আবেগজড়িত সমর্থন জন্মে।৩২ বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি সর্বত্রই প্রায় অভিন্ন ভাষায় বক্তব্যে বলেন যে, বাংলাদেশে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যে ঘটনা ঘটিয়েছে বা ঘটাচ্ছে তা মানবতাবিরােধী। এর ফলে প্রাণে বাঁচার জন্য নজীরবিহীনভাবে প্রতিদিন অসংখ্য শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করছে যা তার দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর সে কারণেই এই সংকট পাকিস্তানের আর অভ্যন্ত রীণ বিষয় নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে মানবিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং সেভাবেই এর সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাই বাংলাদেশ ইস্যু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের এক অন্যতম মিশনে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে ভিতরে-বাইরে প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকা সত্ত্বেও তিনি ও তার উপদেষ্টারা বুঝেসুঝে সঠিক অথচ নিশ্চিত সাফল্য লাভের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার নীতি অনুসরণ করেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপের প্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাবান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’ জানিয়ে দেন যে, বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাদের উপযুক্ত প্রস্তুতি নেই। এ কারণে অনেক রাজনীতিবিদ কর্তৃক ভারতীয় সামরিক বাহিনী সমালােচিত হয়। এতেই শেষ নয়, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন

১১৩২ভারত বিচিত্রা, বত্রিশ বর্ষ, ডিসেম্বর, ২০০৬, সম্পাদকীয় । ১১৩৩ লে, জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২।

রাম অর্থমন্ত্রী ওয়াই.বি. চ্যাবনের সহযােগিতায় জেনারেল মানেকশ’কে অপসারণেরও প্রস্তাব করেন।১১৩৪

সঠিকভাবে পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য ভারতের তখনকার বাস্তব সামরিক অবস্থা কেমন ছিল সে বিষয়ে সম্যক আলােকপাত দরকার। সামগ্রিক সামরিক ব্যবস্থাপনা (স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী) তখন পশ্চিমাঞ্চলীয় ও পূর্বাঞ্চলীয় দুটো ইউনিটে বিভক্ত ছিল। তৎকালীন ভারতের প্রতিরক্ষা সংস্থাসমূহ ছিল অপেক্ষাকৃত শিথিল, বিকেন্দ্রীভুত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রকৃতির।৩ই একটা সর্বাত্বক যুদ্ধের জন্য এগুলাের সমন্বয়সাধন নির্ভর করতাে মূলত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী এবং বাহিনীত্রয়ের প্রধানদের সম্পর্ক ও সমন্বয়ের ওপর, চলতি অবস্থায় যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাহিনীত্রয়ের প্রধানদের সঙ্গে (সেনাবাহিনী প্রধান এস.এইচ.এফ.জেনারেল শ্যাম মানেকশ, বিমানবাহিনী প্রধান পি.সি লাল, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নন্দ) বাংলাদেশ ইস্যুতে সম্ভাব্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে আলােচনায় মিলিত হন। এরই এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে যে, সামরিকভাবে তখনই পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অসুবিধা ছিল মূলত দ্বিবিধ প্রয়ােজনানুসারে সামরিক প্রস্তুতির জন্য ন্যূনতম ছয় থেকে সাড়ে ছয় মাস সময়ের প্রয়ােজন। তাদের মতে তখনই কাজ শুরু করলেও ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর নাগাদ ভারতীয় বাহিনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারবে। এ ব্যাপারে ইস্টার্ণ। কমান্ডের তকালীন চীফ অব আর্মি স্টাফ লে. জেনারেল জেকব লিখেছেন: *

এপ্রিলের শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনালের এস.এইচ.এফ, জে মানেকশ টেলিফোনে জানান যে, সরকার চাইছে ইস্টার্ণ কমান্ড অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করুক। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, এটা অবাস্তব। কারণ আমাদের হাতে আছে শুধু পার্বত্য এলাকায় অভিযান পরিচালনার উপযােগী মাউন্টেন ডিভিশন। তাদের কাছে ব্রিজ তৈরির কোনাে ধরণের সাজ-সরঞ্জাম নেই এবং সমতলে চলাচলের উপযােগী যানবাহনের পরিমাণও তাদের খুবই কম। কলকাতা থেকে ঢাকার মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ও চওড়া স্রোতস্বিনি নদী আছে। আবার বাংলাদেশের অপর পাশে আগরতলার প্রতিরােধব্যবস্থাও ভঙ্গুর। প্রতিরক্ষার জন্য সেখানে শুধু এক গ্যারিসন ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন আছে । দুরূহ যােগাযােগ ব্যবস্থার কারণে শক্তি বৃদ্ধি করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়ােজন । আমাদের মাউন্টেন ডিভিশনগুলােকে উপযুক্ত সরঞ্জামে সজ্জিত করে নদীবহুল অঞ্চলে যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষন দিতেও বেশ সময় লেগে যাবে। আন্ন বর্ষাকালে নিমজ্জিত

——-

১৯৩৪. তপন কুমার দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০। ১১৩৫ লেজেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬। ১৯৩৬ ঐ, পৃ. ২১।

ধানক্ষেতের কারণে সেতুবিহীন নদীগুলাে পার হওয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। সেই মুহূর্তে রওয়ানা দিলেও আমরা বড় জোর পদ্মা পর্যন্ত পৌঁছতে পারব ।…’ জেনারেল মানেকশ’ জানতে চাইলেন, কবে নাগাদ আমরা তৈরি হতে পারব। আমি জানালাম আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম দেয়া হলে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আমরা তৈরি হতে পারব। এর মধ্যে বর্ষার পানি সরে গিয়ে রাস্ত

ঘািটও চলাচলের উপযােগী হয়ে উঠবে। বিপরীতপক্ষে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। এ ছাড়াও প্রতিপক্ষের সমরাস্ত্র মােকাবিলার জন্যও ভারতের প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র মজুদ ছিল না। সামরিক দিক হতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। আর একটি অসুবিধা ছিল মৌসুম সংক্রান্ত। মূলত সামরিক রসদ পরিবহনের উপযােগী যানবাহন সংগ্রহ করাও মৌসুমী কারণে অসুবিধাজনক বলে সেনাবাহিনী প্রধান মানেকশ’ বিবেচনা করেন। কেননা তখন ফসল কাটা ও সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছিল । সে জন্য অনেক যানবাহন ও রাস্তা ব্যবহারের প্রয়ােজন। সেটা না করা হলে দেশ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হবে।”কুটনৈতিক কারণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেলে চীনের ভূমিকা কেমন হতে পারে সেটাও মাথায় রেখে শীতকালে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করা অধিক যুক্তিযুক্ত বলে সামরিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে বিবেচিত হয়। শীতকালে হিমালয়ের পাদদেশ সংলগ্ন অঞ্চলে তুষারপাতে সেখানকার গিরি-খাতগুলাে বরফাচ্ছাদিত হয়ে যাবে এবং চীন তখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এবং আক্রান্ত বাংলাদেশের উত্তর সীমানা দিয়ে পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য পাঠাতে পারবে

———

| ঝাপিয়ে পড়ার সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে চারটি পাকিস্তানি ইনফ্যান্ট্রি বিগ্রেড ছিল। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে এর পরিমাণ দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশটি নিয়মিত ইনফ্যান্ট্রির ব্যটালিয়নে। তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা আধা-সামরিক বাহিনীর সাতটি উইং, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের সশস্ত্র বাহিনীর সাতটি উইং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রটেকশান ফোর্সের। কয়েকটা কোম্পানি এবং প্রচুর অনিয়মিত মুজাহিদ ও রাজাকার ছিল। ছয়টি ফিল্ড রেজিমেন্ট, বেশ কয়েকটি স্বাধীন ফিল্ড ও ভারি মর্টার ব্যাটারি এবং হালকা বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে আর্টিলারি সজ্জিত ছিল। এক রেজিমেন্ট আমেরিকান শ্যাফি (Chaffee) টঙ্ক, শ্যাফি ট্যঙ্কের একটি স্বাধীন স্কোয়াড্রন এবং শ্যাফি ও রাশিয়ান পিটি। ৭৬ (PT 76) ট্যাঙ্কের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্কোয়াড্রন নিয়ে ছিল আর্মার বিভাগ। পাঁচটি স্যার (Sabre) জেট ফাইটার, পরিবহন বিমান ও কয়েকটা হেলিকপ্টার ছিল বিমান বাহিনীর উপাদান আর নৌবাহিনী গঠিত ছিল কয়েকটি গানবােট দিয়ে।” লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।

১৯৫৮ ঐ, পৃ. ১৫৮। ১১৩৯ ঐ, পৃ. ১৫৭-১৫৮।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর হতে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও ও সিকিম-ভুটানের মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ৩০ মাইল প্রশস্ত সিলিগুড়ি কোরিডরটি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ভারত উপযুক্ত সৈন্য মজুদ। করে রাখতাে। কেননা কোনাে কারণে এই করিডােরটির পতন ঘটলে চীন কর্তৃক অতি সহজেই ভারতের পূর্বাঞ্চলের ৭ টি রাজ্যে প্রবেশ করে মূল ভূখণ্ড থেকে। এগুলােকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার আশংকা ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মাথায় প্রবেশ করে যে, পাকিস্তানের গৃহীত সামরিক ব্যবস্থাকে সমর্থনকারী এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র চীন যদি এই সংকীর্ণ গিরিখাত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে ভারত একটি বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। ইতােমধ্যেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যে, চীন আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নিজ পক্ষে রাখার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন অব্যাহত রাখতে সােচ্চার। | তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার ক্ষেত্রে ভারতের সামরিক অসুবিধার বিষয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল সিদ্দিক সালিকও পরবর্তীকালে ভারতীয় সমর বিশেষজ্ঞ ডি.কে, পালিতকে উল্লেখ করে। লিখেছেন:১১৪০

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। কেননা, সশস্ত্রবাহিনী তখনও পুণঃঅস্ত্রসজ্জিতকরণ ও পুণঃগঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগােচ্ছিল। ৫০,০০০ মিলিয়ন রুপি পঞ্চবার্ষিকী প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কেবল বাস্ত বায়িত হবার পথে এবং ভারতীয় সমরসজ্জাকে আরাে জোরালাে করতে তখনও অনেক ব্যবস্থা গ্রহণে বাকি। সেনাবাহিনীতে জনশক্তি সংগ্রহের কাজ পুরােমাত্রায় অর্জিত হয়নি। অনেকগুলাে ইউনিটে জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। চলমান অপারেশন। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক ও লজিস্টিক ইউনিটের ঘাটতি আছে । বিমান বাহিনীতে মিগ-২১ জঙ্গী বিমান উৎপাদন পুরােমাত্রায় উপনীত হতে পারেনি। খুচরাে যন্ত্রাংশের অভাবে কয়েকটি স্কোয়াড্রনের কার্যক্ষমতা নিতর পর্যায়ে চলে এসেছে। নৌ বাহিনীতেও পুনঃসজ্জিতকরণ কর্মসূচি সম্পূর্ণ হতে তখনও বাকী । পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য সেনাবাহিনীকে আরাে কয়েকমাসের ক্র্যাশপ্রােগ্রামের অধীনে আনা দরকার। এর থেকেও মারাত্মক হলাে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার চহিদা। মেটাতে গিয়ে সেনাবাহিনীতে সমম্বয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। দুটি ডিভিশনকে (ভারী অস্ত্র বাদে) পশ্চিম বাংলায় নিয়ােগ করা হয়েছে এবং নাগাল্যান্ডে

——

১১৪০, সিদ্দিক সালিক, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, মাসুদুল হক (অনু.) (ঢাকাঃ নভেল। পাবলিকেশন্স, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৯০), পৃ. ১০৯। তার রচিত মূল গ্রন্থখানির নাম Witness to surrender.

আছে এক ডিভিশন ও মিজোরামে আছে এক ডিভিশন। এ অবস্থায় বিমান বাহিনীও অসুবিধায় পড়বে। বিমান ঘাঁটিগুলােকে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালানাের মতাে করে উন্নত করা হয়নি। কুমিল্লা সেক্টরে অপারেশন চালানাের জন্যে শিলচরের (কুড়িগ্রাম সীমান্তে) বিমানঘাঁটিটি ব্যবহার করতে হবে,

কিন্তু হামলা চালাবার জন্যে প্রয়ােজনানুরূপ নয় । ভারতের শীর্ষস্থানীয় নীতি নির্ধারকরা ধরে নেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়ােগ অর্থাৎ যুদ্ধ অবধারিত। আধুনিকালের যুদ্ধ পরিকল্পনায় কেবলমাত্র আনুপাতিক হার সমন্বিত সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী থাকলেই চলে না। সে সঙ্গে নিজের পক্ষে থাকতে হয় বিশ্ব কূটনীতিতেও শত্রু-মিত্রের সমীকরণ। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি সময়ে উপস্থিত হয় যখন সমগ্র বিশ্বরাজনীতি একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী ব্লক অন্যদিকে সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক অর্থাৎ দুটো শক্তি বলয়ে আবর্তিত এবং স্নায়ুযুদ্ধের চাপে ন্যুজ। এর বাইরে যুদ্ধ-বিরােধী আর একটি ব্লক বিদ্যমান ছিল বটে, যা উপরিউক্ত জোটদ্বয় হতে বাহ্যত আলাদা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য নাম ধারণ করে জোটনিরপেক্ষ । মতাদর্শিক কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলন তখন চীন ও রাশিয়ান ব্লকে বিভক্ত। কমিউনিস্ট দেশগুলাের কোনাে কোনােটি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম । কিন্তু বাস্তবতায় বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা তাদের তেমন ছিল না বললেই চলে। বিদ্যমান এসব জোটের মধ্যে শক্তি-ভারসাম্যের সমীকরণ নির্ণয়ও জটিল বিষয়। এ জটিলতাকে বহুল প্রচলিত ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ তত্ত্ব জটিলতর করে তােলে। বিদ্যমান স্নায়ুযুদ্ধভুক্ত শক্তিগুলাের অবস্থানগত কারণে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন সঙ্গত কারণেই উপরিউক্ত জোট, উপজোটে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনদানকালে ভারতের নীতি নির্ধারকরা উল্লিখিত জটিলতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি করেন। তারা পূর্বাহ্নেই অনুমান করেন যে, বাংলাদেশ ইস্যু উপমহাদেশের তাে বটেই বিশ্ব রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। বিশ্বের বৃহৎ ও বহুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দুটি দেশ ভারত ও চীন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম হওয়া সত্ত্বেও কিছু কারণে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছিল প্রসঙ্গত।

১১৪১ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তির ভূমিকা (ঢাকা: ডানা প্রকাশনী, ১৯৮২), পৃ. ১০।

৩৬৫

উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান চীনকে পক্ষে রাখার জন্য তার অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের অংশবিশেষ চীনকে প্রদান করে ১৯৬২ সালে একটি মৈত্রী চুক্তিতে উপনীত হয়। পরবর্তীতে ঐ এলাকাটি আচিক চীন নামে পরিচিত হয়। চীন-ভারত সম্পর্ক আরাে শীতল হয়ে পড়ে তিব্বতের দালাইলামাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার কারণে। এ ছাড়াও ভারত নিজের নিরাপত্তার প্রশ্নে অনেকটা সােভিয়েত ইউনিয়নমুখী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে আজন্ম-শত্রু ভারতের সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধ বাধায় পাকিস্তান তার নিরাপত্তা বিধানের জন্য অপর পুঁজিবাদী শক্তি-জোট প্রধান আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। আবার চীন একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও মতাদর্শিক কারণে অপর বৃহৎ প্রতিবেশী ও সমাজতান্ত্রিক বলয়কে নেতৃত্বদানকারী সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল না। সােভিয়েট ইউনিয়নের বিপক্ষ শক্তি আমেরিকার সমর্থন ও সহযােগিতাই পাকিস্তানের কাম্য ছিল। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক ছিল। এমতাবস্থায় নিক্সন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় ছিলেন।১৯৯২ তাই দক্ষিণ এশিয়ার একটি ব-দ্বীপ রাষ্ট্র নব্য বাংলাদেশের ঘটনাবলি কেবল আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয় বরং পর্যায়ক্রমে সমগ্র বিশ্ব রাজনীতিকে আন্দোলিত করতে পারে বলে ভারতের নীতি নির্ধারক মহলের প্রত্যয় জন্মে এবং সব দিক বিবেচনা করে তারা ধীর অথচ সুদৃঢ় লক্ষ্যাভিমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট হন। আলােচ্য প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনে চূড়ান্ত সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ভারতীয় বাহিনীকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয় । কিন্তু যতদিন প্রস্তুতি সম্পন্ন না হয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানকে আক্রমণ করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হয় ততদিন পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সামরিক সাহায্য দানেরও একটি নীতি অনুসৃত হয়। | যে প্রতিকূল কূটনৈতিক পরিবেশে ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করতে উদ্যোগী হয়, আন্তর্জাতিকভাবে তাকে পরিপক্ক করার জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল। বিশ্ববাসীর নিকট প্রমাণ করার প্রয়ােজন হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেখানকার বাঙালিদেরই ব্যাপার এবং সংকটটি কেবলমাত্র পাকিস্তানের নয়, ভারতকেও তা স্পর্শ করেছে; রাজনৈতিকভাবেই তার সমাধান বাঞ্ছনীয়—ভারতের পক্ষ হতে চূড়ান্ত সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে বিশ্ববাসীর। নিকট এ ধরনের ধারণা সৃষ্টি, নিজের সামরিক পুণর্বিন্যাস ও কূটনৈতিকযুদ্দে বন্ধু।

——–

১১৪২, আসিফ রশীদ, ‘মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন ভূমিকার দলিল নতুন তথ্য’, প্রথম আলাে, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৩।

খোঁজার জন্য কিছু সময়ের দরকার ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যজনকভাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য বিদেশ বিষয়ক প্ল্যানিং কমিটির চেয়ারম্যানকে রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে ওয়ার কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা হচ্ছে ভারত ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঘটনা। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদেরকে সীমিত পরিমাণ সাহায্যে দানের পাশাপাশি ভারত সরকারের রাজনৈতিক নির্দেশে জেনারেল মানেকশ’ তিনবাহিনী ও আন্তঃগােয়েন্দা বাহিনীগুলাের সমন্বয় সাধনপূর্বক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিকল্পনায় মনােনিবেশ করেন।” মানেকশ’-এর তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশান এর ডিরেক্টর লেফট্যান্যান্ট জেনারেল কে.কে. সিং দ্রুত বিচক্ষণতার সঙ্গে ঐ পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নেন। | প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চূড়ান্ত যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তাদান সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সরকার তিনটি কমিটি গঠন করে। একটি রাজনৈতিক এবং অপর দুটি সামরিক । ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে রাজনৈতিক কমিটি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার বিশেষ আস্থাভাজন কেন্দ্রের বাম ধারার সমর্থক এবং মস্কোর সঙ্গে সুসম্পর্কযুক্ত ডি.পি. ধরকে রাজনৈতিক কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়ােগদান করেন। ডি.পি, ধর একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও প্রাপ্ত হন। যুদ্ধ-প্রস্তুতি সংক্রান্ত যুদ্ধ-কাউন্সিলের প্রধান নিয়ােগ করা হয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ’কে। ডি.পি, ধরকে। যুদ্ধ-কাউন্সিলের সদস্য করা হয়। বাহ্যত সেনাবাহিনী উপপ্রধানকে চেয়ারম্যান করে আন্তঃগােয়েন্দা সংক্রান্ত আর একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এটি শ্যাম মানেকশ’এর অধীনে কাজ করে। সামরিক আন্তঃগােয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র'(Researh and Analysis Wing) এর প্রত্যক্ষ সংযােগ ছিল। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন জেনারেল বি.এন.(জিমি) সরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথমে এই দায়িত্বে নিয়ােজিত হয়েছিলেন ওঙ্কার সিং ক্যালকাট। যাহােক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় পক্ষে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরে দু জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন ডি.পি. ধর ও জেনারেল মানেকশ’ । এ ছাড়াও যারা বিশেষ অবদান রাখেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন পি,এন, হাকসার, টি,এন,

———

১১৪৩ তপন কুমার দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২। ১১৪৪

মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫। জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০।

কল, বি, এন, সরকার, আর.এন, কাউ, পি.এন. ধর, জি পার্থসারথি, সি সুব্রামনিয়ম, অশােক মিত্র১১৪৬ প্রমুখ । | ভারত সরকার বাংলাদেশ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার পর করণীয় সম্পর্কে নিলিখিত নীতিসমূহ অনুসরণ করে:১১৪৭।

১. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চালাবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে মাত্র, ২. মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য দেয়ার অভিযােগে পাকিস্তান যদি ভারতের ওপর আক্রমণ চালায়, তাহলে ভারতীয় বাহিনী তা মােকাবিলা করবে, ৩. বাংলাদেশ সমস্যার যদি কোনাে রাজনৈতিক সমাধান পাকিস্তান সরকার না করে তাহলে ভারতীয় বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামতে হবে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য হবে। ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্ত করা, অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা, ৪, মুক্তিযুদ্ধে যদি প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় বাহিনীকে নামতে হয়, তাহলে অতি দ্রুততার সঙ্গে রাজধানীসহ সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হবে, ৫. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশগ্রহণের অর্থই হবে পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ। সুতরাং সে লড়াই কেবল পূর্বাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা পশ্চিমাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়বে এবং ৬. পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বৃহৎ প্রতিবেশী ও শত্রুভাবাপন্ন চীনের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে ।

লক্ষ্য সাধনের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে কেন্দ্রে অবশ্য ডান-বামের টানাপােড়েনও একটি সমস্যায় পরিণত হয়। নীতি নির্ধারকদের একটি ক্ষুদ্রাংশ প্রথমে আমেরিকাসহ বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে বলে আশাবাদী ছিলেন । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার ঘনিষ্ট নীতি নির্ধারকরা ভিন্নমত পােষণ করেন। তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য। আর সে বিবেচনা থেকেই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়, মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে। এমতাবস্থায় মে মাসে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার দিকে লক্ষ রেখে একটি অন্তর্বর্তীকালীন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।

শুরু হতেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সমগ্র বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ ভারতের প্রচেষ্টায় মুক্তিবাহিনী দেশের যে কোনাে অংশ দখল করে তার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে পারে বলে কর্তৃপক্ষের আশংকা।

—–

১১৪৬ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫। | অশােক মিত্র, আপিলা-চাপিলা (কলকাতা: আনন্দ, ২০০৩), পৃ. ১৯৪। ১১৪৮ তপন কুমার দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩। ১১৪৯

লে. জেনারেল জেকব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪।

জন্মে। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নামক যে মামলা করেছিল তখন থেকেই তাদের এই ধারণা জন্মেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সরকারের সেই ধারণা বদ্ধমূল হয় এবং যাতে কোনভাবেই মুক্তিবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে অংশ দখলে নিতে না পারে সেদিকে অতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয় । নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বাঙালিদের ওপর নজীরবিহীন নির্যাতন চালানাে হয়। নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য জনসংখ্যার এক-সপ্তমাংশ মানুষ শূন্য হাতে ভারতে পাড়ি জমায়। প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া এসব মানুষ ভারতে গিয়ে মানবেতর শরণার্থী জীবনের দুঃখকষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়। সীমানা অতিক্রমকারী এই জনস্রোত বাংলাদেশের সীমানা সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলােতে সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট; ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে অস্তিত্ব রক্ষার দ্বারপ্রান্তে দাড় করিয়ে দেয়। ভারত সরকারের উৎস হতে জানা যায় মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ হতে বাংলাদেশ থেকে যে ক্রমবর্ধমান হারে শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে তাতে কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং রাজ্যসভায় গুরুত্বসহকারে তা আলােচিত হয়। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ হতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমাগত নির্যাতন বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী একমাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিপূর্বক সমগ্র বাংলাদেশ হতে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ‘দুষ্কৃতিকারী’দের মূলােৎপাটনের উদ্দেশ্যে ‘অপারেশন সার্চ এন্ড ডেস্ট্রয় নামে যে ক্র্যাশ প্রােগ্রাম চালানাে হয় তার প্রেক্ষিতে ভারতে শরণার্থী সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। সীমান্তবর্তী কোনাে কোনাে রাজ্যে শরণার্থী সংখ্যা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছাকাছি আবার কোনটিতে বেশি হয়ে পড়ে।১৫১ বাংলাদেশকে তখন সাহায্য

——-

রাজ্যসভায় উপস্থাপিত পরিসংখ্যনে দেখা যায়, ১৭.৪.১৯৭১ তারিখে শরণার্থী সংখ্যা ১,১৯,৫৫৬ জন থেকে ২৪.৪.’৭১ তারিখে তা উন্নীত হয় ৫,৩৬,৩০৮ জনে। পরবর্তী সপ্তাহে তা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ ১.৫.’৭১ তারিখে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২,৫১,৫৪৪ জনে। তার পরবর্তী সপ্তাহে বৃদ্ধির সংখ্যা একটু কম অর্থাৎ ৭.৫.’৭১ তারিখে ১৫,৭২,২২০ জন হলেও মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সকল সীমান্ত দিয়েই নির্যাতিত মানুষেরা জলস্রোতের ন্যায় ভারতে প্রবেশ করে, তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়ায়। ২৬,৬৯,২২৬ জনে। একই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ৩৪,৩৫,২৪৩ জন শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে । Bangladesh Documents Vol. one, p. 675. ** “পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি ছয়জনে একজন ছিলেন পূর্ববঙ্গের শরণার্থী । ত্রিপুরার জনসংখ্যা পনের লাখ, সেখানে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১৪ লাখে। মেঘালয়ের ১০ লাখ মানুষের সংখ্যা শরণার্থীদের নিয়ে ১৭ লাখে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং চুড়ান্ত মুকাবিলার মধ্য দিয়ে শীতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাক সেই ছিল ভারতের চিন্তা।” সাইফুল ইসলাম, স্বাধীনতা ভাসানী ভারত (ঢাকা: বর্তমান সময়, তৃতীয় প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ২০৭।

করা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জন্য নৈতিক কর্তব্য শুধু নয়, রাজনৈতিক দায়িত্ব | হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের তৎকালীন নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ এ কথা স্বীকার করেন যে, পূর্বাঞ্চলে বাংলাভাষী রাজ্যগুলােতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, বাংলাদেশের পক্ষে যে প্রচণ্ড জনমত গড়ে উঠেছিল সেটা যদি দিল্লি উপেক্ষা করত তাহলে পশ্চিমবঙ্গই ভারতের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারত।৯৫২ একদিকে শরণার্থীদের বিরামহীন স্রোত অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যায় থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অব্যাহত চাপ—এই দুয়ের সমন্বয় সাধন করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার নীতি নির্ধারকদের হিমসিম খেতে হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে যতদ্রুত সম্ভব শরণার্থীদের স্বদেশে পাঠানাের মধ্যেই কেবল সমস্যা সমাধান নিহীত বলে বিবেচনা করা হয়।৫৩। | মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি ওসমানী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যরা ভারত সরকারের আহ্বানে দিল্লি যান। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন। তার পক্ষে পি.এন, হাকসারের সঙ্গে আলােচনার সময় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কেউ কেউ বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় নীতির অস্পষ্টতা সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের দাবি জানান। স্বীকৃতিদানে বিলম্বের কারণে তাদের অসন্তুষ্টির বিষয়টি ফুটে ওঠে। এ ব্যাপারে পীড়াপীড়ির বিষয়টি কূটনৈতিক মাত্রা ছাড়ালে হাকসার অনেকটা বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশ সরকার যদি মনে করে অবিলম্বে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া দরকার তাহলে স্পষ্টভাবেই তা ব্যক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভারতের নীতিনির্ধারক মহলের এ ধরনের জবাবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের অনেকের মধ্যে নৈরাশ্য ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।* তাজউদ্দীন আহমদ অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে প্রথমবারের সাক্ষাতে বাংলাদেশ ইস্যুতে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের করণীয় ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। | মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে উক্ত সাক্ষাৎ তাজউদ্দীন আহমদের কাজ করার জন্য আপাতত সহায়ক হয়। কেননা সরকার গঠনের পর আর দশজন সাধারণ রাজনীতিবিদের ন্যায় মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরাও তখনই ভারতের সর্বাত্মক সামরিক সাহায্য লাভের জন্য অস্থির হয়ে | ওঠেন। এমনিতেই তাজউদ্দীন আহমদকে একটা বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে

———-

১১৫২, নীল কমল বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৫। ১১৫০, মঈদুল হাসান , প্রাগুক্ত, পৃ. ২০-২১।

১১৫

ঐ, পৃ. ৩০।

৩৭০

যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল, ভারতের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এর প্রতিক্রিয়া কিছুটা তার ওপর গিয়ে পড়ে; তার জন্য সৃষ্টি হয়। বিব্রতকর অবস্থা। তাজউদ্দীন আহমদবিরােধী তৎপরতা একেবারে বন্ধ না হলেও এ সাক্ষাতের পর কেবিনেট সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অনুধাবন করেন যে, বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদের ওপর নির্ভরশীল নয়, নির্ভর করছে ভারত সরকারের ওপর এবং ভারত সরকারের এ ধরনের চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ। করতে যাওয়ার পূর্বে নানাবিধ উপাদানের সমন্বয় করা আবশ্যক। হতাশাব্যাঞ্জক এই পরিস্থিতিতে মে মাসের প্রথমার্ধে মস্কোপন্থী ন্যাপদলীয় সদস্য এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক মঈদুল হাসান মূলত ‘মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে মত বিনিময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।৫৫ নেতাদের অনেকের মধ্যে হতাশা লক্ষ করলেও তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাফল্য সম্পর্কে অবিচল আস্থাশীল দেখতে পান। প্রধানমন্ত্রী ও তার মধ্যে ১২ ও ১৩ মে একান্তে যে আলােচনা হয় সে সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন: ১৯৫৬

উল্লেখিত দুদিন আলােচনা অধিকাংশ সময় আমাদের দুজনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে মােট প্রায় সাত আট ঘণ্টা ধরে। দেশের সর্বশেষ অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, প্রবাসী সরকার এবং রাজনৈতিক দলসমূহের দ্বন্দ্ব-সমম্বয় প্রচেষ্টা, বিদ্রোহী সেনাদের অস্ত্র, মনােবল ও প্রস্তুতির সমস্যা, মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে ভারতীয় রাজনৈতিক দলসমূহের ভূমিকা ও মনােভাব, ভারত সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সাহায্য ও সাহয্যের প্রতিশ্রুতি, পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিকল্প পদক্ষেপ, অমীমাংসিত পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা-এই সমুদয় বিষয় নিয়েই কম-বেশী আলােচনা হয়। আলােচনার এক পর্যায়ে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে কতদূর অবধি সাহায্য করতে সক্ষম হবে, এ প্রশ্ন আমি তুলি। এর প্রত্যক্ষ কোন জবাব না দিয়ে তাজউদ্দীন কেবল জানান, মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে

তাঁর কোন সন্দেহ নেই। তারা গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন আলােচনায় অনুধাবন করেন যে, চীনের অপর প্রতিবেশী ও আমেরিকার বিপরীতে পরাশক্তিকে নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি দক্ষিণ এশিয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন যােগায় কেবল তার মাধ্যমেই ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ। সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যমণ্ডিত হতে

——–

১১৫৫ ঐ, পৃ. ৩০-৩১।

১১৫৬ ঐ, পৃ ৩২

পারে।১১৫৭ এমতাবস্থায় উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং সম্ভাব্য সংঘাতের বিষয়ে ভারত কিংবা সােভিয়েট ইউনিয়নের চিন্তা-ভাবনা কি ধরনের সেটা জানা এবং মত বিনিময়ের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ যােগাযােগ করার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করেন। সে লক্ষ্যে মঈদুল হাসানকে প্রথমে দিল্লি প্রেরণ করা হয়। | তিনি এই মিশনে ৯ দিনব্যাপী দিল্লিতে অবস্থান করে নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে নিয়ােজিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলােচনায় ভারত সরকারের করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন ধারার মতামতের সন্ধান লাভ করেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রে ডান ও বামের মধ্যে মতভিন্নতা একটা বড় সমস্যা হিসেবে পরিলক্ষিত হয় । দক্ষিণপন্থীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য সম্পর্কে সন্দিহান এবং মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশের নেতৃত্ব বামপন্থীদের। হাতে চলে যেতে পারে বলে তাদের আশংকা জন্মে। পাকিস্তানের স্বপক্ষে চীন ও আমেরিকার সাহায্যের মুখে ভারতের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়েও তারা উদ্বিগ্ন। আমেরিকার ইচ্ছার বিপরীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করতে গিয়ে ভারত মার্কিন প্রভাব বলয় হতে বের হয়ে সাহায্যের জন্য আরাে বেশি সােভিয়েত-মুখী। হয়ে পড়তে পারে বলেও তাদের চিন্তায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল । শরণার্থী সমস্যা। থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, প্রয়ােজনে পাকিস্ত েিনর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার জন্য জনসংঘ বা অনুরূপ ডানপন্থী সংগঠগুলাের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়। | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্তিদানপূর্বক একটি রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ার পক্ষে ভারত সরকারের মধ্যে মধ্যপন্থী একটি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। তাদের মতে বহু সমস্যাসংকুল ভারতের জন্য। এ ধরনের সমাধানই বরং মঙ্গলজনক। তবে এ সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন যত বিলম্বিত হবে ততই ভারতের অভ্যন্তরীণ অবস্থা। জটিল হয়ে উঠবে। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা। যায়। মুল ভূখণ্ড হতে দূরবর্তী পার্বত্য রাজ্যগুলাের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা চীনের সাহায্য

————–

১১৫৭, “বিষয়টি আরাে গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়ােজনীয়তা স্বীকৃত হয় দুটি মূল প্রতিপাদ্য থেকে। প্রথমত আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে নিজস্ব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভারতের পক্ষে অবশিষ্ট বিকল্প শক্তি তথা সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট সমঝােতায় পৌছানাে সম্ভব কিনা। চীনের উত্তর সীমান্তে উসরী নদী বরাবর এবং সিনকিয়াং প্রদেশের পশ্চিমে মােতায়েন সােভিয়েট ইউনিয়নের অন্ন চল্লিশ ডিভিশন। সৈন্য চীনের ভারত বিরােধী সামরিক প্রবণতার সম্ভাব্য প্রতিবন্ধক হতে পারে বলে আমরা । মনে করি।” মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২। ১৯৫৮, ঐ, পৃ. ৩৪-৩৫।

নিয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারে বলেও নীতি নির্ধারকদের আশংকা জন্মে। অন্যদিকে ভারত সরকারের কেন্দ্রে যারা বামধারার সমর্থক বলে পরিচিত, উপরিউক্ত ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাভাবনা ছিল জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযােগিতা অব্যাহত রাখতে যে কোনাে বিকল্প বিবেচনা করা যেতে পারে। যে কোনাে বিকল্প নির্বাচনের বিষয়টির ক্ষেত্রে নিজের সামরিক শক্তির ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা উভয়কেই বিবেচনা করা যেতে পারে। স্বভাবতই এ ব্যাপারে বন্ধুভাবাপন্ন পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। বস্তুত এই ধারাটির চিন্তা ভাবনা এবং তাজউদ্দীন আহমদ ও মঈদুল হাসান কলকাতায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ যেমনটি করেছিলেন- দুটোর মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। এদের দ্বান্দ্বিক প্রকৃতির চিন্তাভাবনা সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন:১১৬০

…ভারতে আগত ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানের জন্য বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই, সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য ভারতের সর্বাত্মক সাহায্য প্রদান ছাড়া অন্য উপায় নেই, ভারতের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের আগে তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝােতা প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারতের অন্য কোন উপায় নেই—পরিস্থিতির এই গ্রন্থিবদ্ধ যুক্তিতে তাদের সাড়া পাওয়া যায় প্রথম আলাপেই। যেমন, দিল্লীতে পি.এন হাকসারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু বামপন্থী মার্কিন অর্থনীতিবিদ ডানিয়েল থর্নার আমার যে বৈঠকের আয়ােজন করেন, সেখানে পরিস্থিতির এই যুক্তি উত্থাপনের পর আলােচনা চার ঘণ্টারও অধিক সময় স্থায়ী হয়। এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পি.এন, ধর সেই আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। আলােচনার শেষ পর্যায়ে আমি তাদের জানাই যে, আমার ভূমিকা বেসরকারি হলেও পরিস্থির এই মূল্যায়ন ও পলিসি- প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং বর্তমান সংগ্রাম যাতে সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে তজ্জন্য মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত দুটি দলসমেত স্বাধীনতা সমর্থক সব কটি দলের সমবায়ে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের

ব্যাপারেও তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। উল্লিখিত মিশনে পি,এন,হাকারের সঙ্গে আলােচনার এক পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে প্রস্তাবিত বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে আগ্রহ ও সােভিয়েট ইউনিয়নের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ

——–

১১৫৯ নজরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩।

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬-৩৭। এ বিষয়ে আরাে জানার জন্য দেখুন উক্ত গ্রন্থের ৩৪-৩৯ পৃ. ।

শুরু করার পক্ষে মত প্রদানের মাধ্যমে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এ পর্যায়ে প্রবাসী সরকারকে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞার বেশ প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। সরকারের পক্ষ হতে ভারতের উচ্চতম মহলের আস্থা অর্জন করতে না পারলে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের ঝুঁকি গ্রহণ আদৌ সম্ভব হতাে না। এই দুতিয়ালীর মাধ্যমে তারা অনুধাবন করেন বাংলাদেশের মানুষ যে বিপুল আবেগে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে, প্রবাদপ্রতিম নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেও তাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদের মতাে যােগ্য রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তি বাংলাদেশ সরকারকে নেতৃত্বদান করছেন। | বস্তুত উদ্ভূত বাস্তবতায় ভারত সরকারের অভ্যন্তরে অবস্থিত বামধারাটি পরিপূর্ণভাবে ক্রিয়াশীল হওয়ার মধ্যেই চূড়ান্ত অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে অবশ্য কমপক্ষে দুটো উপাদানের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। প্রথমত ডানপন্থীদের কল্পিত মার্কিনী হস্ত ক্ষেপে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হওয়ার বিষয়টি যে অবাস্তব এবং আমেরিকা। বরং পাকিস্তানকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিতে আগ্রহী—এটা যতদিন প্রমাণিত না হয় ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। দ্বিতীয়ত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সােভিয়েট ইউনিয়নকে বাংলাদেশের প্রয়ােজনে না হলেও ভারতের কারণে উপমহাদেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে ভারতকে সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপন করা। প্রথমটির ক্ষেত্রে তখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয় যে, নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি আমেরিকার জনমতকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে পাকিস্তানের প্রতি সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখতে আগ্রহী । কেননা প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ছিল বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আরাে গুরুত্ব লাভ করে ইয়াহিয়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলার লক্ষ্যে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২১ ও ২২ জুন প্রকাশিত সংবাদ হতে বিশ্ববাসী জানতে পারে, “নিরস্ত্র মানুষ হত্যার কাজে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে জেনেও মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের অনুমতিক্রমে পাকিস্তানী দুটো জাহাজ ‘সুন্দরবন’ ও ‘পদ্মা’ সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে যথাক্রমে ৮ মে ও ২১ জুন পাকিস্ত েিনর উদ্দেশ্যে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে”।১১৬১

| ভারতের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতাদের যে অংশটি আমেরিকার মধ্যস্ততায় পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ তারা চরম হতাশায় পতিত

——-

১১৬১ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১।

হন। প্রথম সপ্তাহে অমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ভারত ও পাকিস্তান সফরে আসেন। প্রথমে ভারত সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দরা গান্ধীকে অনুরােধ করেন, ভারত যেন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য না করে। এর জবাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কিসিঞ্জারকে অনুরােধ করেন, আমেরিকা যেন পাকিস্তানকে বাধ্য করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতায়। উপনীত হতে । হেনরি কিসিঞ্জার এ ব্যাপারে অক্ষমতা ব্যক্ত করলে ইন্দিরা গান্ধীও জানিয়ে দেন যে, সেক্ষেত্রে শরণার্থী সমস্যার সমাধানকল্পে ভারতের পক্ষ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য বৃদ্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এভাবে বাহ্যত তৃতীয় পক্ষের বিষয় নিয়ে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে এক প্রকার কূটনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর কিসিঞ্জার পাকিস্তান সফরে যান এবং সেখান থেকে গােপনে চীন সফর করেন। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য ১৯৬২ সাল থেকে চলে আসা চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে তার সীমান্ত রক্ষার জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি আর কার্যকর থাকবে না বলে তিনি ঘােষণা প্রদান করেন।৬৯ চীনও তার বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ও আমেরিকার সহযােগিতায় আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য নিজ পক্ষে টানা এবং ভেটো ক্ষমতাধর আমেরিকার সমর্থন লাভের মাধ্যমে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ অর্জন করার এক কূটনৈতিক লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। এতদিন যে আমেরিকাকে চীন ‘কাগুজে বাঘ বলে অভিহিত করে এসেছে, বাংলাদেশ প্রশ্নে এখন তার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হয়। স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যমে দুভাগে। বিভক্ত পৃথিবীতে একদা চীন ও ভারতের উদ্যোগে পঞ্চশীলা নীতির ভিত্তিতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সত্তর দশকের শুরুতে বাংলাদেশ ইস্যুতে কিছুটা আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের প্রশ্নে তাদের উদ্ভাবিত নীতি হতে সরে এসে। পরস্পর বিরােধী প্রধান দুটো শক্তির সঙ্গে মিলিত হয় এবং দ্বিমেরুকরণের শেষ। বিন্দুতে উপনীত হওয়ার মাধ্যমে আর একটি বিশ্বযুদ্ধের আশংকা দেখা দেয় । বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে পরাশক্তিগুলাের নয়া মেরুকরণ ত্বরান্বিত

করে।১১৬৬

—-

১১৬২, ঐ, পৃ. ৪২। ৭. জয় বাংলা, ১১ সংখ্যা, ২৩ জুলাই, ১৯৭১।

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩। **Mizanur Rahman Shelly, Emergence of a new Nation in a MultiPolar World: Bangladesh (Dacca: University Press, 1979), p. 103. ১১৬৬ সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০।

৩৭৫

আমেরিকার ইচ্ছা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সহযােগিতা দানের বিপক্ষে এটা হচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে পরাশক্তিধর আমেরিকার এক ধরনের হুমকিবিশেষ। একই সঙ্গে খুব সম্ভব অপর পরাশক্তি সােভিয়েট ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যকার বিদ্যমান সহযােগিতামূলক সম্পর্ক যাতে আরাে অগ্রসর হয়ে কোনাে প্রকাশ্য ও সুনির্ধারিত কূটনৈতিক ও সামরিক আঁতাত গড়ে উঠতে না পারে সে লক্ষ্যে চীন-আমেরিকা-পাকিস্তান আঁতাত গড়ে তােলার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত । এখানে দৃশ্যত চীনকে পক্ষে টেনে তার সামরিক শক্তির সমাবেশ প্রতিবেশী ভারত সীমান্তে ঘটিয়ে জাতীয়ভাবে ভারতের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে অভ্যন্তর হতে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করা হতে ভারতকে বিরত রাখার একটা সূক্ষ্ম কূটচাল নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মাথায় ছিল। কেননা দিল্লি সফরকালে ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা না করার যে অনুরােধ কিসিঞ্জার করেছিলেন তা সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়। এই প্রত্যাখানজনিত অপমান তিনি ভুলতে পারেন নি কখনাে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সুত্র হতে জানা যায় ইন্দিরা গান্ধীকে ঐ জুটি খুব ঘৃণা করতেন, তাদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটত প্রায়শই তার সম্পর্কে কদর্য গালাগালি হতে।

সুতরাং সমস্যা সমাধানে ভারতের জন্য যে বিকল্পটি খােলা থাকে তা হলাে সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক চুক্তিতে উপনীত হওয়া। বাংলাদেশ সমস্যায় সম্পৃক্ত হওয়ার পর ভারতের পক্ষ হতে ঐ পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আরাে গভীর করার জন্য কি ধরনের প্রচেষ্টা চলছিল তখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের জানা ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশের কারণেই ভারতের নিরাপত্তাহীনতা ও কূটনৈতিক একাকীত্ব দেখা দেয় এবং সমস্যা সমাধানে সার্বিক মূল্যায়নে সােভিয়েট ইউনিয়নের সহযােগিতা অনিবার্য হয়ে ওঠে, সেহেতু বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঐ বিষয়ে খোঁজ নেয়ার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করেন। প্রায় একক সিদ্ধান্তে তিনি চরম গােপনীয়তা বজায় রেখে উল্লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।১৯৬৭

বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন, সােভিয়েট ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণহত্যার শুরু হতে সােভিয়েট ইউনিয়ন বিভিন্ন সময়ে তার উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করে এলেও জুন মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতির বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সন্দেহ পরিলক্ষিত হয়। কলকাতাস্থ

———

১১৬৭ ঐ, পৃ. ৩৭-৩৮।

সােভিয়েট কূটনৈতিক প্রতিনিধি ভি. আই, গুরগিয়ানভ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিনিধি মঈদুল হাসানের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খােলামেলাভাবে কতিপয় যুক্তিপূর্ণ মৌলিক বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি বিঘােষিত নীতির ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদী মুক্তিযুদ্ধ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে ভারতের সমস্যা এবং বাংলাদেশের নেতৃত্বের যােগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপনপূর্বক এক প্রকার নেতিবাচক মনােভাব ব্যক্ত করেন। তার এই তত্ত্ব ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন যে, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, সেখান থেকে বাঙালিদের ফিরে আসার আর কোনাে বিকল্প নেই, প্রাথমিক বিশৃঙ্খলাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব । মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক জাতীয় চরিত্র প্রদান করার জন্য সােভিয়েতঘেঁষা বাম দলগুলাের এমন কি চীনপন্থী বলে পরিচিত মওলানা ভাসানীর বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন দানের কথাটি উল্লেখ করা হয়। এর দ্বারা সােভিয়েট প্রতিনিধির নিকট প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা। হয় যে, এটি একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হলেও এতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ও উপাদান রয়েছে । এই যুদ্ধে সহযােগিতা দানের ক্ষেত্রে ভারতের আন্তরিকতারও অভাব নেই। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় ভারতের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রয়ােজন। সে নিরাপত্তা ভারত না পেলে সেখানে ১৯৬৯ সাল থেকে দক্ষিণপন্থীদের হ্রাসমান প্রভাব বিপরীতমুখী হওয়ার আশংকা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সমস্যার কারণে দক্ষিণপন্থীদের চাপে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে সেক্ষেত্রে মার্কিনি নীতির নিকট আত্মসমর্পণ করতে হতে পারে । এই বক্তব্যের তাৎপর্য সােভিয়েত প্রতিনিধি অনুধাবন করেন বলেই মনে হয়। যার ফলে তার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরে আরাে আলােচনার আগ্রহ ব্যক্ত করা হয়। এরপর প্রতি এক সপ্তাহের ব্যবধানে কমপক্ষে আরাে তিনটি আলােচনা হয় যার পরিসর খুব সম্ভব জুন মাস অতিক্রম করে। ভারতের পক্ষ থেকে নিশ্চয় সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যােগাযােগ করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের সক্রিয় উদ্যোগ সেই প্রচেষ্টাকে আরও যৌক্তিক, আরাে জোরালাে করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মােড় পরিবর্তনকারী এসব নির্ধারক উপাদানের ওপর ব্যাপক অনুসন্ধানের দাবি রাখে। এখানে আর একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে এ বিষয়ে অতি গােপনে একক বিবেচনাবােধের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হয়। অবশ্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরা তা বাস্তবায়নে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে তাকে সাহায্য করেন। তাজউদ্দীন আহমদ এমনিতেই

—————

১১৬৮ ঐ পৃ ৩৮

১১৬৯ মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯।

বিপন্ন অবস্থায় ছিলেন, তার সঙ্গে যদি এসব গােপন তৎপরতা প্রকাশ পেত তাহলে কী হতে পারতাে সেটা বুবাতে অসুবিধা হয় না। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য, তার প্রণীত পরিকল্পনাকে বৈধকরণের জন্য মন্ত্রিপরিষদের অনুমােদন প্রয়ােজন ছিল এটা যেমন ঠিক, তেমনি এর বাইরে নিজস্ব বিবেচনামাফিক কতিপয় বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাহায্যে ভিন্ন রকমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্ত বায়ন করতে হয়। এটা করতে হয় এ জন্য যে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতার দলকেন্দ্রীক চিন্তা ও প্রত্যাশাবিরােধী অনেক স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়, যেগুলাে প্রকাশ্য আলােচনা করে অনুমােদন করানাে সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে, মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ ঘন ঘন আলােচনায় মিলিত হত। করণীয় বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ একান্তে স্ববিবেচনায় কিছু সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করে রাখতেন যেগুলােকে ঐসব আলােচনায় অনুমােদন করিয়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর গ্রহণ করতেন। | অন্যদিকে পুঁজিবাদী ন্যাটো জোটের প্রতিপক্ষ সমাজতান্ত্রিক ব্লক তথা ওরশ জোটকে নেতৃত্বদানকারী সােভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রতি শুরু থেকেই তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল, তবে আমেরিকা যেমনটা এক প্রকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়, সােভিয়েট ইউনিয়ন ততটা প্রকাশ্যে বাগাড়ম্বর করে নি, তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল পরিশীলিত ও কূটনীতি-রীতিসিদ্ধ । পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। যে, এক্ষেত্রে সােভিয়েট ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নিছক সাদামাটা। এপ্রিলের ২ তারিখে সােভিয়েট নেতা নিকোলাই পদগনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৮ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং সােভিয়েট ইউনিয়ন সফরে গিয়ে সেখানকার সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তার পূর্ববর্তী মত ব্যক্তকরণপূর্বক সমস্যা। সমাধানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। পরবর্তী দিন একটি যৌথবিবৃতি প্রকাশিত হয়। খুব সম্ভব এরই ফলে ১০ জুন সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন (Alexy Kosygin) ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতিতে সােভিয়েট সরকারের গভীর উদ্বেগের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন “আমরা মনে করি পাকিস্তান সরকারের অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে এমন পরিবেশ সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া উচিত যার ফলে সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসে এবং উদ্বাস্তুরা সসম্মানে তাদের গৃহে

———

এইচ.টি. ইমাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪। | বস্তুত ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সােভিয়েট ইউনিয়ন ও পাকিস্তানের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল । ১৯৭০ সালে দুদেশের মধ্যে সম্পাদিত পাঁচশলা সহযােগিতা চুক্তির আওতায় আর্থিক ও কারিগরি সহযােগিতা অব্যাহত থাকে। সৈয়দ আনােয়ার হােসেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০।

প্রত্যাবর্তন করতে পারে।”১১৭২ এই বিবৃতির সঙ্গে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, উপমহাদেশে অবনতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক শক্তি প্রয়ােগের কারণে এবং সে সমস্যার সমাধানও করতে হবে পাকিস্তানকে। অর্থাৎ বিষয়টির রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয়। কূটনৈতিক দিক থেকে সােভিয়েট ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে। পাকিস্তান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমর্থন না করা। তখনকার বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এর অর্থ দাঁড়ায় সােভিয়েট ইউনিয়ন প্রয়ােজনে তার করণীয় নির্ধারণে প্রস্তুত। কিন্তু এটা তখন পর্যন্ত স্পষ্ট ছিল না যে, এই পরাশক্তি প্রয়ােজনে সরাসরি শক্তি প্রয়ােগে এগিয়ে আসবে কি-না। সােভিয়েট ইউনিয়ন প্রভাবিত কয়েকটি পূর্ব ইউরােপীয় দেশ এর অল্পকালের মধ্যেই বাংলাদেশের বিষয়াবলিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের দাবি জানায়। এসব লক্ষণ থেকে অনুমিত। হয় যে, সােভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশ ইস্যুতে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। | এই বৈশ্বিক পটভূমিতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ইস্যুটি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ফলে আমেরিকাসহ পাকিস্তানের পুরনাে বন্ধু-সমর্থক রাষ্ট্রগুলােও অভ্যন্তরীণ দিক। থেকে অব্যাহতভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন ও প্রয়ােজনীয় সাহায্য-সহযােগিতা দান। করার ক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪ টি উপায়ে বাংলাদেশ বিরােধিতায় অগ্রসর হয় বলে কোনাে কোনাে বিশ্লেষক মনে করেন। এগুলাে হলাে:৯৭৪

জুলাইয়ের শেষার্ধে ও আগস্টের প্রথম দিকে মার্কিন সরকারের বাংলাদেশ বিরুদ্ধতার কার্যক্রম মােটামুটি চারটি স্তরে অনুসৃত হতে দেখা যায়ঃ(১) গণহত্যার শুরু থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র, গােলাবারুদ ও যন্ত্রাংশের যে সরবরাহ শুরু

————–

১১৭২ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫। ১১৭৩ মার্শাল টিটো ইন্দিরা গান্ধীর নিকট চিঠি লিখে জানান যে, সমস্যা সমাধানে তিনি মধ্যস্ততা করতে রাজি আছেন। ৯.৭.’৭১ তারিখের জয় বাংলা-এর ৯ম সংখ্যায় দেখা যায় যে, বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী টোডর জীপকভ বলেন,“বাংলাদেশ সমস্যা এখন আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক উদ্যোগে রাজনৈতিক উপায়েই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।” হাঙ্গেরীর সরকারের পক্ষ থেকেও মােটামুটি ঐ ধরনের মন্তব্য করা হয়। সেখানকার প্রধানমন্ত্রী মি: জেনাে ফক বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারীর দুঃখ দুর্দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানান। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত ভারতের কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দীন আলী আহম্মদকে বলেন যে, বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি পাকিস্তান সরকাকে চাপ দেবেন। জয় বাংলা, ৭ম সংখ্যা, ২৫ জুন, ১৯৭১। ১৯৭৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬২-৬৩।

হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অস্বীকৃতি এবং মার্কিনি জনপ্রতিনিধি ও জনমতের। তীব্র বিরােধিতা সত্ত্বেও এক অদ্ভূত যুক্তিতে তা অব্যাহত থাকে। (২) মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য প্রদান থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে ভারতের উপর যে বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি করা হয়, তারই অংশ হিসাবে ১৭ জুলাই কিসিঞ্জার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের মুখে ভারতকে রক্ষা করার অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। (৩) মুক্তিযােদ্ধাদের সীমান্ত পারাপার এবং দেশের অভ্যন্তরে তাদের গতিবিধি ও তৎপরতার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তােলার ক্ষেত্রেও আমেরিকার উৎসাহের কোন ঘাটতি ছিল না। পূর্ব বাংলার সীমান্তে সাহায্য ও পুণর্বাসন বিশেষজ্ঞ হিসেরে ১৫৬ জন পর্যবেক্ষক মােতায়েন করার ব্যাপরে জাতিসংঘকে সম্মত করানাের কাজ আমেরিকার ‘আগ্রহ ও ব্যয়ভার গ্রহণে সম্মতির ফলেই সম্ভব হয়। এমন কি মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতারােধ করার জন্য এমন কিছু কিছু কাজ উদ্যোগের আভাস পাওয়া যায়, যাতে আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূচনাপর্বের স্মৃতি জাগ্রত হয়। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি সৈন্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সহায়তা চলছিল এক রকম প্রকাশ্যেই ।.. (৪প্রবাসী সরকারের একাংশের সাথে যােগাযােগ প্রচেষ্টা করে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভিতর থেকে বিভক্ত ও লক্ষ্যচ্যুত করার মার্কিনি কার্যক্রম সম্ভবতঃ এ সময় অথবা এর কিছু আগে থেকে শুরু হয়।

বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পর্যায়েও পত্রপত্রিকার সমালােচনা, জনবিক্ষোভ এবং কোনাে কোনাে প্রভাবশালী সিনেট সদস্যের সমালােচনা উপেক্ষা করে পাকিস্তানকে সাহায্য দানের নীতি অব্যাহত রাখে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের প্রত্যয় জন্মে যে, পাকিস্তানকে সাহায্য দান বন্ধ করলে বরং ইয়াহিয়ার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে তাদের কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের যােগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা সত্ত্বেও শুধুমাত্র চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক স্থাপনে ইয়াহিয়ার অবদানের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।” জুলাই মাসে মার্কিন-চীন-পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলােকে নিয়ে ন্যাটো জোটের বাইরে আর একটি বলয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমেরিকার নেতৃত্বে শক্তির এ ধরনের পুণর্বিন্যাস প্রচেষ্টার ফলে সঙ্গত কারণেই ভারতকে এমন একটি পরাশক্তির দিকে ধাবিত হতে হয় যেটা আমেরিকার বিপরীত মেরুর পরাশক্তি এবং উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে ভারতের জন্য সহায়ক। এই প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা গান্ধী ডি.পি, ধরকে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের দায়িত্ব প্রদান করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৬৯ সালের প্রথমভাগে উসরী নদী বরাবর চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর সােভিয়েট ইউনিয়ন ভারতসহ কয়েকটি এশীয় দেশের

—————-

১১৭৫ আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলাে, ৩ ডিসেম্বর,২০০৩।

৩৮০

সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল । ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাসীন হয়ে। পেশােয়ারের অদূরে বাটাভের মার্কিন ঘাটির চুক্তি নবায়ন না করায় মৈত্রী চুক্তির ব্যাপারে সােভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রহ কমে যায়। সে সময় ভারতের পক্ষে সােভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে আলােচনায় ডি.পি. ধর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে জুলাই মাসে পাকিস্তানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে অগ্রসর হয় তখন ভারতীয় মন্ত্রিসভার ‘রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটি’ দু’ বছরের পুরাতন ঐ অসমাপ্ত আলােচনার সুত্র ধরে সােভিয়েট ইউনয়নের সঙ্গে একটি মৈত্রী চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।” নতুন এই উদ্যোগে আবার ডি.পি, ধরকেই দায়িত্ব প্রদান করা হয়। একই সঙ্গে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হতে তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে নীতি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করেন।

| সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের এসব কূটনৈতিক আলােচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সমস্যা সমাধানে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন অত্যাবশ্যক। সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধকে আস্ত র্জাতিক পরিমণ্ডলে সকল দলের যুদ্ধ এবং এতে কমিউনিস্টদেরও অংশগ্রহণ আছে প্রতিপন্ন করার জন্য মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে নীতিগতভাবে সম্মত বলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানানাে হয়। | সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির অনিবার্যতা উপলব্ধি করে ভারতীয় কটনীতিকরা মস্কোর সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনে সচেষ্ট হন। প্রবীণ কূটনীতিক ডি.পি, ধরকে মস্কো প্রেরণ করা হয়। এ ছাড়াও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব টি.এন. কল, ডি.পি, ধর এবং দু জন প্রবীণ সামরিক গােয়েন্দা অফিসার ভারতে নিয়ােজিত সােভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত নিকোলাই পেগভের সঙ্গে গােপনে দেখা করেন। এ সময় বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও দিল্লিতে যান। অকস্মাৎ সােভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর ৮ আগস্ট দিল্লি আসার ঘােষণা প্রদান করা হয়। এমতাবস্থায় কূটনৈতিক এসব তৎপরতায় একটা চূড়ান্ত সংঘাত আসন্ন বলে কোনাে কোনাে মহলের ধারণা জন্মে।” আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহলকে হতবাক করে দিয়ে ৯ আগস্ট নতুন দিল্লিতে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ২০ বছর মেয়াদী সহযােগিতামূলক একটি মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়-শরণ সিং ও আঁদ্রে গ্রেমিকো

————–

১১৭৬ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ, ৬৭-৬৮। ১৯৭৭ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯-১১০। ১৯৮, দি টাইমস, ৭ আগস্ট, ১৯৭১, পিটার হ্যাজেলহাস্ট এর প্রতিবেদন।

চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১২ টি অনুচ্ছেদযুক্ত এই চুক্তিতে পারস্পরিক স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, একে অপরের ভূখণ্ডের অখণ্ডত্ত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও ঐগুলাে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।১১৭৯ ৮ ও ৯ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত হয় যে, চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্র দুটোর যে কোনটি অন্য কোনাে শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে অপরটি তার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এর ফলে একদিকে বাংলাদেশকে সহযােগিতা করার ক্ষেত্রে ভারতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রশ্নে সম্ভাব্য ভারতপাকিস্তান যুদ্ধে চীনকে নিস্ক্রিয় রাখার ব্যবস্থাও এক প্রকার নিশ্চিত হয়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের উচ্চতম মহলে দীর্ঘ আলােচনার পর এ চুক্তিটি সম্পাদিত হলেও অনেকের নিকট তা ছিল এক ধরনের চমকবিশেষ। কারণ। মন্ত্রিপরিষদের প্রবীণ রাজনীতি বিষয়ক কমিটির গুটি কয়েক সদস্য ব্যতীত অন্যান্যরা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয়ে জানতেন না।” আমেরিকা চুক্তিটি সম্পর্কে প্রথম অবহিত হয় সংবাদ পত্রের মাধ্যমে। নিক্সন। প্রশাসনের নিকট এটা Bombshell’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে কিসিঞ্জার মূল্যায়ন করে লিখেন:১৮৩

Mrs.Gandhi was resisting a tide of public opinion in favour of a showdown. The Soviets were allegedly fearful that she might be forced againest her inclinations to recognize Bangladesh and thus trigger a Pakistani declaration of war. By signing the treaty, so the analysis went, the USSR gave Mrs Gandhi a diplomatic success that would help her maintain her policy of moderation and restraint, the Soviet Union could rest assured that Indian teritory would not be used for hostile bases.

১১৭৯ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৬৩-৬৫ এবং J.N. Dixit, Liberation and Beyond: IndoBangladesh Relations (Dhaka: The University Press Limited, 1999), pp. 289-293. চুক্তিটির পুরাে নাম Treaty of Peace, Friendship and Cooperation between the Goverment of India and the Government of the Union of Soviet Socalist Republics. 3 . Henry Kissinger, op.cit., p. 866.

মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭।

Henry Kissinger, op.cit., p. 866. ১১৮৩ Ibid., p. 867.

১৯৮১ মঈনুল হ

অন্যদিকে পাকিস্তান চুক্তিটির মর্ম যথার্থভাবেই অনুধাবন করে। এ সম্পর্কে ১২ আগস্ট পাকিস্তান টাইমস লিখে:১১৮৪

The treaty amounts to be delibarate move to create a situation in which India may feel free to attack Pakistan with the assurance that Soviet commitment to aid India would provide

a deterent to Chinese intervention on our behalf. সব মিলিয়ে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমূল পরিবর্তনকারী প্রভাব বিস্তার করে। কেননা এতদিন কূটনৈতিক দিক থেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভারত মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযােগিতা করে আসছিল । চুক্তিটি সম্পাদিত হওয়ার পর সােভিয়েত ইউনিয়নের সহযােগিতা দানের বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করে । কেবল চীনকে নিরপেক্ষ রাখার জন্যই এটা কার্যকর ছিল না, উপরন্তু জাতিসংঘে প্রয়ােজনে দেশটির ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়, যা কূটনৈতিক দিক থেকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা

ক. বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড বস্তুত ভারতের সহযােগিতা গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার গঠনের উদ্যোগটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের যাত্রা শুরু হয়। একই সময়ে কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীকে বাংলাদেশ পক্ষে যােগদানে উদ্বুদ্ধকণের মধ্য দিয়ে এর সফল সূত্রপাত ঘটান তাজউদ্দীন আহমদ স্বয়ং। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের একেবারে সূচনালগ্নে হােসেন আলীর পক্ষে নানা কারণে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল কঠিন কাজ। এরূপ দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় এক পর্যায়ে তার স্ত্রী তাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন এই বলে যে, পাকিস্তানের অধীনে দাসত্ব করার পরিবর্তে তারা প্রয়ােজনে অনাহারকে বেছে নেবেন। বস্তুত ১৮ এপ্রিল কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশেনে পক্ষ ত্যাগের যে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হয় তাতে হােসেন আলীর স্ত্রী অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় উচ্চারণ করেন:১১৮৫

—–

১১৮৪ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৫।

Arun Bhattacharrjee, Dateline Mujibnagar (Delhi: Vikash Publishing House Pvt. Ltd, 1972), p. 24.

I do not recognise any authority… I have watched helplessly…I have watched helplessly and silently…I have wept helplessly and silently. The Pakistanis had been keeping us under their feet…. They were treating us like dogs, like rubbish…we had no self respect. I am not going to listen to anybody…I declare

my country as Independent. সরকার গঠনের পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড.এ.আর, মল্লিক, আবদুস সামাদ আজাদ, এম.আর. সিদ্দিকী এবং অন্যান্যদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক মিশনে নিয়ােগদান করলে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান ও অন্যত্র বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য বিষয় বলে উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিভিন্ন স্তরের প্রবাসী বাঙালিদের প্রতিও পুনঃপুন আহ্বান জানান, তারা যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যােগদান, জনমত গঠন, অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করেন। ১৯৭১ সালের ২৪ মে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যৌথ স্বাক্ষরিত একটি পত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের সরকার গঠনের বিষয়ে অবহিত করা হয়।১১৭৬

সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের পর আবু সাঈদ চৌধুরীকে ২১ এপ্রিল বহিবশ্ব (বিভিন্ন দেশ ও আর্ন্তজাতিক সংগঠন) ও জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়ােগ করা হয়। তবে নিয়ােগ প্রাপ্তির পূর্ব থেকেই তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লন্ডনের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ২৪ এপ্রিল বিলেতে অবস্থানরত বাঙালিরা কভেন্টি শহরে লুলু বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে একটি সম্মেলনে মিলিত হলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সকল দল ও মতের প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। ফলে ‘Action Committee for the People’s Republic of Bangladesh in the U.K’ নামক একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ৫ সদস্য বিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা ছিলেন: আজিজুল হক ভূঁইয়া, কবীর চৌধুরী, মনােয়ার হােসেন, শেখ আবদুল মান্নান এবং শামসুর রহমান। যুক্তরাজ্যের অন্যান্য এলাকাতেও অনুরূপ কমিটি গঠন করে আবু সাঈদ চৌধুরীর।

———-

১১৮৬ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০। ১১৮৭ ঐ, পৃ. ১৬৪। ১১৮৮ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ৩৬।

সঙ্গে পরামর্শক্রমে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানানাে হয়।১১৮৯ আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন ছাড়াও ইউরােপের অপরাপর দেশ, আমেরিকা ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। যুদ্ধ সূচনার অব্যবহিত পরে সরকার ঘােষণার সংবাদ তাদের জানা না থাকলেও লন্ডনের প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন উপায়ে অবহিত হন যে, সংগঠিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে যাচ্ছে। লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে দ্বিতীয় সচিব (অর্থনৈতিক সেক্রেটারি) মহিউদ্দিন আহমদ প্রমুখ আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎপূর্বক বাংলাদেশ। সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে যথাসময়ে সে আহ্বান পাঠানাে হবে বলে তাদেরকে তিনি আশ্বস্ত করেন। | ওদিকে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী ২৪ মে। নিউইয়র্ক পৌছেন। ২৮ মে সেখানে কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি। বলেন অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে কোনাে প্রকার সমঝােতায় পৌছা সম্ভব নয়। তার ভাষায় বাংলাদেশ এখন বাস্তব ঘটনা ।”৯২ ২৯ মে আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে ‘কাউন্সিল ফর রিলিজিয়ন এ্যান্ড পিসের জেনারেল সেক্রেটারির অফিসে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে দেশটিকে স্বীকৃতি প্রদান না করা পর্যন্ত এতদঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।৯৯৩ | প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার একদিকে যেমন সামরিক শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাভূত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে, অন্যদিকে তেমনি কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পাকিস্তানের সকল ষড়যন্ত্র মােকাবিলা ও বিশ্বব্যাপী। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। যুদ্ধকালে কোনাে রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে বাংলাদেশ সরকারের এই কূটনৈতিক তৎপরতা সহজসাধ্য ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক রাষ্ট্র ভারত এক্ষেত্রে যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়, বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা অনেকটা তার সহায়ক হিসেবে পরিচালিত হয়। তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতায় কূটনৈতিক এই যুদ্ধ সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে কোনাে অংশেই সহজসাধ্য ছিল না; বরং বলা যেতে পারে তা ছিল বহুমাত্রিক ও জটিল।

——

১১৮৯ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০-৫১। ১৯৯০, এ, পৃ. ৪০। ১৯. ঐ, পৃ. ৪১। ১৯৯৪, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭। ১১৯৩, ঐ, পৃ. ২২১।

৩৮৫

তবে পাকিস্তান বাহিনীর নজীরবিহীন গণহত্যা ও বর্বরতা এবং পূর্ব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সাধারণভাবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু তৎকালীন বিশ কূটনীতির রীতি ভঙ্গ করে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত প্রায় কোনাে দেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন এগিয়ে আসেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে মস্কোতে বিশ্বশান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যােগদানের জন্য প্রেরণ করা হয় আবদুস সামাদ আজাদকে। নিয়ম মাফিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা খাবার টেবিলে নিজ নিজ দেশের পতাকা রাখতে পারেন। আবদুস সামাদ আজাদ তা করতে চাইলে স্বাগতিক দেশটি বাধাদান করে। মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ভারতের অভ্যন্তরে বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভ্রান্ত মনােভাব দূর করে জনমত গঠনে সহায়ক হয়। অনুরূপভাবে পাকিস্তান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের হস্তক্ষেপ বলে যে অপপ্রচার চালায় তার মােকাবিলা করে বিশ্ববিবেককে বাংলাদেশের পক্ষে আনতে তা খুবই কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এ.আর, মল্লিক, এম আর খান, রেহমান সােবহান, আবদুস সামাদ আজাদ ও অন্যান্যরা ভারতবর্ষ, ইউরােপ, আমেরিকা, মধ্য এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। বাম রাজনীতিবিদদের একটি গ্রুপ মস্কো সফরে যান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা দেয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতের চেষ্টা করেন। ফলে কেবল মস্কোই নয়, পূর্ব ইউরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ক্রমশ ইতিবাচক মনােভাব পােষণ করতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে জড়িত সকল গ্রুপ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। প্রতিনিধিরা সভা-সমাবেশ-সেমিনার, প্রকাশনা প্রভৃতির মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমর্থন আদায় এবং অর্থ, অস্ত্র ও প্রয়ােজনীয় অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তারা পাকিস্তান কারাগারে বন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিধানেরও চেষ্টা চালান। | নামমাত্র ভাড়ায় পেমব্রিজ গার্ডেন ওয়েস্ট এন্ডের একটি হােটেলে বাংলাদেশ মিশনের জন্য বাড়ি সংগ্রহ করা হয়। এ বিষয়ে জনৈক জহুরুল ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে যােগাযােগ করে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ব্যয় নির্বাহের আগ্রহ প্রকাশ করলে মিশন খােলার কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। ওদিকে ৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে লন্ডনের পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব

১১৯৪, দলিলপত্র, ১৫শ থণ্ড, পৃ. ১৪২। ১১৯৫ আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮।

মহিউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দেয়ার পর লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন খােলার প্রায় সকল উপাদানের সমাবেশ ঘটে। ২৪ আগস্ট সেখানে বাংলাদেশ মিশন খােলা হয়। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ না করলেও গণতন্ত্রের পীঠস্থান লন্ডন কলকাতার পরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সরকারের অনেক সংস্থা নানাভাবে সহযােগিতা প্রদান করে।

ইংল্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রচারণার জন্য পাকিস্তানপন্থীরা মুক্তি নামক একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশ করে। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তান পক্ষের লােকেরা প্রচার করে যে, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে একটা আপােষ-রফা করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রচারণাটি প্রবাসীদের মনে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। এমতাবস্থায় ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট থেকে নিশ্চিতভাবে জেনেছেন, বাংলাদেশ সরকার কোনাে প্রকার আপােষরফা করবে না। সুতরাং বিভ্রান্ত হওয়ার কোনাে কারণ নেই। একইভাবে তিনি বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান। | সেপ্টেম্বর মাসে বিচিাপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলাে সফরে বের হন। এই সফরে বাংলাদেশের পক্ষে ব্যাপক সহানুভূতি লক্ষ করা যায়। এক পর্যায়ে সুইডেনের অধিবাসী বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুণার মিরডাল বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির সভাপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন। তার মাধ্যমে সুইডেনের প্রশাসকদের নিকট থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। জাতিসংঘের আসন্ন বার্ষিক অধিবেশনকে সামনে রেখে কূটনৈতিক এই সফর ছিল। গুরত্বপূর্ণ।৯৯৯ জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সরকার আবু সাঈদ চৌধুরীকে নির্দেশ প্রদান করলে তিনি লন্ডন হয়ে নিউইয়র্কে গমন করেন।

শুরু থেকেই আমেরিকায় অবস্থিত পাকিস্তান কূটনৈতিক মিশন ও বিভন্ন পেশায় নিয়ােজিত বাঙালিরা বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রতি নজর রাখেন। ২৫-২৬ মার্চের ঘটনার সংবাদ শুনে নিউইয়র্কের পাকিস্তান দূতাবাসের (বাঙালি) ভাইস কনসাল মাহমুদ আলী বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। দূতাবাসের

——–

১১৯৬ ঐ, পৃ. ৯৯-১০০। ১১৯৭ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০। ১১৯৮ ঐ, প, ১০২।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলােতে সফর সম্পর্কিত বিষয়ে আরাে জানার জন্য দেখুন, আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২-১২০ পৃ.।

বাঙালি একাউন্টট্যান্ট গউসউদ্দিন আহমদও সেখানকার বাঙালি সম্প্রদায় কর্তৃক আয়ােজিত সমাবেশ ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠে। পাকিস্তান কূটনৈতিক মিশনের উপরিউক্ত দু জন সদস্য পক্ষত্যাগ করে জনমত গঠনের জন্য। প্রকাশ্যভাবে কাজে নামলেও অন্যান্যরা কৌশলগত কারণে তা করেন নি। ইতােমধ্যে প্রবাসী বাঙালিদের কোনাে কোনাে ব্যক্তি কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানাের আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।২০০০ ততদিনে তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশক্রমে রেহমান সােবহান ‘মােহনলাল২০ ছদ্ম নামে আমেরিকায় পৌছেন। আবু সাঈদ চৌধুরীও নিউইয়র্কে গমন করেন। অনতিবিলম্বে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশন খােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি কূটনীতিক আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ পক্ষে যােগদান করেন।১২০২ এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত স্থানে বাংলাদেশ মিশনের কাজ-কর্মে গতিশীলতা আসে এবং ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারের পথ প্রশস্ত হয়। মুহিত ছাড়াও পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস থেকে ডিফেক্ট করে আবুল ফাতাহ, খুররম খান পন্নী, এস,এ, করিম ও অন্যান্যরা বাংলাদেশ সরকারের। কূটনৈতিক তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ততদিনে ড.এ.আর। মল্লিক, এম.আর সিদ্দিকী, ডা. আসহাব-উল হক, সিরাজুল হক, ফকির। সাহাবুদ্দিন, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. মফিজ চৌধুরী, ফনীভূষণ মজুমদার প্রমুখ। বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার কাজ চালানাের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে গমন করেন। তারা বাংলাদেশ ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বহু দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেন। | আবদুস সামাদ আজাদ নির্বাচিত প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলনে (১৩-১৬ মে) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারটি তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকার আবদুস সামাদকে প্রেরণ করে। তার সফরসঙ্গি হন সাংবাদিক ওয়ালী আশরাফ, ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী ও ড.সারওয়ার আলী। ঐ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা

———

১২০০ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০। ১২০৯. অশােক মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯১। ১২০, আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ১১৮।

প্রতিনিধিদের নিকট পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলার বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করা ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই।২০৩ এর ফলে ঐ সম্মেলনটিতে উপস্থিত ৫৫ টি দেশের ১২৫ জন সদস্য একটি প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন, যাতে বলা হয় সিয়াটো, সেন্টো বা অন্য কোনাে সামরিক জোট যেন পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে গণহত্যার জন্য অস্ত্র সরবরাহ না করে।১২০৪ | আবু সাঈদ চৌধুরী যেমন ইউরােপ ও আমেরিকায় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে প্রধান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড.এ.আর, মল্লিক প্রথমে ভারতে এবং পরে আমেরিকায় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি চট্টগ্রামে প্রতিরােধযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ.আর. মল্লিক অন্যান্যদের ন্যায় রামগড় ত্যাগ করে ভারতের আগরতলায় চলে যান। বিভিন্ন কাজে সহযােগিতা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাকে আগরতলা থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা মালেক উকিলকে প্রেরণ করেন।১২০৫ তিনি কলকাতায় গিয়ে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক প্রভৃতি পেশার অগ্রসর মানুষদের নিয়ে গড়ে তােলেন “লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া’ নামক একটি সংগঠন। সংগঠনটির সভাপতি নিযুক্ত হন এ.আর, মল্লিক নিজে এবং সম্পাদক হন জহির রায়হান (১৯৩৫-১৯৭২)। অন্যান্য সদস্যরা হলেন সৈয়দ আলী আহসান, খান সারওয়ার মুরশিদ, ফয়েজ আহমদ, ব্ৰজেন দাস, কামরুল হাসান ও অন্যান্যরা। এর সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত সহায়ক সমিতির সংযােগ ঘটে। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার জন্য দুই বাংলার বুদ্ধিজীবীদের একটা মিলিত কর্মকাণ্ড পরিচালনার ভিত রচিত হয়ে যায়। অল্পকাল পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙ্গা ভবনে এ.আর, মল্লিকের সভাপতিত্বে সকল পর্যায়ের কয়েক হাজার শিক্ষকের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই গঠিত হয় বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি। তিনি এই সংগঠনটির সভাপতি নিযুক্ত হন, সহসভাপতি ও

——

১২০৩ দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৬৫। ১২০৮, ঐ, পৃ. ২১৬।

| এ.আর.মল্লিক, আমার জীবন কথা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম (ঢাকা, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৫), পৃ. ৭৫। ১২০৫ ঐ, পৃ. ৭৬।

সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে কামরুজ্জামান এম.এন.এ. ও ড. আনিসুজ্জামান।১২০৭ | মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের এভাবে সংগঠিত করার এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মল্লিককে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কূটনৈতিক সফরে। প্রেরণ করেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থিত বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য প্রায় ৩০ টি গণসংযােগ। করেন।২০৮ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে এলাহাবাদ, পাটনা, কেরালা, মাদ্রাজ, দিল্লি, পুনা, বােম্বে, আলীগড়, অমৃতসর, বর্ধমান, জয়পুর, লখনৌ প্রভৃতি। ভারতের মুক্তিযুদ্ধ বিরােধিতাকারী জনগােষ্ঠী বা ব্যক্তিদের প্রকৃত বিষয়টি বুঝিয়ে বাংলাদেশ পক্ষে সমর্থন আদায় করাই ছিল তার এই মিশনের প্রধান লক্ষ্য। তা করতে গিয়ে অনেক জায়গাতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পান, আবার কোথাও বিরােধীদের মােকাবিলা করতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা চালানাের ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বেশ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐ সংগঠনটি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসভা কিংবা গণসংযােগের আয়ােজন করে দেয়। প্রদত্ত ভাষণের হিন্দি, উর্দু কিংবা আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদেরও ব্যবস্থা করে। তদুপরি বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি মুক্তিসংগ্রামের উপর ভিত্তি করে বেশ কিছুসংখ্যক প্রকাশনার কাজ করে যা পূর্ব। বাংলার ঐতিহাসিক সংগ্রামের যথার্থতা প্রমাণের সহায়ক হয়।২০৯ | কুটনেতিক ফ্রন্টে যেসব প্রতিনিধি কাজ করেন তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত রিপাের্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার সাংস্কৃতিক দল প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কালচারাল টুপ’ নামে পরিচিত এই গ্রুপটি বােম্বে, পুনা, গােয়া প্রভৃতি স্থান। সফর করে।২১০ এ ধরনের সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা ভারত এবং এর বাইরে জনমত গঠনে যথেষ্ট সহায়ক হয়। ভারতের বড় বড় শহর ও বিশ্ববিদ্যায়ের প্রায় সর্বত্রই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে বিপুল সমর্থন লক্ষ করা যায়। পাটনা, দিল্লি, বােম্বে, লক্ষৌ, এলাহাবাদ প্রভৃতি শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশগুলােতে ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি তাদের প্রবল আগ্রহেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পাটনার।

——-

১২০৭ ঐ, পৃ.৭৭। ১২০৮ ঐ, পৃ. ৭৮। ১২০৯ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক সমিতি। অনেকগুলাে প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ এর। ন্যায্যতার বিষয়টি তুলে ধরে । দেখুন, A Nation is Born, pp. 4-5. ১২১০ ঐ, পৃ. ২৮২।

৩৯০

সমাবেশটি জনগণের উপস্থিতি ও আগ্রহের দিক থেকে ছিল স্মরণীয়। এখানে ভারতের বিরােধীদলের নেতা রাজনারায়ণ উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। বােম্বের সভায় উপস্থিত হন মহারাষ্ট্রের নবাব ইয়ার। জং।

| তবে ভারতের বিশেষত উর্দু-ভাষী মুসলিম প্রধান এলাকাগুলােতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বিরূপ মনােভাব লক্ষ করা যায়। লঙ্গেী ও আলীগড়ের পরিবেশ ছিল কিছুটা বৈরী প্রকৃতির। এখানকার একটি সমাবেশে এ.আর, মল্লিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার ব্যাপক বৈষম্যের খতিয়ান এবং নির্বিচারে নিরীহ মানুষদের হত্যা ও যাবতীয় নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন। এতে তাদের বিরুদ্ধ মনােভাব কিছুটা দূরীভুত হয়।

জয়প্রকাশ নারায়ণ গান্ধী পিস ফাউণ্ডেশন এর সহযােগিতায় ১৮ হতে ২০ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়ােজন করেন। এতে ২৫ টি দেশের প্রায় ১৬০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হন। সম্মেলনটির নাম দেয়া হয় “মিট অন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ.আর, মল্লিককে উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরােধ করেন। উপস্থিতদের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। সম্মেলন শেষে নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বি.পি, টগরালার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। টগরালা তখন ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। তিনি তার অধীনস্থ কিছুসংখ্যক গােৰ্খা সৈন্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সহযােগিতা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি তাৎক্ষণিকভাবে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সহযােগিতার সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। পরে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে জানালে তিনি বলেন যে, যেহেতু নেপালের ঐ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন, তাই ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়া তার। কোনাে সাহায্য গ্রহণ করলে তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভাল নাও হতে পারে। যাহােক ভারতে এ.আর. মল্লিকের গণসংযােগ কর্মকাণ্ড ও কূটনৈতিক তৎপরতা বেশ সফল হয়। তিনি একজন প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হওয়ার সুবাদে ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষকসহকর্মী ও বন্ধুজন পান, যারা তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে বেশ সহায়ক ভূমিকা। পালন করেন।১২১১

—–

১২১১ ভারতে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে এ.আর. মল্লিকের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, এ.আর মল্লিক, প্রাগুক্ত, পৃ.৭৫-১০৩।

ভারতের সর্বাত্মক সহযােগিতা লাভের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত ঘটনা সেখানকার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক মহলকে অবহিত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। সে লক্ষ্যে একদিকে উক্ত সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল এবং এ.আর, মল্লিককে প্রেরণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে মে মাসের শেষের দিকে ফনিভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি সংসদীয় দল প্রেরিত হয় দিল্লিতে। অন্য দু জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ও বেগম নূরজাহান মুরশেদ। তাদের কাজ নির্ধারিত হয় দিল্লি গিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নিকট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যথার্থতা তুলে ধরা।১২১২ সেখানে পৌছে প্রতিনিধি দলের নেতা ফনিভূষণ মজুমদার বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের পক্ষে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের সঙ্গে আলােচনা করা সম্ভব নয়। ৬ দফা দাবিকে অস্বীকার করে এবং গণহত্যা চালিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সে পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।* ঐ প্রতিনিধি দলটি ৩১ মে ভারতের লােকসভা ও রাজ্যসভায় পাকিস্তান শাসনাধীনে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য, নির্যাতন এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যাসহ মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ভারতের কয়েকটি প্রতিবেশী দেশেও বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য প্রতিনিধি দল প্রেরিত হয়। ফকির শাহাবুদ্দিনকে শ্রীলংকায় এবং জ্যোতিপাল মহাথেরােকে প্রেরণ করা হয় থাইল্যাণ্ডে। আবদুল মালেক উকিল, সুবােধ মজুমদার ও আবদুল মমিনকে পাঠানাে হয় ভুটান ও নেপালে। | আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিনিধি দলের সদস্যদের ডেকে অনুধাবন করানাের চেষ্টা করেন যে, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলাের সমর্থন লাভ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারতের ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের জন্য এটা ছিল খুব জরুরি।২১৫ আর একটি প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে মােল্লা জালালুদ্দিন ও ড. মাহমুদ শাহ কোরেশী সিরিয়া ও লেবানন সফর করেন। কিন্তু মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত

———

১২১২, এ.আর মল্লিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১১। ১২১৩, ঐ, পৃ. ২১৪। ১২১৪. মুহাম্মদ নুরুল কাদির, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩০। ১২১৫ ঐ, পৃ. ১৩১।

পাকিস্তানকেই সমর্থন দিয়ে যায়। উল্লেখ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত ও সিনেটের বিরােধিতার মুখে নিক্সন ও কিসিঞ্জার গােপনে তৃতীয় দেশ ইরান ও জর্ডানের মাধ্যমে পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য অব্যাহত রাখেন। ১২১৬ ভারতে ব্যাপক ও সফল গণসংযােগ ও কূটনেতিক তৎপরতা শেষ হতে না হতেই ড. মল্লিককে নিউইয়র্কে পাঠানাে হয় জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনের পূর্বে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব দরবারের জনমত গড়ে তােলার জন্য। সেখানে তিনি প্রথমে জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেন। পরে আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গ রাজ্যে মাসাধিককাল ধরে। বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী বাঙালি ও মার্কিন জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য গণসংযােগ করেন। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য তিনি নিউইয়র্ক, কলম্বিয়া, পেনসিলভানিয়া, স্ট্যানফোর্ড, বার্কলি, লংবীচ, শিকাগাে, বাফেলাে, হার্ভাড, নর্থ ক্যারেলিনা, বােস্টন, ইয়েল, টেক্সাস ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন। আমেরিকায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার সময় কখনাে কখনাে পাকিস্তানপন্থীদের বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সরকারের সে প্রচেষ্টায় বেশ কিছুসংখ্যক ভিন্ন মতাবলম্বী বাঙালি যুক্ত হয়। এমন কি ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে ইতিহাসে সর্বাধিকসংখ্যক বাঙালি প্রতিনিধি প্রেরণ করে পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রেরিত এই অধিবেশনে একজন সরকারি কর্মকর্তাসহ মােট ৬ জন বাঙালি ছিলেন। এরা হলেন ইউসুফ জে আহমদ, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান, এ.টি, সাদী, ড. ফাতেমা সাদেক এবং মিসেস রাজিয়া ফয়েজ।১২১৯ | টেক্সাসে ড. ফাতেমা ও অন্যান্য কয়েকজন বাঙালি বাংলাদেশবিরােধী প্রচারে লিপ্ত ছিলেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের মনে বিভ্রান্তি, হতাশা, ক্ষোভ সঞ্চিত হতে থাকে। এই পর্যায়ে একই সভামঞ্চে ড. এ.আর. মল্লিক তাদের বক্তব্য খণ্ডন করেন। মার্কিনী ও ফরাসিদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এভাবে বাংলাদেশ পক্ষের প্রতিনিধি দলকে পেনসিলভানিয়া, হার্ভাড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বিরােধীবক্তব্য খণ্ডন করতে হয়। এ সময় ফিলাডেলফিয়াতে একটি জাহাজে অস্ত্র বােঝাই করা হচ্ছিল, যা অবিলম্বে পাকিস্তানের উদ্দেশে বন্দর ত্যাগ করার কথা। সংবাদ পেয়ে স্থানীয় বাংলাদেশ পক্ষের জনতা জাহাজের যাত্রা বন্ধ করার জন্য ছুটে যায়। এ. আর. মল্লিকের

——

১২১৬, আসিফ রশীদ, প্রাগুক্ত, প্রথম আলো, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৩। ১২১৭ মুহাম্মদ নুরুল কাদির, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭। ১২১৮ এ.আর. মল্লিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪। ১২১৯ আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০-১৪১।

আমেরিকাতে কূটনৈতিক সফরকালে কোনাে একটি অজ্ঞাত সংস্থার পক্ষ থেকে তার নিকট প্রস্তাব করা হয় যে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঋণে অস্ত্র সরবরাহ করতে এবং নিজেদের ব্যবস্থাপনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত করে এনে দিতে চায়। বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলে ঐ কোম্পানিকে ঋণ পরিশােধ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযােগ দিতে হবে । কিন্তু তিনি কৌশলগত কারণে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণে অস্মতি জ্ঞাপন করেন ।*১২২০।

| অন্যদিকে পাকিস্তানের সমর্থক বাঙালিরা শাসকগােষ্ঠীর সুরে বলেন যে, তাদের। ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা মূলত ভারতের প্ররােচনা ও হস্তক্ষেপের ফল। তাদের মতে এ যুদ্ধ পাকিস্তানের ইসলামি জেহাদ। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সফর করে নেজামী ইসলামি নেতা মৌলভী ফরিদ আহমদ এ ধরনের অপপ্রচার চালান। ঐ সফর শেষে করাচি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতীয় দূতাবাসের সহযােগিতায় রেহমান সােবহান ও একজন পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলীকে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করার জন্য প্রেরণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সরকার মধ্যপ্রাচ্যে ভারত সরকারের সহযােগিতা গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে বটে, কিন্তু তাতে রেহমান। সােবহান বা পাকিস্তানি বামপন্থী ছাত্রনেতা তারিক আলীকে প্রেরণ করা হয়নি। এ ধরনের তথ্য প্রদানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং কমিউনিস্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাজ বলে চিহ্নিত করা।

বাংলাদেশের পক্ষে উল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলাের পাশাপাশি পাকিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতাকে প্রতিহত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের পক্ষে প্রেরণ করেন অধ্যাপক রেহমান সােবহান ও অন্যান্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদকে। এ সম্পর্কে রেহমান সােবহান লিখেছেন:

তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলামের সঙ্গে যখন ছিলাম তখনই একদিন বিবিসিতে শুনলাম যে, ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম,এম, আহমেদ ওয়াশিংটন যাচ্ছেন পাকিস্তানের দাতাদেশগুলাের কনসাের্টিয়ামে তাদের সাহায্য অব্যাহত রাখার আবেদন নিয়ে। তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারলেন যে, সাহায্যের নামে। পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রক্রিয়ায় কোনরকম সহায়তাকে আমাদের সকল রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে।

———

১২২০ এ.আর, মল্লিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪-১১৪। ১২২১ ঐ, পৃ. ১০০। ১২২২. রেহমান সােবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮), পৃ. ১০৫।

তাজউদ্দীন আমাকে দায়িত্ব দিলেন, অবিলম্বে লন্ডন ও ওযাশিংটন যাওয়ার জন্য, যাতে ওখানে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পাকিস্তানের প্রধান দাতা দেশগুলাের কাছে তাদেরকে এ-ধরনের সাহায্য বন্ধ রাখার জন্য প্রচার চালাতে পারি। আমার দ্বিতীয় কাজ ছিল, পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনগুলােতে কর্মরত সকল বাঙালি কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। আমার নিদিষ্ট লক্ষ্য ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন-যেখানে অসংখ্য বাঙালি কর্মচারি রয়েছে, তাদের সমর্থন আদায় করা। কারণ, তাদের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে

প্রচার চালানাের পক্ষে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করবে। রেহমান সােবহান এপ্রিলের মাঝামাঝি লন্ডনে পৌছে আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হন। তার পূর্ব পরিচিত সাংবাদিক Brian Lapping-এর সহযােগিতায় ব্রিটিশ লেবার পার্টির কতিপয় নেতার সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। তাদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি হাউস অব কমন্সের একদল সদস্যের উদ্দেশে বক্তৃতায় আবেদন জানান যে, তারা যেন পাকিস্তানকে নতুন সাহায্যদান স্থগিত রাখার ব্যাপারে রক্ষণশীল দলীয় সরকারের প্রতি চাপ প্রয়ােগ করেন। শুরু থেকেই তাদের নিকট সহানুভূতিসূচক সমর্থন পাওয়া যায়। লেবার দলের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিনিধি Denis Healy-এর সাথে তার যােগাযােগ স্থাপিত হয়। এরপর সিনিয়র এম,পি Sir Alice Douglas Hume, Dodds Parker প্রমুখের মাধ্যমে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যােগাযােগের চেষ্টা করেন, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। তবে মে মাসের শেষদিকে তিনি আমেরিকায় সফর শেষে আবার ব্রিটেনে ফিরলে সেখানকার বিরােধী দল, প্রচার মাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি বেশ সহানুভূতিমূলক জনমত লক্ষ করেন। ইতােমধ্যে লন্ডনসহ ব্রিটেনের বড় বড় শহরে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে যে সব সংগঠন গড়ে ওঠে সেগুলাে সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ করে যাতে বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধের উদ্যাগ গ্রহণ ও পাকিস্তানকে সকল প্রকার বৈদেশিক সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানানাে হয়। বিরােধী শ্রমিক দলের কতিপয় প্রভাবশালী নির্বাচিত সদস্য বাংলাদেশ ইস্যুতে বেশ তৎপরতা দেখান। কোনাে কোনাে বিরােধিদলীয় নেতা ভারতে এসে শরণার্থী শিবিরগুলাে পরিদর্শন এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ব্রিটিশ প্রচার মাধ্যমগুলাে গুরুত্বসহকারে এ বিষয়ে প্রচার কাজ অব্যাহত রাখে। তবে বাংলাদেশ প্রশ্নে ব্রিটিশ রক্ষণশীল সরকারের পক্ষে গােড়া থেকে যথেষ্ট সতর্কতামূলক সমর্থন পরিলক্ষিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৪ মে লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড

—-

১২২৩ দলিলপত্র, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ২৭-২৮।

হীথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে সংঘটিত সমস্যা এবং ভারতের উপর এর। চাপ সম্পর্কে আলােচনা করলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ব্রিটেন ভারতের ন্যায় মনে করে এই সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান হওয়া উচিত। পাকিস্তানকে নিরস্ত করতে বিশ্বব্যাংক কিংবা কনসাের্টিয়ামের মাধ্যমে চাপ প্রয়ােগের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তাতে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন থাকবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। রেহমান সােবহান ব্রিটেনে উপরিউক্ত প্রাথমিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর চলে যান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। ততদিনে অধ্যাপক অনিসুর রহমান ও অধ্যাপক নুরুল ইসলামও সেখানে পৌছেন। এপ্রিল মাসের গােড়ার দিকে অধ্যাপক আনিসুর রহমান ‘আবদুর রশীদ এবং অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ‘নির্মল সেন’ নাম ধারণ করে ভারতে গিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অশােক মিত্র, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ঘনিষ্ট বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাদেরকে ইউরােপ ও আমেরিকায় গিয়ে সেখানকার বুদ্ধিজীবী মহলে কাজ করার জন্য অনুরােধ জানান। তারা আমেরকিা পৌছে কিছু কিছু কাজ করেন যা। রেহমান সােবহানের কূটনৈতিক তৎপরতার অনেকখানি সহায়ক হয়। রেহমান সােবহান সেখানকার বাঙালি কূটনীতিবিদদের নিকট বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান সম্বলিত তাজউদ্দীন আহমদের বার্তা পৌছে দেন। অতঃপর আমেরিকার কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। সিনেটর Edward Kennedy, Frank Church এবং তাদের সহকারী যথাক্রমে Gerry Tinker, Dale Diehan এর সঙ্গে ঘনিষ্ট যােগাযােগ সৃষ্টি হয়। এই যােগাযােগের ফলে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এ তারা বাংলাদেশের পক্ষে জোরালাে ভূমিকা পালন করেন। একই সঙ্গে সেখানকার বিখ্যাত সংবাদপত্রগুলােও যথেষ্ট সহায়ক হয়। ঠিক এ সময় ইয়াহিয়া খানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম.আহমদ তার পুরনাে কিছু পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলে একটা পাল্টা ব্যবস্থা করা হয় নির্দলীয় সিনেটর Saxby এর মাধ্যমে। রেহমান সােবহানের সৌজন্যে তিনি একটা ভােজসভার আয়ােজন করেন। এ ভােজসভাতে এম.এম. আহমদের অনুষ্ঠানে যােগদানকারী ব্যক্তিদের চেয়েও অনেক প্রভাবশালী নেতা ও সিনেটর উপস্থিত হন। এদের মধ্যে ফরেন রিলেসন্স কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর Church

——–

১২২৪মাসুদা ভাট্টি, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩। ১২২৫ মােঃ আনিসুর রহমান, পথে যা পেয়েছি, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা: এ্যাডর্ন পাবিলিকেশন, ২০০২), পৃ. ১০৭।

১২২৬’ রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭।

Fulbright, রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যালঘুদের নেতা সিনেটর Scott ছিলেন উল্লেখযােগ্য। তাদের সামনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিক ভিত্তি ও নজিরহীন গণহত্যার বিবরণ প্রদান করা হয়, যা তাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করে। এতে মন্ত ব্য করা হয় যে, এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে যে কোনাে ধরনের সাহায্যদান পরােক্ষভাবে তাদেরকে গণহত্যায় সহযােগিতা প্রদানের নামান্তর হবে। এর ফলে পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্যদান চাপের মুখে পড়ে। বাংলাদেশ পক্ষের প্রচার মার্কিন প্রচারমাধ্যমগুলােতে যেভাবে স্থান পায় এবং সেখানকার রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তাতে মােটের ওপর এম.এম, আহমদের মিশন ব্যর্থ হয়ে যায়। এতে তিনি এতটাই হতাশ হন যে, নিজের সংবাদ সম্মেলন পর্যন্ত বাতিল করে দেন। বাংলাদেশ সরকারের এ ধরনের প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক মহলকে প্রভাবিত করা এবং পাকিস্তানকে সাহায্যদান হতে বিরত রাখা।১২২৭” এ ছাড়াও পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলােকে এ ব্যাপারে একটা যুক্তিপূর্ণ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করা। বিশ্বব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন ইংরেজ কর্মকর্তা I.P. Cargil এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রেহমান সােবহান বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। Cargil বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং সে সুত্রে প্যারিসে পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামে সভাপতিত্ব করেন। তাকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একটি নােট প্রদান করা হয়। তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে ইতিবাচক আশ্বাস দেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট Robert Mcnamara-এর সঙ্গেও রেহমান সােবহানের ফলপ্রসূ সাক্ষাৎ ঘটে। মূল তথ্যগুলাে উল্লেখ করে Aid to Pakistan: Background and Options’ শিরােনামে একটি পেপার তাকে প্রদান করা হয়। এসব প্রচেষ্টার ফলে কনসাের্টিয়াম তাদের ভাষায় পূর্ব পাকিস্ত নে’ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তানকে সাহায্যদান করা হতে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। Cargil-এর নিকট প্রদত্ত নােটের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা ঢাকা ও ইসলামাবাদ সফর শেষে যে রিপাের্ট পেশ করেছিলেন তার আলােকে প্যারিস কনসাের্টিয়াম উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। | প্যারিস কনসাের্টিয়ামের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি অর্থপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এতে সচেতন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় উপমহাদেশে বয়ে চলা ঘটনাপ্রবাহের প্রতি। ততদিনে বাংলাদেশ সরকার

———

১২২৭ ঐ, প, ১০৭-১০৯। ১২২৮ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৪০৪।

প্রাথমিক কাঠামােগত কাজ অনেকখানি গুছিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এরপর সরকার। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিদেশে অবস্থানরত সকল বাঙালি কূটনীতিকের প্রতি একটি সাধারণ আহ্বান জানায়। এতে বলা হয় “বাংলাদেশ সরকার বিদেশে অনেকগুলাে মিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আপনার জন্য প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করার উপযুক্ত সময় এবং এইসব। মিশনে কাজ করবার দায়িত্ব নিতে হবে। আপনার আনুগত্য আপনি তারবার্তায় কোলকাতার ৯ সার্কাস এভেনুস্থিত বাংলাদেশ মিশনে এক পক্ষকালের মধ্যে জানিয়ে দিলে আপনার দায়িত্ব নির্ধারণ করা হবে। বাংলাদেশ সরকার আপনাদের সবাইকে আপনাদের উপার্জন ও চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আপনারা স্থানীয়ভাবে। সাহায্যের জন্য বন্ধুস্থানীয় মিশনের সংগে যােগাযােগ রাখবেন।”১২২৯ এর ফলে ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস ও নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ দফতরে পাকিস্তান মিশনের মােট ১৫ জনের মধ্যে ৬ জন বাঙালি কূটনীতিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে একযােগে আনুগত্য ঘােষণা করেন। বস্তুত প্যারিস কনসাের্টিয়ামে দাতাগােষ্ঠীর নিকট থেকে সাহায্য প্রাপ্তির প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর একযােগে বাঙালি কূটনীতিকদের পক্ষত্যাগ করার ঘটনা ছিল পাকিস্তানের জন্য দ্বিতীয় বড় রকমের আঘাত। | বিশ্বব্যাপী কুটনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ক্রমবর্ধমান জনমত, পাকিস্তানের কূটনৈতিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসা, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বসহকারে এসবের প্রচার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। আগস্ট মাসে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উল্লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনতিবিলম্বে সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এরূপ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মদদদাতা। আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমদ ও আরাে কোনাে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে একটা গােপন যােগাযােগ গড়ে তােলার চেষ্টা করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার মাধ্যমে উপমহাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব অক্ষুন্ন রাখা। একই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের। বিচার সামরিক আদালতে করা হবে বলে ঘােষণা প্রদান করে। পাকিস্তান। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে যুদ্ধরত বাঙালি জাতির মধ্যে উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তান সরকার সত্যই যদি মুজিবকে রাষ্ট্রদোহীর

———-

১২২৯ আবুল মাল আবদুল মুহিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৯। ১২৩০ আবদুল মতিন, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬।

অভিযােগে শাস্তি দিতে চায় তা রােধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্ত। র্জাতিকভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে।১২৩১ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লন্ডনের আইনজীবী প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড শেরিডাল এন্ড কোম্পানীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। কোম্পানীটি সলিসিটর সন্ ম্যাকব্রাইডকে। ইসলামাবাদে পাঠানাের ব্যবস্থা করে। উক্ত আইনজীবী ইসলামাবাদে পৌছালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় যে, সামরিক আদালতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার করা হবে এবং কোনাে বিদেশী আইনজীবীকে মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হবে না। বাঙালিরা এ ধরনের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে বিভিন্ন সমাবেশ হতে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে একটি প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করা হয়।৩২ অন্যত্রও এ ধরনের সভা-সমাবেশ অবিরামভাবে অব্যাহত থাকে। পরিশেষে এ্যাকশন কমিটি মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন পাকিস্তানি আইনজীবীকে নিয়ােগ দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।২৩৩ একই উদ্দেশ্যে আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের নিকট একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি। মন্তব্য করেন “শেখ মুজিব একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি। তার বিচার করার অধিকার কারও নেই। গােপন বিচার একেবারেই সভ্যতা বহিভুত। এই প্রহসন বন্ধ ও শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করবেন, এটাই আমাদের আশা ।১২৩৪

৩৯৯

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!