You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাজউদ্দীন আহমদ

পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৬৫ সাল হচ্ছে এক বিশেষ ক্রান্তিলগ্ন । পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৮ বছর ধরে বাঙালির দাবির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগােষ্ঠী সম্মান দেখায়নি, বরং সময় সুযােগমতাে তা দমনের চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯৬৫ সালে তা উচ্চতম বিন্দুতে পৌঁছে, কেননা একদিকে এসব দাবির যথার্থতা প্রমাণিত হয়, অন্যদিকে পারস্পরিক বােঝাপড়ার মনােভাব নিঃশেষ হয়ে যায় । ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর এই সম্পর্ক দ্রুত ক্রমাবনতি ঘটে এবং মাত্র ৬ বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ব বাংলায় এবং ১৯৭১ সালে তা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয় । আসলে পাকিস্তান জন্ম থেকেই তার অস্তিত্বের সংকটে ভুগছিল। কারণ সে তার নিজের থেকে অনেক বড় ও বাস্তব ঐতিহাসিক জাতিকে কুক্ষিগত করে বৃথাই তাকে হজম করার চেষ্টা চালাচ্ছিল।*** বিশ্বজগতে সৃষ্টির মধ্যেও নানা দুর্ঘটনা দেখা যায়। পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করা ছিল মনুষ্যসৃষ্ট এ ধরনের একটি দুর্ঘটনাবিশেষ একই দেহে দুটি স্বতন্ত্র শিশুর মতাে। এ জন্য প্রয়ােজন দেখা দেয় অস্ত্রোপচারের যা ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় ।

————–

৫২২, ড, প্রীতি কুমার মিত্র, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস ১৯৫৮-১৯৬৬’, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭-১৯৭১ (ঢাকা আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ১৪৪।

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণিত রাজনৈতিক পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা এবং বাঙালিদের উপলব্ধি সম্বন্ধে আলােকপাত করলে বুঝা যায় কিভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বাধিকারের দাবিতে পরিণত হয়। কতিপয় অর্থনীতিবিদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ব্যাপারে প্রথমে মুখ খােলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড.সাদেক (যিনি পূর্ব পাকিস্তান পরিসংখ্যান বাের্ডের সদস্য ছিলেন), ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড.এ.এফ.এ হুসেন, রেহমান সােবহান ও অন্যদের নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য। বাঙালিদের মধ্যে ড.সাদেকই প্রথম পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্যের ব্যাপারে আলােকপাত করেন। এ সকল অর্থনীতিবিদ পূর্ব পাকিস্তানের অথনৈতিক পরিকল্পনার সাথে নানাভাবে জড়িত ছিলেন এবং বৈষম্যের বিষয়টি তকালীন বাঙালি রাজনীতিবিদদের অনেককেই অবহিত করেন। এরই প্রেক্ষিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান ১৯৫৬ সালে মন্তব্য করেছিলেন যে, পাকিস্তানের দুঅঞ্চলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সমস্যা বিরাজমান এবং সেগুলাের আলাদাভাবে সমাধান বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ সৃষ্টিতে এই ধারণা দ্বিঅর্থনীতির তত্ত্বে পরিণত হয় ।

| বিদেশিদের মধ্যে অস্ট্রীয় অর্থনীতিবিদ কলিন ক্লার্ক পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে (১৯৫২)পাকিস্তান পরিদর্শনকালে উভয় অঞ্চলের মধ্যকার প্রকট বৈষম্য লক্ষ্য করেন। এরপর তিনি অস্ট্রিয়ার বিদেশবিষয়ক বিভাগের ‘গােপন প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়নের জন্য জোর সুপারিশ করেন। বিকল্প হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু লােককে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন পাকিস্ত নি সরকারকে।পরবর্তীকালে রেহমান সােবহানও এ বিষয়ে লেখালেখি করেন। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূর না করলে পশ্চিম পাকিস্তান ক্রমাগত ধনী এবং পূর্ব পাকিস্তান দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকবে। পরবর্তীকালে সংগত কারণেই ব্রিটিশ ডােমিনিয়নের কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতাে অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হতে থাকে।৫২৫

(Dhaka:

৫২৩. Shyamali Ghosh, The Awami League (1949-1971) Academic Publishers, 1990), p.110 ৫২৪. Ibid, p. 110. ৫২৫, Ibid, p. 113.

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১২৫ আর পশ্চিম পাকিস্তানে ২২৫ টাকা। কিন্তু দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকীতে তা আরাে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে হয় ১৯০ ও ২৯২ টাকা। ১৯৬০-১৯৬১ থেকে ১৯৬৪-১৯৬৫ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় মােট বরাদ্দের ৬৮%।*** উভয় অঞ্চলে মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্যের ফলে ১৯৫৯-১৯৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান অপেক্ষা যেখানে ছিল ৩২% সেখানে ১৯৬০-১৯৭০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১% তে।২৮ বৈষম্যের এরূপ আরও পরিসংখ্যান আছে যা পর্যালােচনা করলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। কিন্তু অবাঙালি শাসকগােষ্ঠী এসব বৈষম্যের প্রতি কোনাে দৃকপাত তাে করেই নি বরং যতটা সম্ভব পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার অব্যাহত রাখে।

কোরীয় যুদ্ধ পর্যন্ত পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ পাট উৎপাদন হতাে পূর্ব বাংলায় । রপ্তানীকৃত এসব পাটের মূল্যবাবদ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানে না এনে নিয়ে যাওয়া হতাে পশ্চিম পাকিস্তানে। অর্জিত এই মুদ্রা দিয়ে তিনবার রাজধানী স্থানান্তর এবং ব্যয়বহুল সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিকে শস্যশ্যামল করে তােলা হয়। অন্যদিকে সুজলা সুফলা পূর্ব বাংলা হয়ে পড়ে সম্পদহীন। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া হতাে, তার সমুদয় অর্থ ব্যয় করা হতাে না। বিপরীত পক্ষে ২য় ও ৩য় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্যে গৃহীত প্রকল্পে বরাদ্দের চাইতে ৫৯০০ মিলিয়ন টাকা অধিক খরচ করা হয়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে কোনাে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয় নি।*২* ফলে

—————

২২৬ এস,এম বারানভ, পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য ১৯৪৭-১৯৭১, আবুল বারাকাত ও অন্যান্য (অনু.) (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৮৬), পৃ. ২৬-২৭।

৫২৭, ঐ।

*** GW. Chodhury. The Last Days of United Pakistan (Dhaka: The University Press Limited 1998), p. 15. এ বিষয়ে আরাে দেখুন, রেহমান সােবহান, বাঙালী জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি’, সিরাজুল ইসলাম (সম্পা.), বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা: এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৯২), পৃ. ৬২০। *** Safar Ali Akanda, “East Pakistan and Politics of Regionalism”, unpublished Ph.D. Thesis, University of Denver 1970, p. 179, উদ্ধৃত:

———-

পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রয়ােজনীয় প্রকল্প ও ব্যয়ের অভাবে লবণাক্ততা ও বন্যার প্রকোপ বেড়ে গিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে ।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৯৪৭-১৯৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ৭ জন, তার মধ্যে ৪ জনই পশ্চিম পাকিস্তানি, পূর্ব পাকিস্তানের ৩ জনের মধ্যে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে বাদ দিলে খাজা নাজিমুদ্দীন ও বগুড়ার মােহাম্মদ আলী প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন। পাকিস্তানের সমগ্র শাসনামলে কোনাে বাঙালিকে অর্থ সচিব পদে নিয়ােগ কিংবা পরিকল্পনা কমিশনে স্থান দেয়া হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক পদে বাঙালিদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত নগণ্য। সমাজে চলাফেরা ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযােগ সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য এত প্রকট ছিল এবং অবাঙালিদের আচরণে তা এমনভাবে প্রকাশ পেত যাতে মনে হতাে বাঙালিরা পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।

সেনাবাহিনীর জন্য পাকিস্তান সরকার বরাবরই সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করতাে। কিন্তু সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে বাঙালিদের স্থান ছিলাে না। বললেই চলে। ১৯৫৬ সালের একটি পরিসংখ্যানে সামরিক বাহিনীতে বাঙালি-অবাঙালি বৈষম্যটি যথাক্রমে ছিল নিমরূপ: ৫০০ লে: জে: ০-৩, মেজর জেঃ ০-২০, ব্রিগেডিয়ার ১-৩৪, কর্নেল ১-৪৯, লে: কর্নেল ২-১৯৮, মেজর ১০-৫৯০।

উল্লিখিত হিসেব অনুযায়ী সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার যেখানে ছিল মাত্র ১৪ জন সেখানে অবাঙালি অফিসার ছিল ৮৯৪ জন। নৌবাহিনীতে বাঙালি ৭ জন, অবাঙালি ৫৯৩ জন, বিমানবাহিনীতে বাঙালি ৬০ জন, অবাঙালি ৬৪০ জন। ‘৭১-এর ২ বছর পূর্ব হতে সামরিক বাহিনীতে বাঙালি। সদস্য সংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায় নি।

অনুরূপভাবে বেসামরিক প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পদগুলােতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ১৯৬১ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯ জন সচিবের মধ্যে একজনও বাঙালি ছিলেন না। অন্যান্য পদে বাঙালি-অবাঙালি বৈষম্যটিও উল্লেখ করার মতাে: জয়েন্ট

——————–

ড, মাে. মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৮৪৭-১৯৭১ (ঢাকা: সময় প্রকাশন, ১৯৯৯), পৃ. ২৫১। ৫৩° ঐ, পৃ. ২১৬, “Vernender Grover”, ঢঢ়. ২০-২১ হতে উদ্ধৃত।

———-

সেক্রেটারি: ৭-৩৯, ডেপুটি সেক্রেটারি: ২৪-১০০, সেকশান অফিসার: ৮৮৬৭৫ জন।৫৩১

১৯৫৫-৫৬-১৯৬৬-৬৭ অর্থ বছর পর্যন্ত শিক্ষা খাতে পূর্ব পাকিস্তানে মােট ব্যয় বরাদ্দ করা হয় ৭৯৭.৬ মিলিয়ন রুপি, অন্যদিকে একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ২০৮৪. ৫ মিলিয়ন রুপি। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাচক্র কিংবা নীতি নির্ধারকরা পূর্ব বাংলাকে নিজেদের দেশ ভাবতে পারেনি কখনাে। তারা এটাকে একটি উপনিবেশ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব শােষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালিরা কেবল প্রতিক্রিয়া করতে পারতাে, ক্রিয়া করার সুযােগ না থাকায় প্রতিকার পেত না। সে অর্থে তাদের শাসনামলকে পাকিস্তান। শাসিত বাংলাদেশ বলা চলে, যেমনভাবে ইংরেজ আমলকে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ বলা হয়। কোনাে আত্মমর্যাদাশীল জনগােষ্ঠী এ ধরনের বৈষম্য ও দুঃশাসন মেনে নিতে পারে না । উল্লিখিত বৈষম্যের বিষয়টি সচেতন ও বুদ্ধিজীবী মহলের দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও সাধারণ মানুষকে তা বুঝানাে সহজ ছিল

। এমতাবস্থায় মধ্য ষাটের দশকে একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি কার্টুন চিত্র দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়। এতে দেখা যায় যে, একটি গাভী পূর্ব বাংলার শস্য-শ্যামল ক্ষেত হতে খাদ্য গ্রহণ করছে আর তার পেছনের অংশটি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত, গাভীটির সামনে কিছুসংখ্যক কংকালসার ছেলেমেয়ে। তার দুধ দহন করছে একজন পাঞ্জাবি গােয়ালা এবং পূর্ব বাংলার কংকালসার শিশুদেরকে দুধ দেবে না বলে হাত উচিয়ে জানাচ্ছে । এই প্রচারটি মফঃস্বল এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন। বাঙালিরা যখন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই ধরনের তিক্ত উপলব্ধিতে উপনীত হয় এবং উভয় অঞ্চলে মধ্যে অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা উচ্চমাত্রায় পৌছে তখন ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় ।

——————

অমিতাভ গুপ্ত, গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তসৈনিক শেখ মুজিব (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ২৫০ ৫৩২, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫।

“In any vital national issue they could only react; they could never act” G.W. Choudhury, op.cit., p. 7.

ড, মাে, মাহবুবর রহমান, একাত্তরে গাইবান্ধা (ঢাকা: বাংলাদেশ চর্চা, ২০০৫), পৃ. ৩৮।

৫৩৪

————–

ইতােমধ্যেই পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগে ১৯৬৫ সাল নাগাদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এই সময় কতিপয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন আওয়ামী লীগে যােগদান করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে বঞ্চিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সমাজকর্মী, ব্যবসায়িক, সংস্কৃতিকর্মীর নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ তথা কৃষক-শ্রমিকের মিলিত ধারায় একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় দশকে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জমিদার স্থানীয় তাঁবেদার গােষ্ঠীর প্রাধান্য ছিল। তাদের প্রভাবে ভূমিহীনের সংখ্যা ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কারণে সমাজে ক্রমশ অসস্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ধরনের একটা অবস্থায় ১৯৬০-১৯৬১ সালের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে উল্লিখিত সংযােগ ঘটেছিল । ১৯৬৫ সালে ভারত-পকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়ে কোনাে কোনাে নেতা ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনা করেন। এদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকের নাম করা যেতে পারে । এ সম্পর্কে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী কর্তৃক প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকার হতে জানা যায় যে, যুদ্ধের সংবাদ পাওয়ার পর আলফা ইনসুরেন্স কোম্পানিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান চাকরি করতেন) কোম্পানির অফিসেই শেখ মুজিবুর রহমান বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন “দেশটাকে বাঁচানাে যায়। একটা বড় সুযােগ এসে গেছে। আমরা যদি স্বাধীনতা ঘােষণা করে দেই।”৫৩৭°সেখানে উপস্থিত অধ্যাপক ইউসুফ আলী, কামারুজ্জামান ও অন্য দুএকজন পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে এক প্রকার জোর করে মুজিবকে তার ধানমণ্ডির বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়ি পৌঁছেই বিষয়টি আলােচনার জন্যে তাজউদ্দীন আহমদকে ডেকে পাঠান। তারা এই

————–

[৫৩৫. ডক্টর রংগলাল সেন, সমাজকাঠামাে: পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র (ঢাকা: নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ১৯৯৭) পৃ. ১১৭। ৩৬, এ সময় ভূমি সংস্কারের নামে পরিবার প্রতি জমি বণ্টনের পূর্বতন ১০০ বিঘার পরিবর্তে ৩৭৫ বিঘা করা হয়। ফলে বেকার ও ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়ে যায় । ঐ, পৃ. ১১৬। ৩৭. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.),বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র পঞ্চদশ খণ্ড (তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮৫), পৃ. ৩৩৬। গলপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে মােট ১৫ খণ্ডে দলিলপত্রগুলাে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর হতে অত্র গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য এই উৎসটি দলিলপত্র নামে উল্লেখ করা হবে। [৫৩৮ ঐ, পৃ. ৩৩৬।

——–

সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এর জন্য জাতীয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বহু বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। সে জন্য সর্বাগ্রে জাতিকে প্রস্তুত করা জরুরি। | ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের শেষ নাগাদ ভারতীয় সৈন্যরা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে লাহাের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালি সৈন্যদের বীরত্বে লাহাের শহর কোনােমতে রক্ষা পায়। পাকিস্তান বাহিনী কাশ্মির সীমান্তের ছকা সেক্টরে সামান্য সাফল্য লাভ করলেও অন্যত্র পরাজিত হয় । এমতাবস্থায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য শক্তির চাপে ১৭ দিন। যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধবিরতি ঘােষিত হয়। সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতা কোসিগিনের (Kosygin) মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতামূলক তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সম্পাদিত ৯ দফাভিত্তিক ঐ চুক্তির কোনাে ধারাতেই কাশ্মির সমস্যার বিষয়টি উল্লেখমাত্রও করা হয়নি।

যুদ্ধ ও তাসখন্দ চুক্তির প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের দু অঞ্চলে দু রকম হয়। তবে উভয় অংশের প্রতিক্রিয়াই আইয়ুব খানের বিপক্ষে যায় । যুদ্ধে কাশ্মির জয় করতে না পারায় এবং তাসখন্দ চুক্তিতে কাশ্মির সমস্যার উল্লেখমাত্র না। থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা আইয়ুব খানের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যটুকুও চুক্তির মাধ্যমে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে বলে তারা মনে করে। পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর বীরত্ব সম্পর্কে তাদের মনে এতদিন ধরে যে ধারণা ছিল তা চুরমার হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকলে সুচতুর জুলফিকার আলী ভুট্টোর ইন্ধনে সেখানকার উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতারা চুক্তিবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সেখানে এই আন্দোলন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, তা দমনের জন্যে সরকার ওখানকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সমাবেশের ওপর গুলি চালালে ২ জন ছাত্র নিহত হয়।

—————-

৫৩৯ ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১। ৫৪০ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার: বাংলাদেশ-গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ংকর অধ্যায়, গােলাম হিলালী (অনু.) (ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিেিটড ,তাবি), পৃ. ২৭-২৮। ৫৪ মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩), পৃ. ২৪০। *, আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চারদশকের রাজনীতি পরিক্রমা: ১৯৫৩-১৯৯৩ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ (ঢাকা: ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ১০৮।

———

তাসখন্দ চুক্তির প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে বিরােধীদলসমূহের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সম্মেলনের উদ্যোক্তারা মূলত সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থী দলের নেতা হলেও পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানও ছিলেন এই সম্মেলন আয়ােজকদের অন্যতম। তৎসত্ত্বেও প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্য নেতৃবৃন্দ উক্ত সম্মেলনে যােগদান করতে আগ্রহবােধ করেন নি। ন্যাপ ও এন.ডি.এফ-ও শেষ পর্যন্ত যােগ দেয় নি।৫৪৩

এমতাবস্থায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান পূর্ব বাংলায় এসে নেতাদের বুঝানাের চেষ্টা করেন যে তার সম্মান রক্ষার্থে হলেও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যােগদান করা উচিত। শেষে শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ইউসুফ আলী, মালেক উকিল ও অন্যদের নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এমতাবস্থায় ইত্তেফাক-এর তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া পরামর্শ দেন সম্মেলনে যােগদান করলে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের যাওয়া উচিত। মানিক মিয়ার এ ধরনের পরামর্শের প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য কয়েকজন প্রথম সারির নেতার সম্মেলনে যােগদান করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

আইয়ুব খান তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর করার পর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। এ উপলক্ষে গভর্নর মােনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের আলােচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুজিব ও তার সঙ্গীরা মােনেম খানকে জানান যে, আইয়ুব খান যদি স্বয়ং কথা বলতে চান, তাহলে তারা বিবেচনা করবেন। অন্যথায় মােনেম খানের সঙ্গে আলােচনার কোনাে যৌক্তিকতা তারা খুঁজে পান না। যাহােক আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাতের একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তার সঙ্গে কথা বললে, কোন্ কোন্ বিষয়ে আলােচনা করা হবে তা নিয়ে নেতারা চিন্তা ভাবনা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ঐগুলােকে লিখিত রূপদান করা হয়। এটিই মূলত ৬ দফার প্রাথমিক

————

৫৪৩, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩। ৫৪. আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাঙ্কার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

——————-

রূপ।৫৪৬ এটি রচনা করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এর একটি কপি নুরুল আমীনকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৩ দফাবিশিষ্ট এই দাবিনামার বিষয়ে আইয়ুব খানের সঙ্গে আলােচনা করা সম্ভব হয়নি।*৫৪৭দফা প্রণয়ন সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৭২ সালের ৭ জুন দৈনিক বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার হতেও ঘটনার এই পারম্পর্য সম্পর্কে জানা যায় ।৫৪৮

পঁয়ষট্টি সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান আসলেন ঢাকায়। জনাব নুরুল আমিন উদ্যোগ নিলেন তার সাথে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরােধী দলের। নেতাদের সাক্ষাৎ ঘটানাের। আমাদের সাথে আইয়ুব খানের সে সাক্ষাঙ্কার। হয়েছিল কিন্তু এর আগে আমরা তৎকালীন স্থানীয় সমস্যাসহ পাকিস্তানের রাজনৈতিক পটভুমিকায় তৈরী করি একটি দাবিনামা। তাতে ছিল ১৩ টি দফা। নূরুল আমিন সাহেবকেও তার একটি কপি আমরা দিয়েছিলাম । কিন্তু তিনি সে কপির দফাগুলাে দেখেই চমকে উঠলেন। বললেন, তাহলে তাে আর আলােচনাই হতে পারে না আইয়ুব খানের সাথে। আমরা অনড় রইলাম । তবুও সাক্ষাকার। হলাে । সম্ভাবত নূরুল আমিন সাহেব তার একটি কপি আইয়ুব খানকে দিয়েছিলেন। তারপর আসল ১৯৬৬ সাল লাহােরে বসল সর্বদলীয় কনফারেন্স ।… যাবার আগে শেখ সাহেব বললেন, লাহাের কনফারেন্স-এর জন্যে বাঙ্গালিদের পক্ষ থেকে কিছু তৈরি করে নিতে। আমরা তখন সেই ১৩ দফার স্থানীয় কিছু বাদ দিয়ে তৈরি করলাম এক দাবিনামা। তাতে অনেক উপ-দফা বাদ দিয়ে মােট দাবি হলাে ৬ টি।

পরবর্তীকালে ৬ দফার রচয়িতা কে ছিলেন তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, এটা কোনাে নতুন দাবি ছিল না, পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব দাবি উচ্চারিত হয়। সেগুলােকে সুসংঘবদ্ধ রূপায়ণ করা হয় ছয় দফায় । এর প্রণেতা সম্পর্কে যতগুলাে ধারণা আছে সবগুলাের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের লেখায় । তিনি লিখেছেন:

———–

৫৪৬ আবদুল আজিজ বাগমার, স্বাধীনতার স্বপ্ন-উন্মেষ ও অর্জন (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯), পৃ. ৬৫। ৫৪৭ আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৫৪৮ দৈনিক বাংলা, ৭ জুন, ১৯৭২। ” Nurul Islam, Making of a Nation: Bangladesh An Economist’s Tale (Dhaka: The University Press Limited, 2003), p. 85.

———

I donot know the exact authorship of the draft of the six-points Programme. It never occured to me to inquire about it from those who would have known, specially Tajuddin. The widely believed verson was that it was Sheikh Mujib who articulated the main issues and requested Tajuddin to put them in writing in a systematic way in the form “various points.” Later on, they were reported to have been drafted in English by a senior civil servant from East who was very close to Sheikh Mujib, one of the accused in the Agartala Conspiracy Case and later on, Secretary General of the Bangladesh government in 1972.

লাহােরে বিরােধীদলসমূহের সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলটি ৪ ফেব্রুয়ারি করাচী পৌছে। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মালেক উকিল, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এ.বি.এম. নুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী।৭৫° সেখানে পৌছে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ওপর রচিত কাগজপত্র বের করে সবাইকে দেখান এবং বুঝিয়ে বলেন। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যতীত কেউ ৬ দফার ব্যাপারটি জানতেন না। তাই তারা প্রথমটা অবাক হন এবং নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেন।৫৫২

৫ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রতিনিধিদল করাচী থেকে বিমানে করে সরাসরি লাহােরে পৌঁছেন। ঐ দিন ৬ তারিখের সম্মেলনের বিষয়-নির্বাচনী বৈঠক বসে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর বাস ভবনে। সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিল মুসলিম। লীগের সভাপতি সৈয়দ মােহাম্মদ আফজাল হােসেন। এখানেই শেখ মুজিবুর

————–

৫৫০, দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৩৩৭। ৫৫. ঐ, পৃ. ৩৩৭। ৫৫২, “এই ৬ দফা যদি অনমনীয় হয় তাহলে এটা সরাসরি এক দফার দিকেই যাবে, আমরা কি এজন্য তৈরী হয়েছি? প্রায় সবাই একমত প্রকাশ করলাম। তাজউদ্দিন ভাই মুচকি মুচকি হাসছেন। জানিনা নেতার সঙ্গে তার পূর্বে এ সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে কিনা। বঙ্গবন্ধু অনেক দিক দিয়ে বিষয়টির ওপর আলােকপাত করে বললেন, “আজ হােক কাল হােক পূর্ব পাকিস্তানকে একদিন আলাদা হতেই হবে। এরকম কৃত্রিম ভৌগােলিক অবস্থান আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে দুটো অংশ কতকাল দাঁড়িয়ে থাকবে? এটা সত্য কথা যে, আমরা দেশবাসীকে এখনও তৈরী করার কাজে হাত দেই নি। তবে বাঙ্গালিরা অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। সংগঠনের মাধ্যমে এটা করা যাবে’।” ঐ, পৃ. ৩৩৭, অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সাক্ষাৎকার। ৫৫৩ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪২।

১৫৮

রহমান আলােচ্য সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ তাে বটেই উপরন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দও এর বিরােধিতা করেন। ফলে বিষয়-নির্বাচনী কমিটি-আলােচ্যসূচিতে ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করতে অসম্মতি জানায়।৫৫৪ আওয়ামী লীগের ৬ দফা আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত না করার কারণে সাবজেক্ট কমিটির বৈঠক থেকে ‘ওয়াক আউট’ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। শুধু তাই নয় পরদিনের মূল সম্মেলনে যােগদানের যৌক্তিকতাও খুঁজে পান নি আওয়ামী লীগ নেতারা।৫৫৫ পরদিনই পত্রিকাগুলােতে প্রকাশিত হয় যে, শেখ মুজিব ৬ দফার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হতে চান ।

সম্মেলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একদিকে সদ্য-সমাপ্ত পাক-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জনগণের মধ্যে ভারতবিরােধী মনােভাব জাগিয়ে তােলা, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থরক্ষা করতে আইয়ুব খান ব্যর্থ হয়েছেন এটা জনগণের নিকট তুলে ধরে তাকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করা। তারা ৬ দফার ন্যায় স্বায়ত্তশাসনের দাবিসম্বলিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনার জন্য মােটেও প্রস্তুত ছিলেন না। সুতরাং শুরু থেকেই ৬ দফা পশ্চিম পাকিস্তানিদের রােষানলে পড়ে। শুধুই পশ্চিম পাকিস্তানেই নয় পূর্ব পাকিস্তানের অনেক দল ও নেতার সমালােচনার সম্মুখীন হয় ৬ দফা কর্মসূচি। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতাও এর বিরােধিতা করেন। এ সম্পর্কে ১৯৬৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের প্রচার সংক্রান্ত সাবজেক্ট কমিটির সভায় রাজশাহীর মজিবর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়। সম্ভবত দলের প্রবীণদের মধ্যে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতি একটা সহানুভূতি অবশিষ্ট ছিল। কারণ রক্ষণপন্থীরা চাননি যে, তাদের আন্দোলনের ফসল পাকিস্তান বিভক্ত হােক। এ হচ্ছে ঐ সময়ের আওয়ামী লীগের নবীন-প্রবীণ প্রজন্মের সংঘাত। প্রবীণদের বিরােধিতা সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, মােল্লা জালালুদ্দীন, আবদুল মান্নান ও অন্য তরুণ নেতারা ৬ দফার পক্ষে ব্যাপকভাবে প্রচার কাজে

—————-

৫৫৪. ঐ, পৃ. ২৪২। ৫৫৫ দলিলপত্র, ১৫শ খণ্ড, পৃ. ৩৩৭। ৫৫৬, মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫। ৫৫৭, ঐ, পৃ. ২৪৮। এই আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস ১৯৪৯-১৯৭১ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৩), পৃ. ১৪২।

———–

দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর শুরু করেন।৫৫৯ এরই মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসেন। পরবর্তীকালের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দ, অন্যভাবে বলা যায় বাঙালি জাতির সামনে তরুণ প্রজন্মের নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ৬ দফাকে যাতে জনগনের মধ্যে পৌছে দেয়া যায় সে জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই প্রদেশব্যাপী বড় বড় শহরগুলােতে জনসভার কাজ শুরু করা হয়। মাঝেমধ্যে বিরতি দিয়ে ৮ মে পর্যন্ত এই গণসংযােগের কাজ অব্যাহত থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের জনসভার মাধ্যমে এই কার্যক্রমের শুরু। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের পূর্বেই দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলা শহরে গণসংযােগের কাজ শেষ হয়। এরমধ্যে ৬ দফার ওপর একটি পুস্তিকা রচিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মােট ২ টি ভূমিকাসহ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা প্রকাশিত হয়। ৬ দফা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে কোনাে মহল কর্তৃক বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। ফলে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকাসহ ৬ দফা প্রকাশ করা ছিল একটি সময়ােপযােগী সিদ্ধান্ত। এতে সাধারণ শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের ৬ দফা। সংক্রান্ত ধারণা পরিষ্কার হয়ে যায় ।

বস্তুত ৬ দফা নতুন কোনাে বিষয় ছিল না। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, এগুলাে ১৯৫০ সালের বিকল্প খসড়া প্রস্তাবে এবং যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারেই স্থান পেয়েছিল। তাছাড়াও আওয়ামী লীগ তার বিকাশ পর্বে স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে কিছু কিছু বিষয় উত্থাপন করেছিল । সংক্ষেপে এগুলাের সমন্বয়ে ৬ দফা দাবি প্রণীত হয় । তবে এতে ঐগুলাে আরাে সুবিন্যস্ত রূপ লাভ করে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে স্বার্থ-সম্পদ ও ক্ষমতা পরিচালনার প্রতি এতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। এ বিষয়ে ১৯৭২ সালের ৭ জুন তারিখে দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের উল্লিখিত সাক্ষাৎকারটি স্মরণীয়।

নিমে ৬ দফার মূল বিষয়গুলাে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলাে:

—————-

৫৬০ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৮। | পাইওনিয়ার প্রেস হতে প্রচার সম্পাদক আবদুল মমিন কর্তৃক মুদ্রিত হয়ে ১৫ পুরানাে পল্টন হতে ৬ দফার উপর পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়। ৫৬২, ছয় দফার পূর্ণ টেক্সট দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী (সম্প.), বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ: প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৮), পৃ. ২৭৩২৭৭।

———

প্রথম দফা: ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সরকার গঠন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয় ।

দ্বিতীয় দফা: কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে কেবলমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় রেখে সকল বিষয় প্রদেশসমূহের নিকট হস্তান্তরের আহ্বান জানানাে হয়।

তৃতীয় দফা: এই দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে যে কোনাে একটি গ্রহণের আহবান জানানাে হয়। যেমন

ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রার প্রচলন এবং দু অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ‘স্টেট ব্যাংক স্থাপন অথবা, খ. একই মুদ্রা পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে রাখা যেতে পারে, তবে শাসনতন্ত্রে সুনির্দিষ্ট বিধানের অধীনে মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে মুদ্রা পাচার না হতে পারে । সে লক্ষ্যে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি রিজার্ভ ব্যাংক স্থাপনের দাবি করা হয় ।

চতুর্থ দফা: সকল প্রকার খাজনা, কর অর্থাৎ রাজস্ব নির্ধারণ এবং আদায়ের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে প্রদান করার দাবি জানানাে হয়। প্রাদেশিক সরকারের আদায়যােগ্য অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে আপনা আপনি জমা হয়ে যাবে—এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে। এভাবে জমাকৃত অর্থ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

পঞ্চম দফা: এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিমলিখিত শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয়:

১. দু অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব সংরক্ষণ, ২. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণে স্থাপন,

৩. কেন্দ্রের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুঅঞ্চল হতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে আদায়,

৪. দেশজ দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি। রপ্তানি অব্যাহত রাখা,

৫. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ‘ট্রেড মিশন স্থাপন এবং আমদানি রপ্তানি করার অধিকার প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া।

ষষ্ঠ দফা : পূর্ব পাকিস্তানের জরুরি নিরাপত্তা বিধানের জন্য আধাসামরিক বাহিনী গঠন।

| ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য ৭ এপ্রিল থেকে সফর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ইতােমধ্যে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ অর্থাৎ ১৮,১৯,২০ মার্চ ইডেন হােটেলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিলে নতুন প্রেক্ষিতে দলকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বৃহত্তর পরিসরে যাতে দল নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয় সে জন্য একদিকে দলের পুনর্গঠন অন্যদিকে ৬ দফাকে দলের মূলদাবি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এবং প্রাক্তন সিনিয়র সহ-সভাপতি মােশতাক আহমদ এই পর্যায়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য তৎপরতা চালান। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমান ও কাউন্সিলররা তাজউদ্দীন আহমদকে উক্ত পদের যােগ্য বলে বিবেচনা করেন। তাজউদ্দীন আহমদকে সম্ভবত মােশতাক আহমদ তখন থেকেই প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেন। নেতৃত্বের এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে পরিপূর্ণরূপে কৃষিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিবেচনায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ উভয়েই বাংলার মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। পূর্বতন নেতাদের ন্যায় তাদের ছিল না বিদেশে পড়ার ডিগ্রি, কিংবা পৈতৃকসূত্রে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা সুপ্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ঐতিহ্য।

—————–

৫৬৩ সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০০), পৃ. ২৪৪। ৫৬টি, নাজিমুদ্দীন মানিক, একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলাে (ঢাকা: ওয়ারী বুক সেন্টার, ১৯৯২), পৃ. ১০৭।

——-

বাংলার আর ৫ টি মধ্যবিত্ত পরিবারের ন্যায় তাদেরও একই আর্থ-সামাজিক আবস্থান। এতদঞ্চলের মানুষের নাড়ির সঙ্গে তাদের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মধ্যবিত্তের আশা-আকাক্ষা সুখ ও দুঃখের সঙ্গে তারা গভীরভাবে পরিচিত।

১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ ৬ দফার পক্ষে বক্তৃতা করেন। উল্লেখ্য যে, একই সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান সফর করছিলেন। তিনি ৬ দফার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি হুমকি প্রদর্শন করেন। যে, প্রয়ােজনে অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের মাধ্যমে ৬ দফাকে নির্মূল করবেন।৫৬৫

৬ দফাকে কেন্দ্র করে সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রচারণার ক্ষেত্রে মুখােমুখি অবস্থায় উপনীত হওয়ায় সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় আইয়ুব খানের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বিচারপতি মােহাম্মদ ইব্রাহিম। ১৯৬৬ সালের ২৬ মার্চ সরকারের উদ্দেশে অস্ত্রের ভাষা বিদেশি আক্রমণ প্রতিরােধের জন্যে জমা রেখে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যুক্তির ভাষায় কথা বলার আহ্বান জানান। অন্যদিকে আইয়ুব খানের প্রাক্তন বিদেশ মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে বলেন যে, অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের আগে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ২১ মার্চ ভুট্টোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পল্টন ময়দানে অথবা ভুট্টোরই পছন্দমতাে যে কোনাে স্থানে যে কোনাে দিন তার সঙ্গে বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টোকে ৬ দফার প্রশ্নটি চিরতরে মীমাংসার জন্য আইয়ুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানে ৬ দফার ওপর গণভােট অনুষ্ঠানের জন্য রাজি করানাের আহবান জানান। তিনি আরাে বলেন, উক্ত গণভােটে আইয়ুব খানের দল যদি ৩০% আসন লাভ করতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ ৬ দফার প্রশ্নে স্বীয় নীতি পুনর্বিবেচনা করতে প্রস্তুত। এভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভুট্টো ও আইয়ুব খানের প্রতি বড় রকমের পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভুট্টোকে মােকাবিলা করবেন। ভুট্টো এই পাল্টা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে পল্টন ময়দানে এর আয়ােজন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ

——–

৫৬৫ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৯। ৫৬৬, ঐ, পৃ. ২৭০। ৫৬৭ ঐ, পৃ. ২৭১।

১৬৩

করে আওয়ামী লীগের অবস্থানের কথা জানান। তার সঙ্গে কথা বলে ভুট্টো বুঝতে পারেন যে, তর্ক-যুদ্ধে সুবিধা করা যাবে না। নির্ধারিত দিনে উৎসুক জনতা উপস্থিত হতে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ শােনা যায়, কাউকে কিছু না বলে ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করেছেন।৫৬৮

রাজনীতিক ও কূটনীতিবিদ হিসেবে ভুট্টোর নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল। বাঙালি রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে একটা অবজ্ঞা তার মনে কাজ করতাে। তাজউদ্দীন আহমদের মতাে প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ ও যুক্তিবাদী নেতা। আওয়ামী লীগ বা বাঙালিদের রয়েছে সেটা তার অজ্ঞাত ছিল। তাকে ভয়। পেয়েই ভুট্টো বাকযুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে এক প্রকার পালিয়ে যান। এভাবেই পরবর্তীকালেও দেখা যায় তাজউদ্দীন আহমদ যে কোনাে সংকটকালে দলের হয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেন। এখানে আরাে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, পুনরুজ্জীবিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সকল নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা তার হাত দিয়েই সম্পাদিত হয়। গভীর অভিনিবেশসহকারে দলের এ সব কাজ তিনি করতেন। তার কাজ যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্যে শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত সজাগ থাকতেন। পরবর্তীকালে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ক্রমাগত বেড়ে চলে। এ সম্পর্কে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করা হলাে:৫৭০

স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে যখনই আওয়ামী লীগের পুরানাে পল্টনের কেন্দ্রীয়। অফিসে (১৫ পুরানাে পল্টন) গেছি, তখনই দেখেছি তাজউদ্দীনকে হয় শেখ মুজিবের বিবৃতি অথবা দলীয় সভায় তােলার জন্য প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে । ফর্সা, গােলগাল চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ মুখ । বেশি মানুষের ভিড়ে লাজুক এই শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির মানুষটি প্রখর ব্যক্তিত্বশালী নেতা ছিলেন না। কিন্তু তার শিক্ষা, বুদ্ধি, সংগঠন শক্তির সংগে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব সাহস ও জনপ্রিয়তার মিশ্রনে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় দলে পরিণত হয় ।… আমি তাজউদ্দীনকে ঠাট্টা করে ডাকতাম চেী অব বেঙ্গল। অর্থাৎ বাংলাদেশের চৌ এন লাই। চৌ এন লাইকে আমি ১৯৫৬ সালে ঢাকায় দেখেছি। তাজউদ্দীনও চৌ এর মতাে ছােটখাটো। তবে অত পাতলা নন। কিন্তু রাজনীতিতে দুজনই স্বল্পভাষী ও

——————–

৫৬৮ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ, পনেরই আগষ্ট পঁচাত্তর (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬), পৃ. ৪২-৪৩। ৫৬৯ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। ৫৭০ আবদুল গাফফার চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০-৪১।

নেপথ্যবিহারী মানুষ। তাজউদ্দীন অবশ্য বৈঠকি বক্তা হিসেবে অদ্বিতীয়। তখন তার কথা থামানাে যেতাে না।

তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরই একজন প্রয়ােগবাদী মার্জিত রুচিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকেন। অন্তত রাজনৈতিক মহলে সকলের নিকট ব্যক্তিগত সততা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং বিরল রাজনৈতিক গুণাবলির কারণে প্রশংসার পাত্রে পরিণত হন। এই প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার যে, আমাদের দেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে সাধারণত বিরূপ সমালােচনাই শােনা যায়। তাকে যারা দূরে থেকে কিংবা কাছে থেকে জানেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতি বা অন্য রাজনীতির মানুষ তারা সকলেই তার সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলেন যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যিই বিরল ও ব্যতিক্রমী।৫৭১ | ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য অবিরাম সফরসূচি দেখে অনুমান করা যায় যে, নেতারা পূর্বাহ্নে অনুধাবন করেছিলেন, সরকার ৬ দফা প্রচারের সুযােগ বেশি দিন দেবে না। যে কোনাে মুহূর্তে তাদেরকে গ্রেফতার করা হতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ৬ দফাকে সাধারণ মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়াই ছিল নেতাদের লক্ষ্য ও কৌশল । শিল্পশহর নারায়ণগঞ্জে মে মাসের ৮ তারিখে এক বিশাল শ্রমিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা শেষ করে বাড়ি ফিরলে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, এম.এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী (১৯১৬-১৯৭৪), খন্দকার মােশতাক আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, রাজশাহীর মুজিবুর রহমান ও অন্যদের প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়।

৬ দফা কর্মসূচি দিয়ে ব্যাপক গণসংযােগের মাধ্যম আওয়ামী লীগ। প্রদেশের প্রধান জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের দেখাদেখি অন্যান্য দল ৬ দফার ন্যায় অনেক দফা যুক্ত করে মাঠে নামে। একই সঙ্গে অনেক দল সরাসরি ৬ দফাকে প্রত্যাখ্যান করে। এক্ষেত্রে কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি দল আইয়ুব খানের ন্যায় ৬ দফাকে ‘বিপজ্জনক’ বলে আখ্যায়িত করে । মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ৭

————-

আবুল কাশেম ফজলুল হক ‘তাজউদ্দিন আহমদ স্মরণে’, মাহবুবুল করিম বাচ্চু (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ: স্মৃতি এ্যালবাম (ঢাকা: পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস, ১৯৯৭), পৃ. ২৮। ৫। মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৭।

—–

এপ্রিল ৬ দফাতে অর্থনৈতিক মুক্তি নেই বলে তা প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু মওলানা ভাসানীই নন ৬ দফা সম্পর্কে অন্যান্য বাম দলের মনােভাব ছিল নেতিবাচক। কমিউনিস্ট গ্রুপসমূহ এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ৬ দফার উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সম্পৃক্তির বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করে। তাদের ধারণা জন্মে আইয়ুব খানকে বিপাকে ফেলে তার সঙ্গে আমেরিকার আরাে ঘনিষ্ঠ হওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। আবার কেউ কেউ সন্দেহ করেন যে, ৬ দফা আইয়ুব খানের সহযােগীদের দ্বারা প্রণীত। ৭ই কিন্তু পরবর্তীকালের ঘটনাবলিতে প্রমাণিত হয় যে, এগুলাে ছিল ভুল অনুমান । বস্তুতপক্ষে ৬ দফা পূর্ব বাংলার মানুষ ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রচনা করেছিল। আওয়ামী লীগ শুধু জনগণের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করে ৬ দফায়। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক সকল দলই ৬ দফার বিরােধিতা করে।”৭৬ এই বিরােধিতা কেবল আদর্শিক কারণেই ছিল না। বস্তুত এসব দলের জনপ্রিয়তা তেমন ছিল না বললেই চলে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে বাদ দিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এ সময় বাস্তব সাংগঠনিক অবস্থা ছিল খুব দুর্বল। আইয়ুবের সামরিক শাসন প্রত্যাহার করার পর অন্যান্য দল বুঝে ওঠার আগেই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতাদের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে দলটির পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং জনগণের মধ্যে একটি শক্ত ভিত রচিত হয়। আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনপ্রিয়তায় অন্যান্য দল থেকে ঈর্ষণীয় দূরত্বে এগিয়ে যায় । | আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে গ্রেফতার করায় প্রদেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় । ৯ মে জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের নেতা নুরুল আমিন এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দকে বন্দি করার তীব্র প্রতিবাদ করে এ কাজকে ‘চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার ওপর নয়া হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেন। জাতীয় পরিষদের বিরােধীদলীয় সহকারী নেতা শাহ আজিজুর রহমান গ্রেফতারকে ‘জবরদস্তি’ বলে মন্তব্য করেন। গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১০ মে ঢাকার শ্রমিক

———–

৫৭৩, ঐ, পৃ. ২৭১-২৭২। ৫৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৯২), পৃ. ১৩৩। ৫৭৫, মােঃ শাহজাহান, “বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা (১৯৬৬-১৯৭১): একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ”, অপ্রকাশিত পিএইচ.ডি. থিসিস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০২, পৃ. ১৩৮। ৫৭৬ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১০-১১১।

এলাকায় বিক্ষোভ পালিত হয়। ১৩ মে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ দিবস পালন করে। সারাদেশেই ক্রমাগত গ্রেফতারের প্রতিবাদে ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার পর সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০ মে ওয়ার্কিং কমিটির অবশিষ্ট সদস্যরা একটি জরুরি সভার মিলিত হয়ে ৭ জুন প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।”৫৭৭ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ঐ দিন সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। হরতালে কলকারখানা, গাড়ি-ঘােড়া সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক জীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে হরতাল ও বিক্ষোভ প্রতিরােধের জন্যে সরকার প্রস্তুত হয়েই ছিল। হরতাল সমর্থকদের ওপর সরকারের বাহিনী হামলা চালালে ১১ জন নিহত, অসংখ্য আহত এবং ৮০০ ব্যক্তিকে আটক করা হয়। কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরােপের মাধ্যমে আন্দোলন সংক্রান্ত সকল প্রকার সংবাদ প্রকাশ নিষিদ্ধ করে। সরকারি প্রেসনােট (যা দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা ৮ জুন প্রকাশিত হয়) থেকে সহজেই অনুমান করা গিয়েছিল যে ৭ জুন কী ঘটনা ঘটে গেছে। প্রেসনােটে ৭ জুনের হরতালের ওপর সরকারের অতি সতর্ক বিবরণ ও মনােভাব ফুটে ওঠে যাতে আন্দোলনকারী জনতাকে বারবার ‘উদ্ধৃঙ্খল জনতা’ বলে অভিহিত এবং আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ বলে চিহ্নিত করা হয় । | প্রকৃতপক্ষে ৬ দফার আন্দোলন ছিল পূর্বের সকল আন্দোলনের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এ আন্দোলন মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে | স্পর্শ করে। যেমন রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক, ছােট বড় দোকানদার, বাস | ও ট্যাক্সিচালক, দিনমজুর প্রভৃতি নি আয় ও পেশার মানুষ বিক্ষোভের মাধ্যমে। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুনঃপুন। নিষেধ সত্ত্বেও আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। * তাজউদ্দীন আহমদের ভাষায় ঐতিহাসিক ৭ জুন হচ্ছে ৬ দফার দিবস, ঐতিহাসিক সংগ্রামের যুগান্তকারী মােড় পরিবর্তনবিশেষ।৮০ | ৭ জুনের সফল কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ৬ দফাভিত্তিক প্রথম পর্যায়ের আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটে। ১০ ও ১১ জুন দুই দিনে ১১ ঘন্টাব্যাপী সভায়

————

৫৭৭ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮-২৭৯। ৫৭ ঐ, পৃ.২৮১-২৮৩। হরতালের সার্বিক চিত্র জানার জন্য দেখুন, ইত্তেফাক ৮ জুন, ১৯৬৬। সকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হরতালের পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ করায় বাঙালি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক এই দৈনিকটি বাজেয়াপ্ত করা হয় । 4. Shyamali Ghosh, op.cit., p. 125.

/৮০ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলােচনার পর প্রথম পর্যায়ের আন্দোলন সফল করায় জনগণকে। ধন্যবাদ জানানােসহ দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়।৫৮১ ১৯৬৬ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ৬ দফা। জনগণ কর্তৃক মূল দাবি হিসেবে অনুমােদন লাভ করেছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের। প্রায় সকল নেতাকে পর্যায়ক্রমে আটক করায় জেলা পর্যায়ের অথবা অঙ্গ। সংগঠনের নেতারা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এর ফলে আন্দোলন কেবল। ঢাকাকেন্দ্রিক না থেকে জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক আবদুল মমিন। ও অন্যান্যদের গ্রেফতার করা হলে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ। সম্পাদিকা আমেনা বেগম (১৯২৭-১৯৮৯) অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। প্রশংসনীয়ভাবে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি। ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামের এক জনসভার মাধ্যমে ৬ দফার ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের। আন্দোলনের সূচনা করেন । চট্টগ্রামের ঐ জনসভায় তিনি সকল রাজবন্দির মুক্তি। দাবি করেন এবং বলেন যে, ৬ দফা হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার। বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তি।৫৮৪

আন্দোলন চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ। কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। এর পশ্চাতে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল পরিবার। পরিজন বা ঘনিষ্ঠজন থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা। ইতােমধ্যে আওয়ামী । লীগের প্রথম সারির প্রায় সকল নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে তাজউদ্দীন আহমদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এনে রাখা হয় ১০ নং সেলের ৪ নং কক্ষে। জেল জীবনেও তাজউদ্দীন আহমদের। ছন্দবদ্ধ জীবন ও নেতৃত্বসুলভ আচরণ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৫৮৬

——

৫৮১. Shyamali Ghosh, op.cit, p. 128. ৫৮২, Ibid, p. 128. ৮e. Ibid, p. 130. ইচ. Ibid, pp. 130-131. এই সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। ৫৮৬ এ বিষয়ে সহবন্দী ও রাজনৈতিক সহকর্মী আবদুল মমিন বলেন “By nature he was a gentleman, by nature he was a Democrat. বঙ্গবন্ধুকে (তখনও বঙ্গবন্ধু । হননি) ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আর্মীরা রাতে জেলগেট হতে ধরে নিয়ে গেল । ক’দিন পরে আমাকে পূর্ববর্তী ১০ সেলের ৭ নং রুমে আনা হয়। তন থেকেই তাজউদ্দীন আমি-সার্বক্ষণিক সঙ্গি, অন্যরাও ছিলেন। উনি খুব লেখা পড়া করতেন। খুব ডিসিপিন্ড লােক ছিলেন। হাসির গল্প বলি, আমাদের সামনে একটা লন ছিল। লনে।

শাশুড়ির অসুস্থতার কারণ দর্শিয়ে স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের আবেদনের প্রেক্ষিতে জেল কর্তৃপক্ষ ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে ঘণ্টা খানেকের জন্যে তাকে প্যারােলে মুক্তি দেয়। এ সময় তিনি শাশুড়ির সঙ্গে সাক্ষাৎসহ দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গেও সংক্ষেপে যােগাযােগ করেন। রাজনৈতিক আলােচনায় জেলখানাতে বসেই সহকর্মী রাজনীতিবিদদের তিনি জানান যে, ৬ দফা শেষাবধি স্বাধীনতার দাবিতে পর্যবসিত হবে।৫৮৮ ৬ দফা প্রণয়নের সময়ই তারা অনুধাবন করেন যে, এ সকল দাবি অনমনীয় হলে স্বাধীনতা ছাড়া কোনাে বিকল্প থাকবে না।

। | ৬ দফা ছিল মূলত শাসনতন্ত্রিক দাবি। এর মধ্য দিয়েই উভয় অঞ্চলের স্বার্থ-সংঘাতের বিষয়টি সর্বশেষ বিন্দুতে উপনীত হয়। একদিকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা অন্যথায় শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা নিয়ে এই সময়ের আন্দোলন এগিয়ে চলে। অল্পকাল পরে সরকার যে আগরতলা মামলা তথা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা দায়ের করে তার ভিত্তি ছিল সরকারের গােয়েন্দা বিভাগের রিপাের্ট। কৌশলগত কারণে তখন এই অভিযােগ সংশ্লিষ্ট ঐ সব সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতারা অস্বীকার করেন। সরকারও যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের অভাবে এবং গণঅভ্যুত্থানের চাপে পড়ে মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন তথ্য থেকে ঘটনার যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমানও পরবর্তীকালে এ বিষয়টি স্বীকার করেন। মামলার বিবরণ হতে জানা যায়, ১৯৬৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠেয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিংশতিতম দিবস পালনের দিনে সামরিক ঐ গ্রুপটি সশস্ত্র

————–

রশি ঝুলানাে ছিল। গােসল করে লুঙ্গি গামছা আমরা এতে শুকাতে দিতাম। আমি এমনি এতে কাপড় নেড়ে দিতাম । তাজউদ্দীন প্রত্যেক দিন গােসলের পর লুঙ্গি গামছা দড়িতে এমনভাবে নেড়ে দিতেন যাতে চার মাথা সমান হয় এবং শুকানাের পরে ইস্ত্রি করার মতাে দেখায় । উনি আমারটাও ঐভাবে ঠিক করে দিতেন। শেষে আমি এমনি দড়িতে ভেজা গামছা লুঙ্গি রেখে আসতাম আর উনি অভ্যাসসমত প্রতিদিনই আমরাটাও ঠিক করে উনার মতাে করে নেড়ে দিতেন।” আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৫৮৭ সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ। (ঢাকা: প্রতিভাস, ২০০১), পৃ. ৩৫। ৫৮ আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ** G.W. Choudhury, op.cit., p. 25.

অ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল ও স্বাধীনতা ঘােষণার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সরকার পূর্বাহ্নেই সম্ভবত বিপ্লবী পরিষদের অর্থ আত্মসাৎকারী ও স্বপক্ষ ত্যাগকারী আমীর হােসেনের মাধ্যমে পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পারে। ফলে ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান বাতিলসহ কোনাে কোনাে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহীদের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতেন এবং তাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যােগাযােগও ছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি জানলেও জড়িত হননি বা সে ধরনের প্রয়ােজন হয়নি । ঐ গ্রুপের বৈঠক তাজউদ্দীন আহমদের সাত মসজিদ রােডের বাড়িতেও একবার হয়, কিন্তু তিনি তাতে উপস্থিত ছিলেন না। বিষয়টি পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থাও জানত। এসব ঘটনার জের ধরে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে মােট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা হয়। বিচারপতি এস.এ. রহমানের নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। বিশেষ ট্রাইবুনাল। গঠিত হয় বিচারপতি মজিবর রহমান খান ও বিচারপতি মাকসুমুল হাকিমকে নিয়ে। আনীত অভিযােগে বলা হয়, ভারতের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যপুষ্ট হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল ৭৯৩

পূর্ব পাকিস্তানের উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বিস্ফোরন্মােখি হয়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র সমাবেশে পলিশি গুলিবর্ষণে ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় । আইয়ুব খান কর্তৃক পদচ্যুত জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারবিরােধী আন্দোলন চাঙ্গা করে তােলার চেষ্টা করেন। সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যেমন জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল পীরজাদা ও অন্যদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সখ্যতা। তাদের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগেন ।

—–

৫৯০. এক ফয়েজ আহমদ,আগরতলা মামলা শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭), পৃ. ২৩। ৫৯৯ ঐ, পৃ. ২৪। ৫৯. ডা. করিমের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৫৯৩, মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০১। ৫৯৮ ড. মােহাম্মদ হাননান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।

১৭০

তবে অনতিবিলম্বে উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযােগে তাকে গ্রেফতার করে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে রাখা হয়।৫৯৫ পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৬৮ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের ছাত্ররা স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে ঢাকাসহ সমগ্র প্রদেশে বিক্ষোভ মিছিল করে। ১৯৬৯ সনের ১ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের উভয় (মতিয়া ও মেনন) গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। দেশের রাজনৈতিক দুর্যোগকালে সমাজের সচেতন অংশ হিসেবে ছাত্ররা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাতেই ন্যাপের ১৪ দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফার সমন্বয়ে এগার দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে মাঠে নামে। সকল ফ্রন্টের ছাত্র সংগঠনই এতে অংশগ্রহণ করে । ছাত্রদের অনুকরণে মূল রাজনৈতিক দলগুলাে ১৯৬৯ সালের ৮ জানুযারি সমগ্র পাকিস্তানের ৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (Democratic Action Committee বা DAC) গঠন করে। DAC ছাত্রদের আন্দোলনে যুগপৎ সমর্থনদানসহ নিজেদের কর্মসূচি ঘােষণা দেয়।** ভাসানী ন্যাপ অবশ্য DAC – এ যােগদান করেনি।৬০০।

————

৫৯৫Archer K Blood, The Cruel Birth of Bangladesh (Dhaka: The University Press Limited, 2002), p. 32. ৯৬ মিছিলে ছাত্ররা যে প্যাকার্ড বহন করে ঐগুলিতে লেখা হয় ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে’ ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও ‘জরুরী আইন বর্জন কর’ ‘প্রহসনী নির্বাচন বন্ধ কর’ ‘বন্যা সমস্যার সমাধান চাই’ প্রভৃতি । মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫২। *** Md. Abul Kashem “History of the Student Movement in East Bengal and East Pakistan (Now Bangladesh), 1947-1969: An Analytical Study”, Unpublished Ph.D Thesis, Department of History, Jadavpur University, India, 1992, p. 396. ** ডক্টর আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্মেষ, পৃ. ৩৭, ছাত্র আন্দোলন পরিষদ। ও তার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের জন্য দেখুন, Abul Kashem, Student Action Committee (SAC) and the Mass-Upsurge of 1969 Rajshahi University Studies, Part-A, Vol. 26, 1998, pp. 27-65. ৫৯ অধ্যাপক আবদুল হালিম, ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৬৬-১৯৬৯’, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭০।

৬০০ ঐ, ১৬৯।

———-

এ ধরনের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট আহবান করা হয়। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে ঢাকা শহরে একটি বিশাল ছাত্র মিছিল বের হলে মিছিলে গুলি চালানাের ফলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং আইনের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদের (১৯৪২-১৯৬৯) মৃত্যু ঘটে। ছাত্রহত্যার সংবাদ গােটা শহরে দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে। আসাদ হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ তিনদিনব্যাপী সারা প্রদেশে শােক পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে মিছিল বের হলে সাধারণ নাগরিকরাও সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তা স্বতঃস্ফূর্ত রূপ ধারণ করে। ২৪ জানুয়ারি ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল প্রকৃতপক্ষে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিক, কর্মচারী ও নাগরিকদের ঢল। দিশেহারা সরকারের সশস্ত্র বাহিনী জনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে নবকুমার ইনসটিটিউট-এর নবম শ্রেণীর ছাত্র কিশাের মতিউর রহমানসহ (১৯৫৭-১৯৬৯) কয়েকজন নাগরিক নিহত হন। এরপর ক্ষিপ্ত জনতা সরকার সমর্থিত ও নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান’ ও ‘মর্নিং নিউজ’ এর অফিস। পুড়িয়ে দেয়।”৬০১ ২৪ জানুয়ারি পরিস্থিতি এত জঙ্গি হয়ে ওঠে যে, আগরতলা মামলার শুনানি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আন্দোলন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে দাবাগ্নির মতাে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। ১৪৪ ধারা জারি করে। সেনাবাহিনী নামিয়ে কিংবা ব্যাপক ধরপাকড় করেও এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় নি। এ সময় কমপক্ষে ১০০ জন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিহত হয়। পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আন্দোলন জঙ্গিরূপ ধারণ করার আর একটি কারণ ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলা’-এর অভিযুক্তদের নিকট থেকে স্বীকারােক্তি আদায়ের লক্ষ্যে যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল, তার বর্ণনা মামলা চলাকালে কোর্টে তারা ব্যক্ত করেন। এ সংবাদ দৈনিক পত্রিকাগুলােতে প্রতিদিন গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হতে থাকে। এতে জনগণের ধারণা হয় যে, সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উক্ত মামলা দায়ের করেছে বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য এই চক্রান্তমূলক মামলা করা হয়েছে। সুতরাং এই মামলা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেয়।

—————–

৬০১, ঐ, পৃ. ১৭১-১৭২। ৬০২ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪। ৬০° ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৫।

পরিস্থিতি সামাল দিতে আইয়ুব খান ১ ফেব্রুয়ারি তার মাস পহেলা ভাষণে রাজনৈতিক আলােচনার জন্যে দায়িত্বশীল দলগুলাের প্রতি আহবান জানান।৬০৪ এ ব্যাপারে বিরােধী দলগুলাের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে এক প্রকার চাপও দেয়া হয়। কিন্তু সে সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে আলােচনায় অংশ নেয়ার মতাে তেমন কোনাে নেতা বাইরে ছিলেন না। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম আগরতলা মামলার একজন সহযােগী আইনজীবী হিসেবে মামলা চলাকালে একদিন শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের ইস্যুকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের যারা জেলে বন্দি আছেন তাদের মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করা যায় কিনা? মুজিব তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথমে মুক্ত করার জন্যে বলেন। কেননা তার বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা ছিল না। ইতােমধ্যে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রধান নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ঢাকায় আসেন বিরােধী দলগুলােকে সম্মেলনে যােগ দিতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্য। আমীর-উল-ইসলাম তাকে গিয়ে বলেন যে, আওয়ামী লীগের এমন কোনাে নেতা বাইরে নেই যিনি ঐ ধরনের কনফারেন্সে যােগ দিতে পারেন। কাজেই তাদের যদি প্রকৃতই আগ্রহ থেকে থাকে তাহলে অন্তত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে যেন অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হয়। যাহােক নসরুল্লাহ খানের হস্তক্ষেপে একদিনের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্তি দেয়া হয়। এভাবেই টানা ৩৩ মাস কারাবাসের পর তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তি পান ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি । তার মুক্তির ব্যাপারটি তার পরিবার পরিজনদের নিকটও আকস্মিক বলে মনে হয়। | তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তি পেয়েই অতি দ্রুততার সঙ্গে সাংগঠনিক কাজে মনােনিবেশ করেন। তিনি নেতা-কর্মী ও সচেতন দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারের বিরুদ্ধে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত

——-

৬০৪. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৬-১৩৭। ৬০থ “… তখন উনি (মুজিব ভাই) আমাকে বললেন যে, এক কাজ করতে পারিস? তাজউদ্দীনকে বের করে আনতে পারিস কিনা দেখ। তার বিরুদ্ধে তাে (আগরতলা) মামলা নাই। তারা যদি Round Table Conference-এ আওয়ামী লীগকে চায় তাহলে তাজউদ্দীনকে ছেড়ে দিতে পারে। একটা পার্টির প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারী দুজনকে জেলে রেখে কি করে এই আলােচনায় যেতে বলে? তখন আমি বলি, চেষ্টা করে দেখতে পারি।” ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৩ জুন, ২০০১। ২০০৫ সালের ২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদের ৮০তম জন্মদিনের একটি আলােচনা সভায় ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ও আরাে অনেকের উপস্থিতিতে ড. কামাল হােসেনও বলেন যে, প্রথমেই তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্ত করার জন্য মুজিব তাদেরকে বলেছিলেন। ৬০৬, ঐ। ৬০৭ সিমিন হােসেন রিমি, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬।

চরম সংগ্রামের প্রথম পর্যায়। এ পর্যায়ে কোনাে হঠকারী কাজ যেন জাতিকে তার ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না করতে পারে সে বিষয়ে বিশেষত প্রবীণদের। প্রতি আহবান জানান।৬০৮ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সরকার আগরতলা মামলাকে একটি রাজনৈতিক বিষয় বলে বিবেচনা করলে ভাল করবে।৬০৯ তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম অনতিবিলম্বে কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।৬১০ বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ সময় তাদের মধ্যে আলােচনা হয়।” তাজউদ্দীন আহমদ পরে সাংবাদিকদের নিকট শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে রাখার সমালােচনা করে বলেন যে, গণআন্দোলনের চাপের মুখে সরকার মুজিবসহ সকল রাজবন্দিকে অচিরেই মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।১২ তার এই প্রত্যয়দীপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী অল্প কয়েকদিন পরেই সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে কর্তৃপক্ষ প্রচার করে যে, তিনি নাকি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল সরকারের গভীর ষড়যন্ত্রের প্রথম পরীক্ষামূলক কেস। কেননা রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার যথার্থতা প্রমাণের জন্য সরকার জোর জবরদস্তিমূলক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয় এবং প্রতিহিংসাবশত একে একে অভিযুক্তদের হত্যার নীলনকশা করে বলে ধারণা করা যায়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার সংবাদ শােনামাত্র পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান করা হয় । ঐ বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকায় বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বাসায় অগ্নিসংযােগ করে তীব্র বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।১৯ বিচারপতি এম.এ.রহমান সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে মামলার কার্যক্রম পরবর্তী ৩ সপ্তাহের জন্যে স্থগিত রেখে সপরিবারে ঢাকা ত্যাগ করেন। পরদিন জনতা সার্জেন্ট জহুরুল হকের লাশ নিয়ে মিছিল-সহযােগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এখানে স্মরণযােগ্য যে, ১৪ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পাকিস্তানে প্রথমবারের মতাে

———–

৬০৮ ঐ, পৃ. ১৮। ৬০৯ ঐ, পৃ. ১৯। ৬১০ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ৩১ মার্চ, ২০০১। ৬১. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। ৬৯২, ঐ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। ৬১৩. মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৬।

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১। এ বিষয়ে আরাে দেখুন, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আত্মস্মৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৬-১৭। ৬১৫ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১।

একসঙ্গে হরতাল পালিত হয়।৬১৬ এতে করে প্রতীয়মান হয় যে, এ সময় পাকিস্ত েিনর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যা ইতঃপূর্বে কখনাে। পরিলক্ষিত হয় নি। ১৭ তারিখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান যেন বারুদস্তুপে পরিণত হয়। সরকার উপায়ান্তর না দেখে ঐ দিন সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয় । এদিকে ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে সামরিক বাহিনী হত্যা করে। নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি তখন বিক্ষুব্ধ ছাত্রদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় ছিলেন। রাজশাহীতেও কয়েকদিন ধরে ঢাকার ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ চলছিল। পর পর এ সকল হত্যাকাণ্ড সমগ্র বাঙালি জাতির অসন্তুষ্টিকে বিদ্রোহে রূপান্তরিত করে। এরপর আন্দোলন কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক না থেকে সমগ্র প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু হয় । ড. জোহা হত্যা ও উদ্ভূত সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সমগ্র ঢাকা শহর বিদ্রোহের অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতা তথা বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও ইপিআর গুলিবর্ষণ করলে ঢাকাতে ২০ জন এবং কুষ্টিয়া ও নােয়াখালীতে ৪জন নিহত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারিকে প্রথমবারের মতাে সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করেও জনতার এই সর্বব্যাপী ক্ষুদ্ধ উত্থানকে রােধ করা যায়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসের একটি সমাবেশের ওপর পুলিশ গুলি চালালে খুলনাতে ৮জন নিহত হয়। আইয়ুব খান আহূত পিন্ডিতে ১৯ তারিখের গােলটেবিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নেতারা আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি ব্যতীত যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। এখানে উল্লেখ্য যে, তাজউদ্দীন আহমদ গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমগুলােতে দেয়া সাক্ষাৎকারে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তিকে পূর্বশর্ত হিসেবে বিশেষভাবে জোর দেন।

সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত তাজউদ্দীন আহমদ অন্যান্য নেতা, শুভার্থী ও শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনার পর পিন্ডির গােলটেবিলে যােগদানের ব্যাপারটিকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পৌছার পর সেখানকার উদারনৈতিক

———-

৬১৬, ঐ, পৃ. ১৪০। ৬১৭, মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৭-৩৬৮। ৬১৮ ঐ, পৃ, ৩৬৮। ৬১৯ ঐ, পৃ. ৩৬৮। ২৩. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪২। ৬২৯, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।

১৭৫

নেতাদের সুর পাল্টে যায় এবং তারাও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি ব্যতীত প্রস্তাবিত পিন্ডি বৈঠকে যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে নেতাদের এ ধরনের অস্বীকৃতি আইয়ুব খানের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। অনুমান করা যায় যে, তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সঙ্গে কথা বলেন। অথবা মুজিবের বার্তা পৌঁছে দেন যাতে সেখানকার নেতারা প্রভাবিত হন। আইয়ুব খানের আশা জন্মেছিল যে, শেষাবধি তিনি গােলটেবিলের মাধ্যমে একটা গােজামিলের সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো দিকে বইতে শুরু করলে পরিশেষে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন যে, পরবর্তী নির্বাচনে আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।৬২২

২০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে পরবর্তী একমাস পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান হারে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও সহিংস ঘটনা বেড়েই চলে। আসাদ, মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ড. জোহা এবং অন্যান্যদের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বাঙালির মরণপণ উত্থানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৮ হতে ২১ ফেব্রুয়ারি ৪ দিনব্যাপী পূর্ব পাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্তপর্বে উন্নীত হয়। ঢাকা শহরসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এই অভ্যুত্থানের চমৎকার ভাষাচিত্র পাওয়া যায় লেখক আবদুল হকের উল্লিখিত রােজনামচায়। মহাপ্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও মােনেম খান জনতার সদ্যউথিত শক্তির নিকট অস্তিত্বহীন মৃত অশ্বে পরিণত হন। জনগণের ওপর তাদের ক্ষমতার সামান্যতম প্রভাবও আর অবশিষ্ট থাকে না।** আইয়ুব খানের কর্তৃত্ব এবং পাকিস্তান তখন একজন যক্ষা রােগীর শেষ অবস্থায় উপনীত হওয়ার ন্যায় বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। | বিভিন্ন দলের নেতাদের দাবির মুখে সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু বেগম মুজিব ও নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে শেখ মুজিব ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমতাবস্থায় সমগ্র পাকিস্তান রাজনীতির জটিল গ্রন্থি খােলার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায় উল্লিখিত দাবি। মেনে নেয়া । এই কাজটি আত্মঘাতী হবে জেনেও আইয়ুব খান তা করতে বাধ্য

———–

৬২২ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৮।

১৮, ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে গণঅভূত্থানের বিবরণের জন্য দেখুন, আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৩-১৪৪। ৬২*, ঐ, পৃ. ১৪৬। ***. GW Choudhury, op.cit., p. 57. 620 Ibid, p. 37. Also Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy (Dacca: UPL, 1979), pp. 146-147.

হন।৬২৭এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরে এসে ২১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন—সরকারের আন্তরিকতা থাকলে তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে কেবল তখনই গােলটেবিলে যােগদান সম্ভব হতে পারে। পরিশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার এই মামলাটি প্রত্যাহারপূর্বক সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৯ আগরতলা মামলার আসামিরা ছাড়াও নিরাপত্তা আইনে আটক ৩৪জন রাজবন্দিকেও মুক্তি দেয়া হয়। কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহসহ অন্য নেতারাও মুক্তি পান। এর মধ্য দিয়ে আইয়ুব শাসনের নৈতিক পতন ঘটে। অন্যদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে বিজয়ী বীরের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে।৬৩১ | পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। জনসভার বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মােশতাক আহমদ কমিউনিস্ট প্রভাবিত ছাত্রদের ১১ দফা না মানার জন্য। মুজিবকে বলেন । কিন্তু তাজউদ্দীন যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বাঙালি জাতির এই জাগ্রত চেতনাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা জরুরি। মুজিব তাজউদ্দীনের যুক্তি মেনে নেন। যাহােক ঐ জনসভাতে ডাকসুর সহসভাপতি তােফায়েল আহমদের প্রস্তাবক্রমে উপস্থিত জনতা শেখ মুজিবকে। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। প্রকৃতপক্ষে সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা নিয়ে সেই মুহূর্তে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক।৬৩৫

———

৬২৭” দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। * Arun Bhattacharjee, Dateline Mujibnagar (Delhi: Vikash Publishing House Pvt.Ltd., 1972), p. 69. ৬২* আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬। * Pakistan Observer, 23 February, 1969. *** GW. Choudhury, op.cit., p. 26. ৬৩২, আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৭। ৬৩৩ ড. কামাল হােসন, তাজউদ্দীন আহমদের ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ, ২৩ জুলাই, ২০০৫। ৬৩৮ সন্তোষ গুপ্ত, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস’, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৮। ৬৩৫ Archer K Blood, op.cit., p. 46.

নানা দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ সাল নাগাদ বাঙালি জাতিসত্তার যে উন্মেষ ঘটেছিল, বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় তা ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কামারশালার হাপরে উত্তপ্ত টকে লাল লােহার মতাে। অবস্থায় উপনীত হয়। এরপর প্রয়ােজন হয় সেই উত্তপ্ত লােহারূপী নিখাদ। জাতীয়তাবােধকে সঠিক ও প্রয়ােজনীয় আকার প্রদান করে ব্যবহারােপযােগী করে গড়ে তােলার। এজন্য প্রয়ােজন হয় সুনিপুণ, দক্ষ কারিগরের। পূর্ব পাকিস্তানের জনগােষ্ঠীকে একটি জাতিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে এই পর্বে মুজিবতাজউদ্দীন নেতৃত্বের দৈরথ যােগ্যতার সাথে সেই কারিগরের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটা জাতীয় রূপ পরিগ্রহ করে। যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী মােহের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তা সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক এই জাতীয়তাকে পরিত্যাগ করে এতদঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমবায়ে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক জাতীয়তাবাদী চেতনা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। বাঙালির সদ্যউথিত এই চেতনাকে মাত্র দুবছরের ব্যবধানে মুজিব-তাজউদ্দীন পরিপূরক জুটি নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে। রাজনৈতিকভাবে একটি জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। অভ্যুত্থানের পর থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ পর্যন্ত মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি জাতীয়তাবাদের উত্তাপে তপ্ত ঐ চেতনাকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগিয়ে একটা রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। প্রফেসর নুরুল ইসলাম (যিনি উভয়ের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাটান) এর মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনসম্মােহনী ক্ষমতা আর তাজউদ্দীন আহমদের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও নিপুণ কর্মপরিকল্পনার সমন্বয়ে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম সৌভাগ্য রচিত হয়।৬৩৬

| বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে কৌশলগত কারণেই গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করা প্রয়ােজন; এতে যােগ দিয়ে ব্যর্থতার দায়ভার আইয়ুব খানের ওপর চাপানাে যেতে পারে, আর আলােচনা ব্যর্থ হলেও নিশ্চিতভাবে তা বিকাশমান বাঙালি। জাতীয়তাবাদরই শক্তি বৃদ্ধি ঘটাবে- এ ধরনের মূল্যায়ন থেকে আলােচনায় যাওয়ার পূর্বে একবার মুজিব ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তার প্রবল নিষেধ।

————-

৬৩৬, ড. মযহারুল ইসলাম ও অন্যান্য (সম্পা.), জাতীয় চার নেতা স্মারক গ্রন্থ (ঢাকাঃ জাতীয় চার নেতা পরিষদ, ১৯৯৬), পৃ. ৮৪-৮৫।

সত্ত্বেও ৬৩৭ ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্য নেতৃবৃন্দসহ লাহাের যাত্রা করেন। ঐ প্রতিনিধিদলে অন্যরা ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মমিন, নূর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল (১৯২৪১৯৮৭), এম.এ. আজিজ, ময়েজউদ্দিন (১৯৩৩-১৯৮৪) ও মতিয়ার রহমান। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে ন্যাপ নেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করেন নি।৬৩৯ | আইয়ুব খান নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু মুজিব তাতে প্রলুব্ধ না হয়ে পাকিস্তান শাসনাধীনে পূর্ব বাংলার শােষিত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন এবং এর প্রতিকারের জন্য ৬ ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার ব্যাপারে গুরুত্বারােপ করেন। আইয়ুব খান সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে সম্মত হলেও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট বাতিল ও সংখ্যাসাম্য নীতি মানতে অসম্মতি জানান। সুতরাং বলা যেতে পারে, গােলটেবিলের মাধ্যমে কালক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হলাে না। এই ফলাফল জানার পর পূর্ব বাংলায় বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।

সমস্যা সমাধানে একদিকে গােলটেবিলের ব্যর্থতা অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে লৌহমানব আইয়ুব খান কোণঠাসা হয়ে পড়েন। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হয় যে, তিনি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে ভুল করেছেন। এ ছাড়াও সদ্য ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান, ভাসানী ও ভুট্টো কর্তৃক আন্দোলনের হুমকি প্রদান প্রভৃতি পাকিস্তানের রাজনীতিতে তার অবস্থানকে একেবারে শূন্য অবস্থানে নামিয়ে আনে। প্রকৃতপক্ষে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের রাজনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায় । উপায়ন্তর না দেখে তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সেনাপ্রধান ইয়াহিয়ার অনুকূলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি তার পদত্যাগপত্রে দেশের সমুদয় প্রশাসনিক

—–

এম, আর, আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি (ঢাকা: সাগর পাবলিশার্স, ১৯৯৭), পৃ. ১০৯। ৩৮ মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পৃ. ৩৭৪। ৮৩৯ সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।

মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৬।

ঐ, পৃ. ৩৭৬-৩৮৩। গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের প্রদত্ত বক্তব্য দেখুন। দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৩৯-৪৪৪। ” আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০।

ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেন। এভাবেই প্রবল ক্ষমতাধর আইয়ুব খান হারিয়ে যান ইতিহাসের পাতা থেকে। কিন্তু রেখে যান সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তরসূরি যথাক্রমে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে। এদের চক্রান্তের কারণেই বাঙালি জাতি সকল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে এবং বিপুলভাবে ভােটে বিজয়ী হয়েও যথারীতি ক্ষমতা পায়নি।৬৪৪

সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্যা

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর উৎস থেকে জানা যায়, যখন গােলটেবিল আলােচনা শুরু হয় তখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা তৎপর হয়ে ওঠেন। ইয়াহিয়া খান পেশাগত ব্যাপারে যথেষ্ট দক্ষ হলেও রাজনৈতিক ব্যাপারে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর নির্ভর করতেন এবং ভুট্টো এই নির্ভরতার সুযােগ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে রাও ফরমান আলী খানের পর্যবেক্ষণটি উল্লেখ করা যেতে পারে: ৩৪৬

নিয়তি নির্দিষ্ট পরবর্তী বছরগুলােতে ভুট্টোর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নির্দেশনার ওপর ইয়াহিয়া সর্বতােভাবে নির্ভর করেছেন। প্রেসিডেন্টের সি.ও. এস এবং প্রকৃত প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী পদে জেনারেল পীরজাদা থাকায় সরকারের সকল গােপন তথ্যই ভুট্টো জানতে পারতেন এবং পীরজাদার মাধ্যমে ইয়াহিয়ার অনেক সিদ্ধান্তের

ব্যাপারেই তিনি প্রভাব খাটাতেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন যে, সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া তার অন্য কোনাে উদ্দেশ্য নেই। তিনি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। অতঃপর নির্বাচনের ভিত্তি হিসেবে যে আইনগত কাঠামাে আদেশ বা এল.এফ.ও. ঘােষণা করেন তাতে রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি, পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট, জনসংখ্যাভিত্তিক নির্বাচন, সমতা ইত্যাদি বিষয়ে ন্যায়সংগত সমাধানে পৌছানাের আহবান জানান। অন্যথায় তিনি স্বীয় বিবেচনায় ব্যবস্থা গ্রহণ।

——-

৬৪৩সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮১। আইয়ুব খানের পদত্যাগপত্রের পূর্ণ টেকস্টের জন্য দেখুন, দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৪৬। ৯* রাও ফরমান আলী খান, বাংলাদেশের জন্ম, শাহ্ আহমদ রেজা (অনু.) (ঢাকা: ইউ.পি.এল., ১৯৯৬), পৃ. ২৪। ৬৪৫ ঐ, পৃ. ২৩। উ০৬ ঐ, পৃ. ২৪-২৫।

১৮০

করবেন বলে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন।৬৪৭ তিনি অবশ্য গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ভিত্তি, সংবিধান প্রণয়ণ প্রভৃতি বিষয়ে অনেকগুলাে উদার ও গ্রহণযােগ্য প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে সার্বজনীন ভােটাধিকার, প্রদেশের সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি বিষয়কে গ্রহণ করা হয়। এবং বলা হয় নির্বাচিত গণপরিষদ ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা করবে।৬৪৮ তার এই ঘােষণার প্রতি রাজনৈতিক দলগুলাে মােটামুটি অনুকূল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ছিল; পরিবেশ পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক ভিত্তিও তাদের পক্ষে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর নতুন রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টিকে প্রস্তুত হওয়ার সুযােগ দেয়ার জন্যে এক বছর সময় প্রদান করা হয়।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন সম্ভাবনা এবং জনতার। সম্ভাবনাময় উত্থানকে যে কোনভাবে চক্রান্তকারী মহল নস্যাৎ করে দিতে পারে। বলে তাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যয় জন্মে। তাই কারামুক্তির পর থেকেই তিনি পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একদিকে সংগঠনকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সুসংগঠিতকরণে মনােযােগ দেন, অন্যদিকে তিনি মাঝেমধ্যেই বক্তৃতা, বিবৃতি, আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে তার আশংকার কথা। ব্যক্ত করেন এবং মহলবিশেষের চক্রান্ত ও অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে সাবধান। থাকতে বলেন। তার অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই জানেন যে, বাঙালি যখনই তার অধিকার আদায়ের জন্যে একতাবদ্ধভাবে সােচ্চার হয়েছে, তখনই তা বানচাল করার জন্য সব সময় তৎপর থেকেছে শােষকগােষ্ঠী। তারা নানা অপতৎপরতার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে বারবার তার অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এবার যে এর ব্যতিক্রম হবে না তা তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়েই বুঝতে পারেন। মুক্ত হয়েই প্রথম সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে চরমপন্থীদের উস্কানি ও স্বার্থান্বেষীদের প্ররােচনা সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানের জন্মােত্তর কাল থেকে এই সর্বপ্রথম দেশের দুই অঞ্চলের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি কামনার উত্থান ঘটেছে একইসূত্রে। এই জোয়ারকে একদিকে স্তব্ধ করে দেয়ার ফাদ পাততে পারে কর্তৃপক্ষ, তেমনি জনগণকে সচেতন না করে জোয়ারে গা ভাসানােও মারাত্মক পরিণাম ডেকে আনতে পারে। অপর এক বিবৃতিতে

——

৬৪৭ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬০- ১৬২। ৬০৮ এল.এফ.ও. এর পূর্ণ টেক্সট দেখুন, দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৫০২-৫২০। ৩৪* আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৯। ৩৫৫ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০। ৬৫ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।

বলেন, দেশবাসীর সার্বিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে সফল করার জন্যে সকল প্রকার গুণ্ডামি প্রতিরােধ করে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, অতি বিপ্লবী শ্লোগানধারী ও গােলযােগ সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে।৬৫২ তাজউদ্দীন আহমদ এ ধরনের আশংকা করার কারণ ছিল, বিশেষত মওলানা ভাসানী হুমকি দিয়ে বলেন, যে কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে নিজের সম্পত্তি বিনাশের ঝুঁকি নেবেন। কারণ আমরা তার বাড়ি পুড়িয়ে দেবাে এবং তাকে শেষ করে ফেলবাে’ । তিনি আরও বলেন, ১৪ দফা ও ১১ দফা দাবি

মানলে আমরা ভােটগ্রহণ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেবাে, ব্যালট বাক্স ছুড়ে ফেলবাে এবং ভােটগ্রহণ কর্মচারীদের প্রহার করবাে’ । কোথাও কোথাও পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চাই’ লিখিত পােস্টারও দেখা যায়। এ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ আশংকা করেন, জেগে ওঠা জনগণের অপরিপক্ব ঐক্যকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চক্রান্ত চলছে। তিনি সেভাবে নাম উল্লেখ না করলেও বুঝা যায় যে, ভাসানী ও ভুট্টোর কার্যকলাপকে সন্দেহ করেন। জনগণকে প্রস্তুত করার আগে এ ধরনের কথাবার্তা নিঃসন্দেহে আন্দোলনকে স্যাবােটাজের শামিল। এ সময় ভাসানী যেসব কথা বলেন তার পশ্চাতে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের চেয়ে দলীয় অবস্থানকে সংহত করাই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়।৬৫৮ | এ সময় হতেই তাজউদ্দীন আহমদ সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার পাশাপাশি জননেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন নাগাদ সাধারণ মানুষের নিকটও তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। এ ধরনের একটা শ্লোগানের কথা জানা যায়, বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীন/ওরা আনবে নতুন দিন।”৬৫ শেখ মুজিবের ন্যায় বিপুল জনসম্মােহনী নেতার সমসাময়িককালে তাজউদ্দীন আহমদের এরূপ পরিচিতি অর্জন কঠিন ব্যাপারই বটে। তার এই

———–

৬৫২, ঐ, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।

. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫২। ৬৫*, রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১। ৫৫ * পূর্বাহ্নে জনাব তাজউদ্দীন ও অন্য নেতৃবৃন্দ এখানে আগমন করিলে নদীর তীরে (বৈদ্যের বাজার, ঢাকা) বিপুল জনতা আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ‘তাজউদ্দীন আহমদ জিন্দাবাদ’ সহকারে তাহাদিগকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে।” দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ মার্চ, ১৯৬৯। ৬৫৬ নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল হামিদের সাক্ষাৎকার।

গ্রহণযােগ্যতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

ভুট্টো যখন পশ্চিম পাকিস্তানে তার দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতকরণে ব্যস্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন দেশে বিদেশে ৬ দফা ও ১১ দফার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা এবং পাকিস্তান কাঠামােতে বাঙালির দীর্ঘদিনের শােষণ বঞ্চণার কথা ব্যাখ্যাপূর্বক জনমত গঠনে তৎপর। গােলটেবিল আলােচনা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বুঝে যান নির্বাচন অত্যাসন্ন। কারণ আর কোনাে সামরিক শাসন দিয়েই জনতার ঐ চেতনাকে দমন করা যাবে না। পূর্ব বাংলায় কর্মরত সামরিক বাহিনীর বেসামরিক বিষয়ে দেখাশােনার দায়িত্বে নিয়ােজিত কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলী খানের এই উপলব্ধি হয়েছিল ১৯৬৮ সালেই। তিনি পরবর্তীকালে লিখেছেন ‘কোন জাতি যদি তার শাসকদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায় তাহলে তাদের (শাসকদের) উৎখাতের জন্য সে জাতির কোন অস্ত্রের প্রয়ােজন হয় না’।৬৫৭

কোনাে চক্রান্তের মুখে যাতে নির্বাচন বিলম্বিত না হয় সে লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ অনতিবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানান, সকল মানুষ যাতে ভােটার হতে পারে সে সুযােগ সৃষ্টিরও আহ্বান রাখেন। তিনি ৬ ও ১১ দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং পাকিস্তান কাঠামােতে পূর্ব বাংলার শােষিত হওয়ার ব্যাপারটিকেও মাঝেমধ্যে দেশবাসীর সামনে হাজির করেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সফরকালে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং জামায়াত নেতা মওদুদী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কটাক্ষ করে বক্তৃতা করেন। এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বিশেষ মহলের স্বার্থরক্ষার অনুকূলে ছিল। এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা মওদুদী ও নবাবজাদা নসরুল্লাহ এবং তাদের সহচরদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাল্টা বক্তব্য রাখেন। এ বিষয়ে ১৯৬৯ সালের ৮ জুলাই ইত্তেফাকে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়:৬৫৮

জনাব তাজউদ্দীন নবাবজাদা ও তাহার অনুচরবর্গকে হােটেল কক্ষের ছত্রছায়া হইতে বাহির আসিয়া পূর্ব পাকিস্তানের যে কোন স্থানে দাঁড়াইয়া আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে তাহার ও তাহাদের অভিযােগের পুনরাবৃত্তি করিবার চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। আওয়ামী লীগের ৬ দফার অন্তর্ভুক্ত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব ও এক ইউনিট বাতিলপূর্বক পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশসমূহের পুনরুজ্জীবনের

———-

৬৫৭ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫। ৬৫৮ দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ জুলাই, ১৯৬৯।

দাবির প্রতি কটাক্ষ করিবার পূর্বে এই তিনটি ইস্যুর উপর অবিলম্বে দেশব্যাপী | গণভোেট অনুষ্ঠান করিয়া সত্যিকার গণতন্ত্র প্রীতির পরিচয় দেওয়ার জন্য তিনি

নবাবজাদার প্রতি আহবান জানান। অন্যদিকে মওলানা মওদুদীর তীব্র সমালােচনা করে বলেন, যে পাকিস্তান | সৃষ্টির তিনি বিরােধিতা করেছিলেন এখন সেটা রক্ষার জন্যে তিনি সদ্য ঘটে যাওয়া। গণঅভ্যুত্থানকে ভারতীয় হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন। তাজউদ্দীন আহমদ। মওদুদীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযােগ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলার আন্দোলনে ভারতীয় চরের হাত আবিষ্কার করে তিনি এখানকার মানুষের বিরুদ্ধে কটাক্ষ । করেছেন। অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচনের দাবি এবং পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর নিকট হতে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই ইয়াহিয়া খান। জাতির উদ্দেশে তার প্রথম বক্তৃতায় ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর নির্বাচনের তারিখ | ঘােষণা দেন। নির্বাচন অত্যাসন্ন জেনে মওলানা ভাসানীও পশ্চিম পাকিস্তানি । নেতাদের ন্যায় এমন সব দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতে থাকেন যেগুলাে সরাসরি | নির্বাচনবিরােধী এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ইঙ্গিতবাহী। তিনি অবশ্য বলেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না। তার নামে প্রকাশিত ভােটের আগে ভাত চাই নামক পুস্তিকাখানিতে এই দাবি সাধারণ্যে তুলে ধরা | হয়। প্রতিক্রিয়ায় তাজউদ্দীন আহমদ ভাসানীর তীব্র সমালােচনা করেন। চরম || ডান ও চরম বামপন্থী দলগুলাের স্বরূপ সম্পর্কেও তাজউদ্দীন আহমদ সুচিন্তিত ও | যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করেন:৬৬৩

.. তিনি বলেন যে, কায়েমি স্বার্থবাদে সামান্যতম আঘাত লাগিলেই ইসলামের নামে চরম দক্ষিণপন্থীরা কর্মতৎপর হইয়া উঠে। চরম বামপন্থীদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করিয়া | বলেন যে, ইহারা ভােটের আগে ভাত চান কিন্তু কে তাহাদের ভাত দিবে, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ছাড়া? তিনি বলেন যে, প্রকৃত গণপ্রতিনিধি নির্বাচন করার মাধ্যমেই

———

৬৫৯ ঐ, ২২ মার্চ, ১৯৬৯। ৩৩° “আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করি। এতে আমরা উল্লেখ করি, বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিতদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখন বিচ্ছিন্নতার পক্ষে । আমাদের অভিমতে বলা হয়, সামরিক শাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় এবং সে কারণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য আমরা সুপারিশ করেছিলাম।” রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮। ৬৬ আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭। ৬৬২, দৈনিক ইত্তেফাক, ২ অক্টোবর, ১৯৬৯। ৬৬৩. ঐ, ৩০ অক্টোবর, ১৯৬৯।

জনসাধারণ ভাত, কাপড়, শিক্ষা, চিকিৎসা ন্যায্য মূল্যে দ্রব্যাদি প্রাপ্তি এবং উৎপাদিত

দ্রব্যের প্রাপ্য মূল্য আশা করিতে পারেন । ঐ সকল তথাকথিত ধর্মীয় ও বিপ্লববাদী দলের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, জনতার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তখন যারা ভােটের আগে ভাত চান, কিংবা এর পেছনে ভারতীয়দের হাত আবিষ্কার করেন, তারা ভােট কিংবা ভাত কোনােটাই চান না। তারা চান নির্বাচনকে বানচাল করে বাঙালির ভাগ্য তমসাচ্ছন্ন করে রাখতে। | অন্যদিকে ইসলামপন্থী দলগুলাে সরাসরি ইসলামের নামে, পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে আওয়ামী লীগের বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এক্ষেত্রে উভয় গ্রুপের অবস্থান দাড়ায় নির্বাচনবিরােধী, যা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্র, পুঁজির মালিকদের স্বার্থরক্ষায় সহায়ক ছিল।

ভারতের আহমেদাবাদে সংঘটিত দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যাতে পূর্ব বাংলায় কোনাে প্রকার দাঙ্গা না বেধে যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্যে তাজউদ্দীন আহমদ ১ অক্টোবর দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দেন। এর অনতিবিলম্বে ঢাকার মােহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ভােটার তালিকা প্রণয়নকে কেন্দ্র করে বিহারীবাঙালি দাঙ্গা বেধে যায়। বাঙালির ঐক্যের মুখে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নতুন ছিল না। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ৪ নভেম্বর উদ্ভূত পরিস্থিতির বিষয়ে তাকে টেলিফোনে অবহিত করেন এবং দু নেতা একমত হন যে, এর পেছনে সুগভীর চক্রান্ত রয়েছে।৬৬৬ | ১৯৪৭ উত্তর পাকিস্তানের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অগ্রণী সৈনিক হচ্ছে ছাত্রসমাজ। এই চেতনার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, প্রতিটি ক্রান্তিকালে দিশেহারা পূর্ব বাংলার মানুষকে সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। জাতীয়তাবাদী এই সংগ্রামে তীরের অগ্রভাগের ন্যায় তাদের অবস্থান। তাই সরকার সব সময়ই ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টা করতাে। গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার ৬ জন ছাত্র নেতা যথা তােফায়েল আহমদ, আ.স.ম. আবদুর রব, মােস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুবউল্লাহ ও ইব্রাহীম খলিলের বিরুদ্ধে সামরিক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে

———-

৬৬৪ ঐ, ৫ জানুয়ারি, ১৯৭০। ৬৩৫ ড. মাে. মাহবুবর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭-১৬৮ ।

‘ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৭-৪৩৮।

১৮৫

অভিযােগ আনয়ন করে। ১৯৬৯ সালের ১ অক্টোবর প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ঐ সকল ছাত্র নেতার অভিযােগ প্রত্যাহার করে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছার পরিচয় দেয়ার আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ সময় ঢাকায় এসেছিলেন। তার আগমনের প্রাক্কালে খুব সম্ভব ঐ আহ্বানের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগের পূর্বে ছাত্র নেতাদের ওপর হতে অভিযােগ প্রত্যাহার করেন। | আসন্ন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্যে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৯ সালের ১ আগস্ট দলের পূর্ববর্তী গঠনতন্ত্রের প্রয়ােজনীয় সংশােধনীসহ সময়ােপযােগী। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। এটি সর্বশেষ সংশােধনীসহ ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর গৃহীত হয়। এই গঠনতন্ত্রে কেন্দ্র হতে সর্বনি স্তর ইউনিয়ন পর্যন্ত সংগঠনের রূপরেখা, ক্ষমতা, কার্যাবলি, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান রাখা হয়। সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক রচিত ও সংশােধিত দলের অঙ্গীকার ও গঠনতন্ত্র দেখে অনুমান করা যায়, আসন্ন নির্বাচনে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে তারা যেন দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চলেছেন। অঙ্গ সংগঠনসমূহসহ দলের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সুসমন্বিত একটি সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রয়াস এতে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সমগ্র প্রদেশের সাংগঠনিক অবস্থা তার নখদর্পণে থাকায় তাজউদ্দীন আহমদ পার্টিকে এ ধরনের একটি উত্তম। গঠনতন্ত্র উপহার দিতে সক্ষম হন। এরই ফলে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন সহজসাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, বিজয় অর্জনের পর সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে বিশ্ব ইতিহাসের এক বিরল অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তােলা সম্ভব হয় এ ধরনের শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি থাকার কারণে। তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক বাস্তবতার কারণেই ১৯৭১ সালে সমগ্র পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরােধও গড়ে ওঠে।

———–

৬৬৭ ঐ, পৃ. ৪২৮। ৬৬৮ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক রচিত ও পঠিত গঠনতন্ত্রের সম্পূর্ণ টেক্সটের জন্য দেখুন, ড. আবুল কাশেম, (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ: ঐতিহাসিক দলিল (ঢাকা: জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০১),পৃ. ২৩২-২৬০।

এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও সাংবাদিক সম্মেলনে সমানভাবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তীব্র সমালােচনা করে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করেন সেগুলাে লক্ষ্য করার মতাে। যেমন:৬৬৯

শ্রমজীবী সংগঠনগুলাের ন্যায্য দাবির প্রতি তিনি সমর্থনদান করেন। বক্তব্যে বলেন যে, পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা দ্রব্যমূল্য বেশি কিন্তু শ্রমিকরা মজুরি পায় কম, এই বৈষম্য দূর করা দরকার। কৃষকদের উৎপাদনের অতি আবশ্যকীয় উপকরণ সার ও কীটনাশকের ক্রমবর্ধমান মূল্য, অন্যদিকে ধনিক শ্ৰেণীকে কোটি কোটি টাকার ট্যাক্স হলিডে’ প্রদানের তীব্র সমালােচনা করেন। দলের পক্ষ থেকে কৃষককুলকে রক্ষার জন্যে উৎপাদনের উপকরণসমূহের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বাতিল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্রে এগুলাে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।

তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়েও সমানভাবে আলােকপাত করেন। যেমন- পশ্চিম পাকিস্তানে পরপর তিনটি স্থানে রাজধানী স্থানান্তরে এবং ইসলামাবাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে আমেরিকা থেকে ঘাস আমদানি করতে টাকার অভাব হয় না, কিন্তু নদীমাতৃক পূর্ব বাংলার জীবনমরণ বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্যে টাকার অভাব হয় বলে তিনি তীর্যক মস্ত ব্য করেন। তিনি বার বার হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালের প্রস্ত বিত ক্রুগ কমিশনের রিপাের্ট অনুযায়ী স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের আহবান জানান। এক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার অভাব ও অবহেলাকে দায়ী করেন। বন্যার কারণে বিগত ১৭ বছরে ৩৪ শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বলে তিনি অভিযােগ করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে বাজেট বহির্ভূতভাবে মংলা তারবেলা বাঁধ নির্মিত হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের এই অভিযােগের সত্যতা বাঙালিরা অনতিবিলম্বে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করে। ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর দিবাগত রাতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলভাগে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস হয়, যাতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, পরিসংখ্যানাতীত সম্পদ বিনষ্ট হয়। বাঙালির এই দুর্যোগকালে ইয়াহিয়া খান চীনের সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করে বেইজিং থেকে ফেরার পথে ঢাকায় থামেন এবং হেলিকপ্টারযােগে আকাশ থেকে এই দৃশ্য দেখে যান মাত্র। কিন্তু দুর্গতদের উদ্ধার কিংবা পুনর্বাসনের কার্যকর কোনাে উদ্যোগ

—–

৬৬৯ এ বিষয়ে জানার জন্য দেখুন, সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ: ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃ. ১৯-৮৯।

গ্রহণ করেন নি।৬৭০ তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতারা নির্বাচনের কাজ ছেড়ে দৌড়ে যান নিহতদের দাফন ও দুর্গতদের সাহায্যের জন্যে। ৪ দিনব্যাপী তার এই সফরকালে তিনি যেন শ্মশানের মধ্যে কাটান। রামগতি, লক্ষীপুর, চরমােহন, চরবেপারী, ভােলা জেলার বিভিন্ন স্থানে তিনি দুর্গতদের যথাসাধ্য সাহায্য করেন। ভােলা জেলার বেতােয়া খালের তীর, বিল এবং ধানক্ষেত হতে অসংখ্য লাশ নিজ হাতে উদ্ধার করে তিনি জনগণের সহায়তায় ঐগুলাে দাফন করেন। বিবৃতি মারফত তিনি উপকূলীয় অঞ্চলে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ হতে মানুষকে রক্ষার জন্যে স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তােলার আহ্বান জানান, যেগুলােতে আপৎকালে দুর্গত মানুষেরা আশ্রয় নেবে, অন্য সময় শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে এগুলােকে ব্যবহার করা যাবে। | ১৯৭০ সালের ঐ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের পর সরকারিভাবে তাদেরকে উদ্ধার ও পুনর্বাসনে অবহেলা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উদ্ধার প্রচেষ্টা জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সম্ভবত নির্বাচনী ফলাফলে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুটা প্রভাব বিস্তার করে। নির্বাচনের পূর্বে মুজিব ও আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা নব্বই শতাংশ আসন পেতে পারেন বলে অনুমান করেন। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদে ৯৯ শতাংশ আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রায় প্রদানের নিকটতম কারণ হিসেবে এই প্রলয়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে । দৈনিক পূর্বদেশ নির্বাচনের পূর্বে ‘বাংলার মানুষ কাঁদো’ এই শিরােনামে এক হৃদয় বিদারক আবেগ উদ্রেককারী প্রবন্ধ ছাপে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পুঁজিপতি ও টেক্সটাইল মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযােগ এনে বলেন যে, লক্ষ লক্ষ মরদেহের সৎকার করার জন্য তারা ১ গজ কাপড়ও দেয় নি। সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযােগ করেন অন্যদেশের সেনাবাহিনী দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে এলেও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেনি বলে । | অসহায় মানুষেরা শাসকদেরকে তাদের পাশে পায়নি, পেয়েছে বাঙালিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। তাই নির্বাচনে তারা তাদের রায় প্রদানে ভুল করেনি। অবশ্য এর অল্প পরে ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলাব্যাপী যে মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগে অন্ততপক্ষে তিনগুণ প্রাণহানি এবং অপরিমেয় ধন-সম্পদের ক্ষতি

————

৬৭০ আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৬),

পু, ২২।

*** Archer K Blood, op.cit., p. 58. ৬৭, দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ নভেম্বর, ১৯৬৯।

Archer K Blood, op.cit., p. 116.

অপেক্ষা করছিল সাধারণ মানুষ তখন পর্যন্ত অনুমান করতে পারেনি। কিন্তু নেতারা সেই দুর্যোগের আশংকা করছিলেন ঠিকই। ২৬ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান একটি লিখিত বিবৃতিতে এ আশংকার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন দুর্গত এলাকায় বড়জোর কয়েক সপ্তাহের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া যেতে পারে কিন্তু অবশিষ্ট এলাকায় নির্ধারিত তারিখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তিনি আরাে বলেন, নির্বাচন হয় ভালাে, আর যদি না হয় জাগ্রত জনগণকে আত্মশক্তিতেই সর্বময় ক্ষমতার মালিক হতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লােক মারা গেছে, স্বাধিকার অর্জনের জন্য দরকার হলে বাংলার আরাে ১০ লাখ লােক প্রাণ দেবে।৬৭৪ মওলানা ভাসানীও ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে ১৪ লাখ লােকের প্রাণহানির কথা উল্লেখ করে বলেন স্বাধীনতার জন্য দরকার হলে আরাে ১৫-২০ লাখ মানুষ আত্মােৎসর্গ করবে। তিনি আরাে বলেন, জয় বাংলা স্লোগান বন্ধ করার জন্যে সৈন্য দেয়া হয়নি। পূর্ব বাংলায় সৈন্য নিয়ােগ করা হলে ধরে নিতে হবে এর পশ্চাতে চক্রান্ত রয়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ জানুয়ারি পল্টনের একটি জনসভায় নির্বাচন বানচাল করা হলে, কিংবা নির্বাচনের রায়কে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন: পল্টন নতুন করে ডাক দেবে, স্বাধিকারের দাবি কেউ রুখতে পারবে না।

| এমতাবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচনের পূর্বে সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ ও জনগণকে সচেতন করার জন্য দলের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন বিজয় লাভ

করা পর্যন্ত সকল প্রকার শােষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। তিনি প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন যে, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের হাত হতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে এনে সাধারণ মানুষের ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য

আওয়ামী লীগ অঙ্গীকারাবদ্ধ। ৬ ও ১১ দফা ভিত্তিতে জাতিকে সংবিধান উপহার | দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। | ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণসংযােগের সময় তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকজন সঙ্গীসহ একটি জনসভার কাজ শেষ করে ঢাকা ফেরার পথে গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তিনি পায়ে আঘাত পান। কয়েকদিন বাসাতে বসেই সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তার প্রত্যয় জন্মে যে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যতই ফল ভালাে করুক না কেন স্বেচ্ছায় বাঙালিদেরকে হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হবে

, যুদ্ধের মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হবে। আহত তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে কোনাে কোনাে সুহৃদ দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, “ভয় নেই, মরবাে না,

————–

৬৭৪. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৬।

সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৮। ৬৭৬ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭০।

জেনারেল হামিদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে মরব না।৬৭৭ তার এ ধরনের কৌতুকর বক্তব্য থেকেও আসন্ন সংকটের আভাস পাওয়া যায়।

| জলােচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ঘটনা ছাড়াও আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রচারিত পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন’ নামক একটি পোেস্টার জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকরভাবে সাহায্য করে। এতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। শত আশংকা ও বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার জন্যে নির্ধারিত ১৬২টি জাতীয় পরিষদের আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । দুর্গত এলাকাগুলােয় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি জাতীয় পরিষদের ৯টি আসনে। এবং প্রাদেশিক পরিষদের ১৮টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতাে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলার জন্যে নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ৭ জন মহিলা আসনসহ (পরােক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে) মােট ১৬৭টি লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। অবশিষ্ট ২ টির মধ্যে একটি লাভ করেন। পিডিপি নেতা নূরুল আমিন, অন্যটি স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায়। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ২৮৮ টি, অন্যগুলাে লাভ | করে স্বতন্ত্র সদস্যরা ৭টি, পিডিপি ২টি, জামায়াতে ইসলামী ১টি, ওয়ালী-ন্যাপ | ১টি, অন্যান্য ইসলাম পছন্দ দল ১টি আসন।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি পাঞ্জাবে ৬৪, সিন্ধুতে ১৮, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ১টি, মােট ৮৩টি আসন লাভ করে | পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় পরিষদে | পিপলস পার্টির মােট আসন সংখ্যা হয় ৮৮। পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ | কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও কোনাে আসন পায়নি। অন্যদিকে পূর্ব বাংলায়

———-

৬৭৭ জাওয়াদুল করিম, মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯১), পৃ. ৪০। ৬৭৮ সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫। | ৬৭৯ পূর্ব পাবিস্তান মােট ভােটারের সংখ্যা ছিল ৩১২১১২০৯, পাঞ্জাবে ১৬৩৬৪৪৯৯, সিন্ধুতে ৫৩৪৯৫২৩, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ৩০৭৪২১৭ এবং বেলুচিস্তানে | ৯৫৬০৪৫। প্রদত্ত ভােটের শতকরা হার ছিল যথাক্রমে ৫৭, ৬৯, ৬০, ৪৮ ও ৪০ | ৩

শতাংশ ভােট নষ্ট হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভােটের ৭৫.১১ শতাংশ। | লাভ করে । দেখুন, মােঃ শাহজাহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২৮। ১৮ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের জন্য দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৪ এবং মােঃ শাহজাহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২৯-৪৩২। ৩৮ সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৭।

১৯০

পিপলস পার্টি কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করেনি। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের জনগণের রায় পূর্ব ও পশ্চিমে দু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় । সম্ভবত পাকিস্তান জন্মের পর কোনাে সাধারণ নির্বাচন না দেয়ার একটি কারণ ছিল। এই যে, শাসকগােষ্ঠী অনুধাবন করেছিলেন যে, নির্বাচন হতে দিলে পূর্ব বাংলা। তার স্বতন্ত্র স্বার্থের বিষয়টি ছেড়ে দেবে না। বস্তুত ১৯৪৬ ও ১৯৭০ সালের। ভােটের মধ্যে একটি চরিত্রগত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ সমর্থনকে। পাকিস্তানের পক্ষে গণভােট বলে বর্ণনা করেছিলেন, ১৯৭০ সালের রায়কে শেখ। মুজিব স্বাধিকারের (যার পরিণতি ছিল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা) পক্ষে গণরায় বলে মন্তব্য করেন।৬৮২

দল এ ধরনের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের। প্রাদেশিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১০ ডিসেম্বর নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে। অভিনন্দন জানান এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে। তাদেরকে স্ব-স্ব এলাকায় থেকে প্রচার কাজ চালানাের নির্দেশ দেন। ২০ ডিসেম্বর। সরকারিভাবে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়। ঐ দিন। তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানে চক্রান্তের রাজনীতি যারা করে তাদেরকে সাবধান। করে দিয়ে একটি বিবৃতিতে বলেন যে, যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় বানচালের। দূরভিসন্ধির ন্যায় এবার ৬ দফার প্রশ্নে বাংলার আপামর জনসাধারণের রায়কে বানচাল করার কোনাে অপচেষ্টা করা হলে তা আগুন নিয়ে খেলার শামিল। হবে।এ ধরনের আশংকা যে অমূলক ছিল না পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ তার। প্রমাণ । তার এ ধরনের যথার্থ অনুমান সম্পর্কে প্রতিপক্ষের কেউ কেউ অবগত। ছিলেন বলে পরবর্তীকালে জানা যায়। রাও ফরমান আলী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন।

দলের মধ্যে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ ছিল, যারা মনে করতেন। যে, পশ্চিম পাকিস্তান শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। সে কারণে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের পাশাপাশি সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। কাক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সংগঠন এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। হয়েছিল।” তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই । তাদের এই আশংকার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি এমতাবস্থায় নেতাকর্মী ও বাঙালি সমাজকে ঘরে ঘরে ৬ দফার দুর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানান।

————

৩৮২, মােঃ শাহজাহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৩। ৬৮৩, দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭০। ৬৮৪ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫। উ৮৫ দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জানুয়ারি, ১৯৭০।

২০ ডিসেম্বর নির্বাচনী ফল প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জুলফিকার আলী। ভুট্টো দম্ভোক্তি করে অসংযতভাবে বলেন যে, পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে পাকিস্ত েিনর সংবিধান রচিত হতে পারবে না, সরকারও গঠিত হতে পারবে না। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাবে দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে; প্রদেশ দুটি পিপিপি-এর দুর্গবিশেষ। পরদিন ২১ ডিসেম্বর তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, তেইশ বছর পূর্ব পাকিস্তান দেশ শাসনের ন্যায্য হিস্যা পায়নি, তাই বলে আগামী তেইশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর প্রভূত্ব করবে তা হতে পারে না। তিনি আরাে বলেন যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে পিপলস পার্টির পক্ষে আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। তিনি মূলত এ সময় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের দুঅঞ্চলের জন্য দুজন প্রধানমন্ত্রী ও ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েও তার। ক্ষমতালােভী মনােভাবের প্রকাশ ঘটান।

আইয়ুব খানের পদত্যাগের পরবর্তী ঘটনাবলি পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, ইয়াহিয়া খান নামেমাত্র ক্ষমতাসীন ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সে সময় পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক শাসকগােষ্ঠীর মধ্যে ভুট্টো মূল প্রভাবকে পরিণত হন। কারণ তিনি একদিকে রাজনীতিবিদ ছিলেন। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীতে তিনি একটা ভালাে প্রভাব বলয় গড়ে তােলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণে। তাকে উৎসাহিত করেছিলেন ভুট্টো। তাই রাজনৈতিক ব্যাপারে তাকে ভুট্টোর ওপর নির্ভর করতে হতাে। ইয়াহিয়ার মনে হয়তাে বা আশা জন্মেছিল যে, ভুট্টোর রাজনৈতিক শক্তিতে কাজে লাগিয়ে কোনভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে স্থান করে নেবেন। একই উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকেও তিনি দূরে ঠেলে দিতে চাননি, অন্ততপক্ষে মার্চ মাসের অসহযােগ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর উপরিউক্ত বক্তৃতা ও মনােভাব পূর্ব বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ২১ ডিসেম্বর এর তীব্র বিরােধিতা করে বিবৃতি প্রদান

করেন:৬৮৯

৬৮৬. আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০। ৬৯* রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩। ৬৮৮ “আমার মনে হয় যে, নির্বাচনের আগে মুজিবের প্রতি ইয়াহিয়ার এমনিতর বন্ধুত্বপূর্ণ। মনােভাবের কারণ ছিল এই যে, ইয়াহিয়াকে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে মুজিব অঙ্গীকার করেছিলেন।” ঐ, পৃ. ৩৩। ৬৯৯ দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭০।

পিপলস পার্টির সক্রিয় সহযােগিতা ছাড়া শাসনতন্ত্র রচিত হইতে কিংবা কোন কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হইতে পারিবে না বলিয়া জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর। বরাতে প্রকাশিত বক্তব্য সঠিক নয়। পাঞ্জাব এবং সিন্ধু আর ক্ষমতার ভিত্তি’ নয় । ক্ষমতার এই ধরনের ভিত্তির বিরুদ্ধেই জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালিত হইয়াছে। জনগণ সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই ভােট দিয়াছে-যে গণতন্ত্রে ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং এক ব্যক্তির এক ভােট’ নীতির ভিত্তিতে পরিষদ গঠিত হয়। এই পদ্ধতিতে পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল শাসনতন্ত্র রচনার এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখে । বর্তমানে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অনুরূপ দলরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে এবং জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করিয়াছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অন্যদলের সহযােগিতা গ্রহণ করিয়া বা না করিয়া কাজ চালাইতে পারে। এই ধরনের সহযােগিতা গ্রহণ করা বা না করা আওয়ামী লীগের উপর নির্ভরশীল। কোন এক বিশেষ প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অন্যান্য প্রদেশের প্রতিনিধিদের তুলনায় বিশেষ মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্ব দাবি।

করিতে পারে না। ভুট্টোর দম্ভোক্তি ও অযৌক্তিক মন্তব্যের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী । লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই মন্তব্য অত্যন্ত সুচিন্তিত, দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতিফলন। পূর্বেই বলা হয়েছে, জাতীয় পরিষদের মােট আসন সংখ্যা ৩১৩টি, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই লাভ করে ১৬৭ টি। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের এককভাবে কেন্দ্রে। সরকার গঠনের আইনগত অধিকার জন্মে। অন্যদিকে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮৮ টি আসন পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক নির্বাচিত সদস্যের সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হতাে না। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে কতসংখ্যক সদস্যের মতামত দরকার তার উল্লেখ LFOতে ছিল না। ৯০ রাও ফরমান আলী খান বলেন “ এল.এফ.ও-দুই তৃতীয়াংশের সাধারণ প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টি আরােপ করেনি, ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই পরিষদে পাস না হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কাজেই তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টোর অগণতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু দম্ভোক্তির বিরুদ্ধে যে প্রত্যয়ী মন্তব্য করেন তা ছিল যথার্থ। শান্তি। পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে যথেষ্ট আশংকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে । LFO অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা ছিল। তাই অনতিবিলম্বে শাসনতন্ত্র রচনার প্রাথমিক কাজ শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। শাসনতন্ত্র

————-

৩৯০ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৮।

কেমন হবে তা পূর্বেই বিভিন্ন জনসভা, বক্তৃতা বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেছিলেন।

| ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ নৌকাকৃতির একটি মঞ্চে নির্বাচিত ১৫১ জন জাতীয় ও ২৬৮ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতীক হিসেবে ১৭টি কবুতর উড়িয়ে দেন। আমার সােনার বাংলা গানটিও গাওয়া হয়। শপথের শেষাংশে উচ্চারণ করা হয়:৬৯১

…৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচির উপর প্রদত্ত সুস্পষ্ট গণরায়ের প্রতি আমরা একনিষ্ঠভাবে বিশ্বস্ত থাকিবে এবং শাসনতন্ত্রে ও বাস্তব প্রয়ােগে ৬ দফা কর্মসূচিভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও ১১ দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটাইতে সর্বশক্তি

নিয়ােগ করিব ! …জয় বাংলা। জয় পাকিস্তান। এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে শপথ করানাের পশ্চাতে বহুমুখী সুদূরপ্রসারী কৌশল ছিল। এক্ষেত্রে অন্তত দুটো বিষয়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে- প্রথমত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল নির্বাচিত সদস্যের অভিন্ন প্রতিজ্ঞা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা, দ্বিতীয়ত নির্বাচিত সদস্যরা ভবিষ্যতে কোনভাবে যেন প্রতিপক্ষের দ্বারা প্রলুব্ধ হতে না পারেন সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বস্তুত উক্ত শপথগ্রহণ ছিল ক্ষমতাভােগী ও ক্ষমতালােভী পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন অঙ্গীকার ও বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত ঘােষণাবিশেষ।৬৯২

১১ তারিখে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১২ ও ১৩ তারিখ দুদিন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হন। বিভিন্নভাবেই আওয়ামী লীগের মনােভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। ইয়াহিয়া খানের অন্যতম মন্ত্রী জি.ডাব্লিউ. চৌধুরী এ সম্পর্কে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। কেবিনেটের একজন বাঙালি সদস্য হাফিজউদ্দীনকে শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের অভ্যন্তরীণ খবরাখবর জানার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্রটি দেখতে চান। শেখ মুজিব এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ করতে বলেন।

———–

৬৯১. মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫২৫। ৩৯, আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা: খােশরােজ কিতাব মহল, ১৯৯৯) পৃ. ৫৪২-৫৪৩।

কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষণিকভাবে বলেন যে, এটা উপযুক্ত সময় ছাড়া দেখানাের আবশ্যকতা নেই। ১৩ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার কতিপয় উপদেষ্টা যেমন লেফট্যানেন্ট জেনারেল পীরজাদা, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার এবং গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসানকে নিয়ে শেখ মুজিব ও তার প্রতিনিধিদলের সাথে ৩ ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে উপস্থিত থাকেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং আরাে কয়েকজন নেতা। আলােচনার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার প্রতিটি দফা একে একে ব্যাখ্যা করে বলেন, এতে অন্যায় কিছু নেই, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জন্যেও এটা উপযােগী। ইচ্ছা করলে তারাও তা গ্রহণ করতে পারে। তিনি বলেন, ৬ দফার ওপর শাসনতন্ত্র রচনা করে এক কপি ইয়াহিয়াকেও দেয়া হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া জানান পশ্চিম পাকিস্তান ৬ দফার বিরুদ্ধে, তাই তারা এটা মানতে চাইবে না। এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল বিষয়টি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গেও আলােচনার পরিকল্পনার কথা জানান। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান উপলব্ধি করেন পূর্ব বাংলার সামগ্রিক কর্তৃত্ব মুজিব ও আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে চলেছেন। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর মতে, মুজিব নির্বাচনের পূর্বে ইয়াহিয়াকে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট রাখার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং ৬ ও ১১ দফাকে পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্যে নয় বরং নির্বাচনে জয়লাভের জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। রাও ফরমানের মতে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর মুজিব তার মনােভাব পরিবর্তন করেন এবং বলেন যে, ৬ ও ১১ দফা অপরিবর্তনীয়। ফলে ইয়াহিয়া হতাশ হয়ে এটাকে মুজিবের বিশ্বাসঘাতকতা বলে চিহ্নিত করেন। এর সঙ্গে ভুট্টোর কূটকৌশলেও তার মনােভাব মুজিব ও আওয়ামী লীগ বিরােধিতায় পর্যবসিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা সফরকালে মুজিব ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনায়

স্পষ্টত বুঝতে পারেন যে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে প্রেসিডেন্ট করার কোনাে সম্ভাবনা নেই। এরপর ১৪ জানুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে সরকার গঠন সম্পর্কিত জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে হতাশ ও বিরক্ত ইয়াহিয়া খান বলেন- ‘তাকে (মুজিবকে) গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই তাে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। যখন তিনি আসবেন এবং ক্ষমতা নেবেন তখন আমি সেখানে থাকবাে না।’ এরপর তিনি কতিপয় জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে ১৭

——–

৬৯৩ S. GW. Choudhury, op.cit., p. 152. ৩৯৪ সন্তোষ গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০০। ৬৯৫ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩।

১৯৫

জানুয়ারি বুনাে হাঁস শিকারের অজুহাতে লারকানা গমন করেন। সেখানে গিয়ে | ওঠেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাসভবন ‘আল মুরতােজা’তে। সেখানে ইয়াহিয়া

ও ভুট্টোর মধ্যে সঠিক কী বিষয় আলােচনা হয়েছিল তখন তা জানা না গেলেও পরবর্তীকালে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে, তারা ভারতের সঙ্গে একটি যুদ্ধ বাধিয়ে পশ্চিমে ভারতকে পরাজিত করে এবং পূর্বে ভারতের নিকট পরাজিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার একটি চক্রান্তে লিপ্ত হন । যাহােক ঘটনাপ্রবাহের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ সচেতন বাঙালিরা সজাগ দৃষ্টি রাখেন। পরদিন ভুট্টোর বাসভবনে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার পায়চারিরত ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। অথচ ঢাকায় অবস্থানকালে প্রেসিডেন্ট বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। নেতৃবৃন্দ স্বভাবতই ষড়যন্ত্রের আশংকা করেন। পরবর্তীকালের ঘটনাপ্রবাহ থেকে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় যে, ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে রচিত সংবিধান এবং কালাে বাঙ্গালি জারজদের শাসন তারা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। | ইয়াহিয়া ও ভুট্টো পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যােগসাজশে যখন বাঙালিবিরােধী চক্রান্তে লিপ্ত তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনাপূর্বক আইনগতভাবে ক্ষমতা গ্রহণের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো ও অপরাপর নেতাদের সঙ্গেও আলােচনা অব্যাহত রাখা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকায় ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানানাে হয়। এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব বাংলার ঘটনাপ্রবাহের প্রতি কড়া নজর রাখতে শুরু করে। এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের প্রতিবেদনে। বস্তুত নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রবণতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এবং পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদঞ্চলে তার স্বার্থের বিষয়টি দেখতে

৬৯৬. মােঃ শাহজাহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪১। ৬৯৭ সিদ্দিক সালিক, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, মাসুদুল হক (অনু.) (ঢাকা: নভেল পাবলিকেশন্স, ১৯৯০), পৃ. ৪৪। ৬৯৮ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১।

Archer K Blood, op.cit., pp. 135-152. 900 Roedad Khan, The American Papers (Dhaka: The University Press Limited, 1999), pp. 468-480. Department of State, Telegram, Secret 593.

পায়। ১৯৭১ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের লেখা এক মূল্যায়নের শেষাংশে মন্তব্য করা হয়:৭০১

the continued unity of Pakistan has now become a major question….In the event of hostilities between Bengali nationalists and the Pakistani military over separation, we might wish to wait for a clear verdict before extending recognition to an independent East Pakistan. A violent split would pose more difficult and sensitive situation both East and West Pakistanis would attack great importance to the question

of foreign recognition. উল্লেখ্য, অপরাপর পরাশক্তির মধ্যে গ্রেট ব্রিটেনও এই সময় পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর ১৯৭০ সালের ২১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত সিরিল পিকার্ডো আশংকা ব্যক্ত করে স্যার ডগলাস হিউমের নিকট একটি প্রতিবেদন। পাঠান। তাতে স্পষ্টত লেখা হয়, যেহেতু উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রবণতা ভিন্ন। প্রকৃতির সেহেতু ভােটের মাধ্যমে বিভাজিত অঞ্চল দুটো একটি সমঝােতাপূর্ণ সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হবে না। পাকিস্তানের অতীত রাজনীতির কথা উল্লেখ করে আরাে বলা হয় যে, একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠা প্রায়। অসম্ভব। ১৯৬৯ সাল নাগাদ পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্যের প্রেক্ষিতে কোনাে কোনাে অর্থনীতিবিদও সমস্যা সমাধানযােগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুর রহমানের একটি গবেষণাপত্রের অংশবিশেষ। উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন:৭০৩

পূর্ব পাকিস্তান এখন মনে করে যে, সে স্বায়ত্তশাসন পেলেই কেবল নিজের ইচ্ছেমতাে তার নিজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ বেছে নিতে পারে, আর এই জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি সে কিছুতেই ছাড়তে পারে না। অন্যদিকে) পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা এই দাবির মধ্যে শুধু তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিই নয়, যে সামাজিক কাঠামাের উপর তাদের ক্ষমতা ও বিশেষ সুবিধাদি দাঁড়িয়ে আছে। তার স্থিতিশীলতার উপরেও হুমকি দেখছে। এইজন্য আগামী কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলিতে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ঐকমত্য হবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এ

—————

| Ibid, pp. 479-480. ৭০২ মাসুদা ভাঠি, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ব্রিটিশ দলিলপত্র (ঢাকা: জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০০৩), পৃ. ৪০-৪৩। ৭০৩ মােঃ আনিসুর রহমান, পথে যা পেয়েছি, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা: এ্যাডর্ন পাবলিশার্স, ২০০২), পৃ. ৭৬।

হলে শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রে পৌছাবার সম্ভাবনা সূদূরে, কারণ তীব্র স্বার্থের দ্বন্দ্বের মধ্যে শান্তি আসতে হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মতানৈক্যের মীমাংসার যে ঐতিহ্য ও তার প্রতি যে শ্রদ্ধার প্রয়ােজন এদেশে সেটা গড়ে ওঠবার সুযােগ এখনও

হয়ে ওঠেনি। এদিকে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সমঝােতার পথ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠতে থাকলে ২৭ জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো কয়েকজন সঙ্গীসহ ঢাকায় আসেন। তিন দিনব্যাপী তারা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা আলাপআলােচনায় মিলিত হন। কূটনৈতিক এ সফরকালে ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতার মনােভাব বুঝার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তাদের মনােভাব বুঝার চেষ্টা করা হয়। ইতঃপূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ পরামর্শ করে জানুয়ারি মাসে প্রথমে অধ্যাপক রেহমান সােবহানকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক আকস্মিক সফরে প্রেরণ। করেন। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় কোনাে রাজনৈতিক দল শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কিনা বা সে সম্পর্কে তাদের মনােভাব কী তা জানা। রেহমান সােবহান পিপলস পার্টির নেতা ড. মুবাশ্বের হাসান, মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরী, ভুট্টোর সংবিধান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার রফি রাজা, আবদুল হাফিজ পীরজাদা ও অন্যদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে আলােচনা করে বুঝতে পারেন যে, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে তাদের কোনাে আগ্রহ নেই। রেহমান সােবহান এ প্রসঙ্গে। মন্তব্য করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের সূত্র উল্লেখ করে লিখেছেন, এরপরে ভুট্টো তার প্রতিনিধিদের নিয়ে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ৬ দফার কার্যকারিতার বিষয়ে আলােচনার পরিবর্তে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। আলােচনার বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদ ভুট্টো। ও তার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলােচনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এ থেকে কোনাে সুফল পাওয়া যায়নি। মুজিব ও তার সহকর্মীরা ভুট্টো ও তার সহযােগীদের জানিয়ে দেন ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ জনগণের যে ম্যান্ডেট পেয়েছে, তা পরিবর্তনের ক্ষমতা দলটির নেই। ফলে আলােচনায় তেমন অগ্রগতি হয়নি এবং তা সাধারণ্যে প্রকাশ করাও হয় নি। এমতাবস্থায় কোনাে অগ্রগতি ও দিক নির্দেশনা ছাড়াই আলােচনা অসমাপ্ত রেখে ৩০ জানুয়ারি ভুট্টো তার দলের সদস্যদের নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। শেখ মুজিবুর

৭০৪ রেহমান সােবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য (ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮), পৃ. ৯১।

রহমান তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখের সাথে পরামর্শ করে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতার মনােভাব ও পরিস্থিতি বুঝার জন্যে গােপনে আবদুস সামাদ আজাদকেও প্রেরণ করেন। আবদুস সামাদ আজাদ ২ ফেব্রুয়ারি সেখানে গিয়ে ওঠেন কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানার বাড়িতে। সেখানেই অনেক নেতার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ও আলােচনা। হয়। আবদুস সামাদ আজাদ জানতে পারেন যে, ৬ জন জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে ভুট্টে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে তিনি নেতাদেরকে পরিস্থিতি অবহিত করেন। সামাদ আজাদের নিজের

ভাষায়: ৭০৫

সবকিছু শােনার পর বঙ্গবন্ধু জানতে চান ঢাকা শহরের লােক…দশদিন সফর শেষে ঢাকা ফিরি ১২ ফেব্রুয়ারি। আমার উপর অর্পিত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করতে সক্ষম হই। সেদিনই তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে এ সম্পর্কে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে রিপাের্ট করি বিস্তারিতভাবে। আমি সেদিন জানিয়েছিলাম ইয়াহিয়া খান যাই বলুন না কেন জাতীয় সংসদের বৈঠক বসার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে এদেশের গণতন্ত্রকামী নিরস্ত্র জনতার

উপর একটা সার্বিক আক্রমণ পরিচালনার ।। জনগণকে অন্যত্র সরানাে ঠিক হবে কি-না । তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুস সামাদ আজাদ যুক্তি দেখান, এটা করা হলে জনগণ আতঙ্কিত হবে। বরং আসন্ন আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণই হবে সঠিক পন্থা। এরপর আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড প্রতি জেলাতেই ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটি গঠন করার নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়। সামরিক বাহিনীর দিক থেকে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নতুন ছিল না। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের জন্য যে কোনাে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারও জোট বাঁধেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্ব হতেই তারা এ বিষয়ে অতি সতর্ক ছিলেন বলে ঐ সকল সামরিক অফিসারের সূত্র হতে পরবর্তীকালে জানা যায়। সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা তাদের অনুপাত ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কতিপয় বাঙালি সামরিক অফিসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালান।

৭০৫ আতিকুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের অপ্রকাশিত কথা (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ৫৫-৫৬।

এরূপ সংকটজনক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার তারিখ ঘােষণার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। ১৩ ফেব্রুয়ারিতেই প্রেসিডেন্ট ৩ মার্চ ঢাকায় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং দলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের এক যৌথ সমাবেশে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাকে স্বাগত জানানাে হয় এবং ১৬ তারিখে সমাবেশের দ্বিতীয় দিনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সংসদীয় দলের নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সহকারী নেতা এবং ক্যাপটেন মনসুর আলীকে প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচন করা হয়। হুইপ নির্বাচিত হন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম নিযুক্ত হন ডেপুটি হুইপ। এখানে লক্ষণীয় তাজউদ্দীন আহমদকে কোনাে পদে রাখা হয়নি। সম্ভবত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব আশা করেছিলেন দলটি সমগ্র পাকিস্তানের ক্ষমতার অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং প্রদেশে থাকবেন তাজউদ্দীন আহমদ।

| নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমাবেশে পূর্ব পাকিস্ত নি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, জনগণ ভােটের মাধ্যমে যে আস্থা আওয়ামী লীগের প্রতি জ্ঞাপন করেছে, তার ভিত্তিতে যথাযথ দিক নির্দেশনা দানই সম্মেলনের লক্ষ্য। তিনি বলেন, এই রায়ের ভিত্তিতে যতদিন সার্বিক অধিকার, নির্ভেজাল গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আহূত ৩ মার্চের অধিবেশন আদৌ হবে কিনা সে বিষয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি আশংকা ব্যক্ত করে বলেন যে, এতদিন ধরে যারা শােষণ নির্যাতন চালিয়ে এসেছে তারা মরণ কামড় দেবেই । তবে বাংলার মানুষ তা সর্বাত্মকভাবে প্রতিহত করতে প্রস্তুত ।” ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করার দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এগুলাে এখন জনগণের সম্পদ এবং তা উপেক্ষা করা বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারাে নেই। | ১২ ফেব্রুয়ারি নিজের নির্বাচনী এলাকায় শ্রীপুর হাই স্কুল মাঠে তাকে দেয়া এক গণসংবর্ধনায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যে কোনাে মূল্যেই হােক ক্ষমতা হস্ত Tস্তর না করার চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়া হবে। তিনি ঐ সভাতে বলেন, জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন একমাত্র আওয়ামী লীগকেই তাদের স্বার্থের

——-

৭০৭ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০।

ঐ, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১।

২০০

রক্ষাকারী দল হিসেবে ভােট দিয়ে বিজয়ী করেছে। তাই তিনি নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ঘােষণা করেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কেন্দ্রীয় চাকরিতে জনসংখ্যানুপাতে নিয়ােগদান, অন্যায় কর বাতিল ও আবাদযােগ্য খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করবেন।

১৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক অধিবেশন বসে। অধিবেশন শেষে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া মূলনীতি সম্পর্কে আলােচনা সমাপ্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের সামনে তিনি ঐ দিন আর একটি বিষয়ে সতর্কতামূলক মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৩০ জানুয়ারি কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্টের কথিত দুজন সদস্য ‘গঙ্গা’ নামক একখানি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহাের বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। ছিনতাইকারীরা ভারতীয় কারাগারে বন্দি কয়েকজন সহকর্মীর মুক্তি দাবি করে। ভারত সরকার এ ধরনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান সরকারের নিকট বিমান ফেরত পাঠানাের জন্য আহ্বান জানায়। অন্যদিকে ভুট্টো তড়িঘড়ি ঢাকা ত্যাগ করে ২ ফেব্রুয়ারি। ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎপূর্বক তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। এর অল্প পরে বিমানটির বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়। ফলে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ভুট্টোর যােগসাজশের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এর পরিণতি কি তা কূটনৈতিক জ্ঞানের অধিকারী ভুট্টোর অজানা থাকার কথা নয়। ভারত পরিশেষে ৩ ফেব্রুয়ারি তার আকাশসীমায় পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, প্রথাগতভাবে অতীতের মতােই তিনি ভারতবিরােধী’ আর একটি ইস্যু সৃষ্টি করে পরিস্থিতির মােড় অন্যদিকে ঘুরাতে সচেষ্ট ছিলেন। তঙ্কালীন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কারাে কারাে মতে প্রস্তাবিত আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনাে সদস্য ঢাকায় না আসতে পারেন। তার ব্যবস্থা করাই ছিল এর প্রকৃত লক্ষ্য। এরূপ পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন। | প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানকে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ স্বাগত জানালেও ভুট্টো তাতে যােগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি পশ্চিমাঞ্চলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ও সামরিক কর্তাব্যক্তিদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগের নীতি ও অবস্থানের বিপরীতে সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে উভয় অঞ্চলের মধ্যে সকল ধরনের সমঝােতার পথ ক্রমাগত রুদ্ধ হতে

——–

“৭০৯ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০।

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৪। ** দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১।

থাকে। পূর্ব বাংলার দিক থেকে বিচার করলে সমঝােতার কিছুই ছিল না। কেননা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক পুঁজিপতি ও আমলা শ্ৰেণীটি বাঙালির শাসন মেনে নিতে রাজি ছিল না। তাদের নিকট আওয়ামী লীগ প্রণীত শাসনতন্ত্র মেনে নেয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা জটিলতা দেখা দেয়। কেননা ৬ ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র মেনে নিলে খােদ পশ্চিম পাকিস্ত ানের অন্যান্য প্রদেশও একই দাবি করবে বলে মনে করা হয় যাতে করে পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে হয়ে যেতে পারে। ফলে পাঞ্জাবি পুঁজিপতিদের সর্বনাশ হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। এজন্য ভুট্টো আহূত অধিবেশনে যােগ না দেয়ার অজুহাত খুঁজতে থাকেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো মন্তব্য করেন যে, বর্তমানে ভারত ও পাকিস্ত নি যুদ্ধের মুখােমুখি। তাই নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে তার পক্ষে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করা সম্ভব নয়। তিনি আরােও অজুহাত খাড়া করেন, অধিবেশনে আওয়ামী লীগ প্রণীত শাসনতন্ত্র পিপলস পার্টির নেতারা মেনে নিতে না চাইলে তাদেরকে ঢাকায় হত্যা করা হতে পারে। এ পর্যায়ে ভারতীয় বিমান ছিনতাই ঘটনার রহস্য উন্মােচিত হয়। কারণ ভারতের আকাশসীমা নিষিদ্ধ হলেও শিলং হয়ে পূর্ব বাংলায় আসার পথ উন্মুক্ত ছিল এবং অধিবেশন কমপক্ষে আরাে ১৫ দিন পরে হওয়ার কথা। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের প্রণীত শাসনতন্ত্রের বিরােধিতা করা যেতাে। কিন্তু তা না করে বরং তিনি আহূত অধিবেশন বানচালে চেষ্টা করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো দলীয় একটি কর্মী সমাবেশে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পিপিপি ব্যতীত তৃতীয় আর একটি শক্তিসামরিক বাহিনীর কথা উল্লেখ করেন। ঐ দিনই তিনি প্রেসিডেন্টের এক জরুরি তারবার্তা পেয়ে রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন এবং পরদিন অথাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ৫ ঘণ্টাব্যাপী এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে কিছু সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ আমলাও উপস্থিত ছিলেন। সভাশেষে ভুট্টো আহূত অধিবেশনে যােগদান না করার ব্যাপারে পিপলস পার্টি পূর্ব সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেন। সরকারের পক্ষ থেকে পরদিনই এল এফ.ও.এর ২৩ নং ধারা পরিবর্তন করে বলা হয় যে, পরিষদ সদস্যরা অধিবেশনের আগে পদত্যাগ করতে চাইলে লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনের নিকট আবেদনের মাধ্যমে তা করতে পারবেন। তার পরদিনই পিপলস পার্টির নির্বাচিত সদস্যরা একযােগে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে ভুট্টোকে ম্যান্ডেট প্রদান করেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আওয়ামী

————-

৭১২. মুনতাসীর মামুন, ইয়াহিয়া খান ও মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০১), পৃ.

২৮।

আবদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৬।

লীগের কাজে বাধাদান করা। এ থেকে প্রেসিডেন্টের এল.এফ.ও. সংশােধনী আদেশ ও পিপিপি সদস্যদের একযােগে পদত্যাগের হুমকির মধ্যে গভীর যােগসূত্র ও ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ভুট্টো কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক আমলার উপস্থিতিতে ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেন। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর জেদের নিকট নতিস্বীকার ও পক্ষ অবলম্বন করেন। তারই প্রশ্রয়ে ভুট্টো কেবল অধিবেশনে যােগদানের বিরােধিতাই করেননি, বরং অন্য দলীয় কোনাে সদস্য যাতে যােগ দিতে না আসেন সেজন্য হুমকি দিয়ে বলেন ঢাকায় আহুত অধিবেশন। ‘কসাইখানায় পরিণত হবে। সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের তৃতীয় একটি শক্তি | এবং পিপিপি নেতাদের একযােগে পদত্যাগের হুমকি প্রদান এ সবের মধ্য দিয়ে

ভুট্টো পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে একচ্ছত্র নীতি নির্ধারকে পরিণত হন। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রসঙ্গিক হতে পারে। নির্বাচনের পর ভুট্টো পাকিস্তানে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, সৌদি আরব, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের দূতাবাসের নাম করা যায়। বস্তুত পূর্বাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমান ও পশ্চিমাঞ্চলে জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধান দু নেতায় পরিণত হলে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইয়াহিয়ার অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় তৃতীয়। সেনাবাহিনীতেও তার প্রভাব হ্রাস পায়। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা অতীতের ন্যায় সামরিক ক্ষমতাভােগ করার পক্ষে ছিলেন। সে সম্ভাবনা তারা ইয়াহিয়ার পরিবর্তে ভুট্টোর মধ্যে অধিক পরিমাণে দেখতে পান। সামরিক বাহিনীতে ক্রমাগত স্বপক্ষীয় ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়ে ইয়াহিয়ার চেয়ে ভুট্টো নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেন এবং একটা জটিল পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকারান্তরে তিনি পূর্বাঞ্চলের নির্বাচিত রাজনীতিক ও জনগণকে হুমকি প্রদান করেন। ফলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা সমঝােতার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট শেষাবধি বাঙালিদের ক্ষমতাপ্রাপ্তির প্রত্যাশাকে সমূলে উৎপাটনের জন্যে ভুট্টোর পক্ষাবলম্বন করে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের দিকে এগিয়ে যান। তিনি সামরিক প্রশাসকদের উপস্থিতিতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর মনােভাব ব্যক্ত করেন। ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করার পর তিনি ২১ তারিখে সকল প্রদেশের গভর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের একদিনের সম্মেলনে ডেকে দেশে আবার সামরিক শাসন জারিসহ ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয়

——-

| ৭১৪. ঐ, পৃ. ১৮৬।

১৫ মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫-২৬।

পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গভর্নর আহসানের সঙ্গে মুজিব, তাজউদ্দীন ও ড.কামাল হােসেন সাক্ষাৎ করতে গেলে গভর্নর তাদেরকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করেন। রাও ফরমান আলী লিখেছেন এ সংবাদে তাজউদ্দীন আহমদ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা সব সময়ই জানতাম যে, আপনারা সাংবিধানিক পন্থায় আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না।’৭১৬

| এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সমঝােতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন আলাপ আলােচনার মধ্য দিয়ে গভর্নর আহসানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধুসহ তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু তাই নয় পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের প্রতি তাকে সহানুভূতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পরিশেষে ১ মার্চ তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। এখানে স্মরণযােগ্য, সামরিক শাসক আযম খানও বাঙালির প্রতি সহানুভূতিশীল মনােভাব প্রদর্শন করলে আইয়ুব খান তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন।”” গভর্নর আহসান তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, আন্দোলনের খবরাখবর নিয়মিতভাবে কোনাে কোনাে বাঙালি কর্মকর্তা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে চিফ সেক্রেটারি শফিউল আযমের প্রতি ইঙ্গিত করেন।৭১৮

বাঙালির ন্যায্য দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল আহসান ব্যক্তিগতভাবে অধিবেশন মুলতবি রাখার বিষয়টি শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদকে জানিয়ে দেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ভাব দেখানাে হয় সমঝােতা-আলােচনা শুরু হতে যাচ্ছে। এবং এতদুদ্দেশ্যে ঢাকায় প্রেসিডেন্টের আগমন সময়ের ব্যাপার মাত্র।” অন্যদিকে ভারতের ওপর দিয়ে আকাশ পথ নিষিদ্ধ হলেও শ্রীলংকার আকাশসীমা ব্যবহার করে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ প্রতিনিধিদের পরিবর্তে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পি.আই-এর বিমানযােগে ২৭ বালুচ ও ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের পদাতিক সৈন্যদের ঢাকায় আনয়ন শুরু হয়।২০ ১ মার্চ পর্যন্ত সৈন্য আনার প্রক্রিয়া চলে ।

——————

৭১৬ রাও ফরমান আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮। ৭১৭ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আযম খানের পত্র বিনিময়ের জন্য দেখুন, দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৪০। ৭১৮ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫ এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ২ মে, ২০০১। ৭৯ রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬। ৭২০ সিদ্দিক সালিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৮।

স্থানীয় ৫৭ বিগ্রেডের সঙ্গে এই সৈন্যদের মিশিয়ে ফেলা হয়। একইভাবে সম্ভাব্য ‘্যাকশনের জন্যে সামরিক রসদ আনা অব্যাহত থাকে। মূলত সংকট কাটানাের জন্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্যোগের পাশাপাশি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকেই সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ এগিয়ে চলে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেনারেল “ইয়াকুব ও তার ষ্টাফরা ‘ব্লিৎস’ নামক একটি অপারেশন পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছিলেন । অপারেশন পরিকল্পনা গােপন রাখার চেষ্টা করা হলেও এর শুরুতেই বাঙালি কর্মচারীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষও তা জেনে যায়। ফলে এ পর্যায়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা স্বাধীনতা লাভের জন্য চরমভাবে অধৈর্য হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দের চেয়ে জনগণ, এমনকি যে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলাে ভােটে অংশগ্রহণ করেনি তারাও অধীর হয়ে পড়ে। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রজ্ঞার সঙ্গে ধৈর্যধারণ ও স্বাধীনতা লাভের প্রাসঙ্গিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন। সামরিক শাসন জারির সংবাদ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরে তাজউদ্দীন আহমদ ২২ ফেব্রুয়ারি সলিমুল্লাহ নৈশ কলেজে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতাদানকালে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে বলেন। তিনি জনগণকে ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য অগ্নিশপথের আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৫ ফেব্রুয়ারি এম.এন.এ. এবং এবং এম.পি.এ-দের সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়েও তাজউদ্দীন আহমদ তার এই আশংকার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বলেন যে, রীতি মােতাবেক যেখানে নির্বাচনের পরেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা উচিত ছিল সেখানে কালক্ষেপণ শুভ লক্ষণ বহন করে না। কিন্তু বাঙালিরা এবার এ ধরনের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সামরিক প্রস্তুতি যখন এগিয়ে চলছিল তখন। আওয়ামী লীগ ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান প্রণয়নের কাজে হাত দেয়। তবে তারা এ বিষয়ে নির্বাচনের পরবর্তী মাসগুলােতে ক্রমাগত প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সােবহানের নিমােক্ত বর্ণনা। প্রাসঙ্গিক:৭২৩

নির্বাচনের পরবর্তী মাসগুলােতে সংবিধান নিয়ে আলােচনার জন্যে অনেকগুলাে বৈঠকে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু । এই বৈঠকগুলােতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের

———–

৭২১ ঐ, পৃ. ৫৩। ৭২২ দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। ২৩ রেহমান সােবহান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯০-৯১।

উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমেদ, নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান কিামারুজ্জামান], খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং ড. কামাল হােসেন ছাড়াও ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী, অধ্যাপক সারওয়ার মুরশেদ, অধ্যাপক আনিসুর। রহমান এবং আমি । এই বৈঠকগুলাে সাধারণতঃ অনুষ্ঠিত হত বুড়িগঙ্গা নদীর কাছাকাছি একটি বাড়িতে। প্রায় সারাদিনব্যাপী এসব গভীর আলােচনায় অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক আলােচনা ছাড়াও ড. কামাল হােসেন খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। যা-ই হােক, এদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন শান্ত কিন্তু সহযােগিতার ক্ষেত্রে সৃজনশীল। জটিল টেকনিক্যাল বিষয়গুলাে ধারণ করার ক্ষেত্রে তার ছিল অসাধারণ ক্ষমতা, দ্বান্দ্বিক দক্ষতা এবং গভীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন খুবই সক্রিয় অংশ গ্রহণকারী । তবে আলােচনায় আমাদের যে লাভটি হত তা হচ্ছে তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রখর কমনসেন্স। এক সময় এই দলটি তার আলােচনা এবং চর্চার সমাপ্তি টানল। আওয়ামী লীগ সংবিধানের একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলল এবং তার সমঝােতার অবস্থানও পুরােপুরি তৈরি করে

ফেলল যাতে ভবিষ্যতে প্রয়ােজনে রাজনৈতিক আলােচনায় ব্যবহার করা যায় । বাঙালিদের পক্ষ থেকে প্রণীত উক্ত খসড়া সংবিধানটি বুঝে দেখার ইচ্ছা, ধৈর্য, সময় কোনটিই ইয়াহিয়া খান বা ভুট্টোর ছিল না। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্জন করে তারা বাঙালি জাতিকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে আর একটি ষড়যন্ত্রের জাল। বিস্তার করতে সচেষ্ট হন।

২০৬

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!