You dont have javascript enabled! Please enable it!

অসহযােগ থেকে মুজিবনগর সরকার তাজউদ্দীন আহমদের কর্মতৎপরতা

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। সময়ের ঘটনাপ্রবাহ কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয় বরং পৃথিবীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ সংযােজন। সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা নাও দেয়া হতে পারে-এম সন্দেহের প্রেক্ষাপটে যখন ১ মার্চ দুপুরে পাকিস্তান বেতার থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণা প্রচারিত হয় তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর পাকিস্তান কাঠামােতে থাকা নয়, কোনাে স্বাধিকার কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি নয়, এবার পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করার লড়াইয়ে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর মুখােমুখি হতে হবে- গণমানুষের এই চেতনাকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ এক সর্বব্যাপী অসহযােগ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের সঙ্গে অঘােষিতভাবে সম্পর্ক ত্যাগ করে গড়ে তােলে একটি বিকল্পধারার প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রশাসনিক সকল ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়ে যায় আওয়ামী লীগের হাতে। উপায়ন্তর না দেখে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকরা শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে একটি লােক দেখানাে সমঝোতা প্রয়াস চালান যাকে নিছক প্রহসন বলে অভিহিত করা যেতে পারে । | এমতাবস্থায় একদিকে বাহ্যত সমঝােতার পথ খােলা রাখা, অন্যদিকে প্রতিরােধ-প্রস্তুতি গ্রহণ আওয়ামী লীগের কর্মকৌশল হিসেবে গৃহীত হয় । তাজউদ্দীন আহমদ দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে অসহযােগ আন্দোলন তথা বিকল্পধারার প্রশাসন পরিচালনার

দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দাবির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন, আর তাজউদ্দীন আহমদ কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তার সহযােগিতায় অসহযােগ পরিচালনার যাবতীয় বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করতে থাকেন। পরে মুজিব-ইয়াহিয়া সমঝােতা আলােচনা শুরু হলে তাজউদ্দীন আহমদও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়াও দলের সাধারণ | সম্পাদক হিসেবে নিস্তর পর্যন্ত সংগঠনকে অনুমিত বিপদ মােকাবিলার জন্য প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হন। প্রহসনের আলােচনার অন্তরালে প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ইয়াহিয়া আঘাত হানার নির্দেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু | শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতারা | আত্মগােপন করে ভারতে প্রবেশ করেন। অতঃপর তিনি ভারতের সহযােগিতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ। সংঘটনে তৎপর হন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় ঘটে।

অসহযােগ ও ডি-ফেক্টো প্রশাসনিক কর্তৃত্ব

১ মার্চ ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতকরণের সংবাদ প্রচারের সময় | আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হােটেল পূর্বাণীতে মিলিত হয়েছিলেন। ঐদিন দুপুরে সংবাদটি রেডিও পাকিস্তান হতে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় বের হয়ে আসে। উত্তেজিত জনতা অতঃপর হােটেল পূর্বাণীতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের নিকট থেকে দিক নির্দেশনা চায় । তারপর তারা সমগ্র ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের হাতে শাসনভার অর্পিত হবে | এটাই ছিল সাধারণ মানুষের ধারণা। নির্বাচন পরবর্তীকালে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব, ভুট্টোর হুমকিপূর্ণ বিভিন্ন বিবৃতি, সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষণ প্রভৃতি সমগ্র বাঙালি জাতিকে আতংকিত করে তােলে। এমতাবস্থায় ১ মার্চ দুপুরের ঐ ঘােষণার প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালিরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের মতাে মানসিক অবস্থায় উন্নীত হয়। তারা অনুধাবন করে পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি সামরিক বেসামরিক আমলা ও ক্ষমতাভােগী নেতৃত্ব বাঙালির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অনিচ্ছুক। সুতরাং ক্ষমতায় যেতে হলে শক্তি প্রয়ােগ ছাড়া

গত্যন্তর নেই । এ প্রসঙ্গে রাও ফরমান আলী খানের পর্যবেক্ষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। হতে পারে। তিনি লিখেছেন৭২৪:

১ মার্চের দুপুরে যখন পরিষদের অধিবেশন মুলতবি সংক্রান্ত ঘােষণাটি প্রচারিত হল, তখন প্রত্যেক বাঙালির প্রতিক্রিয়া ছিল সহিংস এবং সকলের ভেতরেই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার মারাত্মক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল। সমগ্র বাঙালি জাতিই এবার যুদ্ধের পথে নেমে গিয়েছিল। ঘােষণাটির মধ্য দিয়ে ছাঁচ তৈরি করা হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই যে অধিবেশন মুলতবি করার ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে ১ মার্চেই পাকিস্তানের ভাঙ্গন ঘটেছিল। পরবর্তীকালে ঘটনাবলি

ছিল প্রধান ঘটনাবলির অনুসরণ মাত্র। নানা শ্রেণী পেশার মানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষুব্ধ উত্থানের প্রেক্ষিতে যে সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি তারাও পিছিয়ে থাকেনি। সকল বাঙালি এক হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের পেছনে। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে সমগ্র ঢাকা শহর বিদ্রোহী নগরীতে পরিণত হয়। দেশি অস্ত্রে সজ্জিত জনতা এদিন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী কয়েকটি স্লোগান দিয়ে তাদের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। এসব স্লোগানের মধ্যে কোথাও কোথাও উচ্চারিত হতে শােনা যায়: ইয়াহিয়ার ঘােষণা—বাঙালিরা মানে না, পাকিস্তানের পতাকা—জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান—আজিমপুরের গােরস্থান ইত্যাদি। | এভাবে জনতার চেতনায় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের মৃত্যু হয় এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে । এক্ষেত্রে দলগুলাের চেয়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে এগিয়ে থাকতে দেখা যায় । বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতারা সরাসরি স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বেশ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়ার নীতি অবলম্বন করেন। কেননা স্বাধীনতার মতাে চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী বিষয়ের সঙ্গে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা উপাদান সম্পর্কিত।

—-

৭২৪ রাও ফরমান আলী খান, বাংলাদেশের জন্ম, শাহ আহমদ রেজা (অনু.) (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ৫৯। গ্রন্থের নাম How Pakistan Got Divided. ৭২৫. নাজিমুদ্দীন মানিক, একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলাে (ঢাকা: ওয়ারী বুক সেন্টার, ১৯৯২), পৃ. ১৪। ৭২৬ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ২৪৩-২৪৪।

শেখ মুজিব ঐ দিন বিকেলে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন। যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণাকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া। হবে না। তবে তিনি ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। কিন্তু জনগণ এতে আশ্বস্ত হয় নি। তারা Action Action বলে চিৎকার দিতে শুরু করে । উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ। জনতার উদ্দেশে তিনি ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ২ মার্চ থেকে প্রতিদিন ৬-২ টা পর্যন্ত অসহযােগের কর্মসুচি ঘােষণা করেন। এটা করে তিনি ও আওয়ামী লীগ। নেতৃবৃন্দ মূলত জেগে ওঠা আবেগকে ক্রমাগত শাণিত করার সুযােগ গ্রহণ করেন। একদিকে, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পথও উন্মুক্ত রাখেন। তদুপরি স্বাধীনতার মতাে চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে পূর্ব বাংলার অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ এবং নিজ দলের মধ্যে আলােচনা ও পরিকল্পনার পথ। প্রশস্ত রাখেন।

২ মার্চ ছাত্রদের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে অস্বীকার করে স্বাধীন সার্বভৌম । বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘােষণা আর এক মাত্রা যােগ করে। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে আয়ােজিত সভা মূলত সর্বস্তরের অংশগ্রহণের ফলে বিক্ষুব্ধ জনসভায় পরিণত হয়। আগত সকল শ্রেণীর মানুষের হাতে দেশি অস্ত্রশস্ত্র, মুখে তাদের স্বাধীনতার প্রত্যয়দীপ্ত স্লোগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের বটতলা চত্বরে উদ্বেলিত বিক্ষুব্ধ জনসভায় পূর্বাহ্নে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন, তােফায়েল আহমেদ, আবদুর রব, শেখ শহিদুল ইসলাম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকারী বক্তৃতা করেন। ২৭ ছাত্রনেতারা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে ১৯৭০ সালে ৭ জুনে তৈরি করা ‘জয় বাংলা বাহিনীর পতাকা বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে উত্তোলন করেন। এই পতাকাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও স্বাধীনতাযুদ্ধে পতাকাটির তাৎপর্য অপরিসীম। তাই এটি কিভাবে কোথায় কাদের প্রচেষ্টায় প্রথমে তৈরি হয়েছিল তা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র হতে এ বিষয়ে নিরূপ জানা যায়:

———-

৭২৭ সায়েরা সালমা বেগম, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ছাত্র লীগ (১৯৪৮১৯৭১) মূলধারা পর্যালােচনা” অপ্রকাশিত এম.ফিল, থিসিস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০১, পৃ. ২৯৩। ৭২৮ মাসুদুল হক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সি আই এ (ঢাকা: ওসমানিয়া লাইব্রেরী, ১৯৯০), পৃ. ৪৪-৪৮। এ বিষয়ে আরাে জানার জন্য দেখুন, আতিকুর রহমান, জাতির পিতা ও পতাকা কাহিনী (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), গ্রন্থখানি ।।

২১০

আসলে পতাকাটি একটি আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফসল। ১৯৭০ সালের ৬ জুন রাতে ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৮ নম্বর কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় একটি আলােচনা সভা। তাতে উপস্থিত ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ, আ.স.ম. আবদুর রব, মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)। এরা সবাই ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। সভায় শেখ মুজিবকে (৭ জুন ১৯৭০) পতাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পতাকার ডিজাইন কেমন হবে। এবং তার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখা হয়। সবুজের ভেতরে লাল সূর্য। হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতীক। রক্তবর্ণ সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র বসিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয় এভাবে যে, এই আন্দোলনের সঙ্গে পশ্চিম বাংলা কিংবা ভারতের যােগসূত্র নেই। মুক্ত বাংলা আন্দোলনের সঙ্গেও এর কোন সংশ্রব নেই । আলােচনা চলাকালীন সময়ে হাসানুল হক ইনু ছিলেন পাশের রুমে (ইনু ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)। তাকে ডেকে আনা হয় এবং তার ওপর পতাকার ডিজাইন তৈরি এবং বানিয়ে আনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ঐদিন সকালে কুমিল্লার তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা শিব নারায়ণ দাস এসে উঠেছিলেন ইকবাল হলে । তিনিও ছিলেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তার আসাটা ছিল নিতান্তই কাকতালীয়। শিব নারায়ণ দাস আঁকতে জুকতে পারতেন ভাল। হাসানুল হক ইনু তার সাহায্য চাইলেন। তিনি সাদা কাগজের ওপর পেন্সিল দিয়ে করে দিলেন ডিজাইন। …শিব নারায়ণ দাস সাক্ষাৎকারে বলেন যে, সাদা কাগজের ওপর পতাকার নকশা এঁকে দেন। এর পরের কাজ দর্জির কাছে যাওয়া, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় অফিস ৪২ বলাকা ভবনের লাগােয়া কক্ষ “নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স’। এই সুত্রেই দোকানের ম্যানেজার মােহাম্মদ নাসিরুল্লাহর সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীদের পরিচয় (তারা তাকে মামা ডাকতেন)। (নাসিরুল্লাহ ও পতাকার কাটিং ও সেলাইকারী আব্দুল খালেদ মােহাম্মদীর ১-১৪ এপ্রিল, ১৯৮৯ এর সাক্ষাৎ অনুযায়ী) হাসানুল হক ইনু এবং শিব নারায়ণ দাস রাত প্রায় সাড়ে দশটার দিকে আমাদের দোকানে আসেন। দোকানের মালিক ও অন্যান্য কর্মচারী ততক্ষণে যে যার ঘরে চলে গেছে। হাসানুল হক ইনু ও শিব নারায়ণ দাস কাগজের ওপর আঁকা ছাত্রলীগের পতাকার একটি ও বাংলাদেশের পতাকার আরেকটি নকশা দেখিয়ে এবং সাইজের কথা বলে জানতে চাইলেন কোন রংয়ের কাপড় কতটুকু লাগবে। আমরা কাপড়ের পরিমাণ বলে দিতে তারা বেরিয়ে গেলেন এবং নিউমার্কেট থেকে লেডি হ্যামিলটন কাপড় নিয়ে ফিরলেন। আমরা কাজ শুরু করি রাত বারােটার পর ।

কাজ শুরুর আগে দোকানে প্রবেশের প্রধান গেটের গ্রিল টেনে তালা মেরে দিই। কাপড়ের কাটিং শেষ হলে হাসানুল হক ইনু ও শিব নারায়ণ দাস বাইরে চলে যান। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ফিরে আসেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কাজ দেখেন। ভাের চারটার দিকে দুটো পতাকার কাজ শেষ হয়ে যায়। তারা নিয়ে চলে যান।

পরদিন ১৯৭০ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠানের পূর্বে পতাকাটা পুরাে খােলার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঝলক দেখেই কিছুটা ব্ৰিত হন।৭২৯ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অনুসারী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগেই এ ধরনের পতাকা দেখে ব্রিত হতেই পারেন, কিন্তু তার এক বছর পরে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হতে যে রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব ঘটে তার প্রেক্ষিতে ছাত্র-জনতার সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত পতাকা উত্তোলনের ঘটনা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে পাকিস্তানি শাসকচক্রের সঙ্গে বােঝাপড়ার সংগ্রামে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিঃসন্দেহে শক্তি জোগায়। পতাকা তৈরির সময় ছাত্রনেতৃবৃন্দ এতে পূর্ব বাংলার মানচিত্র সন্নিবেশ করে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পতাকাটি আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফসল হলেও পরবর্তীকালে এটা স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রভূত অবদান রাখে। বিশেষত ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য অপরিসীম। | ১৯৭১ সালে ২ মার্চ উক্ত পতাকা উত্তোলনের পাশাপাশি পূর্বদিনের স্লোগানের সাথে আরাে কতিপয় স্লোগান যুক্ত হয়। যেমন- “জয় বাংলা-বাংলার জয়, জাগাে জাগাে-বাঙালি জাগাে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর—বাংলাদেশ স্বাধীন করাে। এ সময় ৬-দফা নয়, এক দফা চাই শীর্ষক একটি প্রচারপত্রে ঢাকা শহর ছেয়ে যেতে দেখা যায়। বিক্ষুব্ধ ঐ জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ মানুষকে হত্যার তীব্র নিন্দা জানান এবং কর্মসূচি হিসেবে নিজ মুখে ৩-৭ মার্চ পর্যন্ত ৪ টি ঘােষণা প্রদান করেন। এগুলাে ছিল ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিতকরণ ও গণহত্যার প্রতিবাদে জাতীয় শােকদিবস, ৩-৬ মার্চ প্রতিদিন ৬-২ টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন, প্রচার মাধ্যমগুলােতে আন্দোলনের সংবাদ

———–

৭২৯. আতিকুর রহমান, ঐ, পৃ. ২৪। ৭৩০ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ ২২।

রফিকুল ইসলাম পিএসসি, একটি ফুলকে বাঁচাবাে বলে (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃ. ৫৯। ৩২, মােনায়েম সরকার (সম্পা.), বাঙালির কণ্ঠ (ঢাকা: বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ১৯৯৮), পৃ. ২২৬-২২৭।

পরিবেশন না করা হলে বাঙালি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে অসহযােগিতা করার আহ্বান এবং ৭ মার্চ বিকেলে নতুন কর্মসূচি হিসেবে জনসভায় ঘােষণা প্রদান। অবশ্য এরপর থেকে সকল কর্মসূচি বিবৃত করতেন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।৭৩৩

২ মার্চ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উক্ত কর্মসূচি ছাড়াও পল্টন ময়দানে অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাপ এবং আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বাংলা জাতীয় লীগের পৃথক দুটি জনসভা হয়। এতে বক্তারা প্রত্যেকেই জাতীয় পরিষদের আহূত অধিবেশন অকস্মাৎ স্থগিত করার পেছনে চক্রান্তের কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনের আহ্বান জানান। তারা এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। অন্যদিকে সরকার সর্বাত্মক সামরিক শাসনের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, এক্ষেত্রে বাঙালি মুখ্য সচিব শফিউল আযমের একটা প্রচেষ্টা ছিলসিদ্দিক সালিক অবশ্য একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, বাঙালি ঐ মুখ্য সচিব সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করে তােলার লক্ষ্যে এই মন্ত্রণা দেন। কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায় শফিউল আযম শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক সরকারের অনুগত থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। জনতার সর্বব্যাপী উত্থানে সরকারের আন্দোলন দমনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ৩ মার্চ থেকে পরিস্থিতি উত্তরােত্তর উত্তাল হয়ে ওঠে। সান্ধ্য আইন ভঙ্গকারী বিক্ষোভরত জনতার ওপর সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করলে সরকারি হিসেব মতে ঘটনাস্থলেই অন্তত ৬ জন নিহত হয়। হাসপাতালে মৃত্যু হয় ৩৫ জনের। আহত হয় ১১৩ জন। ৩ মার্চ ঐ সকল মৃতদেহ নিয়ে জনতা মিছিল বের করলে তা ক্রমাগত স্ফীত হতে থাকে। সশস্ত্র জনতা জানতে পারে যে, পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ আহুত একটি জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা পল্টন ময়দানের

———-

৭৩৩ আবদুল আজিজ বাগমার, স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯), পৃ. ১৩৬। ৭৩৪ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২২। ৩৫. সিদ্দিক সালিক, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, মাসুদুল হক (অনু.) (ঢাকা: নভেল পাবলিকেশন্স, ১৯৯০), পৃ. ৫৮। সিদ্দিক সালিক রচিত মূলগ্রন্থের নাম Witness to surrender “৩৬ রেহমান সােবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয় একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮),পৃ. ৭৮।

দিকে ধাবিত হয়। মার্চের ৩ তারিখে ছাত্রলীগ পূর্বদিনের চেয়ে আরাে একধাপ এগিয়ে স্বাধীনতা প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন যার মূল কথা হলাে শােষণমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।” ৭৩৭ ৩ মার্চের সভায় ছাত্রনেতাদের চাপ থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগের পঠিত ইশতেহার ও প্রস্তাবনার দিকে না গিয়ে এমন একটি পথ অবলম্বন করেন যাতে বিক্ষুব্ধ জনতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্রমাগত জাতিকে প্রস্তুত করা যায়; অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্র যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ আনতে না পারে । ঐদিন ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন। মুজিব এই প্রস্তাবকে একটা জাতিকে বন্দুকের নলের মুখে রেখে নিষ্ঠুর তামাশা বলে মন্তব্য করেন। সরকারের উদ্দেশে আরাে বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ৭ মার্চ পর্যন্ত তিনি সরকারকে সমঝােতার জন্য সময় দেন, অন্যথায় জনগণকে ট্যাক্স প্রদান বন্ধ করে অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

| স্বাধীন বাংলার পতাকার ধরন ও প্রকাশ্যে উত্তোলন এবং প্রদত্ত স্লোগানগুলাের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে অনুধাবন করা যায় যে, ৩ মার্চ ১৯৭১ নাগাদ বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সকল মানসিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এদিন রাষ্ট্রের নাম, জাতীয় পতাকা, জাতির পিতা, আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের ধরন প্রভৃতি বিষয়ে প্রকাশ্য ও আনুষ্ঠানিক ঘােষণা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে দেয়া হয় । ছাত্র ও যুব নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা শােনার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন। শেখ মুজিব সরাসরি এ ধরনের ঘােষণা

দিলেও পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করবাে। আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা করুন।… ভয় দেখাইয়া লাভ নাই, আমি মরিবার জন্য প্রস্তুত। আমি মরে গেলেও ৭ কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে।”৩৮ শাসনতান্ত্রিকভাবে যে পাকিস্তানের সঙ্গে আর

———-

৭৩৭ সায়েরা সালমা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৪। ৩৮. দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ মার্চ, ১৯৭১। আরাে দেখুন, মােঃ শাহজাহান, “বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা (১৯৬৬-১৯৭১): একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ”, অপ্রকাশিত পিএইচ.ডি, থিসিস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০২, পৃ. ৪৫৪।

একত্রে থাকা সম্ভব নয় তা তিনি স্পষ্ট করে বলেন । ৩ মার্চের এই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে চলমান আন্দোলনকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালনা করার একটি রূপরেখা তৈরি হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান এ পর্যায়ে আশংকা করেন, তাকে যে কোনাে মুহূর্তে গ্রেফতার করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে আন্দোলনকে কিভাবে অব্যাহত রাখা যাবে সে সম্পর্কেও দিক নির্দেশনা দেন। তিনি মুক্তিকামী বাঙালির এই উত্থানকে অব্যাহত রাখার জন্যে বলেন:৭৩৯

বাংলার ভাইয়েরা আমার, আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায় । আমি যদি নাও থাকি আমার সহকর্মীরা আছেন, তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকেন, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হইয়া। নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে-যেকোন মূল্যে স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে

হইবে। এতে শেখ মুজিবের বিকল্প নেতৃত্ব ভাবনা ফুটে ওঠে। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ সংঘটন পর্যন্ত একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দলটিতে স্তরভিত্তিক একটি নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এর সর্বোচ্চে অবস্থানকারী নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপটেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মােশতাক আহমদ ও অন্যান্যরা। সাংগঠনিক সকল বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের ওপর মুজিবের গভীর আস্থা ও নির্ভরশীলতা জন্মে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন অধ্যায় হতে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক জাওয়াদুল করিমের পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা যেতে পারে:

সেই সময় বঙ্গবন্ধুর যেসব বিবৃতি খবরের কাগজে ছাপা হতাে, তার প্রায় সমস্ত গুলােই তাজউদ্দীনের রচনা করা । আমার মনে আছে, একবার আওয়ামী লীগ অফিসে বন্যা সম্পর্কিত বঙ্গবন্ধুর একটি বিবৃতি দেয়ার কথা। সেদিন তিনি বিকেলের দিকে খুবই ব্যস্ত। তাকে কিছু বলবার জন্য অনুরােধ করাতে কিছু পয়েন্ট দিলেন এবং বললেন আমি যেন লিখে তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখিয়ে তা কাগজে প্রকাশের জন্য পাঠাই।

———–

মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ৫৭৩-৫৭৪। “”? জাওয়াদুল করিম, মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৪০।

২১৫

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ ৩২ নং ধানমণ্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একটি আলােচনা সভা হয়। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বাঙালি জাতি আজ অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। সামনে মাত্র দুটো বিকল্প—সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের মুক্ত করা অথবা ভুট্টো ইয়াহিয়া ও অন্যান্যদের ইচ্ছার নিকট নতি স্বীকার করে পরাধীন থেকে যাওয়া। এই ক্রান্তিকালে দীর্ঘ সংগ্রামের সহকর্মীদের কাছে তিনি করণীয় বিষয়ে পরামর্শ চান। আলােচনার এক পর্যায়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ স্বাধীনতার বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে বিচার বিশ্লেষণের আহ্বান জানান। কিন্তু অন্য নেতারা জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে মত ব্যক্ত করেন। পরিশেষে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বক্তব্য রাখেন। সাংবাদিক নাজিমুদ্দীন মানিকের ভাষ্যে:৭৪০।

বঙ্গবন্ধু তার সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে পরিস্থিতির একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে যেতে চেয়েছিলেন। আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করবােই, বঙ্গবন্ধু এবং আমরা যারা তার সহকর্মী আদর্শের অনুসারী সকলেই তাই চাই। আর সেদিক দৃষ্টি রেখেই বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা কর্মসূচী দিয়েছিলেন। এই ৬ দফার প্রশ্নে আমরা গণরায় পেয়েছি। পাকিস্তানের ভাবী সংবিধান হতে হবে ৬ দফার ভিত্তিতেই, এর কোন বিকল্প নেই । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তা মেনেও নিয়েছিলেন। এখন তারা ভিন্ন সুরে কথা বলছেন, যার পরিণতিতে আজ এক দফা সামনে এসে গেছে। আমরা প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথেই ফেলেছি। বঙ্গবন্ধু যে অগ্নিপরীক্ষার কথা বলেছেন, আমরা অবশ্যই তাতে উত্তীর্ণ হবাে। তার জন্য বড় প্রয়ােজন যে জাতীয়

ঐক্য, এই মুহূর্তে তা প্রতিষ্ঠিত। এই ঐক্যের ফসল ঘরে তুলতে হবে। তাজউদ্দীন আহমদের একটি অসাধারণ দক্ষতা ছিল এই যে, তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে পূর্ববর্তী বক্তাদের অনুপযুক্ত যুক্তিগুলাে খণ্ডন করে হাউসকে নিজ পক্ষে। টানতে পারতেন। আর সেটার প্রতি মুজিবের থাকতাে অকুণ্ঠ সমর্থন। যাহােক পরিশেষে সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এদিকে ৩ তারিখে ভুট্টো আবার পাকিস্তানের ৩ টি শক্তির কথা উল্লেখ করে বিবৃতি দেন। এর জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ ৪ মার্চ নিমােক্ত বিবৃতি প্রদান। করেন: ৭৪৫

৭৪১. নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০। ৭৪২., ড. কামাল হােসেন, ২৩ জুলাই, ২০০৫, তাজউদ্দীন আহমদের ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন। ৭৪৩ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১।

——

পাকিস্তানের ক্ষমতার রাজনীতিতে শক্তি মাত্র একটিই এবং তা হচ্ছে আওয়ামী লীগ । আর সামগ্রিক রাজনৈতিক শক্তিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির একটা অবস্থান রয়েছে। তারা জাতীয় পরিষদে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরােধী দল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোন রাজনৈতিক দল নয়, দেশের প্রশাসনিক কাঠামােতে অন্যান্য বিভাগের একটি বিভাগ মাত্র। তবে দেশের প্রতিরক্ষার ভার যেহেতু তাদের ওপর সেহেতু তাদের একটা গুরুত্ব রয়েছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক অঙ্গনে টেনে আনার খেসারত পাকিস্তানের জনগণ গত ২৩ বছর দিয়েছে। এখন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সে সময় সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে আনার অর্থ একটা

হীন কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়। | পূর্ব বাংলায় যখন ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান তখন ৪ মার্চ প্রাক্তন গভর্নর আহসানকে বাঙালিদের প্রতি দুর্বলতার অভিযােগ এনে সরকার প্রত্যাহার করে নেয়। মার্জিত রুচিসম্পন্ন আহসান পূর্ব বাংলার মানুষের বৈধ দাবিদাওয়ার প্রতি বেশ সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সমঝােতার ক্ষেত্রে তিনি চমৎকার ভূমিকা। পালন করতে পারতেন। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে জেনারেল ইয়াকুবকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়। আহসানকে প্রত্যাহার করার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা উদ্ভূত পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পরিবর্তে সামরিক সমাধানের দিকে এগুচ্ছে। ৪ তারিখেই ইয়াহিয়ার সামরিক উপদেষ্টা পীরজাদা প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খানকে পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠান। সেখানে যাওয়ার পূর্বে তিনি ঐ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান এবং জানতে চান কোনােভাবে পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায় কিনা। এই সময় সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত হন। এরপর রাও ফরমান আলী খান লিখেছেন:৭৪৬

যা হােক ব্যক্তিটিকে দেখার পর মুজিবকে বলতে শুনলাম, “ভাই তাজউদ্দীন, প্লিজ ভেতরে আসুন।’ তাজউদ্দীন, গােড়া ভারতপন্থী আওয়ামী লীগার, ভেতরে এলেন এবং বসলেন । তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে সম্ভবত পাকিস্তানকে ঘৃণা করতেন। তিনি আট বছর পর্যন্ত হিন্দু ছিলেন বলে একটা প্রচারণা ছিল। আমি গল্পটিকে সত্য মনে করিনি। কিন্তু তার মানসিক গঠনে এর প্রকাশ ঘটত। মুজিব তাজউদ্দীনকে বললেন, ‘জেনারেল ফরমান জানতে চাচ্ছেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব কি না।’ তাজউদ্দীন বললেন, হ্যা, তা করা যায়, কিন্তু একটি নতুন ফর্মুলায় । এতসব

——–

৭৪৬ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৬।

হত্যাকাণ্ডের পর আমরা আর একই ছাদের নীচে ভুট্টোর সঙ্গে বসতে পারি না। তিনিই এসব কিছুর জন্য দায়ী। পরিষদকে দুটি অংশে বিভক্ত করতে হবে, একটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রতিটি পরিষদ তার নিজের প্রদেশের জন্য সংবিধান রচনা করবে। তার পর উভয় পরিষদ পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনার জন্য বসবে। আমি বললাম ‘শেষ পর্যন্ত জনাব ভুট্টোর সঙ্গে আপনাদের বসতেই হবে। তারা (শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন) বললেন, ‘কিন্তু সেটা হবে সমান সমান। তারা যা বলছিলেন তা ছিল একটি কনফেডারেশন গঠনের ফর্মুলা।

উপযুক্ত তথ্যের আলােকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক হিসেবে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন তাদের অর্জিত অধিকার (সমগ্র পাকিস্তান শাসনের বৈধ অধিকার) হতে সরে আসছেন। খুব সম্ভবত এর ব্যাখ্যা হতে পারে, সে সময় তারা ভাবছিলেন বিনা রক্তপাতে আপাত একটা কনফেডারেশনের অধীনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যারপর নিকটবর্তী লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন । কিন্তু সে পথও প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায় সামরিক বাহিনীর ওপর পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রভাবের কারণে। কেননা তার চক্রান্তে সামরিক বাহিনী ততদিনে শক্তি প্রয়ােগের নীতি নির্ধারণপূর্বক প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এ বিষয়েও রাজনীতির পরােক্ষ কুশীলব রাও ফরমান আলীর গ্রন্থ থেকে জানা যায়: ৭৪৭

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমাকেই প্রথম ডাকা হয়েছিল। তখন ৫ মার্চের সকাল প্রায় ১১ টা । আমি ভেবেছিলাম প্রেসিডেন্ট তার অফিসে থাকবেন। পরিবর্তে দেখলাম তিনি তার বাসভবনের পেছন দিকের বারান্দায় বসে আছেন। তার সঙ্গে ছিলেন জেনারেল হামিদ ও জনাব ভুট্টো । তারা তিনজনেই মদ পান করছিলেন। ইয়াহিয়া খালি পায়ে ছিলেন, তিনি তার পা দুটিকে সামনের টেবিলে তুলে দিয়েছিলেন। আমার তখন নীরাের কথা মনে পড়লাে, রােম যখন পুড়ছিল নীরাে তখন বাঁশী বাজাচ্ছিলেন। আমি স্যালুট করলাম। প্রেসিডেন্ট আমাকে চেয়ার নিতে বললেন, আমি বসলাম । তারপর তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম স্যার আমি যা বলতে যাচ্ছি তা জনাব ভুট্টোর অস্বস্তির কারণ হতে পারে। আমি কি অনুরােধ… আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই জনাব ভুট্টো তার গ্লাস তুলে নিলেন এবং সংলগ্ন ঘরটিতে চলে গেলেন। আমি তাকে মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সম্পর্কে জানালাম । আমি যখন তাকে জানালাম যে পরিস্থিতি ৬ দফারও বাইরে চলে গেছে তখন তিনি বললেন, সন্ধ্যায় ডিনারের জন্য আসুন। পরিস্থিতি।

—–

৭৪৭ ঐ, পৃ. ৬৭।

হত্যাকাণ্ডের পর আমরা আর একই ছাদের নীচে ভুট্টোর সঙ্গে বসতে পারি না। তিনিই এসব কিছুর জন্য দায়ী। পরিষদকে দুটি অংশে বিভক্ত করতে হবে, একটি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। প্রতিটি পরিষদ তার নিজের প্রদেশের জন্য সংবিধান রচনা করবে। তার পর উভয় পরিষদ পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনার জন্য বসবে। আমি বললাম শেষ পর্যন্ত জনাব ভুট্টোর সঙ্গে আপনাদের বসতেই হবে। তারা (শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন) বললেন, ‘কিন্তু সেটা হবে সমান সমান। তারা যা বলছিলেন তা ছিল একটি কনফেডারেশন গঠনের

ফর্মুলা। উপযুক্ত তথ্যের আলােকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক হিসেবে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন তাদের অর্জিত অধিকার (সমগ্র পাকিস্তান শাসনের বৈধ অধিকার) হতে সরে আসছেন। খুব সম্ভবত এর ব্যাখ্যা হতে পারে, সে সময় তারা ভাবছিলেন বিনা রক্তপাতে আপাত একটা কনফেডারেশনের অধীনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, যারপর নিকটবর্তী লক্ষ্য স্বাধীনতা অর্জন । কিন্তু সে পথও প্রায় রুদ্ধ হয়ে যায় সামরিক বাহিনীর ওপর পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রভাবের কারণে। কেননা তার চক্রান্তে সামরিক বাহিনী ততদিনে শক্তি প্রয়ােগের নীতি নির্ধারণপূর্বক প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। এ বিষয়েও রাজনীতির পরােক্ষ কুশীলব রাও ফরমান আলীর গ্রন্থ থেকে জানা যায়:৭৪৭

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমাকেই প্রথম ডাকা হয়েছিল। তখন ৫ মার্চের সকাল প্রায় ১১ টা। আমি ভেবেছিলাম প্রেসিডেন্ট তার অফিসে থাকবেন। পরিবর্তে দেখলাম তিনি তার বাসভবনের পেছন দিকের বারান্দায় বসে আছেন। তার সঙ্গে ছিলেন জেনারেল হামিদ ও জনাব ভুট্টো। তারা তিনজনেই মদ পান করছিলেন। ইয়াহিয়া খালি পায়ে ছিলেন, তিনি তার পা দুটিকে সামনের টেবিলে তুলে দিয়েছিলেন। আমার তখন নীরাের কথা মনে পড়লাে, রােম যখন পুড়ছিল নীরাে তখন বাশী বাজাচ্ছিলেন। আমি স্যালুট করলাম। প্রেসিডেন্ট আমাকে চেয়ার নিতে বললেন, আমি বসলাম । তারপর তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম ‘স্যার আমি যা বলতে যাচ্ছি তা জনাব ভুট্টোর অস্বস্তির কারণ হতে পারে । আমি কি অনুরােধ… আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই জনাব ভুট্টো তার গ্লাস তুলে নিলেন এবং সংলগ্ন ঘরটিতে চলে গেলেন। আমি তাকে মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সম্পর্কে জানালাম । আমি যখন তাকে জানালাম যে পরিস্থিতি ৬ দফারও বাইরে চলে গেছে তখন তিনি বললেন, সন্ধ্যায় ডিনারের জন্য আসুন। পরিস্থিতি

—-

৭৪৭ ঐ, পৃ. ৬৭।

মােকাবিলার জন্য আমি একটি ভাষণ রেকর্ড করেছি। আমরা সন্ধ্যায় আরাে

আলােচনা করবাে । বস্তুতপক্ষে প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনীর ওপর ভুট্টোর প্রভাব এমন পর্যায়ে পৌছে যে, সকল কিছুই তার ইচ্ছেমতাে ঘটতে শুরু করে। এমনকি ইয়াহিয়ার। যে ভাষণটি ৬ মার্চ প্রচারিত হয় তাও ভুট্টো লিখে দেন বলে অনেকের ধারণা। জন্মে। এতেই প্রমাণিত হয় ভুট্টোর ইচ্ছাবিরােধী কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা ইয়াহিয়া সরকারের ছিল না। পাকিস্তানি একটি সূত্রেও এর স্বীকৃতি। রয়েছে। এ বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের জাতীয় প্রতিরক্ষা সচিব জেনারেল গুলাম উমর কর্তৃক উল্লিখিত একটি ঘটনার কথা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তিনি বলেন:

১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় একটু ঝামেলা হচ্ছিল। জেনারেল ইয়াকুব থেকে। এই খবর যখন জানতে পারলাম তখন আমি ছিলাম করাচিতে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ছিলেন করাচিতে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি ভুট্টোও আছেন সেখানে। ইয়াহিয়া আমাকে বললেন, ইয়াকুবকে খবর পাঠাও—বি ফার্ম বাট জাস্ট। ভুট্টো বাধা দিয়ে বললেন, না আরাে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া। উচিত। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মি. ভুট্টোকে অথরিটি।

দিয়েছেন আমাকে নির্দেশ দেয়ার? প্রেসিডেন্ট কিছু বললেন না ।। এদিকে মার্চের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে । রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুএকটা ইসলাম-পছন্দ দল ব্যতীত সব দলই স্বাধীনতার জন্যে। উন্মুখ হয়ে ওঠে। বলা যায় এভাবে বাঙালিদের মধ্যে একটি জাতীয় ঐকমত্য। প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে সামরিক বাহিনী বেপরােয়াভাবে ‘বিদ্রোহীদের ওপর। গুলিবর্ষণ করলে অনেক মানুষ হতাহত হয়। এ সময় বিহারীরা বাঙালিদের ওপর সুযােগ বুঝে ঝাপিয়ে পড়তে থাকে। তারা বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযােগ করলে বিপুল। পরিমাণ জানমালের ক্ষতি হয়। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ ৬ মার্চ দমন ও হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের। হত্যা করা হচ্ছে মূলত পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ও কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্যে। এটাকে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে অভিহিত।

———

৭৪৮ ঐ, পৃ. ৬৮-৬৯।

মুনতাসীর মামুন, পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: সময়। প্রকাশন, ১৯৯৯), পৃ. ১৩৩।

৭৯।

২২০

করেন। তিনি ৫ মার্চ ঢাকার স্টেডিয়াম গেটের জনসভায় বক্তৃতার শেষাংশে

বলেন: ৭৫০

বিশ্ববাসী জানিয়া রাখুন, বাংলাদেশের মানুষের ওপর আজ যে নির্যাতন নামিয়া আসিয়াছে, তাহারা বীরের মতাে উহা প্রতিরােধ করিতেছেন। আজ আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ মুক্তি অর্জন এবং এক স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক

হিসাবে বাঁচিয়া থাকিবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই বক্তব্য যে কতটা যথার্থ তার প্রমাণ মেলে ৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জে শত শত মহিলার মিছিল থেকে। তারা রাজপথে লাঠি-সােটা হাতে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। তারা শ্লোগান দেয়, ‘মা বােনেরা অস্ত্র ধরাে-বাংলাদেশ স্বাধীন করাে, গুলি। মারা চলবে না-রক্তের বদলে রক্ত চাই’। রাজনীতিতে এটি একটি নতুন মাত্রা সংযােজন করে। মুসলিম সমাজে মহিলারা সাধারণত রক্ষণশীল মনােভাবাপন্ন। তাদের রাজনৈতিক চেতনার মানও স্পষ্ট নয়। কিন্তু পরিস্থিতি এত তীব্র হয়ে ওঠে যে একটি মফঃস্বল শহরে শুধুমাত্র মহিলাদের উদ্যোগে ও আয়ােজনে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। ওদিকে ঢাকাতে লেখক ও শিল্পীরা ক্ষুব্ধ মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উপস্থিত হন। ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন ড. মযহারুল ইসলাম, শামসুর রাহমান, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বােরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী মহিউদ্দীন ও অন্যান্যরা। তারা দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করে বলেন যে, জনতার যে উত্থান ঘটেছে বুট-বুলেট-বেয়নেট দিয়ে আর তা দাবিয়ে রাখা যাবে না। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, বণিক সমিতি প্রভৃতি সংগঠন অসংখ্য সমাবেশ করে এবং পৃথক পৃথকভাবে ঐগুলাে পূর্ব বাংলার মানুষের দাবি অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানায়।৫২ |

অন্যদিকে ৬ তারিখে প্রেসিডেন্টের ভাষণ প্রচারিত হয় যাতে তিনি উদ্ভূত। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এবং বাঙালিদের আন্দোলনকে কতিপয় ব্যক্তির পাকিস্তান ধ্বংসের প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করে বলেন যে, পাকিস্তানের সংহতি, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। এ পরিস্থিতিতে তারা চুপ করে থাকতে পারে না। ভুট্টোর “ত্রিশক্তি তত্ত্ব আর

————-

৭৫০ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০০), পৃ. ৯৬-৯৭। ৭৫১ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮। ৭৫২. দেখুন, আতিউর রহমান, অসহযােগের দিনগুলি: মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃ. ১০০-১০৩।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যের অপূর্ব মিল লক্ষণীয়। উক্ত বেতার ভাষণের মাধ্যমে মূলত তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকি প্রদান করেন । ভাষণে তিনি ১০ মার্চ সর্বদলীয় বৈঠক এবং ২৫ মার্চ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্যের কথা ঘােষণা করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং পরে টেলিপ্রিন্টারে বার্তা প্রেরণ করেন। এই পর্যায়ে তিনি মুজিবকে অনুরােধ জানান যাতে তিনি এমন কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন যেখান থেকে ফেরা যাবে না।৭৫৩ । | একদিন পর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও নির্দেশনা শােনার জন্যে সমগ্র বাঙালি জাতি উন্মুখ হয়ে ওঠে। একদিকে গত এক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা- জনতার উত্থান, অন্যদিকে পাকিস্তানীদের নানা ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ বাঙালিরা প্রত্যক্ষ করে। স্বাধীনতা। ঘােষণার জন্যে ছাত্র ও যুব নেতাদের অব্যাহত চাপ এবং ন্যাপ (ওয়ালী), ন্যাপ (ভাসানী), চীনপন্থী বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষ থেকে অনুরূপ আকাক্ষা নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তােলে। এর বিপরীতে ইয়াহিয়ার ভাষণ, টেলিফোনে মুজিবের প্রতি আকস্মিকভাবে কিছু না করার আহ্বান এবং টেলিপ্রিন্টারে প্রেরিত বার্তা, সামরিক বাহিনীর কামান ও মেশিনগানগুলাে রেসকোর্সমুখী করে স্থাপন প্রভৃতি ঘটনা গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। বিপরীতমুখী এই দুধরনের আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ঘটাতে না পারলে কিংবা সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে জেগে ওঠা এই জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। করণীয় নির্ধারণের জন্য শেখ মুজিব দলীয় উপদেষ্টাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে দিন-রাত আলােচনা চালিয়ে যান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় আলােচনা স্থগিত রাখা হয়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ভাষণ দেবেন। সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে দুই দিন ধরে এ বিষয়ে একাধিক খসড়া প্রণীত হয়। আবদুস সামাদ আজাদ জানান, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তিনি ও আবদুল মমিন ৭ মার্চের ভাষণের ‘সিনােপসিস’ তৈরির জন্য ধানমণ্ডির ৩১ নং সড়কে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ফজলুর রহমান।

৭৫৩* সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪। প্রেসিডেন্টের ভাষণের জন্য দেখুন, Archer K. Blood, The Cruel Birth of Bangladesh (Dhaka: The University Press Limited, 2002), pp. 169-171.

*. মােঃ শাহজাহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৬-৪৫৭। ” সুকুমার বিশ্বাস, অসহযােগ আন্দোলন ৭১ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ঢাকা: আগামী প্রখাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ১৪৬।

সি.এস.পি-এর বাসায় আলােচনায় মিলিত হয়েছিলেন।৭৫৬ পরিস্থিতির এত দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে যে, শেষাবধি ভাষণের ব্যাপারটি নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। | টান টান উত্তেজনা নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় জনতা বিকেলের নির্ধারিত জনসভায় উপস্থিত হয়। প্রথমে তাজউদ্দীন আহমদ মাইক নিয়ে স্বল্প ভূমিকা শেষ করে বলেন, আপনাদের সামনে এবার জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিকেল ৩ টা দুই মিনিট থেকে ৩ টা ২০ মিনিট পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান আটপৌরে বাংলা ভাষায় এপিকধর্মী যে ভাষণ বাঙালি জাতির উদ্দেশে প্রদান করেন তা এক কথায় বিস্ময়কর অবিস্মরণীয়। শব্দচয়ন, পরম্পরা, শব্দের আবেগময় উচ্চারণ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতির ২৩ বছর ধরে শােষিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন এবং সরাসরি স্বাধীনতার ঘােষণা না দিলেও সকল প্রস্তুতি নিতে বলেন এমনভাবে যে, এক অর্থে এটাকে কার্যত স্বাধীনতা ঘােষণাও (defecto declaratiofi of Independence) বলা যেতে পারে। ৫৮ তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে জাতিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন । ভাষণটা এমনভাবে দেয়া হয় যাতে স্বাধীনতা ঘােষণাজনিত কারণে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ না দেয়া যায়, আবার অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘােষণারও তেমন কিছু বাকি না থাকে। এটা খুব কঠিন কাজ, কিন্তু বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও শৈল্পিকভাবেই তা সম্পন্ন করেন। ঢাকায় কর্তব্যরত মার্কিন কূটনীতিক Archer K Blood এ বিষয়ে যথার্থই মন্তব্য করেন: “Mujib’s speach on Sunday March 7 was more notable for what he did not say than for what he actually said.” বস্তুত মুজিবের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আগামী দিনের গেরিলা যুদ্ধের কৌশল রচিত হয়ে যায়। সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা না করায় অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে হতাশ হন, এটা যেমন সত্য তেমনি রাজনীতি ও কূটনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা পরবর্তীকালে স্বীকার করেন যে, ঐ ধরনের ঘােষণা ছিল চূড়ান্ত বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। কেননা তা করলে নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত জনতাকে সরাসরি আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত একটি নৃশংস

——–

৭৫৬ আতিকুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।

. Archer K Blood, op.cit., p. 173. “. ড. আবুল কাশেম, স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে দু একটি বিষয়ের কিঞ্চিত অবতারণা এ,এইচ,এম, মাসুদ দুলাল (সম্পা.), মাতৃভূমি (জাতির জনকের জন্মদিনে বিশেষ প্রকাশনা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ, ২০০৪), পৃ. ৯৪। *** Archer K Blood, op.cit., p. 172.

বাহিনীর সামনে ছেড়ে দেয়া হতাে মাত্র। তার চাইতে একটি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে প্রাথমিক প্রতিরােধ কিভাবে করতে হবে সে নির্দেশনা তার ভাষণে প্রদান করেন। ভাষণে শেখ মজিবুর রহমান ৪ টি বিষয়ে স্পষ্ট দাবি জানান—(১) সামরিক শাসন প্রত্যাহার, (২) সৈন্যদের ছাউনিতে ফিরিয়ে নেয়া, (৩) গণহত্যার তদন্ত এবং (৪) অবিলম্বে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ।

৭ মার্চের ভাষণের পর অসহযােগ আন্দোলন দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত হয়। এ সময় তাউদ্দীন আহমদেরও কাজ বেড়ে যায় বহুগুণে। তিনি যাবতীয় নীতি নির্ধারণী বৈঠক করতে থাকেন এবং বিবৃতির আকারে ঐগুলাে প্রকাশ করেন। এ পর্যায়ে অসহযােগ আন্দোলনের তীব্রতাও বৃদ্ধি পায়। অসহযােগ আন্দোলনের সহজ অর্থ হচ্ছে আন্দোলনকারি জনগণের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে কোনাে প্রকার সহযােগিতা না করা। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এবং তাজউদ্দীন আহমদের সুদক্ষ। পরিচালনায় যে অসহযােগ আন্দোলন সৃষ্টি হয় তা কেবল অসহযােগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সরকার কাঠামাের বিপরীতে একটা আলাদা প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। সে অর্থে অসহযােগের এক নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। | ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন তাজউদ্দীন আহমদ দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঐগুলাের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, করণীয় ও দিক নির্দেশনাসহ ১৩ দফাভিত্তিক কর্মসূচি প্রদান করেন ঐদিন সন্ধ্যায়। নির্দেশে বলা হয়। ব্যাংকগুলাে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সাধারণ লেনদেনের জন্য এবং অতঃপর ৩ টা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজের জন্য খােলা থাকবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলাের কাজের সুবিধার্থে স্টেট ব্যাংক খােলা রাখতে হবে। জরুরি প্রয়ােজনীয় যেমন- বিদ্যুৎ, কয়লা, সার, বীজ, কীটনাশক এবং এগুলাের পরিবহন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে যথানিয়মে কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। তবে এক্ষত্রে ট্রেজারি কিংবা একাউন্ট অফিসের চালানের মাধ্যমে তা করতে হবে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাসমূহের সাহায্য, পুনর্বাসন কাজ অব্যাহত রাখা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠিপত্র, টাকা-পয়সা পাঠানাের জন্য ডাক ও তার বিভাগ এবং পরিবহন বিভাগকে অব্যাহতভাবে কাজ করে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যান্য জরুরি সেবাসংস্থা যেমন- গ্যাস, পানি, স্বাস্থ্য, নিস্কাশন ব্যবস্থাকে যথানিয়মে কাজ করে যেতে বলা হয়। তাছাড়া শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ বিভাগকে কাজ করে যেতে হবে। এগুলাে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সহায়ক হয়। ফলে অসহযােগ আন্দোলন সকল স্তরের মানুষের সমর্থন লাভের মাধ্যমে সর্বব্যাপী। হয়ে ওঠে । মার্চের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে তাজউদ্দীন আহমদ আরাে সম্প্রসারিত

———–

দেখুন, আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯-১১০।

আকারে ১৫ ও ৩৫ দফাভিত্তিক কর্মসূচি প্রদান করেন যা এক অর্থে একটি বিপ্লবী সরকারের ভিত্তি রচনা করে। এগুলাে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রের নাগরিক জীবনের প্রতিটি খাতকে বিকল্প ধারায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয় এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিকে একটা বিপ্লবী ছাঁচে অভ্যস্ত করার প্রয়াস এতে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। নির্দেশাবলি অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, সরকারি সকল পর্যায়ের পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে যেতে থাকেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়সহ অন্য বিষয়গুলাে সমগ্র বাংলায় তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত দেখাশােনা করার জন্য প্রতিটি শহর, মহল্লা ও গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। নির্দেশ মােতাবেক সরকারি, আধাসরকারি অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, কর প্রদানও স্থগিত করা হয়। ব্যাংক চালু থাকে অভ্যন্তরীণ লেন-দেনের জন্য। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠানাে বন্ধ থাকে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে টেলিফোন, ট্রাংক কল ব্যবস্থা, বিদেশে সংবাদ প্রেরণ বিশেষ ব্যবস্থায় চালু থাকে। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বেতার যােগাযােগ ব্যতীত সকল প্রকার যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায় অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নর ইয়াকুবের পরিবর্তে বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে | পরিচিত টিক্কা খানকে বাংলার গভর্নর হিসেবে পাঠানাে হয়। ৭ মার্চ তিনি ঢাকায় আসেন। পরদিনই তিনি শপথ নিতে চাইলে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে টিক্কা খানকে শপথ করাতে অস্বীকৃতি জানান। LFO অনুযায়ী শপথ অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট প্রদেশের বিচারপতি কর্তৃক পরিচালিত হওয়ার কথা। টিক্কা খানকে শপথ পাঠ করাতে কোনাে বিচারপতি রাজি না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়ােগ দেয়। এদিকে বেতারের বাঙালি কর্মচারীদের বিদ্রোহের মুখে সরকার পরদিন রেডিও কর্তৃপক্ষকে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। কেননা শেখ মুজিবুর রহমান সে ধরনের আহ্বান রেখেছেন। ৮ মার্চ সকালে তা | প্রচার করা হয়। তার আবেগময় এই ভাষণ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধারণ মানুষ উত্তেজনা ও আবেগে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। তার নির্দেশগুলাে তাদের নিকট অপরিবর্তনীয় বলে বিবেচিত হয়। | ৮ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ অসহযােগের প্রথম পর্বের আন্দোলন সফল করার জন্য দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি হতাহত

২২৫

সম্পর্কে সরকারের প্রেসনােটের তীব্র সমালােচনা করে নিমােক্ত বিবৃতিটি প্রদান

করেন; ৭৬১

ইতিহাস রচনাকারী বাংলার দুর্জেয় বীর জনগণকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। ক্ষমতাসীন চক্র শক্তির দ্বারা বাংলার জনগণের ওপর তাদের খেয়াল চাপিয়ে দেবার জন্যে যে হীন অপচেষ্টায় নেমেছে বাংলার বীর জনগণ এক অভূতপূর্ব ঐক্য ও সংকল্পে বলীয়ান হয়ে তাদের সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করে নবতর ইতিহাস রচনা করে চলেছে ।… সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রেসনােটে যে কথা বলেছে আমি তার নিন্দা করছি। প্রেসনােটে হতাহতের সংখ্যা যে কেবল নগণ্য করে দেখানাে হয়েছে তা-ই নয় বরং কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতাে বলা হয়েছে যে, নিহতের সংখ্যা ১৭২ এবং আহতের সংখ্যা অ৮। এই হত্যাকাণ্ড ভীতি ও নিন্দা প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট নয়। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক গুলি চালানাের ফলে কেবলমাত্র লালাদেশের মানুষের মধ্যেই যে অপরিমেয় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে তা নয় বরং সর্বত্রই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের মধ্যেই তা ব্যাপক ক্ষোভের উদ্রেক করেছে । কেবলমাত্র লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের ক্ষেত্রেই গুলি চালানাে হয়েছে বলে প্রেসনােটে যে কথা বলা হয়েছে তা জানা ঘটনাসমূহের বা প্রকৃত ঘটনাসমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বাধিকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে যারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল তাদের মিছিলের উপর গুলি চালানাে হয়েছে ।

পুলিশ আর ই.পি.আর. বাহিনী গুলি চালিয়েছে বলে প্রেসনােটে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যে কথা বলা হয়েছে আমি তার তীব্র নিন্দা করছি। বাঙালির বিরুদ্ধে বাঙালিকে। লেলিয়ে দেবার জন্য এবং বাঙালিদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টির জন্যই গুলি চালনার আহ্বান পুলিশ ও ইপিআর-এর ঘাড়ে চাপানাে হয়েছে। বাঙালিরা আজ সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ ও একক শক্তিতে বলীয়ান হয়েছে এবং এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি ও

সন্দেহ সৃষ্টির কোন প্রচেষ্টাই আজ আর সফল হবে না। প্রকৃতপক্ষে পুলিশ ও বাঙালি ইপিআর যথাসাধ্য আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেয়। এ জন্য একটা পর্যায়ে তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টাও সামরিক কর্তৃপক্ষ করে।। অনুরূপভাবে সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদেরকেও নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালানাে হয়। তাই শুরু থেকেই সামরিক কর্তৃপক্ষ পুলিশ, ইপিআর বাহিনীকে ‘লস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচনা করে অপচেষ্টা চালায় যাতে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ঐ সব বাঙালি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা যায়। সে কারণেই পরবর্তীকালে ২৫ মার্চ কালরাত্রির শুরুতেই বাঙালি ঐ আধাসামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে দেখা যায়।

——-

[৭৬১ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৬-৯৭।

আন্দোলনকারীদেরকে সামরিক কর্তৃপক্ষ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যায়িত করে। অথচ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বরং অসাধারণ | ভূমিকা পালন করে। বলতে গেলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তা ভালভাবেই রক্ষিত | হয়। তবে বিহারী সম্প্রদায়ের প্রতি সকল স্তরের বাঙালির একটা ক্ষোভ পুঞ্জিভূত ছিল। এজন্য কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে তাদের জানমালের ওপর বিক্ষুব্ধ | ত নিতা হামলা চালায়। তাজউদ্দীন আহমদ অবশ্য এ ধরনের কাজ না করার জন্য। * আন্দোলনরত জনতার প্রতি নির্দেশ দেন। বিষয়টি তার ব্যক্তিগত নীতি ও বােধেরও পরিপন্থী । তাই তার বাড়ির পাশেই এ ধরনের একটি ঘটনার কথা | জানতে পেরে তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। তিনি নির্দেশ | দেন, কেউ যেন দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে এ ধরনের কাজ করতে না পারে।৬২ | সংগ্রামরত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও পরিবারগুলােকে সাহায্য দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ | একটি তহবিল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ জনগণের প্রতি আহ্বান জানান আগ্রহীরা যেন কেবলমাত্র নির্দিষ্ট রসিদ গ্রহণের পরে সাহায্যাদি প্রদান করেন। | এ দিকে ১২ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের অপরাপর সকল রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহ, ট্রেড ইউনিয়নসমূহ, লেখক-শিল্পীদের বিভিন্ন সংগঠন, সাংবাদিক ইউনিয়ন চলমান অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। এবং ক্ষেত্র বিশেষে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে গমন করে তাদের করণীয় | বিষয়ে নির্দেশ গ্রহণ করতে থাকে। বস্তুতপক্ষে এ সময় ধানমণ্ডির ৩২ নং রােডের এই বাসভবনটি হয়ে ওঠে অসহযােগ আন্দোলনের তথা বিকল্প প্রশাসনের প্রধান

| প্রদেশটির এমন কোনাে সংস্থা বা সংগঠন ছিল না যা আওয়ামী লীগের | হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরােধিতা করে। মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবকে পুত্ৰতুল্য উল্লেখ করে বলেন যে, শেখ মুজিব মহান সংগ্রামী নেতা। তিনি বা অন্য | কেউ যা পারেননি, শেখ মুজিবুর রহমান তা পেরেছেন। ৯ মার্চ তিনি পূর্ব। পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আবেদন জানান। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি অহিংস অসহযােগের পরিবর্তে সমন্বয়

————

৭৬২, সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃ. ৫২। ৭৬৩ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৮-১৬৯।

মাহমুদউল্লাহ (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র | (১৯০৫-১৯৭১) (ঢাকা: গতিধারা, ১৯৯৯), পৃ. ৩৯৬।

কমিটি গঠন করে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়।৭৬৫ জাতীয় সরকার গঠন করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান জানায় আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, নুরুল আমিনের পি.ডি.পি, প্রভৃতি সংগঠন। উল্লেখ্য, ৯ মার্চ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি একটি জরুরি সভায় মিলিত হয়েও জাতীয় সরকার গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরােধ জানানাের সিদ্ধান্তে পৌছে। এসময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সীমিত পরিসরে হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে। এ বিষয়ে আলী আসগর খান এবং খান আব্দুল ওয়ালী খানের নাম করা যেতে পারে।

মার্চের উত্তাল দিনগুলােতে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার। ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের পাশাপাশি ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। ১১ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন সকল স্তরের মানুষের করণীয় সম্পর্কে কতিপয় নির্দেশনা প্রচার করে। রাজনৈতিক প্রচার অব্যাহত রাখা, সর্বত্রই সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী গঠন, নিজেদের উদ্যোগে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য সুদৃঢ় করার আহ্বান জানায় ঐ সংগঠনটি। এ সময় একটি বেনামি প্রচারপত্রের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধের করণীয় ও কৌশল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় ।৭৬৮

১৩ মার্চ নাগাদ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস, রেলওয়ে, ডাক বিভাগ সকল স্তরের অফিসার ও কর্মচারী সমিতির পক্ষে অসহযােগের প্রতি আনুগত্য স্বীকার সমাপ্ত হয়। ততদিনে প্রদেশের সকল বেসামরিক ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে। কাজেই সার্বিক বিবেচনায় সমাজের প্রায় সকল প্রকার শক্তি ও সংস্থা আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হয়। এ কারণে ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারলেও মফঃস্বলে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের সামরিক সূত্র হতেও জানা যায় যে, অসহযােগ চলাকালে সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব কেবলমাত্র প্রদেশের ৭ টি সেনানিবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এমন কি সামরিক রসদ সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এই অসহযােগ।

———–

৭৬৫ ঐ, পৃ. ৩৮৮-৩৯৩। ৭৬৬. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪। ৭৬৭, মাহমুদউল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০২-৪০৩। ৭৬৮ ঐ, পৃ. ৩৯২। ৭৬৯ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭।

আন্দোলনের সাফল্য সম্পর্কে রেহমান সােবহান ১৩ মার্চ যে প্রবন্ধ লিখেন তা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক । তিনি লিখেন:৭৭০

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যা নজিরবিহীন সেটা হচ্ছে এই যে, ইসলামাবাদের শাসকদলের সঙ্গে অসহযােগিতাটা হয়েছে সামগ্রিক অর্থে। কেননা, গত সপ্তাহে প্রশাসনের কোন ব্যক্তিকেই সরকারের পক্ষে কাজ করতে পাওয়া যায়নি-পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কিংবা মুখ্য সচিব বা চিফ সেক্রেটারি কাউকেই না । আমার জানা মতে সমকালীন ইতিহাসে অন্যকোন দেশেই এরকমটি কখনাে ঘটে নি। এমনও হয়েছে যে, কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হযতাে রুটিনমাফিক তার নিয়ন্ত্রক দপ্তরে কোন সংবাদ পাঠাতে চেষ্টা করেছেন, সেক্ষেত্রে তার অধীনস্থ কর্মচারীরাই সেই কাগজপত্র ছিড়ে ফেলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।

সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র সেক্রেটারিয়েট অচল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বেসমরিক প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কর্মমুখর হয়ে ওঠে। কাজ চালানাের জন্য সচিবালয়ের মতাে একটি অস্থায়ী কাঠামাে গড়ে ওঠে সেখানে। ধানমণ্ডিতে অবস্থিত অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বাসভবন অর্থ সচিবালয় এবং ড. কামাল হােসেনের সার্কিট হাউসের বাড়িটি প্রশাসনের তৃতীয় সচিবালয় হিসেবে কর্মমুখর হয়ে ওঠে। স্বয়ং পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন বেসামরিক প্রশাসনের প্রধান রাও ফরমান আলী খান লিখেছেন “ইডেন বিল্ডিং-এর পরিবর্তে প্রাদেশিক সচিবালয়ের কাজ-কর্ম চলছিল শেখ মুজিবের ধানমনিণ্ডর বাস ভবনে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়েসহ সকল সরকারি বিভাগই আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের নির্দেশাবলি পালন করছিল। সমঝােতা আলােচনায় অংশগ্রহণের জন্য ঢাকায় আগত ইয়াহিয়া খানের জন্য গণভবনের বাঙালি বাবুর্চিরা পর্যন্ত রান্নাবান্নার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। গােয়েন্দা সংস্থাসমূহও ফ্লোর অতিক্রম করেছিল।” মফঃস্বল এলাকাসহ দেশের সর্বত্রই স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যরা যুক্ত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কাজ করতে শুরু করে । সার্বিকভাবে অসহযােগ আন্দোলনের কারণে প্রশাসনিক, আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক বা অন্য কোনাে ক্ষেত্রেই গতি বিঘ্নিত হয় নি। বরং তা আরাে সচল ও বৈপ্লবিক চরিত্র লাভ করে।

—-

৭৭০ রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩। * ৭৭১সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ.৭১-৭২। “৭৭২ রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৩।

৭৭৩রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।

তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হােসেন, ব্লেহমান সােবহান, নুরুল ইসলাম, আমীর-উল-ইসলাম, আবদুল মমিন ও অন্যদের সহযােগিতায় প্রশাসনিক কাঠামাে গড়ে তােলেন।৭৭৪ বিভিন্ন স্থানে তারা প্রতিদিন নিয়মিত মিলিত হয়ে প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাঁদের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার ওপর প্রায় প্রতিদিন তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের অবহিত করতেন। শুধু তাই নয় দলের মাধ্যমে সারা দেশের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দান অব্যাহত রাখেন। অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনায় তিনি হয়ে ওঠেন এর রূপকার ও প্রধান প্রশাসক। পরবর্তীকালে তার এই অভিজ্ঞতা যুদ্ধকালীন নবগঠিত সরকার পরিচালনা করতে প্রভূত পরিমাণে সহায়ক হয়।

ইতঃপূর্বে আওয়ামী লীগ ঘঘাষিত নির্দেশাবলি বাস্তবতার আলােকে পর্যালােচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ ১১ মার্চ কতিপয় ব্যতিক্রমী বিধি বিবৃতি আকারে প্রদান করেন। এতে তিনি চলমান আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিকে সক্রিয় রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন অর্থনীতিকে ধ্বংস এবং ক্ষুধার্ত জনতাকে দুর্দশায় ফেলার জন্য স্বার্থান্বেষী ও গণবিরােধী শক্তিসমূহের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়া হবে না। তিনি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃচ্ছসাধনের প্রয়ােজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন। নির্দেশাবলিতে আরাে বলেন, উপযুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পণ্যাদি ক্রয়ের জন্য সপ্তাহে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যাংক হতে উত্তোলন করতে পারবে। শিল্পোৎপাদন যাতে স্বাভাবিক থাকে সে জন্যই এই ব্যবস্থা। ন্যাশনাল ব্যাংককে অন্য ব্যাংকগুলাের চাহিদা পূরণে রিডিসকাউন্টিং অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। বিদেশি পর্যটক ও নাগরিকরা অবাধে যে কোনাে অনুমােদিত ডিলারের মাধ্যমে নগদ বিনিময় করতে পারবেন।৭৫

এদিকে আসন্ন বিপদের কথা অনুধাবন করে বিদেশি দূতাবাসগুলাে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে শুরু করে। এমনকি জাতিসংঘের মহাসচিব ঢাকা থেকে কর্মকর্তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। ফলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে আতংকের সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এমতাবস্থায় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের তীব্র সমালােচনা করে বিবৃতি দেন।৭৭৬ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে পূর্ব বাংলা

৭৭৪. Nurul Islam, Making of a Nation-Bangladesh: An Economist’s Tale (Dhaka: The University Press Limited, 2003), ৭৭৫.. পথ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৭-১৯০।

*. আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি ১৯৫৩-১৯৯৩ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিেিটড, ১৯৯৬), পৃ. ১৯৩।

৭৩০

পরিস্থিতি সম্পর্কে যখন বিপদের আশংকা বিরাজমান তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা আগমনের ঘােষণা প্রদান করেন। এর জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন যে, ইয়াহিয়াকে একজন অতিথি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। তার আপ্যায়ন ও নিরাপত্তা বিধান মুজিবের নেতৃত্বাধীন বিকল্প সরকারের দায়িত্ব। সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রেসিডেন্ট ভবনের জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের পুনঃসংযােগ দেয়ার অনুরােধ করা হলে আন্দোলনকারীরা সেগুলাে দিতে অস্বীকার করে।৭৭৭ এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে পশ্চিমের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার ইঙ্গিত প্রদান করা হয়। অবশ্য বাস্তবে পশ্চিমের কোনাে কর্তৃত্বই আর অবশিষ্ট ছিল না। এমতাবস্থায় আন্দোলন বানচাল করে দেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ নানা চেষ্টা চালায়। ১২ মার্চ রেডিও পাকিস্তান থেকে একটি সংবাদে বলা হয় ভুট্টো সমঝােতার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট একটি তারবার্তা প্রেরণ করেছেন। এ ধরনের সংবাদকে তাজউদ্দীন আহমদ ভিত্তিহীন, দুঃখজনক ও উদ্দেশ্যমূলক বলে মন্তব্য করেন এবং বিভ্রান্তি অপনােদনের চেষ্টা

চালান।৭৭৮

ইতিহাসের বিরল ঘটনা হিসেবে দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটে ১৪ মার্চ। এ উপলক্ষে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানান। কর্মসূচিকে আরাে সম্প্রসারিত করে অব্যাহত রাখার জন্য ১৪ তারিখেই তিনি আরাে কিছু কর্মসূচি পেশ করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যে গৌরবােজ্জ্বল অসহযােগ আন্দোলনের দ্বিতীয় সপ্তাহ সমাপ্ত হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে এবং সেক্রেটারিয়েটসহ সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে পালনের জন্য তিনি আরাে কিছু নতুন কর্মসূচি নির্দেশাবলির আকারে বিশদভাবে উল্লেখ করেন। এই পর্যয়ে চলমান আন্দোলনকে আরাে বেগবান করার লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ সর্বমােট ৩৫ দফার আরাে একটি কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এগুলাের মাধ্যমে প্রদেশের সকল প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটসমূহ, সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহ, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশস্থ সকল কোর্টকে হরতাল পালন করতে এবং বর্ণিত বিশেষ নির্দেশাবলি ও

————-

৭৭৭ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩। ৭৭৮ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ মার্চ, ১৯৭১। “” ৭৭৯ আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫।

. দৈনিক পূর্বদেশ, ১৫ মার্চ, ১৯৭১, সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৬-২১৩।

বিভিন্ন সময়ে যে সব ছাড় বা ব্যতিক্রম ব্যাখ্যা দেয়া হবে তা সবই মেনে চলার জন্য বলা হয়। বর্ণিত নির্দেশাবলিতে বলা হয় বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসকরা প্রচলিত নিয়মে অফিস না খুলে অসহযােগ আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ নির্দেশনা অনুযায়ী নিজ নিজ কর্মস্থলে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে কাজ করবেন। আনসার বাহিনীর সদস্য এবং জেলখানার ওয়াডাররা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সড়ক, রেল ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কেবলমাত্র সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহন ব্যতীত সকল কাজ যথারীতি করে যাবে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিবহনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। শুল্ক বিভাগকে আদায়কৃত শুল্ক নির্দিষ্ট ব্যাংকে জমা করার নির্দেশ দেয়ার সাথে বলা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে আদায়কৃত অর্থ কেন্দ্রে না পাঠিয়ে নির্দিষ্ট ব্যাংকে বিশেষ একাউন্টে জমা করতে হবে । অনুরূপভাবে দেশের অভ্যন্তরে ডাক ও টেলিযােগাযােগ এবং ব্যাংক ও বীমা অফিসগুলােকেও পরিবর্তিত নির্দেশনানুযায়ী কাজ করে যেতে বলা হয়। বেতার, টিভি ও সংবাদপত্র অসহযােগের সকল প্রকার সংবাদ পরিবেশন করবে। আরাে বলা হয়। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎসহ জরুরি সেবা সংস্থা কাজ করে যাবে যথা নিয়মে, এবং সকল প্রকার মেরামতি ও সংরক্ষণমূলক কাজ অব্যাহত থাকবে। সে লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। জেলা হাসপাতাল, টিবি ক্লিনিক, কলেরা রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ সকল হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য সেনিটেশান সার্ভিসগুলাে যথারীতি কাজ করে যাবে। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স কাজ করে যাবে। এবং সকল হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রয়ােজনীয় ওষুধপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী। সরবরাহ অব্যাহত রাখবে। ধান ও পাটবীজ, সার ও কীটনাশক ক্রয়, চলাচল ও বণ্টন যথারীতি চলতে থাকবে। কৃষি খামার ও চাল (ধান) গবেষণা ইনস্টিটিউট ও এর। সকল প্রকল্প স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করে যাবে। দুর্গত এলাকার ত্রাণ কাজ, খাদ্য মজুদ, কৃষিঋণ প্রদান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সকল প্রকার। নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে । সকল প্রকার কর্মজীবীর বেতন ও পেনশন দান করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ ও সংস্থা যথানিয়মে কাজ করে যাবে। ব্যাংকগুলাে সকাল। ৯ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত লেনদেনের কাজ এবং ৪ টা পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজের জন্য খােলা থাকবে। উপযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সপ্তাহে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা। পর্যন্ত দেয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে অতীত অর্থ উত্তোলনের হার পরীক্ষা করতে হবে । ঠিকাদারি কিংবা অন্য কাজের জন্য এর চেয়ে বেশি প্রদান করতে হলে উপযুক্ত সংস্থার সার্টিফিকেট প্রয়ােজন হবে। তবে বিদেশি নাগরিক ও কূটনৈতিক মিশনগুলাে অবাধে তাদের একাউন্টের কাজ পরিচালনা করতে পারবেন। নির্দেশগুলাে যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব দেয়া হয় সংগ্রাম কমিটির ওপর।

বস্তুত ১৫ মার্চ থেকে অসহযােগ আন্দোলন একটি সুসংগঠিত বিকল্প ধারার সরকার ব্যবস্থায় উন্নীত হয়। উপরিউক্ত নির্দেশাবলির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ। প্রদেশের বেসামরিক সকল স্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করে এবং প্রদেশের সকল মানুষকে একটি অভিন্ন ব্যবস্থায় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। গৃহীত ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর হওয়ার ফলে প্রমাণিত হয় যে, বিকল্প প্রশাসনের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এমন অনিশ্চিত ব্যবস্থা কতদিন চলবে তা অজানা। তাজউদ্দীন আহমদ ১৫ মার্চ বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল সংগ্রাম নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সর্বোচ্চ সাফল্যের লক্ষ্যে অধিকতর ত্যাগ স্বীকারে সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা সংগ্রাম দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন হতে পারে । ৩৫ দফা নির্দেশাবলিতে এ ধরনের পরিস্থিতি মােকাবিলার একটি প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায় ।

প্রদেশে এত ব্যাপক কিছু ঘটে চলা সত্ত্বেও তথাকথিত সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের সামান্যতম ইঙ্গিতও লক্ষ্য করা যায় না। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন যে, তিনি মুজিবের সঙ্গে শিগগিরই দেখা করবেন এবং এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে মুজিব খুশি হবেন। ১২ মার্চ ইয়াহিয়া খানের ঢাকা আগমনের। বিষয়ে সংবাদ পাওয়া যায়। ঠিক এমন সময় পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো আর একটি ফর্মুলা বের করে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির হাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হােক। তার ফর্মুলায় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির কোয়ালিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। তার এ ধরনের বক্তব্যে খােদ পশ্চিম পাকিস্তানেই সমালােচনা শুরু হয়। সেখানকার অনেক নেতা বলেন যে, কেন্দ্রে আওয়ামী লীগেরই ক্ষমতায় যাওয়া উচিত।”৭৮১ বস্তুতপক্ষে ভুট্টো এ সময় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তার উক্ত প্রস্তাবের সমালােচনা করে পাকিস্তানের কোনাে কোনাে নেতা ও সামরিক কর্তাব্যক্তি বলে থাকেন যে, ভুট্টোর এই প্রস্তাব রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ছিল।

মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনার অন্তরালে পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি

এমতাবস্থায় ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একদল উপদেষ্টা সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসে প্রদেশের উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন।

৭৮১আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৬। ৭৮২ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪।

উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা, জেনারেল রাও ফরমান আলী খান, এয়ার কমােডর মাসুদ ও অন্যরা। আলােচনা। শুরু হয় সামরিক বিষয়াদির ওপর। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি এই আলােচনায় স্থান পায়নি।৭৮৩ তবে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খারাপ আচরণের মাধ্যমে শীতল মনােভাব বুঝিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি স্থির করেন যে, মুজিবের দিকে কড়া করে তাকাবেন আর দুপুরের আহারের জন্য প্রথামাফিক তাকে নিমন্ত্রণ করবেন না। | ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া ও মুজিবের মধ্যে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী প্রথম আলােচনাটি অনুষ্ঠিত হয়। এসময় শেখ মুজিবুর রহমান ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার কারণে পূর্ব বাংলায় কী কী ঘটনা ঘটেছে তা। ইয়াহিয়া খানকে অবহিত করেন। আলােচনা শেষে বের হয়ে আসার পর সাংবাদিকের কাছে মুজিব জানান, তার যা বলার বলে এসেছেন, এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা ইয়াহিয়া খানের। তবে আলােচনা চলতে বাধা নেই।

পরদিন সকালে মাত্র ১ ঘন্টা আলােচনা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের অকস্মাৎ বের হয়ে আসা দেখে বিস্মিত সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন। তাকে। অধিক প্রশ্ন না করার জন্য সাংবাদিকদের অনুরােধ করেন। তিনি বলেন, এটা এক দু’মিনিটের আলােচনার বিষয় নয়। আলােচনা চলছে, চলবে । পক্ষান্তরে জানা যায় সেদিন শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে কারণে খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন । সিদ্দিক সালিক। জানান যে, মুজিব ও ইয়াহিয়া উভয়েই ঐদিন খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন। এরপর ইয়াহিয়া খান সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য টিক্কা খানকে নির্দেশ দেন। টিক্কা খান ঐ দিন রাতেই জি.ও.সি খাদিম হােসেন রাজাকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ প্রেরণ করেন। পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জনসংযােগ কর্মকতা মেজর সিদ্দিক সালিকের সূত্র উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন:

মূল অপারেশনাল পরিকল্পনার খসড়া প্রণয়নের জন্যে ১৮ ই মার্চ জি.ও.সি অফিসে | মেজর জেনারেল খাদিম (হােসেন) রাজা ও মেজর জেনারেল ফরমান বৈঠকে বসেন। তারা এই ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌছেন, অপারেশন ‘ব্লিৎস’ এর আর।

————–

৭৮৩, সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২। ৭, ঐ, পৃ. ৭৩। ৭৮৫ ঐ, পৃ.৭৪। ৭৬, ঐ, পৃ.৭৩।

* ঐ, পৃ. ৭৫।

প্রয়ােজন নেই।…ঐ বৈঠকেই জেনারেল ফরমান হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল। প্যাডের উপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিলে নতুন পরিকল্পনাটি লিপিবদ্ধ করেন। আমি জেনারেল ফরমানের নির্দোষ হাতে মূল পরিকল্পনাটি দেখেছিলাম। পরিকল্পনাটির দ্বিতীয় অংশটি লেখেন জেনারেল খাদিম। তাতে প্রাপ্ত সমর সম্ভারের বণ্টন ও বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের কর্মধারা ভাগ করে দেয়া হয়েছিল ।… পাঁচ

পৃষ্ঠাব্যাপী এই পরিকল্পনাটির নামকরণ করা হল অপারেশন সার্চলাইট’। ১৮ মার্চ সিদ্দিক সালিক অপারেশন সার্চ লাইট প্রণয়নের কথা বললেও এর প্রণেতা রাও ফরমান আলী খান বলেন যে, ২৩ মার্চ বাঙালিরা যখন পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে কেবল তখনই এই পরিকল্পনা করা হয়। এ ছাড়াও সর্বব্যাপী আক্রমণ চালানােকে বৈধকরণের জন্য পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্টরা বলেন যে, বাঙালিরা অবাঙালিদেরকে হত্যা ও নির্যাতন করছিল—অর্থাৎ একটা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেই চলছিল না। সুচতুরভাবে তারা বলেন, রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই কেবল সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।৭৮৮ কিন্তু এই বক্তব্য সঠিক নয়, পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ তার প্রমাণ। মনে রাখা দরকার অপারেশন সার্চলাইট ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণেতা রাও ফরমান আলি তার গ্রন্থে বারবার বলতে চেয়েছেন যে, পাকিস্তানের এই বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক নেতা ও পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকারী কতিপয় সামরিক অফিসার যাদের পূর্ব বাংলা সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না, তারাই দায়ী। পূর্বাহ্নেই সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানের অন্য একটি সূত্র হতে জানা যায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে কেন্দ্রে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। বরং বাঙালিদের। বিচ্ছিন্নতাবােধের বিষয়ে তারা আরাে বেশি সচেতন হয় এবং সম্ভাব্য অভ্যন্তরীণ গােলযােগ দমনের উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনী ব্লিৎস নামক একটি অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বস্তুত ১৯৭০ সালের শেষের দিকে। বলা হয়ে থাকে প্রথম সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছিল। মনে রাখা দরকার পাকিস্তানের এই সেনাবাহিনী ১৯৭০ সালের সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাসের সময় কোনভাবে বাঙালির সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কাজেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’ তৎকালীন পূর্ব বাংলা সম্পর্কে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের, ক্ষেত্রবিশেষে কোনাে কোনা রাজনীতিবিদের অবিশ্বাসের ধারাবাহিক ও পরিণত চক্রান্তমূলক পরিকল্পনা, যার অর্থ হচ্ছে বাঙালিরা ভােটে বিজয় লাভ করে

———–

৭৮৮ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ.৮০। ৭৮৯ মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১-৬৩।

২৩৫

বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তা দমন করা। একাত্তরের অসহযােগের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে তাদের ধারণা জন্মে আরাে ব্যাপক-

বিস্তৃত এবং সর্বব্যাপী দমন। অভিযান পরিচালনা না করলে পূর্ব বাংলায় তাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা অসম্ভব । এর প্রমাণও পাওয়া যায় কোনাে কোনাে সামরিক অফিসারের ভাষ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ চাইনে, মাটি চাই জাতীয় মন্তব্য থেকে। কাজেই অপারেশান সার্চলাইট আকস্মিক এবং কেবলমাত্র সাময়িক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে প্রণীত কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। এটা ছিল একটি জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়ার নীলকশাবিশেষ।

১৮ মার্চ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোনাে বৈঠক হয়নি । ঐ দিন একদিকে যখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ প্রয়ােগের হিসেবনিকেশের কাজ শুরু করে, অন্যদিকে তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তৎপরতা শুরু হয়। এ সময় প্রবীণ নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রাম সফর করছিলেন। পাকিস্তান বাহিনী কী ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা দেখে আসার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে সেখানে যাওয়ার জন্য তিনি বলেন। পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে অনুমান করা যায় কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি মুজিবকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন । কিন্তু ঢাকার পরিস্থিতি এমন ছিল যে মুজিবের সেখান থেকে নড়ার কোনাে সুযােগ ছিল না। এমতাবস্থায় মােশতাক আহমদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী ও আবিদুর রেজাকে (জাতীয় পরিষদ সদস্য) ভাসানীর নিকট প্রেরণ করা হয়। এর দু-তিন দিন পরে ঢাকায় কোনাে একটি বাড়িতে ভাসানীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। | জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার পরেই আওয়ামী লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় যদি সামরিক ব্যবস্থা বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে প্রতিবেশি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হয়। মার্চ মাসের ৬ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ গােপনে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে,সি, সেনগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অতি সত্বর দিল্লির মনােভাব জানানাের প্রতিশ্রুতি দেন। তাজউদ্দীন আহমদকে। এর পরেই কে.সি. সেনগুপ্ত দিল্লি যান। ১৭ মার্চ তিনি ফিরে এলে পরদিন ১৮ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ আবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

——–

৭৯০ ঐ, পৃ, ৮০।

৭৯১ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ৭১ এর দশ মাস (ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ৪৭।

কে.সি. সেনগুপ্ত জানান যে, যদি বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বড় ধরনের আঘাত হানে তাহলে ভারত সরকার যথাসাধ্য করবে। সাহায্যের প্রকৃতি কেমন হবে সে বিষয়ে আলােচনার জন্য পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত হয় ২৪ মার্চ। কিন্তু সে সময় ঘটনাপ্রবাহের এমন উত্তেজনাকর অগ্রগতি ঘটে যে, ঐ সাক্ষাৎ আর অনুষ্ঠিত হয়নি।৭৯২

পূর্ব বাংলার ঘটনাপ্রবাহে বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সােভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম উদ্বেগ প্রকাশ করে। ঢাকাস্থ সােভিয়েত কনসাল পেট্রভ ভলটিন ১৯ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সােভিয়েত সরকারের এই উদ্বেগের কথা জানান। শেখ মুজিবুর রহমান এ ধরনের সহানুভূতির কথা জানতে পেরে সোভিয়েত সরকারের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। | ১৯ মার্চ আবার মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলােচনার এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তাব দেন যে, সংকট সমাধানের জন্য প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হােক। শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেন যে, তার আগে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। মুজিব ইয়াহিয়াকে আরাে অবহিত করেন, আওয়ামী লীগ সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছে। এবং সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তা পেশ করা হবে। আলােচনা শেষে সংবাদিকদের মুজিব বলেন, তিনি সব সময়ই আশাবাদী তবে খারাপ কিছুর জন্যও প্রস্তুত। একই দিন দুপক্ষের উপদেষ্টাদের মধ্যেও ২ ঘণ্টাস্থায়ী আলােচনা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে উপস্থিত থাকেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড. কামাল হােসেন। বিপরীতপক্ষে উপস্থিত থাকেন বিচারপতি এ.আর. কর্নেলিয়াস, প্রেসিডেন্টের স্টাফ অফিসার পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। আলােচনা শেষে তাজউদ্দীন আহমদ অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে আলােচনার ভিত্তিতে তারা কতিপয় প্রাথমিক বিষয়ে পর্যালােচনা করেছেন। তবে আলােচ্য বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে কোনাে কিছু বলা হতে বিরত থাকেন।৯৬

তি

———

৭৯২. মাহবুব করিম (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ নেতা ও মানুষ (ঢাকা: প্রকাশনী, ২০০২), পৃ. ৮০। ৭৯৩, নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩। ৭৯৪ ঐ, পৃ. ১০২। ৭৯৫ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩০। ৭৯৬ ঐ, পৃ. ২৩৮।

কথিত সমঝােতা আলােচনা যখন সাধারণ মানুষের মনেও সন্দেহ জাগায় তখন ১৯ মার্চ ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে সাধারণ জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। জনতা জানতে পারে যে, বাঙালি সেনা সদস্যদেরকে নিরস্ত্র করা হচ্ছে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। ঐ দিন ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেব আরবার জয়দেবপুর থেকে ঢাকার দিকে আসার চেষ্টা করলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুল্লাহ ও শ্রমিক নেতা আবদুল মােতালেবের নেতৃত্বে ব্যারিকেড জোরদার করে। তারা সামরিক মালামালবাহী ট্রেনও আটকে দেয়। সামরিক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করলে বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ নিহত হয়।৭৯৭

মূলত জয়দেবপুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা সচেতন হয়ে যায় । তারা পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করে। এর মধ্য দিয়েই আগামী দিনের মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ অনেকটা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তাই জয়দেবপুরের ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এটিকে মুক্তিযুদ্ধের উপক্রমণিকা বলা যেতে পারে।

কোন্ প্রক্রিয়ায় চলমান সংকট কাটিয়ে ওঠা যায় সে বিষয়ে কোনাে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা গৃহীত হওয়ার পূর্বেই জয়দেবপুরের ঘটনা উভয়পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস আর দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। এমতাবস্থায় ২০ মার্চ উভয়পক্ষের উপদেষ্টাসহযােগে আলােচনা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় পরিণত হয়। প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি জানানাে হয় । ২০ তারিখের এই আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে উপস্থিত হন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান, মােশতাক আহমদ, ড. কামাল হােসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের, উপদেষ্টাদের মধ্যে এ বৈঠকে উপস্থিত থাকেন এ.কে, ব্রোহী, কর্নেলিয়াস ও পীরজাদা ।৭৯৮ আলােচনা শেষে বিদায় নেয়ার সময় বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের শেখ মুজিবুর রহমান তার বাড়িতে আসতে বলেন। সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হলে উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এবং– অস্পষ্ট)-সমঝােতায় উপনীত হওয়ার জন্য আলােচনা চলছে এবং তা অব্যাহত

—————

নবম খণ্ড, পৃ. ২২৩-২২৬। মেজর জেনারেল কে,এম, শফিউল্লাহর ৭৯৭ দলিলপত্র, সাক্ষাৎকার । \ ী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদ,

থাকবে। পরবর্তীকালে ড. কামাল হােসেনের সূত্র হতে জানা যায় যে, ঐ দিন আলােচনায় সমস্যা সমাধানে শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল।

২০ মার্চ সকালে ছাত্র ইউনিয়নের ৫০০ জনের একটি সুসজ্জিত গণবাহিনী। ১০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এতে সাধারণ মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা ও সাহস বেড়ে যায়। ১৮ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান বাহিনীর হামলার ব্যাপারে সকল মহলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছিল। সুতরাং আলােচনায় যে কোনাে লাভ হবে না এবং শেষ পর্যন্ত একটা সংঘাত যে ঘনিয়ে আসছে তা সাধারণ মানুষও অনুধাবন করে ।

কোনাে এক সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব ব্যবস্থা মােতাবেক মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে একটি অসাত স্থানের উদ্দেশে রওনা দেন। এ বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন আবদুস সামাদ আজাদ ও ন্যাপের আবদুল জলিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়নি। কারণ ভাসানী উক্ত বাড়িতে অবস্থান না করে সরাসরি টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হন। আবদুস সামাদ আজাদের উদ্দেশ্যে একখানি চিঠি লিখেন টাঙ্গাইলে চলে গেলাম, তুমি এসে দেখা কর। মুজিবকে বলবে সাক্ষাতে আলােচনার সুযােগ হলে ভাল। তবে সে যেভাবে চলছে তার বাইরে যেন • যায়। যাহােক ভাসানী হয়তাে ঐ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঢাকায় সাক্ষাৎ করাকে সঠিক বলে মনে করেন নি। কেননা তার নিজ পক্ষীয় ন্যাপের কোনাে কোনাে নেতার সঙ্গে চলমান আন্দোলনকে সমর্থন করা না করা নিয়ে বিরােধ উপস্থিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেখা যায় তার দলের সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া চীন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেন। এমনকি তিনি সানীকে ভারত থেকে কোনভাবে বের করে আনা যায় কিনা সে চেষ্টাও করেন। কিন্তু শুরু থেকেই ভাসানী চলতি পর্যায়ের আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলকে সমর্থন দেন। তিনি ৯

————–

৭৯৯ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ২৬৮-২৬৯। ড. কামাল হােসেনের সাক্ষাৎকার ।

সায়েরা সালমা বেগম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৭-৩০৮। | নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬। ৮০২ আতিকুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯-৬০। ৮০৩ মশিউর রহমান যাদু মিয়া সবসময়ই বিরােধী দলের মধ্যে পাকিস্তান সরকারের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন। ষাটের দশকে এ ধরনের একটি ঘটনার জন্য দেখুন, S.A. Akanda, “The Working of Ayub Constitution and the People of Bangladesh’, The Journal of the Institute of Bangladesh Studies (IBS), Vol. IV, 1979-80, pp. 83-116.

মার্চ পল্টন ময়দানে আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি স্বাধীনতার ঘােষণা না দেয়ার প্রেক্ষিতে অনেকে হতাশ হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় পল্টনের ঐ জনসভায় মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করতে পারেন বলে অনেকের ধারণা জন্মেছিল। এই পরিস্থিতিতে ঐ দিন সকালে শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন নেতাকে তার নিকট প্রেরণ করেন। তারা মওলানাকে অনুরােধ করেন তিনি যেন স্বাধীনতা ঘােষণা না করেন। তিনি তাদের যুক্তির সঙ্গে একমত হন।৮০৪

২১ মার্চ ইসি খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের মাপ এসিডেন্ট ভবনে অনির্ধারিত একটি বৈঠক হয়। দেড় ঘণ্টাস্থাসী এই আলােচনার সময় মুজিবের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদও অংশগ্রহণ করেন। এই আলােচনার পর ভুট্টো নাকি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তার সহকর্মীদের নিকট মন্তব্য করেন যে, ভবিষ্যতে এই তাজউদ্দীনই হবেন তাদের জন্য বড় সমস্যা। এ বিষয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করার মতাে। তিনি লিখেছেন,

নজউদ্দীনকে পাকিস্তানিরা বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সহকর্মীরা কি ভয় করতেন তার একটা ঘটনা বলি। ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলির কথা। ভুট্টোও এসেছেন ঢাকায়। আছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে । কড়া মিলিটারি পাহারা । আমরা কজন বাঙালি সাংবাদিক তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়েছি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে আলােচনা করছিলেন। এক সময় আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে উর্দুতে বলে উঠলেন: আলােচনা বৈঠকে আমি মুজিবকে ভয় পাই না । ইমােশনাল এপ্রােচে মুজিবকে কাবু করা যায়। কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে ‘নটরিয়াস’ লােকটি বসে থাকে, তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি মেইন প্রবলেম।’ আমি বলছি এই তাজউদ্দীন হবে তােমাদের জন্য বড় সমস্যা। আমি সংগে সংগে নােট বইয়ে কথাটা লিখে নিলাম। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি

কথাটা কতবড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাঁড়াবে। বৈঠক শেষে বের হয়ে এসে নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের জানান যে, ইতঃপূর্বের আলােচনার সূত্র ধরে কতিপয় শাসনতান্ত্রিক বিষয়ে ব্যাখ্যার জন্য তারা

——–

৮০৪, ঐ, পৃ. ৫৮। ৮০৫ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৯। ৮৬ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগষ্ট পঁচাত্তর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ৪১-৪২।

২৪০

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনা করেছেন। তারা তাকে জানিয়ে আসেন যে, আগামী | ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্র পৌছে দেয়া হবে। দলের শীর্ষ | পর্যায়ের নেতা ও উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েক দফা আলােচনা-পর্যালােচনার পর

খসড়া শাসনতন্ত্রটি প্রণীত হয়। আওয়ামী লীগের উক্ত শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলায় | প্রথমত সামরিক আইন প্রত্যাহার করে আপাতত ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে কেন্দ্রে | অসামরিক সরকার গঠন করা, দ্বিতীয়ত প্রদেশগুলােতে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ

দলগুলাে কর্তৃক সরকার গঠন করা এবং তৃতীয়ত পরিষদের বাইরে পূর্ব ও | পশ্চিমাঞ্চলের সদস্যরা পৃথক পৃথক বৈঠকে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা অথবা সে বিষয়টি বিবেচনা আনবে মর্মে প্রস্তাব দেওয়া হয়। | পৃথক মুদ্রা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম.এম. আহমেদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পৃথক ব্যবস্থা মেনে | নেয়ার জন্য ইয়াহিয়াকে বলেন যে, সমস্যার সমাধান করতে হলে পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নিতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক সমাধানের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া ও তার অন্য উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় এই বলে যে, সামরিক শাসন তুলে নিলে ইয়াহিয়া কিসের ভিত্তিতে ক্ষমতায় থাকবেন কিংবা কোন্ ক্ষমতাবলে তিনি জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করবেন? আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বুঝানাের চেষ্টা করা হয় যে, এটা কোনাে সমস্যা সৃষ্টি করবে না। এসব প্রশ্নে উভয় পক্ষের মধ্যে বিতর্ক বেধে যায়। এদিকে ভুট্টো প্রেসিডেন্টকে ফোন করে জানিয়ে দেন যে, তাকে বাদ দিয়ে কোনাে সমঝােতা হলে তিনি তা মানবেন না।১০

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোকে ঢাকায় আসার জন্য অনুরােধ করেন। এমতাবস্থায় ভুট্টো প্রায় ১৬ জন উপদেষ্টা-সঙ্গী ও বিশেষ নিরাপত্তাকর্মী নিয়ে ২১ মার্চ ঢাকায় এসে পৌঁছেন অনেকটা হলিউডের গ্যাংস্টারের আদলে। আওয়ামী লীগ ভুট্টোকেও অতিথি হিসেবে গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা তার নিরাপত্তা ও অন্যান্য দায়িত্ব গ্রহণ করে বুঝিয়ে দেয়

—————

৮০৭ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৮। bor Nurul Islam, op.cit., pp. 95-96.

আতিকুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮-৬৯। সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৭।

Archer K Blood, op.cit., p. 190. ৮১২ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৮।

যে, পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে সামরিক । কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর নির্ভর করতে পারেনি। তাই । বিমানবন্দর থেকে সামরিক বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় যেভাবে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাকে আনা ও প্রহরার ব্যবস্থা করা হয় তাতে অনুমান করা স্বাভাবিক যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসনে তার কর্তৃত্ব ইয়াহিয়ার চেয়ে কোনাে অংশে কম নয়।

ভুট্টোর ঢাকা আগমনের কিছু পূর্ব হতে পশ্চিম পাকিস্তানের অপরাপর নেতারাও এসে পৌছেন এবং মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সবমিলিয়ে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যাতে মনে হয় সমস্যা সমাধান অথবা চরম সংকট অত্যাসন্ন। কিন্তু এসবই ছিল লােক দেখানাে ব্যাপার যা বুঝতে অনেকের একটু সময় লাগে। বস্তুত ১৮ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা প্রণীত হলেও আরাে কিছু সময়ের প্রয়ােজন দেখা দেয়। বস্তুত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব আর্মি স্টাফ গােপনে পূর্ব বাংলার সেনানিবাসগুলাে পরিদর্শন করে অপারেশন প্রস্তুতি সম্পর্কে অবহিত করেন। পূর্ব বাংলার চলমান অসহযােগ আন্দোলনকে তখন পর্যন্ত অনেক পশ্চিম পাকিস্তানি। নেতাই বুঝে উঠতে পারেননি। তারা মনে করেন এটা হচ্ছে কতিপয় শহুরে মানুষের চায়ের কাপে ঝড় তােলার মত ব্যাপার, সামরিক বাহিনী সামান্য শক্তি প্রয়ােগ করলেই তা দমে যাবে।

২২ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বস্তুত এটি ছিল। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার ষষ্ঠ দফা বৈঠক। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিবকে বলেন যে, তার সঙ্গে যেসব আলােচনা হয়েছে তা ভুট্টোকে অবহিত করেছেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মুজিবের সঙ্গে কি আলােচনা হয়েছে এবং প্রকৃতই। ভুট্টোকে সে বিষয়ে অবহিত করেছেন কিনা সে বিষয়ে একটু ফাক থেকে যায়। ইতােমধ্যে প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব তাকে জানিয়ে দেন যে, তার ৪ দফা দাবি পূরণ করা না হলে তিনি অধিবেশনে যােগদান করবেন না। কাজেই সম্ভবত তাকে শান্ত করার জন্য ২২ মার্চ জাতীয় পরিষদের আহূত অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি আতঙ্ক বিরাজমান ছিল। তারা অনুমান করে যে, প্রেসিডেন্ট যদি অধিবেশন স্থগিত না করে তাহলে সামরিক শাসন আরাে কঠোরতর করে ধরপাকড় শুরু করা হতে পারে। এমনকি নির্বাচনের ফল বাতিল

——–

৮১৩ ঐ, পৃ. ৬৭।

এমতাবস্থায় পরিষদের

করা হতে পারে বলেও অনেকের ধারণা জন্মে।৮১৪ অধিবেশন স্থগিত হওয়ায় জনমনে কিছুটা স্বস্তি আসে।

যদিও পাকিস্তান বাহিনীর ধ্বংস ক্ষমতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম ধারণা ছিল না, তদুপরি শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সত্যই যথাসাধ্য ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠতে থাকে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাে বটেই, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলােও প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে দেশি অস্ত্র ও কৌশল প্রশিক্ষণ জোর তালে এগিয়ে চলে । ২২ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণকারী বাঙালি কর্নেল ও আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্য এম. এ. জি. ওসমানী অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার হাতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে একখানি তরবারি তুলে দিয়ে তাদের আনুগত্যের কথা জানান।”৫ কর্নেল ওসমানী ব্রিটিশ আমলে সামরিক বাহিনীতে রিক্রুট হওয়া সর্বোচ্চ পদমর্যাদার বাঙালি সামরিক অফিসার ছিলেন। চিরকুমার ও সুশৃঙ্খল প্রকৃতির এই সামরিক অফিসার শুধুমাত্র বাঙালি হওয়ার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বৈষম্যের শিকার হন। তার অব্যবহিত পরের উত্তরসূরি জেনারেল রাও ফরমান আলী খান এ সম্পর্কে যথার্থই লিখেছেন:

বিগত আট বছর ধরে ডিডিএমও পদটিতে ছিলেন কর্নেল ওসমানী, একজন পূর্ব পাকিস্তানী । পরবর্তীকালে তিনি যদিও মুক্তিবাহিনীর জেনারেল হয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে তাকে পদোন্নতি পাওয়ার যােগ্য বলে বিবেচনা করা হত । তিনি বাঙালি ছিলেন এবং সম্ভবত উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা তাকে বিশ্বাস করতেন। । দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি রীতিমতাে আতংকিত হয়ে গেলাম, এ কথা জেনে যে, তাকে কোন ফাইলপত্র দেখতে দেয়া হয় না, এমনকি চাপরাশিরা পর্যন্ত তাকে অবজ্ঞা করে চলে। তার অফিস ঝাড় দেয়া হয়

না, অফিসটি নিষ্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন, অকার্যকর এবং সর্বোতভাবে উপেক্ষিত। সুতরাং চাকরি জীবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা ও ক্ষোভ জন্মেছিল। তারপর ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও অন্যদের নিয়ে তিনি বাঙালি সৈন্যদেরকে সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগের মনােনয়নে জাতীয় পরিষদের

——

৮১৪ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১২।

ঐ, পৃ. ১১২ এবং সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৮। রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২-১৩। সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬-২৭।

সদস্য নির্বাচিত হন। অসহযােগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তার তৎপরতাও বৃদ্ধি করেন।৮১৮ তবে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের তৎপরতার ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা বেশ সতর্ক ছিলেন। বস্তুত চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে নেতৃত্ব দেয়ার মতাে বাঙালি অফিসারদের কৌশলে বন্দী করা হয়, অথবা নিরস্ত্রীকরণ কিংবা ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেখা যায়। যেমন ২০ মার্চ কৌশলে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে মেজর জেনারেল মজুমদারকে ঢাকায় এনে বন্দি করা হয়। তদস্থলে নিয়ােগ দেয়া। হয় জানজুয়াকে। আগরতলা মামলার আসামি কমান্ডার মােয়াজ্জেমকে ২৫ মার্চ রাতেই হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনী। প্রদেশের ৭টি সেনানিবাসেই বাঙালি সৈন্যদের উক্ত কায়দায় নিষ্ক্রিয় করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় ।

২৩ মার্চ অসহযােগ আন্দোলনের সর্বোচ্চ বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। পাকিস্তানে ২৩ মার্চ জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হতাে। এবার এর কয়েক দিন পূর্বে ২৩ মার্চকে শেখ মুজিবুর রহমান লাহাের প্রস্তাব দিবসের স্মরণে প্রতিরােধ দিবস ও সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা প্রদান করেন। অসহযােগের প্রেক্ষিতে বাঙালিদের নিকট দিবসটি আলাদা তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। সকল অফিসআদালত ও ভবন চূড়া হতে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে তদস্থলে পূর্বোক্ত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। দোকান-পাট, গাড়ি, বাড়ি, অফিসআদালত, সকল সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে এই পতাকা শােভা পায়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ভবনেও বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়। এর মধ্য দিয়েই জনগণের নিকট পাকিস্তানের মৃত্যু এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ২৩ তারিখের এই উত্থান সম্পর্কে The People পত্রিকা লিখে A New Flag is Born। এ সম্পর্কে সিদ্দিক সালিকের পর্যবেক্ষণটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত । তিনি লিখেছেন:৮১৯

পাকিস্তানের পতাকা তখন মাত্র দুটি স্থানে দেখা গেল। একটি উড়ছিল গভর্নর। হাউসে ও অন্যটি সামরিক আইন সদর দফতরে । কিছু দুষ্টু ছেলে গভর্নমেন্ট হাউসের পশ্চিম প্রবেশ দ্বারে বাংলাদেশের একটি ছােট্ট পতাকা সেঁটে দিয়েছিল। কিন্তু সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রতীক হয়ে তখনাে প্রধান ভবনের শীর্ষে পাকিস্তানের পতাকা পত পত করে উড়ছিল । অবশ্য তাকে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছিল ।

——

৮১৮ আতিকুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭-৩৮। ৮১৯ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯।

ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাসগুলােতে, যেমন ব্রিটিশ হাইকমিশন ও সােভিয়েত কনস্যুলেট অফিসেও বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখা যায়। অবশ্য চীনা দূতাবাসে পাকিস্তানের পতাকা প্রথমে উড়তে দেখা গেলেও আন্দোলনকারীরা তা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।৮২০ একই ঘটনা ঘটে নেপাল, ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসেও। বিতর্ক এড়াবার জন্য ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে কোনাে পতাকাই উত্তোলন করা হয়নি। পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় আকাশ কাপানাে জয় বাংলা স্লোগান। তাই বলা যেতে পারে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের যে অন্তঃসারশূন্য ভাবদর্শিক জন্ম হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ( ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগের গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণেও ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করা যায়। তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। একজন বাঙালিও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙালিরা শান্তিপূর্ণভাবে যে অধিকার আদায় করতে চেয়েছিল, প্রয়ােজন হলে সে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত। তার এ ধরনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, শান্তিপূর্ণভাবে অধিকার আদায়ের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে এবং সশস্ত্র সংঘাত অত্যাসন্ন।

পূর্বদিন ২২ মার্চ ড. কামাল হােসেনের অফিসে প্রণীত শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলােচনার জন্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সদস্য ও উপদেষ্টারা একটি জরুরি আলােচনায় মিলিত হন। পূর্ব প্রতিশ্রুতি মােতাবেক ২৩ তারিখ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের ৩ জন নেতা যেমন- তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ড.কামাল হােসেন প্রেসিডেন্ট ভবনে গমন করেন এবং শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবটি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের নিকট হস্তান্তর করেন।২৫ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম.এম. আহমেদ ও

—————

৮২০ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৮। ৮২ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬০।

Archer K Blood, op.cit., p. 192. ৮২৩ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬০। ৮২৪ আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবটির জন্য দেখুন, আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯-১৬৩।

২৪৫

অন্যরা আওয়ামী লীগের উক্ত নেতাদের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন। এ সময় বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি গাউস বক্স বেজেঞ্জো ও পাঞ্জাব কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সরদার শওকত হায়াত খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।৮২৫

একই দিন বিকেলে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে একটি আলােচনায় মিলিত হন। তারা ছিলেন: ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, জমিয়াতুল ওলামায়ে পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মওলানা শাহ আহমদ নুরানী। অপরদিকে আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ড. কামাল হােসেন ও অন্য নেতৃবৃন্দ। তবে ঠিক কোন বিষয়ে আলােচনা হয় তা জানা যায় না ।। ( ২৩ মার্চ ঢাকাসহ প্রদেশের অন্যান্য স্থানে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা বেধে যায়। ঢাকার মীরপুর, মােহাম্মদপুর, কুষ্টিয়া, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা, সৈয়দপুর প্রভৃতি স্থানে দাঙ্গা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র বােঝাইকৃত সােয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছালে দারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। অসহযােগের নির্দেশ মােতাবেক বাঙালি কুলিরা ঐগুলাে খালাস করতে। অস্বীকৃতি জানায়। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তা খালাস করতে চাইলে। সাধারণ মানুষ প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তােলে। সামরিক বাহিনী বাধাদানকারী জনতার ওপর গুলি চালালে অনেক মানুষ নিহত হয়। ফলে সেখানে এবং পর্যায়ক্রমে ঢাকা ও অন্যত্র এই সংবাদ মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ।

পাকিস্তানের জন্মের পর বিহারী সম্প্রদায় ভারত থেকে পূর্ব বাংলায় এসে বসবাস শুরু করেছিল। তারা সরকারের সমর্থনে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাধানাের চেষ্টা করতাে। তাদের চলন-বলনে প্রকাশিত হতাে যেন তারাই পাকিস্তানের সৃষ্টির জন্য মূল ভূমিকা পালন করেছে এবং এর প্রকৃত রক্ষক ও শুভাকাক্ষী তারাই। বাঙালিদের প্রতি তাদের বিদ্বেষভাব সুবিদিত। সুতরাং ১৯৭১ সালে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা যখন শুরু হয় তখন উভয় সম্প্রদায়ই পরস্পরকে চরম আঘাত হানার চেষ্টা করে। তাদের সহযােগিতায় বিভিন্ন আবাসিক এলাকা থেকে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাদা পােশাকধারী সদস্যরা অকস্মাৎ হানা দিয়ে ধরে এনে হত্যা করতে শুরু করে ।

৮২৫ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬১।

এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও অসহযােগ আন্দোলনের রূপকার তাজউদ্দীন আহমদ তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন:

সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে সামরিক তৎপরতার খবর আমি উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি । রংপুরে বেপরােয়া গুলিবর্ষণ ও অসংখ্য হতাহতের খবর পাওয়া গেছে এবং সেখানে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে। মীরপুরে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই সকল কার্যক্রম অস্বাভাবিক ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে যখন রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে, তখন এই সকল অবাঞ্ছিত তৎপরতার দ্বারা পরিবেশকে বিষাক্ত করে তােলা হচ্ছে। আমরা আবারও জানিয়ে দিতে চাই যে, একটা রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হওয়ার প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে

তার পরিণতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা তা করতে দেবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার প্রতিবাদে এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে ২৭ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। | ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ড. কামাল হােসেন প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়ে বিচারপতি কর্নেলিয়াস, এম, এম, আহমেদ, লে.জে, পীরজাদা ও কর্নেল হাসান এর সাথে আলােচনায় মিলিত হন। আলােচনাটি চলে প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা ধরে । সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কর্তৃক উপস্থাপিত সাংবিধানিক খসড়া প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক নিয়ে এখানে আলােচনা হয়। আলােচনা শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যা বলার তা সমাপ্ত হয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পালা প্রেসিডেন্টের। আলােচনা দীর্ঘদিন চালানাের বাস্তবতা আর নেই। কেননা বিলম্বের কারণে পরিস্থিতি আরাে ভয়াবহ রূপ ধারনের আশংকা রয়েছে । সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আর কোনাে আলােচনায় বসতে ইচ্ছুক কিনা? এর জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন। যে, তাদের প্রস্তাবিত বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যার জন্য প্রেসিডেন্ট বা তার উপদেষ্টারা চাইলে এ ধরনের আলােচনা হতে পারে। তবে সে জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা

————-

৮২৬ আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৯। ** ৮২৭ সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৪-২৬৫। ৮২৮ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৮। *** সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৬।

করা সম্ভব নয়। বল এখন তাদের কোর্টে। যা বলার তারাই বলবেন— প্রেসিডেন্টকে এখন তার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করতে হবে।৮৩০ এরপর উভয়পক্ষের মধ্যে আর কোনাে আলােচনা হয়নি। ড. কামাল হােসেনের সূত্র থেকে জানা যায়, তারা প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আহ্বান সম্বলিত টেলিফোনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু তা কখনাে আসেনি।৮৩১

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের উক্ত প্রতিনিধিদল আলােচনা শেষে বিদায় নেয়ার পর ভুট্টো, পীরজাদা ও অন্যদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান মিলিত হন। তারা একমত। হন যে, আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসন থেকে সরে এসে শাসনতান্ত্রিক ভাঙ্গনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাঙালির উত্তুঙ্গ প্রত্যাশার রাশ টেনে ধরার ক্ষমতা সম্ভবত কারই তখন ছিল না। প্রদেশটিতে সকল স্তরের মানুষ এবং প্রায় সকল। রাজনৈতিক দল আর স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট নয় স্বাধীনতার চেয়ে কম কিছু তারা মানতে রাজি নয়। বস্তুত মার্চের ২ তারিখ থেকেই স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য। বিভিন্ন স্তর থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তথা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রবল চাপ ক্রমাগত বেড়ে চলে। অপেক্ষাকৃত তরুণ অংশটি এ বিষয়ে এগিয়ে থাকে। সে তুলনায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বরং অত্যন্ত ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সামান্যতম সুযােগও হাত ছাড়া করতে চাননি। এর কারণ হচ্ছে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যেন বিশ্ববাসীর নিকট আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে প্রতিপন্ন করার সুযােগ না পায়। এর পক্ষে আর একটা যুক্তি এই যে, পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা পাকিস্তানের জনসংখ্যার মােট ৫৬ ভাগ এবং নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তারা নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। সুতরাং কোনােভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘিষ্ঠদের থেকে বিছিন্ন হতে পারে না, সেটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে জন্মকাল থেকে পাকিস্তান প্রচলিত সংখ্যালঘু সমস্যার। পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমস্যায় ভুগছিল। এটা হয় শাসকগােষ্ঠীর কর্তৃত্ববাদী ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে। এতদঞ্চলকে তারা উপনিবেশ মনে না করে। যদি ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করতে পারতাে তাহলে এই সংকট এত দ্রুত নাও সৃষ্টি হতে পারতাে।

যাহােক, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭-৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা থেকে

———–

৮৩০ নাজিমুদ্দীন মানিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২১। ৮৩, ড. কামাল হােসেনের সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ২৭৮। ৮০২. সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০।

১৯৭১ সালের ১৬-২৪ মার্চ পর্যন্ত সমঝােতা প্রচেষ্টা সম্পর্কে নিলিখিত তথ্য জানা

যায়৩৩,

১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অনুসরণে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাবলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিয়ে সামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে। জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন ও কেন্দ্রীয় সরকার তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রদেশসমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা প্রথমে পৃথকভাবে মিলিত হবেন, পরে পরিষদের পূর্ণ অর্থাৎ যুক্ত অধিবেশনে সংবিধানের চূড়ান্ত রূপদান করা

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে সকল আলােচনা শেষে ২৪ তারিখে উক্ত সিদ্ধান্তে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। ২৫ তারিখে চূড়ান্ত অধিবেশন হওয়ার বিষয়ে তারা সম্মত হন। | ১ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় যা ঘটে তার প্রেক্ষিতে জনতার চাওয়াকে আওয়ামী নেতৃত্বের উপেক্ষা করে যেনতেন প্রকারে সমঝােতায় উপনীত হওয়াও অসম্ভব। মুজিব এ সময় মানুষের চাওয়াকে কেবল তুঙ্গে তুলতে পারেন, তিনি সামান্যতম ইঙ্গিত দিলে হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু স্বাধীনতার দাবি থেকে সরিয়ে আনার ক্ষমতা তার ছিল না। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান বাহ্যত সামরিক বাহিনীর প্রধান ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেও প্রকৃত ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন ভুট্টো। তার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে কোনাে সমঝােতায় উপনীত হওয়ার ক্ষমতা ইয়াহিয়ার ছিল না। তিনি নির্বাচন পরবর্তীকাল থেকে যা কিছু করেন তার সবই ভুট্টোর ইচ্ছা অনুযায়ী হয় । ১৬ মার্চ থেকে যে অভিনয়ের আলােচনা শুরু হয় তাও ভুট্টোর ইচ্ছায়। কেননা চরম আঘাত হানার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়ােজন ছিল। বাহ্যত বিশাল ক্ষমতাধর দুজন ব্যক্তি, যাদের হাতে চলতি সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে; ১৬ মার্চ থেকে তারা যে আলােচনা শুরু করেন তা কোনাে প্রকার সুফল বয়ে আনা ছাড়াই চরম পরিণতি বরণ করে। আজ এটা প্রমাণিত যে, সমস্যা সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলদের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনা

——

৮৩৩ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ২২২-২২৩।

ছিল বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটনের লক্ষ্যে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে সাজানাে নাটকবিশেষ।৮৩৪

| ২৪ তারিখ তাজউদ্দীন আহমদ স্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেন, সমঝােতার জন্য আর বিলম্ব করা সম্ভব নয়। তিনি সামরিক কর্তৃপক্ষকে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের পক্ষে প্রকাশ্য মন্তব্য করা না হলেও দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতারা ২৪ তারিখ থেকে একে একে ঢাকা ত্যাগ করতে শুরু করেন। এ লক্ষণ অনেকটা ঝড়ের পূর্বে পাখিদের ঘরে ফেরার মতাে। পশ্চিম পাকিস্তানি এসব নেতা তখন মুজিব, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলােচনা করেন মূলত সংঘাত এড়াবার জন্যে। তাদের এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে G.w Choudhury এর মন্তব্যটি বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন: “…They could only discuss the post mortem of the Dacca dialogues.” অন্যদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের নির্দেশ পৌছে দেয়া শুরু করে । সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এই পর্যায়ে আসলে আর করার কিছু ছিল না।

অন্যদিকে ২৪ মার্চ অসংখ্য মিছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে আসতে থাকে। তিনি প্রায় সবগুলাের সামনে কিছু সময়ের জন্য হলেও উপস্থিত হন এবং বলেন লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। কখনাে বলেন, আরাে প্রচণ্ড সংগ্রামের আদেশ দেওয়ার জন্য আমি বাচিয়া থাকিব কিনা জানি না, কিন্তু আপনারা নিজেদের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম। চালাইয়া যাইবেন।’ ২৫ মার্চ সকাল হতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে সব নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন কিংবা টেলিফোন করেন তাকেই সরে পড়তে কিংবা নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বলেন। এ সময় তিনি অনেকটা তার অকাল পরিণতি মেনে নেন এবং নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ করেন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী রেহমান সােবহান লিখেছেন “বঙ্গবন্ধুর আচরণে তাঁকে বরং অদৃষ্টবাদী মনে হচ্ছিল, কারণ তিনি যেন তার

৮৩৪. W G.W Choudhury, The Last Days of United Pakistan (Dhaka: The University Press Limited, 1998), p. 180. ** ৮৩৫. আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৯। ৮৩৬, সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০। 599 G.W Choudhury, op.cit., p. 178.

সুকুমার বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৮। রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭।

২৫০

সম্ভাব্য অকাল পরিণতিকে মেনেই নিয়েছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন নতুন প্রজন্ম এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে।”

২৫ মার্চ সন্ধ্যায় খবর আসে যে, ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন।৮৪০ বস্তুত অসহযােগের নেতারা ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগের পূর্বেই এই খবর পেয়ে যান। সূচিত আলােচনা সমাপ্ত না করে কিংবা চলতি সমস্যার শাসনতান্ত্রিক কোনাে সমাধান না দিয়ে ঢাকা ত্যাগের অর্থ বুঝতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কোনাে অসুবিধা হয় না। বস্তুত ইয়াহিয়া খান নির্দেশ দিয়ে যান যে, তার বিমান লাহােরের ৪০ মাইল সীমানার মধ্যে পৌছার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। চরম ব্যবস্থা গ্রহণের বা এ্যাকশান শুরু করার চূড়ান্ত সময় নির্ধারিত হয় ২৫-২৬ মার্চের জিরাে আওয়ার । | শেখ মুজিবুর রহমান হাইকমান্ড সদস্যদেরকেও অনুরােধ করেন সরে পড়ার জন্য। আত্মগােপন করার প্রয়ােজন হতে পারে এমন অনুমানের প্রেক্ষিতে নেতারা কেউ কেউ পুরানাে ঢাকার একটা বাড়ি কয়েকদিন আগেই দেখে এসেছিলেন। এটি ছিল সিরাজুল ইসলাম এম.পি.এ-এর একটি গােপন আস্তানা। কিন্তু নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সকলের অনুরােধ উপেক্ষা করে নিজ বাড়িতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । তিনি এর যুক্তি হিসেবে বলেন যে, তাকে না পেলে আর্মিরা ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে। এও বলেন, তার বাড়ির আশপাশে গুপ্ত। ঘাতকরা অবস্থান নিয়েছে। তিনি বাড়ির বাইরে গেলেই তাকে হত্যা করে চরমপন্থীদের ঘাড়ে এর দায় চাপানাে হবে। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ, ড.কামাল হােসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এবং আরাে অনেকেই জিদ ধরেন যে, মুজিব আত্মগােপনে না গেলে তারাও কেউ তা করবেন না। এমতাবস্থায় তিনি তার অনুগামীদের এক প্রকার জোর করে অতি দ্রুত তার বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেন। যাহােক মুজিব আত্মগােপনে যেতে সম্মত না হওয়াকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে অনেক রকমের বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ৩ টি বিষয়কে মনে রাখলে সুবিচার করা হবে। প্রথমত তিনি যেটা বলেছিলেন সেটাই ছিল যথার্থ । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবাদিকদেরকে দেয়া প্রথম সাক্ষাৎকারেও একই যুক্তি ব্যক্ত করেন। দ্বিতীয়ত মুজিব কখনাে আত্মগােপনের রাজনীতি

———–

৮৪০ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮১-৮২। ৮৪১ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩। ** এইচ.টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৪), পৃ. ২৭৯। ৮৩ আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৮৬।

করেননি।৮৪৪ পাকিস্তানের জন্মের পর যতবার সরকার তাকে বন্দি করেছে। | ততবারই মুক্তি পেয়েছেন ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নিয়ে। এ ধরনের আকাশ-ছোঁয়া জনপ্রিয়তা নিয়ে শুধু দৈহিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আত্মগােপনে যাওয়া সম্ভবত তার অহংবােধেও বাধে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, আলােচনাচলাকালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্য ও রসদ আনা হতে থাকে। ২৫ মার্চ তিনি সংবাদ পান যে, চট্টগ্রামে সােয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাস করতে বাঙালিরা প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে । মুজিব এ সংবাদ শুনে বলেন “অস্ত্র দিয়ে বাংলার মানুষকে দমন করা যাবে না । আমি এবং আমার

পরিবারবর্গকে হত্যা করলেও তারা সাত কোটি বাঙালিকে হত্যা করতে পারবে | না।”৮৪৫ তৃতীয়ত মুজিব আত্মগােপন করলে ভারতে যাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল বলে

মনে হয় না। সেটা করলে আগরতলা মামলা থেকে শুরু করে পাকিস্তান সরকার | তার বিরুদ্ধে যে অভিযােগ উত্থাপন করে এসেছে সেটাই আন্তর্জাতিক কূটনীতিক মহলে সত্য বলে প্রমাণিত হতাে। মুক্তিযুদ্ধে মুজিবের স্ট্র্যাটেজিক এই কৌশল ছিল সম্ভবত অপরিবর্তনীয়।

অসহযােগ আন্দোলনচলাকালে মুজিবের নেতৃত্বে যে Defecto প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়েছিল তার যাবতীয় বিষয় পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগ | হাইকমান্ডের অধীনে রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী ও আমলাদের কয়েকটি বলয় গড়ে | ওঠে। এতে সর্বশীর্ষে ছিলেন বঙ্গবন্ধু । পরবর্তী স্তরে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও অন্যান্যদের সমন্বয়ে একটি হাইকমান্ড। বুদ্ধিজীবীদের বলয়ে ছিলেন, রেহমান। সােবহান, ড. কামাল হােসেন, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর-উল| ইসলাম ও অন্যরা এবং প্রশাসনের বিভিন্ন বাঙালি কর্মকর্তা যারা পক্ষ ত্যাগ করে | আওয়ামী লীগের বিকল্পধারার প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। | বুদ্ধিজীবী ও আমলাদের নিয়ে কয়েকটি সেল গঠন করা হয়, যেগুলাের প্রত্যেকটির | সমন্বয়ক ও মধ্যমণি হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট ধীশক্তি, ধীর-স্থির, সৃজনশীল ও বৈপ্লবিক মননশীলতার পরিচয় দেন। আমীর-উল-ইসলামের বক্তব্যে এর সমর্থন পাওয়া যায়:৮৪৬

———

৮৪৪ এম.এ মােহাইমেন, ঢাকা আগরতলা মুজিবনগর (ঢাকা: পাইওনিয়ার পাবলিকেশান্স, ১৯৮৯), পৃ. ৬৭। ৮৪৫ ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও শেখ মুজিব (ঢাকা: আগামী | প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ১৩৩। | ৮৪৬ আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৮১-৮২ ।

বঙ্গবন্ধুর মনের কথা তাজউদ্দীন আহমদের জানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ইঙ্গিতই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্যের খসড়া আমরা রচনা করে। দিতাম । নেতার নির্দেশ অনুযায়ী তা করা হতাে তাজউদ্দীন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে কান পেতে কথা শুনতেন। একজন নিখুঁত শিল্পীর মতাে আমাদের রচিত খসড়াগুলি তিনি শুনতেন।… অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মােকাবিলার তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি

ছিল তাজউদ্দীন আহমদের। তার এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে যুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট সহায়ক হয়। একইভাবে রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও আমলাদের বলয়টি তাকে নানাভাবে সহযােগিতা প্রদান করে। আওয়ামী রাজনীতির মধ্যে অপেক্ষাকৃত তরুণ অংশ যারা অধিকাংশই ছাত্র-যুবক, তাদেরকে নিয়েও আর একটি বলয় গড়ে ওঠে। আন্দোলনে তরুণতর অংশটির ওপর এদের প্রভাবও লক্ষণীয়। তারা। অধিকতর বিপ্লবপন্থী, মূল নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বিষয়ে এগিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগ্রহী এবং অনেক পূর্ব থেকেই স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি চাপ প্রয়ােগ করেন। স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিষয়টিও এক্ষেত্রে বিবেচনার দাবি রাখে। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতিগত অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও বাঙালির শৃঙ্খল-মুক্তির ব্যাপারে তারা যথেষ্ট অবদান রাখেন।

বাংলাদেশ সরকার গঠন

অসহযােগের পরে প্রকৃতই কি ঘটতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে নেতাদের তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। তবে পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন অসহযােগের সময় ইয়াহিয়া খানের সামরিক উপদেষ্টা লে. জে, পীরজাদার নিকট টিক্কা খান কর্তৃক প্রেরিত চরম ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কিত গােপন বার্তাটি তার হাতে এসে পৌছেছিল। এটি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করেন। যাহােক, নেতাকে আত্মগােপনে সম্মত করাতে না পেরে তাজউদ্দীন আহমদ তার সাত মসজিদ রােডের বাড়িতে পৌছে স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে বলেন যে, তিনিও আত্মগােপন করবেন না; বন্দিত্ব গ্রহণ অথবা পাকিস্তান বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করবেন। এ সময় তার মেজাজ আরাে খারাপ হয়ে যায় তার সংগৃহীত রাইফেল ও

———

৮৪৭ মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১ (ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিেিটড, ১৯৮৬), পৃ. ৯।

পিস্তলটি খুঁজে না পাওয়ার কারণে।৮৪৮ অল্প পরে ড. কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে তাকে দ্রুত বের হবার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। অগত্যা তিনি অনেকটা সশস্ত্র অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত তাজউদ্দীন আহমদের এক হাতে ছিল একটা ছােট ব্যাগ এবং কাঁধে একটি রাইফেল, রীতিমতাে মুক্তিযােদ্ধার অবয়ব।*** অল্প পরে এ ধরনের অবয়বে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, বনে-বাদাড়ে অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধাকে দেখা যায়। তাদের গাড়িটি অনতি দূরের মােড় অতিক্রম না করতেই বিপরীত দিক থেকে সামরিক বাহিনীর লােকেরা এসে তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তল্লাশি চালায়। আবদুল আজিজ বাগমারের অবাঙালি স্ত্রী বেগম আতিয়ার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় জোহরা তাজউদ্দীন ও তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানরা রক্ষা পান। অন্যদিকে তারা বাড়ি হতে বের হওয়ার পূর্বেই কুমিল্লা হতে নির্বাচিত একজন এম.পি. এ. এসে জানান সামরিক বাহিনী বাঙালি ইপিআর অধ্যুষিত পিলখানা আক্রমণ করেছে। কাজেই দ্রুত কোথায় আশ্রয় গ্রহণ করা জরুরি। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ড. কামাল হােসেন তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়ার কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে যান। তার যুক্তি ছিল তিনজন একত্রে থাকা ঠিক হবে।

। এপ্রিলের ৪ তারিখে সেনাবাহিনী তার আশ্রয়স্থল ঘেরাও করলে তিনি মিঠঠা। খানের নিকট ধরা দিতে বাধ্য হন। তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে কারাবন্দী করে রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর। সঙ্গে ১০ জানুয়ারি ‘৭২ স্বদেশে ফিরে আসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, সম্ভবত ড. কামাল হােসেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্রোহীর জামাতা হওয়ার সুবাদে সেনাবাহিনীর লােকেরা তার স্ত্রী ও কন্যাদেরকেও পাকিস্তানে নিয়ে যায়। এদিকে জনৈক মুসার গাড়িতে করে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলাম কোনমতে লালমাটিয়া পর্যন্ত পৌঁছেন। রাস্তায় মােহাম্মদপুরে পূর্ব পরিচিত রেল ইঞ্জিনিয়ার আবদুল গফুরের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। এর পাঁচ-সাত মিনিট পরেই চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার সিগন্যাল স্বরূপ প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণের ঝলকানির সঙ্গে ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে। শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্রের গর্জন। চারদিকে

৮৪৮ আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭। স্মরণীয় আবদুল আজিজ বাগমার সে সময় তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকতেন অবাঙালি স্ত্রী আতিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। ** আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৮৭। ৮৫০ মুহাম্মদ নুরুল কাদির, দুশাে ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা (ঢাকা: মুক্ত প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ, ৬১২।

এসবের আড়ালে মানুষের আর্ত চিৎকার মিশে বাতাস ভারি করে তােলে। ঘটনার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায় তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েন। শহরে কি ঘটছে তা আঁচ করার জন্য তারা বাড়ির দোতলা ছাদে রাখা বালি, সুরকি ও ইটের পাশে অবস্থান নেন। মাঝে মধ্যেই যুদ্ধাস্ত্রের নীলাভ আলাের ঝলকানি দেখতে এবং মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার ও বােমাবর্ষণের শব্দ শুনতে পান। এর ফাঁকে ফাঁকে প্রতিরােধকারীদের ৩০৩ রাইফেলের গুলির শব্দ এবং ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি ভেসে আসে। আবার অবাঙালি অধ্যুষিত মােহাম্মদপুর এলাকা থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিও শােনা যায়। এভাবে সারা রাতই তারা ঐ ছাদে অবস্থান করেন। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটছিল তা সবই ছিল তাদের অনুমানের বিষয় মাত্র। এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন:৮৫২

মধ্যরাতের দিকে ব্রাশফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দিন আহমদ বলে ওঠেন, এবার দস্যুরা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করছে। এ সময় তিনি কেঁদে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু কি তার বাসা থেকে বেরিয়েছেন? বঙ্গবন্ধু যখন কোন অবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে অসম্মত হন, তখন আমাদের সর্বশেষ অনুরােধ ছিল তার বাড়ির পেছনে জাপানিদের অফিসে যেন তিনি চলে যান।… এক সময় আমরা দুজন ছাদ থেকে নেমে এলাম। শুধু ভাবছি আর ভাবছি। এমনিভাবে রাত ভাের হতে

চলল । চারদিক থেকে গুলির শব্দ আসছে । শরীর ও মন অবসন্ন হয়ে উঠছে। সাধারণ নিরীহ জনতার ওপর এ ধরনের নারকীয় এবং একটি পূর্ণমাত্রার সামরিক আক্রমণ চালানাে হতে পারে তা নেতারা কল্পনাও করতে পারেননি। তাদের ধারণা ছিল বড়জোর রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও ধরপাকড় হতে পারে। পরিস্থিতির ভয়াবহতায় তাজউদ্দীন আহমদ বিমূঢ় হয়ে পড়লেও করণীয় নির্ধারণে মােটেও বিলম্ব করেননি। অবিরাম আক্রমণ ও সান্ধ্যআইন বলবৎ করার কারণে বের হতে না পেরে তারা পরবর্তী রাতও গফুর সাহেবের বাসায় থাকতে বাধ্য হন। এ সময় তিনি স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ক্ষীণ একটা যােগাযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং তাদের প্রয়ােজনীয় কিছু নির্দেশ প্রদান করেন। তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, যে কোনভাবেই হােক পাকিস্তান বাহিনীর নজিরহীন নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে। তারা যথাসাধ্য নিজেদের চেহারা পরিবর্তন ও ছদ্মনাম

————

৮৫২, আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৮৯। ৮৫৩ আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০-১৮১। এ বিষয়ে আমীর-উল-ইসলামের সূত্র হতে জানা যায় যে, ঐ বাড়ির কাছেই ছাত্রদের একটি মেস ছিল। তারা রেডিওর। মাধ্যমে সংবাদ জানার চেষ্টা করেন। তাদের মাধ্যমেই এলাকার কোন কোন নেতার সঙ্গে। একটা ক্ষীণ যােগাযােগ স্থাপন ও নির্দেশ প্রদান করেন।

২৫৫

ধারন করে মফঃস্বল পথে অগ্রসর হতে থাকেন।৮৫৪ তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলামের যথাক্রমে নামকরণ হয় মহম্মদ আলী ও রহমত আলী । অল্প পরে তারা এই নামে ভারতে প্রবেশ করেন। | ২৬ মার্চে তারা সামনের মেসে অবস্থিত ছাত্রদের রেডিও হতে ইয়াহিয়ার ক্ষুব্ধ ভাষণ শুনতে পান। এই ভাষণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেশদ্রোহী’ এবং আওয়ামী লীগকে ‘নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের নিকট থেকে তারা আরাে অবহিত হন যে, অস্ট্রেলিয়া রেডিও রাতে “পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর আক্রমণের সংবাদ প্রচার করেছে। ৫ ২৭ মার্চ সান্ধ্য আইন ও অবিরাম গােলাগুলি চলা সত্ত্বেও খুব সতর্কতার সঙ্গে বাজার করতে যাওয়ার বেশে তারা সাত মসজিদ রােডের পাশ দিয়ে অনির্দিষ্ট পথে দ্রুত এগিয়ে যান। তখন পর্যন্ত তারা জানতেন না গত দুদিনে তাদের পরিবার পরিজনের কি হয়েছে, তারা মৃত নাকি জীবিত? সাত মসজিদ রােড পার হতে গিয়ে নিজ পরিবার পরিজনের কথা ভেবে তাজউদ্দীন আহমদের চিত্ত উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। রাস্তায় পড়ে থাকা এক টুকরাে কাগজে তিনি স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে একটি ছােট্ট চিরকুট লিখেন, যাতে ফুটে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার গভীর উপলব্ধির কথা। লিখেন “লিলি, আমি চলে গেলাম। যাবার মুহূর্তে কিছুই বলে আসতে পারি নাই, মাফ করে দিও। ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও, কবে দেখা হবে জানি না… মুক্তির পর।” | ঢাকা ত্যাগের পূর্বে বিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি শেখ মুজিব, অন্যান্য নেতা সর্বোপরি শহর সম্পর্কে ভাসাভাসা সংবাদ সংগ্রহ করেন। শেখ মুজিব সম্পর্কে আত্মগােপন এবং গ্রেফতার দুরকমেরই সংবাদ জানা যায়। অন্য নেতাদের সম্পর্কে সংবাদ পান যে, তারা প্রায় সকলে আত্মগােপন করেছেন এবং কেউ কেউ ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে গেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব নির্ধারিত স্থানে লােক পাঠিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেন যে, বঙ্গবন্ধু সেখানে যাননি। কাজেই তার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা ত্যাগ করে অবিলম্বে বিকল্প পথানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন। আপাতত তার লক্ষ্য দোহার-নবাবগঞ্জ পথে পদ্মা নদী পার হয়ে ক্রমাগত

————

৮৫৪ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৯০।

৮৫৬ ঐ, পৃ. ৯১-৯২।

মাহবুবুল করিম বাচ্চু (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতি এ্যালবাম (ঢাকা: পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস, ১৯৯৭), পৃ. ১৯। ৮৮ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৯১।

ফরিদপুর-কুষ্টিয়া সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পথে তারা ঢাকা থেকে গ্রামের দিকে পলায়নপর জনস্রোতের সঙ্গে মিশে যান। অসংখ্য দৃশ্যের মধ্যে রাস্তায় সংগ্রাম কমিটির অসংখ্য তেজদীপ্ত নেতা-কর্মীর প্রতিরােধ কর্মকাণ্ডও প্রত্যক্ষ করেন। বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধ যুদ্ধের নেতা-কর্মীকে করণীয় বিষয়ে নির্দেশ দিতে দিতে তারা ক্রমাগত ভারত সীমান্তের দিকে এগিয়ে যান। কয়েকজন নির্বাচিত পরিষদ সদস্যের সঙ্গেও তাদের সাক্ষাৎ হয়। তাজউদ্দীন আহমদের মতাে একজন নেতার সাক্ষাৎ পেয়ে তাদের মনােবল অনেক বেড়ে যায় । সঙ্গী আমীর-উলইসলাম কুষ্টিয়া জেলার বাসিন্দা হওয়ার কারণে তাদের গতি অনেকটা সেদিকেই। কোথাও পায়ে হেঁটে, কোথাও সাইকেল-মােটর সাইকেল বা নৌকায়, কোথাও বা ঘােড়ার পিঠে করে তারা এগিয়ে যান। মফঃস্বলের এসব অঞ্চলে তখন পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসে পৌছতে পারেনি। কিন্তু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। আবার সংগ্রাম কমিটির নেতা-কর্মীদের প্রত্যয়দীপ্ত প্রতিরােধও লক্ষ করার মতাে। আরাে লক্ষ্য করেন, এই বিপদের দিনে ভেদাভেদ ভুলে সকল স্তরের মানুষ পরস্পরের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষায় প্রস্তুত। এসব দৃশ্য তাজউদ্দীন আহমদকে ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণে প্রভূত পরিমাণ অনুপ্রেরণা জোগায়।

| তাজউদ্দীনের ভাষ্যমতে, ২৭ মার্চ ফরিদপুরে দলীয় নেতা ইনাম আহমদের বাড়িতে অবস্থানকালে তারা মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জনৈক মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করার সংবাদ অবহিত হন। পরদিন তারা পদ্মার তীরবর্তী একটি গ্রামে একজন তাঁতির বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় গ্রামের দিকে পাকিস্তান বাহিনীর আগমন সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তারা ঐ বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হন।৮৬০ ২৯ মার্চ নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা ফরিদপুর থেকে মাগুরার পথে রওনা দেন। ঠিক এ সময় রাজবাড়ির মহকুমা প্রশাসক শাহ মােহাম্মদ ফরিদের সাথে তাদের সাক্ষাৎ ঘটে। পারস্পরিক পরিচয়ের পর তার নিকট থেকে জানা যায় যে, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক ইলাহী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সাথে যােগ দিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও ঝিনাইদহ, যশাের, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের খবর পান।

——-

৮৬০ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮৮।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার বিষয়টি আলােচনা করা দরকার। নেতাদের বিদায় দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাড়িতেই অবস্থান করেন। চারদিকে চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হলে তিনি পূর্ব ব্যবস্থা মতাে ইপিআর এর ওয়ারলেসযােগে সংক্ষিপ্ত একটি বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। এ ছাড়াও কিছুসংখ্যক ব্যক্তির নিকট স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি প্রেরণ করেন তারা। যেন দেশের বিভিন্ন স্থানে তা প্রচার করতে পারেন।৮৬২ ইংরেজিতে রচিত ঘােষণাপত্রটিতে বলা হয়, অকস্মাৎ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও অন্যান্য স্থান আক্রমণ করেছে। প্রতি মহল্লায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সর্বত্রই প্রতি মহল্লায় মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তাদের সাথে রয়েছে সামরিক বাহিনীর বাঙালি রেজিমেন্ট, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সকলকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে যাওয়ার জন্য তিনি আহ্বান জানান- কোনাে আপােসের প্রশ্ন নেই, বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ন্যায় প্রতিষ্ঠার এই যুদ্ধে তিনি বিশ্ববাসীকে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়ানােরও আহ্বান জানান। নিজের অবস্থান ব্যক্ত করে বলেন সেটাই সম্ভবত তার শেষ নির্দেশ। পরদিন ২৬ মার্চ সকালেই মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণার একটি টেলিপ্রিন্টার বার্তা চট্টগ্রামে পাওয়া গেলে সেখানকার সংগ্রাম কমিটির ডা. আবু জাফর, এম.আর. সিদ্দিকী, আবদুল হান্নান ও অন্যরা বাংলায় তর্জমা করে এর নাম দেন ‘বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীর প্রতি। দুপুরে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান চট্টগ্রাম বেতারে অনির্ধারিত সংক্ষিপ্ত একটি অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এই ঘােষণাটি পাঠ করেন । তরজমাকৃত আবেদনটি সাইক্লোস্টাইল করে অসংখ্য কপি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মােহাম্মদ আবদুল হান্নান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ সম্পর্কে বলেন যে এ কাজে বেতারের প্রকৌশলী মীর্জা নাসিরুদ্দীনের সহযােগিতা গ্রহণ করা হয়েছিল। কেননা পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে তারা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। মীর্জা নাসিরুদ্দীনকে কেন্দ্রে এনে প্রচারের এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অল্প পরে কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হলে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দ্বীপ স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কিত একটি হ্যান্ডবিল কয়েকবার পাঠ করেন। আবদুল হান্নানও পূর্বোক্ত

————–

৮৬২, মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪৬। ৮৬৩, পিলখানার অয়ারলেস অপারেটর মােঃ আশরাফ আলী সরদারের সাক্ষাঙ্কার, দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ১৯। ৬৫ এম,আর, সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৮৩।

(.ঘোষণাটি পুনরায় পাঠ করেন। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানমালার সম্প্রচার সীমা বেশি না থাকার কারণে তা অনেকেই শুনতে পায়নি। মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণা সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীকালে দুঃখজনকভাবে বিতর্ক দেখা দেয়। নিছক

রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে বলা হয় শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি, স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রতিরােধ যুদ্ধের একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব মেজর জিয়া। বস্তুত বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান বন্দি হওয়ার আগে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায় । বাংলাদেশের অন্তত দু ব্যক্তি তাদের দিনলিপিতে ২৬ মার্চ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার কথাটি লিখেছেন এদের মধ্যে একজন কাজী ফজলুর রহমান। আর একজন দিনলিপিকার আবদুল হক ২৭ তারিখ লিখেন: “২৭ মার্চ, ১৯৭১, আজ সকালে উঠেই শুনলাম শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন, অসহযােগ চালিয়ে যেতে বলেছেন এবং যেভাবে সম্ভব পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরােধ করতে বলেছেন।”৮৬৬ উৎস সম্পর্কে বিপ্লবী বাংলা বেতার কেন্দ্রের নামােল্লেখ করেন। ২৭ মার্চে কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় ২৬ তারিখ মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার বিষয়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়।৬৭ The Times পত্রিকাতেও অনুরূপ সংবাদ পরিবেশিত হয় ২৭ মার্চ তারিখে। ২৭ মার্চ দিল্লি থেকে প্রকাশিত The Statesman পত্রিকাটিও পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক বাহিনী। কর্তৃক চরম ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা, মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণা এবং নেতাদের আত্মগােপন করার সংবাদ পরিবেশন করে। ২৬ মার্চ রাতের সংবাদে বিবিসি প্রচার করে “ পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন পুরােমাত্রায় কার্যকর করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তীব্র সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরােধের ডাক দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন একজন ছাত্র মুসা সাদিক উল্লেখ করেন যে, দৈনিক আজাদী পত্রিকা

——–

৮৬৫ কাজী ফজলুর রহমান, দিনলিপি একাত্তর (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৭), পৃ. ২১। ৮৬৬. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০১-২০২।

৬. যুগান্তর, ২৭ মার্চ, ১৯৭১। ৮৬৮, আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী বাংলাদেশ ১৯৭১ (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯১), পৃ. ২৬।

Sheelendra Kumar Sing, Bangladesh Documents, Vol. one (Dhaka: The University Press Limited, 1999), pp. 280-281. ৮ আজকের কাগজ, ২৫ মার্চ, ২০০২।

অফিসে ২৬ তারিখ রাতে প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার টেলেক্স বার্তার টেকসটি নিজে দেখেন। ঢাকাস্থ ব্রিটিশ দূতাবাস থেকে পাঠানাে প্রতিবেদনে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে গােপন রেডিও স্টেশন থেকে মুজিবের কণ্ঠ ভেসে আসার কথা উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক স্বয়ং এ বিষয়ে লিখেছেন:

যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিও’র সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলাে । এই কষ্ঠের বাণী মনে হল আগেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করলেন।… ঘােষণীয় বলা হয় এই হয়তাে আপনাদের জন্যে আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তা-ই নিয়ে। দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান- যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈনিকটি

বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিস্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে। | মুজিব কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গে মুদ্রণ ও ইথার মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে কিছু পার্থক্য লক্ষণীয়। এখানে মনে রাখা দরকার টেলিপ্রিন্টারে ভাষণের কপি আবেদন আকারে ছেপে বিলি করা হয়েছিল । অন্যদিকে পিলখানা আক্রান্ত হলে সেখানকার বাঙালি ওয়ারলেস অপারেটর দেলােয়ার হােসেন ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার খবর দেশের বিভিন্ন স্থানেই প্রেরণ করেন। তিনি বলেন যে, তাদের সবাইকে বন্দি করা হয়েছে, কিছুক্ষণ পর হয়তাে তাকেও বন্দী করা হবে। তিনি এমতাবস্থায় চট্টগ্রামের ইপিআর ওয়ারলেস অপারেটরকে এ খবর দিয়ে পাকিস্তানিদের খতম করার আহ্বান জানান। এ ধরনের খবর ও মুজিব কর্তৃক প্রেরিত বার্তার মধ্যে স্পষ্টত পার্থক্য থাকলেও ঐ সময় অনেকের নিকট অভিন্ন বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

বেলাল মােহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ও অন্যদের চেষ্টায় ২৬ মার্চেই কালুরঘাটে স্বল্প দৈর্ঘের ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয় ।

———–

৮৭১ মুসা সাদিক, মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম (ঢাকা: রিলায়েবল কম্পিটার, ১৯৯৫), পৃ. ২৬২৭। ৮৭২, মাসুদা ভাট্টি (সংকলিত), বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ: ব্রিটিশ দলিলপত্র (ঢাকা: জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০০৩), পৃ. ৬১। ৮৭৩ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৫-৮৬। ৮৭* দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ১৯।

২৬০

তারা সদ্য স্থাপিত এই প্রচার কেন্দ্রটির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইপিআর এর মেজর রফিকের কাছে সহযােগিতা প্রার্থনা করেন। যে কোনাে কারণেই হােক। ঐ সাহায্য না পেয়ে তারা পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়ার নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে সহযােগিতা চাইলে তিনি তাৎক্ষণিক রাজি হন। সেখানে তিনি গিয়ে উপস্থিত হলে বেলাল মােহাম্মদ স্বাভাবিক রসবােধ থেকে বলেন ” আচ্ছা মেজর সাহেব, আমরা তাে সবাই ‘মাইনর’, আপনি ‘মেজর হিসেবে স্বকণ্ঠে কিছু প্রচার করলে কেমন হয়। এতে জিয়াউর রহমান উৎসাহ বােধ করেন এবং বেলাল। মােহাম্মদ কর্তৃক এগিয়ে দেয়া এক পাতা সাদা কাগজে প্রথমে নিজেই স্বাধীনতার ঘােষণা দিচ্ছেন এমনভাবে লিখতে উদ্যত হন। কিন্তু পরে বেলাল মােহাম্মদের কথায় বুঝতে পারেন যে, এটা ঠিক হচ্ছে না, তখন তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণাসম্বলিত একটি বার্তা রচনা ও পাঠ করেন।৮৭৫ এটি অবশ্য মুজিব কর্তৃক প্রেরিত বার্তাটির অনুরূপ ছিল না। ৩০ মার্চ পর্যন্ত তা মাঝেমধ্যে পুনঃপ্রচার করা হয়। তবে ২৮ মার্চ জিয়াউর রহমান মুজিবের নাম বাদ। দিয়ে Provisional Head of Bangladesh বলে উল্লেখ করেন। এতে রাজনৈতিক মহলে অসন্তোষ দেখা দিলে পরে আবার সংশােধিত আকারে ঘােষণাটি প্রচার করানাে হয়। সংশােধিত এই ঘােষণায় মূল ঘােষণা থেকে অনেক বড় হয় এবং সেখানে সুচিন্তিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিবেশিত হয়। বস্তুত তখন পর্যন্ত সরকার গঠিত হয়নি। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু মুজিবকে বাদ দিয়ে একজন মেজর কর্তৃক নিজেকে সাময়িক প্রধান হিসেবে ঘােষণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নিশ্চিত বিভ্রান্তি দেখা দেবে বিবেচনা করে নেতারা ঐ প্রচার বন্ধ করান। মেজর জিয়া হঠাৎ কেন নিজেকে সামরিক প্রধান হিসেবে ঘােষণা করেন? এর জবাবও পাওয়া যায় বেলাল মােহাম্মদের তথ্য হতে। ক্যাপটেন ওয়ালী, ক্যাপটেন ভুইয়া প্রমুখও ইচ্ছা ব্যক্ত করেন যে, তাদের নামও রেডিওতে প্রচারিত হােক। এমতাবস্থায় সকলকে লালদীঘি ময়দানে যার যা আছে তাই নিয়ে। উপস্থিত হওয়ার জন্য একটি আহ্বান জানানাে হয় । আহ্বানকারী হিসেবে ঐ সব।

———————

৮৭৫ প্রথম আলাে, ১৮ জুলাই, ২০০০।

বেলাল মােহাম্মদের ভাষ্যমতে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত মােট ৪ বার স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয়টিতে তিনি নিজেকে ‘Provisional Head of Bangladesh এবং | Chief of Bangladesh Liberation Force’ বলে ঘােষণা করেন। দেখুন, বেলাল মােহাম্মদ, স্বাধীনতার ঘােষক’ নিয়ে বিতর্ক’, প্রথম আলাে, ১৮ জুলাই, ২০০০। ৮৭৭ এম.আর, সিদ্দিকীর সাক্ষাত্তার, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১৮৩।

* শামসুল হুদা চৌধুরী, একাত্তরের রণাঙ্গন (ঢাকা: আহমদ পাবলিশিং হাউজ, ১৯৮৪), পৃ. ৩৩।

ক্যাপটেনের নামােল্লেখ করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কর্তৃপক্ষ ভুল বুঝতে পেরে এই প্রচার বন্ধ করে দেয়। কেননা সমাবেশস্থলে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আক্রমণ চালানাের আশংকা ছিল । যাহােক অন্যদের নাম এভাবে প্রচারিত হওয়ার কারণে সম্ভবত নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান নির্ধারণের জন্য জিয়াউর রহমান ২৮ মার্চ Provisional Head of Bangladesh ঘােষণা প্রদান করেন। এ থেকে নিজেদের মধ্যে একটি প্রতিযােগিতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতা ঘােষণার কিছু বাকি ছিল না। এ কথা সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের জানা যে, স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ধারাবাহিকতার সর্বশেষে আসে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গ। এটার সঙ্গে জড়িত থাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রশ্ন। তাই যে কেউ স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে পারেন না। মেজর জিয়াউর রহমান যেটা করেছিলেন সেটা হলাে মহান নেতা শেখ মুজিবের পক্ষে একজন মেজর হিসেবে স্বাধীনতার ঘােষণাটি পাঠ করেছিলেন মাত্র। এটি ঘটে অকস্মাৎ, এর সঙ্গে পূর্বাপর কোনাে সম্পর্ক ছিল না। পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সামরিক গুরুত্ব তীব্রভাবে অনুভব করে। সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও একজন মেজর পদমর্যাদার বাঙালি সামরিক ব্যক্তিত্ব কর্তৃক ঐ ঘােষণা প্রচার সাধারণ মানুষের নিকট বিভিন্নভাবে পৌছে যায় যা প্রতিরােধকর্মে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের নিকট পারিপার্শ্বিক গুরুত্বপূর্ণ এই সংবাদ বহন করে যে, সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও তাদের সাথে রয়েছেন। এতে সকলেই আশান্বিত হয়। এটি প্রচারের ক্ষেত্রে কৃতিত্ব হচ্ছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতাদের। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে কর্মরত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মীর শওকতের বক্তব্যটি বেশ পরিষ্কার । স্বাধীনতার ঘােষক কে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন:

আপনার বিবেককেই জিজ্ঞাসা করুন। এটা অনস্বীকার্য যে, ২৫ এবং ২৬শে মার্চ, ‘৭১-এর চরম মুহূর্তে প্রতিটি বাঙ্গালির মনেই স্বাধীনতার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে । সেই হিসেবে প্রতিটি বাঙ্গালি সেদিন হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার এক একজন ঘােষক। কিন্তু কে সেই মহান নেতা যিনি সেদিন অন্তরালে থেকেও প্রতিটি বাঙ্গালিকে যােগিয়েছিলেন এই সাহস? কোন আহ্বানে বাঙ্গালি সেদিন পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা ? ৭ই মার্চ, ‘৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কে জাতিকে স্বাধীনতার ডাক শুনিয়েছিলেন ? ২৬শে মার্চ ‘৭১ সন্ধ্যা হতে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মূল বেতার কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে অবস্থান করে যারা স্বাধীনতার কথা বললেন, বিভিন্ন ঘােষণা প্রচার করলেন, কে তাদের সেদিনের প্রেরণার উৎস

———

৮৭৯ প্রথম আলাে, ১৮ জুলাই, ২০০০। ৮৮০ শামসুল হুদা চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৮-১৬৯।

ছিলেন? কার পক্ষে তারা প্রচার করেছিলেন সে সব ঘােষণা, স্বাধীনতার কথা? কাজেই বলুন কে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি? কে বা কারা ঘােষক ছিলেন, সেটা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল না? এই আনুষ্ঠানিকতার বিতর্কে আমি জড়িয়ে পড়তে

চাই না। কিন্তু মীর শওকত নিজেকে সেই বিতর্ক থেকে মুক্ত রাখতে পারেননি। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা ঘােষণার ‘ড্রাম তত্ত্ব উপস্থাপন করে তিনি বলেন যে, মেজর জিয়াউর রহমান একটি ড্রাম জোগাড় করে তার ওপর দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দেউলিয়ার কারণে পরবর্তীকালে স্কুল এই প্রশ্নটি কোনাে কোনাে মহলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে জিয়াউর রহমান কখনাে নিজেকে স্বাধীনতার ঘােষক বলে দাবি করেননি। | যাহােক তাজউদ্দীন আহমদ তখন স্বাধীনতা ঘােষণার নেপথ্যে এত কিছু জানতেন না। বরং সে সময় মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার বিষয়টি অবহিত হয়ে তিনি সরকার গঠনের ব্যপারে আরাে বেশি তৎপর হয়ে ওঠেন। ২৯ মার্চ গভীর রাতে অনেক বিপদ অতিক্রম করে তারা মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতা। সােহরাব হােসেনের বাড়িতে পৌঁছেন। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ প্রয়ােজনীয় নির্দেশাবলি দিয়ে অতি প্রত্যুষে একটি জিপে করে ৩০ মার্চ ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজের মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের প্রতিরােধ যুদ্ধের সমন্বয়ক মাহবুব উদ্দীনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। মাহবুব উদ্দীন ছিলেন ঝিনাইদহের মহকুমা পুলিশ অফিসার বা SDPO। সেখানে তিনি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরার সাথে যােগাযােগ রেখে প্রতিরােধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তাজউদ্দীন আহমদের নিকট থেকে প্রতিরােধ সংগ্রামের স্থানীয় নেতারা সার্বিক বিষয়ে অবগত হন এবং করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা লাভ করেন। অন্যদিকে স্থানীয় নেতাদের নিকট থেকে তাজউদ্দীন আহমদ জানতে পারেন হাজার হাজার মানুষ বন্দুক, রাইফেল, দা, কুড়াল, বর্শা, বল্লম, লাঠি-সােটা প্রভৃতি দেশি অস্ত্রসহযােগে যশাের সেনানিবাস ঘিরে রেখেছে। কুষ্টিয়াতেও তিন শতাধিক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। চুয়াডাঙ্গাতে ইপিআর-এর মেজর ওসমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানকার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসককে হত্যা করা হয়েছে এবং অবাঙালি জেলা প্রশাসক প্রতিরােধকারী বাহিনীর হাতে বন্দি। ঝিনাইদহে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ মাহবুব উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে মেজর ওসমান ও তওফিক ইলাহীর সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন। কুষ্টিয়ার বীর জনতাকে সাহায্য করার জন্য চুয়াডাঙ্গা থেকে ইপিআর বাহিনীর একটি দল পাঠানাে হয়। কুষ্টিয়ার খণ্ডযুদ্ধে জনতার বিজয় হলে

এতদঞ্চলের প্রতিরােধ যােদ্ধাদের মনােবল বহুগুণ বেড়ে যায়। বস্তুত বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের এ এলাকাতেই প্রথম সফল প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। এর পাশে পাবনাতেও প্রশাসনের বাঙালি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও জনতার উদ্যোগে অনুরূপ অনুপ্রেরণাদানকারী প্রতিরােধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, এ সময় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও অন্যান্য অঞ্চলেও বাঙালিদের প্রবল প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। কিন্তু এ সকল প্রতিরােধের সংবাদ একত্রিত করে একটি চিত্র দাঁড় করার মতাে পারস্পরিক যােগাযােগ তখন পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। | ৩০ মার্চ নাগাদ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত হতে বাঙালি জাতিকে রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে যথাসম্ভব দ্রুত একটি সরকার গঠন এবং এর মাধ্যমে প্রতিরােধ যুদ্ধসহ পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কোনাে বিকল্প নেই। ২ মার্চ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন ও বিকল্প প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে জনতার যে উন্থান এবং ২৫ মার্চ থেকে গত কয়েক দিনে ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত রাস্তায় প্রতিনিয়ত যেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তার ভিত্তিতে এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার কথা জানতে পেরে তারা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কেবলমাত্র রাজনৈতিকভাবে সরকার গঠন করে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমেই স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে।৮৮১” এভাবেই একটা সর্বাত্মক জনযুদ্ধের পরিকল্পনা তার মনের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় । প্রতিরােধকর্মে নিয়ােজিত নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে এবং স্বীয় বিবেচনায় উপলব্ধি করেন এ ধরনের একটা সর্বাত্মক জনযুদ্ধের জন্যে প্রয়ােজন প্রাথমিকভাবে অস্ত্রসহ যাবতীয় সামরিক রসদ, প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ এবং যােদ্ধা ও পলায়নপর ভয়ার্ত মানুষদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। ৮৮২ এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের সহযােগিতা অত্যাবশ্যক। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, তওফিক ইলাহী, মাহবুব উদ্দীন, মেজর ওসমান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচিত প্রতিনিধি ডা, আসহাবুল হক ও অন্যদের সঙ্গে আলােচনা করে ভারতের সাহায্য প্রার্থনার সিদ্ধান্তে উপনীত হন । ক্ষুদ্রকারের হলেও ২৫ মার্চের পরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য এটিই হচ্ছে প্রথম আলােচনা। সে লক্ষ্যে তিনি ৩০ মার্চ বিকেলে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, তওফিক ইলাহী ও মাহবুব উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে জীবননগর হয়ে কুষ্টিয়া সীমান্ত

———-

৮৮১ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২। ৮৮২ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৯৯।

দিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হন।৮৮৩ সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তারা ভারত সীমান্তে গিয়ে পৌঁছেন। অতঃপর তাজউদ্দীন আহমদ দেশের মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধে ভারত বা অনুরূপ দেশের সাহায্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌছেন যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষের ন্যায় ভারতে প্রবেশ করবেন না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তাকে যথাযথ মর্যাদায় গ্রহণ করে প্রত্যাশিত সাহায্যদানের আশ্বাস প্রদান করলেই কেবল তিনি ভারতে প্রবেশ করবেন। অন্যথায় তিনি দেশের ভিতরে প্রতিরােধ বাহিনীর সঙ্গে থেকে মরণপণ লড়াই করে যাবেন। সীমান্তে পৌছে তাই। তওফিক ইলাহী ও মাহবুব উদ্দীনকে ‘উঁচু পর্যায়ের দুজন আওয়ামী লীগ নেতার আগমন সংবাদ বহনকারী হিসেবে ভারত ভূখণ্ডে প্রেরণ করেন মূলত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনােভাব জানার জন্যে। আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে তিনি অপেক্ষা। করতে থাকেন সীমান্তস্থিত টঙ্গি খালের ওপর নির্মিত একটি কালভার্টের পাশে। অপেক্ষার এই সময়ে তাজউদ্দীন আহমদ নানা প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-উৎকণ্ঠায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে একটি স্মৃতিচারণে তাজউদ্দীন আহমদ

বলেন:৮৬

…যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতালাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে। গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে অনিবার্য সুযােগ। দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টঙ্গি নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলাে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা

সগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা। ভারতীয় একজন সাংবাদিকের তথ্য থেকে জানা যায় যে, ২৮ তারিখে কুষ্টিয়ার এক শ্রমিক নেতার বাড়িতে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ঐ সাংবাদিককে কিছু দায়িত্ব দিয়ে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার অনুরােধ করেন। ঐ সাংবাদিক তাজউদ্দীন আহমদের ভারত গমনের আগাম সংবাদ বয়ে নিয়ে যান এবং বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর

————

৮৮৩. আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৪। ৮৮৮, ঐ, পৃ. ১৮৪।

Arun Bhattachrjee, Dateline Mujibnagar (Delhi: Vikas Publishing House, Pvt., 1972), p. 9. ৮৮৬ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২।

২৬৫

রায়কে জানান। সুতরাং ভারতে প্রবেশের পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ রাজনৈতিকভাবে যােগাযােগের একটা চেষ্টা করেছিলেন।

মাহবুব উদ্দীন ও তওফিক ইলাহী বিএসএফ-এর স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে। দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামের প্রকৃত পরিচয় না জানিয়ে বলেন যে, সীমান্তে আওয়ামী লীগের খুব উঁচু পর্যায়ের দুজন নেতা অপেক্ষা করছেন। তারা ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করতে চান। স্থানীয় কমান্ডিং অফিসার একজন মেজর ও কয়েকজন জওয়ানকে প্রেরণ করেন। আগন্তুকদের সসম্মানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মেজরের নেতৃত্বে বিএসএফ-এর ঐ দলটি তাদের প্রচলিত কায়দায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উলইসলামকে অভিবাধন জানিয়ে ভারত ভূ-ভাগে নিয়ে যায়। ইতােমধ্যে ভারত সরকারের উঁচু পর্যায়ের বিভিন্ন কূটনৈতিক স্তরের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে কোথা থেকে অল্প সময়ের মধ্যে বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গােলক মজুমদার এসে হাজির হন এবং তারা ছদ্মনামেই প্রথমে পরিচিত হন। এভাবে তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে প্রবেশ করে শুরু থেকেই উঁচু মানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বােধের পরিচয় দেন। এভাবেই একটা অসম্ভব বিপদসঙ্কুল পরিবেশে মুজিবহীন আওয়ামী লীগ ও বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করে। তাজউদ্দীন আহমদ নতুন এক রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন।

| ২৫ মার্চ রাত হতে শুরু করে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা থেকে ভারতের নদীয়া সীমান্তে পৌঁছা পর্যন্ত তাজউদ্দীন যে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তা দ্বারা সারা দেশের। ঘটনা অনুমান করেন মাত্র। দলীয় নেতাদের অবস্থান সম্পর্কেও তার কোনাে ধারণা ছিল না। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ হতে বাঁচার জন্য ভয়ার্ত সাধারণ মানুষের সদর হতে মফঃস্বলের দিকে এবং মফঃস্বল হতে ভারত সীমান্তের দিকে ছুটে চলার স্রোত তিনি প্রত্যক্ষ করেন। লক্ষ্য করেন একইভাবে সংগ্রাম কমিটি, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের সর্বোপরি সাধারণ মানুষগুলাের অসাধারণ হয়ে ওঠার দৃশ্য। বাঙালি জাতির এই উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ চূড়ান্ত অভীষ্টে পৌছার সংগ্রামে নেতৃত্বদানের উল্লিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

অন্যদিকে ভারত সরকার ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের কিছু। পূর্ব হতে পূর্ব বাংলার মানুষের সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি সতর্কতামূলকভাবে

——–

অমর সাহা (সম্পা.), কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ৭০-৭১। ৮৮৮ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১০০।

Arun Bhattacharjee, op.cit., p. 9.

পর্যবেক্ষণে রাখে । ২৫ মার্চের ঘটনাবলির বিষয়টি পরদিন কোনাে কোনাে প্রচার মাধ্যমে যৎসামান্য স্থান লাভ করে । ব্যাপকভাবে এটি আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে স্থান না পাওয়ার কারণ ছিল পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ আক্রমণের পূর্বে বিদেশি সকল সাংবাদিককে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটক রেখে পরদিন বিশেষ বিমানযােগে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। অবশ্য বেসরকারিভাবে ভারতের মানুষ ২৬ মার্চেই সর্বব্যাপী এই আক্রমণের খবর জানতে পারে। ভারত সরকার যে বিষয়টি অতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২৭ মার্চ রাজ্য সভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ হতে। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আশা করা গিয়েছিল যে, পাকিস্তানে নতুন আলােকিত অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে, যা। তাদেরকে সংহত ও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করবে। কিন্তু তা হতে দেয়া। হয়নি। পরিবর্তে পূর্ব বাংলার মানুষকে ঘাের অন্ধকারে নিক্ষেপ এবং মর্মান্তিক ও দুঃসহ পীড়নের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে তা কেবল তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়; তা ভারতের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার ঐ ভাষণে আরাে বলেন বাংলাদেশে (তার ব্যবহৃত শব্দ পূর্ব। পাকিস্তানে) যা ঘটেছে তা গভীর দুঃখজনক ও মর্মন্তুদ, কূটনৈতিক কারণে এ ব্যাপারে এর চেয়ে প্রকাশ্যে বলা উচিত নয়। এর মাত্র ৩ দিন পরে ৩১ মার্চ সংসদে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এতে ‘BANGLADESH’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। প্রস্তাবটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ২৭ তারিখের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেন যে, পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক উত্থানে ভারতীয়রা আশান্বিত হয়েছিল। তাদের এই প্রচেষ্টাকে ভারত স্বাগত জানিয়েছিল বস্তুত মানবিক মূল্যবােধের কারণে। ভারতীয়দের আশা ছিল গণতান্ত্রিক এই চেতনার মধ্য দিয়ে প্রতিবেশি দেশটিতে উন্নততর পরিবেশ সৃষ্টি হবে যার ফলে রাষ্ট্র দুটোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। পরিবর্তে পূর্ব বাংলায় যে মর্মান্তিক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করা হয়, তার বিরুদ্ধে। ধিক্কার জানানাের ভাষা তাদের জানা নেই । ইন্দিরা গান্ধীর ভাষায়: …even the strengthening of Pakistan has been lost and has been lost in a manner which is tragic, which is agonising and about which we can not find strong enough words to speak because this again is a

——-

৮৯০ দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ. ৫৩১।

Sheelendra Kumar Sing, Bangladesh Documents, Vol. one (Dhaka: The University Press Limited, 1999), p. 669.

new situation’। তিনি আরাে বলেন যে, সেখানে কেবল আন্দোলন দমন করার জন্য নয় বরং নিরস্ত্র মানুষের ওপর ট্যাংক চালানাে হয়েছে। | বস্তুত ভারতই প্রথম অত্যন্ত তীব্র ভাষায় বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ জানায় এবং ধ্বংসযজ্ঞের শিকার বাঙালি জাতির সূচিত মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। অভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্বের কারণে নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের বাঙালিদের সংগ্রামের প্রতি ভারতের জনগণের মনে প্রবল সহমর্মিতা সৃষ্টি হয়। এই সমর্থন ও সহমর্মিতার ভিত্তি হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক রীতিতে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়। শুধু তাই নয় সােহরাওয়ার্দী-উত্তর আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের যােগ্য নেতৃত্বে উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী। | রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে, যা ভারতের কংগ্রেস এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নীতির কাছাকাছি। তদুপরি দ্বিমেরু বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষিতে আজন্ম শত্রু পাকিস্তানকে জব্দ করার এটি ভারতের জন্য একটি উত্তম সুযােগও বটে। | ঠিক এ ধরনের পরিস্থিতিতে ৩০ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার | আমীর-উল-ইসলামকে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যথাযােগ্য সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করে। তাজউদ্দীন আহমদের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনতিবিলম্বে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গােলক মজুমদারকে প্রাথমিক পরিচয়ের পর তাজউদ্দীন আহমদ এই অনুরােধ জানান। অবশ্য তার পূর্বেই বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে ভারত সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির কাছে তাদের আগমনের খবরটি পৌছে যায়। এর ফলে বিশেষ প্রটোকলের আওতায় গােলক মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলামকে দমদম এয়ারপাের্টে নিয়ে যান। মধ্যরাত নাগাদ সেখানে পৌছে তাদের উদ্দেশে আগত স্বয়ং বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীকে বিমান থেকে অবতরণ করতে দেখতে পান। রুস্তমজী জওহরলাল নেহরুর নিরাপত্তা প্রধানের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। সে সুবাদে নেহরু পরিবারের সঙ্গে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। ইন্দিরা গান্ধীরও তিনি বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি। প্রথম থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সঙ্গী আমীর-উল-ইসলাম লক্ষ্য করেন, যখনই ভারতীয় কোনাে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয় তখনই তারা ব্যাকুলভাবে জানতে চান ‘শেখ মুজিব কেমন আছেন?’ রুস্তমজীও সেই প্রশ্ন করেন।

দমদম এয়ারপাের্টে রুস্তমজী ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে সাক্ষাৎ করানাের | পর তাদেরকে নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত ‘আসাম ভবনে’ রাখা হয়। এখানে তারা প্রায় সারারাত ধরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনাক্রমে

বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং সে সম্পর্কিত পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে নেন। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বিএসএফ এর ঊর্ধ্বতন এই দুই কর্মকর্তা আকৃষ্ট হন । তাজউদ্দীন আহমদ মন্তব্য করেন যে, ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলটি পৃথিবীর রাজনৈতিক মনােযােগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। যাহােক, টেবিলের ওপর মানচিত্রের সাহায্যে বাংলাদেশের কোন সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগের কোন্ কোন্ নেতা, এম.এন.এ, এম.পি.এ- দের সঙ্গে যােগাযােগ করা যেতে পারে তার নির্দেশনাসম্বলিত একটি তালিকা প্রণয়ন করেন তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম। রুস্তমজী ও গােলক মজুমদারের ব্যবস্থাপনায় প্রয়ােজনীয় কর্মকর্তাদের ডেকে প্রণীত তালিকাটি তাদের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং নির্দেশ দেয়া হয় তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের যথাসম্ভব দ্রুত সংগ্রহ করে আনা অথবা তাজউদ্দীন আহমদের বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্যে। এসব প্রাথমিক নীতিনির্ধারণী ও যােগাযােগ স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতেই রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। তিনি ৩১ মার্চ প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন স্থানে যােগাযােগ ও খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন এবং বাংলাদেশে প্রতিরােধ যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট নির্দেশ পাঠান। এ সময় তিনি ১০ নং রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডের একটি বাড়ি খোঁজ করেন। যেটিতে চিত্তরঞ্জন সুতার বসবাস করতেন। তিনি মূলত গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর মাধ্যমে মুজিবের পক্ষে ভারতীয় সরকারের সাথে যােগাযােগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। অসহযােগের সময় মুজিব যুবনেতাদেরকে এই বাড়ির ঠিকানা বলেছিলেন এবং তাজউদ্দীন সেটি ঘটনাচক্রে অবহিত হন। কিন্তু উক্ত বাড়িতে চিত্ত সুতার ভিন্ন নামে বসবাস করায় তাজউদ্দীন আহমদ তখন তাকে পাননি। যাহােক, রুস্তমজীর সহযােগিতায় কলকাতার পাকিস্তান কনসুলেটের নিকট একটি বাড়ি ঠিক করা হয় যেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশাসনিক নির্দেশাবলি প্রেরণ ও অন্যান্য কাজ করা যেতে পারে। ইতােমধ্যেই তারা বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের ছােট্ট একটি স্থান চুয়াডাঙ্গায় সরকারের শপথ অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই স্থানটিকে বেছে নেয়ার কারণ সম্ভবত প্রতিরােধ যুদ্ধে স্থানটি হানাদারমুক্ত থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছিল। তাছাড়াও স্থানটি ভারত সীমান্তের সঙ্গে এমনভাবে সংলগ্ন যে, এর ওপর বিমান হামলা

———–

৮৯২ আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশ ১৯৭১, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৭), পৃ. ৬১৭। ৮৯৩ দলিলপত্র, ‘১৫শ খণ্ড, পৃ, ১০২।

সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ- আলােকের অনন্তধারা (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০৬), পৃ. ৬৭।

চালাতে হলে ভারতের আকাশ সীমায় অনিবার্যভাবে প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু আবেগের আতিশয্যে ডা, আসহাবুল হক বিদেশি সাংবাদিকদের নিকট তা প্রকাশ করে ফেললে পরদিন পত্রিকাতে এই পরিকল্পনার কথা ফাস হয়ে যায়। এমনকি কলকাতায় তাদের উপস্থিতির কথাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। অতঃপর দলের নেতৃত্বে সরকার গঠনপূর্বক যুদ্ধের সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়নে মনােযােগ দেন। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিটি বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চিন্তার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইতােমধ্যেই মেজর ওসমান, ডা. আসহাবুল হক ও অন্যান্য প্রতিরােধ যুদ্ধের নেতারা যারা মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, পাবনা এবং দেশের সকল সীমান্তে প্রতিরােধ যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করছিলেন, তারা ভারতের নিকট প্রকাশ্যে অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কূটনৈতিক কারণে প্রকাশ্যে অস্ত্র সাহায্য চাওয়া সঠিক নয় বলে বিবেচনা করেন । তাই আসহাবুল হক এবং এ ধরনের নেতা যাদের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করা সম্ভব হয় তাদেরকে ভারতের নিকট থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করা হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেন।”** অবশ্য বিএসএফ প্রধান কিছু হালকা অস্ত্র প্রতিরােধ যযাদ্ধাদের সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে এ ক্ষেত্রে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে জানান যে, মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দানের বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরেই কেবল তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা যেতে পারে। আপাতত হয়তাে ছােট-খাটো অস্ত্র সাহায্য তারা দিতে পারেন, কিন্তু একটি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ব্যাপকভিত্তিক যে ধরনের অস্ত্রের প্রয়ােজন তা সরবরাহের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নির্ভর করছে। উচ্চতম রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। তদুপরি ২৫ মার্চে যে ধরনের গণহত্যা পাকিস্তান বাহিনী শুরু করে, তার কোনাে পূর্বাভাসই ভারত সরকার পায়নি এবং সে কারণে করণীয় বিষয়ে তাদের তেমন কোনাে প্রস্তুতি ছিল না। কাজেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সাহায্যদানের বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মার্চ ভারতে প্রবেশ করার পরে । তিনি ভারতে প্রবেশের স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনুধাবন করেন যে, উচ্চতম রাজনৈতিক মহলের সিদ্ধান্ত ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কোনাে কার্যকর সাহায্যদান করা সম্ভব নয়। তবে এও বুঝতে পারেন, ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ইতিবাচক। তাদের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে

———

৮৯৫ ঐ, পৃ. ১০২-১০৩। ৮৯৬, ঐ, পৃ. ১০৩।৮৯৬ Arun Bhattacharjee, op.cit., p. 10. ৮৯৮ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।

. Arun Bhattacharjee, op.cit., p. 5.

২৭০

তিনি ৩১ মার্চ টেলিফোনে মেজর ওসমানকে নির্দেশ দেন তিনি যেন একটি অস্ত্রের তালিকা যথাসম্ভব শিগগিরই তার নিকট পৌছানাের ব্যবস্থা করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে রাজনৈতিক যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ার পরেই কেবল বিএসএফ সামান্য কিছু অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের দেয়, যাতে তারা প্রতিরােধ যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে পারে। পরদিনই মেজর ওসমান ও মাহবুব উদ্দীন একটি অস্ত্রের তালিকাসহ কৃষ্ণনগর সীমান্তে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এ সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লে. কর্নেল এইচ.আর. চক্রবর্তী, এম.কে ভিমানী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ৯০০ এ সময় সর্বশেষ পরিস্থিতির বিষয়ে তাদের মধ্যে আলােচনা হয়। কুষ্টিয়া-কৃষ্ণনগর সীমান্তে একটি ঘরে তারা আলােচনায় মিলিত হন। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলােকপাত করেন। এ সম্পর্কে অরুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন:৯০১

…they sat down in a closed room without a fan in the scorching April heat and started poring over a map to discuss the Kustia situation. Mohammad Ali (Tajuddin Ahmed) even touched on the international situation and sounded a note of caution about China and its agents in Bangladesh. It has agreed at the meeting that Mohammad Ali and Rahmat Ali (Amir-Ul- Islam) should go to Delhi and convince the Indian leaders about the nationalistic and secular nature of their

struggle and their faith in ultimate victory. ঐ আলােচনা শেষ হওয়ার পর গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদের হাতে অস্ত্র সাহায্যের প্রতীক হিসেবে একটি মেশিনগান ও অন্যান্য কিছু গােলাবারুদ তুলে দেন এবং এই সংগ্রামে বাঙালির বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এই অস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যশােরে একটি খণ্ডযুদ্ধে শত্রু বাহিনীর একজন ক্যাপটেনসহ ৪৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের সৈন্য ও ৩ টি ট্রাক ধ্বংস করে দেয়।৯০৩

মেজর ওসমান ও অন্যদের বিদায় দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ সার্বিক পরিস্থিতির সংবাদ সংগ্রহ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সন্ধানে কয়েকটি সীমান্ত

————–

৯০০ আবু ওসমান চৌধুরী, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম (ঢাকা: নাজমহল, ২০০১), পৃ. ১৭১। sos.৯০১ Arun Bhattacharjee, op.cit., p. 12. ৯০২, আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।

. Arun Bhattacharjee, op.cit., p. 13.

এলাকা, যেমন হিঙ্গলগঞ্জ, টাকী, হাসনাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল সফর করেন।* ৩১ মার্চ প্রচার মাধ্যমে দেয়ার জন্য একটা বিবৃতি তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে সমন্বয়ক মনােনয়ন করা হয়েছে মর্মে একটি বিবৃতির কথা জানা যায়। সম্ভবত এই প্রথমবার ভারতে তাজউদ্দীন। আহমদের নাম আলােচনায় স্থান পায়। তবে বিএসএফ-এর তত্ত্বাবধানে তাদেরকে যথাসম্ভব গােপনে রাখা হয়। বিএসএফ-এর অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় তাদের জন্য উপযুক্ত জামা-কাপড় সংগ্রহ করে দেন।

বিএসএফ-এর ব্যবস্থানায় ১ এপ্রিল দিবাগত রাতে গােলক মজুমদারের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলাম দিল্লি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক রসদবাহী একটি বিমানে করে রওনা হয়ে যান। বিমানটিতে তখন মালামাল বােঝাই থাকার কারণে এর পিছনের দিকে ফাঁকা জায়গায় কোনাে প্রকারে ৪ জনের জন্য জায়গা করা হয়। শেষ রাতে তারা দিল্লির একটি সামরিক বিমান ঘাটিতে অবতরণ করেন। গােয়েন্দা সংস্থা ও প্রচার মাধ্যমের নজর থেকে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধিদ্বয়কে আড়াল করে রাখার উদ্দেশ্যে তাদেরকে এভাবে নেয়া হয়।

বিশেষ গােপনীয়তায় বাংলাদেশের এই দুই নেতাকে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় বিএসএফ-এর অতিথিশালায় । গােলক মজুমদার ও রুস্তমজীর প্রচেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ৩ এপ্রিল সন্ধ্যারাতে । তার আগে দুদিন তাকে অপেক্ষা করতে হয় সাক্ষাতের আনুষ্ঠানিক আয়ােজন এবং তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য। এ সময়ের মধ্যে তিনি আরাে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্ভবত এপ্রিল মাসের ২ তারিখে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের দুজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ রেহমান সােবহান ও আনিসুর রহমান দিল্লি পৌছেন এবং অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক। উপদেষ্টা অশােক মিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অশােক মিত্রের জন্ম ঢাকায় এবং ছাত্র জীবনের অধিকাংশ সময় পূর্ব বাংলার বাসিন্দা থাকার কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের সাথে পূর্ব পরিচয় ছিল। এসব পরিচয় ভারত সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনে যথেষ্ট সহায়ক হয়।৯০৮

————–

৯০৪ আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।

Arun Bhattacharjee. op.cit., p. 11. ৯০৬. আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫। ৯০৭ অশােক মিত্র, আপিলা-চাপিলা (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৩), পৃ. ১৯২। ৯০৮ ঐ, পৃ. ১৯১।

এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পি.এন হাকসার (পৃথ্বীনাথ), ডি.পি.ধর, (দুর্গা প্রসাদ) অন্যতম। তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলাম এবং রেহমান সােবহান ও আনিসুর রহমান প্রায় একই সময় দিল্লি পৌছেন। এ প্রসঙ্গে অশােক মিত্র লিখেছেন:৯০৯

ঘটনাক্রম অতি দ্রুত এগিয়ে গেল । কয়েক দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে স্থিতধী নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ, দিল্লি পৌছে গেলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে মুখােমুখি যুদ্ধে আপাতত লিপ্ত না হয়েও ভারতবর্ষ কোন ধরনের কী পরিমাণ সাহায্য করতে

পারে, তার বিশদ ফিরিস্তি তৈরি হলাে। প্রায় একই সময় এম.আর. সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া, আবদুর রউফ ও অন্য কয়েকজন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা দিল্লি পৌছেন। এ সকল বুদ্ধিজীবী ও দলীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাদের সঙ্গে সরকার গঠনের বিষয়ে আলােচনা করেন। অনিশ্চিত পরিবেশে তার গুরু দায়িত্বের বিষয়ে তিনি যে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান লিখেছেন:

আমরা এর মধ্যেই জেনেছিলাম যে তাজউদ্দীন দিল্লিতে। পরের দিন আমরা তাজউদ্দীনের সাথে দেখা করি। তিনি তাঁর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী শান্ত ছিলেন এবং তার হাতে এখন যে কঠিন দায়িত্ব পড়েছে সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তার কথাবার্তায় ভারতের হাতে আমরা যেভাবে পড়ে গেলাম সে সম্বন্ধে শান্ত উদ্বেগ

লক্ষ্য করি। অন্য নেতারা কে কোথায় রয়েছেন তা জানা না থাকায় এবং সময়ের স্বল্পতাহেতু এর চেয়ে বেশি ব্যাপক পরিসরে সরকার গঠনের বিষয়ে আলােচনার কোনাে অবকাশ ছিল না। পরবর্তীকালে দেখা যায়, প্রতিরােধ যুদ্ধের নেতারা অনেকেই এই সময় সরকার গঠনের প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন। এমতাবস্থায় একাধিক সরকার গঠনের ঘােষণা হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকতাে না। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা দুরূহ কাজে পরিণত হতে পারতাে। এমনকি এ ধরনের কোনাে গ্রুপের সঙ্গে শত্রুরা যােগাযােগ স্থাপন করেও বাঙালি জাতির এই সংগ্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বিকলাঙ্গ করে দিতে পারতাে, যা অচিরেই আত্মঘাতী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হতাে।

————–

৯০৯ ঐ, পৃ. ১৯২।

সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৮। ** আনিসুর রহমান, পথে যা পেয়েছি, প্রথম খণ্ড (ঢাকা: এ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ২০০২), পৃ. ১০৪ ।

অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের চরম সিদ্ধান্তের পরেই কেবল ভারতের উচ্চতম রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য দিল্লি গমন করেন। অবশ্য তখনও সরকারে তার অবস্থান কি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে তার কোনাে কোনাে উপদেষ্টা ও প্রটোকল কর্মকর্তা তাজউদ্দীন আহমদকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ইতােমধ্যে বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়েছে কিনা এবং তিনি কোন পদাধিকারী ব্যক্তি হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন? এমতাবস্থায় তিনি ত্বরিত সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ভারত সরকারকে জানাবেন, ২৫-২৬ মার্চ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান সরকার গঠন করেছেন এবং স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বে তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ করবেন। কেননা সেক্ষেত্রে ভারতের নিকট থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহযােগিতা লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। এই ধরনের

স্পর্শকাতর ও গুরুতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম তাকে সাহায্য করেন। তার যুক্তি হলাে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন না করলেও ২ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে বিকল্প প্রশাসন ব্যবস্থা ক্রমাগত গড়ে ওঠে তাতে হাই কমান্ডের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। বস্তুত হাই কমান্ডের ব্যবস্থাপনায় এই বিকল্প প্রশাসন পরিচালিত হয়। এতে তাজউদ্দীন আহমদ নীতি নির্ধারণের সকল বিষয় দেখতেন, কার্যকর করার জন্য শুধুমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমােদন গ্রহণ করতেন। ২৫ মার্চের পর থেকে বাঙালি জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ মােকাবিলার জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ভারতের সাহায্য সংগ্রহে সচেষ্ট তিনিই প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি। কাজেই প্রধান নেতার অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা থাকার কথা নয়। তাজউদ্দীন কর্তৃক নিজেকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঘােষণায় তার নৈতিকতা নিয়ে কেউ হয়তাে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু সেই বাস্তব পরিস্থিতিতে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসংঘবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সামনে এছাড়া কোনাে বিকল্প ছিল না। এক্ষেত্রে তিনি Real Politics-এর পরিচয় দেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অপরিসীম হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।

৯১২, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২। ৯১৩ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১০৭ ।

কেননা আওয়ামী লীগ একটি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল, যেখানে ভিন্নমত এবং উপদলীয় চিন্তা-চেতনা থাকা স্বাভাবিক। জনসম্মােহনী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে দলে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে সে বিষয়েও তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ণমাত্রায় জ্ঞাত ছিলেন।৯১৪ তিনি দিব্যচক্ষে সবই পূর্বাহ্নেই অনুমান করেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই সিদ্ধান্তকে যেভাবেই দেখা হােক না কেন, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল সর্বাগ্রকরণীয় বিষয় এবং সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। উপস্থিত ও একক এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের গতি সঞ্চারে মাইলফলক বিশেষ হলেও তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিপক্ষরা মুক্তিযুদ্ধের ৯ টি মাস তাকে ক্রমাগত কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করে। এর প্রভাব দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অব্যাহত থাকে।৫

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সাক্ষাৎটি ঘটে ৩ এপ্রিল সন্ধ্যারাতে । প্রাথমিক সম্ভাষণ বিনিময়ের পরে ইন্দিরা গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন ” How is Sheikh Mujib? Is he all right?” এ ধরনের প্রশ্নের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ প্রস্তুত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জবাবে বলেন, শেখ মুজিব তাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার বিশ্বাস মুজিব গােপন স্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন। তবে ২৫ মার্চের রাতের পর থেকে মুজিবের সঙ্গে তাদের কোনাে যােগাযােগ নেই।” তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলােচনার সময় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যে কোনাে মূল্যে তা অর্জন। করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, বাঙালির এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্যে পাকিস্তান বিষয়টিকে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকীকরণের চক্রান্ত করতে পারে। কাজেই বাঙালির এই যুদ্ধকে জয়যুক্ত করতে হলে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে হবে। তার আগে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সামরিক রসদপত্র প্রয়ােজন। আক্রান্ত মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করছে, তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়দান করাও প্রয়ােজন। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট সুনিদিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সহযােগিতা প্রার্থনা করেন। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল: দেশ ত্যাগ করে যারা ভারতে প্রবেশ করছে তাদেরকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ, ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুমতি, মুক্তিবাহিনীর

———-

৯১৪, ঐ, পৃ. ১০৭। ৯১৫ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২। ৯১৬, ঐ, পৃ. ১১। * দলিলপত্র, ৯১৭শ খণ্ড, পৃ, ১০৬, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকার ।

২৭৫

সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও সামরিক রসদ সরবরাহ ইত্যাদি। তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সূক্ষতা ও দূরদর্শিতা ইন্দিরা গান্ধীর মনােযােগ আকর্ষণ করে। প্রথম দিনের এই আলােচনায় উভয়পক্ষের কোনাে সহযােগী উপস্থিত ছিলেন না। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৪ এপ্রিল আলােচনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থাকেন রুস্তমজী, পিএন, হাসার, কর্নেল মেনন ও জনৈক রাম। কিন্তু বাংলাদেশ পক্ষে থাকেন তাজউদ্দীন আহমদ একাই। তবে দ্বিতীয় দিনের আলােচনায় যাওয়ার পূর্বে তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত রেহমান সােবহান, আনিসুর রহমান, এম.আর. সিদ্দিকী ও অন্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার। উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলােচনার সময় উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযােগিতার আবেদন ছাড়াও বাংলাদেশের মানুষের অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে কিভাবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ পদদলিত করেছে সে বিষয়ে আলােকপাত করেন। আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার বাঙালিদের বিষয় সেটারও ব্যাখ্যা দেন । এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বিশেষ সহায়ক হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি কোনাে সহযােগী ছাড়াই আলােচনা করে তাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম। হন। বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে ইতঃপূর্বে সীমান্তের ওপারের ভারত ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মহল তেমন কিছু না জানলেও রাজনীতি ও কূটনীতির বিষয়ে তার সাবলীল উপস্থাপন ও চিন্তার গভীরতা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ভারতীয় নেতৃত্ব অন্তত একটি বিষয়ে নিশ্চিত হন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মতাে যােগ্য ও যথার্থ একজন নেতা ভারতের সাহায্য প্রার্থনার জন্য। উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং ভারতীয় সাহায্য-সহযােগিতা লাভের বিষয়টি সহজতর হয়।

———————-

৯১৮ ঐ, পৃ. ১০৬। ** আবদুল আজিজ বাগমারের লেখা এবং আমীর-উল-ইসলামের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সাক্ষাতের তারিখে একদিনের পার্থক্য লক্ষ করা যায় । আমীর-উল ইসলামের মতে ৪ এপ্রিল এবং আবদুল আজিজ বাগমারের মতে ৩ এপ্রিল এই সাক্ষাৎ হয়। খুব সম্ভব তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ৪ এপ্রিল দ্বিতীয় সাক্ষাৎ করেন। মঈদুল হাসান কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায় যে, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তাজউদ্দীন আহমদ দু দফা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দেখুন, মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩। ৯২০ আবদুল আজিজ বাগমার, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫।

দ্বিতীয় দিনের আলােচনায় প্রার্থিত বিষয়ে ভারত সরকারের সহানুভূতি উদ্রেক করে এবং সর্বাত্মক সহযােগিতার আশ্বাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের জন্য একটি রেডিও স্টেশনের ব্যবস্থা করা এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সামরিক বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য নগেন্দ্র সিংহ নামক একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে নিয়ােগ দেয়া হয়। একই সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ যাতে অনতিবিলম্বে তার সরকারের কাজকর্ম শুরু করতে পারেন সে লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় নেতা ও যােগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য একটি ছােট্ট বিমানও তাকে ব্যবহার করতে দেয়া হয়। বস্তুত এরপর তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পরিচালনার ভিত্তি খুঁজে পান এবং সরকার গঠনের যাবতীয় আয়ােজনে অগ্রসর হন। এই পর্যায়ে অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের প্রত্যক্ষণটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি লিখেছেন:৯২৩

I had the distinct impression, on the basis of dicussions with my contacts in Delhi, that there had been no prior contact between Sheikh Mujib and Indira Gandhi before the crackdown by the Pakistan army through any high-level accredited emissary. Therefore no contingency plan was worked out with India as to the kind of assistance that might be necessary and what would be its modalities. Tajuddin and his colleagues, on their arrival in India, had to establish their credentials as the genuine representatives of the Party as well

as their capacity to lead a war of liberation. এ সময় রেহমান সােবহান ও আমীর-উল-ইসলামের সক্রিয় ও সৃজনশীল সহযােগিতায় তাজউদ্দীন আহমদ সরকার গঠনের মৌলিক কিছু নীতি নির্ধারণ ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খসড়া প্রণয়ন করেন। এর মধ্যে রাষ্ট্রের নামকরণ ও আদর্শ, পররাষ্ট্রনীতি, সরকার কাঠামাে, সরকারের মন্ত্রিপরিষদ নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এসব ব্যাপারে অবশ্য আওয়ামী লীগের বিগত কাউন্সিলের বিঘােষিত নীতি ও গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত বিষয়সমূহকে প্রাধান্য দেন। তিনি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি গুরুত্বারােপ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকও তারা এ সময় নির্ধারণ করেন। আমীর-উলইসলামের স্বহস্ত অংকিত এই প্রতীকটিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ

——-

৯২১ মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩-১৪। ৯২২ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১০৯। ১৯২৩ Nurul Islam,op.cit;, p. 115.

প্রথম অনুমােদন দেন।৯২৪ এরপর তারা তিনজন তিন বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তি সরকার গঠনের একটি ঐতিহাসিক ঘােষণাপত্র প্রস্তুত করেন। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশনায় রেহমান সােবহান ইংরেজিতে এবং আমীর-উল-ইসলাম বাংলায় এটি রচনা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ তার সুন্দর হস্তাক্ষরে এক কপি নিজে লিখে নেন। তারপর তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে দিল্লিতে বসেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ রেকর্ড করা হয়।২৬ | তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লিতে গিয়ে কেবল মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সহযােগিতার বিষয়টিই নিশ্চিত করেননি। উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালার লক্ষ্যে একটি সরকার গঠনের প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন যে, তিনি প্রায় একক ও তাৎক্ষণিকভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তা দলের নেতাদের নিকট গ্রহণযােগ্য না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তার গৃহীত পদক্ষেপগুলাে কার্যকর করতে হলে দলের প্রভাবশালী নেতাদের সমর্থন ও সক্রিয় সহযােগিতা গ্রহণ ছিল খুব জরুরি । তিনি অতি দ্রুত কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বিএসএফ-এর ব্যবস্থাপনায় লর্ড সিনহা রােডের একটি বাড়িতে ওঠেন। অতঃপর নেতারা কে কোথায় আছেন বা ভারতে পৌছেছেন কিনা সে বিষয়ে খোঁজ-খবর শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন। ইতােমধ্যেই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের অন্যতম সদস্য এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান কলকাতার গাজা পার্কের একটি বাড়িতে উঠেছেন। তার সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি তাকে সকল বিষয় অবহিত করেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ছাড়াও ছাত্র ও যুবনেতাদের মধ্যে। শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, সিরাজুল আলম। খান ও অন্যান্য নেতার কলকাতা আগমনের সংবাদ পান। বাংলাদেশ থেকে আগত এসব নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ কথা বলে বুঝতে পারেন যে, তার দিল্লি গমন ও সরকার গঠনকে ভালােভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না। তাদের মতে তাজউদ্দীন আহমদ অন্যদের জন্য অপেক্ষা করে দিল্লি যেতে পারতেন।

তাজউদ্দীন আহমদ কোন পরিস্থিতিতে, কি কারণে এত দ্রুত দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎপূর্বক সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং চলতি অবস্থায় কী করণীয় এসব বিষয়ে আলােচনার জন্য ৮ এপ্রিল কলকাতার ভবানীপুর

———-

৯২৪, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১০৮। ৯২৫ ঐ, পৃ. ১০৯। ৯২৬ ঐ, পৃ. ১০৯। ৯২৭ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১০।

এলাকার একটি বাড়িতে আগত নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। কিন্তু সভার শুরুতেই প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি মন্ত্রিসভা গঠনের বিরােধিতা করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন সকলে যুদ্ধরত এবং বঙ্গবন্ধু শত্রুর হাতে বন্দি এমতাবস্থায় সরকার গঠন করে মন্ত্রীত্ব নিয়ে কলহ করার দরকার নেই। বরং তার পরিবর্তে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে সকলের উচিত হবে যুদ্ধের মাঠে যাওয়া। তিনি সরকার গঠন ও সামরিক কমান্ড সংক্রান্ত তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার না করার দাবি জানান।২৮ তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উলইসলাম ব্যতীত উপস্থিত সবাই এই বক্তব্য সমর্থন করলে পরিস্থিতি এক জটিল দিকে মােড় নেয়ার উপক্রম হয়। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন কামারুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, তােফায়েল আহমদ প্রমুখ। সভায় আলােচকরা কেউ মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার | যৌকিতা অথবা দিল্লি আলােচনার উপযােগিতার বিষয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলেন নি। তারা অধিকাংশই মুখ্যত প্রশ্ন তােলেন তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পূর্বাহ্নে প্রেরিত প্রতিনিধি চিত্তরঞ্জন সুতারকে বেশ তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। এ পর্যায়ে আমীরউল-ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের সরকার গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং বলেন এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ভারতীয় সাহায্যপ্রাপ্তি সহজতর ও মুক্তিযুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত হবে। এছাড়াও তিনি শেখ ফজলুল হক মণির প্রস্তাবিত যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের বিরােধিতা করে বলেন:৩২

বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে তাহলে। জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা কোনটির আদেশ মেনে চলবেন? কোন্ কাউন্সিলের সাথে বিদেশের সরকার সহযােগিতা করবে? এক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠনের সম্ভাবনা।

——–

ঐ, পৃ. ১১১। ঐ, পৃ. ১১০। মঈদুল হাসান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।

ঐ । বরিশাল জেলার পিরােজপুরের অধিবাসী চিত্তরঞ্জন সুতার ১৯৫৪ সানের নির্বাচনে পাকিস্তান কংগ্রেস দলের সদস্য হিসেবে সংরক্ষিত তপসিলী আসনে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের অসহযােগের সূচনাতে কলকাতায় গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য একটি বাড়ি ভাড়া করে বসবাস করতে থাকেন। তাকে কেন্দ্র করেই ভারতে মুজিব বাহিনীর। ••াম শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ফিরে এলেও ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর তিনি পুনরায় কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। দেখুন, মাসুদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১। ১৭ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১১।

নাই কি? …কোন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে

অবমাননা করা হবে। আমীর-উল-ইসলামের পর স্থিতধী তাজউদ্দীন আহমদ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপূর্বক বক্তৃতা করেন। এর দ্বারা বিশেষত কামারুজ্জামান সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তার বিবেচনাপ্রসূত হস্তক্ষেপে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও ফজলুল হক মণি ব্যতীত সকলেই সরকার গঠনের যৌক্তিকতা মেনে নেন। এ পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ বুঝতে পারেন যে, তিনি এক বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন। আরাে অনুধাবন করেন, তিনি যদি অটল না থাকেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধ বিপন্ন হতে বাধ্য। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট যদি মুক্তিযুদ্ধের নেতাদের মতবিরােধের সংবাদ পৌছে তাহলে তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করা কঠিন হবে। সুতরাং তিনি গৃহীত ব্যবস্থাবলির প্রতি দৃঢ় সমর্থন সংগ্রহ ও সরকারের কাজ-কর্ম শুরু করার লক্ষ্যে অন্য নেতাদের খোঁজখবর শুরু করেন। | মুজিব সংগঠন পরিচালনায় তাজউদ্দীনের ওপর নির্ভর করতেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে কে নেতৃত্ব দেবেন সে বিষয়ে নির্দেশনা না থাকার কারণে এই জটিল দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। একটি জাতীয়তাবাদী দলে নেতৃত্বের কলহ থাকা বিচিত্র বিষয় নয়। তাই নিজেকে অনেকেই শেখ মুজিবের যােগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। এদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণি অন্যতম । কিন্তু প্রকৃত বিচারে আওয়ামী লীগে তার কোনাে স্থান থাকার কথা নয়। ছাত্র ও যুবনেতাদের ওপর তার একটা প্রভাব থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার আদৌ কোনাে অবস্থান তার ছিল

। তার প্রধান যােগ্যতা ছিল তিনি মুজিবের ভাগ্নে এবং যুবনেতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি হচ্ছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়। এখন সে ভিত্তি ত্যাগ করে যুবনেতা বা অন্যদের দাবি অনুযায়ী ভিন্নতর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ভারতের পক্ষেও মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যদান সম্ভব নয়। কারাে সঙ্গে আলােচনা না করে তাজউদ্দীন আহমদের উল্লিখিত পদক্ষেপগুলাে গ্রহণের পশ্চাতে ক্ষমতা কজা করার দূরভিসন্ধি আছে বলে শেখ ফজলুল হক মণি মনে করেন। এমনকি সামগ্রিক বিষয়টি পরে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানান। শেখ মণির তাজউদ্দীন বিরােধিতার আর একটি ভিত্তির কথা জানা যায়। যেহেতু শেখ মুজিব যুবনেতাদের পূর্বোল্লিখিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে ভারত সরকারের সাথে যােগাযােগ করার নির্দেশ দিয়েছিলন সেহেতু তারাই প্রকৃত প্রতিনিধি।

————

৯৩৩ এম.এ. মােহাইমেন, ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর, পৃ. ৮৩।

২৮০

সম্ভবত তিনি শেখ মণির মাধ্যমে বিধানসভার সদস্য ও তার বন্ধু সমর গুহকে ভারতীয় সাহায্য সংগ্রহের ব্যাপারে সহস্ত লিখিত একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মণি তা সমর গুহকে না দিয়ে এটি নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। এসব প্রচেষ্টার কারণেই সম্ভবত পরবর্তীকালে মণি। ও যুবনেতারা ভারত সরকারের সঙ্গে বিশেষ সংযােগ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাদেরকে সার্বিক সাহায্য করেন চিত্তরঞ্জন সুতার। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফ এর সহযােগিতায় ভারতে প্রবেশ ও সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করেন। ফলে বিএসএফ এবং ‘র’ এর মধ্যে একটি প্রতিযােগিতা শুরু হয় যার প্রভাব পড়ে যুবনেতা ও তাজউদ্দীন আহমদের সম্পর্কের টানাপেড়েনের ওপর। | ৮ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভবানীপুরের ঐ গােপন বাড়িতে যে। বিরােধিতার সম্মুখীন হন তার সমাধান প্রয়াসে ১০ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সম্ভাব্য সদস্য ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ-খবর সংগ্রহের জন্যে একটি রাশিয়ান ডকেটো বিমানে করে সীমান্ত এলাকায় উড়ে চলেন। আকাশের খুব নিচ দিয়ে। উড়ে যান আর বিভিন্ন স্থানে নেমে নেতাদের খোঁজেন অথবা সংগ্রহের চেষ্টা করেন। সঙ্গে রাখেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ফজলুল হক মণি, তােফায়েল আহমেদ ও নগেন্দ্র সিংকে। এভাবে মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, শিলচর, আগরতলা প্রভৃতি স্থানে নেমে উদ্দীষ্ট নেতাদেরকে সংগ্রহ করেন অথবা বিএসএফ কর্তৃপক্ষকে সংগ্রহ করে আনার অনুরােধ করেন। দুপুরে পৌছেন। বাগডােরা বিমান ঘাঁটিতে। সেখান থেকে জিপে করে শিলিগুড়ি পৌছেন। তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গােলক মজুমদার। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত মােতাবেক শিলিগুড়িতে অবস্থিত একটি রেডিও স্টেশন থেকে তাজউদ্দীন আহমদের রেকর্ডকৃত ভাষণটি প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়। ঐ। দিন সম্ভবত বালুরঘাট থেকে সংগ্রহ করা হয় সম্ভাব্য মন্ত্রিপরিষদ সদস্য মনসুর আলীকে।৩৫ তিনি তাজউদ্দীন আহমদের সরকার গঠন ও প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণকে সমর্থন করেন। ইতােমধ্যে তােফায়েল আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লে মণি তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন। এদিকে মণি তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ প্রচারের ব্যাপারে পূর্বের আপত্তি থেকে সরে আসলেও আগরতলা পৌছে সীমান্তের

——

৯৩৪. মাহবুব করিম (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ নেতা ও মানুষ, পৃ. ৮১। ৩৫ ডা. টি, হােসেনের ভাষ্যমতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপটেন মনসুর আলীর একসঙ্গে তুরা হয়ে আসামে এসে পৌঁছেন ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় । এ বিষয়ে দেখুনঃ Dr. T. Hossain, Involvment in Bangladesh’s Struggle for Freedom (Dhaka: Manbatbadi Karmakedra, Second Edition, 2001), p. 36.

কাছাকাছি সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে কারাে কারাে সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসার পর এ ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তােলেন। তার এ ধরনের আচরণে তাজউদ্দীন আহমদ ব্রিত ও বিরক্তিবােধ করেন। তিনি এক পর্যায়ে তার ভাষণটি না প্রচার করার জন্য আমীর-উল-ইসলামকে বলেন। সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর এ ধরনের বাধা আসা সত্ত্বেও আমীর-উল-ইসলাম পূর্বের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অবশ্য তখন ক্যাসেটটি যথাস্থানে প্রচারের জন্য পৌছে যাওয়ায় নিষেধ করার সুযােগ ছিল না। ঐ দিন রাত সাড়ে ৯ টায় তাজউদ্দীন আহমদ, মণি, আমীরউল-ইসলাম ও অন্যরা যখন নৈশভােজ করছিলেন ঠিক তখন তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে বাংলাদেশ সরকার গঠন সংক্রান্ত ভাষণটি আকাশবাণীর একটি কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। অসুস্থতাজনিত কারণে মনসুর আলী আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন । ঘুম থেকে উঠে উক্ত প্রচারের সংবাদ শুনে খুশিই হন। এই ভাষণটি পরে আকাশবাণীর বিভিন্ন কেন্দ্র এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল পুনঃপ্রচার করা হয়। | বেতার ভাষণটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উৎপত্তির যৌক্তিক বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কোন্ ঘটনা পরম্পরায় এর উৎপত্তি, বর্তমান পরিস্থিতি কি, দেশের কোন্ এলাকায় কাদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে চলছে সে বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ তার বেতার ভাষণে উল্লেখ করেন। মুক্তির এই যুদ্ধকে তিনি ‘জনযুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করে এতে সকল স্তরের মানুষকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা পারদর্শী তাদের অবিলম্বে স্বাধীন বাংলা সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করে দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়। নির্দেশ দেয়া হয় জনগণ যেন শত্রু বাহিনীকে সর্ব উপায়ে অসহযােগিতা করে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিষয়টি মাথায় রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখারও নির্দেশদান করেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার এই যুদ্ধে তিনি জাগ্রত বিশ্ববাসীর নিকট নিঃশর্ত নৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য সহযােগিতাদানের আহ্বান জানান। | তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন যে, বাঙালি জাতি আজ একটি অন্যায় যুদ্ধ ও ধ্বংসের শিকার। মানুষের রক্ত ও ঘামে সিক্ত হয়ে জন্ম নিচ্ছে নতুন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যার মূল বাণী-কল্যাণ, সাম্য আর সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। | ভাষণটিতে বাঙালির প্রাথমিক প্রতিরােধ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়া এবং প্রবল জনসমর্থনের ভিত্তিতে প্রতিরােধ বাহিনীর ক্রমশ শক্তি সঞ্চয়ের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। ফলে এটি যুদ্ধরত বাঙালি জাতিকে সর্বাত্মকভাবে অনুপ্রাণিত করে। বস্তুত দেশবাসীর উদ্দেশে বাংলাদেশ সরকারের

———

৯৩৬ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১৪।

পক্ষ থেকে এটিই প্রথম ব্যাপক ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ, যুক্তিযুক্ত ও অনুপ্রেরণাদানকারী ভাষণ। এ সম্পর্কে গবেষক আফসান চৌধুরী লিখেছেন “এর উদ্দেশ্য ছিল। বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা যে একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা সেটি সবাইকে জাননাে।”৯৩৭

ভাষণটি প্রচারিত হওয়ার অল্প পরে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ | করতে আসেন কর্নেল নুরুজ্জামান ও রংপুরের নেতা আবদুর রহমান। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সারারাত ধরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলের অবস্থা ও করণীয় বিষয়ে আলােচনা করেন। পরদিন ১১ এপ্রিল সকালে তারা আবার বিমানযােগে সীমান্ত দিয়ে আসামের তুরা পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হন। সেখানে পূর্ব নির্দেশ | অনুযায়ী বি এসএফ সদস্যরা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান এম.পি.এ. ও অন্যদেরকে সংগ্রহ করে অপেক্ষমান রাখে । সরকার গঠনের সংবাদ পেয়ে তারা বেশ খুশি হন। ফলে ল্প পরে গঠিত মন্ত্রিপরিষদের মােশতাক আহমদ ব্যতীত অন্য তিনজন সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলী | তাজউদ্দীন আহমদের গৃহীত পদক্ষেপ সমর্থন করেন। | ইতােমধ্যে আগরতলায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এসে উপস্থিত হন। পূর্বদিন খন্দকার মােশতাক আহমদ ডা. টি. হােসেনের সহযােগিতায় আগরতলায় পৌছেন। আরাে এসে হাজির হন অবসর গ্রহণকারী কর্ণেল ওসমানী, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, জহুর আহমদ চৌধুরী ও অন্যরা। এম.আর সিদ্দিকীও দিল্লি থেকে ফিরে আসেন। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিভিন্ন স্তরের নেতা ও বুদ্ধিজীবীকে আগরতলা সীমান্তে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে মােখলেছুর রহমান (সিধু ভাই নামে পরিচিত) সিধু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওসমানীকে পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান | সেনাপতির পদ গ্রহণের অনুরােধ জানালে তিনি সম্মত হন।

—-

৯৩৭ আফসান চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৬।

দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১৬।

মােখলেসুর রহমান সিধু ১৯২১ সালের ১৫ মার্চ নিলফামারী জেলার ডিমলা থানার অন্তর্ভক্ত খগাখড়িবাড়ি গ্রামে জনুগ্রহণ করেন। মুসলিম লীগ রাজনীতিতে প্রথমে যুক্ত হলেও পাকিস্তানের জন্মের পর বামধারার রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। ২৫ মার্চের পর পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নােয়াখালি-কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় অবস্থান করে তিনি মুজিবনগর সরকারের নিকট বিভিন্ন সংবাদ প্রেরণ করতেন মডেল বিবি রাসেল তার কন্যা। ১৯৮৯ সনের ১৫ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন।

রাতে আগরতলা সার্কিট হাউসে উপস্থিত নেতাদের নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠকে বসেন। আলােচনায় ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশের অবস্থা ও তার গৃহীত ব্যবস্থা ইত্যাদি স্থান পায়; পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও মতবিনিময় করা হয়। এখানে ভবিষ্যৎ কর্মসূচিও প্রণীত হয়। উল্লেখ্য যে, মােশতাক আহমদ তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণকে মেনে নিতে সম্মত ছিলেন না। তিনি নিজে ঐ পদ দখল করার চেষ্টায় ছিলেন । নাখােশ হয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলে বসেন তাকে। যেন মক্কায় হজ্জ করতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সভার কাজ অসমাপ্ত রেখে তিনি। পেটের পীড়ার অজুহাতে কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ পেছনে পেছনে দরজা পর্যন্ত এসে মােশতাকের নিকট অন্তত তিন মাস সময় ধৈর্য ধরতে বলেন। পরে তার অনুরােধের প্রেক্ষিতে ডা. টি, হােসেনের প্রচেষ্টায় মােশতাক আহমদ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন। পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে এই সরকারের প্রকাশ্য শপথ অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেয়া হলে ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় তা সম্পন্ন করার একটি সিদ্ধান্ত হয়। | তাজউদ্দীন আহমদ সফল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে কলকাতা ও দিল্লিতে যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এভাবে অনেক বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে তা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রভাবশালী সদস্যদের অনুমােদন লাভ করে। একই সঙ্গে মােটামুটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কোনাে বিকল্প নেই। আগরতলায় অতঃপর অন্যান্য কাজ শেষ করে তিনি এপ্রিলের ১৩ তারিখে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে আর। একটি অতীব তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তাজউদ্দীন আহমদ হাত দেন। এটি ছিল।

—–

৯৪০. বৈঠকটি প্রকৃতপক্ষে এম.আর সিদ্দিকীর কুঞ্জশ্রী নামক বাংলাে প্রকৃতির আবাসস্থলে অনুষ্ঠিত হয় বলে ডা. টি হােসেনের লেখা হতে জানা যায় । Dr.T. Hossain, op.cit., pp. 39-40. “. Ibid, p. 40. *, পরে ডা.টি হােসেন গবেষককে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর তারিখে বলেন যে, তিনি মােশতাককে সম্মত করাতে শেষ পর্যন্ত ভয় দেখান এই বলে ‘তাজউদ্দীন আহমদ যদি ভারতীয় লােকজন দিয়ে আপনাকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে বলে মােশতাক আহমদ হারিয়ে গেছে তাহলে কি কারাে কিছু করার আছে? তার চেয়ে কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ আপনার জন্য ভাল হবে না? মুক্তিযুদ্ধ। পরিচালনার জন্য এই মন্ত্রণালয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যােগাযােগ হবে এর মাধ্যমে । তারপর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন।’ Ibid, pp. 4()-43.. *** দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১৮।

কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলীকে তার সকল স্তরের বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারি নিয়ে বাংলাদেশ পক্ষে যােগদানে সম্মত করানাের প্রচেষ্টা। তাজউদ্দীন আহমদ প্রত্যাশা করেন যে, মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের পর পরই যেন কলকাতা মিশনের কূটনীতিকরা বাংলাদেশ পক্ষে যােগদান করেন। এর যেমন কূটনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, তেমনি প্রশাসনিক কাজ চালানাের জন্য একটি প্রকাশ্য কার্যালয় ছিল খুব জরুরি। কেননা বাংলাদেশ সরকার তখন ছিল সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য। কাজেই তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলা থেকে কলকাতা ফিরেই এই বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন। অন্তত দুবার হােসেন। আলীর সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে একান্তে আলােচনায় মিলিত হন (এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলােচনা করা হবে)।

| চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী করার খবর পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়ে পড়লে ১৩ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় হামলা চালায়। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানটি বিলম্বিত হয় । পরবর্তীতে কবে কোথায় এটি সম্পন্ন হবে তা অতি গােপন রাখা হয়। ইতােমধ্যে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র রচনা, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ ও অনুষ্ঠানমালা সম্পর্কিত বিষয়গুলাে সম্পন্ন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদের মৌলিক কিছু নির্দেশনার ভিত্তিতে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি আগেই রচনা করেছিলেন। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সম্পর্কিত বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ কোনাে একজন খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদকে দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নিতে বলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম কলকাতার ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীকে এটি দেখালে তিনি এক কথায় চমৎকার ও অপরিবর্তনীয় বলে মন্তব্য করেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ১৬ এপ্রিল আমীর-উল ইসলাম ও আবদুল মান্নান এম.এন.এ কলকাতা প্রেসক্লাবে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের জানান যে, তারা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা এনেছেন। সকলকে আগামীকাল (১৭ এপ্রিল) খুব সকালে প্রেসক্লাবে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হচ্ছে, তাদের জন্য গাড়ী প্রস্তুত থাকবে। আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয় বিএসএফ এর সাহায্যে। | নির্ধারিত স্থান মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক একটি বৃক্ষটাকা গ্রাম । ঐ অঞ্চলটি তখনও পাকিস্তানি কর্তৃত্বের আওতা বহির্ভুত ছিল। ছােট স্থানটি

৯৪৪ UPI, New Delhi, 14 April, 1971. ৯৪৫ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১১৯। ৯৪৬ ঐ, পৃ. ১২০।

২৮৫

বৃক্ষাচ্ছাদিত এবং তিনদিক থেকে ভারত ভূভাগ দ্বারা বেষ্টিত থাকার কারণে এর ওপর বিমান আক্রমণের আশংকা ছিল কম। আবার স্থল আক্রমণ হলেও কিছু সময়ের জন্য তা ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। ফলে নেতা ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের পক্ষে নিরাপদে ভারত ভূমিতে প্রবেশ সম্ভব হতে পারে। মূলত কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করেই সরকারের শপথ গ্রহণের মতাে অনুষ্ঠানের জন্য স্থানটি নির্বাচন করা হয়। | ১৭ এপ্রিল প্রথম প্রহর থেকে নেতাদের গাড়িতে উঠিয়ে দেয়া শুরু হয়। সকালে আমীর-উল-ইসলাম ও আবদুল মান্নান কলকাতা প্রেসক্লাবে গিয়ে দেখতে পান দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড় উপচে পড়ছে। তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করতে যাচ্ছে । পরিশেষে প্রায় ৫০-৬০ টি গাড়ির বহর নির্দিষ্ট স্থানের দিকে সাংবাদিকদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে।

ওদিকে মেহেরপুরে প্রতিরােধকর্মে নিয়ােজিত কয়েকজন নেতাকে ১৭ এপ্রিল প্রথম প্রহরের দিকে সংক্ষেপে জানানাে হয় যে, সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সকাল হতে সে মর্মে মাইকিং শুরু হলে বৈদ্যনাথতলা ও এর আশপাশে স্থানীয় উৎসুক জনতার ভিড় ক্রমাগত জমে ওঠে। সকাল ৯ টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ অন্য নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গিয়ে পৌছেন। অবশ্য সাংবাদিকদের বহনকারী গাড়িবহর তার কিছু পরে সভাস্থলে পৌছে । | স্থানীয় জনগণের বাড়ি থেকে জীর্ণ ও সাধারণের ব্যবহার্য কাঠের আসবাব সংগ্রহ করে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। নেতাদের সঙ্গে আসা বিএসএফএর জনৈক কর্নেল চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে অতি সাধারণ একটি মঞ্চ তৈরি হলে সেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যবর্গ সেনাবাহিনী প্রধান এম.এ. জি. ওসমানী, নির্বাচিত প্রতিনিধি আবদুল মান্নান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রমুখকে ওঠানাে হয় । উপস্থিত জনতা ঐতিহাসিক এই ক্ষণে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে সকলকে স্বাগত জানায়। মাহবুব উদ্দীন কয়েক পাটুন ইপিআর, পুলিশ ও মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যকে গার্ড অব অনারের জন্য প্রস্তুত করেন। অনুষ্ঠানের শেষের

———–

৯৪৭ মােহাম্মদ নুরুল কাদির, একাত্তর আমার (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৯), পৃ. ৪৬৪৭। ৯৪৮ দলিলপত্র, নবম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫।

দিকে মেজর ওসমান কয়েকজন সঙ্গীসহ যুদ্ধের মাঠ থেকে এসে পৌছেন। ১৯৭৩ সালে প্রদত্ত তওফিক ইলাহীর একটি সাক্ষাৎকার হতে এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিলিখিত বর্ণনা পাওয়া যায়:৯৫০

বেলা প্রায় ১১ টা নাগাদ বহুপ্রতিক্ষীত অনুষ্ঠানের সূচনা হল। আমি জিপে করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও অন্য কয়েকজনকে মঞ্চের ৫০ গজের মধ্যে তােরণের কাছে নিয়ে এলাম । মাহবুব গার্ড অব অনারের নেতৃত্ব দিল । সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করলেন। পিছনে দাড়িয়ে জেনারেল ওসমানী । সৈয়দ নজরুল ইসলাম যখন পতাকা উত্তোলন। করছিলেন তখন সাংবাদিকরা তাদের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি ছােট দল জাতীয় সংগীত ‘আমার সােনার বাংলা গাইলাে। একটা জাতির জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করলাম ।… গার্ড অব অনারের পর ভাবী মন্ত্রিসভার সদস্যরা মঞ্চে উপবেশন করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা। ঘােষণা করলেন। তারপর এক এক করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণদান করলেন। রাষ্ট্রপতির পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঘােষণা করা হল, লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের নিচে পাকিস্তান সমাধিস্থ হয়েছে। আর এই সমাধির উপরে একটি জাতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সেই জাতি হলাে বাংলাদেশ ।

মানুষ এই ঘােষণাকে অভিনন্দিত করলাে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভার শপথ পাঠ করানাের পর স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে বলা হয়, বর্তমান অবস্থা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষই দায়ী । ২৫ মার্চ পর্যন্ত সব কিছুই সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী চলে। এসেছে। বৈধ ভােটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান শাসনের অধিকার অর্জন করে। ক্ষমতা হস্তান্তর ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত পরিষদের অধিবেশন পর্যন্ত আহ্বান করে। শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হােক, বাঙালিদের পক্ষ থেকে এ ধরনের কেবল প্রত্যাশাই পরিলক্ষিত হয়নি, উপরন্তু সরকারের এ ধরনের সকল প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ সকল প্রচেষ্টাকে সমাধিস্থ করা হয় আলােচনার ফলাফল ঘােষণা না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গােপনে ঢাকা ত্যাগ এবং নিরস্ত্র-নিরীহ সকল শ্রেণীর মানুষের ওপর নির্বিচারে পুরােমাত্রায় সামরিক আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে।

———

ঐ, পৃ. ৩৬৬-৩৬৭। ৯৫ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১২১।

কেবল সম্ভাবনাময় গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্যই এ আক্রমণ চালানাে হয়নি; নীলনকশা অনুযায়ী একটি ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী জনগােষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যেও তা পরিচালিত হয়। জাতীয়ভাবে তাদের জীবনে এমন বিপর্যয় ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার ইতঃপূর্বে আর কখনাে হতে হয় নি। আক্রান্ত হয়ে বাঙালি। জাতি এমন একটি অবস্থায় উপনীত হয় যে, আত্মরক্ষার মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নে রুখে দাঁড়ানাে ছাড়া কোনাে বিকল্প খােলা ছিল না। এমতাবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ঘােষণা করেন এবং জাতিকে শেষ রক্তবিন্দু। দিয়ে চাপিয়ে দেয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। জাতি বীরত্বের সঙ্গে সে ঘােষণা মােতাবেক হানাদারদের মােকাবিলা অব্যাহত রেখেছে। বাঙালি জাতির এ যুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রাম। এমতাবস্থায় ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে সার্বিকভাবে রক্ষা করা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তথা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নৈতিক দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনের জন্য একটি সরকারের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। এটা জনগণের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। ঘােষণাপত্রটিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিশ্বসংস্থার সনদ মেনে চলার অঙ্গীকারও সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়। রাষ্ট্র হিসেবে সাম্য, মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কেননা দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিরা সে ধরনের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে এবং বস্তুত সে কারণে আজ তারা প্রতিপক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। আরাে উল্লিখিত হয় যে, যতদিন পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভব না হচ্ছে ততদিন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে সকল নির্বাহী ক্ষমতা পরিচালনা করবেন। তার অক্ষমতা বা অনুপস্থিতির কারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়ােগ করবেন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। যুদ্ধরত একটি জাতির জন্য এটা একটা আপাত ব্যবস্থা হিসেবে উত্তম । আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের দৃষ্টিতে যৌক্তিকতার বিষয়টিসহ এভাবে অল্প কথায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার ঘােষণার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়। | আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে দেখা যায় যে, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ১৭৭৪ সালে আমেরিকাতে এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল । কংগ্রেস কর্তৃক ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ‘Declaration of Independence’ নামক সনদ ঘােষণার মাধ্যমে তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। এটা রচনা করেছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের তাত্ত্বিক গুরু নামে পরিচিত William Jefferson (১৭৪৩-১৮২৬)। আমেরিকার স্বাধীনতা সনদ ঘােষণার পর বাংলাদেশ ব্যতীত আর কোথাও অনুরূপ ঘােষণা প্রদান করে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা দেখা যায় না। বাংলাদেশের ঘটনাটি আরাে অনন্য এ জন্য যে, একটি সংখ্যাগুরু জনগােষ্ঠী দীর্ঘদিন অন্য আর একটি ভৌগােলিকভাবে দূরবর্তী ও বিচ্ছিন্ন সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর শাসনাধীনে থাকার পর নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার সকল শর্তই অর্জন করে। শুধু তাই নয় সমগ্র পাকিস্তান শাসন করার অধিকার অর্জিত হয়। কিন্তু সে সুযােগ থেকে তাদেরকে কেবল বঞ্চিত করার চক্রান্তই করা হয়নি, উপরন্তু তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার সকল প্রয়াস চালাতে চাইলে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার চেয়ে বড় অধিকার আর কি হতে পারে? জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ঘােষণা ছিল সম্পূর্ণরূপে বৈধ অধিকার। ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতটি উল্লেখ করে বলেন যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নিকট যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়। এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্বাধীনতা ঘােষণা প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করা হয়। তাহলে সে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জনগণের ইচ্ছানুসারে ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনবিদ Quiency Wright অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে জাতিসংঘ ১৯৬০ সালের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করে ১৫১৪ (XV) ও ১৫৪১ (XV) নং প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের নিকট বিনাশর্তে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে প্রস্তাব পাশ করে। কাজেই জাতিসংঘের

—-

৯৫২, আব্রাহাম লিংকন মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম উদ্বোধনী ভাষণের উপসংহারে সংখ্যাগরিষ্ঠের সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে বলেন” A mjority held in restraint by costitutional checks and limitations, and always changing easily with deliberate change of popular options and sentiments, is the only true sovereign of a free people. Whoever rejected it does, of necessity, fly to anarchy or to despotism. Unanimity is impossible; the rule of a minority, as a permanent arrangement, is wholly inadmissible; so that, rejecting the majority principle, anarchy or despotism in some form is all that is left.” Subrata Roy Chowdhury, The Genesis of Bangladesh: A Study in the International Legal Norms and Permissive Conscience (Bombay: Asia Publishing House, 1972), p. 214. ৯৩ Ibid, pp. 210-211. আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার বৈধতার বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আরাে দেখুন অত্র গ্রন্থের ১৮৮২২২ পৃ. ।

শর্তানুযায়ীও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা ছিল সম্পূর্ণরূপে বৈধ। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের রচয়িতা William Jefferson এর বক্তব্যটিও বাংলাদেশের সরকার গঠনের বৈধতার পক্ষে একটি জোরালাে যুক্তি। তিনি

বলেন:৯৫৪

When in the course of events, it becomes necessary for one people to dissolve the political bonds which have connected them with another, and to assume among the powers of the earth, the separate and equal station to which the laws of nature and of nature’s God entitle them a decent respect to the opinions of mankind reqires that they should declare the

causes which impel them to the separation. সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন, মৌলিক মানবাধিকার, জাতিসংঘ সনদ প্রভৃতি সব দিক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার অধিকার যথার্থ । পৃথিবীব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আদর্শিক তত্ত্বের ইতিহাস যা ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতিলাভ করে তার সকল উপাদানের সমাবেশ ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণায়।

যাহােক, বাংলাদেশ সরকার যে একটি বাস্তব সত্য এবং তা পরিচালনার জন্য। এর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত মন্ত্রী আছেন তা প্রতিষ্ঠার জন্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দকে হাজির করা হয়। জনসম্মুখে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নিলিখিত ব্যক্তিদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘােষণা দেয়া হয়:

রাষ্ট্রপতি : শেখ মুজিবুর রহমান উপরাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী : এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান পরারষ্ট্রমন্ত্রী : খন্দকার মােশতাক আহমদ। সেনাবাহিনী প্রধান কর্নেল (অব:) আতাউল গণি ওসমানী। তাকে

অবশ্য একজন মন্ত্রীর পদমর্যাদাও প্রদান করা হয়। সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত প্রাঞ্জল, যুক্তিপূর্ণ ও আবেগঘন ভাষায় ভাষণদান করেন যা উপস্থিত সকলকে স্পর্শ করে ।

—–

৯৫৪* মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পৃ. ৬৭১।

২৯০

তিনি প্রধান সেনাপতি হিসেবে এম.এ.জি. ওসমানীর নাম ঘােষণা করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নেরও জবাব দেন। মুক্তিযুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবের জনসম্মােহনী ভাবমূর্তিকে কাজে লাগানাের জন্য স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। এ ধরনের অনুষ্ঠানে মুজিবের অনুপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হয়। জনতা প্রতিক্ষণই মুজিব যে কোনাে সময় এসে পড়বেন বলে প্রতীক্ষা করে। বস্তুত সাধারণ জনতা ও অনেক যােদ্ধারই জানা ছিল না যে মুজিব বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ জনতার অনুভূতিকে স্পর্শ করার জন্য ঐ নামকরণ করেন। তিনি জনগণকে মুজিবের বন্দি হওয়ার সংবাদ দিয়ে হতাশ করতে চাননি। তিনি বুঝাতে চান, মুজিব আছেন, তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, তারই নির্দেশে সবকিছু হচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে ও বক্তৃতায় পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলার শােষিত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত জোরালাে যুক্তি দিয়ে উল্লেখ করেন এবং বলেন এরই ফলে বাংলাদেশের জন্ম অনিবার্য হয়ে ওঠে। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন যে, তাদের বলা উচিত পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী । স্বাধীন বাংলাদেশ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত-পালিত করছে। দুনিয়ার কোনাে জাতি নতুন এই শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। তার ভাষায়:৯৫৫

আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না … আমরা কোন শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভূক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। আমরা তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না ।… বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করে নি। জয় বাংলা ।

বস্তুত বিদেশি সাংবাদিকদের কল্যাণে বাংলাদেশের জন্মের সংবাদ ঐ দিনই বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক

৯৫৫ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ১২০।

প্রেক্ষাপটে এই শপথ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাস্তব ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

এভাবে তাজউদ্দীন আহমদ অকল্পনীয় আঘাতে হতবিহ্বল বাঙালি জাতির যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সরকারের অধীনে আনতে সক্ষম হন। প্রবল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে তিনি এই প্রায় অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেন। বস্তুত তিনি নিজের চেতনায় বাঙালির বিস্ফোরিত পূর্ণাঙ্গ সত্ত্বাকে ধারণ করেন। এ ধরনের একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছা খুব দুরূহ কাজ জানা সত্ত্বেও তিনি এই সুকঠিন দায়িত্বটি স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে। নেন। মুজিবনগরে স্থাপিত বাংলাদেশের এই সরকারের ধরন যাই হােক না কেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে সমগ্র নির্বাহী ক্ষমতা তাজউদ্দীন আহমদের পরিচালনার সুযােগ সৃষ্টি হয়। যুদ্ধকালে কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব অধিক কার্যকর হয়, তবে ঝুঁকির বিষয়টি ছিল । রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন শক্রর হাতে বন্দি। তাকে দিয়ে চরম মুহূর্তে লক্ষ্য-বিরােধী কোনাে চুক্তি করিয়ে নেয়ার বাহ্যত। আশংকা ছিল। দিল্লিতে বসে যখন তাজউদ্দীন কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন বিষয়টি তাকে খুব ভাবায়। এক পর্যায়ে তিনি সঙ্গীদের বলেন যে, তিনি মুজিবকে যতটুকু জানেন তাতে তাকে দিয়ে বাঙালির স্বার্থবিরােধী কোনাে কিছু পাকিস্তানিরা বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ করাতে সক্ষম হবে না।”” শপথ অনুষ্ঠান হওয়ার খুব অল্পকাল পরে দ্রুততার সঙ্গে কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রােডের বাড়িতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের একটি সচিবালয় স্থাপন করেন। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান এবং সরকারের সচিবালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশ সরকারের সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কর্মযজ্ঞ ।

৯৫৬, ঐ, পৃ. ২২৪। ৯৫৭ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ১০৮।

২৯২

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!