বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার, ৩রা ফাল্গুন, ১৩৮০
পনেরোই ফেব্রুয়ারিঃ আমাদের প্রেরণার উৎস
আজ পনেরই ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৪ সাল। কালের চাকা ঘুরতে ঘুরতে বর্ষ পরিক্রমায় পনেরই ফেব্রুয়ারি আজ আবার ফিরে এসেছে। সত্যনিষ্ঠ বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনায় ভাস্বর পনেরই ফেব্রুয়ারি। অজুত প্রাণের আকুতি ভরা অভিব্যক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে আজকের পনেরই ফেব্রুয়ারি। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে নবতর জীবনযাত্রায় দীপ্ত হবার আবাহন আজকের পনেরই ফেব্রুয়ারির। পনেরই ফেব্রুয়ারি এসেছিল ১৯৬৯ সালেও । আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও। সেদিনের শীত শীত সকালে শিশির সিক্ত সোনালী রোদের আবহাওয়া যে পনেরই ফেব্রুয়ারীর জন্ম হয়েছিল বাঙালি জাতি ও জাতীয়তাবাদের সামগ্রিক চেতনায় চিরন্তন প্রেরণার উৎস হিসেবে অবশ্যই বিরাজ করবে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সত্ত্বা অর্জনে রক্ত দানের শুভ উদ্বোধন ঘটেছিল এদিনই।
বর্ষ পরিক্রমায় বিশ্বের সর্বত্র দিনপঞ্জিতে এখন ফেব্রুয়ারি মাস। কিন্তু বাংলাদেশের মতো আর কোথাও এ মাসটা এত ঘটনাবহুল আর তাৎপর্যপূর্ণ মাস বলে বিবেচিত নয়। ফেব্রুয়ারি মাসটাই হচ্ছে এদেশের আত্মদানের আর নবশক্তির মহাউদ্বোধনী মাস। এ মাসের প্রতিদিন প্রতিক্ষণ প্রতিটি বাঙালির ধমনীতে ব্যঙ্গময়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সাল। সারা বাংলাদেশে মুহ্যমান। প্রতিবাদ আর বিদ্রোহী প্রত্যয়ে দীপ্ত। খবর এল নির্মম বন্দিশালায় নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন এক বীর বাঙালি। সার্জেন্ট জহুরুল হক। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আসামি হিসেবে কুর্মিটোলা সামরিক ঘাঁটিতে বন্দি সার্জেন্ট জহুর। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। অজুহাত খাড়া করা হলো তিনি নাকি পালাতে গিয়েছিলেন। বাঙ্গালীদের উপর পাঞ্জাবি প্রভাবিত পাকিস্তানি শাসকদের বর্বর নির্যাতনের আরেক নজির।
কাহিনী এইটুকুই। কিন্তু তার প্রেক্ষাপট এবং পেছনের ইতিহাস আরো ব্যাপক বিরাট বিস্তৃত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক অবৈধ শিশুর জন্মের পর থেকে এই ইতিহাসের শুরু। ইতিহাস তার নব জীবন পেল ১৯৬৬ সালে। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করার পর থেকেই। নতুন জাতির ইতিহাস রচিত হতে লাগলো -তার সাথে সাথে নির্যাতনেরও। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে নির্যাতনের নতুন রূপরেখা নির্ণিত হোল- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আসামী পাকিস্তানি সেনা বাহিনীতে কর্মরত ৩৪ জন বাঙালি জোয়ান। তাদের সাথে যুক্ত হলো আরো একটি নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এবং তিনিই নাকি এই ষড়যন্ত্রের হোতা। মামলার শুনানি শুরু হলো ১৯৬৮ সালের জুন থেকে। শুনানির সাথে সাথে তাহলে বিড়ালগুলো বেরুতে থাকলো। বাংলার মানুষ- বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারলেন কত অসার এ মামলা। এদিকে বর্বর আইয়ুবী শাসনের নিষ্পেষণও দিন কেবল বাড়তেই থাকল। প্রতিবাদ বিদ্রোহ প্রত্যয়ী বাংলার মানুষ। নেতৃত্ব দিলেন ছাত্রসমাজ। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে দুর্বার গণআন্দোলন শুরু হলো। ১৯৬৯ সালের ২৪ শেখ জানুয়ারি ঘটলো অভ্যুত্থান। আইয়ুবের আসন টলটলায়মান। পাকিস্তানি সৈন্যরা পশ্চাদমুখী। ষড়যন্ত্র মামলাও যায় যায়। কিন্তু পাঞ্জাবি চক্রান্ত তাতে ক্ষান্ত নয়। ওরা মামলার আসামিদের সবাইকে হত্যার চক্রান্ত মাতলো। সার্জেন্ট জহুর সেই চক্রান্তেরই বলি।
অবশেষে সার্জেন্ট জহুরের রক্তে কলঙ্কিত আইয়ুব মামলা প্রত্যাহার করল । বাঙালি বুঝলো আর নয়। এবার নিজেদের ভাগ্য নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সার্জেন্ট জহুরের রক্তের সিড়ি বেয়ে বাঙালি এগিয়ে যায় স্বাধীনতার পথে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি আজ স্বাধীন কিন্তু সার্জন জহুরের রক্তদানের মূল্যায়ন সঠিকভাবে আজও হয়নি। তাই আজ বাঙালির নতুন করে শপথ নেবার দিন। দুর্জয় শপথে উপ্ত হবার দিন। আসুন, বায়ান্নো থেকে একাত্তুর পর্যন্ত সার্জেন্ট জহুরের মতো বাঙালি বীরেরা যে জন্য রক্ত দিয়েছেন, তার মর্যাদা রক্ষায় আমরা জাতিগতভাবে নতুন শপথে উদ্দীপ্ত হই।
পাকিস্তানের স্বৈরাচারের সংকট
পাকিস্তানের স্বৈরাচার উৎকট আকার ধারণ করেছে। সরকার বিরোধী বিক্ষোভও ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি চণ্ডনীতির এত ব্যাপক হয়েছে যে, বালুচ গণমুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক হাজারেরও বেশি সৈন্য নিহত অথবা আহত হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর জোয়ান ও অফিসার রয়েছে। বালুচ জনগণের মুক্তি আন্দোলনকে দমনের জন্য ভুট্টো সরকার এদের সেখানে আক্রমনাত্মক অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। ‘পিপলস ফ্রন্টের’ এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে ভুট্টো সরকার বেলুচিস্তানের দমন নির্যাতন চালানোর জন্য ১৫০ কোটি টাকা ও এক লক্ষ গ্যালন পেট্রোল খরচ করেছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে ইরানি হেলিকপ্টার সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে বলেও পত্রিকাটিতে অভিযোগ করা হয়েছে। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অসংখ্য সৈন্য, ইরানের শাবাজ ট্যাংক ও হেলিকপ্টার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর শক্তিকে জোরদার করে চলেছে এবং সম্মিলিত ভাবে বেলুচিস্তানের মুক্তিকামী জনগণের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। সমগ্র বেলুচিস্তান এখন এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বেলুচিস্তানের এই বর্বর নির্যাতন অভিযান পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো সায়েব কুখ্যাত টিক্কা খানকে নিয়োগ করেছেন। এই টিক্কা খানই বাংলাদেশে বর্বর আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ বাঙ্গালীদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বেলুচিস্তানের নিরীহ বালুচদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, হাজার হাজার লোককে আশ্রয়হীন করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আরেকটি বাংলাদেশেরই অবতারণা করেছে। পানি এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বালুচদের উপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে তাতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এতে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আরো দুর্বার হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী শাসক চক্র বালুচদের স্বাধীকার সংগ্রামকে খুব বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করার যৌক্তিক কারণ নেই। পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। বেলুচিস্তানের শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হবে। পাকিস্তানে সম্প্রতি তিনজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো বালুচদের নির্মূল করার জন্য যে ষড়যন্ত্র আঁটছেন, তাতে মদদ যোগাচ্ছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান। ভুট্টা সরকার দশ হাজার বালুচদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলেন তালিকাভুক্ত করেছেন। ফলে বহু বালুচ পরিবার পাকিস্তান ছেড়ে আফগানিস্তানের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ভুট্টো সাহেব শান্তির পথে পা বাড়িয়ে নানা রকম টালবাহানা অব্যাহত রেখেছেন। উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভুট্টো সাহেব ইদানিং যে সকল কূট জাল বিস্তার করেছেন, তাতে অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে এবং এতে পাকিস্তানের সঙ্কট বাড়বে বৈ কমবে না।
বাড়িওয়ালাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য
বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্য ঢাকার ভাড়াটের কাছে আজ এক মর্মান্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাড়াটে উচ্ছেদের নামে বাড়িওয়ালারা যেমন খুশি তেমন আচরণ করছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বারবার লেখা হয়েছে। সরকারের দৃষ্টিও আকর্ষন করার চেষ্টা হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে ভাড়াটেদের জীবনের একটা নিশ্চয়তা দেওয়া আজ কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব। একটি বাড়ি ভাড়া আইন কার্যকর আজ আবশ্যকীয় ব্যাপার। নিত্যদিন ঢাকায় দুই একটি ঘটনা ঘটছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে। ভাড়াটেরা আজ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ ভাড়াটের অনুপুস্থিতিতে বাড়িওয়ালা তার বাড়ির দখল নিয়েছে। প্রায় তিরিশ চল্লিশ জন ভাড়াটে চাকরিজীবী একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস করে বাড়ি করছিল। এবং গত আট দশবছর তারা সেই বাড়িতেই বাস করে আসছিল। ঘটনার দিন চাকরিজীবীরা অফিসে গেলে বাড়িওয়ালা বাড়ির ছাদ ভেঙ্গে ফেলে তাদের উচ্ছেদ করার শেষ পথ অবলম্বন করে। বর্তমানে নাকি ভাড়াটেরা ঐ উন্মুক্ত বাড়িতেই বাস করছে। ভাড়াটে উচ্ছেদের এহেন ন্যক্কারজনক পন্থা ইতিপূর্বে আর শোনা যায়নি। ন্যূনতম মানবিক আচরণের পরিচয়ও বাড়িওয়ালা দেয়নি। সরকারী নীতি পূর্বাপর বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে অস্পষ্ট অথচ এমনতর কাজ কোন অবস্থাতেই আইনের চোখে উপেক্ষণীয় নয় বিষয় নয়। আমরা বহু বার এধরনের ঘটনা ঘটার আশংকা করে সরকারকে সতর্ক হবার আহবান জানিয়েছি। কিন্তু তার কোন ফল আমরা দেখিনি। ভাড়াটেদের জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা কর্তৃপক্ষ দিতে পারেননি এবং আইনের আশ্রয় পাবার কোন গ্যারান্টিও ভাড়াটেরা আজ পর্যন্ত পায়নি। ঊশৃংখল আচরণের সীমা অতিক্রম করে বাড়িওয়ালারা আজ যে কীর্তিকলাপ করছে তারা আশু বন্ধ আমাদের কাম্য। ভাড়াটেরা যদি দেশের নাগরিক হয় তাহলে আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার তাদের ন্যায্য। যদি ভাড়াটেদের পূর্বের দিনের নির্ধারিত ভাড়া বৃদ্ধি করার আবশ্যকতা থাকে তাহলে সেটাও একটা নিয়ম বা আইনের মাধ্যমে হওয়া উচিত। অন্যদিকে ভাড়াটেদের অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের প্রতি দৃষ্টি রাখাও কর্তৃপক্ষের নৈতিক কর্তব্য। অনতিবিলম্বে দেশের ভাড়াটেদের প্রতি বাড়িওয়ালাদের সীমাহীন দৌরাত্ব বন্ধ হোক- এটাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক