বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩রা ডিসেম্বর, সোমবার, ১৭ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
রেল দূর্ঘটনার হিড়িক
একটি নয়। দুটি নয়। পরপর ন’টি রেল দুর্ঘটনা। তাও আবার এক মাসের মধ্যে। বলতে গেলে নভেম্বর মাসটিই ছিল রেল দুর্ঘটনার মাস। রেল দুর্ঘটনার হিড়িক দেখে মনে হয়, রেল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, যে কোন উপায়েই হোক না কেন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়িয়ে বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করবেন। যদি তাই না হবে তবে মাত্র একদিন আগে যমুনা নদীবক্ষে তিনটি রেলের বগী নিমজ্জিত হওয়ার পরদিনই আবার কুমিল্লার নিকটবর্তী স্থানে দু’টো ইঞ্জিনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো কি করে?
সর্বশেষ রেল দুর্ঘটনাটি ঘটে ময়নামতি স্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে বিজয়পুর ব্রিজের কাছে।
সংবাদে প্রকাশ, চট্টগ্রাম মেইল ঢাকা থেকে সাড়ে দশটায় ছাড়ে। শেষ রাতের দিকে ময়নামতি স্টেশন থেকে প্রায় এক মাইল দূরে বিজয়পুর ব্রিজের কাছে এসে মেইলের ইঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দেয়। ইঞ্জিনের ট্যাংকের পানি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় ইঞ্জিনের রেডিয়েটর ফ্যান অচল হয়ে পড়ে। ইঞ্জিনের এই গোলযোগ গাড়ীর চালক ধরতে পারেনি। ট্রেনটি নির্ধারিত সময়ে লালমাই না পৌঁছায় লাকসাম স্টেশন থেকে কোন রকম দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ট্রেনের সন্ধানে একটি উদ্ধারকারী ইঞ্জিন প্রেরণ করা হয়। উদ্ধারকারী ইঞ্জিনটি দ্রুতবেগে লালমাই স্টেশন ছাড়িয়ে যায়। এদিকে ইঞ্জিনের গোলযোগ সারিয়ে মেইল ট্রেনটিও চলতে শুরু করে। আর এরই ফলশ্রুতিতে দুটো ইঞ্জিনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে।
গত ২৩শে নভেম্বর মোবারকগঞ্জ স্টেশনে দুর্ঘটনা, তেজগাঁ রেল স্টেশনে গ্রীন এ্যারোর লাইন থেকে ছিটকে পড়া, রাজবাড়ীর পাতুরিয়া রেল দুর্ঘটনা, আখাউড়ায় লাইট ইঞ্জিন ও প্যাসেঞ্জার ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ ছাড়াও ইতিপূর্বে আরো রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এমনকি রেলওয়ে ইঞ্জিন স্বশরীরে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশের নজিরও রয়েছে। বাংলাদেশের রেল দুর্ঘটনার হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে রেলযাত্রীদের বাড়ি থেকে বেরুবার আগে প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই বেরুতে হবে। কেননা কে যে কখন দুর্ঘটনার কবলে করবেন তা কেউ বলতে পারেন না। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, সিগন্যালিং ও লাইনক্লিয়ারের ত্রুটি বিচ্যুতির জন্যই অধিকাংশ দূর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। সুতরাং কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পর দু’একজন কর্মচারীকে বরখাস্ত করেই এ সমস্যার সমাধান হবে না।
দেশ স্বাধীন হবার পর রেলওয়ে বিভাগে বিশেষতঃ ট্রেন সার্ভিসে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনের তুলনায় ইঞ্জিন ড্রাইভার, স্টেশন মাস্টার বা গার্ডের সংখ্যা অনেক কম থাকাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রাতারাতি অনেককেই প্রমোশন দিয়েছেন। শোনা যায়, অনেকে আবার তদ্বিরের জোরেই চাকরি বাগিয়েছেন। ফলে কারিগরি অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনেকে হয়েছেন ইঞ্জিন ড্রাইভার, কেউ বা গার্ড কেউ বা স্টেশনমাস্টার। তারই ফলশ্রুতিতে ক্লিনার হয়েছেন ড্রাইভার, পয়েন্টসম্যান হয়েছে স্টেশন মাস্টার। অভিজ্ঞতা নামক জিনিসটিকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। আর এমনি রাতারাতি যারা ড্রাইভার হয়েছেন তারা ধুনুতে ঘুমুতে বাড়ি ঘরের মধ্যে ইঞ্জিন চালিয়ে দেয়। নদীতে রেলবগী ফেলে পালিয়ে যায়। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একটা কথা ভুলে গেছেন যে, আনাড়ী বা আনকোরা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অবকাশ ট্রাফিক বিভাগে নেই। অন্য কোথাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালে বড় জোর মালামালের ক্ষতি হতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে যাত্রীদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত।
কথায় বলে কম দুঃখে কাতর অধিক দুঃখে পাথর। রেল দুর্ঘটনার হিড়িক দেখে শেষ পর্যন্ত পাথরে পরিণত হওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ আপাততঃ খোলা নেই বলেই মনে হচ্ছে। যদি তাই না হবে তাহলে একের পর এক রেল দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরও রেল কর্তৃপক্ষ এখনো নিরব কেন? একটা করে দুর্ঘটনা ঘটে দু’চারজন কর্মচারী বরখাস্ত হয়, দুর্ঘটনার তদন্ত চলে, তারপর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে৷ পরিশেষে আমরা বলবো যে, গতানুগতিক কর্মচারী বরখাস্ত, তদন্ত ইত্যাদির পথ অনুসরণ না করে মূল সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। আর এ মূল সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে ট্রাফিক বিভাগটিকে ঢেলে সাজানো ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করার মধ্যে।
প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রকাশ, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় নাকি তামার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। সরকার এই তামা উত্তোলনের ব্যাপারটি বর্তমানে পরীক্ষা করে দেখছেন। প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে যে, বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিকগণ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোর খনিজ সম্পদ উত্তোলণের জন্যে ব্যাপক জরিপ চালিয়ে এ খনিগুলোর সন্ধান পেয়েছেন। তাদের মতে মাটির নিচে প্রায় দুশো ফিট তলাতেই তামার খনি রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জেনেছিলাম যে, বগুড়া ও তদাঞ্চলের কয়লার খনি রয়েছে এবং তা উত্তোলনের জন্যে সরকার ব্যাপক জরিপ চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে খনির অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভূতাত্ত্বিকদের অভিমত যদি সত্যি হয় তাহলে তা উত্তোলনের জন্যে সরকারের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে যদি আমরা যথাযথ কাজে লাগাতে সক্ষম হই তাহলে গোটা জাতির কল্যাণ অবধারিত। বিশেষ করে কয়লা এবং তামার খনির মতো মূল্যবান খনি যার সঙ্গে আরো অন্যান্য সম্পদও পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা উত্তোলন করে জাতির কল্যাণের জন্যে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে বেশী তৎপর হওয়া আবশ্যক। খনিজ সম্পদের দিক থেকে আমরা বোধ হয় মোটেই পিছপা নই- শুধু পরিপূর্ণ জরিপ ও উত্তোলনের কাজ সমাধা করা এখন আবশ্যক।
আমাদের কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদই দেশের মূল অর্থনীতির কাঠামো। কৃষি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারও অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রকৃতির দানকে যদি এ জাতি গ্রহণ করতে অক্ষম হয় তাহলে গোটা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সরকার অবশ্যই ভবিষ্যৎ জাতি গড়ার প্রয়োজনীয়তায় সকল সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করবেন। তামার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে এটা জাতির জন্যে একটি সুখবর। এই আবিষ্কৃত খনির জরিপ কাজ অবিলম্বে সমাধা করে উত্তোলনের প্রয়োজনীয়তার উপর সরকার গুরুত্ব আরোপ করবেন বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক