You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৭ই ফেব্রুয়ারী, রোববার, ৫ই ফাল্গুন, ১৩৮০

পাকিস্তানের ‘ধীরে চলো’ নীতি

উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ও ভারত দিল্লি চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তান দিল্লি চুক্তি শুধু সম্পাদন করেই খালাস, চুক্তিটি বাস্তবায়িত করে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো রকম কার্যকর তৎপরতা চালাচ্ছে না। বরং লোক বিনিময়ের প্রশ্নে পাকিস্তান ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করছে। পাকিস্তানে সম্ভুক গতির কারণেই বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানিদের প্রত্যাগমন বিলম্বিত হচ্ছে। আটকে পড়া নাগরিকদের সমস্যাকে পাকিস্তান ‘মানবিক সমস্যা’ হিসেবে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সমস্যা আজ অবধি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং গতপরশু বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন যে, পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান মন্থরগতি অবলম্বন করেছে এবং নাগরিক বিনিময়ের প্রশ্নটি পাকিস্তান যদি ‘মানসিক সমস্যা’ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, উপমহাদেশের অস্বস্তিকর আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সরদার শরণ সিং এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেনের মধ্যে বৈঠকের পর গত পরশু এক যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্ত ইস্তেহারে নাগরিক বিনিময় ক্ষেত্রে পাকিস্তানি ‘ধীরে চলো’ নীতির প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে উদ্বেগ। দিল্লি চুক্তি অনুযায়ী এ পর্যন্ত দুই লক্ষাধিক নাগরিককে নিজ নিজ দেশে প্রেরণ করা হয়েছে বলেও যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছে। এবং আশা করা হয়েছে আগামী দু’মাসের মধ্যেই নাগরিক বিনিময়ের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। অবশ্য পাকিস্তান যদি নিজের দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে, তবেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে বলে যুক্ত ইশতেহারে আশা করা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সরদার শরণ সিং সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বীকৃতি দিলেই উপমহাদেশে শান্তি ফিরে আসবে। তিনি বলেছেন, দিল্লি যুক্তির প্রথম পর্যায় লোক বিনিময়। এই লোক বিনিময় কাজ সম্পন্ন হলে অন্যান্য সমস্যা বলিও ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে। তবে, সবার আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি দান করতেই হবে। সরদার শরণ সিং লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে উচ্চারণ করেছেন যে, ওই সম্মেলনে যেন পাকিস্তান উপমহাদেশের অন্যতম দু’টি দেশ ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো রকম বিভ্রান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টির না করেন। কারণ, ওই সম্মেলনে ভারত কিংবা বাংলাদেশ সম্পর্কে নিন্দা করা হলে উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে, সৃষ্টি হবে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখনো অটুট, তাই উপমহাদেশীয় প্রশ্নাবলী উত্থাপন সিমলা চুক্তির বরখেলাপ হতে বাধ্য। সরদার শরণ সিং বলেছেন, ইসলামী সম্মেলনের উদ্দেশ্য আরবদের প্রতি সমর্থন জানানো। ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই আরবদের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে সমর্থন করে এবং প্যালেস্টাইনি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতেও সোচ্চার। কাজেই ইসলামী সম্মেলনের ভারত এবং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে পাকিস্তান যদি কোনরকম হিতাহিত জ্ঞানশূন্য তার পরিচয় দেয় তাহলে তা হবে চরম হঠকারিতা। ভারত এবং বাংলাদেশ আগাগোড়াই উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং এই শান্তির পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অনলস ভূমিকা পালন করে চলেছে। কিন্তু পাকিস্তানের মতিগতির কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। উপমহাদেশের সমস্যার সমাধান কল্পে পাকিস্তানি তৎপরতা বড়ই মন্থর। নাগরিক বিনিময় একটি ‘মানবিক সমস্যা’ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান নিজেদের নাগরিক প্রত্যাগমনের প্রশ্নটি নিদারুণ উদাসীনতার সঙ্গে বিবেচনা করছে। এই উদাসীনতা উপমহাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পরিপন্থী। সময় এখনও অতিক্রান্ত হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মনোভাবকে ইতিমধ্যেই স্বাভাবিক করা দরকার। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তানের কোনো বাঁচোয়া নেই। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ইতিমধ্যেই বিশ্বের ১১৬টি দেশ স্বীকৃতির জয়মাল্য দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। এ অবস্থায়, পাকিস্তানের এক রৈখিকতার অবসান হওয়া একান্ত বাঞ্ছিত। নইলে, উপমা দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা তো হবেই না, বরং পাকিস্তান কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

পরলোকে এনায়েত করীম

মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বার চেতন-অবচেতন মুহূর্তেও যিনি নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা ভুলে যাননি- সেই মানুষটি আর নেই। আত্মীয় পরিজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জনাব এনায়েত করীম গতকাল ৬:২৫ মিনিটে পরলোক গমন করেছেন (ইন্নালিল্লাহি অ-ইন্না-হি- রাজিউন) একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের পর সদ্য স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে প্রয়োজন ছিল একজন অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল ও কর্মঠ কূটনীতিবিদের। জনাব এনায়েত করীম সে দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসেন সানন্দে ও স্বেচ্ছায় এবং তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘনঘন মূর্ছা যাচ্ছেন এমন সঙ্কটময় মুহূর্তেও তিনি অস্ফুট কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর কথা, বলেছেন গণভবনে জরুরি ফাইল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার কথা। এ কর্তব্যনিষ্ঠার তুলনা হয়না। একথা স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের ১১৬টিরও বেশী দেশ স্বীকৃতি জানিয়েছে এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছে তার পেছনে জনাব করীমের অবদানও কম নয়। স্বাধীনতার পর একেবারে শুরু থেকেই তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরটিকে ঢেলে সাজিয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তার চিকিৎসার জন্য কলকাতা থেকে আগত ডাঃ বসু স্বদেশে ফিরে যাবার সময় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছেন যে, অত্যধিক পরিশ্রমই জনাব করীমের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
জনাব করীম আর নেই। তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা জানাবার ভাষা আমাদের নেই। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করার সঙ্গে সঙ্গে একথাই বলবো যে, তার মত কর্তব্যনিষ্ঠ, সৎ ও দেশ প্রেমিক মানুষেই আজ বাংলার ঘরে ঘরে প্রয়োজন।

রপ্তানি বাণিজ্যে নগদ ভর্তুকি প্রসঙ্গে

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি করে যাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায় এবং বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যকেও সচল ও গতিশীল রাখা যায়, সেজন্য সরকার সমস্ত সাবেক রপ্তানি নীতির এক আমূল সংস্কার সাধন করে রপ্তানি খাতে কিছুদিন আগে এক নতুন ধরনের ‘ইন্সেন্টিভ’ এর ব্যবস্থা করেন।
এ ‘ইন্সেন্টিভ’ আর কিছু নয়- রপ্তানিকারককে কিছু নগদ সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়ে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আরো বর্ধিতভাবে আকর্ষিত করা। এতে একদিকে যেমন রপ্তানি বাণিজ্যে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করা বা রপ্তানি বাণিজ্যের স্থায়ী ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হবে অন্যদিকে তেমনি দেশের বহির্বাণিজ্য রপ্তানি বৃদ্ধি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
যে কোন কোন ধরনের রপ্তানির ওপর বা কোন কোন আইটেমের উপরে ভর্তুকি দেওয়া হবে সেই সম্পর্কেও কর্তৃপক্ষ একটি তালিকা দিয়েছিলেন। যেমন আদা, তেঁতুল, পিয়াজ, রসুন ও অনুরূপ বাংলাদেশজাত দ্রব্য। গতবছর ২৭শে জুলাই থেকে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে উল্লেখিত পণ্য বিক্রির জন্য সরকার এ নগদ ভর্তুকি দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
কথা ছিল, বিদেশি আমদানিকারক ঋণপত্র বা এল-সি খুললেই সরকার রপ্তানিকারকদের সরাসরি নগদ ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করবেন।
সাবেক বোনাস ভাউচারের মারপ্যাঁচে জর্জরিত এ দেশের বেসরকারি রপ্তানিকারকেরা সরকারের এমন প্রতিশ্রুতি পেয়ে অনেকটা আশান্বিতও হয়েছিলেন। যে জন্যে সর্বমহলেই সরকারের উদারনীতির যথেষ্টভাবে প্রশংসিতও হয়েছিল।
শুধু তাই নয় সরকারের এই ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পর আমাদের অনেক বেসরকারি রপ্তানিকারকেরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে নির্দিষ্ট ঋণপত্র খোলার পর নির্দিষ্ট বাংলাদেশ জাত দ্রব্য রপ্তানিও করে ফেলেছেন শুধু এই আশায় যে, সরকারের নগদ ভর্তুকি থেকে তারা সামান্য লাভের আস্বাদ পাবেন। কারণ ভর্তুকি দ্বারা উপযুক্তভাবে পরিপূরিত না হলে নাকি এসব রপ্তানির কোনো অর্থই হয় না। কারণ, রপ্তানি করে যে পয়সা পাওয়া যায় তাতে পুঁজি ঠিক থাকে না। এমনকি কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে অবহিত বলে মনে হয়।
অথচ, বিভিন্ন মহল থেকে যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তা শুধু হতাশা ব্যঞ্জকই নয়। দারুণ উদ্বেগজনকও বটে।
যেসব বেসরকারি রপ্তানিকারকেরা সমস্ত নিয়ম প্রতিপালন করে কতৃপক্ষের প্রতিশ্রুতির ভরসায় তাদের পণ্য ইতিমধ্যেই রপ্তানি করে ফেলেছেন, তারা অভিযোগ করছেন যে, অনেক দরখাস্ত আবেদন পত্র দেয়া সত্বেও তারা নাকি তাদের প্রাপ্য ভর্তুকির টাকা পাচ্ছেন না। এতে তাদের নাকি নানা ভাবে দুর্ভোগও পোহাতে হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষ যত্নবান হবেন। আমরা সবাই সার্বিকভাবে সেই আশাই করছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!