You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.05 | জনসংঘ চান স্বাধীন বাংলাদেশ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

জনসংঘ চান স্বাধীন বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের সনােভাবের কঠোর সমালােচনা করেছেন জনসংঘ। তাদের ধারণা, পূর্ববাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না এলে শরণার্থীরা যেতে পারবেন না বাড়ীঘরে। এই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদান এবং মুক্তিফৌজকে সবরকমের সাহায্য করা। এর জন্য যদি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হয়, তাও নেওয়া উচিত। অযথা সময় নষ্ট করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। তারা যদি আগেই মনঃস্থির করতে পারতেন তবে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব হয়ে উঠত। এত শরণার্থীর সমাবেশ ঘটত না ভারতে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং বারবার বলছেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলাে এগিয়ে না এলে। নিজস্ব পথ বেছে নেবে ভারত। বাইরের কোন রাষ্ট্র এগিয়ে আসেনি। ইয়াহিয়া খান তার আটাশে জুনের বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সমাধানের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। ভারতের নিজস্ব পথ নেবার সময় এসে গেছে। কিন্তু নয়াদিল্লী দিচ্ছেন না কোন পথের ইঙ্গিত। তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন মৌল প্রশ্নের প্রত্যাশিত উত্তর। ফলে জনসাধারণের মনে জমে উঠছে নিদারুণ নৈরাশ্য। কেন্দ্রীয় সরকারের কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না কেউ।
ভারতে আগত শরণার্থীদের অবস্থানের মেয়াদ ছ’মাস। প্রধানমন্ত্রী নিজেই দিয়েছেন এই মেয়াদ। অবস্থা যা। দাঁড়াচ্ছে তাতে ছ’মাস কেন ছ’ বছরেও সমস্যার সমাধান হবে কিনা সন্দেহ। শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করতে পারেন একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার। অন্যান্য রাষ্ট্রের মুখ চেয়ে বসে থাকা অর্থহীন। ইয়াহিয়ার উপর প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে নারাজ। এমনকি শরণার্থীদের জন্য তাদের দানও অকিঞ্চিৎকর। প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন একথা। বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন কার্যকর সিদ্ধান্ত নেই নয়াদিল্লীর। তাঁরা শূন্যে ভাসছেন। যত দিন যাবে সমস্যা তত ঘােরাল হয়ে উঠবে। এর সম্ভাব্য পরিণতি ভয়াবহ এবং যুদ্ধের চেয়েও সাংঘাতিক। অবস্থার যে মূল্যায়ন করেছেন জনসঙ্ঘ তার সঙ্গে জাতির বৃহত্তম অংশ একমত। সর্বোদয় নেনা শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণও কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী। বিশ্বপরিক্রমা করে ফিরেছেন তিনি। তাঁর মতামতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মনেপ্রাণে তিনি যুদ্ধবিরােধী। শ্রীনারায়ণ চান অবিলম্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি। তার জন্য এই যুদ্ধবিরােধী নেতা যুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত। বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং সমরসম্ভার দিলেই যুদ্ধ লেগে যাবে—এ ধারণা সত্যি নাও হতে পারে। ডি ফ্যাকটো স্বীকৃতিতে দোষ নেই। তাতে প্রয়ােজন মিটবে এবং বাধ্যবাধকতা থাকবেও কম। আমেরিক, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ যদি বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে অস্ত্র জোগাতে পারে, তবে গণহত্যা বন্ধের জন্য ভারত মুক্তিফৌজকে অস্ত্র দিতে পারবে না কেন? বিশেষ করে, শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে হবে বাংলাদেশে। মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামীল লীগের সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত না হলে এ সম্ভব নয়। নয়াদিল্লীর সামনে অন্য কেন পথ খােলা নেই। তাদের টালবাহানা অসহনীয় এবং আত্মহত্যার সামিল।
জনসঙ্ঘ নিঃসন্দেহে সমস্যার গােড়ায় হাত দিয়েছেন। সীমান্ত অঞ্চল থেকে শরণার্থীদের সরিয়ে নেবার যৌক্তিকতা জনসঙ্ঘের নেতারা স্বীকার করেননি। এখানে তারা বাস্তববােধ হারিয়ে ফেলেছেন। ষাট সত্তর লক্ষ শরণার্থী থাকতে পারেন না পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসাম এবং মেঘালয়ে। এ অঞ্চলে তাদের স্থান সঙ্কুলান অসম্ভব। জনসঙ্ঘের দাবী মেনে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যদি বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেন এবং মুক্তিফৌজকে সামরিক সাহায্য করতে থাকেন তবে লড়াই বাধতে পারে। এ ঝুঁকির সম্ভাবনা জনসঙ্ উড়িয়ে দেননি। এতগুলাে শরণার্থীকে সীমান্তে রেখে লড়াই-এ নামার অথ নরমেধ যজ্ঞের অবতারণা। এই শরণার্থীরাই হবেন পাক সৈন্যদের কামানের বলি। ভারত তখন কোনদিক থেকে সামলাবে? শরণার্থীদের আগলাবে, না পাক-চমুর মােকাবিলা করবে? একথা নিশ্চিত, শরণার্থীরা অদূর ভবিষ্যতে ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। লড়াই বাধলে দু-চার মাসের মধ্যে তা শেষ হবে—এমন ভবিষ্যদ্বাণী কেউ করতে পারেন না। যুদ্ধের মত শরণার্থী সমস্যাও জাতীয় সমস্যা। এর বােঝা যত সাময়িকই হােক না কেন, ভাগাভাগি করে নিতে হবে প্রত্যেকটি রাজ্যকে। বাংলাদেশ থেকে পাক-সৈন্যদলের সমূল উচ্ছেদের পর আসবে শরণার্থীদের ফেরত পাঠাবার প্রশ্ন। পূর্বাঞ্চলের বাইরে তাদের সাময়িক আবাস তৈরী হলেও অসুবিধার কিছু নেই। অল্প সময়ের নােটিশে ওদের ফেরত পাঠানাে খুবই সম্বব। বাংলাদেশ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের মনােভাবের কঠোর সমালােচনা অবশ্যই সময়ােপযােগী। কর্তৃপক্ষের ওটা পাওনা। জনসংঘ প্রকৃতপক্ষে জনমতেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। কিন্তু অন্য রাজ্যে শরণার্থী পাঠাতে তাদের অস্বীকৃতি অদূরদর্শিতা। তাতে রয়েছে সামগ্রিক দায়িত্ব এড়াবার উৎকট প্রচেষ্টা। এ মনােভাব ভারতের হাত সবল করবে না, আনবে দুর্বলতা। ফলে লাভবান হবে পাকিস্তান।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ জুলাই ১৯৭১