You dont have javascript enabled! Please enable it!

কে এই গোয়েন্দাবাহিনী প্রধান রউফ? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

এখন ব্রিগেডিয়ার রউফ সম্পর্কে বলছি। কেন এবং কিভাবে তিনি DFI তে আসলেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে রউফ (তৎকালীন মেজর) আই এস আই এর ডাইরেক্টরেটের প্রধান (ISI Det Comd) ছিলেন। সেসময় ৬ দফা দাবীর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করা হয়। সেসময় “আগরতলা ষড়যন্ত্র” নামে একটি দেশদ্রোহীমূলক মামলা করা হয়। যেখানে জুনিয়র আর্মি, নেভি অফিসার এবং তিন বাহিনীর অন্যান্য র‍্যাংকের কিছু সেনাকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের সবাইকে এরেস্ট করা হয় এবং দেশদ্রোহিতার জন্য বিচার করা হয়। এই সুযোগে পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে থামানোর জন্য তাঁকেও এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে। শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ৬ দফা পাকিস্তানীরা ভালো চোখে দেখেনি – বিশেষ করে আইয়ুব খান। পাকিস্তানীরা মনে করেছিলো সে খুব বেশী বেশী চাচ্ছে।

সেকারণে তাঁকে (শেখ মুজিবকে) ঠাণ্ডা করার জন্য তারা “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলায় তালিকাভুক্ত করে। সেকারণে অন্যান্য দেশদ্রোহীমূলক বাঙালি আর্মি অফিসার ও লোকদের সাথে তাঁকে চার্জ করা হয়। এই অপরাধ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি ছিলো মৃত্যুদণ্ড। ISI ডিরেক্টরেট তখন বিষয়টা দেখভাল করছিলো। সেখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিগেডিয়ার (তৎকালীন মেজর) রউফের সাথে পরিচিত হন।

যখন “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলা চলমান ছিলো মানুষ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো তাঁকে সরানোর জন্যই এটা করা হয়েছে। ফলে তারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা তুলে নিতে বিদ্রোহ শুরু করে এবং সেটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেটি তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ছড়িয়ে পরে। আন্দোলন এত চরম আকার ধারণ করে যে সরকার বাধ্য হয়ে মামলা বন্ধ করে দেয় এবং শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়। জনগণ তাঁকে ফিরে পেয়ে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেয়। সেই থেকে শেখ মুজিব আমাদের বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেবার সাথে সাথে অন্যান্য সকল ইউনিফর্মড অফিসার ও বাহিনীর লোকদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তিতে এসকল অফিসার ও অন্যান্য সবাইকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। মামলা তুলে নেবার পর, ঢাকায় আই এস আই এর ডাইরেক্টরেটের (ISI Det) এও পরিবর্তন আনা হয়। মেজর (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফকে প্রোমোশন দিয়ে লে কর্নেল করে শিয়ালকোটে বদলি করা হয়। শিয়ালকোটে তাকে ৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেটি সেখানেই অবস্থিত ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের পুরোটা লে কর্নেল রউফ পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের ব্যাটেলিয়নেই ছিলেন। পরে ১৯৭৩ সালে তিনি এই ব্যাটেলিয়নের সাথে পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েটেড হয়ে ফিরে আসেন।

পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশনের পর প্রায় সকল অফিসার ও বাহিনীর লোককে নতুন গঠিত বাংলাদেশ আর্মিতে নিয়ে নেওয়া হয়। এই রিপ্যাট্রিয়েটেড লোকেরা জানে যে আমরা একটি রিপ্যাট্রিয়েশন বিষয়ক সরকার প্রদত্ত্ব ফর্মুলা অনুযায়ী তাদেরকে চাকরীতে বহাল করেছি। সেই ফর্মুলার ভিত্তিতে তাদেরকে বাছাই করা হয়েছিলো। যতোটা তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিলো যে তালিকা অনুযায়ী তাদের বহাল রাখা হবে। লে কর্নেল রউফ আরও অনেকের সাথে সেসময় আর্মিতে বহাল ছিলেন এবং এদেরকে বিভিন্ন ইউনিটে পদায়ন করা হয়। এরপর তারা লক্ষ্য করেন যে একাত্তরের পূর্বের হিসাব অনুযায়ী তাদের কিছু জুনিয়র অফিসার তাদের চাইতে সিনিয়র র‍্যাংকে আছে। সেটি তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। বাইরে থেকে তারা যথেষ্ট ভদ্রতা দেখালেও ভেতরে ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা করতেন।

রিপ্যাট্রিয়েশন শুরু হবার আগে আমাদের যে গাইডলাইন ছিলো সেই অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে কাউকে এমন কোন অফিসারের আণ্ডারে রাখা হবেনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে যে তাদের (রিপ্যাট্রিয়েটদের) জুনিয়র ছিলো। কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা ষত্বেও এটা সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। একথা উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যে ঐসব জুনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদেরকে ২ বছরের সিনিয়রিটি প্রদান করা হয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান আর্মির হিসেবে অনেক রিপ্যাট্রিয়েটেড অফিসার তাদের র‍্যাংকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন। বিশেষ করে যারা লে কর্নেল এবং এর উপরের র‍্যাংকের। এদের মধ্যে কে কর্নেল রউফ ছিলেন যিনি সিলিং এর সর্বোচ্চ লেভেলে আছেন। অর্থাৎ তিনি আর প্রোমোশন পাবেন না। তাছাড়া আমরা খেয়াল খুশি মত কিছু করতে পারিনা। এমনকি আমরা এরকমও ভেবেছিলাম যে তাদের কাউকে কাউকে দেশে ফিরে আসার পর পাকিস্তানে যে র‍্যাংক ছিলো তার চেয়ে উপরের র‍্যাংক দেবো। এটা তাদের মনোবল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে করা হয়। যখন আমি এই বিষয়গুলোর পরিকল্পনা করছিলাম এবং এই অফিসারদের কাকে কোথায় দেয়া যায় সেসব রেডি করছিলাম তখন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন DFI প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল) আমিনুল ইসলামের স্থলে লে কর্নেল রউফকে দিতে। আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লে কর্নেল রউফকে চিনতেন সেই “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার সময় যখন তিনি (বঙ্গবন্ধু) মিলিটারি কাস্টডিতে ছিলেন। সেসময় হয়ত কোনোভাবে লে কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফ বঙ্গবন্ধুকে বিমোহিত করেছিলেন এবং তার বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেকারণে সেই বিশ্বাসের স্থান থেকে বঙ্গবন্ধু লে কর্নেল রউফকে ডিজিএফাই করার আদেশ দিলেন।

পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশনের পরে লে কর্নেল (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) রউফ ডিজিএফআই হলেন। এটা একটি স্বতন্ত্র ও খুব গুরুতপূর্ণ নিয়োগ। গোয়েন্দা সংক্রান্ত বিষয়ে তার একদিকে যেমন চিফদের সাথে এক্সেস আছে অপরদিকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির সাথেও তার এক্সেস আছে। (এখানে উল্লেখ্য যে রউফ ১৮১ জন পাকিস্তানী অফিসারের একজন)। ডিএফআই তে চাকরীর শুরুতে লে কর্নেল রউফ খুব নিয়মিতভাবেই গোয়েন্দাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় আমাদের কাছে (তিন বাহিনী প্রধান) রিপোর্ট করতেন। যতদিন এই অফিসটা আর্মি হেডকোয়ার্টারে ছিলো ততদিন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত রিপোর্ট করতেন। কিন্তু কার্যালয়টি এখান থেকে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে ধীরে ধীরে রিপোর্ট দেবার পরিমাণ কমতে থাকলো। একসময় এমন অবস্থা হল যে প্রেসিডেন্টকে আমার জানাতে হল যে ব্রিগেডিয়ার রউফ আমাকে নিয়মিত গোয়েন্দা রিপোর্ট দিচ্ছেন না – অন্তত যতটুকু তার দেবার কথা। তথ্য পেতে আমাকেই তাকে (রউফ) কল করতে হত।

Source: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC

Translated by Dr Razibul Bari

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!