You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশকে স্বীকৃতির শর্ত?

বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের দাবী প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের। কেন্দ্রীয় সরকারের ইতস্ত ত মনােভাবে অনেকেই ক্ষুব্ধ। একথা সত্য, পাক-সৈন্যদলের বিরুদ্ধে সত্যিকারের লড়াই করতে হবে স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকারকে। নয়াদিল্লী তাদের হয়ে বন্দুক কাঁধে নিয়ে ময়দানে নামবেন না। নামলে স্বাধীন বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে না। বর্তমান অবস্থায় দরকার মুক্তিফৌজের হাত জোরদার করে তােলা। তা করতে হলে প্রয়ােজন স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং প্রয়ােজন অস্ত্র সরবরাহ। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলাে প্রয়ােগের উপযুক্ত শিক্ষণ। তাতে বাড়বে মুক্তিফৌজের মনের জোর এবং লড়াই এর ক্ষমতা। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের লড়াই বেধে যাবে—এ ধারণা ঠিক নাও হতে পারে। ওটা নির্ভর করছে ইসলামাবাদের মর্জির উপর। ওরা কাশ্মীর কিম্বা বাংলাদেশ সীমান্তে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। সংবাদ পাওয়া গেছে, কাশ্মীরের যুদ্ধ বিরতি সীমারেখায় পাকিস্তান হানাদার জড় করছে। তাদের দু-একটি দল সীমান্ত অতিক্রমের সময় খতম হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং তার সরকারকে অস্ত্র সাহায্য করতে গেলে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। ভারত এগিয়ে গিয়ে আক্রমণ করবে না। কিন্তু আক্রান্ত হলে প্রত্যাঘাতে বিরত থাকবে না।
মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং মুক্তিফৌজের জন্য অস্ত্র সাহায্য চান। কিন্তু তারা পাক-ভারত যুদ্ধ বিরােধী। শুধু মার্কসবাদী কমিউনিস্ট কেন, পাক-ভারত লড়াই অনেকেই চান না। লড়াইটা বাস্তব এবং তার ফল সুদূরপ্রসারী। ওটা পরিহার করা অবশ্যই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই সব সময় যুদ্ধ এড়িয়ে চলা যায় না। মুক্তিফৌজকে সামরিক শিক্ষণ এবং সামরিক সাহায্য (অস্ত্র-শস্ত্রের যােগান) দিতে গেলে পাকিস্তান যদি মরিয়া হয়ে ওঠে তবে ভারত কি করবে? হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? ১৯৬৫ সালে নয়াদিল্লী গায়ে পড়ে লড়াই করতে যান নি। আয়ুব খান তাদের উপর ওটা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ভারত প্রত্যাঘাত করেছিল মাত্র। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি চাচ্ছেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে পাক-ভারত যুদ্ধ বর্জন। এই অবাস্তব শর্ত মেনে চলা অসম্ভব। বড়জোড় নয়াদিল্লী বলতে পারেন, আমরা বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অস্ত্র সাহায্য দিয়েই ক্ষান্ত থাকব। নিজেরা আক্রমণ করব না। কিন্তু তার ফলে যদি আক্রান্ত হই তবে লড়াই অবশ্যই চলবে। যারা বলছেন, যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে তাঁদের কথা বােঝা যায়। কিন্তু মার্কসবাদী কমিউনিস্ট স্বীকৃতি দিলে এবং মুক্তিফৌজকে সামরিক সাহায্য করলে পাকিস্তান ভারতের উপর চড়াও হবে না—এমনকি প্রতিশ্রুতি কি মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতারা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে আদায় করতে পারেন?
তারপর আছে মুক্তিফৌজকে অস্ত্র সাহায্যের প্রশ্ন। এই মুক্তিফৌজটা কাদের? অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। এই সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিলে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র যাবে তাদের হাতেই। সৈনিক সংগ্রহ এবং তাদের মধ্যে অস্ত্র বণ্টন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারেরই দায়িত্ব। কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা অস্ত্র পেলেন এবং কারা পেলেন না তা দেখবেন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। সেখানে নাক গলানাের অর্থ সঙ্কটকালে রাজনৈতিক দলাদলি এবং হানাহানির প্রশয় দান। বাঁচা মরার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে দলীয় প্রাধান্যের স্বপ্ন দেখা মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক নয়। যারা এ ধরনের চিন্তা করছেন সমস্যার গুরুত্ব তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে উপলব্ধি করা দরকার। প্রায় সত্তর লক্ষ শরণার্থী এসেছেন ভারতে। আরও আসছেন। ইয়াহিয়ার রাজত্বে ওরা ফিরতে পারবেন না। মুক্তিযােদ্ধারা লড়ছেন একটি আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। ভারতের সাহায্য ছাড়া একে সাফল্যের দিকে টেনে নেওয়া অসম্ভব। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম না করলেও পাকিস্তানের ভারত-বিদ্বেষী উার চলবে। তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। ঘাড়ের উপর শত্রু এসে পড়লেও লড়াই করব না—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়াদিল্লী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারেন না। বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং তাদের অস্ত্র সাহায্য দিতে হবে। তার জন্য যদি পাকিস্তান যুদ্ধ বাধায় তবে যুদ্ধ করতে হবে। এই হচ্ছে দাবী। এর ব্যতিক্রম শুধু কথার কচকচানি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!