You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দীক্ষা ও সমাজচেতনা - সংগ্রামের নোটবুক

তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দীক্ষা ও সমাজচেতনা

তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দীক্ষা

প্রেক্ষিত বিচারে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি অন্যসাধারণ ঘটনা। প্রাচীন এই অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেকাংশে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক যুগে বাংলার সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে বারংবার। ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হয়েও ভৌগােলিক কারণে বাংলা বরাবরই ছিল বিচ্ছিন্নপ্রবণ কিংবা স্বাধীনচেতা প্রকৃতির। বাংলাদেশের আজকের যে মানচিত্র তার উৎপত্তি র্যাডক্লিক সীমানা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে। তবে অতীতে ভারতের যে অঞ্চলগুলাের সঙ্গে এর রাজনৈতিক নৈকট্য কিংবা সংযােগ ছিল সেগুলাের সাথে এই জনপদের কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সাদৃশ্য ন্যূনতম হলেও ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে যে অঞ্চলের সাথে যুক্ত করে একটি অভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামাের অধীনে আনয়ন করা হয়। তার সাথে বাংলার একমাত্র ধর্মীয় সাদৃশ্য ছাড়া আর কোনাে মিল ছিল না। কখনাে কখনাে জাতি গঠনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও শুধুমাত্র তার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক জাতি গঠিত হতে পারে না। তদুপরি অঞ্চল দুটোর মধ্যে ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতাও একক রাষ্ট্রকাঠামাের অনুকূলে ছিল না। বস্তুত দুটো ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলা প্রকৃত অর্থে ব্রিটিশের পরিবর্তে আর একটি ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড়ে বাধা পড়ে। ফলে পাকিস্তানের জন্মক্ষণ থেকেই বিরােধ দেখা দেয়। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে এতদঞ্চলের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। তখন থেকেই আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাচেতনা এখানে প্রবেশ করে। ফলে একটা ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত হয়েই ছিল অলক্ষে । কিন্তু সেটা একটি স্পষ্ট, অবয়ব পেতে বেশি সময় লাগেনি মূলত

অবাঙালি শাসকগােষ্ঠীর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপের কারণে । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে। পাকিস্তানের জন্মের পূর্বে ও পরে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান প্রমুখ। নেতা জনজাগরণ সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু আধুনিক ধ্যান-ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্র প্রস্ততকরণে এদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কতিপয় সহকর্মীর অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। তবে এর জন্মক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শী ও বিচক্ষণতাপূর্ণ নেতৃত্বদানের বিষয়টি বিশেষভাবে মূল্যায়নের দাবি রাখে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বিরূপ পরিবেশে যুদ্ধরত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রেখে রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার বিরল গৌরব তার প্রাপ্য।

তাজউদ্দীন আহমদের পূর্বপুরুষ খান ফখরুদ্দীন শাহ ওরফে ফকির শাহ চতুর্দশ শতকের গােড়ার দিকে দিল্লি থেকে পূর্ব বাংলায় এসে ময়মনসিংহের নিগুয়ারিতে বসতি স্থাপন করেন। তার ষষ্ঠ উত্তরপুরুষ ইব্রাহিম খান প্রাক্তন ঢাকা জেলার (বর্তমানে গাজীপুর জেলা) অন্তর্গত কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে এসে বসতি গড়ে তােলেন। এলাকায় অচিরেই এটি একটি সম্রান্ত মুসলিম পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইব্রাহিম খানের পুত্র মৌলভী মােহাম্মদ ইয়াসিন খানের ঘরে মাতা মেহেরুন্নেসা খানমের গর্ভে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন আরবি-ফারসি ভাষায় শিক্ষিত কৃষিভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সমসাময়িক মুসলিম সমাজের যুগ-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিবারটির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ ধরনের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করলেও স্বপ্রণােদনায় নিজেকে গড়ে তােলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। তার মধ্যে বিস্ময়কর রকমের জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক চেতনা এবং অপূর্ব সাংগঠনিক প্রতিভার সমন্বয় ঘটে। তার মানবীয় গুণাবলি, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতাবােধ, সর্বক্ষেত্রে নিয়মনিষ্ঠ জীবনাচার, সর্বোপরি ‘মেথােডিক্যাল রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড তার সম্পর্কে শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় উদ্রেক করে। বস্তুতপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষকাল হতে শুরু করে বাংলাদেশের

————————-

১. সাক্ষাৎকার, সিমিন হােসেন রিমি । ২ আতিউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন (ঢাকা সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭), পৃ. ১১৬।

———————-

অভ্যুদয় পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের তিনি একজন কেন্দ্রীয় সংগঠক ও তাত্ত্বিক নেতা। তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং এর অন্যতম স্থপতি । তাই তিনি যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করে গড়ে ওঠেন। সে সম্পর্কে সম্যক আলােকপাত প্রাসঙ্গিক বিষয়। | তাজউদ্দীন আহমদের জন্মের কিছুকাল পূর্বে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তির মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে সংগঠিতভাবে জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ক্রমশ ব্রিটিশ শাসনবিরােধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে বিকাশমান জাতীয়তাবাদী এই চেতনাকে দুর্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে রাজনৈতিক দূরভিসন্ধিমূলক ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯০৫ সালে ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামক একটি নতুন প্রদেশ গঠন করে। নব্যসৃষ্ট প্রদেশের মুসলমানেরা হিন্দু জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। অন্যদিকে পূর্বতন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অবশিষ্টাংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যগণ মুসলমানদের তুলনায় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমতাবস্থায় দুই বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম সংখ্যালঘিষ্ঠের একটা স্বার্থ-সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। অবিভক্ত বাংলায় বহুকাল ধরে কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার মানুষ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। তাই ১৯০৫ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন প্রদেশের কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে অল্প পরিমাণে হলেও আশার সঞ্চার হয়। কেননা তারা উপলব্ধি করে যে, নতুন প্রদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে কলকারখানা, কোর্ট-কাচারি, বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ফলে পূর্ব বাংলা একদিকে যেমন কলকাতার মুখাপেক্ষী থাকবে না তেমনি এই এলাকার অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু ব্রিটিশের ‘বিভাজন ও শাসন নীতি’র দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরে কংগ্রেস অনতিবিলম্বে ভারতব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলে। আন্দোলনের চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গবিভাগ রদ করতে বাধ্য হয়। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে সদ্য-জাগ্রত আশা হতাশায় পরিণত হয়। বঙ্গবিভাগ রদজনিত এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্যে (বলা যেতে পারে, পূর্ব বাংলার অনুগত মুসলিম নেতাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে) ১৯২১ সালে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ফলে অনুন্নত এ অঞ্চলটির পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের

————————

ড. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৫৮’, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ১৯৪৭-১৯৭১ (ঢাকা আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯), পৃ. ১৮।

—–

মধ্যেও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে একটি নতুন মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর অল্পকাল পরে ১৯৪০ সাল নাগাদ দ্বিজাতি তত্ত্বের (twonation theory) ভিত্তিতে ভারতের মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের ধ্যান-ধারণা তাদের চেতনাকে আবিষ্ট করে। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এর একটা। প্রভাব পড়ে। ভারতীয় রাজনীতিতে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে যখন এ ধরনের মেরুকরণ ‘চলছিল তখন মুসলিম সাহিত্য সমাজ” (১৯২৭-১৯৩৬) কর্তৃক প্রকাশিত শিখা নামক একখানি বার্ষিক বাংলা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার জন্ম হয়। ১৯২৭ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাখানি পর পর ৫ টি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ, আবুল হুসেন, আবদুল কাদির, আবদুল হক, আবুল ফজল, আবদুল ওদুদ, কাজী মােতাহার হােসেন, আনওয়ারুল কাদিরসহ আরাে অনেকেই এই গােষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন। পত্রিকার মর্মবাণী ফুটে উঠতাে প্রতিসংখ্যায় প্রথম পাতায় মুদ্রিত একটি তত্ত্ব কথার মধ্য দিয়ে-“জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”ই বুদ্ধি মুক্তির চর্চা’য় অল্প সময়ের মধ্যে এই গােষ্ঠীটি আলােকদীপ্ত এক নতুন জোয়ারের সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে পূর্ব বাংলায় ধীরে ধীরে একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে। ওঠে। তাজউদ্দীন আহমদ শিখাগােষ্ঠীর আলােয় উদ্ভাসিত উদার দৃষ্টিসম্পন্ন সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলেন। এই সময়ে গড়ে ওঠা তার মতাে মুক্তবুদ্ধির তরুণরাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সােপান রচনাকারী ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তীকালের সকল গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।” | তৎকালীন গ্রাম-বাংলার রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সদস্য হিসেবে ৬-৭ বছর বয়সে তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষা জীবনের শুরু হয় পারিবারিক

————————

৪. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (সম্পা.) শিখা সমগ্র (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০২-২০০৩), প্রথম ফ্ল্যাপ।

৫.ঐ.পৃ ৭

৬. শামসুজ্জামান খান, “বিংশ শতাব্দীতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ ও বাংলাদেশের। উত্থান’, প্রথম আলাে, ঈদসংখ্যা, ২০০৩, পৃ. ১২৫। . আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৭।

৮.ঐ

—-

পরিচালনায় গ্রামের মক্তবে। এই মক্তবে তিনি বছরখানেক লেখাপড়া করেন। তাজউদ্দীন আহমদের স্কুলের পাঠ্য একটি বিষয় ছিল আরবি । তিনি স্কুল জীবনের বিভিন্ন সময়ে পড়াশােনা করতে গিয়ে বাংলা ইংরেজির মতােই আরবি ভাষাতেও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন এবং এই সময়টাতেই মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান শরীফ মুখস্থ করে হাফিজ পর্যায়ে উন্নীত হন। তার লিখিত ডায়েরি হতে জানা যায় মাঝেমধ্যে তিনি জুম্মার নামাজে ইমামতি করতেন। স্কুলের সাধারণ পড়াশােনার প্রতি তার গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করে পিতা তাকে বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরবর্তী ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান । অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি শিক্ষকদের নজর কাড়েন । এখানে তিনি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর ভর্তি হন স্বীয় গ্রাম দরদরিয়া থেকে পাঁচ মাইল দূরবর্তী কাপাসিয়া এম.ই. স্কুলে। এটি ছিল ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল । রক্ষণশীল মুসলিম সমাজের গ্রাম-প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ছেলের অতি আগ্রহের কারণে পিতা তাকে বিজাতীয় এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেন। একজন আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ ঐ স্কুলে লেখাপড়া করতেন। থানা সদরে অবস্থিত এই স্কুলে অধ্যয়নকালে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এ সময় তিনজন ব্রিটিশবিরােধী বিপ্লবী রাজবন্দি কাপাসিয়া থানার হেফাজতে ছিলেন। ঘটনাচক্রে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদের । প্রেক্ষিত বিচারে একজন মুসলিম বালকের মধ্যে অসাধারণ মেধা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় পেয়ে তারা তার প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর তাদের সংস্রব ও সহযােগিতায় অতি অল্প বয়সে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগােল, রাজনীতি, মনীষীদের জীবনী প্রভৃতি বিষয়ে বেশ কিছুসংখ্যক পুস্তক অধ্যয়নের সুযােগ লাভ করেন। এভাবেই অলক্ষ্যে

———————

৯.*, মক্তব হচ্ছে বাংলাদেশের মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য ধর্মবিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে সাধারণত আরবি অক্ষরজ্ঞান, কোরান ও হাদিস সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া হয়। ১০. তাজউদ্দীন আহমদের বড় বােন সুফিয়া খানমের সাক্ষাৎকার, ৬ নভেম্বর, ১৯৯০। এই গবেষণা কাজে ২০০০ সালের পূর্বে গৃহীত যেসব সাক্ষাৎকার রেফারেন্স হিসেবে। ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলাের সবই তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমির নিকট থেকে সংগৃহিত। * মুসলমান সম্প্রদায় শুক্রবারে সাপ্তাহিক যে প্রার্থনায় মিলিত হয় তাকে জুম্মার নামাজ বলে এবং যিনি নামাজ পড়ান তাকে ঈমাম বলে। ১২. আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৬।

  • বড়বােনের শ্বশুর বাড়ি। সুফিয়া খানমের সাক্ষাত্তার, ৬ নভেম্বর, ১৯৯০। ১৮ জয় বাংলা, মুজিবনগর ৪র্থ সংখ্যা, ২ জুন ১৯৭১।

১০

পরবর্তীকালের ‘সােস্যাল ডেমােক্র্যাট’ তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক দর্শনের | সােপান রচিত হয়। তাজউদ্দীনের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার বিচ্ছুরণ লক্ষ্য করে ঐ বিপ্লবীরা ভবিষ্যতে তাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসার পরামর্শ দেন। | প্রতিভার বিকাশ ও নেতৃত্বদানে উপযােগী হয়ে গড়ে ওঠার জন্য তারা তাকে। আরাে উন্নত স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেন। ফলে তাজউদ্দীন আহমদ অতঃপর ভর্তি হন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে। এটি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি স্কুল । তবে নজরবন্দি ঐ বিপ্লবীদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের শেষ সাক্ষাৎ হয় নি। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, অন্তরীণাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে তারা তাজউদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তার আবাসস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে ফুটবল প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণের জন্য অবস্থান করছিলেন বিধায় তার প্রাথমিক জীবনের দীক্ষাগুরুদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাটুকু হয়নি। বাড়ি ফিরে তিনি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তাদের রেখে যাওয়া গােলাপগুচ্ছ পেয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের হৃদয়ে রয়ে যায় তাদের শােষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান । এভাবেই বালক তাজউদ্দীন আহমদের জীবনপ্রত্যুষেই দৈবক্রমে বিপ্লবী রাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষা ঘটে এবং তার রাজনৈতিক জীবনে এর গভীরতর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । তাজউদ্দীন আহমদ অপেক্ষাকৃত উন্নততর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধানে এরপরও দুবার স্কুল পরিবর্তন করেন। নিকোলাস ইনস্টিটিউশনের শিক্ষকগণও তার মেধা ও প্রতিভায় অভিভূত হন। এতদসত্ত্বেও ১৯৪১ সালে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন ঢাকা মুসলিম বয়েজ হাই স্কুলে। এখানেও তিনি শিক্ষক-সহপাঠীদের মনােযােগ আকর্ষণ করেন। তাজউদ্দীনের ডাফরিন হােস্টেলের রুমমেট ও সহপাঠী মাে. ওয়াহিদুজ্জামান চমকপ্রদ স্মৃতিচারণ করেন এইভাবে: পড়াশােনায় সে ছিল এক্সট্রাঅর্ডিনারিলি ব্রিলিয়ান্ট। তার ছিল প্রখর স্মরণশক্তি। তার যা পড়াশােনা সে তা ক্লাসেই করে আসত। …আমি আমার এই জীবনে এমন মেধাসম্পন্ন জ্ঞানী ছাত্র আর দেখিনি। একবারের বেশি কোনাে বই পড়তে হয় নি। তার। শুধু একবার চোখ বুলালেই বুঝে ফেলত সব। স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক তাকে পছন্দ করতেন। মনে আছে, ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে আমাদের স্কুল থেকে আমরা আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং দেখতে গেলাম।

————-

১৫.ঐ

১৬ মাে. ওয়াহিদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার, ৩ এপ্রিল, ১৯৯১। ওয়াহিদুজ্জামান তাজউদ্দীন আহমদের স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠি।

——-

(বর্তমানে বুয়েট)। ফিরে আসার পর সুপারিনটেন্ডেন্ট স্যার বললেন, “তােমরা আজ। যা দেখে এলে সেই বিষয়ে কিছু লিখে আমাকে দেখাও। আমরা সবাই ইংরেজিতে। লিখলাম । তাজউদ্দীন ইংরেজিতে যা লিখল তা পড়ে স্যার বললেন, ইংরেজিতে। এম.এ পাস করে কোনাে শিক্ষকও এমন লিখতে পারবেন কিনা ভাবতে হবে। আমরা সবাই তার ওই লেখাটা পড়লাম। আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের সাথে বাংলা, ইংরেজি, অংক, এ সমস্ত নানা বিষয় নিয়ে তাজউদ্দীনের তর্ক হত । শিক্ষকরা তার

সম্পর্কে বলতেন অদ্ভুত রকমের মেরিটোরিয়াস ছেলে । একই সূত্র হতে জানা যায়, হােস্টেলের কঠোর নিয়ম-কানুন তাজউদ্দীন। আহমদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। এমনকি কঠোর প্রকৃতির হােস্টেল সুপার। আম্বর আলী মাঝেমধ্যে হলে কোনাে ভালাে ইংরেজি সিনেমা এলে তাজউদ্দীনকে। তা দেখে আসার জন্য বলতেন। স্কুলের উচ্চ শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি কখনাে কখনাে কোর্টে গিয়ে বাদীবিবাদী পক্ষের উকিলদের জেরা করা এবং বিচারকের রায় প্রদানের যুক্তিগুলাে। শুনতেন। হােস্টেলের কক্ষে ফিরে এসে সহপাঠী ও সমমনা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে। এসব বিষয়ে আলােচনা-সমালােচনা করতেন। এক পর্যায়ে তিনি আইনজীবী। হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ঢাকা বয়েজ স্কুলের এমন অন্তরঙ্গ পবিবেশ ও ঈর্ষণীয় সুযােগ সুবিধা পাওয়া। সত্ত্বেও কোনাে কোনাে শিক্ষকের যুক্তিহীন আচরণ তাকে ক্ষুব্ধ করে। তাই নিজে। উদ্যোগী হয়ে ঐ স্কুল ত্যাগ করে সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলে ভর্তি হন। এখান। থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এবং কলকাতা শিক্ষা বাের্ডে প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের। পরিচয় দেন। তার প্রখর মেধার পরিচয় পাওয়া যায় ইতােপূর্বেই এম, ই। স্কলারশীপ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করলে। তাজউদ্দীন। আহমদ মানবতার সেবায় নিবেদিত স্কাউটিং-এর সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন। এদিকে । স্কুলের ছাত্র থাকাকালে ১৯৪২-১৯৪৩ সাল থেকেই তিনি মুসলিম লীগের ঢাকাস্থ । কলতাবাজারের অফিসে যাওয়া-আসা শুরু করেন। তখন থেকেই দেশ ও দেশের। মানুষের সার্বিক মুক্তির বিষয়ে তার চেতনার জগৎ পরিপুষ্ট হতে শুরু করে । সে। কারণেই সম্ভবত ব্যক্তিগত জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের তােয়াক্কা না করে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পরই তিনি রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে। যােগদান করেন। ব্রিটিশবিরােধী উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে সমাজ ও রাজনীতি

———–

১৭ ঐ।

১৮.ঐ

————-

সচেতন তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও অন্যদের সঙ্গে নিয়ে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সামন্তবাদী আহসান মঞ্জিলস্থ খাজা পরিবারের কর্তৃত্বলােপ করতে সচেষ্ট হন। পিতার ইচ্ছা পূরণ করতে না পারায় তিনি অনুতপ্ত বলে ডায়েরিতে লিখে রাখেন। এর অল্পকাল পরে পিতার মৃত্যু হলে তার মধ্যে এ অনুশােচনাবােধ সাময়িকভাবে জাগ্রত হয়। কিন্তু কোন্ ইচ্ছার কথা লিখেছেন তা। স্পষ্ট নয়। সম্ভবত তার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা পিতার কাম্য ছিল না। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ১৯৪৭ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের কাউন্সিলর হিসেবে কয়েকজন সহরাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে কলকাতা ও দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যােগদান করতে যান। এ সময় এক ফাকে তিনি হযরত নিজামুদ্দীন আওলিয়ার দরগাহ পরিদর্শন করেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এ সময় বাংলার ছাত্র সমাজ বিদ্রোহ করেছিল । তাজউদ্দীন আহমদও এই শিক্ষাবর্জন আন্দোলনে যুক্ত হন। এক বছর শিক্ষাবর্জন আন্দোলনে যুক্ত থাকার পর পরবর্তী বছর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। এর কিছুদিন পর ঢাকা কলেজে চলে যান। তবে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে যুক্ত রাখার কারণে সময়মতাে পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন । তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন মূলত ঢাকা তথা পূর্ব-বাংলায় মুসলিম লীগ রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত উদার ধারা সৃষ্টির লক্ষ্যে। ঢাকাতে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক অফিস ও সংগঠন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। চারজন সার্বক্ষণিক কর্মী-উদ্যোক্তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম ও সর্বকনিষ্ঠ । সবচেয়ে বয়ােজ্যেষ্ঠ ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন আরমানিটোলা স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক কামরুদ্দীন আহমদ (১৯১২-১৯৮২ খ্রি.)। তিনি ছিলেন ঢাকায় উদারপন্থী আন্দোলনের পুরােধাস্থানীয় । তিনি চাকরিরত থাকার কারণে কর্মী বাহিনীকে পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন টাঙ্গাইলের বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ শামসুল হক।

——————-

১৯ ডা. এম.এ. করিমের সাক্ষাত্তার, ১৯৯০। ডা. এম.এ. করিম তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম সহকর্মী। ২৭ সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং মুক্তিযুদ্ধ (ঢাকা প্রতিভাস, ২০০১), পৃ. ২৫৮। ২১” ঐতিহাসিক এসব ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যুসন যথাসম্ভব উল্লেখ করা হবে।

কামরুদ্দীন আহমদের নিজের লেখা হতে এ সময়ের কর্মকাণ্ড এবং তাজউদ্দীন আহমদের কর্মস্পৃহা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়: আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস গঠন করা হলাে ১লা এপ্রিল ১৯৪৪ সালে ঢাকায় ১৫০ নং চক মােগলটুলিতে। সর্বক্ষণের কর্মীদের মধ্যে। ছিলেন চারজন- শামসুল হক, শামসুদ্দীন, তাজুদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ শওকত আলী। এরপর মােহাম্মদ মােহসীনের নিকট থেকে হুশিয়ার সাপ্তাহিক কাগজ কিনে নিয়ে বহুদিন পার্টির পত্রিকা হিসেবে পরিচালনা করবার দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছিলাম তাজুদ্দীন আহমদের কাছ থেকে। চিরদিনই সে নিজেকে পশ্চাতে রাখতে অভ্যস্ত ছিল বলে তার কর্মদক্ষতার কথা অনেকের নিকট জানা ছিল না। সে ছিল অনেকটা নীরব কর্মী। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সবচেয়ে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন কামরুদ্দীন আহমদ। অন্যদিকে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে যে কয়েকজনের নাম ঘুরে ফিরে এসেছে, তার মধ্যে তিনি অন্যতম। তাজউদ্দীন আহমদ সবচেয়ে প্রবীণ ও নেতৃস্থানীয় কামরুদ্দীন আহমদের অনেকটা সচিব হিসেবে কাজ করতেন। তাদের মধ্যে সম্পর্কের একান্ত ঘনিষ্ঠতা অন্ততপক্ষে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল—উভয়পক্ষের সূত্র হতেই এর সমর্থন মেলে। প্রগতিশীল আদর্শে দীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগের মতাে একটি পশ্চাদপদ ভাবাদর্শসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ যুক্ত হওয়ার কারণ কি? এর জবাব খুঁজতে গিয়ে সে সময়ের পূর্ববঙ্গীয় রাজনীতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায়। এ বিষয়ে স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালে জয় বাংলা পত্রিকাকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে নিলিখিত স্মৃতিচারণ করেন:২৩ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে এবং পরে ঢাকার পাকিস্তান ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আবুল হাশিম মুসলিম লীগকে ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে আনার আহ্বান জানালেন, কেবল তখনই আমি মুসলিম লীগ রাজনীতির একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই জনাব শামসুল হকের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে ইসলামপুরের একটি ছােট ঘরের ছাদে চালু করেছিলাম মুসলিম লীগ সংগঠনের

——————

২২, কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা ইনসাইড লাইব্রেরী, ১৩৮২ বঙ্গাব্দ), পৃ. ২৬-২৭। ২৩ জয় বাংলা, ৪র্থ সংখ্যা, ২ জুন ১৯৭১।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে সাধারণ মানুষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি বিচার করলে তাজউদ্দীন আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের এই সংকল্প অগ্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। কারণ পূর্ব বাংলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন পর্যন্ত তেমন কোনাে রাজনৈতিক বােধেরই সৃষ্টি হয়নি। রাজনীতি তখন পর্যন্ত কেবল মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বিত্তবান ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোথাও কোথাও কমিউনিস্ট সদস্যদের গােপন তৎপরতা থাকলেও সাধারণ মানুষের তাতে তেমন সম্পৃক্তি লক্ষ্য করা যায় না। প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল বলতে ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। তবে প্রাদেশিক পর্যায়ে দল দুটোর পূর্ব বাংলায় তেমন উল্লেখযােগ্য সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না বললেই চলে। বঙ্গ বিভাগের পর থেকে ব্রিটিশ সরকার মুসলিম তােষণনীতির অংশ হিসেবে ঢাকার অবাঙালি সামন্তস্থানীয় নবাব পরিবারকে বশে রাখার চেষ্টা করতাে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার নবাব পরিবারই হয়ে ওঠে মুসলিম লীগ রাজনীতি চর্চার মূল কেন্দ্র। এ ধরনের পরিস্থিতিতে খাজাদের কবল থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করে সাধারণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে পরিণত করতে চাওয়ার মধ্যে একটা বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। বস্তুত তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগ সংগঠনকে ব্রিটিশের পদলেহী খাজাদের সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতেন। তাই বলা যেতে পারে, তিনি ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন । আর সেটা সম্ভব হয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের (১৯০৫-১৯৭৪) অপেক্ষাকৃত উদার চিন্তাধারার কারণে। তাদের প্রত্যয় জন্মে যে, সামন্তবাদী খাজাদের নিকট থেকে মধ্যবিত্তের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা যেতে পারে কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে এবং সেটা করা সম্ভব তাদের মধ্যে থেকে। সুতরাং তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পেছনে ছিল কায়েমি স্বার্থের অবসান ঘটিয়ে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ন্যায় একটি মহৎ সংকল্প । তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবন পর্যালােচনা করলে দেখা যায় তিনি কোনাে অবস্থাতেই তার এই আদর্শ ও সংকল্প থেকে সরে আসেন নি। সাধারণত নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে এমনভাবে অটল থাকা খুব কঠিন কাজ। আবুল হাশিম বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে|

———-

২৪.ঐ

২৫ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯।

ঢাকার মুসলিম লীগ কর্মীরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে । সেটা সম্ভব হয় তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, শামসুদ্দীন, মােহাম্মদ শওকত ও অন্যান্য সার্বক্ষণিক ও কতিপয় খণ্ডকালীন কর্মীর প্রচেষ্টায় এবং কামরুদ্দীন আহমদের সাংগঠনিক দক্ষতাগুণে। সম্পাদক আবুল হাশিম নিজেও এ সকল দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর দ্বারা বহুলাংশে অনুপ্রাণিত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আবুল হাশিম ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর খাজাদের মনােনীত প্রার্থী সাতক্ষীরার আবুল কাশেমকে পরাজিত করে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরদিন তিনি এক উদারনৈতিক কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। এই কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বক্তৃতায় বলেন “সলিমুল্লাহর সময় থেকে ‘নেতৃত্ব বন্ধক আছে ‘আহসান মঞ্জিলে’, ‘প্রচার বন্ধক রয়েছে ‘দৈনিক আজাদ’এর মালিকের কাছে এবং আর্থিক’ বন্ধক রয়েছে ‘ইস্পাহানী’র নিকট,” যেখান থেকে দলকে মুক্ত করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রথমেই তিনি প্রাধান্য দেন প্রাদেশিক পার্টি অফিস গড়ে তােলার প্রতি। তার অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, শামসুদ্দীন, মােহাম্মদ তােয়াহা, শওকত আলী ও অন্যান্যরা কালক্রমে ১৫০ চক মােগলটুলিতে মুসলিম লীগের অফিস গড়ে তােলেন। মূলত এটা ছিল আহসান মঞ্জিলের নবাব পরিবারের প্রভাব থেকে পার্টির কর্মকাণ্ডকে দূরে সরিয়ে আনার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। বস্তুত এ সময় পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে খাজা পরিবার এমনভাবে চেপে বসেছিল যে, সেই প্রভাব খাটিয়ে ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে শুধুমাত্র নবাব পরিবার থেকেই ৯ জনকে নির্বাচিত করে আনা হয়। এমতাবস্থায় ঢাকায় মােগলটুলিতে স্বতন্ত্র পার্টি অফিস গড়ে তােলার গুরুত্ব যেমন ছিল তেমনি তা ছিল দুরূহ ব্যাপার । পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এই পার্টি অফিসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই অফিসকে কেন্দ্র করেই পাকিস্তানের জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় বিরােধী রাজনৈতিক শক্তি ক্রমশ সংগঠিত হয়। ভারত বিভাগের পর কলকাতা

———————-

২৬ “পার্ট-টাইম কর্মীদের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এ. কে, আর আহমদ, নাঈমুদ্দীন আহমদ এবং ডা. এম এ করিম । এর উপরও যারা নানা কাজে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছেন তাদের মধ্যে নাম করা যায় নজমুল করিম, মােহাম্মদ নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র ।” ঐ, পৃ. ২৬। ২৭, আবুল হাশিম, আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলার রাজনীতি, শাহাবুদ্দীন মহম্মদ আলী (অনু.) (ঢাকা নওরােজ কিতাবিস্তান, ১৯৮৭), পৃ. ৬৪। ২৮, ঐ, পৃ. ২১। ২৯ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫। ৩০ আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।

————

থেকে মুসলিম লীগ নেতা কর্মীরাও এখানে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পার্টি অফিস গড়ে তােলার পর মুসলিম লীগের এই তরুণ ও উদারনৈতিক অংশটি নিজেদের অনুকূলে পার্টিকে সংগঠিত করতে সচেষ্ট হলে দলের রক্ষণপন্থীদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এটাকে মুসলিম লীগের কেবল অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দল বলা যায় না। স্পষ্টত এর পিছনে ছিল মতাদর্শিক পার্থক্য। | এই সময় ঢাকার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দীন আহমদ দলের উদারনৈতিক ধারার একটি কর্মসূচি প্রকাশ করেন যা তাদের আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। এতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদসহ মৌলিক মানবাধিকারের অনেক বিষয় উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের দাবি ইউরােপের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে জোরালাে ও জনপ্রিয় কর্মসূচিতে পরিণত হতে দেখা যায় । বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের গােড়া থেকে ভারতবর্ষেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে এবং কৃষক প্রজাপার্টির কর্মসূচিতে এর ক্ষীণ প্রভাব লক্ষণীয়। ইশতেহারভিত্তিক নতুন এই কর্মসূচি মুসলিম লীগের রক্ষণশীলদের যেমন ক্ষিপ্ত করে তােলে তেমনি। তাজউদ্দীন আহমদের মতাে উদারপন্থীদের প্রভূত পরিমাণে অনুপ্রেরণা জোগায় । এই উদ্যোগের সঙ্গে কমিউনিস্টদের একটি সম্পর্ক ছিল বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্বভাবতই মূলধারার মুসলিম লীগ নেতাদের মনে ঢাকার কর্মী বাহিনী। সম্পর্কে সন্দেহ জাগে । ঢাকায় নতুন এই উদ্যোগের সমন্বয়ক কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন:৩৪ কমিটি সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আসাদুল্লাহ সাহেব ঢাকা সদর মহকুমার ভার নিতে রাজি হলেন। বাকি মহকুমাসমূহের ও উত্তর সদরের ভার পড়লাে আমাদের পাটি অফিসের উপর। শামসুদ্দীন মুন্সিগঞ্জের ভার নিলেন, তাজুদ্দীন ভার নিলেন উত্তর সদরের। মানিকগঞ্জের ভার পড়লাে মছিহউদ্দীন (রাজা মিয়া) এর উপর । নারায়ণগঞ্জ শহর আলমাছ আলী আর শামসুজ্জোহার উপর আর সেই মহকুমার ভার পড়লাে আবদুল আওয়ালের উপর, আর ঢাকা শহরের ভার নিল ইয়ার মহম্মদ ও মােহাম্মদ শওকত আলী ।

——————

৩১ বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড (ঢাকা জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৫), পৃ. ১৭৩। ৩২, ম্যানিফেষ্টোতে আইনের চোখে সমতা, নাগরিক অধিকার, শ্রমের স্বাধীনতা, শিক্ষার অধিকার, সকল প্রকার একচেটিয়া স্বার্থের উচ্ছেদ সাধন, শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার, ইসলাম ধর্মের সমতা ইত্যাদি বিষয়ে আলােকপাত করা হয়। ঐ, পৃ. ১৭৪-১৭৫। ৩৩, আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪। ৩৪ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮।

———

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, কর্মী বাহিনীকে পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন দক্ষ সংগঠক শামসুল হক। তিনি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও যৎসামান্য অর্থ। দিয়ে কয়েকদিনের জন্য কর্মীদের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিতেন। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যেত, তাজউদ্দীন আহমদ নির্দিষ্ট কাজ শেষ করে এসে তাকে প্রদত্ত যৎসামান্য অর্থের প্রায় পুরােটাই পার্টি ফান্ডে ফেরত দিতেন।

তাদের প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া যায় অতি দ্রুত। ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাস নাগাদ পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা বেড়ে ১০ লাখে উন্নীত হয়। এর ফলে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খাজা পরিবারের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে পুনরায় আবুল হাশিমকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা সম্ভব হয়। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে খাজা পরিবারের বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদদের মতাে নিবেদিতপ্রাণ উদারতাবাদী যুবকর্মীদেরই বিজয়। ১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের ঐ কাউন্সিল অধিবেশনেই তাজউদ্দীন। আহমদ সর্বপ্রথম মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তিনি কাউন্সিলের একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে মুসলিম লীগকে আজাদ পত্রিকাভিত্তিক প্রচারের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালানাে হয়। এর বিকল্প হিসেবে হুশিয়ার নামক একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এর পূর্বতন মালিক ছিলেন মােহাম্মদ মােহসীন। তার কাছ থেকে পত্রিকাটি মােগলটুলির পার্টি অফিস কিনে নেয় । এটা প্রকাশ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাজউদ্দীন আহমদ।” এভাবে জীবনের শুরুতেই তাজউদ্দীন আহমদ পত্রিকা প্রকাশনা বা সম্পাদনা করতে গিয়ে শুধু রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সাফল্যের পরিচয় দেননি বরং এতে তার বুদ্ধিবৃত্তি ও সমাজ-সংস্কৃতি সম্বন্ধে তথ্যপূর্ণ পাণ্ডিত্য অর্জনের প্রাথমিক ভিত্তি। রচিত হয় । তার রাজনৈতিক জীবনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । অন্যদিকে, আবুল হাশিম ১৯৪৪ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ফলে ব্রিটিশের আশীর্বাদপুষ্ট খাজা পরিবারের

—————-

৩৫, আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। জনাব আবদুল মমিন আওয়ামী লীগের প্রাক্তন প্রচার সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হতে তাজউদ্দীন আহমদের অন্যতম ঘনিষ্ট ব্যক্তি। ৩৮ কামরুদ্দীন আহমদ, পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি (ঢাকা ইনসাইড লাইব্রেরী, ১৩৭৬ বঙ্গব্দ), পৃ. ৬৪। ৩৭, আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯। * সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দিন আহমদ ইতিহাসের পাতা থেকে (ঢাকা: প্রতিভাস ২০০০), প্রথম ফ্ল্যাপ দ্রষ্টব্য। ৩৯ কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭।

———–

ন্যায় মওলানা আকরম খাঁর সঙ্গেও প্রগতিশীল মুসলিম লীগ কর্মীদের সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কেননা তিনি এতদিন ধরে আজাদ-এর মাধ্যমে নিজেদের মতামত দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত এবং একচেটিয়া বাণিজ্য করে আসছিলেন। | এরপর ইস্পাহানী ও অনুরূপ পুঁজিপতি মুসলিম লীগ সমর্থকদের নিকট থেকে দলের ‘আর্থিক বন্ধকী’ মুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একক কোনাে ব্যক্তির নিকট থেকে দল চালানাের জন্যে টাকা না নিয়ে সদস্যদের নিকট থেকে ফি সংগ্রহ করা হবে। এভাবে মুসলিম লীগ সদস্যদের নিকট থেকে সংগৃহীত অর্থের দু পয়সা ইউনিয়ন শাখায়, দু পয়সা মহকুমা শাখায় বাকি চার। পয়সা জেলা শাখার ফান্ডে জমা করা হতাে। দলকে চাদাদানকারী প্রভাবশালী মুসলিম লীগ পুঁজিপতিদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য এই সিদ্ধান্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক এই অভিযানের সঙ্গেও তাজউদ্দীন আহমদ খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন। তার দায়িত্ব পড়ে ঢাকা উত্তর-সদরের।” এসব ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মুসলিম লীগের সংগঠনে কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে । ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাস নাগাদ প্রাথমিক সদস্য ফি বাবদ প্রায় ১৫ হাজার টাকার অধিক অর্থ সংগৃহীত হয়। এর ফলে অল্প সময়ের মধ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় শক্তিশালী গণভিত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । ১৯৪৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই ভারতব্যাপী দলটি মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এক প্রকার অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন পূর্ব বাংলার উদারতাবাদী মুসলিম লীগের এই অংশটি পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হলেও লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলা অঞ্চলে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই তারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করেন এবং বিপুল বিজয়কে সম্ভব করে তােলেন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে তাজউদ্দীন আহমদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা জানা যায় । এ বিষয়ে কামরুদ্দীন আহমদ স্মৃতিচারণায় লিখেছেন যে, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহের গফরগাঁও আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন গিয়াস উদ্দিন। পাঠান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এমারত পার্টি” নামক একটি স্থানীয় দলের

————-

৪০.ঐ

৪১. এ, প, ২৮। ৪২, আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৫।

————

সভাপতি মওলানা শামসুল হুদা। তিনি ঐ এলাকায় এত প্রিয়নেতা ছিলেন যে, গিয়াস উদ্দিন পাঠানের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশংকা দেখা দেয় । মওলানা শামসুল হুদার বিপক্ষের কোনাে প্রার্থীর অনুকূলে প্রচারণা চালানাে অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মুসলিম লীগের বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় নেতা। শামসুল হক ও আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) কিছুসংখ্যক কর্মী নিয়ে গফরগাঁও গমন করেন। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে না পেরে তারা কামরুদ্দীন আহমদকে ঢাকা থেকে কিছুসংখ্যক গুণ্ডা প্রকৃতির লােক নিয়ে অনতিবিলম্বে গফরগাঁওয়ে যেতে বলেন। এ সম্পর্কে কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন: তাদের পছন্দ করা দেড়শত ঢাকার ডাকসাইটে লােক নিয়ে আমি এবং তাজুদ্দীন আহমদ রওনা হলাম। স্টেশনে এসে যা দেখলাম তাতে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলাে। মস্ত বড় বড় রামদাও নিয়ে হাজার হাজার লােকের মিছিল। আমাদের ক্যাম্পে যাবার পথে, আমাদের দু’পাশে তারা রামদাও, বর্শা উচু করে লাফাচ্ছে, আর চীকার করছে, এমারত পার্টি জিন্দাবাদ’, মাওলানা শামসুল হুদা জিন্দাবাদ’ । আমি কিযে করবাে ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম তাজুদ্দীন সমানভাবে স্লোগান দিচ্ছে ‘লাঙ্গল যার জমি তার জমিদার নিপাত যাও’ ‘জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করাে’ । একবারও বলছে না মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’। এ শ্লোগানে কাজ হলাে, তাদের চীঙ্কার থেমে গেল। আমি শরিয়তুল্লাহ বা দুদু মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন চোখে দেখিনি কিন্তু এমারত পাটির আমীর মওলানা শামসুল হুদার ক্ষমতা দেখে মনে হলাে গফরগাঁওয়ে যেটা করতে পেরেছেন সেটাই একটু বৃহৎ আকারে তিতুমীর বা হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তার ছেলে দুদু মিয়া করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভালােভাবেই জানতেন ঐ এলাকাটি ছিল প্রজা আন্দোলনের পুরানা ঘাঁটিবিশেষ। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রত্যুৎপন্নমতি তাজউদ্দীন আহমদের করণীয় নির্ধারণে মােটেও বিলম্ব ঘটেনি। তাদের প্রত্যাশার কথাও তাজউদ্দীন আহমদের অজানা ছিল না। তাই তিনি তাৎক্ষণিকভাবে যে শ্লোগান দেন, তারা তাতে শান্ত হয়ে যায়। কেননা তাজউদ্দীন আহমদের উচ্চারিত কথাগুলাে তাদেরই প্রাণের দাবি। পরবর্তীকালের রাজনৈতিক জীবনে তিনি অসংখ্যবার এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন এবং সমাধানও করেন উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পৃক্তির বিষয়ে

————-

৪৩. কামরুদ্দীন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৬৩।

সরদার ফজলুল করিমও উল্লেখ করেছেন। সিলেটের গণভােট প্রসঙ্গে তিনি এই কথা উল্লেখ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যরা যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন, সাময়িকভাবে তা অর্জিত হয়; পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে খাজা বা নবাব পরিবারের প্রভাব অনেকখানি হ্রাস পায়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আবুল হাশিমের আহ্বান ও ইশতেহারে বর্ণিত বিষয়াবলি পুরাে মাত্রায় হৃদয়ঙ্গম করেন এবং তার প্রতি অবিচল থাকেন। পরবর্তীকালে আবুল হাশিম নানা কারণে প্রগতিশীল দর্শনে নিজেই টিকে থাকতে পারেননি। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কেবলমাত্র টিকেই থাকেননি বরং উত্তরােত্তর এর সমৃদ্ধি ঘটিয়ে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাই বলা যেতে পারে, আবুল হাশিম পূর্ব বাংলার একদল তরুণ রাজনৈতিক কর্মীকে শৃঙ্খল-মুক্তির যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন-প্রচেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ সবের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক দর্শনের শক্তভিত রচিত হয়। বাল্যকালে অর্জিত বিপ্লবী আদর্শ, আবুল হাশিমের ইশতেহারে বর্ণিত কর্মসূচি এবং তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ সবকিছুর মিশ্রণে তার মনে এই ব্যক্তিক দর্শনের শক্ত ভিত রচিত হয়। তার এই দর্শনের মূলে স্থান পায় সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি এবং কুসংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক, শােষণহীন উদার একটি সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তােলা—সর্বোপরি একটি বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামাে নির্মাণ করা । তাজউদ্দীন আহমদের তরুণ বয়সেই এই সুদৃঢ়বােধ জন্মে যে, কৃষি-প্রধান পূর্ব বাংলার সামষ্টিক মুক্তি অর্জন করতে হলে কৃষক। সম্প্রদায়ের সার্বিক কল্যাণ ছাড়া কোনাে বিকল্প নেই। তার লেখা ডায়েরি ও সমসাময়িক কালের নানা তথ্য থেকে তার এই রাজনেতিক দর্শনের সমর্থন মেলে। কালিক বিচারে তার এই বােধ নিঃসন্দেহে প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনার পরিচায়ক। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অধীনে দুই যুগ ধরে এ সব মৌলিক অধিকারের দাবিতেই পূর্ব বাংলার মানুষকে আন্দোলন করতে হয় । তাজউদ্দীন আহমদ সেক্ষেত্রে একদিকে সকলের অগােচরে যেমন আন্দোলনের দর্শনগত ভিত। রচনা করেন, অন্যদিকে তেমনি একজন সুনিপুণ সংগঠক ও নেতা হিসেবে সঠিক পথে আন্দোলনকে পরিচালনা ও দিক নির্দেশনা প্রদান করেন ।

—————-

৪৫. সরদার ফজলুল করিম, সেই সে কাল কিছু স্মৃতি কিছু কথা (ঢাকা: প্যাপিরাস, ২০০২), পৃ. ৩০।

———-

১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে নানাবিধ মেরুকরণ পরিলক্ষিত হয়। ঐ যুদ্ধে ব্রিটেন জড়িয়ে পড়লে ভারতীয়দের সহযােগিতা জরুরি হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ করে কংগ্রেস ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়ে সােচ্চার হয়। অন্যদিকে মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারতে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলাে নিয়ে মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। এ বিষয়ে কংগ্রেসের কোনাে কোনাে নেতার সাম্প্রদায়িক মনােভাব কতকটা দায়ী থাকলেও বলা চলে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম সারির নেতারা কংগ্রেসে তেমন সুবিধা করতে না পেরে মুসলিম লীগের ব্যানারে ঐ। ধরনের দাবির প্রতি অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলা অঞ্চলে শুরু হয় অখণ্ড বাংলা বনাম বিভক্ত বাংলার আন্দোলন। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সহযােগিতায় একই সঙ্গে বাংলার রাজনীতিতে আবার অবাঙালি ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী নেতাদের প্রভাব বৃদ্ধির তৎপরতা শুরু হয়। ইতঃপূর্বে বাংলার রাজনীতিতে খাজা পরিবারের প্রভাব খর্ব হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৬ সালের ১৯২২ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে অবাঙালি এ সকল নেতার তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ঐ নির্বাচনে মুসলিম লীগ এমনভাবে প্রার্থী মনােনয়ন দান করে যে, ভারসাম্য থেকে যায় অবাঙালি প্রভাবিত নেতাদের পক্ষে । মনােনয়নপ্রাপ্ত ১১৯ জনের মধ্যে ৫৭ জনই ছিলেন খাজা পরিবারের প্রভাবাধীন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৪টি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শ্রমিকদের জন্য সংরক্ষিত একটি করে মােট ১১৬টি আসন দখল করতে সক্ষম হয়। এর ফলে সংগত কারণেই একটি শক্তিশালী ব্লক অবাঙালি। মুসলিম লীগ নেতাদের পক্ষে গড়ে ওঠে এবং পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আবার ফিরে আসে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে বণিক স্বার্থের রক্ষাকারী খাজা পরিবার ও অন্যান্য অবাঙালি নেতাদের চক্রান্ত এখানেই থেমে থাকেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তান গণপরিষদে মােট সদস্য ছিলেন। ৬৯ জন। এর মধ্যে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ছিলেন যথাক্রমে ৪৪ ও ২৫ জন। মুসলিম লীগ রাজনীতির জোয়ার ও সাম্প্রদায়িক ধূম্রজালের সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬ জনকে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব করার সুযােগ দেয়া হয়। পূর্ব বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাদের কোনাে সম্পর্ক ছিল না । উপরন্তু বাঙালি জনগােষ্ঠী সম্পর্কে এসব নেতার মনােভাব ছিল নেতিবাচক। দেশ

৪৬ দেখুন, কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭ এবং প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬-৪৭। ** প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭।

———

বিভাগের পরে আরাে ১০ জন সদস্যকে পাকিস্তান গণপরিষদে অন্তর্ভুক্ত করায় | মােট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৯ জনে। এর ফলে পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রকৃত প্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ জনে যা হিসেবের সমীকরণে পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের পক্ষে রয়ে যায়। এভাবে দেখা যায় বিভাগােত্তর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে খাজা পরিবার ও অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের প্রভাব আবার ফিরে আসে। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে তারা ব্রিটিশের বিশেষ তােষামুদে গােষ্ঠী হিসেবে এ সুযােগ-সুবিধা আদায় করে নেন। অন্যদিকে এই নির্বাচনে এ.কে. ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টিকে ভােটাররা এক প্রকার প্রত্যাখ্যান করে । পাকিস্তান আন্দোলনের সম্মােহনী ধূম্রজালে এতদঞ্চলের মুসলিম সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় অসাম্প্রদায়িক প্রজাপার্টি আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলার তেমন কেউ ছিলেন না, অন্তত মুসলিম লীগ সদস্যদের মধ্যে তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। বস্তুত পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা বাঙালি-বিদ্বেষী মনােভাব নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই অগ্রসর হতে থাকেন। | ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় লাভের পর ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল দিল্লির এ্যাংলাে এরাবিক কলেজে মুসলিম লীগের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সালে লাহােরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই কনভেনশনে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও অন্যান্য অবাঙালি নেতা চাতুর্যপূর্ণ কৌশলে তা বাতিল করে একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটাকে অবাঙালি প্রভাবিত পুঁজিমালিক মুসলিম লীগ নেতাদের নিছক একটা প্রতারণামূলক কাজ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতাে তাদের একটা চক্রান্ত সফল হয়। অথচ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাঙালি মুসলমানরা লাহাের প্রস্তাবের ওপর গণভােট বিবেচনায় দ্ব্যর্থহীন রায় প্রদান করেছিল। নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বিশেষত ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা তুলনা করলে এটা প্রমাণিত হয়।” | ভারতের পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত বঙ্গ প্রদেশ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যার ৯৩, ৯০ শতাংশ মুসলমান মুসলিম লীগের পক্ষে রায় প্রদান করে। অথচ

—————–

৪৮ ঐ, ৪৭। ৪৯ আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৭। | অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫ (ঢাকা দ্বিতীয় সংস্করণ বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ সােসাইটি লি., তাবি), পৃ. ৯।

——-

পশ্চিমাঞ্চলের পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুর গড়ে ৮০.৫১ শতাংশ মুসলমান মুসলিম লীগের পক্ষে ভােট দেয়। পূর্বাঞ্চলের মুসলমানেরা নিশ্চয়ই সহস্রাধিক মাইল দূরবর্তী অপর মুসলিম প্রধান অঞ্চলের সঙ্গে একক রাষ্ট্র গঠনের জন্যে রায় প্রদান করেনি। তবে এ নির্বাচনের ফলে দলটির নেতারা তথা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ও অন্যরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। মনে হয় এই বিপুল বিজয় ঐ নেতাদের মনে বেপরােয়া মনােভাবের জন্ম দেয়; এর ভিত্তিতে তারা লাহাের প্রস্তাবকে সংশােধন করে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনেই কেবল তৎপর হননি, উপরন্তু ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষিতেও তারা বেশ সুবিধাজনক স্থানে পৌছেন। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, এ.কে. ফজলুল হক, আবুল হাশিম ও অন্যরা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। এর কারণ সম্ভবত সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রভাব না থাকা। কাজেই উক্ত অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতারা প্রভাব খাটিয়ে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব সংশােধন করে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত সদস্যদের সম্মেলনে একমাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাস করিয়ে নেন। সাধারণভাবে রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলে যে নীতি গ্রহণ করা হয় তা দলটির জন্য আইনের মর্যাদা পায়। এ ধরনের নীতি কখনাে গ্রহণযােগ্য না হলে পরবর্তী কাউন্সিলে কিংবা বিশেষ কনভেনশনে সকলের উপস্থিতিতে তা পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগের যে কনভেনশন হয় তাতে কেবল আইন পরিষদ সদস্যরাই উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে মুসলিম লীগের সাধারণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। রীতি অনুযায়ী এই সংশােধন আইনসম্মত হয়নি। এ কথা ঠিক যে, বাংলার নেতা এ.কে. ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহাের প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। কিন্তু মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের কিছুসংখ্যক নেতার কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্ত সমগ্র ভারতের মুসলমানদের জন্য ক্ষতি ডেকে আনতে পারে সে বিষয়ে ফজলুল হক ১৯৪১ সালেই অনুধাবন করেন । তিনি বলেন যে, ভারত উপমহাদেশে কেবলমাত্র বাংলা ও পাঞ্জাব ব্যতীত কোথাও মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। সমগ্র ভারতের ৩৩% বাঙালি-মুসলমান, কিন্তু মুসলিম লীগ রাজনীতিতে তাদেরকে গণ্য করা হয় না। এমতাবস্থায় ১৯৪১ সালে অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খানের নিকট লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করেন। তার বক্তব্যের কিয়দংশ নিম্নরূপ:

———

৫২. হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পা.), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র : প্রথম খণ্ড

———-

At present I feel that Bengal does not count much in counsels of political leaders outside province, though we constitute more than one-third of Muslim population of India. My critics prejudge and condemn without knowing facts and forgot my lifelong services to Muslim community. I confidently hope that political dictators in future will act with greater foresight so as to prevent creation of situation from which escape can be effected only by course of action which is revolting to sound

sense or even conscience. অন্যদিকে এ বিষয়ে অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের মনােভাব ও তৎপরতা গােপন থাকেনি। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন যে, মুসলিম জগতের স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানে দশ মাইল পেলে পূর্ব বাংলায় বিশ মাইল ছাড় দিতেও তিনি। প্রস্তুত। সীমানা কমিশনের কার্যক্রমের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে তার এই উক্তির মধ্য দিয়ে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়। অথচ আসামের রানীর প্রাণান্তকর চেষ্টা সত্ত্বেও প্রায় একই ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী আসামকে বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত করার প্রস্তাব তারা (খাজা নাজিমুদ্দীন) সমর্থন করেন নি। উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে আসামে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ৩৪ টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ অর্জন করে ৩১ টি আসন। সে অর্থে আসামকেও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টা অনেকখানি যৌক্তিক ছিল। অপরদিকে শেখ আবদুল্লাহর বিরােধিতা সত্ত্বেও পশ্চিমা অবাঙালি নেতারা কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অধীনে। পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। | এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পশ্চিম পাঞ্জাব ও কলকাতা নগরীর ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা যেতে পারে। উভয় রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও লিয়াকত আলী খানের মধ্যে একটি সমঝােতা হয় । উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব ও কলকাতা নগরী পড়েছিল যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। দুটো শহরই গড়ে উঠেছিল তার অপর অংশের সম্পদ হতেও। উক্ত সমঝােতার সময় শহর দুটোর আর্থিক মূল্য ধরা হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে চার হাজার কোটি টাকা এবং কলকাতা নগরীর ছয় হাজার কোটি টাকা। মােট মূল্যের দুই ভাগ করে ভারতের কাছে পাকিস্তানের পাওনা হয় দুই হাজার কোটি টাকা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ভারতের

————–

(ঢাকা তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২), পৃ. ৫। এরপর এই উৎসটি শুধু দলিলপত্র বলে উল্লেখ করা হবে। ৫৩. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৫-৯৬।

২০

সঙ্গে উদার সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে বলেন প্রাপ্য ঐ দুই হাজার কোটি টাকা দেয়ার প্রয়ােজন নেই। মজার বিষয় পূর্ব বাংলার প্রাপ্য সম্পদ ছেড়ে দেন বটে কিন্তু তার বিনিময়ে লাভ করেন পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রধান নগরীটি। ভূ-স্বর্গ কাশ্মিরকে লাভ করার উদ্দেশ্যেও পাকিস্তান একাধিকবার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে । এসবই হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের চক্রান্ত যার মূল কারণ হচ্ছে বাঙালিদের প্রতি তাদের অবিশ্বাস ও অবজ্ঞা। পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার ৫৬% বাঙালি। আসামকে পূর্ব বাংলার সঙ্গে যুক্ত করা হলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাত পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় আরাে বেড়ে যেতাে। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সমীকরণে পূর্বাঞ্চল আরও সুবিধাজনক স্থানে থাকতে পারতাে এবং পশ্চিমাদের দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা আরাে বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক হতে পারতাে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম জগৎ’ এর অজুহাতে প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমাঞ্চলে অধিক ভূমি দখল এবং পূর্ব বাংলার বিপরীতে পশ্চিমাঞ্চলে জনসংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধির তৎপরতায় লিপ্ত হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে দেখা যায়, বােম্বে, মাদ্রাজ ও মধ্যপ্রদেশে মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত সবগুলাে আসন মুসলিম লীগ লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য পরস্পর সন্নিহিত অঞ্চল না হওয়ায় ঐগুলাে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। তদুপরি ঐসব অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যায় ছিল নগণ্য। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই আবেগ এবং ভৌগােলিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একমাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্র গঠন অপেক্ষাকৃত গ্রহণযােগ্য সমাধান হতে পারতাে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের দুটো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের সম্প্রীতি হুমকির মুখে এসে পড়ে। আলাদা রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে মুক্তি অন্বেষণের চেয়ে ফেডারেশন গঠনেই প্রকৃত মুক্তি ঘটানাে সম্ভব—এই দূরদর্শী চেতনা নেতাদের মধ্যে তেমন লক্ষ্য করা যায় না। তবে কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারত উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ সংকট ও ট্র্যাজেডি এড়ানাের জন্য একটি ফেডারেশন গঠনের ফর্মুলা প্রণয়ন করেন। কিন্তু সেটির প্রতি মুসলিম লীগ বা কংগ্রেস কোনাে দলই গুরুত্ব প্রদান করেনি। তবে এ.কে. ফজলুল হক এ বিষয়ে বরাবরই যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল তথা তল্কালীন বঙ্গদেশ ও আসামে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির

————————

৫৫. নাজিমুদ্দীন মানিক, একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলাে (ঢাকা ওয়ারী বুক সেন্টার, ১৯৯২), পৃ. ৭৫। * এ বিষয়ে জানার জন্য দেখুন, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ভারত স্বাধীন হল, সুভাষ মুখােপাধ্যায় (অনু.) (কলকাতা ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৮৯), পৃ. ১৩৭-১৪০।

————–

প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন। ১৯৪২ সালের ২০ জুন তিনি যে বক্তব্য রাখেন তা স্মরণ করা যেতে পারে:৫৭

India and more particularly Bengal and Assam are facing today the gravest of perils. Foreign aggression threatens not only our security but also our hearths and homes, our hopes and aspirations, our social, economic and cultural stability, in a word everything that we hold dear inviolable…the first condition is the establishment of better communal ralations and the creation of an atmosphere of mitual goodwill and cooperation. The need for unity and solidarity of the people of Bengal has never been so pressing and immediate as today and it is only on the basis of such unity that we can hope to overcome the perils which threaten to engulf us. বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার কোননা কোনাে নেতা এ বিষয়ে জোরালাে যুক্তি উপস্থাপন করলেও বাস্তবে তা কার্যকর করার মতাে কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ব্রিটেন ভারতবর্ষ হতে হাত গুটিয়ে নেয়ার ঘােষণা দিলে মুসলমানদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। বলা চলে পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় অতি মাত্রায় ‘পাকিস্তান’ মােহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বাঙালি নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দোদুল্যমান অবস্থাও কম দায়ী ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে ফজলুল হকের কৃষক প্রজাপার্টি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সম্মানজনক আসন লাভ করলেও ১৯৪৬ সালে। দলটি মাত্র ৫টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বাদ দিলেও এ.কে. ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দোলাচলের কারণে পশ্চিমা অবাঙালি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অবাধ সুযােগ পান। ফজলুল হক একই সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজাপার্টির সদস্যপদ বহাল রেখেছিলেন। এটা রাজনীতিতে তার দোদুল্যমান মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে কৃষক প্রজাপার্টির ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য তার এই দ্বিধাগ্রস্ত ক্ষমতান্বেষী মনােভাব কতকটা দায়ী ছিল।” বলা যেতে পারে এ সকল বাঙালি নেতা ঐ পর্যায়ে মারাত্মক রকমের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন। সেটা বুঝতে

————-

৫৭ দলিলপত্র প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮। ৫৮ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাঙালির ইতিহাস (ঢাকা অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ১১০। ৫৯ ঐ, পৃ. ১০৯।

————

অবশ্য তাদেরকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অথচ পূর্ব বাংলায় ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে কৃষক প্রজাপার্টির যে উত্থান ঘটেছিল তা ধরে রাখা গেলে বাংলার ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতাে। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে কয়েকজন বাঙালি হিন্দু-মুসলিম নেতা বাংলাকে অখণ্ড রাখার প্রয়াস চালান। উল্লেখযােগ্যদের মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ। তাদের এ উদ্যোগকে ঢাকার মােগলটুলি পার্টি অফিসের তাজউদ্দীন আহমদের ন্যায় উদারপন্থী নেতা-কর্মীরা স্বাগত জানান। কিন্তু সম্মিলিত সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মজার বিষয় হলাে কংগ্রেস ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে ভারতব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল অথচ ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস নির্দ্বিধায় বাংলা বিভক্তিকে সমর্থন করে। ইতােমধ্যে অবশ্য রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক বদলে যায়। পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক পুঁজিপতি শ্ৰেণীটি ১৯১১ সালের পরে যুক্ত বাংলায় নিজেদের সংখ্যালঘুত্বকে প্রকটভাবে অনুভব করে। কেননা একদিকে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়, অন্যদিকে ঢাকাকেন্দ্রিক আর একটি শ্রেণীর উদ্ভব তাদের পূর্বের কর্তৃত্বকে খর্ব করে । ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ফলে এদের উপলব্ধি জন্মে যে, যুক্ত বাংলায় তাদের পক্ষে কর্তৃত্ব করা সম্ভব নয়।” বৃহত্তর বাংলা বিভক্ত হােক এটা কংগ্রেস যেমন চেয়েছিল তেমনি পাকিস্তানের পুঁজিপতি প্রভাবিত অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতারাও একই প্রত্যাশা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে অবাঙালি পুঁজিপতিরা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বিভক্তি চেয়েছিল। তাদের নিজ বাজার সৃষ্টির জন্য। | ভারত বিভক্তির কিছুকাল পূর্বে বাংলার উভয় সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক মানুষ “হিন্দু বাংলা’ ও ‘মুসলিম বাংলার যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তা সমষ্টিগতভাবে বাঙালির স্বার্থবিরােধী হয়ে ওঠে। সেটা বুঝতে অবশ্য কিছুটা সময় লাগে। এমতাবস্থায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটি সংবাদ সম্মেলনে এক দীর্ঘ বক্তৃতার মাধ্যমে ‘স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে জোরালাে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐক্য, পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের দিক বিবেচনায় বাংলা অবিভাজ্য । বাংলা ভারত ইউনিয়নের সঙ্গেও যােগ দেবে না। কেননা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলাে থেকে কোনাে সাহায্য করা হয়নি, এতেই

——————-

বদিউজ্জামান, মুসলিম মধ্যবিত্তের রাজনীতি (ঢাকা ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৭), পৃ. ৯-১০। ৬২. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭।

———

প্রমাণিত হয় বাংলার বিষয়টি ভিন্ন প্রকৃতির। কাজেই বাংলাকে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলা বিশ্বের একটি অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের যে অংশটি বাংলা বিভক্তির পক্ষে দাবি জানায় তার পিছনে ১৯৩৭ সাল থেকে ক্ষমতা বঞ্চনাজাত হতাশাবােধ কাজ করে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এর প্রেক্ষিতে তিনি অবিভক্ত বাংলায় এমন একটা সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা বলেন যাতে সকলের অংশগ্রহণের সুযােগ থাকবে। তিনি মন্তব্য করেন, বাংলা বিভক্ত করা হলে তা হবে বাঙালির আত্মহত্যার শামিল। এ পর্যায়ে মুসলিম লীগের অপেক্ষাকৃত উদার অংশের নেতা আবুল হাশিম অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলা গঠনের লক্ষ্যে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন যাতে এতদঞ্চলের সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের সমঅধিকারের বিষয়টি স্বীকৃত হয়। তিনি বক্তব্যের উপসংহারে বাংলাকে প্রতিক্রিয়াশীলদের | হাত হতে রক্ষার আহ্বান রেখে বলেন:

Mr.C.R. Das is dead. Let his sprit help us in moulding our glorious future. Let the Hindus and Muslims of Bengal agree to his formula of 50:50 enjoyment of political power and economic privileges. I again appeal to the youths of Bengal in the name of her past traditions and glorious future to unite, make a determined effort to dismiss all reactionary thinking and save Bengal from the impending calamity. একই উদ্দেশ্যে শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৭ সালের ১২ মে ৬ দফাভিত্তিক একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যাতে অবিভক্ত সার্বভৌম বাংলাকে একটি সােস্যালিস্ট রিপাবলিক হিসেবে গড়ে তােলার আহ্বান জানানাে হয়। বিষয়টি নিয়ে সােদপুরে গান্ধিজীর সঙ্গেও আলােচনা করা হয়। শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বকসী ও অন্যরা অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা বিভক্তির বিরােধিতা করেন এবং সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের সঙ্গে অবিভক্ত বাংলা গঠনের একটি সমঝােতামূলক রূপরেখা প্রণয়ন করেন। শরৎ বসু ২০ মে তার বাসায় একটি ভােজসভায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতার

————

৬৩. দেখুন, দলিলপত্র প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২-২৪। ৬৯ অমলেন্দু দে, স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের পরিকল্পনা প্রয়াস ও পরিণতি (কলকাতা রত্না প্রকাশন, ১৯৭৫), পৃ. ২৫-৩৩। | ৬ই দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২৭।

৬৬, দেখুন, অমলেন্দু দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭। | ৬৭ ঐ, পৃ. ৩৮-৩৯।

————–

উপস্থিতিতে এই সমঝােতা চুক্তিতে উপনীত হন । যেখানে উপস্থিত ছিলেন সােহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, আবুল হাশিম, আবদুল মালেক, মহম্মদ আলী, কিরণ শঙ্কর রায়, সত্যরঞ্জন বকসী ও শরৎচন্দ্র বসু। সমঝােতা চুক্তির একটি কপি। গান্ধীজীর নিকট প্রেরণ করা হলে তিনি প্রস্তাবটির প্রতি কিঞ্চিৎ সহানুভূতি প্রকাশ করেন বটে, কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। কেননা কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা জওহরলাল নেহেরু, আচার্য কৃপালনী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও অন্যরা এর ঘাের বিরােধিতা করেন। এ ছাড়াও পুঁজিপতি হিন্দুদের প্রভাবাধীন পত্রিকাগুলাে বাংলা বিভাগের পক্ষেই বরং অবস্থান গ্রহণ করে। ক্রমাগত হিন্দু নেতারাও এ থেকে সরে আসেন, কেবল শরত্যন্দ্র বসু এই দাবিতে অটল থাকেন। অন্যদিকে সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের নিকট ২১ মে একখানি দীর্ঘ চিঠি লিখেন যাতে ব্যাখ্যা করে বলা হয়, অবিক্ত বাংলা গঠন লাহাের প্রস্তাবের পরিপন্থী নয়। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতৃত্বের নিকট থেকে ইতিবাচক কোনাে সাড়া পাওয়া যায়নি।” | যাহােক ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে বাংলা ও আসামকে নিয়ে অবিভক্ত বাংলা নামক একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের মৌল চেতনা ও ভাবাদর্শের সাথে পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ ও চেতনার অধিকতর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে গেলে মুসলিম লীগের অপেক্ষাকৃত উদার অংশটি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আবুল হাশিম ক্ষেদোক্তি করেন এই বলে যে, যে বাংলার নেতারা এক সময় সমগ্র ভারতের রাজনীতিতে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন সেই বাংলা বর্তমানে রাজনৈতিক দেওলিয়ার শিকার। তারা অবাঙালিদের দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হচ্ছে, বাঙালি আজ সংকটের সম্মুখীন। অপরদিকে ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিলে সেটাই বাঙালি হিন্দু

———–

৬৮.ঐ

৬৯. Kamruddin Ahmad, A Socio Political History of Bengal and the Birth of Bangladesh (Dacca : Inside Library., 1975), p. 34. ৭০ Ibid, p. 82 .

হারুন অর রশিদ, ‘অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নেপথ্য কাহিনী’, প্রথম আলাে, ঈদসংখ্যা, ‘ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৯৯। স, ডক্টর আবুল কাশেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ উন্মেষ, বার্ষিক সংকলন ২০০০-২০০১ (রাজশাহী: বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ড, রাজশাহী), পৃ. ৩১। 19. Kamruddin Ahmad, op.ct., pp. 81-82.

————-

২৫

পরিষদ সদস্যদের নিকট অধিক গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বৃটিশ সরকারের প্রতিনিধি ও গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা ঘােষণা করেন। বাংলা এবং পাঞ্জাবের ব্যাপারে ঐ পরিকল্পনায় বলা হয় যে, প্রদেশ দুটোর বিধানসভার সদস্যরা মিলিত হয়ে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। ভারত বিভাগের কিছুকাল পূর্বে বাংলা প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে উদারপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের আবির্ভাব ঘটেছিল । চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম, ফজলুল হক ও অন্যান্য নেতার প্রয়াসে বাংলায় একটি উদার রাজনৈতিক ও সহযােগিতামূলক আবহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এর অতি অল্পকালের মধ্যে বাংলা বিভক্ত হয় সাম্প্রদায়িক প্রশ্নেই । ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বিধানসভার সদস্যরা বস্তুত সামপ্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা বিভাগের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। বাংলা ভাগ করার পক্ষে YES চিহ্নিত লবিতে ৩৫ জন হিন্দু সদস্য এবং NO চিহ্নিত লবিতে ১০৬ জন মুসলিম সদস্য ভােট প্রদান করেন। বৃহত্তর পশ্চিম বাংলা অঞ্চলের ৭৯ জন বিধায়কের মধ্যে ৫৮ জন হিন্দু সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে এবং ২১ জন মুসলিম সদস্য বিপক্ষে রায় দেন। পূর্ব বাংলার বিধানসভার এই ভােটাভুটিতে ৪ জন হিন্দু বাঙালি এবং ১ জন খ্রিস্টান বাঙালি সদস্য অখণ্ড বাংলার পক্ষ নেন। ফজলুল হক দ্বিধাগ্রস্ত থাকার কারণে পক্ষে বা বিপক্ষে কোথাও উপস্থিত থাকেননি। কাজেই ১৯৪৭ সালে কেবলমাত্র ভারতই বিভক্ত হয়নি, বিভক্ত হয় বাংলা ও পাঞ্জাব। বস্তুত সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের মনে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের ক্রমাগত রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রশ্নে আশঙ্কা জন্মে। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। তার শাসনামল এবং ব্যক্তিগত চলাফেরা উভয় বাংলার হিন্দু প্রতিনিধিদের বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে

———————-

৭৪ সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস নতুন দৃষ্টিকোণে একটি সমীক্ষা (ঢাকা : প্যাপিরাস, ১৯৯৬), পৃ. ১০৪। ৭৫ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০০। ৭. বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ড. মােহাম্মদ হাননান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১-১৩৬। ৭৭, ঐ, পৃ. ১৩৩ ও ১৩৫। *. ঐ, পৃ. ১৩৫। ** প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮। ৮০ সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪।

————

অনেকটা প্রভাবিত করে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাঙালিদের নেতৃত্বে বিকাশমান ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করা এবং হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ সৃষ্টির লক্ষ্যে যেখানে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করেছিলেন, সেখানে ১৯৪৭ সালে বাংলার শেষ গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারােস বাংলা বিভাগকে পূর্ব বাংলার স্বার্থবিরােধী চিহ্নিত করে এর কুফল সম্পর্কে একটি নির্মম ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তিনি বলেন যদি কখনাে ভারত বিভক্ত হয় তাহলে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাংলা হয়ে উঠবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চাষাড়ে বস্তি (Rural Slam)। কারণ বাংলাকে ভাগ করলে পূর্ব বাংলার কাঁচামালে গড়ে ওঠা কলকাতা নিশ্চিতভাবে পড়বে পশ্চিম বাংলার অংশে, এটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার জন্য হয়ে উঠবে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ; মৃত্যুর পরােয়ানা পাওয়া অবস্থার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া যার পরিণতি। এতদঞ্চলের আপামর জনসাধারণ একমাত্র ধর্ম ব্যতীত সামাজিক সকল ক্ষেত্রে অভিন্ন সংস্কৃতির ধারক-বাহক এবং তাদের রয়েছে গৌরবােজ্জ্বল ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস। একমাত্র ধর্মীয় প্রসঙ্গ বাদ দিলে বাংলা অঞ্চলে একক নৃগােষ্ঠীর সমন্বয়ে একটি জাতীয়তাবাদী সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের সকল উপাদানই বিদ্যমান। অনুমান করা যায় অভিন্ন বাংলা যদি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়, তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য তা একটি হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারেএ ধরনের সন্দেহ তাদের মনে স্থান পাওয়া বিচিত্র নয়। ফলে ১৯৩৭ সাল থেকে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে যে আশা উদ্দীপনা জাগে, বিশেষ করে ১৯৪৪ সাল থেকে ঢাকায় মুসলিম লীগের উদারনৈতিক কর্মীদের মনে, তাকে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য বলির পাঁঠায় পরিণত করা হয়। তাদের মনে হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি। কাজেই এর অবসান হলে সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটবে । কিন্তু বাস্তবে পূর্ব বাংলার জন্যে শাসকগােষ্ঠীর পরিবর্তন হয় মাত্র—পূর্বের ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রভুর পরিবর্তে এবার নতুন প্রভু হয়ে আসে অবাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম পুঁজিপতি এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারা।

—————–

৮১” ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়ের, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, রবিশেখর সেনগুপ্ত (অনু.) (ঢাকা এম.সি. সরকার আ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ), পৃ. ২৫৯। ৮২, ঐ, পৃ. ১২৭। ৮৩. ঐ, পৃ. ১২৮। ৮৪ ঐ, পৃ. ১২৮।

————

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই আবুল হাশিম ও তার পূর্ববঙ্গীয় অনুসারীরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বরূপ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন এবং কিছুটা ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়েন। মােগলটুলির রাজনৈতিক ঐ কর্মীরা আরাে হতাশাগ্রস্ত হন যখন জানতে পারেন যে, আবুল হাশিম ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এমতাবস্থায় আবুল হাশিম তাদেরকে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেন যে, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের অপেক্ষাকৃত উদারপন্থীদের একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়েই কেবল পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তারা অল্প সময়ের মধ্যেই হতাশা কাটিয়ে উঠে রাজনীতিতে বিকল্পধারা সৃষ্টির জন্য তৎপর হন। তারা স্থির প্রতিজ্ঞা করেন, আর কোনাে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হবেন না। এই ধরনের রাজনৈতিক আকাক্ষার ফলেই ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে জন্মলাভ করে ‘Peoples Freedom League’ নামে একটি ছােট সংগঠন। এ ধরনের প্রয়াসের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে যুক্ত হন কামরুদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, শওকত আলী, শামসুদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ ও অন্যরা। | তাই তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবনকে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত একটি পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ সময়ের মধ্যে তিনি কৌশলগত কারণে মুসলিম লীগের ব্যানার থেকেও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠকরূপে নিজেকে গড়ে তােলেন। তাদের প্রচেষ্টাতেই পূর্ব বাংলায় একটি উদার রাজনৈতিক মনােভাবসম্পন্ন কর্মীবাহিনী গড়ে ওঠে যা পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে রুখে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের সূচনাকালে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে যে র্যাডিক্যাল ধারা প্রবেশ করে তার মূলে অন্তত দুজন পথিকৃতের নাম পাওয়া যায়। এরা হলেন কামরুদ্দীন আহমদ ও তাজউদ্দীন আহমদ। এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদের সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মী বাহাউদ্দীন চৌধুরী বলেন: এই যে রাষ্ট্রীয় কাঠামাে হবে, তাতে সমাজতান্ত্রিক ধাচে একটা বণ্টন ব্যবস্থার ব্যপারে, মালিকানার ব্যাপারে চিন্তাটা তার মধ্যে ছিল। তিনি কিন্তু কখনই মার্ক্সিস্ট

—————

| ৮৫. কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭। ৮৬ ঐ, পৃ. ৯৭। ৮. বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), পৃ. ২৯২। ৮৮ বাহাউদ্দীন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, ২৬ অক্টোবর, ১৯৯০।

রাজনীতিতে আসেননি। কিন্তু একটা সামন্তবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার। যেটাকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র বলা যেতে পারে, এটি পুরােপুরি ছিল তার মধ্যে- যা ছিল মুসলিম লীগ নেতাদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন। আমি একটা কথায় জোর দিতে চাই, মুসলিম লীগের রাজনীতি তখন যারা করতেন তারা কিন্তু সমাজ কাঠামাে নিয়ে চিন্তাভাবনা তেমন করেননি। তারা ক্ষমতার পরিবর্তনটাই প্রধান করে দেখতেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ সেইখানে বােধ হয় এককভাবে সমাজের চেহারা কী হবে, সাধারণ মানুষের। অবস্থাটা কী হবে, এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন এবং সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে। ভূস্বামীদের নেতৃত্ব, তাদের সঙ্গে যে আমাদের একটা বিরােধ বাধতে পারে, এই রকম একটা চিন্তা তার মধ্যে ছিল । পূর্ব বাংলার আর্থ-সামজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে তাজউদ্দীন। আহমদের চিন্তার গভীরতার বিষয়ে বাহাউদ্দীন চৌধুরী সাক্ষাৎকারে আরাে বলেন: পাকিস্তান হওয়ার পরে হয়তাে মুসলিম লীগের অনেক বড় নেতাও চিন্তা করেন নি যে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের বা পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ ব্যবস্থা কী হবে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে, রাষ্ট্রীয় কাঠামাে কী হবে- সে সময় আমরা এসব চিন্তা করতাম ।… আমাদের চিন্তার এই ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর মধ্যমণি ছিলেন তাজউদ্দীন। আমরা মনে করতাম যে, যেভাবে মুসলীম লীগের নেতৃত্ব চলছে তাতে ভবিষ্যতে আমাদের যে সমাজ কাঠামাে আসবে, তাতে আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা তা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা- এই সন্দেহেই আমরা সবসময় দোদুল্যমান ছিলাম। পাকিস্তান আন্দোলনের সময়েও আমরা ঠিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ কথাটা হয়তাে উচ্চারণ করিনি, কিন্তু আমাদের যে রাষ্ট্রীয় সীমানা, আমাদের যে আলাদা একটা সত্ত্বা, পশ্চিমাদের চেয়ে আলাদা একটা সত্তা আছে, এটা কি আমাদের মনের মধ্যে একটা অনুভুতির মতাে ছিল। এবং এর প্রবক্তাই বলা হােক বা এক্সপােনেন্ট, তা ছিলেন তাজউদ্দীন। | তকালীন ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টি, ফরােয়ার্ড ব্লকের কয়েকটি গ্রুপ, কংগ্রেস প্রভৃতি কয়েকটি দলের সীমিত পরিসরে কর্মকাণ্ড ছিল। এদের সঙ্গে ঢাকার (উদারপন্থী মুসলিম লীগের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক যােগাযােগকারী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।” সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ অনেকখানি প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ একজন সংগঠক ছিলেন বলে তিনি সহকর্মীদের নিকট অনেকটা রাজনীতির শিক্ষকের মতাে ভূমিকা পালন করতেন।

———–

৮৯.ঐ

৯০.ঐ

ঐ।

———

এ সম্পর্কে তার সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মী বাহাউদ্দীন চৌধুরীর মূল্যায়নটি বেশ উপযুক্ত বলেই মনে হয়। তিনি বলেন:

চল্লিশের দশকেই বলতে গেলে বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানদের একটা উত্থানের | সময়- যে কারণে আমরা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলাম। এই অংশের পাকিস্তান আন্দোলনের একটা ভিন্নরূপ ছিল, যেটা সারা ভারতবর্ষে ছিল না। সেটা হলাে এখানে লড়াইটা বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক না হয়ে একটা শ্রেণী সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল এবং সেই আদিকালে তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের মধ্যে মার্ক্সিস্ট লিটারেচার সম্পর্কে সবচাইতে বেশি জ্ঞানী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বইপত্র পড়তেন, বলতে গেলে আমাদের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। বাইরে তার ব্যাপক পরিচিতি না থাকলেও কর্মীদের মধ্যে তার একটা শ্রদ্ধার স্থান ছিল এবং তিনি খুব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। সেই সময়ে যে সমস্ত লেখালেখির কাজ হত, বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশ করা হত, সেসব ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সর্বদা প্রধানতম ভূমিকা পালন করতেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হন। উপরিউক্ত সময়টিকে তার রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় স্তর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ সময়ে তিনি এবং তার কতিপয় রাজনৈতিক সহকর্মী চলমান সকল । গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি পূর্বোল্লিখিত গণ আজাদী লীগ নামক উদারপন্থী রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যান। আবার মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়ার সাথেও সম্পৃক্ত। ছিলেন। দেশ বিভক্তির পর আরাে অনেকের ন্যায় তিনিও শিক্ষা জীবনে। প্রত্যাবর্তন করেন।” অনিয়মিত প্রার্থী হিসেবে সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে ঢাকা বাের্ডে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। | তাজউদ্দীন আহমদ অল্প বয়স থেকেই নিয়মিতভাবে ডায়েরি লিখেছেন। তার এই গুণাবলি এবং ডায়েরির পাতায় লিপিবদ্ধ বিষয়ের আলােকে বলা যায় যে,

————-

৯১.ঐ

৯২. বদরুদ্দীন উমর, ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ২৯৪। ৯৩ তাজউদ্দিন আহমদের ডায়েরী, ৬ আগস্ট, ১৯৪৭। সিমিন হােসেন রিমি তাজউদ্দীন। আহমদের ডায়েরীগুলাে বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করছেন। এ পর্যন্ত ১৯৪৭-১৯৪৮ এবং ১৯৪৯-১৯৫০ সালের ডায়েরীগুলাে প্রকাশিত হয়েছে। এসব ডায়েরী থেকে গবেষণা। কাজের অনেক তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এখন থেকে এই সূত্রটি শুধুমাত্র ডায়েরী হিসেবে বর্ণিত হবে।

৩০

তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে উন্নত ও ব্যতিক্রমী চিন্তা-চেতনার মানুষ। এই ধরনের। বৈশিষ্ট্য সমকালীন কোনাে নেতার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয় না। যাহােক, তার । ডায়েরি থেকে জানা যায়, তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর নানা প্রতিকূলতার মধ্যে। থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারায় বিকশিত হওয়ার প্রচেষ্টা, সরকারের লেলিয়ে দেয়া গােয়েন্দা ও মুসলিম লীগের গুণ্ডা বাহিনীর তৎপরতা, মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাজনিত সংবাদ শুনে মানসিক বৈকল্য, প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা, বাসস্থান ও জীবিকার সমস্যা, অন্যদিকে ভাষা। আন্দোলনের উৎপত্তি ও তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, এমনকি পরীক্ষার । প্রবেশপত্র সংগ্রহও তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এতসব সমস্যা সত্ত্বেও তিনি । ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেও খুব ভালাে ফল করতে সক্ষম হন। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র হতে জানা যায়, পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাকে খুঁজে বের করে (অনিয়মিত প্রার্থী হওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষের নিকট তিনি। পরিচিত ছিলেন না) সংবর্ধনা প্রদানের জন্য। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক চর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার পূর্ব হতেই সেখানকার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর তার জীবনে। রাজনীতি ও শিক্ষা একাকার হয়ে যায় । তিনি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু তার প্রায়। সময় কাটতাে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জনসেবা করে । সম্মান শ্রেণীর শেষবর্ষের দিকে এসে তার এ ধরনের কাজ-কর্ম বহুগুণ বেড়ে যায়। ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তার রুমমেট মুজাফফর আলী। তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশুনা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বেশ আগ্রহােদ্দীপক সব ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। লেখাপড়া সম্পর্কে বলেন, তারা দুজনে আগে থেকে নােট করে রাখতেন। কিন্তু পরীক্ষার সময়ও সারাদিন নানা কাজে বাইরে কাটানাের পর রুমে ফিরে তাজউদ্দীন কয়েক ঘণ্টা রুমমেটকে। সব নােট পড়ার জন্য বলতেন। মনােযােগ সহকারে শােনার ফাকে ফাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেন। ফল বের হলে সবার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে অন্যদের তাক লাগিয়ে দিতেন। হলের হাউস টিউটর, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী শিক্ষকরাও তাকে

————-

৯৪. আবদুল মমিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ৯৫ মুজাফফর আলীর সাক্ষাৎকার, ১০ আগস্ট, ১৯৯১।

———–

ভালাে ছাত্র ও ছাত্রনেতা হওয়ার কারণে সমাদর করে চলতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে তাজউদ্দীনের মাঝেমধ্যে গভীর তত্ত্বপূর্ণ আলােচনা হতাে। এসব শিক্ষকের মধ্যে বি.করিম, ড. এম.এন. হুদা ও অন্যদের নাম উল্লেযােগ্য। তাদের নাম তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে শ্রদ্ধার সাথে উল্লিখিত হয়েছে । তাজউদ্দীন আহমদের দীর্ঘ সময়ের রুমমেট মুজাফফর আলী তার লেখাপড়া ও রাজনৈতিক ‘ভিশন সম্পর্কে বলেন:৬ তার সাথে চার বছর থাকতে থাকতে আমার মন-মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন হয়েছিল । গরিবের জন্য তাজউদ্দীন সাহেবের খুব দরদ ছিল। তার রাজনীতি করার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল যে, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই দুর্বল, কাজেই এদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানাের জন্য কাজ করতে হবে। এই যে অফুরন্ত লােকসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য খুব চিন্ত ভাবনা করতেন। আমাকে বলতেন, “ভাই, অর্থনীতি নিয়েছি এই জন্য যে, অর্থনীতি না বুঝলে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি করব কীভাবে! রাজনৈতিক চিন্তা

ভাবনা করতে গেলে প্রথমে অর্থনীতিটা বুঝতে হবে । অন্যত্র মুজাফফর আলী তাজউদ্দীন আহমদের একই ধরনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। উল্লেখ্য যে, শিক্ষা জীবনে তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রদের মধ্যে অনেক সময় ব্যয় করলেও তার মূল প্রবণতা ছিল জাতীয় রাজনীতির প্রতি। ঢাকার অপেক্ষাকৃত উদার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অনেকেই মূল মুসলিম। লীগের বিপক্ষে মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগে সংঘবদ্ধ হন। প্রাথমিকভাবে তাদের সংগঠিত হতে তাজউদ্দীন আহমদ সহযােগিতাও করেন, অবশ্য ঐগুলােতে নানা কারণে তিনি যােগদান করেননি। কিন্তু নিজেদের উদার ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তােলার কাজ অব্যাহত রাখেন। এখানে তারা পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক মুক্তির দিক নির্দেশনা হিসেবে কিছু খসড়া মােসাবিদা (Paper works) কাজ সম্পন্ন করেন। তবে শেষাবধি এই ধারাটিকে বিকশিত করে জাতীয় ধারায় পরিণত করা যায় নি। তাজউদ্দীন আহমদ। এ সকল কাজ করার পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল আন্দোলন গড়ে ওঠে তার সব কয়টিতেই একেবারে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা পালন করেন। চিন্তাশীল ও প্রচারবিমুখ প্রকৃতির তাজউদ্দীন আহমদের উপস্থিতি হয়তাে অন্য অনেকের মতাে সরব ছিল না, কিন্তু আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তার অবদান

————

৯৬.ঐ

৯৭ আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৮।

———

ছিল মৌলিক ও কেন্দ্রীয় । এত সব ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও ১৯৫৩ সালে তিনি অর্থনীতি বিষয়েজাতক (সম্মান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলের উত্তর ১৪ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন । ১২ নং-কক্ষে থাকতেন তার বিশেষ ঘনিষ্ঠ এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মমিন। এ সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ নানা সমস্যা নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নিকট আসতেন আর তিনি পরম ধৈর্য সহকারে তাদের কথা শুনে সেসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। তার এই প্রবণতা দেখে আবদুল মমিন তখনই অনুমান করেন যে, তাজউদ্দীন আহমদ ভবিষ্যতে বড় রকমের জননেতা হবেন। | অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করার পর তাজউদ্দীন আহমদ ভর্তি হন আইন বিষয়ে । কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের কারণে পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ১৯৫৩ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দিয়ে সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সদর উত্তর-পূর্ব আসনে অংশগ্রহণ করেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শাসকদল মুসলিম লীগের প্রদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক ফকির আব্দুল মান্নান। এই নির্বাচনে বিপুল ভােট ব্যবধানে সরকারি দলের ওজনদার প্রার্থী ফকির আব্দুল মান্নানকে তিনি পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পরে জাতীয় রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর হয়নি। তবে ১৯৬৪ সালে জেলখানায় বসে আইন বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। প্রখর মেধা, অনুসন্ধিৎসা শিক্ষকভক্তি প্রভৃতি সদর্থক গুণাবলির সমাবেশ ঘটে তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে। তিনি নিরীক্ষাধর্মী শিক্ষায় অধীত বিষয়কে অনুধাবনের চেষ্টা করতেন । নীচু শ্রেণীতে অধ্যয়নের সময় থেকেই তার পড়াশােনার পরিধি পাঠ্য পুস্তকের বাইরে বহু দূর বিস্তৃতি লাভ করে। সেজন্যই বােধ হয় তিনি শিক্ষা, সমাজসেবা, রাজনীতি চর্চা, মানুষের কল্যাণ ভাবনাসর্বক্ষেত্রেই একসঙ্গে সাবলীল গতিতে বিচরণ করতে সমর্থ হন। এসব ক্ষেত্রে যখন যে বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন তাতে সাফল্য অর্জন করেছেন অবলীলায়।

————–

৯৮ তাজউদ্দীন আহমদ লাভ করেন ১৯০৩৯ ভােট পক্ষান্তরে ফকির আব্দুল মান্নান পান মাত্র ৫৯৭২ ভােট। Report on the Election to East Bengal Legislative Assembly 1954, Published by Bangladesh Election Commission, 1977, p. 42.

——-

তাজউদ্দীন আহমদের এসব গুণাবলির প্রায় সবটাই স্বশিক্ষণ পদ্ধতিতে অর্জিত । তবে কিছু কিছু প্রবণতা তার বাল্যকালেই দেখা যায়। তখন থেকেই তিনি মানসিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব হয়ে ওঠেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি তার পরিবেশ ও পরিস্থিতি থেকে রস গ্রহণ করে বেড়ে ওঠেন এবং তার সঙ্গে যােগ হয় নিজ বিচার বিবেচনা ও বুদ্ধিমত্তা । তাজউদ্দীন আহমদ হচ্ছেন তৎকালীন বাংলার গ্রাম ও শহুরে আবহের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এবং স্বপ্রণােদনায় শিক্ষিত আলােকদীপ্ত একজন মানুষ। এসব কিছুর সমন্বয়ে যে তাজউদ্দীন আহমদ, তার চেতনার গােটা জগৎ জুড়ে সৃষ্টি হয় মানুষের সার্বজনীন কল্যাণ ভাবনা। কৃষি-নির্ভর বাংলার অর্থনীতির সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক, বাজার দরের ওঠানামা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে তার ডায়েরিতে অনেক লেখার সন্ধান মেলে। ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ ডায়েরিতে। জনগণের কল্যাণ ভাবনার পরিচয় দেন। তিনি লিখেন: এ বছরের ১লা বৈশাখ থেকে বর্ষাকালের ৩১.১০.১৯৪৯ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন অব্যাহত বৃষ্টির পর আকস্মিকভাবে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় শাক সজী, মরিচ বিশেষ করে শীতের সব ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ বছর আগেভাগে শীতের প্রকোপ শুরু হয়ে যায় এবং গত বছরের তুলনায় শীতের দাপট অনেক বেশি। অসুখ বিসুখ বিশেষ করে জ্বরের প্রকোপ ছিল বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার চর্মরােগ বেশি হয়েছে। দু’মাস আগের তুলনায় এ বছরের শেষে বিশেষ করে আমাদের এলাকার লােকজনের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক সহজতর হয়েছে। গত এক পক্ষকাল ধানের দাম ছিল গড়ে ১০ থেকে ৮ টাকা এবং চালের দাম ছিল ১৭ থেকে ১৯ টাকা । গতপক্ষে পাটের সর্বনি দাম ছিল প্রতি মণ ১৪ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২৮ থেকে ২৯ টাকা। তবে প্রকৃত চাষীদের হাতে কোনাে পাট নেই। টাকার মূল্যমান অনেক বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রধানত প্রভাবিত হয়েছে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভূমিমালিক। মধ্যবিত্ত শ্রেণী । জিনিসপত্রের দাম কম থাকায় শ্রমিক শ্রেণী উপকৃত হয়েছে । কাপড়ের দাম অনেক কমে গেছে। এ বছর বিশেষ করে মাছ খুব অপ্রতুল। খুঁটি ও কাঠের দাম খুব মন্দা যা এ মৌসুমে সাধারণত হয় না। ডায়েরির উপরিউক্ত ভুক্তিটি বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায় তার চিন্তার মধ্যে সার্বিক কল্যাণবােধ কতটা প্রােথিত হয়। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত মূল্য পায় না, এর সুফল ভােগ করে সমাজের

————

৯৯ ডায়েরী ১৯৪৯-১৯৫০, পৃ. ৫০।

————-

একটি ক্ষুদ্র অংশ। এই চেতনা তার রাজনৈতিক দর্শনকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। এটা ঠিক যে বাল্যকাল থেকেই অর্থনীতির প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের বিশেষ আগ্রহ জন্মে, যেটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। ১৯৫৪ সালেই কামরুদ্দীন আহমদের অনুরােধে তিনি আই.এম.এফ-এর সঙ্গে শিল্পায়ন বিষয়ে আলােচনার জন্য যে রূপরেখা সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করে দেন তাতে তার উন্নয়ন দর্শনের কিঞ্চিৎ আভাস পাওয়া যায়। তাতে তিনি কুটিরশিল্প ও বৃহৎ কারখানার মধ্যে সংগতি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে তার ডায়েরিতে লিখেন:১০০ নারকেল ছােবড়া, বেত, মধু, কাগজ, কার্ডবাের্ড, পাট, সুতা ও বস্ত্র শিল্প (গড়ে তােলার কথা) উল্লেখ করলাম। আমি আই.এম.এফ ঋণের অর্থে সড়ক নির্মাণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট মত প্রকাশ করলাম। কারণ তাতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় । যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন মূল্যের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা। তাজউদ্দীন আহমদ এখানে কোন্ যুদ্ধের কথা বলেছেন তা পরিষ্কার নয়। তবে এ সময় কোরীয় যুদ্ধের অবসান হয় এবং বাংলাদেশের পাটের চাহিদা পূর্বের তুলনায় কমে যায়। আজ এটা প্রমাণিত যে, বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিক কাঠামাে ভেঙ্গে যাওয়ার পর আই.এম.এফ, বা অনুরূপ সংগঠনগুলাের মাধ্যমে বিশ্বের ধনী। দেশগুলাে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে যা কিনা ‘নয়া উপনিবেশবাদ’ নামে পরিচিত। এই নীতি ও কৌশল অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়-এটা তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালেই অনুধাবন করেন। এভাবে দেখা যায়, অর্থনীতি নিয়ে তিনি সারা জীবনই চিন্তা-ভাবনা করেছেন। দেশ স্বাধীন করার পর সীমিত সময়ের জন্য হলেও অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে যােগ্যতার পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেন। উন্নয়ন ভাবনার ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হন। তবে তার মূল প্রবণতা ছিল উঁচু মাত্রার গণতন্ত্রের প্রতি। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আমীর-উল। ইসলামের মূল্যায়ন হচ্ছে “তাজউদ্দীন আহমদ বেশি গণতন্ত্রী ছিলেন, এই দিক থেকে যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে যেন সমাজতন্ত্র আনা যায়, জোর করে চাপিয়ে দেয়া

————–

১০০ ডায়েরী, ২৯ অক্টোবর, ১৯৫৪।

মােহাম্মদ হারুণ অর রশীদ ‘রাজনৈতিক কূটনীতিবিদ তাজউদ্দিন, মাহবুবুল করিম বাচ্চু (সম্পা.), তাজউদ্দিন আহমদ স্মৃতি এ্যালবাম (ঢাকা তাজউদ্দিন স্মৃতি পরিষদ, ১৯৯৭), পৃ. ৬০।

——–

৩৫

ঠিক হবে না এবং সেটা সম্ভবও হবে না। অতএব প্রকৃত অর্থেই উনি গণতন্ত্রী ছিলেন।”১০২ অধ্যয়নের প্রতি সুগভীর অনুরাগের ফলে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে তার অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত হয়, তেমনি বাস্তব জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে তার বিস্ময়কর প্রজ্ঞা জন্মে। ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদ যখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে আসীন তখন জয় বাংলা পত্রিকায় তার সম্পর্কে যে। প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়: বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ ২৭ বছরের একনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দিন। বিশ্ব ইতিহাস, ভূগােল ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতির যে কোন ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যে কোন স্থানের অবস্থিতি সাথে সাথে তিনি বলে দিতে পারবেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরাইল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাসই যেন তার নখদর্পণে।। বাল্যকাল থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের জানার কৌতূহল ছিল দুর্নিবার। ছােট কোনাে নতুন শব্দের অর্থ জানার জন্যে পায়ে হেঁটে চলে যেতেন পাঁচ সাত মাইল দূরবর্তী স্থানে। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় তার জ্ঞান ছিল অসাধারণ। ইংরেজি ভাষায় লিখিত তার ডায়েরির পাতায় চোখ বুলালেই বুঝা যায় সাবলীল গতিতে বিশুদ্ধ ও অর্থপূর্ণ বাক্যবিন্যাসে তিনি কতটা পারঙ্গম ছিলেন ।

তাজউদ্দীন আহমদের সমাজচেতনা।

তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষা-দীক্ষার ধরন, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার সব কিছুকে মিলিয়ে বিচার করলে বলা যায় তিনি হচ্ছেন চিরন্তন বাংলার মাটি ও মানুষের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা একজন রাজনৈতিক কর্মী। যুগ-মানসের চেয়ে অগ্রগামী তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে গড়ে তােলেন বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের রূপকার হিসেবে। এতদসঙ্গে যে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগ্রহণ করে বেড়ে ওঠেন সে বিষয়েও সম্যক আলােকপাত করা।

—————

১০২ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার , ১৩ জুন, ২০০১। ১০৩, জয় বাংলা, ৪র্থ সংখ্যা, ২ জুন ১৯৭১। ১০৪ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা (ঢাকা সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৯৪), পৃ.

————–

দরকার। প্রকৃতিনির্ভর কৃষিভিত্তিক এবং পশ্চাৎপদ আবহমান বাংলার সমাজ জীবনের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলােকে তিনি যথার্থই অনুধাবন করেন। যে সকল সমস্যা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় সেগুলােও তার নজরে পড়ে এবং সমস্যার বিপুলতা সাধারণ মানুষকে যেখানে দমিয়ে দেয় সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ আবাল্য ঐগুলাে সমাধানের যথাসাধ্য প্রয়াস চালিয়ে এসেছেন। ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ে বালক তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সম্পাদিত সমাজের কল্যাণমূলক একটি ঘটনা সম্পর্কে জানা যায় । স্বলে যাওয়ার পথে তাদেরকে ৬ টি খাল অতিক্রম করতে হতাে। এতে আপামর সকলেরই অসুবিধা হতাে। তাজউদ্দীন আহমদ তার ছাত্র বন্ধুদের সহযােগিতায় গজারী গাছের গুড়ি দিয়ে ঐগুলােতে সঁকো তৈরি করে দিয়ে অনন্যসাধারণ নজির স্থাপন করেন।”৫ খাল-বিলের এই বাংলাদেশে যােগাযােগের ক্ষেত্রে বালক তাজউদ্দীন আহমদের এই উদ্যোগ, নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেদের করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনার এক চমৎকার উদাহরণ। বিশেষত অত অল্প বয়সে ঐ ধরনের উদ্যোগ তার চিন্তার মৌলিকত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। বাল্যকালেই তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে মানবসেবার মতাে উচুমানের গুণাবলি প্রস্ফুটিত হয়। আর্ত-পীড়িত ও বিপর্যস্তদের প্রতি তার অকৃত্রিম মমত্ববােধের পরিচয় পাওয়া যায় । বালক তাজউদ্দীন আহমদ গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত এক অসহায় বৃদ্ধাকে সেবা-যত্ন ও মমতা দিয়ে সুস্থ করে তােলেন।” তিনি যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন গ্রামে মহামারী দেখা দেয়। তাদের গ্রামে প্রবেশের মুখে নদীর তীরে প্রথম বাড়িটাতে কেউ সুস্থ ছিল না। তিনি ছুটিতে বাড়ি এসে ঐ পরিবারের দুর্দশা দেখে নিজ হাতে পীড়িতদের সেবা-যত্ন করে সবাইকে সুস্থ করে তােলেন।১০৭ মানব দরদী রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অসহায়, দুর্বল, পীড়িত ও বিপর্যস্তকে সাহায্যের জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতেন। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার কথা তার ডায়েরি ও অন্যান্য সূত্র হতে জানা যায়। ২৫ আগস্ট

—————-

মােহাম্মদ হারুণ অর রশীদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯।

“গ্রামেই এক বিধবা মহিলার দুপায়ে ছিল মারাত্মক ঘা, এটা ছিল ছোঁয়াচে রােগ। গ্রামের কোন মানুষ ঐ মহিলার ধারে কাছে ভিড়তােনা, তার বাড়ীতে কেউ যেতনা, এমনকি তার পুত্র আবুল কাশেমও মার কাছে থাকতাে না। যে ঘাটে সে গোসল করতে কেউ সেখানে যেত না। তাজউদ্দিন ঐ মহিলাকে শুশ্রুষা করেছেন। তার বাড়ী গিয়ে তার হাতের সামান্য রান্না খেয়েছেন তৃপ্তিসহকারে।” আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯। ১৭ সিমিন হােসেন রিমি, আমার বাবার কথা, পৃ. ৫১-৫২।

———

১৯৪৭ তারিখের ডায়েরিতে ক্ষোভ ও হতাশার সঙ্গে একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। যাতে তার দরদী হৃদয়ের পরিচয় মেলে:১০৮

হিরনের সঙ্গে স্টেশনে গেলাম। সেখানে গাড়ীওয়ালা ও যাত্রীদের মধ্যে ভাড়া নিয়ে। ঝগড়া মেটালাম ।…আপার ক্লাসের প্রবেশ পথে একটা উলঙ্গ বৃদ্ধা পড়ে আছে-মৃত্যু। পথযাত্রী । মিটফোর্ড হাসপাতালে টেলিফোন করলাম । কেউ সাড়া দিল না । ওয়ালীর সঙ্গে দ্রুত হাসপাতালে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানালেন তাদের করার কিছু নেই। তারা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে যােগাযােগ করতে বললেন। লীগ। (মুসলিম লীগ) অফিসে গিয়ে এ,এস,এম, কে (সম্ভবত এসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাসটার] টেলিফোন করলাম। তিনি ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন। সন্ধ্যায় আবার হিরনের সঙ্গে স্টেশনে গেলাম। আপার ক্লাসের গেটের সামনের মুমূর্ষ মহিলাকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এখনও সরায় নি। এ.এস.এম. বি.আর.পি জি,এস,ও-কে নােট দিলেন। কেউ কর্ণপাত করলেন না। জি.এম.ও.কে টেলিফোন করলাম। তিনি আমাদের মিঃ আলীর সঙ্গে দেখা করতে অনুরােধ করলেন। এ, এস, এম,-এর নােটের কপি নিয়ে শামসুদ্দীন তার সঙ্গে দেখা করলাে। তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর আরেকটি নােট দিলেন। এভাবে একটি জীবনের উপর দিয়ে সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য চললাে। ২১-২২ বছরের তরুণ তাজউদ্দীন এই ঘটনা লিখে রাখেন তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে। এর মধ্যে উঠতি বয়সী আদর্শবান একজন তরুণের আবেগমিশ্রিত অনুভূতি রয়েছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই বয়সেই তিনি আমলাতন্ত্রের জটিলতা। সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। | পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, ছাত্রাবস্থায় তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করলে মাঝেমধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন প্রয়েজনে গ্রাম থেকে লােকজন আসতাে। ১৯৫৪ সালে তিনি তখন MPA; দরদরিয়া গ্রামের এক বালক জনৈক শিকারীর লক্ষ্যচ্যুত গুলিতে আহত হয়। আহতকে ঢাকায় নেয়া হলে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। তাকে নিজের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে তােলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।১০৯ তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন বিশেষত চিকিৎসার্থে গ্রাম থেকে লােকজন তার সাহায্য নেয়ার জন্যে আসবেনই। তাই তাদের সাহায্য সহযােগিতা দেয়ার জন্য। তিনি সুব্যবস্থা করে রাখতেন। তার বড় ভাইয়ের কলেজ পড়ুয়া ছেলে।

———————

১০৮ ডায়েরী, ২৫ আগস্ট, ১৯৪৭। ১০৯ মােহাম্মদ হারুণ অর রশীদ, প্রাগুক্ত, পৃ, ৫৯।

“তখন আমরা কারকুন বাড়ি লেনে থাকতাম। ৬০ টাকা বাসাভাড়া। সেই সময় দুস্থ, অসুস্থ লােক যারা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসত তাদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াই

————

দলিলউদ্দীনের কাজই ছিল ঐ সব রােগীকে নির্দিষ্ট ডাক্তারের নিকট নিয়ে যাওয়া । শুধু শহরে নয় মানুষের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে তিনি। উদ্যোগ নিতেন। গ্রামের মানুষকে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা নিতে তিনি উদ্বুদ্ধও করতেন। এ বিষয়ে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠ ডা. করিমের স্মৃতিচারণটি উল্লেখ করার মতাে। তিনি বলেন:১১ প্রতিষেধক টিকা গ্রামবাসীদের দেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আমাদের একবার নিয়ে। যান । থাকার খাবার ব্যবস্থা উনার ওখানে। কিন্তু লােকজন টিকা নিতে আসছে না। এর কারণ কি? তাজউদ্দীন একদিন রাতে বের হলেন। দেখলেন কতিপয় কবিরাজ গােছের মানুষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগণকে টিকা না নেয়ার জন্যে বলছে এবং ভয় দেখাচ্ছে যদি তারা টিকা নেয় এবং পরে অসুখ হয় তাহলে তারা আর তাদের (গ্রামবাসীর) চিকিৎসা করবে না। তাজউদ্দীন এ ধরনের কয়েকজনকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন এবং বলেন যে, এই অপরাধের জন্য তাদের কপালে টিকা নিতে হবে। ওরা তাজউদ্দীনের কাছে ক্ষমা চায় এবং নিজেরা টিকা নিয়ে অন্যদের তা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। সমাজসেবার মতাে মহৎ কাজ করতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ উপলব্ধি করেন যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা কারণে মনােমালিন্য হয়, কিন্তু সেগুলােকে বাড়তে দেয়া বা থানা-পুলিশ করতে দেয়া উচিত নয়। কেননা এ ধরনের অবস্থার সুযােগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বস্তুত তিনি হয়ে ওঠেন এলাকার মানুষের জন্য নির্ভরযােগ্য সালিশ কেন্দ্র। তার ডায়েরিতে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার উল্লেখ আছে । গ্রাম বাংলার কৃষক পরিবারের একজন সচেতন ও অগ্রসর মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের ভাবনার মূল বিষয়টিই ছিল কৃষককুলের মঙ্গল সাধন তথা তাদের উন্নতি করা। কৃষকদের কল্যাণ ভাবনার বিষয়ে তার সূচিত একটি চমৎকার সৃজনশীল উদাহরণ পাওয়া যায় এক ধরনের খাদ্য-সমিতি গঠনের ঘটনা। হতে । গ্রামবাংলায় প্রতি বছরই কমবেশি সাধারণ কৃষককুলকে খাদ্যাভাবে পড়তে হয়। এ ধরনের অবস্থা মােকাবিলা করার লক্ষ্যে তিনি নিজেদের উদ্যোগে এক

———————

ছিল আমার প্রথম কাজ। মেয়ে রােগী হলে ডা. জোহরা কাজী অথবা তার বােন শিরিন কাজীর কাছে নিয়ে যেতাম। আর পুরুষ রােগী হলে ডা. দত্তের নিকট। রােগ তেমন জটিল না হলে নিয়ে যেতাম ডা. করিমের কিশাের মেডিক্যাল হলে। রােগী নিয়ে গিয়ে কাকুর কথা বললেই তারা ব্যবস্থা করে দিতেন। কাকু পূর্ব থেকেই তাদেরকে বলে। রাখতেন।” দলিলউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

* ডা, করিমের রেকর্ডকৃত সাক্ষাঙ্কার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ১১ দলিলউদ্দিনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

———

ধরনের খাদ্য মজুত ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। ফসলের মৌসুমে বিশেষত অবস্থাপন্ন কৃষকের নিকট থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে জমা রেখে সংকটকালে তা বিতরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন তিনি। সাধারণভাবে এটি ‘ধর্মগােলা’ নামে পরিচিতি পায়। এ বিষয়ে তার ডায়েরি থেকেও জানা যায়:১৩ বিকেলে আমাদের বাড়িতে দরদরিয়ার সবাই এবং টানচৌড়াপাড়ার দু’জন এসেছিল। প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত সমিতির মজুদ থেকে ধান বণ্টন করা হলাে। অন্যান্যদের মধ্যে আবদুল খালেক, রজব আলী, জব্বার, আব্বাস, আয়েত আলী, ‘জাবর আলী, আক্কাস আলী এবং আহমদ উপস্থিত ছিলেন। এভাবে তিনি সাধারণ কৃষককুলকে আপকালীন সময়ে নিজেদের উদ্যোগে বেঁচে থাকার উপায় অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন বক্তৃতাবিবৃতি থেকে দেখা যায় যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষকদেরকে খাদ্যাভ্যাস বদলানাে, চাষাবাদের ধরন বদলানাে এবং আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন-কৌশল গ্রহণের জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। | তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে আবহাওয়ার প্রতিবেদন নিয়মিত লক্ষ্য করা। যায় যা তার ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনারই বহিঃপ্রকাশ। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির। ফলাফল ভেবে অবলীলাক্রমে তার উৎকণ্ঠার কথাও লিখেছেন। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সাধারণত কেউ আবহাওয়ার কথা নিয়মিতভাবে লিখেন না । আমরা যেখানে প্রতিদিন আকাশের দিকে পর্যন্ত তাকাই না, সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ শুধু আকাশ পর্যবেক্ষণই করেননি, তার গতি-প্রকৃতি, আবহাওয়ার অবস্থা সূক্ষাতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। আবহাওয়া সম্পর্কে তার এ ধরনের প্রবল আগ্রহের কারণ কী? এদেশের কৃষি তখন পর্যন্ত ছিল পুরােপুরি প্রকৃতিনির্ভর। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার মতাে সচেতন মানুষের পক্ষে উদাসীন থাকা। সম্ভব ছিল না। কৃষকদের অবস্থাকে সম্পর্কিত করে তার ভাবনার উদাহরণ হচ্ছে তার ডায়েরির অসংখ্য ভুক্তি। ৬.২.১৯৫০ তারিখে অনেকদিন পরে বৃষ্টি হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ঐ দিন তার ডায়েরিতে আবহাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে যে

————–

১১৩, ডায়েরী, ২১ এপ্রিল, ১৯৫০। ১১৪ আতিউর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৪।

“এই মুহূর্তে সমস্ত এলাকায় ফসলের জন্য বৃষ্টি অতি প্রয়ােজন। বৃষ্টির অভাবে | আমাদের এলাকার মতাে শুদ্ধ এলাকার ফসল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ।”২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, “এই মাসের পর্যাপ্ত বৃষ্টি আউশ ফসলের জন্য অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলেই মনে হয়।” ডায়েরী, ৩০ এপ্রিল, ১৯৫০।

৪০

বিচিত্র ভাষা ও বিষয়ের অবতারণা করেন তা থেকে বুঝা যায় আবহাওয়ার বিষয়ে। তার আগ্রহ কত সূক্ষ্ম:১১৬

গত রাত শেষে মেঘ জমতে শুরু করেছে। রাত ১০ টা পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া। অপরাহ্নে হঠাৎ কালাে মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। সাড়ে ৪ টার দিকে বৃষ্টি শুরু হল, সঙ্গে শিলা আর প্রবল ঝড়াে বাতাস । বিকেল প্রায় ৫টা কি তারও বেশী সময় পর্যন্ত পূর্ণ তেজে চলল এমন অবস্থা। বেশ ভাল বৃষ্টিই হল । শিলাখণ্ডগুলাে আকৃতিতে খুব একটা বড় না হলেও ক্ষতি করার জন্য যথেষ্টই বলতে হবে। ৬ টা পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি চলতেই থাকল। রাত মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রইল । আবহাওয়া বিষন্ন আর শীতল। বৃষ্টির মৌসুমের পর ভাল বৃষ্টিপাত । চাষি সম্প্রদায়ের জন্য এই বৃষ্টি আশীর্বাদের মতে, বিশেষ করে শীতের শস্য কলাই, মরিচ, তামাক ও অন্যান্য শাক-সবজির জন্য। যদিও শিলাবৃষ্টি আম ও লিচুর মুকুলের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। অন্যায়ভাবে কোনাে ব্যক্তি দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের শিকার হলে তার প্রতিবাদ করতে তাজউদ্দীন দ্বিধা করতেন না। ঢাকার একটি এতিমখানায় কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় কয়েকজন ভাল এতিম। ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিকারের আশায় বহিষ্কৃত ঐ সকল এতিম ছাত্র তার। নিকট এসে সাহায্য প্রার্থনা করে। তিনি তাদের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের ১৪ নভেম্বর ১৯৪৭ থেকে ৩ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখের মধ্যে লিখিত ডায়েরিতে মাঝেমধ্যেই উল্লেখ আছে। তিনি সরেজমিনে এতিমখানা পরিদর্শন করে বহিষ্কৃতদের অভিযােগের সত্যতা খুঁজে পান। এরপর এতিমদের সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু তাদের নিকট থেকে তেমন কোনাে সহযােগিতা না পেয়ে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ তাজউদ্দীন তার মর্মবেদনা ও উপলব্ধির কথা ডায়েরিতে লিখে রাখেন:১১৭ আমি মনে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম । হয়তাে বা প্রচণ্ডতর একটি; যখন দেখলাম, কামরুদ্দীন সাহেবসহ কেউ এতিমখানার ছাত্রদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না । সামান্য একটু চেষ্টার পরিবর্তে ছেলেগুলােকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম ও তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর প্রথম, অষ্টম শ্রেণীর প্রথম এবং সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী ও কুশলী কারিগরী ছাত্রগুলাে, তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে হারাবে। এসব দরিদ্র এতিম ছেলেদের জন্য কেউ এতিমখানার ক্ষমতাধর ভদ্রলােকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এগিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও

————-

১১৬ ডায়েরী, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০। ১১। ডায়েরী, ২৮ নভেম্বর, ১৯৪৭।

—–

অতীতে এমন দেখা গেছে আমরা কালু, নুরুল হুদা ও আফতাবউদ্দিন ভুইয়া এবং অন্যান্যদের জন্য গুরুত্বহীন বিষয়ে কত চেষ্টাই না করেছি। আমরা সংসদীয় রাজনীতির জন্য সময় দিতে পারি। কিন্তু যখন এসব ছেলের জন্য কিছু করতে চাই তখন সময়ের প্রশ্ন আসে। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের বিবেক ও স্বার্থের সাথে প্রতারণা করছি । আমাদের সব ভাল কথা জনগণকে ধোকা দেওয়ার জন্য। নির্দোষ ছেলেরা ! খুব সংবেদনশীল তাজউদ্দীন আহমদের এই আর্তি ও ক্ষোভ তথাকথিত ভাল। মানুষী অথবা ভণ্ডামির বিরুদ্ধে একক দ্রোহ বলা যেতে পারে। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এতিম ছেলেদের জন্য কিছু করতে না পারার নিদারুণ মর্মপীড়া। এ থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানবতাবাদী তাজউদ্দীন আহমদের বিদ্রোহী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। তার নিখাদ উপলব্ধির গুরুত্ব আজকের সমাজ-বাস্তবতাতেও সমানভাবে প্রযােজ্য। একইভাবে ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সদা সােচ্চার ও আপােসহীন। গাজীপুর জেলার বিশাল এলাকা জুড়ে তখনও ছিল গজারী বন । তখনও বন দু’ রকমের ছিল, সংরক্ষিত বা সরকারি মালিকানাধীন এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাজউদ্দীন আহমদের পারিবারিক সূত্রে গজারী বন ছিল। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ব্যক্তি মালিকানাধীন বন বা গাছ কাটতে হলেও এলাকার বন বিভাগের বৈধকরণ সীল গ্রহণ করতে হতাে। কিন্তু এক্ষেত্রে বন কর্মচারীকর্মকর্তারা সুযােগমতাে ঘুষ গ্রহণ করতাে। বিষয়টি তাজউদ্দীন আহমদের নজরে। আসার পর এর বিরুদ্ধে একটি গণসচেতনামূলক আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা। করেন। কিন্তু বন বিভাগের অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাজউদ্দীন আহমদ, তার ছােট ভাই এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে চক্রন্তমূলক ডাকাতি মামলা দায়ের করে। এ কারণে এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ অন্যদের সঙ্গে তাকেও হাজতে পাঠিয়ে দেয়। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তাকে জীবনের প্রথম হাজতবাস। করতে হয়। তিনদিন পর জামিনে মুক্তি পান। এমতাবস্থায় তার মনে এক ধরনের বােধের জন্ম হয় যা লিখে রাখেন ডায়েরিতে:১২০

বিচ্ছিন্নভাবে কোনাে আন্দোলন সম্ভব নয়। এতে ঘটনার পর ঘটনা জড়িয়ে আন্দোলন নিস্তেজ হয়ে যায় । সমাজের কাঠামাে এবং ব্যবস্থার যেকোনাে নির্দিষ্ট অংশ থেকে অন্যায় নির্মূল করার চেষ্টা সমস্যাটিকে আরও জটিলতার দিকে নিয়ে

———–

১১৮ দলিলউদ্দীনের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০। ১৯৯ ডায়েরী, ৭ জুলাই ১৯৫০ এবং ২৫ মে, ১৯৫০ তারিখের ভুক্তি ২টি দেখুন। ১২০ ডায়েরী, ১৯ নভেম্বর, ১৯৫০।

——–

যায়। এতে সংস্কারকগণ কয়েকজনের দ্বারা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন। তাই একই সাথে জোরালাে আঘাত এবং আমূল পরিবর্তন এই অবস্থার সমাধান বলে মনে হয়। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ বন বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা চালান। এমনকি বিষয়টিকে তিনি বনবিভাগের উচ্চতর কার্যালয়েও নিয়ে যান। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে এর মােকাবিলা করার জন্য জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান ও অন্যান্য নেতার স্মরণাপন্ন হন। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এ রকম নানা প্রকার সাহসী কাজের কারণে তাজউদ্দীন আহমদ নিজ এলাকাতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।১২১ সাধারণ মানুষের নিকট তার গ্রহণযােগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভােট পেয়ে তিনি বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে । ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা একটি দুরারােগ্য ব্যাধিবিশেষ। বাংলা অঞ্চলে এর কুফল সচেতন মহলের অজানা নয়। একই নৃগােষ্ঠী, ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলায় কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরােধ সৃষ্টি হয় এবং বাংলার সমাজ জীবনে এর কুপ্রভাব পড়ে যা ১৯৪৬ সাল নাগাদ মর্মন্তুদ। ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে চরম আকার ধারণ করে। তাজউদ্দীন আহমদ সমাজ ও সভ্যতা-সচেতন মানুষ হিসেবে এ ধরনের জঘন্য মনােভাব প্রতিরােধ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করে যান । বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রথম সারির একজন প্রবক্তা ও নেতা। ১৯৪৬, ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালে বাংলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। এবং মানবতার চরম অবমাননায় মর্মাহত হন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি অসহায়ের। মতাে নীরব দর্শক হয়ে থাকেন নি। একজন সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করে অসহায় ও বিপদাপন্ন

—————-

১২১ বন কর্মচারীদের সার্বিকভাবে কাজ না করার ফলে সাধারণ মানুষের যে ভােগান্তি হয় সে ব্যাপারে আতাউর রহমান সাহেবের সাথে কথা বললাম। তিনি বন-মন্ত্রীর কাছে প্রতিনিধি হিসেবে যাবার জন্য রাজী হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, মওলানা ভাসানীকে নিয়ে জানুয়ারীর কোন একদিন শ্রীপুরে একটি সম্মেলনের আয়ােজন করবাে।” ঐ, ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৫০। ১২কামরুদ্দীন আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৫। *** Suranjan Das, Communal Riots in Bengal 1905-1947 (Delhi Oxford University Press, 1993), p. 171.

——–

সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য তিনি বরাবরই আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এ ব্যাপারে তার ডায়েরিতে কয়েকটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। | ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সুলতানি কিংবা মােগল আমলেও ছিল না। এর জন্ম ইংরেজ আমলে, তাদের কূটচালে। তাদের ‘ভাগ করাে ও শাসন করাে’ নীতির কারণে বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরী মনােভাবের সৃষ্টি হয় এবং ১৯০৯ সালে পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তা প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করে । এর প্রেক্ষাপট অবশ্য রচিত হয় তার আগেই । লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী ভূমি ব্যবস্থায় বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নব্য হিন্দু জমিদার ও মহাজনের উৎপত্তি ঘটে । সূর্যাস্ত আইনের অধীনে প্রাচীন যে সকল জমিদার তাদের জমিদারী হারান ঐতিহাসিক কারণে তারা অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের । ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমনের পূর্বে সুলতানি ও মােগল আমলে এদের উৎপত্তি এবং তা বংশ পরম্পরায় চলে আসে । পুরানাে জমিদারদের মধ্যে অবশ্য অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন এবং তাদেরও কেউ কেউ জমিদারী হারান । কিন্তু মুসলমানরা ক্ষমতা হারানাের ক্ষোভবশত কোম্পানী-প্রবর্তিত ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা হতে বিরত থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায় এগিয়ে আসে এবং সরকারের বাম্পানির চাকরিতে সুযােগ লাভ করে। ভারতবর্ষের স্থানীয় শক্তিগুলাের মধ্যে সম্প্রদায় হিসেবে তারা এগিয়ে গেলে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এ সকল বিত্তশালী হিন্দুর প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে জমিদার, মহাজন এবং জমিদারদের রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারিদের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রজাসাধারণের ওপর পীড়নে পরিণত হয়। এ ধরনের নির্যাতন উভয় সম্প্রদায়ের প্রজাদের ক্ষেত্রেই সংঘটিত হতাে। কিন্তু যেহেতু নিপীড়নকারীরা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সেহেতু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ জন্মলাভ করে।১২৫ সুতরাং কিছু ঐতিহাসিক কারণে বাংলার দুটো প্রধান সম্প্রদায়ের অসম বিকাশ ঘটে, যার পরিণতিতে স্থায়ীভাবে জন্মলাভ করে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার প্রাক্কালে এই বিষফল সম্পর্কে মানবতাবাদী নেতারা বিশেষত কংগ্রেসের। প্রাক্তন সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ একটি নির্মম ভবিষ্যদ্বাণী

করেন:১২৬

—————

১২৪. ডায়েরী, ১০-২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ এর মধ্যে কয়েকটি ভুক্তি আছে । 1 Enayetur Rahim, Provincial Autonomy in Bengal (1937-1943) (Rajshahi The Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi University, 1981), p. 212. ১২৬ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৯।

—–

রাত পােহালে হঠাৎ একদিন তারা দেখবে তারা আর সেখানের . কেউ নয়, তারা হয়ে গেছে পরদেশী দুটি বিসংবাদী রাষ্ট্র একে অন্যের সংখ্যালঘু সমস্যার কোনাে সমাধান বালাতে পারবে না; পারস্পরিক জারি আর ব্যবস্থা চালু করে

প্রতিশােধ আর প্রতিহিংসায় তা ইন্ধন জোগাবে। মহান ঐ নেতার ভবিষ্যদ্বাণী নির্মমভাবে অব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে মূলত ভারত ও পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক জন্মলাভের এক বছর পূর্বেই, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ আহুত ‘Direct Action Day’-এর কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনাবলি থেকে। ঐদিন কলকাতা ও পূর্ব বাংলার নােয়াখালীতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় অসংখ্য মানুষ নিহত হয়।” উভয় সম্প্রদায়ই সুযােগ অনুযায়ী পরস্পরের ওপর মরণ আঘাত হানে। এ থেকে নারী পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা কেউ রক্ষা পায়নি। কলকাতায় এ ভয়ঙ্কর নরহত্যা ও ধ্বংসস্তূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। নােয়াখালীতেও এই হত্যাকাণ্ড ছিল মর্মন্তুদ। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এ অপকর্মের জন্য উভয় সম্প্রদায় পরস্পরকে দায়ী করে।১২৯ কিন্তু মজার বিষয় হলাে জিন্নাহ কর্তৃক আহুত Direct Action Day’তে বাংলা প্রদেশ ব্যতীত ভারতের আর কোথাও সহিংস ঘটনা ঘটে নি। এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত লাহােরেও না। সাম্প্রদায়িকতার এই যে সহিংস সূত্রপাত তার প্রভাব ভারতবর্ষে অদ্যাবধি বিদ্যমান। ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালেও ভারত ও পাকিস্তানে বড় রকমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয় ।

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হলে এবং র্যাডক্লিফ-এর নীতিহীন সীমানা নির্ধারণের কারণে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিপুলসংখ্যক মানুষ স্বদেশভূমি ত্যাগ করে পরস্পর বিদেশভূমিতে (হিন্দুরা ভারতে, মুসলমানরা পাকিস্তানে) পাড়ি জমায় শরণার্থী হিসেবে। এ সময় প্রতিপক্ষের দ্বারা অনেক লুটপাট, খুন, ধর্ষণ প্রভৃতি মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এর জের শেষ হতে না হতেই কলকাতায় সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের দায়িত্বহীন বক্তৃতার পর কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পাইকারী হারে মুসলিম নিধন আরম্ভ হয়। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব বাংলার ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে নারকীয় হিন্দু নিধন ও নির্যাতন শুরু হয়।১৩১ এ ধরনের

—————-

১২৭” দেখুন, Suranjan Das, op.cic., pp. 172-176. ১২. রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক সংগ্রাম-প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র (ঢাকা জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ১৯৯৮), পৃ. ৫৫। ১২৯ ঐ, পৃ. ৫৪-৫৫।

| ১৩১ অলি আহাদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২।

—-

৪৫

মানবতাবিরােধী জঘন্য অপরাধের ব্যাপারে বিবেকবান তাজউদ্দীন আহমদ চুপ করে থাকতে পারেননি। তিনি একদিকে এর কারণ ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন, অন্যদিকে ঢাকা শহরে এবং নিজের মফঃস্বলে সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা চালান এবং দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিতও করেন। এ সম্পর্কে তার ডায়েরিতে বিস্তারিত বিবরণ তিনি লিখে রাখেন।

| ঢাকায় এই দাঙ্গা শুরু হয় ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। তিনি বেলা ১টা হতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, মগবাজার, ইংলিশ রােড, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে ঘুরে ঘুরে হিন্দুদের ওপর কিছুসংখ্যক মুসলমানের আক্রমণ প্রত্যক্ষ করেন । তাজউদ্দীন আহমদ দাঙ্গার কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে ঐদিনের ডায়েরিতে লিখেন:১৩২

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতাে ঢাকা আজ দুপুর ১২ টা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করল। গত ৩/৪ দিন ধরে কোলকাতায় যে দাঙ্গা চলছিল এটি তারই ধারবাহিকতার ফল। শরণার্থীরা বিশেষভাবে বিহারীরা এই গােলযােগের জন্য দায়ী। স্থানীয় জনগণ যদিও এসবের বিপক্ষে নয়, তবে তারা উদাসীন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম লুট, হত্যা আর অগ্নিসংযােগ চললাে। পুলিশ এসব বন্ধ করার কোনাে চেষ্টাই করলাে না। অবাঙালি পুলিশরা বরং উৎসাহ যােগাচ্ছিল । পুরাে প্রশাসন নীরব। দর্শকের ভূমিকা পালন করলাে । দাঙ্গাকারীদের এই আক্রমণের ফলে প্রথমে আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘুদের বিষয় সম্পত্তি এবং তারপর ব্যক্তি। ক্রমবর্ধমানভাবে পূর্ণোদ্যমে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকলাে । হিন্দুদের জীবনটাই দুষ্কৃতকারীদের মনােযােগের বস্তুতে পরিণত হয়েছে । কিছু পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাপকসংখ্যক বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে । চলন্ত ট্রেনের কামরায় নৃশংসভাবে হত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। একতরফা এই হিন্দু-হত্যাকাণ্ড প্রতিরােধ করার জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সম্প্রীতি সভা হয় কাজী মােতাহার হােসেনের সভাপতিত্বে । এতে বক্তৃতা করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এ.কে.এম. মাহমুদ কিবরিয়া, আবদুল আওয়াল ও অন্যরা। এই আলােচনা সভায় তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত থেকে লক্ষ্য করেন যে, আক্রান্তদের রক্ষার সুনির্দিষ্ট কোনাে কর্মসূচি ছাড়াই সভা শেষ

হয়ে যায় ।১৩৩

—————

১৩২, ডায়েরী, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০। ১৩৩, ঐ, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০।

——

ভয়াবহ এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ চলে যান নিজ গ্রামাঞ্চলে। ১৪ ফেব্রুয়ারি সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সংগঠিত করার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন । ঐ দিন সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা ও করণীয় বিষয়ে আলােচনা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারির ডায়েরিতে তার এসব উদ্যোগের বিষয়ে কিঞ্চিৎ লিখে রাখেন:১৩৪ খুব ভােরে উঠেছি। ৯ টায় রায়দের কাচারী ঘরে গিয়েছিলাম। কাচারী ঘরে। আনুষ্ঠানিক মিটিং হলাে। স্থানীয় গণ্যমান্য মুসলিম ব্যক্তিবর্গ-আবিদ বেপারী, হাশেম মৃধা, নবার পালান প্রমুখসহ ৪০ জন হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বর্তমান গোলযোগ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের অবস্থান এবং ঘটনার প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করলাম । তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এখানে উপস্থিত সবাই সরকারের পাশে থাকা এবং গােলযােগ বন্ধের শপথ করলাে। বেলা আড়াইটায় বরমার উদ্দেশে রওনা হলাম। কাপাসিয়া থানার বরমা অঞ্চলে কতিপয় হিন্দু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ ঐগুলাে পরিদর্শন করতে যান। সেখানে জনৈক শিক্ষক মফিজউদ্দিন ও থানার সেকেন্ড অফিসারকে সাথে নিয়ে তিনি ঐ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলাের দুঃখ দুর্দশা দেখে আসেন। অতঃপর রাত সাড়ে ৮ টায় সেখানে। একটি সম্প্রীতি সভা করেন। এই সভায় অনেক লােকের উপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলাের বর্ণনা দেন। অতঃপর উপস্থিত সবাইকে শান্তি। রক্ষার জন্য শপথ করান। ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদ শান্তিরক্ষার জন্য সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে গণসংযােগ অব্যাহত রাখেন। নিজ এলাকাতে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধ করার পর ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন । ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মাসের শেষে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ডায়েরির বিশেষ ভুক্তিতে তাজউদ্দীন লিখেন:১৩৭

—————-

১৩৪, ঐ, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০।

. “সাহেব বেপারী বাড়ীতে একা ছিলেন। তার সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের ইউনিয়নের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললাম। আমরা একমত হলাম যে, আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পর শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশংকা নেই।” ডায়েরী, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০। ১৩৭ ঐ, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার আড়াই বছর পর প্রথমবারের মতাে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং এই দাঙ্গার ঢেউ কিছু মফঃস্বল শহর এবং পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে পশ্চিম বাংলা থেকে শরণার্থীদের বিশাল বহর দ্রুত দেশে প্রবেশ করেছে। প্রথমবারের মতাে পূর্ব বাংলা মারাত্মক শরণার্থী সমস্যার সম্মুখীন। হলাে । এই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়েরও একটা বড় অংশ দেশ ত্যাগ করেছে। শরণার্থী গমনাগমন মার্চ মাসের শেষাবধি অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা ও আসাম অঞ্চল থেকে প্রচুর শরণার্থী পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে।১৩৮

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে তিনি আরাে জোরালাে এবং জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত হযরত মােহাম্মদের দাড়ি বলে কথিত একটি স্মৃতিচিহ্ন হঠাৎ হারিয়ে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটি হিন্দু কাফেরদের কাজ বলে অভিযােগ করে এবং দেশব্যাপী মুসলমানদেরকে তার প্রতিশােধ নেয়ার জন্য উস্কানি দিতে থাকে । এই উস্কানির ফলে খুলনা থেকে আরম্ভ করে রাজশাহীর দারুসা কর্ণহার পর্যন্ত সারা পূর্ব পাকিস্তানে একপাক্ষিক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য। সরকার প্রধানত বিহারী মােহাজেরদের ব্যবহার করে। কারণ তারা কেবল হিন্দু বিদ্বেষীই ছিল না, তারা বাঙালি মাত্রকেই ঘৃণার চোখে দেখতাে । হিন্দু সম্প্রদায়ের ধনসম্পদের ওপরেও তাদের লােলুপ দৃষ্টি পড়ে। কয়েকদিন ধরে সরকারি সহযােগিতায় এক প্রকার বিনা বাধায় লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযােগের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটিত হয়। একটা পর্যায়ে দাঙ্গাকারীরা এত উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে তারা অরক্ষিত, বিপদগ্রস্ত হিন্দুদের আশ্রয়দানকারী বাঙালি মুসলিমদেরকেও আক্রমণ করে বসে। এমনকি পূর্ব বাংলার উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরও আক্রমণ চালায় তার দাঙ্গাবিরােধী ভূমিকার জন্য। এরূপ পরিস্থিতিতে সচেতন বাঙালি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দাঙ্গা প্রতিরােধের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা এর পুরােভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সচেতন বাঙালিদের এ ধরনের তীব্র প্রতিরােধের মুখে ১৯৬৪ সালের ১৫ জানুয়ারি। নাগাদ দাঙ্গার মােড় ঘুরে যায় । সচেতন বাঙালিরা দাঙ্গাবিরােধী আন্দোলন গড়ে

————–

১৩৮, ঐ, ৩১ মার্চ, ১৯৫০। ১৯ ড, প্রীতি কুমার মিত্র, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.) প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬।

* আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা ১৯৫৩ ১৯৯৩ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ (ঢাকা ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ, ৮৫। ১৪১ ঐ, প, ৮৫।

তােলেন। ৯৯ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিরােধ কমিটি গঠিত হয় এবং “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক একটি আহ্বান ১৭ জানুয়ারি দৈনিক পত্রিকাগুলােতে প্রকাশিত হয়। এতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির স্বাক্ষর দান করেন। বিবৃতিতে দাঙ্গার ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়। প্রতি মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি দাঙ্গা প্রতিরােধের জন্য আহ্বান জানায়। এ ধরনের নাগরিক প্রতিরােধের মুখে এক পর্যায়ে ২০ জানুয়ারি নাগাদ দাঙ্গা অনেকটা থিতিয়ে আসে। বিলম্বে হলেও অনেকেই বিপদাপন্ন হিন্দু প্রতিবেশী পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করে তােলেন। এক্ষেত্রে বেগম রােকেয়ার বােন হােমায়রার পুত্র ও বিশিষ্ট সমাজসেবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব পঞ্চাশাের্ধ আমীর হােসেন চৌধুরীর নাম স্মরণযােগ্য। তিনি ছিলেন নজরুল ফোরাম-এর চেয়ারম্যান। হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে দাঙ্গাকারীরা তাকে হত্যা করে।১৪৩ তারা ১৬ জানুয়ারি নটরডাম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার নােভাককেও হত্যা করে।

দাঙ্গা প্রতিরােধ আহ্বানের অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়। তারা অবশ্য জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু সরকারের দমন আইন থেকে রেহাই পান নি। তাদের বিরুদ্ধে ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অপরাধ সংঘটনের অভিযােগে মামলা দায়ের করা হয়।*৫ | তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তান আমলে সংঘটিত দুটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আজীবন। অক্ষুন্ন থাকে। সাম্প্রদায়িকার প্রশ্নেই তিনি প্রথমে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেননি। বরং একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালান। আওয়ামী মুসলিম লীগে কেবল তখনই তিনি যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যখন এর নেতারা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, দলটিকে অতি সত্বর অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করা

হবে।১৪৬

—————-

১৪২, মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ২০৯ -২১০ | ১৩ অমিতাভ গুপ্ত, গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব (ঢাকা অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ৩০৭-৩০৮। ১৪৮, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭। ১৪ই মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০। ১৬ ড. আনিসুজ্জামানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

পাকিস্তানের স্বাধীনতার আড়াই বছর পর প্রথমবারের মতাে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং এই দাঙ্গার ঢেউ কিছু মফঃস্বল শহর এবং পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে পশ্চিম বাংলা থেকে শরণার্থীদের বিশাল বহর দ্রুত দেশে প্রবেশ করেছে। প্রথমবারের মতাে পূর্ব বাংলা মারাত্মক শরণার্থী সমস্যার সম্মুখীন হলাে। এই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়েরও একটা বড় অংশ দেশ ত্যাগ করেছে। শরণার্থী গমনাগমন মার্চ মাসের শেষাবধি অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা ও আসাম অঞ্চল থেকে প্রচুর শরণার্থী পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে।১৩৮ ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে তিনি আরাে জোরালাে এবং জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে হযরতবাল মসজিদে রক্ষিত হযরত মােহাম্মদের দাড়ি বলে কথিত একটি স্মৃতিচিহ্ন হঠাৎ হারিয়ে গেলে পাকিস্তান সরকার সেটি হিন্দু কাফেরদের কাজ বলে অভিযােগ করে এবং দেশব্যাপী মুসলমানদেরকে তার প্রতিশােধ নেয়ার জন্য উস্কানি দিতে থাকে । এই উস্কানির ফলে খুলনা থেকে আরম্ভ করে রাজশাহীর দারুসা কর্ণহার পর্যন্ত সারা পূর্ব পাকিস্তানে একপাক্ষিক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় । এই দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য সরকার প্রধানত বিহারী মােহাজেরদের ব্যবহার করে। কারণ তারা কেবল হিন্দু বিদ্বেষীই ছিল না, তারা বাঙালি মাত্রকেই ঘৃণার চোখে দেখতাে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধনসম্পদের ওপরেও তাদের লােলুপ দৃষ্টি পড়ে। কয়েকদিন ধরে সরকারি সহযােগিতায় এক প্রকার বিনা বাধায় লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযােগের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটিত হয়। একটা পর্যায়ে দাঙ্গাকারীরা এত উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে তারা অরক্ষিত, বিপদগ্রস্ত হিন্দুদের আশ্রয়দানকারী বাঙালি মুসলিমদেরকেও আক্রমণ করে বসে। এমনকি পূর্ব বাংলার উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরও আক্রমণ চালায় তার দাঙ্গাবিরােধী ভূমিকার জন্য । এরূপ পরিস্থিতিতে সচেতন বাঙালি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা দাঙ্গা। প্রতিরােধের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া, তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা এর পুরােভাগে দায়িত্ব পালন করেন। সচেতন বাঙালিদের এ ধরনের তীব্র প্রতিরােধের মুখে ১৯৬৪ সালের ১৫ জানুয়ারি নাগাদ দাঙ্গার মােড় ঘুরে যায়। সচেতন বাঙালিরা দাঙ্গাবিরােধী আন্দোলন গড়ে

—————

১৩৮ ঐ, ৩১ মার্চ, ১৯৫০। ১৩৯ ড. প্রীতি কুমার মিত্র, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.) প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৬।

ও আবদুল হক, লেখকের রােজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা ১৯৫৩ – ১৯৯৩ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ (ঢাকা ইউনির্ভাসিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯৬), পৃ. ৮৫। ১৪১ এ, পৃ. ৮৫।

৫০

তােলেন। ৯৯ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিরােধ কমিটি গঠিত হয় এবং “পূর্ব পাকিস্তান। রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক একটি আহ্বান ১৭ জানুয়ারি দৈনিক পত্রিকাগুলােতে প্রকাশিত হয়। এতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্বাক্ষর দান করেন। বিবৃতিতে দাঙ্গার ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়। প্রতি মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি দাঙ্গা প্রতিরােধের জন্য আহ্বান জানায়। এ ধরনের নাগরিক প্রতিরােধের মুখে এক পর্যায়ে ২০ জানুয়ারি। নাগাদ দাঙ্গা অনেকটা থিতিয়ে আসে। বিলম্বে হলেও অনেকেই বিপদাপন্ন হিন্দু প্রতিবেশী পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিপন্ন করে। তােলেন। এক্ষেত্রে বেগম রােকেয়ার বােন হােমায়রার পুত্র ও বিশিষ্ট সমাজসেবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব পঞ্চাশাের্ধ আমীর হােসেন চৌধুরীর নাম স্মরণযােগ্য। তিনি ছিলেন নজরুল ফোরাম-এর চেয়ারম্যান। হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে দাঙ্গাকারীরা তাকে হত্যা করে। তারা ১৬ জানুয়ারি নটরডাম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার নােভাককেও হত্যা করে।

| দাঙ্গা প্রতিরােধ আহ্বানের অভিযােগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য নেতা গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়।”” তারা অবশ্য জামিনে মুক্তি পান। কিন্তু সরকারের দমন আইন থেকে রেহাই পান নি। তাদের বিরুদ্ধে ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় অপরাধ সংঘটনের অভিযােগে মামলা দায়ের করা হয়। | তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তান আমলে সংঘটিত দুটো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রতিরােধেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আজীবন অক্ষুন্ন থাকে। সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নেই তিনি প্রথমে মুসলিম ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেননি। বরং একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালান। আওয়ামী মুসলিম লীগে কেবল তখনই তিনি যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যখন এর নেতারা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, দলটিকে অতি সত্বর অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত করা

হবে ১৪৬

—————–

১৪. মযহারুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৮), পৃ. ২০৯ -২১০। ১৪৩ অমিতাভ গুপ্ত, গতিবেগ চঞ্চল বাংলাদেশ মুক্তিসৈনিক শেখ মুজিব (ঢাকা অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৭), পৃ. ৩০৭-৩০৮। ১৪৪, ড. প্রীতি কুমার মিত্র, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭। ১৪৭ মযহারুল ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১০। ১৯* ড. আনিসুজ্জামানের রেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০০।

——-

তাজউদ্দীন অনুধাবন করেন যে, সমাজের উন্নতি ও ব্যক্তির মননবিকাশের। ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই। তিনি নিজে প্রচলিত ধারণার বৃত্ত ভেঙে ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন উদাহরণ সৃষ্টি করেন তেমনি অনুধাবন করেন, সমাজের সমন্বিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার জন্য প্রয়ােজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তােলা । তাই নিজ এলাকাতে। আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।১৪৭ অবশ্য মাদ্রাসা শিক্ষাকেও অবহেলা করেননি তিনি।১৪৮

| সমাজের একজন অগ্রগামী মানুষ হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন আহমদ আন্তরিকতা, সততা, গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবতাবােধের অনুকরণীয় উদাহরণ। সৃষ্টি করেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্য তিলে তিলে গড়ে তুলে সমাজ ও জাতির। নিকট নিজেকে দায়বদ্ধ করেছিলেন, সেখান থেকে তার আমৃত্যু সামান্যতম বিচ্যুতি ঘটেনি। কিন্তু নিজে ছিলেন প্রচারবিমুখ। এ ব্যাপারে তার মধ্যে এক প্রকার উদার। অহংবােধ কাজ করতাে। ফলে জাতি তার মতাে একজন মহান মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা এবং কর্মময় জীবনের অনেক বিষয় অবগত নয় ।

————

১৪৭, ডায়েরী, ১ জানুয়ারি, ১৯৫০। ১৪৮ ঐ, ১২ মে, ১৯৫০।

৫২

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ-বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর – কামাল হোসেন